অদ্ভুতুড়ে

অদ্ভুতুড়ে

দেওঘরে বেড়াতে গিয়ে বাবার পুরোনো বন্ধু অবিনাশ চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমি হোটেলে উঠেছি শুনে তিনি জোর করেই আমাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে এলেন। অবিনাশ কাকুকে আমি বরাবরই একটু ভয় আর সমীহ করে চলতুম কারণ তাঁর মেজাজটা ছিল বড়ো চড়া সুরে বাঁধা, রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকত না।

অবিনাশ কাকুর বাড়ির নাম ‘রোজ ভিলা’। সার্থক নাম। বাড়ির সামনেই একটা চমৎকার গোলাপবাগান, একখানি সুন্দর সবুজ লন। আমার জন্য একতলায় বাঁ-দিকের শেষপ্রান্তের ঘরটা নির্দিষ্ট হল, ঘরটা অন্য সময় নাকি বন্ধই থাকে। এমন সুন্দর পরিবেশে আরও একটা সুন্দর বস্তু যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল, সেটি হল অবিনাশ কাকুর ভাইঝি ভাস্বতী। গায়ের রং কচি কলাপাতার মতো, টানা টানা ভুরু, দু-চোখে যেন সমুদ্রের গভীরতা, নাকটা একটু চাপা হলেও ভালোই লাগে, আর পদ্মের পাপড়ির মতো নরম দুটি ঠোঁট।

প্রথম দর্শনেই আমি মজে গেলুম। ভাস্বতীও যেন আমার দিকে একটু হেলেছে মনে হল। ওর চোরা চাউনি, প্রসন্ন দৃষ্টি সেই ইঙ্গিতই দিল আমাকে। সাহস করে মুখ ফুটে আমার মনের বাসনা ওকে জানাতে পারছি না। প্রথমত এ ব্যাপারে আমি একেবারেই অনভিজ্ঞ, দ্বিতীয়ত অবিনাশ কাকুর কথা ভেবে থমকাতে হচ্ছিল আমাকে। আমি যদি ধরা পড়ে যাই আর আমি তাঁর আতিথেয়তার অবমাননা করেছি বলে উনি গালমন্দ করেন এই ভয় ছিল। তা ছাড়া অবিনাশ কাকুর মেজাজের কথা তো আমার অজানা নয়।

একদিন রাত্তিরে বিছানায় আমি এপাশ ওপাশ করছিলাম। মুরগির মাংস রান্না হয়েছিল, খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে, আইঢাই করছিল পেটটা। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। হঠাৎ আমি চমকে উঠলুম। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলুম দরজার ঠিক সামনেই অবিনাশ কাকু দাঁড়িয়ে আছেন, উনি যে কখন ঘরে ঢুকেছেন আমি টেরই পাইনি। তবে কি উনি আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে আমাকে সমঝে দিতে এসেছেন! তখুনি আমার মনে পড়ল উনি তো সকালের ট্রেনে পাটনা গেছেন, পরশু ফেরার কথা। এই সুযোগে আজ ভাস্বতীর সঙ্গে একা একা সন্ধেবেলা গোলাপবাগানে বসার সুযোগ হয়ে গেল আমার। অবশ্য কথা বেশি হয়নি কারণ আমরা দু-জনে কেউই বাকপটু নই, যেমন আমি কম কথা বলি তেমন ভাস্বতীও।

অবিনাশ কাকুই ঘরে ঢুকেছেন সন্দেহ নেই। বাড়িতে লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে থাকেন, এখনও সেই পোশাক, কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা অসামঞ্জস্য। ঘরটা বড়ো, চাঁদের আলো ঘরে ঢুকলেও সর্বত্র তার অবাধ গতি নয়। সেই আলো-আঁধারির লুকোচুরিতে হঠাৎ আমার মনে হল সত্যিই কি অবিনাশ কাকু, না তাঁর আত্মা। কোনো দুর্ঘটনায় হয়তো তাঁর মৃত্যু হয়েছে তাই তাঁর আত্মা কিছু বলতে এসেছে আমাকে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, আর তখুনি সেই মূর্তিটা কথা বলল, ‘বলতে পারেন, অবিনাশবাবু কি আজ রাতে ফিরবেন?’ প্রশ্নকর্তার কথায় উৎকণ্ঠার সুর আমার কান এড়াল না।

আমি অসীম সাহসে বুক বেঁধে শান্ত গলায় বললুম, ‘আজ রাতে উনি ফিরবেন না।’

‘শুনে খুশি হলুম,’ সামনের চেয়ারটায় বসে বলল মূর্তি, ‘গত আড়াই বছর ধরে আমি এ বাড়িতে আছি কিন্তু ওই ভদ্রলোক একটা রাতও বাইরে কাটাননি। আজ আমার কী স্বস্তি তা বলে বোঝাতে পারব না।’

পা দুটো টান টান করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল সেই মূর্তি। এখন ওর চেহারা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, মুখে সত্যিই একটা নিশ্চিন্ততার ছাপ।

‘আড়াই বছর!’ আমি সবিস্ময়ে বললুম, ‘আপনার কথা আমার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।’

‘হ্যাঁ, পুরো আড়াই বছর,’ সেই মূর্তি বলল, ‘আপনার ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিক। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন আমি আসলে একজন ভূত।’

‘আমি তাই অনুমান করেছিলুম,’ আমি জবাব দিলুম, ‘আপনি কি অবিনাশবাবুর ভূত?’

‘হ্যাঁ, আমি তাঁর ভূত,’ মূর্তি জবাব দিল, ‘অথচ আমার সে-অধিকার নেই। এই কারণেই আমি এত বিচলিত, এত ভয় আমার। কাহিনি এতই বিচিত্র যে, অভূতপূর্ব বললে মিথ্যে বলা হবে না। আড়াই বছর আগে অবিনাশ চক্কোত্তি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল যখন সবাই ভেবেছিল তিনি মারা গেছেন। সেই ভুল খবরের ভিত্তিতেই আমি তাঁর ভূতের পদটা পেয়েছিলুম। ভেবে দেখুন আমার অবস্থাটা, এখানে এসে ওই পদের দায়িত্ব বুঝে নেবার পরেও ভদ্রলোক বেঁচে রইলেন, শুধু তাই নয় ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন। আমি ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেলুম। আগের অবস্থায় ফিরে যাবার ক্ষমতাও আমি হারিয়ে ফেলেছি, আবার যে মরেনি তাঁর ভূত হবার অধিকারও আমার নেই। সে এক বিটকেল অবস্থা। আমার বন্ধুবান্ধবরা আমাকে পরামর্শ দিল টুঁ শব্দটি না করে আমি যেন আমার পদটা আঁকড়ে থাকি, অবিনাশ চক্কোত্তির যথেষ্ট বয়স হয়েছে, যেকোনোদিন উনি পটকে যেতে পারেন, তখন তাঁর ভূতের পদটা ন্যায়ত আমার দখলে আসবে। কিন্তু ব্যাপার তা ঘটল না,’ ভূতের গলায় একটা হতাশার সুর, ‘বুড়োটা ক্রমেই যেন আগের স্বাস্থ্য ফিরে পাচ্ছে, কতকাল আমাকে এই সংশয় আর দোদুল্যমান অবস্থায় কাটাতে হবে তা আমি জানি না। সারাক্ষণ আমাকে ওই বুড়োর সামনে যাতে না পড়ি সেদিকে লক্ষ রেখে চলাফেরা করতে হয়। এ বাড়ি ছাড়বার উপায় আমার এখন নেই, এদিকে ওই বুড়ো চক্কোত্তি সবসময় যেন আমাকে অনুসরণ করছে। বিশ্বাস করুন, ওই বুড়োটাকে আমি ভূতের মতো ভয় করি।’

‘হ্যাঁ, সত্যিই বড়ো জটিল ব্যাপার,’ আমি মন্তব্য করলুম, ‘কিন্তু আপনি অবিনাশ চক্রবর্তীকে ভয় করেন কেন? উনি আপনার ক্ষতি করতে পারেন না।’

‘তা পারেন না বটে,’ ভূত স্বীকার করল, ‘কিন্তু ওঁকে দেখামাত্র আমার হৃৎকম্প শুরু হয়। জীবিত মানুষের ভূত হয়ে আমি এখনও আছি— এটাই মস্ত বেআইনি ব্যাপার। ভেবে দেখুন, আমার অবস্থায় পড়লে আপনার মনের অবস্থা কেমন হত?’

অমন অবস্থার কথা চিন্তা করতে গিয়ে আমার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল।

‘তা ছাড়া, ভুল করে কারো ভূত হলেও,’ ভূত আবার বলতে থাকে, ‘অবিনাশ চক্কোত্তির ভূত না হয়ে অন্য যেকোনো মানুষের ভূত হওয়া অনেক ভালো। ওর কী মেজাজ! যদি কখনো আমাকে দেখে ফেলে, আর জানতে পারে আমি এতদিন তাঁর বাড়িতে অনধিকার বাস করছি তবে গালাগালি দিয়ে আমার ভূত ছাড়িয়ে দেবে। আমি ওঁকে রাগে ফেটে পড়তে দেখেছি, তখন তাঁর সামনে যে কেউ কুঁকড়ে যাবে।’

এসব ঘটনা অবশ্য আমার অজানা নয়। তা যদি না হত তবে আমি হয়তো সাহস করে ভাস্বতীর কথাটা তাঁর কাছে পাড়তুম।

‘আপনার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে,’ আমি বললুম এবং সত্যিই বেচারি ভূতের জন্য দুঃখ হল আমার। ‘আপনার পরিস্থিতিটা সত্যিই বেশ ঘোরালো।’

‘আসলে আমি এখানে এসেছি অবিনাশ চক্কোত্তির স্থান নিতে, তাঁর সঙ্গে বসবাস করতে নয়। চক্কোত্তি যদি ব্যাপারটা টের পায় তবে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বে।’

আমি সম্মতিসূচক ঘাড় দোলালুম।

‘এখন উনি বাড়ি নেই, আমি নিশ্চিন্তভাবে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারি,’ ভূত বলল, ‘আপনার কাছে সব খুলে বলতে পেরেও আমি খুশি। জানেন, এ ঘরে আসার পর থেকে প্রত্যেক রাত্রেই আমি আপনাকে লক্ষ করছি, কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি। আপনি আমার সঙ্গে আলাপ করলে চক্কোত্তি মশাই যদি আমার ব্যাপারটা টের পেয়ে যান সেই ভয়েই চুপ করে ছিলুম। উনি হয়তো ভাববেন আপনি একলা ঘরে আপন মনে কথা বলছেন।’

‘কেন, আপনার গলা উনি শুনবেন না?’ আমি কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলুম।

‘না,’ ভূত জবাব দিল, ‘এমন সময় আসে যখন সামনাসামনি পড়লে যে কেউ আমাকে দেখে ফেলতে পারে কিন্তু যার সঙ্গে আমি কথা বলছি সে ছাড়া অন্য কেউ আমার কথা শুনতে পাবে না।’

‘কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল কেন আপনার?’

‘কারণ কতদিন মৌনী বাবা সেজে বসে থাকা যায় বলুন। ভূত হলেও আমাদের কথা বলার ইচ্ছে তো হয় আর এখানে কাছেপিঠে আর কোনো ভূত নেই। তা ছাড়া এমন কারু সঙ্গে আমরা কথা বলতে ভালোবাসি যাদের মন দুর্ভাবনায় ভরে আছে, যারা চট করে ভয় পায় না। আপনার মনের অবস্থা এখন তেমন। ভালোবাসার ব্যাপারে কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না।’

‘সে কী!’ আমি থতোমতো খেলুম।

‘লজ্জা পাবেন না,’ ভূত হাসল। ‘যাক আপনার কাছে আমার একটা আর্জি আছে। ব্যাপার-স্যাপার যা দেখছি চক্কোত্তি খুড়োর এখন মরার ভাবগতিক নেই ফলে আমার অবস্থাটা দিন দিন জটিল হয়ে পড়ছে। এখন আমার একমাত্র সুযোগ হল যদি বদলি হতে পারি।’

‘বদলি!’ আমি অবাক হয়ে বললুম।

‘মানে আমি যখন জীবন শুরু করেছি, আমার এখন আসল ভূত হতে হবে। সত্যিই মারা গেছে এমন একজনের ভূত।’

‘সে আর এমন কী কঠিন ব্যাপার,’ আমি জবাব দিলুম। ‘কত লোকই তো মারা যাচ্ছে, সুযোগ একটা নিশ্চয়ই আসবে আপনার।’

‘আপনি যত সহজ ভাবছেন ব্যাপারটা তত সহজ নয়,’ ভূত বিরস মুখে জবাব দিল, ‘এসব পদের জন্য যে কী ভীষণ প্রতিযোগিতা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। একটা ভূতের পদ খালি হওয়ামাত্র, তার জন্য যে কী কাড়াকাড়ি পড়ে যায় সে-ধারণা আপনার নেই।’

‘অবস্থা যে এমন গুরুতর তা আমার জানা ছিল না,’ আমি কৌতূহলী হয়ে উঠলুম, ‘এ ব্যাপারে একটা নিয়ম থাকা উচিত কিংবা একটা সিনিয়রিটি মানে যাতে সবাই পর পর চাকরি থুড়ি কেউ মারা গেলেই ভূতের খালি পদটা পেতে পারে।’

‘তা হবার আর উপায় নেই,’ ভূত দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আপনাদের যেমন বেকার সমস্যা, আমাদেরও তেমনি ওইসব পদের জন্য অগুনতি দাবিদার, সবসময় ভিড় লেগেই আছে। অনেককে সারাজীবন অপেক্ষা করেই কাটাতে হয়। আমার কথাই ধরুন না কেন, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কী গেরো বাধিয়ে বসে আছি। তাই ভাবছিলুম এ ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন। অল্প সময়ের মধ্যে কোথাও একটা ভূতের পদ খালি হবে, এমন ঘটনা আপনার হয়তো জানা থাকতে পারে। আপনি আমাকে খুব অল্প আগে জানালেও আমি চটপট বদলির জন্য প্রস্তুত হয়ে নেব।’

‘তার মানে, আপনি আমাকে আত্মহত্যা করতে বলছেন নাকি?’ আমি বেশ রাগত সুরেই বললুম, ‘কিংবা আপনার সুবিধের জন্য আমি একটা খুন করি তাই চাচ্ছেন?’

‘না, না অতটা নয়,’ আমার রাতের সঙ্গী একটু মুচকি হাসল, ‘অবশ্য প্রেমিক প্রেমিকাদের আমরা ভালো শিকার মনে করি। প্রেমে ব্যর্থ হলেই আত্মহত্যার প্রবণতা আসে কিনা, সেদিক দিয়ে আপনি ভালো টার্গেট। কিন্তু আমি আপনার কাছে অতটা আশা করছি না। আপনিই একমাত্র জীবিত মানুষ যার সঙ্গে আমি কথা বলছি। আমার উপকার হয় এমন কোনো খবর আপনি আমাকে দিতে যদি পারেন সেকথা বলছি, প্রতিদানে আপনার ভালোবাসার ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করব প্রতিজ্ঞা করছি।’

‘আমার তেমন কোনো ব্যাপার আছে বলে আপনি জানেন দেখছি,’ আমি না বলে পারলুম না।

‘নিশ্চয়ই,’ ভূত একটা হাই তুলে জবাব দিল, ‘এখানে আছি অথচ আমার অলক্ষ্যে কিছু ঘটবে, তা কি হয়!’

আমাকে আর ভাস্বতীকে সবসময় এমনকী আমাদের একটু অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও, একটা ভূত চোখে চোখে রেখেছে একথা ভেবে আমার কেমন যেন বিচ্ছিরি লাগল। তবে এ ভূতের ব্যাপারটা একটু আলাদা, তাই ক্ষমা করা যায়।

‘আমাকে এখন যেতে হবে,’ ভূত হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কাল আবার দেখা হবে। মনে রাখবেন, আপনি আমাকে সাহায্য করলে আমিও আপনাকে সাহায্য করব।’

পরদিন ভাস্বতীকে এ ঘটনার কিছু আমি বললুম না। হয়তো ও ভয় পাবে নয়তো আমার মাথায় গোলমাল আছে ভাববে, ফলে যেটুকু আশা আমার আছে তাও যাবে। আমি মনে মনে ভগবানকে ডাকলুম, অবিনাশকাকু যেন তাড়াতাড়ি ফিরে না আসে, এর মধ্যে নিশ্চয়ই আমি সাহস করে ভাস্বতীর কাছে আমার মনের কথা খুলে বলতে পারব।

সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ির সামনে ঢাকা বারান্দায় আমি আর ভাস্বতী বসে আছি। আকাশে চাঁদ, ফুরফুরে বাতাস বইছে। আমার মন পুলকিত হয়ে উঠল। আমি প্রেম নিবেদনের জন্য মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিতে লাগলুম। ভাস্বতীও বোধ হয় আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল, ওর চোখে-মুখেও ফুটে উঠল একটা প্রত্যাশার ছবি।

কীভাবে কথাটা পাড়ব মনে মনে মহড়া দিচ্ছি, ঠিক এমন সময় চোখ তুলে দেখি ভাস্বতীর ঠিক পেছনেই আমার মুখোমুখি বারান্দার রেলিংয়ে দু-পা ঝুলিয়ে তিনি বসে আছেন। আমার থেকে মাত্তর দশ কি বারো পা দূরে। ভাগ্যিস ভাস্বতী অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল নইলে আমি যেমন ভয়ানক চমকে উঠেছিলুম ওকে কৈফিয়ত দেওয়া মুশকিল হত। ঠিক তেমনি ভাস্বতী যদি ওর কাকুর নকল আত্মাকে অমনভাবে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখত তবেই হয়েছিল আর কি।

আমি ঘাবড়ে গেছি দেখে ভূত বলল, ‘ভয় পাবেন না, ভাস্বতী আমাকে দেখতে পাবে না, আর আমার কথাও শুনতে পাবে না।’

আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করলুম।

‘সুতরাং সেদিক দিয়ে আপনার বিচলিত হবার কারণ নেই,’ ভূত বলল, ‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনি আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মোটেই এগুতে পারছেন না। আমি যদি আপনি হতুম, তবে আর অপেক্ষা না করে মনের কথা বলতুম। এর চাইতে ভালো সুযোগ আর আপনার আসবে না। কেউ এখন বিরক্ত করার নেই। তা ছাড়া আমি যা বুঝছি, ভদ্রমহিলাও আপনার কাছ থেকে ওই ধরনের কথাই শুনতে চাইছেন। চক্কোত্তি মশায় কখন এসে পড়েন ঠিক নেই। উনি এখানে থাকলে তাঁর ভাইঝির সঙ্গে প্রেম করা আপনার পক্ষে অত সহজ হবে না। ভদ্রলোকের যা মেজাজ হয়তো আপনাকে ঠেঙিয়ে বিদায় করবেন।’

‘ঠিক বলেছেন,’ আমি বললুম, ‘উনিই এখন প্রধান বাধা।’

‘কে বাধা!’ ভাস্বতী আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশ্ন করল।

আমার কপালে ঘাম দেখা দিল। নিজের অজান্তেই আমি ভূতের কথার জবাব দিতে গিয়ে একটা বিচ্ছিরি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলেছি।

‘না মানে,’ আমি আমতা আমতা করে বললুম, ‘আমার আপিসের একজনের কথা ভাবছিলুম।’

‘আপনি বুঝি সবসময় আপিসের কথা ভাবেন,’ ভাস্বতী ঠেস দিয়ে প্রশ্ন করল।

‘না, লোকটা বড্ড আমার পেছনে লেগেছে,’ মিথ্যে কথা বলতে আমার আটকাল না।

‘আপনারা পুরুষমানুষরা আপিসে একজন শুধু আরেকজনের পেছনেই লাগতে পারেন,’ ভাস্বতীর গলার স্বর একটু যেন খাদে উঠেছে, বোধ হয় অন্য ধরনের প্রসঙ্গ ও আশা করেছিল।

আমার নিজেকে অসহায় মনে হল।

‘আপনার অমন করে কথা বলা উচিত হয়নি,’ ভূত বলল। ‘আমাকে যা বলার মনে মনে বললেই আমি টের পেতুম। এমন অসাবধানী হলে আপনি তো অসুবিধেয় পড়ে যাবেন। আপনার সব কিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাক তাই আমি চাই, তাহলে আপনিও আমাকে সাহায্য করতে পারবেন।’

আমার বলতে ইচ্ছে হল একজন জলজ্যান্ত ভূতের সামনে কোনো মহিলার কাছে প্রেম নিবেদন করা সম্ভব নয়। বরং উনি এখন বিদায় হলেই আমার উপকার করবেন। কিন্তু সেকথা মুখ ফুটে আর বলতে পারলুম না।

‘আমার বদলির ব্যাপারে সুবিধে হয় এমন কোনো খবর বোধ হয় আপনার কানে আসেনি,’ ভূত আবার বলল। ‘এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য আমি রাত্তিরে আপনার ঘরে দেখা করতে পারি কিংবা যদি বলেন আমি এখানে অপেক্ষা করছি।’

‘আপনার এখানে অপেক্ষা করার দরকার নেই,’ বেশ একটু রাগত স্বরে আমি বললুম, ‘আপনাকে কিছুই বলার নেই আমার।’

‘কী বললেন!’ ভাস্বতী স্প্রিং-এর মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখ আরক্ত, দু-চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। আমি আপনার জন্য এখানে অপেক্ষা করছি! কী ভেবেছেন আপনি!’ ওর নাকের ফুটো দুটো ফুলে উঠেছে। ‘আমাকে কী বলার থাকতে পারে আপনার!’

‘ভাস্বতী!’ আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগুবার চেষ্টা করলুম।

‘থাক থাক আর কথা ঘোরাতে হবে না,’ দু-চোখ গোল করে ঘুরিয়ে ভাস্বতী বলল, ‘আপনি নিজেকে কী মনে করেন? আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি কেমন। আপনার কাছে কিছু শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি, তাই না?’

‘বিশ্বাস করো ভাস্বতী,’ আমি প্রায় কেঁদে ফেললুম, ‘তোমাকে লক্ষ করে আমি ওসব কথা বলিনি।’

‘ও, তাই বুঝি!’ ভাস্বতীর গলায় ব্যঙ্গের সুর, ‘এখানে আমি ছাড়া আর কেউ তো নেই, তবে কি ভূতকে লক্ষ করে বলেছেন?’

‘ঠিক বলেছ, মানে না,’ আমি কথার খেই হারিয়ে ফেললুম।

আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিবাণ মেরে ভাস্বতী ভেতরে চলে গেল।

‘হতভাগা কোথাকার!’ রাগে আমি ভূতকে ধমকে উঠলুম, ‘তুমি এই ঘটনার জন্য দায়ী। আমার জীবন তোমার জন্য ব্যর্থ হয়ে গেল।’

‘আপনি মিছিমিছি আমাকে দোষ দিচ্ছেন,’ ভূত প্রতিবাদ করে উঠল। ‘আমি আপনাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলুম, উৎসাহ দিয়েছিলুম, কিন্তু আপনি অসাবধানী হয়ে এই গণ্ডগোলটা পাকিয়েছেন। তবে আপনি নিরাশ হবেন না, সাহস করে বুক বাঁধুন, আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত আপনার উদ্দেশ্য সফল হবেই।’

পরমুহূর্তে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাত্তিরে খেতে বসে ভাস্বতী আমার সঙ্গে একটি কথাও বলল না, আমি ওর হাবভাব দেখে আর ঘাঁটালুম না।

সারারাত আমার ঘুম হল না।

পরদিন ভাস্বতী হঠাৎ এত কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, সারাদিন ওর দেখাই পাওয়া গেল না। দুপুরে খাবার সময় দেখা হল, অতিথির সঙ্গে যতটুকু শিষ্টাচার না করলেই নয় তার বেশি ভদ্রতা ওর দিক থেকে প্রকাশ পেল না। তবু আমার মনে হল আমার মতো ওর মনেও সুখ নেই।

সেদিন সন্ধেবেলা অন্যান্য দিনের মতো বাড়ির সামনে ঢাকা বারান্দায় সাজানো বেতের চেয়ারের একটা দখল করে বসল না ভাস্বতী।

আমি ওকে বসবার ঘরে পেলুম। একটা গল্পের বই খুলে ও বসে ছিল। আমি ওর সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে গতকাল সন্ধ্যার ঘটনার জন্য বার বার ক্ষমা চাইলুম। বললুম, আমি অন্যমনস্কভাবে চিন্তা করতে করতে নিজের অজান্তেই জোরে কথা বলে ফেলেছিলুম এবং তার সঙ্গে ভাস্বতীর কোনো সম্পর্ক নেই।

‘আপনি কী বলতে চেয়েছিলেন আমি জানি না,’ ভাস্বতীর জবাব দিল, ‘কিন্তু আপনার আচরণ রূঢ় ছিল একথা অস্বীকার করতে আপনি পারেন না।’

আমি বললুম, ‘আমার রূঢ় আচরণের জন্য আমি অনুতপ্ত, কিন্তু আমি শপথ করে বলছি তোমাকে আমি অপমান করতে চাইনি, অমন ঘৃণিত কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ ইনিয়েবিনিয়ে আমি অনেক কিছুই বললুম, তার মধ্যে অনেক স্তোকবাক্যও ছিল, ফলে মনে হল যেন চিঁড়ে ভিজেছে, মনটা নরম হয়েছে ভাস্বতীর।

সুযোগ বুঝে আমি আমার বক্তব্য পেশ করতে লাগলুম। আমার জীবনে অর্থ-সম্মান সব কিছু আছে, কিন্তু নেই সুখ। শূন্য ঘরে আমার দীর্ঘশ্বাস দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফেরে, আমার জীবন পূর্ণ করার কেউ নেই।

এই পর্যন্ত বেশ ভালোই বলছিলুম, ভাস্বতীও আনত নয়নে আমার কথা শুনছিল। ওর পাকা আপেলের মতো গাল দুটো যেন আরও পাকা মনে হচ্ছিল। আমি উৎসাহী হয়ে আমার চেয়ারটা আরও একটু কাছে টেনে বসলুম। আর তখুনি রসভঙ্গ করলে, ভূতটা দুম করে ওখানে দেখা দিল, সঙ্গেসঙ্গে আমার বুকটা চুপসে গেল। আমার সব আশা নির্মূল হয়ে গেল। জলজ্যান্ত একটা ভূত সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে কি আর মনের কথা খুলে বলা যায়।

‘জানেন,’ ওটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘চক্কোত্তি মশাই ফিরে আসছেন। আর আধঘণ্টার মধ্যেই তিনি বাড়ি পৌঁছে যাবেন। আপনারা ভালোবাসার পাটটা চুকিয়ে নিন। অবশ্য ওকথা বলার জন্য আমি ছুটে আসিনি। দারুণ খবর আছে আমার। শেষ পর্যন্ত বদলি হয়েছি আমি। চল্লিশ মিনিটও হয়নি উগ্রপন্থীদের হাতে একজন খুন হয়েছে। দিব্যি জোয়ান মানুষ, তাই তার ভূতের পদ নিয়ে কেউ চিন্তাও করেনি। আমার কয়েকজন বন্ধু সঙ্গেসঙ্গে আমার নাম ভূতের দফতরে সুপারিশ করেছে আর তারা সেটা মেনে নিয়েছে। চক্কোত্তি মশাই বাড়ি পৌঁছুবার আগেই আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমার নতুন পদ নেবার পরই এই ঘেন্নার চেহারাটা ছেড়ে ফেলব। একজন সত্যিকার মরা মানুষের ভূত হওয়ার কী যে আনন্দ তা আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। চক্কোত্তি এসে গেল বলে। বিদায় বন্ধু বিদায়।’

আমি আর সময় নষ্ট করলুম না। ভাস্বতীর সামনে দু-হাঁটু গেড়ে বসে বললুম, ‘ভাস্বতী, তোমাকে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন দেখেছি, তুমি কি আমার হবে না?’

‘বুদ্ধু কোথাকার,’ ভাস্বতী মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপবার চেষ্টা করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *