একটি কুকুর ও আমি

একটি কুকুর ও আমি

বাগানের বেড়ার ধারে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টিটা যায় আমি সামনের দিকে মেলে দিলাম। দূরে একটা খড়ের বড়ো ঘর চোখে পড়ল, তার আশেপাশে ছোটো ছোটো কয়েকটা খড়ের চালা, মনে হয় ওটা একটা খামার। একটি মেয়ে, বোধ হয় বউ হবে, কাপড় মেলছে। তার মূর্তি দূর থেকে এত অস্পষ্ট দেখাচ্ছে যে, মনে হচ্ছে যেন ঘোমটা পরা একটা পুতুল।

নির্জনতার জন্যই এই বাড়িটা আমার পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু জায়গাটা যে এত নির্জন তা আগে বুঝতে পারিনি। ছোট্ট বাড়ি। দুটো ঘর, রান্না ঘর, স্নানের একটু ঘেরা জায়গা, পায়খানা আর সামনের দিকে একফালি বাগান। আমার একার পক্ষে লোভনীয়। চারদিকের নিঃসঙ্গতা আমার সত্যিই ভালো লেগেছিল। দূরে ওই কামারের মালিকই আমার একমাত্র প্রতিবেশী, আর কোনো ঘরবাড়ি চোখে পড়ে না। সবচেয়ে কাছের গ্রাম ধরালি, আমার বাড়ি থেকে প্রায় এক মাইল। যা রসদ আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম, এই চারদিনে তা ফুরিয়ে এসেছে, আজকালের মধ্যেই গ্রামে জিনিসপত্র সওদার জন্য যেতে হবে। তার আগে বাগানটা একটু পরিষ্কার করা দরকার, অনেকদিন অযত্নে পড়ে থাকায় বড়ো বড়ো ঘাস ও বুনো আগাছায় চারদিক ভরে গেছে।

মেয়েটি বোধ হয় ওই খামারের মালিকের বউ। কাপড় মেলা শেষ করে সে আবার চলে গেছে। তাকে যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল আমি যেন একজন মানুষের সান্নিধ্য অনুভব করছিলাম। এখন আবার নিজেকে বড়ো নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।

আমি উপুড় হয়ে বসে খুরপি দিয়ে বড়ো বড়ো ঘাস তুলতে লাগলাম। বাগানটা যে অবস্থায় আছে তাতে মনে হয় বাড়িটা অনেকদিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। মাটির তলায় একটা শক্ত কিছুতে ঠোকা লেগে খুরপিটা আমার হাত থেকে ছিটকে গেল। আমি হাঁটু ভেঙে ঘাসের ওপর বসে বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি আলতোভাবে টিপতে টিপতে অলসভাবে চারদিকে চোখ বুলোতে লাগলাম। হঠাৎ এক অতিথির আবির্ভাবে আমি সজাগ হয়ে উঠলাম।

একটা কুকুর আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কুচকুচে কালো, বেশ হৃষ্টপুষ্ট আর পরিচ্ছন্ন। আমার থেকে সামান্য দূরে পা মুড়ে কুকুরটা বসে পড়ল, তারপর মাথাটা একদিকে হেলিয়ে যেন লক্ষ করতে লাগল আমাকে। আমি শিস দিয়ে ওটাকে ডাকলাম। কুকুরটার কান দুটো খাড়া হয়ে উঠল। কুকুরটার গলায় একটা চামড়ার গলাবন্ধ;;গলাবন্ধের সঙ্গে আবার পেতলের একটা চাকতি ঝুলছে। চাকতির এক পিঠে খোদাই করা রয়েছে ‘লালু’, আর উলটোদিকে ‘মাধব, আদর্শ কুটির’। আমার বুঝতে দেরি হল না যে, কুকুরটার নাম লালু আর ওর মালিক আদর্শ কুটিরের মাধব নামে এক ব্যক্তি।

কুকুরটা দু-পা পিছিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল, যেন কিছু খুঁজছে। তারপরই ছুটে ঘন এক ঝোপ থেকে একটা শক্ত রবারের বল মুখে করে আমার কাছে ছুটে এল। বলটা আমার পায়ের সামনে নামিয়ে জায়গা নিয়ে দাঁড়াল। এইভাবে কিছুক্ষণ খেলা চলার পর কুকুরটা যেন হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে হাঁটা দিল। ঝোপঝাপের আড়ালে মিলিয়ে গেল ওর দেহটা। আমি বাড়ির ভেতর ফিরে গেলাম।

স্টোভে জল চাপিয়ে আমি যখন অপেক্ষা করছি তখন আমার মনে হল মাধব নামটা কোথায় যেন আমি শুনেছি, কিন্তু কোথায় তা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। চা বানিয়ে পেয়ালা হাতে নিয়ে আমি চেয়ারে বসলাম। মাধব নামটা ঘুরে-ফিরে আমার মাথায় ঝিলিক খেলতে লাগল, আর একটা অস্বস্তিতে মন ভরে উঠল আমার। আদর্শ কুটিরের মাধব। কোথায় যেন একটা চেনা সুর আমার কানে ঠেকছে। কিন্তু আবার হারিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কালো মেঘ সূর্যকে ঢেকে ফেলল। বৃষ্টির আশঙ্কা করে বাগানে ফেলে আসা যন্ত্রপাতি কুড়িয়ে আনতে ছুটলাম আমি। কোদাল আর নিড়ানিটা পেলাম, কিন্তু খুরপিটা আমার চোখে পড়ল না। আমি বড়ো বড়ো ঘাসের ফাঁকে খুঁজতে লাগলাম। বৃষ্টি এসে পড়ায় অগত্যা আমাকে বাড়ির ভেতর আশ্রয় নিতে হল।

ঘরে বসে একটা কাগজ পেনসিল নিয়ে আমি ফর্দ করতে বসে গেলাম। গাঁয়ের মুদিখানায় ওটা দিতে হবে। পেছনদিকের দরজায় কেউ যেন নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। দরজাটা খুলতেই লালু ঘরে ঢুকল। শরীরটাকে সজোরে ঝাড়া দিয়ে ও এদিক-সেদিক শুঁকল। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওর সঙ্গ পেয়ে আমি মনে মনে খুশিই হলাম।

ওকে দেবার মতো দুটো বিস্কুটও আমার নেই, সব ফুরিয়ে গেছে। ফর্দের মধ্যে আমি বিস্কুটও ঢুকিয়ে দিলাম। লালু সারা ঘরটা একবার চক্কর দিয়ে এক কোনায় গুঁড়িসুড়ি মেরে শুয়ে পড়ল। বাইরে বৃষ্টি চেপে নেমেছে। আমি জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলাম। বাগানে জল জমে গেছে, বৃষ্টি থামলে আবার যে কাজ শুরু করব তার উপায় নেই। বরং গ্রামে গিয়ে কেনাকাটা সারব। আমি ভাবতে লাগলাম ফর্দে আর কিছু যোগ করার আছে কি না।

একটা নীচু গোল টেবিলের ওপর থেকে ছোট্ট একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি আমি হাতে তুলে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। আমার আগে যিনি এ বাড়িতে ছিলেন মূর্তিটা বোধ হয় তাঁরই। আরও কিছু জিনিস মায় আসবাবপত্র সমেত বাড়িটা আমি কিনেছিলাম। আগে যিনি ছিলেন তিনি কেন এসব নিয়ে যাননি তা আগেও আমার মনে জেগেছিল।

মূর্তিটা আবার টেবিলের ওপর আমি রেখে দিলাম। লালু উঠে দাঁড়িয়েছে, আড়মোড়া ভেঙে ও লেজ নাড়তে লাগল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি ধরে এসেছে। গাঁয়ের দিকে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমি লালুকে খুঁজলাম, কিন্তু ও কখন যে চলে গেছে টের পাইনি।

মেঠো পথ ধরে আমি গাঁয়ে পৌঁছুলাম। মুদির দোকানে ফর্দটা দিতেই যে লোকটি জিনিস বিক্রি করে সে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। মুদিখানায় আর কোনো ক্রেতা ছিল না। ছোটো গ্রাম। নতুন মানুষ দেখেই বোধ হয় লোকটির দু-চোখে একটু কৌতূহলের ছায়া। আমি তাঁকে বললাম যে, এখানে নতুন এসেছি। শান্তি কুটিরের আমি নতুন মালিক। শান্তি কুটিরের নাম শুনেই লোকটি যেন চমকে উঠল, তারপর তার মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল, ‘ও-লোকটি যেন চমকে উঠল, তারপর তার মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল, ‘ও বাড়িটার তবে এতদিনে গতি হল।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওটা কি অনেকদিন খালি পড়ে ছিল?’

লোকটি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘হ্যাঁ, তা মাস ছয়েক তো বটেই।’

আমি অবাক হলাম, বললাম, ‘আজকাল এতদিন কোনো বাড়ি খালি পড়ে থাকে না তো!’

‘কাছাকাছি লোকজন নেই বলেই বোধ হয় বাড়িটা খালি পড়ে ছিল,’ লোকটি মাথা নীচু করে বলল। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

আমি বললাম, ‘না,’ তারপরই হঠাৎ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘অসুবিধে হবার কোনো কারণ আছে কি?’

লোকটি যেন চমকে উঠল, মুখ নীচু করে বলল, ‘না…না…!’

দোকানের মালিক এই সময় এলেন, আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে আদর করে বসালেন, তারপর দোকানের লোকটিকে আমার জন্য চা আনতে বললেন। লোকটি চলে যেতেই তিনি বললেন, ‘এক সময় এ জায়গাটা লোকজনের ভিড়ে ভরে উঠেছিল। শান্তি কুটিরই অবশ্য তাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল। এদিকটা যেমন নিরিবিলি তেমন শান্ত, তাই ওই বাড়িতে খুন হওয়ায় বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল।’

আমার রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে গেল। খুন! শান্তি কুটিরে!

মালিক ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ‘বিনোদবাবু ও বাড়িটা ভাড়া নেবার মাত্র তিনমাস পরই ব্যাপারটা ঘটেছিল। ভদ্রলোক ছবি আঁকতেন, বেশ সুপুরুষও ছিলেন। মাধব হল আপনার বাড়ি থেকে যে খামারটা চোখে পড়ে তার মালিক। তার বড়ো আদরের কুকুর লালু কেন জানি না বিনোদবাবুর বাধ্য হয়ে পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওটা শান্তি কুটিরে পড়ে থাকত। কুকুরটা অন্য একজনের ভক্ত হয়ে পড়ায় মাধব খুব বিরক্ত হয়েছিল। আমার দোকানে জিনিস কিনতে এসে একদিন স্পষ্ট সেকথা বলেই ফেলেছিল। ওর ধারণা হয়েছিল বিনোদবাবু কোনো কৌশলে তার কুকুরকে বশ করেছেন। ঘটনা হয়তো আর বেশিদূর গড়াত না যদি না মাধবের বউ কুকুরটাকে ডাকতে শান্তি কুটিরে আনাগোনা শুরু করত।’

এতক্ষণে আমার মনে পড়ল। মাধব আর আদর্শ কুটির— বিচারের সময় কাগজে যে খবর বেরিয়েছিল তা আমার নজর এড়ায়নি, তাই ও নাম দুটো ঘুরে-ফিরে আমার কানে বাজছিল।

দোকানের মালিক বলে চললেন, ‘কুকুরটাই সমস্ত অনিষ্টের গোড়া বলতে পারেন। ওটা ওই শান্তি কুটিরে না গেলে মাধবের বউ হয়তো কোনোদিন ওই বাড়িতে পা দিত না। কুকুরকে নিয়ে ঝগড়াটা চরমে উঠল খুনের আগের দিন। বিনোদবাবু সন্ধেবেলা এখানে এসেছিলেন। মাধবও সেই সময় এসে পড়ে। দু-জনের মধ্যে তর্কাতর্কি, তারপরই একটা মারামারি হয়ে যায়। মাধবের পেটা শরীর, জোয়ান মানুষ। বিনোদবাবুকে সে মেরে মাটিতে শুইয়ে দেয়, খুন করবে বলেও শাসায়।

পরদিন কী ঘটেছিল তা ঠিক কেউ জানে না। যে ছেলেটি বিনোদবাবুর কাজকর্ম করত সে-ই প্রথম দেখতে পায় তার মনিব শোবার ঘরে চিত হয়ে পড়ে আছে। ও ভয় পেয়ে আমাদের কাছে ছুটে আসে।

‘বিনোদবাবুর কপালে একটা গর্ত আর তার চারপাশে বারুদের দাগ আমরা সবাই দেখেছিলাম।’

‘পুলিশ সেদিনই মাধবকে গ্রেপ্তার করে। একজন রাখাল তাকে নাকি খুব ভোরে শান্তি কুটির থেকে বেরুতে দেখেছিল। মাধব অবশ্য পুলিশের কাছে বলেছিল সে বিনোদবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যাপারে দেখা করতে গিয়েছিল। ও যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে তখন বিনোদবাবু চেঁচাচ্ছিলেন। রিভলভারের গুলিতেই যে বিনোদবাবু মারা গিয়েছিলেন সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই কিন্তু রিভলভারটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাধব নিশ্চয়ই ওটা লুকিয়ে রেখেছিল। ও কোথা থেকে ওটা জোগাড় করেছিল জানা যায়নি।’

‘বিচারের সময় জানা যায় মারা যাবার দু-দিন আগে বিনোদবাবু শহরে এক ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গিয়েছিলেন। ডাক্তারবাবু তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। উনি পেটে ক্যান্সার রোগে ভুগছেন, আয়ু আর বেশিদিন নেই। তিনি নাকি বিনোদবাবুকে একথা বলেওছিলেন। বুঝতেই পারছেন, মাধব মিছিমিছি খুন করেছিল, আর কিছুদিন ধৈর্য ধরে থাকলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যান্সার রোগে বিনোদবাবুর মৃত্যু হত। মাধব যদি রিভলভারটাও বিনোদবাবুর হাতে গুঁজে দিত কিংবা ঘরে ফেলে রাখত, তবে হয়তো সমস্ত ঘটনা বদলে যেত। ডাক্তারবাবুর কাছে সব শোনার পর জীবনের প্রতি তাঁর আর মায়া ছিল না, তাই আত্মহত্যা করেছেন এই কথাটা ফেলে দেওয়া যেত না। বেচারা মাধব এখন জেলে পচছে, বিচারে ওর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।’

‘ব্যাপারটা তবে এই ঘটেছিল!’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম।

মুদিখানার মালিক মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘দলে দলে লোক এই ঘটনার পর এখানে এসেছিল। একজন শিল্পী, ছবির মতো একটা বাড়ি,— যেন একটা উপন্যাস।’

ভদ্রলোক নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলেন।

আমি ফেরার পথ ধরলাম। যাবার সময় আমার যা সময় লেগেছিল ফেরার সময় কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি সময় লাগল, পা দুটো যেন আর চলতে চাইছে না।

লালু যেন আমার জন্যই বাগানে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখামাত্র কাঠের গেটের ওপর সামনের দু-পা তুলে জিভটা বের করে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি একটু থমকে দাঁড়ালাম। কেন জানি না ওকে আদর করার ইচ্ছেটা আর হচ্ছিল না। আমি গেট খুলে ভেতরে ঢোকামাত্র ও আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল, আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলল। আমার খালি মনে হতে লাগল বিনোদবাবুর সঙ্গেও হয়তো কুকুরটা এই একই আচরণ করেছে। তাঁরও গা ঘেঁষে চলেছে। তাঁর মৃত্যুর কারণও হল এই কুকুরটা। কেন জানি আমার মনে হচ্ছিল শান্তি কুটির আমার পক্ষে আর নিরাপদ নয়। এটা আসলে বিনোদবাবুর বাড়ি, আসবাবপত্র তাঁরই, আমি যেন এখানে অনাহূত। কোন ঘরটায় ভদ্রলোক খুন হয়েছিলেন! বাড়ির আনাচেকানাচে তাঁর স্মৃতি যেন জ্বলজ্বল করছে। কেন জানি না আমার শরীরটা কেঁপে উঠল। লালু যেন আমার মনের ভাব বুঝতে পেরেছে। আমার মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে ও যেন কিছু বলতে চাইছে।

হঠাৎ কীসের একটা তাড়নায় আমি পেছন ফিরে তাকালাম আর তখুনি মাধবের বউকে আবার দেখতে পেলাম। যে কাপড়গুলি সে মেলে দিয়েছিল, সেগুলি তুলছে। আমি দূর থেকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বউটি একটা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। অল্প বয়স মনে হয়, কিন্তু দূরের জন্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ বউটি এ বাড়ির দিকে তাকাল আর আমার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। লালু এখানে আছে টের পেলে বউটি কি ওকে ডাকবার জন্যে এখানে আসবে? আমার ধমনীতে দ্রুত রক্ত চলাচল শুরু হয়ে গেল, অতীত যেন আমাকে গ্রাস করতে চাইছে। বিনোদবাবু বেঁচে থাকতে যেসব ঘটনা ঘটেছিল আবার কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, আর এবার ঘটনার নায়ক হব আমি!

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আমি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করে আবার আমি বাগানের কাজে হাত লাগালাম। বাড়ি থেকে বাইরে থাকতেই আমার মন চাইছে। ভেতরে যদি হঠাৎ অশরীরী বিনোদবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়! লালু সেই যে আমি বাড়ি ফেরার পর সঙ্গে এসেছিল তারপর থেকে ওকে আর দেখতে পাচ্ছি না।

বিকেলের দিকে মুদির দোকান থেকে আমার জিনিসপত্র এসে গেল। যে নিয়ে এসেছিল, সে চলে যাবার পর আমি সেগুলো গুছিয়ে তুলতে লাগলাম। এই সময় হঠাৎ আমার খেয়াল হল ব্রোঞ্জের মূর্তিটা টেবিলের ওপর নেই। আমার কেমন যেন খটকা লাগল। আজ সকালেই আমি ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। নীচু ছোটো গোল টেবিলটার ওপর ওটাকে আমি আবার রেখে দিয়েছিলাম সে-বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কোথাও ওটাকে খুঁজে পেলাম না। আশ্চর্য! ওটা কি উবে গেল! কেউ কি আমার অবর্তমানে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছিল? কিন্তু মূর্তিটা ছাড়া আর কিছু খোয়া গেছে বলে আমার নজরে পড়ল না।

বেরুবার আগে আমি দরজা টেনে দিয়েছিলাম, কারণ আমার স্পষ্ট মনে আছে ফিরে আসার পর চাবি দিয়ে আমাকে দরজা খুলতে হয়েছিল। বাড়িটা যিনি তৈরি করিয়েছিলেন তাঁর রুচিবোধ আছে বলতে হবে। বিলিতি কায়দায় দরজা বাইরে থেকে টানলেই লক হয়ে যায়, চাবি ছাড়া খোলা যায় না। ওটার চাবি বাড়ি কেনার সময় আমার দখলে এসেছিল, বিনোদবাবুই নিশ্চয়ই ওটা ব্যবহার করতেন। হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথায় ঝিলিক খেলে গেল। এইসব দরজার সাধারণত দুটো চাবি থাকে যাতে একটা হারিয়ে গেলে অসুবিধেয় পড়তে না হয়। বিনোদবাবু যখন বাড়িটা ভাড়া করেছিলেন তখন তাঁকে নিশ্চয় দুটো চাবিই দেওয়া হয়েছিল। মুদির দোকানের মালিক সকালে কথায় কথায় বলেছিলেন যে, বাড়িটা কিনবেন বলেই নাকি বিনোদবাবু প্রথমে ভাড়া নিয়ে একটা ট্রায়াল দিচ্ছিলেন। দ্বিতীয় চাবিটা তবে কোথায় গেল?

তখুনি আমার মনে পড়ল সকালে খুরপিটাও রহস্যজনকভাবে উধাও হয়েছে। আমি বাগানে ফিরে গিয়ে যেখানে ওটা হারিয়েছিলাম সে-জায়গাটা আবার খুঁজতে শুরু করলাম। লালু এসে আমার পাশে দাঁড়াল। ওর আসা যাওয়া যেন বাতাসের মতো, এই আছে এই নেই।

খুরপিটাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। খুরপি আর ব্রোঞ্জের মূর্তি, দুটোই যেন হাওয়া হয়ে গেছে। আমার কেন জানি মনে হতে লাগল এ দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একটা অদৃশ্য হাত যেন কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই এ কাজ করেছে। আমি যেন পাকচক্রে এই বাড়ির অতীত ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি, একটা বিপদের মুখে যেন আমাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।

লালু হঠাৎ কোথা থেকে বলটা মুখে করে আমার সামনে দাঁড়াল। ও বোধ হয় আবার খেলা শুরু করতে চায়। কিন্তু বলটা ওর মুখ থেকে নেবার জন্য আমি হাত বাড়াতেই ও কয়েক পা পিছিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর কান দুটো খাড়া হয়ে উঠেছে। তারপরই ও পেছন ফিরে কিছুটা দৌড়ে গেল। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ও যেন আমাকে ওর অনুসরণ করতে আহ্বান জানাচ্ছে। আমি সম্মোহিতের মতো ওর পিছু নিলাম।

ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে ও মাঠের মধ্যে নেমে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমার একবার মনে হল ও যেন আমাকে খামারবাড়ির দিকে নিয়ে চলেছে, যেখানে আছে মাধবের বউ। কিন্তু একটু পরেই আমার ভুল ভাঙল, ও চলেছে অন্যদিকে। একটু গিয়েই ও থেমে আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াচ্ছে, আমি কাছাকাছি যেতেই আবার এগিয়ে যাচ্ছে।

বেশ কিছুটা গিয়ে একটা ঘন ঝোপের সামনে কুকুরটা থামল, তারপর পা দিয়ে ঝোপের এক জায়গা সরিয়ে বলটা মুখ থেকে ফেলে দিল। তারপর কয়েক পা দূরে সরে জিভ লকলক করতে করতে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাল, যেন ওর চোখ কথা বলছে। বলছে এ জায়গাটা ভালো করে দেখো। আমি হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে ঝোপ সরালাম।

ঝোপের মধ্যে একটু জায়গা আশ্চর্যরকম পরিষ্কার। বাইরে থেকে বোঝবার উপায় নেই। বলটা প্রথমেই আমার চোখে পড়ল, তারপর খুরপি আর ব্রোঞ্জের মূর্তিটা। আরও কিছু আমার নজরে এল। ছবি আঁকবার একটা তুলি, এক পাটি চটি আর একটা রিভলভার। একটা কুকুর মুখে করে আনতে পারে এমন সব জিনিস। আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম। বিনোদবাবু মারা যাবার পর কুকুরটা যদি রিভলভারটা মুখে করে এখানে এনে লুকিয়ে রাখে তবে আত্মহত্যার প্রশ্নটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমি রুমাল দিয়ে সন্তর্পণে রিভলভারটা তুলে নিলাম, ওটার হাতলে যদি আঙুলের ছাপ অক্ষত থাকে তবে তার গুরুত্ব অনেক। ঘন ঝোপের ভেতর থাকায় ঝড় জলের হাত থেকে ওটা রক্ষা পেয়েছে। আমি উঠে গিয়ে এপাশ-ওপাশ চোখ ফেরালাম, কিন্তু লালুকে আর দেখতে পেলাম না। নিজের দুষ্কর্মের জন্য নিজেই ধরা দিয়ে ও যেন লজ্জায় পালিয়েছে।

পরদিন সকালেই আমি শহরে গিয়ে থানায় দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম, সব কথা খুলে বললাম তাঁকে। তিনি নীরবে আমার কথা শুনলেন, তারপর একজন সাব ইনস্পেকটরকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর কাছেও ঘটনার আগাগোড়া বললাম। তিনি সব শোনার পর রুমালে জড়ানো রিভলভারটা সতর্কভাবে টেবিলের ওপর রাখলেন।

‘এই রিভলবারটা নিশ্চয়ই বিনোদবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে নতুন আলোকপাত করবে,’ আমি তাঁদের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম।

দারোগাবাবু আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা করবে।’ তারপরই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি শান্তি কুটিরে নতুন এসেছেন, তাই না?’

আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

দারোগাবাবু সাব ইনস্পেকটরের মুখের দিকে তাকালেন, তাঁদের চোখে যেন কী কথা হয়ে গেল। তারপর দারোগাবাবু বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘বিনোদবাবুর আঙুলের ছাপ যদি এটাতে পাওয়া যায়, পাওয়া যাবেই বলে আমার বিশ্বাস, তবে নতুন করে আবার কেসটা খাড়া করতে হবে। আপনি কীভাবে রিভলভারটার সন্ধান পেলেন তারও একটা রিপোর্ট দাখিল করতে হবে আমাদের। তবে আমাদের রিপোর্টটা বেশ ভেবেচিন্তে করতে হবে।’

‘ভেবেচিন্তে কেন?’ আমি একটু অবাক হয়েই দারোগাবাবুর মুখের দিকে তাকালাম!

‘মুশকিল যে কুকুরটাকে নিয়ে,’ দারোগাবাবু চিন্তিত মুখে জবাব দিলেন।

আমি ততোধিক বিস্ময়ে বললাম, ‘আমি তো আপনাদের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। কুকুরটা আবার কী মুশকিল করল?’

দারোগাবাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কুকুরটা মাধবের বড়ো ন্যাওটা ছিল। মাধবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবার পর থেকেই ও অনশন শুরু করে, কিছুই মুখে দিত না। না খেয়ে খেয়েই শুকিয়ে মরে গেল কুকুরটা, সে আজ প্রায় ছ-মাস আগের কথা।’

দারোগাবাবু থামলেন। কিন্তু আমি যেন কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *