আঙুল পিশাচ

আঙুল পিশাচ

শশিশেখর সান্যাল একতলায় তাঁর লাইব্রেরিতে গদি-আঁটা রিভলভিং চেয়ারে বসে ছিলেন। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর একটা মোটা বিদেশি বই খোলা ছিল। বাঁ-হাতের আঙুলের স্পর্শ ও অনুভূতির সাহায্যে ‘ব্রেইল’ পদ্ধতিতে তিনি সেটা পড়ছিলেন। শশিশেখর অন্ধ; অবশ্য মাত্র ক-বছর হল তিনি দৃষ্টি হারিয়েছেন। কর্মজীবনে অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাঁকে সম্মানের শীর্ষে তুলে ধরেছিল। দৃষ্টি হারিয়েও তিনি মুষড়ে পড়েননি, কঠিন অধ্যবসায়ের ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ‘ব্রেইল’ শিখে নিয়েছেন, শিখে নিয়েছেন বললে ভুল হবে, রীতিমতো দক্ষতা অর্জন করেছেন।

শশিশেখরের বয়স ষাট, বিয়ে করেননি। টেবিলের দক্ষিণ প্রান্তে তাঁর ভাইপো অসমঞ্জ বসে ছিল। অসমঞ্জের বয়স পঁয়ত্রিশ। শশিশেখরের বড়োভায়ের ছেলে। বলতে গেলে, সান্যাল বংশের সে-ই একমাত্র প্রদীপ। অসমঞ্জ প্রাণীবিদ্যায় ডক্টরেট। এই অল্প বয়সেই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে সে একটা জটিল গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত। তার বাবা এক নামি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিলেন, সুতরাং টাকাপয়সার কোনো অভাব তার নেই, রীতিমতো ধনী বলা চলে। অসমঞ্জ ফাঁক পেলেই শশিশেখরের কাছে এসে কিছু সময় কাটিয়ে যায়। কাকা-ভাইপোর মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শশিশেখরের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের প্রতি অসমঞ্জর গভীর শ্রদ্ধা, কাকার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে সে কখনোই কুণ্ঠা বোধ করে না।

শশিশেখর বই পড়ছিলেন আর মাঝে মাঝে অসমঞ্জর সঙ্গে দু-চারটে কথা বলছিলেন। অসমঞ্জ হঠাৎ লক্ষ করল, তার কাকা বাঁ-হাতের আঙুল দিয়ে ‘ব্রেইল’ পদ্ধতিতে বই পড়ছেন আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ডান হাতের ডট পেনটাও একটা সাদা কাগজের ওপর কী যেন লিখে চলেছে। অসমঞ্জ প্রথমে ভাবল, তার কাকা বাঁ-হাতের আঙুলের অনুভূতি দিয়ে যা পড়ছেন, হয়তো ডান হাতে ধরা কলম দিয়ে তাই লিখছেন। সে একটু কৌতূহলী হয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে লেখাগুলি পড়তে লাগল

‘শশিশেখর সান্যাল, শরদিন্দু সান্যাল (অসমঞ্জর বাবার নাম), বিনয়েন্দ্র সান্যাল (অসমঞ্জর ঠাকুরদার নাম), বিমলেন্দু সান্যাল (অসমঞ্জর ঠাকুরদার ভায়ের নাম), অসমঞ্জ সান্যাল, শশিশেখর সান্যাল, শরদিন্দু সান্যাল, বিনয়েন্দ্র সান্যাল, বিমলেন্দু সান্যাল…’

অসমঞ্জ বেশ একটু বিস্ময় অনুভব করল। তার কাকার বাঁ-হাতের আঙুল যেমন দ্রুত চলছে, ডান হাতে ধরা ডট পেনটাও যেন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমান তালে লিখে চলেছে। পাঠ্যবস্তু আর লেখার মধ্যে কিন্তু আকাশ-পাতাল প্রভেদ। অসমঞ্জ সবিস্ময় ভাবতে লাগল, এ কি সম্ভব! একই মানুষের পক্ষে একই সময় গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা কিছু পড়া ও অন্য কিছু লিখে যাওয়া প্রায় একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। তবে কি তার কাকা প্রকৃতির খেয়ালে এক অবিশ্বাস্য মানসিক উৎকর্ষতা লাভ করেছেন! অনেক সময় দেখা গেছে মানুষের কোনো ইন্দ্রিয়হানি ঘটলে, তার অপর এক ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি বৃদ্ধি পায়। যে অদ্ভুত ঘটনা সে অবলোকন করল, তা কি সেরকম কোনো ব্যাপার! শশিশেখর বই বন্ধ করলেন, সঙ্গেসঙ্গে ডান হাতটাও থেমে গেল। অসমঞ্জ বইয়ের মলাটের ওপর চোখ বুলিয়ে দেখল উদ্ভিদবিজ্ঞানের ওপর লেখা একটা বই। তার কাকা যে নিজের অজ্ঞাতসারেই বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রের মতো লেখার ক্ষমতা অর্জন করেছেন, সে-বিষয়ে অসমঞ্জর মনে কোনো সন্দেহ রইল না। বৈজ্ঞানিক চিন্তা দিয়ে সে এটাকে অবচেতন মনের একটা ক্রিয়া বলেই মনে করল।

অসমঞ্জ সেদিনকার মতো বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। কাকুলিয়া রোডে তার পৈতৃক বাড়িতে সে একাই বাস করে, এখনও বিয়ে করেনি। তবে ঠিক একা বলাও চলে না, চাকর রামু ও ঠাকুর ছাড়া তার প্রাইভেট সেক্রেটারি দ্বৈপায়ন বসুও ওই বাড়িতে থাকে। দ্বৈপায়ন অসমঞ্জরই সমবয়সি। এম এসসি পাশ করে সে যখন চাকরির চেষ্টায় ঘুরছিল, তখন আকস্মিকভাবেই অসমঞ্জর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। দ্বৈপায়নের চটপটে কথাবার্তা ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারায় অসমঞ্জ প্রীত হয়। লোভনীয় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তার সেক্রেটারির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব করতেই দ্বৈপায়ন এককথায় রাজি হয়ে যায়। অসমঞ্জ তার নির্বাচনে যে ভুল করেনি, তা প্রমাণ হতে বেশি সময় লাগেনি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দ্বৈপায়ন অসমঞ্জর গবেষণার কাজ ও বৈষয়িক ব্যাপারে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অসমঞ্জর সব চিঠিপত্রের জবাব দেওয়া, রিপোর্ট টাইপ করা, এমনকী তার বিষয়-আশয় দেখাশোনাও সে দক্ষ সেক্রেটারির মতো চালাতে লাগল। দু-জনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠতেও বেশি সময় লাগল না; এই ক-বছরে তা নিবিড় বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে, সম্বোধন আপনি থেকে এসে দাঁড়িয়েছে তুমিতে।

নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় অসমঞ্জ বেশ কিছুদিন শশিশেখরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। তা বলে কাকার অবচেতন মনের অদ্ভুত ঘটনাটি সে ভুলে যায়নি। প্রথম সুযোগেই সে এলগিন রোডে কাকার সঙ্গে দেখা করতে এল। এ ক-দিনেই কাকার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে, একটা অস্থির অস্থির ভাব। বৈষয়িক ব্যাপারে চিঠি ডিকটেশন দিতে তিনি সেদিন ব্যস্ত ছিলেন, তাই বই পড়ার অবকাশ তাঁর ছিল না। অসমঞ্জ ফিরে এল, কিন্তু হাল ছাড়ল না। ক-দিন পর একটা ছুটির দিন দেখে সে দুপুর বেলা এলগিন রোডে চলে গেল। কাকার স্বাস্থ্য সম্বন্ধেও সে একটু উদবিগ্ন হয়েছিল।

দোতলায় কাকার শোবার ঘরে গিয়ে সে দেখল, তিনি মাথার নীচে উঁচু করে বালিশ দিয়ে, অনেকটা হেলান দেওয়া অবস্থায়, খাটের ওপর ঘুমিয়ে আছেন। দু-হাতের আঙুলগুলি পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে বুকের ওপর আলগাভাবে রয়েছে। অসমঞ্জ ভাবল, সে একটা এক্সপেরিমেন্ট করবে। সন্তর্পণে একটা খাতা আর একটা পেনসিল সে বুকের কাছে ধরতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ডান হাতের আঙুলগুলো যেন সজীব হয়ে পেনসিলের দিকে প্রসারিত হতে চাইল, কিন্তু বাম হাতের আঙুলের বন্ধনে থাকায় ওই প্রয়াস সফল হল না। পরক্ষণেই ডান হাতের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে বাম হাতের আঙুলের কবজা থেকে নিজেদের মুক্ত করে পেনসিলটা তুলে নিল, তারপর খাতায় লিখতে শুরু করল

‘সান্যাল বংশ শিক্ষা ও আভিজাত্যে নিশ্চয় গর্ব বোধ করতে পারে, কিন্তু সেইসঙ্গে তাদের রক্তে যে অস্বাভাবিকতা বংশপরম্পরায় চলে আসছে তাও অস্বীকার করা যায় না।’

‘তুমি কে?’ অসমঞ্জ নীচু গলায় প্রশ্ন করল।

শশিশেখরের ডান হাত লিখল, ‘তা জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না।’

‘এসব কি আমার কাকাই লিখছেন?’ অসমঞ্জ আবার প্রশ্ন করে।

‘দুর বোকা!’

‘আমার পরিচিত কেউ?’

‘অধৈর্য হোয়ো না অসমঞ্জ, শিগগিরই তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে।’

‘কবে?’

‘তোমার কাকা মারা গেলে পর—’

‘কোথায় দেখা পাব?’

‘কোথায় পাবে না?’

‘আমাদের বংশ সম্বন্ধে তুমি এত জান, তুমি কি আমার কোনো পূর্বপুরুষ?’

‘অনুমান করতে বাধা নেই।’

পরের প্রশ্ন না করে অসমঞ্জ খাতায় লিখল, ‘এখন ক-টা বাজে?’

খাতায় লেখা পড়ল, ‘তিনটে পঁচিশ। খাতা পেনসিলটা সরিয়ে ফেলো অসমঞ্জ, তোমার কাকা জেগে উঠে কিছু যেন টের না পান। আমরা যে এভাবে পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান করছি তা অবশ্যই শশিশেখরের কাছে গোপন রাখতে হবে। বিদায়, আবার দেখা হবে।’

শশিশেখর যেন চমকে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। অসমঞ্জ অবশ্য তার আগেই কাকার ডান হাতের আঙুলে ধরা পেনসিলটা সরিয়ে ফেলেছিল। শশিশেখর অসমঞ্জর উপস্থিতি টের পেয়ে যেন একটু ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কতক্ষণ এসেছ?’

‘এই তো…’

‘বোসো। কিছুদিন ধরে ঘুমের মধ্যে এমন সব বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখি, মাথামুণ্ডু নেই…।’

‘হয়তো ভালো ঘুম হচ্ছে না। ডক্টর চৌধুরীকে একবার কল দেব?’

‘না।’ একটু থেমে শশিশেখর বলতে থাকেন, ‘এমন সব অদ্ভুত স্বপ্ন! অন্ধকার দেশ, মানুষজন, ঘরবাড়ি সবই যেন আবছা অন্ধকারে ঢাকা। কাকা—’

‘কাকা!’

‘হ্যাঁ, তোমার ঠাকুরদার ভাই, আমার কাকা…।’

‘কিন্তু তাঁর কথা বলছেন কেন?’

শশিশেখর সঙ্গেসঙ্গেই উত্তর দিলেন না। মুহূর্তকাল নিঃশব্দে কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘তুমি বড়ো হয়েছ, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, এখন আর তোমার কাছে গোপন রাখা উচিত হবে না। আমার কাকা, অর্থাৎ বিমলেন্দু সান্যাল, দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলেন। হিংস্র, নিষ্ঠুর, ধূর্ত। এককথায় উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া মানুষ। শেষ পর্যন্ত তিনি সামান্য কারণে আপন মামাতো ভাইকে ছুরি মেরে হত্যা করেন। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়েছিল। পরপর ক-দিন আমি তাঁকে স্বপ্নে দেখেছি। এই এখন তন্দ্রার মধ্যেও…, তুমিও যেন কেমনভাবে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছ মনে হল। অসমঞ্জ, জীবনের পথ কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল, শত প্রলোভনেও সত্যকে ত্যাগ কোরো না। তোমার ঠাকুরদার ভাই…’

এক দমক কাশি ওঠায় শশিশেখর তাঁর কথা শেষ করতে পারলেন না, কিন্তু অসমঞ্জ অবাক হয়ে দেখল, তাঁর ডান হাত পাশেই রাখা পেনসিলটা চট করে তুলে খাতায় খস খস করে কী যেন লিখল। শশিশেখর ব্যাপারটা জানতেই পারলেন না। লেখা শেষ হবার সঙ্গেসঙ্গেই পেনসিলটা আবার তাঁর হাতের আঙুল থেকে সরে পড়ল। অসমঞ্জ খাতাটা সরিয়ে এনে পড়ল।

‘শশিশেখরের কথায় কান দিয়ো না। আমরা দু-জনে বন্ধু, তাই না অসমঞ্জ?’

অসমঞ্জ স্তম্ভিত হয়ে গেল। তবে কি…?

তিনদিন পর অসমঞ্জর টোকিয়োতে এক আন্তর্জাতিক প্রাণীবিদ্যা সম্মেলনে যোগ দিতে যাবার কথা, কাকার কাছে তাই সে বিদায় চাইল। শশিশেখর তাকে শুভ কামনা জানিয়ে বললেন, ‘আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে, অসমঞ্জ। পরপারের ডাক আমি যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তোমার সঙ্গে হয়তো আমার এই শেষ দেখা। একটা কথা, বংশমর্যাদায় আমরা কুলীন, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতিতে তিন পুরুষ ধরে আমরা সমাজের বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছি, কিন্তু দোষত্রুটি নিয়েই মানুষ, আমরাও তার ঊর্ধ্বে নই। একটা খামখেয়ালি মনোবৃত্তি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এক্সেনট্রিসিটি’, তা আমাদের বংশের মজ্জাগত দোষ। তুমি বিয়ে করতে আর দেরি কোরো না। বুদ্ধিমতী, বাস্তবজ্ঞানসম্পন্না একটি মেয়েকে বধূ নির্বাচিত করো। আর একটা কথা— যদি আমাদের আর দেখা না হয়, তাই বলে রাখছি— তোমার টাকাপয়সার অভাব নেই। আমার উইলে আমার সব সম্পত্তি শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করবার নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু আমার মূল্যবান আর দুষ্প্রাপ্য বইগুলো তোমার কাজে লাগতে পারে ভেবে সেগুলো তোমাকে দিয়ে গেলাম।

‘ওঃ, আর একটা কথা— শেষ সময়ে মানুষ নিজের ওপর শাসন হারিয়ে ফেলে, অসংগত আবদার কিংবা দাবি করে, সেসবে কান দিয়ো না। গুড বাই, অসমঞ্জ।’

শশিশেখর তাঁর ডান হাতটা ভাইপোর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। অসমঞ্জ প্রসারিত সেই হাতটা নিজের মুঠির মধ্যে মৃদুভাবে চেপে ধরল। মুঠো আলগা করার পূর্বমুহূর্তে শশিশেখরের ডান হাতের চাপের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি অসমঞ্জর শরীরে যেন বিদ্যুৎতরঙ্গ বইয়ে দিল; মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, যেন তার কাকার ডান হাতটা বৃদ্ধের হাত নয়। শক্তসমর্থ কোনো জোয়ানের সঙ্গে সে করমর্দন করছে, আর স্পর্শেও যেন একটা অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া।

টোকিয়ো থেকে দিন পনেরো পর ফিরে অসমঞ্জ শশিশেখরের মৃত্যুসংবাদ শুনল। অসমঞ্জর মনে হল, কাকার মৃত্যু অনেকটা আকস্মিক। শেষ দিকে তিনি যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। কাকার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর কথাবার্তা থেকে অন্তত তাই মনে হয়। শশিশেখরের উইলে তাঁর সম্পত্তির তত্ত্বাবধান এবং শিক্ষা ও রিসার্চের উন্নতিকল্পে, সুষ্ঠু ব্যয়ের উদ্দেশ্যে একটি ট্রাস্ট গঠন করার নির্দেশ ছিল, অসমঞ্জকে তিনি সেই ট্রাস্টের অন্যতম অছি নিযুক্ত করেছেন।

কাকার আজীবনের বিরাট গ্রন্থ-সংগ্রহ নিয়ে অসমঞ্জ বেশ ফাঁপরেই পড়ল। তার নিজের বাড়ির লাইব্রেরি ঘরটা প্রকাণ্ডই বলতে হবে। তার বাবার পড়ার নেশা ছিল। আলমারি ভরতি সব বই ছাড়াও তিনি ঘরের চারদিকে গ্যালারির মতো সিমেন্ট বাঁধানো তাক তৈরি করিয়েছিলেন, সারি সারি তাকগুলো দেওয়াল জুড়ে ঘরের কড়িকাঠ পর্যন্ত উঁচু। একটা কাঠের মই বেয়ে ওপরের তাকগুলো থেকে বই নামাতে হয়।

কাকার বইগুলো ঠিকমতো গুছিয়ে রাখা অসমঞ্জর কাছে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। দ্বৈপায়নই পরামর্শ দিল, সাধারণ গ্রন্থাগারে যেমন বড়ো বড়ো কাঠের তাকওলা বই রাখার আলমারি থাকে, সেই ধরনের বেশ কিছু তৈরি করিয়ে আপাতত সমস্যার সমাধান করা হোক। সেই ব্যবস্থাই হল। প্রকাণ্ড লাইব্রেরি ঘরটা বইয়ে ভরে গেল।

কয়েকদিন পরের কথা। সন্ধেবেলা অসমঞ্জ তার বসবার ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল। দ্বৈপায়ন এসে ঘরে ঢুকল। একটা বিশেষ দরকারে তাকে সিঁথি যেতে হবে, ফিরতে রাত হতে পারে। অসমঞ্জকে সে বলল, ‘আজকের সব চিঠিপত্র লাইব্রেরির টেবিলের ওপর চাপা দিয়ে রেখেছি। কয়েকটা ব্যক্তিগত চিঠিও আছে। হ্যাঁ, আর একটা হাত দেড়েকের মতো লম্বা কাঠের বাক্স পার্সেলে এসেছে, ভেতরে একটা জ্যান্ত প্রাণী আছে মনে হচ্ছে। যেমন লাফাচ্ছে আর পায়ের নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে, তাতে মনে হয়, ওটার ভীষণ খিদে পেয়েছে। আমি আর ওটা খুলিনি। আচ্ছা, তাহলে চলি।’

দ্বৈপায়ন রাত্রের খাওয়াটা সিঁথিতেই সেরে নেবে বলেছিল, তাই অসমঞ্জ ন-টার মধ্যে খেয়ে নিল। রামুকে লাইব্রেরি ঘরে কফি দিতে বলে চিঠিপত্র দেখবার জন্য সে ওই ঘরের দিকে পা বাড়াল।

ধূমায়িত কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে রামু ঘরে ঢুকতেই অসমঞ্জ তাকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার আনতে বলল, কাঠের বাক্সর চারদিক স্ক্রু দিয়ে আটকানো ছিল। স্ক্রু-ড্রাইভার ছাড়া খোলা মুশকিল। স্ক্রু-ড্রাইভার এনে রামু বলল, ‘পিয়োন বলছিল, পোস্ট অপিস থেকে বাক্সর ওপরে কয়েকটা ফুটো করে দিয়েছে। ভেতরে যে জ্যান্ত প্রাণীটা আছে, সেটা নাকি তা না হলে দম বন্ধ হয়ে মারা যেত।’

গবেষণার জন্য অসমঞ্জর নানারকম জীবজন্তুর প্রায়ই প্রয়োজন হয়। তার ল্যাবরেটরি চিড়িয়াখানার একটা খুদে সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। অসমঞ্জ মনে মনে ঠিক করল, দ্বৈপায়নকে বলবে, যে কোম্পানি প্রাণীটা পাঠিয়েছে তাদের কড়া একটা চিঠি লিখতে। এ ধরনের অসতর্কতা ক্ষমা করা যায় না। বাক্সের স্ক্রুগুলি খুলে সে একটা মোটা বই ঢাকনার ওপর চাপা দিল, তারপর ল্যাবরেটারি থেকে একটা খাঁচা আনতে গেল। খাঁচা নিয়ে লাইব্রেরির দরজায় ফিরে আসতেই একটা কিছু পড়ার শব্দ হল, মেঝের ওপর দিয়ে যেন কিছু চলে গেল। অসমঞ্জ দেখল মোটা বইটা মাটিতে পড়ে আছে আর বাক্সের ভেতরটা শূন্য। বইটা তুলে ঝাড়তে ঝাড়তে সে ভাবল, প্রাণীটার শক্তি তো কম নয়, এই মোটা বইটা ফেলে দিয়েছে।

প্রাণীটাকে খুঁজে বের করা সহজ ব্যাপার নয়। বইয়ের পাহাড়ের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে! বইয়ের তাকের পেছনে সে ওটার নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল, কিন্তু শব্দ লক্ষ করে এগুতেই সে বুঝতে পারল, ওটা অন্য একটা শেলফের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। হতাশ হয়ে সে তার চেয়ারে ফিরে এসে চিঠিপত্রগুলো পড়তে লাগল। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হল, যেন কেউ সুইচ নিভিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।

আলো কে নেভাল? বেশ আশ্চর্য হয়েই অসমঞ্জ দেওয়ালে যেখানে সুইচ বোর্ড আছে, অন্ধকারে সেদিকে এগুলো। দু-পা এগিয়েই সে থেমে গেল। ঘরের অপর প্রান্তে একটা শব্দ হচ্ছে, অনেকটা বুকে ভর দিয়ে চলার মতো শব্দ। সে তাড়াতাড়ি সুইচ টিপতেই ঘর আলোতে ভরে উঠল, কিন্তু অসমঞ্জ কিছু দেখতে পেল না, ওই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রাণীটা আবার আত্মগোপন করেছে।

অসমঞ্জ আবার তার চেয়ারে ফিরে এল। ঘরটা বড়ো ঠান্ডা মনে হচ্ছে, কেমন যেন একটা বিষাদের ছায়া। পেছনদিকের উঁচু গ্যালারি থেকে ধপ ধপ করে দুটো মোটা বই মাটিতে পড়ল। অসমঞ্জ ফিরে তাকাতেই একটা একটা করে আরও দুটো পড়ে গেল। অসমঞ্জ অস্ফুট কণ্ঠে বলল, ‘বেটা, তোকে উপোস করিয়ে রাখব, এই তোর ঠিক শাস্তি। জল ছাড়া জীবদেহের রাসায়নিক রূপান্তর তোর ওপর দিয়েই পরীক্ষা করব।’

তাকে যেন ব্যঙ্গ করে আরও গোটা কয়েক বই মাটিতে পড়ল।

অসমঞ্জ আবার তার চিঠিপত্র নিয়ে বসল। শেষ যে চিঠিটা সে পড়ছিল, সেটা তাদের পরিবারের অ্যাটর্নির চিঠি। চিঠিতে তার কাকার মৃত্যুর বিবরণ এবং উইলের ধারা সম্বন্ধে নানান মন্তব্য ছিল। চিঠির শেষের দিকটা বড়োই অদ্ভুত।

‘আপনার কাকার একটা অনুরোধ (অসমঞ্জ পড়তে লাগল) আমাদের কাছে বড়োই আশ্চর্য লেগেছে। শশিশেখর সান্যালের নির্দেশ ছিল তাঁর মৃত্যুর পর খুব সাধারণভাবে তাঁকে যেন দাহ করা হয়, ফুল দিয়ে মৃতদেহ সাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন আমরা তাঁর আর একটা চিঠি পাই।

সেই চিঠিতে তিনি তাঁর পূর্ব নির্দেশ সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে তাঁর দেহ যেন মূল্যবান পালঙ্কে (যেটাতে তিনি শুতেন) বহন করা হয়, নিউ মার্কেট থেকে বাহারি ফুল এনে তাঁর সর্বাঙ্গ যেন ঢেকে দেওয়া হয় আর তাঁর ডান হাতটা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে যেন আপনাকে পাঠানো হয়। এর অন্যথা যেন কিছুতেই না হয়।’

অসমঞ্জ চিঠিটা হাতে করে হতভম্বের মতো বসে রইল। কাকার শেষ কথা হঠাৎ তার মনে পড়ল, ‘শেষ সময় মানুষ নিজের ওপর শাসন হারিয়ে ফেলে, অসংগত আবদার কিংবা দাবি করে— সেসবে কান দিয়ো না।’

পেছনের গ্যালারিতে কেউ যেন হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। চোর নাকি? একটা জানলার পর্দা কেউ যেন সরিয়ে দিল। নিশ্চয়ই কেউ গ্যালারিতে আছে। পাশের জানলার পর্দাটাও সরে গেল আর বাইরে থেকে এক ঝলক চাঁদের আলো গ্যালারির মাঝখানে অন্ধকার জায়গাটা আলোকিত করে তুলল।

অসমঞ্জ হাতে একটা ভারী পেপারওয়েট নিয়ে পা টিপে টিপে শব্দ লক্ষ করে এগুলো আর সঙ্গেসঙ্গে দ্বিতীয়বার ঘরের আলো নিভে গেল। মেঝের ওপর দিয়ে আবার বুকে হেঁটে চলার শব্দটা শোনা গেল। চাঁদের আলোয় অসমঞ্জ নিঃশব্দে সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। বিরাট ঘর, তাই আলো ও পাখা মিলিয়ে গোটা আষ্টেক পয়েন্ট আছে। সাধারণত অসমঞ্জ তার পড়াশুনো ও কাজকর্মের জন্য যে টেবিল চেয়ার ব্যবহার করে, ঠিক তার ওপর কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো আলোটাই জ্বালায়। ওটা হাই পাওয়ারের বালব হলেও সমস্ত ঘরের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। পুরো ঘর আলোকিত করতে হলে সবকটা লাইট জ্বালানো দরকার হয়ে পড়ে। অসমঞ্জ পায়ে পায়ে সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে পর পর সবকটা লাইটের সুইচ টিপল। সঙ্গেসঙ্গে সমস্ত ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠল।

সেই আলোয় অসমঞ্জ যা দেখল, তাতে তার মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠার উপক্রম। সে দু-চোখ কচলে নিল, সে কি স্বপ্ন দেখছে? যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে হাত দশেক দূর দিয়ে একটা হাত, মানুষের হাত, সর সর করে অনেকটা বিছের মতো বুকে ভর দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে। আসলে আঙুলগুলোই হাতটাকে চালনা করছে। কারণ আঙুলগুলো ঘন ঘন প্রসারিত হচ্ছে ও পরক্ষণে মুড়ে যাচ্ছে এবং ওই প্রক্রিয়ায় সঙ্গে সঙ্গে হাতটা এগোচ্ছে। হ্যাঁ, আঙুলগুলোই যে হাতটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।

অসমঞ্জ স্তম্ভিতের মতো এই বিচিত্র ঘটনা দেখতে লাগল। কাকার বইগুলো যেসব নতুন কাঠের র্যাকে রাখা হয়েছিল, তারই একটার ফাঁকে হাতটা অদৃশ্য হয়েছে, সেদিকে ছুটে গেল। একটা র্যাকের বুকসমান উঁচু তাক থেকে একটা বাঁধানো মোটা বই পড়ে গেল আর সেই ফাঁকের মধ্যে খস খস করে একটা শব্দ শোনা গেল। অসমঞ্জ বুঝল যে হাতটা ওই ফাঁকের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সে তার চেয়ারে ফিরে এল। হাতটাকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে তার আর ভরসা হল না। দ্বৈপায়ন ফিরে আসুক তারপর যা হয় করা যাবে। একটা হাত সজীবভাবে চলে বেড়াচ্ছে, এ কী করে সম্ভব! অ্যাটর্নির চিঠিতে তার কাকার অন্তিম নির্দেশ অনুযায়ীই কি ওটা তার কাছে পাঠানো হয়েছে? কাকার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎকারের সময় ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর ডান হাত যা লিখেছিল সেটা অসমঞ্জর মনে পড়ল, ‘তোমার কাকার মৃত্যুর পর আমাদের দেখা হবে।’ তবে কি—! অসমঞ্জর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিম শিহরন বয়ে গেল।

বাইরে দ্বৈপায়নের কণ্ঠস্বর শুনে তার মনে বল ফিরে এল। দারুণ একটা স্বস্তি সে অনুভব করল। দ্বৈপায়ন ঘরে ঢুকে একটু বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘কী ব্যাপার, এতগুলো আলো জ্বলছে কেন?’ তারপরই তার দৃষ্টি পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা বইগুলোর ওপর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সে অসমঞ্জর মুখের দিকে তাকাল।

‘আমার কাকার ডান হাতটা,’ অসমঞ্জ এক নিশ্বাসে বলেই থেমে গেল। তারপর বলল, ‘তোমাকে কী করে বোঝাব জানি না, তখন থেকে সেই হাতটা আমার সঙ্গে যেন মশকরা করছে। ইউ হ্যাভ গট টু হেলপ মি টু ক্যাচ ইট।’

‘কী আবোল-তাবোল বকছ, নেশা করনি তো?’

‘নেশা না তোমার মাথা,’ অসমঞ্জ একটু রাগত কণ্ঠে বলে, ‘ওই র্যাকের ফোকরের মধ্যে হাতটা লুকিয়ে আছে, আমি বাজে কথা বলছি কি না নিজেই গিয়ে দেখ।’

অসমঞ্জর কথা শেষ হবার সঙ্গেসঙ্গেই র্যাক থেকে বই সরাবার শব্দ হল। দ্বৈপায়ন বলল, ‘ইঁদুর।’

সে এগিয়ে গিয়ে র্যাকের সামনে দাঁড়াল, তারপর দু-একবার মুখ দিয়ে হুস হুস শব্দ করল, কিন্তু ওদিক থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। জামার আস্তিন গুটিয়ে দ্বৈপায়ন ঠাসা বইয়ের মধ্যে যে ফাঁক সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল।

‘হ্যাঁ, কিছু একটা আছে, আমাকে যেন চিমটি কাটছে, আরে, আরে…’ সে তাড়াতাড়ি হাতটা টেনে নিল।

‘কী হল?’ অসমঞ্জ ব্যগ্র কণ্ঠে শুধোয়।

‘আমার হাত ধরে টানছিল। মনে হল যেন মানুষের শক্ত আঙুল আমার কবজি চেপে ধরেছে। মাই গড!’

‘ওটাকে কী করে বার করা যায়?’

‘জাল দিয়ে ঘিরে দিলে কেমন হয়?’

‘জাল দিয়ে ধরা যাবে না। ভীষণ ধূর্ত হাতটা। কী তাড়াতাড়ি মেঝের ওপর দিয়ে চলে গেল যদি দেখতে…!’

‘এক কাজ করা যাক, এই শেলফ থেকে কিছু বই নামিয়ে ফেলি। ফাঁকটা বড়ো হয়ে গেলেই ওটাকে বন্দি করতে অসুবিধে হবে না।’

কথামতো তারা কয়েকটি বই নামিয়ে ফেলল। হাতটা যেন পালাবার চেষ্টা করছে। ওর আঙুলগুলো ছটফট করছে দেখা গেল। দ্বৈপায়ন তার বলিষ্ঠ দুই হাত দিয়ে সেই অদ্ভুত জিনিসটাকে চেপে ধরে বলল, ‘আরে, এটার মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। জোর আছে তো! সত্যিই তো একটা হাত! আমিও তোমার মতো নেশা করে প্রহেলিকা দেখছি নাকি?’

অসমঞ্জ রাগত কণ্ঠে বলল, ‘বোকার মতো কথা বোলো না। ওটাকে বের করে নিয়ে এসো, আবার বাক্সর মধ্যে ঢুকিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে বন্দি করতে হবে।’

হাতটাকে বের করে আনা দ্বৈপায়নের পক্ষে খুব সহজ হল না। বাইরে আনামাত্র দু-জনে জোর করে ওটাকে বাক্সর মধ্যে ঢুকিয়ে কাঠের ঢাকনা আবার স্ক্রু দিয়ে আটকে দিল। কপালের ঘাম মুছে অসমঞ্জ তার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ডান দিকে চতুর্থ ড্রয়ারে বাক্সটাকে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিল। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্বৈপায়ন বলল, ‘বারোটা পঁয়ত্রিশ, চমৎকার কাটল সময়টা। এবার তোমার কাকার হাতের কথা কী বলছিলে খুলে বলো তো।’

দু-জনে সারারাত লাইব্রেরিতে বসেই কাটিয়ে দিল। অসমঞ্জ গোড়া থেকে সব কিছুই দ্বৈপায়নকে বলল। শুনতে শুনতে দ্বৈপায়নের দু-চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। অসমঞ্জর চোখ থেকে ঘুম উবে গিয়েছিল, দোতলার বারান্দা পেরিয়ে একা শোবার ঘরে যেতে হবে ভাবতেই তার গা ছম ছম করে উঠছিল।

সকাল বেলা চা-পর্ব সেরে দু-জনে আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে ঢুকল। দিনের আলোয় ঘরের গতরাত্রের বিভীষিকা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে। দ্বৈপায়নই বলল, ‘হাতটা আর একবার দেখা যাক, আমরা দু-জনেই কাল রাত্রে নেশা করেছিলাম কি না তা প্রমাণ হয়ে যাবে।’

‘ভালো কথা, এই নাও চাবি।’ অসমঞ্জ বলল।

দ্বৈপায়ন চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে লম্বা চৌকো কাঠের বাক্সটা টেবিলের ওপর রাখল। দু-জনেই বাক্সটার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

‘কী হল?’ অসমঞ্জই প্রশ্ন করে।

‘আমি ভাবছিলাম তুমিই বোধ হয় ঢাকনা খুলবে।’

‘কেন, ওটা দেখবার ইচ্ছে তো তোমারই হয়েছে।’

‘বেশ, তোমার যদি ভয় করে তবে আমিই খুলছি।’

দ্বৈপায়ন স্ক্রু খুলে ঢাকনা আলগা করল, তারপর সেটাকে টেবিলের ওপর রেখে বাক্স থেকে হাতটা বের করে আনল। দিনের বেলায় হাতটা দেখে কনুই থেকে বিচ্ছিন্ন একটা সাধারণ হাত ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। গতরাত্রে ওটা যে তাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে তা কে বলবে!

‘হাতটা কি মড়ার হাতের মতন ঠান্ডা?’ অসমঞ্জ একটু যেন ব্যগ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করে।

‘ঈষদুষ্ণ। তোমার আমার শরীরের উত্তাপের চাইতে কম বলেই মনে হচ্ছে। এখন তো হাতটাকে বেশ নরম লাগছে। জানি না, কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এটাকে এত টাটকা রাখা হয়েছে। তোমার কি মনে হয় এটা তোমার কাকার হাত?’

‘হ্যাঁ, সে-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। অনামিকায় ওই কাটা দাগটা ভুল হবার নয়। ওটাকে আবার বাক্সে ঢাকা দাও দ্বৈপায়ন, আমি সহ্য করতে পারছি না। ঢাকনায় স্ক্রু লাগাতে হবে না, আমি ড্রয়ারে চাবি লাগিয়ে দিচ্ছি, ওটা আর বেরুতে পারবে না।’

একটা বীভৎস পরিবেশে অসমঞ্জর স্নায়ু ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছিল। দ্বৈপায়নকে সঙ্গে নিয়ে সে তার মার্সিডিজে দিন কয়েকের জন্য দীঘার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। সেখানে সম্পূর্ণ বিশ্রাম আর মুক্ত পরিবেশে তার মন হালকা হয়ে গেল। একটা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে সে কলকাতায় ফিরল। বাক্সসুদ্ধ হাতটাকে সে গঙ্গায় বিসর্জন দেবে।

কলকাতায় ফেরামাত্র রামু একটা সমস্যা নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হল। রান্নার ঠাকুর জবাব দিয়েছে। সে নাকি বলছে, বাড়িতে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে। অসমঞ্জ একটু চমকাল, কিন্তু মুখে বলল, ‘ঠাকুর আজকাল গাঁজা খাচ্ছে নাকি?’

রামু বলে, ‘আমিও তাই বলেছিলাম।’

রামু হঠাৎ মাথা চুলকোতে থাকে।

অসমঞ্জ একটু বিস্মিত হয়েই বলে, ‘কী হল?’

রামু বলে, ‘আজ্ঞে বাবু, আমার একটা অন্যায় হয়ে গেছে। আপনার চিঠি পেয়ে লাইব্রেরি ঘর থেকে আমি টেবিলের ড্রয়ার খুলে কাঠের বাক্সটা বের করেছিলাম। একজন চাবিওলা ডেকে চাবি খুলতে হয়েছিল। বাক্সর মধ্যে যে ইঁদুরটা ছিল, সেটা ভীষণ লাফালাফি করছিল। না খেতে পেয়ে যে মরে যায়নি, তাই আশ্চর্যি। আমি বাক্সটাকে ড্রয়ার থেকে বের করে একটা খাঁচা এনে ঠিক করছি, এমন সময় ওটা কেমন করে না জানি বাক্স থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেল।’

অসমঞ্জ এতক্ষণ হাঁ হয়ে রামুর কথা শুনছিল। তার বক্তব্য শেষ হতেই সে বলল, ‘কী বলছিস তুই? আমি তো কোনো চিঠি লিখিনি।’

‘কিন্তু চিঠিটা যে আমি লাইব্রেরি ঘরে টেবিলের কাছে মেঝের ওপর কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আপনারা যেদিন চলে গেলেন সেদিন বিকেল বেলা ঘর ঝাড়-পোঁছ করবার সময় ওটা আমার চোখে পড়ে। এই তো আমার পকেটেই রয়েছে।’

জামার পকেট থেকে সে ছোট্ট একটা চিরকুট বের করে অসমঞ্জর হাতে দিল। অসমঞ্জ সবিস্ময় দেখল, লেখাটা ঠিক তারই হাতের লেখার মতো। চিরকুটটা সে পড়তে লাগল—

‘রামু, লাইব্রেরিতে আমার বড়ো টেবিলের ডান দিকের ড্রয়ারগুলো চাবি দেওয়া আছে। চাবিটা যেমন করে হোক খুলে ফেল। চতুর্থ ড্রয়ারে যে কাঠের বাক্সটা আছে সেটা বাইরে রেখে দে। আর কিছু তোকে করতে হবে না। অবশ্যই কাজটা করিস।’ —অসমঞ্জ সান্যাল।

অসমঞ্জ স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার পাশেই দ্বৈপায়ন বসে ছিল, সে হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নিল। অসমঞ্জই রামুকে আবার প্রশ্ন করল, ‘তুই খাঁচা আনার পর ওটা পালিয়ে গেল?’

‘আমি খাঁচাটা ঠিক করছি, এমন সময় ইঁদুরটা বাক্স থেকে লাফ মেরে বেরিয়ে পালিয়ে গেল।’

‘ইঁদুর! তুই নিজের চোখে দেখেছিলি?’

‘আজ্ঞে,’ রামু মাথা চুলকিয়ে বলে, ‘ঠিক দেখিনি, বাক্সটার দিকে পেছন ফিরে খাঁচা ঠিক করছিলাম, শব্দ শুনে পেছন ফিরেছি, ততক্ষণে ওটা একটা আলমারির কাছে চলে গিয়েছিল। বেলাও পড়ে এসেছিল, অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছিল না।’

‘রংটা কেমন?’

‘অনেকটা তামাটে বলে মনে হয়েছিল। ওটা কেমন অদ্ভুতভাবে হেঁটে যাচ্ছিল, আর ল্যাজ ছিল না।’

‘তুই ওটাকে ধরার চেষ্টা করিসনি?’

‘করেছিলাম, কিন্তু চোখের পলকে ওটা লুকিয়ে পড়ল। আমি ইঁদুর ধরার জাঁতিকলটা পেতে লাইব্রেরির দরজা বন্ধ করে রেখেছিলাম। মানদা (ঠিকে ঝি) পরদিন সকালে ঘর মোছবার জন্য ঘরে ঢুকে দরজা আর বন্ধ করেনি, ওই ফাঁকে নিশ্চয় ওটা পালিয়েছে।’

‘তোর কি মনে হয় ঠাকুর ওটা দেখেই ভূতের ভয় পেয়েছে?’

‘আজ্ঞে, ঠিক তা নয়। ঠাকুর বলছে, সে একটা হাতকে রান্নাঘর থেকে মাছ নিয়ে যেতে দেখেছে। মানদাও নাকি একদিন অন্ধকার সিঁড়ির মুখে কী-একটা নরম জিনিস মাড়িয়ে দিয়েছিল। পা সরিয়ে নেবার সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে হয়েছিল যে কয়েকটা আঙুল যেন তার পায়ের গোড়ালি চেপে ধরেছে। চিৎকার করে উঠতেই ওটা ওকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। মানদার মেয়ে কমলিও মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে কাজে জোগান দিতে আসে। সেদিন বাসন মাজার পর ও কলে হাত ধুয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছছিল। তখন সন্ধে। কমলি গান করছিল আর অন্যদিকে তাকিয়ে হাত মুছছিল, হঠাৎ ওর খেয়াল হল যে ও অন্য কারো হাত মুছছে, বেশ ঠান্ডা হাতটা।’

‘যত সব গাঁজাখুরি গল্প!’ দ্বৈপায়ন এবার বলে উঠল।

‘তুই নিশ্চয় এসব বিশ্বাস করিস না?’ অসমঞ্জ আচমকা রামুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

‘আমি? আজ্ঞে না, আমি হাত-টাত কিছু দেখিনি।’

‘কিছু শুনিসওনি নিশ্চয়?’

‘আজ্ঞে, মাঝে মাঝে বাইরের কলিং বেলটা বেজে ওঠে। দরজা খুলে আমি কাউকে দেখতে পাই না। রাত্রে আপনার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি আগেই যেন কে বন্ধ করে রেখেছে। আপনার খাঁচায় কতরকম জীবজন্তু আছে। কোনো বাঁদর হয়তো খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসব বাঁদরামি করছে।’

রামু তার কাজে চলে গেলে দ্বৈপায়ন বলে, ‘চিঠিটা সম্বন্ধে তোমার কী মনে হয়?’

‘বুঝতে পারছ না? তোমার মনে আছে বাক্সর ঢাকনায় স্ক্রু না লাগিয়েই আমরা ওটা ড্রয়ারে চাবি বন্ধ করে রেখেছিলাম। ওই ড্রয়ারে পুরোনো কিছু কাগজ আর নিশ্চয় একটা পেনসিল ছিল। হাতটা আলগা ঢাকনা সরিয়ে বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে, তারপর এক টুকরো কাগজে আমার হাতের লেখা নকল করে চিঠিটা লিখে দেরাজের চুলচেরা ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। রামু ঘর পরিষ্কার করতে এসে মেঝের ওপর কাগজটা কুড়িয়ে পায়।’

‘কিন্তু হাতটা নিশ্চয় লিখতে পারে না!’

‘পারে না! তুমি দেখনি, আমি ওটাকে লিখতে দেখেছি।’

শশিশেখরের অজ্ঞাতে তাঁর ডান হাতের যন্ত্রের মতো লিখে যাওয়ার ব্যাপারটা সে বিশদভাবে বর্ণনা করে।

‘একটা ব্যাপার তাহলে পরিষ্কার হল। অ্যাটর্নি মি চৌধুরীকে লেখা সেই চিঠিটা, যেটায় তোমার কাকা তাঁর ডান হাতটা তোমাকে দানপত্র করে গিয়েছিলেন, আসলে এই শয়তান হাতটারই লেখা, তোমার কাকা কিছুই জানতেন না।’

‘আমার কাকার হাত যদি না হয়, তবে কার হাত?’

‘এখন মনে হচ্ছে, কোনো বিদেহী আত্মা তোমার কাকার জীবিতকালে তাঁর ওপর ভর করেছিল। তাঁর ডান হাতকে মৃত্যুর পর ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করাই ছিল ওটার উদ্দেশ্য। সেই আত্মা ওই হাতের ওপর ভর করে আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে।’

‘এখন আমাদের কী কর্তব্য?’

‘আমাদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে, যাতে সুযোগ পেলেই ওটাকে আবার বন্দি করা যায়। যদি বন্দি নাও করতে পারি, তাতে ক্ষতি নেই, ওটা রক্তমাংসের হাত, চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না।’

অসমঞ্জর মুখ দেখে সে খুব একটা আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হল না। দিন দুই নিরুপদ্রবে কেটে গেল। তৃতীয় দিন সকালে দ্বৈপায়ন ওটাকে আবার দেখতে পেল। ওপরে ওঠবার সিঁড়ি যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেই একতলা ও দোতলার মাঝামাঝি রেলিং-এর পোস্টের ওপর ওটা যেন বিশ্রাম করছে। আচমকা ওখানে ওটাকে দেখে দ্বৈপায়ন প্রথমে হকচকিয়ে গেল। দ্বিধা কাটিয়ে সে এক লাফ মেরে এগুতেই হাতটা ঢালু রেলিংয়ের ওপর দিয়ে বিছের মতো অথচ দ্রুতগতিতে, ওপর দিকে উঠতে লাগল, তারপর একসময় দ্বৈপায়নের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।

দিন তিনেক পর অসমঞ্জ লাইব্রেরিতে বসে গবেষণার কিছু একটা লিখছিল। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। হঠাৎ তার নজরে পড়ল ঘরের অপর প্রান্তে মেঝের ওপর একটা বই খোলা আর হাতটাও সেখানে। অসমঞ্জ অবাক হয়ে দেখল, কোন বই গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি লাইন পড়তে গেলে মানুষ যেমন একটা আঙুল পাতার ওপর রেখে পড়ে, হাতের তর্জনীটাও তেমনভাবে নড়ছে।

অসমঞ্জ চেয়ার ঠেলে উঠতেই হাতটা সচকিতভাবে বইটা ছেড়ে তরতর করে একটা আলমারি বেয়ে ওপরে উঠে গেল; তারপর অসমঞ্জর নাগালের বাইরে গিয়ে আঙুলগুলো মুঠো করে শুধু বুড়ো আঙুলটা নাচাতে লাগল, যেন তাকে কলা দেখাচ্ছে। অসমঞ্জ মই বেয়ে ওপরে উঠবে কি না ভাবছে, হাতটা বোধ হয় তার মনের ভাব অনুমান করেই বইয়ের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দিন কয়েক কেটে গেছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটেনি। পঞ্চমী নামে অসমঞ্জর একটা পোষা কাকাতুয়া ছিল। মাঝে মাঝে খাঁচার ভেতর দিয়ে পা বের করে পাখিটা অদ্ভুত কৌশলে খাঁচার দরজা খুলে বেরিয়ে আসত। দু-চার দিন এঘর ওঘর করার পর ধরা দিত, কিন্তু পালিয়ে যাবার চেষ্টা করত না। অসমঞ্জ একদিন সন্ধেবেলা লাইব্রেরিতে কাজ করছে, এমন সময় পাখিটা ঘরে ঢুকে কয়েকবার চক্কর দিল, তারপর একটা কড়িকাঠে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে অসমঞ্জকে দেখতে লাগল। অসমঞ্জ তার স্বভাব জানে। তাই সে নিজের কাজ করে চলল, হঠাৎ কাকাতুয়াটি বলে উঠল—

‘অসমঞ্জ, এই অসমঞ্জ!’

অসমঞ্জ একটু মুচকি হাসল।

‘বদমাশ, তোকে খুন করব,’ পাখিটা বলে উঠল।

অসমঞ্জ একটু বিরক্তভাবে ওপরদিকে তাকাল আর সঙ্গেসঙ্গে সে চমকে উঠল। হাতটা কড়িকাঠ বেয়ে কাকাতুয়ার দিকে এগুচ্ছে। একটা অজানা আশঙ্কায় সে শিউরে উঠল। হাতটার চলার ভঙ্গি কী বিচ্ছিরি আর কী দ্রুতগতি! অসমঞ্জ কিছু করার আগে ওটা কাকাতুয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচ আঙুল দিয়ে পাখিটার গলা টিপে ধরল। সে এক বীভৎস দৃশ্য! পাখিটাও অতর্কিতে এমনভাবে আক্রান্ত হয়ে ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডেকে উঠল, তারপর নিজেকে মুক্ত করার জন্য ধারালো নখ দিয়ে ওটাকে আঁচড়াতে লাগল। ওই অবস্থায় ঝটপট করতে করতে কাকাতুয়াটা ঘরের চারিদিকে কয়েকবার চক্কর দিল। কিন্তু কণ্ঠলগ্ন হাতের ভার সইতে না পেরে এক সময় ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল। মাটিতে পড়েও দু-জনের মধ্যে যেন ধস্তাধস্তি হুটোহুটি চলতে লাগল। তারপর একসময় পাখির চোখের মণি দুটো কয়েকবার ঘুরে সাদা অংশ বেরিয়ে এল, গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়েই থেমে গেল। পাখিটা ঢলে পড়ল। হাতের আঙুলগুলো পাখির গলা ছেড়ে দেবার আগেই অসমঞ্জ একটা ক্রুদ্ধ আবেগে লাফিয়ে পড়ে হাতটাকে প্রাণপণ শক্তিতে চেপে ধরল। তারপর চেঁচিয়ে দ্বৈপায়নের নাম ধরে ডাকতে লাগল।

দ্বৈপায়ন ছুটে আসতেই অসমঞ্জ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘শয়তানটাকে পাকড়াও করেছি। দেখ, আমার পঞ্চমীকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে।’

দ্বৈপায়ন এক নজরে সমস্ত ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করে নিল, তারপর বলল, ‘আমি কাঠের বাক্সটা নিয়ে আসছি, তুমি ওটাকে ধরে রাখতে পারবে তো?’

‘পারব। হাতটা বোধ হয় এতক্ষণ পঞ্চমীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে কিছুটা কাবু হয়ে পড়েছে।’

দ্বৈপায়ন বাক্স নিয়ে ফিরে আসতেই অসমঞ্জ হাতটাকে তাড়াতাড়ি বাক্সের মধ্যে পুরে ফেলল, তারপর উন্মত্তের মতো একটা বড়ো পেরেকের ছুঁচোলো প্রান্ত নির্জীব হাতের ওপর রেখে একটা হাতুড়ি দিয়ে পেরেকের মাথায় দমাদম হাতুড়ি চালাতে লাগল। সঙ্গেসঙ্গে যেখানে পেরেকটা বিঁধেছিল, সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। হাতটা যেন যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল। একটা বড়ো বিছেকে লোহার শলাকা দিয়ে বিঁধলে সে যেমন কুঁকড়ে উঠে, শলাকাটাকে দংশন করবার চেষ্টা করে, হাতের আঙুলগুলোও তেমনি বেঁকে রুদ্ধ আক্রোশে যেন পেরেকটাকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করছে।

‘শিগগির ঢাকনাটা নিয়ে এসো,’ অসমঞ্জ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে একটা চেয়ারের ‘কুশন’ দিয়ে বাক্সের ওপরটা চেপে ধরল। দ্বৈপায়ন এক ছুটে একটা ঢাকনা নিয়ে এল। স্ক্রু দিয়ে বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে অসমঞ্জ সেটাকে আবার দেরাজে পুরে চাবি বন্ধ করে দিল। তারপর একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে সে হাঁপাতে লাগল। দারুণ উত্তেজনায় তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছে তখনও, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। একটু আত্মস্থ হবার পর অসমঞ্জ বলল, ‘ড্রয়ারটা আর খুলছি না, হাতটা ওখানেই দম বন্ধ হয়ে মরুক।’

কিছুদিন বেশ নিরুপদ্রবেই কেটে গেল। অসমঞ্জ আবার তার গবেষণায় আত্মনিয়োগ করল। তারপর হঠাৎ একদিন রাত্রে তার বাড়িতে ছোটোখাটো একটা চুরি হয়ে গেল। চোর বিশেষ কিছুই নিতে পারেনি। পুলিশ ইনস্পেকটর যিনি তদন্তে এসেছিলেন, বললেন, ‘আপনার ভাগ্য ভালো, মশাই, যেভাবে চোর ঘরগুলোতে হানা দিয়েছিল, তা থেকে মনে হয় লোকটা ঘুঘু। নিশ্চয় কিছু একটা বিপদের সংকেত পেয়ে কাজ হাসিল করার আগে সরে পড়েছে।’

অসমঞ্জও তাঁর সঙ্গে একমত হল। ইনস্পেকটর একটু দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘একটা ব্যাপার আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না। চোর যেভাবে আপনার আলমারি খুলেছিল, তা থেকে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, সে একজন দাগি আসামি। কিন্তু এমন পাকা লোক এতটা কাঁচা কাজ করল!’

অসমঞ্জ একটু বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘কাঁচা কাজ?’

‘হ্যাঁ, মানে এ ধরনের ঘুঘু চোরেরা কোনো চিহ্ন সাধারণত রেখে যায় না। কিন্তু যে লোকটা এসেছিল সে চারিদিকে তার আঙুলের ছাপ রেখে গেছে, যেন খুশিমতো ছড়িয়ে গেছে। আপনার লাইব্রেরি ঘরের দরজা জানলায় নতুন রং করিয়েছেন, সেই কাঁচা রঙের ওপর আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। তা ছাড়া একতলার প্রায় সব ঘরে একই হাতের আঙুলের ছাপ পেয়েছি। ব্যাপারটা আমার কাছে একটু আশ্চর্য ঠেকছে।’

অসমঞ্জ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘বাঁ-হাত না ডান হাত?’

‘ডান হাত সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমার মনে হয় লোকটার বোধ হয় একটু মাথা খারাপ আছে। তা না হলে এই চিরকুটটা লিখবে কেন?’ পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো বের করতে করতে তিনি বললেন, ‘এটা সিঁড়ির মুখে কুড়িয়ে পেয়েছি। লেখা আছে, ”আমি চললাম, অসমঞ্জ! তবে শিগগিরই ফিরে আসব।’ আপনি কি হাতের লেখাটা চেনেন?”

অসমঞ্জ বিমূঢ়ের মতো মাথা নাড়ল! কিন্তু একটা সন্দেহ তার মনে দোলা দিতে লাগল। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে তার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ডান দিকের দেরাজগুলো খুলে ফেলল। যে আশঙ্কা সে করেছিল তা-ই সত্যি। কাঠের বাক্সর ঢাকনাটা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে, আর বাক্সের ভেতরটা শূন্য। কিন্তু হাতটা বেরুল কীভাবে! চোর কি তবে দেরাজ খুলে কাঠের বাক্সে কী আছে দেখবার জন্য স্ক্রু আলগা করে ঢাকনা খুলেছিল আর সেই ফাঁকে হাতটা বেরিয়ে গেছে। এই ভৌতিক কাণ্ড দেখেই হয়তো চোরটা চুরি মাথায় রেখে চম্পট দিয়েছে। চারদিকে যে আঙুলের ছাপের কথা ইনস্পেকটর বলল তা নিশ্চয় চোরের নয়, ছাপগুলো ওই হাতটার। কী সাংঘাতিক!

সেদিনই সে মনস্থির করে ফেলল, এ বাড়ি ছেড়ে বেশ কয়েক মাস সে বাইরে থাকবে। এখানে তার কাজ একটুও এগুচ্ছে না। বলতে গেলে কাকার মৃত্যুর পর থেকে সে কিছুই করেনি। দ্বৈপায়নকে সে তার সিদ্ধান্তর কথা জানাল। সেও তাতে উৎসাহ দিল। কারণ এই হাতের ব্যাপারে তার মতো সাহসী লোকও বেশ ঘাবড়ে গেছে। তা ছাড়া অসমঞ্জর ওপর তার অগাধ বিশ্বাস, তার গবেষণার ওপর তার গভীর আগ্রহ, সুতরাং বাইরে গিয়ে যদি অসমঞ্জ আবার পুরোদমে গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে, তবে সেও খুশি হবে।

মধুপুরে অসমঞ্জর বাবা শখ করে একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ছুটিছাটায় বেড়াতে যাবেন এই ছিল তাঁর বাসনা। বাড়িটা বাংলো ধরনের, একতলা। বাড়িটা আগে এক সাহেবের ছিল। একটা বসবার ঘর, দুটো শোবার ঘর, খাবার ঘর আর বাথরুম, এই নিয়ে বাংলোটা বেশ অনেকটা জায়গার ওপর। সাহেব তাঁর নিজের দেশের মতো বাংলোটাকে বানিয়েছিলেন। শোবার ঘরের সংলগ্ন স্নানের ঘর। প্রত্যেক ঘরে শীতে আগুন পোহাবার জন্য ফায়ার প্লেস বা তাপ চুল্লিরও ব্যবস্থা ছিল। তবে বিজলি বাতি নেই, হ্যাজাক আর হ্যারিকেন লন্ঠন জ্বালিয়েই কাজ চালাতে হয়।

অসমঞ্জর গাড়িতেই ওরা মধুপুর গেল। ওরা যখন পৌঁছোল তখন রাত হয়ে গেছে। রামু বড়ো টিফিন ক্যারিয়ার ভরে খাবার দিয়ে দিয়েছিল। মালি তাড়াতাড়ি সেগুলো গরম করে দিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা শোবার ঘরে গেল। দুটো শোবার ঘর পাশাপাশি, মাঝখানে একটা দরজা দিয়ে দু-ঘরের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। মালি এসে বিছানা ঝেড়ে-ঝুড়ে পেতে দিল। দু-জনে দু-ঘরে শোবে। অসমঞ্জ তার নির্দিষ্ট শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে পাশের ঘরে দ্বৈপায়নকে উদ্দেশ করে বলল, ‘রামুর কাণ্ডটা দেখেছ? এখানে খুব শীতে আমার গাড়ি চালাতে কষ্ট হবে ভেবে চামড়ার কনুই পর্যন্ত বড়ো দস্তানাটা দিয়ে দিয়েছে, তাও আবার দিয়েছে একটা।’

তারপরই দ্বৈপায়ন অসমঞ্জর ভয়ার্ত চিৎকারে চমকে উঠল।

‘দ্বৈপায়ন, শিগগির, হাতটা এই দস্তানার মধ্যে লুকিয়ে আছে!’

তারপরই একটা কিছু সজোরে ছুড়ে ফেলার শব্দ। দ্বৈপায়ন পড়ি-মরি করে ছুটে এসে দেখল, অসমঞ্জ বেতস পাতার মতো কাঁপছে। দ্বৈপায়নকে দেখে সে বলে উঠল, ‘আমি ওটাকে স্নানের ঘরে ছুড়ে দিয়েছি। দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে চৌবাচ্চায় জলের মধ্যে পড়েছে।’

দ্বৈপায়ন লন্ঠন হাতে নিয়ে স্নানের ঘরে উঁকি দিল। হ্যাঁ, হাতটা চৌবাচ্চার মধ্যেই পড়েছে। অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে চৌবাচ্চাটার চারপাশে শ্যাওলা পড়ে গেছে। হাতটা চৌবাচ্চার গা বেয়ে উঠতে চেষ্টা করছে আর পিছলে পড়ছে। হাতের তালুর উলটোদিকে একটা গর্ত দ্বৈপায়নের নজরে পড়ল। অসমঞ্জ যে পেরেক ফুটিয়েছিল তারই গর্ত। হাতটা যেন হামা দিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে, কিন্তু কিছুটা উঠেই অসহায়ের মতো পিছলে পড়ে যাচ্ছে।

‘তুমি ওটার ওপর নজর রাখো, আমি একটা বাক্স-টাক্স কিছু নিয়ে আসছি।’ দ্বৈপায়ন প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে সে অসমঞ্জর চিৎকার শুনতে পেল, ‘দ্বৈপায়ন, জলদি! শয়তানটা উঠে পড়েছে! না, শয়তান, তোকে পালাতে দেব না। দ্বৈপায়ন কোথায় গেলে, আমি ধরে রাখতে পারছি না, পিছলে যাচ্ছে। আমাকে নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। জানলাটা খোলা আছে, শিগগির বন্ধ করো। আঃ, বেরিয়ে গেল।’

দ্বৈপায়ন ছুটে এল আর তৎক্ষণাৎ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে জমির ওপর ধপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হল। লন্ঠন নিয়ে ওরা বাইরে অনেক খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু হাতটাকে আর দেখা গেল না।

এরপরই অসমঞ্জ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে বললেন যে মানসিক আঘাত থেকেই অসুখটা হয়েছে। এ কেস অফ নার্ভাস ব্রেকডাউন ডিউ টু সাম গ্রেট ইমোশনাল শক। তিনি রোগীর পরিচর্যার জন্য একজন অভিজ্ঞ নার্সের কথা বললেন। একটা সতর্কবাণীও তিনি করলেন, রোগীর ঘরে সারারাত যেন আলো জ্বলে, অন্ধকারে একা তাকে কোনোমতেই যেন রাখা না হয়।’

অসমঞ্জ কিন্তু নার্স রাখার প্রস্তাবে সম্মত হল না, বলল, দ্বৈপায়নকেই সবসময় তার কাছে থাকতে হবে। বাইরের লোক রাখলেই হাতটা তাকে কায়দা করে আবার ঘরে ঢুকে পড়বে। দ্বৈপায়ন তাকে অভয় দিয়ে বলল, ‘ওসব কথা তুমি আর চিন্তা কোরো না। হাতটা এবার দেখে মনে হল যেন অনেক নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তুমি ওটাকে দেওয়ালে ছুড়ে মারাতে ওটা আরও ঘায়েল হয়েছে। এভাবে বেশিদিন আর ওটা টিঁকে থাকতে পারবে না, ওর আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। তুমি একটু ভালো হলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। বাক্স-বিছানা কিছুই সঙ্গে নেব না, এক জামাকাপড়ে বেরিয়ে পড়ব। হাতটা কোনো কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আর আমাদের সঙ্গ নিতে পারবে না। আমরা কাউকে আমাদের ঠিকানা জানাব না, কোনো পার্সেল এলে ফেরত দিয়ে দেব। বেটার চোখে আমরা এবার এমন ধুলো দেব…!’

দ্বৈপায়নের প্রস্তাব অসমঞ্জর খুব মনে ধরল। কয়েকদিনের মধ্যেই সে হেঁটে চলে বেড়াতে পারবে। কিন্তু কেন তাকে এভাবে পালিয়ে বেড়াতে হবে? দ্বৈপায়নকে অনেকটা অনুযোগের কণ্ঠে সে বলল, ‘আমি কী করেছি বলতে পারো? কী আমার অপরাধ? কেন এই হাত-পিশাচটা রাক্ষুসে আঙুল নিয়ে আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে?’

দ্বৈপায়ন তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘ঠিক তা নয়। প্রথম যখন হাতটাকে আমরা ধরেছিলাম, তখন ওটার ঘৃণাই বল কি বিরাগই বল, সকলের বিরুদ্ধে যেন মুখিয়ে ছিল। কাকাতুয়াটাকে অকারণে কেমন নৃশংসভাবে গলা টিপে মারল, মনে নেই? তুমি পেরেক দিয়ে ওর গায়ে ফুটো করার পর থেকে ওটা তোমার ওপর খেপেছে মনে হয়। দেরাজে বেশ কিছুদিন বন্দি থাকার সময় প্রতিহিংসার চিন্তাটা বোধ হয় ওর মনে আসে।’

অসমঞ্জ দ্রুত আরোগ্যলাভ করতে লাগল। দ্বৈপায়ন সবসময় তার ঘরে পাহারা থাকে, চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিও সে রেখেছিল। পয়লা জানুয়ারি তারা মধুপুর ছাড়বে, কোথায় যাবে তা গাড়িতেই ঠিক করা হবে।

একত্রিশে ডিসেম্বর এল। প্রচণ্ড ঠান্ডা। অসমঞ্জর ঘরের দরজা-জানলা সবসময় বন্ধ থাকে। একদিন মালি ঘরে আলো বাতাস ঢুকবে বলে একটা জানলা খুলতেই প্রচণ্ড ধমক খেয়েছিল।

সন্ধেবেলা অসমঞ্জ আর দ্বৈপায়ন দাবা নিয়ে বসল। খেলায় তারা তন্ময় হয়ে গেছে, এমন সময় মালি একটা চিঠি নিয়ে এল। বিকেলের ডাকে এসেছে। দ্বৈপায়নই সাধারণত অসমঞ্জর চিঠিপত্রের জবাব দেয়, একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি ছাড়া।

চিঠিটা সে মালির হাত থেকে নিয়ে খুলল। খুবই সংক্ষিপ্ত চিঠি, কোনো ঠিকানা বা স্বাক্ষর নেই।

‘আজ রাত দশটায় আমাদের শেষ সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুত থেকো।’

‘কার চিঠি?’ অসমঞ্জ প্রশ্ন করে।

‘আমার চিঠি,’ বুকপকেটে চিঠিটা রাখতে রাখতে দ্বৈপায়ন উত্তর দেয়। ইচ্ছে করেই সে মিথ্যে কথা বলল। অসমঞ্জর বর্তমান শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পক্ষে চিঠির বক্তব্য মোটেই সুখকর হবে না। সে ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, না সব বন্ধ আছে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে দু-জনে আবার দাবায় বসল। অসমঞ্জর অসুখ হবার পর থেকে মালি এই শোবার ঘরেই দু-জনের খাবার দিচ্ছিল। ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। ঘরটা বেশ গরম হয়ে উঠেছে। কনকনে শীতের পক্ষে আরামদায়ক। রাত দশটা বাজল, সঙ্গেসঙ্গে বন্ধ দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল।

‘কে?’ অসমঞ্জ একটু চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করে।

কোনো উত্তর নেই।

‘মালি!’ অসমঞ্জ আবার গলা হাঁকে।

এবারও কোনো সাড়া নেই।

‘নিশ্চয়ই সেই হাতটা,’ অসমঞ্জ দরজায় লাগানো ছিটকিনির দিকে তাকিয়ে বলে।

দ্বৈপায়ন এবার উঠে দুটো ঘরেরই দরজা জানালা সব দেখে আসে।

‘না, সব ছিটকিনি দেওয়া আছে।’ সে আবার দাবায় বসে। জানালার কাচের শার্সির ওপর কী-একটা শব্দ হল।

‘কীসের শব্দ?’ অসমঞ্জ বলে ওঠে।

‘ও কিছু না, বাতাসে জুঁই গাছের ঝাড়টা বোধ হয় জানালায় ধাক্কা মারছে।’

‘না, না, কেউ যেন ঠক ঠক করছে।’ অসমঞ্জ উঠে যে জানালা থেকে শব্দ আসছিল তার পর্দাটা সরিয়ে ফেলল। তারপরই সে দু-পা পিছিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘দেখো, দেখো, হাতটা কেমন করে ঝুলছে! ওটার হাতে ওটা কী?’

দ্বৈপায়ন ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল, ‘একটা ছুরি। দেখো, কেমন করে ছুরির ফলাটা জানালার দুই কপাট যেখানে মিশেছে তার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে ছিটকিনি খুলবার চেষ্টা করছে।’

হঠাৎই অসমঞ্জ বলল, ‘এবার তোমার চাল দ্বৈপায়ন, ঘোড়া সামলাও।’

দ্বৈপায়নকে কিন্তু তার ঘোড়া নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হল না। সে ভাবছে অসমঞ্জ হঠাৎ এত সাহস পেল কোথা থেকে! অসমঞ্জই আবার কথা বলল, ‘কী হল, একটা চাল দিতে তুমি রাত কাবার করে দেবে নাকি?’

‘তুমি দেখছি সমস্ত ব্যাপারটা বেশ ঠান্ডা মাথায় নিয়েছ, স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ভয়ে আমার হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে।’

‘ভয় করবার কিছু নেই, দ্বৈপায়ন। ভালো করে চিন্তা করে দেখো, হাতটা অশরীরী কিছু নয়। জীবন্ত প্রাণীর মতোই ওটাকে পৃথিবীর টাইম আর স্পেসের নিয়মগুলো মেনে চলতে হচ্ছে। এমন নয় যে ওটা শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে কিংবা বন্ধ দরজার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। সুতরাং এই ঘরে ঢোকবার কোনো ছিদ্রপথ না পেয়ে ওটাকে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে। আমি ভয়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে ভয়কে জয় করতে শিখেছি। আজ রাতটা কোনোমতে কাটিয়ে কাল সকালে ওটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব।’

হঠাৎ দ্বৈপায়ন বলে উঠল, ‘সর্বনাশ! আমার বাথরুমের জানলাটা বোধ হয় খোলা আছে।’

‘শিগগির,’ অসমঞ্জ দ্বৈপায়নকে এক ঠেলা মেরে বলল, ‘ছুটে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে এসো।’

দ্বৈপায়ন ছুটে গেল। তার ঘরে লন্ঠন ছিল না, ঘরটা অন্ধকার। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দরজার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল। মনে মনে একটা গালাগালি দিয়ে সে অসমঞ্জর ঘরে ফিরে এসে লন্ঠনটা নিয়ে আবার ছুটল।

বাথরুমের ছোটো জানলাটা সত্যিই খোলা, ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। জানালা বন্ধ করে সে আবার অসমঞ্জর ঘরের দিকে এগুলো। নিজের ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল দ্বৈপায়ন।

ফায়ার প্লেসে ধিক ধিক জ্বলা আগুনে ঘরটা আবছা আলো আবছা অন্ধকার। সেই স্তিমিত আলোয় দ্বৈপায়ন স্তম্ভিত হয়ে দেখল, হাতটা মাটির ওপর বুকে হেঁটে অসমঞ্জর দিকে এগুচ্ছে, আঙুলের মধ্যে শক্ত করে ছুরিটা ধরা, শুধু বুড়ো আঙুল খোলা। বুড়ো আঙুলে ভর দিয়েই হাতটা এগুচ্ছে মনে হয়, তাই আস্তে আস্তে বেশ কষ্ট করে ওটাকে নড়াচড়া করতে হচ্ছে। দ্বৈপায়ন আতঙ্কে ওটার দিকে তাকিয়ে আছে, তার সমস্ত বিচার বুদ্ধি সে যেন হারিয়ে ফেলেছে। দ্বৈপায়নের চোখের সামনে যেন একটা ছবি ভেসে উঠল। হাতটা অসমঞ্জর কাছে গিয়ে তার পা ও কোমর বেয়ে ওপরে উঠছে, তারপর বুকের কাছে গিয়ে;;;।

মাথাটা ঘুরে উঠতেই দ্বৈপায়নের যেন চমক ভাঙল, আর কিছু চিন্তা না করেই সে হাতের লন্ঠনটা সজোরে সেই শয়তানটাকে লক্ষ করে ছুড়ে মারল। ঝন ঝন করে লন্ঠনের কাচ ভেঙে গেল। লন্ঠনটা সোজা গিয়ে হাতে লেগেছে। হাতটা তখন মেঝেয় বিছানো একটা মাঝারি আকারের কার্পেটের ওপর দিয়ে এগুচ্ছিল। লন্ঠনের কাচ ভেঙে যেতেই কার্পেটে আগুন ধরে গেল। দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল কার্পেটে। দ্বৈপায়ন এক ছুটে অসমঞ্জকে টান মেরে আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে এল। হাতটা সেই আগুনের মধ্যে পড়ে ছটফট করছে। আগুনের গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসার কী নিষ্ফল চেষ্টা! চারদিকের আগুন ওটাকে যেন ঘিরে ধরেছে। ওদের চোখের সামনে হাতটা পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে, কয়লার মতো কালো— কুঁকড়ে যাচ্ছে হাতটা— সে এক বীভৎস দৃশ্য!

অসমঞ্জও বিস্ফারিত চোখে দৃশ্যটা দেখছিল, হঠাৎ সে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল। দ্বৈপায়ন তাকে টেনে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে মালিকে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। মালি যখন ছুটে এল, তখন ঘরে রীতিমতো বহ্ন্যুৎসব শুরু হয়ে গেছে। ধোঁয়ায় চারদিকে অন্ধকার।

আগুন যখন নেভানো হল ততক্ষণে কার্পেট পুড়ে ছাই, বিছানাও আধপোড়া। সেই অভিশপ্ত হাতের কোনো চিহ্ন কিন্তু আর কোথাও পাওয়া গেল না। ওটা যে পুড়ে খাক হয়ে গেছে সে-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ দু-জনের কারো মনে ছিল না।

জীবন্ত পাঁচ আঙুলের পিশাচ হাতটাকে আর কখনো দেখা যায়নি।

(বিদেশি ছায়ায়)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *