নতুন বউ

নতুন বউ

বিয়ে মানেই কি যৌনতা?

অস্মিতার আকস্মিক প্রশ্নে প্র‌ায় ছিটকে গেল রাজকুমার। একটা হাউই ছুটে যাচ্ছিল সাত রঙের ফুল ফোটাতে ফোটাতে, হঠাৎ মাঝপথে দম হারিয়ে হুশ করে নেমে গেলে যেমনটা হয় তেমনই রাজকুমারের জোশ। ফুলশয্যার রাতে নতুন বউয়ের মুখে এরকম একটা ধাক্কার মুখোমুখি হবে তা ধারণার বাইরে ছিল তার।

অস্মিতা ঠিক নতুন বউ তা নয়, তাদের বিয়েটা দু’দিন আগে হলেও তার আগে অন্তত বছর দুয়ের নিবিড় প্রে‌মপর্ব। এই দুবছরে তাদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে কোনও বাক্যালাপ হয়নি। বলতে কি অস্মিতা খুবই ইন্ট্রোভার্ট ধরনের। কোনও দিন চুমু খাওয়ার কথা বললেও মৃদু ধমক দিয়ে বলেছে, তোমাদের ছেলেদের কি মেয়েদের শরীর ছাড়া আর কোনও ভাবনা নেই?

রাজকুমার অতএব চুমু খাওয়ার মতো অশ্লীল ভাবনায় ইতি টেনে প্রে‌ম করে গেছে দু বছর ধরে, লক্ষ করেছে বিয়ের জন্য কখনও তাড়া দেয়নি অস্মিতা। তার একমাত্র প্যাশন ছবি-আঁকা। ক্যানভাসের সামনে বসে প্যালেটে তুলি ডুবিয়ে পরম মগ্নতায় কাটিয়ে দিতে পারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অস্মিতার তুমুল ঔদাসীন্য দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে নিজেই একটু চাপ সৃষ্টি করেছিল অস্মিতার উপর। অস্মিতা বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, তার বাবা-মায়েরও কোনও উদ্যোগ দেখেনি মেয়ের বিয়ে দিতে। রাজকুমার বুঝেছে মেয়ের বিয়ে হলে তার বাবা-মায়ের ঘর শূন্য হয়ে যাবে এ যেন তাঁদের ভাবনার বাইরে। মেয়ে আইবুড়ো থাকলেই তাঁদের সুবিধে।

বেশ জোর খাটিয়েই বিয়েটা করতে হল রাজকুমারকে। পাত্র হিসেবে সে নেহাৎ মন্দ নয়। ব্যাঙ্কের অফিসার, দেশের বাড়িতে কিছু জমিজমাও আছে। অস্মিতার মা-বাবাকে বোঝাল, তাঁদের নেতাজিনগরের বাড়ি থেকে রাজকুমারের সদ্য কেনা রানিকুঠির ফ্ল্যাটের দূরত্ব খুব বেশি হলে এক কিলোমিটারও না। এ-বেলা ও-বেলা দেখা হবে মেয়ের সঙ্গে বাবা-মায়ের।

বিয়ে তো হল, ফুলশয্যার রাতে এরকম একটা ঝাপট খাওয়ার পর মধুচন্দি্রমায় যাওয়ারও কোনও ইচ্ছে রইল না রাজকুমারের। অস্মিতা বরাবরই যেন কেমন-কেমন। কীরকম নির্বিকার, আত্মমগ্ন। ওকে নিয়ে কোনও পাহাড়ি দেশে যাবে এমনটাই ভেবে রেখেছিল, কিন্তু ফুলশয্যার পর সাতদিনের মধ্যেও অস্মিতা তার হাতে হাত পর্যন্ত রাখতে দেয়নি দেখে হতাশ হতে শুরু করল রাজকুমার।

ফলে মধুচন্দ্রিমায় দূরে কোথাও যায়নি, বিয়ের পর বেড়ানোর জায়গা বলতে ওরা বেছে নিয়েছে রাজকুমারের গাঁয়ের বাড়ি সরসপুরে। কলকাতা ছেড়ে এই প্র‌থম কোনও গাঁ-বাড়িতে এসেছে অস্মিতা। সাতদিনের থাকা, প্র‌থম তিনদিন সরসপুর ঘুরে দেখে অস্মিতার চোখে ঘোর। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। প্র‌কৃতির নিজের হাতে গড়া বোটানিক্যাল গার্ডেন। অস্মিতার হাতে সারাক্ষণ একটা ছোটো নোটবই। যে-দৃশ্যই তার পছন্দ হয়, অমনি ঘাসের উপর বসে পড়ে নোটবইয়ের পৃষ্ঠায় তার একটা স্কেচ করে নেয়। বেশিরভাগ সময় রাজকুমারকে সঙ্গে নেয় না। বলে, তুমি বড্ড বকবক করো। কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয়ে যায়।

অস্মিতা একা-একাই ঘোরে তন্ময় হয়ে। রাজকুমার সবসময় তাকে একা ছাড়ে না, অনেকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে তন্ময় হয়ে ঘোরা মেয়েটাকে। কোথায় যেতে কোথায় চলে যাবে তার নতুন বউ তার ঠিক নেই। কখনও অস্মিতা তার চোখ এড়িয়ে ঘুরতে বেরোয় একা একা।

রাজকুমার তাকে খুঁজতে বেরোয়। কখনও শেষ বিকেলে বারোয়ারিতলায় গিয়ে সে যখন একা একা চরাচরে সূর্যাস্ত দেখে, তখনও লোকে তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকায়, সূর্যাস্তের পরও যখন সে ঘরে ফেরে না, দেখে কীভাবে অন্ধকারের পোঁচ লেগে কেমন কালচে হয়ে যাচ্ছে চরাচর, তখনও তার দিকে লক্ষ রাখে গাঁয়ের মানুষ। সন্ধের পর যখন আঁধারে ডুবে যাচ্ছে তার কমলারঙের শাড়ি, সে ঘরে ফিরছে না, তখন কোনও গাঁয়ের মানুষ হয়তো তাকে বলল, বউমা, ঘরে যাও।

হয়তো তখন তার সাড় ভাঙে। চারদিকে চোখ পেতে দেখে সে বিশাল প্র‌ান্তরে দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। চমক ভাঙতে সে পা চালিয়ে ফিরতে থাকে ঘরের দিকে। হঠাৎ কোনো বুনোফুলের গন্ধ নাকে যেতে সে থমকে যায় ফের, অন্ধকারে চোখ চালিয়ে খুঁজতে থাকে সেই বুনোফুলের গন্ধের উৎস। পথের দুপাশে বুনোঝোপ। তার মধ্যে কী না কী লুকিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সে বিষয়ে তার সংবিৎ নেই, সে পাতালতা সরিয়ে দেখতে চায় কী ফুলের গন্ধ এটা। সেই আবিষ্কারের মধ্যেই তার নজরে পড়ে ঘন অন্ধকারে কী দ্যোতনা ছড়িয়ে ফুটে আছে একটা বিশাল লালফুল। তার বিশাল পাপড়িগুলো জ্বলছে কী অদ্ভুতভাবে!

হঠাৎ তার চমক ভাঙে কারও ডাকে, ফিরে দেখে রাজকুমার খুঁজতে বেরিয়েছে তাকে। তামে অমন ঝোপঝাড় ঢুঁড়ে বেড়াতে দেখে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, তুমি এত রাতে একা-একা?

অস্মিতা তাতে কুণ্ঠিত হয় না, বলে, দেখে যাও, কী চমৎকার একটা ফুল। নাম জানো?

রাজকুমারের তাতে উৎসাহ নেই, বলল, ফুল তো সরসভূমির সর্বত্র। তাতে তো নতুন কিছু নেই!

কিন্তু এই ফুলটা তুমি কখনও দেখোনি! নামও জানো না?

সরসভূমিতে কত ফুল আছে যার নাম কেউ জানে না।

ধরো, এই ফুলটার নাম দিলাম রক্তমঞ্জরী।

রাজকুমার চমৎকৃত হয়, বলে বেশ নাম। ঠিক আছে কাল রক্তমঞ্জরী ফুল নিয়ে একটা কবিতা লিখে তোমাকে উপহার দেব। এখন চলো।

একটা লাইন মুখে মুখে তৈরি করো তো!

ঠিক আছে, শোনো।

‘রক্তমঞ্জরী তুমি একা একা ফুটে আছো বনের আড়ালে

সঙ্গোপনে, রাজার কুমারী সেজে।’ হয়েছে?

অস্মিতা হেসে বলল, হয়েছে।

তুমি এতক্ষণ একা-একা কোথায় ঘুরলে?

বারোয়াতিলায় দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দারুণ লাগে। চলো না, দেখবে দূরের বিলের জলে কীরকম টুপ করে এসে বসে পড়ে সুয্যিদেব। তখন তার শরীরে কী যে সুন্দর রং মেখে নেয় কী যে বলব! টুকটুকে লাল শরীর নিয়ে বসে থাকে চুপটি করে, বোধহয় ইতি-উতি তাকিয়ে দেখে কেউ তাকে দেখছে কি না। যখন দেখে আমি তাকে দেখছি, সে আরও একটু লাল হয়, মেয়েরা লজ্জায় লাল হলে যেমন দেখায় আর কি। তারপর অমনি আবার টুপ করে ডুব দিতে থাকে জলের মধ্যে। অমনি বিলের জল লালে লাল।

রাজকুমার শিউরে ওঠে কেন যেন। অস্মিতার গলার স্বরে থরথর কাঁপ। তার চোখে কী এক উদাসীন চাউনি। রাজকুমার বলল, তুমি এজন্য এত দূর আসো রোজ রোজ?

কী জানি। বিকেল হলেই সুয্যিদেব যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকেন।

নীল আকাশে তখন সাদা মেঘের ভেলা উড়ে যায় দিক থেকে দিগন্তের পথে। সেই ভেলায় কখনও চড়ে বসে অস্মিতা তার নীল শাড়ি আঁচল উড়িয়ে ভেসে যায় যেখানে তার ইচ্ছে, যত দূরে তার মন চায়। এ এক অদ্ভুত ভ্রমণ তার।

সাদা মেঘের ভেলা দূরে উড়ে যাওয়ার পর সে বাস করতে থাকে এক ঘোরের মধ্যে। যেন পার হয়ে যাচ্ছে একটা লম্বা ক্যালেন্ডার। তার দু চোখ আশ্বিন পার হয়ে হিমের স্পর্শ নিয়ে পা ফেলতে থাকে কার্তিকের দিকে। লক্ষ করতে থাকে পৃথিবীর গায়ে কেউ যেন নতুন করে আঁকতে থাকে জলছবি। রং বদলে যায় পৃথিবীর। সবুজ বল্লমের মতো লকলক করতে থাকে ধানপাতা। হেমন্তে তখন মল্লিকার ফুটে ওঠার ধুম। যে-গাছগুলি নিরীহ বালিকার মতো এলেবেলে দাঁড়িয়ে থাকত চলার পথের এখানে-ওখানে, তারাই ফুলন্ত হয়ে রূপসী হয়ে উঠল হঠাৎই। অস্মিতাকে ডেকে বলতে থাকে, দ্যাখো, আমাকেও দ্যাখো তুমি।

অস্মিতা তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ইস, কী সুন্দর তোরা! আমি কেন তোদের মতো হতে পারিনে?

অস্মিতা তখন পার হচ্ছে হেমন্তের জলছবি। কার্তিকের দিনগুলিতে হাঁটতে থাকে সার সার ধানের ডগায় পা ফেলে ফেলে। ধানের পাতায় আঁকা হতে থাকে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। অস্মিতার তুলিতে ক্রমে ভরে ওঠে নানা রঙের আলোছায়া। কখনও তার চোখে পড়ে একজোড়া হরিয়াল বসে আছে সজনে গাছটির ডালে। খণ্ডদুপুরের এমন সব টুকরো মুহূর্ত অস্মিতাকে ঋদ্ধ করে নানান অভিজ্ঞতায়। বাড়ির অন্যরা যখন এমন আশ্চর্য সব ভেজা দুপুরে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত, অস্মিতার তুলি এঁকে চলে সরসপুরের এমন সব ছবি যা আগেও কখনও ছিল না, পরেও হবে না। নানা রঙে ভরে ওঠে তার সাদা ক্যানভাস।

তার মধ্যে দেশে আরও হিম পড়তে শুরু করে। একটু একটু করে শীতের হাওয়ায় কাঁপতে থাকে ধানের শিষ। অস্মিতা অবাক হয়ে দেখে কখন যেন একটু একটু করে ধানের পাতায় হলুদ রং ধরেছে। হলুদ হয়ে গেছে শীষগুলো। মাঠের পর মাঠে কাঁচাপাকা ধান ঢেউ তুলতে থাকে নিজের শরীরে। গর্ভবতী নারীর মতো তার শরীর ভারী হয়ে উঠছে দ্রুত। কোথাও কোথাও মাটিতে নুয়ে পড়েছে সোনার বর্ণ ধান।

তিনদিন সরসপুরকে তার নোটবইতে তুলে নেওয়ার পর একদিন বলল, কাছাকাছি আর কোনও গ্র‌াম আছে যা এর চেয়েও সুন্দর?

আছে বইকি।

পরদিন সকালে প্র‌াতঃরাশের পর রাজকুমার তাকে নিয়ে চলেছে সরসপুর সংলগ্ন গ্র‌াম দিকচিহ্ন। দুটি গ্র‌াম লাগোয়া হলেও তাদের মধ্যে জড়িয়ে আছে আত্মীয়তা। সরসপুরে যারা বসবাস করে, তাদেরই শরিকরা থাকে দিকচিহ্ন গ্র‌ামে। দুই গাঁয়ে এক অলিখিত রেষারেষি। হাঁটতে হাঁটতে তুলনাও চলছিল দুই গাঁয়ের যার যার গরিমার।

দুটি ছিমছাম ঝাউগাছের মতো পাশাপাশি অস্মিতা আর রাজকুমার, নতুন বরবউ হেঁটে যাচ্ছে দিকচিহ্নের দিকে। অস্মিতা শিল্পী, হাঁটতে হাঁটতে তার তুলিতে তখন ভরে আসছে রকমারকম রং। সেই তুলি দিয়ে সে এঁকে চলেছে কোনও এলেবেলে বালকের মতো উধাও হয়ে যেতে থাকা দিকচিহ্নের আঁকাবাঁকা মেঠো পথটি। এখানে দুপাশে বাঁশবন। বাঁশবনের কঞ্চির আঙুলগুলি নিচু হয়ে নেমে এসে অস্মিতার শাড়িতে টান দিচ্ছে দুষ্ুটমির ছল করে।

অশত্থ গাছের ছায়ার সীমানা পেরোলেই বাঁশবনের ভিতর দিয়ে এই গুহাপথ। উপরে অসংখ্য কঞ্চির জাপটাজাপটির সহাবস্থান। পথে পড়ল এক মস্ত দিঘি— যার চারদিকের পাড় বাঁধানো, প্র‌তি কিনারেই একটি করে বাঁধানো ঘাট। টলটলে জল দেখে স্নানে নামতে ইচ্ছে করছিল অস্মিতার। বলল, এসো না, স্নান করি—

রাজকুমার সপাটে ঘাড় নেড়ে বলল, না, নতুন বউ খোলা জায়গায় স্নান করলে গাঁয়ে নিন্দে হবে নিশ্চিত।

অস্মিতার মুখ বেজার, বলল, সরসপুরে কত মেয়ে-বউরা তো পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড় ছপছপিয়ে ঘরে ফিরছে দেখলাম।

তারা স্থানীয় মেয়ে-বউ। তুমি কলকাতা থেকে এসেছ।

অস্মিতা কিছু বুঝে বা না-বুঝে আবার হাঁটা শুরু করে জেদি গলায় বলল, আমি এই দিঘিতে স্নান করবই। কাউকে না বলে একা চলে আসব।

দিঘিতে ছাপাছাপি পদ্মফুলের রাশি, জল অনাবিল, টলটলে। রাজকুমার তাকে নিবৃত্ত করতে বলল, দিঘিতে কেউ স্নান করা দূরে থাকুক, তার ধারে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে না এমন সাপের বাস।

অস্মিতা খিলখিলিয়ে হাসে, তা সাপেদেরও তো একটা বাসভূমি চাই। কোথায় যাবে বেচারারা! আমি তাদের সঙ্গে ভাব করে নেব। আমাকে কিছু বলবে না।

লোকে বলে এই দিঘিতে গাঁয়ের জমিদার-বউ ডুবে মরার পর তার জলে সেই বউয়ের শাপ লেগেছে, তাই এত সাপ।

অস্মিতা হাসল। রাজকুমার এখনও বুঝে উঠতে পারছে না তার বউকে। বিয়ের আগেও অস্মিতা ছিল তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন যেন আরও।

অস্মিতা তখন দু চোখে বিস্ময় নিয়ে হেঁটে চলেছে অদূরে নতুন গড়ে ওঠা দিকচিহ্নের দিকে। এ সবই ছিল ধানমাঠ। সভ্যতা এখন সেখানে গড়ে তুলেছে একতলা-দোতলা পাকা বাড়ি।

দিকচিহ্ন এক অদ্ভুত গাঁ, কিছুটা সবুজ, কিছুটা ধূসর। বাড়িগুলো সবই সাদা। তাদের চারপাশে গাছগাছালির সমাহার। ফুল আর ফলফলারির গাছই বেশি। এ হল নতুন গড়ে ওঠা বসত। এখানকার জীবনে শহুরে ছাপ।

রাজকুমার বলল, জমিদারবাড়ির অনেক উত্তরাধিকারী এখন কলকাতায় বসবাস করে। কেউ চাকুরে। কেউ বাণিজ্য করে লক্ষ্মীলাভের আশায়। গ্র‌ামের জমিজমা এখন অধিকাংশই বর্গাদারদের দখলে। প্র‌ায় সময়েই জমিদারদের ভাগ এসে পৌঁছোয় না। কোথাও বেনামে জমি। নায়েব বা গোমস্তা ধরনের লোক দেখভাল করে সেই সব জমিজমার। যেটুকু ভাগের ধান এসে পৌঁছয়, তা বিক্রি করে জমা হয় শরিকদের নামে।

রাজকুমার কী বলল না বলল তাতে অস্মিতার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে ঘুরে ঘুরে দেখে চলেছে নতুন গাঁয়ের ছবি-ছবি দৃশ্যপট। ঘুরছে তো ঘুরছেই। দেখছে দালানবাড়িগুলোর গঠনবৈচিত্র্য। কোনওটাই কলকাতার মতো হাল ফ্যাশনের নয়। নতুন, কিন্তু গ্র‌াম্যতার ছাপ সবখানে। সেটাই দস্তুর। অস্মিতার হাতে ছোটো ডায়েরিটা, তাতে টুকটুক করে এঁকে চলেছে নানা রেখাচিত্র। সেগুলো পরে ক্যানভাসে তুলে নেবে এক-এক করে।

ঘুরতে ঘুরতে দুপুর পার করে ফেলল অস্মিতা। কী এক ঘোরের মধ্যে তার চোখ অবিরাম ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে প্র‌তিটি মুহূর্তের ছবি। যেন এই পৃথিবীটা তার কাছে শুধু ছবির সমন্বয়। যত নতুন দৃশ্যের কাছে যাচ্ছে, তার মুখে ফুটে উঠছে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। তার সামনে ঘটে চলেছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়।

ঘরের ফেরার পর এক অভাবনীয় উল্লাসে জমজম করছিল তার অভিব্যক্তি। রাজকুমারকে বলল, ভাগ্যিশ তুমি নিয়ে এসেছিল দিকচিহ্নে। গোটা গাঁ-টাই যেন একটি অ্যালবাম।

রাজকুমার ভাবছিল হয়তো আজ অস্মিতা তার কাছ ঘেঁষে শোবে। তার গায়ে হাত রাখতে দেবে। কিন্তু হা হতোস্মি! সে রাতেও বিছানায় শুয়ে যথারীতি এক হাত দূরত্ব বজায় রাখল অস্মিতা। রাজকুমার কাছ ঘেঁষে শুতে চেয়েছিল, তার হাতটা সপাটে সরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল, সম্পর্কটা অশ্লীল করে তুলো না।

পলক না-ফেলতে অস্মিতা ঘুমে কাদা।

রাজকুমার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে পাশ ফিরে ঘুমোতে চাইল, কিন্তু তার চোখে ঘুম আসে কই!

সেদিন অনেক রাতে হঠাৎ রাজকুমার অনুভব করল তাকে কে যেন ঠেলছে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না হাতটা অস্মিতারই কি না।

অস্মিতা তখন মোবাইলের টর্চ জ্বেলে উঠে পড়েছে বিছানা থেকে, ফিসফিস করে বলল, দেখছ না, বাইরে কীরকম রমরম করছে জ্যোৎস্না! ওঠো শিগগির।

রাজকুমারের চোখে তখন রাজ্যের ঘুম, কিন্তু শুয়ে থাকার জো রইল না, উঠে পড়তেই হল।

অস্মিতার পরনে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি, হাওয়ায় লাল আঁচল উড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। অস্মিতার পিছু পিছু চলতে শুরু করে ঘুম-জড়ানো গলায় বলে, ইস, এমন ঘুম-চোখে কি কখনও রাস্তায় বেরিয়ে টো টো করে ঘোরা যায়!

বনজ্যোৎস্নায় চাপুড়চুপুড় ভিজে অস্মিতা হাঁটতে থাকে বাড়ির উত্তরদিকে। কাল দিকচিহ্ন যাওয়ার পথে দেখে এসেছে তলপা বাঁশের ঝাড়। কী সুন্দর কয়েকটা চারা বেরিয়েছে ঝাড়ের গোড়ায়। সেই চারার অফ হোয়াইট রং দেখে আসা ইস্তক ছটফট করছে তারা আজ কতটা বড়ো হল! আজ পায়ে পায়ে গিয়ে দেখে, ও মা, অফ হোয়াইট রঙে এর মধ্যে কচি কলাপাতার রং। মাথায়ও অনেক বেড়েছে একদিনের ফুরসতে। রাজকুমার বলছিল বাঁশের চারা রোজ নাকি এক হাত করে বাড়ে। অস্মিতা তার ফরসা নরম হাত দিয়ে মাপতে চেষ্টা করে চারাগুলোর উচ্চতা।

অস্মিতা দ্রুত পায়ে হেঁটে চলেছে জ্যোৎস্নায় রুপোভেজা হয়ে। পার হয়ে যাচ্ছে বারোয়ারিতলা, পার হয়ে যাচ্ছে দুর্গামণ্ডপ, পার হয়ে যাচ্ছে মস্ত অশত্থগাছটার তলা। অনেক ব্যস্ত পা ফেলে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে মস্ত দিঘিটার এক দুরূহ কোণে। এদিকটায় সচরাচর মানুষজন আসে না। এত রাতে তো আসবেই না।

মাথার উপরে গোল সোনালি রুমালি-রুটির মতো মস্ত চাঁদটা তখন জ্যোৎস্নার গুঁড়ো ছড়াচ্ছে অঝোরে। জ্যোৎস্নার গুঁড়ো তখন মিশে যাচ্ছে দিঘিটার জলে। জ্যোৎস্নায় ভিজছে দুই চেনা, অথচ অচেনা দুই নারী-পুরুষ।

রাজকুমার বুঝে পাচ্ছে না অস্মিতা এত রাতে, দিঘির তীরে কী করতে চায়!

অস্মিতা হঠাৎ রাজকুমারের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল, ফিসফিস করে বলল, দিঘিতে স্নান করব।

এখন! এত রাতে!

তুমি তো বললে দিনের বেলা স্নান করলে আমার নিন্দে হবে।

কিন্তু তাই বলে এখন?

অস্মিতা কোনও কথা না বলে তার পরনের শাড়িটা খুলে ছুড়ে দিল দিঘির কিনারে কলমির ঝোপের দিকে।

রাজকুমার চমকে উঠল।

অস্মিতা তখন স্নান করতে মরিয়া। তার পরনের বাকি পোশাকও উড়িয়ে দিল হাওয়ায়, সেগুলো ভাসতে ভাসতে গিয়ে ঠেক খেল গিমে আর বউটুনির শাকের ঝোপে।

রাজকুমার শিউরে উঠল নগ্ন অস্মিতাকে দেখে। তার সম্পূর্ণ শরীর এই প্র‌থম দেখল। সোনার মতো ঝকঝক করছে। সেই শরীরের ঐশ্বর্য দেখে রাজকুমার থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার গলায় তখন স্বর ফুটছে না, ফ্যাঁসফেসে গলায় বলল, অস্মিতা, এত রাতে স্নান কোরো না। তাছাড়া এই দিঘিতে অনেক—

অস্মিতা তার রুপোভেজা সোনালি শরীর নিয়ে এগিয়ে এল রাজকুমারের দিকে, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বলল, তাহলে তুমিই আমাকে স্নান করিয়ে দাও। তুমি নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছ আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নই। এই জ্যোৎস্না রাতে খোলা আকাশের নীচে আমি অনুভব করতে চাই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলি। মানুষের যৌন-অনুভূতি জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। এক স্বর্গীয় অনুভূতি। রাতের অন্ধকারে তাকে কলুষিত করার কোনও মানে হয় না। এসো, এই প্র‌গাঢ় জ্যোৎস্নায় আজ দু’জনে ভিজি। প্র‌বলভাবে ভিজি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *