1 of 2

আবিষ্কার

আবিষ্কার

আর কতক্ষণ দাঁড়াব, বাবা? ছোট্ট মিনু বিরক্তিমাখা মুখে বলল। রণেন বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও, আর একটু দাঁড়াও, ট্রেনটা এসে যাবে।

সুমিতা ফোড়ন কেটে রণেনকে চটাবার জন্যে বলল, আর এসেছে!

ওরা বাতাসিয়া লুপের ওপর দাঁড়িয়েছিল। ‘ঘুম’ স্টেশন থেকে ট্রেনটা অনেকক্ষণ ছেড়েছে। ট্রেনটাকে রওনা হতে দেখেই ওরা ট্যাক্সি করে এসে এখানে নেমে গেছিল। রণেন ঝুলিটা কাঁধে তুলে নিয়ে স্ত্রী ও মেয়ের হাত ধরে উঁচু টিলায় উঠেছিল।

এই বাতাসিয়া লুপ।

মিনু নীচের উজ্জ্বল অথচ মেঘাচ্ছন্ন উপত্যকার দিকে চেয়ে বলল, ওইখানে নীল ওটা কী বাবা? রণেন অন্যমনস্ক গলায় বলল, বর্ধমানের মহারাজার বাড়ির চুড়ো। তার পাশেই তো আমাদের বাড়ি। দেখতে পাচ্ছ না?

মিনু আবার বলল, চুড়োটা নীল করেছে কেন বাবা?

রণেন ভালো করে শুনলও না মিনু কী বলল—ও যেন কীসের ঘোরে ছিল।

মাথা নেড়ে অন্যমনে বলল, এমনিই।

মিনু রেললাইনের আরও বাইরের দিকে গিয়ে নীচে তাকিয়ে রইল।

সুমিতা থার্মোফ্লাস্কের গ্লাসটা দু-হাতে ধরে আরাম করে শেষচুমুক দিচ্ছিল চায়ে। রণেনের পাশেই ছোটো শতরঞ্চির ওপর ও বসেছিল। এই শেষবিকেলে রণেনের খুব ভালো লাগছিল। শেষমুহূর্তে রণেন সুখের শীর্ষে অধিষ্ঠান করছিল।

পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেরা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছিল। রোদটা মাঝে মাঝে একমুহূর্তের জন্যে বাইরে এসে আবার একলাফে আড়ালে চলে গিয়ে ‘কুমির কুমির’ খেলছিল মেঘগুলোরসঙ্গে। রণেন এইমুহূর্তে যেন মিনুর চেয়েও ছোটো হয়ে গেছিল। ঘাসের ওপর ফুটে থাকা ছোটো ছোটো ব্যাঙের ছাতার মতো রঙিন ফুলগুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে মোহাবিষ্টের মতো রণেন অনেক কথা ভাবছিল।

ও কি কখনোও ভেবেছিল যে ও এমনভাবে কোনোদিন ছুটি কাটাবে? এত সুখে?

একটা সময় ছিল যখন দু-বেলা পেট ভরে খেতে পাবে যে এমন কথাও জোর করে ভাবতে পারেনি।

রাত জেগে পড়াশুনো করেছে। দুপুরে ইউনিভার্সিটি এবং সকাল-বিকেল টিউশনি। আর কিছু রণেন তখন ভাবতে পারেনি; ভাবতে চায়নি। শুধু একটা ভদ্রগোছের চাকরি চেয়েছিল—যাতে অন্য দশজন মধ্যবিত্তর মতো ভদ্রভাবে ডাল-ভাত খেয়ে চলে যায়।

তার পর আশাতীতভাবে অনেক কিছু এসেছে রণেনের জীবনে। একে একে এসেছে। সরকারি চাকরিতে এক্কা-দোক্কা খেলার মতো এক-এক পা করে অনেক উঁচুতে উঠে এসেছে ও ক-বছরের মধ্যে। কী করে যে এমন হল তা ও নিজেও জানে না। এমনি করে—এমনকী বিয়েও করে ফেলেছে একদিন। একটি ছিপছিপে সুন্দরী মেয়ে তার সমস্ত শরীর ও মিঠুয়া মন নিয়ে সম্পূর্ণভাবে তার একার হয়ে গেছে। কলকাতার দক্ষিণাঞ্চলেভালো ফ্ল্যাট নিয়েছে রণেন—যদিও ছোট্ট। মেয়েকে ভালো স্কুলে ভরতি করেছে। সব মিলিয়ে রণেন খুব সুখে আছে। তার সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও সে সুমিতাকে সুখে রেখেছে। সুমিতার জন্যে রান্নার লোক রেখে দিয়েছে। একটা ছোকরা চাকর আছে। রবীন্দ্রসংগীতের স্কুলে ভরতি করিয়ে দিয়েছে সুমিতাকে। যদিও সুমিতার গলার স্বরটা পাতিহাঁসের মতো ফ্যাঁসফেসে—তবু সুমিতা যখন ওর নতুন শেখা গানগুলি রণেনকে কাঁপা-কাঁপা গলায় শোনায় তখন রণেনের বেশ লাগে।

সব মিলিয়ে এইমুহূর্তে রণেনের ভীষণ ভালো লাগছে।

প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কখনো কখনো এমন ভীষণ ভীষণ ভালো-লাগা হঠাৎ এসে ভীরু বৃষ্টির মতো মনের জানলায় করাঘাত করে—সেইসব মুহূর্তে সে যে কোনোদিনও অসুখী ছিল, কোনোদিন অসুখী হতে পারে—এসব ভয়ের ভাবনা একবারও মনে আসে না।

ঠাণ্ডা হাওয়া এসে মাঝে মাঝে ওর চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। বাতাসিয়া লুপে দূরাগত ছোট্ট রেলগাড়ির অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ রণেন আধশোয়া ভঙ্গিতে বসে সুমিতার দিকে চেয়ে ভালোলাগায় একটি বেগুনি প্রজাপতির মতো কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

সুমিতা বলল, কী দেখছ আমার দিকে? অসভ্যর মতো?

কেন? অসভ্যর মতো কেন?

ওরকম করে তাকাচ্ছ কেন? আমাকে কি আগে দেখোনি?

দেখব না কেন? এমন করে হয়তো দেখিনি।

কেমন করে?

অত জানি না।

এমন সময় পুপ-পুপ-পুপ-পুপ করে রেলগাড়ির আসার আওয়াজ শোনা গেল।

মিনু দৌড়ে এল লাইন পেরিয়ে, চেঁচিয়ে বলল, মা! বাবা, ওই যে আসছে।

ওরা তিনজনেই উঠে দাঁড়াল। রণেন ঝোলানো ব্যাগে থার্মোফ্লাস্ক এবং শতরঞ্চিটা পুরে ফেলল।

এমন সময়ে ট্রেনটা লুপের প্রান্তে দেখা দিল।

পুপ-পুপ-পুপ-পুপ করে ঘুরে ঘুরে খয়েরি ট্রেনটা ধোঁয়ার নিশ্বাস ফোঁস ফোঁস করতে করতে একটা মেটে গোখরো সাপের মতো এঁকে বেঁকে লুপের এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে এল। তার পর দম নিতে নিতে নীচ দিয়ে আবার ঘুরে গেল।

মিনু চটা-চট করে দু-তিনবার হাততালি দিয়ে ফেলল।

দেখতে দেখতে ট্রেনটা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পাক খেয়ে নীচে নেমে আবার দার্জিলিং-এর দিকে মুখ করে মোটরগাড়ির রাস্তার পাশ পাশে চলতে লাগল।

ওরা তিনজনে একদৃষ্টে চেয়ে রইল অপস্রিয়মাণ রেলগাড়িটার দিকে।

গাড়িটা যখন আর দেখা গেল না তখন রণেন একটা সিগারেট ধরাল, বলল, চলো, এবার ফেরা যাক।

সুমিতা শাড়িটা হাত দিয়ে সমান করতে করতে বলল, চলুন স্যার আমি রেডি।

রণেন বলল, ঢং হচ্ছে!

মিনু কাছে এসে বলল, কী হয়েছে বাবা?

রণেন হাসল, বলল, দেখো না, তোমার মায়ের বেশি বেশি আনন্দ হয়েছে।

সুমিতাও হাসল, বলল, বেশ। হয়েছে তো হয়েছে।

এই সুন্দর বিকেলে স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে এমন সুন্দর জায়গায় বেড়াতে এসে ওর যে আনন্দ হয়েছে, একথা সুমিতা গোপন করল না। গোপন করার প্রয়োজনও বোধ করল না।

তার পর ধীরে ধীরে ওরা তিনজন বাতাসিয়া লুপ থেকে নেমে এসে কার্ট রোডে পৌঁছোল। রাস্তায় পৌঁছোতে দেখল দূর থেকে একটি ট্যাক্সি আসছে। ‘ঘুম’ থেকে আসছে—দার্জিলিং যাবে। অন্য সওয়ারিও ছিল দু-একজন—ভাগের ট্যাক্সি।

রণেন বলল, ধরব নাকি ট্যাক্সিটা? না হেঁটেই যাবে?

সুমিতা প্রথমে কোনো কথা বলল না। তার পর বলল, জানি না। যা ভালো বোঝো।

ওরা এইসব বলাবলি করতে করতে ট্যাক্সিটা ওদের পেছনে ফেলে চলে গেল ফুল স্পিডে।

কিছুক্ষণ অপস্রিয়মাণ ট্যাক্সিটার দিকে চেয়ে থেকে ওরা কার্ট রোড ধরে হাঁটতে লাগল।

আকাশটা বেশ অন্ধকার হয়ে আসছে। ইদানীং প্রায়ই সন্ধের দিকে বৃষ্টি হচ্ছে।

কিন্তু বড়ো বড়ো পা ফেলে ফেলে এমন ছবির মতো নির্জন রাস্তায় হাঁটতে ভারি ভালো লাগে রণেনের। সেই ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। কেষ্টনগরে ঘূর্ণি থেকে যখন কলেজে আসত। বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটত। হাওয়াটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল কাঁপিয়ে নিমগাছের ফুল ঝরিয়ে, একরাশ লালচে ধুলো উড়িয়ে আগে আগে দৌড়ে যেত। বাতাসে আম কাঁঠালের গন্ধ ম ম করত—গির্জার পেটাঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজত—পিকু মল্লিকাদের বাড়ির ঝাঁকড়া কাঠটগরের ডাল থেকে অসময়ে, রসিক কোকিল বুকের মধ্যে উহুউহু ভাব জাগিয়ে কুহু কুহু করে ডেকে উঠত। আহা! সেই সবদিন। এইরকম একলা পথে হাঁটলেই রণেনের সেইসব পুরোনো—খোলামেলা বাধাবন্ধনহীন দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ওদের চরম দারিদ্র্য সেইসব দিনগুলোরভরন্ত ভালোলাগাকে একটুও বিকৃত করতে পারত না।

রণেন আকাশের দিকে একবার তাকাল। হয়তো বৃষ্টি আসবে। এলেই বা? সঙ্গে দুটি ছাতা আছে। একটি প্রমাণ মাপের অন্যটি মিনুর। বৃষ্টি যদি আসেই—তাহলে সুমিতা আর ও—দুজনে বড়ো ছাতাটার আড়ালে হাঁটবে—ছোটো ছাতাটা মিনুকে খুলে দেবে।

একটা বাঁক নিতেই উলটোদিক থেকে একটি ল্যাণ্ডরোভার গাড়ি আসতে দেখা গেল। গাড়িটা কাছে আসতেই সুমিতা চেঁচিয়ে বলল, অ্যাই দেখো, দেখো, চলে গেল। দেখছ?

রণেন অবাক হয়ে বলল, কী?

ইশ! দেবানন্দ! চলে গেল।

তুমি দেখলে?

হ্যাঁ একটা কমলা-রঙা জামা পরা—মাথায় স্ট্র হ্যাট—শুটিং করে ফিরল, কি কোথাও যাচ্ছে বোধ হয়।

রণেন কিছু বলল, না, হয়তো সত্যিই দেখে থাকবে সুমিতা, কারণ কাল ম্যালে শুনেছিল যে দেবানন্দ, ওয়াহিদা রেহমান সব মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলে উঠেছেন। কী একটা বইয়ের শুটিং হচ্ছে নাকি এখন বিজন-বাড়িতে।

রণেন কিছু বলল না দেখে সুমিতা বলল, কী? কিছু বলছ না যে?

রণেন হাসিমুখে বলল, কী বলব?

সুমিতা বলল, খুব ডাঁট হয়েছে না? দেবানন্দ, হয়তো তোমাকে দেখে ভাবল, এ আবার কোন হিরো?

রণেন আবার হাসল। বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে!

সুমিতা হাঁটতে হাঁটতে ওর গায়ের সঙ্গে লেগে গেল—বলল, ইয়ার্কি কেন? তুমি কি খারাপ দেখতে—তুমি তো হ্যাণ্ডসাম—তুমি টপ দেখতে—

রণেন মোটা কোট পরে থাকা সত্ত্বেও—সুমিতার কার্ডিগান পরা নরম লতানো শরীরের ছোঁওয়া ওর শরীরে বিদ্যুৎ খেলিয়ে দিল। রণেন ফিস ফিস করে চোখ নাচিয়ে বলল, খুউব? চলো আজ বাড়িতে। তোমাকে কী করি।

সুমিতা কল কল করে হাসতে হাসতে সরে গিয়ে বলল, ভালো হবে না বলছি! জংলি।

তার পর দুজনেই লজ্জা পেয়ে সামনে তাকাল—দেখল—না—মিনু ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপই করছে না—নিজের মনে স্কুলে নতুন শেখা ইংরিজি গান গাইতে গাইতে হাত দুলিয়ে অনেক আগে আগে চলেছে।

মিনু ওদের কথা বা সান্নিধ্য শোনেনি বা দেখেনি।

সুমিতা চেঁচিয়ে বলল, মিনু বাঁ-দিক ঘেঁষে চলো—গাড়ি আসছে।

বলতে বলতেই আর একটা ফাঁকা ট্যাক্সি হুস করে চলে গেল ওদের পাশ কাটিয়ে হাওয়ার দোলা লাগিয়ে দার্জিলিং-এর দিকে।

রণেন বলল, কী হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে নাকি? পথ তো কম নয়।

সুমিতা বলল, আমার জন্যে কী? মিনুটা সকালে অনেক হেঁটেছে—পাশের বাড়ির অশোকাদির মেয়েদের সঙ্গে ম্যালে গেছিল—ওরই কষ্ট হবে। আমার কোনো কষ্টই হয় না তুমি পাশে থাকলে।

রণেন আরেকটা সিগারেট ধরাল, বলল, বাবা, এত ভালোবাসা?

সুমিতা বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।

তার পর আরও অনেকখানি পথ চুপচাপ হাঁটল ওরা তিনজনে।

জীবনে ও যে সুখী হয়েছে, সুখী আছে একথা ভাবতে ভাবতে মনে মনে, হাসতে হাসতে রণেন সুমিতার গা ঘেঁষে পথ চলছিল, এমন সময়ে সুমিতা বলল, আমার গায়ে পড়ল একফোঁটা।

চমকে উঠে রণেন বলল, কী?

বৃষ্টি।

মিনু চেঁচিয়ে উঠল—‘যা বৃষ্টি ধরে যা লেবুপাতায় করমচা’—

সুমিতা ধমকে উঠল—কী হচ্ছে মিনু রাস্তার মধ্যে?

তার পর নিজের মনে নীচু গলায় বলল, পথ তো কম বাকি নেই। এখন বৃষ্টি নামলে কী হবে? সুমিতার গলাটা একটু বিরক্ত শোনাল।

রণেন অত গা করল না, আকাশের দিকে একবার তাকাল। বলল, হলে হবে। ভয়ের কী? মজাই তো হবে।

সুমিতা উত্তর দিল না কথার।

এবার বেশ জোরে জোরে নানারকম অর্কিড এবং কুয়াশার গন্ধমাখা কনকনে হাওয়া বইতে শুরু করল। বাতাসিয়ার হাওয়াটা ওদের পেছন থেকে ধাক্কা দিতে লাগল।

রণেন বলল, জানো সুমিতা, পাহাড়ি পথে চলার একটা নিয়ম আছে, আমাদের অফিসে এক বুড়ো পাহাড়ি দারোয়ান আছে, সে শিখিয়েছে।

সুমিতা কোনো উত্তর দিল না!

রণেন তবুও বলল, শুনবে? চড়হাই মে বুড্ডা, উতরাইমে জোয়ান।

এমন সময়ে এমন একটা দমকা হাওয়া এল যে, সুমিতার হাত থেকে মিনুর ছাতাটা হাত ফসকে উড়ে গিয়ে পড়ল।

শব্দ শুনে মিনু পেছন ফিরে ছাতাটা কুড়োতে যাবে এমন সময়ে একটা ট্রাক প্রায় মিনুর গা ঘেঁষে চলে গেল।

রণেন আর সুমিতা দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মিনু’!

অনেকক্ষণ পর সুমিতা কথা বলল। বলল, ঢং না করে মেয়েটার হাত ধরে চললেই তো হয়।

রণেনের মনেও এই কথাটা জেগেছিল, কিন্তু ঠিক ওইভাবে সুমিতা কথা না বললেও পারত।

রণেন কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে মিনুর হাত ধরল। এতক্ষণের খুশির মচমচে উষ্ণতাটা হঠাৎ কেমন ভিজে কুয়াশার মতো স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেল।

ওরা ভাগ্যকুল হাউসের কাছে পৌঁছেছে ততক্ষণে; কিন্তু ততক্ষণে অন্ধকারও হয়ে গেছে। পথের বাঁ-দিকের খাদের ওপরের আকাশে হালকা ছাই-রঙা আলোটুকু পুরোপুরি মুছে যাবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সঙ্গে সঙ্গে দমকে দমকে দামাল হাওয়া। পথের বাতিগুলো ঠিক সেই মুহূর্তেই নিভে গেল।

মিনু ‘বাবা’, ‘বাবা’, বলে হঠাৎ অন্ধকারে ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

রণেন তাড়াতাড়ি সুমিতার হাত থেকে মিনুর ছাতাটা নিয়ে সেটা খুলে মিনুর হাতে দিয়ে বলল, দু-হাতে ধরে থাকো মিনু, বুকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকো।

পেছন থেকে সুমিতা অত্যন্ত বিরক্তিমাখা গলায় বলল—আমি তো ভিজে গেলাম!

রণেন, এই যে, এই যে, বলে তাড়াতাড়ি বড়ো ছাতাটা খুলে সুমিতাকে দিল।

মনে মনে বলল, বেচারি।

তার পর দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে মিনুর ওভারকোটের কলারটা বাঁ-হাতে চেপে ধরল—যাতে অন্ধকারে ও পড়ে না যায়—বাঁ-দিকের নীচু দেওয়ালে হোঁচট খেয়ে হঠাৎ পড়ে গেলে—নীচের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে মিনু—। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এই মিনুকে।

লোকে কুকুরের কলার ধরে যেমন করে কুকুরকে বেড়াতে নিয়ে যায় মিনুকে তেমনি করে ধরে রণেন বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটতে লাগল।

সামনের কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না—মাঝে মাঝে পথের পাশের বাড়ির বন্ধ কাচের জানালা থেকে যতটুকু আলো বৃষ্টির ঝালর বেয়ে পথে এসে পড়েছে তাতেই পথ চলতে হচ্ছে। যত জোরে পারে রণেন পা চালাল মিনুকে নিয়ে। একবার মিনু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার মতো হল। একবার ওর ছাতাটা হাওয়ায় উলটে গেল।

সুমিতা ছাতা মাথায় পেছন পেছন আসছিল—মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ গলায় রাতের পাখির মতো কী যেন বলতে বলতে।

এই ব্যাপারটার জন্যে রণেন মনে মনে একেবারে অপ্রস্তুত ছিল। হঠাৎ এমন বিশ্রী বৃষ্টির জন্যে এবং এই হঠাৎ বৃষ্টির মতো সুমিতার হঠাৎ রূঢ় ব্যবহারের জন্যে।

সুমিতা একবারও রণেনকে ডাকল না তার ছাতার নীচে এসে মাথা বাঁচানোর জন্যে। কিছু বললও না।

দেখতে দেখতে রণেনের মাথা একেবারে ভিজে গেল। অনেকক্ষণ মোটা কোট ভেদ করে জল ঢুকতে পারেনি—এখন জল ভেতরেও ঢুকতে লাগল। গরম প্যান্ট থাকা সত্ত্বেও হাঁটু অবধি ভিজে গেল। রণেন তবু ভাবল—যাক সুমিতা আর মিনুর মাথায় তো ছাতা আছে। ওদের মাথাটা তো বাঁচছে অন্তত—। দার্জিলিং-এ এমন করে বৃষ্টিতে ভিজলে নিউমোনিয়া হওয়াও বিচিত্র নয়।

এই দুর্যোগের ওপর আবার সরু পথের পাশ বেয়ে সাঁ সাঁ করে ঘন ঘন ট্রাকগুলোচলে যেতে লাগল—তাতে পথের ভয়াবহতা আরও বেড়ে গেল।

ওরা তিনজনেই প্রাণপণে, প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে অন্ধকারে, এলোপাথাড়ি সাঁতার দিতে দিতে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।

সুমিতা দৌড়োতে দৌড়োতে বলল—কিপটে অনেক দেখেছি। কিন্তু তিনটাকা ট্যাক্সি ভাড়া বাঁচাবার জন্য এমনভাবে কষ্ট দিতে কারুকে দেখিনি।

মিনু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা, আর কতদূর আছে বাড়ি পৌঁছোতে?

রণেন বলল, এই তো এসে গেছি বাবা। আর অল্প একটু।

ততক্ষণে প্রলয় শুরু হয়ে গেছে। ছাতাটাও মিনু আর ঠিক করে ধরে রাখতে পারছে না—অতটুকু মেয়ে কি ওইভাবে ছাতা রাখতে পারে? তখন রণেন একহাতে ছাতাটা মিনুর মাথার ওপর শক্ত হাতে ধরে অন্য হাতে ওর কলারের পেছন ধরে হাঁটতে লাগল।

সুমিতা দাঁত চেপে বলল, আর কোনোদিন তোমার মতো ছোটো মন, কৃপণের সঙ্গে কোথাও আসব না। এই আমার শেষ বাইরে আসা। তোমার সঙ্গে।

এই সময়ে মোড় ঘুরতেই বাড়িটা দেখা গেল। ঘরে ঘরে বাতি জ্বলছে।

দরজায় গিয়ে পৌঁছোতেই কাঞ্চা দৌড়ে এসে দরজা খুলল।

ততক্ষণে রণেনের জামাকাপড় ও শরীরের কোনো অংশই শুকনো নেই। সুমিতাও ভিজেছে। মিনুও ভিজেছে। তবে ওরা যা ভিজেছে তা জলের ছাটে।—মাথায় ছাতা থাকাতে রণেনের মতো সম্পূর্ণভাবে অসহায়ের মতো ভেজেনি।

রণেন ঘরে পা দিয়েই কাঞ্চাকে বলল, কফি বানাও।—খুব গরম কফি।

রণেন ভেবেছিল, সুমিতা মিনুকে আগে সামলাবে—গা-মাথা মোছাবে—কিন্তু কিছু না করে সে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল এবং সেখান থেকে মিনুর নাম ধরে চিৎকার করতে লাগল।

মিনু দৌড়ে গেল—এবং সুমিতার কথামতো আলনা থেকে একটি শুকনো শায়া নিয়ে মাকে দিতে ছুটল। সুমিতা শায়াটা হাত বাড়িয়ে নিল, তারপর রণেনের প্রায় মুখের ওপর দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করল। ভিজে গায়ে মিনুটা বার বার কেঁপে উঠল।

মিনু বলল, বাবা বড়ো শীত কচ্ছে।

রণেন এসব কাজ কখনো করে না—করতে পারেও না, কিন্তু তখন মিনুর অবস্থা দেখে না করে উপায় রইল না। ও মিনুর ভেজা জামাকাপড় ছাড়িয়ে ওকে পাশের ঘরের বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ওর পা-হাত ভালো করে ধুইয়ে কোলে করে এনে বিছানায় তুলে দিল—বলল, এক্ষুনি লেপের নীচে ঢোকো।

মিনু হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে লেপের নীচে চলে গিয়ে দুটি উজ্জ্বল কালো চোখে রণেনের দিকে চেয়ে রইল।

রণেনের প্যান্ট-কোট গড়িয়ে জল নামছিল। মিনু ফিসফিস করে মার চেঁচামেচিতে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভয় ভয় গলায় বলল, বাবা তোমার শীত করছে না?

শীত করছিল যে না, তা নয়, কিন্তু রণেনের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

ও ভাবছিল, দার্জিলিং-এর মতো জায়গায় মে মাসের শেষে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়াটা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। জেনেশুনে সে ট্যাক্সি না নিয়ে সত্যিই ভুল করেছে। ওর মূর্খামির জন্যেই সুমিতা ও বেচারি মিনুর এমন দুরবস্থা হল। মনে মনে রণেন নিজেকে গালাগালি দিচ্ছিল।

কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে রণেন বসবার ঘরে গিয়ে জুতো খুলতে লাগল। জুতোটা একেবারেই ভিজে গেছে। ভিজে ভারী হয়ে গেছে। একটা জুতো খুলেছে—এমন সময়ে কাঞ্চা এসে বলল, সাব কফি হো গ্যয়া।

কাঞ্চা ট্রেতে করে দু-কাপ কফি এবং এক-কাপ গরম দুধ নিয়ে এল।

কী ভেবে রণেন বলল, আমাকেই দাও—মেমসাহেব কাপড় বদলাচ্ছেন। এই বলে ট্রেটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল রণেন—ওই একপাটি জুতো পরা অবস্থায়ই—ভাবল, সুমিতাকে গরম কফি খাইয়ে নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করবে।

সুমিতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে শাড়িটা ভালো করে জড়াচ্ছিল—কফি হাতে রণেনকে ঢুকতে দেখেই ওকে আক্রমণ করে বলল, ন্যাকামি অন্য জায়গায় কোরো—তোমার অনেক ভালোবাসার লোক আছে—তাদের কাছে—তার কাছে কোরো—এখানে নয়। আমার কাছে নয়। যার একটা ট্যাক্সি করার মুরোদ নেই, যার একটা জুতো কিনে দেবার সামর্থ্য নেই, সে আবার হাতে করে কফি আনে। হুঁ:! না এলেই হত! অসভ্য স্বার্থপর। এই চটি পায়ে জল-কাদায় হেঁটে আমার সারাশাড়িতে রাস্তার নোংরা কাদা উঠে এসেছে। বলতে বলতে শেষের দিকে সুমিতা কেঁদে ফেলল—একটুখানি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদলও—তার পর বলল, এক জায়গায় বেড়াতে এনে আমাকে খাটিয়ে মারছ—হাঁটিয়ে মারছ—লজ্জা করে না? যার সামর্থ্য নেই তার বেড়াতে আসার দরকার কী? ফেলে দাও এ কফি। ভালোবাসা দেখাতে এসেছ তুমি!

রণেন এত কথার পরও সেদিন কিছু বলল না। অন্যদিন হলে হয়তো বোঝাবার চেষ্টা করত যে ও একথা বলে অন্যায় করেছে। আজকাল সুমিতার এইরকম ব্যবহারে ও নিথর হয়ে যায়—উলটো ঝগড়া করার মতো জোর পায় না।

রণেন হাতে-ধরা ট্রেটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, কফিটা খেয়ে নাও। বেশ ভিজে গেছ তুমি। কফি খেলে ভালো লাগবে।

সুমিতা বলল, আমার ভালো তোমার দেখতে হবে না। আমি খাব না কফি। তুমি এ ঘর থেকে বেরোও।

রণেন একটা নিশ্বাস ফেলল, তার পর মিনুকে বলল, মিনু, তুমি এই দুধটুকু খেয়ে ফেলো।

বলার সঙ্গে সঙ্গে সুমিতা ছোঁ মেরে কাপটা মিনুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। যত রাগ মিনুর ওপর পড়ল,—বলল, অসভ্য মেয়ে—এক্ষুনি ভাত খাবে? তবে এখন যে দুধ খাচ্ছ? সারাসকাল ধরে ঘরে বসে রান্না করলাম—একটুও কনসিডারেশান নেই কারো। বলেই রণেনের ওপর রাগটা—মিনুর নরম গালে ঠাস করে একচড় মেরে প্রকাশ করল।

শীতে-কাঁপা বেচারি মেয়েটা কেঁদে উঠল। ভয়ে ওর মুখ নীল হয়ে গেল।

সুমিতা কাঞ্চাকে বলল—দুধ লে যাও। বাবা আভি দুধ নেহি পিয়েগী।

কফি কারুরই খাওয়া হল না।

রণেন বসবার ঘরে ফিরে গিয়ে জুতো খুলতে খুলতে ভাবছিল যে, যে-কথাগুলোসুমিতা বলল, সেগুলো সত্যিও বটে আবার নোংরা মিথ্যাও বটে। ট্যাক্সি নেয়নি সত্যি, কিন্তু পয়সা বাঁচাবার জন্যে যে নেয়নি তা নয়।

এখানে এসে অবধি সুমিতাকে বহুদিন ম্যালে উঠতে নামতে বাটার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা জুতো কিনতে বলেছে।

সুমিতা নাক কুঁচকে বলেছে, আমার ওরকম জুতো ভালো লাগে না। চটিই ভালো। গরম জামাকাপড় সুমিতার যথেষ্ট আছে, কিন্তু তার বেশিরভাগই সুমিতার ‘অপছন্দের’—।

আসবার আগে রণেন বার বার করে বলেছিল দুটি গরম ব্লাউজ বানিয়ে নিতে, তাও বানায়নি সুমিতা। তার সামান্য সামর্থ্যর সবটুকু দিয়ে সে সুমিতাকে সুখী করতে চেয়েছে সর্বতোভাবে, কিন্তু তবু সুমিতা সুখী নয়। সুমিতা ওকে বোঝে না, ওকে ভালোবাসে না; ওর জন্যে একটুও কষ্ট অনুভব করে না।

ভাবতে ভাবতে মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল রণেনের।

ওঘর থেকে মাঝে মাঝেই আহত বাঘিনির মতো চাপা গর্জন করছিল সুমিতা।

তার পর আরও অনেক কিছু হয়েছিল। রণেনের মনে নেই সব। এক সময়ে সে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে লেপের তলায় গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। ভীষণ ক্লান্তি লাগছিল রণেনের। শরীরে ও মনে।

সেদিন সকালে ও নিজে বাজারে গেছিল। ইলিশ মাছ কিনে এনেছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবছিল রণেন। কাটিহার থেকে চমৎকার স্বাদের ইলিশ চালান আসে দার্জিলিং-এ। সুমিতা ইলিশ মাছভাজা করবে বলেছিল—সবাই মিলে মাছভাজা-তেল দিয়ে এক এক থালা ভাত খাবে ভেবেছিল। আর কাঁচালঙ্কা-কালোজিরে দিয়ে ইলিশের ঝোলও করেছিল সুমিতা—।

কিছুক্ষণ পর কাঞ্চা এসে ডাকল রণেনকে।

রণেন বলল, খাব না।

কাঞ্চা কাঁচুমাচু মুখে আরও একবার এসে অনুনয় করে বলল—কুছ তো খানাই হ্যায় হুজৌর।

কাঞ্চার মুখ দেখে হঠাৎ রণেনের মনে হল এ লোকটার বোধ হয় রণেনকে দেখে খুব করুণা হচ্ছে—নইলে রণেন খাবে না শুনে লোকটার মুখে এমন বেদনার ছায়া কেন? কথাটা ভেবেই রণেনের হাসি পেল। ভাবল, কাঞ্চাকে যাবার সময়ে ভালো করে বকশিশ দেবে। ভালোবাসে যখন, তখন টাকা ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে তো তার ভালোবাসা ফেরত দেওয়া যাবে না। ভালোবাসে! ফু:, ভালোবাসে! ভাবল রণেন।

উত্তরে শুয়ে শুয়েই রণেন বলল, না: খাব না।

তার পর একা ঘরে শুয়ে শুয়ে বাইরের পাইন বনের পাহাড়ি ঝিঁঝির ট্যাক-ট্যাক ট্যাক-ট্যাক আওয়াজ শুনতে শুনতে অবসন্ন রণেনের খুব ঘুম পেল।

খাওয়ার ঘর থেকে ইলিশমাছভাজা-তেলের গন্ধ আসছিল। রণেন লেপ থেকে নাক বের করে একবার হাওয়া শুঁকল। শেয়ালের মতো। বাড়ির পাশের ঝরনার নীচের জঙ্গল থেকে সত্যি শেয়ালও ডাকছিল। শেয়ালের ডাক শুনতে শুনতে একসময়ে রণেন ঘুমিয়ে পড়ল।



রাত কত হবে?

অনুমান করার চেষ্টা করল রণেন।

মিউনিসিপ্যালিটির সীমানার শেষ আলো জ্বলছে রাস্তায়। মোটা পর্দার ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে আলো এসে ঘরের মধ্যে একটা কমলা-রঙা ছায়া সৃষ্টি করেছে।

রণেন একটা হাই তুলল।

একটু আগেই ও স্বপ্ন দেখছিল। বোধ হয় খিদের জন্যেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল। স্বপ্নটা তখনও চোখে লেগেছিল।

ছোটোবেলায় কেষ্টনগর রাজবাড়িতে ও বারোশিবের মেলায় গেছে! নাগরদোলা উড়ছে আকাশে, পাঁপর-ভাজার গন্ধে আকাশ ভারী, গোরুর গলার ঘণ্টা বাজছে ডুঙডুঙিয়ে—আর বুড়ির চুল খাচ্ছে রণেন। গোলাপি-রঙা একতাল হালকা বুড়ির চুল—মুখে দিতেই চুপসে গেছে—জল হয়ে গেছে।

মেলায় কত দোকান, কত খেলনা, কত কী, কত কী—কিন্তু রণেনের হাতে যা পয়সা ছিল—একটি আনি—তা দিয়ে ও বুড়ির চুল খেয়ে ফেলছে। তার পর খালিহাতে একা-একা, একা-একা ও বারোশিবের মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কিছু কিনবে যে, সে উপায় নেই।

পাশ ফিরে শুল রণেন। মিনুটা লেপের মধ্যে ডুবে গেছে। ওকে দেখা যাচ্ছে না। মার গা-ঘেঁষে ও শুয়ে আছে। মেয়েটাও ওকে ভালোবাসে না—। মা যা বলে তাই শোনে—মার পায়ে পায়ে ঘোরে। রণেনকে কেউই ভালোবাসে না। অথচ জীবনে যদি সে সত্যি কিছু চেয়ে থাকে—কতদিন, তা শুধু নি:স্বার্থ ভালোবাসা—। টাকা নয়, যশ নয়, কিছু নয়, শুধু ভালোবাসা।

ভাবতে ভাবতে ভীষণ বিপন্ন হয়ে পড়ল রণেন। এক অসীম শূন্যতা ওর টনসিলের চারপাশে লেত্তির মতো পাক খেয়ে ফুলে-ফেঁপে ওর গলাটা সম্পূর্ণ বুজিয়ে দিল। রণেনের মনে হল, ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে। রণেন অস্বস্তিতে খাটে উঠে বসল।

মিনুর পাশে সুমিতা রণেনের দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে। লেপটা ওর ঢেউ খেলানো শরীরের ওপর গড়িয়ে গেছে। খোঁপাটা এলিয়ে আছে। কী বিশ্রী নাক ডাকছে সুমিতা। সুন্দরী মেয়েদেরও নাক ডাকে?

এই সুমিতার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রণেনের চেনা—সমস্ত তিল, তিল-তিল করে জানা। ওদের মধ্যে গোপনীয় বলতে কিছুই নেই। ওরা এক—ওরা অঙ্গাঙ্গি।

ফোঁত-ফোঁত-ঘোঁত-ঘোঁত করে সুমিতার নাক ডাকছে—নিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সুমিতার সুডৌল বুক উঠছে নামছে।

সায়ান্ধকারে সুমিতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ওর শ্রুতিকটু নাকডাকানি শুনতে শুনতে—প্রতিটি নি:শ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে রণেনের বুকের ভেতর থেকে একটা দূষিত শ্লেষ্মার মতো ঘৃণা পিছলে পিছলে উঠে আসতে লাগল।

রণেনের খুব ইচ্ছা হল—এই প্রবাসী রাতের অন্ধকারে সুমিতার গলা টিপে ধরে—ওর বুকের ওপর চেপে বসে ওকে গলা টিপে মেরে ফেলে—কিংবা ওর ঘুম ভাঙিয়ে ওকে আদর করার অছিলায় ওর গলার খাঁজে হঠাৎ কনুই দিয়ে চাপ দেয়। সুমিতাকে ও যে কেন ভালোবাসবেই, ওর সঙ্গেই থাকবে ; তার কোনো যুক্তি খুঁজে পেল না রণেন—অনেক ভেবেও। ওকে ছেড়ে না-যাবার কোনো কারণ খুঁজে পেল না।

রণেন একটা বালিশ নিজের কোলে টেনে নিয়ে সোজা হয়ে বসল! তার পর আবার বালিশটা সরিয়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সুমিতার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ভালো করে ওকে দেখল। সুমিতার সুন্দর মুখটাকে ঘৃণার মোম জ্বালিয়ে অনেকক্ষণ ধরে কাছ থেকে দেখল। তার পর মোমটা নিভে গেলে ও নিজেও মিইয়ে গেল।

ফিরে এসে নিজের জায়গায় আবার পা-টান টান করে শুল। শুয়ে শুয়ে ভাবল ও একটা ইডিয়ট। ওর বাবা ইডিয়ট ওর ঠাকুরদা ইডিয়ট। যারা বিয়ে করে, করেছে, সবাই ইডিয়ট। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সংসার এ সমস্ত বুজরুকি—বোকা লোকদের ঠকানোর জন্যে, সস্তা ফটাফট মেশিন।

এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে নিজেকে এবং নিজের বোকা পূর্বপুরুষদের গালাগালি দিতে দিতে বোধ হয় ঘুমিয়েই পড়েছিল রণেন, এমন সময়ে হঠাৎ ভয় পেয়ে মিনু চিৎকার করে উঠল।

রণেন ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে না বসতে মিনু অসহায় গলায় বলল, বাবা, তুমি কোথায় বাবা?

সুমিতা গাঢ় ঘুমের মধ্যে অস্ফুটে কী একটা বলে পাশ ফিরে শুল।

রণেনের বুকের মধ্যে কোথায়-না-জানি লুকিয়ে থাকা এক-শো অ্যালার্ম বেল একসঙ্গে ঝমঝমিয়ে বেজে উঠল।

রণেন উঠে বসে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে মিনু?

মিনু ঘুম জড়ানো করুণ গলায় বলল, ভুঁড়োশেয়াল।

ভুঁড়োশেয়াল? কোথায়?

একটু আগেই আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল বাবা জানালা দিয়ে।

রণেন ওর গায়ে হাত রেখে বলল, দুর বোকা। জানালা তো সব বন্ধ।

মিনু তবুও বলল, না বাবা, এসেছিল।

তার পরই উঠে বসে ওর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমি তোমার কাছে শোব বাবা। আমি তোমার কাছে শোব।

রণেন বলল, এসো এসো, বলে মিনুকে হাত বাড়িয়ে বুকে জড়িয়ে নিজের বালিশে, নিজের লেপে নিয়ে শুল।

মিনুর ছোট্ট পাখির মতো নরম উষ্ণ শরীরটা কুঁকড়ে—পরমনিশ্চিন্তিতে তার বাবার গায়ের সঙ্গে লেপটে রইল। মিনুকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল রণেন—এবং ঠিক সেই সময়ে, সেই সময়ে—মিনুর গলার কাছে মিনুর হাতের পাতায় রণেন ওর নিজের গায়ের গন্ধ পেল। একেবারে ওর নিজের গায়ের গন্ধ।

মিনুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে সেই আবছায়ায় হঠাৎ রণেন বুঝতে পারল যে, এই বিষাদ এবং আনন্দ, এই ঘৃণা এবং ভালোবাসা, এই জ্বালা এবং শান্তি—এই সব কিছুই ভাগাভাগি করে সুমিতার সঙ্গে ওকে একসঙ্গে বেঁচে থাকতে হবে।

কাল অথবা পরশু অথবা বরাবর হয়তো আজকের মতোই লড়াই হবে, ভুল বোঝাবুঝি হবে। হয়তো হবেই। কিন্তু তবু পালাবার পথ ওদের দুজনেরই বন্ধ।

কবে যেন এক গর্বিণী রজনিগন্ধা-রাতে আজকের এই বুকে-জড়ানো মিনু মেয়েকে ওরা ওদের প্রিয় শরীরের সুগন্ধ সমান ভাগে ভাগ করে সৃষ্টি করেছিল। সেই সুগন্ধি-সৃষ্টির মুহূর্তে ওরা একে অন্যের কাছে নি:শর্তে ও নিরুপায়ে চিরদিনের জন্যে বিক্রিত হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *