একটি মহিরুহের জন্ম

একটি মহিরুহের জন্ম

প্র‌তিযোগিতার বিষয়টি অভিনব বলেই রাজি হয়েছিলেন রতনবাবু। তিনি নিজে ছোটোদের গল্প-কবিতা লেখেন, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে নির্মাণ করেন ছোটোদের অবাক পৃথিবী, লেখার প্র‌তিটি মুহূর্তে মানসপটে ঘোরাফেরা করে সেই কচিকচি সুন্দর মুখগুলো, তাই ‘অভিযান’ ক্লাবের সমর দে যখন জানালেন, ‘আপনারা তো ছোটোদের জন্য লেখেন, সেই ছোটোরাই যদি লেখক হতে চায়, তাহলে নিশ্চয় তাদের উৎসাহ দেবেন আপনারা!’ রতনবাবু তিলমাত্র দ্বিধা না করে সায় দিয়ে বলেছিলেন, নিশ্চয়।

সে-কারণেই তিন ঘণ্টার ট্রেনজার্নি করে সাতসকালে চলে এসেছেন এত দূরে। শীতের দিন বলে ট্রেনের কামরার ওম আর দুলুনি খুবই উপভোগ্য। সঙ্গে আর এক অগ্র‌জ সাহিত্যিক কার্তিকবাবুও আছেন, ফলে শালটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, ট্রেনের ওমের মধ্যে গল্পে-গল্পে কেটে গেল বেশ। যদিও নিজেরা বলাবলি করছিলেন সব শিশুই কি আর সাহিত্য রচনা করতে পারে! তবু তাদের মধ্যে দু-একজনও যদি উতরে দিতে পারে একটা গল্প, তাই বা কম কীসের!

জেলাশহরটিতে পৌঁছে সার্কিট হাউসে দুপুরের খাওয়া সেরে বিকেলে গেলেন প্র‌তিযোগিতার নির্দিষ্ট হলটিতে, গিয়ে দেখলেন সে এক এলাহি কাণ্ড! প্র‌ায় পঞ্চাশজন শিশু ও কিশোর সেজেগুজে এসে ভর্তি করে ফেলেছে স্থানীয় গ্র‌ন্থাগারের প্রে‌ক্ষাগৃহ। সঙ্গে তাদের বাবা-মা, অভিভাবক-অভিভাবিকারা। তাঁরাও তাঁদের বাড়ির ছোটোদের প্র‌তিভা বিষয়ে খুবই আশাবাদী। সঙ্গে এসেছেন শুধু নয়, তাদের জন্য গুছিয়ে নিয়ে এসেছেন টিফিন ও জলের বোতল। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে তাদের কানের কাছে বলে দিচ্ছেন কিছু টিপস, হয়তো গল্প লেখার কিছু সূত্র।

বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ছোটো ছোটো চারাগাছ। মৃদু হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাদের চুলের রাশি।

তাদেরই মধ্যে হালকা সবুজ চুড়িদার পরা একটি কিশোরী তার হাত ধরে থাকা এক বালকের কানে কানে কিছু বলছে, আর ইশারা করে দেখাচ্ছে রতনবাবুর দিকে। রতনবাবু আড় চোখে দৃশ্যটি দেখে কিছু আঁচ করতে চাইলেন।

কিশোরীটিকে দেখে কেন যেন মনে ধরে গেল রতনবাবুর এই চারাগাছটি যেন বড়ো হয়ে গেছে একটু।

এই অভিনব প্র‌তিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে ছোটোরা অনেকেই রীতিমতো সিরিয়াস। কারও মুখে উজ্জ্বল আভা, কারও মুখে অপার কৌতূহল, কেউ নিতান্ত নিরীহ মুখে দেখছে কর্তাব্যক্তিদের কাণ্ডকারখানা, কারও বা মুখ শুকিয়ে গেছে প্র‌তিযোগিতায় স্থান পাবে কি পাবে না এই ভেবে।

আবার কোনও বাচ্চা দেখে নিচ্ছে পেনের নিবে কালি আছে কি না, কেউ প্যান্টের ভিতর শার্ট গুঁজে ঠিকঠাক করে নিচ্ছে তাদের পোশাক, এক মহিলা চিরুনি দিয়ে আলবোট কেটে দিচ্ছে তাঁর পুত্রের, কোনও বালক পাট পাট করে রাখছে শার্টের কলার, এক বালিকা তার লম্বা চুলের বেণিটা ঠিক করে নিচ্ছে, কেউ ঠিক করে নিচ্ছে স্কার্টের ফির‌ল, কেউ গুছিয়ে নিচ্ছে স্টেপ-কাট চুলে বাঁধা রঙিন রিবন।

কোনও কোনও মায়েরা অতি-উৎসাহী হয়ে এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইছন গল্প লেখার পরীক্ষায় হাতের লেখার জন্য কোনও নম্বর আছে কি না!

কর্মকর্তা বিব্রত মুখে বললেন, দাঁড়ান, রতনবাবুকে জিজ্ঞাসা করে দেখি। উনিই তো খাতা দেখবেন।

হালকা সবুজ চুড়িদার পরা কিশোরী খুবই কৌতূহলী চোখে ঘোরাফেরা করছে এখানে-ওখানে, আর বারবার তাকাচ্ছে রতনবাবুর দিকে। মেয়েটির তাকানো লক্ষ করে রতনবাবু ভাবছিলেন মেয়েটি তাঁকে হয়তো দেখেছে কখনও। অন্তত মেয়েটির কৌতূহলী চোখ দেখে তাঁর এরকম ধারণা।

প্রে‌ক্ষাগৃহের চেয়ারগুলি উপচে গেল একটু পরেই, এমনকী কয়েকজন অভিভাবক বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন পিছনদিকে। পূর্ণ প্রে‌ক্ষাগৃহে তখন সমর দে ঘোষণা করলেন প্র‌তিযোগিতা শুরু হচ্ছে এখনই, যে সব প্র‌তিযোগী এখনও কাগজ-কলম হাতে পায়নি তারা যেন সেগুলি নিয়ে প্র‌স্তুত হয়। শিশুসাহিত্যিক রতনবাবু একটি গল্পের অর্ধেক বলবেন প্র‌তিযোগীদের কাছে, প্র‌তিযোগীদের লিখতে হবে গল্পের বাকি অর্ধেক।

ঘোষণা শুনে প্রে‌ক্ষাগৃহে সামান্য গুঞ্জন, কেন না কেউ ভেবেছিল হয়তো গল্পের বিষয় বলে দেওয়া হবে, লিখতে হবে পুরো গল্পটাই। কিংবা কোনও ছবি টাঙানো হবে দেওয়ালে, সেই ছবি দেখে লিখতে হবে গল্প। কিন্তু তাদের ধারণার সঙ্গে মেলেনি প্র‌তিযোগিতার বিষয়।

এখনকার বাচ্চারা এত ধরনের প্র‌তিযোগিতায় অবতীর্ণ হয় যে, কোনও কাজেই তারা পিছপা হয় না। চেয়ারে পাশাপাশি বসে তারা প্র‌স্তুত হয় কাগজ ও কলম বাগিয়ে, আর রতনবাবু বলতে শুরু করলেন গল্পের মুড়োর অংশটি।

রতনবাবুর গল্প বলার ভঙ্গিটিও বেশ। তিনি বলছিলেন দুই গাঁয়ের ছাত্রদের মধ্যে অনুষ্ঠিত একটি ফুটবল খেলার ফলাফল নিয়ে। ‘ক’ গাঁয়ের ছেলেরা প্র‌থম থেকেই জিতছিল এক গোলে, খেলা শেষ হতে যখন মাত্র তিরিশ সেকেন্ড বাকি, সবাই নিশ্চিত তারা জিতেই গেছে, সেসময় বাঁশি বাজার ঠিক আগের মুহূর্তে ‘খ’ দলের স্ট্রাইকার হঠাৎ গোল শোধ করে দিতে তুমুল হইহই। রেফারি যখন এক্সটা টাইম খেলাবেন বলে বাঁশি বাজাতে যাবেন ‘খ’ দলের স্ট্রাইকার রেফারির কাছে গিয়ে বলল, গোলটা সে করেছে ঠিকই, কিন্তু বল পায়ে লাগার ঠিক পরেই বলটা লেগেছিল তার হাতে। ওটা হ্যান্ডবল।

খুদে প্র‌তিযোগীরা যখন উদ্‌গ্র‌ীব হয়ে বাকি গল্পটা শুনবে বলে প্র‌স্তুত হচ্ছে, সেখানেই রতনবাবু থেমে গিয়ে বললেন, ঠিক এর পরে কী ঘটতে পারে তা নিয়েই লিখতে হবে গল্পটা।

তিনি চেয়ারে বসার পর কিছুক্ষণ প্রে‌ক্ষাগৃহে পিনপতন নিস্তব্ধতা। প্র‌তিযোগিতায় অংশগ্র‌হণ করতে আসে যে-ছোটোরা তারা সব বিষয়েই ভীষণ গুরুত্ব দেয়। এও তাদের কাছে একটা রিয়ালিটি শো। রতনবাবু দেখছিলেন কচিকচি মুখগুলো ক্রমশ মগ্ন হচ্ছে যার-যার ভাবনার পৃথিবীতে। কল্পনার ডানা ভাসিয়ে দিচ্ছে সেই অ-দেখা ফুটবল মাঠের জটলার মধ্যে। ভাবছে সেই স্ট্রাইকারটির কথা, গোলে বল ঢোকার আগের মুহূর্তে বলটি তার হাতে লেগেছিল কি লাগেনি তা তো রেফারি দেখতে পাননি, শুধু তাই নয়, মাঠের অন্য কেউই দেখতে পায়নি। তার গোলে ‘খ’ দল তো ম্যাচটা ড্র‌-ই করে ফেলেছিল, কিন্তু তার স্বীকারোক্তির ফলে এহেন প্র‌বল প্র‌তিযোগিতামূলক খেলাটায় হয়তো হেরে যেতে হবে তাদের!

গল্পের অর্ধেক লেখার জন্য ছোটোদের সময় দেওয়া হল এক ঘণ্টা। আর কী আশ্চর্য, প্র‌ত্যেকেই দেখা গেল কী অপরিসীম মনোযোগ দিয়ে লিখছে বাকি অর্ধেক গল্প। এই এক ঘণ্টা তাদের কাছে এক হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ক্ষেত্র। কিন্তু এই লড়াই, সৃজনের লড়াই। প্র‌তিটি মুহূর্তই তারা কাটাচ্ছে সৃজনশীলতার মধ্যে। তাদের মস্তিষ্ক বিচরণ করছে সৃষ্টির গভীর গহনে। তাই তাদের মুখগুলোও হয়ে উঠেছে কী সুন্দর আর পবিত্র।

এক ঘণ্টা পরে যখন কর্মকর্তারা নিতে শুরু করলেন লেখাগুলো, তখনও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন প্র‌তিযোগী নিবিষ্ট শেষ কয়েকটি লাইন লিখে ফেলে প্র‌থম হওয়ার তাড়নায়।

সব খাতা নেওয়া হয়ে গেলে সমরবাবু ঘোষণা করলেন গল্পগুলি আজ রাতে খুঁটিয়ে পড়বেন রতনবাবু, তাঁর বিচারই হবে চূড়ান্ত, তারপর কাল সকালে ঘোষণা করা হবে বিচারের ফলাফল।

ছোটোরা তখন স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবছে অন্তত আজ রাতের মতো নিশ্চিন্ত, তাদের অভিভাবকরাও প্র‌স্তুত বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য, সেসময় সমরবাবু মাইকে ঘোষণা করলেন, সবাই আর একটু আমাদের সঙ্গে থাকুন। আমাদের মধ্যে করবী রজক নামে এক কিশোরী উপস্থিত আছে, সে খুব ভালো আবৃত্তি করে। আজ তার প্রি‌য় কবি রতনবাবু এখানে এসেছেন, তার একটি কবিতা সে আবৃত্তি করে শোনাতে চায় কবিকে, সেই সঙ্গে আপনাদের সবাইকে।

করবীকে সবাই চেনে না, অভিভাবকেরা বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে ঘরে ফেরার উদ্যোগ করেছিলেন, হঠাৎ থমকে গিয়ে কেউ কেউ বিরক্তির রেখাও ফুটিয়ে তুললেন মুখে। বাচ্চারা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, এখন ছুটি পেতে হইহল্লা করছিল নিজেদের মধ্যে, তারা কৌতূহলী চোখে তাকাল মঞ্চের দিকে।

করবী নামের কিশোরী তখন মঞ্চে উঠে দাঁড়িয়েছে মাইক্রোফোনের সামনে। তার অভিব্যক্তিতে একই সঙ্গে ঔজ্জ্বল, তন্ময়তা, আত্মবিশ্বাস ও সংশয়। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করল তার কবিতা ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’। রতনবাবু মঞ্চের একদিকে বসে রোমাঞ্চিত হয়ে শুনলেন কিশোরী তার নম্র‌ অথচ প্র‌ত্যয়ী কণ্ঠে বলতে শুরু করেছে তার স্বপ্ন ফেরি করার কথা।

আর কী আশ্চর্য, প্র‌থম পংক্তিটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে হলঘরের কলরব করতে থাকা প্র‌তিটি মানুষ হঠাৎ চুপ করে একাগ্র‌ হল করবীর আবৃত্তির দিকে। বাচ্চারাও চেঁচামেচি ভুলে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সেই মেয়েটির দিকে যাকে এতক্ষণ তেমনভাবে লক্ষ করেনি কেউ।

সমস্ত প্রে‌ক্ষাগৃহে তখন অনুরণিত হচ্ছে কিশোরীর উদ্দীপ্ত কণ্ঠ। তার প্র‌তিটি অক্ষর ধ্বনিত হচ্ছে এক আশ্চর্য দ্যোতনা ছড়িয়ে। পংক্তির শব্দগুলি আরও মাত্রা পাচ্ছে উচ্চারণের চমৎকারিত্বে। একটু আগেই ছুটির আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল যে প্রে‌ক্ষাগৃহ, হঠাৎ কোন মন্ত্রবলে স্তব্ধ হয়ে গেছে প্র‌তিটি প্র‌াণবিন্দু। যে-বাচ্চারা স্বভাবচঞ্চল তারাও এই মুহূর্তে বিস্ফারিতনয়ন।

সেই কিশোরী তখন দুই চোখ বোজা, এক অনন্ত পথ ধরে সে যাত্রা করেছে দুই হাতে গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন ভরিয়ে। উপস্থিত সমস্ত মানুষের কাছে ফেরি করে চলেছে তার স্বপ্নের পশরা। তার শব্দনিক্ষেপণে সেই স্বপ্ন পৌঁছে যাচ্ছে সবার প্র‌াণের মধ্যে।

খুব দীর্ঘ সময় নয় তার এই স্বপ্ন ফেরি করা, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে চলবে তার ফেরিওয়ালা হওয়ার মুহূর্তগুলি। অবশেষে যখন সে থামল, সমস্ত হলঘর থেমে আছে মহাকালের গতিপথে যতি দিয়ে। অতঃপর তার চোখ খুলে গেল, সে তাকিয়ে দেখল তার সামনে স্বপ্ণে ভরপুর মানুষগুলিকে। আর কী আশ্চর্য, তারা যেন হাততালি দিতেও ভুলে গেছে এই মুহূর্তে। অবশেষে যখন ফিরে এল তাদের সংবিৎ, তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রে‌ক্ষাগৃহ। এত দীর্ঘসময় ধরে চলল সেই অভিনন্দন যে সে নিজেই বিস্মিত। সেই শৈশব থেকে তার এই আবৃত্তি করার প্রে‌রণা, কিন্তু এরকম তো কখনও হয়নি! আজ যেন তার উচ্চারণগুলি সম্মোহিত করে ফেলেছে সমবেত শ্রোতাদের।

রতনবাবু নিজেও বিস্মিত হয়ে শুনছিলেন তাঁরই রচিত কবিতা। তাঁরও মনে হচ্ছিল কতজনেই তো এই কবিতা আবৃত্তি করে, কিন্তু এমন তো কখনও হয়নি যখন আবৃত্তিকারের প্র‌তিটি শব্দ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁর হৃদয়ও! তাঁর মনে হচ্ছিল এ কবিতা তাঁর লেখা নয়, কিংবা তাঁরই লেখাটির পুনর্জন্ম হল আরও একবার। অথবা বহু বছর আগেকার লেখাটি পুনর্লিখিত হল আবার।

হাততালি শেষ হলে অভিভূত, আপ্লুত কিশোরী ধীর পায়ে সরে এল মাইক্রোফোনের সামনে থেকে। এক পলক নজর ফেলল রতনবাবুর দিকে। সে বুঝতে পারছে শুধু রতনবাবুই নন, সমস্ত প্রে‌ক্ষাগৃহ এখন তাকেই দেখতে অবাক হয়ে। যেন সবাই তাকে অন্যভাবে আবিষ্কার করল আজ। করবী নামে ছোট্ট চারাগাছটি হঠাৎই মহীরুহ হয়ে গেছে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।

মুক্তোর মতো টলটল করে উঠল দুটি বাঙ্ময় চোখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *