1 of 2

অনিকেত

অনিকেত

কলিং বেল টেপাতে যতীন ঘরে এল। ঋত্বিক বলল, যতীন পরিতোষবাবুকে জিজ্ঞেস করো তো ধরবাবুর টাইপটা হল কি না। একপাতার একটা চিঠি কতক্ষণ লাগে টাইপ করতে? তিনি ইন্টারকম-এর রিসিভারই বা তুলছেন না কেন?

একটু পরই ধরবাবু ঘরে ঢুকলেন এসে। মুখে উদবেগ, যেমন সবসময়েই থাকে, বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল স্যার।

এ আর নতুন কথা কী? একপাতা টাইপ করতে লাগান আধঘণ্টা তাও কতগুলো ভুল থাকবে কে জানে! বলেই, টাইপড ম্যাটারটা নিয়ে বলল, বসুন।

ম্যাটারটা তার পরই পড়তে পড়তে ভুরু কঁচকে বলল, Media শব্দটা প্লুরাল, Medium সিঙ্গুলার। যেমন DATA আর DATUM আপনি কোন গ্রামার পড়েছিলেন ইংরেজির?

সে কি আর আজকের কথা স্যার! আমি নাইনটিন ফিফটির ম্যাট্রিকুলেট।

তা তো বুঝলাম কিন্তু কার ইংলিশ গ্রামার পড়েছিলেন?

নেসফিল্ড সাহেবের।

অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রিপোজিশান চ্যাপটারটা পড়েছিলেন কি ভালো করে?

খুব ভালো করে পড়েছিলাম স্যার আর সেজন্যেই তো গোলমালে পড়ি। চাড্ডাসাহেব কোন স্কুলে পড়েছিলেন জানি না। উনি বোধ হয় অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রিপোজিশানের চ্যাপটারটা পড়েননি আদৌ। আমি কারেক্ট ইংলিশ লিখলে উনি কেটে দেন।

আপনি তো একটাও ইংরেজি কাগজ পড়েন না—স্টেনোগ্রাফারের কাজ করবেন কী করে?

পড়ে কী লাভ হবে স্যার? আজকালকার একটা কাগজও কি শুদ্ধ ইংরেজি লেখে? তাও ‘THE STATESMAN’ আছে কিছুটা পদের। অন্য কাগজগুলো পড়লে যা কষ্ট করে শিখেছিলাম তাও ভুলে যাব। হ্যাঁ ইংরেজি জানতেন ব্যানার্জিসাহেব। সেইন্ট জেভিয়ার্স-এ পড়াশুনো করেছিলেন, স্কুলে এবং কলেজে। তিনি আমাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতেন।

চাড্ডাসাহেব ‘ডুন’ স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তা কি জানেন আপনি?

জানি স্যার। সে তো রাহুল গান্ধি, রাজীব গান্ধিও ওই স্কুলেই পড়েছিলেন। ওই স্কুল থেকে অনেক ছাগল বেরিয়েছে। দাদু ইংল্যাণ্ডের হ্যারো বা ইটন-এ পড়লেই কি নাতিও আপসে পন্ডিত হয়ে যায়?

আস্তে বলুন। আপনি আমার চাকরিটাই খাবেন দেখছি। জানেন না? রাহুল গান্ধি তাঁর শালার জিগরি দোস্ত। তার পর চিঠিটা কারেক্ট করে দিয়ে ঋত্বিক বলল, বহুবছর হয়ে গেল ধরবাবু, এবারে কিন্তু আপনাকে আর এক্সটেনশান দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া, আপনি তো কম্পিউটারে বসতেই রাজি নন। আপনি ড্রাফট করবেন আর সেটি ঘোষবাবু কম্পিউটারে টাইপ করবেন, এভাবে কি চলে? পৃথিবীটা বদলে গেছে। সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে পারলেন না আপনি।

ধরবাবু চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। তার পর বললেন, ঠিকই বলেছেন। আমিও রিটায়ার করতে চাই কিন্তু খাব কী? ছেলেটা তো বি কম পাস করেই প্রেম করছে। সে কিন্তু কম্পিউটার শিখেছে। সে তার বাপের মতো অশিক্ষিত নয়। তার একটা কিছু করা যায় না স্যার? সে আমার মতো হাবাও নয়। ফটাফট ইংরেজি বলতে পারে। তার প্রেমিকাও তাই। সে একটি কল-সেন্টারে চাকরি করে। আমার দু-গুণ মাইনে পায়। ছেলের একটা গতি হলেই এরা বিয়েটা করতে পারে। বিয়ে করলেই অবশ্য আলাদা হয়ে যাবে।

ঋত্বিক বলল, আমি চাড্ডাসাহেবকে বলেছিলাম একবার। উনি বললেন, আপনার ছেলেকে নিলে ব্যাড প্রিসিডেন্ট হবে। যারাই রিটায়ার করবেন বা করেছেন তাঁরা সকলেই ছেলেকে ঢোকাতে চাইবেন। তবু আরও একবার বলে দেখব। আপনি অনেক দিনের এমপ্লয়ি।

দেখুন আর একবার বলে। যাই স্যার?

আসুন।

ধরবাবু চলে গেলে ঋত্বিক ভাবছিল ওঁর কথা। ও যখন এই কোম্পানিতে ঢোকে আজ থেকে পনেরো বছর আগে তখন ধরবাবু বড়োসাহেবের পি এ। কী দাপট ছিল তখন, কিন্তু সকলের সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করতেন—ওর মতো নবাগন্তুকদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। এ কোম্পানিতে পেনশান নেই। প্রভিডেন্ট ফাণ্ড-এর টাকা হয়তো কবেই খরচ হয়ে গেছে। ছেলেটিকে ভালো স্কুল ও কলেজে পড়িয়েছিলেন অনেক কষ্ট করে। ধরবাবু বলছিলেন, ছেলে নাকি বিয়ের পরেই আলাদা হয়ে যাবে। জামাইটি সেলস ট্যাক্সে কাজ করে। সম্ভবত উপরি আয় আছে কিছু। সে-ই যতটুকু পারে তাঁদের সাহায্য করে। কত মানুষের কত কষ্ট, কত অসুবিধে। ভাবতেও খারাপ লাগে ঋত্বিকের। কিন্তু ক-জনের কষ্টই বা লাঘব করার ক্ষমতা রাখে সে? লাঘব করতে পারে না বলেই সবসময়ে পীড়িত থাকে। মাঝে মাঝেই ভাবে, লটারির টিকিট কাটবে। একটা লেগে গেলে খুবই ভালো হয়। কত টাকা পেলে কাকে কাকে কত টাকা দেবে তার লিস্ট করে মাঝে মাঝেই অবসরে বসে কিন্তু ও জানে যে, ওর কপালে বিনাশ্রমে একপয়সাও রোজগার লেখা নেই। যতটুকু পারে মা ও বোনের জন্যে করে। বাবা তিন বছর আগে গত হওয়ার পর থেকে তার দায়িত্বও বেড়ে গেছে অনেক। বছরে একবার করে মা এবং বোনকে নিয়ে বেড়াতেও যায়। মা বিয়ের কথা বলেন প্রায়ই কিন্তু স্ত্রী এলে তার জীবনের এই ইকুয়েশান যদি বদলে যায়, সেই ভয়ে বিয়ের কথা ও নিজে ভাবে না। তা ছাড়া, বোনের বিয়ে না দিয়ে বিয়ে করাটা সম্ভবও নয়। বোন দীপিকা আজকালকার মেয়েদের মতো চালাকচতুরও নয়। শাড়ি ছাড়া কিছু পরে না। সম্বন্ধ করেই তার বিয়ে দিতে হবে। প্রেম-টেম হবে না ওর মনে হয়। মায়ের হাঁটু নড়বড়ে হয়ে গেছে। আর বেশি দিন হয়তো বেড়াতে যেতেও পারবেন না, হাঁটুর অপারেশন না করিয়ে। তাই মা যতদিন স্বচ্ছন্দে চলতে ফিরতে পারেন ততদিন মায়ের জন্যে যতটুকু পারে করতে চায়। বাবা, মাকে যতখানি সম্ভব আরাম আদরেই রেখেছিলেন। ও তার ব্যত্যয় ঘটাতে চায় না।

ধরবাবু থাকেন উত্তর কলকাতার এক অন্ধগলিতে। গতচল্লিশ বছর ভাড়া আছেন। জরাজীর্ণ বাড়ি। বাইরের দিকে অশ্বত্থর চারা গজিয়েছে। বাড়িওয়ালা থাকেন দোতলাতে। বয়েস তাঁর আশি হয়েছে। এক সলিসিটারের অফিসের টাইপিস্ট ছিলেন। ওই বাড়িটা তাঁর পৈত্রিক বাড়ি। তিনি আর তাঁর স্ত্রী থাকেন। ছেলে-মেয়ে নেই।

ধরবাবু তিরিশ টাকা ভাড়াতে এবাড়িতে ঢুকেছিলেন। এখন বেড়ে বেড়ে ভাড়া সোয়া দু-শো টাকা হয়েছে।

বাড়িওয়ালা সত্য চাটুজ্জ্যের সামান্য কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ও কোম্পানি-কাগজ আছে। বাড়িভাড়া আর ওইসব থেকে যা রোজগার তাতেই কায়ক্লেশে চলে। যেমনভাবে চলে, তাকে চলা বলে না। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই হাঁটুর সমস্যা আছে। বাড়ির বাইরে বড়ো একটা বেরোন না। কখনো-কখনো ছাদে যান। টবে কিছু ফুলের গাছ আছে। যৌবনে চাঁদনি রাতে, ওই ছাদে স্ত্রী চারুমতীকে নিয়ে বসন্তে ও গ্রীষ্মে মাদুর পেতে শুয়ে থাকতেন সারারাত ফুলের গন্ধের মধ্যে। চারুমতী হিমাংশু দত্তর গান গাইতেন। চাঁদ ও চামেলির গান। সেসব বড়ো সুখের দিন ছিল। এখন সেইসব সুখের দিনের কথা ভাবেন।

এক ভাগনে আছে, এল আই সি-তে কাজ করে। সে মাঝে মাঝে আসে খোঁজখবর করতে। কিন্তু সত্যবাবুর মনে হয়, সে খোঁজ করতে আসে কবে সত্যবাবু পটল তুলবেন। তার ধারণা, মামা মরলে, বাড়িটা মামা তাকেই দিয়ে যাবেন। বাড়িটা পেয়ে গেলে সেখানে মাল্টিস্টোরিড বাড়ি বানাবে। একদিন বলে ফেলেছিল যে, ঠিকাদারের সঙ্গে কথাও হয়ে আছে। সাড়ে চার কাঠা জমির ওপর বাড়ি। ভাড়াটে—ধরবাবুকে কিছু টাকা থোক দিয়ে উঠিয়ে দেবে—তিনি কোনো বস্তি-টস্তিতে ঘর দেখে নেবেন।

সত্যবাবু বোঝেন যে, তাঁর ভাগনে আর শকুনের মধ্যে তফাত বিশেষ নেই। মৃতপ্রায় মানুষকে গাছের ডালে বসে শকুন যেমন নজর করে সত্যবাবুকেও তেমনই নজর করে ভাগনে। ভাবেন, তিনি তো মরে বাঁচবেন কিন্তু চারুমতীর কী হবে? তারপর নিজেকেই বলেন, যা হওয়ার তা হবে।

সত্যবাবু ঠিক করেছেন যে, ভাড়াটে ধরবাবুকেই বলে যাবেন চারুমতীর দেখাশোনা করতে। ধরবাবুর ছেলে বিয়ের পরে আলাদা হয়ে গেলে সত্যবাবুর অবর্তমানে চারুমতী ধরবাবুর সঙ্গেই থাকতে পারেন। গতদীর্ঘ চল্লিশ বছরে তাঁদের সম্পর্কটা বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের সম্পর্ক আর নেই। বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গেছে। তা ছাড়া, সত্যবাবু প্রথম দিন থেকেই ধরবাবুর স্ত্রী কুমুদিনীকে বেশ পছন্দ করেন এবং ধরবাবুও করেন চারুমতীকে। এই সম্পর্ক আচারের মতো। ডাল-ভাত খেয়ে খেয়ে যে একঘেয়েমি আসে তা যেমন আচার খেলে কেটে যায় তেমনই আর কী! এই বয়েসে, যখন শরীর ঘুমিয়ে পড়ে, তখন মন বোধ হয় আরও সজাগ হয়। বয়েস হলেও কাম মরে না, যদিও দুজনের বাঘই এখন গুহাবাসী। সত্যবাবুর আবার ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিসের রোগীদের কামভাবও অন্তর্হিত হয়। সে বড়ো দুঃখের সময়। যাঁরা জানেন, তাঁরাই জানেন। দুজনেই টাইপিস্ট ছিলেন বলে দুজনের মধ্যে এক পেশাগত বন্ধুত্বও জন্মেছে। ধরবাবু অবশ্য স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। তাই, মাইনে সত্যবাবুর চেয়ে অনেকই বেশি পেতেন এবং এখনও পান। তা ছাড়া তিনি অফিস থেকে ফেরার সময়ে ডালহাউসি পাড়া থেকে প্রতিদিনই হেঁটে বাড়ি ফেরেন তাই এত বয়েসেও যথেষ্টই ফিট আছেন। হাঁটুর কোনো সমস্যা নেই। জিনস আর টপস পরা তরুণীদের সামনে থেকে তো বটেই, পেছন থেকে দেখেও শরীরে এখনও রিকিঝিকি ওঠে। সে এক দারুণ পরিণতিহীন উত্তেজনা। পাকা ফোড়াতে আঙুল বোলানোর মতো একধরনের সুখানুভূতি।

বাড়ি ফিরে বহুদিনের পুরোনো সাইমা হাতঘড়িটি দেওয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে দিয়ে চান করতে গেলেন উনি। কলঘরটি উঠোনের এককোণে। এ-বাড়িতে অ্যাটাচড বাথরুম নেই। নিমসাবান দিয়ে চান করে হাতকাটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ওপরে গেলেন।

আজ শনিবার। জামাই নগেন পাঁঠার মাংস পাঠিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের বাঙালি পাঁঠার দোকান থেকে কিনে। কুমুদিনী মাংস রান্না করছেন। মাংসের গরমমশলার গন্ধে পুরো একতলা মম করছে। প্রায় এককেজি মাংস। ধরবাবুর দাঁতও ঠিক আছে। মাংস খেতে অসুবিধে হয় না। কুমুদিনী বলেছেন, কিছুটা সত্যদা আর চারুমতী বউদির জন্যে পাঠিয়ে দেবেন।

মাংস রান্নার গন্ধ নাকে যেতেই তাঁর সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ল। তাঁদের অফিসেই নতুন ঢুকেছে। জিনস এর প্যান্ট-এর ঊরুমুখে একটা ভাঁজ আছে। ঊরুসন্ধি তাতে প্রকট হয়। মাংসের গন্ধর সঙ্গে সেই মেয়েটির কথা মনে হতেই শরীরে রিকিঝিকি উঠল।

ধরবাবু কুমুদিনীকে বললেন, আমি ওপরে যাচ্ছি। তুমিই কি নিয়ে আসবে? না, আমি নেমে আসব?

তুমি যাও, আমিই নিয়ে যাব। ওঁদের বোলো মাংসের কথা। মাংস রান্নার গন্ধ দোতলাতেও পৌঁছেছে নিশ্চয়ই তবে ওঁদের জন্যে যে পাঠানো হবে সেকথা তো ওঁরা জানেন না।

ঠিক আছে। আমি গিয়ে বলছি।

তার পর বললেন, পুনুর জন্যে মেটে রেখো। ও মেটে খেতে ভালোবাসে।

পুনুর আজ পার্টি আছে ন্যাপাদের বাড়ি। আজ ন্যাপার জন্মদিন।

নেমন্তন্ন?

হ্যাঁ। আজকাল নেমন্তন্নকেই ‘পার্টি’ বলে।

ও।

দোতলাতে উঠে দেখলেন চারুমতী শোয়ার ঘরে। আয়নার সামনে টুলে বসে চুল আঁচড়াচ্ছেন গা ধুয়ে উঠে।

বউদি কোথায়?

চারুমতীকে দেখেও, না দেখার ভান করে ধরবাবু বললেন।

বসুন ঠাকুরপো। আমি আসছি।

সতুদা কোথায়?

ছাদে। আপনি ছাদেই যান-না। আমি আসছি এখুনি।

বেশ।

তার পর বললেন, কুমুদিনী একটু পরে পাঁঠার মাংস নিয়ে আসবে আপনাদের দুজনের জন্যে।

মাংস রান্নার গন্ধ তো গা ধুতে ধুতেই পেয়েছি। কিন্তু আমাদের পাঠানো কেন?

জামাই মাংস কিনে পাঠিয়েছে। আপনারা কত কিছু পাঠান। আমরা আর কীই-বা দিতে পারি।

পাঁঠার মাংস ছাড়াও তো অনেক কিছুই দেন ঠাকুরপো, বিশেষ করে আপনি। তার দাম কি কিছু নেই? বিশেষ করে আমার কাছে?

আমি জানি যে সেসবের দাম আপনি বোঝেন। কুমুদিনীও অনেক কিছু দেয় আপনার সতুদাকে। সেও সেসবের দাম বোঝে। সেসবের তুলনায় পাঁঠার মাংসর কোনো দামই নেই। সেসবই তো অমূল্য।

তা ঠিক।

তার পর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আমি চললাম ওপরে। একটা টিপ পরে আসবেন কিন্তু।

বুড়ি হয়ে গেছি এখন আর সাজগোজ কি মানায়?

যদি তা দেখার লোক থাকে এবং তার দেখার চোখ থাকে তাহলে অবশ্যই মানায়।

আপনি সব সময়েই টিপ পরতে বলেন কেন?

আপনার অমন সুন্দর ফর্সা চওড়া কপাল—টিপ না পরলে খালি খালি লাগে।

চওড়া কপালই বটে। না হলে কি আর ৩২/৪/৯ গুলু খানসামা লেন-এ জীবন কাটে।

আজকে একটা গান শুনব আপনার। রবিবাবুর গান।

আমি তো রবিবাবুর গান কমই জানি।

ওই যে, সেই গানটা।

কোন গান? ওই যে, ‘মানে না মানা, আঁখি ফিরাইলে বলে, না, না, না’।

ঠিক আছে। ওপরে যাই আগে।

ছাদে উঠে ধরবাবু দেখলেন ধুতি আর ফতুয়া পরে সতুদা মাদুরে শুয়ে আছেন। কানের কাছে একটা ট্রানজিস্টর। গান শুনছেন।

কী দাদা? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

হাড় মটমটিয়ে উঠে বসে সতুবাবু বললেন, ও, ধনু? এসো এসো। আজকাল তো আসোই না। কী করে যে দিনরাত কেটে যায়। তার ওপরে টিভি। কিছুই দেখার থাকে না অথচ বাধা অনেক। সামনে বসলে আর নড়া যায় না। আমি অবশ্য ইংরেজি চ্যানেলগুলোই দেখতে চাই কিন্তু তোমার প্রিয় বান্ধবীর তো অখাদ্য বাংলা সিরিয়াল ছাড়া কিছুই রোচে না।

তা আর কী করা যাবে? ভিন্ন রুচি লোকা:।

আপনার জন্যে পাঁঠার মাংস রান্না করে নিয়ে আসছে সে গা ধুয়ে।

পাঁঠার মাংস কেন, কোনো মাংসই যে খেতে পারি না আজকাল। পাঁঠার মাংসের চেয়েও ভালো মাংসও তো অনেক আছে।

দাদার রস একটুও কমেনি।

থাকার মতো আর তো কিছুই নেই। একটু রসও যদি না থাকে তাহলে বেঁচে লাভ কী? তা ছাড়া, বাঁচার সময়ও তো শেষ হয়ে এল। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দময় এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার তো সময় হয়ে গেছে অনেকদিন। টিকিটও কাটা। রিজার্ভেশনই এখনও হয়নি। এইযা।

এমন সময়ে বিডন স্ট্রিট দিয়ে একটা মৃতদেহ নিয়ে গেল কারা যেন, ‘বল্লহরি, হরি বোল’ করতে করতে। এরা দুজনেই উৎকর্ণ হয়ে শুনলেন। আগে মধ্যরাতে এই উল্লসিত চিৎকারে বুক ছ্যাঁৎ করে উঠত। চমকে বিছানাতে উঠে বসে দু-হাত জড়ো করে অদেখা অচেনা মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেন। আজকাল অধিকাংশ মৃতদেহই, বিশেষ করে অবস্থাপন্নদের, কাচের গাড়ি করে যায়। গেল যে, তা বোঝা পর্যন্ত যায় না। তবে অনেক মৃতদেহ, বিশেষ করে উত্তর কলকাতাতে এখনও কাঁধে করেও নিয়ে যায়, কেউ কেউ টেম্পো বা ছোটো লরিতেও নিয়ে যায়।

সতুবাবু প্রণাম করলেন। ধরবাবু প্রণাম করলেন না। সেটা লক্ষ করে সতুবাবু বললেন, ধনু ভায়া, তুমি কি মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নও?

ধরবাবুর ভালো নাম ধনুর্ধর। কানাছেলের নাম পদ্মলোচন হয়। ধনুহীন অবস্থাতেই জীবন কাটালেন, কারোকেই তির মেরে ধরাশায়ী করতে পারলেন না অথচ ওইরকম হাস্যকর নামের বোঝা বয়ে জীবন শেষ করে আনলেন। ধরবাবু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, সতুবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বললেন,

Every death diminishes me.

For whom the bell tolls

the bell tolls for thee

আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কী একটা উপন্যাসের মুখবন্ধে আছে। নামটাই ভুলে গেছেন। এখন প্রায়ই এরকম হয়।

সতুবাবু চুপ করে রইলেন। কিছু বললেন না।

ছাদে টবে হাসনুহানা, জুঁইলতা, বনসাই চাঁপা ইত্যাদি গাছ করেছেন কুমুদিনী। ওঁরই বেশি শখ ফুলের। বাসন্তী হাওয়ায় গন্ধ উড়ছে।

ধরবাবু বললেন, সতুদা, আপনার তো ডেঞ্চার আছে। মাংস খেতে অসুবিধা কীসের?

আরে ডেঞ্চারে মাড়িতে ব্যথা করে শক্ত কিছু খেতে। তাই খাই না। শরীর এখন বাইরের কিছুকে গ্রহণ করে না। এমনকী হাতঘড়ি পর্যন্ত পরতে ইচ্ছে করে না। কালেভদ্রে কোথাও গেলে একটা রুপোর ট্যাঁকঘড়ি আছে, সেটাই ব্যবহার করি। বাবা ব্যবহার করতেন। এখন বেঁচে আছি বটে—কিন্তু তা শুধুই প্রশ্বাস নেওয়া আর নিশ্বাস ফেলা। একে বাঁচা বলে না। ওই যে মৃতদেহটি চলে গেল বিডন স্ট্রিট দিয়ে তার সঙ্গে আমার তফাত বিশেষ নেই। বাড়ি আছে কিন্তু তাতে বাস করি না।

চারুমতী উঠে এলেন একটি ট্রেতে দু-গ্লাস আমপোড়া শরবত নিয়ে। গা ধুয়ে একটি বাড়িতে কাচা তাঁতের শাড়ি পরেছেন। পয়লা বৈশাখের জন্যে ননদ, ছেলের হাতে অগ্রিম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। দু-তিন দিন পরা হয়ে গেছে।

শরবতটা নিতে নিতে চান করে ওঠা চারুমতীর গায়ের গন্ধে এবং গলার ও বুকের পাউডারের গন্ধে আমোদিত হলেন ধরবাবু। বললেন, আপনারটা কই?

আমি খেয়ে এসেছি।

একটু পরে কুমুদিনী আসবে মাংস নিয়ে।

তাই?—আমিষ আজকাল ভালো লাগে না।

চুমু খেতেও?

চুমু আর খাচ্ছে কে?

অনুমতি দিলে খাবার লোকের অভাব আছে?

চুমু কি অনুমতি নিয়ে খায়? চুমু জোর করেই খেতে হয়। সেই জোরটুকুই চুমুর সব।

ধরবাবু বললেন, সতুদা, তুমি কি বউদিকে চুমু খাবার সময়েও ডেঞ্চার পরেই খাও?

সতুবাবু হেসে বললেন, কতদিন এসব পাট চুকিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়া, ডেঞ্চার তো একটি কাচের বাটিতে জলে ডোবানোই থাকে। বাইরে গেলে পরি নইলে কথা বলার সময়ে থুথু ছিটকোয়।

ধরবাবু শরবত-এ চুমুক দিয়ে বললেন, দারুণ হয়েছে। আপনার হাতের গুণই আলাদা।

আপনি যার ভালো দেখেন তার সবই ভালো দেখেন।

তা দেখি।

তার পর বললেন, একটা গান শোনানইনা বউদি।

আজকাল আমাদের গান তো তামাদি হয়ে গেছে। এখন শুধু ব্যাণ্ডের গান।

না, না, আমাদের ওইসব পুরোনো গানই ভালো লাগে। গান একটা রবিবাবুর গান।

চারুমতী ধরে দিলেন, ‘ও-গান আর গাসনে, গাসনে। যে-দিন গিয়েছে চলে সে আর ফিরিবে না, তবে ও-গান গাসনে…’

গান শেষ হতেই কুমুদিনী ছাদে উঠে এলেন। বললেন, তোমার দরজা ‘হাঁ’ করে খোলা দিদি।

চারুমতী বললেন, তবুও কেউ ঢোকে না, সে-দরজা দিয়ে। এখন ঘরদোর সবই আছে কিন্তু বাড়ি নেই কুমু।

ওরা সকলেই সেই কথাতে চুপ করে রইলেন। পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ির কার্নিশে কবুতরেরা অস্ফুটে বকম বকম করছিল। কবুতর সোহাগে সম্ভাষণ করছিল কবুতরিকে।

ধরবাবু ভাবছিলেন, এজন্ম তো প্রায় শেষই করে এনেছেন। পরের জন্মে কবুতর-কবুতরি হয়ে জন্মাবেন, যদি পরজন্ম থাকে। জীবনের এই শেষ অঙ্কে পৌঁছে নানা প্রশ্নই মনে জাগে। এর পরের বাড়ি সম্বন্ধে কোনো ধারণা তো নেই। পাড়া সম্বন্ধেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *