হেডমাস্টারমশাই উবাচ

হেডমাস্টারমশাই উবাচ

মাদারিপুর স্কুলে পড়াকালীন দিনগুলিতে স্কুলের হেডমাস্টারমশাই সমরেন্দ্র বসু ছিলেন আমার অন্যতম আইডল। তিনি খুব সুপুরুষ বা দীর্ঘকায় বা সুন্দর চেহারার মানুষ ছিলেন তা নয়, কিংবা মধুর স্বভাবের ছিলেন তাও নয়, বরং ছিলেন ঠিক উল্টোটাই। খুবই মাঝারি উচ্চতার, গায়ের রং শ্যামবর্ণ, সামান্য স্থূল চেহারার মানুষ। পরনে ধুতির উপর থাকত ধবধবে সাদা শার্ট, শার্টের কলারের নীচে রাখা থাকত একটি সাদা রুমাল যাতে ঘাম লেগে ময়লা হয়ে যায় শার্টের কলার! তাঁর গলার স্বর ছিল প্র‌ায় বাঘের মতো গম্ভীর, অত্যন্ত রাশভারী, তাঁর দাপটে ছাত্ররা তো বটেই শিক্ষকরাও থাকতেন বেশ ভয়ে-ভয়ে। কিন্তু তাঁর যে যোগ্যতাবলি আমাকে আকৃষ্ট করত তা হল ক্লাসে তাঁর ইংরেজি পড়ানো।

তখনকার দিনে গ্র‌ামে এমএ পাসের সংখ্যা খুব বেশি ছিল তা নয়, একজন হেডমাস্টার হওয়ার যোগ্যতা হিসেবে এমএ হওয়াটাই ছিল প্র‌ার্থিত, কিন্তু স্কুলের বুকলিস্টে তাঁর নামের পাশে লেখা থাকত বিএ (হন্‌স ইন ইংলিশ)। হন্‌স অর্থে অনার্স। তাঁর নামের নীচে জনা কুড়ি শিক্ষকের মধ্যে অন্তত সাত-আটজন ছিলেন নানা বিষয়ে এমএ। একজন শিক্ষক হবিবুল্লা সাহেবের নামের পাশে লেখা থাকত ডাবল এমএ।

কিন্তু সেই এমএ, ডাবল এমএ-রাও হেডমাস্টারমশাইয়ের প্র‌তাপে অস্থির।

আমরা যারা একটু উপরের ক্লাসে উঠেছি, একমাত্র তাদেরই ক্লাস নিতেন তিনি। সেভেন ও এইটে পড়াতেন গ্র‌ামার। বলতেন গ্র‌ামার আর ভোকাবুলারি, ভালো ইংরেজি শেখার জন্য এই দুটির বিশেষ প্র‌য়োজন। ক্লাস নাইনে তিনি পড়াতে শুরু করলেন একটা নাটিকা, ‘দি বিশপ’স ক্যান্ডেলস্টিকস’। তাঁর ইংরেজি পড়ানোর একটা অন্য আভিজাত্য ছিল।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই জানতাম তিনি জাতিতে খির‌স্টান। তাঁর গলায় সর্বক্ষণ ঝুলতে থাকত একটা ত্রুশ। আমাদের স্কুলটা খুবই পুরনো, বির‌টিশ আমলে তৈরি। স্কুলটা গড়েছিলেন খির‌স্টান মিশনারিরা, হয়তো সেই সুবাদে বিএ হন্‌স হওয়া সত্ত্বেও একজন খিস্টানকেই নিযুক্ত করা হয়েছিল হেডমাস্টার হিসেবে।

তাঁর পঠনের আকর্ষণেই আমরা ক্লাসে বসে থাকতাম ‘পিনড্র‌প সাইলেন্স’। পড়ানোর সময় তাঁর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠত ভারী চমৎকার। ক্লাস নাইন থেকে ক্রমশ উপলব্ধি করতে পারছিলাম ইংরেজিতে তাঁর কী অসম্ভব জ্ঞান। টেক্সট বুক খুলে নাটিকার পৃষ্ঠা খুলে প্র‌থম দিনেই বলে দিয়েছিলেন, এটি কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ নাটক নয়, ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত নাটক ‘লা মিজারেবল’-এর প্র‌থম দৃশ্য নিয়েই এই নাটিকাটি। পুরো নাটকটার গল্প আমি একদিন বিশদে বলব তোমাদের। তবে বড়ো হয়ে মূল নাটকটা ইংরেজিতে পড়ে নিও অবশ্যই। তোমাদের যে-অংশটি পাঠ্য করা হয়েছে, সেই দৃশ্যে এক জেল-পালানো কয়েদি হঠাৎ ঢুকে পড়েছে একজন বিশপের ঘরে। তার উদ্দেশ্য কোনও একটি মূল্যবান বস্তু চুরি করে পালানো। সেই মূল্যবান বস্তুটি হল বিশপের একটি রুপোর বাতিদান।

হেডমাস্টারমশাইয়ের বিশেষত্ব ছিল তিনি নাটিকাটি পড়াতেন প্র‌ায় অভিনয় করে। একবার কনভিক্টের ভূমিকায়, একবার বিশপের ভূমিকায় পড়তেন সংলাপগুলি। পড়ার সময় তাঁর কণ্ঠস্বরে প্র‌য়োগ করতেন অভিনব বৈচিত্র্য। আমরা চাক্ষুষ করতে পারতাম দৃশ্যগুলি।

তাঁর কণ্ঠস্বরের সেই বৈচিত্র্য, ওঠানামা, স্বরক্ষেপণ শুনতে শুনতে নিবিষ্ট হয়ে পড়তাম সেই দৃশ্যটির গভীরে।

প্র‌ায় মাস তিনেক পরে তিনি পৌঁছোতে পারলেন নাটিকাটির শেষ দৃশ্যে যখন বিশপ হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন কয়েদিকে, কিন্তু তাকে পুলিশে তো দিলেনই না, উপরন্তু সেই মূল্যবান বাতিদানটি তাকেই দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যাতে সে ভালো হয়ে ওঠে।

সেই প্র‌সঙ্গটি পড়ানোর সময় গলাটা কীরকম ধরে গিয়েছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের।

দীর্ঘসময় ধরে নাটিকাটির সঙ্গে আমরাও এমনই একাত্ম হয়ে ছিলাম যে, শেষ দৃশ্যে পৌঁছে চোখে জল এসে গিয়েছিল আমাদেরও।

কিন্তু শুধু কি ‘বিশপ’স ক্যান্ডেলস্টিকস’ পড়ানোতেই তাঁর অভিনবত্ব!

যখন আইজ্যাক নিউটনের জীবনকাহিনি কিংবা ‘আঙ্কল পোজার হ্যাঙ্গস অ্যা পিকচার’ পড়াতে শুরু করলেন, কণ্ঠস্বরে বৈচিত্র্য এনে পড়াতে লাগলেন এক-একটি বাক্য, আস্তে আস্তে গভীরে ঢুকে যেতেন বিষয়ের, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম সেই পড়ানো।

আমাদের ক্লাসে দু-তিনজন ছিল একটু বেশি বয়সি, তারা বেশ ফচকে স্বভাবের, তাদেরই একজন অবিনাশ কীভাবে যেন সংগ্র‌হ করল এক অভিনব সংবাদ। সংবাদটি হল হেডমাস্টারমশাইয়ের স্ত্রী নাকি পরমাসুন্দরী।

খবরটা কারও কারও কাছে তেমন শোভন মনে হয়নি! হেডমাস্টারমশাই গুরুজন, যথেষ্ট বয়স্ক, তাঁর স্ত্রীর রূপ নিয়ে তো ছাত্রদের মাথা ঘামানোর কথা নয়!

কিন্তু কার কী মনে হল না হল তাকে ফচ্‌কেদের কিছু যায় আসে না, একদিন কোনও একটা অজুহাত নিয়ে মণিময় চলে গেল হেমমাস্টারমশাইয়ের বাড়ি। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল লাফাতে লাফাতে। কেন তাদের এই উল্লফন তা জানতে অন্য ছাত্ররা ঘিরে ধরল তাদের।

আর একজন ফচকে অশোক, বেশ ঢ্যাঙ্গা চেহারা, আমার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ বছরের বড়ো, নানা স্কুলে বারংবার ফেল করে, অজস্র‌ কুকর্ম করে বিতাড়িত হতে হতে এসে ঠেকেছে আমাদের এই মাদারিপুর হাই স্কুলের ক্লাস নাইনে। এখানেও শুরু করেছে তার নানা অ-ব্যাকরণীয় কাজকর্ম। এই বয়সেই সিগারেট খেয়ে তার ঠোঁটদুটো কালো কুচকুচে, ঠোঁটের সেই কৃষ্ণবর্ণ রং তার অহংকারের বিষয়।

সেই অশোকের উল্লম্ফনই সবচেয়ে বেশি, এসে কলার তুলে বলল, প্যারাগন! প্যারাগন!

প্যারাগন মানে আমাদের মধ্যে অনেকেই জানে না! কিন্তু অশোক হচ্ছে ক্লাসের ফেলু ছেলে, তার কাছে প্যারাগন শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করার চেয়ে সুইসাইড করাও ভালো।

প্যারাগন শব্দ অশোক যখন জানে, নিশ্চয় শব্দটার মানে খারাপ কিছু।

অশোক দারুণ ঘুঘু ছেলে, অন্যদের মুখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করেছে এসব বিশেষণ গুডিগুডি বয়দের জানার কথা নয়, তাই বিষয়টি আরও খোলসা করতে বলল, প্যারাগন অফ বিউটি।

হ্যাঁ, এবার বিষয়টি পরিষ্কার হল সবার কাছে। বিউটির বিউটিত্ব জেনে অনেকেই জিজ্ঞাসা করল, খুব সুন্দর?

অশোক হে হে করে হেসে বলল, সিনেমার পরিচালকরা সুন্দরী নারী খুঁজে খুঁজে হল্লা হয়ে যায়! যদি জানত এই মাদারিহাটে এরকম একজন সুন্দরী নারী আছে, নির্ঘাত হরণ করে নিয়ে যেত!

পরক্ষণে আক্ষেপ করে বলল, সাধে কি আর হেডমাস্টারমশাইয়ের সাতখানা ছেলেমেয়ে হয়েছে। এরকম জিনিস পেলে—

অশোকের কথাবার্তা বড্ড অশ্লীল মনে হয়!

অশোকের সঙ্গে গিয়েছিল আর এক ফক্কড় ছেলে লালমোহন, সেও সোনা হেন মুখ করে শুনছিল অশোকের পেশ করা বিবরণ, এতক্ষণে সে বলল, বুঝলি, রূপকথার রাজরানির কথা পড়েছিস? এ হল সেই রাজরানি। গা থেকে গোলাপের রং যেন ফেটে বেরোচ্ছে! চোখ যেন সেই পটল-চেরা। নাক কী টিকলো। সামনে যখন এসে দাঁড়াল মনে হল রূপকথার বই থেকে উঠে এসেছে এক্ষুনি! দেখে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার!

লালমোহনের বর্ণনা শুনে মনে হল সে যেন রাতারাতি কবি হয়ে গেছে!

তাদের রকমসকম দেখে অন্য সবারই তখন মনে উসকে উঠেছে অজস্র‌ কৌতূহল! সবাই চাইছে তাঁকে একবার চোখের দেখা দেখতে! কিন্তু দোর্দণ্ডপ্র‌তাপ হেডমাস্টারমশাই, তাঁর মুখোমুখি হতেই ভয় করে, তাঁর বাড়িতে যাওয়া, সে এক অসম্ভব ব্যাপার!

কিন্তু অশোকরা গেলই বা কী করে!

শুনে অশোক জামার কলারটা আরও একটু তুলে বলল, বুদ্ধি! বুদ্ধি! বুঝলি? বের‌ন। সুপার বের‌ন।

অশোকের বের‌ন যে আমাদের সবার চেয়ে ভালো তা বুঝতে বাকি নেই কারও! নইলে সে এক-একটা ক্লাসে উঠতে দু-বছর তিন-বছর সময় নেয়! সে অবশ্য বলে, দু-বছর তিন বছর করে কেন পড়ি জানিস তো! ভালো করে পেকে তারপর ক্লাসে উঠি। ফাইনালে উঠে দেখবি কী ফাটাফাটি রেজাল্ট করি!

অশোক অবশ্য তার সুপার বের‌নের পরিচয় ব্যক্ত করে, বুঝলি, বিকেলে দেখলাম হেডস্যার স্কুল থেকে ফিরে রিকশায় উঠে কোথায় যেন গেলেন! অমনি আমরা তিনজনে তাঁর বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ি। ব্যস, জানি তো স্যার বাড়িতে নেই, দরজা অন্য কেউ খুলবে। কপাল এমনই যে, দরজা খুললেন হেডস্যারের স্ত্রী, তাঁকে নিরীহ মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার আছেন?’, উত্তর শুনলাম, ‘না, উনি তো এখনই বেরলেন একটা দরকারে। কী দরকার?’ মাথা চুলকে বললাম, ‘একটা দরকার ছিল। ঠিক আছে, কাল স্কুলে দেখা হলে বলব।’ বলেই অমনি কাট। আমাদের যা দরকার ছিল তা তো মিটে গেছে। নয়ন সার্থক।

অশোকরা বারবার এমন উল্লম্ফন করছে দেখে বাকিদেরও শখ হয় রাজরানি দেখে আসার। কিন্তু রোজ-রোজ তো আর স্যার বেরবেন না। অন্য কী অজুহাত খাড়া করা যায় তা নিয়ে গবেষণা করতে থাকে সবাই। আর আমি তো রামভীতু। স্যারের বউ দেখতে গিয়ে স্কুল থেকে রাসটিকেট হই আর কী!

তখন রাসটিকেট শব্দটা ছাত্রদের কাছে অতীব ভীতিপ্র‌দ। ছাত্ররা কেউ দুষ্কর্ম করলে তাকে চিরতরে ছুটি দিয়ে দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। সে আর এ জীবনে এ-দেশের কোনও স্কুলে পড়ার সুযোগ পাবে না।

কিন্তু আমি ভীতু হলে কী হবে, কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকজন অত্যুৎসাহী ছাত্র নানা অজুহাত আবিষ্কার করে ঘুরে এল হেডস্যারের বাড়ি থেকে। আমি রূপকথার পোকা বলে তিনি ‘রূপকথার রানির মতো দেখতে’ শুনে আমারও বেশ ইচ্ছে করছিল যেতে, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না!

হঠাৎ একদিন একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম আচমকা। সেদিন টিফিন পিরিয়ডে টিচার্স রুমে গিয়েছি, ইতিহাস স্যার আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন, যা তো অঙ্কুশ, হেডমাস্টারমশাই হঠাৎ বাড়িতে গেলেন, কিন্তু তাঁকে এখনই একবার স্কুলে আসতে হবে। খুব জরুরি দরকার। ডেকে নিয়ে আয় তো!

আমি দুরু দুরু বক্ষে, পুলকিত হৃদয়ে, চাতক চক্ষু মেলে গিয়ে হাজির হলাম হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়ি, কড়া নাড়তে গিয়ে দেখি হাত কাঁপছে।

নিশ্চয় হেডমাস্টারমশাই-ই খুলবেন, আমি ইতিহাসের স্যারের কথাটা বলব বলে প্র‌স্তুত হয়েছি, সেসময় ওপাশে ছিটকিনি খোলার শব্দ। পরক্ষণে দরজা খুলে যেতে আমি কথাটা বলতে গিয়েও কঁৎ করে গিলে ফেলি ও চিত্রার্পিতবৎ তাকিয়ে থাকি। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি তাঁর বয়স কত তা অনুমান করা সম্ভব নয়, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসা কোনও রাজরানিই। আমি তখন বিস্মৃত হয়েছি কী কারণে এসেছি এ-বাড়িতে, আমার সেই হতভম্ব ভাব দেখে হঠাৎ শিঞ্জিনীর রিনিঝিনি ধ্বনির মতো কানে এল, স্যারকে চাই?

তাঁর সেই মধুর মধুর বংশী বাজে’র মতো কণ্ঠস্বর শুনে চকিতে ফিরে আসে আমার সম্বিৎ, তড়িঘড়ি বলে ফেলি, ইতিহাস স্যার বললেন, হেডস্যারকে কী জন্য যেন দরকার।

হেডস্যারের শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছেন। তুমি ইতিহাস স্যারকে বলো গিয়ে।

ঠিক আছে, তাই বলছি।

বলে অমি এক বুক শিহরন নিয়ে লাফিয়ে ফিরে আসি সেখান থেকে।

তখনও সেই অপরূপা নারীর রূপসৌন্দর্য সম্মোহিত করে রেখেছে আমাকে। একেই বোধহয় বলে ডিমছাঁদের মুখ। গায়ের রং এমন গভীর গোলাপি যে মনে হচ্ছিল তাঁর গায়ে ক্যারামের স্ট্রাইকারের মতো একটু টোকা দিলেই আরও রক্তাভ হয়ে উঠবে তাঁর গায়ের ত্বক। দুই চোখের চাউনি এমনই নরম আর স্নিগ্ধ যে, আমার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন মনে হচ্ছিল নরম জ্যোৎস্না ছিটোচ্ছেন আমার গায়ে। তাঁর কণ্ঠস্বর এমনই সুরেলা যেন মনে হচ্ছিল জলতরঙ্গের সুর ছড়াচ্ছিল চারদিকে।

সত্যিই যেন এক রাজরানি কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার সামনে আবির্ভূত হয়ে আবার ফিরে গেছেন তাঁর প্র‌াসাদে।

সেই রাজরানির রূপ ও সৌন্দর্যের কাহিনি তখন উঁচু ক্লাসের ছেলেদের মুখে মুখে ঘুরছে। যারা দেখার সুযোগ পেয়েছে সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য তারা সাতকাহন করে বলছে যারা তাঁকে দেখেনি তাদের। সব চেয়ে মজার বিষয় হল তিনি যে সবার চেয়ে অনেক বড়ো, হেডস্যারের স্ত্রী সম্পর্কে এত কথা বলাবলি করতে নেই তাও যেন বিস্মৃত হয়েছে সবাই। নারীর রূপ এমনই হৃদয়হরণকারী।

ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার পর একটা যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল আমাদের স্কুলে। একটাই স্কুলবিল্ডিং, তাতে সকালে মেয়েদের ক্লাস হয়, দুপুরে ছেলেদের। দুই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিও আলাদা। কিন্তু গাঁ-দেশে খুব বেশি মেয়েরা স্কুলে পড়ে না। বিশেষ করে উপরের ক্লাসগুলোতে মেয়েদের সংখ্যা এমন কমে গেল যে, দুই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি একত্র বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, সকালে মেয়েদের স্কুলের ক্লাস নাইন আর টেন তুলে দেওয়া হবে, এই দুই ক্লাসের মেয়েরা পড়বে দুপুরে ছেলেদের স্কুলে।

বিষয়টি আমাদের মধ্যে রাষ্ট্রর‌ হতে সারা স্কুলে বয়ে গেল এক আশ্চর্য শিহরন। ক্লাস নাইন আর টেনে বয়ে গেল রোমাঞ্চের হিল্লোল। এতদিন ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেরা, মানে যারা একটু বড়ো হয়েছে, তারা মেয়েদের স্কুলের ছুটির সময় হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকত স্কুল-গেটের দিকে, কখন ছুটি হবে মেয়েদের, তাদের একটু চোখের দেখা দেখবে। যেন মেয়েরা এক আশ্চর্য অচেনা জগৎ যা দেখতে হয় দূর থেকে। বেশি তাকাতেও ভয় হত কেন না তা হলে কে কখন গুরুজনরা দেখে ফেলবে ছেলেদের আদেখলেপনা, তাই নিয়ে বকাবকি করবে।

সেই অচেনা জগৎ হঠাৎ একেবারে কাছে এসে পড়বে, সেই মেয়েরা পড়বে ছেলেদের সঙ্গে একই ক্লাসে এ যেন ছিল সবার ভাবনার বাইরে। কয়েকদিন অনেকের চোখে ঘুম এল না, কয়েকদিন সবাই এক আশ্চর্য রোমাঞ্চে ওতপ্রোত হয়ে রইল। সারাক্ষণ কয়েকজন ছাত্র এক জায়গায় হলেই গুজগুজ ফুসফুস। কোন কোন মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে, কোন কোন মেয়ে ক্লাস নাইনে, মেয়েদের স্কুলে ছুটির সময়ে তারা যেই বেরোতে থাকে ক্লাস থেকে, তাদের চিহ্নিত করা হতে থাকে আর রোমান্সের স্রোত বয়ে যেতে থাকে অন্তঃসলিলার মতো।

অবশেষে পৌঁছোয় সেই বিশেষ দিনটি যেদিন বেলা এগারোটায় ক্লাস শুরু হতে দেখা গেল ক্লাস টেনের ঘরে একটা বেঞ্চি রাখা হয়েছে লম্বভাবে যাতে ছেলেদের পাশে না বসতে হয় কাউকে। প্র‌থম ক্লাস ছিল অঙ্ক স্যারের, তাঁর পিছু পিছু তাদের আবির্ভাব, স্যার তাঁর চেয়ারে বসতেই তিন কিশোরীও সেই বেঞ্চিতে নিরীহ মুখে বসে পড়ে। দুজনের ফ্রক পরা, একজনের শাড়ি।

তিনজনের নামও তখন জেনে গেছে সবাই। যার মুখটা গোলছাঁদের, চোখ দুটো ভাসা-ভাসা, হলুদ-ফরসা গায়ের রং, দু-পাশে দুটো লম্বা বিনুনি ঝোলানো, তার নাম করবী। যার মুখটা ডিমছাঁদের, তার গায়ের রং আরও সুন্দর, প্র‌ায়-গোলাপি, তার চোখ দুটো কী অপরূপ, যেন রাজকন্যাদের মতো, পিছনে একটা বাহারি খোঁপা, তার নাম লাবণ্য। একমাত্র সে-ই ক্লাসে আসে শাড়ি পরে। আর যার মুখটা একটু চৌকো ধরনের, গায়ের রং যাকে বলে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চোখ দুটো ধারালো, পিছনে লম্বা একটা বেণি, তার নাম রিমা।

তখনও ক্লাস নাইন-টেনের মেয়েদের ফ্রক পরাই ছিল রেওয়াজ। তিনজনেরই মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যাই। কী সুন্দর দেখতে তাদের! তবে আমরা খেয়াল করছিলাম লাবণ্য শাড়ি পরে আসে বলে তাকেই যেন সবচেয়ে সুন্দরী বলে মনে হয়। শাড়ি-পরা মেয়েটির রূপ দেখে আমরা বলাবলি করতে থাকি, এমন সুন্দর মেয়ে কি আমাদের মাদারিপুর গ্র‌ামে ছিল!

তিনটি মেয়েই কিন্তু বেঞ্চিতে বসে থাকে প্র‌স্তরবৎ হয়ে, তাদের দুই চোখ বিদ্ধ মাটির দিকে, একটিবারের জন্যও ছেলেদের দিকে চোখ ফেলে না! কেন তাদের এই মৃত্তিকাপ্র‌ীতি তা নিয়ে গবেষণা করে ছেলেরা। যেন তাদের কার চোখ পটলচেরা, কার চোখ পদ্মফুলের মতো, কার চোখে হরিণী চাউনি তা দেখার যোগ্যতা ছেলেদের নেই।

তারা চোখ তুলে তাকায় শুধুমাত্র যে-মুহূর্তে স্যাররা চক আর ডাস্টার নিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, তারপর সারাক্ষণ চোখ রাখে স্যারের পড়ানোর দিকে, যেইমাত্র স্যার পড়ানো শেষ করে বাইরে বেরিয়ে যান, অমনি তাদের চোখ আবার মৃত্তিকাগামী।

আরও বিস্ময়ের বিষয় হল যেই না টিফিনের ঘণ্টা পড়ে, অমনি তারা তিনজন স্যারের পিছু পিছু চোখ নিচু করে বেরিয়ে যায় ক্লাসের বাইরে। যেন ক্লাসের ছেলেরা তাদের কাছে হয় অবজ্ঞার বস্তু, নয়তো ভীতিপ্র‌দ মানুষজন। স্যারদের অনুপস্থিতিতে তারা ছেলেদের সঙ্গে ক্লাসে কাটাবে না! সসীম সেকেন্ড বয়, রেগেমেগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল, ‘কেন, আমরা কি সব বাজে ছেলে নাকি!’ তিমির বলল, ‘করবী নামের মেয়েটা হঠাৎ চোখ ফেলেছিল আমার দিকে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে চোখে এমন ভাব করল যেন আমি একটা নরকের কীট। যেন ওর দিকে তাকিয়ে আমি অন্যায় করেছি!’ নিমাই বলল, ‘যখন কো-এডুকেশন ছিল না, ভালোই ছিলাম। হঠাৎ আমাদের মনে ঢুকে গেল হীনমন্যতা।’ বিষয়টা নিয়ে আমরা নানারকম আলোচনা করি নিজেদের মধ্যে। কেউ কেউ বলল, যাও বা আমরা কো-এডুকেশনের স্বাদ পেতে যাচ্ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা তো হলই না, উপরন্তু আমাদের কপালে জুটল ‘বাজে ছেলে’র তকমা!

এই বলাবলির মধ্যে একদিন হেডমাস্টারমশাই এলেন ক্লাস নিতে। তাঁর পড়ানোর অবকাশে হঠাৎ বললেন, নারী হল মায়ের জাত। তাদের সম্ভ্রম করতে শিখবে। দেখবে তাদের কোনওভাবে সম্মানহানি না হয়। স্বামী বিবেকানন্দ কীরকম নিরাসক্ত ছিলেন জানো তো? কখনও মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতেন না! তিনি কী বলেছিলেন মনে আছে? হে ভারত, তুমি ভুলিও না—

হেডমাস্টারমশাইয়ের মুখের উপর তো কথা বলতে পারে না, নইলে কেউ কেউ মুখিয়ে ছিল এই কথার একটা সমুচিত জবাব দিতে। তিমির বলল, কেন, আমরা কি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি নাকি যে, হেডস্যার এরকম একটা কথা বললেন! আমাদের কি উনি স্বামী বিবেকানন্দর মতো নারী হইতে শতহস্ত দূরে থাকতে বলছেন!

সসীম মুচকি হেসে বলছিল, হেডমাস্টারমশাই উবাচ যখন, কথাগুলো মনে রাখবি সবাই।

ছাত্ররা তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে তিনজন মেয়ের বায়োডেটা। কে কোথায় বাস করে, তারা কোন বাড়ির মেয়ে, তাদের এত দেমাকই বা কীসের!

সংগোপনে আলোচনা করে কার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস কত!

ক্লাস টেনের ছেলেরা বেশ ত্রুদ্ধ হয়ে ছিল, তারা দুঁদে গোয়েন্দার মতো অচিরেই আবিষ্কার করে ফেলল করবীর বাড়ি কাঁটাগঞ্জে, তার বাবার দশ বিঘে ধানজমি আছে, দোতলা বাড়ি। রিমার বাবা কোনও একটা ব্যাঙ্কের কর্মী, ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেন কলকাতায়। কিন্তু লাবণ্যর পরিচয় আবিষ্কৃত হতে আমরা বেশ ঘাবড়ে গেলাম। বলা যায় বিস্ময়ান্বিত। আমাদের জানা ছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের সাতটা ছেলেমেয়ে, জানা ছিল তাদের মধ্যে একজন ছেলে আমাদের আগের বছরেই পাস করে গেছে এই স্কুল থেকে, একজন ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। কিন্তু এখন জানতে পারি তাঁর আরও একটি ছোটো ছেলে আছে, আর মেয়ের সংখ্যা নাকি চারজন, তাদেরই একজন লাবণ্য। অন্যরা বয়সে আরও ছোটো।

আমাদেরই নিমাই এরকম একটি রোমহর্ষক সংবাদ পরিবেশন করতে আমরা প্র‌থমে ভীত, তারপর শিহরিত, তারপর সতর্ক হয়ে যাই হেডমাস্টারমশাইয়ের মুখখানা স্মরণ করে।

লাবণ্য হেডমাস্টারমশাইয়ের মেয়ে! তাই নাকি! সে কারণেই লাবণ্যকে দেখতে একেবারে রাজকন্যাদের মতোই! কী সুন্দর তার দুটি চোখের গড়ন! যেন শুধু স্বপ্ণেই দেখা যায় এরকম নরম চাউনির চোখ! রাজরানির মেয়ে তো রাজকন্যা হবেই!

কিন্তু তার পরিচয় জানার পর আরও সতর্ক হয়ে যাই সবাই। আমরা যাও বা এক-একবার নজর ফেলি রিমা বা করবীর দিকে, ভুলেও দেখি না লাবণ্যকে। লাবণ্য তার রঙিন শাড়ির আঁচল বিছিয়ে চুপচাপ বসে থাকে শান্ত এক দিঘির মতো। লাবণ্য সত্যিই যেন নারীজাতির এক আদর্শ।

শুধু সেই একদিনই নয়, হেডমাস্টারমশাই মাঝেমাঝে পড়ানোর অবকাশে হঠাৎ বলত লাগলেন, মেয়েদের সম্মান করবে, মায়ের মতো ভাবতে শিখবে। যদি কখনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে হয় তবে কথা বলার সময় তাকিয়ে থাকবে তার পায়ের দিকে।

হেডমাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর ছাত্ররা হাসাহাসি করত নিজেদের মধ্যে। তিনটি মেয়ের কেউ একজন আসছে দেখে চুপিচুপি বলত, ‘এই সর্‌ সর্‌, মা আসছেন!’ কেউ পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার পর ফিসফিস করত, ‘মায়ের চলনটি ভারী সুন্দর’।

অবিনাশ, অশোকদের মতো ফচকেরা কিন্তু হেডস্যারের এই জ্ঞানদান ভালো মনে মেনে নিতে পারল না! অশোক বলল, হুঃ হেডস্যার নিজে কী করেছেন? সাত-সাতটা বাচ্চা পয়দা করেছেন! এটা কি ওঁর উচিত হয়েছে! দুটো হয়, বড়ো জোর তিনটে হয়, আর উনি কিনা সাতটা বাচ্চা বানিয়েছেন!

দিলীপ একটু ভালো ছেলে টাইপের, বলল, তা উনি কী করবেন? ভগবান যদি ওঁকে সাতটা বাচ্চা দেন, তা ওঁর কী করার আছে!

অশোক বড়ো বড়ো চোখ করে তাকায়, বলে, ওঁর কী করার আছে মানে! উনি রাত জেগে ওই কাজটা না করলে কি অমনি অমনি বাচ্চা হয়!’

‘ওই কাজ’ শব্দটা তখন সবে চালু হয়েছে ছাত্রদের মধ্যে। ক্লাস টেনে ওঠার পর ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয়েছে জানবৃক্ষের আপেল খাওয়া। প্র‌থম-প্র‌থম কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি ব্যাপারটা। মেয়েদের দিকে কী জানি কেন সব ছেলেদেরই একটা আকর্ষণ তৈরি হয় বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। সেই আকর্ষণটা আসলে কীসের জন্য তা পরিষ্কার হত না কারও কাছে। মেয়েরা দেখতে সুন্দর হয় বলে! মেয়েরা বেশি সাজগোজ করে থাকে বলে! মেয়েদের গা-হাত-পা অনেক নরম হয় বলে!

একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বা কোনও বাড়ির উঠোনে মেয়েদের দিকে একবার চোখ পড়লে কেন দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে হয় তা নিয়ে জোর আলোচনা হত ছাত্রদের মধ্যে। কিন্তু ক্লাস টেনে ওঠার পর একদিন সসীমই প্র‌থম বলল আমাকে, জানিস, এই এই ব্যাপার!

আমি অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললাম, যাহ্‌, তুই খুব অসভ্য।

না রে, পৃথিবীর সব নারী-পুরুষই এরকম অসভ্য কাজ করে, তার পরেই বাচ্চা আসে মেয়েদের পেটে। তুইও বিয়ে হলে এরকম অসভ্য কাজ করবি।

আমি জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলি, ধুর, এসব পারা যায় নাকি? আমি এরকম অসভ্য হতে পারবই না! তুই কাউকে এসব আর বলবিনে। তোকে সবাই অসভ্য ছেলে ভাববে।

সসীম শব্দ করে হেসে ওঠে।

ক-দিন ধরে আলোচনা চলতে থাকে হেডমাস্টারমশাইয়ের মতো মানুষ কী করে সাতটা বাচ্চা করতে পারলেন!

দিলীপের কথা শুনে অশোক হাসতে শুরু করল খ্যাক খ্যাক করে, কী বিশ্রীভাবে। বলল, হেডমাস্টারমশাই আমাদের সারাক্ষণ জ্ঞান দিয়ে যান স্বামী বিবেকানন্দ হতে। এদিকে নিজে বছরের পর বছর এই অসভ্য কাজটা করে গিয়েছেন বউয়ের সঙ্গে।

দিলীপ প্র‌বলভাবে ঘাড় নেড়ে লড়ে যাচ্ছে অশোকের সঙ্গে, বলল, হেডমাস্টারমশাইয়ের আর দোষ কী! বিয়ের পর একবার হয়তো সেই অসভ্য কাজটা করেছিলেন, তারপর থেকেই বছর বছর বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে।

ধুর পাঁঠা, তাই আবার হয় নাকি? প্র‌ত্যেকবার বাচ্চা হওয়ার আগে ওই সব—

দিলীপ এবার রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করে, যাওয়ার আগে বলে গেল, মোটেই না, বিয়ের পর প্র‌থম-প্র‌থম হয়তো ওসব করে, তারপর নিশ্চয় অসভ্য কাজ আর করে না! আমার বাবা-মা মোটেই এত অসভ্য না। তুই একটা বাজে ছেলে বলেই এরকম যা-তা বলছিস!

দিলীপ চলে গেলে হা হা করে হাসতে থাকে অশোক, বলল, দিলীপ এত ক্ষেপে গেল কেন রে?

সসীম যে-পাড়ায় বাস করে, দিলীপ থাকে সেখানেই। সসীম রাখে তার বাড়ির খবর, হাসতে হাসতে বলল, দিলীপরা এগোরোটা ভাইবোন, তাই বোধহয়।

শুনে হেসে ওঠে বাকিরাও। বিষয়টা আমার মনে বিরূপ প্র‌তিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এত সব আলোচনা মনে হয় অবাস্তব, অসভ্য। মেয়েদের দিকে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে থাকাটা আমার কাছে অস্বস্তিকর শুধু নয়, বাজে ছেলেদের কাজ বলে মনে হয়।

আমি বরাবরই একটু ভীত ধরনের, পাছে হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে অভিযোগ করে মেয়েরা, তাই অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে তাকিয়ে থাকতাম কখনও আকাশের দিকে, কখনও সবুজ গাছগাছালির দিকে। ভুলেও মেয়েদের মুখের দিকে নয়। নিমাই যখন বলত, ‘দেখেছিস করবী কী সুন্দর গাঢ় হলুদ রঙের একটা স্কার্ট পরে এসেছে! হেবিব লাগছে রে!’ আমি একঝলক স্কার্টের রং পরখ করেই ফিরিয়ে নিতাম চোখ। মণিময় হয়তো বলল, ‘রিমা চুলের স্টাইল যেমন একটু আধুনিক করার চেষ্টা করে, তেমনই রকমারি তার চুলের কারুকাজ, আবার হাঁটার ভঙ্গিমায় আনতে চেষ্টা করে অতিরিক্ত স্মার্টনেশ।’ আমি একঝলক তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করি কী কারুকাজ আজ তার ফাঁপানো খোঁপায়! অবিনাশ হয়তো ফিসফিস করে বলল, ‘লাবণ্যর শাড়ির রং দেখেছিস? কী জেল্লা দিচ্ছে মাইরি!’ লাবণ্যর নাম শুনে আরও সতর্ক হয়ে যাই। লাবণ্য যদি বুঝতে পারে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি বা তার শাড়ির রং দেখছি, হয়তো হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে কমপ্লেন করে দেবে আমার নামে, তখন তো সাড়ে সর্বনাশ!

কিন্তু অবিনাশ নাছোড়, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বলল, রামধনু শাড়ি কখনও দেখেছিস? মাদারিপুরে এরকম শাড়ি কেউ কখনও পরেনি! সাতটা রং ফুটে বেরচ্ছে শাড়ির খোল থেকে।

এরপর আর না তাকিয়ে থাকা যায়! আমি খুব দ্রুত প্র‌থমে লাবণ্যর মুখের দিকে, পরক্ষণে তার শাড়ির দিকে চাইতে যাব, হঠাৎ দেখি কি লাবণ্য তাকিয়ে আছে আমারই দিকে! এরকম বমাল ধরা পড়ে যেতে আমি খুব ঘাবড়ে যাই! লাবণ্য দেখল আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি, এরকম তাকিয়ে দেখাটা খুবই অন্যায়, অন্তত আমাদের হেডমাস্টারমশাই যেরকম বলেন, তাঁর নিরিখে মেয়েদের দিকে ছেলেদের তাকানোটাই নিষেধ, সেখানে আমি—

লাবণ্যর শাড়ির রং দেখা মাথায় উঠল, আমি চোখ ফিরিয়ে দেখতে চেষ্টা করছি জানালার বাইরে আকাশের রং কতটা নীল, সামনের শিরীষ গাছটার ডালে কোনও টিয়াপাখি ঘুরছে কি ঘুরছে না!

টিফিনের ঘণ্টা বেজে উঠলে যেইমাত্র লাবণ্যরা তিনজনে বেরিয়ে গেল স্যারের পিছু পিছু, অমনি আমি রেগে যাই অবিনাশের উপর, বলি, তুই বললি বলে আমি লাবণ্যর দিকে তাকালাম, আর ও যে দেখে ফেলল আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখছি! এখন কী হবে? যদি ও ওর বাবাকে গিয়ে বলে যে—

অবিনাশ হেসে বাঁচে না, বলল, তুই যে তাকিয়েছিস তা ও জানবে কী করে?

বলি, কেন, ওর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হল যে!

অবিনাশ হাসতে থাকে, তার মানে তুই যেমন ওর দিকে তাকিয়েছিস, তার আগে ও-ও তোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। ঠিক কি না?

আমি বুঝতে চেষ্টা করি বিষয়টা।

তাহলে ওর দিকে তাকিয়ে তুই যদি অপরাধ করে থাকিস, তার আগে ও-ই তোর দিকে তাকিয়ে সেম অপরাধ করেছে! বল, করেছে কি না! যে আগে তাকিয়েছে তার অপরাধ বেশি।

আমি থতমত খেয়ে ভাবতে থাকি লাবণ্যর অপরাধ বেশি কি না!

শোন, তুই ক্লাসের ফার্স্টবয়, তুই ওদের দিকে না-তাকালেও ওরা তিনজনেই তোর দিকে মাঝেমধ্যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখে। আমরা তো রোজ দেখি।

আমি বিস্ময়ের চরমে, বলি, তাই নাকি?

তুই তো এসব বিষয়ে বোকা-হাবলা। সারাক্ষণ বইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে থাকিস। ক্লাসের ফার্স্টবয়ের একটা ভ্যালু আছে না! আমি যদি ফার্স্টবয় হতাম না, তাহলে তিনজনই আমার প্রে‌মে হাবুডুবু খেত, দেখতিস?

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই, তিনজনে একসঙ্গে?

অবিনাশ হাসে, বলে, তিনজনের সঙ্গেই, কিন্তু কেউ কারও খবর রাখবে না। একে অন্যেরটা জানতে পারবে না!

প্র‌থমে একটু অবাক হই, তারপর ব্যাপারটা খুব খারাপ মনে হয়, বললাম, না, এটা খুব খারাপ।

অবিনাশ হাসতে হাসতে চলে যায় সেখান থেকে।

অবিনাশ আমার মধ্যে কয়েক চামচ বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেল, কেন না যে মুহূর্তে আমি জেনে গেলাম করবী লাবণ্য আর রিমা আমার দিকে মাঝে মধ্যে চোরাচোখে তাকায়, আমারও সারাদিনে বেশ কয়েকবার চোখ চলে যাচ্ছিল তাদের দিকে। আর কী আশ্চর্য, প্র‌তিবারই দেখি তিনজনের কেউ না কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি যেই না তাদের দিকে চোখ রাখি, অমনি তারা এক ঝটকায় অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয় মুখ।

আমি বেশ পুলকিত হই তাদের এই চকিতে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায়, অর্থাৎ তারা যে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, আর আমার চোখে ধরা পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অপরাধী মনে করে চোখ সরিয়ে নেয় দ্রুত, এটা বেশ মজার বলে মনে হয় আমার। সমস্যা হচ্ছে তিনজনেই তাকায় আমার দিকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একটু অন্য চোখে তাকাচ্ছে কি না বুঝে উঠতে পারি না!

আমার দৌড় ওই পর্যন্তই। তাকানো, ধরা পড়ে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া, ব্যস।

কিন্তু ছাত্রদের অনেকেই আর ওদের দিকে তাকাতাকি করেই সন্তুষ্ট থাকতে চাইল না, আরও এক ধাপ এগোতে চাইল। ক্লাস নাইনের মেয়েরা যেখানে বসে, তার ঠিক পিছনেই বসে ক্লাস টেনের ছেলেরা। দুটি ক্লাসের মধ্যে একটি টিন-নির্মিত প্র‌তিবন্ধক আছে ঠিকই, কিন্তু প্রে‌মপত্র পাচার হওয়ার পক্ষে সেই বাধা আর বাধা রইল না। ক্লাস টেনের অবিনাশ দুটি ক্লাসের প্র‌তিবন্ধকতার মধ্যে একটি ছোট্ট ঘুলঘুলি আবিষ্কার করে তার মধ্য দিয়ে প্রে‌মমিশ্রিত চিরকুট গলিয়ে দিতে পারঙ্গম হয়ে গেল। বেশ চলছিল এই প্রে‌মপর্ব, হঠাৎ অবিনাশ ও ক্লাস নাইনের চিত্রার মধ্যে চালাচালি হওয়া সেই চিরকুট একদিন বিট্রে করে লুট হয়ে গেল ক্লাস নাইনের এক ছাত্রের হাতে।

ক্লাস নাইনের ছাত্র সেদিনই ইংরেজি বইয়ের সেই সেলফিস জায়েন্টের মতো একটা কাগজ রেখে গেল ক্লাস টেনের টেবিলে, তাতে লেখা, ট্রেসপাসার্স উইল বি প্রোসিকিউটেড।

অবিনাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ক্লাস নাইনের লিলিপুট প্রে‌মিকদের কী স্পর্ধা!

তার সঙ্গে আরও এক প্র‌লয়ঙ্কর কেলেঙ্কারি বাধিয়ে দিল আমাদের ক্লাসের অশোক। করবীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে লাইন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় একদিন টিফিন পিরিয়ডে সিগারেট ধরাল বেশ আয়েশ করে। তার লক্ষ্য তখন সিগারেট খাওয়া নয়, করবী-লাবণ্য-রিমাদের রেখে যাওয়া বইয়ের ব্যাগগুলো। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মুখের ভিতর ভরে ফেলল কয়েক মুঠো ধোয়া। তারপর করবীর ব্যাগের চেন খুলে তার ভিতর ভরে দিলে সেই ধোঁয়ার রাশি।

টিফিন পিরিয়ড শেষ হতে যথারীতি স্যারের পিছু পিছু ক্লাসে প্র‌বেশ করল তিন কন্যা। বেঞ্চির প্র‌থমে করবী, তারপর লাবণ্য, শেষে রিমা। স্যার পড়ানো শুরু করতে তিনজনে যার-যার ব্যাগ খুলে বইখাতা বার করল, কিন্তু বাকি দুজনের ব্যাগ থেকে বইখাতা বের হলেও করবীর ব্যাগ থেকে গলগল করে বেরতে শুরু করল কারখানার চিমনির মতো ধোঁয়া।

সেই দৃশ্য দেখে করবী প্র‌থমে লাফিয়ে উঠল ভয়ে যেন বা তার ব্যাগে আগুন ধরে গেছে এখনই ডাকতে হবে ফায়ার বির‌গেডের ইঞ্জিন। পরক্ষণে গভীর করে শ্বাস টেনে উপলব্ধি করলে ধোঁয়াটা আসলে ঠিক কী, সঙ্গে সঙ্গে ওয়াক শব্দ করে বোঝাতে চাইল সেই ধোঁয়ার গন্ধে বমির উদ্রেক হয়েছে তার, অতঃপর তার ফরসা দুই মুখে সঞ্চার হল গাঢ় রক্তের প্র‌লেপ, দুই চক্ষুতে তখন যেন সত্যিই অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেছে এমন ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে বলল, স্যার, আমরা কি নরকে পড়তে এসেছি!

ইতিহাস স্যার তখন নিমগ্ন হয়ে বোঝাচ্ছিলেন ঔরঙ্গজেবের নৃশংসতা। তাঁর বক্তিতায় ব্যাঘাত ঘটলে পড়ানো থামিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন করবীর দিকে। ঠিক কী হয়েছে তা বুঝতে সময় নিলেন কয়েক মিনিট। বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম হতে তাঁরও দুই চোখ থেকে নির্গত হতে শুরু করল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, মুঘল সম্র‌াটের নিষ্ঠুরতার বিবরণ দিতে গিয়ে তাঁর নিজের দুই চোখে আগেই দপদপ করছিল এক ধরনের ক্রোধ, সেই ক্রোধ উদ্‌গীরণ করতে চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন গরুর কাজ? কাদের গোয়ালে থাকে?

গরু বলে যাকে চিহ্নিত করলেন সেই ছাত্রটি তখন নির্বিকার ভঙ্গিতে দৃষ্টি স্থাপিত করেছে স্যারের তীবর‌ দুই চোখের দিকে, কিন্তু বেশিক্ষণ নির্বিকার থাকতে পারল না বলে দৃষ্টি নামিয়ে বিদ্ধ করতে লাগল তার সামনে মেলে ধরা বইয়ের পৃষ্ঠায়।

ইতিহাস স্যার আরও বার দুই একই ভঙ্গিতে গর্জন করার পরেও গরুটি হাম্বা রব করল না দেখে স্যার বললেন, কে দেখেছ এই জঘন্য কাজটা করতে? কার কাজ এটা?

তখনও সবাই নিশ্চুপ দেখে হঠাৎ তাকালেন আমার দিকে, তুই দেখেছিস কে এই কাজটা করেছে?

ক্লাসে ফার্স্ট বয় হওয়ার অনেক পজিটিভ দিক থাকলেও, তার নেগেটিভ দিকও কম নয়! আমি মিথ্যা বলব না জেনে বিষয়টার সত্যতা জানতে আমাকেই দাঁড় করালেন সাক্ষীর কাঠগড়ায়।

আমি তখন প্র‌বল সংশয়ে দোদুল্যমান। অশোকের নাম বললে পরে কোনও এক সময় স্কুলের বাইরে সে আমাকে পাঁড়প্যাঁদানি দেবে নির্ঘাত। আর না বললে স্যারের চোখে হয়ে যাব মিথ্যুক। আমি তখন ভিতরে ভিতরে কাঁপছি, হঠাৎ মাথায় এসে গেল এক অকাট্য যুক্তি, বললাম, স্যার, টিফিন পিরিয়ডে আমি ক্লাসে ছিলাম না। জল খেতে গিয়েছিলাম কলতলায়।

ইতিহাস স্যার তক্ষুণি মেনে নিলেন আমার কথা। তাঁর কণ্ঠস্বরে তখন বরফশীতল স্তব্ধতা, বললেন, তাহলে আমাকে গোয়েন্দা হতে হয়। আমি ঠিকই ধরে ফেলব কে এই অপরাধী। স্কুল-লাইফে সিগারেট খাওয়া মানে পাপ। পাপ কখনও চাপা থাকে না। বলে আমার উপরই দায়িত্ব দিলেন কালপ্রি‌ট কে তা নির্ধারণ করতে।

বললেন, অঙ্কুশ, তুমি তোমার প্র‌ত্যেক সহপাঠীর সামনে গিয়ে দাঁড়াও। প্র‌ত্যেকেই হাঁ করে থাকবে। তুমি নিশ্চয় সিগারেটের গন্ধ পাবে তার মুখে। কার মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বেরচ্ছে বলো।

আমি তখন বেজায় ফাঁপরে। ক্লাসে উপস্থিত চল্লিশজন ছাত্র, তাদের প্র‌ত্যেকের মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো, সেই গন্ধ শোঁকা, সে এক বিদঘুটে কাণ্ড। তাছাড়া আমি জানি কার মুখ থেকে এই গন্ধ বেরোবে। তখন আর মিথ্যে বলার কোনও সুযোগ থাকবে না!

স্যারের কথার অমান্য করা চলবে না! প্র‌থমেই দিলীপের মুখের সামনে নাক নিয়ে যেতেই আমি ওয়াক শব্দ করে বোঝালাম গন্ধে বমি পাচ্ছে আমার।

আমি জানতাম গাঁয়ের ছেলেদের মুখ থেকে তো আর ভালো গন্ধ বেরবে না! অনেকে ভালো করে দাঁতই মাজে না, দুর্গন্ধ বেরোবেই। অতএব—

ইতিহাস স্যার আমার কাঁচুমাচু মুখ দেখে বোধহয় বিষয়টা উপলব্ধি করলেন, বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমি হেডমাস্টারমশাইকে সব বলছি।

বলে ক্লাস শেষ না করেই টেবিলের উপর রাখা চক আর ডাস্টার তুলে নিয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন হেডমাস্টারমশাইয়ের চেম্বারের উদ্দেশে।

তাঁর রিপোর্টিং-এর যা ফলাফল হল তা আমাদের প্র‌ত্যেকের বুকে শেলবিদ্ধ হওয়ার মতো। পরদিন ক্লাসে এসে অপেক্ষা করছি তিন কন্যার উপস্থিতির জন্য, কোথায় সেই ফ্রক আর শাড়ির বাহার! কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার ঘণ্টা বেজে গেল, প্র‌থম ক্লাস অঙ্কের স্যারের, তিনি এলেন, বোর্ডে অঙ্ক কষানো শুরু করে দিলেন, কিন্তু করবী-লাবণ্য-রিমার দেখা নেই। স্যারও কিছু বললেন না, শুধু অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে রইলেন সারাটাক্ষণ।

আমরা বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম ক্লাস নাইনের মেয়েরা ক্লাসে এসেছে, তাদের জন্য বোধহয় আরও অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা, কিন্তু ক্লাস টেন যেন অকস্মাৎ বেরঙা।

ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টাও বেজে গেল, স্যার যাওয়ার জন্য প্র‌স্তুত হয়ে তুলে নিলেন চক আর ডাস্টার, বেরোনোর আগের মুহূর্তে বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ তো স্কুলে পড়তে আসো না, বাঁদরামি করতে আসো। তার ফলে মেয়েগুলোর পড়াই বন্ধ হয়ে গেল। হেডমাস্টারমশাই বলেছেন ক্লাস টেনের মেয়েদের আর কাউকে স্কুলে আসতে হবে না। তারা বাকি পড়া বাড়িতেই পড়ে সোজা টেস্ট দিতে আসবে। তাও তাদের পরীক্ষা হবে টিচার্স রুমের পাশের ঘরে যাতে বাঁদরদের মুখ আর তাদের না দেখতে হয়!

অতঃপর ক্লাস টেনের ছাত্রদের বুক থেকে নির্গত হল সমবেত দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের ধাক্কা খেলে বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের বের‌কার আরও সপাটে পড়ত নির্ঘাত। স্যার চলে যাওয়ার পর সবাই মিলে দু মিনিটের নীরবতা পালন। স্কুলজীবনে যাও বা কেউ কেউ রোমান্সের ফুল ফোটাতে শুরু করেছিল সেই অ্যাডভেঞ্চারের সমাপ্তি ঘটল সেদিন থেকে।

ক্লাস টেনের ছাত্রদের জীবন এমন মরুভূমি হয়ে যাওয়ায় বাকি সবার রাগ তখন বর্ষিত হতে লাগল অশোকের উপর। অশোকও হঠাৎ তার অবিমৃশ্যকারিতার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে গম্ভীর হয়ে রইল বাকি ক-দিন। ততদিনে ডিসেম্বর মাস পার, টেস্ট পরীক্ষা নির্বিঘ্নে হয়ে যাওয়ায় স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগও হয়ে উঠল ক্ষীণ।

বাকি তিনমাস রুদ্ধশ্বাস পড়ার মধ্যে করবী-লাবণ্য-রিমারা স্মৃতি থেকে ভ্যানিস। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে উচ্চ শিক্ষার্থে কলিকাতা গমন করিলে মাদারিপুরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি।

তারপর অনেকদিন মাদারিপুরের খবর আর পাওয়া যায়নি। আমি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে চাকরির চেষ্টা করছি, সেসময় মাদারিপুরে আসার সৌভাগ্য হয়ে গেল একদিন। ফেলে যাওয়া শৈশব- কৈশোরের দিনগুলির স্বাদ পেতে ক্লাসের অনেক বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ করে ফেলি। সসীম ছিল কলকাতায়, তাকেও চিঠি লিখে আসতে বলি মাদারিপুরে। একদিন বিকেলে এক ক্লাবঘরের সামনে দেখা হয়ে যায় অনেকের সঙ্গে। ঘাসের উপর গোল হয়ে বসি। তারপর যা হয় এতদিন পরে দেখা হওয়ার ফলে সবার ভিতরেই উপচে পড়ে একরাশ উচ্ছবাস। সসীমও চিঠির গুরুত্ব দিয়ে হাজির হয়েছে সবার সঙ্গে রি-ইউনিয়নে। অশোক এখন কোথায় থাকে তা কেউ জানে না, তবে দিলীপ, মণিময়, অবিনাশ, তিমির সবাই হাজির। কথা শুরু হতে না হতেই করবী-লাবণ্য-রিমার খবরই নিতে চাইল সবাই।

আমরা শুনেছিলাম হেডমাস্টারমশাই বছর দুয়েক আগে অবসর নিয়েছেন, এখন স্কুলে এসেছেন নতুন একজন, রণদেব মিত্র।

কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমাদের কারও আগ্র‌হ নেই। আমরা বলাবলি করছিলাম আমাদের হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে গেলে কেমন হয়! কেমন আছেন অবসরের পর! তাঁর সেই গম্ভীর ব্যক্তিত্বে এখন চিড় ধরেছে কি না!

সসীম মুচকি হেসে বলল, শুধু হেডমাস্টারমশাইকে দেখতেই যাবি?

যে-উদ্দেশ্যটা মনে মনে ছিল তা ঝেড়েই কাশল সসীম। এখন অবশ্য তাঁর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্য তাঁর স্ত্রীকে দেখার জন্য নয়, তাঁর কন্যা লাবণ্য এখন কেমন আছে, তাকে কেমন দেখতে হয়েছে সেটাই লক্ষ্য।

সসীম বলল, দ্যাখ, হয়তো এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে তার!

তখনও নিমাই এসে পৌঁছয়নি আড্ডায়, সে এল একটু পরেই। নিমাই এখন এখানেই একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে, তাই মাদারিপুরের খবরাখবর তারই মাধ্যমে জানা গেল বেশি। দু-চার কথাবার্তার পর এমন একটি বোম ফাটাল যার জন্য কেউই প্র‌স্তুত ছিলাম না আমরা। হঠাৎ কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, জানিস, হেডমাস্টারমশাইয়ের আবার একটা মেয়ে হয়েছে।

আবার?

ঘটনাটা এমনই অবিশ্বাস্য, সেই সঙ্গে কৌতুকরও যে, একসঙ্গে সব ক-টি কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হল ‘আবার’ শব্দটা।

সসীম জিজ্ঞাসা করল, সে আবার কী! কত বয়স হল ওঁর?

হিসাবটা আমরা সবাই-ই করছিলাম মনে মনে, নিমাই একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর দেওয়ার মতো বলল, পঁয়ষট্টি।

পঁ—য়ষট্টি! আবার সমস্বরে চিৎকার।

অবিনাশ এবার রসনার খোরাক পেয়ে গেছে, তার অভিব্যক্তি চকচক করছে এক অভাবনীয় প্র‌াপ্তিতে, বলল, কী মাজার জোর রে! পঁয়ষট্টিতে বাচ্চা পয়দা করেছে!

সসীম মজা করে বলল, করবেন না কেন? এরকম সুন্দরী বউ পেলে তোরও পঁয়ষট্টিতে বাচ্চা হবে! যা সোনার খনি!

আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ছিলাম বিষয়টি নিয়ে এরকম রগড় করতে দেখে। দিলীপ বরাবরই ভালোমানুষ টাইপের, ক্লাস টেনে থাকতে বলেছিল, ‘তা হেডস্যার আর কী করবেন? ভগবান যদি বাচ্চা দেন বছর-বছর’, এখন বিষয়টা বোঝার মতো বয়সে পৌঁছেছে, বলল, মাদারিপুরে কিন্তু এ নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে!

তখন সন্ধে হয়ে আসছে, অন্ধকারের গুঁড়ো নেমে আসছে একটু একটু করে, মাথার উপরে উড়ে উড়ে যাচ্ছে ঘরে ফেরা পাখি। সেই আধো-আলো আধো-অন্ধকারের পটভূমিতে বসে কয়েকজন যুবক গুনগুন করে আলোচনা করছিল হেডমাস্টারমশাইয়ের একদা মুখ-নিঃসৃত বাক্যগুলি। তিনি তাদের বলেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠতে, এতদিনে তারা স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠে তাঁর উদ্দেশে বলতে চাইছিল তাঁরই কথাগুলি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *