১. প্রথম দিন

পাখিদের শহরে যেমন – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১১

.

সায়েকা, তুতুল, দিদু, মুন, মন, মুনমুন— এইসব
আসলে যার নাম— আমার মামোর জন্য

.

প্রশ্নচিহ্ন। দাঁড়ি নয়, প্রশ্নচিহ্ন দিয়েই আমাদের জীবনটা তৈরি। অন্তত কপিলের তাই মনে হয়। যেদিকে তাকায় সেদিকেই নানা প্রশ্ন দেখতে পায় কপিল। পুরনো বাড়ির পিছনে প্রোমোটারদের মতো, সুন্দরী মেয়ের পিছনে পাড়া-বেপাড়ার ছেলেদের মতো, বসতির পিছনে রাজনৈতিক দাদা-দিদির মতো, প্রশ্নচিহ্নও নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে রয়েছে জীবনের পিছনে। কপিল অবাক হয়ে এই সব ‘হুক আর ডটের’ সারিদের দ্যাখে। দ্যাখে, অত্যাচারী বরের হাতে বেল্টের মার খেয়েও মেয়েটি যত্ন করে সিঁদুর পরছে, ছেলের হাতে চূড়ান্ত অবহেলা পেয়েও মা ভগবানের কাছে তার মঙ্গল প্রার্থনা করছে, মেয়েটি জীবন থেকে ছেলেটিকে নিখুঁতভাবে বাদ দিলেও ছেলেটি যেতে পারছে না অন্য কোথাও, লোকে ভুল ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছেন ফোনে, নীরবতা পালনের সারিতে সবাই হাসছে ফিক-ফিক করে, সবাই কুকুরের সঙ্গে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় কথাই বলছে না! কপিল অবাক হয়ে দ্যাখে, ভিখিরির বাচ্চাটা ফুটপাথে বসে ছেঁড়া পুতুল নিয়ে খেলছে আর হাসছে, হেসেই যাচ্ছে। কেন? কপিল জানে না। মনে হয়, এক সমুদ্র জ্ঞান পড়ে রয়েছে ওর সামনে। তাই প্রশ্ন করে যায় কপিল। বেঁচে থাকা, না-থাকার ফাঁকগুলোতে রেখে যায় ওর প্রশ্নদের আর উত্তরের আশায় উদগ্রীব হয়ে বসে থাকে। উত্তেজনায় গায়ে কাঁটা দেয় কপিলের।

এই এখনও যেমন দিচ্ছে। মাথার উপর দিনের আলোর ছাতা বন্ধ করে আনছে সন্ধে। উঁচুতে, খুব উঁচুতে একটা তারা চকচক করছে। জলের উপর থেকে বয়ে আসছে হাওয়া। এসব কে করছে? কে ওই সামনের আবছা অন্ধকারে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে বসিয়ে রেখেছে? মেয়েটার মাথা ছেলেটার কাঁধে রাখা। ছেলেটাও একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েটার কাঁধ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা কাঁদছে। চারদিকের গাছের খসখসে আওয়াজ আর শেষ আলোয় পাখিদের সারাদিনের কথাবার্তাগুলোর সম্মিলিত কিচিরমিচিরের উপর দিয়েও মেয়েটার ফোঁপানো ভেসে আসছে এদিকে। কপিল জানে মেয়েটা কেন কাঁদছে। জানে, ছেলেটা মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলেও কোনওরকম সান্ত্বনা ও দিতে পারছে না। কপিল জানে, ছেলেটা একটু পরে ওর গলার নীলের উপর সাদা টিপ-টিপ টাইটা খুলে ব্যাগে ঢোকাবে। জলের বোতল বের করে ছিপি খুলে মেয়েটাকে দেবে। জানে, তারপর নিজেই দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকবে। গত মাস-দু’য়েক ধরে তো এসব প্রায় রোজই দেখছে ও।

দু’-একবার হাঁটার ভান করে কথাও শুনেছে ওদের। শুনেছে, ছেলেটা বেসরকারি বিমা সংস্থার হয়ে পলিসি বিক্রি করে, মেয়েটার মুখে ‘সোনা’ ডাক শুনলে ছেলেটার নাকি ভাল লাগায় দম বন্ধ হয়ে আসে, মেয়েটার নাকি বিয়ের কথা চলছে! ছেলেটা এখনও তেমন সুবিধে করতে পারছে না কাজে।

বুড়োবয়সের কৌতূহলে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ওদের নাম কী? বাড়িতে কে আছে? ইচ্ছে করে জানতে, ওরা সত্যি কতটা ভালবাসে একে অপরকে!

তবে ভালবাসা কতটা তা কি আর মাপা যায়? কপিল তো কোনওদিন বুঝতেই পারল না ভাব-ভালবাসা, প্রেম-টেম ব্যাপারগুলো। তাই হয়তো বিয়ে করে উঠতে পারেনি।

কী ভাবছ কপিল? একদলা কফ পাশের ঝোপের দিকে থুঃ করে ছুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল গোপীনাথ।

কপিল বলল, না, ওই সামনের দু’টিকে দেখছিলাম। আচ্ছা গুপিদা, প্রেম ছাড়া কি বিয়ে হয়? ওরা যে এখানে বসে প্রেম করে, ওদের বিয়ে হবে?

গুপি আর একবার থুতু ফেলে শ্বাস নিল একটু। বর্ষাকাল পড়লেও তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। চারদিকে কেমন যেন একটা দমধরা ভাব। পশ্চিম আকাশে মেঘ জমছে। কেব্‌ল-এ দেখছিল আলিপুর আবহাওয়া দফতর থেকে বলা হয়েছে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছে।

কী গুপিদা, কপিল কী জিজ্ঞেস করছে? জগৎ বাঁধানো দাঁতের কিটকিট শব্দ তুলে কনুইয়ের খোঁচা দিল গুপিকে।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাঁড়াও শ্বাস নিই একটু। বুকে কফেরা যেভাবে হরতাল বাঁধিয়েছে না, হাওয়ার কি জো আছে একটুও ঢোকে? তা কপিল কী বলছিলে? বিয়ে হবে কিনা?”

“না, ঠিক তা নয়, কপিল টাকের মধ্যে জেগে থাকা দুর্বল ঘাসের মতো চুলে হাত বোলাল, জিজ্ঞেস করছিলাম প্রেম ছাড়া কি বিয়ে হয়?”

“কেন? এই সত্তর বছর বয়সে প্রেম করার ইচ্ছে হয়েছে না বিয়ের?” গুপি কথা শেষ করে নাক টানল।

“দুর, আমার না, ওই যে সামনের ছেলেমেয়ে দু’টোর।”

“ও, নবকাত্তিক আর শ্রীরাধিকার?” গুপি হাঁপাল একটু, “ওসব ভেবে তোমার কী লাভ? তা ছাড়া ওই দু’টো তো শুধু ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদে। আরে বাবা, অতই যদি দুঃখ, তবে একসঙ্গে আছিস কেন? আর প্রেম ছাড়া বিয়ে? চারদিকে দেদার হচ্ছে। এই যে আমি বিয়ে করেছিলাম। দু’-চার পিস বাচ্চাও নামালাম, তারপরেও কি বউয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল? হয়নি। এখন আশি বছরে এসে মনে হয় প্রেম করাটা মিস হয়ে গেল।”

“গুপিদা!” জগৎ বিরক্ত হল, “এত বয়সেও বাজে কথা গেল না তোমার! তোমায় যে বইটা দিয়েছিলাম, পড়েছ?”

“ধম্মের বই?” গুপি আবার ফুসফুস ঝাড়া দিল, “চোরা না শোনে ধম্মের কাহিনি। শোনো ভাই, করতাম পিওনের কাজ। যথেষ্ট টাকাপয়সা উপরি হিসেবে নিতাম। বউকে দিয়ে সবটা হত না বলে, কালীঘাটের টিনের ঘরে মালতীর কাছে যেতাম। আমার সর্ব-অঙ্গে পাপ কিলবিল করছে। ধম্মের এন্ট্রি হবে না ভাই। আশি তো হল, আর ক’টা বছরই বা থাকব? নিজের মতোই থাকতে দাও। আমার খাঁচাটা ধম্মের জন্য নয়।”

এত কফ, শ্বাসকষ্ট, কিন্তু গোপীনাথ কথা পেলে আর কিছু চায় না। এত বয়সেও তার মুখ যথেষ্ট আলগা। তবে লোকটা দুঃখ পেয়েছে জীবনে। দুই ছেলে ও স্ত্রীর মৃত্যু দেখতে হয়েছে। এখন বড়ছেলের বউ, তার বাচ্চা আর বউয়ের ভাইয়ের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকে। অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়।

সেদিক থেকে দেখলে জগতের অবস্থা ভালই বলতে হবে। ওরও স্ত্রী গত হয়েছে। তবে বাচ্চাকাচ্চাও নেই। ভাগনির বাড়িতে থাকে। বয়স কপিলেরই মতো। সারাদিন ঠাকুর-দেবতা আর ধম্ম-কম্ম নিয়ে আছে। পারলে সারা পৃথিবীকে সেই সব বই পড়াবে। জগৎ বলে, চারদিকে এত হানাহানি, এত মারামারি। এর কারণ জানো? ধর্মের অভাব। ধর্ম মানে ঠাকুরের নাম জপা নয়। ধর্ম মানে ডিসিপ্লিন। নির্দিষ্ট এক সুস্থ জীবনের ছাঁচ। এটাই এখন কেউ বোঝে না। তাই তারা সব বিপথগামী। সবার তাই ধর্মকথা শোনা উচিত।

এর উত্তরে গুপি বলে, আচ্ছা, বুড়ো হলেই ধম্ম-ধম্ম করে নৃত্য করতে হবে, সেটা কি সরকার থেকে নিয়ম করে দিয়েছে? বুড়োদের শখ-আহ্লাদ নেই?

আজকেও জগৎ আর গোপীনাথের একটা তর্ক বেধে উঠতে পারে। এসব একদম ভাল লাগে না কপিলের। ওর মনে হয়, কী হবে অনর্থক তর্ক করে? নিজের মত প্রতিষ্ঠা করে কী এমন রাজার ধন লাভ করে মানুষ? তার চেয়ে এমন সুন্দর সন্ধের মুখে জলের ধারে বসে থাকা, চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখাটা বেশি ভাল নয় কি?

বাড়িতেও দাদার সংসারে এভাবেই থাকে কপিল। যদিও দাদা মারা গিয়েছে। দাদার বউ আর তার দুই ছেলে নিয়ে সংসার। বড়জনের তো বিয়েও হয়েছে। সংসারের সব কিছুতে অংশ নিলেও মনে-মনে একটু সরে থাকে কপিল।

সংসার থেকে একটু আলগা থাকলেও সব কিছুর থেকে কিন্তু মন সরিয়ে রাখতে পারে না ও। এই এখন যেমন সামনের সিমেন্টের সিটে বসা ছেলেটা আর মেয়েটার থেকে মন সরাতে পারছে না। মেয়েটা এখনও কাঁদছে। ছেলেটা কপালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। আচ্ছা, এত ঝঞ্ঝাট সত্ত্বেও লোকে প্রেম করে কেন?

“শালা বুড়োটার আলুর দোষ আছে মাইরি। সামনে মেয়েটার দিকে দেখছে দ্যাখ? এই বয়সেও এত? কত ব্যাটারি আছে রে?”

কথাটা চাবুকের মতো এসে লাগল কপিলের কানে। কপিল আহত চোখে তাকাল। আবছা অন্ধকারে ওদের থেকে হাত-পনেরো দূরে দু’টো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ছেলে দু’টো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল। আর যেতে-যেতে, কপিল লক্ষ করল, গোপীনাথের দিকে দেখল রোগা অসভ্য ছেলেটা। একদম কাছে বলে গোপীনাথও দেখল ছেলেটাকে আর সঙ্গে-সঙ্গে কেমন যেন চুপসে গিয়ে জগতের সঙ্গে ক্রুসেডের ইতি টানল।

ছেলে দু’টো যেতে যেতে বলল, “আজ রথী বেরচ্ছে না? শালা, ও এলেই কাজ শুরু হবে। জয়ের ঢ্যামনামো সব বের করব এবার। শিবিদা বলেছে, ঝাপুবাবু…”

আর শুনতে পেল না কপিল। শুধু শুনল পাশের থেকে গোপীনাথ অস্ফুটে বলছে, “ও, তা হলে ওর সময় হল! আমি তো…”

সামনে মনখারাপ করে বসে থাকা ছেলেটা-মেয়েটা, পাশের আচমকা হতভম্ব হয়ে যাওয়া গোপীনাথ আর দু’টো ছেলের খারাপ কথার সঙ্গে কপিলের চোখ গেল পশ্চিম কোণে জমতে থাকা মেঘের দিকে। আচমকাই শিরশির করে উঠল ওর শরীর। মনে হল, এসবই যেন কীসের এক ইঙ্গিত বহন করছে। কী যেন একটা প্রস্তুতি চলছে। মনে হল, সামনে অন্যরকম দিন আসছে।

প্রথম দিন

জয়, ২৭ জুন: সকাল

আজ চার বছর হল। চুল আঁচড়ে চিরুনিটা রাখতে গিয়ে টেবিল ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ায় কথাটা মনে এল জয়ের। চার বছর। দেখতে-দেখতে কেমন করে যে কেটে গেল বছরগুলো! চার বছর আগের এই দিনটায় জয়ের মনে হয়েছিল, ও আর বেঁচে থাকতে পারবে না। মনে হয়েছিল, বেঁচে থাকার কোনও কারণই যে আর নেই! কিন্তু দ্যাখো, চার বছর কেটে গেল। চারটে গ্রীষ্ম, শীত, বর্ষা পেরিয়ে এল জয়ের শরীর। সেই যে মনে হয়েছিল বেঁচে থাকার কোনও কারণ নেই, তা হলে কি এতগুলো বছর এমনি-এমনি বেঁচে রইল ও?

নিজেকে ভাল করে দেখল জয়। মাথার সামনে চুল সামান্য উঠে গিয়েছে। চিবুকে এক পরত বেশি মাংস। বয়স থাবা বসাচ্ছে। কিন্তু তবু এখনও যথেষ্ট সুপুরুষ ও। এখনও বয়সের চেয়ে অনেক ছোট মেয়েরা অন্যরকম চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকায়। কেয়াও তো ওর রূপ দেখেই ধরা দিয়েছিল। বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে, পাড়ায় লোকাল হেডলাইন তৈরি করে, হিন্দি ছবির ক্ল্যাইম্যাক্সের মতো টানটান উত্তেজনায় বিয়ে হয়েছিল ওদের। তখন কেয়া পাগলের মতো ভালবাসত ওকে। বলত, “তোমায় আমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। তোমার জন্য আমার বুকের ভিতর একটা চন্দনকাঠের বাক্স আছে।”

তখন ওকে খুব ভালবাসত কেয়া। তখন ওকে আগলে রাখত ভালবাসা দিয়ে। কিন্তু সবই ‘তখন’। কারণ এখন ছবিটা পালটে গিয়েছে। এখন কেয়া কেমন যেন বয়ার মতো দূরে ভেসে থাকে। এখন কেয়া মাঝে-মাঝেই খুব কঠিন কথা বলে। এখন কেয়ার বুকের ভেতর চন্দনকাঠের সেই বাক্সটা আর নেই। কিন্তু যতই দূরে-দূরে থাকুক, কেয়া জয়ের সব কিছু গুছিয়ে হাতের কাছে এগিয়ে দেয় আজও। দয়া করে? না বোঝাতে চায়, আমি তোমার চেয়ে সুপিরিয়র? আমার মন বড়? জানে না, জয় ঠিক বুঝতে পারে না।

নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জয়ের। জীবন যদি পোষা কুকুর হত, তা হলে চার বছর আগের সময়টাকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখত ও।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল জয়। অনেক উঁচুতে পাখিরা উড়ছে। আর তার চালচিত্র যে আকাশ, তার মুখ বেশ ভার। এবার বিশেষ বৃষ্টি হচ্ছে না। কে বলবে বর্ষা চলছে? টিভিতে, খবর কাগজে, চারদিকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কথা শোনে জয়। শোনে, এভাবে চললে পৃথিবীর খুব দুর্দিন আসছে। দুর্দিন! হাসি পায় ওর। আরে বাবা, আজকে বাঁচলে তো কালকের কথা ভাববে। চারদিকে এত লোক পিলপিল করছে। সবাইকে তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে। কিন্তু সুযোগ অল্প। তাই তো সবাই আঁকাবাঁকা পথ নেয়। তার ফলে পৃথিবীকেও ভুগতে হয়। তা ছাড়া…

ধুস! মাথাটা নাড়াল জয়। কীসব আবোল-তাবোল ভাবছে। গত কয়েকমাস ধরেই এই এক সমস্যা হচ্ছে জয়ের। মাঝে-মাঝেই মনটা হাবিজাবির দিকে চলে যাচ্ছে। ঠিক সামলাতে পারছে না। এতে মনঃসংযোগের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। কাজে টুকটাক ভুল থেকে যাচ্ছে। সুতনুর কাছে বকাও খাচ্ছে।

শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল জয়। সাড়ে আটটা বাজে। গড়িয়া থেকে লেক গার্ডেন্স যেতে হবে ওকে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, ন’টার ভিতর পৌঁছতে পারবে কিনা, কে জানে! সুতনু অফিসে বেরোয় সাড়ে ন’টা নাগাদ। জয়ের দেরি হওয়া মানে সুতনুরও দেরি হয়ে যাওয়া।

খাওয়ার টেবিলে মামাশ্বশুর বসে রয়েছে। নাম জগৎ। কিন্তু জগৎ-সংসারের কোনও কিছুর উপর এর কোনও টান আছে বলে মনে হয় না। সারাদিন মোটা-মোটা ঠাকুর-দেবতার বইয়ে মুখ গুঁজে রয়েছে মানুষটা। কারও সঙ্গেই বিশেষ কথা বলে না। বিকেল হলে অটোয়-অটোয় পৌঁছে যায় রবীন্দ্রসরোবর। এত দূরে রোজ গিয়ে কী আনন্দ পায় কে জানে! সেখানেও তো মনে হয় বিশেষ কথা বলে না কারও সঙ্গে। তবে মানুষটা ভাল। ঠান্ডা। আর জয়কেও পছন্দ করে। কে বলবে, এদের বাড়ির লোকজনই জয়কে বিয়েটা মানতেই পারেনি!

জয় বলল, “তোমার জন্য কিছু আনতে হবে মামু?”

“আমার জন্য?” জগৎ মুখ তুলল।

“হ্যাঁ। গত পরশু বলছিলে যে ইসবগুল শেষ হয়ে আসছে। সেটা আনতে হবে কি? আর ভিটামিনের ক্যাপসুলটা?”

“আজ চার বছর হল, না জয়?”

ধক করে উঠল জয়ের বুকটা। মানুষটা মনে রেখেছে? তখন তো সবে এ বাড়িতে এসেছিল। অতটা ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়নি। তাও দিনটা মনে রেখেছে?

“আজ একটা পুজো দিও। এমন দিনে ঈশ্বরের কাছে যেতে হয়।” জগৎ বইয়ে মুখ ডোবাল আবার।

ঈশ্বর! কোথায় থাকে সে? তার ঠিকানা কী? কাছাকাছি ল্যান্ডমার্ক? পিনকোড কত? শালা! ঈশ্বর বলে কিচ্ছু হয় না। এসব ভিতু মানুষদের ফাঁদে ফেলার জন্য ধান্দাবাজ মানুষদের কল। এমন দিনে ঈশ্বরের কাছে যেতে হয়! হুঁঃ! যদি সেই ব্যাটা থাকতই, তা হলে কি এভাবে বাড়িটা শূন্য থাকত? তবে কি টলমলে পায়ে…

খট শব্দে বাথরুমের দরজাটা খুলে বেরল কেয়া। স্নান সারা হয়ে গিয়েছে। লাল সায়ার উপর লাল ব্লাউজ। আর এসবের উপরে লাল শাড়িটা আলগোছে জড়ানো। কত ছোট কেয়া জয়ের চেয়ে? বড়জোর বছরতিনেক। বলে, মেয়েরা নাকি সহজে বুড়িয়ে যায়। একদম বাজে কথা। কেয়ার যেন বয়স কমছে। এমনিতেই পাতিলেবুর মতো গায়ের রং কেয়ার। তার উপর লাল শাড়ি গায়ে। ইদানীং মাথার চুলেও ডোরাকাটা খয়েরি রং করিয়েছে। এইসব মিলিয়ে কেয়াকে দেখলেই পেটে গুড়গুড় করে জয়ের। নিজের বউকেই পরস্ত্রী লাগে।

এখনও কেয়ার দিকে চোরাদৃষ্টিতেই তাকাল জয়। গুড়গুড় ভাবটা আরও নীচের দিকে নামছে। কতদিন যে কেয়াকে ও ধরেনি! কেয়া আর ওর সঙ্গে শোয় না।

“তুমি এখনও বেরোওনি?” কেয়া নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

“না, বেরব এবার। এই মামুর কাছে জানতে এসেছিলাম, কিছু লাগবে কিনা।”

“যশের সঙ্গে কথা বলেছিলে গতকাল?” কেয়া জিজ্ঞেস করল।

“যশ!” জয় থমকাল একটু। এই রে, নামটা চেনা-চেনা লাগছে। কিন্তু কী বলতে গিয়ে কেয়া বলেছিল নামটা ঠিক মনে করতে পারছে না ও।

“হ্যাঁ যশ! গতকাল তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল না ওর সঙ্গে? সন্ধে আটটায় ওর বেলতলার অফিসে যেতে বলেছিল না তোমায়?”

“ও!” জয় চোয়াল শক্ত করল। এই রে, একদম ভুলে গিয়েছিল। আসলে কেয়া একটা বিউটি পার্লার খুলতে চায়। তার জন্য একটা ঘর মোটামুটি ঠিক হয়েছে মহুয়া সিনেমার কাছাকাছি। সেই সম্বন্ধেই কথা বলার ছিল। কেয়ার একটা লেডিস টেলারিং শপ আছে। তাতে খদ্দেরও বেশ ভাল হয়। ফলে সন্ধেবেলা দোকান ছেড়ে বেরতে পারে না কেয়া। সেই জন্য জয়কে কয়েকদিন আগে বলে রেখেছিল যশের সঙ্গে দেখা করার জন্য। হাজার ঝঞ্ঝাটের মধ্যে সেটাই ভুলেছে ও।

জয় অপরাধীর মতো মুখ করে তাকাল কেয়ার দিকে। ও দেখল, পাতিলেবু রাগের চোটে ক্রমশ কমলালেবুর রং নিচ্ছে। কেয়ার রাগ হলে আর জ্ঞান থাকে না। এই কমলা রঙের মুখের মেয়েটাকে বেশ ভয় পায় জয়।

কেয়া বলল, “এতটা ইরেসপনসিবল কী করে হলে তুমি?”

“আমি…মানে…”

“মানে? কীসের মানে? যত্তসব বাজে কথা মনে থাকে! এখনই সুতনু কিছু বলুক, লেজ ঘাড়ে করে দৌড়বে তখন। আর আমার কথা মনে থাকে না, না?”

“শোনো কেয়া, ক’দিন ধরে হাজারটা ঝঞ্ঝাট চলছে। তারই মাঝে এটা, মানে…তুমি রাগ কোরো না।” জয় এগিয়ে গেল কেয়ার দিকে।

কেয়া দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “একদম কাছে আসবে না। ইরেসপনসিবল! অসভ্য একটা লোক! কেন যে বাড়ির অমতে…”

“আমায় বিয়ে করে খুব পস্তাচ্ছ, না?” জয় দেখল, জগৎ বইপত্তর গুছিয়ে নিজের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে গেল।

“ন্যাকামো হচ্ছে, না? ন্যাকামো? কেন যাওনি যশের কাছে? কেন? আমি কিছু করি তুমি চাও না, সেটা বললেই হয়।”

“আমি চাই না তুমি কিছু করো? তোমার এই টেলারিংয়ের দোকানটা কে ঠিক করে দিয়েছে? কে মেশিন, আসবাবপত্তর কিনে দিয়েছে?”

কেয়া বলল, “লজ্জা করে না, কাজ করে আবার বলছ? সারা জীবনে আমার জন্য আর কী করতে হয়েছে তোমায়? একটা-একটা…”

জয় মাথা নিচু করে ডাইনিং টেবিলের পাশে রাখা ডিভানটায় বসে পড়ল। ভাল লাগছে না এসব। সকালের মনখারাপটা ক্রমশ রাগের দিকে বাঁক নিচ্ছে। রাগ, এই রাগই একসময় সর্বনাশ করেছিল জয়ের। সেই দিনটায় পুলিশের সঙ্গে রাগারাগি না করলে হয়তো…এই রাগটাকেই ও ভয় পায় সবচেয়ে বেশি। ও জানে, কেয়া এখন অনেক কথা বলবে ওকে। কিন্তু সে-সবে কান দিলে হবে না। তা হলে রাগ আরও বাড়বে। কেয়াকে কিছুতেই ও বোঝাতে পারবে না যে গত কয়েকটা বছর কীভাবে কেটেছে ওর।

সুতনু রায় জয়ের বস। জয়ের প্রায় সারাটা দিন কাটে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে। সুতনু লোকের কাছে জয়ের পরিচয় করায় পিএ হিসেবে। কিন্তু জয় জানে পিএ-র চেয়েও জয়ের দায়িত্ব অনেক বেশি। সুতনুর জন্য প্রয়োজনমতো শরীর পেতে গুলিও নিতে হবে জয়কে। আলো, অন্ধকার, সুতনুর সমস্ত কাজের জন্যই, জয়কে দরকার।

গত কয়েকদিন স্ক্র্যাপের লোহার টেন্ডারটা নিয়ে খুব অশান্তি গিয়েছে। লিলুয়া ওয়ার্ডের লোহার স্ক্র্যাপের উপর এতদিন দখল ছিল ঝাপুবাবুর। সেটা ভেঙে সেখানকার স্ক্র্যাপ কেনার জন্য গত বছরখানেক খুব চেষ্টা করেছিল সুতনু। সঙ্গে অবশ্য জয়ও ছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সফল হয়েছে ওরা। স্ক্র্যাপের বরাতটা পেয়েছে। এই নিয়ে গত চার মাসে দু’টো কাজ ঝাপুবাবুর প্রায় মুঠো খুলে বের করে নিয়েছে ওরা। এই স্ক্র্যাপের কাজটা পাওয়ার পর ঝাপুবাবু ফোন করেছিল সুতনুকে। অনেক অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল, “আমি একটু দুঃখও পেয়েছি।”

জয়ের পুরনো ইন্সটিংক্ট বলে যে ঝাপুবাবুর দুঃখ পাওয়াটা কোনও ভাল ইঙ্গিত নয়। এই জন্য ওদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। ঝাপুবাবু একজন কোল মাফিয়া। পাশাপাশি কোলিয়ারিগুলোতে অ্যাশ হ্যান্ডলিংয়ের বড়-বড় কাজ করে। আর রেলের স্ক্র্যাপ কেনার ব্যাপারটা তো আছেই। এ ছাড়া ঝাড়খণ্ড আর বিহারে নানা রকম এক্সটরশন, কিডন্যাপের রমরমা ব্যবসার ক্ষেত্রেও ওর নাম শোনা যায়। তাই এমন গুণধর লোক দুঃখ পেলে ডাউনচেনের মানুষজনও খুব একটা সুখে থাকে না।

তবে সুতনু রায়ও কিছু যোগীপুরুষ নয়। তারও নানা ধূসর ব্যবসা আছে। বেআইনি ডলার ভাঙানো, লুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণীর স্মাগলিং, ব্লু-ফিল্মের প্রোডাকশন থেকে আরও নানা ক্ষেত্রে প্রায় ‘গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ়’ বানিয়ে ফেলেছে মানুষটা। ইদানীং জয় শুনছে যে, বিদেশে লোক পাচার করার ব্যাপারটাও সুতনু মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। ইউরোপ, আমেরিকায় সস্তার লেবারের চাহিদা বেশ ভাল। ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের হিসেবে ভাবলে রোজগার নেহাত মন্দ হবে না।

এসবের সঙ্গেই অ্যাশ হ্যান্ডলিং, কুলিং টাওয়ার, রেলের স্ক্র্যাপ, কাস্ট আয়রন মোল্ডিংয়ের ব্যবসাটাও রেখেছে সুতনু। এই কালো-সাদা সমস্ত কাজেই জয়কে ছায়ার মতো লেগে থাকতে হয় সুতনুর সঙ্গে। সকাল ন’টা থেকে রাত এগারোটা-সাড়ে এগারোটা অবধি ও সুতনুর সঙ্গে থাকে।

কিন্তু এখনই প্রায় ন’টা বাজতে দশ। আজ দেরি হবেই। ডিভান থেকে এবার উঠে দাঁড়াল জয়। কেয়া অনেক চিৎকার-চেঁচামেচি করে সদ্য ঘরে গিয়েছে। আবার কিছু শুরু করার আগে বেরিয়ে পড়তে হবে। পাশের টেবিল থেকে বাইকের চাবিটা তুলে নিল ও। আর ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল পকেটে। ফোনটা বের করে নামটা দেখল জয়। বলাই এইচ। আরে, হঠাৎ হাতকাটা বলাই ফোন করল এ সময়?

“হ্যাঁ, বল।” সংক্ষেপে বলল জয়।

“শিবি নড়াচড়া শুরু করেছে। তুমি ঠিকই বলেছ জয়দা।”

“হুম,” জয় গম্ভীর হল, “শোন, সময়-সময় জাস্ট খবর দিয়ে যাবি আমায়। আর আমায় না জানিয়ে কিচ্ছু করবি না। বুঝেছিস?”

“হ্যাঁ জয়দা,” বলাই খুব বাধ্য গলায় বলল।

“পরে যোগাযোগ করছি। এখন রাখ।” জয় ফোনটা কেটে পকেটে ঢোকাল। ভুরুটা আপনা থেকেই কুঁচকে গিয়েছে। এমনটা যে হবে ও আন্দাজ করেছিল। ঝাপুবাবু তো চুপ করে বসে থাকার লোক নন। শিবি ঝাপুবাবুর হয়ে কাজ করে। মানে অন্ধকার কাজকর্ম। তবে শিবির দলেও বলাই লোক ফিট করে রেখেছে। সেখানকারই খবর আর কী! তবে এখনই এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না। আরও দু’-একটা দিন না গেলে বোঝা যাবে না যে ঝাপুবাবু কী করতে চায়!

ফোনটা আবার ককিয়ে উঠল। ওঃ, এই হয়েছে এক অশান্তি! সাড়ে আটটা বাজল কি বাজল না, এই ফোনটা থেকে-থেকে কেঁদে-ককিয়ে অস্থির হয়ে যায়। মোট তিনটে মোবাইল জয়ের। তবে তার একটা নম্বরই সবার কাছে আছে।

“হ্যালো।” স্ক্রিনে নাম না দেখেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে ফোনটা কানে তুলল জয়।

“প্রায় ন’টা বাজে। তুমি এখনও এলে না তো? তুমি কোথায়?” সুতনুর চকচকে ভীষণ ভদ্র গলাটাকে আজ কেমন একটু কঠিন শোনাল।

“দাদা, বাড়িতে কেয়ার একটু শরীরটা খারাপ হয়েছে, তাই এখনও বেরতে পারিনি।” জয় সটান মিথ্যে বলে দিল।

“ও,” একটু সময় নিল সুতনু, তারপর বলল, “ঠিক আছে, শোনো কিছু ডলার আসছে। মার্কেটের হাফ প্রাইস। নিউ মার্কেটের পিছনে শামিম থাকবে। তুমি ওর সঙ্গে দেখা করো। প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো মাল। প্রথমে তিরিশ লাখ দিতে হবে। বুঝতেই পারছ, তোমায় কী করতে হবে।”

জয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আবার। আজ দীর্ঘশ্বাসের দিন।

হবেই তো, আজ যে ২৭ জুন! চার বছর আগে এমন দিনেই তো…

“হ্যালো, জয়, শুনতে পাচ্ছ?” সুতনুর গলায় অধৈর্য।

“হ্যাঁ, দাদা,” কথা বলতে গিয়ে জয়ের গলাটা কাঁপল এবার।

হ্যালো, কী হয়েছে? সুতনু অবাক হল!

“না দাদা, কিছু নয়।”

“জয়, তুমি ঠিক আছ? কী হয়েছে?”

জয়ের গলার ভিতর আচমকা রবারের বল আটকে গেল যেন। যেন মনে হল, জীবন বেরিয়ে যাবে একদম। মনে হল, আর কোনওদিন কথা বলতে পারবে না। তবু প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে-নিতে বলল, “দাদা, আমি ঠিক পৌঁছে যাচ্ছি। আপনি ভাববেন না।”

“সত্যি তুমি ঠিক আছ তো?” সুতনু আবার জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ দাদা। আমি পৌঁছে যাচ্ছি।”

ন’টা দশ। ঘড়িটা দেখে একবার শামিমকে ফোন করে জয় বলে নিল কখন কোথায় দেখা করবে। অন্ধকার কোনও কাজে গেলে জয় সঙ্গে মেশিন রাখে। মেশিন মানে একটা চাইনিজ নাইন এম এম। দেড় লক্ষ টাকা দাম। সুতনুই কিনে দিয়েছে। কিন্তু আজ সঙ্গে নেবে না। কারণ জানে শামিম নিজেরটা নিয়ে বেরবে। তা ছাড়া আজ এসব ধরতে ইচ্ছে করছে না।

জুতোর র‍্যাকটা কেয়ার ঘরের পাশে রাখা থাকে। সেখান থেকে জুতোটা নিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল জয়। ঘরের ভিতর মোবাইলে কথা বলছে কেয়া। কিছুক্ষণ আগের সেই রাগ আর নেই। বরং মুখে চওড়া হাসি। বুকটা আচমকা জ্বলে গেল জয়ের। কী এত হাসির কথা যে আজকের দিনেও হাসতে হবে? জয় দরজার কাছে গিয়ে কান পাতল।

যা শুনল তাতে শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় এসে জমা হল ওর। আজও ফোনে বাঁশির সঙ্গে গল্প করছে! বাঁশি কী খেয়েছে, কাল কখন রাতে ঘুমিয়েছে, তা জেনে কেয়ার কী লাভ? বাঁশির সঙ্গে কথা বলার সময় কেয়া কেন এমন শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে যায়? কেয়া কি বাঁশিকে বলেছে জয় আসলে কে? কোন নরক থেকে উঠে এসেছে ও? বলেছে যে, নরকের টুকরোগুলো এখনও বেঁচে আছে জয়ের মধ্যে!

রথী, ২৭ জুন: সকাল

ভাঙা মোম রং ঘষে-ঘষে আকাশটাকে সূর্যাস্তের মতো খুনখারাপি লাল করে দিচ্ছে ছেলেটা। ছোট মাথাটা ঝুঁকে আছে কাগজের উপর। বাঁ-হাত দিয়ে ধরে রয়েছে কাগজটাকে। আর ডান হাতের ছোঁয়ায় নীল আকাশের কিছুটা লাল আর কিছুটা বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। কুড়ি মিনিট ধরে রথী দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ছেলেটার ছবি আঁকা দেখছে। একটা ভাল রং-পেনসিলের বাক্সও নেই। সবকটা রংই কেমন ময়লা, ভাঙা আর ছোট। রথী জানে, ভাল বাড়ির ছেলেরা এমন রং-পেনসিল বাতিল করে দেয়। সেই বাতিল রং দিয়ে ছেলেটা এমন দারুণ ছবি আঁকছে! ওর মতো ন’-দশ বছর বয়সে রথী নিজে কী করত ভাবতেই গত কুড়ি মিনিটে বেশ কয়েকবার লজ্জায় নিচু হয়ে গিয়েছে রথীর মাথা। এমন মানুষদের কাছে এলে রথীর মনে হয়, জীবনটা যদি প্রথম থেকে আর একবার শুরু করার সুযোগ পাওয়া যেত! কিন্তু জীবন বাচ্চাদের ক্রিকেট নয়। এখানে আউট মানে আউট। কোনও সেকেন্ড চান্সের জায়গা নেই।

এই গলিটা সরু। পাশ দিয়ে কালো-জল-বওয়া ড্রেন চলেছে। তবে সত্যি-সত্যি জল বইছে না তাতে। বরং দাঁড়িয়ে রয়েছে। জলের উপরের তলটা কেমন থকথকে হয়ে আছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। গলির একদম শেষপ্রান্তে একটা প্লাস্টিক আর টালির তাপ্পি মারা চায়ের দোকান। হিমি চা আনতে গিয়েছে সেখান থেকে। রথী বলেছিল, খাবে না। কিন্তু হিমি শোনেনি। সাধ্য বিশেষ কিছু নেই হিমির। কিন্তু তবু যেটুকু আছে, তা দিয়েই রথীকে আপ্যায়নের চেষ্টা করে মেয়েটা। কে বলবে, এই মেয়ে বিকেল হলে রং মেখে ব্রিজের রেলিং ধরে দাঁড়ায়? কে বলবে, এই মেয়ে ক্ষয়াটে চেহারার লোকগুলোর নীচে শুয়ে রোজ রাতে পিষ্ট হয়? খারাপ লাগে রথীর। কিন্তু ও জানে ওর কিছুই করার নেই। পৃথিবীতে সব খারাপ লাগাকে সারানো যায় না।

গতকাল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে রথী। ছ’মাস পরে বাইরের পৃথিবীতে এসে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল ওর। মনে হচ্ছিল, চারদিকে সব কিছু খুব যেন দ্রুতগতিতে চলছে। লোকজন যেন দ্রুত হাঁটছে। দ্রুত কথা বলছে। দ্রুত উড়ে যাচ্ছে কাক আর চড়াই। মাথাটা কেমন ঘোলাটে লাগছিল রথীর। বাঁ-হাতের কনুই-এর নীচে জেল থেকে মেরে দেওয়া স্ট্যাম্পটা ঘষতে-ঘষতে নেলো বলছিল, শালা এমন দেগে দেয় কেন বলো তো? সরকারের অন্য কাগজে দ্যাখো আবছা, প্রায় চোখে দেখতে পাওয়া যায় না এমন স্ট্যাম্পের দাগ। আর আমাদের হাতে দ্যাখো, যেন গরুর গায়ে ছাপ্পা লাগিয়েছে! শালা!

নেলোর সঙ্গে জেলেই আলাপ হয়েছিল রথীর। প্রথম দিন পুরনো হোমরা-চোমরা কয়েদিদের চড়চাপড় খেয়ে রাতে যখন এককোণে বসেছিল রথী, নেলো এসে একটা বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘কী বস, একটু নাট পেঁচিয়েছে বলেই এমন ফোকাস নিভিয়ে বসে আছ? তাও তো পিছনে টুনি জ্বালেনি।”

“মানে?” বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করেছিল রথী।

“ও মাল, তুমি কে গো? জেলে এসেছ আর এসব শিখে আসোনি? যাক গে, নাও বিড়ি খাও। মনটা চনমনে হবে একটু।”

রথী বলেছিল, “আমি সিগারেট খাই, বিড়ি খাই না।”

“কী?” নেলো এমন মুখ করে তাকিয়েছিল যেন জীবনে প্রথম এমন কথা শুনছে।

“কী হয় বিড়ি খেলে? জাত যায় নাকি?”

“ব্লসম রাগ করে।” প্রায় মুখ ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিল রথীর। তবে তা বলেনি। বরং বলেছিল, মুখে গন্ধ হয়।

“অ্যাঁঃ, গন্ধ হয়!” নেলো বলেছিল, এখানে কে তোমায় চুমু মারাতে আসবে? শালা পৃথিবীটাই টান্টুর আন্ডিল হয়ে গিয়েছে।

তা সেই রাত থেকেই নেলোর সঙ্গে ভাব হয়ে গেছিল রথীর। ভুলভাল কথা বললেও লোকটা যে ভাল, বুঝতে পেরেছিল রথী। তারপর ক্রমশ এই ছ’মাসে বুঝেছে, লোকটা রথীকে পছন্দই করে।

গতকাল ঘটনাচক্রে একসঙ্গে ছাড়া পেয়েছে দু’জন। তবু নেলোর যেন যেতে ইচ্ছে করছিল না। বলছিল, “এঃ, শালা আবার খোঁচড়গিরি করতে হবে। তার চেয়ে জেলেই ভাল ছিলাম। তা রথীবাবু, তুমি এখন কোথায় যাবে, দিদির বাড়ি না প্রেমিকার কাছে?”

“প্রেমিকা?” থতমত খেয়ে গিয়েছিল রথী। নেলো জানল কী করে? গত ছ’মাসে তো ব্লসমের নাম একবারও ভুলেও কাউকে বলে দেয়নি! তা হলে?

“শোনো শালা, ন্যাকামো কোরো না। আমি কি ঘাসে মুখ দিই নাকি? তোমার প্রেমিকা নেই?”

“কী যা-তা বলছ?” বেকায়দায় পড়ে গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করেছিল রথী। ও চায় না ব্লসমের কথা এদের মতো লোক জানুক।

“যা-তা বলছি? শালা বিড়ি খেলে মুখে গন্ধ হয়! প্রেম না করলে কোন হারামি বলে এমন কথা? আমায় ঢপ মেরে সুবিধে হবে না।”

রথী কিছু না বলে চুপ করেছিল।

নেলো আবার বলেছিল, “সে যা হোক। তোমার পেরাইভেট ব্যাপারে আমি চুলকোতে যাব না। তা এখন কোথায় যাবে?”

দিদির বাড়িতে যে যাওয়া যাবে না সেটা ভালই জানত রথী। গতকাল দিদির মেয়ের জন্মদিন ছিল। এ দিনটায় দিদি মেয়ের স্কুলের কিছু ছেলেমেয়েকে নেমন্তন্ন করে। কেক কেটে, লুচি-মাংস খেয়ে, দশ-বারো বছরের ছেলেমেয়েরা হইচই করে ওদের ছোট্ট বাড়িটা জুড়ে। এমন দিনে ‘জেলফেরত মামা’ ব্যাপারটা ঠিক খাপ খাবে না।

রথী বলেছিল, “দেখি।”

নেলো ছাড়েনি ওকে। এক মদের ঠেকে নিয়ে গিয়ে গলা অবধি বাংলা খাইয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে শুকনো লঙ্কা দিয়ে তৈরি মুরগির নাড়িভুঁড়ির চাট।

রাত দশটায় কলকাতাকে পাহাড়ি অঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল রথীর। পা ফেলতে গিয়ে দেখছিল দু’দিকে বিশাল খাদ। এখন কোথায় যাবে ও? কম্পাস খারাপ হয়ে যাওয়া জাহাজের মতো কালীঘাট ব্রিজের মাথায় দাঁড়িয়েছিল রথী। হলুদ আলোয় ভেসে যাওয়া কলকাতা ক্রমশ নির্জন হচ্ছিল সামনে। ঠিক তখনই হিমির কথা মনে পড়েছিল ওর। কালীঘাট ব্রিজের পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে নামলেই যে অঞ্চল, তারই এক গলিতে হিমি থাকে।

হিমি এক খদ্দের ছেড়ে আবার বেরনোর তোড়জোড় করছিল। এমন সময় রথীকে দেখে থমকে গিয়েছিল।

“এই নাও চা।” হিমি ছোট্ট কাচের গ্লাসটা রথীর সামনে ধরল।

রথী হেসে বলল, “এবার চলে যাব। একবার ছানুর কাছে যেতে হবে।”

“ছানু?” হিমি অবাক হয়ে তাকাল।

সত্যিই তো, হিমি জানবে কী করে? রথীর নিজেকে বোকার মতো লাগল। বলল, “ওই, আমার বন্ধু। ওর সঙ্গে কাজ আছে একটু।”

“মানে তো সেই গুন্ডাগিরি!” হিমি রথীর থেকে চোখ সরাল না।

“না-না!” রথী গরম চায়ে যতটা সম্ভব চুমুক দিল। তাড়াতাড়ি শেষ করে কাটতে হবে এখান থেকে। হিমি ছাড়বার পাত্রী নয়। এখনই জ্ঞান দিতে শুরু করবে।

“তুমি বোঝো না এসব খারাপ? ভদ্রবাড়ির বিএ পাশ করা ছেলে হয়ে গুন্ডামো করে ছ’মাস ঘানি ঘুরিয়ে এলে। এতে কি তোমার মান বাড়ল?”

রথী প্রাণপণে আর একটা চুমুকে চা-টা শেষ করল। পানসে, গরম একটা তরল জিভের বারোটা বাজিয়ে নেমে গেল পেট অবধি। ও অন্যদিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা করল। হিমির কথা শোনার কোনও মানে হয় না।

অন্য কেউ হলে কিন্তু রথী তাকে আরও দশটা কথা শুনিয়ে দিত। এমনকী মেরেও দিতে পারত। কিন্তু হিমির ব্যাপারটা অন্যরকম। হাতকাটা বলাইয়ের গ্রুপের চারজন একবার তাড়া করেছিল রথীকে। হাতে ওয়ানশটার আর চপার ছিল। সেদিন মৃত্যু নিশ্চিত ছিল রথীর। কালীঘাট ব্রিজ দিয়ে দৌড়ে নেমে ও এই গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছিল। পিছনে ধেয়ে-আসা পায়ের আওয়াজ ক্রমশ দূরত্ব কমাচ্ছিল। একটা গুলি প্রায় কোমর ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুভয় দিশেহারা করে দিয়েছিল রথীকে। সামনের বাঁ-দিকে একটা গলি পেয়ে তার ভিতর আচমকা লেফট টার্নে ঢুকে গিয়েছিল ও। তারপর কিছুটা দৌড়ে উপায় না দেখে টিনের দরজা দেওয়া একটা চৌকো ঘরের ভিতর নিজেকে প্রায় ছুড়ে দিয়েছিল রথী।

“কী হল, কথা কানে ঢুকছে না?” হিমি আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল রথীর পেটে। ছ’ফুট লম্বা শরীরটা একটু ঝুঁকল সামনে।

রথী হাসল, বলল, আমি আসি হিমি। ছ’মাস পিছিয়ে পড়েছি জীবন থেকে। এক-একটা মুহূর্ত এখন আমার কাছে দামি।

হিমি হাসল, “যাও। তবে সাবধানে।”

‘সাবধানে।’ মা একসময় বলত এমনভাবে। স্কুলে বেরনোর সময় বা কলেজে যাওয়ার সময়ও মা বলত, ‘সাবধানে।’

কার থেকে সাবধান? কীসের থেকে সাবধান? তা জানত না রথী। হয়তো মা-ও জানত না। কিন্তু সংস্কারবশত বলত, “সাবধানে।”

সাবধানতা রথীর জীবনে নেই। ছোট থেকেই ডানপিটে ও। ছ’ ফুটের শরীরটা লোহা দিয়ে তৈরি। মারপিট করতেও পিছপা হত না। কলেজে ভর্তি হয়েই অমন দশাসই চেহারার জন্য সহজেই ও সকলের নজরে পড়ে গিয়েছিল। না বুঝেই কলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েছিল। কলেজে রুলিং ইউনিয়নের একটা ছেলের সঙ্গে সামান্য কথায় একদিন ঝগড়া শুরু হয়েছিল। হাত চালিয়ে দিয়েছিল রথী। ছেলেটা মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল একদম। আর কলেজের বিরোধীরা রথীকে ‘আমাদের ছেলে’ বলে মাথায় নিয়ে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছিল।

পড়াশোনায় কোনওদিনই সুবিধে করতে পারেনি রথী। কেউই কোনওদিন ওকে নিয়ে নাচানাচি করেনি। ফলে জীবনে প্রথম ‘হিরো’ হয়ে রথীর মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সেই শুরু, তারপর কলেজ ইলেকশন থেকে শুরু করে লোকাল ভোট, সবেতেই জড়িয়ে পড়েছিল রথী।

একদিন বেঁটে, কটা চোখের সুন্দরমতো একজন লোক এসে ওকে বলেছিল, “বরেনদা আমায় তোমার কথা বলেছেন। এসো, আমার সঙ্গে কাজ করো।”

“কী কাজ?” রথী অবাক হয়েছিল।

লোকটা হেসে বলেছিল, “দেশোদ্ধার ভাই দেশোদ্ধার! এই তো দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার বয়স। তোমার পোটেনশিয়াল আছে। না হলে বরেনদার মতো এমএলএ তোমার কথা বলেন? গত ইলেকশনে তুমি তো একদম ক্যান্টার করে দিয়েছ!”

আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর রথী রাজি হয়ে গিয়েছিল লোকটার সঙ্গে কাজ করতে। কিন্তু ঠিক কী কাজ করবে, তা বুঝতে পারেনি। তবে পড়াশোনা করে যে কিছু হবে না সেটা ভালই বুঝেছিল ও। তাই দ্বিধা করেনি।

লোকটা যাওয়ার আগে হেসে বলেছিল, “মন দিয়ে কাজ করলে এ লাইনে উন্নতি বাঁধা। তবে খতরা আছে। পারবে তো?”

রথী নিজের হাত মুঠো করে বলেছিল, “সেটা দেখে নেবেন।”

“গুড!” লোকটা হেসেছিল। তারপর চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মুহূর্তকাল। বলেছিল, “কাল থেকে আমার অফিসে এসো। এই নাও কার্ড। আমার নাম শিবরতন ঘোষ। তবে সবাই আমায় শিবি বলে।”

ছানুর একটা পানের দোকান আছে। সেখানে অবশ্য সাট্টার বোর্ডও বসে। তবে বাইরে থেকে পানটাই বোঝা যায়। ইদানীং ছানু পুরিয়ার লাইনেও ঢোকার চেষ্টা করছে। শিবির কান এড়িয়ে ব্যাপারটা ঘটাতে চায় ও। কারণ ছানুর কথা, বিড়াল শালা জানলেই কমিশন খাবে। শিবির চোখটা ধূসর বলে ওকে পিছনে রথীরা বিড়াল বলে। রথী ছানুকে এই ব্যবসায় জড়াতে বারণ করেছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে? বরং ছানু নানাভাবে রথীকে নিজের কাজে লাগাতে চায়।

তবু ছানুকে পছন্দ করে রথী। ছেলেটার মধ্যে একটা অদ্ভুত সারল্য আছে। জেলে যাওয়ার দু’দিন আগে ওর কাছে বাইশ হাজার টাকা রাখতে দিয়েছিল রথী। টাকাটা নিতে হবে এবার। ওখান থেকে হাজার-পাঁচেক দিদির হাতে ধরাতে না পারলে দিদি বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।

বলতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, রথীর দিদি, মানে রণিতা, পয়সার ব্যাপারটা ভাল বোঝে। ছোট থেকেই নিজেরটা গুছোতে জানত ভাল। বিয়ের পর জামাইবাবুর প্রতাপে টাকা নিয়ে খিটিমিটি করতে পারত না। কিন্তু দেড় বছর আগে জামাইবাবুর আচমকা মৃত্যুর পর দিদি যেন আরও টাকার লোভী হয়েছে। যদিও কথায়-কথায় বলে, “টাকা না গুনে রাখলে আমার চলবে? মেয়েকে তো আমাকেই মানুষ করতে হবে।” জামাইবাবুর জমানো টাকার সুদ আর বৃদ্ধ শ্বশুরের পেনশন দিয়েই সংসার চলে দিদির। তাই শ্বশুরমশাই গোপীনাথকে দিদি বিশেষ কিছু বলে না। যা বলার বলে রথীকে।

রথী কী করবে? কোথায় যাবে ও? বাবা-মা দু’জনেই মারা গিয়েছে। থাকার মধ্যে দিদি। তাই তার কাছেই থাকে। অন্তত দু’বেলা রান্না-করা ভাতটা তো মুখের কাছে পায়। একা ঘর ভাড়া করে থাকলে সেটাও তো হত না। অবশ্য ভাতের সঙ্গে মুখঝামটাও পায় রথী। কিন্তু গায়ে মাখে না। জানে, দু’-আড়াই হাজার টাকা ফেললে দিদি চুপ করে যাবে। টাকার চেয়ে বড় শান্তিরক্ষক আর কেউ নেই সংসারে। শালা, সব্বাই টাকার বশ!

কিন্তু এবার দুই-আড়াইয়ে হবে না। ছ’মাস জেলে ছিল রথী। দিদির মুখ বন্ধ করতে হলে মিনিমাম পাঁচ হাজারের নোট ছাড়তে হবে। তাই ছানুর কাছে না গিয়ে উপায় নেই রথীর।

পান বানানোর জন্য ছানু একটা নতুন ছেলে রেখেছে। আর দোকানের বাইরে বড় কোল্ডড্রিঙ্ক রাখার ফ্রিজটার পাশে টুল নিয়ে বসে রয়েছে নিজে।

তবে ছানুর সঙ্গে কথা শুরুর আগেই ছানুর থেকে হাত-দশেক দূরে দাঁড়ানো দু’টো ছেলে আর একটা মেয়ের দিকে নজর গেল রথীর। একটা ভাল চেহারার লম্বা ছেলে চামড়ার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে টাই ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রথীর অভ্যস্ত চোখ বুঝল ছেলেটা বেচুবাবু। ঘুরে-ঘুরে কিছু বিক্রি করে। গলার টাইটা দিয়ে মশারিও টাঙানো যায়। দ্বিতীয় ছেলেটার কাঁধ অবধি কোঁকড়া চুল। গোঁফটা কামানো। কেমন বদখত একটা ফ্লোরাল প্রিন্টের শর্টশার্ট পরে রয়েছে। পিঠে কোনাকুনি করে নেওয়া একটা ব্যাগ। এমন কাটিংয়ের পিস দেখলেই জুতোতে ইচ্ছে করে রথীর। ওর কলেজেও এমন কিছু যন্তর ছিল। কেউ কবিতা লিখত, কেউ গান গাইত, আর এমন ভাব করত যেন সকাল-বিকেল নোবেল প্রাইজ় রিফিউজ় করছে।

ভাল জিনিস শেষে খাওয়ার মতো সবচেয়ে দর্শনীয় জিনিসটার দিকে শেষে চোখ গেল রথীর। চাপা জিন্সের প্যান্ট আর লম্বা ঝুলের একটা টপ পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা। মুখে কোনও মেক-আপ নেই; কিন্তু সুন্দর ত্বকই তো আসল মেক-আপ। টিভিতে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে গেল রথীর। আর আচমকাই তলপেটে একটা মোচড় লাগল। গত ছ’মাস কোনও মেয়েকে স্পর্শ করেনি ও। যেন ভুলেই গিয়েছে মেয়েদের ধরতে কেমন লাগে। মেয়েটাকে দেখে শরীরের ভিতরের একটা ঘুমন্ত রাক্ষস জেগে উঠল যেন। রথীর মনে হল, এক্ষুনি রাক্ষসটার খাবার চাই।

“ওভাবে দেখিস না,” ছানুর কথায় সংবিৎ ফিরল রথীর।

ও চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে রে মালটা? এ পাড়ায় থাকে?”

“না। এ পাড়ার জিনিস নয়। ওই টাই-পরাটা এ পাড়ার ছেলে।”

রথী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শালা, এদের কারা পায় রে বিছানায়?”

“ব্লসম ঠিকই করছে তা হলে!” ছানু উত্তর দিল।

“কে? ব্লসম? মানে?” রথী বুঝল না কোন কথার কী উত্তর দিচ্ছে ছানু।

ছানু টুল থেকে উঠে রথীর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, শোন, শিবি তোকে ডেকেছে। তার আগে এটাও শোন যে, ব্লসম ভাল মেয়ে। ভাল ছেলেরও কিন্তু অভাব নেই।

“মানে? কী বলছিস তুই? শালা কথার প্যাঁচ মারছিস?” রথীর ধৈর্য থাকছে না আর। ওর মনে হচ্ছে, ছানু কী যেন বলতে চায়।

“অন্য মেয়ের শরীর না দেখে নিজের পোষা মেয়েটির দিকে তাকা। গত ছ’মাস ব্লসমের সঙ্গে তো যোগাযোগ নেই তোর। তুই কি জানিস, আজকাল অন্য একটা ছেলের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে ওকে?”

‘কী?” রথী ভুরু কোঁচকাল।

“হ্যাঁ। যা বলছি শোন। ব্লসম কিন্তু…”

হাত তুলে ছানুকে থামিয়ে দিল রথী। ব্লসম অন্য ছেলের সঙ্গে ঘুরছে? কেন? রথী কি মরে গিয়েছে? না, রথীকে ভুলে গিয়েছে ও?

বিষাণ, ২৭ জুন: সকাল

“আচ্ছা বিষাণ, আজকাল সবাই কথার শেষে ‘চলো, যাই’, ‘চলো, পরে কথা হবে।’ এমন বলে কেন রে? কোথায় যাবে বল তো? সবাই ‘চলো’ ‘চলো’ করে মাথাখারাপ করে দেয়। রাস্তায় যেতে-যেতে চারদিকে যত কথা শুনি, তার বেশির ভাগই কথা শেষে কোথায় যেন যেতে বলে। ব্যাপারটা কী বল তো?” কপিল চিন্তিত মুখে বিষাণের দিকে তাকাল।

এ লোকটার মাথায় একটু ছিট আছে। সবসময় এমন-এমন সব কথা বলে যে, কোনও উত্তরই দেওয়া যায় না। সেদিন বলে কী, চাঁদে তো জল পাওয়া গিয়েছে। তা সেখানে আবহাওয়া নেই বলে মানুষ বাঁচতে পারে না। কিন্তু মাছেদের তো জল হলেই হয়। তা বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু মাছ ছেড়ে দিয়ে আসছে না কেন চাঁদের জলে? বিষাণ এর কী উত্তর দেবে? তাও সায়েন্সের ছেলে হলে না হয় কিছু বলা যেত। ওর তো অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স ছিল। নম্বরও খুব ভাল ছিল না। কেউ-কেউ বলেছিল সিএ পড়তে। কিন্তু বিষাণ সে-রাস্তা মাড়ায়নি। আরে বাবা, করমচা গাছে কি আঙুর হয়? অবশ্য ওর গাছে করমচাও হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে ওর!

বিষাণ ওয়াটার পিউরিফায়ার বিক্রি করে। কমিশন বেসিস। দরজায়-দরজায় ঘুরে-ঘুরে লোককে সুস্থ জল খাওয়াতে চায় ও। কিন্তু এ বড্ড কঠিন কাজ। জিনিস বিক্রি করার মতো কঠিন আর কিছু হয় না। লোকের পকেট থেকে একটা চার আনা বের করার চেয়ে বোধহয় পৃথিবীর সব কাজ সোজা। অন্তত বিষাণের তাই মনে হয়। তা ছাড়া ওদের কোম্পানিটা চেন্নাইয়ের। খুব একটা নামকরাও নয়। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়, কিন্তু তাতে পুরনো দিনের বাতিল এক অভিনেত্রী চোখ-মুখ উলটে এই পিউরিফায়ারের জল কত সুস্বাদু তা বোঝানোর চেষ্টা করেন। বিজ্ঞাপনটা যতবার দ্যাখে, বিষাণের মনে হয়, ভদ্রমহিলা ওদের পিউরিফায়ারের জল খেয়ে সত্যি চোখ-মুখ উলটে পড়ে যাচ্ছিলেন না তো! তা ছাড়া বাজারে নানারকমের পিউরিফায়ার এসে যাওয়ায় কম্পিটিশনও খুব টাফ। ফলে বিষাণ খুব-একটা সুবিধে করতে পারে না। সারাদিন এ দরজায়-ও দরজায় ঘুরে-ঘুরে বাড়ির বউদি, মাসিমা, কাকিমা, দিদিমাদের মুখঝামটা খায়। মাসের শেষে কমিশনকে মুখঝামটা দিয়ে ভাগ করে দেখে হাতে পড়ে রয়েছে মনখারাপ।

তবে এই সেলসম্যান ছাড়াও বিষাণের আর একটা পরিচয় রয়েছে। ও প্রাইভেট টিউশনিও করে। দু’টো ছেলে আর একটা মেয়েকে পড়ায়। ক্লাস টেন অবধি অঙ্ক আর ইলেভেন-টুয়েলভে অ্যাকাউন্টেন্সির ঝাঁকা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান বিতরণ করে। এই দুই রোজগারের যোগফলের থেকে নিজেরটুকু বাদ দিয়ে সংসারে হাজার দেড়েক টাকা দেয় ও। এ নিয়ে বাড়িতে আর কেউ কিছু না বললেও দাদা চন্দ্র মাঝে-মাঝেই খুব ঝামেলা করে। বলে, টাকা বাড়াতে, তা না হলে যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ও।

বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? কোথায় যাবে? বাবা তো মারা গিয়েছে বছর-দশেক আগে। এখন মা আর দাদা-বউদি ছাড়া কে আছে ওর? দাদার কথায় বউদি প্রতিবাদ করে মাঝে-মাঝে। কিন্তু দাদাটা বড্ড মুখরা। বিষাণকে দু’-একবার চড়-থাপ্পড়ও মেরেছে। মা বরাবরই শান্ত। ফলে কিছুই বলতে পারে না। মুখ বুজে ছোটছেলের হেনস্থা দেখে। আর চন্দ্র অশান্তি চরমে তুললে বলে, আমি তো গোটা টাকাটাই সংসারে দিই। ও তো চেষ্টা করছে। ওকে আর কিছু বলিস না। তা ছাড়া বিষাণ বোঝে শত অত্যাচার করলেও মা কোথায় যেন চন্দ্রকে একটু বেশি ভালবাসে।

চেষ্টা করাই নাকি জীবনে সব। সাফল্য নাকি সেকেন্ডারি ব্যাপার। হুঃ, বিষাণ বোঝে, এগুলো স্পিচ ঝাড়ার ব্যাপারে আদর্শ ডায়ালগ হলেও আসলে একদম ফালতু কথা। ভাবে, ও যদি একটা ভাল চাকরি জোটাতে পারত, তা হলে এই বয়সে হাঁটুর ব্যথা নিয়ে মাকে আর বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানোর ঝক্কি নিতে হত না। ওর অপদার্থতার জন্য মা-ই মাঝখান থেকে কষ্ট পাচ্ছে। মাঝে-মাঝে ওর মনে হয়, জীবনে যেন গিঁট লেগে গিয়েছে, ছাড়াতে পারছে না কিছুতেই। একটা ভদ্রগোছের চাকরির ভীষণ দরকার ওর। কিন্তু কোথায় চাকরি? অনেক তো দেখল, পেল না তো কিছুই। মা মাঝে-মাঝে বলে, অজুকে বলতে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারে না। হোক না অজু খুব বড় বাপের ছেলে। থাক না ওদের প্রচুর হাত। তা বলে বন্ধু হয়ে বন্ধুর কাছে হাত পাতবে? ও জানে আর পারবে না। করমচা গাছে কি আর আঙুর হয়?

“কী রে? বললি না তো! তোকে কী জিজ্ঞেস করছি?” কপিল আবার খোঁচাল।

বিষাণ বলল, “তুমি টাইয়ের নট বাঁধতে পারো?”

“কী?” কপিল এমন মুখ করল যেন গরুকে খুঁটোর সঙ্গে বাঁধতে বলা হয়েছে।

“টাইয়ের নট। দ্যাখো, খুলে গিয়েছে। রোজ কত সাবধানে গলা থেকে খুলে রাখি যাতে নটটা না গণ্ডগোল হয়। কিন্তু দ্যাখো, আজ দেখি টাইয়ের নটটা খোলা। নিশ্চয়ই মায়ের কাজ। এখন কে বেঁধে দেবে এটা?”

কপিল টেবিল থেকে রেডিয়ো তুলে নব ঘোরাতে-ঘোরাতে বলল, “তা আমি কী করব? আমি তো আর খুলে দিইনি। যা দোয়েলকে বল।”

দোয়েল মানে বউদি। মেয়েটা বিষাণের সমবয়সি। বুদ্ধিমতী। বিষাণকে যথেষ্ট আগলে রাখে। বিষাণ জানে, দোয়েলকে বললেই বেঁধে দেবে চট করে। কিন্তু দোয়েল তো স্নান করতে গিয়েছে। দোয়েলের এটাই একটা প্রবলেম। স্নান করতে যাওয়া তো নয় যেন অগস্ত্যযাত্রা। মাঝে-মাঝে চন্দ্র চিৎকার করে খুব। বলে, কী আছে বাথরুমে যে ওখানে অতক্ষণ সময় কাটাতে হবে? কিন্তু তবু দোয়েল শোনে না। দোয়েল বাথরুমে মানে একঘণ্টার জন্য বাথরুম বুক্‌ড। সেই দোয়েল সবে বাথরুমে ঢুকেছে। দোয়েলের বাইরে বেরনো অবধি অপেক্ষা করতে গেলে অফিস যাওয়া ডকে উঠবে। কিন্তু টাইটা যে অফিসের কাউকে দিয়ে পরে বাঁধিয়ে নেবে তাও সম্ভব নয়। বস ঝাড় দেবে খুব। এই সেল্‌স-এ একটা ব্যাপার আছে। ছ’জন সেল্‌সম্যানদের নিয়ে তৈরি এক-একটা টিমের মাথায় যারা টিমলিডার থাকে, তারা যেন এক-একজন হিটলার। পান থেকে চুন খসিয়েছে কী ধুয়ে-মুছে ইস্ত্রি করে ছেড়ে দেবে। এ যেন স্কুলের ডিসিপ্লিন!

কপিল রেডিয়োটা খুটখাট করতে-করতে বলল, “আজকাল কিছু বিক্রি করতে বেরুলে টাই পরতে হয় কেন রে?”

বিষাণের বিরক্ত লাগল। কপিলের প্রশ্নের শেষ নেই। বুড়ো মানুষ, কোথায় চুপচাপ বসে ভগবানের নাম করবে, না সারাদিন এটা কেন? ওটা কেন? কান ঝালাপালা করে দেয় একেবারে!

কপিল সম্পর্কে কাকা হয় বিষাণদের। বাবার নিজেরই ভাই। আগে বাইরে থাকত। বাবা মারা যাওয়ার পর ওদের সঙ্গে থাকে। এই ঘরটাতে কপিলের সঙ্গেই বিষাণ শোয়। আর যতক্ষণ জেগে থাকে এই প্রশ্নবাণ সামলাতে হয় ওকে।

“কীরে, বললি না তো কেন টাই পরে কোনও কিছু বিক্রি করতে বেরুতে হয়?”

বিষাণ বলল, “যাও না, দাদার ঘরে একটা ছেলে এসেছে। টাই পরা। ও-ও কিছু বিক্রি করতে এসেছে। ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো।”

“অ্যাঁ? চন্দ্রর ঘরে?” কপিল চুপ করে গেল।

বিষাণ জানে, কপিল মরে গেলেও চন্দ্রর ঘরে ঢুকবে না। চন্দ্রকে যমের চেয়ে বেশি ভয় পায় ও।

কপিল চুপচাপ রেডিয়ো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর কোনও প্রশ্ন করল না।

ওদের এই বাড়িটা তিনতলা। তিনতলাতেই ওরা ভাড়া থাকে। বাড়িওলা একতলায় থাকেন। স্বামী-স্ত্রীই থাকেন শুধু। দু’জনেরই বয়স হয়েছে। হাঁটুতে ব্যথা, তাই নিজেরা নীচের তলায় থেকে উপরের দু’টো ফ্লোর ভাড়া দিয়েছেন। এই তিনতলায় উঠতে মায়েরও কষ্ট হয়। কিন্তু কী আর করা যাবে?

বিষাণ পায়ে-পায়ে দাদার ঘরে গেল। আধঘণ্টা আগে এসে বসে-থাকা লোকটা এখনও বকে যাচ্ছে। অবশ্য লোক না বলে ছেলে বলাই ভাল। কী সব ইন্সিওরেন্স-টেন্স নিয়ে খুব কঠিন-কঠিন কথা বলছে দাদাকে। কোথায় কত টাকা রাখলে কত গ্রোথ হবে, কোথায় ডিভিডেন্ড ভাল, কোথায় ট্যাক্স বেনিফিট পাওয়া যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। বিষাণ দেখল দাদা খুব মন দিয়ে শুনছে।

“দাদা।” বিষাণ ভয়ে-ভয়ে ডাকল।

চন্দ্র মুখ তুলল। বিরক্তি যে কারও খুলির মধ্যে ছাপা হতে পারে, চন্দ্রকে না দেখলে সেটা বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। চন্দ্র বিরক্ত গলায় বলল, তোর আবার কী হল? দেখছিস না কাজ করছি?

“খুব জরুরি দরকার।” বিষাণ নিচু গলায় বলল।

“তাড়াতাড়ি বল। এই কাজটা শেষ করে আমাকেও অফিস বেরতে হবে।”

টাইটা একটু বেঁধে দিবি?

টাই? চন্দ্র থতমত খেল একটু। ও সরকারি চাকরি করে বলে টাই-ফাইয়ের বালাই নেই। চন্দ্র বলল, “তুই এটাও পারিস না? কেন করিস এসব? তোর মতো অপদার্থকে কে চাকরিতে নেয়? যা ভাগ, আমি পারব না।”

বিষাণের কান গরম হয়ে গেল। বাইরের লোকের সামনে এ কী হেনস্থা! বলল, “কেন, তুই বাঁধতে পারিস না?”

“আমায় তুই টাই বাঁধা শেখাবি?” চন্দ্র রেগে গেল হঠাৎ, “বেরো এখান থেকে। ননসেন্স কোথাকার!”

“আমি বেঁধে দেব?” সামনে বসে থাকা ছেলেটা বলে উঠল। হয়তো বিষাণের হেনস্থা দেখেই ওর করুণা হয়েছে।

বিষাণ ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, প্লিজ।

ছেলেটা নিজেও একটা টাই পরে রয়েছে, নীলের উপর সাদা টিপ-টিপ। বিষাণ হেসে টাইটা বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা দু’মিনিটের ভিতর ডাব্ল নটের টাই বেঁধে দিল। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের ঘরে এসে ব্যাগটা গুছিয়ে নিল বিষাণ। এবার বেরবে।

“ছাতাটা নে, যখন-তখন বৃষ্টি আসবে।” কপিল কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল।

“ছাতা?” বিষাণ চিন্তা করল। ছাতা ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগে না ওর। তার চেয়ে রেনকোট ভাল। কিন্তু রেনকোট পরে বাসে উঠলে বিস্তর গালাগাল খেতে হয়। দোনোমনো করে ছাতাটাই নিল ও। যদিও জানে, এই পলকা ছোট ছাতাগুলো কোনও কম্মের নয়। অনেকটা ওর মতো।

“আচ্ছা, আমাদের সময় তো লোকে এমনি-এমনি জল খেয়ে নিত। আর এখন সবাই এত ‘ওয়াটার পিউরিফায়ার ছাড়া জল খাব না’ বলে লাফায় কেন রে?”

বিষাণ দেখল, বাজারের ব্যাগ হাতে আবার ঘরে উদয় হয়েছে কপিল। বিষাণের কাঁদতে ইচ্ছে করছে এবার। ওরে বাবা, এ লোকটাকে কে পাঠিয়েছে পৃথিবীতে? এ মানুষ না কোয়েশ্চেন ব্যাংক?

বিষাণ এবার কড়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ট্যাঁ-ট্যাঁ করে কেঁদে উঠল ওর মোবাইল। অজু! মোবাইলে নামটা দেখে অবাক হল বিষাণ। এমন সময় তো ফোন করে না অজু! তা হলে? নিশ্চয়ই কোনও দরকার আছে। বিকেলে আবার ওর সঙ্গে কোথাও যেতে হবে নাকি?

অজুর পুরো নাম অজেয় বোস। বিষাণের স্কুলজীবনের বন্ধু। স্কুলে থাকতেই অজুর মাথায় কবিতার পোকা ঢুকেছিল। কলেজে সেটা আরও বাড়ে। আর এখন তো ও নিজেই পোকা হয়ে গিয়েছে। অজুকে দেখলে রীতিমতো ঘাবড়ে যায় বিষাণ। চোখ দু’টো সব সময় এমন ঢুলুঢুলু করে রাখে যেন মহাকাব্য লিখল বলে। অজুর বাপের প্রচুর বড় ব্যবসা আর দেদার টাকা। কিন্তু অজু কিছু করে না। অবশ্য এটা বললে ও খুব রেগে যায়। বলে, “আমি বাংলা ভাষার স্বাস্থ্যরক্ষা করি। জানিস, লিট্‌ল ম্যাগাজ়িন বের করা কত কঠিন কাজ?”

বিষাণের বলতে ইচ্ছে করে, তুই তো সারা বছরে মোট দু’টো ম্যাগাজ়িন বের করিস। তাও দু’ফর্মার। কিন্তু বলে না। কী হবে বলে? অজুর যা করার তা করবেই। সব মানুষ কি আর একরকম হয়? অজুর মতো মানুষজনেরও থাকা উচিত পৃথিবীতে, শুধু পয়সার-পিছনে-ছোটা মানুষজনে পৃথিবী ভর্তি হয়ে গেলে বড় বিপদ হবে।

তবে চন্দ্র একদম পছন্দ করে না অজুকে। বলে, “বাপের বখাটে ছেলে। কাম-ধান্দা ছেড়ে কবিতা মারাচ্ছে। জানোয়ার!” মাকে উদ্দেশ করে চন্দ্র বলে, “তোমার ছোটছেলেকে বলে দাও, ওই মোরগের ঝুঁটির মতো দেখতে ছেলেটা যদি এ বাড়িতে ঢোকে, তবে ওর সঙ্গে তোমার ছোটটাকেও জুতিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেব। সব ফ্রিলোডার্সের দল। বিনে পয়সায় বেঁচে থাকতে এসেছে।”

পৃথিবীসুদ্ধু লোকের উপর চন্দ্রর যে কেন রাগ, ভগবান জানেন। তবে অজু বোঝে যে, চন্দ্র ওকে পছন্দ করে না। তাই চন্দ্র থাকাকালীন বাড়িতে আসে না ও। তেমন দরকার হলে ফোন করে।

“হ্যালো।” ফোনটা কানে ধরল বিষাণ।

“কী রে রকেট সিং, এখনও বেরোসনি?” অজু হাসল।

“এবার বেরব।”

“তা তোর ওই রাবণ দাদাটি বাড়িতে আছে না কেটেছে?”

বিষাণ বলল, “না, আছে। কেন?”

“তবে আর যাব না। তুই তাড়াতাড়ি পাড়ার মোড়ে আয়। পানের দোকানটার সামনে আমরা ওয়েট করছি। আয় তাড়াতাড়ি। কুইক।”

“আমরা মানে?” বিষাণ জিজ্ঞেস করবার আগেই কুইক লাইন কেটে দিল অজু। অসহায় লাগল বিষাণের। অজুর পাল্লায় পড়লে আজ অফিসে দেরি হয়ে যাবে। পিউরিফায়ারের জন্য আজ সল্টলেকের কয়েকটা জায়গায় বেশ কিছু বাড়িতে চেজ় করতে হবে ওকে। তাদের নামধাম দিয়ে অন্তত ফিডব্যাক ফর্ম ভরাট করে আনতেই হবে। অজু আটকে দিলেই বিপদ।

সকালেই রুটি-তরকারি খেয়ে নিয়েছিল বিষাণ। তাই এখন আর খাওয়ার ঝঞ্ঝাট নেই। খাবার টেবিল থেকে মায়ের তৈরি করে রেখে যাওয়া চাউমিন-ভর্তি টিফিনবাক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে জুতো পরতে শুরু করল বিষাণ। বাইরে এমন মেঘ করেছে, যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামবে। সেল্স-এর কাজে বৃষ্টি একটা বাধা। তবে বর্ষাকালে পিউরিফায়ারের বিক্রি বাড়ে। এটাই যা আশার কথা।

কপিল বাজারে বেরিয়ে গিয়েছে। দোয়েল স্নানে। থাকার মধ্যে চন্দ্র। বিষাণ আর ওই ঘরের দিকে গেল না। দাদা আসছি, চেঁচিয়ে বলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল। কে জানে কাকে নিয়ে অজু হাজির হয়েছে। ছেলেটা নিজে কাজকম্ম করে না বলে ভাবে কেউ-ই করে না। এমন সময় কেউ আসে? এই নিয়ে কিছু বললেই অজু বলবে, বেশি সময় দেখাস না। ভুলে যাস না আমার ম্যাগাজ়িনে তুইও একজন সদস্য। প্রতিটা সংখ্যায় ‘বিষাণ দেব’ নামটা ছাপা হয়।

বিষাণের বলতে ইচ্ছে করে, “ভারী তোর ম্যাগাজ়িন রে! কীসব হাবিজাবি শব্দে ভর্তি। চাই না অমন নাম ছাপতে! কাগজ কেনো, ছাপাতে দাও, দোকানে বিলি করো, সব যেন আমার দায়!” বলতে ইচ্ছে করে, “পারব না, যা!”

কিন্তু পারে না, কিছুই বলতে পারে না বিষাণ। কে যেন ওর জিভে পাথর চাপিয়ে দেয়। কঠিন কথা বলে অন্যের মুখ ম্লান করে দেওয়ার শিল্পটা শেখা হয়নি ওর।

পাড়ার মোড়ের পানের দোকান মানে ছানুদার দোকান। এখান থেকে মাঝে-মধ্যে মায়ের জন্য পান কিনে নিয়ে যায় বিষাণ। ছানুদার সঙ্গে ভালই আলাপ আছে ওর।

পাড়ার রাস্তাটা সোজা গিয়ে বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছে। ওই বাঁকের পাশেই দোকানটা। ফলে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না অজুকে। বিষাণ দ্রুত পা চালাল। যতটা সংক্ষেপে সম্ভব কথা শেষ করে ওকে কাটতে হবে।

বাঁকটা ঘুরতেই হঠাৎ হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল বিষাণের। জিভ শুকিয়ে গেল। একটা ছোট্ট বিদ্যুত্কণা নিমেষের মধ্যে শিরদাঁড়ার গোড়া থেকে মুড়ো অবধি ওঠানামা করে নিল খানিক। বিষাণ দাঁড়িয়ে পড়ল।

ছানুদার দোকানের থেকে একটু দূরে অজুর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুমু। একটা চাপা জিন্স আর লম্বা ঝুলের টপ পরেছে। ক্লিপ দেওয়া থাকলেও কপালের উপর কয়েকটা ডানপিটে চুল লাফিয়ে পড়েছে। এই মেঘলা জুনের সকালে এমন একটা মেয়ে কেন এসেছে এখানে? ও তো বলেছিল বিষাণের মুখ দেখবে না। বলেছিল, অপদার্থ বিষাণ যেন কখনও না আসে ওর সামনে। তা হলে সেই কথা ভুলে হঠাৎ এল কেন কুমু? ও জানে না, ওকে দেখলে বিষাণের কত কষ্ট হয়?

জয়, ২৭ জুন: বিকেল

“পরশু দিন সকালে তিরিশ লাখ টাকার জোগাড় করতে হবে। কিন্তু পরশু তো রোববার!”

শামিমের কথাটা এখনও কানে বাজছে জয়ের। বাচ্চা ছেলে! পকেটে মেশিন নিয়ে ঘুরলেই কি সব হয়? এই আটত্রিশ বছরের জীবনে জয় যা দেখেছে, তা দেখতে হলে শামিমকে আরও দু’বার জন্মাতে হবে।

বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতেই থাকত জয়। কিন্তু মায়ের মনটা ছিল ফড়িংয়ের মতো। আর তাতে আরও ঘি ঢেলেছিল মায়ের রূপ। মামার বাড়িতে গিয়ে ওঠার এক বছরের মধ্যে নিজের চেয়ে চার বছরের ছোট একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় মা। কোথায় যায়, কেউ জানতে পারেনি কোনওদিন।

নেহাত দিদিমা ছিল, তাই জয় আঠারো বছর অবধি ওই বাড়িটাতে থাকতে পেরেছিল। দিদিমা মারা যাওয়ার পর মামারা তাড়িয়েই দিয়েছিল ওকে।

সেসময় কী কাজ না করেছে জয়? রঙের মিস্ত্রি, ছুতোরের হেল্পার, খালাসি, পোর্টের কুলি, আরও নানারকম। সেখান থেকে সাঁতরাতে-সাঁতরাতে এত অবধি আসতে হয়েছে জয়কে। শামিমরা ভাবতেই পারবে না সেই পথ। মায়ের থেকে রূপটা পেয়েছে জয়, কিন্তু মায়ের মতো চঞ্চল মন পায়নি। কাজের ব্যাপারে ও খুব মনোযোগী। আটচল্লিশ ঘণ্টারও কম সময়ে তিরিশ লাখ টাকা জোগাড় করা কঠিন কাজ নয়। এসব টাকা তো আর কেউ ব্যাংক থেকে তোলে না। এসব টাকার লেনদেনে রবিবার কোনও অন্তরায় নয়।

যে লোকটা ডলার বিক্রি করবে, সে তেইশ টাকায় ডলার দিচ্ছে। কিন্তু নোটগুলো জেনুইন কিনা তার জন্য রামনকে পাকড়াও করতে হবে। টাকার চেয়ে এই ব্যাটাকে ধরাটা বেশি জরুরি আর কঠিন। রামনের যেন পায়ের তলায় সর্ষে আছে। কখন যে কোথায় থাকে! তবে নোট চেনার ব্যাপারে মাস্টার লোক। সারা পৃথিবীর কারেন্সি প্রায় মুখস্থ। ওকে নিয়ে রোববার যেতে হবে ডলার কিনতে। কিন্তু তখন থেকে রামনের মোবাইলে ট্রাই করে যাচ্ছে। কিছুতেই পাচ্ছে না। মোবাইল সুইচ্ড অফ। গাড়ির সামনের সিটে বসে অস্থির লাগছে জয়ের। ওর ইচ্ছে করছে, কলকাতার যে দু’-তিন জায়গায় রামনের ডেরা আছে সেখানে একবার নিজে ঢুঁ মারে। রামন ব্যাটাচ্ছেলে অন্য কাউকে দেখলে একদম ভাগিয়ে দেবে। একমাত্র জয়ই পারে রামনকে কথা শোনাতে। একমাত্র জয় বললেই রোববার কাজ করতে রাজি হবে ও।

আসলে রোববার কিছুতেই কাজ করতে চায় না রামন। বলে, “ভগবান পর্যন্ত ছ’দিন ইউনিভার্স বানিয়ে একদিন রেস্ট নিয়েছিলেন। আর আমি নেব না?”

এমন লোককে কাজে নামাতে হলে এখন থেকেই তোড়জোড় শুরু করতে হবে। কিন্তু তার বদলে কী করছে জয়? না, পাহারাদারের চাকরি।

কলকাতায় আকাশটা আজ বড্ড নিচু হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে, কে যেন মেঘলা রঙের একটা মশারি টাঙিয়ে দিয়েছে শহরটার মাথায়। এত মেঘ কোনওদিন জমতে দেখেনি জয়। এখনও তেমন বৃষ্টি হয়নি। এবার মনে হচ্ছে, সেই ঘাটতি সুদে-আসলে উশুল করে নেবে প্রকৃতি।

ঘড়ি দেখল জয়। পৌনে পাঁচটা। সূর্যটা আকাশের ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধে হতে এখনও অনেক বাকি, তবু অন্ধকার হয়ে এসেছে। আর এর ভিতর এই ঝুপ্পুস গাড়ির মধ্যে বসে বিরক্ত লাগছে জয়ের। সেন্টের গন্ধে নাক আর মাথা দুই-ই জ্বলে যাচ্ছে একদম।

সুতনুর সব ভাল লাগে জয়ের। কিন্তু এই একটা জিনিস ছাড়া। বাড়িতে বউ থাকতে কেন যে অন্য মেয়েমানুষের কাছে লোক যায়, বুঝতে পারে না জয়। ও তো ভাবতেই পারে না যে, কেয়াকে ছেড়ে ও অন্য মেয়েদের দিকে তাকাবে। যতই কেয়া ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুক, তবু জয় অন্য মেয়েদের দিকে নজর পর্যন্ত দেয় না।

অবশ্য সবাই যে এমন হবে তা নয়। সবাই যে জয়ের মতো একনিষ্ঠ হবে তার কোনও মানে নেই। ওর নিজের মা-ই তো অন্যরকম ছিল।

গাড়ির পিছনের সিটে বসে থাকা মেয়েটার নাম জিনা। বয়স একুশ-বাইশ। সামান্য মাজা রং। চাপা নাক। কিন্তু চোখ দু’টো বিশাল বড়। ঠোঁটটাও চওড়া আর ছোট্ট।

একটা জান্তব আকর্ষণ যে আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তা বলে এর সঙ্গে এতটা বাড়াবাড়ি করা সুতনুর উচিত নয়।

সুতনুর স্ত্রী সিমি, মানে বউদি খুব ভাল। কখনও বউদিকে জোরে কথা বলতে শোনেনি জয়। সুতনু যা বলে, মুখ বুজে মেনে নেয়। এমনকী মাঝে-মাঝে বাইরের লোকের সামনেও বউদিকে সুতনু যা-তা বলে। ফর্সা ছোট্ট মানুষটা অপমানে একদম এইটুকু হয়ে যায়। জয়ের এত রাগ হয়! কিন্তু ও নিরুপায়। সামান্য বেতনভুক। পয়সার ওজনে জিভ নাড়াতে পারে না।

সুতনুদের বাড়িটা বিশাল বড়। একটা অংশে সুতনুরা থাকে আর অন্য অংশে থাকে ওর দাদা বিতনু। এই বিতনু মানুষটা খুব সৎ। একটা বড় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ফার্ম আছে ভদ্রলোকের। দেদার পয়সা। তবে সাদা পয়সা। সুতনুর মতো কালো পয়সা নয়। বিতনুর সামনেই একমাত্র সুতনু সংযত থাকে।

তবু কেন যে এই জিনাকে নিয়ে সুতনু এমন বাড়াবাড়ি করে! গিরিশ পার্কের কাছে জিনাকে একটা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে সুতনু। সঙ্গে দু’জন জাঁদরেল চেহারার মহিলাকেও রেখেছে সেখানে। তারা কাজের সঙ্গে-সঙ্গে জিনাকে পাহারাও দেয়। আর জিনার যখন বাইরে বেরতে ইচ্ছে হয়, সুতনু গাড়ি দিয়ে জয়কে পাঠিয়ে দেয়। জয়কে ছাড়া আর কারও হাতে জিনাকে ছাড়তে ভরসা পায় না সুতনু। আটচল্লিশ বছর বয়সের লোক যখন নিজের অর্ধেকের চেয়েও কম বয়সের মেয়ের প্রেমে পড়ে তখন এমনই হয়।

তবে জিনা যন্তর জিনিস। যাকে বলে একদম কম্পালসিভ ফ্লার্ট। জয়কে পেলেই জিনা শরীর আর কথা বাঁকাতে শুরু করে। নানা অছিলায় জয়কে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। বিরক্ত হলেও জয় তা দেখাতে পারে না। শুধু নিজেকে সরিয়ে রাখে।

“তোমার পুরো নাম যেন কী?”

পিছনের সিট থেকে সামান্য ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় প্রশ্নটা ভেসে এল।

জয়ের দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা। মেয়েটা আবার বকতে শুরু করল। ওফ! ও বলল, “জয়সেন রাউথ।”

“সেন রাউথ। দূর, এমন কোনও টাইটেল হয় নাকি?” মেয়েটা হাসল। যেন খুব মজার কথা বলে ফেলেছে।

“আমার পুরো নাম জয়সেন। সেনটা নামেরই অংশ।” গাড়ির ড্রাইভার বিষ্ণুর ঠোঁটে আলতো হাসি দেখে জয় আরও গম্ভীর হয়ে গেল।

“ও, জাস্ট লাইক তানসেন, না?” কাচ ভাঙার মতো হাসির শব্দ এল পিছনের সিট থেকে।

আবার রামনের মোবাইলে ট্রাই করল জয়। এখনও বন্ধ। শালা করছেটা কী? আজ তো রোববার নয়, আজ শুক্রবার। তা হলে? কোন চুলোয় আছে যে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে?

“আচ্ছা তোমার ওয়াইফের নাম কী?” জিনা প্রশ্ন করল।

“কেয়া।” উত্তর না দিলে জয় জানে মেয়েটা আরও বাড়াবাড়ি করবে।

“ইজ় শি প্রিটি?”

“হ্যাঁ, খুব সুন্দরী।” কথাটা বলা মাত্র সকালে কেয়ার লাল পোশাকে মোড়া শরীরটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। হাসিটা ভেসে উঠল। বাঁশির সঙ্গেই না কথা বলছিল? বুকের ভেতর কে যেন এক বিকার অ্যাসিড ঢেলে দিল জয়ের। বাঁশির সঙ্গে অমন করে কথা বলে কেন কেয়া?

কেয়ার যে লেডিস টেলারিং শপটা আছে, সেখানে কাজ করে বাঁশি। ও ছাড়া আরও তিনজন মেয়েও কাজ করে সেখানে। বাঁশির বয়স সাতাশ-আঠাশ বছর। মিশমিশে কালো রং আর দৈত্যের মতো চেহারা। ভাল নাম বংশী। কিন্তু লোকের মুখে সেটা বাঁশি হয়ে গিয়েছে।

দোকানের মাল আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে বাইরের সমস্ত কাজ বাঁশি একা হাতে করে। কেয়া খুব নির্ভর করে ছেলেটার উপর। তবে ইদানীং মানে মাস-দু’য়েক হল একটু বেশিই নির্ভর করছে। বাঁশির বাড়ির অবস্থা ভাল নয়। বাবা পুরুতগিরি করে। ফলে বাঁশির উপরই সংসার। এমন একটা ছেলেকে কেয়া সাইকেল কিনে দিয়েছে। মোবাইলও কিনে দিয়েছে। কখনও-কখনও রাতে বাঁশির সঙ্গে ফোনে গল্প করতেও শুনেছে কেয়াকে। কষ্টে, হিংসায় মরে গিয়েছে জয়। আর শুধু গিয়েছে নয়, যায়। এই গাড়ির মধ্যে বসেই ওর শরীর একদম দুমড়ে আসছে যন্ত্রণায়। আজকের দিনটাতেও কেয়া কী করে পারে সব ভুলে হেসে কথা বলতে?

“সুতনু তোমায় বলেছে যে আজ আমার বার্থডে?” জিনা আবার প্রশ্ন করল।

“না।” জয় ভাবল, ও কে যে বলবে? আর বলেই বা হবেটা কী?

তুমি কি ভেবেছ, রোজ রোজ এই গিরিশ পার্ক থেকে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে সুতনু আমায় আসতে দেবে? জানো না, ও একটা স্বার্থপর দৈত্য? আমি খুব করে বলেছি বলেই শপিং-এ আসতে অনুমতি দিল। তাও তোমার সঙ্গে।

“আয়াম সরি। দাদা আসতে পারবেন না। কিছু ক্লায়েন্ট এসেছে বাইরে থেকে। তবে রাত আটটার পর তো…”

“জানি, আসবে। হাফ ড্রাঙ্ক হয়ে, খানিকটা নাচানাচি করবে, তারপর হেদিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।” জিনা বিরক্ত হয়ে বলল।

জয়ের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এসব কথা কি ওকেই বলতে হবে? বিষ্ণু এখনও ফুড়ুক-ফুড়ুক করে হাসছে। জিনার পারসোন্যাল ড্রাইভার। যদিও সুতনুর অনুমতি ছাড়া জিনাকে নিয়ে কোথাও বেরোয় না। এমন একজনের সামনে কি এসব বলার কোনও যুক্তি আছে? বন্ধ দরজার ওদিকে সুতনু জিনার সঙ্গে কী করে তা কি লোকের সামনে না বললে হচ্ছে না?

লর্ডসের মোড়ের জ্যামে গাড়িটা আটকে আছে। এখানে খুব জ্যাম হয়। ধোঁয়া আর মেঘে এই লর্ডসের মোড় যেন আরও কালো হয়ে আছে। আর রাস্তায় ওই গ্যাঞ্জামের ভেতরই ছেলেটাকে চোখে পড়ল জয়ের। বিষাণ!

গায়ে রোঁয়া-ওঠা শার্ট, গলায় সস্তার টাই, নীল প্যান্ট আর পিঠে ঢাউস একটা ব্যাগ। লম্বাচওড়া আর লাজুক এই ছেলেটাকে সুতনুদের বাড়িতে কখনও-কখনও দেখা যায়। সুতনুর বড়দা বিতনুদের অংশে আসে ছেলেটা। সঙ্গে অবশ্য আর একটা ছেলেও থাকে। অজু। অজু যতটা কিম্ভূত হয়ে থাকে, এ ছেলেটা ততটাই সাদাসিধে।

বিতনুর স্ত্রী আনন্দী বউদি। বউদি কবিতা লেখেন, খুব চড়া মেক-আপ করেন আর কলকাতা শহরের প্রায় সমস্ত পার্টিতেই উপস্থিত থাকেন। বউদি একটা ম্যাগাজ়িনও বের করেন। মানে, বউদি টাকা দেন আর কী! বের করে ওই অজু। সঙ্গে বেগার খাটে এই বিষাণ।

আনন্দী বউদির সঙ্গে প্রায় কোনও কথাই বলে না জয়। কিন্তু বউদির মেয়ে কুমুদ্বতী খুব মিশুকে। কে বলে সুন্দরী মেয়েদের অহংকার থাকে? বরং ভীষণ আপন করে কথা বলে সবার সঙ্গে। মেয়ে আর মা-তে বিশাল ফারাক।

জয় দেখল বিষাণের ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে। গাড়ির ঠান্ডার ভিতরে বসে থাকলেও জয় জানে মেঘ-চাপা কলকাতা সেদ্ধ হচ্ছে গরমে। এত কষ্ট করে বিষাণ ক’টা টাকা পায়? এমন মানুষের কষ্ট দেখলে জয়ের নিজের ফেলে-আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ওকেও একসময় খুব কষ্ট করতে হয়েছে।

মলের সামনে গাড়ি থেকে নামল জয়। জিনাকেও দরজা খুলে দিল। বিষ্ণুকে পার্কিংয়ে গাড়ি লাগাতে বলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

এই মলটা কয়েক বছর হল হয়েছে। আগে জায়গাটা অন্যরকম ছিল একদম। এখন ভীষণ জমজমাট। মলটাকে দেখলে জয়ের মনে হয় যেন কোনও রাক্ষসের মাথা অর্ধেক ডুবে আছে মাটিতে। যেন আচমকা ঘুম ভেঙে সে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে মানুষজনকে।

গাড়ি থেকে নেমেই গরম লাগছিল জয়ের। মলের ভিতরে ঢুকে আবার ভাল লাগল। বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা ভাব চারিদিকে।

জিনা একদম গায়ের কাছে ঘেঁষে এল আচমকা। জয়ের হাতে শরীর ঠেকিয়ে আদুরে গলায় বলল, “তুমি আমায় কোনও গিফ্ট কিনে দেবে না?”

“আমি? কেন?” ভুরু কুঁচকে গেল জয়ের।

“বারে, আজ আমার জন্মদিন না!” জিনা জয়ের গায়ের সঙ্গে লেগেই গেল একেবারে।

এ তো মহা মুশকিল! সুতনু জয়কে ভরসা করে মেয়েটার সঙ্গে পাঠায়। সেখানে মেয়েটা যদি এমন করে তা হলে তো বিপদ! ও তাড়াতাড়ি সরে গেল। বলল, “প্লিজ়। এমন কোরো না।”

“ডোন্ট ইউ লাইক মি? তোমার আমায় ছুঁতে ইচ্ছে করে না?”

“জিনা! জয় শক্ত গলায় বলল, দাদা আমায় তোমার সঙ্গে পাঠিয়েছেন। দাদা এসব জানলে কিন্তু রেগে যাবেন।”

“ছাড়ো তো!” জিনা মুখ বাঁকালো, “ওর ধক জানা আছে আমার। নেহাত টাকার দরকার আমার তাই…না হলে…তুমি এখনও এত হ্যান্ডসাম কী করে আছ? আমার তোমার সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে।” হাতকাটা পিঙ্ক কালারের টপের ওপর জেগে থাকা দু’টো বুক দিয়ে আলতো করে জয়ের হাতটা ছুঁয়ে দিল জিনা।

জয়ের শক লাগল যেন। বহুদিন পর এমন স্পর্শ পেল ও। নিমেষে কান লাল হয়ে গেল জয়ের। ও চোয়াল শক্ত করল। দেখল জিনা ঠোঁট কামড়ে হেসে এসকালেটরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

জয়ও পা বাড়াল আর সঙ্গে-সঙ্গে যেন জমেও গেল ওর পা। এ কী দেখছে ও? সত্যিই দেখছে তো?

উপরে ওঠার এসকালেটরের একদম উলটোদিকে নীচে নামার এসকালেটর। আর সেটা দিয়ে ভেসে-ভেসে নীচে নেমে আসছে কেয়া। পরনে সেই লাল শাড়ি। আর কেয়ার পিছনে দু’-তিনটে প্যাকেট হাতে বাঁশি! দু’জনে খুব হেসে-হেসে কথা বলছে। মনে হচ্ছে, দু’জনের চারদিক থেকেই পৃথিবী মুছে গিয়েছে একদম। যেন আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না ওরা।

এত দূর গড়িয়েছে ব্যাপারটা? এখন একসঙ্গে শপিংয়ে যেতে শুরু করেছে? আর কী-কী করছে একসঙ্গে? কোথায় যাচ্ছে? মাথার ভিতরটা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে জয়ের। কেয়া এমন করতে পারছে ওর সঙ্গে? বাঁশি আছে বলেই কি জয়কে আর দরকার পড়ে না? কী পেয়েছে ওরা? কী ভেবেছে? জয় কিছু জানতে পারবে না? বুঝতে পারবে না? দাঁড়াও, আমি দেখছি। জয় পকেট থেকে মোবাইল বের করে দ্রুত একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল। ফোনে এই লাইনটা পাওয়া খুব দরকার।

বিষাণ, ২৭ জুন: বিকেল

লর্ডসের মোড়টা পৃথিবীর সবচেয়ে হিজিবিজি জায়গার একটা। এখানে আসলেই ভিড় আর গাড়ির হট্টগোল দেখলে বিষাণের মনে হয়, পৃথিবীর সব মানুষের যাতায়াতের পথই যেন লর্ডস মোড় হয়ে যায়!

আজ কাজে বিশেষ সুবিধে হয়নি। যে ক’টা বাড়িতে গিয়েছে সব জায়গাতেই সে অসফল হয়েছে। পিউরিফায়ার বিক্রি করা যে এত ঝক্কির হবে, কে জানত! আসলে ও বুঝতে পারেনি যে কাজটা কঠিন। বুঝতে পারেনি যে, লোকের পকেট থেকে টাকা বের করা ভীষণ শক্ত। প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেল ও এই কাজটা করছে। কিন্তু রেজাল্ট খুব খারাপ।

ওদের কোম্পানি থেকে ট্রেনিং-এর নামে দু’সপ্তাহের একটা পিণ্ডি হয়েছে। তাতে পিউরিফায়ারের ভিতরে কী-কী থাকবে, তাদের কাজ কী, অন্য পিউরিফায়ারের চেয়ে তারা কোথায় আলাদা, এসব শেখানো হয়েছে। কিন্তু সেসবই এমন ভাসা-ভাসা যে, কোনও কিছুর সম্বন্ধেই স্পষ্ট করে জেনে উঠতে পারেনি বিষাণ। আর খদ্দেররাও সব এক-একজন মহাপণ্ডিত!

আজকেই তো প্রায় কুড়িটা বাড়িতে ভিজিট করেছে। তার পনেরোটাতে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল। বাড়ির মহিলারাই কথা বলেছে। আর সব এমন-এমন প্রশ্ন করেছে যে তাদের কাছে কপিলকাকু বাচ্চা! এক ভদ্রমহিলা তো বললেন, “আমি পলিমার নিয়ে পড়াশোনা করেছি। ফিল্টারের বডি মেটিরিয়ালের স্ট্রাকচারটা বলুন দেখি? মানুষকে জল খাওয়াতে বেরিয়েছেন আর পিউরিফায়ারের বডির পলিমার স্ট্রাকচার জানবেন না, তা তো হয় না!”

আর একজন বলেছেন, “আগে একমাস জল খাব, তারপর টাকা দেব। রাজি?”

বিষাণ সারাদিনে একটা ব্যাপার বুঝেছে, উপার্জন করা ভীষণ কঠিন এক কাজ। তা ছাড়া আজ আর একটা সমস্যাও হচ্ছিল। বারবার একজোড়া চোখের কথা মনে পড়ছিল ওর। ক্ষুধার্ত, হিংস্র একজোড়া চোখ। এমন দৃষ্টি কোনওদিন দেখেনি ও। ওই চোখ দু’টো দেখার পর থেকে সারাটা দিন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। একটা রাগ পাক খাচ্ছে মনে। চাপা, মনখারাপ মেশানো একটা রাগ।

লোকটা দাঁড়িয়েছিল ছানুদার পানের দোকানের সামনে। অজু আর কুমুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েই লোকটাকে চোখে পড়েছিল বিষাণের। দোহারা লম্বা আর গালটা সামান্য ভাঙা। তবে আসলে যেটা চোখে পড়েছিল তা হল চোখ। যেন পৃথিবীর সমস্ত আগুন ঢুকেছিল চোখের ভিতর। আর সেই আগুনের লক্ষ্য ছিল কুমু। ভীষণ রাগ হচ্ছিল বিষাণের। ভীষণ মনখারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, দু’হাতে গলা টিপে শেষ করে দেয় লোকটাকে। কুমুর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানোর একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড!

তবে বিষাণ জানে, ফাঁসির দড়ি ছোট আর পৃথিবী বিশাল বড়। প্রায় সবাই তো কুমুর দিকে ওভাবেই তাকায়। অত সুন্দর হতে কে বলেছিল ওকে? একদিন, ঠিক এই প্রশ্নটা কুমুকে করবে ও। ঠিক জিজ্ঞেস করবে, সবার সামনে কেন অমন দু’টো চোখ তুলে ও তাকায়? কেন অমনভাবে ওর সঙ্গে কথা বলে?

সকালে লোকটার দৃষ্টি মনের মধ্যে ফোস্কা ফেলে দিয়েছিল বিষাণের। আর সারাদিন ধরে ফোস্কাটা খুব ভুগিয়েছে ওকে। তবে শুধু ফোস্কা নয়, কুমুও কষ্ট দিচ্ছে ওকে।

সিগন্যালটা লাল হয়েছে এবার। গাড়ির স্রোত থেমে গিয়েছে। পিঠে গন্ধমাদন নিয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে রাস্তা পেরল বিষাণ। গল্ফগ্রিনের রাস্তায় কিছুটা হেঁটে এক কবির বাড়ি যেতে হবে। অজুর পত্রিকার জন্য চারটে লেখা দেবেন ভদ্রলোক।

‘অজুর পত্রিকা’ কথাটা অবশ্য টেকনিক্যালি ঠিক নয়। টেকনিক্যালি বলতে গেলে পত্রিকাটা আনন্দী আন্টি, মানে কুমুর মায়ের। কিন্তু সহযোগী সম্পাদক হিসেবে রয়েছে অজু। বছরে বত্রিশ পাতার দু’টো ম্যাগাজিন বের করে কী যে মোক্ষলাভ হয় আর এতে বাংলা ভাষার কী যে উপকার হয়, ভগবান জানে! কিন্তু আন্টির কাছে ওই দু’টো সংখ্যার প্রকাশকালই বছরের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। দু’টো সংখ্যাই রীতিমতো ঢাকঢোল বাজিয়ে প্রকাশ করে আন্টি।

বড় ব্যাংকোয়েট হল ভাড়া করে, ককটেল পার্টি দিয়ে, প্রেস ডেকে, সে এক রাজসূয় যজ্ঞ করে আন্টি। সেই পার্টিতে সাহিত্য, নাটক, ফিল্মজগতের লোকজন আসেন। খচাখচ শব্দে ক্যামেরা ঝলসায়, গ্লাস আর প্লেট হাতে পোজ় দেয় সবাই। আর তেমন দু’-একটা ছবি পরদিন কোনও-কোনও কাগজে বেরোয়ও।

এসব অনুষ্ঠানগুলোয় যেতে কী যে খারাপ লাগে বিষাণের, ও কাকে বোঝাবে? ও একদম এই ইভেন্টগুলোয় যেতে চায় না। অত আলো, ঝলমলে পোশাক, মিথ্যে হাসি, ভান-একদম সহ্য হয় না ওর। বরং কষ্ট হয়। একঘর ভর্তি লোকের সামনে থেকে পা গুটিয়ে ফুটো মোজা লুকিয়ে রাখার মতো নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় ও। মনে হয়, এত অতিরিক্ত কিছুর মধ্যে ও বেমানান। সারা জীবনই তো ওর ব্যক্তিগত ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই কার্ভটায় সাপ্লাইয়ের পাল্লা নীচের দিকে। তাই কোথাও সাপ্লাইয়ের বাড়াবাড়ি ঠিক সহ্য করতে পারে না বিষাণ।

কিন্তু যেতে হয় ওকে। অজু ছাড়ে না। বলে, আমাদের পত্রিকার অ্যাকটিভ কর্মী তুই, এভাবে পিছিয়ে গেলে চলবে? তাই গেলেও এই সব পার্টিগুলোয় একদম মনে-মনে মরে গিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে ও। আর হিংসুটের মতো দেখে, সকলের লুব্ধ দৃষ্টির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কুমুদ্বতী।

তবে এমন একটা অনুষ্ঠানে গতবার গিয়েছিল বলেই না এই চাকরিটা হয়েছিল ওর। সে যতই যেমন চাকরি হোক, জলজ্যান্ত চাকরি তো একটা! তবে বিষাণ জানে, এর পুরো ক্রেডিটটাই লাবানার।

লাবানা, মানে লাবানা মিত্র, এখনকার উঠতি গায়িকা। এই ব্যান্ডের যুগেও ও একক অনুষ্ঠান করে। সিন্থেসাইজ়ার, গিটার, মাউথ অর্গ্যান সাজিয়ে স্টেজের মধ্যে দাঁড়িয়ে একাই গান করে। আর হলভর্তি লোক ওইটুকু একটা মেয়ের মাস্তানি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।

কত বয়স হবে লাবানার? তেইশ কী চব্বিশ! বিষাণের চেয়ে দু’-তিন বছরের ছোটই। তবু কী সাংঘাতিক কনফিডেন্স! কী দুর্দান্তভাবে মেয়েটা নিজেকে ক্যারি করতে পারে! প্রথম দিন দেখে তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল বিষাণ।

সেদিন কলকাতার একটা নামি হোটেলে ম্যাগাজ়িন-প্রকাশের পার্টি ছিল। আনন্দী আন্টিদের তো টাকার অভাব নেই, তাই এই পার্টির আয়োজনটাও খুব চড়া সুরেই ছিল। আর বিষাণের স্বভাব মতো, ও এককোণে একটা ফ্রেশ লাইম সোডা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এত চকচকে পরিবেশে নিজেকে ভীষণ বেমানান লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল, সুযোগ পেলেই পালিয়ে যাবে। ঠিক তখনই, মার্বেলের মেঝে ফুঁড়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল লাবানা।

হাতে ধরা জিনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেছিল, “আচ্ছা অহংকারী তো তুমি! কাউকে কথা বলার যোগ্য মনে করো না, না? অ্যান্ড ডু ইউ নো, দ্যাট ইউ হ্যাভ পাপ্পি আইজ়?”

পাপ্পি? কুকুর ছানা? বাচ্চা কুকুর? না কুকুরের বাচ্চা? মেয়েটা কি অপমান করছে ওকে? নাকি এও কমপ্লিমেন্ট! এত উপরমহলের কথাবার্তা ঠিক ধরতে পারে না বিষাণ। সেদিনও পারেনি। উত্তরে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল আরও।

লাবানা সেদিন আরও অনেক কথা বলে যাচ্ছিল একনাগাড়ে। ওর হাতে সিগারেটটা পুড়ে শেষ হয়ে আসছিল ক্রমশ। লাবানা বিষাণের মোবাইল নাম্বার, অ্যাড্রেস চাইছিল। জিজ্ঞেস করছিল, কোথায় চাকরি করে ও? বলেছিল, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করলে ও একটা কাজের বন্দোবস্ত করে দিতে পারে। ওর কথা আর মাথা নাড়ানোর ঝাপটায় ছোট করে কাটা চুলটা নড়ছিল। ফর্সা গাল দু’টো লাল হয়ে উঠেছিল একদম। চোখের দৃষ্টিটা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছিল। শেষের দিকে লাবানা বিষাণের একটা কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে-আস্তে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছিল ওর উপর। জড়ানো গলায় বলেছিল, “পাপ্পি আইজ় আর সেক্সি আইজ়।”

আনন্দী আন্টি লাবানার অবস্থা দেখে চলে এসেছিল ওদের সামনে। বলেছিল, “মেয়েটার লিমিট জ্ঞান নেই দেখছি! এঃ, এখন ওকে কে বাড়ি পৌঁছে দেবে? ডিসগাস্টিং!”

অজু বলেছিল, “বাইরে ড্রাইভার আছে, যা বিষাণ, তুই পৌঁছে দিয়ে আয় ওকে।”

“আমি?” আঁতকে উঠেছিল বিষাণ।

“ইয়েস, তুমি যাও,” আন্টি যেন আপদ বিদায় করতে পারলে বাঁচে, “ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। ও নিয়ে যাবে। অ্যাড্রেস আছে আমার কাছে।”

হলভর্তি লোক এমনভাবে বিষাণের দিকে তাকিয়েছিল যেন ও মোজ়েস। দুর্গতদের ত্রাণের জন্য ঈশ্বর ওকে পাঠিয়েছেন। লোহিতসাগরটা ওকেই পার করিয়ে দিতে হবে।

গাড়ির পিছনের সিটে বসে লাবানার ভার সহ্য করতে-করতে ওর বকবকও শুনছিল। লাবানা জড়ানো গলায় কথা বলে যাচ্ছিল অনর্গল। গাড়ির ভিতর বসে রাতের ছমছমে কলকাতা দিয়ে যেতে-যেতে বিষাণ ভাবছিল, ও একটা বিশাল চিড়িয়াখানার ভিতর আটকে গিয়েছে আর সবাই ওকে নিজের মতো নাচাতে চাইছে।

সেই লাবানাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পর আর পার্টিতে ফিরে যায়নি। ফোন করে লাবানার পৌঁছনোর সংবাদ অজুকে দিয়ে ও চলে গিয়েছিল বাড়িতে।

এর দু’দিন বাদে সকালে মোবাইলে একটা ফোন পেয়েছিল বিষাণ। অচেনা নাম্বার দেখে দোনামনা করে ধরেছিল। ওপাশ থেকে একটা গলা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, “হ্যালো বিষাণ! লাবণ্য বলছি। কেমন আছ?”

“লাবণ্য?” বিষাণ থতমত খেয়ে গিয়েছিল।

“হ্যাঁ লাবণ্য। মানে লাবানা ইয়ার। আমার ভাল নাম লাবণ্য। লাবানাটা হল স্পাইডারম্যান। মানে পিটার পার্কার যেমন স্পাইডারম্যান। তেমন আমিও স্টেজের জন্য লাবানা। আমি ফোন করেছিলাম টু সে থ্যাংকস। সেদিন আমি হাই হয়ে গিয়েছিলাম একটু। ইউ ওয়্যার আ রিয়েল স্পোর্ট। বাই দ্য ওয়ে, আমার তো জ্ঞান ছিল না। গাড়িতে আমার এখানে-ওখানে হাত দাওনি তো?”

“মানে?” প্রশ্নের বহর দেখে আঁতকে উঠেছিল বিষাণ।

“আরে, জাস্ট জোকিং ইয়ার,” ফোনের ওপারে খিকখিক করে হেসেছিল লাবানা, “তবে আই রিমেমবার আদার থিংস। আমার মেসোর একটা ছোট্ট রেফারেন্স আছে। আমি ফোন নম্বরটা মেসেজ করছি। সেখানে ফোন করে নাও। ইউ মে গেট আ জব। তবে নাথিং স্পেশাল, জাস্ট আ স্টেপ ওয়ান। কেমন?”

লাবানার মেসোর এক বন্ধুর এই পিউরিফায়ার কোম্পানিতে স্টেক আছে। তার কথায় চাকরি হয়েছে বিষাণের। না, খুব ভাল কিছু নয়। কিন্তু তবু কানা মামা তো! ছাত্র ঠেঙিয়ে আর কাজ করে যা আসে তাতেই কোনওমতে চলছে বিষাণের।

চাকরিটা পাওয়ার পর পুরো ঘটনাটা অজুকে বলেছিল বিষাণ। অজু শুনে বলেছিল, “চাকরির দরকার থাকলে কুমুর বাবা বা আমার বাবাকে বলতে পারতিস। কে লাবানা না সাবানা, তাকে বলতে গিয়েছিস কেন?”

পাশে দাঁড়ানো কুমু বলেছিল, “দিস ইজ় সো চিপ ম্যান। সো এলএস। এর চেয়ে গলায় রুমাল বেঁধে ফুটপাথে দাদের মলম বিক্রি করতে পারতে! কোনও স্ট্যান্ডার্ড নেই তোমার? একটা মেয়ে তোমার গায়ে পড়ল আর তুমি লোভীর মতো দু’ টাকার জন্য তার ফেলে দেওয়া হাড় চুষতে ছুটলে! তুমি তো খুব গ্রিডি! গেট আ লাইফ বিষাণ। গেট আ রিয়াল লাইফ।”

কুমুর এমন আচমকা আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল বিষাণ। ও ভাবতে পারছিল না কেন কুমু এমন বলছে! তবে মাথা নিচু করে নিয়েছিল ও। কী হবে মানুষের সঙ্গে তর্ক করে?

পরে অজু বলেছিল যে, কুমুর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেক-আপ হয়েছে বলে ও আজকাল হঠাৎ-হঠাৎ রিঅ্যাক্ট করে। তাই বিষাণ যেন কিছু মনে না করে।

ব্রেক-আপ হয়েছে শুনে মনের গোপন একটা কোনায় দুম করে হাউই ফেটেছিল বিষাণের। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি ও। কারণ ও তো জানে, বুঝতে দিয়ে কোনও লাভ নেই। বরং তাতে ও-ই হাসির খোরাক হবে সবার।

এই চাকরিটা নেওয়ার পর থেকেই কেন কে জানে কুমু অন্যরকমভাবে কথা বলে বিষাণের সঙ্গে। আগে যেমন বিষাণকে নিয়ে এখানে-ওখানে যেত দরকারি কাজে। এখন আর যায় না। তার উপর গত দু’সপ্তাহ আগে আর একটা বিপত্তি হওয়ায় ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। বিষাণ জানে না, এর থেকে কীভাবে মুক্ত হবে ও।

পকেটের মোবাইলটা হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল। সবসময় ভিড়ে থাকতে হয় বলে মোবাইলটাকে ভাইব্রেশন মোডে দিয়ে রাখে বিষাণ। ফোনটা বের করে ঘাবড়ে গেল বিষাণ। চন্দ্র! দাদা! ও তো আজ পর্যন্ত কোনওদিন ফোন করে না বিষাণকে! তা হলে? হঠাৎ!

বিষাণ হাঁটা থামিয়ে কানে ফোনটা লাগাল, “হ্যাঁ, বল।”

“কোথায় তুই?”

“কাজে আছি। কেন রে? কোনও দরকার ছিল?”

“শোন, আজ সন্ধে আটটার ভিতর বাড়িতে আসবি। খুব জরুরি দরকার আছে। অন্য কোথাও কোনও রাসকেলের সঙ্গে গ্যাজাতে বসে যাবি না। ইট্‌স ভেরি আর্জেন্ট। মনে থাকে যেন!” চন্দ্র বিষাণকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে কট করে লাইনটা কেটে দিল। কী কেস রে ভাই! বিষাণ মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুলটা ঘেঁটে নিল একটু। চন্দ্র কী বলবে? কয়েকবার তো আলাদা হয়ে যাব বলে হুংকার দিয়েছে, সেটাই কাজে পরিণত করবে না তো? ভয় আর নিরাপত্তাহীনতায় একটা ঠান্ডা বরফের টুকরো দ্রুত পিঠ বেয়ে নেমে গেল। কী বলবে চন্দ্র? শরীর হঠাৎ দুর্বল লাগল বিষাণের। পা দু’টো যেন জবাব দিয়ে দিল। আর ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না।

কলকাতা আরও কালো হয়ে এল মেঘে। আরও গভীর হয়ে উঠল তার আকাশের অন্ধকার উদর। দু’-চারটে আগুনের রেখা সাপের মতো লকলক করে উঠল আকাশে। দমকা হাওয়ায় আশপাশের গাছপালা পাক খেয়ে উঠল। দূরে প্লাস্টিকের ত্রিপল উড়ল খানিক। লোকজনের ব্যস্ততা হঠাৎই বেড়ে গেল একটু। আর এরই ভিতর দু’টো-চারটে করে ক্রমশ অর্বুদ সেনানিসমেত বৃষ্টি আক্রমণ করল কলকাতাকে।

রথী, ২৭ জুন: সন্ধে

কাকের গলার রঙের আকাশ এখন কালো হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে বিকেলে আর এই সন্ধেতেও তার গতি বাড়েনি। ক্ষুধার্ত বুড়ির একঘেয়ে বিলাপের মতো হয়ে চলেছে বৃষ্টি। বড় রাস্তা থেকে এই পর্যন্ত আসতে গিয়ে চটির সঙ্গে ছিটছিট কাদা জিন্স আর হাফশার্টের পিছনটার বারোটা বাজিয়েছে। এরকম বৃষ্টি জঘন্য লাগে রথীর। যে-কোনও ঘ্যানঘ্যানে জিনিসই অসহ্য লাগে ওর।

দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে সময় দেখল রথী। ছ’টা চল্লিশ বাজে। আর বড়জোর কুড়ি মিনিট দেখবে ও। তারপর বেরিয়ে যাবে। শিবি কি ভেবেছে ও-ই একমাত্র ব্যস্ত লোক? আর অন্য কারও কোনও কাজ নেই? সেই পৌনে ছ’টা থেকে এখানে বসে রয়েছে ও। শরীরে শিকড় গজিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমনিতেই মেজাজ পুরো খাট্টা। তার উপর এমন অপেক্ষা! রথীর রাগ হচ্ছে খুব।

শিবি কেন ডেকেছে কে জানে! ছানু ঠিক বলতে পারেনি। শুধু বলেছে, “গতকাল তোর রিলিজ জেনেই তোকে দেখা করতে বলেছে বিড়ালটা।”

রথীর ভিতরটা আর একটা কারণেও আড় হয়ে আছে। কারণ ও মনে-মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই ক’মাসে। আজ সেটা শিবিকে জানাতে হবে।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল ও। না কিছু নেই। অবশ্য মেসেজ বা কোনও মিস্ড কল এলে তো বুঝতেই পারত। তবু নিজের অজান্তেই বারবার ফোনটায় চোখ চলে যাচ্ছে ওর। একটা কলও করল না মেয়েটা? কেন? কেন করল না?

মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রথী বলল, “হ্যাঁ রে পবন, দাদা কোথায় একবার দ্যাখ না। মাইরি আর কতক্ষণ বসে থাকব বল তো? আমার কি আর অন্য কাজ নেই?”

পবন ছেলেটার বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। কিন্তু হাবভাব বিশাল বড়। মাথার সামনে রং করা চুলগুলো দেখলে মনে হয় যেন জং ধরেছে চুলে। বাঁ কানে দুল। আর চুলের পিছনটা পুরনো কুড়ি পয়সার মতো ছুঁচলো করে কাটা। আর টিকির মতো চুলের গুচ্ছ ঝুলছে পিছনে। যতবার চোখ পড়ছে, ততবার মেজাজটা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে ওর। শিবি এমন একটা মর্কটকে কেন অফিসে বসতে দেয়? সে যতই চা-খাবার আনার কাজ হোক।

আজ অফিসে অন্য কেউ নেই বলে পবনই ফোন ধরছে। রথীর কথায় চোখের সামনে ধরা একটা ছেঁড়া ম্যাগাজ়িন সরাল পবন। বলল, “অন্য কাজ থাকুক না-থাকুক, সেটা কি দাদার প্রবলেম? দাদা ওয়েট করতে বলেছে। ব্যস, চুপ মেরে ওয়েট করো। বেশি ঘ্যানঘ্যান করে আর নাট ঢিলে করবে না।”

“মানে?” রথীর মনে হল রোগা পাতলা ছেলেটাকে চেপ্টে টিকিটের মতো করে দেয়।

“মানে কিলিয়ার। দাদার জন্যই তো সবার এত তেল। তো সেই দাদার অপেক্ষায় একটু বসে থাকা যায় না?”

“তেল মানে?” রথী উঠে দাঁড়াল। আর একটা ফালতু কথা বললেই ও ভুলে যাবে যে শিবির অফিসে বসে রয়েছে।

মারমুখো রথীকে দেখে এবার ঘাবড়াল পবন। বলল, “আহা, তোমায় বলছি নাকি? তুমি কেন মনে নিচ্ছ?”

রথী বসে কড়া গলায় বলল, “শোন পবন, তেল, মালমশলা তুই যা দেখতে চাস, দেখাব। আর ফারদার যদি ফালতু কথা বলিস তোকে এমন ক্যালাব না যে, ছ’মাস বিছানা থেকে উঠতে পারবি না।”

পবন হাসল, ইটের মতো দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল ওর। বলল, “টেম্পার হেভি গরম মনে হচ্ছে? ছ’মাস জেলে ছিলে বলে শরীর ঝাড়তে পারোনি তো, তাই শরীরের গরম মাথায় জড়ো হয়েছে। যাও কোথাও গিয়ে আজ শরীরটা ঝেড়ে এসো, দেখবে দিমাগ সফেদ হয়ে গিয়েছে।”

রাগতে গিয়েও হঠাৎ মনে-মনে কেমন যেন নেতিয়ে পড়ল রথী। আচমকা ঝনঝন করে পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। রথীর আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। তা হলে কি ব্লসম ফোন করল?

তাড়াতাড়ি ফোনটা পকেট থেকে বের করল রথী। যাঃ শালা! ষোলো চাকার ট্রাক যেন বসে গেল বুকের ভিতরের নরম কাদায়। দিদি!

রণিতার গলাটা এখনও ভারী হয়ে আছে। রথী বুঝল, দুপুরবেলার ঝামেলার জের এখনও মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে দিদি।

সকালে ছানুর থেকে টাকা নিয়েই চলে যেতে পারেনি রথী; বরং দোকানে জমে গিয়েছিল। এত মাস পরে দেখা! তাই গল্প জমে ছিল অনেক। দুপুর একটা নাগাদ হঠাৎ খেয়াল হয়েছিল রথীর, আরে, বাড়ি যেতে হবে যে! দিদি তো জানত গতকাল ও আসবে, রান্না করে রেখেছিল কি? এখন গেলে দিদি আবার খেপে যাবে না তো? বলবে না তো, “গতকাল তো ছাড়া পেয়েছিস, তা বাড়িতে আসিসনি কেন? রান্না করে রেখেছিলাম। খাবার নষ্ট হলে কী হয় জানিস না?”

ওদের বাড়িটা একটু পুরনো, ড্যাম্প-ধরা। বাড়ির ভিতর একটা ছোট্ট চাতাল আছে। তার এককোণে কলের জলে বাসন ধুচ্ছিল রণিতা। বাড়িতে পা দিয়েই রথী বুঝেছিল দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছে সবার। ও ভেবেছিল, দিদি অন্তত ও কেমন আছে, সেটা জানতে চেয়ে কথা শুরু করবে। কিন্তু প্রথম বলটাই একদম বুকসমান বিমার হয়ে ছুটে এসেছিল। যা ভেবেছিল ঠিক সেই প্রশ্নটাই করেছিল দিদি।

রথী বলেছিল, “না, মানে… মুনিয়ার গতকাল জন্মদিন ছিল তো…তাই…”

“তাই কী? তাই আসিসনি? আমার কি ঢ্যামনা পয়সা? প্রতি বছরই কি গুষ্টির লোককে পাত পেড়ে খাওয়াব নাকি? তার উপর বাড়ির একজন যদি জেলে যায়?”

রথী মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। দেখেছিল, একচিলতে বারান্দায় বসে গুপি জুলজুল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এ লোকটা দিদির শ্বশুর। এ বাড়িতেই থাকে নিজের মতো। পেনশনের টাকা থেকে সংসারে টাকা দিয়ে আর কোনও ঝঞ্ঝাটে ঢোকে না।

“কী রে, কাল রাতে কোন আঘাটায় মরেছিলি?” দিদি ঝুড়িভর্তি বাসন তুলে গলার ঝাঁঝ আরও বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেছিল।

“না, এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। ভাবলাম, জন্মদিনে যদি লোক আসে তাদের সামনে …মানে…ইয়ে…” রথী কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

“খুব অসুবিধের কথা ভাবতে শিখেছিস, না? জানোয়ার! বলেছিলাম, জামাইবাবুর দোকানটা খুলে ঝেড়ে-ঝুড়ে বোস। দু’টো পয়সার সুরাহা হবে। না, গুন্ডামি করতে গিয়েছে। অত ধক আছে নাকি তোর? ক’টা পয়সা নিয়মিত দিস সংসারে? তুই কি ভাবিস, দিদি চামার, তাই মাঝে-মাঝে থোক কিছু টাকা দিলেই মুখ বন্ধ হয়ে যাবে? কোনও বন্ধু তোকে ছ’মাস দেখতে গিয়েছিল জেলে? বন্ধুর বাড়িতে রাত কাটিয়েছে!” দিদি বাসনগুলো তুলে ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল।

রথী বুঝতে পারছিল যে, দিদি আরও অনেকক্ষণ গজগজ করবে। এখন কিছু বলতে গেলে বিপদ আছে। ও মুখ বুজে স্নান সেরে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েছিল। তারপর তাকের একটা নির্দিষ্ট জায়গা থেকে চাবি পেড়ে নিয়ে ছোট আলমারিটা খুলেছিল। গত ছ’মাস বন্ধ ছিল ওর মোবাইল। সেটাকে চার্জে বসিয়ে ছানুর থেকে আনা টাকাপয়সা ছোট লকারটায় ঢুকিয়ে রেখেছিল।

“খেয়ে যা, হুট করে বেরিয়ে যাস না।” দিদি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল।

“খাব?” রথী রণিতার দিকে তাকিয়েছিল। দিদির গলা এখন নরম। রাগের ঝাঁঝটা আর নেই। মনে-মনে নিজেকে ছোট মনে হয়েছিল রথীর। দিদি হয়তো অতটাও চামার নয়। কই, এসে থেকে তো একবারও টাকা দেওয়ার কথা বলেনি!

ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, কচুর লতি আর চারাপোনার ঝোল, খুব সাধারণ খাবার। কিন্তু বহুদিন পর বাড়ির খাবার পাওয়ায় শরীর যেন ছেড়ে দিয়েছিল। মুখ ধুয়ে দিদির ঘরে গিয়েছিল রথী। দিদি মুনিয়ার একটা ফ্রকে বোতাম লাগাচ্ছিল। ওকে দেখে জানতে চেয়েছিল, “কিছু বলবি?”

“পাঁচ হাজার টাকা আছে এতে। এ ক’মাস তো কিছু দিতে পারিনি, তাই…” পাঁচশো টাকার নোটগুলো এগিয়ে দিয়ে সংকোচের সঙ্গে বলেছিল রথী।

দিদি টাকাটা নিয়ে বলেছিল, “গতকাল জেল থেকে বেরিয়ে আজকেই এতগুলো টাকা পেলি কোথায়?”

“ছানুর কাছে কিছু টাকা পেতাম। তাই সকালে গিয়েছিলাম। ভাবলাম, গত ক’মাস তো দিতে পারিনি কিছু, তাই…” রথী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল।

“শোন রথী, এবার এসব গুন্ডামো ছাড়। পার্টির পোষা গুন্ডা হয়ে কি বাকি জীবনটা কাটাবি? জেলে যেতে কি খুব ভাল লেগেছে তোর? না এতে মান বেড়েছে? তোর ফিরিঙ্গি গার্লফ্রেন্ড তো সেই জন্যই ফুটে গেল।”

“কী? ফুটে গেল? কে? ব্লসম?” রথীর শরীরে আবার বিদ্যুৎ চমকেছিল।

“না তো কে? আর থাকবেই বা কেন? অত সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে জেল-খাটা কয়েদির সঙ্গে ঘুরবে? তাকে বিয়ে করবে? তুই ভাবলি কী করে? দেখা হয়েছিল তো আমার সঙ্গে। কিন্তু এমন ভাব করল যেন চিনতেই পারেনি। আমিও ছাড়িনি, পাকড়েছিলাম শক্ত করে। আমি কি ভুলে গিয়েছি তোর কত টাকা ওর পিছনে খরচ হয়েছে? দরকারের বেলায় আমার ভাই আর সেই ছেলেটার যখন বিপদ হয়েছে তখন পালক ঝেড়ে ফেলার ধান্দা, না?

“আঃ,” এই প্রথম বিরক্ত হয়েছিল রথী, “কী হয়েছিল বল না।”

“কী আবার হবে? আমি ডেকে যেই কথা বলতে গিয়েছি, বলে কিনা আমায় চেনে না! আমাদের বাড়িতে দু’বার খেয়ে গিয়েছে মেয়েটা। তোর পয়সা আমার সংসারে না লেগে ওর উনুন জ্বালিয়েছে, আর বলে কিনা চেনে না! মানুষের কি বিপদ হয় না? তা বলে মানুষের খারাপ সময়ে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে?”

মাথার ভিতরটা ফাঁকা লাগছিল রথীর। বুকে কষ্ট হচ্ছিল খুব। এ কী বলছে দিদি? সকালে ছানু বলছিল, ব্লসম অন্য একজনের সঙ্গে ঘুরছে। এখন দিদি বলছে, ব্লসম দিদির সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে রাজি নয়। তা হলে এই ছ’মাসে কি সত্যিই পৃথিবী এতটা বদলে গেল? ব্লসম পুরনো দিনগুলো সব ভুলে গেল! ছ’মাস জেলে ছিল বলে কি এখন অচ্ছুত হয়ে গিয়েছে ও?

সারা দুপুর ঘুমোতে পারেনি রথী। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেছিল। হাতের উপর ছাপ মারা জেলের রাবার স্ট্যাম্পটা ঘষে-ঘষে প্রায় মুছে ফেলেছিল। তবু বুঝতে পারছিল, স্মৃতি থেকে তা মোছা যাবে না, নামের উপর থেকে ‘জেল-খাটা’ শব্দটা মোছা যাবে না।

শেষ দুপুরে একটা ছোট ফোল্ডিং ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল রথী। মোবাইলে ব্যালান্স নেই। সেটা ভরতে হবে যে! কারণ, ব্লসম এ সময় কাজে থাকে। ফোন ছাড়া ওর সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব।

ফোনে টাকা ভরে তড়িঘড়ি ফোন করেছিল রথী। রিং হচ্ছিল ওপাশে। প্রতিটা রিংয়ের সঙ্গে কে যেন স্ক্রুয়ের প্যাঁচে ওর ফুসফুস দু’টো থেকে হাওয়া বের করে নিচ্ছিল ক্রমশ। ফুসফুসের শেষ হাওয়াটুকু বেরনোর পরও ফোন ধরেনি ব্লসম। ‘নো আনসার’ হয়ে নিজে থেকেই কেটে গিয়েছিল ফোনটা। আকাশের সমস্ত মেঘ এসে হুটোপাটি করে ঢুকে পড়েছিল রথীর শরীরে। রথী যেন হাঁটতে পারছিল না। পা দু’টো যেন শরীরের ভার বইতে পারছিল না। মেঘের যে কত ওজন তা আজ বেশ বুঝেছে ও!

দিদি গম্ভীর গলায় বলল, “বাড়িতে আটা নেই। আসার পথে কুড়িটা হাতরুটি আর তড়কা নিয়ে আসিস। আমি ডিমের ঝোল বানিয়ে রাখছি।”

“ঠিক আছে। আমি ন’টার মধ্যেই ফিরব।”

“ন’টা? অত দেরি করবি কেন? এমন দুর্যোগে কী করবি তুই অত রাত অবধি বাইরে?”

“আমার একটু কাজ আছে।”

রণিতা এমনভাবে ফোনটা কাটল যে, রথী বুঝতে পারল দিদি আরও রেগে গিয়েছে। কিন্তু কী আর করবে? ওকে একবার রানিকুঠি যেতেই হবে। ব্লসমকে যে একবার মুখোমুখি ধরতেই হবে। আটটা অবধি ডিউটি ওর। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সাড়ে আটটা হয়। সেই সময়টা ওদের পাড়ার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালে অন্তত একবার ব্লসমকে ধরা যেতে পারে। আগে হলে রথী ব্লসমদের বাড়িতেই চলে যেত; কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। ব্লসম যদি বাড়িতে কিছু ঝামেলা পাকায় তা হলেই সব ভন্ডুল হয়ে যাবে।

অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। আর বসে থাকা সম্ভব নয়। এই মনোহরপুকুর থেকে রানিকুঠি মোড়ে যেতে মিনিমাম পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে আজ। বৃষ্টি হলে কলকাতা শহরটার যা অবস্থা হয়, তাতে দশ মিনিট টেনে-হিঁচড়ে আধঘণ্টা হয়ে যায়। এই অফিসে বসে সামনের রাস্তায় গাড়ির মিছিল দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, মেন রোডের অবস্থা কেমন!

রথী দেখল সাড়ে সাতটা বাজে। এখন যদি শিবি আসে, সে ব্যাটাই আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট খেয়ে নেবে। ফলে ব্লসমকে আর ধরা যাবে না। অবশ্য আর একটা সম্ভাবনাও উঁকি মারছে রথীর মনে।

এই ছ’মাসের ভিতরে যদি ব্লসমের কাজ বদলে যায়? যদি কাজের সময় বদলে যায়? কিন্তু চিন্তা করে কে কবে রাজা হয়েছে? রথী উঠল। পবনের কাছে গিয়ে বলল, “আমি একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। বসে-বসে কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছে একদম।”

পবন হাসল, “ঠিক আছে। তবে কাছাকাছি থাকো।”

রথী বাইরে বেরিয়ে এল। ছাতাটা বড্ড ছোট আর পলকা, বৃষ্টির জন্য একদম উপযুক্ত নয়। তবু সেটা খুলে যতটা সম্ভব মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করল রথী। বৃষ্টিটা হয়েই চলেছে ক্রমাগত।

রানিকুঠির মোড় থেকে আরও কিছুটা হেঁটে ছোট গলির মুখটায় গিয়ে দাঁড়াল রথী। এ জায়গায় আলোটা একটু কমজোরি। মনখারাপের মতো একটা হাওয়া ভেসে আছে। বৃষ্টির টাপুরটুপুর হয়েই চলেছে মাথার উপর। পায়ের চটিটা ভিজে জাব হয়ে আছে একদম।

মোবাইলের আলোয় সময় দেখল রথী। আটটা সাঁইত্রিশ। আর কতক্ষণ দাঁড়াবে ও? ন’টার মধ্যে বাড়ি না গেলে তো দিদি কুরুক্ষেত্র করবে। আর ভাল লাগছে না!

স্ট্রেস, মনখারাপ আর ক্লান্তিতে শরীর নুয়ে আসছে যেন। দুপুরের পর কয়েক কাপ চা ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি ওর। তার উপর গত কুড়ি মিনিটে শিবির অফিস থেকে চারটে কল এসেছিল, ও একটাও ধরেনি। বিড়ালের মতো চোখ দু’টোর পিছনে যে রাগটা আছে, তা মনে-মনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রথী। কী করবে এখন ও? ব্লসমের জন্য সবাই রেগে যাচ্ছে ওর উপর। কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে মেয়েটা? ও কি জানে, রথী ওর জন্য সবার কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠছে?

দূর থেকে ব্লসমকে দেখে একসমুদ্র জল বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল রথীর। ছ’মাসে কিছু পালটায়নি মেয়েটার। সেই ছিপছিপে চেহারা, সুন্দর রং আর ঈষৎ পাহাড়ি মুখের গড়ন। কিন্তু এই অদ্ভুত মোমের পুতুলের মতো মুখটা দেখলে রথীর বুকের ভিতর কত যে উথালপাথাল হয়, সেটা কাকে বোঝাবে ও? ওর নিজেকে যে ব্লসমের সামনে কত অসহায় লাগে সেটা ও-ই জানে!

“ব্লসম, ব্লসম,” কী করবে বুঝতে না পেরে রথী সরাসরি এগিয়ে গেল ব্লসমের দিকে, “তুমি আমার ফোন ধরছ না কেন? কী হয়েছে?”

ব্লসম মুখ তুলল। চোখে প্রাথমিক আশ্চর্য ভাব। তারপর নিমেষেই সেটা বদলে গেল রাগে। মাখনরঙা মুখটা হঠাৎ লাল হয়ে গেল।

“ব্লসম, কখন থেকে ফোন বাজছে তোমার। ধরছ না কেন?” রথীর মনে হল ব্লসমের সামনে মাটিতে বসে পড়ে একদম।

ব্লসম কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগল। “ব্লসম, ব্লসম!” বলে পিছন-পিছন হাঁটতে লাগল রথী।

ব্লসম দাঁড়াল না একটুও, হাঁটার গতি বদলে দৌড়ে গলির ভিতর ঢুকে গেল। রথী আর না দৌড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

ব্লসম ওর সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলল না! এতদিন পর দেখল, তবু একটা কথা পর্যন্ত খসাল না মুখ থেকে! ও কি সব ভুলে গেল? সব কিছু পিছনে ফেলে দিল? একবারও চিন্তা করল না রথীর কথা? ও জানে না, রথী কতটা ভালবাসে ওকে? জানে না, রথী ওকে ছাড়া বাঁচবে না?

গলির ভিতরে ব্লসম ক্রমশ আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। আলো আর আবছায়ায় ডুবে-ভেসে, ডুবে-ভেসে ও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। রথীকে ফেলে এক কলকাতা বৃষ্টির ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মোমের পুতুলের মতো মেয়েটা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *