সমুদ্রে যখন ঝড় ওঠে

সমুদ্রে যখন ঝড় ওঠে

সমুদ্রের উপকূলে ছোট্ট একটি গ্রাম। বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই সমুদ্রের কোল ঘেঁষে একটা প্রাচীরের আকার নিয়েছে। বড়ো বড়ো কথাটা হয়তো একটু বিভ্রান্তিকর, আসলে বলা উচিত প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই। কেমন করে ওগুলো যে ওখানে এসে জড়ো হয়েছে, স্তূপীকৃত অবস্থায় প্রাচীরের আকার নিয়েছে, তা কেউ জানে না। তবে ওটাই যে সমুদ্রের রোষ থেকে গ্রামটিকে রক্ষা করছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রচণ্ড ঝড় যখন ফুঁসে ওঠে, উন্মত্তের মতো আছড়ে পড়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ পাথরের চাঁইগুলোর ওপর, আর সেই দুর্ভেদ্য প্রাকৃতিক পরিখায় বাধা পেয়ে সহস্রধা হয়ে ছিটকে পড়ে বিপুল হতাশায়, তখন সে-দৃশ্য সত্যিই ভয়ংকর। ওই পাথরের চাঁইগুলো না থাকলে কবেই গ্রামটি সমুদ্রের জঠরে চলে যেত। তবে অবলুপ্তি না ঘটলেও সমুদ্রের হিংস্র দংশন থেকে গ্রামটি পুরোপুরি রেহাই পায় না। পাথরের চাঁইগুলোর ফাঁক দিয়ে কুল কুল করে ঢুকে পড়ে লোনা জল, ক্ষতি করে ফসলের। অবশ্য ক্ষতিটা ভয়াবহ নয়, কারণ যে পরিমাণ জল ঢুকলে বন্যার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব, তার সামান্যই ঢুকতে পারে গ্রামের ভেতর। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের তোড়ে প্রকাণ্ড মাছ ঢুকে পড়ে গাঁয়ের পথে-ঘাটে, অসহায়ের মতো আটকা পড়ে, শিকার হয় গাঁয়ের মানুষের।

গ্রামটি ক্রিশ্চান প্রধান। একটি গির্জেও আছে। প্রতি রবিবার উপাসনার জন্যে ওখানে সমবেত হয় গাঁয়ের লোকেরা। বিয়ে এবং অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানেও গির্জেয় এসে জড়ো হয় তারা।

গাঁয়ের লোকেদের উপজীবিকা প্রধানত দুটি— চাষবাস আর সমুদ্রে মাছ ধরা। এখানকার জমিতে ভুট্টা, জোয়ার, যব, বার্লি প্রচুর ফলে। সমুদ্রপিঠ থেকে গাঁয়ের ভূমি বেশ উঁচু। ঝড়জলের সময় ঢেউগুলো খুব উঁচু হয়ে আসে বলেই পাথরের চাঁইয়ের ভেতর দিয়ে চোরাপথে সমুদ্রের লোনা জল গ্রামে ঢুকে পড়ে।

গোমেজ আর ডিসুজা এই গ্রামেরই ছেলে। পাশাপাশি ওদের বাড়ি। দু-জনেই একসঙ্গে গাঁয়ের স্কুলে পড়েছে, একসঙ্গে খেলেছে, মারামারি করেছে, আবার ভাবও হয়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি ওদের। এখন ওদের বয়স পঁচিশ— দু-জনেই সমবয়সি। এক আকস্মিক ঘটনা ওদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে, পরস্পরের মধ্যে সেতুর বন্ধ করেছে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর। যখন ওদের বাইশ বছর বয়স তখন গাঁয়ে কলেরা দেখা দেয়। গাঁয়ের অনেক লোক সেবার বলি হয়েছিল সেই মহামারির। গোমেজ আর ডিসুজার বাড়ির কেউ সেই কোপের হাত থেকে রেহাই পায়নি; শুধু ওরা দু-জন আশ্চর্যভাবে বেঁচে গিয়েছিল। এই নিদারুণ বিয়োগান্ত ঘটনাই ওদের বন্ধুত্ব মজবুত করে তুলতে সাহায্য করেছে। দু-জনেই দু-জনের ব্যথার ব্যথী, বিপদের সাথি।

গোমেজের গায়ের রং কালো হলেও একটা চকচকে ভাব আছে। ওর কোঁকড়ানো চুল, টানা টানা চোখ, খাড়া নাক আর দৃঢ়তাব্যঞ্জক চিবুক এক বলিষ্ঠমনা পুরুষের পরিচয় বহন করে। ও যেমন মিশুকে, আমুদে, তেমন কর্মঠ।

ডিসুজার গায়ের রং টকটকে, ওকে রীতিমতো সুপুরুষ বলা চলে। তবে ও একটু গম্ভীর প্রকৃতির, গোমেজের মতো সবার হঙ্গে হইহুল্লোড় করতে ভালোবাসে না। অনেকেই ওকে দেমাকি ভাবে। আসলে ও একটু অন্তর্মুখী, নিজেকে যেন গুটিয়ে রাখতে চায়।

গোমেজের বাপ-ঠাকুরদার ছিল কৃষিজীবিকা। উত্তরাধিকার সূত্রে তাই সে পেয়েছে অনেকটা জমি আর নিজস্ব বাড়ি— দালানকোঠা অবশ্য নয়। গাঁয়ের গির্জেই একমাত্র ইট, সিমেন্ট দিয়ে তৈরি; আর সব বাড়িই নারকেল পাতায় বোনা শক্ত ছাউনি দেওয়া, দেওয়ালে মাটির প্রলেপ, উঁচু মাটির দাওয়া— সিমেন্টের মতো শক্ত, আর ঝকঝকে উঠোন। পরিশ্রমী গোমেজ নিজে জমিতে চাষ করে, লোক খাটায়। ওর নিজের হাল আর বলদ আছে, আর আছে গোয়ালে গোরু। দুধ বেচেও ভালো পয়সা হয় ওর। পাঁচ মাইল দূরে ছোটো যে শহর আছে সেখানে ও দুধ চালান দেয়, তার ব্যবস্থা আছে। অবশ্য এ সবই বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসছে, গোমেজকে নতুনভাবে উদ্যোগী হতে হয়নি। ঠিক ধনী না হলেও ওর অবস্থা সচ্ছল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ডিসুজারও চাষের জমি আছে, তবে তা বেশি নয়। আসলে পুরুষানুক্রমে ওরা হল ধীবর, মাছ ধরাই পেশা। ডিসুজাও বাপ-ঠাকুরদার বৃত্তি বেছে নিয়েছে। ছোটোবেলা থেকেই বাবা-কাকার সঙ্গে সে নৌকায় সমুদ্রে ভেসেছে, জাল দিয়ে মাছ ধরেছে। এখন ও একজন ঝানু মাছশিকারি, ঝড় তুফানের মধ্যেও শক্ত হাতে হাল ধরে, বুক এতটুকু কাঁপে না। বেপরোয়া বলেই বোধ হয় ওর জালে মাছ পড়ে বেশি। সেই মাছ নিয়ে ওরা চলে যায় শহরে— সমুদ্রপথেই যায়। সারি সারি সব নৌকো মাছ নিয়ে শহরে গঞ্জে যায়, সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করে মাছের ব্যাপারীরা। মোটামুটি ভালো আয় ডিসুজার। নিজের নৌকো, নিজের জাল আর গোমেজের মতো অত জায়গাজমি না থাকলেও নিজের বাড়ি তো বটে।

বেশ কাটছিল ওদের দিনগুলো। কাজের অবসরে ওরা দু-বন্ধু নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করত, ভবিষ্যতের জল্পনাকল্পনায় মেতে উঠত। ঠিক এমন সময় ঘটল একটা অঘটন। আগে যে গাঁয়ের মোড়ল ছিল সে বছর চারেক হল মারা গেছে। তার বিধবা স্ত্রী একমাত্র মেয়ে লছমিকে নিয়ে সমুদ্রের কাছাকাছি নিজেদের ডেরায় থাকত। মোড়ল বেঁচে থাকতে ওদের অবস্থা ছিল সচ্ছল, কিন্তু এখন অবস্থা পড়ে এসেছে। সামান্য যা জমিজমা অবশিষ্ট আছে তা থেকেই যা হয় তাতেই কোনোমতে দিন চলে।

মোড়ল যখন মারা যায় তখন লছমির বয়স ছিল মাত্র তেরো। এখন ওর বয়স সতেরো। ভরা নদীর মতো ওর শরীরে জোয়ার এসেছে, উপচে পড়তে চাইতে প্রথম যৌবনের লাবণ্য। ওর দীঘল গভীর দু-চোখে যেন মোহময়ী দৃষ্টি, সুপক্ব ডালিম ফলের মতো লালিমা ওর দু-গালে, পাতলা টুকটুকে ঠোঁট দুটো যেন মিষ্টি হাসিতে জানাচ্ছে আমন্ত্রণ। গোমেজ আর ডিসুজা একদিন আবিষ্কার করল গাঁয়ের আর সব জোয়ান বুড়োর মতো তারাও মুগ্ধ লছমির রূপে, অন্তর দিয়ে কামনা করছে তাকে।

ওদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো যোগ্যতা সারা গাঁয়ে আর কারো ছিল না, তাই নিরাশ হয়েই সবাই ফিরে গেল মাথা হেঁট করে। রইল শুধু ওরা দু-জন। লছমি ছিল একটু সরল প্রকৃতির। ও পড়ল মহা ফাঁপরে। দু-বন্ধুর মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নেবে তা কিছুতেই ঠিক করতে পারে না ও। প্রেমাস্পদ হিসেবে দু-জনের কেউ কারুর চাইতে কম নয়। ডিসুজা রূপবান সন্দেহ নেই, কিন্তু গোমেজের চেহারায় পৌরুষ ভাব আকর্ষণ না করে পারে না। তা ছাড়া অবস্থার কথা বিচার করলে গোমেজের পাল্লা ডিসুজার চাইতে ভারী।

লছমির এই মানসিক দ্বন্দ্বে ওর মা এগিয়ে এলেন পরামর্শ দিতে। কানে কানে মন্তর দিলেন, ‘পুরুষ জাতটাকে বিশ্বাস নেই, বুঝলি? তুই দু-জনকেই হাতে রাখ, বাকি যা করার আমি করব।’ আসলে লছমির মায়ের মনে জেগেছিল লোভ। গোমেজ আর ডিসুজা দু-জনকেই তার মেয়ে দোহন করুক এই ছিল তার মনের বাসনা। মেয়ে সরল বিশ্বাসে দু-জনকেই প্রশ্রয় দিতে লাগল, আর মা আশ্রয় নিলেন ছলচাতুরির। দুই বন্ধুর এতদিনের বন্ধুত্বের শক্ত গাঁথুনিতে বুঝি দেখা দিল ফাটল।

এমন অবস্থা দাঁড়াল যে দু-জনের কেউই লছমিকে চোখছাড়া করতে চায় না, একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন যদি ভুলিয়ে ওর মন জয় করে ফেলে এই আশঙ্কায় লছমিকে ওরা সবসময় ঘিরে রাখতে চায়। ফলে কাজকর্মের ক্ষতি হতে থাকে, কিন্তু সেদিকে ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই।

কখনো যদি গোমেজ লছমিকে একা পেয়ে নিজের মনের ইচ্ছেটা ব্যক্ত করে, বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি লছমি, তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী হয়ে এসো’; ও তখন ম্লান মুখে জবাব দেয়, ‘কিন্তু ডিসুজাও তো আমাকে ভালোবাসে, গোমেজ।’ গোমেজ ঠোঁট কামড়ায়।

ডিসুজা যদি বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি লছমি, তোমাকে বিয়ে করতে চাই’; বিষণ্ণ মুখে জবাব দেয় লছমি, ‘গোমেজও তো আমাকে ভালোবাসে, আমাকে বিয়ে করতে চায়!’ ডিসুজার বুকের ভেতরটা জ্বলে ওঠে, একটা হিংস্র কামনা উঁকিঝুঁকি দেয় মনে।

গ্রামের কুমারী মেয়েরা লছমিকে ঈর্ষা করে। বর হিসাবে গোমেজ আর ডিসুজা দু-জনেই তাদের কাম্য, কিন্তু ওরা তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না, লছমিকে নিয়েই বিশ্বজগৎ ভুলে আছে ওরা। অন্য মেয়েদের সে যে ঈর্ষার কারণ তা লছমি বোঝে, একটা অহংকার আর আত্মপ্রসাদে ভরে যায় ওর মন। দু-জনের কাউকেই ছাড়তে চায় না ও। ওদের সে ঠিক প্রেমিকের চোখে দেখে না, ওরা যেন তার দুটি মূল্যবান অলংকার— তার সম্পদ।

লছমির মা মেয়ের নাম করে ওদের দোহন করতে থাকেন মনের সুখে। ওরা যদি অস্থির হয়ে ওঠে, একটা চূড়ান্ত ফয়সালা করতে চায় লছমির ব্যাপারে, তিনি বলেন, ‘বাছারা, আমার ছেলে নেই, তোমরাই আমার ছেলের মতো। তোমরা দু-জনেই ওকে ভালোবাসো আর ও ভালোবাসে তোমাদের। তাই কারো মনে দুঃখ দিতে লছমি চায় না, আমিও সেকথা বলি। বরং এখন যেমন চলছে, তাই চলুক! লছমি তোমাদের দু-জনেরই, তোমরা দু-জনেই লছমির। তা ছাড়া, লছমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই, ও চলে গেলে আমি শূন্য ঘরে কী নিয়ে থাকব!’

ওরা হতাশ হয়, কিন্তু হাল ছাড়ে না। একদিন-না-একদিন লছমি ওদের মধ্যে একজনকে বেছে নেবে, সে-আশা ছাড়তে পারে না ওরা। কিন্তু ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হবেন কার ওপর! পরস্পরের প্রতি একটা সূক্ষ্ম অবিশ্বাস ক্রমে ক্রমে আকার নিতে থাকে বিদ্বেষের। মাথার মধ্যে কিলবিল করে ওঠে হিংসে নামক পোকা; কু-চিন্তা আর দুষ্টু বুদ্ধি মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভুলে যায় ওরা অতীত, আশৈশব বন্ধুত্বের স্মৃতি।

একদিন খুব সকালেই লছমিদের বাড়ি এসে হাজির হয় গোমেজ। লছমিকে একান্তে পেয়ে অনুনয় করে বলে, ‘আমি আর পারছিনে লছমি, তুমি একবার মুখ ফুটে বলো, হ্যাঁ, আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছ। আমি সোনা দিয়ে তোমার গা মুড়িয়ে দেব।’

লছমি একটু ভেবে বলে, ‘বেশ, তুমি আমাকে ক-দিন সময় দাও, গোমেজ, আমি একটু ভাবি।’

গোমেজের মনে আশা জাগে, উজ্জ্বল মুখ নিয়ে সে বেরিয়ে আসে আর সঙ্গেসঙ্গে চমকে ওঠে। সামনে দাঁড়িয়ে ডিসুজা। তার চোখে-মুখে হিংস্র, ত্রূর দৃষ্টি। দু-জনে দু-জনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেটে যায় কয়েকটা অস্বস্তিকর মুহূর্ত। তারপর গোমেজ পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

ডিসুজা ঘরে ঢুকে দেখে লছমি আনত মুখে বসে আছে, যেন গভীরভাবে কী ভাবছে!

‘ও কেন এসেছিল?’ ফেটে পড়ে ডিসুজা।

লছমি চমকে ওঠে। ডিসুজার আগমন টের পায়নি ও। ডিসুজার রক্তবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা আঁচ করে নিতে ওর দেরি হয় না। বুকটা যেন কেঁপে ওঠে একটু। মুখে হাসি টেনে ও বলে, ‘এমনি এসেছিল।’

ডিসুজা বুঝতে পারে লছমি চেপে গেল আসল ব্যাপারটা। মুখে ও বলে, ‘আমি আর সহ্য করতে পারছি না, লছমি, একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার…এভাবে আর চলতে পারে না বেশিদিন। তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হও, আমি টাকার উপর বসিয়ে রাখব তোমায়। জানো তো আমাদের কারবারে কাঁচা টাকা, আর আমার মতো পাকা জেলে এ তল্লাটে কেউ নেই।’

লছমি অভিভূত হয় ওর আন্তরিকতায়, বলে ‘আমায় কিছুদিন সময় দাও, ডিসুজা, আমি ভেবে দেখি।’

ঠিক এর দু-দিন পরেই লছমির ঘরে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটে যায়। ওরা তিনজন বসে ছিল, টুকরো টুকরো কথাবার্তা হচ্ছিল। হঠাৎ সামান্য একটা কথায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে গোমেজ আর ডিসুজা। অন্তরের পুঞ্জীভূত ঘৃণা ফেটে পড়ল এক লহমায়। দু-জনেই আস্তিন গুটিয়ে এগিয়ে আসে, ঝাঁপিয়ে পড়ে দু-জনের ওপর, লছমি আর্তনাদ করে ওঠে। শক্তিতে কেউ কম যায় না। তবে গোমেজ ক্ষিপ্রতর, শক্তির ব্যবহারে পটু। ডিসুজাকে চিত করে সে তার বুকে হাঁটু চেপে বসে, দু-হাত দিয়ে গলা টিপে ধরে। ডিসুজার ফর্সা মুখ থেকে যেন রক্ত ফেটে পড়বে, ওর চোখ দুটো বড়ো হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভয়ংকর মুহূর্ত। লছমির চিৎকারে ওর মা ছুটে আসেন। ওরা দু-জন টানাটানি করতে থাকে গোমেজকে। লছমির কাতর কণ্ঠ আর কোমল স্পর্শে বাহ্যজ্ঞান ফিরে আসে গোমেজের। ডিসুজাকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়, তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

বাড়ি ফিরে এসে ধিক্কারে ভরে যায় গোমেজের মন। ছি ছি, সামান্য ব্যাপারে সে খুন করতে বসেছিল তার ছেলেবেলার বন্ধুকে!

সন্ধেবেলায় সে যায় ডিসুজার বাড়ি। ওকে দেখে সে অবাক হয়, গম্ভীর মুখে তাকায়। গোমেজ বলে, ‘আজকের ঘটনার জন্যে আমি অনুতপ্ত, সুজা। ছোটোবেলা থেকে আমরা একসঙ্গে বড়ো হয়েছি, একই ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়েছি, আমাদের সেই বন্ধুত্ব কি লছমির জন্যে ভেসে যাবে! এমন একটা দিন ছিল যখন আমরা একজন আরেকজনের জন্যে প্রাণ দিতেও পিছপা হতাম না, আর আজ আমরা দু-জনে দু-জনের টুঁটি চেপে ধরছি।’

গোমেজের গলায় আবেদনের সুর ঘা দিল ডিসুজার হৃদয়তন্ত্রীতে, ঝংকার দিয়ে উঠল ওর শুভবুদ্ধির বীণার তার। গোমেজ বুজতে পারল ওর মনের ভাব। দু-হাতে ও চেপে ধরল ডিসুজার ডান হাতটা। বলল, ‘ভাই, আমরা এতদিন নরকে বাস করেছি, আর নয়। আগের মতোই বন্ধু হতে চাই আমি তোর, কামনা করি তোর বন্ধুত্ব। আমি প্রস্তাব করছি, নিজেদের মধ্যে শত্রুতা না করে আয় আমরা টস করি। টসে যে জিতবে সে-ই বিয়ে করবে লছমিকে। সম্পূর্ণ ভাগ্যের হাতে ব্যাপারটা ছেড়ে দেব আমরা। টসে যদি তুই জিতিস, আমি শপথ করে বলছি, মনে কোনো গ্লানি না নিয়ে আমি সরে দাঁড়াব তোদের মিলনের পথ থেকে। তেমন, আমি যদি জিতি, তবে তোর কাছ থেকেও সেই ব্যবহারই আমি আশা করব। বল তুই রাজি আছিস।’

ডিসুজা ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল। সত্যিই তো এর চাইতে ন্যায্য প্রস্তাব আর কী হতে পারে! অনেকদিন পর আবার দু-জনে একসঙ্গে বসে মন খুলে কথা বলল।

পরদিন ওরা দু-জন একসঙ্গে গেল লছমিদের বাড়ি। ওদের দেখে লছমি অবাকই হল। গতকাল ওরা খুনের নেশায় মেতে উঠেছিল, আর একদিনেই ওদের এই মনের পরিবর্তন! আশ্চর্য ব্যাপার!

গোমেজই প্রস্তাবটা পাড়ল। লছমির মা-ও এসেছিলেন। তাঁর মতো চতুরার বুঝতে কষ্ট হয়নি ওরা ধৈর্যের শেষ সীমারেখায় এসে পৌঁছেছে, বেশিদিন টালবাহানা করলে সত্যি সত্যিই একটা বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে, আর তা থেকে তাঁর মেয়েও হয়তো রেহাই পাবে না। ভালোয় ভালোয় এখন একটা ফয়সালা হয়ে যাওয়াই মঙ্গল। প্রস্তাবে ওদের দু-জনেরই সম্মতি আছে এটা সুলক্ষণ নতুবা এ নিয়েও একটা অনর্থ ঘটতে কতক্ষণ! মায়ের মত আছে জেনে লছমিও এ ব্যাপারে গররাজি হল না। গতকালের ঘটনায় ও সত্যিই ভয় পেয়েছিল। লছমির মা কিন্তু প্রস্তাবের সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন। ওরা দু-জনেই যখন লছমিকে ভালোবাসে তখন নিশ্চয়ই লছমির সুখই ওদের কাম্য, তা যার হাতেই ও পড়ুক না কেন। তাই তিনি প্রস্তাব দিলেন, ওরা দু-জন দেড় হাজার করে টাকা লছমির হাতে জমা দেবে; মোট তিন হাজার। যে লছমিকে পাবার অধিকারী হবে সে ওই টাকা নিয়ে দূর শহরে যাবে ব্যাবসা করতে। এক মাসের মধ্যে ওই টাকা দেড়া করে সে ফিরে আসবে গাঁয়ে, তারপর বিয়ে হবে। চতুরা রমণী মোক্ষম অস্ত্র ছেড়েছিলেন যাতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না ওদের, অথচ দু-জনকেই একসঙ্গে দোহন করা যাবে ওই ব্যবস্থায়। যে লছমিকে পাবে না তার টাকাও লছমি ভোগ করবে আর ভাগ্যলক্ষ্মী যার প্রতি প্রসন্না হবেন সেও লছমিকে পাবার আশা ও আনন্দে ওই টাকা ব্যাবসায় খাটিয়ে দেড়া করতে সচেষ্ট হবে। এক মাসের মধ্যে সে যদি ফিরে না আসে তবে কিন্তু তার অধিকার খারিজ হয়ে যাবে।

গোমেজ আর ডিসুজার অবস্থা যতই সচ্ছল হোক, কড়কড়ে দেড় হাজার করে টাকা এককথায় বের করে দেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই ওরা দিনদশেক সময় চাইল। লছমির মা তাতে রাজি হলেন তবে ওদের সাবধান করে দিলেন, ওই দশদিন তারা লছমির সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। অগত্যা সেই প্রস্তাব মেনে নিল ওরা দু-জন।

দু-জনেই জমিজমা বিক্রি করে জোগাড় করল টাকা। ডিসুজাকে এজন্য তার নৌকোটাও বিক্রি করতে হল। ঠিক দশ দিনের মাথায় টাকা নিয়ে ওরা হাজির হল লছমিদের বাড়ি। টাকাটা জমা দিয়ে ওরা তিনজন চলল সমুদ্রের ধারে, পাথর প্রাচীরের কাছে, সেখানেই ভাগ্য পরীক্ষা হবে ওদের। জায়গাটার প্রস্তাব করেছিল গোমেজই। নির্জন, নিরালায় ভাগ্য পরীক্ষা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। লছমির মা তাতে আপত্তি করলেন না, কিন্তু তিনি ওদের অনুগামী হলেন না। এটা অবশ্য ওদের পক্ষে ভালো হল।

একটা বড়ো শিলাখণ্ডের ওপর ওরা বসল। আকাশে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। শোঁ শোঁ করে বইছে বাতাস, পাথরের সেই প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে একটা গোঙানির মতো আওয়াজ সৃষ্টি করেছে, হঠাৎ সে-শব্দে ভয় পাওয়া বা চমকে ওঠা বিচিত্র নয়। বোধ হয় ঝড় উঠবে। তখনও দিনের আলো নিভে যায়নি, কিন্তু আকাশের যা অবস্থা হঠাৎ অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আশ্চর্যের কিছু নেই।

গোমেজ একটা রুপোর টাকা বের করল। সেটাকে কয়েকবার ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর টোকায় শূন্যে পাঠিয়ে খপ করে দু-হাতের তালুতে চেপে ধরে, ও পরখ করে নিল। ডিসুজার দিকে ফিরে ও বলল, ‘আমিই প্রথম টস করছি, তুই বলবি হেড না টেল।’ ডিসুজা ঘাড় দোলাল।

গোমেজ টাকাটাকে শূন্যে ছুড়ল, তারপর দু-হাতের মধ্যে চেপে ধরে তাকাল ডিসুজার মুখের দিকে। এক লহমা ইতস্তত করল ডিসুজা, তারপর বলে উঠল, ‘টেল।’ গোমেজ ডান হাতটা ওঠাল; ঝুঁকে পড়ল তার বাঁ-হাতের তালুর ওপর লছমি আর ডিসুজা। ‘হেড।’

ঠোঁট কামড়াল ডিসুজা, মুখে ফুটে উঠল হতাশার চিহ্ন। গোমেজের মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মাত্র একবার টস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, তিনবার করতে হবে।’

জয়ের আনন্দে গোমেজের বুকে তোলপাড় শুরু হয়েছিল, ডিসুজার যুক্তি শুনে ও ক্ষুব্ধ হল। অন্যায় আবদার করছে ডিসুজা। ওর মুখের দিকে তাকাল গোমেজ। দেখল ওর দু-চোখে ফুটে উঠছে আহত পশুর দৃষ্টি, হিংস্র হয়ে আসছে মুখের ভাব। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল গোমেজ। যত সহজে ব্যাপারটার মীমাংসা হবে ভেবেছিল, তা হবার আশা নেই।

মুখে ও বলল, ‘বেশ, তুই এবার টস কর, আমি বলব হেড না টেল।’

ডিসুজা টাকাটাকে নিয়ে কয়েকবার শূন্যে পাঠিয়ে পরখ করে নিল, তারপর দু-হাতের তালুতে চেপে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল গোমেজের মুখের দিকে।

‘হেড।’ যতটা সম্ভব নিজেকে উত্তেজিত না করে বলল গোমেজ। ডান হাতটা ওঠাল ডিসুজা, তারপরই ওর মুখ ভরে গেল খুশির হাসিতে— টেল হয়েছে। দু-জনেই সমান সমান; এবার কে টস করবে? গোমেজই প্রস্তাব করল, যাকে নিয়ে এত কাণ্ড সেই লছমিই ওদের ভাগ্য নির্ণয়ের চূড়ান্ত টস করুক। ডিসুজা সানন্দে সায় দিল এই প্রস্তাবে।

উত্তেজনার ছোঁয়া লছমিকেও স্পর্শ করেছিল। সে কাঁপা কাঁপা হাতে রুপোর টাকাটা নিল ডিসুজার কাছ থেকে, তারপর দু-আঙুলের টোকায় শূন্যে ছুড়ে দিল। ডিসুজা চেঁচিয়ে উঠল, ‘হেড’; ‘টেল,’ বলল গোমেজ। ওদের দু-জনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ওই কথা দুটোর ওপর। দাপাদাপি শুরু হয়েছিল ওদের দু-জনের বুকের ভেতরটায়, উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গেছে ওরা।

লছমি টাকাটা ধরবার চেষ্টা করল না, মাটিতে আছড়ে পড়ল ওটা। তিনটে মাথা ঝুঁকে পড়ল ওটার ওপর। ভাগ্যলক্ষ্মী কার গলায় পরিয়ে দেবে জয়ের মালা। আস্তে আস্তে ওরা আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রাণপণে উত্তেজনাকে দমন করতে চেষ্টা করছে গোমেজ, রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে ডিসুজার মুখ। ‘টেল’।

গোমেজের মুখের দিকে তাকাল ডিসুজা। ওর দু-চোখে ক্ষিপ্ত বরাহের দৃষ্টি। শিউরে উঠল গোমেজ। ভাগ্যের এ পরীক্ষাকে মেনে নিতে পারছে না ডিসুজা, পূর্ব শর্ত ভুলে গেছে কিংবা ভুলতে চাইছে। তারপরই জ্বালাভরা দৃষ্টিটা সরিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল ডিসুজা, যেন আহত একটা শার্দূল হিংসাভরা মন নিয়ে সরে গেল তখনকার মতো।

আকাশে গর্জন করে ওঠে মেঘ, তারপরই নামে মুষলধারে বৃষ্টি। বাতাস যেন পাগল হয়ে উঠেছে, খেপানি বেড়েই চলে ক্রমশ।

লছমির মায়ের শর্তমতো গোমেজ তিন হাজার টাকা নিয়ে চলে গেছে দূর শহরে। ব্যাবসা করে ওই টাকা তাকে দেড়া করতে হবে। সে বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, সৎ! অভীষ্ট সিদ্ধ নিশ্চয়ই হবে। সে-ভরসা তার আছে।

ওই ঘটনার পর কয়েকদিন ডিসুজা সযত্নে লছমিকে পরিহার করে চলবার চেষ্টা করেছিল। একটা ব্যর্থতা আর হতাশায় গুমরে উঠছিল ওর মন, জীবনের ওপর যেন কোনো মায়া ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন ও একেবারে লছমির মুখোমুখি পড়ে গেল। লছমির রূপ যেন আরও বেড়েছে, স্তব্ধ বিস্ময়ে ও তাকিয়ে থাকে তার বাঞ্ছিতার মুখের দিকে। লছমি একটু থতোমতো খায়, পরক্ষণেই ওর নারীমনে করুণা জাগে হতভাগ্য এই মানুষটির জন্যে। মুখে হাসি টেনে বলে, ‘আমাদের বাড়ি আর আস না কেন, ডিসুজা?’

লছমির কোমল গলার স্বর ডিসুজার বুকের ভেতর দগদগে ঘায়ে যেন প্রলেপ বুলিয়ে দেয়। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ও জবাব দেয়, ‘কোন অধিকারে তোমাদের বাড়ি যাব, লছমি!’

‘কেন! বন্ধুত্বের অধিকারে,’ সরল মনে বলে লছমি।

বন্ধুত্ব! মনে মনে হাসে ডিসুজা। যাকে সে চেয়েছিল অন্তরের অন্তরাত্মা দিয়ে, তার সঙ্গে শুধু বন্ধুত্বে তৃপ্ত হবে তার সত্তা! মুখে ও বলে, ‘বেশ যাব, তাড়িয়ে দেবে না তো?’

‘ছি^ঃ, অমন কথা বলতে পারলে তুমি!’ লছমির ভ্রূকুটি শরাঘাত করে ডিসুজার বুকে। এলোমেলো হয়ে যায় চিন্তা। মনের ক্ষুধাটা আবার যেন চাড়া দিয়ে ওঠে।

ডিসুজার আবার আসা যাওয়াকে প্রশ্রয় দেন লছমির মা। যার কোনো দাবি নেই লছমির ওপর, তাকে যতটুকু নিংড়ানো যায় ততটুকুই লাভ। ডিসুজা আসে, লছমির সঙ্গে গল্প করে, সহজ হবার চেষ্টা করে। ভাগ্যের পরীক্ষায় নৌকোটাও সে হারিয়েছে, জমিজমাও গেছে, তাই অন্যের নৌকোয় সে মাছ ধরতে যায়। বাকি সময়টুকু কাটায় লছমির সান্নিধ্যে। ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে লছমির মায়া হয়; মনের গোপনে মাঝে মাঝে একটা ইচ্ছেও উঁকি মারে। ডিসুজার মতো সুপুরুষ গাঁয়ে কেউ নেই, ওর সঙ্গে যদি তার বিয়ে হত।

নিজের মনকে শাসন করতে চায় লছমি, কিন্তু কিশোরী মন চঞ্চল, বাইরের রূপটা সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। ডিসুজা ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে বেড়াতে যায়। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় ওরা গিয়ে বসে সমুদ্রের ধারে সেই শিলাখণ্ডের ওপর, যেখানে নির্ধারিত হয়েছিল ওদের তিনজনের ভাগ্য। নির্জনে ডিসুজা উজাড় করে দেয় তার মন, লছমির রাঙা দু-পায়ে নিবেদন করতে চায় তার প্রেমের অর্ঘ্য। লছমি আনতমুখে শোনে তার স্তুতি, ভালো লাগে একজন জোয়ান পুরুষের মুখে তার রূপ-যৌবনের প্রশংসা।

একদিন গভীর আবেশে ডিসুজা ওকে কাছে টেনে নিতে চাইল, লছমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মনে করিয়ে দিল সে যে গোমেজের বাগদত্তা। মুহূর্তে কালো হয়ে উঠল ডিসুজার মুখ। সে বলল, ‘হ্যাঁ, এক মাস আমি অপেক্ষা করব, তার একটি দিনও বেশি নয়। যদি ওই সময়ের মধ্যে গোমেজ ফিরে না আসে তবে সে তার অধিকার হারাবে, আমি বিয়ে করব তোমাকে। কোনো কথা আমি শুনব না, কোনো বাধা আমি মানব না।’ উত্তেজিত হয়ে ওঠে ও। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেন জানি দুরু দুরু করে লছমির বুক।

গোমেজের কোনো খবর নেই। ডিসুজার মনে কেন জানি আশা জাগে, সে আর ফিরবে না, লছমি তারই হবে। ও বাড়িয়ে দেয় লছমির বাড়ি যাওয়া আসা। গোমেজের অনুপস্থিতির পূর্ণ সুযোগ ও নিতে যায়, বিস্তার করতে চায় তার প্রভাব লছমির কিশোরী মনে। সত্যিই লছমি ঝুঁকতে থাকে ওর দিকে। যে কাছে নেই তার জন্যে ভাবনা করার মতো মনের স্থিরতা আসেনি ওর। তাই যে কাছে রয়েছে, ভালোবাসার মিষ্টি কথায় নিবেদন করতে চাইছে নিজেকে, তাকেই সে একটু একটু করে আকাঙ্ক্ষা করছে, ভুলে যাচ্ছে গোমেজের কাছে তার অঙ্গীকারের কথা।

একমাস পূর্ণ হতে আর মাত্র ক-দিন। হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল, উঠল প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়। বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুঁসে উঠল সমুদ্র। প্রচণ্ড গর্জনে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল শিলাপ্রাচীরের ওপর। গাঁয়ের লোক আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ল। এমন দুর্যোগ গত দশ বিশ বছরে হয়েছে বলে মনে পড়ে না কারো।

দ্বিতীয় দিনেও ঝড়বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। এমন সময় কে একজন খবর দিল দূরে একটা জাহাজ দেখা যাচ্ছে। ঝড়ের দাপটে অসহায় মোচার খোলার মতো ওটা যেন দিগভ্রষ্ট হয়ে এদিকেই আসছে। খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল সারা গাঁয়ে। দুর্যোগ উপেক্ষা করে লোকজন ছুটল সমুদ্রের ধারে। সত্যিই তো, একটা জাহাজ। ওটার মাস্তুল ভেঙে গেছে মনে হচ্ছে, একদিকে কাত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই জাহাজের ক্ষতি হয়েছে, জল উঠেছে পাটাতনে, তাই ওটার ওই অবস্থা। যেকোনো মুহূর্তে জাহাজটা ডুবে যেতে পারে। তা যদি নাও হয়, ওটা সোজা এসে ধাক্কা খাবে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাথরের চাঁইয়ের সঙ্গে আর টুকরো টুকরো হয়ে যাবে চোখের নিমেষে। জাহাজের লোকদের বিপদের কথা ভেবে শিউরে উঠল গাঁয়ের লোক।

সন্ধে হয়ে এসেছে। গাঁয়ের মোড়লের পরামর্শমতো অনেকে হ্যারিকেন লন্ঠন নিয়ে দোলাতে লাগল ঝড় জল উপেক্ষা করে। তাদের মনে ক্ষীণ আশা যদি দূর থেকে আলো দেখে জাহাজে যারা আছে তারা সাবধান হতে পারে। আসে রাত্রি, কালরাত্রি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছু দেখা যায় না। জাহাজের লোকদের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে গাঁয়ের লোকদের চোখে ঘুম নেই। গির্জেয় ঘণ্টা বাজছে— ঈশ্বরের কাছে ওদের বিপদমুক্তির প্রার্থনার ঘণ্টা।

ডিসুজাও সমুদ্রের ধারে অন্যদের সঙ্গে অপেক্ষা করছিল। ঝড় তুফানের সঙ্গে তার নিবিড় পরিচয়— অনেকবারই নৌকা নিয়ে ঝড়ের মুখে সে পড়েছে। জাহাজের আরোহীদের বিপদে সেও সবার মতো উদবিগ্ন।

রাত বেড়েই চলেছে। হঠাৎ ঝড় জল ছাপিয়ে কার যেন আর্তনাদ শোনা গেল। ওরা ছিল পাথরের সেই প্রাচীরের ওপর, আর আর্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছে নীচে উন্মত্ত সমুদ্র থেকে। নিশ্চয়ই ওই জাহাজের কোনো হতভাগ্য ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে এসেছে, সাহায্যের জন্য আকুল প্রার্থনা করছে। যারা উপস্থিত ছিল তারা যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। ওই দুর্যোগে উন্মত্ত সমুদ্রের বুক থেকে কাউকে উদ্ধার করার চেষ্টা আত্মহত্যার সামিল। কে নামবে ওই পিছল শিলাস্তূপ বেয়ে। মুখোমুখি হবে প্রচণ্ড ঢেউয়ের!

হঠাৎ এগিয়ে এল ডিসুজা। উপস্থিত সবার নিষেধ উপেক্ষা করে ও পাথর প্রাচীরের ধার ঘেঁষে নীচে নামতে শুরু করল। দিনের বেলা এবং সমুদ্রের অপেক্ষাকৃত শান্ত অবস্থায় বহুবার ও অন্যান্য জেলেদের সঙ্গে ওভাবে নীচে নেমেছে, জাল দিয়ে মাছ ধরেছে। কিন্তু এমন দুর্যোগময়ী রাতে এই তার প্রথম প্রচেষ্টা। একবার পা হড়কে পড়ে গেলেই সমুদ্র তাকে বুকে টেনে নেবে। ওই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড আর প্রচণ্ড ঢেউয়ের সঙ্গে যুঝবার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।

দুঃসাহসে ভর করে অনেকটা নীচে নেমে এল ডিসুজা। আবার মানুষের গলা শুনতে পেল সে। সাহায্যের জন্য যে আর্তনাদ করছে সে যেন খুব কাছেই আছে। সাবধানে নিজেকে বাঁচিয়ে যেদিক থেকে আর্তনাদ এসেছিল সেদিক লক্ষ করে ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভয় নেই, আমি একটা দড়ি ছুড়ে দিচ্ছি, তুমি ধরো ওটা।’

একটা মোটা পাকানো দড়ি সে ছুড়ে দিল শব্দ লক্ষ করে। বারকয়েক ওভাবে দড়িটা ছুড়ে দেবার পর ওর মনে হল কেউ যেন ধরেছে দড়ির অপর প্রান্তটা। সাহস দিয়ে ও বলে উঠল, ‘শাবাশ, শক্ত করে ধরে থাকো, আমি টেনে আনছি তোমাকে।’

দড়ি ধরে ও টানতে থাকে। দড়িটা যে ধরে আছে সে যে ওই টানে এগিয়ে আসছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। হঠাৎ মুহুর্মুহু গর্জে উঠল বিদ্যুৎ— তীব্র আলোর ঝলকানি। সেই আলোয় ডিসুজা দেখল লোকটি আর কেউ নয়, গোমেজ— ওর মনে হল গোমেজও তাকে দেখছে। আবাল্য বন্ধুকে দেখে আশার আলোয় ওর মুখটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ডিসুজা স্তম্ভিত। সে এখন কী করবে! উদ্ধার করবে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে! লছমিকে পাবার আশা চিরকালের মতো ত্যাগ করবে! লছমির মুখটা ভেসে উঠল ওর চোখের সামনে।

বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আবার নেমেছে মুষলধারে বৃষ্টি, গাঢ় অন্ধকারে ভরে গেছে পৃথিবী। দড়িটা হাত থেকে ছেড়ে দিল ডিসুজা, আর প্রচণ্ড ঢেউয়ে ভেসে গেল ওটা। সঙ্গেসঙ্গে ভেসে এল একটা করুণ আর্তনাদ। বিস্ময় হতাশায় মেশানো সেই আর্তনাদ তপ্ত শলাকার মতো এসে বিঁধল ডিসুজার কানে। দু-হাত দিয়ে দু-কান চেপে ধরল সে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের বেগ, আর ঢেউয়ের প্রচণ্ডতা। আর কিন্তু ভেসে এল না সেই আর্ত কণ্ঠের চিৎকার।

কেমন করে সে যে আবার উপরে উঠে এল তা নিজেই জানে না ডিসুজা। যেন একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে সেই মুহূর্তগুলো। উপরে আসতেই অনেকগুলো শক্ত বাহু এগিয়ে এল ওর সাহায্যের জন্য। ধরাধরি করে ওকে বসাল একটা শিলাখণ্ডের ওপর। ডিসুজা নিজেও জানল না, সেটা সেই শিলাখণ্ড, যার ওপর ওরা তিনজন বসেছিল এক অশুভক্ষণে।

উপস্থিত সকলের উদবিগ্ন প্রশ্নের জবাবে ক্লান্তকণ্ঠে সে বলল মানুষের আর্তনাদ ওটা নয়, বড়ো বড়ো শিলাখণ্ডের ফোকরে বাতাস ঢুকে অমন আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল। কথাটা সরল মনেই বিশ্বাস করল সবাই। বাতাসে সত্যিই অমন শব্দের সৃষ্টি হয়। সে বলল দড়িটা ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে।

নির্ঘাৎ মৃত্যু উপেক্ষা করে ও যে কারু প্রাণ বাঁচাবার আশায় অমন দুঃসাহসিক ঝুঁকি নিয়েছিল তার জন্যে ওর তারিফ করতে লাগল সবাই। টলতে টলতে বাড়ি ফিরল ডিসুজা।

পরদিন সকালে আশ্চর্যভাবে ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল, শান্ত হল সমুদ্র। ওই হতভাগ্য জাহাজটার কিন্তু চিহ্ন দেখা গেল না। কারু বুঝতে বাকি রইল না যে গতকাল রাত্তিরেই ওটার সলিলসমাধি ঘটেছে। সমুদ্রের ধারেপাশে কিন্তু কোনো মৃতদেহ পাওয়া গেল না। বোধ হয় জাহাজে আটকা পড়ে ওটার সঙ্গেই আরোহীরা সমুদ্রের গর্ভে চিরশয্যা গ্রহণ করেছে।

সেই ঘটনার পর ভীষণ একটা পরিবর্তন এল ডিসুজার। সে যেন উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেছে। দু-দিন বাড়ি থেকে বেরুল না সে। তৃতীয় দিন সে ঘরের দাওয়ায় চুপচাপ বসে ছিল, এমন সময় গ্রামেরই একজন এসে দাঁড়াল তার সামনে।

‘শহরে একটা খবর শুনে এলাম,’ লোকটি বলল। ‘তুমি শুনলে খুব দুঃখ পাবে, তবু তোমাকে না বলে পারছি না।’

ডিসুজা ভীষণ আতঙ্কে লোকটির মুখের দিকে তাকায়। তবে কি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে! তার কীর্তির কথা আর কি অজানা নেই!

‘তোমার ছোটোবেলার বন্ধু গোমেজ ওই জাহাজে আসছিল।’

বুকের ভেতর যেন হাপর পড়তে থাকে ডিসুজার।

‘বড়ো শহরে ছিট কাপড়ের ব্যাবসা করে ও নাকি অনেক টাকা করেছিল। টাকাপয়সা, জিনিসপত্তর নিয়ে ওই জাহাজে ও ফিরছিল। জাহাজটা ছোটো একটা মালটানা জাহাজ। যে কোম্পানির ওটা, তারা বলছে কেউ বাঁচেনি। তোমার ছোটোবেলার বন্ধু ছিল গোমেজ, তাই খবরটা শুনেই তোমাকে জানাতে ছুটে এসেছি।’

বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে ডিসুজা। সেটার অন্য অর্থ করে লোকটি, ভাবে বন্ধুবিয়োগের শোকে বিহ্বল হয়ে গেছে ও। সান্ত্বনা দেয় সে, বলে, ‘দুঃখ কোরো না, চিরকাল কেউ বাঁচে না, ওপারের ডাক যখন আসবে তখন যেতেই হবে সবাইকে— শুধু আগে আর পরে।’

ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওর কথা শোনে ডিসুজা।

নিজেকে সামলে আবার উঠে দাঁড়াল ডিসুজা। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। লছমিদের বাড়ি সে গেল। গোমেজ যে ওই জাহাজে আসছিল, জাহাজের সঙ্গে সেও তলিয়ে গেছে সমুদ্রের অতলে, তা গাঁয়ের কারো আর জানতে বাকি ছিল না। ডিসুজাকে দেখে গোমেজের কথা তুলে চোখের জল ফেলল লছমি। পরে চোখ মুছে বলল, ‘শুনলাম ওই রাত্তিরে তুমি নাকি নিজের জীবন তুচ্ছ করে কাকে যেন বাঁচাতে চেষ্টা করেছিলে?’

ডিসুজা চুপ করে থাকে। ওর মৌনতাকে বিনয়ের লক্ষণ মনে করে লছমি বলে ওঠে, ‘তোমরা দু-জনেই যদি আমাকে ফেলে পালাতে তবে কী নিয়ে থাকতাম আমি সারাজীবন!’

সপ্তদশী লছমির হঠাৎ যেন ঘটেছে রূপান্তর।

ডিসুজা ওর চোখে চোখ রাখল, তারপর বলল, ‘এবার আমাদের বিয়েতে আর কোনো বাধা নেই লছমি।’

লছমি চোখ নামাল, তারপর বলল, ‘কিন্তু গোমেজ যে সত্যিই ডুবে গেছে তার কোনো প্রমাণ নেই।’

‘হ্যাঁ, ডুবে গেছে, আমি জানি…,’ হঠাৎ থেমে যায় ডিসুজা।

লছমি অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি জান!’

‘না, মানে…জাহাজটা ডুবে গেছে, ওই জাহাজেই সে আসছিল, কেউ বাঁচেনি…’ একটু থতোমতো খেয়ে জবাব দিল ডিসুজা।

‘কিন্তু এও তো হতে পারে ও দূরে কোথাও ভেসে গেছে, হয়তো অসুস্থ হয়ে আছে,’ তর্কের সুরে বলল লছমি।

‘না…বেশ, তাও যদি হয়, তবে আজ এক মাস শেষ হচ্ছে, গোমেজের আর কোনো অধিকার নেই তোমার ওপর।’

‘তুমি মা-র সঙ্গে কথা বলো,’ লছমি মৃদুকণ্ঠে বলল।

‘তোমার ইচ্ছেটা জানতে চাই, লছমি।’

‘আমার চোখে তোমরা সবাই সমান,’ লছমি পাশ কাটাতে চায় প্রশ্নটা। ডিসুজা ঠোঁট কামড়ায়।

লছমির মা কিন্তু ডিসুজার সঙ্গে মেয়ের বিয়েতে আর অত গরজ দেখালেন না। জমি আর নৌকো বিক্রি করে ডিসুজার অবস্থা আর ভালো নয়, তার ওপর ওই ব্যাপারে ধারদেনাও তার হয়েছে যথেষ্ট। মেয়েকে তিনি জেনেশুনে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না। লছমির মায়ের লোভী মনের পরিচয় অনেক আগেই পেয়েছিল ডিসুজা। ভেতর ভেতর সে জ্বলে উঠল। মুখে বলল গোমেজের সঙ্গে দু-বছর আগে তার লেখাপড়া হয়ে আছে তাদের দু-জনের মধ্যে যে আগে মারা যাবে তার যদি বউ-ছেলে-মেয়ে না থাকে, তবে তার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক হবে অন্যজন। ডিসুজার কথা শুনে লছমির মা-র দু-চোখ চকচক করে ওঠে। তিনি জিজ্ঞেস করেন সেই কাগজ আদালত স্বীকার করবে কি না। ডিসুজা জানায় সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, পাশের ছোটো শহরের এক উকিল ভদ্রলোক সেটার মুসাবিদা করে দিয়েছিলেন।

তারপরই ঠান্ডা গলায় সে বলে ওঠে, ‘ওটা না থাকলেও শর্ত অনুযায়ী আমি এখন নিশ্চয়ই লছমিকে দাবি করতে পারি। আমি আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি, শুধু লছমির মুখ চেয়েই করেছি। আর নয়। আপনি যদি এই বিয়েতে ওজর আপত্তি তোলেন তবে তার পরিণাম ভালো হবে না জেনে রাখবেন।’

ডিসুজার বরফ-ঠান্ডা সেই গলায় চমকে উঠলেন লছমির মা, ভয় পেলেন তিনি। বুঝলেন আর বাড়াবাড়ি না করে ওর সঙ্গেই লছমির বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি দিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল।

দুর্যোগময়ী সেই রাতের ঠিক এক সপ্তাহ বাদে ঠিক হল বিয়ের দিন। তার আগের দিন বিকালে ডিসুজা লছমিকে নিয়ে বেড়াতে বেরুল। হাঁটতে হাঁটতে নির্জন সমুদ্রতীরে ওরা এল, বসল সেই পরিচিত শিলাখণ্ডের উপর। পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে ঝলমল করছে।

জোয়ার এসেছে সমুদ্রে, দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে ঢেউ। বাসুকির মতো সহস্র ফণা তুলে যেন ছোবল মারছে উপলখণ্ডে। হঠাৎ কোথা থেকে এক টুকরো কালো মেঘ ছুটে এসে ঢেকে ফেলল চাঁদকে, বাতাসের মতিগতি বদলে গেল মুহূর্তে। খেপা ষাঁড়ের মতো যেন তেড়ে আসছে ঝোড়ো বাতাস।

হঠাৎ লছমি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘কে, কে ওখানে?’

ডিসুজা চমকে উঠল তার গলার স্বরে। দু-পাশে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘কী হল লছমি, কেউ তো নেই!’

‘আমার…আমার…যেন মনে হল…গোমেজ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে,’ সমস্ত শরীর কাঁপছে লছমির। ‘ওর দু-চোখে কী ভীষণ দৃষ্টি!’

ডিসুজার মনে হল তার হৃৎপিণ্ডে কেউ যেন একটা ছোরা আমূল বসিয়ে দিল। প্রাণপণে নিজেকে সংযত করে সে বলল, ‘তোমার চোখের ভুল, লছমি, গোমেজ এখন সমুদ্রের তলায় ঘুমাচ্ছে।’

লছমির ভয় কিন্তু তবু গেল না, থরথর করে ও কাঁপছে, দু-চোখ বিস্ফারিত। ডিসুজা ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে চলল। পেছনে সমুদ্র যেন ক্রমেই অশান্ত হয়ে উঠছে, পুরো আকাশটাই ছেয়ে গেছে কালো মেঘে— তুফানের পূর্বলক্ষণ। রাত্রে দু-চোখ এক করতে পারল না ডিসুজা। সারারাত বৃষ্টি হল। ঝড়ের দাপটও কম ছিল না। ভোর না হতেই জাদুমন্ত্রবলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল, ঝলমল করে উঠল সূর্য, প্রসন্ন বরাভয়।

বিয়ের সময় সকাল সাতটায়। ডিসুজা নতুন পোশাক পরে কয়েকজন গ্রামের লোকের সঙ্গে গির্জের দিকে রওনা দিল। রাত্রি জাগরণে তার চোখের নীচে কালি পড়েছে, মুখটা ঝুলে পড়েছে একটু। লছমি কনের পোশাকে মা আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে গির্জেয় এসেছে। সাদা পোশাকে লছমিকে দেখতে লাগছে জুঁই ফুলের মতো, কিন্তু যেন বৃষ্টিঝরা বিষণ্ণ জুঁই ফুল। লছমির ভালো ঘুম হয়নি রাত্তিরে, চমকে চমকে জেগে উঠেছে। স্বপ্নে বার বার গোমেজ দেখা দিয়েছে, শুধু নীরবে তাকিয়ে থেকেছে দু-চোখ মেলে। সেই দৃষ্টিতে যেন তীব্র ভর্ৎসনা। স্বপ্নের মধ্যে ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠেছে লছমি, একবার কেঁদেও উঠেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

গির্জের যিনি পাদরি তিনি ওদের বিয়ের মন্ত্র পড়ালেন, ঢং ঢং করে বেজে উঠল গির্জের ঘণ্টা, ঘোষণা করল শুভ অনুষ্ঠানের। হাসি ফুটে উঠল ডিসুজার মুখে। সত্যিই সে আজ পেয়েছে লছমিকে, এখন থেকে ও তার জীবনসঙ্গিনী— গোমেজের আর কোনো অধিকার নেই লছমির ওপর।

ওই গ্রামে বহুকাল ধরে একটা নিয়ম চালু ছিল। বিয়ের পর বর-কনেকে যেতে হবে সমুদ্রের ধারে, উৎসর্গ করতে হবে ফুল আর কিছু খাবার সমুদ্রকে। বোধ হয় সমুদ্র-দেবতাকে তুষ্ট রাখার জন্যই এই প্রথা চালু হয়েছিল সেই কোন যুগে, আজও তা ভক্তিভরে মেনে চলে গ্রামের লোক— খ্রিস্টান -অখ্রিস্টান ভেদাভেদ নেই।

ডিসুজা আর লছমি তাদের লোকজনের সঙ্গে হেঁটে চলেছে সমুদ্রের ধারে, উৎসর্গ করতে পূজার নৈবেদ্য। সার বেঁধে চলেছে তারা, বর আর কনে মিছিলের পুরোভাগে, পেছনে আসছে অন্যরা, আর কিছু উৎসুক ছেলেছোকরা। গত দুর্যোগের চিহ্ন চোখে পড়ে আশেপাশে, অশান্ত সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে এসেছে কত কী!

তারা এগিয়ে চলেছে; আর একটা বাঁক নিলেই এসে পড়বে সমুদ্রের ধারে, মৃদুস্বরে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল ডিসুজা আর লছমি। বাঁকটা পেরিয়েই তারা থমকে দাঁড়াল। বিস্ফারিত হয়ে উঠল তাদের দৃষ্টি, তারপরই তীক্ষ্ন আর্তনাদ করে উঠল নতুন কনে।

তাদের মাত্র ক-হাত দূরে সেই প্রকাণ্ড শিলাখণ্ডটা, যেখানে একদিন ভাগ্যনির্ণয় করতে এসেছিল তিনটি মিলনোন্মুখ প্রাণী। আর সেই মস্ত পাথরের চাঁইয়ের উপর উপুড় হয়ে আছে গোমেজের দেহ, যেন শুয়ে আছে। শরীরটা ফুলে উঠেছে, কিন্তু চোখ দুটো খোলা, যেন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। সে-দৃষ্টিতে ঝরে পড়ছে তীব্র ঘৃণা আর ভর্ৎসনা। বাঁ-হাতটা ঝুলছে আলগা ভাবে, আর ডান হাতটা প্রসারিত সামনের দিকে, যেন হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে লছমিকে লক্ষ করে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে সবাই।

জ্ঞানহারা লছমির দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই ডিসুজার। সে তখন পাথর হয়ে গেছে, আর বিড়বিড় করে কী সব বলছে।

আজও সেই গ্রামে সমুদ্রের ধারে এক পাগলকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। মাথায় তার রুক্ষ জটা, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। বিড়বিড় করে সে বলে, ‘আমি তো দড়িটা ছেড়ে দিয়েছিলাম, তুই ভেসে গিয়েছিলি, তবে আবার ফিরে এলি কেন!’

আর লছমি! দারুণ মানসিক আঘাতে সে মূক হয়ে গেছে, বোবা হয়ে গেছে চিরদিনের মতো। কালো মেঘবরণ তার চুল ওই একদিনের ঘটনায় শনের মতো সাদা হয়ে গেছে, মুখে নেমে এসেছে অকাল বার্ধক্য। ঘরের দাওয়ায় স্তব্ধভাবে সে বসে থাকে। সমুদ্রে যখন ঝড় ওঠে, অশান্ত হয়ে ওঠে ঢেউ, তার দু-চোখে ফুটে ওঠে তাড়া খাওয়া হরিণীর মতো দিশেহারা দৃষ্টি-গভীর আতঙ্ক নেমে আসে দু-চোখের তারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *