প্রেতাত্মার প্রতিহিংসা

প্রেতাত্মার প্রতিহিংসা

বিলেতের এক কুলীন বংশে জর্জ উডফলের জন্ম। ইং ১৮৫০ কিংবা তার সমসাময়িক কোনো এক বছরে ভাগ্যের অন্বেষণে সে দেশান্তরী হয়েছিল, পাড়ি দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়।

১৮৫১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হারগ্রেভস নামে ক্যালিফোর্নিয়ার এক স্বর্ণখনির মালিক সিডনি থেকে প্রায় একশো মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটা খাঁড়ির কাছে সোনার সন্ধান পেয়েছিলেন। তারপর ভিক্টোরিয়াতেও যখন সোনার খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, তখন বিদেশ থেকে আগত মানুষদের মধ্যে স্বর্ণ আহরণের যে উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল, উডফলও তাতে যোগ দিয়েছিল। কাতারে কাতারে দুঃসাহসী মানুষের এই স্বর্ণ-তৃষা বা তার পেছনে দৌড় থেকেই এসেছিল ‘গোল্ড-রাশ’ কথাটা।

উডফল এই দৌড়ে আরও দু-জনের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। তাদের নাম হার্পার আর ফ্রিথ— দু-জনেই গুন্ডা প্রকৃতির মানুষ। হার্পার কয়েক বছর আগে একটা কয়েদি বোঝাই জাহাজে ওখানে এসেছিল। ইংল্যান্ড থেকে অবাঞ্ছিত কয়েদিদের সেসময় অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসন দেওয়ার প্রথা ছিল। তবে হার্পার কিংবা ফ্রিথ কেউই খুব খারাপ চরিত্রের লোক ছিল না। স্বর্ণের সম্ভাবনায় তখন কিন্তু হাজার হাজার বদ চরিত্রের মানুষ এসে ভিড় করছিল অস্ট্রেলিয়ায় এবং এই ব্যাপারটা ওখানকার কর্তৃপক্ষের কাছে শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

হার্পার কিংবা ফ্রিথ কেউই নাম স্বাক্ষর পর্যন্ত করতে পারত না তবু উডফলের সঙ্গে তাদের বেশ দোস্তি হয়ে গেল। একজন শিক্ষিত ইংরেজ ভদ্রলোক তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে, আচরণে উন্নাসিকতার লেশমাত্র নেই, এটা কম কথা নয়।

তাদের বরাত ভালো, সোনার সন্ধান তারা পেয়েছিল। এজন্য দুর্গম পাহাড়ে তাদের যেতে হয়েছিল। স্বর্ণরেণু আর স্বর্ণপিণ্ড যা তারা খোঁড়াখুঁড়ি করে পেয়েছিল, তাদের ভাগ্য ফেরাবার পক্ষে তা যথেষ্টই বলতে হবে। বাকি জীবনটা আরামে কাটাবার মতো সোনা এসেছিল তাদের হাতে। কিন্তু সোনার সন্ধানে যারা সব কষ্ট আর পরিশ্রম তুচ্ছ করে বেরিয়ে পড়ে, তারা বোধ হয় কখনো যা পেয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না। একরকম রোগে তারা আক্রান্ত হয়, সেটা হল স্বর্ণ-তৃষা, আরও সোনা চাই…আরও।

যে সোনা তাদের হাতে এসেছে, সিডনিতে গিয়ে তা বিক্রি করার কথা তারা আলোচনা করছিল, এই সময় একটা আশ্চর্য গুহা তারা আবিষ্কার করল। যে পাহাড়ে ওই গুহাটা ছিল, সেটা দেখে ওদের মনে হয়েছিল রাশি রাশি সোনা আছে ওই পাহাড়ের গহ্বরে গহ্বরে; একটা নয়নাভিরাম জলপ্রপাত নেমেছিল ওটার গা বেয়ে। ওই গুহার ভেতর ঢোকা সহজ ছিল না। অনেক পরিশ্রম করে পাহাড়ের গা বেয়ে এদিক-ওদিক উঠে গুহার প্রবেশপথটা ওরা খুঁজে পেল। পাহাড়ের মুখে একটা খাড়া স্তম্ভের মাঝামাঝি অংশের মতো ওটার আকৃতি। ওখানে নামবার জন্য গুহামুখ থেকে তলায় আলগা শিলাখণ্ডের ভেতর দিয়ে ছুঁচোলো খুঁটি ঢোকাতেও হয়েছিল তাদের।

নীচে নেমে তারা অবাক হয়ে দেখল ভেতরটা একটা গির্জার মতো গভীর গিরিগুহা বা খাদ। দূরে বিরাট জলপ্রপাতের মেঘগর্জন গুহার ভেতর প্রতিধ্বনিত হয়ে গম গম করছিল। ওদের টর্চের আলোয় ঝলমল করে উঠল জমাট বাঁধা চুন আর ঝকমক করে উঠল বহুবর্ণের পাথরের সমান ও সমান্তরাল সব প্রান্ত। সবচেয়ে যা ওদের উত্তেজনার সৃষ্টি করল তা হল, যেসব বিরাট স্তম্ভ অবলম্বন করে গুহার ছাদ টিকেছিল, সেগুলো স্ফটিকে মোড়া।

কিন্তু এই অপূর্ব আর বিস্ময় জাগানো জায়গা থেকে নামমাত্র সোনা পাওয়া গেল। ঝকঝকে চমৎকার স্ফটিক দৃষ্টিমধুর হলে কী হবে, তাতে সোনার অনুপাত ছিল নেহাতই অল্প। তাই সংগ্রহ করতে তাদের একটা শিলাস্তর ভাঙতে হল। ওটা দেখতে ছিল চমৎকার খোদাই করা গির্জার বেদির মতো। ওটার পেছনে আরেকটা ছোটো গুহা তাদের নজরে পড়ল।

ওখানে সোনার সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে তারা ঠিক করল ছোটো গুহাতেই রাত কাটাবে, পরদিন যাত্রা করবে সিডনি।

সেই রাতে সভ্যজগতে ফিরে যাবার কথা নিয়েই তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের সোনার মূল্যের একটা হিসেব কষে দেখল তাদের কঠিন পরিশ্রমের ফল খারাপ হয়নি। ভবিষ্যতে প্রত্যেকেই মোটামুটি স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাতে পারবে। এই সোনার জন্য তাদের অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে, এই সভ্যজগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করাই হবে তাদের জীবনের লক্ষ্য।

এসব কথা যখন হচ্ছিল, জর্জ উডফল কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। তার চিন্তাধারা বইছিল অন্য স্রোতে। সঙ্গী দু-জনের কাছে যা সোনা পাওয়া গেছে তাই ছিল যথেষ্ট, কিন্তু তার কাছে নয়। দেশে নিঃস্ব হয়ে সে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল ভাগ্যকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য। তার সঙ্গী দু-জন স্বর্ণ খননকারী মজদুর ছাড়া আর কিছু নয়, তাদের প্রত্যাশাও কম, যা পেয়েছে তাই মনে করছে অনেক। তবে তিনজনের মোট সোনার বিনিময়ে যে টাকা পাওয়া যাবে তা একজন ভদ্রলোকের ভাগ্য গড়বার পক্ষে পর্যাপ্ত।

কিন্তু সঙ্গী দু-জনের সোনা চুরি করে চম্পট দেওয়া সম্ভব নয়। সারা জীবনের মতো চিহ্নিত হয়ে থাকতে হবে। এ ধরনের অপরাধ কেউ ভোলে না, ক্ষমাও করে না, একদিন-না-একদিন আঘাত আসবেই।

মাত্র একটাই সমাধান আছে— সঙ্গীদের খুন করা।

হার্পার আর ফ্রিথ একটু পরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। উডফল শুয়ে শুয়ে নানারকম মতলব আঁটছিল। গুহার মধ্যে যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল তা নিভে যাবার আগেই খুব চটপট কাজ সারতে হবে।

আগুন কমে আসা পর্যন্ত উডফল অপেক্ষা করল, তারপর নিঃশব্দে এবং এক নিমেষে তার ক্ষুরধার ছুরি দিয়ে আঘাত হানল। ফ্রিথ ছিল ঠিক তার পাশেই, ছুরির ফলা ভেদ করল তার হৃৎপিণ্ড। হার্পার কিন্তু হঠাৎ জেগে উঠল। হিংস্র, বন্য পরিবেশে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে, বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করে দেয়, সেটাই বোধ হয় ওর ঘুম ভাঙার কারণ।

হার্পার টলমল করে উঠে দাঁড়াল, তারপর সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ল উডফলের ওপর। কিন্তু হার্পারের চোখে তখনও ঘুমের আমেজ তাই তাকে কাবু করতে বেশি বেগ পেতে হল না উডফলের। তার গলা চেপে ধরে কণ্ঠনালী চিরে দিল। দু-জনে প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি করতে করতে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। উডফলের ছুরিটা হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু হার্পারের গলা থেকে তার বজ্রমুষ্টি শিথিল হল না। হার্পার অর্ধ অচেতন অবস্থায় লুটিয়ে পড়ল।

উডফল এবার ছুরিটা কুড়িয়ে সঙ্গীকে খতম করার জন্য তেড়ে গেল। হার্পার আপ্রাণ চেষ্টায় উঠে বসেছে, তার মুখ বিবর্ণ, দু-চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, হাঁ করে সে নিশ্বাস নিচ্ছে। কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না, আধবসা অবস্থায় দু-হাত জোড় করে কাতর দৃষ্টিতে সে দয়া ভিক্ষা করল।

কিন্তু উডফল দয়া করল না। ছুরির ফলাটা সজোরে হার্পারের বুকে বসিয়ে দিল। হার্পারের মরণ আর্তনাদ ভূ-গর্ভের সমাধিকক্ষের মতো ওই পর্বতগুহা থেকে গুহান্তরে ধাক্কা খেয়ে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল।

তখন রাত, তবু উডফল ঠিক করল তখুনি ওই জায়গা ছেড়ে চলে যাবে। সঙ্গীদের বোঁচকা থেকে তাদের সংগৃহীত সোনা সে নিজের বোঁচকায় ভরল। কিন্তু চরম বিশ্বাসঘাতকতায় যাদের সে খুন করেছে, গলাকাটা অবস্থায় পড়ে থাকা তাদের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তার বিবেক হঠাৎ জেগে উঠল, ভাবল ওদের কবর দেবে। ফলে তার অপরাধের চিহ্নও লোপ পাবে।

কিন্তু গুহার মধ্যে ওই পাথুরে মেঝে খুঁড়ে গর্ত করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। অনেক কষ্টে সামান্য একটু গর্ত করার পর তাকে হাল ছাড়তে হল। এই দুর্গম, নির্জন জায়গায় কেউ কোনোদিন আসবে, এই গুহা আবিষ্কার করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম, যদিও-বা আসে এই খুনের সঙ্গে তাকে জড়াবার কোনো প্রমাণ নেই।

ওই অগভীর গর্তটার মধ্যেই সে মৃতদেহ দুটি টেনে নিয়ে আলগা নুড়ি পাথরে যতটা সম্ভব চাপা দিল। এভাবে তাদের ফেলে সে যাত্রা করল সিডনি।

তারিখটা ছিল বিশে সেপ্টেম্বর, সাল ১৮৫২ কি ১৮৫৩।

সিডনিতে কেউ তাকে চিনত না। সেসময় ওই নগরের জনসংখ্যা ছিল মাত্র এক লাখ, আজ যেখানে তা কুড়ি লাখও ছাড়িয়েছে। অত বড়ো জায়গায় কেউ তার পরিচয় কিংবা তার সম্বন্ধে কিছু জানবে এমন সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। সবাইকে সে বলে বেড়াল, বিলেত থেকে অল্প কিছুদিন হল সে এসেছে, সঙ্গে কিছু পুঁজিও আছে, সেটা সে ব্যাবসায় খাটাতে চায়।

উডফল সুযোগসন্ধানী ছিল না এমন অপবাদ কেউ দিতে পারবে না। গুহার মধ্যে সুযোগ খুঁজে সে তার সঙ্গীদের খুন করেছিল, আত্মসাৎ করেছিল তাদের বহু পরিশ্রমের ধনরত্ন। এখানেও সে সুযোগ বুঝে একটা খনিতে তার প্রায় সমস্ত টাকা বিনিয়োগ করল। এক সপ্তাহ পরে ওই খনির শেয়ার চড় চড় করে বেড়ে গেল, আর রাতারাতি বড়োলোক হয়ে গেল উডফল।

নিজের সাফল্যে খুব খুশি উডফল, জঘন্যতম অপরাধের স্মৃতি তার মন থেকে প্রায় মুছেই গেছে। এখন সে জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করছে, পটস পয়েন্ট-এ একটা চমৎকার বাড়ি কিনেছে। মাঝে মাঝে তার বাড়িতে ভোজ-উৎসব হয়, নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন গণ্যমান্য মানুষ।

আবার ফিরে এল সেপ্টেম্বর। মাসের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় নিজের বাড়িতে খোলা জানলার সামনে বসে ছিল উডফল। একটু দূরে অন্ধকারে চোখে পড়ছে পোর্ট জ্যাকসনের অস্পষ্ট জলরাশি আর পোতাশ্রয়ের উজ্জ্বল আলো— এই দুয়ের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল উডফলের দৃষ্টি। হঠাৎ কৃতকর্মের জন্য তার মনে দারুণ অনুতাপ হল। তখন তার মনে হচ্ছিল হাতের রক্ত মুছে ফেলার জন্য সব ধনসম্পদ ত্যাগ করতে সে রাজি আছে। মনের এমন অবস্থায় আবেগের বশে সে একবার ভাবল পুলিশের কাছে গিয়ে তার অপরাধ স্বীকার করবে।

আবেগতাড়িত মনের ওই অবস্থা অবশ্য বেশিক্ষণ রইল না। জানলা থেকে সে সরে এল, ভেবে দেখল মৃত ব্যক্তি কথা বলতে পারে না, সুতরাং তার কোনো ভয় নেই।

ঘরের ভেতর ফিরে দাঁড়াতেই সে শুনতে পেল স্পষ্ট গলায় কে যেন বলে উঠল, ‘সময় হয়েছে, এসো শুরু করি।’

বাড়িতে চোর ঢুকেছে মনে করে উডফল রিভলভার হাতে সারাবাড়ি খুঁজে দেখল, কিন্তু না, বাইরের কেউ আসেনি।

সব বাতি নিভিয়ে সে শোবার আয়োজন করল, একটা বড়ো মোমবাতি নিয়ে এগিয়ে চলল ঘরের দিকে। সবে এক পা বাড়িয়েছে, ভারী শরীরের মতো কিছু একটা ধপ করে তার পায়ের সামনে আছড়ে পড়ল। আতঙ্কে দু-পা পিছিয়ে যেতেই নানারকম শব্দ কানে আসতে লাগল তার— যেসব শব্দ মাসের পর মাস তাকে তাড়া করছে, কিন্তু এখন সেই শব্দ প্রচণ্ড হয়ে তার কানে যেন তালা ধরিয়ে দিচ্ছে।

সেই জলপ্রপাতের গর্জন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তারপরই ছুরিবিদ্ধ হার্পারের মরণ আর্তনাদ ওর কানের পর্দা যেন ফালা ফালা করে দিল। আরও নানারকম ভয়াবহ, অবর্ণনীয় সব শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সারা বাড়িতে।

উডফল দু-হাতে কান চেপে বসে পড়ল, কিন্তু সেই ভূতুড়ে শব্দ অপ্রতিরোধ্য। সে যেন ফিরে গেছে সেই গুহায়, ফিরে এসেছে সেই ভয়ংকর রাত— একটা জীবন্ত দুঃস্বপ্ন যেন তার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

এই ভয়াবহ শব্দে তার কাজের লোকরা জেগে উঠবে এই আশাঙ্কাই সে করছিল। সব শব্দকে ছাপিয়ে উঠছিল হার্পারের তীব্র মরণ আর্তনাদ।

কিন্তু কেউ এল না। আস্তে আস্তে উডফলের কাছে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, সে ছাড়া আর কারো কানে ওই শব্দ যাচ্ছে না— শয়তানের ঐকতান শুধু তাকেই উপলক্ষ করে।

এই উপলব্ধি হওয়ামাত্র সব শব্দ হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ঠিক যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছে এমনভাবে হার্পারের গলা সে শুনতে পেল

‘তুমি ভুলে যাচ্ছ জর্জ। আর সাতদিন পরেই বিশে সেপ্টেম্বর। তোমাকে সেকথা মনে করিয়ে দিতে আমরা এসেছি।’

ভীষণ আতঙ্কে শিউরে উঠল উডফল। তার বদ্ধ ধারণা হল শুধু হার্পার নয়, ফ্রিথের আত্মাও উপস্থিত আছে ঘরের মধ্যে, কিন্তু কথা বলছে হার্পার, যে হার্পারের মরণ আর্তনাদ তার মগজে জীবন্ত প্রতিধ্বনি হয়ে আছে।

‘তোমার সময় এখনও আসেনি জর্জ, কিন্তু যতদিন তা না আসে, আমরা তোমাকে মনে করিয়ে দেব। বিশ তারিখে আমরা তোমাকে গুহায় আশা করব। শুধুমাত্র তবেই আমাদের হাত থেকে তুমি রেহাই পাবে।’

‘হ্যাঁ, আমি আসব,’ বিড় বিড় করে বলল উডফল, তারপরই জ্ঞান হারাল।

জ্ঞান হবার পর তার মনে হল সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্ন।

যাহোক গুহায় সে গিয়েছিল, একটা রাত সেখানে কাটিয়েছিল। এই ঘটনায় সে লিখেছিল, ‘সে এক মানসিক যন্ত্রণাদায়ক ভয়ংকর রাত। পরে আমি অবাক হয়ে ভেবেছি ওই ঘটনার পরেও কেমন করে প্রাণ আর সুস্থ মস্তিষ্ক নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।’

ওই গুহায় সেরাতে সাংঘাতিক কিছু যে ঘটেছিল তা শুধু কল্পনাই করা যায়। তবে যে সঙ্গী দু-জনকে খুন করে সে অগভীর গর্তে ফেলে রেখেছিল, তাদের স্পর্শ করার কিংবা নতুনভাবে সমাধিস্থ করার সাহস তার হয়নি। এই কাহিনিতে এটা উল্লেখযোগ্য, পরবর্তী ঘটনায় তা পরিষ্কার হবে।

প্রত্যেক বছর ২০ সেপ্টেম্বর ওই গুহায় ভয়ংকর এক তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়ত উডফল, এক নারকীয় পরিবেশে কাটত তার সারারাত। ওই গলিত শব দুটি যেন তাকে উপহাস করত। একটি করে বছর যায়, আরও পচন ধরে শবের, কঙ্কালসার হয়ে আসে, কিন্তু এক অস্বাভাবিক পরিবেশে তারা যেন জীবন্ত।

এই তীর্থযাত্রাই তাকে শান্তি এনে দেয়। চতুর্থ বছরের পর সে ঠিক করল আর যাবে না, কিন্তু এড়াতে পারল না। হার্পার ফ্রিথের আত্মা তার বাড়ি এসে এমন উপদ্রব শুরু করল যে সে বাধ্য হল তার বাৎসরিক তীর্থযাত্রায় ছেদ না ঘটাতে।

তবে এই ঘটনায় একটা ভালো প্রতিক্রিয়া হল। উডফলের জীবনের ধারা গেল বদলে। সমস্ত আমোদ আহ্লাদ থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে নিল, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার বাসনায় জনহিতকর কাজে সঁপে দিল নিজেকে। দানধ্যানে মন দিল। উপাসনার জন্য নিয়মিত গির্জায় যেতে শুরু করল। সিডনির একজন সম্মানিত মানুষ হিসাবে ছড়িয়ে পড়ল তার নাম। সে যে একজন জঘন্য অপরাধী তা কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না।

কুড়িটা বছর কেটে গেল, তার মধ্যে উনিশবার ওই গুহায় সে রাত কাটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সে মনস্থির করে ফেলল, আর নয়, এবার স্বীকারোক্তি করবে।

একদিন রাত্রে সমস্ত ঘটনা সে খুলে লিখল, কিছুই বাদ দিল না, উপসংহারে সে লিখল, আরও একবার সে ওই গুহায় তীর্থযাত্রা করবে, ফিরে এসে আত্মসমর্পণ করবে পুলিশের কাছে।

শেষবারের মতো সেই গুহায় গিয়েছিল উডফল, কিন্তু আর ফেরেনি।

একজন দয়ালু, পরোপকারী মানুষের আকস্মিক অন্তর্ধানে সিডনিতে দারুণ শোরগোল পড়ে গেল, নগরবাসীরা শোকসভায় তার সম্বন্ধে অনেক গুণগান করল। তার অন্তর্ধানের সঙ্গে কোনো অপরাধজনিত ঘটনার সম্পর্ক আছে এমন সন্দেহ করার কারণ ঘটেনি। তবে বিষয়সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো ত্রুটি বা বিশৃঙ্খলা ছিল না। সিডনির নাগরিকরা তার স্মরণে এক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করল।

পাঁচ বছর এই রহস্যের সমাধান হয়নি।

ইং ১৮০০ সালের সত্তর দশকের শেষের দিকে দু-জন মানুষ ছুটি কাটাতে জনপ্রাণীহীন দুর্গম অঞ্চলে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একজন হলেন উইলিয়াম রোলি, পেশায় ইঞ্জিনিয়র, নিউ সাউথ ওয়েলস-এ অনেকগুলো খাল তাঁর তত্ত্বাবধানে কাটা হয়েছিল। দ্বিতীয়জন হলেন সিডনির একটি গির্জার যাজক, নাম চার্লস পাওয়ার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এমন দুর্গম অঞ্চলে বেরিয়ে পড়া, তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিবাস আর পাখি শিকার করে আগুনে ঝলসে খাওয়া, সপ্তাহান্ত ছুটি কাটাবার একটা চমৎকার রীতি ছিল। অ্যাডভেঞ্চার আর বেড়াবার আনন্দ দুটোই উপভোগ করা যেত একসঙ্গে। যাজকমশাই ওই সফরের বেশির ভাগ সময় নানান বর্ণের ও প্রজাতির প্রজাপতি সংগ্রহে ব্যস্ত রেখেছিলেন নিজেকে।

দু-জনেই উডফলকে নামে এবং চাক্ষুষ আলাপে চিনতেন।

বিশে সেপ্টেম্বর তাঁরা পৌঁছুলেন সেই পাহাড়ের ধারে, যেটা থেকে চঞ্চলা তরুণীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এসেছে নয়নাভিরাম একটা জলপ্রপাত। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে রাতটা তাঁরা ওখানেই কাটাবেন ঠিক করলেন। ওই দিনটা যে একটা হিংস্র ঘটনার বার্ষিকী সেটা তাঁদের জানবার কথা নয়।

রাতের খাওয়া সেরে দু-জনে তাঁবুর ভেতরে পাইপ ধরিয়ে মৌজ করছিলেন। মাঝখানে আগুন জ্বলছে, শুধু ঠান্ডাই নয়, বুনো জন্তুকে ঠেকিয়ে রাখবে তাঁবুর আগুন। তুমুল ঝড়ের সঙ্গে শুরু হল প্রচণ্ড বর্ষণ, সেইসঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত। জলপ্রপাতের ওপর হঠাৎ এক গাঢ় লাল আলোর ছটা যেন তাঁদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ঠিক যেন নেমে এসেছে রক্তের স্রোত। তাঁরা মনে করলেন ব্যাপারটা প্রাকৃতিক বিস্ময় ছাড়া আর কিছু নয়। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাবার পরেও তীব্র আলোর ছটা মিলিয়ে গেল না, ঠিক যেন প্রপাতের মাঝামাঝি জায়গায় জলের মধ্যেই ওটা স্থির হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন একজন মানুষের মূর্তি।

উইলিয়াম আর যাজক চার্লস ব্যাপারটা অনুসন্ধানের জন্য অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি পৌঁছে তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়লেন যেন আর নড়বার চড়বার ক্ষমতা নেই। তাঁদের চোখে পড়ল যাকে মানুষ বলে তাঁদের মনে হয়েছিল সেটা সত্যিই একটা মৃত মানুষের মুখ। অনেক আগেই যার মৃত্যু হয়েছে, এখন মুখ আর গায়ের চামড়া সংকুচিত, শুকিয়ে গেছে, কোথাও কোথাও খসে পড়েছে। রক্তিম আলোর ছটায় ওঠা যেন ঝুলে আছে, আর ইশারায় তাঁদের ডাকছে। তারপরই তীব্র যন্ত্রণায় মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।

ওটাকে যেখানে দেখা গিয়েছিল সেখানে পাহাড় বেয়ে উঠতে তাঁদের প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় লেগে গেল। আরও এক ঘণ্টা লাগল পাহাড়ের শিখরে পৌঁছোতে যেখানে জলপ্রপাত আছড়ে পড়ছিল নীচের খাদে। খাড়া গিরিচূড়া, অন্ধকারে পাহাড়টাকে প্রকাণ্ড দৈত্যের মতো মনে হচ্ছিল।

একটা ভেঙে পড়া গাছ তাঁদের চোখে পড়ল। দেখেই বোঝা যায় ওটাকে কুড়ুল দিয়ে কাটা হয়েছিল, একটা তির নীচের দিকে চিহ্নিত করছিল।

ওটার কাছেই গুহার প্রবেশমুখ তাঁরা দেখতে পেলেন, ঝোপঝাড়ে ওটা প্রায় ঢাকা পড়েছে। রোলি একটা কচি চারাগাছ কেটে ওই ঝোপঝাড়ে বাড়ি মেরে পথ করে এগুচ্ছিলেন, তারপরই গুহার মুখটা বেরিয়ে পড়ল, যেটা খাড়াভাবে নীচে গিয়ে শেষ হয়েছে।

পঁচিশ বছর আগে উডফল আর তার দুই সঙ্গী যে খুঁটি বাড়িয়ে গুহার মুখ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সেটা তখনও তেমন শক্তভাবেই লাগানো ছিল। একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে রোলি আর পাওয়ার নীচে নামলেন।

গির্জার মতো আকৃতির সেই গভীর গিরিগুহায় দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে তাঁরা চারদিক দেখছিলেন। বেদির মতন প্রকাণ্ড পাথুরে গঠন যাজকের মনে অপরিসীম কৌতূহলের সঞ্চার করল। তিনি যখন ঘুরেফিরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ভেতরের সৌন্দর্য দেখছিলেন, রোলি তখন ভাঙা স্ফটিক প্রস্তরের গহ্বর দিয়ে ছোটো গুহায় ঢুকে পড়েছিল।

তাঁর ভয়ার্ত আর্তনাদে পাওয়ার ছুটে গেলেন।

‘কী হল?’ যাজক জিজ্ঞেস করলেন।

‘এখান থেকে চলুন,’ রোলি বললেন, তিনি খুব ভয় পেয়েছেন, ‘এ জায়গাটা ভালো নয়।’

‘কেন? ব্যাপার কী?’ পাওয়ার জানতে চাইলেন।

রোলি লন্ঠনটা তুলে ধরলেন। তাঁদের সামনে অগভীর একটা কবর। ওটা খুঁড়ে যে মাটি পাশে জমা করা হয়েছিল, ওপর থেকে অনবরত ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে তা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। এমনকী যা দিয়ে কবর খোঁড়ার চেষ্টা হয়েছিল তাও সেখানে পড়ে ছিল।

কিন্তু সব ছাপিয়ে গেছে ভয়াবহ এক দৃশ্য। কবরের একপাশে আধবসা অবস্থায় রয়েছে এক নরকঙ্কাল, গায়ের জামা আর প্যান্ট ছেঁড়া ন্যাকড়া হয়ে গেছে, কবরে উঁকি মেরে যেন কিছু দেখছে কঙ্কালটা আর দাঁত বের করে হাসছে, একটা মড়ার খুলির দন্ত বিকশিত বীভৎস হাসি, যা দেখে অতি বড়ো সাহসীরও বুক কেঁপে ওঠে।

কবরের মধ্যে আরও দুটো শব, একটার ওপর আরেকটা, কবরের পাশে যেটা আধবসা অবস্থায় রয়েছে, ওপরেরটা সেটার মতোই কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। তলাকার মৃতদেহটার কিন্তু পচনের শেষ অবস্থা, তবে অন্য দুটোর মতো অত দীর্ঘকালের শব নয়।

ওই মৃতদেহটা কেমন যেন চেনা চেনা মনে হল আতঙ্কিত রোলি আর পাওয়ারের। তবু সাহসে ভর করে রোলি হাতের চারাগাছটা দিয়ে ওপরের কঙ্কালটা একপাশে সরাতেই দু-জনে চমকে উঠলেন। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাবার পর জলপ্রপাতের মাঝখানে যার মূর্তি দেখা গিয়েছিল, নীচের মৃতদেহ তার।

এই আবিষ্কারে দু-জনেই হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। সমস্ত ব্যাপারটাই ভূতুড়ে এ বিষয়ে তাঁদের মনে সন্দেহ ছিল না। একটা ঘটনা তাঁদের কাছে খুব রহস্যজনক মনে হচ্ছিল। দুটো মৃতদেহ অনেক বছরের পুরোনো, তৃতীয়টা সেই তুলনায় অত পুরোনো নয়। তা যদি হয় তবে যার মৃত্যু পরে হয়েছে তার ওপর অন্য মৃতদেহ কী করে এল, যার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে? যুক্তিতে বলে আগে যার মৃত্যু হয়েছে তার দেহটাই থাকবে তলায় আর পরেরটা ওপরে।

রোলি এবং তাঁর বন্ধু যদি কোনো সূত্র পাওয়া যায় এই আশায় গুহার চারদিকে তাকালেন। একটা পুরোনো কোট তাঁদের চোখে পড়ল। ওটাও ন্যাকড়ার মতো হয়ে এসেছে, তবে নামকরা দর্জির ঘরে উৎকৃষ্ট কাপড়ের তৈরি। সিডনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক দর্জির দোকানের লেবেল লাগানো ছিল ওই কোটে। কোটের পকেটে একটা চৌকো ধাতব বাক্স পাওয়া গেল, ওপরে খোদাই করা ছিল ‘জর্জ উডফল, পটস পয়েন্ট, সিডনি।’ সেই বাক্সর ভেতর ছিল উডফলের স্বীকারোক্তি, কেমন করে সব সোনা আত্মসাৎ করার জন্য সে তার সঙ্গী দু-জনকে খুন করেছিল, কীভাবে এক অপ্রতিরোধ্য আর ভয়ংকর অপশক্তির তাড়নায় বছরের পর বছর সে এই গুহায় আসতে বাধ্য হয়েছিল।

উডফলের অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা হল, কিন্তু পুরোটা নয়। স্বীকারোক্তিতে উডফল লিখেছিল শেষবারের মতো সে গুহায় যাবে, ফিরে এসে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু সে আর ফেরেনি। তবে কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছিল?

ওই অগভীর কবরের মধ্যে হার্পার আর ফ্রিথের মৃতদেহ সে শুইয়ে রেখেছিল। উনিশ বছর ওই গুহায় গিয়ে তাদের সেই অবস্থায় শায়িত দেখেছিল উডফল। স্বীকারোক্তি লেখার পর বিংশতি তীর্থযাত্রায় ওই গুহায় গিয়ে সে কী দেখেছিল? তার মৃত সঙ্গীরা কবরের ধারে তারই জন্য অপেক্ষা করছে? স্বীকারোক্তি করার পরেই কি সে অশুভ আত্মার ক্ষমতার শিকার হয়েছিল?

রোলি আর পাওয়ার তিনটি দেহ বা কঙ্কালকে ওই গুহার মধ্যে সমাধিস্থ করেছিলেন। যাজক পাওয়ার তাদের আত্মার মুক্তির কামনায় উপাসনা করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল উডফলের স্বীকারোক্তি যাতে তাঁদের হাতে পড়ে এবং সেইসঙ্গে তিনটি মৃতদেহের ক্রিশ্চান ধর্মমতে সৎকার হয় তাই এক অদৃশ্য শক্তি ওই গুহায় নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের। দীর্ঘকাল যন্ত্রণাপীড়িত তিনটি আত্মা হয়তো শান্তি পেয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

তাদের সমাধির ওপর তিনি আর রোলি স্বর্ণখচিত স্ফটিকের স্তূপ দিয়ে সমাধিস্তম্ভ বানিয়ে দিয়েছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *