শয়তান

শয়তান

আমার এই কাহিনি পাঠ করে কেউ যদি আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেন তবে আমি তাঁকে দোষ দেব না। ঘটনার একমাত্র সাক্ষী মি ভেঙ্কটরমন অনেকদিন আগেই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন, আর অনিমা…! তাকে নিয়েই তো আমার এই কাহিনি।

অনিমাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ওকে বধূরূপে পেয়ে আমি নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম আর আমার পরিচিতরা আমার সৌভাগ্যকে ঈর্ষা করেছিল।

আমি একজন আর্টিস্ট। আর্ট কলেজেই অনিমার সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি যেবার ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র সে-বছরই অনিমা ওখানে ভরতি হয়। ওর সুন্দর চেহারা, রুচিসম্পন্ন বেশবাস আর মার্জিত ব্যবহারে অনেকের মতো আমিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অনিমাও অনেকের মধ্যে আমাকেই বরণ করে নিয়েছিল।

আমার বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের ক্রিমিনাল সাইডের একজন জাঁদরেল অ্যাডভোকেট। শুনেছি তিনি নাকি যুক্তিতর্কের মায়াজালে মরা মানুষকে জীবিত বলে প্রমাণ করতে পারতেন। সারাজীবন তিনি যা রোজগার করেছিলেন তা দু-তিন পুরুষের পক্ষে হেসে খেলে কাটাবার পক্ষে যথেষ্ট। বলা বাহুল্য আমি তার একমাত্র সন্তান।

বিয়ের পর আমরা মধুচন্দ্রিমা যাপনের উদ্দেশ্যে উতকামন্দ গিয়েছিলাম। সমুদ্রপিঠ থেকে উটির উচ্চতা আট হাজার ফুট। মেট্টপালায়াম থেকে ‘ব্লু মাউন্টেন’-এ চেপে নীলগিরি পর্বতের অতুলনীয় শোভা দেখতে দেখতে আমরা চললাম। দুই ধারে খাড়া পাহাড়ের গায়ে গাছপালা, ঘন জঙ্গল, সবই যেন ঘন নীল, নীলে নীলে নীলিমা। পাহাড়ের নাম নীলগিরির কী সুন্দর সার্থকতা! মাঝে মাঝে পুঞ্জ পুঞ্জ শুভ্র মেঘ ভেসে এসে নীল পাহাড়ের ওপরদিকটা ঢেকে ফেলছে, তারপর অনেকটা নীচু দিয়ে আবার চলে যাচ্ছে। এত কাছে মেঘ কোনোদিন দেখিনি তাই আমাদের আনন্দ ও বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। পাহাড়ের ঢালু গায়ে সারি সারি চা বাগিচাও ট্রেন থেকে চোখে পড়ে। চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনিমা মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল, তার দু-চোখে ফুটে উঠেছিল একটা অস্বাভাবিক দীপ্তি।

কলকাতা থেকেই লেখালেখি করে আমি উটিতে একটা বাড়ি ভাড়া করেছিলাম। বাড়ির মালিক এক ভদ্রমহিলা, নাম তাঙ্গম পিল্লাই। মি পিল্লাই এক চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন, বছর কয়েক হল মারা গেছেন। মিসেস পিল্লাই বেশির ভাগ সময় কোয়েম্বাটুর থাকেন। উটির বাড়িতে তিনি বছরে মাস দুই কাটান, বাকি দশ মাস চেঞ্জারদের ভাড়া দেন। আমার এক বন্ধু বিশ্বনাথন মিসেস পিল্লাইয়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়, কলকাতায় এক সওদাগরি অফিসে কাজ করে। তার সুপারিশেই আমি বাড়িটা ভাড়া পেয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট শহর উটি, প্রকৃতির লীলা নিকেতন। মিসেস পিল্লাইয়ের বাড়ি একটা গির্জার কাছে, অঞ্চলটা বেশ নির্জন। গির্জার প্রায় লাগোয়া ক্রিশ্চানদের সমাধিভূমি। শুধু এটার উপস্থিতিতেই অনিমার মনে একটু খুঁতখুঁতের কারণ হয়েছিল, নতুবা সে-খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছিল।

আমরা সৌভাগ্যক্রমে বাড়ির কাজকর্ম করার জন্য একজন পাহাড়ি মেয়ে পেয়েছিলাম, নাম মুনিয়া। মুনিয়ার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ, চমৎকার স্বাস্থ্য, প্রাণপ্রাচুর্যে উচ্ছল ছিল মেয়েটি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওর সঙ্গে আমরা কথাবার্তা চালাতাম। মুনিয়া এক ইংরেজ পরিবারে অনেক বছর ছিল তাই খুব অসুবিধে হচ্ছিল না। যখন ও আমাদের কোনো কথা বুঝতে পারত না কিংবা আমাদের কিছু বোঝাতে পারত না তখন ও হেসে লুটিয়ে পড়ত, আমরাও না হেসে পারতাম না।

দিন কয়েক বেশ আনন্দে কেটে গেল। আমরা উটি গিয়েছিলাম এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে। বাংলাদেশে তখন গরমে প্রাণ আইঢাই, কিন্তু ওখানে সূর্যাস্তের পর থেকেই তাপমাত্রা দ্রুত নামতে থাকে, ফলে রাত্রে বেশ শীত পড়ে। এর মধ্যে একদিন বিকেলে শিলাবৃষ্টি হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আমাদের চারপাশ সাদা হয়ে গেল যেন কেউ বিরাট একটা সাদা চাদর বিছিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া, সে কী হাড় কাঁপানো শীত!

সকাল বিকাল আমি আর অনিমা বেড়াতে বেরুতাম। পাকা সড়ক ধরে অনেকটা হাঁটতাম। সময়টা ছিল শুক্লপক্ষের মাঝামাঝি। জ্যোৎস্নায় পাহাড়ের সৌন্দর্য যেন শতগুণ বেড়ে যেত। অনেক জায়গায় পথের ধারে পাহাড়ি খাদ গভীরে নমে গেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় বনানী ও জঙ্গলাকীর্ণ খাদের মায়াবিনী সৌন্দর্য আমরা মোহাবিষ্টের মতো উপভোগ করতাম।

অনিমাকে সাহস দেবার জন্য একদিন আমরা সমাধিস্থলে গিয়েছিলাম। প্রত্যেক সমাধির ওপর একটা করে ক্রসচিহ্ন। তলাটা বাঁধানো, তার ওপর মৃতের পরিচয় খোদাই করা রয়েছে। বেশির ভাগ সমাধিই ইউরোপিয়ানদের। সমাধিভূমির ঠিক মাঝখানে একটা পাথরের মূর্তি আমাদের বিস্মিত করেছিল। মূর্তিটি প্রায় এক মানুষ সমান, একটা উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। মূর্তির মুখে একটা পৈশাচিক নিষ্ঠুরতার ছাপ। কুতকুতে চোখ দুটিতে যেন শয়তানের দৃষ্টি, একটু তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি বোধ হতে থাকে, মনে হয় চোখ দুটো যেন জীবন্ত।

সমাধিভূমিতে মূর্তিটা কেমন যেন বেখাপ্পা। পরে জেনেছিলাম জীবিতকালে ওই মূর্তির নাম ছিল হেনরি। এই অঞ্চলের এক চা বাগানের সে ছিল মালিক। নৃশংসতায় তার জুড়ি মেলা ভার। তার অধীনস্থ কুলি মজুরদের ওপর সে অকথ্য নির্যাতন চালাত, সামান্য কারণে তার চাবুক নির্দয় হয়ে উঠত। তার বুটের লাথি খেয়ে কতজন যে জীবন হারিয়েছে তার হিসেব নেই। মেয়েরাও রেহাই পেত না। শয্যাসঙ্গিনীর প্রয়োজনে কুলি মজুরদের সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী মেয়ে-বউদের সে ঘর থেকে টেনে বের আনত, স্বেচ্ছায় না এলে চাবকাত, কেউ বাধা দিতে গেলে তার কপালে জুটত প্রচণ্ড প্রহার।

হেনরি নিজেও ছিল বলিষ্ঠ। তার অত্যাচারে কুলিদের মধ্যে চাপা বিক্ষোভ থাকলেও হিংস্র মাতাল সাহেবটাকে তারা জুজুর মতো ভয় করত। তা ছাড়া তখন ছিল পুরো ইংরেজ রাজত্ব, সাদা চামড়ার প্রতি স্বভাবজাত ভীতি দেশীয় লোকদের মধ্যে প্রবল ছিল। স্থানীয় পুলিশ সুপার ছিলেন হেনরির বিশেষ বন্ধু, তাই পর পর কয়েকটা খুনের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। কুলি-মজুর হত্যার অপরাধে সাদা চামড়ার বিচার তখনকার দিনে হয় অকল্পনীয় ছিল নতুবা প্রহসনে দাঁড়িয়েছিল। তা ছাড়া টাকা দিয়ে কেমন করে লোকের মুখ বন্ধ করতে হয় ধূর্ত হেনরি তা ভালোভাবেই জানত। এহেন ব্যক্তির মূর্তি সমাদরে গির্জার সমাধিভূমিতে স্থান পেয়েছে ভেবে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। কিন্তু এই পৃথিবীতে বিস্ময়ের কিছু নেই। টাকায় কী না সম্ভব! জীবিতকালেই হেনরি গির্জার অধ্যক্ষকে প্রস্তাব দিয়েছিল যদি তার মূর্তি সমাধিভূমিতে স্থাপন করা হয় তবে গির্জার কোষাগারে সে প্রচুর টাকা দান করবে।

হেনরি বিয়ে করেনি, চা-বাগান থেকে তার বাৎসরিক আয় ছিল প্রচুর, সুতরাং দু-হাতে টাকা উড়িয়েও সে শেষ করতে পারত না। গির্জার অধ্যক্ষ তার প্রস্তাবিত দানের টাকার অঙ্ক শুনে প্রলোভন সংবরণ করতে পারেননি এবং তারই ফলে জীবিতকালেই হেনরির মর্মর মূর্তি সমাধিভূমিতে স্থাপন করা হয়। অদৃষ্টের এমন পরিহাস, যেদিন এই মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক সেই রাত্রে হেনরি নৃশংসভাবে নিহত হয়।

এক মজুরের বউকে সে ধরে এনেছিল তার বাংলোয়। আত্মপ্রসাদে সেদিন তার খোশমেজাজ ছিল। কামনা চরিতার্থের পর কয়েক বোতল সুরা পান করে সে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল, সেই সুযোগে কুলি বউটি একটা ছুরি দিয়ে তার কণ্ঠনালি দু-ফাঁক করে দেয়। হেনরি কোনোরকম বাধাই দিতে পারেনি। বউটি অবশ্য নিজেও আর বাঁচেনি, পাহাড়ের গভীর খাদে লাফিয়ে পড়ে সমস্ত গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছিল। অবশ্য এটা বহুদিন আগের ঘটনা।

গির্জার পাশ দিয়ে রাস্তাটা ছিল চড়াই, সেই চড়াই পেরিয়ে কিছুটা গেলেই মি ভেঙ্কটরমনের বাড়ি। ভদ্রলোক বিপত্নীক, দুই ছেলের একজন দিল্লি আর একজন ব্যাঙ্গালোরে উঁচুপদে কাজ করে। একমাত্র মেয়ের ভালো বিয়ে হযেছে, থাকে বম্বের নাসিকে। মি ভেঙ্কটরমনের চাকুরিজীবন কিন্তু কেটেছে কলকাতায়। বাংলা ভালো বুঝতে পারেন এবং বঙ্গদেশের প্রতি তার গভীর মমতা কথাবার্তার মধ্যে ফুটে ওঠে। আমরা বাঙালি দেখে যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে তিনি আমাদের প্রকৃত হিতৈষী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মুখেই হেনরির কীর্তিকলাপ শুনেছিলাম।

দিনগুলি যেন দেখতে দেখতে কেটে যেতে লাগল। অনিমার ফর্সা গালে লাল ছোপ পড়ল আর আমিও ওজন বাড়ছে তা বুঝতে পারলাম। পূর্ণিমা পার হয়ে আমরা অমাবস্যা তিথিতে পড়লাম। হঠাৎ একদিন অনিমা জানাল যে মুনিয়া নাকি থাকতে চাইছে না। আমি একটু অবাক হয়েই কারণ জানতে চাইলাম। অনিমা বলল আমি যেন মুনিয়ার কাছ থেকেই কারণটা জেনে নিই। অনিমার আচরণ আমার কাছে বেখাপ্পা ঠেকল। যাই হোক, আমি আর কথা বাড়ালাম না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাবার পর আমি মুনিয়াকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে ব্যাপার কী জানতে চাইলাম। মুনিয়া বলল, তার বাপ ঠাকুরদা সকলেই চা-বাগানের শ্রমিক ছিল। আমরা যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছি আগে সেখানেই ছিল কবরখানার শয়তান সাহেবের বাংলো। সাহেব খুন হয়েছিল মে মাসের অমাবস্যার রাত এগারোটায়। ফি বছর ওই রাত্রে ঠিক এগারোটায় সাহেবের আত্মা জেগে ওঠে, পাথরের মূর্তিতে শয়তান এসে ভর করে আর সেই শয়তান সাহেবটা তার নিজের বাংলোয় ফিরে আসে। আমি অবাক হয়ে বললাম, সাহেবের বাংলো তো এখন আর নেই। মুনিয়া জবাব দিল, তা না থাক, ঠিক জায়গায় এই বাড়িটা তো আছে। এই বাড়ির যিনি মালকিন, তিনি নাকি কখনো মে মাসের অমাবস্যার রাত্রে এই বাড়িতে কাটান না।

আমি জিজ্ঞেস করলাম সেই শয়তান সাহেবকে কেউ কখনো স্বচক্ষে দেখেছে কি না। এ প্রশ্নের ঠিক উত্তর মুনিয়া দিতে পারল না। তার বাপ ঠাকুরদার মুখে সে এই কাহিনি শুনেছে, তা সে কেমন করে অবিশ্বাস করবে। তা ছাড়া প্রতি বছর ওই ভয়াবহ রাতের পর এই বাড়িতে নাকি উৎপাতের চিহ্ন দেখা যায়, মনে হয় কেউ যেন ভীষণ আক্রোশে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গেছে। বৃষ্টিভেজা রাতে ওই নরম মাটির ওপর বড়ো বড়ো পায়ের ছাপও দেখা যায়। আমার বুঝতে কষ্ট হল না এই কাহিনির পেছনে আছে একটা অশিক্ষাজনিত কুসংস্কার, কুলি-মজুরদের মধ্যে যা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে বেশ ভালোভাবেই শেকড় গেড়ে বসেছে। আমি মুন্নিকে অভয় দিয়ে বললাম যে আমরা তো আছি, তার কোনো ভয়ের কারণ নেই। সে কিন্তু কিছুতেই থাকতে রাজি হল না, তবে কথা দিল অমাবস্যার রাতটা কাটার দিন দুই পর সে ফিরে আসবে। আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম অমাবস্যার আর মাত্র ক-টা দিন বাকি।

পরদিন সকালে ভেঙ্কটরমনের সঙ্গে দেখা করে মুন্নির মুখে শোনা কাহিনি তাঁকে আমি খুলে বললাম। সব শুনে তিনি বললেন যে এখানকার নিম্নশ্রেণির লোকদের মধ্যে এ ধরনের একটা প্রবাদ চালু আছে বলে তিনিও শুনেছেন, কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ তিনি পাননি। খালি বাড়িতে চোরের উপদ্রব মোটেই অসম্ভব নয়, সেটাই ফেনিয়ে অমাবস্যার রাত্রে উৎপাতের সঙ্গে জুড়ে বেশ একটা চমদার গল্প সৃষ্টি করা হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটাই আজগুবি আর কুসংস্কার বলে তিনি উড়িয়ে দিলেন।

অনিমা কিন্তু মুনিয়ার মুখে হেনরির প্রেতাত্মার সজীব হয়ে ওঠার কাহিনি শোনার পর থেকে বেশ মুষড়ে পড়েছিল। সামান্য কারণে চমকে ওঠা, কারো পায়ের শব্দ শুনলে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, এসব ছাড়াও একটা ঘোর আতঙ্ক ওকে যেন পেয়ে বসেছিল। আমি ওর অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম, কলকাতা ফিরে যাব কি না ভাবছিলাম। মিস্টার ভেঙ্কটরমনকে আমার অভিপ্রায় জানাতেই তিনি কিন্তু ঘোর প্রতিবাদ করলেন। একটা গাঁজাখুরি প্রবাদে ভয় পেয়ে আমাদের পালিয়ে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারলেন না, বিশেষ করে আমি যখন তিন মাসের টাকা আগাম দিয়ে বাড়ি ভাড়া করেছি। ভেঙ্কটরমনের কথায় আমার পৌরুষে ঘা লাগল। ছোটোবেলা থেকেই আমার খুব সাহস; একবার মফস্সল বন্ধুরে সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে বাজি ধরে আমি একা গভীর রাত্রে শ্মশানে ঘুরে এসেছিলাম। ভেবেচিন্তে আমি স্থির করলাম; না, কলকাতায় ফিরব না বরং অনিমাকে চোখে চোখে রাখব আর ওর মন থেকে ভয় দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। সেইমতো অনিমাকে নিয়ে আমি খুব বেড়াতে লাগলাম। উটি থেকে কিছু নীচে আরেকটা শৈলনিবাস কুনুরে দু-দিন কাটিয়ে এলাম। কুনুরে ‘সিমস পার্ক’ দেখে অনিমার ভালো লাগল। চমৎকার সাজানো গোছানো উদ্যান ‘সিমস পার্ক’, বাহারি পাতা নিপুণভাবে কেটে কেমন সুন্দর সব পশুপক্ষীর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এইভাবে দিন কয়েক কেটে গেল। অনিমা যেন আতঙ্ক অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে, ওর চোখে-মুখে একটা প্রফুল্লভাবে লক্ষ করে আমি খুশি হলাম। মিস্টার ভেঙ্কটরমন রোজ দু-বেলা আমাদের ওখানে বেড়াতে আসতেন, অনেকক্ষণ গল্পগুজব করতেন। অবশ্য হেনরি সম্বন্ধে কোনো প্রসঙ্গই তিনি অনিমার সামনে আলোচনা করতেন না। ভদ্রলোকের বিচারবুদ্ধির ওপর আমার গভীর শ্রদ্ধা জন্মে গেল।

সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সারতে দশটা বেজে গেল। সাধারণত আমরা ন-টার মধ্যেই খাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলি কিন্তু মুন্নি যাওয়ার পর থেকে অনিমাকে একা সব দিক সামলাতে হয় বলে একটু রাত হচ্ছিল। আমরা এসে ড্রয়িং রুমে বসলাম। বেশ শীত করছিল। অনিমা আমার একটা পশমি চাদরে সর্বাঙ্গ ঢেকে বেশ আয়েশ করে বসে ট্রানজিস্টারে গান শুনিছল। আমার কিন্তু ঠান্ডাটা বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিল।

একটা সিগারেট শেষ করে আমি অনিমাকে জিজ্ঞেস করলাম বাইরে একটু হাঁটবে কি না। ও কিন্তু রাজি হল না, সারাদিনের খাটাখাটুনির পর আর ওর হাঁটবার ইচ্ছে নেই। আসলে অনিমা একটু শীতকাতুরে, বাইরে ঠান্ডায় বেরোতেই ওর যত অনিচ্ছা।

আমি একটা গরম ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে বললাম তবে আমি একাই একটু ঘুরে আসি। অনিমার দু-চোখে একটা ত্রাসের ভাব ফুটে উঠল। মুখও যেন একটু বিবর্ণ হল। ও আমার দিকে ভীরু চোখে তাকিয়ে বলল রাত হয়ে গেছে, আমি না হয় আর না-ই বেরুলাম। আমি ওকে ভীরু কপোতী বলে ঠাট্টা করলাম, তারপর আদর করে ওর গালে হাত বুলোতে বুলোতে বললাম যে দশ পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমি আসব, তা ছাড়া কাছেই থাকব। রাত্রে খাওয়ার পর একটু হাঁটা আমার বরাবরের অভ্যেস, না হলে ঘুমই আসে না। অনিমা একথা জানত, তাই আর বাধা দিল না। গির্জার এদিকটা বেশ অন্ধকার, আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের দেখা পেলাম না। বাড়ির সামনেই পায়চারি করছিলাম, বাইরে থেকে জানলা দিয়ে অনিমাকে দেখতে পাচ্ছি, ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ও যেন চোখ বুজে গান শুনছে। দ্বিতীয় সিগারেটটা শেষ করে ভাবলাম গির্জা ছাড়িয়ে খানিকটা গিয়ে ফিরে আসব। বড়ো বড়ো পা ফেলে আমি হাঁটা শুরু করলাম। গির্জা ছাড়িয়ে এগুতেই ঢং ঢং করে রাত এগারোটা ঘোষণা করল।

ফেরার পথে আমার কী খেয়াল হল ভাবলাম সমাধিভূমিটা ঘুরে হেনরির মূর্তিকে একবার দেখে যাই। আগেই বলেছি আমার প্রচণ্ড সাহস ছিল। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। আমি সমাধিভূমির দিকে হাঁটা দিলাম। ভেতরের ঢোকবার কাঠের গেটটা দেখলাম খোলাই রয়েছে। আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি মনে মনে চিন্তা করলাম, অনিমা যদি জানত যে আমি একা এই নির্জন রাত্রে সমাধিভূমিতে এসেছি তবে ও নিশ্চয়ই মূর্ছা যেত। কথাটা মনে হতেই আমি হেসে উঠলাম। ততক্ষণে আমি হেনরির মূর্তি যেখানে ছিল সেখানে চলে এসেছি। টর্চের আলো হেনরির মুখের ওপর ফেললাম। শক্তিশালী টর্চ। আলো দূরে ঠিকরে পড়ল আর আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, মূর্তিটা নেই। তবে কি কেউ ওটা চুরি করেছে আর সেজন্যেই গেট খোলা ছিল। কিন্তু পাথরের মূর্তি চুরি করে লাভ কী! তা ছাড়া অত ভারী মূর্তি সরানো সোজা কথা নয়! তবে কি আমার চক্ষুভ্রম হল! আমি এগিয়ে মূর্তিটা যে বেদির ওপর ছিল তার ওপর হাত বুলোলাম, মসৃণ পাথরের বেদি। হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মতো আমার মনে পড়ল সেইদিনই মে মাসের অমাবস্যা আর একটু আগেই গির্জার ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজেছে। তবে কি…! আমি আর ভাবতে পারলাম না, বাড়ির দিকে ছুটলাম। রাস্তায় পড়তেই মনে হল কেউ যেন আমাকে অনুসরণ করছে। চারদিকে টর্চের আলো ফেললাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, একটা ভীষণ ভয় আমাকে পেয়ে বসল। আমি আর না দৌড়ে হাঁটতে শুরু করলাম আর সঙ্গেসঙ্গে আমার সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। রাস্তার পাশে ঘন ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলির ফাঁক দিয়ে কেউ যেন আমার সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে হাঁটছে। শুকনো পাতার ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে চলার শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, পায়ের শব্দটাও সঙ্গেসঙ্গে থেমে গেল। আমি সেই শব্দ লক্ষ করে টর্চের আলো ফেললাম আর ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলোর আড়াল থেকে কে যেন চাপা বিদ্রূপের হাসি হেসে উঠল। তারপরই আমি দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটলাম। আর ভয় পাওয়ার দরুন কিংবা অন্য যে কারণেই হোক বাড়ির দিকে উলটো মুখ করে আমি ছুটতে লাগলাম। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে একটা ছায়ামূর্তি আমার পথরোধ করে দাঁড়াল। আমি তাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতে একটা শক্ত হাত আমার ডান বাহুমূল চেপে ধরল। আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করলাম কিন্তু আতঙ্কে আমার গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরুল না। পরক্ষণেই মিস্টার ভেঙ্কটরমনের গলা শুনতে পেলাম, হোয়াটস রং উইথ ইউ? আপনি দৌড়োচ্ছেন কেন?

আমার মনে সাহস ফিরে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে আমি সমাধিভূমিতে কী দেখেছি তাঁকে বললাম। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন, তারপর বললেন, আপনার নিশ্চয় ভুল হয়েছে, চলুন তো দেখে আসি। আমরা দু-জনে আবার সমাধিভূমির দিকে চললাম। আশ্চর্য! এবার কিন্তু গেট বন্ধ, অথচ আমি হলপ করে বলতে পারি ওটা আমি বন্ধ করিনি। হেনরির মূর্তির কাছে এসে টর্চ জ্বালিয়ে আমি দ্বিতীয়বার হতভম্ব হলাম। মূর্তিটা বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, শক্তিশালী টর্চের তীব্র আলোয় ওর চোখ দুটো যেন শয়তানের মতো হাসছে। মি ভেঙ্কটরমন বললেন, দেখলেন তো আপনার কেমন চোখের ভুল হয়েছিল। মূর্তিটার কাছেই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ বলে উঠলেন, ডান হাতের কড়ে আঙুলটা দেখছি ভেঙে গেছে। সমাধিভূমি থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। মি ভেঙ্কটরমনই আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার প্রস্তাব করলেন, আমি আর আপত্তি করলাম না। আমার তখন অবস্থা অনেকটা বুদ্ধিভ্রংশের মতো। বাড়িতে ঢুকে আমি অনিমার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে ভাবলাম ও বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

বসবার ঘরে পা দিয়েই আমি থমকে দাঁড়ালাম। ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো, এদিক-ওদিক ছড়ানো, বড়ো সোফাটা ওলটানো, একটা বড়ো কাচের ফুলদানি ভাঙা অবস্থায় মেঝের ওপর পড়ে আছে, যেন কেউ ওটা আছড়ে ভেঙেছে। আমি এবার সত্যিই শঙ্কিত হলাম। অনিমা, অনিমা, বলে প্রায় চিৎকার করে আমি শোবার ঘরের দিকে ছুটলাম। শোবার ঘরে আর এক দৃশ্য আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। মেঝের ওপর অনিমা হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে আছে। ওর বেশবাস বিপর্যস্ত, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, মুখে একটা দারুণ আতঙ্কের ছাপ। কোনো কারণে ভীষণ ভয় পেয়ে অনিমা অজ্ঞান হয়ে গেছে, আমি নিজেকে ধিক্কার দিলাম কেন ওকে একা রেখে বাইরে গিয়েছিলাম। ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে আমি ওর নাম ধার ডাকতে লাগলাম। কপালে হাত দিয়েই আমি চমকে উঠলাম, শরীরটা যেন হিম হয়ে গেছে। মি ভেঙ্কটরমন আমার পেছন পেছন শোবার ঘরে এসেছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি অনিমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ওর নরম কবজি নিজের হাতে তুলে নাড়ি পরীক্ষা করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বোধ হয় ডাক্তারের সন্ধানে খোলা দরজা দিয়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার সব সন্দেহের নিরসন ঘটেছে। অনিমা, আমার প্রিয়তমা অনিমা, আর বেঁচে নেই। মি ভেঙ্কটরমন যে মুহূর্তে ওর কবজিটা তুলে ধরেছিলেন তখনই সমস্ত ব্যাপারটা আমার কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বিমূঢ়ের মতো আমি তাকিয়েছিলাম অনিমার মুষ্টিবদ্ধ ডান হাতের দিকে— ওর ডান হাতের মুঠোয় একটা পাথরের ভাঙা আঙুল।

বিদেশি গল্পের ছায়ায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *