অয়েল পেন্টিং

অয়েল পেন্টিং

ছোট্ট স্টেশন, গাড়ি মাত্র আধ মিনিট দাঁড়ায়। কমলাক্ষ বোস এক হাতে হোলড অল আর অন্য হাতে সুটকেসটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। স্টেশনের কাছেই একটা হোটেল, কোনোমতে মাথা গুঁজবার একটা আস্তানা। আজ রাতের মতো তিনি ওখানেই কাটাবেন, কাল সকালেই তাঁর ভাড়া করা বাড়িতে চলে যাবেন। বাড়ি বললে অবশ্য ভুল করা হবে, ছোটোখাটো একটা প্রাসাদ। নদীর তীরে নির্জন এই প্রকাণ্ড বাড়িটা দেখে গতবার তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। তবে বাড়িটা অনেকদিনের পুরোনো, জীর্ণ, অনেকদিন ধরেই কেউ ওখানে বাস করে না। নির্জন পরিবেশে ভূতুড়ে বাড়ি বলে ভ্রম হওয়াটা বিচিত্র নয়।

আগে এই বাড়িটা নাকি জমিদার বাড়ি ছিল, তাঁদের অনেক কীর্তিকাহিনি এখনও লোকমুখে শোনা যায়। বাড়ির বর্তমান যাঁরা মালিক, তাঁরা অনেকদিন এখানকার পাট চুকিয়ে শহরে বাস করছেন। এক বুড়ো সাঁওতাল বাড়িটা দেখাশোনা করে তবে রাত্রে থাকে না।

বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করে একমাসের জন্য একটা ঘর ভাড়া চাইতেই তিনি তাঁর দিকে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে, ষাট তো হবেই, কিন্তু এখনও বলিষ্ঠ চেহারা, আভিজাত্যের ছাপ চেহারায় ফুটে উঠেছে। ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেছিলেন, ‘একটা ঘর কেন, আপনাকে আমি গোটা বাড়িটাই নামমাত্র মূল্যে ভাড়া দিতে পারি, কিন্তু আমার উপদেশ যদি শোনেন তবে আপনার ও বাড়িতে রাত না কাটানোই মঙ্গল।’ কমলাক্ষ ভদ্রলোকের কথায় বিস্মিত হয়েছিলেন, কারণ জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভদ্রলোক আর কিছু ভেঙে বলেননি। যাই হোক, কমলাক্ষর নাছোড়বান্দা ভাব দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত বাড়ির চাবি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন চিনিবাস, অর্থাৎ যে বুড়ো সাঁওতালের তত্ত্বাবধানে বাড়িটা আছে, তাকেও তিনি খবর পাঠিয়ে দেবেন।

একটা বিশেষ কারণেই এই বাড়িটা কমলাক্ষর খুব পছন্দ হয়েছিল। বাংলা দেশের পাঠক-পাঠিকার কাছে কমলাক্ষর নাম একটা শিহরন আনে। রহস্য গল্পের স্রষ্টা রূপে তিনি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের অবতারণা করেছেন বললে অত্যুক্তি করা হবে না। গোয়েন্দা গল্প তিনি লেখেন না, তাঁর উপজীব্য হল ভৌতিক, ভয়াল, বিভীষিকাপূর্ণ গল্প ও কাহিনি। প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য, তাই পৈশাচিক কাহিনি রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। ইংরেজিতে ‘ড্রাকুলা’ কাহিনির মতো তাঁর গল্প, কাহিনিও পাঠক-পাঠিকাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে, রোমাঞ্চ ও ভয়ে তাদের লোম খাড়া হয়ে ওঠে, কিন্তু তবু রুদ্ধনিশ্বাসে পড়া চাই। এইসব বিশেষ ধরনের ‘হরর’ (horror) স্টোরি লেখার জন্য বিশেষ পরিবেশ না হলে চলে না। কমলাক্ষ প্রতিটি গল্প ও কাহিনি লেখার আগে তাই উপযুক্ত পরিবেশের সন্ধানে বেরুতেন। নির্জন ভৌতিক পরিবেশে এ ধরনের গল্প যত রসোত্তীর্ণ হয় তা শহরের কোলাহলের মধ্যে সম্ভব নয়। তাঁর শেষ বই রাতের আতঙ্ক প্রকাশিত হবার পর তিনি নিরালায় দিনকয়েক পরিপূর্ণ বিশ্রামের আশায় এখানে এসেছিলেন।

এসেছিলেন বললে ভুল হবে, ট্রেনে যেতে যেতে বীরভূম জেলার এই ছোট্ট স্টেশনটি তাঁকে হাতছানি দিয়ে নামিয়ে আনে। অল্প ক-দিন এখানে ছিলেন তখনই জমিদার বাড়িটা তাঁকে আকর্ষণ করে। ছোট্ট জায়গা, পথে ঘাটে সাঁওতালই বেশি চোখে পড়ে। সুন্দর, পরিষ্কার জায়গাটি, ছড়ানো ঘরবাড়ি, তারই মধ্যে জমিদার বাড়িকে কেন্দ্র করে এক বিপুল নির্জনতা। রহস্য গল্প লেখার পক্ষে চমৎকার পরিবেশ। কমলাক্ষ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির মালিকের সন্ধান পেতেও যেমন তাঁর বেগ পেতে হয়নি তেমন উত্তরদাতাদের মুখেও একটা বিচিত্র ভাবান্তর লক্ষ না করে তিনি পারেননি; তবে তখন ভেবেছিলেন হয়তো সেটা তাঁর মনের ভুল।

পরদিন সকালে একটা সাইকেল রিকশায় মাল চাপিয়ে তিনি তাঁর গন্তব্যস্থল অভিমুখে যাত্রা করলেন। রিকশাওয়ালাকে প্রথমে তিনি কোথায় যাবেন বলেননি, দরকারও মনে করেননি। রিকশা চলতে শুরু করলে সে যখন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাল তখনই তিনি তাকে কোথায় যেতে হবে বললেন। রিকশাওয়ালার পা দুটো থেমে গেল, রিকশাও দাঁড়িয়ে গেল। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালা বলল, ‘বাবু, এখানে থাকবেন কোথায়? আমি এখানে তিরিশ বছর আছি, কখনো কাউকে ও বাড়িতে থাকতে দেখিনি। তা ছাড়া…,’ সে যেন থেমে গেল। ‘তা ছাড়া কী?’ কমলাক্ষ একটু কৌতুকের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলেন। ‘রেতে ওই বাড়িতে ওনাদের আবিভ্যাব হয়।’

কমলাক্ষ বুঝলেন রিকশাওয়ালা কাদের কথা বলতে চাইছে। তিনি হেসে বললেন, ‘ভালোই তো, তেনাদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে।’ রিকশাওয়ালা আর কথা বাড়াল না, নিঃশব্দে প্যাডেল করতে লাগল। সেই বিজন ভবনের সামনে রিকশা এসে দাঁড়াল। একজন বুড়োমতো লোক এগিয়ে আসতেই কমলাক্ষ বুঝতে পারলেন সে-ই চিনিবাস। চিনিবাস অনেকটা হেঁট হয়ে দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে তাঁকে নমস্কার জানাল, তারপর মালপত্র নামিয়ে নিল।

চিনিবাসের কাছেও বাড়ির একটা চাবি ছিল। সে আগেই সামনের বড়ো হল ঘরটা ঝাড়-পুঁছ করে রেখেছিল। কমলাক্ষ ঘুরে ফিরে দেখলেন সাবেকি জমিদার বাড়ির মতোই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘর ও মহল নিয়ে বাড়িটা তৈরি। বহুদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে চুন-বালি খসে পড়েছে। এখানে ওখানে ফাটল ধরেছে। জমিদার বাড়ির পেছনে একটা খরস্রোতা নদী চারপাশের নির্জনতাকে যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

চিনিবাসের সঙ্গে ব্যবস্থা হল সে দিনের বেলা রান্না করবে আর রাত্রের রান্নাটা সন্ধের আগেই করে চলে যাবে। সাঁওতাল পল্লিতে নিজের লোকজনের সঙ্গে সে বাস করে, এখানে রাত কাটানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কমলাক্ষর কেন জানি ধারণা হল বাড়িতে কেউ না থাকলেও সে এখানে রাত্রে থাকত না। সাঁওতালরা সাধারণত খুব বিশ্বস্ত ও সাহসী হয়। চিনিবাস অবশ্য বুড়ো হয়েছে, তবে বেশ শক্ত, সমর্থ। সত্যিই কি এই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব আছে! কমলাক্ষ মনে মনে হাসলেন, ভৌতিক পরিবেশে তাঁর ভয়াল কাহিনির বুনিয়াদ ভালোই হবে। তিনি একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে সিগারেট ধরালেন।

দুপুরের খাওয়া সেরে তিনি টানা এক ঘুম দিলেন। রাত জেগে লেখাই তাঁর বরাবরের অভ্যেস; রাত্রের নির্জনতা, গা ছমছমানি, এসব না থাকলে কি আর হরর স্টোরি লেখা যায়! ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। চিনিবাস ইতিমধ্যেই তার রান্নার কাজ শেষ করে ফেলেছে। সে এসে তাঁর সামনে দাঁড়াল, যেন কিছু বলতে চায়। তিনি জিজ্ঞাসু নয়নে তার দিকে তাকালেন। চিনিবাস একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বাবু তু এখান থিক্যা চল্যা যা।’ কমলাক্ষ বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করলেন কেন সে ওকথা বলছে। চিনিবাস যা বলল তার মর্মার্থ হল, ছোটোবেলা থেকে সে এই বাড়ির নুন খেয়েছে তবু বাবুকে কথাটা না বলে পারছে না। এখন যিনি এই বাড়ির মালিক তাঁর বাবা অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন, তাই তাঁর কাকা জমিদারি দেখাশোনা করতেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার। তাঁর নিষ্ঠুরতার সীমা ছিল না। তাঁর রক্তে ছিল খুনের নেশা, কম করেও দশ পনেরোজন প্রজাকে তিনি নিজের হাতে হত্যা করেছিলেন। মানুষকে যন্ত্রণা দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে তিনি পরম আনন্দ উপভোগ করতেন। শেষ পর্যন্ত ঘাতকের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এক বর্ষার রাতে কে বা কারা তাঁকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। লাশ বাড়ির পেছনে নদীর ধারে পড়ে ছিল, ক্ষতবিক্ষত সেই দেহটা চেনবার উপায় পর্যন্ত ছিল না। তারপর থেকেই এই বাড়িতে নানা উপদ্রব শুরু হয়। এই কারণেই সবাই এ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় এবং তারপর থেকেই কেউ এখানে রাত্রিবাস করেনি।

কমলাক্ষ চিনিবাসকে আশ্বস্ত করে বললেন যে ভূতের ভয়টয় তাঁর নেই, চিনিবাস নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যেতে পারে। চিনিবাসের বোধ হয় কথাটা মনঃপূত হল না; সে কমলাক্ষকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু কমলাক্ষ হাত তুলে তাকে নিরস্ত করলেন।

চিনিবাস বিদায় নেবার পর কমলাক্ষ বেরিয়ে পড়লেন, গতবার যখন এসেছিলেন তখন স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল, তাঁর ওখানেই গেলেন। ভদ্রলোক তাঁকে দেখে অবাক। পরে সব শুনে বললেন, ‘করেছেন কী মশাই, এত বাড়ি থাকতে শেষে ওই ভূতের বাড়ি ভাড়া নিলেন। আমাকে লিখলেই তো পারতেন, আপনার মতো বিখ্যাত লোকের অতিথি সেবা করে আমি ধন্য হতাম।’ কমলাক্ষ মৃদু হেসে তাঁর আসল উদ্দেশ্য খুলে বললেন, বাড়িঠার পরিবেশ যে তাঁর কাহিনির পক্ষে আদর্শ তাও বললেন। ভদ্রলোক কিন্তু খঁ%ত খঁ%ত করতে লাগলেন। বিদায় দেবার মুখে তিনি কমলাক্ষর হাতে ছোটো ফ্রেমে বাঁধানো একটি কালী মূর্তি গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘দয়া করে আমার একটা কথা রাখুন, এটা হাতছাড়া করবেন না।’ কমলাক্ষ তাঁর আন্তরিকতায় অভিভূত হলেন, ছবিটা পকেটে ভরে নিলেন।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। মা কালীর ফটোটা তিনি টেবিলের একপাশে সরিয়ে রাখলেন। লিখতে লিখতে তিনি মশগুল হয়ে গেলেন। চমৎকার এক প্লট, তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক-পাঠিকারা পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে যাবে, আতঙ্কে শিউরে উঠবে। তিনি লিখে চলেছেন—

‘গভীর রাত্রি। নির্জন কুঠিবাড়িতে অনঙ্গ একটা ভূতুড়ে গল্পে ডুবে আছে হঠাৎ তার মনে হল ঘরের আবহাওয়াটা কেমন যেন বদলে গেছে, একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ তাকে ঘিরে ক্রমশই যেন জমাট হয়ে উঠছে। একটা অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে সে মুখ তুলে সামনের খোলা জানলার দিকে তাকাল আর পরমুহূর্তে তার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। জানলার চৌকাঠের ওপর একটা হাত, কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন একটা কাটা হাত, সোজা হয়ে আছে। কেউ হাতের তালুতে চিবুক রাখলে হাতটা যে অবস্থায় থাকে অনেকটা সেইরকম। যেন অদৃশ্য অশরীরী কেউ ওইভাবে তাকে লক্ষ করছে। তাকে মুখ তুলতে দেখেই হাতটা আস্তে আস্তে নেমে এল। একটা ভীষণ আতঙ্কে অনঙ্গর বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল। হাতটা আস্তে আস্তে খুব সন্তর্পণে, তার দিকে এগিয়ে আসছে। বিছের মতো ভঙ্গিতে হাতটা এগুচ্ছে।’

এই পর্যন্ত লিখেই কেন জানি না কমলাক্ষ মুখ তুললেন আর সঙ্গেসঙ্গে নিজেও চমকে উঠলেন। তাঁর থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে মাটির ওপর একটা অস্বাভাবিক বড়ো কালো রঙের পেঁচা তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে পেঁচার চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে। মস্ত ঘরটায় মাত্র একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন, ঘরটাকে অন্ধকারই বলা চলে। প্রথম ভয়ের ধাক্কাটা কেটে যেতেই কমলাক্ষর ভীষণ হাসি পেল। তিনি দু-একবার মুখ দিয়ে হুস হুস শব্দ করলেন কিন্তু পেঁচাটার যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। এবার তিনি একটু বিরক্তি বোধ করলেন। টেবিলের ওপর থেকে ছাইদানিটা তুলে নিয়ে তিনি ওটাকে লক্ষ করে ছুড়লেন কিন্তু আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পেঁচাটা সেটাকে এড়িয়ে গেল। কমলাক্ষ আর বসে থাকতে পারলেন না, একটা লাঠি হাতে নিয়ে পেঁচাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। এবার কিন্তু আর ওখানে বসে থাকা নিরাপদ বোধ করল না, উড়ে বিরাট ঘরটার উত্তর কোণে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

কমলাক্ষ চিন্তার খেইটা যেন হারিয়ে ফেলেছেন। মনে মনে পেঁচাটাকে অভিসম্পাত দিয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন। একটা পুরোনো পালঙ্কেই চিনিবাস তাঁর শোবার ব্যবস্থা করেছিল। বিছানা পেতে মশারিটাও টাঙিয়ে দিয়েছিল। শোবার সঙ্গেসঙ্গেই ঘুম এল না, মাথাটা যেন গরম হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। আচমকা তাঁর ঘুমটা ভেঙে গেল। ঘরের মধ্যে আবহাওয়াটা যেন বদলে গেছে, কেমন যেন একটা ভীতিপ্রদ পরিবেশ। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। সেই আলোয় হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল মাথার বাঁ-দিকে পালঙ্কের বাজুর ওপর আর সঙ্গেসঙ্গে তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। বাজুর ওপর পেঁচাটা বসে আছে। ওটার বাঁকানো নাক, জ্বলজ্বল চোখ, তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। তাঁকে উঠতে দেখেই পেঁচাটা উড়ে মাটিতে বসল। কমলাক্ষ মশারি তুলে বেরিয়ে এসে ওটাকে তাড়া করলেন আর সঙ্গেসঙ্গে ওটাও উড়ে আগেরবারের মতো সেই একই জায়গা দিয়ে অদৃশ্য হল। কমলাক্ষ ভাবলেন ওখানে বোধ হয় কোনো ফাটল কিংবা ফোকর আছে। পেঁচাটা হয়তো পরিত্যক্ত এই বাড়িটাতে একা সুখে রাজত্ব করছিল আর ওই ফোকরেই তার আস্তানা, হঠাৎ মানুষের অবাঞ্ছিত আবির্ভাব সে সুনজরে দেখছে না তাই নীরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

কমলাক্ষ আবার শুয়ে পড়লেন। মুখের ওপর রোদ পড়ায় তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। অনেক বেলা হয়ে গেছে, বাইরে রোদ ঝলমল করছে। তিনি দরজা খুলে বাইরে এলেন। চিনিবাস এসে গেছে, তাঁকে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় দেখে সে যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কমলাক্ষ মনে মনে হাসলেন, ভূত না মুন্ডু, সব কুসংস্কার। মুখ ধুয়ে তিনি স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানালেন। এসব জিনিস তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। চা আর বিস্কুট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। পথেই দেখা তাঁর পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি তাঁর খোঁজ নিতে এদিকেই আসছিলেন। তাঁকে দেখে ভদ্রলোকের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কমলাক্ষ বললেন, ‘দেখছেন তো, বহাল তবিয়তে আছি, ভূত আমার ঘাড় মটকায়নি।’ ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, ‘আমিও মনে প্রাণে তাই চাইছি।’ কথায় কথায় কমলাক্ষ তাঁর রাতের অভিজ্ঞতা বললেন। পেঁচার কথা শুনেই ভদ্রলোকের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, তিনি বললেন, ‘কালো পেঁচা, লক্ষণ ভালো নয়।’ কমলাক্ষ একটু কৌতূহলী হয়ে ভদ্রলোকের ওকথা বলার কারণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কালো পেঁচা অলুক্ষণে, মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়।’ কমলাক্ষ হো হো করে হেসে উঠলেন।

সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি আবার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে বসলেন। বিভোর হয়ে তিনি লিখছেন, কলম সাদা কাগজের বুকে খস খস করে কালির আঁচড় টেনে চলেছে। হঠাৎ একটা ভয়ানক অস্বস্তিতে তিনি মুখ তুললেন আর সঙ্গেসঙ্গে পেঁচাটার জ্বলজ্বলে চোখের ওপর তার দৃষ্টিটা স্থির হয়ে গেল। কালকের মতো আজও ওটা মাটিতে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একটা খল, ত্রূর দৃষ্টি, কমলাক্ষর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই সাহস সঞ্চয় করে তিনি হাতের কাছে রাখা লাঠিটা সজোরে ওটার দিকে ছুড়ে মারলেন। লক্ষ্য তাঁর ঠিকই হয়েছিল, কিন্তু পেঁচাটা ঠিক সময় দু-পায়ে লাফিয়ে সরে গেল আর লাঠিটা সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ল। তিনি উঠে লাঠিটার দিকে যেই এগুবেন অমনি পেঁচাটা গতকালের মতো উড়ে সেই একই জায়গায় অদৃশ্য হয়ে গেল। কমলাক্ষ মনে মনে ঠিক করলেন দিনের আলোয় ওই জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখবেন। লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে তিনি আবার লিখতে বসলেন। রাত যখন দুটো তখনও তাঁর দ্রুত কলম চলছে, হঠাৎ তাঁর মনে হল কেউ যেন অলক্ষ্য থেকে তাঁকে দেখছে। তিনি মুখ তুললেন কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না। তিনি আবার লিখতে শুরু করলেন কিন্তু মনটা যেন খচ খচ করতে লাগল। তিনি আবার মুখ তুললেন। না, কিছু নেই। নিশ্চিন্ত হবার জন্য তিনি লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। ঘরের উত্তর কোণে যেখান দিয়ে পেঁচাটা অদৃশ্য হয়েছিল সেখানে উঁচু দেওয়ালে একটা বড়ো অয়েল পেন্টিং টাঙানো রয়েছে। ঘরের দেয়ালে অবশ্য আরও কয়েকটা বড়ো বড়ো অয়েল পেন্টিং আছে। চিনিবাসের কাছে তিনি শুনেছিলেন ওগুলো নাকি পূর্বতন জমিদারদের ছবি। উত্তর কোণের অয়েল পেন্টিংটার সামনে আসতেই স্তিমিত আলোয় তাঁর চোখ পড়ল পেঁচাটা ওপরে বাঁধানো ফ্রেমের ওপর বসে তাঁকে যেন ব্যঙ্গ করছে। পরমুহূর্তে সেটা আলেখ্যের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল। কমলাক্ষ বুঝলেন ছবিটার পেছনেই ওটার আস্তানা। মনে মনে তিনি ভাবলেন, দাঁড়াও বাছাধন, কাল তোমাকে ওখান থেকে দূর করছি। আর রাত না জেগে তিনি শুয়ে পড়লেন। সেরাতে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটল না।

পরের দিন সকালে বেড়াতে বেরিয়ে তিনি একটা টর্চ কিনলেন। শুধুমাত্র লণ্ঠনের ভরসায় না থাকাই ভালো, তা ছাড়া হাতের কাছে টর্চ খুব কাজে দেয়। পেঁচার বাসাটা নির্মূল করার কথাটা দিনের আলোয় তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। হঠাৎ মনে পড়ায় তিনি একটা টেবিল ও চেয়ার অয়েল পেন্টিংটার তলায় টেনে আনলেন, তারপর টেবিলের ওপর চেয়ারটা পেতে লাঠি হাতে চেয়ারে দাঁড়ালেন। লাঠি দিয়ে ছবির পেছনে খোঁচা মেরে, এমনকী ছবিটা খুলে ধরেও কিন্তু তিনি পেঁচাটার দেখা পেলেন না। তিনি একটু আশ্চর্যই হলেন, কারণ পেঁচা দিনের বেলা দেখতে পায় না, তাই ওর আস্তানা ছেড়ে কোথায় গেল? একটা অকারণ অস্বস্তিতে তাঁর মন ভরে গেল আর ঠিক এই সময় তাঁর চোখ পড়ল আলেখ্যর ওপর। তিনি ওটার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। ছবির মুখটা যেন তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে। কী হিংস্র, নিষ্ঠুর দৃষ্টি, তিনি শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। একটা সদেহ, একটা আবছা আবছা আকার যেন তাঁর মনের মধ্যে রূপ নেবার চেষ্টা করছে। অবিকল ওই দৃষ্টি তিনি যেন কোথায় দেখেছেন। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তিনি চমকে উঠলেন। মনে পড়েছে, গতকাল রাত্রে পেঁচাটার দু-চোখে ওই একই দৃষ্টি তিনি লক্ষ করেছিলেন, পেঁচার মুখের সঙ্গে ছবির মুখের কোথায় যেন একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য। মন থেকে তিনি এই চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলেন। তাঁরও কি মতিভ্রম হল! বাইরে এসে চিনিবাসকে তিনি ওই আলেখ্যটা কার জিজ্ঞেস করলেন। চিনিবাস তাঁর দিকে কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর জানাল ওটাই হল সেই কুখ্যাত জমিদারের ছবি, যিনি খুন হবার পর থেকেই এই বাড়িতে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়। কথা শেষ করে চিনিবাস প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘বাবু, এখনও সময় আছে বটে, তু পালায়ে যা।’

সেদিন সন্ধ্যা থেকেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল, রাত ন-টা থেকে নামল মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানি। কমলাক্ষ ঠিক করলেন আজ রাতে আর ঘুমুবেন না, যতটা পারবেন লিখবেন। এই দুর্যোগের রাতে ঘুম আসবেও না। গভীর রাত্রে সেই একই বিচিত্র অনুভূতি আর অস্বস্তিতে তিনি মুখ তুলে দেখলেন পেঁচাটা কুটিল চোখে তাকিয়ে আছে। আজ তিনি প্রস্তুত হয়েই বড়ো বড়ো কয়েকটা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলেন। একটা টুকরো তিনি পেঁচাটাকে লক্ষ করে ছুড়ে মারলেন আর ওটাও লাফ মেরে সরে গেল। কমলাক্ষ আজ যেন খেপে গেছেন, একটার পর একটা পাথরের টুকরো তিনি ছুড়তে লাগলেন আর পেঁচাটাও অসাধারণ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেগুলো এড়াতে লাগল। হঠাৎ একটা টুকরো পেঁচাটার মুখে সজোরে আঘাত করল আর ওটা চিৎকার করে উঠল। তীক্ষ্ন অথচ কর্কশ কণ্ঠের ধ্বনি ঝড়বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে একটা ভয়াবহ আর্তনাদের মতো শোনাল। কমলাক্ষ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন, ঠিক যেন মানুষের মতো চিৎকার, কিন্তু পৈশাচিক। পরমুহূর্তে পেঁচাটা শূন্যে লাফিয়ে তাঁর দিকে দুরন্ত আক্রোশে তেড়ে এল। কমলাক্ষ পাশে রাখা মোটা লাঠিটা দু-হাতে ধরে অন্ধের মতো শূন্যে চালাতে লাগলেন। পেঁচাটা কয়েকবার হিংস্রভাবে তাঁর মাথার ওপর চক্কর দিয়ে আবার সেই উত্তর কোণে উড়ে গেল, অন্ধকারে আর ওটাকে দেখা গেল না।

কমলাক্ষ কয়েক মিনিট নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি যেন বোবা হয়ে গেছেন। তাঁর সর্বাঙ্গ দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে। একটু ধাতস্থ হতেই কী মনে করে টর্চটা হাতে নিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন তারপর উত্তর কোণের দেয়ালে ঝুলন্ত অয়েল পেন্টিংটার ওপর আলো ফেললেন। আলোটা ছবির মুখের ওপর পড়তেই তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন, তাঁর পা দুটো যেন কেউ মাটির সঙ্গে স্ক্রু দিয়ে আটকে দিয়েছে। ছবিটা যেন কদর্য ঘৃণা নিয়ে তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে আর ছবির মুখে, নাকের পাশ দিয়ে রক্তের মতো একটা ক্ষীণ রেখা নেমে এসেছে, উজ্জ্বল আলোয় কমলাক্ষ স্পষ্ট সেটা দেখতে পেলেন। হতবুদ্ধির মতো তিনি টেবিলের কাছে ফিরে এলেন, তাঁর জ্ঞান বুদ্ধির অগম্য এই অদ্ভুত ঘটনা তাঁকে যেন পঙ্গু করে ফেলেছে। জীবনে এই প্রথম তিনি ভয় কাকে বলে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন।

কতক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন খেয়াল নেই, বাইরে বৃষ্টির দাপট যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একবার ভাবলেন এই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করেই তিনি বেরিয়ে পড়েন, এই ভূতুড়ে পরিবেশে আর এক মুহূর্তও না। মনের ইচ্ছেটা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠল। এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে লাঠিটা তুলে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলেন আর ঠিক সেইসময় তাঁর চোখে পড়ল কয়েক হাত দূরে মাটিতে বসে থাকা পেঁচাটার ওপর। তীক্ষ্ন দৃষ্টি দিয়ে ওটা তাঁকেই লক্ষ করছে, যেন তাঁর মনের ভাব ওর অজানা নেই। একটা দারুণ ব্যর্থতা আর অবসাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলল, হতাশায় তাঁর মন ভরে গেল। পরক্ষণেই তিনি গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, না, এত সহজে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন না, শেষ পর্যন্ত দেখবেন। লাঠি হাতে আবার তিনি পেঁচাটাকে তেড়ে গেলেন, ওটাও উড়ে ওপরে উঠল, কিন্তু এবার আর স্বস্থানে অদৃশ্য হল না, একটা জানলার পাল্লার ওপর বসে তাঁর হাবভাব লক্ষ করতে লাগল। কমলাক্ষ আর ওটাকে তাড়া করলেন না, পায়ে পায়ে ছবিটার দিকেই এগিয়ে গেলেন। ছবিটা যেন চুম্বকের মতো তাঁকে আকর্ষণ করছে। ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি আবার টর্চের বোতাম টিপলেন তারপর অয়েল পেন্টিংটার দিকে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইলেন।

দেয়ালে শুধু শূন্য ফ্রেমটা ঝুলছে, ভেতরে ছবিটা যেন জাদুমন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়েছে। একটা তীক্ষ্ন বিদ্রূপাত্মক হাসির শব্দে তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন, হাসির শব্দটা আসছে পেঁচাটা যেখানে বসে ছিল সেদিক থেকেই। তিনি যন্ত্রচালিতের মতো এগিয়ে গেলেন। পেঁচাটাই কি মানুষের মতো হাসছে! তিনি বিহ্বল দৃষ্টিতে ওই কুৎসিত জীবটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ পেঁচাটা আবার উড়তে শুরু করল, তাঁর মাথার ওপর দিয়ে কয়েকবার চক্কর মারল, তারপর আবার মাটির ওপর বসল। কমলাক্ষ আবিষ্টের মতো টেবিলের কাছে ফিরে গেলেন। তিনি ক্রমশই নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন, যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন। পেঁচাটার দিকে সম্মোহিতের মতো তিনি তাকিয়ে রইলেন, ছবির মুখ আর পেঁচার মুখের আদলে যেন কোনো তফাত নেই।

কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন খেয়াল নেই। হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঘরটা যেন চকিতে আলোময় হয়ে উঠল আর পরক্ষণেই কড় কড় কড়াৎ প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল। সেই চোখ ধাঁধানো আলোয় কমলাক্ষ স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন পেঁচাটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি, মানুষ না প্রেত! কালো পোশাক পরা প্রায় ছ-ফুট লম্বা এক মূর্তি, মুখে একটা পৈশাচিক জিঘাংসার চিহ্ন। এক লহমার মধ্যেই কমলাক্ষ মূর্তিটাকে স্পষ্ট দেখেছিলেন আর ভয়ে, আতঙ্কে তিনি টলে পড়তে পড়তে কোনোরকমে দু-হাত দিয়ে টেবিলটাকে ধরে নিজেকে সামলে নিলেন। লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় তিনি মূর্তিটির দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন। মড়ার মতো সাদা মুখ, কোটরে ঢোকা দুই চোখ যেন জ্বলছে। ওই অবস্থাতেও কমালক্ষর বুঝতে অসুবিধে হল না যে মূর্তিটা মানুষ না পিশাচ, সেই ঘৃণ্য জমিদারের প্রেতাত্মা। চিনিবাসের সতর্কবাণী তাঁর কানে যেন বেজে উঠল, ইস তার কথা যদি তিনি শুনতেন। মূর্তিটা নড়ে উঠল, তারপরই দু-হাত প্রসারিত করে ধীর পদক্ষেপে নিঃশব্দে তাঁর দিকে এগুতে লাগল। একটা কান্না কমলাক্ষর বুক ঠেলে বেরিয়ে আসবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ওটা এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে।

একটা পচা গন্ধ। তিনি আর তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, চোখ বুজলেন। তাঁর হাত দুটো যেন বিকারগ্রস্তের মতো টেবিলের ওপর নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ তাতে কী যেন একটা ঠেকল। তিনি অনুভব করলেন ওটা সেই মা কালীর ছবিটা। কিছু না ভেবেই তিনি সেটাকে বুকের ওপর চেপে ধরলেন, মরতেই যদি হয় মা কালির ছবিটা অন্তত বুকে থাকুক, হয়তো পিশাচের হাতে মরলেও মায়ের কৃপায় তিনি নিজে পিশাচে পরিণত হবেন না। কিন্তু ভয়ে আর আতঙ্কে তাঁর তখন মাথার ঠিক নেই, ছবিটাকে উলটো করে তিনি বুকে চেপে ধরলেন, কালীর ছবি পিশাচটার দিকে মুখ করা। হঠাৎ যেন দৈবশক্তিতে তিনি মনের জোর ফিরে পেলেন, চোখ খুলে যে দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল তাতে তিনি বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেলেন। পিশাচটা ডান হাত দিয়ে দু-চোখ ঢেকে এক পা, দু-পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে, ওর মুখে যেন হতাশা আর আতঙ্কের একটা অদ্ভুত সংমিশ্রণের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তারপরেই একটা ক্ষিপ্ত, আহত পশুর মতো বীভৎস চিৎকার করে ওটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আর সঙ্গেসঙ্গে কমলাক্ষ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

ভোর বেলা ঝড়বৃষ্টি শান্ত হয়ে আকাশে সূর্য উঁকি দিল। কাজ করতে করতে চিনিবাসের হঠাৎ খেয়াল হল বাবু তো এখনও ঘুম থেকে উঠল না, এত দেরি তো তাঁর হয় না। কয়েকবার ‘বাবু’ ‘বাবু’ বলে ডেকে আর দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা দিয়েও যখন বাবুর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না তখন নিদারুণ আশঙ্কায় সে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল। অবাক হয়ে সে দেখল বাবু মাটিতে চিত হয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছে; আর তাঁর বুকের ওপর রয়েছে ছোট্ট ফ্রেমে বাঁধানো বিপত্তারিণী কালীর এক বরাভয় মূর্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *