ছায়া

ছায়া

ঘোর সন্ধ্যা। ধীরে-ধীরে তরল অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে। রাস্তার ল্যাম্প-পোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠছে। নিপা কোচিং সেন্টার থেকে পড়া শেষে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। মফস্বল শহরের শহরতলী এলাকা। মাগরিবের আজানের পরপর এই সময়টায় কিছুক্ষণের জন্য রাস্তা-ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে যায়। রাস্তায় নিপার আশপাশে আর কেউ নেই। এই মুহূর্তে নিপা একটা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। ওর কেমন গা ছমছম করছে। মনে হচ্ছে কেউ ওকে অনুসরণ করছে। ও বার-বার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাচ্ছে, কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ নিপা লক্ষ করল, পিছন থেকে আসা ল্যাম্প-পোস্টের আলোতে ওর সামনে দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে। একটা ওর নিজের, অন্যটা খুনখুনে বৃদ্ধ কুঁজো ধরনের কোনও লোকের, যার মুখ ভর্তি উষ্কখুষ্ক জঙ্গুলে দাড়ি। হাতে লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে লোকটা যেন একেবারে নিপার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে এগোচ্ছে।

থমকে নিপা আবার পিছনে তাকাল। নাহ, কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

নিপার বুকটা ধক ধক করতে শুরু করল। এ কী হচ্ছে সঙ্গে?! রাস্তায় ও একা, অথচ দুটো ছায়া দেখা যাচ্ছে-এর কারণ হতে পারে?

নিপা একটা গন্ধও পাচ্ছে। যেন যে তাকে অনুসরণ করছে তার গা থেকেই গন্ধটা আসছে। অত্যন্ত কড়া আতরের গন্ধ। সেই গন্ধে নিপার কেমন মাথা ঝিমঝিম করছে।

ও চলার গতি বাড়িয়ে দিল। দ্রুত লম্বা-লম্বা পা ফেলতে লাগল।

চলতে-চলতে নিপা কাশির শব্দ শুনতে পেল। বুকে শ্লেষ্মা জমা কোনও বৃদ্ধের কাশি। বৃদ্ধ যেন একেবারে ওর ঘাড়ের পিছন থেকে কেশে উঠল।

নিপা ঘাড় ঘুরিয়ে আবার পিছনে তাকাল। আগের মতই কাউকে দেখা যাচ্ছে না। ও চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল।

.

হাঁপাতে-হাঁপাতে শেষ পর্যন্ত নিপা বাড়ি এসে পৌঁছল। ভয়ার্ত কাঁদো-কাঁদো গলায় সবকিছু ওর মাকে জানাল। সব শোনার পর ওর মা বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দিলেন

তিনি নিপাকে বোঝালেন, যেহেতু ও রাস্তায় একা ছিল, তার উপর কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে আসছিল-এজন্যই ভয় পেয়েছে। কবরস্থানকে ঘিরে সবার মনেই এক ধরনের ভয় কাজ করে। ভর সন্ধ্যায়, একা-একা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে আসায় সেই ভয়টাই তীব্র হয়ে ধরা দিয়েছে। কেউ ওকে অনুসরণ করেছে, আতরের গন্ধ, কাশির শব্দ—এ সবই মনের ভুল। আর দুটো ছায়া দেখেছে রাস্তার দু’ধারের ল্যাম্প-পোস্টের কারণে। দু’ধারের ল্যাম্প-পোস্ট থেকে আসা ভিন্ন-ভিন্ন আলোতে নিজেরই দুটো ছায়া পড়েছে। একটা ছায়াকে কুঁজো ধরনের কোনও বৃদ্ধের মনে হয়েছে কাধের স্কুল ব্যাগটার জন্য। ছায়ায় স্কুল ব্যাগটাকে পিঠের কুঁজ মনে হয়েছে। ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে রাখায় গালের দু’পাশ বেয়ে নামা ওড়নার ছায়াকে মনে হয়েছে কাল্পনিক বৃদ্ধের জঙ্গুলে দাড়ি। ছায়ার হাতে লাঠি দেখতে পাওয়া, আতরের গন্ধ, কাশির শব্দ-ওসবই বিভ্রম। ভীত-সন্ত্রস্ত মনের অতি কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এত-এতভাবে মা বোঝানোয় নিপা অনেকটাই সুস্থির হলো। ও পোশাক পাল্টে, মুখ-হাত ধুয়ে, হালকা নাস্তা সেরে পড়তে বসল। সামনে ওর এস.এস.সি. পরীক্ষা। পড়ার ভীষণ চাপ। অনেক রাত পর্যন্ত ওকে পড়াশোনা করতে হয়।

.

রাত পৌনে একটা।

নিপা এখনও পড়ার টেবিলে। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। বার-বার হাই উঠছে। এর পরও অতি কষ্টে পড়া চালিয়ে যাচ্ছে। রাত একটা বাজার পর বিছানায় যাবে। ও নিয়ম করে নিয়েছে রাত ঠিক একটা পর্যন্ত পড়ার টেবিলে থাকবে।

রাত একটা বাজার পর নিপা পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। শোবার আগে একবার ওকে বাথরুমে যেতে হবে। টয়লেট সেরে, ফেসওয়াশ দিয়ে মুখটা ভালভাবে ধুয়ে শুয়ে পড়বে। শোবার আগে মুখ ধুয়ে নিলে মুখে ব্রণ কম ওঠে।

নিপা বাথরুমের বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে ফেসওয়াশ মাখছে। ফেসওয়াশের ফেনার কারণে ওর চোখ বন্ধ। মুখে পানির ঝাপটা মেরে ফেসওয়াশের ফেনা পুরোপুরি পরিষ্কারের পর ও চোখ খুলল। অমনি ওর বুকটা ধক করে উঠল। ‘ও, মা,’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল।

চোখ খুলে ও আয়নায় দেখতে পেয়েছে ওর পিছনে কুঁজো ধরনের এক বৃদ্ধ দাঁড়ানো। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁত বের করে কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসছে।

নিপার চিৎকার শুনে ওর বাবা-মা তাঁদের শোবার ঘর থেকে ছুটে এলেন। নিপা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে মৃগী রোগীর মত কাঁপতে-কাঁপতে ভাঙা-ভাঙাভাবে বলল, ‘মা, সেই বুড়োটা! বুড়োটাকে এইমাত্র আমি আয়নায় দেখেছি! আমার পিছনে দাঁড়ানো ছিল!’

বলা শেষে নিপা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর মা মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘এসব কী বলছিস, মা, কোন্ বুড়োটা?!’

নিপা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘সন্ধ্যায় কবরস্থানের সামনে থেকে যে বুড়োটা আমার পিছু নিয়েছিল।’

নিপার বাবা অবাক হওয়া গলায় বলে উঠলেন, ‘কোন্ বুড়ো আবার আমার মেয়ের পিছু নিয়েছিল?! কোনও পাগল-টাগল নাকি?’

নিপার মা বললেন, ‘পাগল-টাগল কিছু নয়, তোমার মেয়ে শুধু-শুধুই ভয় পেয়েছিল। ওর নাকি মনে হয়েছিল বুড়ো কেউ ওকে অনুসরণ করছে। কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না।’ নিপাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মা, তুই এখনও ওসব মাথায় নিয়ে ঘুরছিস? আমি না তোকে কতভাবে বোঝালাম! সবই তোর মনের ভুল!

নিপা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘না, মা, মনের ভুল নয়। আমি এইমাত্র আয়নায় স্পষ্ট বুড়োকে দেখেছি। বুড়োর একপাশের গাল শ্বেতিতে সাদা হয়ে গেছে। একটা চোখ নষ্ট। সেই চোখটা ঘোলাটে। ঠোঁটের দু’কোনায় থুথু জমা। ফোকলা দাঁত।’

নিপার মা মেয়ের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘সবই তোর চোখের ভুল। আয়, তোকে আমি ঘুম পাড়িয়ে দিই।’

নিপাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। একসময় নিপা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। নিপা ঘুমিয়ে যাবার পর মা ওর পাশ ছেড়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন। যাবার আগে নিপার রুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন।

.

শেষ রাতের দিকে কড়া আতরের গন্ধে নিপার ঘুম ভেঙে গেল। ও টের পেল ওর মা এখনও ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। ও ভেবে পেল না মায়ের গা থেকে এমন কড়া আতরের গন্ধ আসছে কেন?!

নিপা পাশ ফিরে মায়ের দিকে ঘুরল। ঘরে ডিম বাতি জ্বলছে। ডিম বাতির আলোতে ও যা দেখল, তা ও কোনও দিন কল্পনাও করেনি। যে ওর মাথায় হাত বোলাচ্ছে সে ওর মা নয়! সেই ভয়ঙ্কর চেহারার বুড়োটা! বুড়োটার একটা মাত্র চোখ লালসায় জ্বলজ্বল করছে। কুৎসিত ভঙ্গিতে বার-বার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে।

নিপা চিৎকার দিয়ে উঠতে চাইল। তার আগেই বুড়োটা নিপার মুখ চেপে ধরল। ও জ্ঞান হারাল।

.

নিপার মা সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেয়ের খোঁজ নিতে এলেন। বিছানায় নিপা নেই। ভাবলেন বোধহয় বাথরুমে।

নাহ, বাথরুমেও নেই! বাথরুমেও নেই!

কাতা হলে গেল কোথায়?!

নিপার খোঁজ আর পাওয়া গেল না। পুলিশে জানানো হলো, সারা শহরে মাইকিং করে ঘোষণা দেয়া হলো, খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলো-কিছুতেই আর নিপার খোঁজ মিলল না।

.

কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে।

না মাঝরাত। মিদুল রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে এসেছে। সে ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। অনেক রাত বলে রাস্তায় কোনও যানবাহন নেই। অগত্যা তাকে স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিতে হয়েছে। পথে একটা কবরস্থানের পাশ কাটিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। তার কেমন গা ছমছম করছে। চারদিক একেবারে সুনসান। উৎকট একটা আতরের গন্ধ পাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে কারা যেন তাকে অনুসরণ করছে। যারা অনুসরণ করছে তাদের গা থেকেই আতরের গন্ধটা আসছে। অথচ আশপাশে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

হঠাৎ মিদুল লক্ষ করল, ল্যাম্প-পোস্টের আলোতে তার সামনে তিনটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। একটা তার নিজের ছায়া, অন্য দুটো কুঁজো ধরনের এক বৃদ্ধের আর এক কিশোরীর।

মিদুলের নিজের ছায়াটার দু’পাশে পড়েছে সেই দু’জনের ছায়া। অথচ তার দু’পাশে কেউই নেই।

ভয়ে ছায়াসঙ্গীদের গলার স্বরও শুনতে পেল মিদুল। বুড়োটার বুকে কফ জমা খল-খল কাশির শব্দ আর কিশোরীর রিনঝিনে গলার খিল-খিল হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ছায়া

ছায়া

ছায়া

আসাম থেকে এক বন্ধু ঘন ঘন পত্রাঘাত করছিল, লিখছিল :

একবার এখানে এসে বেড়িয়ে যাও, বুঝবে প্রকৃতিকে কেন লীলাচঞ্চল বলা হয়।

একটু খোঁটা দিয়ে লিখেছিল,

তোমরা পাহাড়-পর্বত কল্পনা করো আর তারই বর্ণনা পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দাও— অথচ ইট, কাঠ, পাথর ছাড়া কিছুই তোমরা দ্যাখো না।

ভেবে দেখলাম অপবাদটা একেবারে মিথ্যে নয়, তাই ওটা ঘোচাবার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম।

বন্ধু যে এতটুকু বাড়িয়ে বলেনি তা ট্রেনে যেতে যেতেই টের পেলাম। জানলার ধারে বসে শুধু ঘন সবুজের শোভা আর পাহাড়ের সারি— অ-কবির মনেও কবিত্ব এসে যাওয়া বিচিত্র নয়।

বন্ধু স্টেশনে এসেছিল। আনন্দে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমিও অভিভূত হলাম। দেবু, অর্থাৎ আমার বন্ধু, ওখানকার ডাক্তার। অল্প কিছুদিন হল প্র্যাকটিস শুরু করেছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই নাম করে ফেলেছে। এখনও বিয়ে করেনি— একা থাকে। তাই আমাকে নিয়ে ও মেতে উঠল।

কয়েকটা দিন বেশ হইচই করে আনন্দে কেটে গেল। শুনেছিলাম, আসামে রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকার খুব কদর। দেবু আবার বেশ ফলাও করে আমার নাম চাউর করে দিয়েছিল— বলেছিল, ওসব পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখি। ফলে, কিছু স্থানীয় বাসিন্দা কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন, আমার সঙ্গে আলাপ করে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলেছিলেন। অবশ্য আমি যে মনে মনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করিনি একথা বললে সত্যের অপলাপ করা হবে।

একদিন সকাল দশটায় আমি দেবুর বাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় একটা বই নিয়ে বসেছি। মাঝেমাঝে মুখ তুলে পথ দিয়ে লোকজনের চলাফেরা দেখছি। দেবু একজন রোগীর বাড়ি গিয়েছিল, ফিরতে একটু দেরি হবে বলেছিল। গেট খোলার শব্দে আমি চোখ তুললাম।

যিনি এলেন তাঁর নাম মিস্টার হাজারিকা, দেবুরই একজন পেশেন্ট। দেবুর মুখেই শুনেছিলাম, ভদ্রলোকের বয়েস বেশি নয়। একসময় নাকি খুব ভালো স্বাস্থ্য ছিল, কিন্তু গত ক-বছর ধরে তিনি কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের দু-চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, পাণ্ডুর মুখ, গায়ের রং অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে…যেন একটা জীবিত শব। ভদ্রলোকের রোগ যে আসলে কী, তা বহু পরীক্ষা করেও ধরা যায়নি। খিদে হয় না, ঘুম হয় না, দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, অথচ সবরকম প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট করেও শরীরে কোনো অস্বাভাবিকতা বা কিছুর অভাব, ধরা পড়েনি। দেবুই বলেছিল, কেসটা বড়ো অদ্ভুত। সে মেডিক্যাল জার্নালে ভদ্রলোকের কেস হিস্ট্রি প্রকাশ করেছিল। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ; তাকে বিভিন্ন চিকিৎসা-পদ্ধতি বাতলেও দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও কোনো উপকার হয়নি।

আমার মুখে ‘ডাক্তাবাবু বাড়ি নেই’ শুনে তিনি বললেন, সেটা তিনি জানেন, আমার কাছেই তিনি এসেছেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে তাঁকে বসতে বললাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার কাছে আবার তাঁর কী দরকার পড়ল!

একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি তিনি বসলেন। সত্যি কথা বলতে কী, ওই উজ্জ্বল দিনের আলো সত্ত্বেও তাঁর সান্নিধ্য কেন জানি না আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল, গা ছমছম করে উঠল। যেন ওঁর উপস্থিতি অশরীরী আত্মার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিল।

ভদ্রলোক কোটরে ঢুকে যাওয়া দু-চোখ দিয়ে আমাকে লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু কৌতুকের হাসি ঝিলিক খেলে গেল। আমার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল।

ভদ্রলোক খুকখুক করে বারকয়েক কাশলেন। তারপর যেন অনেকটা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনাকে বিরক্ত করছি বলে যেন কিছু মনে করবেন না…।’

‘আপনার কয়েকটা গল্প আমি পড়েছি,’ ভদ্রলোক একটু থেমে বলতে লাগলেন, ‘অলৌকিক কাহিনি নিয়েই আপনি বেশি লেখেন…।’

একজন গুণমুগ্ধ পাঠক, এই ভেবে এতক্ষণে আমি যেন ধাতস্থ হলাম।

‘আপনাকে আমি একটা কাহিনি শোনাতে চাই,’ ভদ্রলোক সোজাসুজি প্রসঙ্গ অবতারণা করলেন।

আমি নিজের প্রশংসা শুনব বলে প্রস্তুত হচ্ছিলাম, হতাশ হলাম। যা হোক, মুখে বললাম, ‘বেশ তো, বলুন, আমি শুনব।’

‘ধন্যবাদ।’ ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে উক্তি করলেন। একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি জানি, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, এমনকী কবে মারা যাব তাও আমার অজানা নয়। তাই এখন আপনাকে বলতে কোনো বাধা নেই।’

আমি একটু চমকে উঠলাম। ভদ্রলোক বলেন কী? কবে মারা যাবেন তাও তিনি জানেন!

‘একজনকে সব খুলে না বলা পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আপনিই উপযুক্ত লোক। দয়া করে আমার কাহিনি আপনি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেবেন। আমার অপরাধের কথা সবাই জানুক, তাই আমি চাই।’ ভদ্রলোক তাঁর পাশের চেয়ারটার দিকে মুখ ফেরালেন, যেন কেউ সেখানে বসে আছে, তাকে শুনিয়েই কথাটা বললেন।

আমার গা আবার শিউরে উঠল।

‘পাঁচ বছর আগে আমার চেহারা এমন ছিল না,’ ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে শুরু করলেন ; ‘আমি একজন ভালো অ্যাথলিট ছিলাম। শরীরে মেদের বালাই ছিল না, অথচ পুষ্ট দেহ ছিল। আমি এক চা-বাগানের হেড অফিসে কাজ করতাম। সেখানেই বড়ুয়ার সঙ্গে আমার আলাপ।’

ভদ্রলোক আবার চুপ করলেন, যেন পুরোনো দিনের কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, ‘বডুয়া আমার থেকে বয়েসে ছোটো হলেও আগেই ওই অফিসে ঢুকেছিল। বেশ সুন্দর চেহারা, অনেকটা মেয়েলি ধরনের। ওর বাড়ি লামডিং-এ, এখানে একটা ঘর ভাড়া করে ও ছিল। প্রথম থেকেই কেন জানি না ও আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমার থাকার জায়গা নেই, হোটেলে আছি, শুনে ওর সঙ্গে থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আমিও ভেবে দেখলাম তাতে আমার অনেক সুবিধে। যা মাইনে পাই তার বেশিরভাগ হোটেলের খরচায় চলে যায়। তার চাইতে ওর সঙ্গে শেয়ার করে থাকলে অনেক কম খরচ হবে। রান্নার জন্যে একজন লোক রেখে দিলে আরও সুরাহা হবে।

‘আমি ওর প্রস্তাবে সম্মত হলাম। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। ভালোই ছিলাম, টাকাপয়সাও বাঁচছিল। বড়ুয়া ক্রমেই আমার একান্ত অনুগত হয়ে পড়ল। আমার সুখ-সুবিধের দিকে ওর তীক্ষ্ন দৃষ্টি লক্ষ করে আমি বেশ মজা পেতাম। ক্রমে এমন অবস্থা হল যে, ও যেন আমার মধ্যে নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলল। মাঝরাতে আমি ওকে সিগারেট আনতে বললে, একমাইল হেঁটে তাও এনে দিতে ও এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ করত না, বরং আমাকে খুশি করতে পেরে ও যেন তৃপ্ত হত। এককথায়, আমার জন্যে সব ত্যাগ করতে ও প্রস্তুত ছিল।

‘দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর গড়িয়ে গেল। আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। এতদিন আমি বড়ুয়ার এই আত্মনিবেদনে আত্মতুষ্টি অনুভব করতাম, কিন্তু আর যেন ওকে ভালো লাগে না। এই একঘেয়েমি, বৈচিত্র্যহীনতা অসহনীয় মনে হতে লাগল। ওর এই মেয়েলি স্বভাব আমার দু-চোখের বিষ হয়ে উঠল। আমি যেন হাঁপিয়ে উঠলাম। ওর সঙ্গ ত্যাগ করবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ওকে কাছছাড়া করতে পারলাম না। বড়ুয়া নানা ছলছুতো করে আমার আলাদা থাকার ব্যবস্থা পণ্ড করে দিতে লাগল। আমি মনে মনে রেগে উঠলাম। ওর সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করতে লাগলাম। তাতে ওর মুখে ব্যথার চিহ্ন ফুটে উঠত— আর সেটা লক্ষ করে আমি উল্লাস বোধ করতাম। নিজের অজান্তেই আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম। এসব সত্ত্বেও বড়ুয়া কিন্তু আমাকে ছাড়ল না, ছায়ার মতো আমার পাশে পাশে থাকত।

‘শেষ পর্যন্ত আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। ওর হাত থেকে আমাকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম, ওকে আমি খুন করব। আমি মতলব আঁটতে লাগলাম। এমনভাবে কাজ হাসিল করতে হবে যাতে আমার ওপর সন্দেহ না আসে। শেষ পর্যন্ত সকলের চোখের সামনেই একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিলাম— আমাকে সন্দেহ করার কোনো কারণই ছিল না।

‘হাসপাতালে শেষ নিশ্বাসের আগে ও আমার দিকে চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখে রাগ বা অভিযোগ ছিল না— ছিল ভর্ৎসনা। বিড়বিড় করে ও বলল, আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না— তোমার পাশে ছায়ার মতো আমি থাকব।’

মিস্টার হাজারিকা একটু থামলেন। আমি ওঁর স্বীকারোক্তি শুনে যেন সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছি।

‘বড়ুয়া ওর কথা রেখেছে,’ হাজারিকা আবার শুরু করলেন, ‘মৃত্যুর পরমুহূর্ত থেকে ছায়ার মতো ও আমার পাশে পাশে রয়েছে। দিনেরাতে সবসময় আমি ওর উপস্থিতি অনুভব করি। এখনও ও আমার পাশে বসে আছে,’ হাজারিকা পাশের চেয়ারের দিকে ঘাড় ফেরালেন।

আমার মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটা হিম-শিহরন বয়ে গেল। আমিও যন্ত্রের মতো ঘাড় ফেরালাম, আর সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠলাম। আমার স্পষ্ট মনে হল, যেন কেউ চেয়ারে বসে আছে, একটা আবছা ছায়ামূর্তি—।

আমার মাথা ঘুরে উঠল। একটু ধাতস্থ হয়ে আবার চেয়ারের দিকে তাকালাম। এবার কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না।

মিস্টার হাজারিকা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর মুখে বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘জানেন, ও আমার কানে ফিসফিস করে কথা বলে। তাই আজ আমি সাহস করে সব কথা আপনাকে খুলে বলতে ভরসা পাচ্ছি। কারণ, ও আমাকে বলেছে, আর মাত্র একটা মাস আমার আয়ু।’ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাজারিকা বললেন, ‘মরেও আমি ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব না।’

তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার স্পষ্ট মনে হল, আর-একজন কেউ পাশের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাজারিকা হাঁটতে শুরু করলেন, আর আমি দ্বিতীয়বার ভয়ানক চমকে উঠলাম।

মাথার ওপর কড়া রোদ। মিস্টার হাজারিকা হাঁটছেন, তাঁর পাশে পাশে তাঁর ছায়াও চলছে। কিন্তু… ছায়া একটা নয়, দুটো…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *