1 of 2

আওলাদ

আওলাদ

ডিসেরগড়ের টিম-এর কেউই তখন মাঠে ছিল না। খেলা শেষ হওয়ার পরই খুব জোর বৃষ্টি নেমেছিল। সবাই দুড়দুড় করে বাড়ি পালিয়েছে। নয়তো মাথা গোঁজার মতো আস্তানার দিকে। বার্নপুরের টিম-এরও বিশেষ কেউ ছিল না। গোলপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে আমি, ফাস্টুমামার বুট, মোজা, হোস ও জার্সি খোলা দেখছিলাম।

আমাদের বার্নপুরের টিম-এর অনিলদা খেলা আরম্ভ হবার দশ মিনিটের মধ্যে ফ্রি কিক-এর সুযোগ নিয়ে একটি অতিসাদামাটা গোল ঢুকিয়ে দিয়েছিল, হারুদার কিক-এ তার হেঁড়ে মাথা পেতে দিয়ে। সেই গোলটা অনিলদার শিং নাড়ার কৃতিত্বের যত বড়ো কীর্তি ছিল তার চেয়ে অনেকই বেশি লজ্জাকর ছিল ডিসেরগড়-এর গোলকিপারের পক্ষে।

মোদ্দাকথা, আজ যেবার্নপুর একগোলে জিতল ডিসেরগড়ের সঙ্গে খেলায়, লিগের ফিরতি ম্যাচে; তার পুরো কৃতিত্বই গোলকিপার ফাস্টুমামার একার।

ওদের চাটুজ্যে আর ধাওয়ান কম করে ছ-ছ-বার আমাদের ডিফেন্সকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে চমৎকার শট নিয়েছিল গোলে। দুটি শট ছিল অ্যাঙ্গুলার। এমনই সোয়ার্ভ ছিল যে, মনে হচ্ছিল ফুটবল তো নয়, যেন ক্রিকেট বল! উড়ন্ত ঘূর্ণি-গোলক। এ ছাড়াও দুটি শট করেছিল ওরা দুজনেই একটি একটি করে, মাটি থেকে ফুটখানেক ওপর দিয়ে। এবং সেই দুটি শটের আগে আক্রমণকারীদের চোখ দেখে কারোরই বোঝার উপায় ছিল না যে বল কোনদিকে যাবে। চ্যাটার্জির শটটা, তার শট নেবার পরমুহূর্তের দৃষ্টি অনুযায়ী যেদিকে যাবে বলে সকলেই ভেবেছিল, তার ঠিক বিপরীত দিকে গেছিল। তারই মিনিট পাঁচেক পর ধাওয়ান শট নিল যখন, তখন গোলকিপারকে বোকা বানাবার জন্যে আপাতদৃষ্টিতে একটুও চাতুরী না করে, চাতুরীর চূড়ান্ত করেছিল। শেষমুহূর্তের দৃষ্টি অনুযায়ী যেদিকে বল যাবে বলে সকলেই ভেবেছিল, বল ঠিক সেই দিকেই গেছিল।

অন্য যে-কোনো গোলকিপার হলে এই শেষ চাতুরীর খেলাতে হেরে যেতই। কিন্তু ফাস্টুমামা; ফাস্টুমামাই! আক্রমণকারীদের সব ছল, চাতুরী, দক্ষতা ব্যর্থ করে দিয়ে প্রতিবারই প্রত্যুৎপন্নমতিত্বর পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গোল বাঁচিয়েছিল। আজকের খেলাটা, বলা চলে; ডিসেরগড় ইলেভেন ভার্সাস ফাস্টুমামার একারই খেলা।

গণেশদা, আমাদের বার্নপুরের টিম-এর কোচ বাঁ-হাতের পাতা দিয়ে টাকের জল মুছতে মুছতে এবং ডানহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী মোটা সিগারের গায়ে রেখে, সিগার টানতে টানতে বললেন, তূর্য, ঘোষ সাহেব আমাকে গতরাতে বলছিলেন যে, তিনি নিজে স্যার আর এন-কে তোমার কথা বলেছেন। লেডি রাণু আর স্যার বীরেন, এর পরে যখন বার্নপুরে আসবেন তখন শুধু তোমারই জন্যে তাঁদের বাংলোতে একটি রিসেপশন-এর বন্দোবস্ত করবেন ঘোষ সাহেব। তুমি হায়ার স্টাডিজ-এর জন্যে যেখানে যেতে চাও, তার সব বন্দোবস্তই ওঁরা করে দিতে রাজি। তুমি ছেড়ে যেয়ো না…

ফাস্টুমামা, ঘামে আর বৃষ্টিতে ভেজা হোস, জার্সি, নী-ক্যাপ, অ্যাংক্লেট ইত্যাদি সব খুলে ব্যাগের মধ্যে রেখে একটি হলুদ-রঙা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। তোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম-জল মুছে বলল, ঘোষ সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস না করে, মানে, আমার সঙ্গে আলোচনা না করে, এটা না করলেই পারতেন। আমার মতটা আগে নেওয়া উচিত ছিল। আমার বাবাই এই কোম্পানিতে চাকরি করেন, আমি তো আর করি না। আমার জন্যে কোম্পানির কোনো চিন্তারই দরকার নেই।

গণেশদা বললেন, তুমি বড়োই উদ্ধত তূর্য। তোমার এই অকারণের ঔদ্ধত্যর কোনো মানে নেই। তোমার ব্যাপারটা যেন একগামলা দুধ-এর মধ্যে একফোঁটা চোনারই মতন। এই একদোষেই তোমার সব গুণ মাটি হবে।

ফাস্টুমামা হেসেছিল। বলেছিল, এটা আমার ঔদ্ধত্য নয় গণেশদা, এটা আত্মবিশ্বাস। আত্মসম্মানও বলতে পারেন।

বলেই, বলল, চল রে বুঁচু! বাড়ি যাবি না?

যাব তো!

আমি ফাস্টুমামার সামনে সাইকেলের রড-এ বসলাম। তার সাইকেলে কোনো ক্যারিয়ার ছিল না। কাদামাখা বুট দুটোর ফিতেতে গিঁট দিয়ে বেঁধে তা সাইকেলের হ্যাণ্ডল থেকে দু-দিকে ঝোলানো ছিল। ভিজে চামড়ার আর মাটির আর ঘাসের গন্ধ লেগেছিল বুটে।

বার্নপুরের পথ আর গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড যেখানে মিলেছে, সেই মোড়ের দিকে, ইদানীং যেখানে ইনকাম ট্যাক্স অফিস হয়েছে, সেই জায়গাটিতে পৌঁছে, বাঁয়ে জি টি রোড ধরে বরাকরের দিকে যাব আমরা। ডান দিকে পড়বে উঁচু পাঁচিল দেওয়া ‘এভিলিন লজ’। ফাস্টুমামারা এবং আমরাও সেখানেই থাকতাম। পর পর কয়েকটি বাংলো ছিল ‘এভিলিন লজ’-এ। সামনে লন ও বাগান।

বার্নপুরের এলাকা প্রায় ছেড়ে এসেছি, বাঁ-দিকে কারখানা শেষ হতে চলেছে; এমন সময়ে জোরে বৃষ্টি নামল আবার। ফাস্টুমামা সুরেলা, উদাত্ত গলায় গান ধরল, ‘আজি বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে’।

ফাস্টুমামার বাবা আর আমার দাদু, মানে, মায়ের বাবা ইণ্ডিয়ান আয়রন অ্যাণ্ড স্টিল কোম্পানির জাঁদরেল অফিসার ছিলেন। আমাদের মামাদের সমবয়েসিই ছিল ফাস্টুমামা। আমি ওঁর খুব ফেভারিট ছিলাম কারণ আমার ছোটোমাসি পরমার সঙ্গে ফাস্টুমামার একটি মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোনীতা হওয়া তখনকার আসানসোল-বার্নপুর-ডিসেরগড়-ধাদকা অঞ্চলে বিশেষ গর্বের ব্যাপার বলেই গণ্য হত। এবং অন্য মেয়েদের গভীর ঈর্ষা এবং দ্বেষের। আমাদের মাতৃকুলের তাই এতে অখুশি হবার কিছু ছিল না। কিন্তু গভীর চিন্তা ছিল, শ্রাবণের বাতাসের মতো ফাস্টুমামার মন কখন যে দিক বদলায়; তা নিয়ে।

ফাস্টুমামার পুরো নাম ছিল তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ফাস্টু’ নামটা ‘ফারস্টু’-র সহজ সমীকরণ। ওর বাড়ির ডাকনাম ছিল চুপু। ওঁর ফারস্টু নামটা প্রথমে দেন বার্নপুরের কারখানার একটি শপ-এর সিনিয়র ফোরম্যান অশেষকাকা। অশেষ রায়। তখন ফাস্টুমামা ক্লাস ফাইভ-সিক্স-এ পড়ত, আমি যেমন সেই খেলার দিনে পড়তাম। স্কুলের পরীক্ষায়, সবরকম খেলাধুলো, ডিবেটিং, গান-বাজনা, অভিনয়, সভ্যতা-ভব্যতা, আচার-ব্যবহার, কোনো দিক দিয়েই তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানোর মতো একজন ছেলেও ছিল না ওই অঞ্চলে।কলেজে উঠেও সেই একই ব্যাপার। তাই অশেষকাকার অশেষ কৌতুকে দেওয়া তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফারস্টু’ নামটা অন্য সব নামকে মুছে দিয়ে ‘ফাস্টু’ হয়ে থেকে গিয়েছিল সকলের মুখে মুখে। ‘তূর্য’ বা ‘চুপু’ নাম আর কারো মনেই পড়ে না।

কারো কাছেই হারব না, কোনো অবস্থাতেই মাথা নোয়াব না, জীবনে দ্বিতীয় কখনোই হব না—এমন একটা জেদ শিশুকাল থেকেই ফাস্টুদাকে পেয়ে বসেছিল। এবং সেই জেদ বজায় রাখতে যতখানি সাধনা, অধ্যবসায় এবং যোগ্যতার প্রয়োজন তার সবটুকুই করবার ও অর্জন করবার জন্যে মরণপণ করত সে। এবং সবসময়েই প্রথমই থাকত। নির্দ্বিধায়। সেইজন্যেই বোধ হয় আমার ছোটোমাসি ‘পরমা’কে অত পছন্দ ছিল তার। পরমা যার নাম, সে মেয়েও যে সাধারণ ছিল না।

বৃষ্টি থামলে গানও থামল।

আমি বললাম, কোম্পানি নিজে থেকে তোমাকে এমন অফার দিচ্ছে আর সেই সাধালক্ষ্মী পায়ে ঠেলছ; তুমি কীরকম:

হা:!

হাসল ফাস্টুমামা। তার পর সাইকেলের প্যাডল চালাতে চালাতে বলল, তুই উ্যলিসিস পড়েছিস? বুঁচু?

না। আমি কী-ই বা পড়েছি! তা ছাড়া সকলেই যদি তোমার মতো ফাস্টু হতে যায় তাহলে আমাদের মতো ফিফথু, সিক্সথু, সেভেন্থু কারা হত! লাস্টুই বা হবে কে?

হা:।

ফাস্টুমামা আবারও হাসল।

বলল, ফাজিল হয়েছিস তো খুব!

আমি বললাম, কার কবিতা এ? আমাদের টেক্সট বইতে তো নেই!

তোর কোন ক্লাস এখন?

সিক্স।

হা:। টেক্সট বইয়ে কতটুকু থাকে রে বুঁচু? স্কুল-কলেজে তো আর কেউ সত্যিকারের বিদ্বান হতে যায় না।

বা:। তবে কী হতে যায়? কেন যায়?

হা:। হা: করে হেসেই আবার চুপ করে গেল ফাস্টুমামা।

আবার হাসল ফাস্টুমামা।

দূর থেকে এবার গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের মোড়টা দেখা যাচ্ছিল। বৃষ্টিভেজা পথ বেয়ে ট্রাক যাচ্ছে পিচের ওপর পিচ পিচ শব্দ তুলে।

আমার ছোটোমাসি, পরমাসুন্দরী, বিদুষী, লাস্যময়ী পরমা, অথবা ফাস্টুমামার বাবা চিত্তদাদু অথবা স্যার আর এন এবং স্যার বীরেন মুখার্জিও বার্নপুরে বা অন্য কোথাওই তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী ফাস্টুমামাকে আটকে রাখতে পারেননি। তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিগন্ত প্রতিদিনই প্রসারিত হতে হতে বার্নপুর থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে লানডানে, লানডান থেকে আবার কলকাতা তার পর দক্ষিণ ভারতের নানা জায়গা এবং বম্বে হয়ে শেষকালে দিল্লিতে থিতু হয়েছিল।

তূর্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বহুমুখী প্রতিভার একজন বিখ্যাত মানুষকে যে এই বুঁচু বোস-এর মতো একজন অতিসাধারণ মানুষ, স্ত্রী-কন্যা-পুত্র পালনকারী, নিছক সাদামাটা জীবিকার্জনের দায়িত্বেই একেবারে ন্যুব্জ হয়ে থাকা মানুষ যে, আদৌ একদিন কাছ থেকে জানতাম, তা অন্যে বিশ্বাসই করতে চায় না। আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাই বলে, হ্যাঁ। তুমি ওকে চেনো না ছাই! প্রমাণ আছে কোনো?

প্রমাণ তো কিছু রাখিনি। আগে যদি জানতাম যে, প্রয়োজন হবে তাহলে রাখতাম হয়তো! তখনকার দিনে তো টিভি ছিল না! কিন্তু খবরের কাগজে এবং রেডিয়োতে তূর্য ব্যানার্জির কথা পড়ে এবং গলা শুনে আমরা যাঁরা তাঁকে জানতাম একদিন তাঁরা সকলেই প্রতিফলিত-গৌরবে আহ্লাদিত হতাম।

শুনেছিলাম যে, উনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যাসি পরীক্ষাতে প্রথম হয়েছিলেন। প্রথম হয়েছিলেন কস্টিং ও চার্টার্ড সেক্রেটারিশিপ পরীক্ষাতেও। লিনকনস ইনন থেকে ব্যারিস্টারিও করেছিলেন। আমাদের ফাস্টুমামা যে কখনো দ্বিতীয় হয়ে আমাদের অস্বস্তির কারণ ঘটাননি তা জেনে আমরা আনন্দিত ছিলাম। লানডান স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে বি এস সি (ইকন) করেছিলেন। তাতেও প্রথম হয়েছিলেন। সাসেক্স-এর একটি মেয়ের সঙ্গে ভাব হয় ফাস্টুমামার। নাম সিমন। তাকে বিয়ে করে জাহাজে ওঠেন। জাহাজেই হানিমুন করবেন বলে। জাহাজ থেকে নেমেই ডিভোর্স হয়ে যায়। ডিভোর্স-এর ব্যাপারেও ফাস্টুমামা প্রথম। আমাদের জানাশোনার মধ্যে কাউকেই কখনোই ‘ডিভোর্স’ করতে শুনিনি তখনকার দিনে। একমাসের মধ্যে সাহেবি-ভাবাপন্ন উচ্চশিক্ষিত এক পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেন ভালোবেসে। তাঁর নাম ছিল ফিঙে।

ফাস্টুমামা টেনিস, গলফ, ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার কাটা, রাইফেল ছোড়া, গান-ক্লাবে গিয়ে স্কিট ও ট্র্যাপ শুটিং, পোলো, গান-বাজনা, অভিনয় ইত্যাদি সব কিছুতেই খুব নাম করেছিলেন। কবিতাও লিখতেন ফাস্টুমামা প্রবাসীতে, ভারতবর্ষে। মানে, ইচ্ছে করলেও তাঁকে মনে না-রাখা সম্ভবই ছিল না আমাদের কারো পক্ষেই।

দেশ স্বাধীন হয়ে যাবার পরেপরেই বোধহয়, ফাস্টুমামা একবার আসানসোল-বার্নপুরের চেনাজানা সকলের বর্তমান ঠিকানা সংগ্রহ করে বিজয়ায় ও পয়লা বৈশাখে একলাইনের হলেও চিঠি লেখেন। নিজে হাতে। তখন তিনি বম্বেতে ছিলেন। আরও পরে দিল্লিতে আসেন।

আমি যে সাহেব কোম্পানিতে কাজ করতাম, সত্তরের দশকে তার হাতবদল হল। এক আধুনিক মাড়োয়ারি গোষ্ঠী কিনে নিল সেই কোম্পানি। তারও বেশ কিছুদিন পরে রিটায়ারমেন্টের সময় যখন এল তখন রিটায়ার করতে না দিয়ে উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে তাদের এক নতুন কারখানার ভার দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাঁরা। সেখানে পাঁচ বছর কাটানোর পর যখন ছুটি চাইলাম তখনও ছুটি মঞ্জুর হল না। আমিও ভাবলাম, রিটায়ার করে বসে গেলেই তো বুড়ো হয়ে যাব, যে ক-দিন কাজের মধ্যে থাকা যায়। আমাকে ওঁরা তখন হালকা কিন্তু খুব দায়িত্বের কাজ দিয়ে নৈনিতালে পাঠালেন। পুরো উত্তরপ্রদেশেরই দায়িত্ব দিয়ে। আমাদের এক ছেলে দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। বড়োজামাই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বম্বেতে থাকে। ছোটোজামাই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ফিলিপস-এ কাজ করে, সে-ও বম্বেতে থাকে। ছেলে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে স্টেটস-এ গেছিল। আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করে সেখানেই থেকে গেছে। গ্রিন কার্ডও পেয়ে গেছে। মাত্র একবার এসেছিল। পিছুটান বলতে কিছু নেই বলেই এসেছি নৈনিতালে। মেয়েরা বছরে নাতি-নাতনিদের নিয়ে একবার আসে। জামাইরা ব্যস্ত। কখনো আসে কখনো আসতে পারে না।

আমাদের কোম্পানির রানিখেত, আলমোড়া, কৌসানি ইত্যাদি জায়গার এজেন্ট সত্যকাম নেগি। হিমাচল প্রদেশের লোক। বহুদিন থেকেই বলছেন একটি লং উইক-এণ্ডে রানিখেতে তাঁদের গেস্ট হাউসে আমাদের নিয়ে গিয়ে রাখবেন। আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। রানিখেতে তো অজস্রবারই যেতে হয়। কিন্তু ছোটোমেয়ে জামাই আসছে এবারে পুজোর সময়ে। তাদের নিয়ে এখানে ক-দিন থাকার ইচ্ছে আছে রুবির। সে কারণেই সরেজমিনে তদন্ত করার অভিপ্রায়েই এবারে আসা।

চমৎকার গেস্ট-হাউস। ‘ওয়েস্ট-ভিউ’ হোটেলের কাছেই। শহরের গোলমাল নেই। ক্যান্টনমেন্ট-এর এলাকার ওপরে। কাছেই ঝুলাদেবীর মন্দির। সামনে ঢালু হয়ে নেমে গেছে গড়ানো পাহাড়, পরিচ্ছন্ন, চিড় আর পাইন বনের আঁচল গায়ে। সারাদিন ঝুরঝুর করে হাওয়া দেয়। আকাশে মেঘের খেলা।

বসবার ঘরে আমরা গল্প করছিলাম। সত্যকাম বলল, কাছেই তূর্য ব্যানার্জির বাংলো। তূর্য ব্যানার্জিকে চেনেন নাকি? বাঙালি তো!

কোন তূর্য ব্যানার্জি?

আমি আকাশ থেকে পড়ে বললাম। আমাদের ফাস্টুমামা?

তূর্য ব্যানার্জি তো ভারতবর্ষে একজনই আছেন। ফাস্টুমামা কে?

আমি হেসে বললাম, ফারস্টু। উনি কোনো ব্যাপারেই তো কোনোদিন হার মানেননি। সবেতেই চিরদিন ফার্স্ট। তাই নাম হয়েছিল ফারস্টু। তার থেকে ফাস্টু। ছেলেবেলায় আমরা প্রতিবেশী ছিলাম। উনি অবশ্য আমার চেয়ে অনেকই বড়ো ছিলেন।

তা তো জানিই। মানে, বড়ো যে ছিলেন! সেটা ঠিক। উনি নিজেও হেসে বলতেন, ‘আই অ্যাম ফার্স্ট বাই প্রফেশান।’

যাবেন নাকি দেখা করতে?

যাব না! কী বলো! এখুনি যেতে ইচ্ছে করছে! শুনেছিলাম বটে যে, রিটায়ার করার পর তিনি এই অঞ্চলেই সেটল করেছেন। একসময়ে আলমোড়ার বশী সেনকে যেমন সকলেই চিনতেন, রানিখেতের তূর্য ব্যানার্জিকেও তেমন সকলেই চেনে।

সপরিবারেই থাকেন?

মেমসাহেব তো কুড়ি বছর আগেই চলে গেছেন। একটিই তো ছেলে, একমাত্র সন্তান। ছেলে-বউ। নাতি-নাতনি নেই।

কী করে?

কে?

ফাস্টুমামার ছেলে?

কী আবার করবে! বাবার অনেক থাকলে বাঙালির ছেলেরা আবার কিছু করে নাকি? কিছু মনে করবেন না, কাজের-কালচারই যদি থাকবে তবে কি আর নিজদেশে তাঁরা উদবাস্তু হতেন বোস সাহেব?

আমি চুপ করে রইলাম। কথাটা তো মিথ্যেও নয়। তা ছাড়া যেটা সত্যকামেরা জানে না, সেইকথাটা হল কাজের সংস্কৃতি তো নষ্ট হয়েইছে, যেসব সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালিদের গর্ব ছিল সেসব সংস্কৃতিরও আজ আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই।

বাঙালি, আদমি বনতা বাঙ্গালকা বাহার যা কর। প্রবাসী বাঙালিরাই বাংলার গর্ব। বুঝলেন!

আমি চুপ করে রইলাম। একথাটাও ঠিক।

এখন যাওয়া যাবে? ব্যানার্জিসাহেবকে দেখতে?

সন্ধে হয়ে গেল। বুড়োমানুষ। শুয়ে পড়েছেন হয়তো। কালই যাবেন বরং সকালে।

সত্যকাম বলল, আমিও আমার পাঁচ বছর বয়েস থেকে ব্যানার্জি সাহেবকে চিনি।

কী করে?

আমার বাবা ওঁর দিল্লির বাংলোর মালি ছিলেন।

সত্যকামের মহত্ত্ব এবং সারল্যে মুগ্ধ হলাম। আজকের দিনের ভান-ভন্ডামির আর অতীত-লুকিয়ে-রাখার দিনে, অত্যন্ত শিক্ষিত এবং অশেষ ঐশ্বর্যর মালিক এমন মানুষও যে আছেন, তা জেনে খুবই ভালো লাগল। যদিও সত্যকাম বয়েসে আমার বড়োছেলের চেয়েও ছোটো তবুও শ্রদ্ধা জাগল ওর সম্বন্ধে।

বয়েস কত হল ব্যানার্জিসাহেবের?

রুবি শুধোল।

তা, পঁচাশি তো হবেই।

অত হবে?

রুবি বলল।

আমি বললাম, তা তো হবেই। আমারই তো সত্তর ছুঁই-ছুঁই। মামাদের সমবয়েসি ছিলেন তো ফাস্টুমামা। আমার মাতৃকুলে তো কেউই নেই। এক ছোটোমাসি ছাড়া। ছোটোমাসির বয়েসও তো এখন আশি হবে। থুরথুরে বুড়ি। আজকের দিনের ছোটোমাসির চেহারা দেখলে ‘এভিলিন লজ’-এর দিনের সেই চেহারার কথা মনে পর্যন্ত আনা যায় না। কিন্তু ফাস্টুমামার বয়েস হলেই বা কী হবে, তাঁকে দেখলেই তুমি বুঝবে যে, বয়েসকেও কী করে হার মানাতে হয় তা ফাস্টুমামা জানেন, বুড়ো হবার মানুষ তূর্য ব্যানার্জি নন।

এমন সময়ে বেয়ারা এসে বলল, ফোন আয়া।

কওন? সত্যকাম শুধোল।

রেখিসাহাব।

‘ওয়েস্ট ভিউ’-এর মালিক।

সত্যকাম গিয়ে ফিরে এল। বলল, ব্যানার্জিসাহেব হোটেলে এসেছেন। হল্লাগুল্লাহচ্ছে জোর। আমার কাছে হুইস্কি আছে কি না জানতে চাইছিলেন রেখি সাহাব।

এখানে তো ওসব মানা। আলমোড়া রানিখেত তো ড্রাই-এরিয়া। সাধুসন্তদের জায়গা।

তা ঠিক। তবে নিজের ঘরে বসে বা বাড়ি বসে খেলে, দেখছে কে? তা ছাড়া, গাঁজা-গুলির ওপরে তো নিষেধাজ্ঞা নেই!

রুবি হাসল।

বেরি ব্যানার্জি, মানে টি ব্যানার্জির ছেলেটা একটা মাতাল। তা ছাড়া…

তা ছাড়া কী?

আমি শুধোলাম।

না:। কিছু না।

কোথাকার মেয়ে বিয়ে করেছে?

দিল্লির মেয়ে।

পাঞ্জাবি?

না। বাঙালি। তবে অনেকের চেয়ে ও এগিয়ে আছে সব বিষয়ে। দিল্লিতেই সেটলড কয়েক পুরুষ হল। বাংলা বলে না।

তাই!

রুবি বলল।

সে আমার ছেলের বউও তো আমেরিকান। এক জামাই মহারাষ্ট্রিয়ান, অন্যজন পাঞ্জাবি। আজকাল আর কেউ ওসব মনে করে না। ভারতীয় তো তাও তারা!

গলফ খেলার টুর্নামেন্ট ছিল আজ। তার পর হোটেলেরই কোনো ঘরে জমায়েত হয়েছে হয়তো।

গলফ কি তার বাবার মতোই ভালো খেলে? বেরি ব্যানার্জি?

না:। বেরি ব্যানার্জির বাবার সঙ্গে কোনো দিক দিয়েই তার মিল নেই। স্কুল-লিভিং সার্টিফিকেটের পরীক্ষাও তিনবারে পাস করতে হয়েছিল। কোনো কিছুই ভালো করে করার মানসিকতা নিয়ে সে জন্মায়নি। তবে বড়োলোকের ছেলে, বসে খায়। হি নোজ হাউ টু এনজয় লাইফ।

না খেটে খেলে, সেই ভাত কি হজম হয়?

হয় নিশ্চয়ই! না হলে এত দিনে তো বদহজম হয়ে মারা যাবার কথা বহুবার।

বলেই বলল, আপনি কি সত্যিই ব্যানার্জিসাহেবকে দেখতে যাবেন স্যার?

কেন বলো তো? তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে, কালকে।

না:। ব্যানার্জিসাহেবকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করি। আমার পায়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে ওঁরই জন্যে। কিন্তু ওঁর ছেলে আমাকে কুকুর-বেড়ালের মতো দেখেন। তবে একথা তো সত্যি যে, আমার বাবা ছিলেন ওঁদের বাড়ির মালি। আমার তো পেডিগ্রি নেই। বেরি ব্যানার্জি আমার সঙ্গে মেশেন না। কিন্তু মদ আছে কি না তার খোঁজ করান অন্যকে দিয়ে। পয়সা লাগে না তো আমার কাছ থেকে নিলে!

তুমি যদি না-ও যাও সত্যকাম, আমাদের যেতেই হবে। আমার স্ত্রী-ও ওঁকে দেখেননি।

আমার মনে পড়ল যে, আমার চাকরি হওয়ার ব্যাপারে ফাস্টুদার হাত ছিল। লালমুখো সাহেবদের সামনে ইন্টারভিউ দিতে ভয় করেছিল খুব। কিন্তু এম ডি অ্যাণ্ডারসন, পাইপ মুখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হাউ ড্যু ইউ নো টুরিয়া ব্যানার্জি?

আমি বলেছিলাম, উই ওয়্যার নেবারস। হি ন্যু মি ভেরি ওয়েল।

দ্যাটস এনাফ ইয়াং ম্যান। হিজ ওয়ার্ডস আর গোল্ড ফর আস। হি স্পোক টু আস বাউট ইউ ফ্রম ডেল্লি।

এই কথাটা আমি স্ত্রীকে কোনোদিন বলিনি। ভাবছিলাম, কত সহজে আমরা যে-কথা কখনো ভোলবার নয়, তা ভুলে যাই! পাপক্ষালন করার জন্যেই সত্যকাম নেগিকে আর ওকেও আজ সবিস্তারে সে-কথা বললাম।

ও শুনে একটু অবাক হল। এতকথা বলেছি এতদিন ফাস্টুমামা সম্বন্ধে অথচ এই কথাটাই বলিনি জেনে।

সত্যকাম বলল, আমার একটু যেতে হবে মেজর-জেনারেলের কাছে। ফিরতে দেরি হবে স্যার। আপনারা খেয়ে নেবেন। কাল সকালেও আমি ভোরে বেরিয়ে যাব। আমাকে ড্রপ করে গাড়ি ফিরে আসবে পৌনে ন-টার মধ্যে। আপনারা যাবেন ব্যানার্জিসাহেবের কাছে ব্রেকফাস্ট সেরে। যাবেনই যখন—

ও চলে গেলে, রুবি বলল, সত্যকামের ইচ্ছা নয় কেন বলো তো যে, আমরা ওখানে যাই?

কী জানি? হয়তো ফাস্টুমামা ওকে পছন্দ করেন না। এখনকার মালিকদেরও যদি কোনো কথা বলেন ফাস্টুমামা, তবে তাঁরাও তা বেদবাক্য বলে মানবে। কে যে এই সংসারে কীসের জন্যে কী করে তা বোঝা ভারি মুশকিল!

তা ঠিক!

রুবি বলল।

তবে সত্যকাম মনে যাই করুক, ফাস্টুমামার কাছে আমি যাবই। সাধারণ মানুষ তো নন তিনি। তাঁর একটা নিজস্ব দর্শন ছিল জীবন সম্বন্ধে। নিজেই যে ফাস্ট হতেন তাই নয়, আমাদের মতো পেছনের সারিতে ভিড়-করা সাধারণ মানুষদের সামনে ফাস্টুমামা এক অন্য আদর্শ জ্বালিয়ে রাখতেন। জ্বলজ্বল করত সেই আলো আমাদের সামনে। আমরা হয়তো কেউই ওঁর মতো হতে পারিনি কিন্তু যতটুকু হয়েছি তার ছিটেফোঁটাও হয়তো হতে পারতাম না; সামনে অমন একটা দৃষ্টান্ত না থাকলে।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পরই আমরা বেরুলাম। সত্যকাম ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ন-টার সময়েই গাড়ি পাঠিয়েছিলেন।

আমি বললাম, খারাপ লাগছে খুব, খালি হাতে যাচ্ছি ফাস্টুমামার কাছে। উনি আমাদের বিয়ের সময় বোম্বে থেকে এক-শো টাকার একটি ড্রাফট পাঠিয়েছিলেন তোমার নামে। তোমার হয়তো মনে নেই। তখনকার এক-শো টাকার দাম আজকে পাঁচ হাজার টাকা। সে-কথা ছাড়াও, আমার চাকরিও তো ওঁরই জন্যে। অন্য ঋণেরও তো কোনো সীমা নেই।

কী নিয়ে যাবে? কলকাতা হলে দিশি জিনিস কিছু নিয়ে যাওয়া যেত।

ও বলল।

দিশি জিনিস মানে?

ইলিশ মাছ, হারান মাঝির দোকানের রসগোল্লা, ভীম নাগের সন্দেশ, শান্তিপুরি ধুতি। এখানে কী নেবে?

তা ঠিক।

ও বলল, শুধু শ্রদ্ধাভক্তি নিয়েই চলো। আমার কিন্তু ভয় করছে। তোমার কাছে ভদ্রলোক সম্বন্ধে এতই শুনেছি, এমন একটা ইমেজ গড়ে উঠেছে মনের মধ্যে এত বছর ধরে তাঁর সম্বন্ধে! তাঁকে দেখে যদি সেটা ভেঙে যায়!

আমি বললাম, নিশ্চিন্ত থাকো। অমন একটা ব্যক্তিত্বর সামনে তুমি কখনোই আসোনি। এরকম কনভার্সেশ্যালিস্টও কম দেখেছি। পরিচ্ছন্নতার, রসবোধের, জীবনবোধের কনসেপ্ট ছিলেন ফাস্টুমামা। জলজ্যান্ত উ্যলিসিস। বুঝেছ? চলো, তোমার ভয় নেই।

তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম। রানিখেত থেকে আলমোড়া যাবার পথের ওপরে অনেকখানি জায়গা নিয়ে দোতলা বাড়িটি। বড়ো বড়ো চিড়-পাইন, ইউক্যালিপ্টাস গাছের মধ্যে দিয়ে ড্রাইভওয়ে চলে গেছে। প্রথমে উতরাই নেমে তার পর চড়াই উঠে।

গাড়ি থেকে নামতেই দুটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর ঘাউ-ঘাউ করে দৌড়ে এল। বাগানে সাদা-রঙা বেতের চেয়ারে হালকা কমলা-রঙা শাড়ি পরে একজন মহিলা বসেছিলেন। ভারি সুন্দরী। তিনি উঠে এসে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা?

ফাস্টুমামা, মানে তূর্যমামার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। উনি আমার মামাদের বন্ধু ছিলেন, আসানসোলের ‘এভিলিন লজ’-এ থাকতাম আমরা, প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগে। মানে, প্রতিবেশী আর কী!

বাংলাতেই বললাম আমি।

তা হবে। মহিলা ইংরেজিতে বললেন। কিন্তু উনি তো কারো সঙ্গেই দেখা করেন না। নামেনই না দোতলা থেকে।

সে-কথাতে এমনই শৈত্য ছিল যে, আমরা দুজনেই একটা ধাক্কা খেলাম।

তবু সামলে নিয়ে আমি বললাম, উনি কেন নামবেন? আমরাই যাব ওঁর কাছে।

জোর করেই যাবেন? এই সময়ে উনি বাথরুমে থাকেন।

বউটির কথাতে আমার খুব রাগ হয়ে গেল! বুড়ো হচ্ছি। ব্লাডপ্রেশার সব সময়েই বেশি থাকে। ওষুধ খাই রোজ, তবুও হঠাৎ মেজাজ গরম হয়ে যায়।

রাগের গলায় বললাম, তূর্যদার ওপরে আমার জোর কিছুটা খাটে। তাঁর ওপরে যখন খাটে, তখন আপনার ওপরেও তা খাটবে আশা করি। আপনার পরিচয়টা?

আমি ওঁর পুত্রবধূ।

একটু চুপ করে থেকে বউটি বলল, আপনারা যখন শুনবেনই না তখন যান, বাট ইউ আর অন ইয়োর ওওন। বিওয়্যার অফ দ্য ডগস। ওরা খারাপ মানুষদের কামড়ে দেয় কিন্তু। আমি আর থাকতে পারছি না। আজকে ‘ওয়েস্ট-ভিউ’ হোটেলে মেয়েদের একটি কফি-মিট আছে। নৈনিতাল, আলমোড়া, কৌসানি থেকে অনেকেই আসবেন। আমার এখুনি যেতে হবে। আমি সেক্রেটারি, এখানের লেডিস ক্লাব-এর। ইউ হ্যাভ টু এক্সকিউজ মি। একটা ফোন করে এলেই…

ঠিক আছে। আপনি নিশ্চয়ই যাবেন। ফোন করে নিশ্চয়ই আসা উচিত ছিল।

ড্রাইভার পেছনের গ্যারেজ থেকে সাদা কন্টেসা গাড়ি বের করে নিয়ে এল। বউটি তাতে চড়ে বলল, বাঈ-ই।

আমি আঙুল নাড়ালাম।

ভারি স্মার্ট মেয়েটি। আর শাড়িটার কোনো জবাবই নেই।

রুবি বলল।

মহিলা বলেই বোধ হয় পারল। মেয়েদের লিবারেশনের পথে যদি সত্যিকারের কোনো বাধা থাকে, তা হল শাড়ি আর গয়না। ওর বোঝার কথা নয় যে, ফাস্টুমামার পুত্রবধূর শাড়ির চেয়ে তার মন এবং ব্যবহারটা আমার কাছে অনেকই বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।

কী শাড়ি ওটা?

শাড়ি সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ আমি শুধোলাম, বোকার মতো।

বালুচরি! তাও জানো না? তুমি না!

মনে মনে বললাম, কীই-বা জানি!

চলো!

রুবি আর আমি ওপরে উঠতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে। কুকুর দুটো বড়ো বিরক্ত করছিল। ভয়ও করছিল। যদি কামড়ে দেয়।

দোতলায় ল্যাণ্ডিংয়ে একজন গাড়োয়ালি মেয়ে, মাঝবয়েসি; এসে কুকুরগুলোকে বকাঝকা করে, অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কীসকা মাংগতা আপলোগ?

বললাম, বড়া ব্যানার্জিসাবকো।

তো, চলা যাইয়ে অন্দর। খাড়া কিঁউ হিঁয়েপর?

বলেই মেয়েটি নিজের ঘরে চলে গেল।

ল্যাণ্ডিং থেকে ঘরে ঢুকলাম। কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে খুব জোরে ডাকলাম, ফাস্টুমামা-আ-আ! তুমি কোথায়? আমি বুঁচু। ‘এভিলিন লজ’-এর বুঁচু।

ঘরটার মধ্যেটা প্রায়ান্ধকার। যদিও বাইরে অনেক আলো। জানালা প্রায় সবই বন্ধ। ঘরের মধ্যে একটি বিরাট খাট। খাটের ওপরে একটা লাল-রঙা মশারি টাঙানো। রঙটা আগে বোধ হয় লাল ছিল। এখন কালচে হয়ে গেছে রানিখেত-এর মতো পলিউশানহীন জায়গাতেও। কত মাস কাচা হয়নি কে জানে! মনে হল, সেই মশারির ভেতরে কেউ শুয়ে আছেন। ঘরের বাইরের বাড়িটার, লনের, বাগানের এবং ড্রাইভের চমৎকারিত্ব অথবা রানিখেত-এর আবহাওয়ার পরিচ্ছন্ন সুস্থতার কোনো রেশই এই ঘরটির মধ্যে পৌঁছোচ্ছিল না। ভীষণ ধাক্কা লাগল বুকে। আরও কাছে এগিয়ে যেতেই ফাস্টুমামাকে দেখতে পেলাম? না, তাঁর প্রেতকে?

নোংরা মশারির মধ্যে, নোংরা একরাশ ছোটো-বড়ো বালিশের ওপরে মাথা রেখে নোংরা একটি ছেঁড়া-খোঁড়া লেপ মুড়ি দিয়ে কঙ্কালসার এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন। হতাশার আর শ্রীহীনতার প্রতিমূর্তি যেন। তাঁর মুখটা হাঁ হয়ে আছে। বেঁচে আছেন কি চলে গেছেন দেখে তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।

হঠাৎ আমার বড়ো ভয় হল। ফাস্টুমামাকে দেখতে এসে ফাঁকা বাড়িতে খুনের দায়ে-টায়ে পড়ব না তো!

ঠিক সেই সময়েই রুবি বলল ফিসফিস করে, আমার কানের কাছে মুখ এনে; দেখেছ! পায়ে জুতো। জুতো পরেই খাটে শুয়ে আছেন? যে-মানুষটার এত টাকা-পয়সা, আত্মীয়-স্বজন, লোকজন, যাঁর কিছুমাত্রই অভাব নেই, তাঁরও এই অবস্থা! ঘরের এককোনায় টিভিটা চলছে। কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই।

বড়ো ভয়ে ভয়ে আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে মশারির কোনা তুলে ডাকলাম, ফাস্টুমামা— আ-আ!

বৃদ্ধ চোখ খুললেন এবারে। চোখ খুলেই বিড়বিড় করে বললেন, ইতনা রাতমে কাহে শোর মাচাতা? মুঝে কুছ না চাহিয়ে। তংক মত করো।

বুঝলাম, সময়ও মরে গেছে তাঁর কাছে। লোহা হয়ে গেছে ঘড়ি।

আমি বললাম, ফাস্টুমামা, আমি বুঁচু। আর এই আমার স্ত্রী, রুবি।

বুঁচু? সেটা কে?

শুয়ে শুয়েই, মুখটা অন্য দিকেই ফিরিয়ে রেখে বললেন, ফাস্টুমামা।

আমি আসানসোলের ‘এভিলিন লজ’-এর বুঁচু, ফাস্টুমামা।

উনি বললেন, দাঁড়া। দাঁড়া। হড়বড় করিস না ছোকরা। বুঁচু কী করতে আসবে এখানে? এত বছর পরে? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাস না। তুই কে রে? ইমপোস্টর?

ফাস্টুমামা!

আমি হতাশ হয়ে জোরে চেঁচিয়ে বললাম।

‘ফাস্টুমামা’— এই নামটি শুনে উঠে বসতে গেলেন তূর্য ব্যানার্জি। কিন্তু পারলেন না। বুঁচু! বলেই বিস্ময়াভিভূত হয়ে থেমে গেলেন। পরাজিত সম্রাট বালিশে মাথা নোওয়ালেন।

তার পর বললেন, ওই তেপায়াতে আমার দাঁতটা আছে। দে তো বুঁচু। কাপের মধ্যে জলে ডোবানো আছে। দাঁত ছাড়া, কথা…

আমার খুব আনন্দ হল। আমার ফাস্টুমামা চিনেছে আমাকে।

দু-পাটি বাঁধানো দাঁত যে কী বীভৎস দেখতে হতে পারে। টগবগে যৌবনে, কোনো যুদ্ধে না-হারার পণে গর্বিত, সাফল্যে ঋদ্ধ যে-মানুষকে একদিন দেখেছি, পুজো করেছি; তাকে এমনভাবে যে দেখতে হবে জানিনি কখনো। জানলে, আসতামই না।

রুবি মশারির মধ্যে ঢুকে, খাটে উঠে; ফাস্টুমামাকে জড়িয়ে ধরে উঠে বসিয়ে তাঁর পেছনে ক-টি বালিশ গুঁজে দিল।

বিছানা-বালিশের যা-চেহারা! ফুটপাথের ভিখিরিও এর চেয়ে পরিষ্কার থাকে। অমন পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে মানুষটা! আমার কান্না পাচ্ছিল। কাকতাড়ুয়ার মতো নড়বড় করে উঠে বসল ফাস্টুমামা—আনস্টেবল ইকুইলিব্রিয়ামের সংজ্ঞা হয়ে।

তোমার নাম কী?

রুবির দিকে চেয়ে ফাস্টুমামা শুধোল।

ওর নাম রুবি, ফাস্টুমামা। ভালো নাম পরমা। ছোটোমাসির নামে নাম। ‘এভিলিন লজ’-এর পরমাকে মনে আছে?

আমি বললাম।

ফাস্টুমামা শিশুর মতো হাসল। নি:শব্দে। স্বর্গীয় এক ভাব ফুটে উঠল মুখে। ভাবল একটু। তার পরে বলল হুঁ! একটু-একটু।

বুঝলাম যে, প্রথম যৌবনের প্রথম-প্রেম ছোটোমাসির কথা এখনও তাহলে মনে আছে। মানুষ যতই অপারগ হোক না কেন, প্রেম উজ্জ্বলই থাকে।

আশ্চর্য হলাম দেখে যে, মামাদের কথা, দিদিমার কথা, অন্য কারো কথাই জিজ্ঞেস করল না ফাস্টুমামা। ‘এভিলিন লজ’-এর কথা উল্লেখ করায় তাঁর স্মৃতির পাখিরা দ্রুতপক্ষে ফিরেই আসবে ভেবেছিলাম। কিন্তু কিছুই হল না। পরিণত বয়েসের নজরুল ইসলাম-এর চোখের দৃষ্টির মতো ঘোলা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ফাস্টুমামা।

কী হল ফাস্টুমামা! তুমি তো হেরে যাবার মানুষ নও! এমন পরাজিতের মতো দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? অ্যাঁ?

ওঁর মনে জোর জোগাবার জন্যে বললাম।

ওই।

বলেই, দু-হাতের পাতা ‘হাত ঘোরালে নাড়ু পাবে, নইলে নাড়ু পাবে না’ বললে উলঙ্গ শিশুরা যেমন করে হাত ঘোরায়, তেমন করে হাত ঘোরালেন। বৃদ্ধরাও যে শিশু, একথাটা পড়েছি এর আগে কিন্তু তা যে এমন সত্যি, তা কখনোই বিশ্বাস করিনি। আর ক-বছর পরে আমিও হয়তো শিশু হয়ে যাব। কিন্তু বড়ো আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম তূর্য ব্যানার্জির এমন দশা দেখে।

পায়ে জুতো কেন? ফাস্টুমামা? রাবারের জুতোই?

ওই! কে পরায় বার বার? বাথরুমে গেছিলাম। লাঠিই সম্বল এখন। কিন্তু লাঠিও লেট-ডাউন করছে। নিজের দুটি পায়ের মতো বড়ো বন্ধু আর নেই। অথচ এই পা-দুটিকেই কত কষ্ট দিয়েছি একদিন। তারা থেকেও নেই।

কেন? ছেলে, বউমা, চাকর, আয়া এতজন তো আছে। জুতো পরাবার লোক নেই?

হা:। কেউ কারো নয় রে বুঁচু। সবাই ছেড়ে যায়, সব ছেড়ে যায়; যশ, মান, গায়ের মাংস, হাত-পায়ের মাংস, হাড় ছেড়ে যায়; মুখের মাংসও। আর কোনো জোরই নেই অবশিষ্ট।

টাকার জোর তো যায়নি তোমার এখনও?

হা:। বলে হাসলেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন মনে হল।

বারবার এই ‘হা:’ হাসিটা শুনে এই মানুষটি যে আমাদের ফাস্টুমামাই সে সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহই রইল না।

ফাস্টুমামা বললেন, গর্তের মধ্যে পড়ে গেলে হাতিকে গুবরে পোকাও লাথি মেরে যায় বুঁচু। এ সংসারটা বড়োই খারাপ জায়গা, বড়ো বিবেকহীন, অকৃতজ্ঞ; চক্ষুলজ্জাহীন। অনেকই পাপ করলে কাউকে এখানে এত দীর্ঘদিন কাটাতে হয়।

তুমি এমন করে বোলো না। তোমার নাম না ফাস্টু! ফাস্টুমামা?

হা:। একদিন তোরাই এই নাম দিয়েছিলি। এখন লাস্টু। ‘ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস।’ ইন দ্য লাস্ট ল্যাপ, আই অ্যাম রাউটেড বাই ওল্ড এজ। আই অ্যাম টোটালি ডিভাস্টেটেড। সারাজীবন অনেক গোলই বাঁচিয়েছি রে বুঁচু, পাঞ্চ করে, ডাইভ করে, ফিস্ট করে, হুক করে, কিন্তু এই শেষের গোলটাকে আটকাতে পারলাম না রে!

বার্ধক্য যে সকলের জীবনেই আসে; আসবে ফাস্টুদা।

না রে! সকলের জীবনকে তো এই জরা অভিশপ্ত করে না। তার অনেক আগেই নিরানব্বুই ভাগ মানুষে, ভাগ্যবান মানুষে এই বিচ্ছিরি জায়গা ছেড়ে চলে যায়।

চুপ করে মাথা নীচু করে রইলাম।

রুবি বলল, ফাস্টুমামাকে, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে; আশীর্বাদ করুন ফাস্টুমামা আমাকে। আমি পরমা। ওকেও আশীর্বাদ করুন। আপনার প্রিয় বুঁচুকে।

ঘোলাটে চোখে পরমার দিকে চেয়ে ফাস্টুমামা বললেন, পরমা! হ্যাঁ। বুঁচুকে আশীর্বাদ করি, শুধু বুঁচুকেই কেন, পৃথিবীর সব পুরুষমানুষকেই আশীর্বাদ করি যেন তাদের জীবদ্দশাতে স্ত্রী-বিয়োগ না হয়। বুঝলে পরমা; তোমরা মেয়েরা, নাতি-নাতনি, রান্নাঘর, তরকারি-কাটা এসব নিয়ে তা-ও সময় কাটাতে পারো। আমরা পুরুষরা অনেকই বেশি অসহায়। চোখ নেই যে পড়ব। পা নেই যে হাঁটব। ঝগড়া করবার লোক নেই যে, ঝগড়া করব। সারাজীবনের সব জিত আমার ধুলো হল।

চোখ যদি নেই তো টিভি দেখো কী করে?

হা:। দেখি না রে। একা থাকতে বড়ো ভয় করে। তাই যতক্ষণ মানুষের গলার আওয়াজ পাই, শুনি।

ফাস্টুমামা, তোমার কাছে আমি হেরে যাওয়ার কথা শুনতে আসিনি।

আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললাম।

এ বড়ো গভীর খাদ রে! দু-পাশেই উঁচু পাহাড়। এই জরা!

পরমা জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিল।

আমি ভাবছিলাম, কেন যে ছাই এসেছিলাম দেখতে!

পরমা বলল, আপনি চলুন। আমাদের সঙ্গে থাকবেন নৈনিতালে। আমরা দুজনে তো একাই থাকি নৈনিতালে। বড়ো বাড়ি। জায়গার অভাব হবে না। অযত্নও হবে না কোনো।

হা:।

হাসলেন ফাস্টুদা।

হাত দুটি আবারও নাড়ু ঘোরানোর মতো নেড়ে বললেন, তা হয় না, পরমা। কার হাতে যে শেষের ভাত খেতে হবে আমাদের প্রত্যেকের, তাও লেখা থাকে। সে-ভাত সম্মানের, না অসম্মানের; তাও। আমার মতো অ্যাগনস্টিক, নাস্তিক মানুষকেও শেষে এই ভবিতব্যে বিশ্বাস করতে হল। তোমাদেরও হবে। ম্যান প্রোপোজেস; গড ডিসপোজেস। ছেলে-বউ ওরা আমাকে নিয়ে যেতে দেবে না তোমাদের বাড়ি।

কেন?

ওদের ইগোতে লাগবে!

তাই?

মাথা নাড়লেন ফাস্টুমামা। বিড়বিড় করে বললেন, আমার আপনজনদের হাত থেকেও আমার মুক্তি নেই। এ এক জেলখানা। একটা রিভলবার এনে দিতে পারিস রে বুঁচু?

অন্ধকার ঘরটা আর জরাগ্রস্ত বৃদ্ধর হাত ছাড়িয়ে কোনোক্রমে বাইরে বেরিয়ে এসে আমরা দুজনেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরমা আর আমি।

সকালবেলার আলো, চিড়-পাইনের ডালে-ডালে; জীবনের সুগন্ধর সঙ্গে ম্যাগনোলিয়া গ্র্যাণ্ডিফ্লোরা আর ওয়াইল্ড-চেস্টনাট গাছের পাতার গন্ধ মিশে ছিল। পাতায় পাতায় হাওয়ার ঝরঝরানি, উপত্যকা থেকে ‘কাউফল-পাক্কৌ’ পাখির ডাক; মনের মধ্যে, প্রাণ সম্বন্ধে, জীবন সম্বন্ধে নতুন করে এক প্রত্যয় জন্ম নিচ্ছিল। আমরা এতক্ষণ যেন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কোনো নিরুপায় আসামির ঘরের মধ্যে বসেছিলাম। যাঁর মৃত্যু, ইচ্ছে করেই বিলম্বিত করা হচ্ছে। ভাবছিলাম, জীবনের যদি এই শেষ পরিণতি; তবে বাঁচা কেন! মিছিমিছি!

সিঁড়ি দিয়ে আমরা নীচে নেমে এসে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন মনে হল ভূতের বাড়িতে গেছিলাম। ভাবছিলাম, একটু জল চাইলে কে দেবে ফাস্টুমামাকে? যদি বাথরুমে যেতে চান, কে নিয়ে যাবে?

গাড়ি ছেড়ে দিল। রুবি ভিজে চোখে বলল, তূর্য ব্যানার্জির হারটা কার হাতে? জরার? না,…?

আমি মাথা নাড়লাম।

তবে?

ওর গলায় কান্না ছিল।

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে উঠতে-থাকা সরীসৃপের মতো ঠাণ্ডা ঘিনঘিনে ভয়টাকেই চুপ পাওয়াবার জন্যে খুব জোরে ধমক দিয়ে উঠলাম আমি। রুবিকে বললাম, চুপ করো! চুপ করো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *