রাতের আতঙ্ক

রাতের আতঙ্ক

বাল্যবন্ধু অরুণের চিঠিটা আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম। ও লিখেছে—

প্রিয় সুব্রত,

আমার এই চিঠিটা পেয়ে তুই হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাবি, হঠাৎ তোকে চিঠি লিখলাম কেন? কলকাতা শহরের হট্টগোলের বাইরে যে কী সুন্দর একটা জগৎ আছে, তা তুই কল্পনাই করতে পারবি না। পাহাড় আর বনময় পরিবেশে আমাদের এই জায়গাটা এককথায় নন্দনকানন। কিছুদিনের জন্য এখানে চলে আয়, তুই মুগ্ধ হয়ে যাবি। বুনো হাঁস আর শিকার প্রচুর মিলবে। তোর শিকারের নেশা প্রাণভরে মেটাতে পারবি। তা ছাড়া রহস্যের গন্ধ পেলে তুই তো আর কিছু চাস না। তাও আছে এখানে। বিশদভাবে এই চিঠিতে লেখা সম্ভব নয়, এখানে এলেই সব জানতে পারবি। বিশেষ করে এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্যই তোকে আসতে লেখা। আমি হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। কবে আসবি জানাস, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব।

ভালোবাসা জানিস।

ইতি—

অরুণ

পু— এইমাত্র একটা সাংঘাতিক খবর এসেছে; শুনে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। সে-কারণেও তোর একবার আসা প্রয়োজন।

আমি চিঠিটা দু-তিনবার পড়লাম। অরুণ যে ঘোরতর সমস্যায় পড়েছে, সে-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ওর চিঠির শেষের দিকে একটা অসহায়তার সুর আমার কানে বেজে উঠল। আমি মনস্থির করে ফেললাম। চিঠির প্যাডটা টেনে নিয়ে খসখস করে লিখে দিলাম কবে রওনা হচ্ছি।

একটা ছোটো পাহাড়ি স্টেশনে আমি নামলাম। অরুণ যেন ব্যগ্রভাবে আমার অপেক্ষা করছিল, আমাকে সে জড়িয়ে ধরল। জীপে চেপে আঁকাবাঁকা রুক্ষ পাহাড়ি পথ ধরে আমরা চললাম। চারদিকের দৃশ্য এত সুন্দর যে কলকাতার প্রাসাদনগরীতে বাস করে আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না। যেদিকে দৃষ্টি যায়, শুধু পাহাড় আর পাইন বনের সবুজ শোভা। পথের পাশে বুনো গাছের ঝোপ। লাল, নীল, হলদে, বেগুনি রংবেরঙের সব ফুল ফুটে ঝোপগুলি অপূর্ব দেখাচ্ছে। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে তার সব সৌন্দর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। ভালো কথা, আমরা যেখানে যাচ্ছি, অরুণ সেই অঞ্চলের থানার দারোগা।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে আমি একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে বললাম, এবার তোমার রহস্যকাহিনি শোনা যাক—

অরুণ আমার মুখোমুখি বসল, তারপর এক চমকপ্রদ কাহিনি শোনাল। ওই অঞ্চলে কিছুদিন ধরে একজনের পর একজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রোগটা যে কী তা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। প্রথমে একটি স্বাস্থ্যবতী মেয়েই এই রোগের কবলে পড়ে। এখানকার অধিকাংশ লোকই পাহাড়ি, শক্তসমর্থ চেহারা। দেখতে দেখতে অসুস্থ পুরুষ কি নারীর শরীর শুকিয়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে, যেন তাদের শরীরের রক্ত কেউ নিংড়ে নিয়েছে। হাসিখুশি জোয়ান মানুষগুলির অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে আর কোটরগত চক্ষু প্রেতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই ঘটনায় ওই অঞ্চলে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়িদের বিশ্বাস, কোনো অপদেবতা বা পিশাচ এসে তাদের মুলুকে আস্তানা গেড়েছে এবং মানুষের রক্ত শুষে খাচ্ছে। তাদের এ বিশ্বাসের মূলে রয়েছে একটি কারণ; সেটা হল প্রত্যেক অসুস্থ ব্যক্তির গলায় পাশাপাশি দুটো ক্ষত চিহ্ন দেখা গেছে। সূক্ষ্ম ক্ষত— যেন কেউ তীক্ষ্ন অস্ত্রের ধারালো অগ্রভাগ গলায় ফুটিয়ে দিয়েছে। দু-বিন্দু রক্ত জমে আছে সেই ক্ষত দুটোর মুখে। অসুস্থ ব্যক্তিদের তিনজন মারা গেছে, এখন একজন ওই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অবশ্য অসুস্থ হবার সঙ্গেসঙ্গেই রোগীরা মারা যাচ্ছে না, ধীরে ধীরে রক্তশূন্যতায় ভুগে, শেষ পর্যন্ত রক্তহীন হয়েই তারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। অসুস্থ অবস্থায় তারা এমন সব অসংলগ্ন প্রলাপ বকছে, যার কোনো মাথা-মুন্ডু নেই। তবে তাদের চোখে-মুখে একটা নিদারুণ ভয়ের চিহ্ন সবাই লক্ষ করেছে।

অরুণের বক্তব্য শেষ হলে আমি বেশ কিছুক্ষণ গম্ভীরভাবে চিন্তা করলাম। ব্যাপারটা যে রহস্যময় তাতে সন্দেহ নেই। কোনো কিছু নেই, এক একজন জোয়ান পাহাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ছে, অথচ অসুখের কারণ নির্ণয় করা যাচ্ছে না; দেখতে দেখতে তাদের শরীর পাণ্ডুর হয়ে বীভৎস রূপ নিচ্ছে। তাদের অসংলগ্ন প্রলাপ, মুখে আতঙ্কের চিহ্ন— সব মিলিয়ে ব্যাপারটা যেন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে। সবচেয়ে যা আমাকে ভাবিয়ে তুলল, তা হচ্ছে তাদের গলায় সূক্ষ্ম ক্ষতের চিহ্ন। কে বা কারা এই ক্ষতের সৃষ্টি করছে? কেমন করেই-বা করছে? সবচেয়ে যা আমার আশ্চর্য লাগল, তা হল একজনের পর একজনের এই রোগের কবলে পড়া, একসঙ্গে একজনের বেশি কখনো অসুস্থ হয়নি। কেন?

অরুণকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, সবকটা ক্ষেত্রেই রোগ ধরা পড়েছে সকালে। অর্থাৎ রাত্রে কোনো-না-কোনো সময়ে ওই হতভাগ্য লোকগুলি রোগে আক্রান্ত হয়েছে।

কথা বলতে বলতে বেশ রাত হয়ে গেল। যদিও সেটা এপ্রিল মাস, তবু উঁচু পাহাড়ি উপত্যকা বলে আমার বেশ শীত করছিল। শরীরটাকে গরম করার জন্য আমি একটা চুরুট ধরালাম, তারপর গায়ে ওভারকোট চড়িয়ে অরুণকে বললাম, চলো, একটু ঘুরে আসি—

প্রথমে অবশ্য সে আপত্তি করেছিল। কিন্তু আমি ওর কোনো বারণই শুনলাম না। বেরিয়ে পড়লাম দু-জনে। অরুণ একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ সঙ্গে নিল, আমি নিলাম আমার টুয়েলভ বোরের বন্দুকটা। পাহাড়ি জায়গা, বলা যায় না যদি কোনো হিংস্র জন্তুর মুখোমুখি পড়ে যাই!

আকাশ পরিষ্কার, অসংখ্য তারা ঝলমল করছে। ঠান্ডা হাওয়ায় আমি তীব্র শীত অনুভব করলাম। অরুণকে আমি বললাম অসুস্থ ব্যক্তির বাড়ির চারপাশটা একবার ঘুরে দেখতে চাই। পথ বেশ কিছুটা চড়াই, তারপর আবার নীচের দিকে নেমে গেছে। উঁচু-নীচু পথে কিছুটা হাঁটতেই আমার শরীর গরম হয়ে উঠল, পরিশ্রম কম নয়। আকাশে নৈশবিহারী পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। পেঁচা, বাদুড় আরও কত কী নাম-না-জানা পাখি। মাঝে মাঝে বাদুড় ছাড়াও বেশ বড়ো বড়ো পাখি উড়ে যাচ্ছে। বিচিত্র কণ্ঠে সব ডেকে উঠছে। সমস্ত অঞ্চলটা সুষুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে, নিশাচর পাখিদের ডাকে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে।

যে বাড়িটা আমাদের গন্তব্যস্থল ছিল, তার কাছাকাছি আসতেই একটা বাদুড় আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, প্রকাণ্ড কালো বাদুড়। এত নীচু দিয়ে পাখিটা উড়ে গেল যে আমরা ওটাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পাখিটাও আমাদের লক্ষ করেছিল। কালো জ্বলজ্বলে চোখ। আমার গা কেমন যেন ছমছম করে উঠল।

আমরা বাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরিদ্র পাহাড়ির কুঁড়ে চালাটা বড়ো বড়ো পাতায় ছাওয়া। বেশির ভাগ কুঁড়েই ওই ধরনের। আমরা বাড়িটার চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে আবার ফেরার পথ ধরলাম।

পরদিন সকালে আমি অরুণকে নিয়ে সমস্ত অঞ্চলটা ঘুরে দেখতে বেরোলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমরা এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। একটা পাহাড়ি নদী সবেগ ছুটে চলেছে, সামনে খাড়া পাহাড়। নদীর তীরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একটা পাথরের দুর্গের মতো বাড়ি। ওই অঞ্চলে এমন একটা বাড়ি দেখব, এ আমি কল্পনাই করতে পারিনি। আমি অরুণকে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িটা কার?

অরুণ বলল, ওটা প্রাচীন এক জমিদার বংশের আদি নিবাস। এক সময়ে তাদের শুধু এই অঞ্চলই নয়, আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেও দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল। অত্যাচারী বলেও তাদের যথেষ্ট দুর্নাম ছিল। শেষ পর্যন্ত প্রজারা খেপে গিয়ে বিদ্রোহ করে। একদিন গভীর রাত্রে তারা দলবদ্ধ হয়ে দুর্গবাড়ি আক্রমণ করে। তাদের রোষানলে জমিদার বংশের সকলেই নিহত হয়, শুধু একজন পালিয়ে বাঁচে। এতদিন বাড়িটা খালিই পড়ে ছিল, আগাছা আর জঙ্গলে ভেতরটা ভরে গেছল। কিছুদিন হল, যিনি পালিয়ে বেঁচেছিলেন তাঁর এক বংশধর আবার ফিরে এসেছেন। জঞ্জাল পরিষ্কার করে বাড়িটা মেরামত করেছেন। ভদ্রলোক বেশ কিছুদিন বিলেতে ছিলেন। অমায়িক, জমিদারসুলভ দম্ভ নেই। অরুণের সঙ্গে নিজে এসে আলাপ করে গেছেন। মনে হয় বেশ ধনী, কারণ বহুদিনের অব্যবহৃত এই প্রকাণ্ড বাড়িটা সংস্কার করতে প্রচুর টাকাপয়সাও নিশ্চয় খরচ হয়েছে। ভদ্রলোক অবিবাহিত, কাজ থেকে অবসর নিয়ে এসেছেন— বাকি জীবনটা পূর্বপুরুষদের ভিটেতেই কাটিয়ে দেবেন এই ইচ্ছে। সাম্প্রতিক রহস্যজনক ঘটনায় তিনিও নাকি বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন। মাঝে মাঝে রাত্রে টহল দিয়ে বেড়ান যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে এই আশায়। আমার প্রশ্নের উত্তরে অরুণ জানাল ভদ্রলোকের নাম মি লেবং। ভদ্রলোক শুধু একজন অনুচর নিয়ে বিরাট বাড়িটায় বাস করেন।

আমাদের কথার মধ্যেই দুর্গবাড়ির প্রকাণ্ড লোহার গেটটা খুলে গেল, আর মি লেবংকে সেই প্রথম দেখলাম আমি। আমাদের দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোক বেশ লম্বা— প্রায় ছ-ফুট। সামনের একটু ঝুঁকে হাঁটেন। অরুণ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। আমার পরিচয় শুনে তিনি চোখ কপালে তুলে কৃত্রিম ভয়ের সুরে বললেন, পাকা শিকারি তার ওপর রহস্যসন্ধানী, সাবধানে থাকাই ভালো। কী জানি আমার অতীত জীবনের কোনো রহস্য যদি ভেদ করে দেন—!

তাঁর কথার ভঙ্গিতে আমরা হেসে উঠলাম, তিনিও হাসিতে যোগ দিলেন। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে; কিন্তু মুখে বার্ধক্যের ছাপ তো পড়েইনি, বরং তারুণ্যের আভাসই চোখে পড়ে। ভদ্রলোকের চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো, গভীর দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী। মুখে একটা আভিজাত্যের ছাপ লক্ষ না করে পারা যায় না, বেশ সুপুরুষ বলা চলে। তবে হাসবার সময় তাঁর সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে পড়ে। ছুঁচোলো দাঁত, সমস্ত মুখের মধ্যে ও দুটোই বেমানান।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা এগিয়ে চললাম। বর্তমান রহস্য সম্বন্ধেও আমাদের আলোচনা হল। মি লেবং বললেন, যতদিন যাচ্ছে, ক্রমশই তিনি হতাশ হয়ে পড়ছেন। অশিক্ষিত পাহাড়িদের বদ্ধমূল বিশ্বাসটাও তিনি এখন আর উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এই প্রসঙ্গে স্কটল্যান্ডে একটা ভয়াবহ ঘটনার কথা তিনি বললেন। তিনি নিজে ওই সময় স্কটল্যান্ডে ছিলেন। একজন দুর্দান্ত খুনিকে ফাঁসির পর কবর দেওয়া হয়। তার কয়েক রাত পর থেকেই পর পর কয়েকটা ঘটনায় পুলিশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

প্রথম ঘটনায় এক গ্রাম্য চাষি রাত্রে যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন ভয়ংকর একটা জীব অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে দেয়, তারপর তার গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত পান করতে থাকে। কয়েক রাত পরে ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, এবার এক তরুণী ওই জীবের শিকার হয়। অবশ্য কোনো ক্ষেত্রেই আক্রান্তরা প্রাণ হারায়নি, কিন্তু তাদের প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছিল। পুলিশ চিন্তা করে দেখল কবরখানার পাশ দিয়ে হাঁটা রাস্তা চলে গেছে, দু-দুবারই ওই পথের ওপরেই জীবটা আক্রমণ চালিয়েছে। তারা ফাঁদ পাতল। এক রাত্রে ওই পথের আশেপাশে সশস্ত্র পুলিশের লোক লুকিয়ে রইল, আর একজন সাধারণ পোশাকে ও পথ দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে লাগল। গত দু-বারই ঘটনা ঘটেছিল রাত দশটার পর, তাই ফাঁদও পাতা হল ওই সময়। অল্প চাঁদের আলোয় সব অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল। হঠাৎ একটা আর্তচিৎকারে পুলিশের দল সজাগ হয়ে উঠল। তারা তাদের সঙ্গীকে লক্ষ করে ছুটল। সে মাটিতে পড়েছিল, আর তার ওপর ঝুঁকেছিল একটা প্রাণী। কয়েক জোড়া পায়ের শব্দে যেন বাধা পেয়েই সে প্রাণীটা তার শিকার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বীভৎস মুখ, অমানুষিক, মুখের দুই কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সবে রক্ত চুষতে শুরু করেছিল, এমন সময় বাধা পেয়ে সে হিংস্রভাবে তেড়ে এল, কিন্তু অতগুলি লোক দেখে শেষ পর্যন্ত পেছন ফিরে দৌড় মারল। একজন তাকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। গুলি তার গায়ে বিঁধল, কিন্তু কিছুই হল না। তার পেছনে পুলিশের দলও ছুটল। সেই অমানুষিক জীবটি কবরখানায় ঢুকে এক জায়গায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তার অনুসরণকারীরাও সেখানে এসে দাঁড়াল। তারপর যে দৃশ্য তারা দেখল, তা ভয়ংকর। সেই কুখ্যাত খুনির কবরটা খোঁড়া— কফিন দেখা যাচ্ছে। কফিনে সে শুয়ে আছে, আর পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সেই দৃষ্টিতে যেন অপরিসীম ঘৃণা ঝরে পড়ছে। দুই কষ বেয়ে ক্ষীণ রক্তের ধারা তখনও মুছে যায়নি।

পুলিশের দল আতঙ্কে শিউরে উঠল। তারা আর সেখানে দাঁড়াল না, পালিয়ে বাঁচল। সারা রাত ধরে পরামর্শ চলল, বিশেষজ্ঞরা এলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, দিনের বেলা কফিন থেকে দেহটাকে বের করে পুড়িয়ে ফেলা হবে। বিশেষজ্ঞরা এটা বুঝেছিলেন যে, রাত্রে ওই জীবটা পিশাচ হয়ে উঠলেও দিনে ওর কোনো ক্ষমতা থাকে না।

পরদিন দেহটাকে কফিন থেকে বয়ে নিয়ে এসে ইলেকট্রিক চুল্লিতে শোয়ানো হল। সুইচ টেপামাত্র চুল্লির আগুন জ্বলে উঠে দেহকে স্পর্শ করল, আর সঙ্গেসঙ্গে জ্বলন্ত আগুনের চিতা থেকে এক অমানুষিক আর্তনাদে সমবেত সকলের শরীর যেন হিম হয়ে গেল।

যাই হোক, শরীরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবার পর থেকে আর কোনো উৎপাত হয়নি।

মি লেবং তাঁর কাহিনি শেষ করে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন। বোধ হয় আমাদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাইলেন।

আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, অরুণের মুখ সাদা হয়ে গেছে। আমি মি লেবঙ-এর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ, এরকম অনেক ভূতের গল্প ইংরেজি বইয়ে পড়েছি।

আমার উত্তর শুনে ভদ্রলোক যেন একটু ক্ষুণ্ণ হলেন বলে মনে হল। তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেন।

আমরা এবার হাঁটা দিলাম সেই পীড়িত ব্যক্তির কুঁড়ের দিকে। দিনের বেলা তাকে ভালো করে পরীক্ষা করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।

আমরা সেই কুঁড়েঘরে প্রবেশ করলাম। কুঁড়ের অন্য লোকজনের মুখ থমথম করছে। ঘরের মধ্যে একটা চারপায়ায় রোগী শুয়ে আছে। বয়স ত্রিশের বেশি নয়। রক্তশূন্যতায় সমস্ত শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে— পাণ্ডুর মুখ। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম। গলায় দুটো ক্ষতের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেন তীক্ষ্ন অথচ সূক্ষ্ম কোনো অস্ত্র গলায় বিঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ঝুঁকে পড়ে, সেই ক্ষত দুটো পরীক্ষা করতে লাগলাম। ক্ষতের মুখে রক্তবিন্দু জমে কালো হয়ে আছে। হঠাৎ রোগী চোখ মেলে তাকাল। ঘোলাটে চোখ, বিভ্রান্ত দৃষ্টি। লোকটি বারকয়েক ঘাড় বেঁকিয়ে তার ডান দিকে বেড়ার গায়ে বড়ো চৌকো যে ফোকর, সেটা দেখল।

আমিও তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ওটা দেখলাম। ফোকরটার মাথার ওপর একটা ঝাঁপ ঠেকা দেওয়া রয়েছে। বুঝলাম, ওই ফোকরটাই হল ঘরের জানলা। কিন্তু লোকটি ওদিকে তাকাচ্ছে কেন? তবে কি কোনো হিংস্র প্রাণী ওর ভেতর দিয়ে ঘরে ঢুকে তাকে আক্রমণ করেছিল? আমি যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখলাম, তা সম্ভব নয়। কারণ সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি নিশ্চয় চিৎকার কিংবা আত্মরক্ষার চেষ্টা করত। ঘরের অন্য লোকজন তখন নিশ্চয় উঠে পড়ে সেই জন্তুটিকে তাড়া করত। তা ছাড়া ফোকরটা অনেক উঁচুতে, নীচে থেকে লাফিয়ে ওই ফোকর দিয়ে ঘরে ঢোকাও সহজ কথা নয়। আমি সেই ফোকরটার তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা— হাত সোজা তুলে দিলে তবে ঝাঁপের নাগাল পাই। বাইরে বেরিয়ে ঠিক ফোকরের তলা এবং তার চারপাশ আমি উবু হয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। না, মাটির ওপর কোনো মানুষ বা জন্তুর পায়ের ছাপ চোখে পড়ল না।

আমি অরুণকে নিয়ে ফিরে চললাম। পীড়িত লোকটির যা অবস্থা দেখলাম, বাঁচবে বলে মনে হয় না। আমার মন বিষাদে ভরে গেল। নিঃশব্দে আমরা দু-জন হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা চিন্তা আমার মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। ওই ফোকর দিয়ে জন্তু ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর ঢোকা অসম্ভব নয়।

অরুণ আমার পাশাপাশি হাঁটছিল। আমাকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে সে একটু অবাক হয়েই বলল, কী হল?

আমি আর ওকে কিছু বললাম না। যে সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তা নিজের মনেই চেপে রাখলাম।

আমি অরুণের কোয়ার্টারেই উঠেছিলাম, ও ব্যাচেলর হওয়ায় কোনো অসুবিধে ছিল না। এক পাহাড়ি ছোকরা কম্বাইন্ড হ্যান্ড হিসেবে ভালোই কাজ করছিল। আমি দুপুরে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম, সারারাত জাগব এই ছিল আমার প্ল্যান। বিকেলের চায়ের টেবিলে অরুণ জানাল, মি লেবং নৈশভোজ তাঁর ওখানে সারবার জন্য খবর পাঠিয়েছেন— দু-জনকেই যেতে বলেছেন। আমি মি লেবং-এর হঠাৎ এই অনুগ্রহের কারণ জিজ্ঞেস করলাম।

অরুণ হেসে বলল, জহুরি জহর চেনে— তোকে দেখেই উনি খাঁটি জহর বুঝতে পেরেছেন। তাই পরিচয় আরও নিবিড় করতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়— আমি উপসর্গ মাত্র।

সন্ধ্যাবেলা অরুণ হঠাৎ একটা জরুরি কাজে আটকা পড়ে গেল। আমাকে একাই মি লেবং-এর ওখানে যাবার জন্য অনুরোধ করল। কেউ না গেলে অভদ্রতা হবে। অগত্যা সাতটার পর আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম। বন্দুকটা আর নিলাম না, ওটা হাতে নিয়ে নেমন্তন্ন খেতে যাওয়াটা আমার বিসদৃশ মনে হল। তবে একটা সুদৃশ্য অথচ মজবুত বেড়াবার লাঠি হাতে নিলাম। অরুণ কিন্তু সহজে ছাড়ল না, তার রিভলভারটা আমার লং কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিল। এসব জায়গায় বিশ্বাস নেই। আজকে চাঁদের আলো গত রাত্রের চাইতে উজ্জ্বল।

মি লেবং-এর দুর্গবাড়ির কাছাকাছি আসতেই আমার মনে হল, যেন লোহার গেটের ওপারে একটা দীর্ঘ কালো ছায়া নড়াচড়া করছে। আরও দু-পা এগোতেই ছায়াটা মানুষের আকার নিল— মি লেবং।

কালো প্যান্ট আর কালো গাউনের মতো একটা পোশাক পরেছেন, তাই কালো ছায়া মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাকে একা দেখে অরুণের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার হঠাৎ কাজ পড়ে যাওয়ার কথা বলে তার হয়ে ক্ষমা চাইলাম।

ভদ্রলোক আমাকে তাঁর বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন। বিরাট হল। নবাব-বাদশার আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাথরের দেওয়াল, মসৃণ মেঝে— কিন্তু কালের ছোঁয়াচ লেগে চারদিকে ফাটল ধরেছে, এখানে ওখানে ভেঙেও পড়েছে। হলের মাঝখানে একটা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছিল। সমস্ত ঘরটার পক্ষে ওই আলো পর্যাপ্ত নয়। আলোর পরেই আবছা অন্ধকার— একটা কেমন যেন ভূতুড়ে পরিবেশ।

আমি কৌতূহল নিয়ে চারদিক দেখছি, সেটা লক্ষ করে মি লেবং হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পে আমার আগ্রহ আছে কি না। আমি সম্মতি জানাতে তিনি বললেন যে, দুর্গবাড়িটা প্রায় চারশো বছর আগে তাঁদের এক পূর্বপুরুষ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি আমাকে সমস্ত বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন।

নীচটা দেখার পর ঘোরানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে আমরা ওপরে উঠতে লাগলাম। বাড়িটা গম্বুজাকৃতি। ওপরে গম্বুজ-ঘরে পৌঁছে আমার হাঁপ ধরে গেল। মাটি থেকে কম করে ষাট ফুট ওপরে উঠেছি। সেখান থেকে নীচে পৃথিবীর দৃশ্য যেন মায়াময় মনে হতে লাগল। মিনিট দশেক সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নীচে নামবার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় একটা বাদুড় কোথা থেকে উড়ে এসে মি লেবং-এর কাঁধের ওপর বসল। তারপর তাঁকে মুখে মৃদু ঠোকর দিয়ে যেন আদর করতে লাগল।

আমার বিস্মিত ভাব লক্ষ করে মি লেবং পাখিটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, এটা কেন জানি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমি এখানে এলেই আমার কাছে চলে আসে।

নীচে নামার পর আমরা খেতে বসলাম। ওই হলের মধ্যেই খাবার আয়োজন হয়েছিল। একটা গোল টেবিলের দুই বিপরীত দিকে দুটো চেয়ার মুখোমুখি সাজানো হয়েছে। একটা বড়ো ট্রের ওপর কাচের পাত্রে সাজানো মুখরোচক সব আহার্য নিয়ে একটি লোক আমার পাশে এসে দাঁড়াল। লোকটিকে দেখে আমি প্রায় চমকে উঠেছিলাম। চীনাম্যান— লম্বায় সাড়ে চার ফুটের বেশি হবে না। লোকটির গায়ের রং পীত, দাঁতগুলিও হলদে আর কুতকুতে চোখ দুটিতে যেন ভাষাহীন দৃষ্টি।

মি লেবং বোধ হয় আমার মনের অবস্থা বুঝেছিলেন। একটু হেসে আমাক আশ্বস্ত করার জন্য তিনি বললেন, ওর নাম ওয়াং, হার্মলেস চ্যাপ।

কাচের পাত্রগুলি আমার কাছে সাজিয়ে দিয়ে ওয়াং চলে গেল।

আমি একটু অবাক হয়েই মি লেবং-এর মুখের দিকে তাকালাম। তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ও, আপনাকে বলা হয়নি। বিলেতে থাকাকালে আমার একটা অদ্ভুত রোগ হয়। ডাক্তাররা তার ডায়াগ্নোসিস দূরের কথা, নাম পর্যন্ত ঠিক করতে পারেননি। এই রোগের ফলে কোনো সেদ্ধ খাবার আমি খেতে পারি না, সব কাঁচা খেতে হয়।

কাঁচা! আমি সবিস্ময় প্রশ্ন করলাম।

হ্যাঁ, কাঁচা। যেমন কাঁচা দুধ, কাঁচা সবজি, ফলমূল এই আর কি। মৃদু হেসে তিনি বললেন, কাঁচা মাংসও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ধাতে সইল না।

রান্না করা কোনো জিনিসই আপনার হজম হয় না?

না। মি লেবং যেন একটু দুঃখের হাসি হাসলেন, আপনারা সব সুস্বাদু, মুখরোচক খাবারে রসনা পরিতৃপ্ত করেন, কিন্তু আমি সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।

মি লেবং-এর জন্য আমি অনুকম্পা বোধ না করে পারলাম না।

তিনি আমার মনের ভাব ঠিক ধরে ফেললেন। বললেন, আমার জন্য কেউ দুঃখ প্রকাশ করুক, তা আমি পছন্দ করি না। আমিও ভগবানের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছি। দেখে নেব, কত বড়ো শক্তিমান তিনি।

মি লেবং-এর দু-চোখ জ্বলে উঠল। মুখে একটা কঠিন ভাব দেখা দিল। আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, মনের আবেগ প্রকাশ করে ফেলার জন্য আমি দুঃখিত। আমার দিকটাও আশা করি, আপনি বুঝতে পারছেন। নিন, শুরু করুন। খাবার জুড়িয়ে যাচ্ছে।

আমি বলাম, আপনি যা খান, তাই দিয়ে যাক। একসঙ্গেই খাওয়া যাবে।

তিনি বললেন, একটা বিশেষ ধরনের খাবার ওয়াং তাঁর জন্য বানাচ্ছে, একটু সময় লাগবে। অগত্যা আমাকে একা একাই শুরু করতে হল। ওয়াং-এর চেহারা কদর্য হলে কী হবে, রাঁধার হাত চমৎকার। মিহি সুগন্ধ চালের ঝুরঝুরে পোলাও, মাংসের শিককাবাব, গোটা গোটা স্নাইপের রোস্টা আর পেস্তাবাদাম দিয়ে পুডিং জাতীয় একটা সুস্বাদু খাবার। সবকটা রান্নাই মুখে লেগে থাকার মতো।

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমি কয়েকবাই লক্ষ করলাম, মি লেবং ঘাড় ফিরিয়ে ওয়াং-এর যাতায়াতের পথের দিকে তাকালেন। শেষের দিকে তিনি যে বেশ অসহিষু হয়ে উঠেছেন, তা বুঝতে পারলাম। আমি মনে মনে ভাবলাম, এমন কী বিশেষ খাবার ওয়াং বানাচ্ছে যে, এত সময় লাগছে!

শেষ পর্যন্ত ওয়াং এল, তার হাতে ছোটো গামলার মতো একটা কাচের বাটি। সেই বাটির দিকে তাকিয়ে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। কাচের স্বচ্ছ বাটিতে লাল তরল রক্ত টলটল করছে, যেন সদ্য কোনো প্রাণী হত্যা করে রক্ত নিয়ে আসা হয়েছে। মি লেবং-এর যেন আর তর সইছিল না, ওয়াং-এর হাত থেকে বাটিটা প্রায় কেড়ে নিয়ে তিনি এক চুমুকে সেটা নিঃশেষে পান করলেন। তার মুখ দিয়ে তৃপ্তিসূচক একটা ধ্বনি বেরোল, আঃ! বাটিটা তিনি ওয়াং-এর হাতে ফিরিয়ে দিলেন।

তাঁর রক্তরাঙা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আমি শিউরে উঠলাম।

মি লেবং একটা তোয়ালে আলগাভাবে ঠোঁটের ওপর চাপতে চাপতে বললেন, টমেটোর রস, ওই আমার একমাত্র খাবার।

টমেটোর রস যে অত লাল হতে পারে, তা আমার ধারণা ছিল না। পাহাড়ি অঞ্চলে সব কিছুই বিচিত্র।

আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর আমি বিদায় নিলাম। মি লেবং আমাকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন।

আমি কিছুটা গিয়ে আবার ফিরে এলাম। মি লেবং ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি গেট টপকে পার হলাম। নিঃশব্দে হাঁটছি। সামনের দিকে না গিয়ে, পাশ ধরে আমি এগোলাম। একটা বাদুড় আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল— একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

হল ঘরের একটা জানলার তলায় এসে আমি দাঁড়ালাম। জানলাটা বেশ উঁচু, মাটি থেকে দাঁড়িয়ে ভেতরের কিছু দেখা যায় না। এদিক-ওদিক তাকাতে একটা কাঠের প্যাকিং বাক্স আমার চোখে পড়ল। আমি দ্বিরুক্তি না করে, সেটা এনে জানলার তলায় রাখলাম। ওটার ওপর উঠে দাঁড়িয়ে আমি ভেতরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম। মি লেবং একটা আরামকেদারায় অর্ধ-শয়ান ভাবে চোখ বুজে আছেন। টেবিলের ওপর উচ্ছিষ্ট বাসনপত্র তখনও পড়ে আছে। আমি মি লেবং-এর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলেশহীন মুখ। দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজতেই মি লেবং উঠে দাঁড়ালেন।

আমি মাথাটা যতদূর সম্ভব সরিয়ে নিলাম, যাতে তিনি আমাকে দেখতে না পান। সর্বনাশ, উনি যে জানলার দিকেই আসছেন। আমি তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে সরে দাঁড়ালাম।

মি লেবং গরাদবিহীন জানলা দিয়ে মাথাটা বের করে আকাশের দিকে তাকালেন। কী দেখছেন, কে জানে। মিনিট কয়েক তিনি ওইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর তাঁর মাথাটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি আবার সন্তর্পণে প্যাকিং বাক্সর ওপর উঠে দাঁড়ালাম। দু-হাত পেছনে রেখে ভদ্রলোক অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। কপালে কুটিল রেখা ফুটে উঠেছে। মিনিট দশেক বোধ হয় তিনি এইভাবে প্রকাণ্ড হলটার এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

তিনি বেরিয়ে যাবার সামান্য পরেই ওয়াং ঘরে ঢুকল। বাসনপত্র তুলে সে চলে গেল। পরমুহূর্তেই সে ফিরে এল— এবার তার হাতে একটা বড়ো মোমবাতি। ঝাড়লন্ঠনের কাচের আধারে কেরোসিন তেলের আলো জ্বলছিল। টেবিলের ওপর একটা চেয়ার দিয়ে সে তার ওপর দাঁড়াল, তারপর ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। সমস্ত হলটা অন্ধকার হয়ে গেল, শুধু মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় যা দেখা যায়।

ওয়াং চলে যাবার পর আরও আধঘণ্টা আমি অপেক্ষা করলাম। তারপর দু-হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে তুলে জানলায় উঠে পড়লাম। সেখান থেকে এক লাফে হলের ভেতর। সূচীভেদ্য অন্ধকার। আমি পকেট থেকে পেনসিল টর্চটা বের করে এগিয়ে চললাম। পা টিপে টিপে অত্যন্ত সতর্কভাবে আমি হাঁটছি। ধরা পড়ে গেলে কৈফিয়ত দেবার কিছু নেই। মি লেবং আমাকে সব ঘর ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন, তাই আমার বিশেষ কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না।

একটার পর একটা ঘরে আমি ঢুকলাম। সব অন্ধকার। টর্চের আলোয় সন্দেহজনক কিছু আমার চোখে পড়ল না। মি লেবংকে দেখতে পেলাম না, তবে কি ভদ্রলোক এত রাত্রে আবার বেরিয়েছেন! অরুণের কথা আমার মনে পড়ে গেল। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে রাত্রে টহল দিয়ে বেড়ান, যদি সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে। কথাটা মনে পড়তেই আমার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল। বাম দিকে শেষ প্রান্তের একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা ভেসে আসছিল। আমি ঢালা বারান্দা দিয়ে সেই দিকে এগোলাম। কিছুটা যাবার পরই সেই ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম।

একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। মূর্তির হাঁটাচলা কেমন যেন সন্দেহজনক। একটু কাছে আসতেই আমি বুঝলাম, ও আর কেউ নয় ওয়াং। সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কেমন যেন একটা সন্ত্রস্ত ভাব। হাতে একটা খনিত্র। বারান্দা ছেড়ে ওয়াং মাটিতে নেমে পড়ল। তারপর বরাবর পুব মুখে হাঁটতে লাগল।

আমি একটু পেছনে থেকে তাকে অনুসরণ করলাম। একটা বড়ো গাছের তলায় সে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে যতটা সম্ভব ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। নিরাপদ ব্যবধান রেখে আমি একটা গাছের আড়াল থেকে ওর সন্দেহজনক আচরণের কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করতে লাগলাম। ওয়াং ততক্ষণে তার হাতের যন্ত্রটা দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করেছে। অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড়ো একটা গর্ত নিপুণ হাতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সে খুঁড়ে ফেলল। আমার বিস্ময়ের অন্ত নেই, এত বড়ো গর্ত করছে কেন? কাকে গোর দেবে? আমার সব কিছু সন্দেহের নিরসন ঘটতে বেশি সময় লাগল না। মাটি খোঁড়া শেষ করে ওয়াং উঠে দাঁড়াল, তারপর অন্ধকারে পড়ে-থাকা কী-একটা টানতে টানতে গর্তের কাছে নিয়ে এল। চাঁদের আলোয় আমি সবিস্ময় দেখলাম ওটা একটা মুন্ডুহীন ছাগল। ছাগলটাকে গর্তের মধ্যে ফেলে ওয়াং এবার মাথাটা নিয়ে এল, তারপর মাটি চাপা দিতে লাগল। কাজ শেষ করে সে উঠে দাঁড়াল, একবার যেন আকাশের দিকে তাকাল, তারপর দ্রুতপায়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

দুর্গবাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিল। আমি আবার গেট টপকে অরুণের কোয়ার্টারের পথ ধরলাম। অনেকগুলি চিন্তা আমার মাথায় কিলবিল করছে, সব রহস্যের একটা সূত্র যেন আমি খুঁজে পেয়েছি। গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে আমি মাথা নীচু করে হাঁটছিলাম। হঠাৎ ইন্দ্রিয়ের ষষ্ঠ অনুভূতিতে আমি মাথা তুললাম, আর সঙ্গেসঙ্গে আঁাতকে উঠলাম। একটা প্রকাণ্ড বাদুড় হিংস্রভাবে আমাকে লক্ষ করেই যেন তেড়ে আসছে। ওর বড়ো বড়ো কালো চোখে পৈশাচিক উল্লাস— মুখটা একটু হাঁ করা, দুটো শানিত দাঁত ঝকঝক করছে। বাদুড়টা প্রায় আমার ওপর এসে পড়েছে। কোটের পকেট থেকে রিভলভার বের করার সময় ছিল না— আমি হাতের লাঠিটা দু-হাতে চেপে ধরে সজোরে ওটাকে লক্ষ করে মারলাম। ওটা সাঁৎ করে সরে গেল, কিন্তু লাঠিটা সম্পূর্ণ এড়াতে পারল না। একটা ডানায় আঘাত লাগল। ঝটপট করতে করতে বাদুড়টা আমাকে ছেড়ে দিয়ে উড়ে গেল। ওটা কোথায় যায়, দেখবার আশায় আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উড়তে উড়তে ওটা দুর্গবাড়ির গম্বুজের ওপর বসল। ঠিক এইসময় এক ফালি মেঘ চাঁদকে ঢেকে ফেলল, সব অন্ধকার হয়ে গেল। মেঘ সরে যাবার পর আর আমি ওটাকে দেখতে পেলাম না।

পরদিন সকালে অরুণকে আমি আমার নৈশ অভিজ্ঞতার কাহিনি বলে, যে সন্দেহ আমার মনে দানা বেঁধেছিল, তা খুলে বললাম।

আমার বক্তব্য শেষ হলে ও অবিশ্বাসের সুরে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই বিংশ শতাব্দীতে কেউ রক্তচোষা বাদুড়ের কথা বিশ্বাস করে?

আমি বললাম, কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে শুনেছি রক্তচোষা বাদুড় আছে। ঘুমন্ত মানুষের রক্ত এমনভাবে তারা চুষে খায় যে, লোকটি টেরও পায় না।

অরুণ কিছুতেই আমার যুক্তি মানতে রাজি নয় দেখে আমি বললাম, পীড়িত লোকটির ঘরে ঢুকে একটা জিনিস তুই লক্ষ করেছিলি কি না জানি না, বার বার সে বেড়ার গায়ে ফোকর বা জানলার দিকে তাকাচ্ছিল। নিশ্চয় তার একটা কারণ আছে। ওই ফোকর দিয়েই কি কোনো জন্তু ঘরে ঢুকে লোকটিকে দংশন করেছিল? যুক্তি দিয়ে আমি ভেবে দেখলাম যে, তা সম্ভব নয়। কারণ ফোকরটা অনেকটা উঁচুতে, কোনো জন্তুর পক্ষে মাটি থেকে অতটা লাফিয়ে ঘরে ঢোকা দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিশেষ করে ফোকরটা যখন নেকড়ে জাতীয় হিংস্র প্রাণীর প্রবেশের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। দ্বিতীয়ত, যদি কোনো প্রাণী ঢুকেই থাকে, তবে কি আক্রান্ত ব্যক্তি চিৎকার করবে না? আর তার আর্তনাদে ঘরের অন্যান্যদের ঘুম ভেঙে যাবে না? তবে আর কী হতে পারে? তোর মনে থাকতে পারে, ফেরার পথে আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। কারণটা আর কিছু নয়, আমার মাথায় চকিতে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল— জন্তু না ঢুকতে পারে, কিন্তু পাখি তো ঢুকতে পারে। সঙ্গেসঙ্গেই আমার মনে পড়ে গেল আগের রাত্রে দেখা সেই বাদুড়টির কথা। অত বড়ো বাদুড় সচরাচর চোখে পড়ে না— চোখ দুটো যেন জ্বলছিল। আফ্রিকার জঙ্গলে যদি রক্তচোষা বাদুড় থাকতে পারে, তবে এখানে কেন নয়? চারধারে পাহাড়, বড়ো বড়ো অসংখ্য গাছ, ঘন জঙ্গল, সব কিছু পরিবেশই তো আছে। কাল রাত্রে বাদুড়টা আমাকে আক্রমণ করবার চেষ্টা করায়, আমার মনে এখন আর সন্দেহ নেই যে, রক্তচোষা বাদুড়ই সব রহস্যের মূল। এটা হয়তো তোকে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, বাদুড় নিরীহ প্রাণী, অকারণে মানুষকে আক্রমণ করার মতো ধৃষ্টতা তাদের হবে না। সুতরাং ওটা সাধারণ বাদুড় নয়। কাল রাত্রে যেটা আমাকে আক্রমণ করেছিল, সেটা আর প্রথম দেখা বাদুড়টা যে এক, সে-বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।

অরুণ এবার আর আমার যুক্তি ঠেলতে পারল না। বলল, তবে উপায়?

আমি বললাম, ওটাকে মারতে হবে— রাত্রে ছাড়া তো ওর দেখা পাওয়া যাবে না।

আমাদের কথার মধ্যে একজন এসে খবর দিল সেই হতভাগ্য রোগীটা মারা গেছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, এবার কার পালা কে জানে। অরুণকে আমি বললাম, সমস্ত অঞ্চলে ঢেঁড়া পিটিয়ে দাও, কেউ যেন রাত্রে ঘরের ঝাঁপ খুলে না ঘুমোয়।

অরুণের সঙ্গে কথাবার্তার পর আমি দুর্গবাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। ওয়াং-এর কাল রাত্রের অস্বাভাবিক আচরণের কারণটা জানার কৌতূহলও আমার কম ছিল না। গেটের কাছাকাছি পৌঁছোতেই মি লেবং বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলোকের ডান হাতে ব্যান্ডেজ, হাতটা ঝোলানো রয়েছে। আমি সবিস্ময় কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, গত রাত্রে আমি বিদায় নেবার ঘণ্টাখানেক পর তিনি বেরিয়েছিলেন। বেশ খানিকটা যাবার পর হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড কালো বাদুড় তাঁকে আক্রমণ করে। আত্মরক্ষার জন্য ডান হাত দিয়ে তিনি বাধা দিতে থাকেন, তারপর একসময় পা হড়কে পড়ে যান। হাতে বেশ চোট লেগেছে।

আর বাদুড়টা? আমি প্রশ্ন করি।

আমি পড়ে যাওয়ার পর কেন জানি না, ওটা আমাকে ছেড়ে উড়ে চলে যায়।

মি লেবং-এর আহ্বানে আমি তাঁর হল ঘরে আবার গিয়ে বসলাম। দু-চারটে কথার পর আমি তাঁকে আমার সন্দেহের কথা বললাম। সব শুনে তাঁর মুখ থেকে যেন রক্ত উবে গেল। লক্ষ করে দেখলাম, বাঁ-হাতটা কাঁপছে। আমি উদবিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন কি না।

তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আপনি যে সাংঘাতিক কথা বলছেন মিস্টার গুপ্ত, রক্তচোষা বাদুড়! ভ্যামপায়ার! কয়েক মুহূর্ত থেমে তিনি বলে উঠলেন, ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলা বইটা পড়েছেন?

আমি ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম।

আপনার কথা শুনে ড্রাকুলার কাহিনি আমার মনে পড়ে গেল, তাই আমি নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। হরিবল স্টোরি।

আমারও মনে পড়ল। কাউন্ট ড্রাকুলা, মানুষ নয়তো প্রেত— দিনের বেলা সে তার কফিনে ঘুমোত, আর রাত্রে জেগে উঠে বাদুড়ের রূপ নিয়ে আকাশপথে শিকারের সন্ধানে বেরোত। অনায়াসে উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে যেকোনো শয়নকক্ষে সে প্রবেশ করত। তারপর স্ব-মূর্তি ধারণ করে নিশ্চিন্তে নিদ্রিত ব্যক্তির গলা থেকে রক্ত চুষে পান করত। যত বেশি রক্ত সে পান করত, তারই তারুণ্যের জোয়ারে সে দীর্ঘায়ু হয়ে উঠত। ধূর্ত, চতুর শয়তানের প্রতিমূর্তি ছিল কাউন্ট ড্রাকুলা। যাদের গলায় একবার সে দাঁত বসাত, তারাও ভ্যামপায়ার হয়ে যেত। এইভাবে প্রেত-সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিল।

এখানকার ঘটনার সঙ্গে ওই কাহিনির কোনো সামঞ্জস্য আছে কি? নিছক রক্তচোষা বাদুড় না হয়ে এখানেও বাদুড়রূপী কোনো প্রেতের যদি আবির্ভাব হয়ে থাকে? পরক্ষণেই আমি আমার উদ্ভট কল্পনার কথা ভেবে মনে মনে হেসে উঠলাম। এটা শুধু বিংশ শতাব্দীই নয়, মানুষ এখন চাঁদের মাটিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে! হঠাৎ আমার চোখ পড়ল মি লেবং-এর ওপর। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তিনি আমাকে লক্ষ করছেন— যেন মনের ভাব বোঝবার চেষ্টা করছেন।

আমার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হতেই তিনি বললেন, আপনিও সম্ভাবনার কথাটা ভেবেছেন দেখছি। তবে কাউন্ট-ড্রাকুলা রাত্রে জেগে উঠত, দিনে তার দেখা পাওয়া যেত না। আমাদের তেমন কোনো লোকের সন্ধান করতে হবে।

আমি ঘটনাকে লঘু করার উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বললাম, ওটা তো নিছক গল্প।

ওয়াংকে দেখতে না পেয়ে, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, সে কোথায়? মি লেবং বললেন সারারাত সে জেগে পাহারা দেয়, তাই দিনের বেলা ঘুমোয়।

অরুণের ঘোষণায় কাজ হয়েছিল। সবাই রাত্রে ঘরের দরজা জানলা এঁটে দিত, তাই দিনকয়েক নিরুপদ্রবে কাটল। তারপরই আবার একজন ওই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হল। এবার একজন সতেরো-আঠারো বছরের যুবতী। মেয়েটি নাকি রাত্রে কোনো বিশেষ কাজে বাইরে বেরিয়েছিল, ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে তার মা বেরিয়ে দেখে সে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

আমি বুঝতে পারলাম, বাদুড়টা এবার মরিয়া হয়ে উঠেছে। ঘরে ঢুকতে না পেরে বাইরের লোকজনকে আক্রমণ করতে শুরু করেছে।

অরুণকে নিয়ে তক্ষুনি সেই বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। এক রাত্রেই মেয়েটি সাদা হয়ে গেছে, ক্ষুধার্ত ভ্যামপায়ার আকণ্ঠ তার রক্তপান করেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। গলার ক্ষত বেশ গভীর। আমার মাথায় একটা মতলব এল। এই সুযোগ হাতছাড়া করব না। মেয়েটির বাবাকে বললাম, রাত্রে যেন ঘরের ঝাঁপ-জানলাটা খুলে রাখে, আমরা বাইরে পাহারায় থাকব। একটা জিনিস যা লক্ষ্যণীয় তা হল প্রতিটি ক্ষেত্রেই আক্রান্ত পুরুষ কিংবা নারী তরুণ; বয়স্ক কেউ এই রোগের কবলে পড়েনি। এ থেকে বোঝা যায়, তরুণের রক্তের ওপরই বাদুড়ের লোভ বেশি।

রাত্রে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি আর অরুণ বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বন্দুকটা নিতে আমি ভুললাম না, অরুণ তার রিভলভারটা নিল। প্রথম রাত্রে কিন্তু কিছু ঘটল না! হয়তো শিকারের অপ্রতুলতা ঘটায় ভ্যামপায়ার একবারে কয়েক দিনের মতো রক্তপান করেছে, তাই শিকারে বেরোবার তাগিদ ঘটেনি। দ্বিতীয় রাতটাও নির্বিঘ্নে কাটল, মেয়েটির অবস্থা একটু ভালোর দিকে। তৃতীয় রাত্রের ভয়ংকর ঘটনা কোনোদিনই আমি ভুলব না। অরুণকে তো কিছুদিন মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে হয়েছিল।

যথারীতি আমরা জানলার অদূরে একটা ঝোপের আড়ালে বসে আছি। পর পর দু-রাতে কিছু না ঘটায় অরুণ আমার সিদ্ধান্তে সন্দিহান হয়ে পড়েছিল।

মেঘলা আকাশ, দু-চার ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে, ঠান্ডা হাওয়ায় আমরা যেন জমে যাচ্ছি। আমার রেডিয়াম ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম রাত বারোটা। হঠাৎ একটা শব্দে আমরা উৎকর্ণ হয়ে উঠলাম, বড়ো কোনো পাখির ডানার ঝটাপট শব্দ। আকাশে চাঁদ না থাকায় চারদিকে জমাট অন্ধকার। আমরা সেই শব্দ লক্ষ করে গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে দৃষ্টি মেলে দিলাম।

একটা কালো ছায়া যেন জানলাটার কিছু ওপরে চক্কর দিচ্ছে। ততক্ষণে অন্ধকারে অন্ধকারে দৃষ্টি কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে। হ্যাঁ, একটা বাদুড়ই বটে। বার কয়েক ঘুরে ওটা ইগলের মতো ভঙ্গিতে নেমে এল, তারপর ফোকর দিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি এ অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং উপযুক্ত ব্যবস্থাও করে রেখেছিলাম। একটা বড়ো কাঠের সিঁড়ি হাতের কাছেই ছিল, সেটাকে তাড়াতাড়ি জানলার ধারে লাগিয়ে আমি উঠে পড়লাম, আমার পেছন পেছন অরুণও উঠে এল। দু-জনে কোনোমতে পাশাপাশি দাঁড়ানো যায়।

ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হলেও ততক্ষণে আমাদের চোখে অন্ধকার অনেকটা সয়ে গেছে। মনে হল, সেই মেয়েটির খাটিয়ার ধারে যেন কালো পোশাক পরা একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আমরা রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। পরক্ষণেই মূর্তিটা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তারপর মুখটা নীচু করল। আমাদের দিকে পেছন ফিরে থাকায় আমরা তার কার্যকলাপ দেখতে পাচ্ছিলাম না; তবে তার উদ্দেশ্য বুঝতে আমার কিন্তু এতটুকু কষ্ট হয়নি।

অরুণের মুখ দিয়ে ভয়বিহ্বল গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল। বিদ্যুদগতিতে লাফিয়ে উঠে মূর্তিটা আমাদের দিকে ফিরে তাকাল। অন্ধকারে আমরা শুধু দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আর ছুরির ফলার মতো ঝকঝকে দুটো দাঁত দেখতে পেলাম। আমাদের কাছ থেকে বাধা পেয়ে বোধ হয় ও হিংস্র হয়ে উঠেছে। কালো গাউনের মতো পোশাক পরা মূর্তিটা দু-হাত ছড়িয়ে দিয়ে পাখির ডানার মতো নাড়াল আর সঙ্গেসঙ্গে হতভম্ব হয়ে আমরা দেখলাম, মাটি ছেড়ে মূর্তিটা শূন্যে উঠে পড়েছে। এতক্ষণ যাকে আমরা মূর্তি বলে মনে করেছিলাম সেটা পাখির মতো ডানা নাড়তে নাড়তে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।

অরুণকে এক হ্যাঁচকা টান মেরে আমি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। অরুণ মাঝ-সিঁড়ি থেকে প্রায় লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ল। বাদুড়টা বেরিয়ে হিংস্রভাবে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমি বন্দুক বাগিয়ে ধরতেই, আমাদের আক্রমণ করা আর নিরাপদ নয় মনে করেই হয়তো বাদুড়টা তার গতি পরিবর্তন করল। এই মুহূর্তটির জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। অরুণও আমার পূর্ব নির্দেশমতো তার পাঁচ ব্যাটারির শক্তিশালী টর্চের আলো ফেলল ওর ওপর, সঙ্গেসঙ্গে আমি ফায়ার করলাম। অব্যর্থ লক্ষ্য। বাদুড়টা শূন্যে দু-বার টাল খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল ধপ করে। আমরা ছুটে গেলাম। বাদুড়টা চিত হয়ে পড়ে আছে, বুকের কাছটা রক্তে ভরে উঠেছে, মুখটা হাঁ করা, দুটো তীক্ষ্ন অস্বাভাবিক বড়ো দাঁত টর্চের আলোয় ঝকমক করে উঠল। আমার বন্দুকের গুলির শব্দে ওই ঘরের এবং আশপাশের লোকজন ছুটে এসেছিল। মৃত বাদুড়টাকে দেখে তাদের মুখে যে দারুণ আতঙ্কের ভাব ফুটে উঠল, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নিজেদের ভাষায় তারা কী সব বলাবলি করতে লাগল, তার একবর্ণও আমরা বুঝলাম না।

শেষ পর্যন্ত ওদের একজন সাহস করে অরুণকে বলল, সাহেব, ওটাকে পুড়িয়ে ফেলো, ও পাখি নয়— পিশাচ!

আমরা ওর কথায় সম্মত হলাম। ওরাই গাছের শুকনো ডালপালা এনে এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল। এসব আয়োজন যখন হচ্ছিল, আমরা তখন বাদুড়টার কাছ থেকে সরে গিয়ে ওদের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। সব ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হলে আমরা ওদের বললাম বাদুড়টাকে টেনে আনতে, কিন্তু ওরা কেউ ছুঁতে রাজি হল না! অগত্যা আমি আর অরুণই এগিয়ে গেলাম। যেখানটায় ওটা পড়েছিল, অরুণ সেখানে টর্চের আলো ফেলল। আর সঙ্গেসঙ্গে তার হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। মুখ দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরুতে লাগল।

আমিও দেখেছিলাম। টর্চের তীব্র আলোয় দেখেছিলাম বাদুড়টার মৃতদেহ অদৃশ্য হয়েছে আর ঠিক সেখানে মাটির ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে মি লেবং-এর মৃতদেহ। বুকের কাছে একটা গোল দাগ, চারপাশ রক্তে ভিজে উঠেছে।

পাহাড়ি লোকগুলি এই দৃশ্য দেখে হাউমাউ করে উঠল। কেউ কেউ পালাল। আমি ওদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মি লেবং-এর দেহটা শেষ পর্যন্ত দাহ করলাম! সব যখন ছাই হয়ে গেল, অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে এসেছে। পুব আকাশে আলোর ছটা ফুটে উঠেছে— যেন অভিশপ্ত অন্ধকারের ভয়ংকরতা দূর করে দিনের প্রথম আলো আশীর্বাদের মতো আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে।

আমার কাহিনি এখানেই শেষ। মি লেবংকেই আমি ভ্যামপায়ার বলে সন্দেহ করেছিলাম, কিন্তু কেন করেছিলাম তা না বললে হয়তো এই কাহিনি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রক্তচোষা বাদুড়ের কথা মনে জাগলেও, লেবং-এর কতগুলি ব্যাপার আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। প্রথমেই তাঁর সামনের দুটো দাঁত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অত সরু ও ছুঁচলো দাঁত আমার কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকেছিল।

দ্বিতীয়ত গম্বুজ ঘরে হঠাৎ একটা বাদুড় তাঁর কাঁধের ওপর বসে যেমনভাবে তাঁকে আদর করেছিল, তা আমার স্বভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয়নি। আমার খটকা লেগেছিল। ওই বাদুড়টা ছিল মেয়ে বাদুড় (পরে আমি যুক্তি দিয়ে যা বুঝেছি), লেবং বাদুড়ের রূপ নিত বলেই ওই বাদুড়টা তার সহজাত অনুভূতি দিয়ে লেবংকে পুরুষ বাদুড় রূপেই দেখত।

তৃতীয়ত, ওয়াং যখন কাচের পাত্রে লাল তরল পদার্থ এনে দিল, তখন আমার মনে সন্দেহ ছিল না যে বস্তুটা কাঁচা রক্ত। লেবং টমেটোর রস বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করলেও রক্ত আর টমাটোর রসের পার্থক্য বুঝব না, এমন বোকা আমি নই।

চতুর্থত, লেবং বেরিয়ে যাবার পর ওয়াং-এর সন্ত্রস্ত ভাব আর ছাগলটাকে মাটিতে কবর দেওয়া থেকেই এটাই আমার মনে হয়েছিল যে ওয়াং তার মনিবের আসল রূপ জানে, তাই তার আচরণে অমন অদ্ভুত ভাব। তাকে সবসময় প্রাণভয়ে ত্রস্ত থাকতে হত, কোনো কারণে হয়তো ওর পালাবার পথ ছিল না। লেবং-এর পক্ষেও একজন অনুচর অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, তাই নিজের স্বার্থেই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। মৃত ছাগলটার রক্তই ওয়াং পাত্র ভরে লেবংকে দিয়েছিল। লেবং নৈশবিহারে বেরোবার পর ওয়াং ওটাকে কবর দেয়। আকাশের দিকে ও তাকাচ্ছিল, তার বাদুড় মনিব ফিরে আসার আগেই কাজটা সারতে হবে, তাই। আমার অনুমান, প্রাণধারণের জন্য লেবং ছাগল কিংবা অন্য কোনো জন্তুর রক্ত পান করতেন। কিন্তু তারুণ্য বজায় রাখার জন্য মানুষ…বিশেষ করে তরুণ-তরুণীর রক্তই ছিল তাঁর প্রধান অবলম্বন। আর যে কারণে আমি নিঃসন্দেহ হলাম যে লেবংই ভ্যামপায়ার, সেটা ঘটল সেই রাত্রে লেবং-এর বাড়ি থেকে ফেরার পথে। লেবং বাদুড় হয়ে ফিরছিলেন, পথে আমাকে দেখে তিনি আক্রমণ করেন। আমি লাঠি দিয়ে সজোরে ওঁর ডানায় আঘাত করেছিলাম। পরদিন দেখলাম লেবং-এর ডান হাতে ব্যান্ডেজ, আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না।

আমাকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই লেবং বলেছিলেন যে, তাঁকেও বাদুড়ে আক্রমণ করেছিল। আমার জেরার উত্তরে তিনি আরও বলেছিলেন পড়ে যাবার পর বাদুড়টা তাঁকে ছেড়ে উড়ে যায়! ওটাও একটা মস্ত ভুল। অসহায়ভাবে পড়ে যাওয়া মানুষকে আক্রমণ করে তার গলায় দাঁত বসানোই হিংস্র ভ্যামপায়ারের প্রকৃতি, শিকারকে ছেড়ে উড়ে যাওয়া নয়। আমার মুখে রক্তচোষা বাদুড়ের থিয়োরি শুনে লেবং ঘাবড়ে যাবার ভান করে ড্রাকুলার কাহিনি টেনে এনেছিলেন। আসলে তিনি একটা চাল চেলেছিলেন, যাতে আমার সন্দেহ তাঁর ওপর না পড়ে। ভ্যামপায়ার যদি সত্যিই কোনো এক মানুষের মূর্তিতে থাকে, তবে ড্রাকুলার মতো তাকে দিনের বেলা দেখা যাবে না। অর্থাৎ লেবংকে দিনের বেলা দেখা যায়, সুতরাং তিনি সব সন্দেহের বাইরে। এখানে তিনি একটু বেশি চালাকি করে ফেলেছিলেন, কারণ আমি রক্তচোষা বাদুড়ের কথাই বলেছিলাম, মানুষরূপী ভ্যামাপায়ারের প্রসঙ্গ একবারও তুলিনি। লেবং যেন আগ বাড়িয়েই নিজের মুখোশ খুলে দিলেন, অতি চালাকের যা হয়ে থাকে। আর যে ছোট্ট ঘটনাটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, তা হল মি লেবং-এর এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস আর রহস্যময় রোগের প্রাদুর্ভাব প্রায় সমসাময়িক। সব কিছু বিচার করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম যে লেবংই ভ্যামপায়ার এবং তাঁকে শেষ করতে হলে বাদুড় অবস্থায় গুলি করে তাঁকে বিনাশ করতে হবে। একবার যার রক্ত পান করেছে, ভ্যামপায়ার আবার তার রক্তের লোভে ছুটে আসবেই। এটা আমার জানা ছিল, তাই ওই ফাঁদ পেতেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *