কবরের কান্না

কবরের কান্না

ডক্টরস’ ক্লাবে আমরা সবাই জড়ো হয়েছিলাম। মাঘ মাসের শেষ। হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় জমাটি ঠান্ডা পড়েছে, সঙ্গে কনকনে হাওয়া যেন হাড় ভেদ করে সূচ বিঁধছে। ক্লাবরুমের দরজা জানালা বন্ধ করে, গরম পোশাকে নিজেদের ঢেকে আমরা গল্পগুজবে মেতে উঠেছিলাম। আমরা অর্থাৎ ডাক্তাররা। আজ আমাদের বার্ষিক সম্মিলনী। পরস্পরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতের এই চমৎকার সুযোগ হাতছাড়া করতে আমরা রাজি নই বলেই হাড়-কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে সবাই জড়ো হয়েছি। চিকিৎসা জগতে যাঁরা প্রথম সারির তাঁদের সান্নিধ্যের লোভটাও কম নয়।

অধিবেশন শেষ হয়ে গেছে। গরম গরম মুখরোচক খাদ্য আর পানীয় আমাদের চাঙ্গা করে তুলেছে। একটা টেবিলে আমরা কয়েকজন গোল হয়ে বসে ছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিলেন সাইকিয়াট্রিস্ট ডা দেব। চিকিৎসাজগতের সঙ্গে যাদের সামান্য পরিচয় আছে, তাদের কাছে ডা দেবের নাম অপরিচিত নয়। শুধু একজন সফল চিকিৎসক বলেই নয়, মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে তাঁর গভীর গবেষণা নতুন আলোকপাত করেছে, বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর নাম। এককথায় তিনি একজন বিশেষজ্ঞ এবং ওপরের সারির অন্যতম। আমরা আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। কে কার চমকপ্রদ কাহিনি আগে বলবে তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। ডা দেব আমাদের হাবভাব দেখে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। ছোটোদের চপলতায় বড়োরা সহনশীলভাবে যেমন হাসেন অনেকটা যেন তাই। হঠাৎ আমাদের মধ্যে একজন তাঁকে লক্ষ করে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনার জীবনের একটা আকর্ষণীয় অভিজ্ঞতা আমরা শুনতে চাই।’

আমরা সমস্বরে সেই প্রস্তাবে সায় দিলাম।

ডা দেব সুদৃশ্য কাচের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমাদের কথা শুনছিলেন। আচমকা এই প্রস্তাবে তিনি যেন একটু থমকে গেলেন। আমাদের সকলের প্রত্যাশিত মুখের ওপর দিয়ে তাঁর দৃষ্টিটা ছুঁয়ে গেল। এক চুমুকে অবশিষ্ট সোনালি পানীয়টুকু শেষ করে গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে তিনি বললেন, ‘অল রাইট, আজ তোমাদের এক অদ্ভুত কাহিনি শোনাব।’

আমরা উৎসুকভাবে আরও ঘন হয়ে বসলাম। ডা দেব তাঁর কাহিনি শুরু করলেন।

‘আমি তখন বিলেতের পল্লি অঞ্চলের এক বেসরকারি মানসিক রোগের হাসপাতালে কাজ করি। বয়সও তখন কম, উদ্যমও প্রচুর। সেখানেই এক বিচিত্র রোগীর সংস্পর্শে আমি আসি। বেশ অনেক বছর ধরেই নাকি ওখানে আছে। খুব শান্তশিষ্ট, কাউকে কখনো অসুবিধেয় ফেলেছে বা বিরক্ত করেছে এমন ঘটনা ঘটেনি। পরে আমি জেনেছিলাম তার ইচ্ছে অনুসারেই তাকে ওই হাসপাতালে রাখা হয়েছিল এবং এজন্য সে রীতিমতো খরচা দিত। তার কোনো নিকট আত্মীয়স্বজন ছিল কি না জানা যায়নি, তবে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে আসত না। আত্মীয়স্বজন তার সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ না করলেও ডাক্তার, মনস্তত্ত্ববিদ, এমনকী প্যাথোলজিস্টদের কাছেও সে আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যখন সে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল তখন সে ছিল প্রায় অজ্ঞাত একজন মানুষ, কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার বিচিত্র ইতিহাস ডাক্তারদের কাছে বিস্ময়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চিকিৎসাজগতে তার কেস হিস্ট্রি নিয়ে এত শোরগোল পড়েছিল যে, সে রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে পড়েছিল। ব্যাপারটা হল সে ঘুমোত না, দিন বা রাত কখনোই নয়। গোড়ার দিকে সে নাকি রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে বেশ কিছুক্ষণ বই পড়ত, তারপর যথারীতি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ত। পাঁচ মিনিট বাদেই জেগে উঠে পড়ত, যেন অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে, শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই। ক্রমে ওই পাঁচ মিনিট ঘুমও তার চোখ থেকে উবে যায়, ফলে রাত্তিরে বিছানায় শোয়া পর্যন্ত সে ত্যাগ করেছিল। রাত আর দিন এক হয়ে গিয়েছিল তার কাছে।

‘তার এই অদ্ভুত মানসিক অবস্থার কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তার জন্য একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার অনুরোধে ওই ঘরে কোনো বিছানা রাখা হয়নি। সাধারণত রাতটা সে বই পড়ে আর লিখেই কাটিয়ে দিত। কী যে সে লিখত তা কিন্তু কাউকে দেখাত না।

‘মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে সে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেত। এই চলে যাওয়ার ক-দিন আগে থেকেই তার মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দিত আর এই ঘটনাটি ঘটত প্রত্যেক বছরে একই সময়, অর্থাৎ অক্টোবরের মাঝামাঝি। মজার কথা, প্রত্যেকবারই তাকে খুঁজে পাওয়া যেত ওই অঞ্চলের গির্জার লাগোয়া কবরখানায়।

‘কেন জানি না লোকটির প্রতি প্রথম থেকেই আমি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলাম, একটা গভীর অনুকম্পা বোধ না করে পারিনি। বোধ হয় এই কারণেই আমি তাকে যতটুকু সম্ভব স্বাচ্ছন্দ্য দিতে চেষ্টা করতাম। লোকটি কথা বলত কম, প্রায় না বললেই চলে, কিন্তু আমার মনোভাব সে বোধ হয় বুঝতে পারত, অন্তত তার দৃষ্টি থেকে তাই মনে হত আমার।

‘আমি ওখানে থাকতে থাকতেই সে মারা গিয়েছিল। একেবারে না ঘুমোনো ব্যাপারটা চিকিৎসকদের কাছে আগ্রহের ব্যাপার হলেও ওটাই তার শরীরের কোষগুলিকে দুর্বল ও অকেজো করে দিয়েছিল। সবরকম চিকিৎসাই ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। যার ফলে তার অকালমৃত্যু ঘটে। মজার ব্যাপার, যতদিন সে বেঁচে ছিল, তার স্বাস্থ্য শুধু অটুটই ছিল না, রীতিমতো বলিষ্ঠ ছিল সে। অমন জোয়ান পুরুষ যদি খেপামি শুরু করত তবে সেটা হাসপাতালের কর্ত,পক্ষের কাছে উদবেগের কারণ হয়ে দাঁড়াত, কিন্তু একদিনের জন্যেও কাউকে সে বিব্রত করেনি।

‘তার মৃত্যুর পর তার জিনিসপত্রের মধ্যে মুখ বন্ধ বড়ো একটা খাম পাওয়া যায়। খামের ওপর আমার নাম লেখা ছিল, আর লেখা ছিল, ”আমার মৃত্যুর পর যেন খামটি খোলা হয়।” খামের ভেতর হিজিবিজি লেখা অনেক কাগজ ছিল।’

ডা দেব একটু থামলেন। শূন্য গ্লাসটার দিকে একবার সতৃষ্ণ নয়নে তাকালেন, তারপর আবার শুরু করলেন, ‘সেই লেখার মধ্যে অনেক অসংলগ্নতা ছিল, অসুস্থ মানুষের সীমাবদ্ধ কল্পনার অসংলগ্নতা বললে অন্যায় হবে না। তবু তার মধ্য থেকে আমি এক আশ্চর্য ঘটনার সন্ধান পেলাম। আমি তার জবানিতেই সেই আশ্চর্য কাহিনি তোমাদের বলছি, অবশ্য একটু গুছিয়ে।’

ক্লাবের বেয়ারা এসে ডা দেবের গ্লাসে কিছুটা সোনালি পানীয় ঢেলে দিল। ডা দেব একটা চুমুক দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন, তারপর বলতে লাগলেন।

‘উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডের এক পল্লি-যাজক হলেও সুখী ছিলাম। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, সরল ও ধর্মবিশ্বাসী মানুষজন। সত্যিই আমার সুখের অন্ত ছিল না। একমাত্র একজন আমার সুখের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গির্জার তত্ত্বাবধায়ক স্যার অ্যালেক রিউপার্টের সঙ্গে আমার অদ্ভুত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, সম্পর্কটা পারস্পরিক বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। একটা সহজাত বিদ্বেষ। আমরা পরস্পরকে ঘৃণা করতাম। অথচ আমাদের এই মনোভাবের যুক্তিসংগত কোনো কারণ ছিল না। স্যার রিউপার্টের চেহারা ছিল রোগাটে, মুখে সাদা গোঁফ আর সাদা দাড়ি; দাড়িটা আবার পাতলা ছুঁচোলো, অনেকটা ছাগলের দাড়ির মতো। আমি আড়ালে তাকে ‘সাদা ছাগল’ বলে উল্লেখ করতাম। তার গলার স্বরটাও আমার কাছে ছাগলের ডাকের মতো বিরক্তিকর মনে হত। গির্জা সংক্রান্ত সব কিছু ব্যাপারেই আমরা খুঁটিনাটি নিয়ে ঝগড়া করতাম, পরস্পরের প্রস্তাবের বিরোধিতা আমাদের অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম রিউপার্ট আমার নামে নানা কুৎসা প্রচার করে পল্লির অধিবাসীদের মন আমার বিরুদ্ধে বিষিয়ে তুলছিল। বিশেষ করে পল্লিতে নতুন অধিবাসী কেউ এলেই রিউপার্ট প্রথম সুযোগেই আমার বিরুদ্ধে তার কাছে বিষোদ্গার করতে ভুলত না।

‘শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল যে, সাদা ছাগলের প্রতি বিদ্বেষ আমার সমস্ত সত্তাকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলল। গির্জার উপাসনার সময় আমি জোর করে আমার দৃষ্টি তার দিক থেকে সরিয়ে নিতাম। তাকে আমি যেমন ঘৃণা করতাম তেমন ভয়ও করতাম। তার ফ্যাকাশে দু-চোখের দৃষ্টি আমাকে সবসময় যেন ব্যঙ্গ আর উপহাস করত। আমি বুঝতে পারতাম আমার ক্ষতি করার কোনো সুযোগ পেলে কখনোই সে ছেড়ে দেবে না।

‘একজন ধর্মযাজক হয়েও পাপের হাত থেকে আমি রেহাই পাইনি, কারণ মনে মনে আমি শুধু তার মৃত্যুকামনাই করতাম না, কল্পনায় অনেকবার তাকে হত্যাও করেছিলাম আমি। ফলে পাপী মন নিয়ে গির্জার সমাবেশে বাইবেলের নির্দিষ্ট কোনো পরিচ্ছেদ পাঠ করার সময় আমার সংকোচ বোধ হত। সেও যেন আমার মনোভাব বুঝতে পারত আর তাই তার ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠত বাঁকা হাসি।

‘এক অক্টোবরে আমার কাছে খবর এল ”সাদা ছাগল” গুরুতর পীড়িত। মিথ্যে বলব না, আমার মনে দারুণ একটা আশা জেগে উঠল। যাই হোক, কর্তব্যের খাতিরে আমি তার বাড়ি রওনা হলাম, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় তার শয্যার পাশে পৌঁছোবার আগেই তার মৃত্যু হল। আমি নিজেকে মুক্ত বোধ করলাম, একটা অপার আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। একজন ধর্মযাজকের পক্ষে এ ধরনের মনোভাব শুধু অসংগতই নয়, গর্হিত, কিন্তু আজ আমার স্বীকার করতে বাধা নেই, তখন আমি একটা মুক্তির স্বাদ অনুভব করেছিলাম।

‘অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার দিন আমিও শোক শোভাযাত্রায় যোগ দিলাম। শোভাযাত্রা চলেছিল গির্জার দিকেই। ওখানে কবরখানায় রিউপার্টকে সমাধিস্থ করা হবে। আমি শবাধারের ঠিক আগে আগে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা খুট খুট শব্দে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। পরমুহূর্তে আমি বুঝতে পারলাম শব্দটা আসছে কফিনের ভেতর থেকে।

‘আমার শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যাপারটাকে আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম, ভাবলাম নিশ্চয়ই আমি ভুল শুনেছি। হয়তো সবটাই আমার মনের কল্পনা। রিউপার্টের বিরুদ্ধে আমার ঘৃণাই হয়তো প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার অবচেতন মনকে নাড়া দিয়েছে।

‘আমি থেমে গিয়েছিলাম, আবার হাঁটতে শুরু করলাম। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক। শব্দটা আবার আমার কানে এল। এবার আর আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। আমি শবাধার-বহনকারীদের মুখের দিকে তাকালাম, তারাও নিশ্চয়ই শব্দটা শুনেছে। কিন্তু আশ্চর্য, তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই আমার চোখে পড়ল না। তবে কি ওরা কিছু শুনতে পায়নি? ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক। আবারও একবার আমি সেই শব্দ শুনলাম, এবার যেন একটু অস্পষ্ট। একটা ভয়ানক সত্য আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। রিউপার্ট মারা যায়নি। পৃথিবীর আলোতে ফিরে আসার জন্য তার কাতর আবেদন একমাত্র আমার কানেই পৌঁছেছে, আমিই তাকে বাঁচাতে পারি।

‘আমার মনে তখন যে ঝড় উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমার চিরশত্রুকে বাঁচাবার ক্ষমতা শুধু আমারই আছে। যাকে আমি মনে মনে অসংখ্যবার খুন করেছি, এখন অজ্ঞতার ভান করে সত্যিই আমি খুনির কাজ করছি। আমার এই ঘৃণিত অপরাধের কোনো প্রমাণ নেই, কোনো সাক্ষীও নেই। আমার যত ক্ষতি সে করেছে, আমার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন যে ঘৃণার বীজ সে ছড়িয়েছে, তা ছবির মতো আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল। আমি অনুভব করলাম কফিনের ভেতর থেকে পাণ্ডুর দু-চোখ দিয়ে সে যেন তার সমস্ত কৃতকার্যের জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইছে, বাঁচার জন্য আমার দয়া ভিক্ষে করছে আর আমি ঘৃণাভরে তার বোবা আবেদন প্রত্যাখ্যান করছি। একটা নিষ্ঠুর উল্লাসে আমার মন ভরে উঠেছে। তারপরই আমি বাস্তব জগতে ফিরে এলাম। আর কেউ যখন শব্দটা শুনতে পায়নি, তখন ওটা নিছক আমার কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

‘আমার মন শান্ত হল। ধর্মীয় শেষকৃত্যাদির পর কবরের মধ্যে কফিনটা নামানো হল। আমাদের চারদিকে ঠান্ডা, স্যাঁৎসেঁতে আবহাওয়া, অস্তগামী সূর্যের বিষণ্ণ পরিবেশ। নরম আলগা মাটি ঝুর ঝুর করে কফিনটাকে ঢেকে ফেলতে লাগল। কফিনের ভেতর থেকে রিউপার্টও কি সেই মাটি পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছে? একটা নিদারুণ হতাশায় সে কি ভেঙে পড়ছে? ঠিক তক্ষুনি আমি আবার সেই শব্দটা শুনলাম। ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক। ক্ষীণ অথচ যেন একটা অদম্য প্রয়াস। তারপরই মাটি চাপা পড়ার শব্দে সেই শব্দটাও চাপা পড়ে গেল।

‘আমি আমার বাসভবনে ফিরে এলাম। পল্লিযাজকদের বাসভবন, গির্জা এবং কবরখানা যে একই জমির ওপর তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

‘চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি আমার বসবার ঘরে আগুন-চুল্লির পাশে আরাম করে বসে ছিলাম। জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছিল। আমি উঠে পর্দাটা টেনে দিলাম আর তখুনি আমার দৃষ্টি পড়ল কবরখানার ওপর। আমি যেন চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছি, আমার সারা অঙ্গ অসাড় হয়ে যাচ্ছে।

‘রাত দশটার সময় যখন আমার সব কাজকর্ম চুকল তখন চারদিক নিস্তব্ধ। যে স্ত্রীলোকটি আমার বাড়ির কাজকর্ম করে সে ওই রাত্রে ছুটি নিয়েছিল। আমি সদর দরজা বন্ধ করে দোতলায় আমার শোবার ঘরে ঢুকলাম। সাড়ে দশটা পর্যন্ত বই পড়ে আমি শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, যেন বেশ কয়েক ঘণ্টা আমি ঘুমিয়েছি। উঠে আলো জ্বালালাম। ঘড়িতে এগারোটা বাজতে কুড়ি মিনিট। আমি যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মাত্র দশ মিনিট আমি ঘুমিয়েছি। আমার কিন্তু নিজেকে খুব ঝরঝরে মনে হচ্ছে। অনেকক্ষণ ঘুমোবার পর যেমন হয়। আমি বুঝলাম আর আমার ঘুম হবে না, ঘুমের প্রয়োজনও বোধ করছি না। আলো নিভিয়ে আমি আবার শুয়ে পড়লাম। অন্ধকারে চোখ মেলে আমি শুয়ে ছিলাম, অজস্র চিন্তা আমার মনে এসে ভিড় করছিল। আমার মন বলছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। চার্চের ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বাজল। আমি উঠে পড়লাম, পোশাক বদলে নীচে নেমে এলাম। আমার যা করবার তা আমাকে একাই করতে হবে। সত্য ঘটনাও আমাকে জানতে হবে। এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করার কেউ নেই।

‘আমি নীচে নেমে পেছনের দরজা খুলে বাইরের ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় এসে দাঁড়ালাম। নির্জন, নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। আমি একটা লন্ঠন আর কোদাল নিয়ে কবরখানায় ঢুকে পড়লাম। একটা গাছের তলায় নতুন একটা কবরের সামনে আমি এসে দাঁড়ালাম, যে কবরটা মাত্র সন্ধেবেলায় ভরাট করা হয়েছে। আমার তখন জোয়ান বয়স, শরীরে প্রচণ্ড শক্তি। সারাটা রাত আমার সামনে পড়ে আছে।

‘লন্ঠনটা মাটিতে রেখে আমি জামার আস্তিন গুটিয়ে নিলাম তারপর কবরটা খুঁড়তে লাগলাম। নরম মাটি। কোনো অসুবিধেই আমার হচ্ছিল না। আমার সারাজীবনের শান্তির জন্য জানা দরকার কফিনের ভেতর থেকে যে শব্দটা এসেছিল তা কি আমার মনের ভুল, না সত্যি। যদি শব্দটা সত্যিই হয়ে থাকে এবং কফিনের ভেতর রিউপার্টের দেহে তখন জীবনের ক্ষীণ স্পন্দন থাকে, তবে তার প্রাণরক্ষার চেষ্টা করে আমি আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করব।

কনকনে হাওয়া বইছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডা তবু পরিশ্রমে আমার শরীর ঘামে ভিজে উঠেছিল। গির্জার ঘড়ির প্রতিটি ঘণ্টাধ্বনির শব্দে আমি চমকে উঠছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার কৃতকর্মের ওরা যেন নীরব দর্শক। অন্ধকারে আমাকে লক্ষ করছে। কবরের দু-পাশে মাটি স্তূপাকার হয়ে উঠেছিল আর মাটি খোঁড়ার ফলে যে গহ্বরের সৃষ্টি হচ্ছিল আমি তার মধ্যে ক্রমশই ডুবে যাচ্ছিলাম।

‘শেষ পর্যন্ত আমার কোদাল কফিনের ঢাকনায় আঘাত করল। আমি যতটা সম্ভব মাটি সরিয়ে ঢাকনার মুখটা পরিষ্কার করলাম। রাতের গাঢ় অন্ধকার চারদিক থেকে আমাকে যেন গ্রাস করতে চাইছে। একা একা কফিনের ভারী ঢাকনা খোলা যে কত কষ্টসাধ্য তা আগে আমি বুঝিনি। আমার চিরশত্রু, যাকে আমি মনপ্রাণ দিয়ে ঘৃণা করে এসেছি, সে ওই ঢাকনার তলায় শুয়ে আছে। একটা ভয়ানক অনুভূতিতে আমার মন ভরে উঠেছে। সেই মুহূর্তে মৃত্যু যে কী ভয়াবহ তা আমি উপলব্ধি করলাম, তার হিম শীতলতা আমাকে স্পর্শ করল।

কোনোমতে স্ক্রুগুলো আলগা করে, কোদালটা ভেতরে ঢুকিয়ে আমি সজোরে চাপ দিলাম। ঢাকনার মুখটা আলগা হয়ে গেল। আমি ভারী ডালাটা খুলে লন্ঠন হাতে নিয়ে কফিনের ভেতর দৃষ্টি ফেললাম। লন্ঠনের মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়তেই আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। ‘সাদা ছাগল’-এর দেহে প্রাণ নেই। আমার আশঙ্কা ছিল কফিনের ঢাকনা খুললেই গর্তে ঢোকা ফ্যাকাশে দু-চোখ দিয়ে সে আমাকে বিদ্রূপ করে উঠবে, কিন্তু আমার সে-আশঙ্কা অমূলক। সে যে মৃত সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যা আমাকে স্তম্ভিত করল, তা হচ্ছে, কফিনের ভেতর সে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *