1 of 2

অনুজ

অনুজ

আজ ১২জুলাই। আজকে আমার দশ বছরের ছোটো ভাই বুলার শ্রাদ্ধ ছিল। সে ৩০ জুন সকাল বেলা ঘুমের মধ্যে চলে গেল। যদিও সে বেশ কিছুদিন হল অসুস্থ ছিল, কিন্তু তার এই হঠাৎ যাওয়াটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক আমাদের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘শ্রাদ্ধের ভিতরকার কথাটি হল শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা শব্দের অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস। সত্যের মধ্যেই, অমৃতের মধ্যেই সমস্ত আছে।’ একথা আমরা পরমাত্মীয়ের মৃত্যুতেই যথার্থ তো উপলব্ধি করি। যাদের সঙ্গে আমাদের স্নেহ-প্রেমের, আমাদের জীবনের গভীর যোগ নেই, তারা আছে কি নেই, তাতে আমাদের কিছুই আসে-যায় না। সুতরাং মৃত্যুতে তারা আমাদের কাছে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। এইখানেই মৃত্যুকে আমরা বিনাশ বলেই জানি।

যাকে আমরা ভালোবাসি, মৃত্যুতে সে যে থাকবে না, এই কথাটা আমাদের সমস্ত চিত্ত অস্বীকার করে। প্রেম যে তাকে নিত্য বলেই জানে। সুতরাং মৃত্যু যখন তার প্রতিবাদ করে, তখন সেই প্রতিবাদকে মেনে নেওয়া তার পক্ষে বড়োই কঠিন হয়ে ওঠে। যে মানুষকে আমরা অমৃতলোকের মধ্যে দেখেছি, তাকে মৃত্যুর মধ্যে দেখব কেমন করে।

রবীন্দ্রনাথের এইকথা ক-টি আজকে খুবই মনে হচ্ছে। মনে আসছে আরও অনেক কথা।

বুলা জন্মেছিল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। তাই বাবা বুলার নাম রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ।

আমরা পাঁচ ভাইবোন ছিলাম। আসলে ছিলাম ছয় ভাইবোন। বুলার আগে আমাদের আর এক ভাই ছিল। সে মাত্র দেড় বছর বয়েসে বসন্ত রোগে চলে যায়। তখন বসন্তের তেমন চিকিৎসাও ছিল না। কবিরাজের চিকিৎসাতে সে কিছুদিন যুদ্ধ করেছিল মৃত্যুর সঙ্গে, কিন্তু তার পর এক সন্ধেবেলায় সে চলে যায়। আমরা তখন রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর ভাড়াবাড়িতে থাকতাম।

আমরা, আমি এবং আমার দুই বোন পাশের ঘরে ছিলাম। বাবা আমাদের ডেকে নিয়ে গেলেন। সেই ভাইয়ের নাম ছিল বাবলু। বাবা ডেকে নিয়ে বললেন যে, বাবলু চলে গেল। আমরা তাকে শ্মশানে নিয়ে যাব। তোমরা এসে একবার শেষদেখা দেখে যাও।

জীবনে সেই প্রথম মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়ালাম। বাবা-কাকারা তাকে কোলে করে কাঁথায় জড়িয়ে, কেওড়াতলায় নিয়ে গেলেন। তখন আমার অবস্থা এতই হতভম্ব যে, মৃত্যুর যে-অভিঘাত সেটাও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি।

এর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। ‘শিশুসাথী’ কিংবা ‘শুকতারা’য় ঠিক মনে নেই, পূজাসংখ্যাতে একটি লেখা বেরিয়েছিল। সেই লেখাটির শিরোনাম ছিল, ‘মানুষ মরণশীল’।

আমি খুব পড়তাম। পড়াশুনোর বইয়ের চেয়ে বাইরের বই-ই আমি বেশি পড়তাম। একদিন খেয়ে-দেয়ে আঁচাতে আঁচাতে, নিজের মনেই বলেছিলাম ‘মানুষ মরণশীল’। সেই বাক্যটি মায়ের কানে গিয়েছিল, এবং বাবলুর মৃত্যুর পর মা, বাবাকে বলেছিলেন যে, খোকনকে জিজ্ঞেস করো তো, ও কেন ওই কথাটা বলেছিল? তখন আমি অত্যন্তই ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার ওই কথাটি উচ্চারণ করার জন্যই বোধ হয় বাবলু চলে গেল।

বাবা আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তুই কেন ওই বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলি সেদিন?

বললাম, খুবই ভয় পেয়ে বললাম, যে আমি এই শিরোনামের একটি লেখা পড়েছিলাম পুজোসংখ্যায়, সেটা পড়ে আমার মধ্যে একটা আলোড়ন হয়েছিল, সেইজন্যই আমি আঁচাতে আঁচাতে অনবধানে ওই বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলাম।

বুলার পরে আমার তৃতীয় ভাই বাবুয়া, যার ভালোনাম ইন্দ্রজিৎ। বুলার ভালোনাম ছিল বিশ্বজিৎ আগেই বলেছি। ইন্দ্রজিৎ জন্মাল বুলার পরে, মা-বাবার শেষসন্তান। বাবুয়া, বুলার পিঠোপিঠি। দেড় বছরের ছোটো।

১৯৪৯-এ আমরা রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর সেই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে ডোভার রোডে এলাম। বাবা সেখানে একটি ছোটো বাড়ি কিনেছিলেন। তার আগে রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে থাকতেই, বাবা বদলি হয়ে বরিশালে চলে গিয়েছিলেন। প্রথমে বাবা একাই গিয়েছিলেন, তার পরে মায়ের সঙ্গে আমি, আমার দুই বোন এবং দুই ভাইও গেছিলাম বরিশালে। তখন বুলা খুবই ছোটো ছিল এবং বাবুয়া তো আরও ছোটো ছিল। আমি বরিশাল জেলাস্কুলে ভরতি হলাম। প্রথমে গিয়ে উঠলাম আমানতগঞ্জে। সেই আমানতগঞ্জের বাড়ি বহুদূর ছিল জেলাস্কুল থেকে। প্রায় আড়াই-তিন মাইল তো হবেই। হেঁটে যেতাম স্কুলে। আর ফেরবার সময়ে বাবার অফিস ছিল মাঝরাস্তাতে, সেই অফিসে গিয়ে একটু কিছু খেয়ে, তার পর আবার হেঁটে ফিরতাম আমানতগঞ্জে। আমানতগঞ্জের পরে বাসা বদল করে গেলাম কাঠপট্টিতে। সেই বাড়ি থেকে স্কুল অতদূর ছিল না। কাঠপট্টির পরে শেষের দিকে নতুন আস্তানা হল জর্ডন কোয়ার্টারে। সেটা খুব পশ এলাকা ছিল বরিশালের এবং জেলাস্কুলের খুবই কাছে। তখন বুলা-বাবুয়া এতই ছোটো ছিল যে, ওদের স্মৃতি আমার কাছে একটু অস্পষ্টই।

বরিশালের পরে আমরা আবার কলকাতায় ফিরে এলাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার দু-দিন আগে। তখন option দিতে হত সরকারি অফিসারদের যে, কে পাকিস্তানে থাকবেন, কে ভারতবর্ষে থাকবেন। বাবা স্বভাবতই option দিয়ে ভারতে ফিরে এলেন। বরিশালের গারো, ফ্লোরিকান, সেইসব প্যাডেল-স্টিমারে চড়া একটা অভিজ্ঞতা ছিল। আমরা সেকেণ্ড ক্লাস-এর ডেক-এ রেলিং ধরে বসে থাকতাম। নদীর দু-পাশের দৃশ্য দেখতাম। সেইসব স্টিমারের বাবুর্চিদের যা রান্না ছিল! মুরগির ঝোল, ইলিশ মাছ। তেমন রান্না, সারাপৃথিবীতে ঘুরেও খুব একটা খাইনি।

মনে আছে, বুলা বরাবরই দুর্বল ছিল। ওর প্রায়ই কিছু-না-কিছু অসুখ করত। তখন আমরা দু-এক বছর বাদে বাদে পুজোর সময়ে বিন্ধ্যাচলে যেতাম চেঞ্জের জন্য। সেইসব পাথরের বাড়ি, পান্ডাদের বাড়ি, ভাড়া নিতেন বাবা। ঠিক বিন্ধ্যাচলে আমরা থাকতাম না। আমরা থাকতাম শিউপুরাতে। বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির তো বিন্ধ্যাচলে ছিল। কিন্তু শিউপুরাতেও বিন্ধ্যপাহাড়, পাহাড় মানে—বিন্ধ্যরেঞ্জ, সেই-ই বিন্ধ্যপাহাড় যে, গুরুকে প্রণাম করার জন্য মাথা নীচু করেছিল, তার পর গুরু ফিরে না আসাতে মাথা আর উঁচু করেনি। সেই পাহাড়ের রেঞ্জ চলে গিয়েছিল বহুদূর অবধি।

পাহাড়ের ওপরে মালভূমি ছিল। তাতে নানা গাছগাছালি, নানা প্রাণী এবং মালভূমির নীচে একটি উপত্যকা ছিল। তাতে নীলগাই ভরতি ছিল। নীলগাই, ময়ূর, নানারকম সাপ, খরগোশ। সেখানে বাজরা চাষ করত দু-একজন চাষি, তাদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। আমি তখন কলেজে পড়ি। নিজের রাইফেল, বন্দুক ছিল না। বাবার একটা ‘ফোর টোয়েন্টি থ্রি’ ফ্রেঞ্চআর্মির রাইফেল নিয়ে সারাদিন ওই পাহাড়ের ওপরের মালভূমিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। সেখানে একদল চিঙ্কারা হরিণও ছিল। চিঙ্কারা হরিণকে ফাঁকা জায়গায় কবজা করা খুব কঠিন। তারা, দেখামাত্র দৌড়ে পালিয়ে যেত। চিঙ্কারা মেরেছিলাম পরে, তবে পাহাড়ের ওপরে নয়।

বাবার সব ওরিজিনাল আইডিয়াজ ছিল যা অন্য দশজন শহুরে মানুষের ভাবনারও বাইরে ছিল। একদিন বাবার নেতৃত্বে আমি, বাবা, বুলা আর আমার মামাতো দাদা দুলুদা এই চারজনে একটা গোরুরগাড়ি করে বেড়ালাম। সঙ্গে গাড়োয়ান এবং তার চেলাও একজন ছিল। উদ্দেশ্য মহৎ—চাঁদনি রাতে মুনলাইট পিকনিক করার জন্যে বেরিয়েছিলাম। আর সেইদিনই শেষবিকেলে হঠাৎ পথের ডান দিকে পাহাড়ের ওপরে ওই চিঙ্কারা হরিণের দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। দেখামাত্র রাইফেল বাগিয়ে একদৌড়ে পাহাড়ের ওপরে চড়লাম। সেইসময়ে আমি নিজেও হরিণের মতোই ক্ষিপ্র ছিলাম। নীচ থেকে বাবা এবং আমার দাদা বলতে লাগলেন, ওই যে রে! তোর পাশে, তোর পাশেই। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি না। তারা নেমে গিয়ে দৌড়ে সমতলে চলে যাচ্ছিল। যেই হরিণটা ঝোপের পেছনে গেছে একটা হরিণের উচ্চতা আমি চকিতে আন্দাজ করে নিয়ে একটা হরিণকে আমি গুলি করলাম। এবং সে সেখানেই পড়ে গেল। চিঙ্কারা হরিণ সেই একবারই শিকার করেছিলাম।

তারা মাপে ছোটো হয়, ঊষর জায়গাতে থাকে এবং দলে থাকে। গায়ের রং হালকা বাদামি এবং অত্যন্তই ক্ষিপ্রগতি। আজকে চিঙ্কারা মারলে সলমান খানের মতো অবস্থা হত। কিন্তু তখন পাখপাখালি, গাছগাছালি, জন্তু-জানোয়ার অনেকই ছিল। আজ থেকে প্রায় বাষট্টি বছর আগের কথা। হা-ভাতে মানুষদের চাপে এবং অত্যাচারে আজকের মতো এমন মরুভূমি হয়ে যায়নি আমাদের পৃথিবী। সুন্দর পৃথিবীতে তখন সকলের জন্যেই জায়গা ছিল। কোনো কিছুরই অকুলান হত না। রাত নামল। বিশ্বচরাচর উল্লসিত করে, পূর্ণিমার তিন দিন আগের চাঁদ উঠল। শিশিরের আর জ্যোৎস্নার গন্ধে ভরে গেল পৃথিবী। তখন গোরুরগাড়ি থামিয়ে একটি ছোটো পাহাড়ি নদীর পাশে মাটির হাঁড়িতে ভাত রান্না করা হল। সঙ্গে ঘি, আলু আর ডিম ছিল, কাঁচা পেঁয়াজ এবং কাঁচালঙ্কা। নদীর জলে পাথর ধুয়ে পাথরের ওপর ভাত মেখে আর ওই আলুসেদ্ধ আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে খেয়ে আমরা মুনলাইট পিকনিক করে ফিরে এলাম। বুলা তখন ছোটো।

একদিন বাবা প্রচুর মাছ কিনেছিলেন। প্রায় রোজই কিনতেন। মাছ খুব সস্তাও ছিল। গঙ্গার মাছ। বড়ো ঘাট ছিল একটি। মা বেচারি! রান্না করে করে একেবারে জীবন চলে যেত।

একদিন রাতের খাওয়ার পরে বুলার গলায় একটা কাঁটা ফুটল, প্রচন্ড যন্ত্রণা। আর মা আমার খুব নরম মনের মানুষ ছিলেন। তিনি তো কান্না দেখে বিচলিত হয়ে আমায় বলতে লাগলেন, তুই যেরকম করে হোক চলে যা। বিন্ধ্যাচলে গিয়ে একজন ডাক্তার ডেকে নিয়ে আয় খোকন।

বাবা ছিলেন অত্যন্ত শক্তমনের মানুষ। বাবা বললেন, এখন কিছুই হবে না, যা হওয়ার কাল সকালে হবে।

মা বললেন, ছেলে আমার মরে যাবে। বাবা বললেন, মরে গেলে যাবে। কিন্তু মরলেও কিছু করবার নেই। এখন কোনো উপায়ই নেই। এত রাত্রিতে, এরকম ছোটো জায়গা, কোথায় ডাক্তার কেউ জানে না। আর ডাক্তার থাকলেও সে আসবে না। কীসে করে আসবে সে? এখন না পাওয়া যাবে টাঙা। তখন টাঙারই দিন। না আছে এখানে ডাক্তারের গাড়ি। এমনকী মোটরসাইকেলও নেই। তখন অটোও ছিল না। সাইকেলরিকশাও ছিল না সেখানে। আর ট্যাক্সি তো ছিলই না। সেই বিভীষিকাময় অথচ নিশ্চেষ্ট রাতের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অথচ কত যুগ আগের কথা। মনে আছে, বুলার গলার সেই কাঁটা নিয়ে ভীষণই ভোগান্তি হয়েছিল।

তার পর পুজোর ছুটি ফুরোলে বিজয়া সম্মিলনি করে কলকাতায় ফিরে যেতাম।

বাবা তখন নতুন অফিস করেছিলেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে। বহরমপুরে ক্যাম্প অফিস। সেখানে উইক এণ্ডে বাবাকে যেতে হত। প্রত্যেক উইক এণ্ডেই। শুক্রবার রাতে এগারোটার সময়ে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে যেতেন। নামতেন গিয়ে শনিবার ভোররাত্তিরে। শনি-রবি কাজ করে রবিবার রাত্তিরে আমাদের এক সিনেমা হল মক্কেল ছিল মোহন টকিজ, খাওয়া-দাওয়া সেরে সেই সিনেমাহলে গিয়ে বাবা বসে ছবি দেখতেন। কিন্তু পুরো সিনেমা দেখা আর কোনোদিনই হত না, ট্রেনের সময় হলে, সিনেমা হলের ম্যানেজার বাবাকে উঠিয়ে দিতেন। কানের কাছে বাবার ফিসফিস করে বলতেন, গুহসাহেব সময় হয়েছে। অথচ তখন হয়তো হিরো হিরোইনকে চুমু খেতে যাচ্ছে অথবা খুব একটা জমাটি গান শুরু হয়েছে। বাবা সেখান থেকে সাইকেলরিকশা করে স্টেশানে এসে, গভীর রাতের ট্রেন ধরে রবিবার সক্কাল বেলায় কলকাতা ফিরতেন।

মনে আছে আমরা তখন ডোভার রোডে আছি। বাবার অনুপস্থিতির সময়ে বুলা ভীষণই অসুস্থ হয়ে পড়ল। তখন আমরা ওই পাড়ায় নতুন গেছি। ওখানকার কিছুই চিনি না। ডাক্তার-মোক্তার কারুরই খোঁজ রাখি না। তা আমাদের সেই ডোভার রোডের মোড়ে, ডোভার রোড আর হাজরা রোডের ক্রসিং-এ গুহ ফার্মেসি বলে একটি ওষুধের দোকান এবং ফার্মাসি ছিল। মায়ের কথাতে আমি সেখানে গিয়ে ডাক্তার ডেকে নিয়ে এলাম। ডা. আর এন গুহ বলে, একজন ডাক্তার ছিলেন। এবং ডাক্তারও খুব ভালো। দারুণ ডায়াগনসিস ছিল। অ্যান্টিবায়োটিকের আন্দাজি ছররা মেরে রোগ সারাবার চেষ্টা করতেন না। ফর্সা, মোটাসোটা। ভালো ব্যবহার খুব। ওঁকে ডেকে আনলাম। তিনি এসে বুলাকে দেখে ওষুধ দিলেন। তখন তো mixture-এর যুগ। তখন তো আর মুঠো মুঠো ট্যাবলেট খাওয়াতেন না ডাক্তাররা। mixture বানিয়ে দিতেন। তা সে পেটের অসুখই হোক বা জ্বরই হোক। নানা রঙের mixture। দাগ কাটা থাকত শিশিতে। বুলার সেই অসুস্থতা থেকে সেইথেকে ডা. গুহ আমাদের পরিবারের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান হয়ে গেলেন। তার আগে ডাক্তারের কোনো প্রয়োজনও পড়েনি।

ডোভার রোডের বাড়ি বিক্রি করে বাবা রাজা বসন্ত রায় রোডে বাড়ি করলেন পঞ্চান্ন সালে। বুলা সেখানেও প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর যতরকম দুর্ঘটনা সব ওরই ঘটত।

গান-বাজনা খুব ভালোবাসত আমার ছোটো দুই ভাই-ই। বিশেষ করে, আধুনিক গান, হিন্দি গান। আমি আবার রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত ছিলাম। গান শিখতামও। আমি ওসব গান তখন বিশেষ পছন্দ করতাম না। একবার কলকাতার বাইরে গেছি অফিসের কাজে। বাবাও ছিলেন না, কোনো কাজে কলকাতার বাইরে গেছিলেন। বাবার নতুন বাড়ির নাম দিয়েছিলাম আমি ‘কনীনিকা’। বাড়িতে লন ছিল একটি। এখনও আছে। সেই লনটিকে করা হত অডিটোরিয়াম, আর একতলার বসার ঘরটি হত ডায়াস। সেখানেই গান-বাজনা হত। আমি বসন্তোৎসব, বর্ষামঙ্গল এসব করতাম প্রতিবছর শান্তিনিকেতনি ঢঙে। তবে সেইসব অনুষ্ঠানে দু-তিনটি মাইক থাকত। যন্ত্র বলতে এ-পর্যন্তই। কিন্তু বুলা, বাবুয়ারা, বাবা ও দাদার অনুপস্থিতিতে নানা ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটস এনেছিল। অ্যামপ্লিফায়ার সাউণ্ডের বড়ো বড়ো বাক্স ইত্যাদিও ছিল। ইলেকট্রিক গিটার, বঙ্গো ড্রামও ছিল। বাড়ির নানা পয়েন্ট থেকে ইলেকট্রিক তার টেনে নিয়ে গিয়ে সেগুলো লাগানো হয়েছিল। সেগুলি খোলবার সময় বুলার প্রচন্ড ইলেকট্রিক শক লাগে। শক লেগে প্রায় মরেই যাচ্ছিল। ওদের সব বন্ধুরাও সঙ্গে ছিল সেই মেগা ফাংশানে। বাবুজি, অরবিন্দ, রাণা, গৈ, রণু, ভাস্কর, অভিজিৎ এবং আরও অনেকে। আগেই বলেছি, ওদের বন্ধুর অভাব ছিল না। আরও অজস্র বন্ধু ছিল। রণজিৎ চ্যাটার্জি ও অরবিন্দ স্কুলের বন্ধু ছিল না।

বুলা এবং বাবুয়া সেইন্ট অ্যান্ড্রুস স্কুলে পড়ত। সেখান থেকেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পাস করল।

বুলা খুবই ভালো রেজাল্ট করল। সায়ান্স নিয়ে পড়েছিল ও। ফার্স্ট ডিভিশান তো বটেই খুবই ভালো নম্বর পেয়েছিল। তখনকার দিনে আজকের মতো নাম্বারের হরির লুঠ ছিল না। বেশি নাম্বার পাওয়া কঠিন ছিল। কিন্তু তখন আরও ভালো নম্বর না হলে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভরতি হওয়ার অসুবিধে ছিল।

তখন ত্রিগুণা সেন ছিলেন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার। ত্রিগুণা সেন মশাইয়ের মেয়ে সুহৃতা ‘দক্ষিণী’তে গান শিখত। ঋতুর বন্ধুস্থানীয় ছিল। আমিও চিনতাম। খুব ভালো মেয়ে। তখন ঋতুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে। সুহৃতার শরণাপন্ন হল ঋতু, কিন্তু তবুও সম্ভব হল না।

বাবা ভেবেছিলেন, বড়োছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেট, মেজোছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যখন হল না তখন বাবা বাধ্য হয়েই ওকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে কমার্সে ভরতি করলেন।

বুলা ক্রিকেট ভালোই খেলত আমাদের বাড়ির লনে। আগেই বলেছি, অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল আমার ভাইদের। আমার যেমন কোনো বন্ধুই ছিল না। সারাটা জীবনই একা ঘরে বসে হয়তো পড়তাম, ছবি আঁকতাম, গান গাইতাম। কিন্তু ওদের বন্ধুবান্ধবের কোনো অভাব ছিল না কোনোদিনই। তার প্রমাণ যাঁরা ওর মৃত্যুদিনে অথবা রাতে শ্মশানে গেছিলেন তাঁরাই বুঝতে পেরেছেন। এবং ওদের প্রায় সব বন্ধুই খুব বড়োলোক ছিল। বুলা শিকারেও যেত মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে। আমি বেশি সুযোগ পেয়েছিলাম বড়োছেলে বলে। তা ছাড়া আমার শিকারি বন্ধুবান্ধব ছিল। জঙ্গলের বন্ধু। বুলা-বাবুয়া ১০-১১ বছরের ছোটো আমার থেকে। তবে বাবা ওদের কোনো কোনো জায়গায় নিয়ে যেতেন।

বি কম পাস করার পরে ও জয়েন করল বাবার ফার্মে CA পড়বে বলে। CA পরীক্ষাতেও ও খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। আমার মতো নয়। আমি তো ভালো ছাত্র ছিলাম না। আমার accountancy পড়তে ভালোও লাগত না। কিন্তু দশটা গাধা মরে একটা বড়োছেলে হয়। বাবার ইচ্ছেয় আমায় CA হতেই হল। Law পড়তাম। আমি CA পাস করা মাত্র, বাবা বললেন, আমি আমার এগ্রিকালচারাল ফার্মে গিয়ে চাষবাস করব। অফিস আমি আর করব না। বললেন, তুমি দেখো।

বলে, আমার ঘাড়ে অত বড়ো ফার্মের দায়িত্ব ফেলে দিয়ে বাবা তাঁর এগ্রিকালচারাল ফার্ম-এ চলে গেলেন। আমায় ল-কলেজ ছেড়ে দিতে হল।

বুলা এত ভালো রেজাল্ট করেছিল যে, ওর রেজাল্ট দেখে ভারতবর্ষের বিভিন্ন বড়ো বড়ো কোম্পানি ওকে চাকরির অফার দিয়েছিল। খুব ভালো ভালো অফার। সেই একটা অফার অ্যাক্সেপ্ট করলে, আজকে হয়তো ও রিটায়ার করত, কারণ ওর বয়স ৬৩ হয়েছিল মৃত্যুর সময়। কিন্তু বিরাট মাইনে পেত, অনেক পার্কস ছিল। গাড়ি পেত, ফ্ল্যাট পেত। কিন্তু যেহেতু বাবার নিজের ফার্ম, বাবার ইচ্ছে ছিল ‘‘আমার ফার্মেই থাকুক।’’

আমি তখন পুরোদস্তুর অফিস করছি।

বুলা আমাদের পার্টনার হয়ে এল ৭২ সালে। বাবা তখনও প্রধান পার্টনার।

আমার বিয়ে হয়েছিল ৬২ সালে, তখন তো বুলা কলেজে পড়ে। তো বিয়ের পরে হাজারিবাগের কাছে চাতরা district-এর কারগু নামের একটা গ্রামে শিকারের বন্দোবস্ত হল। আসলে ওটা অ্যারেঞ্জ করেছিল আমার শিকারি বন্ধু, হাজারিবাগের সুব্রত চ্যাটার্জি, মহম্মদ নাজিম এবং সুব্রতর ভাই মুকুল। কারণ ওরা জায়গাটা চিনত। বছর খানেক আগেই ওরা ওখানে গেছিল। শালিমার পেইন্টস-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ফ্রাঙ্ক বেকারও গেছিলেন তখন। খুব সুন্দর চেহারা ছিল ভদ্রলোকের। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন পরমা সুন্দরী।

সুন্দরবন ইত্যাদি ইত্যাদি জায়গাতে আমাদের সঙ্গে শিকারে গেছিলেন পরে।

বার্ড কোম্পানির ডিরেক্টর ছিলেন দ্বারিকদা, দ্বারিক মিত্র। আরও অনেক বন্ধুবান্ধব মিলে ওঁরা গেছিলেন কারগুতে শিকারে। জায়গাটা চিনত বলে এবং অনেক শিকার, বাঘও ছিল, তাই ওরা ওখানেই অ্যারেঞ্জ করেছিল। আমরা পাঁচ-ছ-টা গাড়ি নিয়ে তাতে তাঁবু, রান্নার ঠাকুর, আমার শ্বশুরবাড়ির কিছু আত্মীয়স্বজন, দুই ভাই বুলা, বাবুয়া, পিসতুতো ভাই ঝন্টু, সেও মারা গেছে অল্প কয়েক দিন আগে, সবাই মিলে গেলাম সেখানে। তাঁবু খাটিয়ে একটা নদীর বেডে, নদীটার নামই ছিল কারগু, ক্যাম্প করে থাকা হল।

বুলা তখন স্কুলে পড়ে। খুব উৎসাহী শিকারি। ছুলোয়া শিকারে আমি একটা খুব বড়ো সম্বর মেরেছিলাম। স্পেকটোকুলার শট-এ। খুব বড়ো শিঙাল সম্বর। আর সুব্রত দু-দিন পরে আর একটা সম্বর মেরেছিল। আর বুলা মেরেছিল একটা wolf। কিন্তু মেরেছিল পয়েন্ট ‘টু-টু’ররাইফেল দিয়ে। হালকা পয়েন্ট ‘টু-টু’র গুলি খেয়ে সে পড়েনি, দৌড়ে চলে গেছিল। তার পরদিন wolf টাকে পাওয়া গেল। সেই বুলার প্রথম বাঘ শিকার, নেকড়ে বাঘ যদিও।

বাবা-মায়ের একটু মনস্তাপ ছিল। ওঁদের ইচ্ছে ছিল, নিজেদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবেন আমার। আমি তো গান শুনে গায়িকাকে বিয়ে করলাম ভালোবেসে।

মা-বাবা বুলার জন্য মেয়ে দেখতে যেতেন। আমাকে যেতে বললে আমি বলতাম, ভদ্রলোকের বাড়ি গিয়ে শিঙাড়া আর রসগোল্লা খেয়ে-দেয়ে, দেখে দেখে সম্বন্ধ করা আমি একবোরে পছন্দ করি না। আমি যাব না তোমাদের সঙ্গে, তোমরা যা-খুশি করো।

বেশ কয়েক জায়গা ঘুরে একটি মেয়েকে মা-বাবার পছন্দ হল। বুলার চেয়ে প্রায় পাঁচ-ছবছরের ছোটো মেয়েটি। মজুমদার বাড়ির মেয়ে। যখন পছন্দ হয়েই গেল, তখন ওদের বাড়িতে মেয়ের আশীর্বাদে আমিও গেলাম বাবা-মায়ের সঙ্গে। মেয়েটির নাম রঞ্জনা। ফর্সা নয়, কিন্তু কালোর মধ্যে খুব মিষ্টি চেহারা। হাসিটি ভারি সুন্দর। সুন্দর দাঁত। ভালো গানও গায়। রঞ্জনাকে প্রথম যখন দেখলাম তখন বুলার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আশীর্বাদ হয়ে গেলে গানও শোনাল রঞ্জনা। রবীন্দ্রসংগীত। বেশ ভালো গায়। ওর দিদি অঞ্জনাও গায়।

বুলার বিয়ে আর আমার জন্মদিন একই দিনে। যার ফলে আমি কোনোদিনই ওর বিয়ের অ্যানিভারসারিতে যেতে পারিনি। ও-ও কোনোদিন আমার জন্মদিনের পার্টিতে আসতে পারেনি।

বাবা হনিমুনে আমাকে ছুটি দেননি। তাই নিয়ে আমার ভীষণ একটা আক্ষেপ ছিল। ছুটি যখন দিলেন, তখন প্রায় তিন মাস হল বিয়ে হয়ে গেছে। গোপালপুর অন-সিতে যাব বলে, বেহেরামপুর গঞ্জামের টিকিট কেটেছি। বেহেরামপুর স্টেশানে নেমে, যেতে হয় গোপালপুর। আমি খুব independent স্বভাবের ছেলে ছিলাম। বাবার তখন চারখানা গাড়ি। কিন্তু আমি বাবার কাছ থেকে কোনো টাকাই নিইনি। যা সামান্য ড্রয়িং করতাম, সেই টাকা নিয়েই গেছিলাম। এয়ারকণ্ডিশানে চড়ার পয়সা ছিল না, 1st Class করে গেছিলাম। গিয়ে বেহেরামপুরে নেমে, ট্যাক্সি করারও পয়সা ছিল না। একটা ছইওয়ালা ঘোড়ার গাড়ি করে গেলাম। এক চাইনিজ ভদ্রলোকের ছোটো একটা হোটেল ছিল। গোপালপুরের বাঁ-দিকে যেখানে ডিলাপিডেটেড বাড়ি ছিল অনেক, সেখানে একটা দোতলা বাড়িতে তিনি হোটেলটা চালাতেন। হোটেলে কুল্লে চারটে ঘর ছিল দুই-তলা মিলিয়ে। কী ম্যানেজার, কী ঝাড়ুদার, কী কুক, সকলের কাজই একা হাতে করতেন। বাবা যে আমাকে হনিমুনে যাওয়ার ছুটি দেননি, সে-কারণেই আমি ফার্ম-এর অংশীদার হওয়ার পরে আমার অফিসের যত কর্মচারী বিয়ে করেছে তাদের প্রত্যেককে ছুটি দিয়ে হনিমুনে পাঠিয়েছি নিজের খরচায়।

গোপালপুরে পামবিচ হোটেল ছিল ওবেরয় গ্রূপের। দারুণ হোটেল। আমি আর ঋতু হোটেলের সামনে দিয়ে যখন হাঁটতাম, স্ত্রীকে আমি বলতাম, আমি যদি কোনোদিন বড়োলোক হই, আমরা এই হোটেলটায় এসে আর এক বার থাকব। খুবই expensive হোটেল।

বুলা ও রঞ্জনার বিয়ের পরে ওদের জন্যে এয়ারকণ্ডিশানড কুপের টিকিট কেটে ওই হোটেল বুক করে দিলাম। বললাম, যা তোরা ওখানে গিয়ে হনিমুন কর।

সে এক গল্প।

মধুচন্দ্রিমাতে তারা তো গেল। তিন-চারদিন পরই পুরী থেকে ট্রাঙ্ককল। গোপালপুর নয় পুরী থেকে।

বুলা বলল, আমরা পুরীতে এসেছি।

সেকী রে! কেন?

ও বলল, কলকাতাতে ফিরে গিয়ে বলব।

ফিরে আসার পরে জানা গেল যে, গোপালপুরে ওরা ভোরবেলাই পৌঁছে গেছিল পামবিচ হোটেলে। সবে বিয়ে করে গেছে। সমুদ্রে স্নান করেছে, দুপুরে জমিয়ে লাঞ্চ খেয়েছে।

আমাদের প্রচুর মক্কেল ছিল যারা, যতরকম ইম্পোর্টেড হুইস্কি, ব্র্যাণ্ডি সব ইম্পোর্ট করত, এবং বড়োদিনের সময়ে কেসকে-কেস সেইসব মহার্ঘ জিনিস আমাদের পাঠাত। আমারটা আমি বাবাকে দিয়ে দিতাম। বাবা তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। বাবা মদ্যপান একেবারেই করতেন না এবং করা পছন্দও করতেন না। আমিই ছিলাম পরিবারের প্রথম কুলাঙ্গার।

বুলা বিয়ে করে গেছে নতুন। সন্ধের পরে একটা হুইস্কির বোতল বার করে খুলেছে। যেই-না খুলেছে, অমনি নতুন বউ রঞ্জনার হাউমাউ করে কান্না। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। বাবাও পছন্দ করতেন না মদ্যপান করা। আমি তো ৩০ বছর বয়েসে জীবনে প্রথম by an accident, শিকারে গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে প্রথম স্কচ খেয়ে চরিত্রনাশ করি। তার আগে কখনো খাইনি।

বুলা বোতল খুলতেই রঞ্জনা তো কান্নাকাটি, মূর্ছা যায় আর কী! তার পরে বলেছিল, ভারি নির্জন জায়গা। ভয় লাগে থাকতে। মনে হয় ভূত আছে। তাই তারা গোপালপুর ছেড়ে দিয়ে বেহেরামপুর এসে পুরীতে চলে এল। পুরীতে ছিল কিছুদিন। বি এন আর হোটেলে, থুরি এস ই আর হোটেলে।

বুলা ফিরে আসার পরে অফিসের অডিটের ভার ও-ই নিল বলতে গেলে, আমি ট্যাক্সেশানই দেখতাম। বুলা খুবই intelligent ছিল। আর ব্যবহারটা খুবই সুন্দর ছিল। উত্তমকুমারের মতো দেখতে ছিল। আমাদের ভাইদের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে সুন্দর।

বুলা অডিট দেখা শুরু করল। এবং আমি ultimately administration এবং finance সবই ওকে দিয়ে দিলাম। হি ভার্চুয়ালি বিকেম দ্য ওনার অফ দ্য ফার্ম।

ও আমাকে খুবই সম্মান করত। আজকালকার দিনে এরকম দেখা যায় না। আমি যদি কখনো ওর ঘরে ঢুকেছি, সঙ্গে সঙ্গে ও উঠে দাঁড়াত। একদিনও এমন হয়নি যে, ও উঠে দাঁড়ায়নি। মক্কেলরা তার ঘরে ভরতি। হয়তো কনফারেন্স করছে। বাট হি অলওয়েজ ইউজড টু স্ট্যাণ্ড আপ।

আসলে যেখানে আর্থিক অভাব নেই, অনেক মানুষ, অনেক ভাই-ই মনে করতে পারে, দাদাকে এই সম্মান দেখানোর কী মানে? প্রয়োজন কী? কিন্তু বুলা সেদিক দিয়ে খুবই conservative ছিল, অত্যন্ত well-principled ছিল। অত্যন্ত ভালো স্বভাব ছিল ওর। আজকে ও নেই, কিন্তু এই কথাটা আমি চিরদিন মনে রাখব।

হয়তো অনেক সময় অশান্তি হত, ভুল বোঝাবুঝি হত, কিন্তু বাইরের লোকের কাছে ও যে-সম্মান আমাকে দিয়েছে সেটা ভোলবার নয় এবং সেটা প্রত্যেক পরিবারের কাছে একটা আদর্শ। দাদাকে কী করে ছোটোদের সম্মান দিতে হয়, সম্মান জানাতে হয়, তা ওকে দেকে শেখা উচিত অন্যদের। ওর ব্যবহার এতই ভালো ছিল যে, আমার শ্বশুরবাড়ি, বিশাল শ্বশুরবাড়ি, আপন শালাই ছ-জন। খুড়তুতো শালা তিনজন, জ্যাঠতুতো শালা তিনজন, শ্যালিকাও অগণ্য, আমার শ্বশুরবাড়িতেও বুলা আমার চেয়ে অনেকই বেশি জনপ্রিয় ছিল। তাদের বিপদে-আপদে, অসুখে বুলা সবচেয়ে আগে গেছে। কারুর হয়তো অপারেশন হচ্ছে, নার্সিংহোমে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আর ওর হাসিমুখ ও মিষ্টি স্বভাবের জন্য, ওকে সকলেই ভালোবাসত, আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসত। ও কিন্তু খুব কমই drink করত। Calcutta Club-এ ওকে member করলাম। আমি করিনি, অন্য কাউকে দিয়ে propose করিয়েছিল। আমি second করেছিলাম।

বুলা, বাবুয়া দুজনেই খুব পরিমিত drink করত। Company enjoy করত ওরা। ওদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই ছিল, যারা প্রচুর drink করত। কিন্তু ওরা কোনো দিন বাড়াবাড়ি করেনি।

আমার এক শিকারি বন্ধু, কটকের, গাড়ি করে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যাচ্ছিলাম। আমার একটি কটেজ ছিল ম্যাকলাস্কিগঞ্জে। পথে এক accident-এ মাথায় চোট লাগে আমার কটকি বন্ধুর। খড়্গপুরের রেলওয়ে হাসপাতালে তাকে তিন দিন রেখে তার পরে কলকাতায় নিয়ে আসি। সেটা একটা ঘটনা।

খড়্গপুরের ডাক্তার বললেন, মাথায় চোট লেগেছে, এখন ছাড়া যাবে না। তখন রিটায়ারিং রুমে আমি এবং আমার এক বন্ধু, আমার চেয়ে বয়েসে ছোটো ছিল, এক ক্লাস বা দু-ক্লাস নীচুতে পড়ত স্কুলে, সেও গেছিল আমাদের সঙ্গে ম্যাকলাস্কিগঞ্জে যাবে বলে। তার জামাইবাবু, দিদি, আরও অনেকে ছিলেন।

বুলাদের শখ ছিল মোটর র‌্যালি করার। বড়োলোকদের শখ এটা। বড়োলোকরাই করতে পারে। একদল বন্ধু ছিল র‌্যালির। ওরা সবাই এনডিয়োরেন্স র‌্যালি করত। কীরকম করত? ডিফারেন্ট স্প্যানে, ডিফারেন্ট স্পিড। এবং সেই স্পিড maintain করতে হবে। আর যদি কেউ স্পিড maintain না করে, পথে গোপন চেকপোস্ট থাকত, সব মার্শালসরাও থাকতেন। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে নম্বর কেটে দিতেন।

কেউ যদি বেশি স্পিডে যায়, অথবা কেউ যদি কম স্পিডে যায়, তাহলেও নম্বর কাটা যাবে। কিন্তু কীরকম র‌্যালি? সকালবেলা কলকাতা থেকে বেরোল, রাত্রিবেলা গিয়ে দিল্লি পৌঁছোল। দিল্লিতে একদিন রেস্ট, গাড়ি সার্ভিসিং, নিজেদের রেস্ট, আবার পরের দিন সকালে দিল্লি থেকে বেরোল, দিল্লি থেকে বম্বে একদিনে। বম্বেতেও তাই, বম্বে থেকে ম্যাড্রাস। ম্যাড্রাস থেকে কলকাতা। এই ৪০০০-৫০০০ মাইলের র‌্যালি করে ওরা অনেক বার প্রাইজ পেয়েছে। অবশ্য আমাদের মক্কেলরা কিছু কিছু স্পনসর করতেন। দে’জ মেডিকেলের ধীরেন দে, বাবার বন্ধু ছিলেন। ভূপেন দেও বাবাকে দাদা বলতেন। এইরকম বড়ো বড়ো মক্কেলরা স্পনসর করতেন, প্রচুর খরচা তো। গাড়িই ছিল বুলার সবচেয়ে বড়ো শখ। রঞ্জনাকে প্রায়ই একটা বি এম ডাব্লু বা মার্সিডিস কেনার কথা বলত। পুরো ইণ্ডিয়াতে ওদের সবাই চিনত নামে। গাড়ির র‌্যালি করে এরা, চ্যাম্পিয়ানস।

বুলার একটা দোষ ছিল, প্রচন্ড খেতে ভালোবাসত। এবং খেতে বাবাও খুব ভালোবাসতেন, আমিও খুব ভালোবাসি। কিন্তু ও ভালোবাসত ভাজাভুজি, যত অখাদ্য পৃথিবীতে আছে। তেলেভাজা, শিঙাড়া, নিমকি, নোনতা। আর বিরিয়ানি। বিরিয়ানিও রাঁধত ও প্রচন্ড ভালো। বিরিয়ানি রান্না করে ওর কলকাতা ও শান্তিনিকেতনের বাড়িতে মানুষকে নেমন্তন্ন করত। বিরিয়ানি রান্না করা কত লোককে যে ও শিখিয়েছে। ওর ছোটোশালি সেদিন ওর শ্রাদ্ধতে স্মৃতিচারণ করে পাঠিয়েছে আমেরিকা থেকে। লিখেছে যে, বুলাদা আমায় বিরিয়ানি রান্না করতে শিখিয়েছিলেন, কত লোককে যে শিখিয়েছেন এবং কত লোককে খাইয়েছেন।

কারুর বাড়ি পার্টি থাকলে, ওর ডাক পড়ত বিরিয়ানি রান্না করার জন্য। আর রান্নাটা ও খুব enjoy-ও করত। এই করতে করতে ওর লিভারটা খারাপ হয়ে গেল। খুব মদ্যপান করলে হয় সিরোসিস অব লিভার, আবার বিধবাদেরও হয়। খালি পেটে থেকে থেকে, আতপ চাল খেয়ে, খালি পেটে বেশি ফল খেয়ে হয়। যেমন, আনন্দবাজারের সুরেশচন্দ্র মজুমদারের হয়েছিল। উনি ব্যাচেলার ছিলেন। প্রচুর ফল খেতেন উনি। বেশি ফল খেলে সেটা পেটে গিয়ে ফার্মেন্টেশন হয়ে মদ হয়ে যায়। উনিও সিরোসিস অব লিভারে মারা গেছিলেন।

অপারেশন হল বুলার বছর পাঁচেক আগে। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই ডাক্তার। ডা. দীপক মুখার্জি, হিমাদ্রী সেনগুপ্ত, …ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। অপারেশানের পরে ওরা সবাই মিলে আমায় বলল, বুদ্ধদেব, বুলার drink করা তো চলবেই না, আর অতিসাবধানে বাকি জীবন কাটাতে হবে। লিভারের অবস্থা খুবই খারাপ। তার পর হায়দরাবাদে গিয়ে এক ডাক্তারকে দেখাত। ব্যাঙ্ক অডিটের কাজেও যেতে হত ওর হায়দরাবাদে।

বুলা গান তো খুব ভালোবাসত, বিশেষ করে আধুনিক গান এবং হিন্দিগান। ও গান গাইতে চাইত। কিন্তু ঈশ্বর ওর গলায় সুর দেননি। সেটা ওরও খুব দুঃখের কারণ ছিল। ও একটা গান গাইত, কোন ছবির গান আমি বলতে পারব না, কোনো হিন্দি ছবির গান হবে। কোনো হিন্দি ছবিই আমি দেখতাম না। ও গাইত, ‘‘দিলরুব্বা’’, আর এটা শুনে ছোটোভাই বাবুয়া এবং আমার ছোটোশালা অভিরূপ, যে এখন বড়ো রবীন্দ্রসংগীত গাইয়ে, অভিরূপ গুহঠাকুরতা, ইঞ্জিনিয়ার। ওরা এত খ্যাপাত বুলাকে, ও যদি-বা কিছু গাইতে পারত, তা ওদের জন্যই সেটা সম্ভব হল না।

একবার আমরা যে-বিন্ধ্যাচলের কথা বলছিলাম, বিন্ধ্যাচলের শিউপুরা নিয়ে আমার অনেক লেখা আছে। একটা খুব জনপ্রিয় উপন্যাসও আছে ‘পুজোর সময়ে’। শিউপুরাতে একটা বড়ো বাড়ি ছিল। আগে গেলে তো আমরা পান্ডাদের বানানো পাথরের বাড়িতে থাকতাম, বিন্ধ্যাচল-শিউপুরা, main রাস্তার ওপর। ওই বাড়িটা অত্যন্ত ভালো বাড়ি, অনেকগুলো বেডরুম, লম্বা এবং চওড়া বারান্দা, ভেতরে-বাইরে। বড়ো উঠোন, হাসনুহানা গাছে ভরতি। তার পাশ দিয়ে রেললাইন গেছে। বম্বে মেল ভায়া এলাহাবাদ থেকে আরম্ভ করে প্রচুর গাড়ি ও মালগাড়ি যেত। সারাদিনই প্রায় ট্রেন যেত। বাথরুম ভেতরেই ছিল কিন্তু ল্যাভাটরি ছিল উঠোন পেরিয়ে গিয়ে রেললাইনের পাশে।

একদিন বুলা ল্যাভাটরিতে গেছে। প্যান্টটা খুলে ল্যাভাটরির দরজায় রেখেছে, দরজা আর লক করেনি। তা আমার শালা অভি গিয়ে সেই প্যান্টটা তুলে নিয়ে পালিয়ে এসেছে। আর বেচারা বুলা প্রায় আধঘণ্টা, অভি, অভি, ভালো হচ্ছে না অভি। গুলি করে দেব তোকে। কিন্তু অভি আর দেয় না। আধ ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ভুগিয়ে তার পর ওকে প্যান্টটা দিয়েছিল।

ওখানে তখন প্রচুর শিকার ছিল চতুর্দিকে। তখন ময়ূর মারা বোধ হয় বেআইনি হয়নি। কিন্তু আমার খুব আপত্তি ছিল, সেইজন্য বাবা আমার ওপর একটু বিরক্তই হয়েছিলেন। মাকে বলেছিলেন, তোমার ছেলে তো সবজান্তা হয়েছে। আমি বলেছিলাম, ময়ূর মারিস না। তা বুলা, একটা ময়ূর মেরেছিল। ময়ূর তো চতুর্দিকে ভরতি ছিল। উত্তর প্রদেশের ওই অঞ্চলে ময়ূর আর নীলগাই কাউকে মারতে দেয় না কেউ। মারার পরে অবশ্য সেই ময়ূরের মাংস খাওয়া হল। এর আগেও যখন মারা বেআইনি ছিল না জঙ্গলে, তখনও ময়ূরের মাংস খেয়েছি। অত ভালো মাংস আর কোনো পাখির হয় না। লোকে বলে, World’s best white meat.

পাহাড়ের ওপরে কালিকুয়োর জল, সে একেবারে বিখ্যাত জল। পেটের যেকোনো অসুখ ভালো হয়ে যায়। ড্রাইভার যেত গাড়ি নিয়ে সেখান থেকে জল আনতে। অনেক সময় আমিও তার সঙ্গে যেতাম। রাইফেল নিয়ে। একবার একটা খুব অলৌকিক ঘটনা ওখানে ঘটেছিল। আগে বলেছি, মালভূমির পায়ের কাছে একটা উপত্যকা ছিল। যাতে ছোটো ছোটো ঢিবি ছিল স্কটল্যাণ্ডের মতো। ভরতি নীলগাই, শুয়োর, খরগোশ, সাপ, লেপার্ডও ছিল কিছু।

ওখানে একজন চাষি ছিল, তার সঙ্গে আমার খুবই বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার নাম বাজীরাও। একদিন বাজীরাও বলল, আমার সব বাজরা খেয়ে যাচ্ছে শুয়োরে, কিছু করুন। একদিন আমি আমার রাইফেল নিয়ে দু-ভাই ও অভিকে নিয়ে গেলাম সেই উপত্যকাতে। বিকেল বিকেল বেরিয়ে প্রায় পাঁচ মাইলের রাস্তা পেরিয়ে সন্ধের মুখোমুখি পৌঁছোলাম। একটি টিলার ওপর বাজীরাও-এর একটা কুঁড়েঘর ছিল। আমরা চৌপাই নিয়ে সেই টিলার ওপরে বসলাম, তা ওরকম করে তো শুয়োর মারা যায় না। শুয়োর তো আমাদের আধমাইল দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিল। শুয়োর এলই না, রাতও হয়ে গেল, গেল যখন, তখন আমরা বাজীরাও-এর টিলা থেকে নেমে শিউপুরার পথ ধরলাম। অল্প একটু চাঁদ আছে, উপত্যকাটা পেরিয়ে গিয়ে মালভূমির ওপর উঠেছি। ওই মালভূমির ওপর অনেক সাধু-সন্তদের আশ্রম ছিল। ছোটো ছোটো আশ্রম। সন্ধের পর ধুনি জ্বালিয়ে সেখানে কেউ মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, কেউ ভজন গাইতেন। এবং তাঁরা আমায় বহুদিন ধরেই দেখছেন, দিনের বেলা রাইফেল কাঁধে করে ঘুরে বেড়াতে। আমার চেহারা তাঁদের হয়তো পছন্দ হয়নি, কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলেননি কখনো। মালভূমিতে একটা বড়ো ঝরনা মতো ছিল। তখন অবশ্য শুকনো ছিল। সেখানে আমি প্রায়ই চিতাবাঘের পায়ের দাগ দেখতে পেতাম। চিতাবাঘের পুরীষ। মাঝে মাঝে স্ক্রাব জঙ্গল, সেই জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ টর্চের আলোতে দুটো লাল চোখ দেখতে পেলাম। সাধারণত মাংসাশী জানোয়ারের চোখ রাতের বেলা আলো পড়লে লাল দেখায়। তৃণভোজী জানোয়ারের চোখ সবুজ দেখায়। তখন আমার হাত খুবই ভালো ছিল। রাইফেল শুটিং-এ আমি অল ইণ্ডিয়া কম্পিটিশনে রিপ্রেজেন্ট করেছি পশ্চিমবাংলাকে। NCC করেছিলাম। তা ছাড়া দশ বছর বয়েস থেকে শিকার করছি। আমি গুলি করলাম দু-চোখের মধ্যিখানে। কিন্তু কিছু হল না, চোখ দুটি অদৃশ্য হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডান দিকে বাঁ-দিকে, সবদিকে লাল চোখ দেখা যেতে লাগল। মানে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। আমি তো পাগলের মতো গুলি করে যাচ্ছি। কিন্তু চোখগুলো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে reappear করছে। আমার খুব ভয় ধরে গেল। এরকম ঘটনা জীবনে ঘটেনি। ভৌতিক ঘটনা। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে বাবাকে এসে বললাম। সেই বাড়ির দারোয়ানদের কাছেও বন্দুক থাকত। ভাইদের কাছেও বাবার বন্দুক ছিল। তা এসব নিয়ে পাঁচ-ছয়জন বন্দুকধারী, সকালে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। কিন্তু না পেলাম রক্তের দাগ, না পেলাম কোনো লেপার্ডের পায়ের দাগ। এই ঘটনা ভাবলে আজও অবাক লাগে।

অভি এখনও ঠাট্টা করে বলে, আপনি তো ভারি শিকারি। অতগুলো গুলি করেও কিছু করতে পারলেন না। চতুর্দিকে বাঘের চোখ। সেই জায়গাটা এলাহাবাদ ও বেনারস থেকে একই দূরত্বে। দুটোই পঞ্চাশ মাইল। ওখানে পাহাড়তলিতে বিরহী নামের একটি সুন্দর শান্ত নদী ছিল, যে-নদী মিশেছিল গঙ্গাতে গিয়ে।

ওখানে নানা জায়গায় যেতাম। বুলা, বাবুয়া আর অভি আমার চামচে ছিল তখন। ছেলেমানুষ সবাই। বুলা আমার চেয়ে প্রায় এগারো বছরের ছোটো, বাবুয়া তার চেয়েও ছোটো, অভি বাবুয়ার চেয়েও ছোটো। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে, আরও অনেক কথা। বুলা আজ নেই বলেই, বেশি করে মনে পড়ে।

একবার আমরা বেতলা গেলাম। নীরেনদা—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল, আনন্দ পাবলিশার্সের বাদলবাবু, আমার আর সুনীলের এক common বন্ধু অসীম রায়, প্যারিসে থাকে, ডাকনাম জগু। সে এসেছিল তখন। জগুকেও নিয়ে গিয়েছিলাম। জগু আর রঞ্জিত গুহ বলে একজন। তিনি প্রধান পান্ডা ছিলেন, সুনীলদের ‘বুধসন্ধ্যা’র। রঞ্জিত চ্যাটার্জি বুলার বন্ধু আর বুলা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ থেকে বেতলা গেছিল, গাড়ি চালিয়ে অত মাইল। আমাদের নেমন্তন্ন করতে। বুলা-বাবুয়া ম্যাকলাস্কিতে একটি বাড়ি কিনেছিল আমার বাড়ি আমি বিক্রি করে দেওয়ার পরে।

পরদিন আমরা গেলাম। আমরা অতজন লোক ওদের বাড়িতে থাকব? ওখানে গেস্ট হাউসও ছিল—মিস্টার ক্যামেরনের গেস্ট হাউস। ওখানেই থাকার বন্দোবস্ত করল বুলারা। তার পর দিন দুপুরে ওদের বাড়িতে lunch খেলাম। সে দারুণ। গাছতলায়, দারুণ lunch-এর ব্যবস্থা করেছিল, এবং বুলা বিরিয়ানি রান্না করেছিল নিজে, সেখানে lunch খেয়ে রাঁচিতে এলাম। তার পর প্লেন ধরে কলকাতায় ফিরেছিলাম।

বুলা আমাকে ভেতর থেকে respect করত তো বটেই, কিন্তু বাইরে দেখাত তার চেয়েও বেশি। এটা অনেক বড়ো কথা। যারা দেখত, তারা অবাক হয়ে যেত। আমার বন্ধুবান্ধব গেছে, তাদের জন্য কী করবে বুলা ভেবে পেত না। লক্ষ্মণের মতো ভাই ছিল সে।

বুলার একদল বন্ধু আছে। তারা প্রত্যেকেই আমায় দাদা বলে ডাকে। এবং নিজেদের দাদার মতোই সম্মান দেয়।

দেবদেবীতে ওর খুব ভক্তি ছিল। যদিও বাড়িতে পূজাআর্চা করত না। কিন্তু এই লোকনাথবাবার আশ্রম, এই তিরুপতি গেল।

আমিও তিরুপতি গেছি একবার, আমার স্ত্রী আর মেয়েদের নিয়ে। কিন্তু আমি কোনো মন্দিরে ঢুকি না। মন্দিরের বাইরে চাতালে বসে থাকি। আমার মা অনেক সময় বলতেন, খোকন, জগন্নাথদেবকে স্বপ্ন দেখেছি, নিয়ে চল। দক্ষিণেশ্বর নিয়ে চল। সব জায়গাতেই মাকে নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি চাতালে বসে থাকতাম, মন্দিরে ঢুকতাম না। অরবিন্দ রায়চৌধুরী বুলার খুবই বন্ধু, ও দক্ষিণেশ্বরের একজন ট্রাস্টি। দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরের ভেতরে ঢোকার সব বন্দোবস্ত করে দিত ও।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনাথ দত্তকে লেখা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বর চিত্তদাহর ভিতর দিয়ে তোমার প্রকৃতিকে আধ্যাত্মিক দীপ্তিতে দ্বিগুণ উজ্জ্বল করে প্রকাশ করুন এই আমি প্রার্থনা করি।’ যিনি দুঃখ দেন, তিনিই ভিতর থেকে সার্থকতা দেবেন এ-সম্বন্ধে, আমরা তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না। একটি জায়গা আছে, যেখানে অন্তরঙ্গ আত্মীয়েরও স্পর্শ পৌঁছোয় না। সেখানে একমাত্র অন্তর্যামী আছেন। তুমি তোমার স্বার্থ, কেবল তোমার পরিবারের নও। ঈশ্বর তোমাকে পৃথিবীর জন্য দান করে যাবেন। তিনি তোমাকে আপিসে, হাটে, খাজাঞ্চিখানায়, দূষিত জনতা ও বদ্ধতার মধ্যে ঘুরতে দেবেন না। তোমার প্রকৃতি সেসব জায়গায় শান্তি পাবে না।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্ত্রী রমা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি এটা বিশ্বাস করি যে, মানুষের আয়ুর দ্বারা মানুষের সত্যিকারের জীবন মাপা যায় না। এ-একটা বিরাট বৃত্ত। হাজার হাজার বছর এর পরিধি। তুমি নেই, আমি নেই, আছে তোমার আত্মা, আমার আত্মা, লক্ষ বছর তার স্থিতিকাল, সেই বিরাট vision নিয়ে যে জীবনকে দেখেছে, জীবনকে সত্যিকারের সে চিনেছে।’

আমার জঙ্গলের বন্ধু ওড়িশার কটকের চাঁদুবাবু আমার খুবই বন্ধু এবং বড়োভাইয়েরই মতো। ফুটুদা, যাঁর ভালোনাম ছিল প্রভাতকুমার শূর, কটকে মারা যাওয়ার পর চাঁদুবাবু আমাকে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে একটি উড়িয়া কবিতা উনি লিখে দিয়েছিলেন—

কেহ রহি নাই,রহিব নাই,রহিব না ইটি—এই ভবরঙ্গভূমিতলে সর্বে নিজ নিজ অভিনয় সারি,বাহিরিব কাল বেলে।

মানে ‘কেউ থাকে না, থাকার জন্য আসে না, এখানে থাকবে না। এই রঙ্গনট্টভূমিতে সবাই নিজ নিজ অভিনয় সেরে সময় হলে চলে যাবে।’

সাহিদ লুধিয়ানবীর একটি শায়েরি আছে, ‘মত কিতনি হি সঙ্গদিল হ্যায়, মগর জিন্দেকি সে তো মেহেরবা হোগি।’

মানে ‘মৃত্যু, সে যত নির্দয়ই হোক-না কেন, জীবনের থেকে সে, নিশ্চয়ই দয়ালু।’

অমিতাভদা, মানে আমার প্রিয়কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে—

ধান কাটা শেষ, রিক্ত মাঠে উড়েছিল খড়কুটো,বাঁচার জন্য বছর ছিল একটা কিংবা দুটো।অর্থবিহীন ভালোবাসায় সেসব জড়ো করে দাঁড়িয়েছিলামকপালখাকি বিশাল তেপান্তরে।খরিশ সাপের বিষের সঙ্গে ঘনিয়ে এল বেলা,গলায় আমার দুলিয়ে দিয়ে গুঞ্জাফুলের মালা।কারা বলল, চলো, যাওয়ার আগে যা-বলতে চাও অল্পকথায় বলো।কেমন করে?আমার কোনো কথাই হয়নি শুরু,সময় কোথায়? খেঁকিয়ে ওঠে প্রবীণ মারাংবুরু। কষ বেয়ে তার রক্ত গড়ায়, কপালে রাজটিকা, শীর্ণহাতে বিছিয়ে দিল নিকষ যবনিকা। ঘণ্টা বাজার আগেই শহর এক লহমায় নিলাম বাঁচার জন্য একটা-দুটো বছর চেয়েছিলাম।

বুলাও বাঁচার জন্য একটি বা দুটি বছর চেয়েছিল। ওর একটি মেয়ে হয়েছিল। ওই একটিই ওর সন্তান। এখন সবে কলেজে উঠেছে। বিয়ের সতেরো বছর বাদে সন্তান হয়েছিল। সেই মেয়ের বয়স এখন সতেরো। এবং তার একটি ছেলেকে পছন্দ হয়েছে। সে আর্মির মেজর।

বুলার খুবই ইচ্ছে ছিল, বিয়েটা দিয়ে যেতে। বিয়েটা হয়ে গেলে, ও যেন তার পরে যায়। হায়দরাবাদের ডাক্তারকেও সেই কথা বলেছিল, যে আমি আর ক-দিন বাঁচব? দু-তিন বছর বাঁচব তো? বাঁচলে, মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে যেতাম।

আসলে মানুষ যা চায় তা তো হয় না। Man proposes God disposes! সবই পূর্বনির্ধারিত।

বাবার এক বন্ধু ছিলেন, আগে আমাদের মক্কেল ছিলেন, পরে আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। আর বলতেন, ছিলাম মক্কেল, হয়েছি বিক্কেল। দুর্গা রায়, শিলিগুড়ির। ভালো শিকারি ছিলেন। এই দুর্গাকাকু একটা কথা প্রায়ই বলতেন, Predestined। সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। আমাদের হাতে বিশেষ কিছু নেই।

হায়দরাবাদে বুলা অনেকবার গেছে। আমাদের ব্যাঙ্ক অডিটের কাজেও হায়দরাবাদ যেতে হত। সঙ্গে আমাদের এক পার্টনার মলয় দত্ত, সেও যেত। বুলার স্ত্রী রঞ্জনা তো যেতই। বার তিনেক সবসুদ্ধু গেছিল হায়দরাবাদে।

তার পরেই ওর হঠাৎ ‘অ্যামনেশিয়া’ হল। ওরা গেছিল ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। আমার নিজের কটেজ যখন ছিল, তখন থেকেই ম্যাকলাস্কিগঞ্জ বুলা এবং বাবুয়ারও অত্যন্তই প্রিয় জায়গা। আমার কটেজ অপর্ণা সেনকে বিক্রি করে দেওয়ার পরে, ওরা দু-ভাই মিলে আর একটা বাড়ি কিনেছিল। সেখান থেকে খুব আনন্দ করে ফিরে আসছিল ওরা। ওর সঙ্গে আরও তিনজন বন্ধু ছিল, মলয় দত্তও ছিল। আসানসোল স্টেশনে নেমে, ও আর উঠল না। ইতিমধ্যে গাড়ি ছেড়ে দিল।

ওরা চারজনে দুটি পৃথক কামরায় বসেছিল। মলয় ভেবেছিল, বুলা বোধ হয় অন্য কামরাতে উঠেছে। তার পর গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর যখন বুঝতে পারল যে বুলা ওঠেনি, তখন তো মাথায় বজ্রপাত। মলয় বর্ধমানে নেমে পড়ল। অন্যরা কলকাতা গেল। ECL-এর অডিট করছে তখন আমাদের ফার্ম। Easter coal-fields Limited. সেই ECL-এর অফিসারদের ফোন করল মলয়, আসানসোলে। তাঁরা অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে স্টেশানে এসে পুলিশে রিপোর্ট করে, যা করার সবই করলেন এবং মলয় উলটো দিকের ট্রেন ধরে ফিরে গেল আসানসোলে।

আমি তখন লক্ষ্ণৌতে গেছি। লিটল ম্যাগাজিনের ওপর এক উৎসবের সূত্রে। তা আমার থাকার কথা ছিল তিন দিন। কিন্তু প্লেন থেকে নেমে গাড়িতে উঠতেই আমার মেয়ে মোবাইলে জানাল যে, ‘কাকুমণি’, বুলাকে ওরা ‘কাকুমণি’ বলত সবাই। ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা আমায় বলত ‘জেঠুমণি’, বলল, কাকুমণি হারিয়ে গেছে। শুনে তো আমার মাথায় বজ্রপাত। আমি গেছি চার দিনের জন্য। আমি ওঁদের বললাম, দেখুন আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। তা ওঁরা বললেন, আপনি উদবোধনী অনুষ্ঠানটি করে চলে যান। তার পর আবার এয়ারপোর্টে এসে টিকিট চেঞ্জ করলাম। সারারাত মোবাইলে সবাইকে ফোন করেছি। তখন পুলিশ কমিশনার ছিলেন প্রসূন। প্রসূন আমার ভাইয়ের মতো। গৌতমও তাই, গৌতমমোহন চক্রবর্তী। তার পর প্রসূন, রজত মজুমদার IG-ও ছিল বুলা-বাবুয়ার খুব বন্ধু। তা সবাই মিলে যতরকম কিছু করা যায়, সব করল। তার পরের দিন, ওরা প্রসূনের নির্দেশে ভবানী ভবন-এ গেল, আমার মেয়ে মালিনীও গিয়েছিল, আমার ভাই বাবুয়ার সঙ্গে।

বুলার মোবাইল থেকে Last Call পাওয়া গেছিল পুরুলিয়ার। ভবানী ভবনের ওঁরা বললেন, দেখুন, আমরা তো টিম পাঠাচ্ছি। আপনারাও নিজেরা খোঁজ করুন। বাবুয়া তিনটি গাড়ি নিয়ে এবং বন্ধু ও আত্মীয়দের নিয়ে চলে গেল পুরুলিয়ায়।

এদিকে বুলা আসানসোল স্টেশনে নেমে এপাশ-ওপাশ করেছে। তার পরে বুঝতে পেরেছে, যে-ট্রেনে এসেছে সে-ট্রেন ছেড়ে গেছে। জানি না, কোন ট্রেনে এসেছিল, শতাব্দী হবে হয়তো, রাঁচি থেকে যে-শতাব্দী আসে। তার পর একটা ট্রেনে চড়েছে, ও জানে না কোন ট্রেন, কোথায় যাবে। একরকম ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই, ও গিয়ে পৌঁছেছে হায়দরাবাদ। হায়দরাবাদে পৌঁছেই ট্যাক্সি নিয়ে শহরে ঢুকতেই, যে-হোটেলে গিয়ে ওরা ওঠে অফিসের কাজে এবং চিকিৎসার জন্য, সেই হোটেলকে চিনতে পেরেছে। হোটেলের কাছেই ডাক্তারের চেম্বারও। হোটেলে পৌঁছেই ও স্ত্রীকে ফোন করেছে।

আমিও একদিন পর লক্ষ্ণৌ থেকে ফিরেছি। দমদমে পৌঁছে গাড়িতে উঠেই ফোন করেছি বাবুয়াকে মোবাইলে।

ও বলল, আমরা পুরুলিয়ায়, তবে চিন্তার কিছু নেই। বুলা হায়দরাবাদে পৌঁছে, ওর স্ত্রী রঞ্জনাকে ফোন করেছিল। ওই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবুয়া প্রসূন মুখার্জিকে ফোন করেছে। প্রসূন হায়দরাবাদের পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেছে। করে বলেছে, এই লোককে হোটেল থেকে বেরোতে দেবেন না। সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে রাখুন। তার পর আমার ভাগনে ও আমার ছোটোবোনের ছেলে, সেও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, গুরগাঁওতে আছে, নেসলের সেক্রেটারি, সে এসে আমরা যেহেতু কেউই নেই, আমি লক্ষ্ণৌতে, বাবুয়াও পুরুলিয়ায়, বুলার স্ত্রী রঞ্জনাকে নিয়ে হায়দরাবাদে গেছে। গিয়ে, ওকে সঙ্গে করে ফিরে এসেছে।

তার পরেও বুলা দু-বার হায়দরাবাদে গেছিল চিকিৎসার জন্য। ডাক্তার খুব আশা দিচ্ছেন যে, আপনি ঠিক হয়ে যাবেন। কিন্তু অনেক শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। শৃঙ্খলার মধ্যে প্রধান হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া। প্রোটিন খেতে পারবেন না। সপ্তাহে দু-দিন শুধু একটু ছোটোমাছ খেতে পারেন। আর আজেবাজে ভাজাভুজি একদম খাওয়া চলবে না।

তবুও তারই মধ্যে যখন অফিসে যেত, নীচ থেকে শিঙাড়া আনিয়ে খেত। তো বাবুয়াও যেত অফিসে বিকেলে। ও বেয়ারাদের খুব বকাবকি করত। কেন শিঙাড়া এনে দিলে? ওরা বলত, সাহেব বলেছে, কী করব?

এই করতে করতেই কেবলই জ্বর হতে লাগল। জ্বর হয়, দু-তিন দিন জ্বর থাকে, ভালো হয়। অফিসে যায়। কিন্তু ওর হাঁটাচলা, কথা বলা সবই যেন, বৃদ্ধের মতো হয়ে গেছিল। আস্তে আস্তে কথা বলত। সবসময় যেন হাঁপ ধরত। একদিন আমাকে এসে বলল, সিঁড়িতে পড়ে গেছে। তার পর থেকেই যখনই অফিসে আসত, মোবাইলে ফোন করে দিত। দুজন বেয়ারা গিয়ে ওকে নিয়ে আসত। জ্বর হত, আর পেট আপসেট হত। অথচ কিছুই খায় না। বলত, গলাভাত খায়, সেদ্ধভাত খায়।

জুন মাসে ২৯ জুন আমার জন্মদিন। আমি বলেছিলাম, ওকে আগে যে, Calcutta Club-এর Crystal room-এ কিছু মানুষকে ডেকেছি। ওকেও ফোন করলাম। ফোন বরাবরই করি। কিন্তু আসতে পারে না, কারণ ওদের বিয়ের তারিখ সেদিন।

ও বলল, দাদা আমি তো যেতে পারব না। সেদিনই আবার রঞ্জিতের নাতির মুখেভাত, টালিগঞ্জ ক্লাবে পার্টি হচ্ছে, ওরা হয়তো যাবে। রঞ্জিত মানে রঞ্জিত চ্যাটার্জি। ‘ওরা’ বলতে, বাবুয়ার স্ত্রী সোনাই, আর বুলার মেয়ে মাম্পি, ওর ভালোনাম মধুরা। ওরা দুজনে গেছিল টালিগঞ্জ ক্লাবে। আর বাবুয়া এসেছিল ক্যালকাটা ক্লাব-এ আমার নেমন্তন্নে। সেই সন্ধেতে ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী বাড়িতেই ছিল, কোথাওই যায়নি। জ্বরও ছেড়েছে তার আগের দিন। তা রাত্তিরে নাকি, আমি তো ক্লাব থেকে ফিরেছি রাত বারোটার সময়ে, রাতে ও নাকি ঘুমোতে পারেনি একদম। ছটফট করেছে। বালিশ বুকে নিয়ে বসে থেকেছে। সকালে ছ-টার সময় উঠে বাথরুমে গেছে। টুথব্রাশটা পুরোনো হয়ে গেছে বলে নতুন টুথব্রাশ চেয়ে দাঁত ব্রাশ করেছে। করে, এসে শুয়েছে। তখন ওর স্ত্রী রঞ্জনা ভেবেছে, সারারাত ঘুমোয়নি, এখন ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক। আটটা, সাড়ে আটটার সময় উঠিয়ে চা দেব। সেদিন ওর অফিসে আসার কথা। হয়তো পারত না, খুবই দুর্বল ছিল। কিন্তু রঞ্জনা যখন চা দিতে এসেছে, তার আগেই মেয়ের সন্দেহ হয়েছে ওকে দেখে। মাকে বলেছে, বাবা যখন ঘুমোয় তখন তো নিশ্বাসের শব্দ হয়। কোনো শব্দ নেই, শুয়ে আছে। তখন রঞ্জনা গিয়ে দেখে যে, He was stone dead। অনেকক্ষণ আগে ঘুমের মধ্যেই চলে গেছে। হার্ট অ্যাটাকে। তা ওর এক বন্ধু ডাক্তার নীরূপ মিত্রকে রঞ্জনা টেলিফোন করেছিল ভোর বেলাতেই। তিনি একটা ওষুধের নাম টেলিফোনে বললেন। বললেন, ঘুম ভাঙলে খাইয়ে দিতে। কিন্তু তখনই নার্সিংহোমে গিয়ে ভেন্টিলেশনে রাখলে হয়তো বেঁচে যেত।

যা হয় ঘটনা। আর রঞ্জনাও এতদিনের অসুখে ও সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছিল। আর সিরিয়াসনেসটা তো কেউই বুঝতে পারেনি। যে-লোক বাথরুমে যায় নিজে, দাঁত মাজে নিজে, সে যে আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে চলে যাবে এভাবে, তা কে ভেবেছিল?

আমি অফিসে যাচ্ছি। মোবাইলে অফিসের সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু আমি যখন গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে পৌঁছেছি, তখন অফিসে বাবুয়ার ফোন এল যে, অফিস বন্ধ করে সকলকে বাড়ি যেতে। তখন তো বুঝতেই পেরেছি আমি। গাড়ি ঘুরিয়ে যখন বাবার বাড়ি গিয়ে পৌঁছোলাম তখন তো দেখলাম শুয়ে রয়েছে, যেন ঘুমোচ্ছে। মুখে কোনো বিকৃতি নেই। আর কিছু করার নেই।

এইভাবেই মানুষ আসে, এইভাবেই মানুষ চলে যায়। মুহূর্তের মধ্যে, আমাদের কিছু করার আগেই। যাবে তো সকলেই, তবে এত অল্প বয়েসে! প্রায় ভালো হয়ে আসছিল। হায়দরাবাদের ডাক্তার খুবই আশাবাদী ছিলেন। এবং মৃত্যুর পর তিনি টেলিফোন পেয়ে খুবই অবাক হয়ে গেছিলেন। কী করে এইরকম হল। He was recovering very fast.

কিন্তু যা হওয়ার তাতো হয়েই গেল।

এই ঘটনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *