ঠাকুরমার গল্প-২

ঠাকুরমার গল্প-২

“বহু-বহু বছর আগে ভারতবর্ষের এক রাজ্যে বিধান নামে একটি রাখাল বালক ছিল। সাতকুলে তার এক মামা ছাড়া আর কেউ ছিল না। রোজ সকাল-বিকেল সে গোরু চরাতে মাঠে যেত। আর বিশেষ কাজকর্ম বিধান জানত না। গোরুগুলোকে ছেড়ে দিয়ে বিধান বড় গাছের তলায় বসে বাঁশি বাজাত।

“রোজকার মতো একদিন সে মাঠে গোরু চরাতে গেছে এমন সময় দেখে কী, আকাশ থেকে বিশাল একটা পুষ্পক রথ এসে নামল দূরের ওই দিঘিটার পাড়ে। বিধান তো অবাক! এ কী নামল আকাশ থেকে! এমন তো দেখেনি কোনও দিন! ওর কৌতূহল হল খুব। ও পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল দিঘির দিকে।

“দিঘির পাড়টা খুব সুন্দর। বড়-বড় গাছে ঢাকা। আর সেই গাছের ফাঁকে-ফাঁকে সুন্দর ছোট-ছোট ফুলের গাছ। বিধান অমন একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল! তারপর খুব সাবধানে একটা ফুল গাছের ডাল সরিয়ে উঁকি দিল। আর যা দেখল, তাতে ও থমকে গেল একদম।

“বিধান ফুল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখল সেই দিঘির পাড়ে বসে রয়েছে সাতটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে। তারা নিজেদের মধ্যে গান গাইছে, হাসছে, গল্প করছে! বিধান তো এমন সুন্দরী কাউকে দেখেইনি কোনও দিন। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেই সাতটি মেয়ের দিকে। ভাবল এরা এল কোথা থেকে? এরা কারা? এখানে এসেছেই বা কেন!

“এমন সময় বিধান শুনল একটি মেয়ে অন্য একটি মেয়েকে বলছে, ‘ছোট, যা তো ফুল পেড়ে আন গাছ থেকে! আমরা আজ মাথার মুকুট বানাব।’

“যেমনি কথা তেমনি কাজ। সাতজনের মধ্যেকার সবচেয়ে ছোট মেয়েটা উঠে ফুল গাছের কাছে এল। তারপর ফুল পাড়তে শুরু করল। আর বিধান একবার ভাল করে দেখল এই মেয়েটাকে! পান পাতার মতো মুখ! পাতলা নাক! টানা-টানা চোখ! ছোট্ট কপাল! এমন কাউকে তো কোনও দিন দেখেনি বিধান! ও এমন মোহিত হয়ে গেল যে ভুলেও গেল সেই মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনের ফুল গাছটার কাছেই।

“তারপর মেয়েটা যেই গাছের ডাল সরিয়ে ফুল তুলতে গেল, তখনই ওর চোখে চোখ পড়ল বিধানের! বিধান নড়তে পারল না। মেয়েটাও বিধানের সামনে থেকে নড়তে পারল না! দু’জনে যেন সম্মোহনে পড়ে গেল দু’জনের!

“এদিকে ছোট বোন আসছে না দেখে বাকি ছয় দিদি উঠে এল দিঘির পাড় থেকে।

“বড় দিদি বলল, ‘কী রে, তুই দেরি করছিস কেন?’

“ছোট বোন কথাই বলতে পারল না। বিধানের থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না যে!

“দিদিরা কত কিছু বলে বোনকে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু কিছুতেই সফল হল না।

“তারপর বিধান জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

“মেয়েটি বলল, ‘রাজিতা।’

“দিদিরা বিধানকে ভয় দেখাল। বলল, ওদের মা স্বর্গের দেবী। যদি জানতে পারে তা হলে বিধানকে এমন অভিশাপ দেবে যে ভাবতেও পারবে না।

“বিধান তাও ভয় পেল না। বরং বলল, রাজিতার জন্য ও সব কিছু করতে পারে। রাজিতাও যেন বিধানের থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। যেন মনে হচ্ছে, এই মানুষটার জন্যই ও এত দিন অপেক্ষা করছিল।

“রাজিতা ওর দিদিদের বলল, ‘আমি বিধানের কাছেই থাকব। তোমরা ফিরে যাও।’

“দিদিদের তো মাথায় হাত, এ কী বলে রাজিতা! ওরা কত করে বোঝাল, মায়ের কথা বলল। কিন্তু রাজিতা শুনলই না কিছু।

“নিরুপায় হয়ে দিদিরা তখন রাজিতাকে খুব আদর করল। ওদের সঙ্গে করে আনা সব কিছু রাজিতাকে দিয়ে দিল। বলল, বিধানের সঙ্গে যেন ভাল থাকে রাজিতা। তারপর ফিরে গেল পুষ্পক রথে।

“তারপর বিধান আর রাজিতা গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে ঘরসংসার করতে লাগল।

“কিন্তু রাজিতার মা, স্বর্গের দেবী হৈমবতী, সে তো রেগে আগুন হয়ে গেল এইসব শুনে! এটা কী করল রাজিতা! মায়ের কথা তার একবারও মনে পড়ল না! সব ছেড়ে গেল নিমেষের মধ্যে! এত সাহস! আর বিধান! কে সে! সামান্য রাখাল বই তো কিছু নয়! তা হলে! তার এত সাহস হয় কী করে! আচ্ছা, দেখা যাবে।

“হৈমবতী সঙ্গে-সঙ্গে তার সৈন্যদের জড়ো করলেন। আর বললেন, এক্ষুনি যেন তারা গিয়ে রাজিতাকে নিয়ে আসে তাঁর কাছে। আর বিধান বাধা দিলে যেন তাকে মেরে ফেলা হয়।

“সৈন্যরা দেবীর কথায় আর সময় নষ্ট না করে সঙ্গে-সঙ্গে মর্তে গিয়ে হাজির হল। ভাগ্য এমন যে বিধান তখন বাড়িতে ছিল না। রাজিতা একাই ছিল।

“সৈন্যরা রাজিতার কোনও কথাই শুনল না। তাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল ঘরের বাইরে। তারপর রথে তুলে রথটি চালিয়ে দিল!

“রথ যখন মাটি ছাড়ছে, ঠিক তখনই বিধান ফিরে এল মাঠের থেকে। আর দেখল রাজিতাকে তার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিধান চিৎকার করল। লোকজনকে ডাকল। সাহায্য চাইল। কিন্তু কেউ এসে সাহায্য করল না ওকে। বিধান ঝাপসা চোখে দেখল, রাজিতাকে ওর থেকে কেড়ে নিয়ে গেল একদল সৈন্য!

“বিধান তারপর থেকে পাগলের মতো হয়ে গেল। ও খায় না, মাঠে যায় না, বাঁশি বাজায় না। কিছু করে না। ক্রমশ বিধান ঘরে বন্দি করে নিল নিজেকে। ভাবল এভাবেই সব ছেড়ে ও মারা যাবে এক দিন।

“এদিকে রাজিতাও নিজেকে ঘরে বন্দি করে নিয়েছে। খায় না, গান গায় না। কারও সঙ্গে কথা বলে না। দিনে-দিনে রাজিতা একা হয়ে গেল। হৈমবতী তার উপর এমন রেগে গিয়েছিলেন যে, মেয়েকে কিছু বোঝানোর চেষ্টাই করলেন না।

“তারপর একদিন রাতে বিধান স্বপ্ন দেখল যে স্বয়ং বিষ্ণু এসে ওকে বললেন, ‘নদীর ধারে একটা বড় সবুজ পাথর আছে। সেটাকে ও একা ঠেলে সরাতে পারলে তার নীচে একটা কাপড় পাবে। সেটাতে বসলেই বিধান স্বর্গে রাজিতার কাছে যেতে পারবে।’

“বিধান সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে আর সময় নষ্ট না করে নদীর পারে চলে গেল। ওই তো বড় সবুজ পাথর। বিধান পাথরটা দেখে খুশি হলেও সঙ্গে-সঙ্গে চিন্তিত হয়ে পড়ল। এত বড় পাথরকে কীভাবে একা-একা সরাবে? কিন্তু চেষ্টা তো করতেই হবে। না হলে রাজিতা যে দূরেই থেকে যাবে সারা জীবন!

“বিধান চেষ্টা শুরু করল। দিনের পর দিন গেল। মাস ঘুরে গেল বছরে। বিধান চেষ্টা করতে লাগল। তারপর একদিন ঠিক মন আর শরীরের জোরে ও সরিয়ে ফেলল পাথরটাকে। আর কী অবাক, ঠিক খুঁজে পেল সেই কাপড়!

“বিধান আর সময় নষ্ট না করে সঙ্গে-সঙ্গে চড়ে বসল সেই কাপড়ে। আর কাপড়টা ওকে উড়িয়ে নিয়ে চলল আকাশে, স্বর্গের পথে!

“এদিকে দেবী হৈমবতী তো খবর পেয়ে গিয়েছেন যে, বিধান আসছে তাঁর মেয়েকে নিয়ে যেতে! এখন কী হবে? বিষ্ণুর বরে বলীয়ান বিধান! ওকে কী করে আটকাবেন?

“উপায় আছে। হৈমবতীর মনে পড়ল। তাঁরও একটা ক্ষমতা আছে। তাঁর চুলের কাঁটা দিয়ে টানা রেখা লঙ্ঘন করার ক্ষমতা নেই কারও! এমনকী, স্বয়ং বিষ্ণুও সে ব্যাপারে অক্ষম!

“হৈমবতী সঙ্গে-সঙ্গে চুলের কাঁটা খুলে আকাশে বিশাল বড় একটা রেখা টেনে দিলেন। আর আকাশপথে আসা বিধান আটকে গেল সেই রেখার ওপারে। আর অন্য পারে বিধানের অপেক্ষায় বসে রইল রাজিতা!

“এই রেখা আর কিছু নয়। এই হল আকাশগঙ্গা! যার দুই পারে বসে দুই বিরহী! রাজিতা আর বিধান!

“মনের যন্ত্রণায় রাজিতা খুব কাঁদে। সারা দিন, সারা মাস, সারা বছর কেঁদে চলে রাজিতা। আর ওর কান্না শুনে বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে পৃথিবীর সমস্ত দোয়েল পাখি উড়ে যায় আকাশে। তারপর একে অন্যের সঙ্গে ডানায় ডানা বেঁধে আকাশগঙ্গার উপর তৈরি করে এক সাঁকো। যাতে সেই সাঁকো পেরিয়ে বিধান এসে পৌঁছোতে পারে তার রাজিতার কাছে।”

“তারপর?” রাজিতা বড়-বড় চোখ করে তাকাল ঠাকুরমার দিকে, “পারল বিধান রাজিতার কাছে পৌঁছোতে?”

ঠাকুরমা শ্বাস নিল বড় করে। তারপর বলল, “আমি জানি না রে।”

“এটাও জানো না!” রাজিতা মুখ গোমড়া করে তাকাল ঠাকুরমার দিকে, “বলো না কী হল তারপর? বিধান পারল রাজিতার কাছে যেতে?”

ঠাকুরমা এবার রাজিতার পাশে বসা রিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর ধীরে-ধীরে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি মনে হয় রিয়ান, পারল?”

নয়

রাজিতা

রাজিতা বলে কোনও দেবতার মেয়ে ছিল না কোনওদিন। ওর বাবা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা পেপার মিলের অসুস্থ ফোরম্যান। মা ঘরের দেওয়ালের মধ্যে দম বন্ধ করে বসে থাকা এক ভাঙা পরি। রাজিতার জীবনে কোনও রূপকথা নেই। কোনও পুষ্পক রথ, রাজপ্রাসাদ বা আকাশগঙ্গা পেরিয়ে কারও কাছে আসার গল্প নেই! পৃথিবীর সমস্ত দোয়েল পাখি ওর জন্য ডানায় ডানা জুড়ে সাঁকো তৈরি করে না। শুধু ওই ছোট্ট চুনকাম করা ঘরটুকুর মধ্যেই ওর গুরুত্ব। ওর অস্তিত্ব।

আর এ শুধু আমার নয়, এই শহরের বেশির ভাগ মানুষের এটাই গল্প। এখানে কেউই যেন কারও কাছে জরুরি নয়। সবাই হাসছে, আসলে কিন্তু হাসছে না! সবাই কথা বলছে, কিন্তু কারওরই যেন শব্দ বেরোচ্ছে মুখ থেকে। সোশ্যাল সাইটে সবাই নিজের হাসিখুশি আর দলবদ্ধ ছবি টাঙিয়ে রাখছে! কিন্তু সবাই কেমন যেন নির্বান্ধব। একা। ভয়ার্ত! যা নেই, তাই হারিয়ে ফেলার আতঙ্ক সবার চোখে-মুখে। যে কোনও দিন ভালবাসল না, তাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট সবার মনে। যে আর আসবেই তার জন্যই যেন সবাই আয়োজন সাজিয়ে বসে রয়েছে সারাজীবন! সবাই সবার থেকে বিচ্ছিন্ন! যেন কিছু পুরনো কলকাতার বাড়ি! তাদের কারও কোনও দোয়েল-সাঁকো নেই!

আমি বাসের জানালা দিয়ে তাকালাম। এক্সাইড মোড়ের কাছে আটকে রয়েছে বড় বাসটা। সামনে গাড়ি-ঘোড়ার অনন্ত জট।

ঘড়ি দেখলাম। বিকেল নেমে আসছে শহরে। ঘোলাটে গঙ্গাজলের মতো আকাশ! আকাশে বিষের কণা উড়ছে!

দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মাঝখানের এই সময়টা যেন এক অদ্ভুত লোডশেডিং! ঝলমলে শহরটা হঠাৎ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে যায়। খুলে নেওয়া বাঁশ আর পিচের উপর রংচটা আলপনা যেন মনে করায় কোনও পূর্বজন্মের স্মৃতিকে। সবাই যেন আচমকা একটু কুঁজো হয়ে যায়। যেন একটু রুপোলি হয়ে যায়!

আমারও এই সময়টা মনখারাপ করে। দুর্গাপুজো খুব ভাল লাগে আমার। ছোটবেলায় বাবা, মা, ভাই আর রিয়ানদের সঙ্গে ঘুরতে বেরোতাম। সারাটা পথ রিয়ান মুখ গোমড়া করে থাকলেও আমার ভাল লাগত খুব। মনে হত মুখ ভার করেছে তো কী হয়েছে! রিয়ান তো আছে আমার সঙ্গেই!

কিন্তু তারপর হঠাৎ কেমন যেন সব ভেঙে গেল! কাকু থাকল না। আর রিয়ানও কেমন যেন গুটিয়ে গেল খোলসের মধ্যে! তারপর থেকে পুজোতে আর বেরোত না রিয়ান। আমায় নিয়ে বাবা-মা বেরোলেও আমার ঘুরতে ইচ্ছে করত না একটুও। কেবলই রিয়ানের মুখটা মনে পড়ত। তাই আরও বড় হওয়ার পর আমি নিজেই চলে যেতাম ওর কাছে। সারাটা দিন কাটাতাম ওদের বাড়িতে। তারপর বিকেলে ফিরে আসতাম।

রাগ করত রিয়ান। মাঝে-মাঝেই বলত কেন আমি আসি। কেন সবাই যখন ঘোরে, আমি এভাবে সময় নষ্ট করি!

আমার হাসি পেত! ‘নষ্ট’ শব্দটার কনসেপ্ট এক-একজনের কাছে এক-এক রকম।

এখন আর হাসি পায় না আমার। বরং সারাক্ষণ কেমন যেন একটা কষ্ট আচ্ছন্ন করে রাখে আমায়। মনে হয় সারাক্ষণ মনের আবহে কে যেন বেহালা বাজিয়ে চলেছে! অন্ধকার এক পাড়া যেন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে আমার মনের মধ্যে! সেই পাড়ায় ছোট-ছোট মেঘলা রঙের বাড়িঘর। চায়ের লিকারের মতো ল্যাম্পপোস্ট। দুধের সরের মতো ধোঁয়ার আস্তরণ! সেই পাড়ার ছোট্ট কোনও এক চিলেকোঠা থেকে নাম না জানা কোনও মানুষ যেন বাজিয়ে চলেছে সেই বেহালা! আর তার কুচিকুচি সুরের টুকরো টুপটাপ করে খসে পড়ছে আমার মনের ভিতর! ক্রমশ সেই ভাঙা, আধ-ভাঙা সুরগুলো ভরিয়ে তুলছে আমায়! আর সমস্ত কিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে।

আমি জানতাম এমনটাই হবে। রিয়ানও বলেছিল একবার সেই কথাটা। বলেছিল, “তোর কপালে দুঃখ আছে রাজি। ডোন্ট স্ট্রাইভ ফর দ্য ইমপসিবল।”

তখন দু’জনে সবে ভর্তি হয়েছি কলেজে। একই স্ট্রিম। একই কলেজ।

ভর্তির দু’সপ্তাহের মধ্যে বিনাঞ্জন বলে একটি ছেলে আমার পিছনে পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটা লম্বা। ছিপছিপে৷ ভাল ক্রিকেট খেলত। উচ্চমাধ্যমিকে ফিফ্থ হয়েছিল। সবাই বলত এমন ছেলে আর হয় না!

আমি যেখানে যেতাম, বিনাঞ্জন আমার পিছন পিছন যেত। ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। এমনকী, ক্যান্টিনেও আমার টেবিলে এসে বসত।

আমার ভাল লাগত না একটুও। সবাই বলত, ভাল ছেলে! বলত, আমার ভাগ্য নাকি খুব ভাল। কিন্তু আমার এসবে বিরক্ত লাগত। আর সবচেয়ে কষ্ট হত এটা ভেবে যে, রিয়ানের এতে কোনও তাপ-উত্তাপ ছিল না। সবটাই যেন সিনেমা দেখছে এমন একটা ইনাৰ্ট দূরত্ব থেকে দেখত।

তারপর একদিন খুব বৃষ্টি হল কলকাতায়। সুকিয়া স্ট্রিট থেকে ঠনঠনে অবধি ডুবে গেল জলের তলায়। আমি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, সারা শহরটাই বৃষ্টির চিকের আড়ালে চলে গিয়েছে। কলেজ যাওয়া যাবে না।

কফির কাপ হাতে নিয়ে আমি তিনতলার বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সাঁকোর থেকে কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ছে নীচে। আর তখনই দেখেছিলাম বিনাঞ্জনকে! আমার হাত থেকে কফির কাপটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল নীচে। এখানে কী করছে ও! বাড়িতে আসবে নিশ্চয়ই! মা যদি দেখে, তবে তো আর অশান্তির শেষ রাখবে না!

একটা ছোট্ট ছাতা নিয়ে আমি দ্রুত নেমে গিয়েছিলাম। জেঠিমা অবাক হয়ে আমায় দেখেছিল। জিজ্ঞেস করার চেষ্টাও করেছিল কী করছি আমি এই বৃষ্টিতে! উত্তর দিইনি।

বিনাঞ্জন দাঁড়িয়েছিল গলির একপাশে। গায়ে ওয়াটার প্রুফ। হাতে প্লাস্টিকে মোড়ানো একটা ফুলের বোকে! আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম ওর সামনে।

“হাই!” বিনাঞ্জন নার্ভাসভাবে হেসেছিল আমার দিকে তাকিয়ে।

“এখানে কী করছিস তুই?” আমি দ্রুত আমাদের বাড়ির দোতলার ব্যালকনির দিকে তাকিয়েছিলাম। মা দেখছে না তো!

বিনাঞ্জন তাকিয়েছিল আমার দিকে। ওর চশমার কাচে বৃষ্টির গুঁড়ো এসে লাগছিল। তার মধ্যে দিয়েও বুঝতে পারছিলাম ওর চোখের দৃষ্টিটা আজ আরও পালটে গিয়েছে।

“কী রে?” আমি তাড়া দিয়েছিলাম।

বিনাঞ্জন সময় নিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “এমন বৃষ্টির সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা প্রশ্ন এসেছিল আমার মনে!”

“কী?” টেনশনে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।

“ফুলকে ফোটায় যে-শক্তি! শিশিরকে পদ্ম পাতায় ধরে রাখে যে-শক্তি! যে-শক্তি ফুটপাথের ছোট্ট বাচ্চাকেও বাঁচিয়ে রাখে শত কষ্টের ভিতর! একটা নক্ষত্রকে আর-একটার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়! বিশাল সূর্যকে নিভিয়ে দেয় এক ফুঁয়ে! নেবুলার পেটে কোটি-কোটি তারার জন্ম দেয়! সেই শক্তিই কি আমায় তোর থেকে দূরে সরিয়ে রাখে?”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

বিনাঞ্জন ফুলটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “ক্যান দিস ফ্লাওয়ার্‌স ব্রিজ দ্য গ্যাপ? লেট রেন বি দ্য ক্যাটালিস্ট! প্লিজ়!”

বিনাঞ্জন আর কিছু বলেনি। চলে গিয়েছিল। পিছনে ঘুরে তাকায়নি একবারও। আমি সেই বৃষ্টির মধ্যে ফুল হাতে ধরে দাঁড়িয়েছিলাম শুধু।

পরের দিন রিয়ানকে আলাদা করে নিয়ে গিয়েছিলাম কলেজ মাঠের একপাশে। ও একটু অবাক আর বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “কী করছিস?”

আমি বলেছিলাম, “ততাকে একটা কথা বলার ছিল।”

“কী? তোর হাতে এড্‌স রোগের ওষুধের ফরমুলা এসে গিয়েছে?”

আমি থতমত খেয়েছিলাম একটু, “মানে?”

“এমন কী হল যে মাঠের কোনায় টেনে আনলি? গোপন কথা থাকলে ফোনে বলতে পারতিস।”

“না, ফোনে বলা যায় না,” আমি মাটিতে জুতো দিয়ে আঁচড় কেটেছিলাম।

রিয়ান তাকিয়েছিল আমার দিকে। তারপর বলেছিল, “বিনাঞ্জন তোকে সোজাসুজি প্রোপোজ় করেছে তো?”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ওর দিকে, “তুই… মানে…”

রিয়ান সোজা তাকিয়েছিল আমার দিকে। ভাবলেশহীন মুখে বলেছিল, “ডোন্ট প্রিটেন্ড যে তুই জানতিস না এটা আসছে।”

আমি বলেছিলাম, “বুঝতে পারিনি যে ও বাড়িতে আসবে।”

“ভেবেছিলি শুধু কলেজেই ও ক্যাম্পেন করবে!”

আমি ছটফট করে বলেছিলাম, “কেন এমন করে ও?”

“ন্যাকামি করিস না রাজি। তুই জানিস তুই কত সুন্দর! বাদ দে, আমায় কেন এখানে ডাকলি?”

আমি সুন্দর! রিয়ান বলল! সব কথা ভুলে আমার মনের মধ্যে ওই একটা ছোট্ট বাক্য প্রজাপতির মতো উড়তে শুরু করেছিল।

রিয়ান কড়া গলায় বলেছিল, “কনসেনট্রেট অন রাইট ওয়ার্ডস। কী চাস?”

“তুই বল আমি কী করব?”

“তোর বিনাঞ্জনকে চুমু খেতে ইচ্ছে হলে খা। রিজেক্ট করতে ইচ্ছে হলে কর। আমার এ ব্যাপারে কোনও লাইক, কমেন্ট, শেয়ার বা ট্যাগ নেই।”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম রিয়ানের বাদামি চোখের দিকে। ওর খাঁজ কাটা থুতনি। হালকা দাড়ি। কপালের উপর এসে পড়া কোঁকড়া চুল কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল।

রিয়ান বলেছিল, “তুই লাই দিয়েছিস, এখন তুই সামলা। আমায় বলছিস কেন?”

“তোকে বলব না?” আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম রিয়ানের দিকে।

রিয়ান বলেছিল, “তোর কপালে দুঃখ আছে রাজি। ডোন্ট স্ট্রাইভ ফর দ্য ইমপসিবল।”

আমি তাও বলেছিলাম, “তুই বল না, আমি কী করব?”

রিয়ান মুখ নামিয়ে চলে গিয়েছিল কোনও উত্তর না দিয়ে।

রিয়ান পালটায়নি আজও। আজও নিজের ইচ্ছে হলে কথা বলে। না হলে নয়। আমি আর থাকতে না পেরে কিছুদিন আগে একটা ছোট্ট ইমেল পাঠিয়েছিলাম ওকে। ও উত্তর দেয়নি। জানি না ও কী মনে করে আমায়! কেন আমায় এত কষ্ট দেয়! আমি কী এমন বলেছি যেটা ও জানত না! কী এমন করেছি যেটা ও আঁচ করেনি! ও কি আমায় ভুলতে চায়? তাই কি প্রায় আড়াই মাস আমার সঙ্গে কোনও রকম যোগাযোগ করেনি!

আমার মনের ভিতরে তাই বেহালা বাজে আজকাল! সেই ছোট্ট চিলেকোঠার থেকে ভেসে আসা বেহালা! বাবার শরীর খারাপ। বাড়িতে অর্থনৈতিক সমস্যা। এইসব কিছু ছাপিয়ে কেন জানি না রিয়ানের হারিয়ে যাওয়াটাই আমায় বেশি করে কষ্ট দেয়। মনে হয় এ পৃথিবী একটা বাতিল জিনিসপত্রে ভর্তি ঘর! এখানে কিছু হারিয়ে গেলে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যে একবার মিশে যায় এর অন্ধকার ‘হাঁ’-এর ভিতর, তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না! মনে হয় আসলে এত দিন রিয়ান বলে কেউ ছিলই না! দোয়েল পাখিরা কোনও দিন উড়তেই পারে না এ পৃথিবীতে!

আমার এখন আপশোস হয়, কেন আমি ওই ইমেলটা পাঠিয়েছিলাম রিয়ানকে। কাছে থেকেই যে অমন করতে পারে, দূরে গেলে তো সে আরওই সরে যাবে। তা ছাড়া আমেরিকা তো শুনি এল ডোরাডো। সেখানে গেলে নাকি জীবন পালটে যায়! রিয়ানেরও গিয়েছে নিশ্চয়ই! তা ছাড়া ওই বান্ধবী আছে যে। নানিয়া ধীলোঁ!

আচমকা বাসের ভিড়টাকে আমার অসহ্য মনে হল। মনে হল নেমে যাই। এখান থেকে হেঁটে ভবানীপুর চলে যাই। মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে আমাকে যেন গিলতে আসছে এই ভিড়টা! কিন্তু তারপরেই মনে হল, কেন যাব ভবানীপুর? কাকিমা ডেকেছে বলেই যেতে হবে? কাকিমার দাদা কোনও এক স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন বলেই যেতে হবে? সবাই আমায় চাকরি দেখিয়ে কিনে নিতে চায়?

কিন্তু আমি জানি এসব ভাবতে নেই। আমার যা জীবন তাতে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের জায়গা নেই আর। আমি কোনও দিনও নিজের দিকটা দেখিনি। আজও দেখব না।

তাও আমার খুব কষ্ট হয় আজকাল। ভবানীপুরের ওই বাড়িটার এক তলায় ছড়িয়ে আছে আমার বড় হয়ে ওঠা। আছে রিয়ানের সঙ্গে কাটানো অসংখ্য মুহূর্ত। ওই বারান্দা, ওর ঘরের স্পাইডারম্যানের পোস্টার, দেওয়ালের কু কু ক্লক, ওর রুপোর চামচ, ছোটবেলার গিটার, এই সব কিছুর সঙ্গেই যেন কুয়াশার মতো জড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতি! কেন সেইসব নিষ্প্রাণ জিনিসেরও অত্যাচার সহ্য করতে হবে আমায়! কী অপরাধ আমার?

বাসটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি কী করব বুঝতে পারলাম না। আমার ভুল হয়েছে। কিছুটা দূরে এসে আমার মেট্রো ধরা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করে আমি বাস ধরেই বিপদে পড়েছি!

আসলে আজ একটা অফিসে গিয়েছিলাম ইন্টারভিউয়ের জন্য। আকাশের সূত্রে খবরটা পেয়েছিলাম কয়েক দিন আগে।

অফিসটা শিয়ালদার কাছে। ওদের সুতোর কারখানা আছে। অফিসের জন্য মেয়ে খুঁজছে ওরা। ইন্টারভিউ ভালই হয়েছে। কিন্তু জানি না কতটা কাজ হবে। আসলে আমার মনে হল ওরা কতকটা আকাশের অনুরোধেই যেন ঢেঁকি গিলেছে!

সেদিন আকাশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার পর ও আমায় অফিস থেকে চলে যেতে দেয়নি। সেই যে বলেছিল, “সুজাতাদি ঠিক বলেছে। আপনি সত্যি অদ্ভুত!” তারপর অফিসের মধ্যে সামান্য কথাবার্তা হয়েছিল আমাদের মধ্যে!

ও বলেছিল, “দেখুন, যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তিনি নেই। তবে আই ক্যান হেল্‌প ইউ।”

আমি কিছুটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম। সারাজীবন ধরে ছেলেদের গায়ে পড়ে উপকার করার অভ্যেসটা আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি।

আকাশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আপনি আমায় দশ মিনিট সময় দেবেন? প্লিজ়?।”

আমরা অফিসের বাইরে বেরিয়ে একটা কফিশপে গিয়ে বসেছিলাম। এসব জায়গায় আমি চট করে ঢুকি না। এক কাপ কফির দামে আমাদের দু’দিনের মাছ হয়ে যায়!

আকাশ দু’কাপ কফি বলে আমার দিকে তাকিয়েছিল, “দেখুন, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু পাইল অন। কিন্তু সুজাতাদি আমার জন্য খুব চিন্তিত। আমি জানি সুজাতাদি কী চাইছে। আমাকেও বলেছে। খুব এমব্যারেসিং ব্যাপার আপনার জন্য। আপনি কেন শুধু-মুদু একজন ডিভোর্সি ছেলের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন! আই আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট।”

কথাটা বলে আকাশ একটু থেমে তাকিয়েছিল আমার দিকে। কী ভেবেছিল যে ওর এই কথাটার ভেতরকার হালকা সেন্টিমেন্টাল ভাবটাকে আমি ‘না, না, তা নয়’ বলে কাউন্টার করব? আমি কাউন্টার করিনি। কিছু বলিনি। কেন বলব!

আকাশ নিজের হতাশাটা লুকিয়ে নিয়ে বলেছিল, “আমি আপনাকে আমার অফিসে জব অফার করছি না। আমি আপনাকে কয়েকটা রেফারেন্স দেব। আপনি নক করতে পারেন।”

আমি কী বলব বুঝতে পারিনি।

আকাশ আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর আমতা-আমতা করে বলেছিল, “আসলে আমি আপনার সঙ্গে কথাও বলতে চাইছিলাম আলাদা করে। একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”

“আমার সঙ্গে!” আমি এই প্রথম অবাক হয়েছিলাম।

আকাশ বলেছিল, “আমার মা টারমিনালি ইল। আমি এক ছেলে। আসলে আমার ডিভোর্স হওয়ার পর থেকে মা খুব ভেঙে পড়েছে। এখন মা চায় আমায় বিয়ে দিতে। আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে। কিছু মনে করবেন না। কিন্তু সত্যি কথাটা সহজভাবে বলাই ভাল। তাই আপনি যদি…”

আমি বলেছিলাম, “একইসঙ্গে চাকরি আর বিয়ে! আমি কনফিউজ়ড হচ্ছি, নাকি আপনি?”

আকাশ থমকে গিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “জানি খুব অড লাগছে আপনার। জানা নেই চেনা নেই, হঠাৎ এমন বিবাহ প্রস্তাব!”

“হ্যাঁ, তা লাগছে।”

“কিন্তু সুজিদি আপনার সম্বন্ধে আমায় বলেছেন সব। আমি তো সেদিন আপনাদের ওখানে গিয়ে দেখলামও আপনাকে। আমি খারাপ মানুষ নই। একটি মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম, কিন্তু সে আমায় ভালবাসেনি। ছেড়ে গেছে। আই ওয়াজ় স্যাড। কিন্তু আর নই। তবে মা আমায় বিয়ের জন্য কিছু বলেনি। কিন্তু আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি এখুনি কিছু বলছি না আপনাকে। কিন্তু আপনি প্লিজ় একটু ভেবে দেখবেন। আমি জানি না আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না! মানে সুজিদি সেসব কিছু বলেনি আমায়। কিন্তু আপনি জানবেন আমি আপনাকে কষ্টে রাখব না,” কথাগুলো এক নিশ্বাসে শেষ করতে-করতে আকাশের সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আগেও লোকজন আমায় প্রোপোজ় করেছে। কিন্তু এমন সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব কেউ দেয়নি!

আমার রাগ হচ্ছিল সুজাতাদির উপর। আমি ভেবেছিলাম আকাশকে বলে দিই রিয়ান সম্পর্কে। কিন্তু তারপর মনে হয়েছিল, কেন বলব! যে, ছেলে আমাকে পোঁছে না! যে আমায় ভুলে গিয়েছে তার কথা কেন বলব?

আমি বলেছিলাম, “আমার খুব অদ্ভুত লাগছে। মানে…”

আকাশ বলেছিল, “আমি মদ খাই না। একটু-আধটু স্মোক করি। ব্যস। আর কোনও নেশা নেই। আমি ব্যালেন্সড মানুষ। বাবা, মা আর আমি। এই তিনজনের সংসার। আপনার আমার বাবা-মাকে ভাল লাগবে। একদিন আমাদের বাড়িতে আসুন।”

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ এমন করে গায়ে পড়ছে কেন?

আকাশ বুঝেছিল আমার কথা। সামনে দিয়ে যাওয়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলেছিল, “আপনি আমায় ডেসপো ভাবছেন হয়তো। সত্যি আমি আ বিট ডেসপারেট। প্রেম করে ঘুরে-ঘারে বিয়ে করার সময় আমার নেই। সুজিদি জানে আমার অবস্থা কেমন। তাই আপনাকে বলেছিল আমার কথা। আপনি যদি একটু ভাবেন। না হয় অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ করুন। সেটাকে আমি লাভে কনভার্ট করে দেব। তবে এটাও মাথায় রাখবেন এর সঙ্গে চাকরির কিন্তু কোনও যোগাযোগ নেই। আর আপনি যদি আমায় বারণও করে দেন, দেবেন। তবে প্লিজ় একবার সবটা র‍্যাশনালি ভেবে দেখবেন।”

আমি কিছু বলিনি সেদিন। আসলে আচমকা এমন আষাঢ়ে প্রস্তাব দিলেও ভঙ্গিটা এমন ভদ্র ছিল যে, আমি কিছু বলতে পারিনি। আমাদের বুঝি সবার জীবনের কমপালশনগুলো তো আলাদা-আলাদা হয়। তাই মানুষের আচরণও আলাদা হয়।

সেদিন আমার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার নিয়েছিল আকাশ। তারপর কয়েকদিন আগে এই চাকরির ইন্টারভিউয়ের ব্যাপারটা বলেছিল৷ না, ইন্টারভিউয়ের কথাটা বলার সময় কিন্তু আকাশ একবারও ওই প্রস্তাবটার কথা আর তোলেনি। শুধু ছোট করে কাজের কথা বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল।

ভবানীপুরে নেমে দেখলাম আশপাশে পুরো অন্ধকার! এমনিতেই সন্ধে হয়ে গিয়েছে, তার উপর এমন অন্ধকার! মনে হল যুদ্ধের শহরে পৌঁছে গেলাম যেন। কালোর মধ্যে কালো দিয়ে আঁকা সব ছবি যেন আমার সামনে দিয়ে হাঁটছে।

বড় রাস্তা থেকে রিয়ানদের বাড়ি হেঁটে পাঁচ মিনিট। কিন্তু বড় রাস্তার ঝাঁ চকচকে কলকাতার থেকে ওই পাঁচ মিনিট দূরত্বেই যে এমন একটা পুরনো কলকাতা আছে সেটা ভাবলেই অবাক লাগে!

পুরনো চুন সুরকির গাঁথনি। পাতলা ইট। ঝরোকা। কাঠের বারান্দা! ঢালাই লোহার রেলিং। কাঠের কড়ি বরগা। আমার কলেজ স্ট্রিটের একটা ছোট্ট রেপ্লিকা যেন ভবানীপুরের এই পাড়াটায় এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাড়াটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। বুঝলাম কোথাও একটা লোকাল ফল্ট হয়েছে। আমি দরজার কড়া ধরে নাড়ালাম।

কিন্তু দেখলাম দরজাটা খুলে গেল! এ কী, দরজাটা খোলা কেন! আমি ঘাবড়ে গেলাম একটু। আমি ভিতরে ঢুকে ‘কাকিমা’ বলে জোরে ডাকলাম। কিন্তু কোনও উত্তর নেই!

আমি ভয় পেয়ে গেলাম আরও। হলটা কী! আমি আন্দাজে-আন্দাজে এগোলাম একটু। আর তখনই দেখতে পেলাম আলোটা। হালকা, নীলচে। এমার্জেন্সি লাইট। আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। আর দেখলাম বড় চেয়ারটায় বসে আছে কাকিমা। আবছা আলোতেও বোঝা যাচ্ছে কাকিমার চোখে জল! মাথার চুল উসকো খুসকো!

আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম কাকিমার পায়ের কাছে, “কাকিমা, ও কাকিমা! সদর দরজা খোলা! তুমি এখানে এভাবে কেন বসে? কী হয়েছে?”

কাকিমা তাকাল আমার দিকে। চোখে বেভুল দৃষ্টি! বলল, “দরজা খোলা! ও! আসলে…আসলে…আমি…আমার…”

আমি কাকিমার হাতটা ধরলাম, “কী হয়েছে বলে প্লিজ়!”

“রিয়ান… রিয়ানকে…” কাকিমার গলাটা কেঁপে গেল হঠাৎ।

আমার পিঠ দিয়ে বরফের গিরগিটি নেমে গেল দ্রুত। আমি কাকিমার হাতে চাপ দিলাম জোরে, “আরে, কী হয়েছে বলো প্লিজ়!”

কাকিমা আবছা গলায় বলল, “সামু ফোন করেছিল। ওকে… ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে!”

দশ

রিয়ান

দোয়েল-সাঁকো! রাজিদের বাড়ির উলটোদিকে থাকত রানিঠাকুরমা। ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার আমি রাজির সঙ্গে ঠাকুরমার কাছে গিয়েছি। ভাল লাগত যেতে। ঠাকুরমা খুব সুন্দর গল্প বলত। এত গল্প কোথা থেকে জেনেছে ঠাকুরমা আমি জানি না। জিজ্ঞেস করলে বলত, “এসব আপনা থেকেই জেনে গেছি!”

আর একটা ব্যাপার দেখতাম। ঠাকুরমার সব গল্পের নায়িকার নাম হত রাজিতা! ছোটবেলায় এই ব্যাপারটায় আমার খুব রাগ হত। কেন সব সময় নায়িকার নাম রাজিতা হবে? আমার নামে তো ঠাকুরমা কখনও কোনও গল্প বলে না! তবে এই নিয়ে আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু রাজি বলত। বলত, “ঠাকুরমা, রিয়ানকে হিরো বানিয়ে তুমি একটা গল্প বলো। আমার শুনতে ইচ্ছে করে!”

রাজির এই ব্যাপারটা ভাল লাগত না আমার। ও কেন বারবার আমায় সমর্থন করে? কেন সবার কাছে আমার হয়ে কথা বলে! ঠাকুরমার ইচ্ছে করত না তাই আমায় নিয়ে গল্প বানাত না। তাতে রাজির কী!

তাও রাজি ছাড়ত না। ঠাকুরমার কাছে বলেই যেত যেন ঠাকুরমা আমায় নায়ক বানিয়ে কিছু একটা গল্প বলে!

ঠাকুরমা শুধু হাসত আর বলত, “ওকে তো আগে জীবনের নায়ক হয়ে উঠতে হবে, তারপর তো ওকে নিয়ে গল্প বলব!”

আমি জানি না রাজি কী করেছে যে ও ছোট থেকেই নায়িকা হয়ে গিয়েছে! তখন এই নিয়ে খুব হিংসে হত আমার। মনে হত আর কোনও দিন যাব না ঠাকুরমার কাছে। কিন্তু তাও ওদের বাড়ি গেলে গল্পের লোভে মাঝে-মাঝে ঠাকুরমার কাছে যেতাম।

ছোটবেলার সেই হিংসের কথা মনে পড়লে হাসি পায়। আর সত্যি বলতে কী এখন কেমন যেন মিস করি ঠাকুরমার ওই সব গল্প!

কয়েক সপ্তাহ আগে পাওয়া রাজির ওই ইমেলটা আমায় যেন আবার মনে করিয়ে দিয়েছে ঠাকুরমাকে। আর কেন জানি না বুকের ভিতর খচখচ করছে তারপর থেকে! খালি মনে হচ্ছে ঠাকুরমাই ঠিক চিনেছিল আমায়! আমি সত্যি ‘নায়ক’ নই!

দোয়েল-সাঁকো! ব্রিজ অব ম্যাগপাইজ়! দোয়েল কি ম্যাগপাই? জানি না। ঠাকুরমা কিন্তু তাই বলত।

যাই হোক, ঠাকুরমার কাছে এক গরমের ছুটির দুপুরে বসে আমি আর রাজি শুনেছিলাম গল্পটা! অদ্ভুত এক ভালবাসার গল্প!

পরে জেনেছি মিল্কি ওয়ের দুই পাশের দুই নক্ষত্র অলটেয়ার আর ভেগাকে নিয়ে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো একটা চিনা রূপকথা আছে। ঠাকুরমা সেটাই ঘুরিয়ে রাজিতার নামে বলেছিল। অলটেয়ার আর ভেগা দু’জন দু’জনকে ভালবাসলেও মিলিত হতে পারে না। তাই তাদের কষ্ট! তাদের চোখে জল! আর তাদের কান্না শুনে বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে পৃথিবীর সমস্ত ম্যাগপাই আকাশে উঠে ওই মিল্কি ওয়ের উপর ডানায় ডানা জুড়ে একটা সাঁকো তৈরি করে, যাতে অলটেয়ার আর ভেগা মিলিত হতে পারে!

রাজির খুব পছন্দ ছিল গল্পটা। ঠাকুরমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলত, “বারান্দার এদিকটা রিয়ান তোর আর ওই দিকটা আমার। মাঝের রাস্তাটা হল মিল্কি ওয়ে। আর দু’বাড়ির মাঝের এই লোহার সাঁকোটা…”

গল্পে হলেও বাস্তবে কি দোয়েল-সাঁকো বলে কিছু হয়? আমাদের মধ্যে কোন দোয়েল-সাঁকোর কথা বলেছে রাজি?

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এসএমইউ শাটল্‌টা একটা স্টপে দাঁড়িয়েছে। আমি ঘড়ি দেখলাম। সকাল সাড়ে দশটা বাজে।

আজ বাইরে হাওয়া দিচ্ছে বেশ। রোদ থাকলেও একটা মিষ্টি হাওয়াও আছে৷ টেক্সাসের সেই বিখ্যাত গরমটা এই নভেম্বরের মাঝে আর ততটা নেই! দিন ছোট হয়ে এসেছে। ফাঁকা শহরটাকে আমার কেন জানি না আরও ফাঁকা লাগছে!

আজ শনিবার৷ কলেজ ছুটি। কিন্তু আমি যাচ্ছি নেমন্তন্নে। আমার সেই বছর পঞ্চাশের সহপাঠী টম গ্রে আমায় তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে।

ভদ্রলোক খুবই ভাল। মধ্যবয়স্ক মানুষ যে এমন বাচ্চাদের মতো হতে পারে আমি ভাবতে পারিনি। টমের সঙ্গে কথা বলার সময় আমার মনে হয় আমি টমের ঠাকুরদাদা হয়তো!

একটা লোক সারাক্ষণ এমন খুশি থাকে কী করে? জিজ্ঞেস করলে বলে, “গম্ভীর থাকলে সব সমস্যা মিটে যাবে? উড ইট হেল্‌প?”

আমি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলাম বলে টমের দেওয়া থ্যাঙ্কস গিভিং-এর নেমন্তন্নটা মিস করেছি। তাই সুস্থ হয়ে বাড়িতে আসার পর টম নিজে বাড়িতে এসে আমায় নেমন্তন্ন করে গিয়েছে!

আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম খুব! আরে, এমন কেউ করে নাকি? এখানের মানুষজন খুব ভদ্র হলেও একটা অদ্ভুত কাচের পার্টিশন তুলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখে অন্যের সঙ্গে! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী একটা দেশ। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। তাই টমকে এমন করে আমার কাছে এসে নেমন্তন্ন করতে দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

টম হেসেছিল খুব। বলেছিল, “আরে, এটা আমেরিকা রিয়ান। রোবটের ফ্যাক্টরি নয়। আমরা সবাই মোটেই অমন শোকেসে সাজানো মানুষ নই। পারসেন্টেজে হয়তো অমন মানুষ একটু বেশি, কিন্তু আমরাও খুব কিছু কম নই। তুমি আসবে আমার বাড়ি। আরে, থ্যাঙ্কসগিভিংটা তুমি তো হসপিটালেই কাটালে! আই ফেল্ট সো ব্যাড! জানো, আমার ছেলে তোমার চেয়ে জাস্ট দু’বছরের ছোট। ইউ মাস্ট কাম। ইউ উইল লাইক ইট। তুমি যদি বলো, আই উইল সেন্ড আ কার।”

আমি ওটা করতে বারণ করেছি। টমের বাড়ি এসএমইউ-এর কাছেই। ফলে এসএমইউ শাট্ল করে কলেজের কাছে নেমে হেঁটে চলে যাব। এটা কোনও ব্যাপার নয়!

আমি দেশে থাকলে এভাবে কারও নেমন্তন্নে যাওয়ার কথা ভাবতামই না! কিন্তু এই দেশে কেউ সামান্যতম নেমন্তন্ন করলেই আমি চলে যাই!

বিদেশে পড়তে আসার আগে আমি ভাবতে পারিনি এখানে জীবন এমন শক্ত হবে! এখানের সবচেয়ে বড় শত্রু হল একাকিত্ব! একেই হাতে টাকা-পয়সা থাকে না। তার উপর প্রায় গোটা সময়টাই কাজে ডুবে থাকতে হয়। আর বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই।

এই নেমন্তন্নগুলোতে গেলে তাও মানুষের সঙ্গে একটু কথাবার্তা হয়! নিজেকে একবেলা রান্না করতে হয় না। আর তেমন-তেমন জায়গায় গেলে তো উদ্বৃত্ত খাবার সঙ্গে করে নিয়ে আসাও যায়।

মাঝে-মাঝে রাতে প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে সামনের অন্ধকার রাস্তাটা দেখে আমার খুব মন খারাপ করে! মনে হয়, এ কোথায় এসে পড়লাম। এখন আমি যদি মরেও যাই, মা তো সঙ্গে-সঙ্গে জানতেও পারবে না। আমায় দেখতে আসতেও পারবে না। চোদ্দো বছর বয়স থেকে সেই যে কলকাতা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা চেপেছিল, সেটা বাস্তবে সম্পূর্ণ হওয়ার পর এমন হেরে যাওয়ার ফিলিং হয় কেন? কেন বারবার মনে হয় আমার চেয়ে কষ্টে আর কেউ নেই! কেন একা খেতে বসে মাঝে-মাঝে জল চলে আসে চোখে। ঘুমের মধ্যে কেন আমি আচমকা রাজির হাতের স্পর্শ পাই! কী হয়েছে আমার! যাকে চিরকাল মুক্তি ভেবে এসেছি, সেটা এমন দ্বীপান্তরের মতো লাগছে কেন? তবে নিজের চাহিদা ও লক্ষ্য সম্বন্ধে নিজেকে যে বুঝিয়ে এলাম এত বছর, সেটা কি ভুল ছিল? নিজেই কি নিজেকে বোকা বানালাম? কেন? কীসের থেকে পালাতে চাইছিলাম আমি?

হাই! আচমকা পিছন থেকে একটা হাত এসে আমার কাঁধে টোকা দিল। আমি অবাক হলাম। কে ডাকছে আমায়। আমার বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ করা রয়েছে। তাই চট করে ঘুরতে পারলাম না। সময় নিয়ে ধীরে-সুস্থে আমি পিছনে ঘুরলাম।

একটা মেয়ে। সামান্য মোটা। লালচে কোঁকড়া চুল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি অবাক হলাম। মেয়েটা কে? আমায় ডাকছে কেন? আমি তো চিনি না!

“ইয়েস?” আমিও সামান্য হাসলাম।

বাসটা বেশ ফাঁকা। পিছনের দিকে আমি আর এই মেয়েটা ছাড়া কেউ নেই।

মেয়েটা নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “লুসি। ওয়ান্না হ্যাভ সাম কাপকেক?”

আমি দেখলাম মেয়েটার হাতে একটা বড় চৌকো প্যাকেট। তার ঢাকনা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল প্যাকেটটা। প্রায় ডজন খানেক কাপকেক! আমাদের দেশে আমরা কাপকেক দেখেছি। খেয়েওছি। কিন্তু এদেশে এসে দেখছি কাপকেক দেখলে এরা কেমন যেন করে! মানে অদ্ভুত একটা ভাললাগা আছে এদের এই কেকটির ব্যাপারে। কেন তা জানি না।

সে থাকুক। যার যা ভাল লাগে। কিন্তু আমার ভাল লাগে না।

আমি হাসলাম। মাথা নেড়ে না বলে বললাম, “থ্যাঙ্কস।”

“দে আর নাইস,” লুসি হাসল, “তুমি নিতেই পারো।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কোনও কেক জাতীয় জিনিস আমি খেতে পারি না। ডিমে অ্যালার্জি আছে আমার। বললাম, “না, না, আমার ডিমে অ্যালার্জি। বাট থ্যাঙ্কস এনি ওয়ে।”

লুসি প্যাকেটটা বন্ধ করে বলল, “সো সরি টু হিয়ার দ্যাট। আমাদের অ্যামেরিকান ওয়ের একটা পার্ট হল কাপকেক। বাই দ্য ওয়ে, আর ইউ অ্যালোন?”

আমি হাসলাম, “হ্যাঁ।”

লুসি অবাক হল, “আজ তো ইউনিভার্সিটি বন্ধ! তা হলে তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

“নেমন্তন্ন আছে,” আমার এমন করে পিছন ফিরে কথা বলতে অসুবিধে হচ্ছে খুব।

“তোমার বোধহয় অসুবিধে হচ্ছে!” লুসি উঠে দাঁড়িয়ে আমার পাশের সিটে এসে বসতে গেল। কিন্তু পারল না।

“সরি, দিস সিত ইজ় তেকেন।”

গলাটা শুনে অবাক হয়ে দেখলাম, ইয়ানা! বাসটা আর-একটা স্টপে থেমেছে আর সেখান থেকে ইয়ানা উঠেছে!

ইয়ানা লুসির উত্তরের অপেক্ষা না করে ধপ করে বসে পড়ল আমার পাশে। লুসি স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট হল। কিন্তু কিছু বলল না। বরং উঠে গিয়ে এবার কিছুটা সামনের দিকের একটা সিটে বসল।

আমি অবাক হয়ে গেলাম, “তুমি!”

ইয়ানা হাসল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা টফি বের করে এগিয়ে দিল আমায়।

আমি টফিটা নিয়ে বললাম, “তোমার গাড়ি কই?”

ইয়ানা ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, “গ্যারাজে। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে একটু।”

আমি মাথা নাড়লাম। ইয়ানার ডাফল ব্যাগের পাশ দিয়ে চারটে র‍্যাকেট উঁকি মারছে। বুঝলাম প্র্যাকটিসে যাচ্ছে।

বললাম, “সরি ইয়ানা, তোমার অনেকগুলো ক্লাস মিস গেছে। আমি ঠিক করিয়ে দেব। কাল সানডে আছে। তোমার টাইম থাকলে আমরা পড়তে বসতে পারি।”

ইয়ানা যেন শুনল না আমার কথাটা। বরং চট করে একবার সামনের দিকে দেখে নিয়ে বলল, “লুসির সঙ্গে কী কথা হচ্ছিল?”

আমি সামান্য অবাক হলাম, “তেমন কিছু নয়। ও কাপকেক দিতে চাইছিল। আমি বলছিলাম যে আমার খাওয়া বারণ!”

ইয়ানা বলল, “তুমি একা কি না জানতে চাইছিল?”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ও কী করে জানল!

ইয়ানা আমার মুখের ভাব দেখে হাসল। বলল, “শি ইজ় ওয়ান ম্যান- ইতার!”

“অ্যাঁ!” আমি ঘাবড়ে গেলাম।

“আরে, উইকেন্ডে ও এমন করে ছেলেদের পটায়,” ইয়ানা হাসল, “তারপর নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে গিয়ে শোয়।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।

ইয়ানা বলল, “আজ তোমার দিন ছিল। ভন্ডুল করে দিলাম বলে রাগ করলে নাকি?”

আমি হেসে মাথা নাড়লাম, “কী বলছ!”

ইয়ানা লুসির দিকে আমায় ইশারা করে হাসল। দেখলাম, সামনের দিকে অ্যাফ্রিকান-অ্যামেরিকান একটা ছেলের সঙ্গে গল্প শুরু করেছে মেয়েটা!

ইয়ানা চাপা গলায় বলল, “শি হ্যাজ় গত হার উইক-এন্দ।”

আমি এখানে এসে যত এদের দেখি অবাক হয়ে যাই। প্রেম ব্যাপারটা নিয়ে এদের খুব অদ্ভুত একটা দ্বিধা আছে। সহজে কেউ কাউকে প্রেমের কথা জানাতে চায় না। কিন্তু শোওয়া ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই জরুরি। এখানে ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড নিয়ে কেউ বিশাল মাথা ঘামায় না। আমি ছোটবেলা থেকেই এসব নিয়ে চিন্তিত নই৷ তা হলেও এসব দেখে প্রথমে যে একবার কালচারাল শক হয়নি তা নয়, কিন্তু এখন আর হয় না। বিশেষ করে নানিয়ার সঙ্গে ব্যাপারটা হয়ে যাওয়ার পর!

আচমকা আমার নানিয়ার কথা মনে পড়ে গেল! সেই ঘটনার পর থেকে মেয়েটা আমায় এড়িয়ে চলছে। আমিও, সত্যি বলতে কী, ওর সঙ্গে কথা বলার উদ্যোগ দেখাচ্ছি না। এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যে দু’জনের কাছেই ব্যাপারটা খুব অস্বস্তির!

আমায় শরথ মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করে, “নানিয়া আর আসে না কেন রে?”

আমি চুপ করে থাকি।

শরথ তাও ছাড়েনা। ওর প্রশ্ন করার বাতিক বজায় রেখে বলে, “ঝামেলা হয়েছে তোদের মধ্যে? কী রে প্রোপোজ়-ফোপোজ় করতে গিয়েছিলি নাকি? তোদের বাঙালি ছেলেদের শালা সর্দির মতো প্রেম হয়! কী রে, প্রোপোজ়ালে নানিয়া রেগে গিয়ে তোর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছে?”

আমি আর পারিনি। বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, “আর কত ভাট বকবি? এবার একটু থাম।”

শরথ হেসে বলেছিল, “আরে রাগ করছিস কেন? তুই যখন সিনে নেই, আমি তখন ট্রাই করব একবার? আমার ওকে দেখলেই খুব টিংলিং ফিলিং হয়! প্রথমে আমি ভাবছিলাম হয়তো হজম হচ্ছে না! গ্যাস! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি অন্য কে! আচ্ছা প্রেম আর পেটের প্রবলেম কি একই রকম ফিলিং দেয়?”

“কী হল?” ইয়ানা আমায় আলতো করে গুঁতো মারল কনুই দিয়ে, “মাঝে-মাঝে কী হয় তোমার? পড়াতে বসেও দেখেছি হঠাৎ-হঠাৎ আনমনা হয়ে যাও! ইউ ইন্দিয়ান পিপল আর সো মিস্তিরিয়াস! আই লাইক ইন্দিয়া ফর দিস। আমার মা জিমন্যাস্ট ছিল। মা দিল্লি গেছে। মায়ের কাছ থেকেই শুনেছি যে খুব সুন্দর দেশ তোমাদের।”

আমি হাসলাম মনে-মনে। দিনকে দিন যা অবস্থা হচ্ছে, একবার দেশে নিয়ে গেলে ‘বাপ-বাপ’ বলে পালাতে পথ পাবে না!

ইয়ানা বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

আমি অবাক হলাম। ইয়ানাকে বেশ কিছু দিন হল পড়াচ্ছি। কথা বলছি। কিন্তু কোনও দিন এমন গলায় কিছু জিজ্ঞেস করেনি! স্বর শুনেই বুঝতে পারছি যে ও ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করবে।

ইয়ানা আবারও বলল, “ইফ ইত ইজ় ওকে উইথ ইউ।”

আমি মাথা নাড়লাম।

“দু ইউ হ্যাভ এনি পদ্রুগা?”

“কী!” আমি বুঝতে পারলাম না।

“আই মিন, গার্লফ্রেন্দ?” ইয়ানা হাসল।

“কোন সেন্সে?” আমি পালটা জিজ্ঞেস করলাম।

“লাইক বয়ফ্রেন্দ-গার্লফ্রেন্দ সেন্সে!” ইয়ানা তাকাল আমার দিকে।

আমি ওর ওই অদ্ভুত নীল চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এভাবে তাকালে হয়ে যাবে।”

“খুব! না!” ইয়ানা হেসে ফেলল। তারপর বলল, “এত লোনলি টাইপ ছেলেদের কোনও মেয়ে পছন্দ করবে না! কী এত কষ্ট তোমার! সবসময় এমন পেনসিভ মুখে থাকো কেন?”

আমি গম্ভীরভাবে বললাম, “তুমি আমার পদ্রুগা হওয়ার চেষ্টা করছ নাকি!”

ইয়ানা ঘাবড়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর আলতো করে আমায় একটা চাঁটি মেরে বলল, “খালি ইয়ার্কি!”

“এ তো ফিজ়িক্যাল কনট্যাক্ট!” আমি বিস্মিত হওয়ার ভান করে বললাম, “তুমি দেখছি খুব ডেসপারেট হয়ে গেছ!”

ইয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হাসতে শুরু করল হঠাৎ! আমি হাসলাম। ইয়ানার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এই ক’দিনে খুবই সহজ আর মজার হয়ে গিয়েছে!

ইয়ানা বলল, “যাই বলো, আমি বুঝেছি!”

“আমার মনের কথা বুঝে ফেললে!” আমি চোখ বড় করলাম, “তুমি দেখছি আমার পদ্রুগা না হয়ে যাবে না!”

ইয়ানা বলল, “কেউ একজন তো আছেই। কিন্তু তুমি সেটা লুকোতে চাও।”

আমি বললাম, “সব কিছু যদি এত সহজ হয়ে যেত ইয়ানা, তবে তো আর ঝামেলাই থাকত না জীবনে! আর আমার কোনও ইন্টারেস্টিং স্টোরি নেই।”

ইয়ানা হয়তো আরও কিছু বলত। কিন্তু বাস এসে পড়েছে ইউনিভার্সিটির সামনে। আমরা উঠে পড়লাম।

বাস থেকে নেমে ইয়ানা তাকাল আমার দিকে। বলল, “আমি কাল আসছি তোমার বাড়ি। আর রিয়ান, যতই তুমি ঢাকার চেষ্টা করো, ইউ দু হ্যাভ আ স্তোরি!”

আমি আবার গম্ভীর হয়ে বললাম, “সত্যি তুমি পদ্রুগা না হয়ে ছাড়বে না!”

এখান থেকে টমের বাড়িটা হেঁটে বেশি দূর নয়। মাইল খানেক। প্রথম- প্রথম জেট ল্যাগের সঙ্গে-সঙ্গে এইসব ‘ইউনিট’ নিয়েও মুশকিল হত। আমরা দূরত্ব বোঝাতে কিলোমিটার বলি, ওরা মাইল দিয়ে বলে। আমরা কিলোগ্রামে ওজন মাপি, ওরা পাউন্ড বলে। আমরা সেলসিয়াস বলি, ওরা ফারেনহাইটে উষ্ণতা-শীতলতা মাপে। তবে এখন আর অসুবিধে হয় না।

আমি হাঁটতে শুরু করলাম। এই প্রথম টমের বাড়ি যাচ্ছি। খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না! তাই একটা ওয়াইনের বোতল কিনেছি। আমার বাঁ হাতে এখনও ব্যান্ডেজ করা। টান বা চাপ পড়লে ব্যথা করে। আমি সাইড ব্যাগটাকে বাঁ কাঁধ থেকে ডান কাঁধে নিলাম। সত্যি, কী যে ভোগান্তি! কোথা থেকে কিছু নেই, হঠাৎ কী যে হয়ে গেল!

সেই রাতে আমার শরীরটা ভাল ছিল না। একটু জ্বর-জ্বর লাগছিল। ভাতও খেতে পারিনি। সামান্য একটু নুডল্স সেদ্ধ করে খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। মোটা একটা কম্বল গায়ে চাপিয়েছিলাম। আর বুঝতে পারিনি আমার কাল সেখানেই ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে!

মাকড়সাটার নাম ‘ব্রাউন রেক্লুজ়’। টেক্সাস শুকনো জায়গা। পুরনো দিনে নাকি নানা বিষাক্ত প্রাণী ও পোকামাকড় পাওয়া যেত এখানে। এখনও বোধহয় কিছু রয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে একটা হল এই মাকড়সাটা। বাদামি, নিরীহ দেখতে। কিন্তু তার পেটে-পেটে যে এত বুঝব কী করে!

ভোর রাতের দিকে কেমন একটা জ্বালা নিয়ে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। দ্রুত আলো জ্বালিয়ে দেখেছিলাম, বাঁ হাতের কনুইয়ের নীচে একটা ছোট গর্ত মতো হয়েছে। ব্যাপারটা কী! আমি বিছানা থেকে নেমে কম্বলটা ঝেড়েছিলাম মাটিতে। আর দেখেছিলাম একটা মাকড়সা। ছোট। পাতলা। বাদামি রঙের। আমি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কী হল! তবে মাকড়সাটাকে সঙ্গে-সঙ্গে মেরে ফেলেছিলাম জুতো দিয়ে। তারপর ক্ষতয় অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ ঘুম ভাঙে প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে। সঙ্গে গায়ে ব্যথা। আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেছে।

কোনওমতে বিছানা থেকে উঠে টলতে টলতে আমি গিয়েছিলাম শরথের দরজায়। ধাক্কা দিয়ে জাগিয়েছিলাম ওকে।

ঘুম চোখে আমায় দেখে প্রথমে কিছুটা বিরক্ত হলেও আমার মুখটা ভাল করে দেখে ও থমকে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করেছিল, “তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?”

আমি বলেছিলাম, “জ্বর খুব। গায়ে ব্যথা। একটা মাকড়সা কামড়েছিল শেষ রাতে। তারপর…”

আমায় আর কথা শেষ করতে দেয়নি শরথ। সঙ্গে-সঙ্গে বলেছিল, “আরে কী বলছিস! কেমন দেখতে মাকড়সাটা? পাতলা, ব্রাউন রঙের?” আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম।

“সর্বনাশ,” শরথের অবশিষ্ট ঘুমটাও চলে গিয়েছিল, “আরে, ওটা ব্রাউন রেক্লুজ়! খুব বাজে মাকড়সা। চল হসপিটালে। আমি তোর সামুদাকে ফোন করছি!”

“হসপিটাল!” আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

“শালা এক আটলান্টিক কে খাবি! খুব ফালতু মাকড়সা। আমাদের কলকাতার ম্যাদামারা জিনিস নয়। চল।”

শরথ দ্রুত সামুদাকে ফোন করে একটা ট্যাক্সি ডেকেছিল! হসপিটাল পৌছোতে-পোঁছোতে আমার জ্বর বেড়ে গিয়েছিল আরও। প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। তাই স্পষ্ট মনে নেই কিছু। শুধু বুঝেছিলাম আমার অপারেশন হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। গায়ে খুব ব্যথা।

সামুদা এসেছিল। সামুদা বাড়িতেও নাকি ফোন করে দিয়েছিল। পরের দিন মায়ের সঙ্গে ফোনে কথাও বলিয়ে দিয়েছিল সামুদা। মা খুব কান্নাকাটি করেছিল ফোনে। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সব। শেষে বলেছিল, “রাজিকে একটা খবর দিস, কেমন?”

প্রায় আঠারো দিন হয়ে গিয়েছে সেই ঘটনার, কিন্তু আজও বাঁ হাতে অস্বস্তি আছে। শুনেছি এই মাকড়সার বিষ থেকে নাকি সুদূরপ্রসারী নানা রোগ হয়। তাই এখনও আমায় ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ড্রেসিং করাতে হয়।

সবই করাচ্ছি নিয়মমতো। কিন্তু রাজিকে আর খবর দেওয়া হয়নি! আমার কেমন লাগে ওকে কিছু লিখতে। কথা বলতে। যে-মেয়েটাকে আমি রোজ দেখতাম, রোজ কথা বলতাম, সেই মেয়েটা গত তিন মাস পুরো ‘নেই’ হয়ে গিয়েছে আমার জীবন থেকে! কিন্তু সত্যি কি গিয়েছে!

রাতে, আমার শোওয়ার ঘরের জানালা দিয়ে মাঝে-মাঝে বাইরের দিকে তাকাই আমি। সাইড ওয়াকের পাশে একটা বড় গাছ আছে। আধো অন্ধকারে মনে হয় কে যেন বসে রয়েছে ওখানে। যেন আমার জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্নিমেষ! যেন ওখানে বসে, আমার দিকে তাকিয়ে তার দিন কাটছে, রাত কাটছে। তার গ্রীষ্ম আর শীত কাটছে! ছোটবেলায় ঠাকুরমার থেকে শোনা এক রূপকথার গল্প মনে পড়ে যায় আমার! আমি আলতো করে আমার জানলায় ব্লাইন্ড নামিয়ে দিই। আমার বুকের ভিতর কেমন একটা কষ্ট হয়। রাজির মুখটা মনে পড়ে! টিকালো নাক আর বড়-বড় চোখ মনে পড়ে! হঠাৎ শীত করে ওঠে খুব। মনে হয় আসলে আমিই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শত্রু! কিন্তু তারপরই বাবার মুখটা মনে পড়ে যায়! মনে পড়ে মায়ের সেই এগারো বছর আগের চোখদুটো! ভালবেসেই একসঙ্গে ছিল না তারা? মা যে এখনও সেই শূন্য অন্ধকার খনি খুঁড়েই সোনা খুঁজে যাচ্ছে! আমি তো মাকে বলতে পারছি না যে, “বাবা কোনও দিন ভালবাসেনি তোমায়!” আমি জানি কলকাতায় থাকলে মা কোনওদিন ভাল থাকবে না। তাই মাকে আমায় এখানে নিয়ে আসতে হবে। প্রেম তার সর্বস্ব লোভানি দিয়ে আমাকে ভোলাবার চেষ্টা করলেও আমি ভুলব না। রাজি আমার জীবনে ওই অন্ধকার গাছের ভ্রমটুকুই হয়ে থাকুক! টমের বাড়ি দেখে আমি চমকে গেলাম! আমি জীবনে এমন বাড়ি শুধু হলিউডের ফিল্মেই দেখেছি! গেট, বাগান আর সুইমিং পুল পেরিয়ে বিশাল বাড়ি! যার একটা দিক পুরো কাচের! আমি মূল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন ভ্যাবলা মেরে গেলাম। আমার ব্যাগের ভিতর রাখা সস্তার ওয়াইনের বোতলটা যেন নিজের থেকেই কুঁকড়ে হোমিওপ্যাথির শিশি হয়ে গেল!

টম আমায় নিজে এসে নিয়ে গেল ভিতরে। ভিতরটা দেখে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম! এটা কোথায় এলাম রে বাবা! এত দামি-দামি পেন্টিং! এমন উড প্যানেল করা ঘর! মাথার উপর ঝাড়বাতি! বসার ঘরেই তিন সেট সোফা! আমি ভাবলাম এমন বাড়িতে থাকতে টমের কমপ্লেক্স হয় না!

দেখলাম ঘরের ভিতর আরও তিন-চারজন রয়েছে। টম তাদের দিকে তাকিয়ে আমায় দেখিয়ে বলল, “মিট আওয়ার নিউ পিটার পার্কার! কার্টেসি, ব্রাউন রেক্লজ়!”

আমি কিছু বলার আগেই দেখলাম সবাই হেসে উঠল টমের কথায়।

টম বলল, “মেক ইয়োরসেল্‌ফ কমফর্টেবল। আমি একটু আসছি।”

টম ঘরের অন্য দিকে চলে গেল। এখন কী করা উচিত আমার! ওই হোমিওপ্যাথির শিশিটা বের করব? নাকি চুপচাপ ঘরে নিয়ে গিয়ে শরথের কাছে সমর্পণ করব! এখানে যা দেখছি দেওয়ালে ওই কোণের ছবিটা অরিজিনাল ক্লদ মনে হলে আশ্চর্য হব না! সেখানে এই ওয়াইন!

আমি কী করব ভাবছি এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে একটা হাত এসে আলতো করে টোকা দিল আমার কাঁধে।

আমি পিছনে ঘুরলাম। আর ঘুরেই মনে-মনে আরও কিছুটা বনবনিয়ে গেলাম! এ এখানে কী করছে? টম একেও বলেছে? আমায় তো জানায়নি কিছু! জানলে আমি আসতাম না। কারণ আমার এই যথেষ্ট জটিল জীবনে আমি আর নতুন করে নানিয়া ধীলোঁ নামক কোনও জটিলতা আনতে চাই না!

এগারো

রাজিতা

শাড়ি খুব ঝামেলার জিনিস! আমি ঠিক সামলাতেই পারি না। খালি মনে হয় এই বুঝি পায়ে জড়িয়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে যাব! আমার এত টেনশন হয় শাড়ি পরলে! কিন্তু কিছু করারও নেই। শাড়ি আজ পরতেই হয়েছে।

আমি ভেবেছিলাম যেমন কুর্তি লেগিংস পরি, তেমনই পরে যাব। কিন্তু জেঠিমা থাকতে আর আমার মর্জি কবে চলেছে!

স্নান করে আমি রোজকারের মতো কুর্তি পরে তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বেরিয়ে যাব এবার। কিন্তু ঠিক তখনই জুডো এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে।

আজ রবিবার। জুডো তো সকাল দশটায় ঘুম থেকে ওঠে না! তবে?

জুডো আমার মনের ভাব আন্দাজ করে বলেছিল, “মা আজ তুলে দিয়েছে ঘুম থেকে। বলে, ‘তোর দিদির জীবনে এত ইম্পরট্যান্ট দিন! আর সেখানে তুই পড়ে-পড়ে ঘুমোবি?”

আমি চোয়াল শক্ত করে নিজেকে সামলেছিলাম। সারা বাড়িতে এমন হ্যাংলামো শুরু হয়েছে যে কী বলব! সুজাতাদিকে একবার একা পাই, এমন বলব না!

আমি জুডোর পিছন-পিছন দোতলায় নেমে এসেছিলাম।

বাবা শুয়েছিল বিছানায়। আমায় দেখে সামান্য হাসি ফুটেছিল মুখে। সুস্থ হাতটা তুলে বসতে বলেছিল পাশে। আমি সেখানে বসতে-বসতে দেখেছিলাম ঘরের অন্য পাশে জেঠিমা আর মা বসে রয়েছে।

আমি ঠোঁট টিপে তাকিয়েছিলাম জেঠিমার দিকে। মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কোনও ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই।

“বলো,” আমি ব্যাগটাকে কোলের উপর গুছিয়ে তাকিয়েছিলাম সামনে।

জেঠিমার হাতে চায়ের কাপ ছিল। সেটা ছোট্ট টেবিলে রেখে জেঠিমা ভাল করে তাকিয়েছিল আমার দিকে। তারপর বলেছিল, “আমি জানতাম তুই এটাই করবি। তাই মিঠিকে বলেছিলাম, আমায় যেন ডাকে একবার।”

আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। আমি কী করলাম আবার! জেঠিমা এমন করে বলছে কেন?

জেঠিমা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “দেখ, তোর মেয়ের অবস্থা দেখ! বুঝতে পারছে না কী করেছে! কী মেয়ে মানুষ করেছিস তোরা?”

বাবা জড়ানো গলায় বলেছিল, “বউদি, এসব থাক না।”

“তুমি চুপ করো,” জেঠিমা বাবাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তোর কাণ্ডজ্ঞান নেই? এমন ড্রেস পরে কেউ ওসব জায়গায় যায়?”

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “এমন ড্রেস পরে ওসব জায়গা মানে!”

“মানে এমন কুর্তি লেগিংস পরে কেউ নিজের হবু শ্বশুরবাড়ি যায়?”

“জেঠিমা!” আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “কার শ্বশুরবাড়ি! কীসব বলছ!”

এবার মা ধমক দিয়েছিল আমায়, “এমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন? বড়দের সামনে এমন অসভ্যতা করতে হয়?”

আমি চুপ করে গিয়েছিলাম সঙ্গে-সঙ্গে। আমি অপমানসূচক কিছুই বলিনি। কিন্তু আজকাল মা কেমন যেন হয়ে গিয়েছে! আসলে বাবার মিল বন্ধ হওয়ার পর থেকে আমাদের সংসারে জেঠু টাকা দিচ্ছে। আমার যা আয় আর বাবার করে রাখা পোস্ট অফিসের এমআইএস থেকে পাওয়া টাকার বেশিটাই চিকিৎসার পিছনে খরচ হয়ে যাচ্ছে। তাই জেঠুর দেওয়া টাকার উপর আমাদের অনেকটা নির্ভর করতে হয়।

আর এই কারণেই মা কেমন যেন হয়ে আছে। কেবলই ভয় পায় জেঠু যদি রেগে যায় তবে হয়তো টাকা-পয়সা আসা বন্ধ হয়ে যাবে। না, মা এভাবে খোলাখুলি কিছু বলে না। কিন্তু আমি তো জানি মাকে!

জেঠিমা বলেছিল, “কীসব বলছি মানে! অমন ছেলে আর পাবি? সুজাতাকে ধন্যবাদ দে।”

আমি বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম। বাবা আলতো করে হাত রেখেছিল আমার পিঠে। জড়ানো গলায় বলেছিল, “তোকে কেউ জোর করছে না মা। তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিচ্ছু হবে না।”

বাবার দিকে তাকিয়ে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। এই মানুষটা যদি সুস্থ থাকত, তা হলে আজ আমায় এমন কিছু করতে হত!

আকাশ যে সত্যি এতটা ভেবে ফেলেছে সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আজ ওর বাড়িতেই আমার নেমন্তন্ন! আকাশের বাবা নিজে ফোন করেছিলেন আমাদের বাড়িতে। তবে তার আগে সুজাতাদি মাকে আর জেঠিমাকে বলে রেখেছিল।

আমি তো যেতেই চাইনি! কেন চাইব? জানি না, চিনি না, নেমন্তন্ন বললেই হল? কিন্তু মা, জেঠিমাকে কে বোঝাবে?

সুজাতাদি নাকি এও বলেছে যে, আকাশের মায়ের তো খুব শরীর খারাপ, তাই আসতে পারবেন না আমাদের বাড়ি। সেজন্যই আমায় দেখতে চেয়েছেন!

মা প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করছিল। বলেছিল, “ডিভোর্সি পাত্র! দোজবরে! আমার মেয়েকে দেব?”

জেঠিমা কিন্তু সেসব পাত্তাই দেয়নি! মাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, “তুই কি পাগল নাকি? আজকালকার দিনে কেউ ওসব ভাবে? অত ভাল ছেলে! কোন বিদেশি মেয়ে ওর মাথা চিবিয়েছিল ঠিক আছে। এখন আমাদের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে! আর সেদিন তো ছেলেকেও দেখলাম। কী সুন্দর দেখতে! তবে? না, না, তুই সুজাতাকে বল, রাজি যাবে ওদের নেমন্তন্নে!”

আমার জীবন নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু তাতে আমার কোনও কথা বলার অধিকার নেই যেন! আমি পিংপং ম্যাচ দেখার মতো একবার মা আর একবার জেঠিমাকে দেখছিলাম!

আজ সেই নেমন্তন্ন আমার! নেমন্তন্ন, নাকি মেয়ে দেখা? আমার মুখটা সকাল থেকেই তেতো হয়েছিল। আর সেটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল জেঠিমা!

জেঠিমা চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিয়ে বলেছিল, “নীচে চল। তোর জন্য শাড়ি কিনে রেখেছি! পরে যাবি। এমন পেতনি হয়ে যাবি না।”

বাবা আলতো করে হাত রেখেছিল আমার পিঠে। নরম গলায় বলেছিল, “ইচ্ছে না হলে যেতে হবে না মা।”

“না! হবে,” মা এবার ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, “আর লাই দিয়ো না! আজ যদি ভাল করে পড়াশোনা করত, অন্তত মাস্টার ডিগ্রিটা করতে পারত, তা হলেও ভাবনা ছিল না। সেটাও পারল না! চাকরি কি গাছে ফলে? ওই তো এত জায়গায় চেষ্টা করল, কিন্তু তাতে হল কিছু? সেদিন তো ঘটা করে একটা স্কুলেও ইন্টারভিউ দিয়ে এল, তবে? রিয়ানের মামার সোর্স! কিছু হল? ওকে বিয়ে দিয়ে দেব। ব্যস!”

আমি আর একটাও কথা না বলে জেঠিমার সঙ্গে নীচে চলে গিয়েছিলাম। মনের ভিতরটা রাগে অসাড় হয়ে গিয়েছিল! মা এমনটা বলতে পারল? আমি কি চেষ্টা করছি না? বিয়ে দিয়ে আমায় বিদায় করতে চাইছে?

আমি দেখেছি কষ্টগুলো চুম্বকের মতো। একটা ব্যাপারে শুরু হয়, তারপর আরও নানা রকম কষ্টকে টেনে-টেনে আনে! যেমন মায়ের অমন কথার থেকে শুরু হওয়া কষ্টটা টেনে এনেছিল রিয়ানের জন্য কষ্ট! মনে হয়েছিল আমায় যখন কেউ চায় না, তখন আমি একাই ভাল।

জেঠিমা রাগী বটে, কিন্তু ভালবাসে খুব আমায়। নিজের হাতে যত্ন করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল আমায়। সামান্য সাজিয়েও দিয়েছিল। আমি কিচ্ছু প্রতিবাদ করিনি। চোয়াল শক্ত করে বসেছিলাম শুধু।

সব কিছুর পরে জেঠিমা আমায় আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, “এমন রূপকে ঢেকে রাখিস কেন? কার উপর রাগ করে? ওই জানোয়ারটার উপর?”

আমার আবার জল চলে এসেছিল চোখে! আর আটকাতে পারিনি। ছোট-ছোট দানায় জলের পুঁতি গড়িয়ে পড়েছিল গাল হয়ে শাড়ির আঁচলের উপর।

জেঠিমা আমার থুতনিটা ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছিল, “কার জন্য কাঁদছিস রাজি? ওই জানোয়ারটার জন্য! তিন মাসের বেশি হয়ে গেছে। ও একবারও ফোন করেছে তোকে? একটা ইমেল করেছে? ভুলে গেছে সারা জীবন ধরে তুই কী-কী করেছিস ওর জন্য! সবাই জানে তুই ওকে কত ভালবাসিস! কিন্তু ও জানে না? ন্যাকা! হাড় শয়তান! আর কোনও দিন এ বাড়িতে আসুক। আমি যদি না ওকে ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছি, তবে আমার নাম পালটে দিবি! যে তোকে ভালবাসবে, জানবি সে তোকে কষ্ট দেবে না! যে কষ্ট দেবে, সে তোকে ভালইবাসেনি জানবি।”

আমি চোখটা মুছে স্বাভাবিক হয়েছিলাম। অন্য এক পুরুষের জন্য নিজেকে সাজালাম? অন্য এক পুরুষের জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করছি? রিয়ান আমায় এত দূরে পাঠিয়ে দিল? কেন? ওই ঘটনাটার জন্য? ও কি জানত না ব্যাপারটা? আমি বললাম বলেই দোষ হয়ে গেল! আমায় এমন করে ছুড়ে ফেলে দিল জীবন থেকে?

জেঠিমা বলেছিল, “আজ যাওয়ার আগে একবার ঠাকুরমার সঙ্গে দেখা করে যাস। প্রণাম করে যাস। কেমন?”

আমি বলেছিলাম, “আকাশকে আমার যদি পছন্দ না হয়?”

জেঠিমা হেসে বলেছিল, “তোদের এই বয়সের সমস্যা কী জানিস? সব কিছুকেই তোরা ইচ্ছে দিয়ে মাপিস! আজ এটা ইচ্ছে, কাল ওটা ইচ্ছে! শোন, জীবনকে দায়িত্ব দিয়ে মাপ, দেখবি মনের ভাললাগা আর আনন্দ অনেক বেশি পাবি।”

অনেক দিন ঠাকুমার কাছে যাইনি। আগে তো রোজ যেতাম। কত গল্প বলত ঠাকুরমা। আজকাল কেমন যেন চুপ হয়ে গিয়েছে মানুষটা। আমার বারান্দা থেকে দেখি একা-একা বসে রয়েছে। আমার দিকে খুব একটা তাকায়ও না! দূরের দিকে তাকিয়ে কীসব যেন ভাবে!

ঠাকুরমাদের বাড়ির সবাই আমায় চেনে। ভালবাসে। কিন্তু এখন আর অতটা ঘনিষ্ঠতা নেই। আজ আমায় এমন সাজগোজ করা দেখে তাই সবাই একটু অবাক হলেও বিশেষ প্রশ্ন করেনি।

কুকি বলে একটা মেয়ে ঠাকুরমার কাজ করে। আমি তিনতলায় সোজা উঠে গিয়েছিলাম। কুকি ঘরের সামনের বারান্দায় ঝাঁট দিচ্ছিল। আমায় দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল একদম। বলেছিল, “রাজিদিদি, তুমি! ভুল করে এলে?”

আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, “না, আসলে নানা ঝামেলায় থাকি তো! তাই আসা হয় না। ঠাকুরমা আছে?”

কুকি হেসে বলেছিল, “আছে, কিন্তু ব্যস্ত!”

“এই সকালে?” আমি অবাক হয়েছিলাম।

কুকি ভুরু নাচিয়ে বলেছিল, “আজ আবার গল্পের আসর বসেছে!”

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম খুব, “আজ আবার আসর বসেছে! এত বছর পরে!”

কুকি বলেছিল, “হ্যাঁ, আমাদের নীচের তলায় ভাড়াটে এসেছে নতুন। তাদের তিনটে বাচ্চা! টুপু, জিকি আর টটি! ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ে। তারাই আজকাল এসে গল্প শুনতে চায়।”

আমি আলতো পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকেছিলাম। আর সঙ্গে-সঙ্গে পেয়েছিলাম সেই গন্ধ! কপূর আর জর্দার! আচমকাই ছোটবেলাটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মনে। যেন দেখতে পেয়েছিলাম সামনের বড় খাটটায় বসে রয়েছে আগেকার রাজিতা আর রিয়ান!

খাটে বসেছিল ঠাকুরমা। সামনে তিনজন বাচ্চা! দু’জন মেয়ে আর একজন ছেলে। আমি ঘরে ঢুকতেই সবাই ফিরে তাকিয়েছিল! ঠাকুরমাও গল্প থামিয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। মুখ দেখেই বুঝেছিলাম খুশি হয়েছে!

আমি ভাল করে ঘরটাকে দেখছিলাম। বহুদিন রং হয়নি! দেওয়ালের জায়গায়-জায়গায় ড্যাম্প৷ ঝুল। খাটের পাশের টেবিলে ওষুধের স্তূপ৷ আমার খুব খারাপ লাগছিল! সত্যি এতটাই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি আমি যে মাস তিনেক আসতে পারিনি!

ঠাকুরমা শান্ত গলায় বলেছিল, “আয়, বোস। জানতাম, তুই আসবি। তোর জেঠি ফোন করে বলেছিল আমায়!”

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জেঠিমার সঙ্গে তা হলে যোগাযোগ আছে ঠাকুরমার!

আমি গিয়ে বসেছিলাম খাটের কোনায়। তারপর বলেছিলাম, “তোমায় রোজ দেখি বারান্দায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে থাকো। কিন্তু আমার দিকে তাকাও না একবারও। কেন?”

“তুই ডাকিস না কেন?” ঠাকুরমা হেসেছিল।

আমি বলেছিলাম, “কেন ডাকব? যে আমার দিকে তাকায় না, আমি মোটেও নিজের থেকে তাকে ডাকি না।”

ঠাকুরমা সময় নিয়েছিল একটু। তারপর থেমে-থেমে বলেছিল, “বুড়ি হয়ে গেছি রাজি! চোখের অবস্থা খুব খারাপ! দশ হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাই না। তোকে কী করে দেখব বল?”

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তা হলে আমি ঘরে এলাম, বুঝলে কী করে?”

ঠাকুরমা বলেছিল, “তোর গন্ধে! আমি তোর গন্ধ পাই! চন্দনকাঠের গন্ধ!”

আমার ভিতরটা কেমন যেন করছিল। খালি চোখে জল আসছিল আমার! বুঝতে পারছিলাম না কেন! কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছিল বুকে।

ঠাকুরমা সামনে এগিয়ে এসে এবার হাত ধরেছিল আমার। তারপর নরম গলায় বলেছিল, “শেষ পর্যন্ত এই হল!”

কী হল! আমি বুঝতে পারছিলাম না! ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অবাক হয়ে। ঠাকুরমা বলেছিল, “আমি জানি তুই কোথায় যাচ্ছিস? ঠিক করছিস একদম। তোরও একটা জীবন আছে রাজি। কাজকম্ম সবই থাকবে কিন্তু একজন ভালবাসার লোকও চাই। না, তুই যাকে ভালবাসবি সে লোক নয়, তোকে যে ভালবাসবে তেমন একটা লোক।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সবাই এই কথা বলে। কিন্তু আমার যে আর কাউকে ভালই লাগে না। মনে হয় রিয়ানকে ছাড়া আমার আর কিছু নেই! কেউ নেই! মনে হয় ও নেই বলেই আমার আজকাল আর কলকাতায় থাকতে ইচ্ছে করে না!

আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু তাকিয়েছিলাম ঠাকুরমার দিকে।

“কিছু বলবি না?”

আমি কোনওমতে বলেছিলাম, “তোমায় একটু প্রণাম করব।”

ঠাকুমা বলেছিল, “দুর পাগলি! ওসব করতে হবে না। শুধু আসিস মাঝে-মাঝে। তোকে না দেখতে পেলে কষ্ট হয়।”

“জানি ঠাকুরমা, আমারও হয়,” আমার গলা বুজে এসেছিল।

ঠাকুরমা আমার হাতটা ধরেছিল। ঠান্ডা, নরম একটা হাত। তারপর বলেছিল, “এত মায়া কেন তোর? এত মায়া করিস না!”

আমি কিছুতেই কথা বলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল এখানেই ঠাকুরমার পাশে শুয়ে পড়ি। আর কোথাও গিয়ে আমার কাজ নেই!

ঠাকুরমা নরম গলায় সুর তুলে বলেছিল, “তুই ছোটবেলায় জিজ্ঞেস করতিস না কেন আমার সব গল্পের নায়িকার নাম রাজিতা? আর কেন রিয়ানের নামে কোনও নায়ক নেই! এখন বুঝতে পারছিস তো কেন নেই!”

আমি ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আজ আমায় বাসে উঠতে বারণ করেছে জেঠিমা। জেঠু আমার সঙ্গে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে দিয়েছিল। আমার হাতে টাকাও গুঁজে দিয়েছিল। আমি না করতে পারিনি। সবার মুখে কেমন যেন একটা তৃপ্তি আর আনন্দ লক্ষ করছি আমি। আমাদের মেঘ-করা বাড়ির ভিতর হঠাৎ যেন পুজোর রোদ উঠেছে!

আমি বাইরে থেকে আসা হাওয়ার ঝাপটা বন্ধ করতে গাড়ির কাচ তুলে দিলাম। আমার ভাল লাগছে না। কিছুই ভাল লাগছে না।

মোবাইলটা বের করে দেখলাম একবার। আকাশ মেসেজ করেছে। আমি ঠিক মতো ট্যাক্সি পেয়েছি কি না! আসছি ক’টায়।

ওদের বাড়ি গোলপার্কের কাছে। আমায় লিখেছে কাছাকাছি গিয়েই যেন ফোন করে দিই। তা হলে পূর্ণদাস রোডের পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

থাকুক, সারা জীবন দাঁড়িয়ে থাকুক। আমার ইচ্ছে করছে সোজা দমদমে গিয়ে একটা প্লেনে চেপে ভোঁ করে রিয়ানের কাছে চলে যেতে! কত দিন দেখিনি ওকে। ওর হাতটা ছুঁইনি। থুতনির ওই টোলটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকিনি। কতদিন ওর বকা খাইনি! ওকে বকিনি! কত দিন ওকে বলতে শুনিনি, “গতকাল আসিসনি কেন রাজি?”

গতকাল কেন? আমি তো আর কোনও দিনই যাব না ওর কাছে। ওকে একটা ইমেল করেছিলাম। উত্তর দেয়নি। ওর নাম্বারে একটা ফোন করেছিলাম ওই মাকড়সার কামড়ের কথা শুনে। ফোন বেজে-বেজে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে! রিয়ান যেন পুরো মিলিয়ে গিয়েছে হাওয়ায়! মাঝে-মাঝে মনে হয় রিয়ান বলে কি আদৌ কেউ ছিল? সবটাই আমার কল্পনা নয় তো?

সেদিন সন্ধেবেলা কাকিমার কাছে রিয়ানের কথা শুনে আমি যে কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! খালি মনে হচ্ছিল রিয়ানের কাছে তো কেউ নেই! ওর যদি সাংঘাতিক কিছু হয়ে যায়!

কাকিমাও ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুব। আমরা দু’জন দু’জনকে ধরে কাঁদছিলাম। তারপর কাকিমার বড়দা মানে বড়মামা উপর থেকে এসে ব্যাপারটা সামলেছিলেন! আর ভাল ব্যাপার হল তার কিছুক্ষণের মধ্যে আলোও চলে এসেছিল।

মাকড়সা কামড়েছিল রিয়ানকে! এমন তো আমি শুনিনি কোনও দিন! বিষাক্ত মাকড়সা বলতে ট্যারান্টুলার নাম জানি। কিন্তু ব্রাউন রেক্লুজ় বলেও মাকড়সা হয়!

রিয়ানের অপারেশন হয়েছে। তারপরেও চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। এই মাকড়সার বিষ নাকি খুব বাজে। একবার শরীরে ঢুকলে নানা উপসর্গ তৈরি করে!

কাকিমা বলেছিল, “ওকে খুব করে বলেছিলাম শীতের ছুটিতে আসতে। ও পারবে না। আসতে-যেতে অনেক খরচ! তার উপর ওখানে ছুটিতে এক্সট্রা ক্লাস নেবে। টাকা পাবে। চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এবার আর আসবে না।”

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হেল্থ ইনশিয়োর করা আছে তো!”

কাকিমা বলেছিল, “গোটাটা কি আর দেয়? বেশ কিছুটা তো নিজেকেই দিতে হয়। জানিস তো গেছেই টাকা ধার করে। কবে যে আবার ছেলেটাকে দেখতে পাব!”

গড়িয়াহাট ফ্লাইওভার দিয়ে নামার সময় মনে হল আমি হয়তো আর কোনও দিনই দেখতে পাব না রিয়ানকে! রিয়ান যে আর দেখা দিতে চায় না! শেষ দিন তো তাই বলেছিল! বলেছিল, “আর কোনও দিন আমার সামনে আসবি না।”

আমি ট্যাক্সি থেকে নেমে আকাশকে ফোন করলাম। দু’বার রিং হতেই ফোনটা ধরল ও।

আমি বললাম, “এসে গেছি আকাশ।”

“এসে গেছ মানে?” আকাশ অবাক হল, “তোমায় বললাম না নামার কিছু আগে আমায় ফোন করবে? তবে? ঠিক আছে, দাঁড়াও ওখানে। পেট্রোল পাম্পের পাশে একটা ছোট মন্দির মতো আছে, তার পাশে দাঁড়াও। আমি আসছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে! কী যে করো! এখন একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তো!”

আমি ফোনটা কেটে ব্যাগে ঢোকালাম। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় জেঠু আমার হাতে একটা বড় মিষ্টির বাক্স ধরিয়ে দিয়েছিল। এটাও জেঠিমার বুদ্ধি। খালি হাতে যেতে নেই কারও বাড়িতে। বাক্সটা বেশ ভারী। জানি না কী মিষ্টি আছে।

আমি চারপাশে তাকালাম। সকাল এখনও দুপুরের দিকে গড়ায়নি। রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরির সামনে বেশ ভিড়। তবে আমার সামনের পূর্ণদাস রোডে তেমন গাড়ি নেই। রাস্তাটা কেমন ছায়া-ছায়া, ভেজা-ভেজা। আমার সাথে এলে ভাল লাগে বেশ। সারা জীবন নর্থে মানুষ তো! তাই সাউথের এই খোলামেলা ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম লাগে! মনে হয় নর্থটাকে কেউ যত্ন করে না। আর সাউথ যেন মায়ের হাতে সাজানো বাচ্চা!

“চলো, চলো, আর দাঁড়াতে হবে না।”

আমি আশপাশ দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আকাশের গলার স্বরে সংবিৎ ফিরল। পাঁচ মিনিটও হয়নি। তার আগেই চলে এসেছে। আমি দেখলাম আকাশ সামান্য হাঁপাচ্ছে। বুঝলাম দৌড়েছে!

আকাশ আমার হাত থেকে মিষ্টির বাক্সটা নিয়ে নিল, “এটা দাও আমায়। আর এসব ফরম্যালিটির দরকার ছিল না কিন্তু।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। সবে তিনদিন দেখছি ওকে। তার মধ্যেই আকাশ এমন ব্যবহার করছে যেন কত দিন চেনে! আমার কিন্তু আড়ষ্টতা যাচ্ছে না। বরং কেমন তেতো হয়ে আছে মুখটা। আর আচমকা কেন কে জানে রিয়ানের মুখটা ভেসে উঠছে সামনে।

পূর্ণদাস রোড থেকে বাঁ দিকে একটা গলি ঢুকে গিয়েছে। আকাশ আমায় নিয়ে সেই পথে ঢুকল। এই রাস্তাটাও ছায়া-ছায়া। দু’পাশে গাছ। কেমন একটা ঠান্ডা ভাব। আমি ভাল করে আকাশকে দেখলাম। একটা টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে আছে। গালে সামান্য দাড়ি। চুলগুলো উসকোখুসকো!

একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং কমপ্লেক্সের ভিতর ঢুকলাম আমরা। গেটের দরোয়ান আকাশকে দেখে হাসল। আকাশ হাত দিয়ে লিফ্টটা দেখিয়ে সেইদিকে হাঁটা দিল।

আমি চারপাশটা দেখলাম ভাল করে। বড় বাড়ি। দশতলা তো হবেই। সামনে গাড়ি পার্ক করার জায়গা। পাশে দরোয়ানদের ঘর। দুটো লিফ্ট আছে। আকাশ একটা লিফ্টের কল-বাটন টিপে অধৈর্য হয়ে পা নাচাচ্ছে!

আমার পা দুটো কেন জানি না অবশ হয়ে এল হঠাৎ! এ কোথায় এলাম আমি? কেন এলাম? সবাই বলল বলেই চলে এলাম! নাকি রিয়ান আমায় অবহেলা করল বলে এমন করে এখানে এসে কিছু একটা দিয়ে শূন্যতা পূরণ করার চেষ্টা করছি? আমার হাত-পা জ্বালা করে উঠল। মনে হল সামনের পৃথিবীটা টাল খেয়ে যাবে। আর আমি বলের মতো ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ব কোনও অজানা খাদে! আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল! মনে হল রাস্তা দিয়ে যাওয়া কোনও ট্যাক্সি থামিয়ে তার চালককে বলি, “আমায় দমদম নিয়ে যাবেন? প্লেন ধরব!”

আচ্ছা, আমরা যাদের চাই তারা আমাদের চায় না কেন? এ কী ধরনের ষড়যন্ত্র! জোর করে মিলে যাওয়া অঙ্ককে কেন এমন করে গুলিয়ে দেওয়া হয়? আর কে-ই বা দেয়? আমরা যাদের ভালবাসি, তারা আমাদের ভালবাসে না কেন? আমরা কি এতই হেলাফেলার! আমাদের জন্মের সময় বুঝি কারও আনন্দ হয়নি!

লিফ্টটা নরম আলোয় মোড়া। চারদিকে স্টেনলেস স্টিলের পাত ঝকঝক করছে। আকাশ ছ’তলার বাটন টিপল।

মসৃণভাবে উঠে গেল লিফ্ট! আকাশ শুধু বলল, “আজ তোমায় এতটা সুন্দর দেখাচ্ছে কেন?”

আমি না, লজ্জা পেলাম না। পা কাঁপল না আমার। কান গরম হল না। মনে হল কেউ যেন জিজ্ঞেস করল ক’টা বাজে! আমি শুধু ভদ্রতা রক্ষা করতে জোর করে হাসলাম।

টিং শব্দে লিপফ্‌টটা থামল ছ’তলায়। আকাশ বাইরে বেরিয়ে দাঁড়াল আমার জন্য। আমি শাড়ি সামলে নিয়ে লিফ্ট থেকে বেরোলাম। সামনেই লম্বা দেওয়াল। তাতে সার-সার মানুষের মুখের ছবি ফ্রেম করে বাঁধানো। এই তলাটা একদম নির্জন!

লিফ্টটা বন্ধ হয়ে আবার নেমে গেল নীচে। আমি দেখলাম আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

আমার অস্বস্তি হল। এমন করে তাকাচ্ছে কেন? আমি বলতে গেলাম, ‘কী, যাবে না?’ কিন্তু তার আগেই হঠাৎ আকাশ এগিয়ে এল আমার কাছে। তারপর “এক্সকিউজ় মি” বলে আচমকা হাত দিয়ে আমার কোমরটা জড়িয়ে ধরে টেনে নিল ওর কাছে। তারপর ঠোঁটটা চেপে ধরল ঠোঁটে।

ব্যাপারটা এমন করে ঘটল যে, আমি বুঝতেই পারলাম না কী হল। আমি শুধু বুঝলাম আকাশ চুইংগাম খাচ্ছে। আর বুঝলাম ওর দাড়ি কাটা উচিত রোজ!

কতক্ষণ আকাশ আমায় ধরে ছিল, জানি না। কিন্তু যখন ছাড়ল, দেখলাম ওর ফরসা মুখটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। শ্বাস দ্রুত!

“আয়াম সো সরি। কিন্তু তোমায় এমন লাগছে! আমি রেজ়িস্ট করতে পারলাম না,” আকাশ ঘন গলায় কোনওমতে বলল কথাগুলো।

তারপর আরও কীসব যেন বলল। কিন্তু প্রথমটুকু ছাড়া আর কিছুই কানে ঢুকল না আমার। আমি শুধু ওই সার বাঁধা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম প্রত্যেকটা ছবি থেকে রিয়ান গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে!

বারো

রিয়ান

এখানে একা হাঁটলে হাওয়া কানে বাজে। বুঝি কতটা নির্জন চারপাশ! আশপাশের সাজানো বাড়িঘরের মধ্যে একটা ঝুলন-ঝুলন ব্যাপার আছে। কিন্তু সবটাই কেমন যেন পরিত্যক্ত শহর মনে হয়! না, লোকজন যে দেখি না, তা নয়। কিন্তু এত কম যে ভাবা যায় না।

আমার ঘরের সামনে একটা ছোট প্যাটিও আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকাই। এমনও সময় গিয়েছে যখন দেখেছি দু’ঘণ্টায় সেই রাস্তা দিয়ে মাত্র চারজন লোক গিয়েছে!

আজ শনিবার। কলেজ ছুটি। কিন্তু পরীক্ষা চলছে। ফলে পড়াশোনাও চলছে পুরোদমে। গতকাল রাতে নানিয়া ছিল আমার এখানে। দু’জনে পড়েছি সারা রাত। তারপর ভোরের দিকে নানিয়া চলে গিয়েছে। আমিও একটু ঘুমিয়ে নিয়েছি।

এ সপ্তাহের বাজার করার দায়িত্ব ছিল আমার। তাই সকাল আটটা নাগাদ শরথ উঠিয়ে দিয়েছিল ঘুম থেকে।

বাজার বলতে কাছের বড় গ্রোসারি। ওখানে সবটাই পাওয়া যায়। মাছের ফিলে, কিছু তরকারি, চাল আর মশলাপাতি নিয়ে এসেছিলাম। তারপর স্নান করে রান্না সেরে আবার পড়তে বসে গিয়েছিলাম।

গতকাল নানিয়ার সঙ্গে পড়ার সময় দুটো অঙ্ক মিলছিল না। আজ পড়তে বসে সারা দুপুর ধরে সেই দুটো মিলিয়েছি। সঙ্গে আরও কিছু থিয়োরি রিভাইস করে নিয়েছি। সোমবারের পরীক্ষা খারাপ হবে না।

এখানে আর কিছুই করার নেই। শুধু পড়তে হয়। খারাপ রেজ়াল্টের কোনও জায়গা আমার জীবনে নেই!

বিকেল চারটে নাগাদ আর পড়তে ইচ্ছে করেনি। তাই বইপত্তর গুটিয়ে বেরিয়েছি একটু হাঁটতে।

বড় রাস্তার পাশের সাইড ওয়াকগুলো বেশ চওড়া। তাতে আবার কিছুটা অংশ ঘাস বোনা থাকে।

আমার কিছুই করার নেই। পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটছি। ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে বেশ। এখানে শীতে কখনও-কখনও বরফও পড়ে! এবার কি পড়বে?

ছোটবেলায় একবার সবাই মিলে লাভা, লোলেগাঁও আর রিশপ গিয়েছিলাম। শীতকাল ছিল সেটা। ডিসেম্বরের শেষ। রিশপে সেবার তুষারপাত হয়েছিল। রাজিতা আর আমি কাঠের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কীভাবে আকাশ থেকে কটন ক্যান্ডির মতো তুষার নামছে! ধীরে, নিশ্চুপে তারা জমে যাচ্ছে পপলার গাছের পাতায়, কাঠের রেলিং, বাড়ির ছাদে, পথের ধুলো-মাটিতে। আর আমাদের চোখের সামনে ধীরে-ধীরে কেমন যেন সাদা হয়ে গিয়েছিল চরাচর!

রাজিতা আমার হাতটা চেপে ধরেছিল। তিরতির করে কাঁপছিল ও। তুষারের যাতে ঘুম না ভাঙে, তেমন গলায় কথা বলছিল। আমার মনখারাপ করছিল খুব। কেন করছিল, জানি না। শুধু জানি, আস্তে-আস্তে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া আকাশ আর টলটলে একটা চাঁদের থেকে ছড়িয়ে পড়া জ্যোৎস্নার নীচে এমন একটা সাদা তুষারের জনপদ আমার বুকের ভিতরও মাথা তুলছে!

সামনেই একটা দোকান আছে। আমি যাতায়াতের পথে দেখেছি৷ নাম, ‘কন্ডোম সেন্স’। শরথ বলেছিল, ওটা সেক্স টয় শপ। ও ঢুকে দেখেছে। আমাকেও জোরাজুরি করেছিল নিয়ে যাবে বলে। আসলে শরথ ছেলেটা খুব অদ্ভুত! কখন যে কী করে আর কী বলে ঠিক নেই! আজ যেমন সকালে আমায় ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলেছিল, “তুই একটা রাস্কেল! কাল নানিয়া ছিল সারা রাত। ওর সঙ্গে শুতে পারলি না?”

আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, “মানে! কী বলছিস তুই?”

শরথ বলেছিল, “আমি মাঝে-মাঝে পড়া থেকে উঠে এসে তোর দরজায় কান পাতছিলাম! খালি পড়া আর পড়া! ভাবলাম তোরা করবি। তোর দ্বারা কিছু হবে না!”

আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। নানিয়ার সঙ্গে আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে পড়ে গিয়েছিল। আমি তাই কথা বলতে পারছিলাম না।

শরথ সেসব লক্ষ করেনি! আসলে ও নিজের অরবিটে থাকে! ওর যা বলার বলে। বাকি কে কী উত্তর দিল, কী দিল না, সেসব নিয়ে ভাবে না বিশেষ!

সকালে আমায় আবার বলেছিল, “তা হলে তোর আর নানিয়ার মধ্যে কিছু নেই?”

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “না, নেই!”

“তোর অন্য কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে?”

আমি আবার চুপ করে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে একটা মুখ ঝলসে উঠেছিল হঠাৎ! বুকের ভিতরটা আচমকা মোচড় দিয়ে উঠেছিল! আজকাল কী হয়েছে আমার! কেন ওর কথা সবসময় মনে পড়ে? ওর ইমেলে রিপ্লাই দিই না! ফোন রিসিভ করি না। যত দূরে যেতে চাই, সরে যেতে চাই, তত কেন বারবার মনে পড়ে ওর কথা? কী হচ্ছে আমার সঙ্গে? ওর কথা মনে পড়লেই আর কোনও কিছু করতে ইচ্ছে করে না কেন? জোর করে সরে থাকি। কিন্তু মনে-মনে সরে থাকতে পারছি না কেন আজকাল!

শরথ এবারও খেয়াল করেনি যে, আমি উত্তর দিচ্ছি না। ও হেসে বলেছিল, “তা হলে বলছিস আমি ট্রাই মারতে পারি? কী রে?”

আমি বলেছিলাম, “সেই টিফানিবউদির কী খবর?”

শরথ বলেছিল, “কথা ঘোরাবি না।”

আমি তাকিয়েছিলাম ওর দিকে। তারপর বলেছিলাম, “নানিয়ার কথা ভেবে দু’বার ফ্যান্টাসাইজ় করে নে। তারপরও যদি ট্রাই মারার ইচ্ছে হয়, তখন বলিস।”

শরথ দু’মাইল লম্বা হাসি দিয়ে বলেছিল, “আমি এত দিন তবে কী করলাম বলে তোর মনে হয়?”

আমার সামনে এক ভদ্রলোক দুটো বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে হাঁটছেন। মেয়েদুটোর বয়স বড় জোর ছয় কি সাত। গায়ে জ্যাকেট। মাথায় চুলো৷ আর দু’জনেরই হাতে দুটো করে গ্যাস বেলুন! বাচ্চাদুটো ক্রমাগত। কিচিরমিচির করে কথা বলে চলেছে। আর ভদ্রলোক যথাসম্ভব তার উত্তর দিচ্ছেন! বুঝলাম, বাবা আর মেয়ে।

আমার ভাল লাগল খুব। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার ছোটবেলার কথা। আমিও বাবার সঙ্গে এমন করে হাঁটতাম। ময়দানে বাবাও এমন একবার আমায় এক গোছা গ্যাস বেলুন কিনে দিয়েছিল। বলেছিল, “ভাল করে ধরে রাখা না হলে কিন্তু উড়ে চলে যাবে!”

আমার কী ভাল লেগেছিল সেদিন! কত রঙের বেলুন। আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে! আমি বেলুনগুলো মুঠোয় ধরে খুব দৌড়োচ্ছিলাম এদিক-ওদিক। বাবা হাসছিল আমায় দেখে। ঘাসে বসে একটা ভুট্টা ছাড়াতে-ছাড়াতে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলছিল, “আস্তে রিয়ান, পড়ে যাবি কিন্তু! সাবধানে।”

সে সব অসাবধানতার বয়স। ভয় না পাওয়ার বয়স! জীবনকে বিশ্বাস করার বয়স!

আমি শুনিনি। হাতের মুঠোয় বেলুনগুলো ধরে খুব ছুটে বেড়াচ্ছিলাম! আর তখনই বিপত্তিটা ঘটেছিল।

ঘাসের ভিতর লুকোনো ছোট একটা ইটের উপর পা পড়ে আমি ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিলাম! আর ব্যস, মাটিতে ছিটকে পড়ে গিয়েছিলাম একদম!

বাবা উঠে এসেছিল কাছে। লেগেছে কি না দেখছিল। আমি কিন্তু ওসব নিয়ে ভাবছিলাম না। শুধু দেখছিলাম আমার হাতের মুঠো ছাড়িয়ে বেলুনগুলো উঠে যাচ্ছে আকাশে। শেষ বিকেলের রঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া আকাশে!

শুধু একটা, মাত্র একটা বেলুন আমি ধরে রাখতে পেরেছিলাম হাতে! পড়ে গিয়েও সেই হলুদ রং-এর বেলুনটা আমার আঙুলে জড়িয়ে ছিল!

পকেটের ভিতর কুড়কুড় করে ফোনটা নড়ে উঠল। এখন আবার কে? আমি ফোনটা বের করলাম। আরে, সামুদা!

“হ্যাঁ দাদা, বলল,” আমি ফোনটা কানে লাগালাম।

সামুদার গলাটা কেমন যেন লাগল, “তুই কোথায়?”

“আমি একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। বলো না, কী হয়েছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সামুদা বলল, “আসতে পারবি একটু?”

আমি সামান্য ইতস্তত করলাম। যাওয়াই যায়, কিন্তু পড়াশোনা করব যে! সোমবার পরীক্ষা। ভেবেছিলাম ঘণ্টাখানেক হেঁটে গিয়ে আবার পড়তে বসব! কিন্তু সামুদার কাছে গেলে তো সেটা আর হবে না।

সামুদা রেগে বলল, “আসতে বলছি আর ঢ্যামনামো করছিস?”

“আসছি সামুদা, রাগ কোরো না,” আমি তাড়াতাড়ি বললাম।

গলা শুনে বুঝতে পারছি সামুদা আপসেট হয়ে আছে। আর আপসেট হয়ে গেলে সামুদা যা খুশি তাই বলে। এমন কী কলকাতায় থাকার সময় তো চড়-চাপড়ও মারত!

“উবের ধরে চলে আয়। আর আসার পথে স্টারবাক্‌স থেকে কফি নিয়ে আসবি। টাকা আমি দিয়ে দেব।”

আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামুদা কট করে ফোনটা কেটে দিল!

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সামুদার হঠাৎ কী হল। প্রথম-প্রথম সামুদার সঙ্গে একটু যোগাযোগ থাকলেও এখন কাজের চাপে খুব একটা যোগাযোগ হয় না! সামুদাও করে না। তা হঠাৎ আজ কী হল বুঝতে পারলাম না!

আমি ফোনের অ্যাপ থেকে একটা গাড়ি ডেকে নিলাম। যেতে যখন হবেই তখন আর দেরি করে লাভ নেই!

আমি হিসেব করে নিলাম যে, যাওয়ার পথে লাভার্স লেন আর গ্রিনভিলের ক্রসিং-এর ওই কফির দোকানটা থেকে কফি নিয়ে নেব। এই দেশে স্টারবাক্‌স থেকে কফি খাওয়ার খুব ক্রেজ় দেখি।

সকালবেলা অফিস যাওয়ার পথে সবাই গাড়ি নিয়ে কফি শপের ড্রাইভ ইনে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝে-মাঝে এত বড় লাইন হয়ে যায় যে, দেখলে অবাক লাগে!

এ দেশে কাজ শুরু হয় সকাল-সকাল। আবার বিকেল পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যে সব শেষ হয়ে যায়। সন্ধেবেলা রেসিডেন্সিয়াল এলাকাগুলো দেখলে তো মনে হয় মফস্সলের রাত! টিমটিম করছে দূরে-দূরে আলো! রাস্তা প্রায় ফাঁকা। আমার প্রথম-প্রথম খুব অবাক লাগত। এখন আর সেসব ভাবি না। বরং আমার নিজেরও রাতের খাবারের সময়টা কী করে যেন সাড়ে আটটা হয়ে গিয়েছে!

গাড়িটা চলে এল দু’মিনিটের মধ্যেই। গাড়িতে উঠে সামুদার বাড়ির ঠিকানাটা বলে বললাম যে লাভার্স লেন হয়ে যেন গাড়িটা যায়। কফি নিতে হবে।

গাড়ির চালক ভদ্রলোকের বয়স ষাটের উপর। আমি বুঝতে পারলাম না ভারতীয় না পাকিস্তানি! আমার নির্দেশ শুনে ভদ্রলোক গাড়ি স্টার্ট করলেন।

রাস্তাটার নাম লাভার্স লেন হলেও মোটে তা আমাদের দেশের মতো গলিঘুঁজি নয়। বরং বেশ বড় আর চওড়া রাস্তা। ওয়ান ওয়ে ধরনের দুটো দিক। আর দু’রাস্তার মাঝে ঘাসের আইল্যান্ড করা। তাতে আলো লাগানো।

“ইন্ডিয়ান? বেঙ্গলি?”

আমি দেখলাম রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ।”

ভদ্রলোক বললেন, “আমিও ভারতীয়। তবে উত্তর প্রদেশের লোক!”

আমি হাসলাম শুধু। এই দেশে এসে দেখছি দুমদাম অনেকেই খেজুরে আলাপ শুরু করে দেয়! আমি তো অভ্যস্ত নই, তাই কেমন একটা লাগে!

ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম হরিলাল মিশ্রা।”

আমি আবারও হাসলাম। কী আর বলব!

ভদ্রলোক কিন্তু তাও দমলেন না। বললেন, “স্টুডেন্ট, না? আমি কিন্তু পালিয়ে, কাজ খুঁজতে এসেছিলাম এখানে। হাতে প্রায় কোনও টাকা-পয়সাই ছিল না। আই ওয়াজ় আ বেগার!”

“তাই!” আমি সোজা হয়ে বসলাম।

হরিলাল যেন আরও উৎসাহ পেলেন, “আমেরিকান ড্রিম! কিন্তু তার তলায় যে কত নাইটমেয়ার লুকোনো আছে, তা কি আর দূর থেকে বোঝা যায়? এই যে তুমি পড়তে এসেছ, যেমনটা ভেবে এসেছিলে তেমন কিছু কি হল?”

আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে মাথা নাড়লাম। কথাটা ভদ্রলোক খারাপ বলেননি।

লাভার্স লেন আর গ্রিনভিলের ইন্টারসেকশনের স্টারবাক্‌স থেকে কফি নিতে বেশি সময় লাগল না। আমি সাবধানে কফির গ্লাসটাকে তার ঢাকনা সমেত হাতে ধরে বসলাম।

হরিলাল বললেন, “তুমি নিজের জন্য নিলে না?”

আমি মাথা নাড়লাম, “আমি খাই না।”

হরিলাল আবার রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, “জানো, আমি যখন প্রথম এদেশে আসি লিটারালি রাস্তায় থাকতাম। পিৎজ়ার দোকানগুলোর সামনে শুতাম। দিনের শেষে ওদের ফেলে দেওয়া খাবারের টুকরো কুড়িয়ে খেতাম। ভাবতে পারো? এটা খাব, ওটা খাব না, এসবের কোনও অপশন ছিল না। আমি ব্রাহ্মণ। দেশে কত নিয়ম মানতাম। কিন্তু এখানে সব খেয়েছি! বাঁচতে হবে তো!”

“কেন? কেন এমন করেছেন?” আমি আর কৌতুহল চেপে রাখতে পারলাম না।

হরিলাল মাথা নেড়ে হাসলেন। তারপর বললেন, “ভালবাসার জন্য! আজ এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সের আমায় দেখলে বোঝা যাবে না। কিন্তু ভাই, আমারও যৌবন ছিল। আমারও একজন ছিল। তার জন্য এসেছিলাম এদেশে! আমাদের ওখানের জোতদারের মেয়ে ছিল সে। আমি গরিব ব্রাহ্মণের ছেলে। মেরে পুঁতে দিত আমায় যদি না পালাতাম। অনার কিলিং শুনেছ তো? তখনকার দিনে আরও বেশি হত। এখানে এসে প্রথম ছ’বছর সব করেছি! এমনকী, হোর হাউজ়েও কাজ করেছি! তারপর আস্তে-আস্তে ভাগ্য ফেরে। আজ আমার চারটে গাড়ি। দোকান, বাড়ি সব আছে। দুই ছেলে। নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার!”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম ভদ্রলোকের দিকে। দেখলে কে বলবে এমন গল্প আছে মানুষটার! ছোটখাটো চেহারা। মাথায় টাক। আস্তে-আস্তে কথা বলেন। কিন্তু এমন ছোটখাটো চেহারার ভিতরে যে এমন একটা দৈত্য লুকিয়ে আছে, কে বলবে! বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজের জায়গা খুঁজে পাওয়া যে কী কঠিন ব্যাপার, যারা ঘরের ভিতর লেপের আড়ালে বসে জীবন কাটায়, তারা বুঝবে না!

আমি বললাম, “আর যার জন্য এত কিছু, সে?”

হরিলাল এই প্রথম মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন আমায়। তারপর হেসে বললেন, “গেস!”

“আপনি গিয়ে তাকে পরে বিয়ে করেছেন,” আমি ঝুঁকে পড়ে সামনের সিটের ব্যাক রেস্টটা ধরলাম।

শব্দ করে হাসলেন হরিলাল৷ বললেন, “মেরা লাইফ হিন্দি ফিল্‌ম নেহি হ্যায় বেটা। ও আমায় ছেড়ে দিয়েছিল। আমি এখানে আসার ছ’মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় ওর। আমি এখানেই বিয়ে করেছি একজন মেক্সিকান মহিলাকে। কিন্তু লালিকে ভুলিনি আজও! আমি গরিব বলে এমনটা করতে পেরেছিল ওরা! তাই জান দিয়ে খেটেছি, যাতে আমিও পয়সা করতে পারি! নাথিং ইজ় শার্পার দ্যান ব্রোকেন পিসেস অব লাভ! ডোন্ট এভার লেট ইয়োর লাভ লিভ ইউ। এখন ভাবি আমি তো ওখানে থাকতেই পারতাম! চেষ্টা করতেই পারতাম! কী হত? মেরে দিত? দিত! মুঝে ভাগনা নেহি চাহিয়ে থা!”

কথাটা শেষ করে কেমন যেন চুপ করে গেলেন হরিলাল মিশ্রা! শেষের কথাগুলো যেন আমায় নয়, নিজেকেই বলছিলেন!

আমি পিছিয়ে বসলাম। খুব অবাক লাগল। কোথাকার হরিলাল মিশ্রা আর কোথাকার রিয়ান মুখার্জি! একটা ছোট্ট ট্যাক্সি কীভাবে দু’জনের জীবনকে কাটাকুটি করে দিল! কেন আমার দেখা হল হরিলাল মিশ্রার সঙ্গে? কেন আমার ঘরের সামনের ওই অন্ধকার গাছের আদলে কেউ একজন অপেক্ষা করে? জীবন কী বলতে চাইছে আমায়? কার কথা বলতে চাইছে? সত্যি কি এই দেশ এতটা একা? না আমারই কোনও এক কারণে আরও একা লাগছে?

সামুদার বাড়ির সামনে নেমে টাকা মিটিয়ে দিলাম আমি। হরিলাল যাওয়ার আগে বললেন, “ছুটির দিনে আমি নিজে গাড়ি চালাই। ভাল লাগে। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল খুব।”

আমি বললাম, “আমারও।”

হরিলাল বললেন, “খুশ রহো।”

গাড়িটা চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ওই দিকে। তারপর সামুদার বাড়ির দিকে এগোলাম। দেখি কী বলতে চায় দাদা! আর ঠিক তখনই কুড়কুড় করে উঠল পকেটের ফোনটা। এখন আবার কে! বের করে দেখলাম নানিয়া!

“বল,” আমি ছোট করে বললাম।

নানিয়া বলল, “ওই অঙ্কটা হয়েছে? আমি পারছি না।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ হয়েছে। আমি তোকে মেল করে দেব।”

নানিয়া বলল, “না, কাল যাব তোর কাছে। তখন দেখে নেব। আর একটা কথা। তোকে সুরিন্দর ফোন করতে পারে। মানে ওর কেন যেন মনে হয়েছে আমার সঙ্গে তোর কিছু সম্পর্ক আছে! তুই কিন্তু ঘাবড়াবি না।”

আমার হঠাৎ হাসি পেয়ে গেল। একদিন এই সুরিন্দর অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে বলে নানিয়া কাঁদতে-কাঁদতে আমার কাছে এসেছিল। আর আজ গঙ্গা উলটো বইছে!

বললাম, “ঠিক আছে। এখন রাখছি।”

“খুব তাড়ায় আছিস মনে হচ্ছে? নানিয়া যেন বিরক্ত হল।

আমি বললাম, “সামুদার এখানে এসেছি। কাল আয়, কথা হবে। বাই।”

ফোনটা কেটে আমি হাসলাম নিজের মনে। আজকাল আবার আগের মতো সহজ হয়ে গিয়েছে নানিয়া। অতীত নিয়ে আমরা আর কথা বলি না। তবে এ ব্যাপারে আমার কৃতিত্ব নেই কোনও। যা করেছে, নানিয়াই করেছে।।

টমের বাড়িতে সেদিন নানিয়াকে দেখে আমি খুবই অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।

নানিয়া বলেছিল, “কী রে, কেমন আছিস?”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাকিয়েছিলাম শুধু।

নানিয়া বলেছিল, “শুনলাম স্পাইডারম্যান হয়ে গেছিস? সত্যি! দেওয়াল বেয়ে হাঁটতে পারিস?”

মাকড়সা কামড়ানোর পর এটা একটা কমন জোক হয়ে গিয়েছে আমায় নিয়ে! তাও আমি মনে-মনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।

নানিয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ঘরের কোনায়। বলেছিল, “দেখ রিয়ান, আমার আর এসব ভাল লাগছে না।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে নিয়েছিলাম।

নানিয়া বলেছিল, “মাথা নামালে হবে না। আমরা খুব ভাল বন্ধু। একটা বিকেল সেটাকে নষ্ট করে দিতে পারে না। আই ওয়াজ় মেন্টালি ডিসটার্বড! তাই কীসের থেকে কী হয়ে গেছে! আমার দোষ নেই। তোরও না। প্রেমে ধাক্কা খেলে এমন রিবাউন্ড হয়।”

আমি এবার তাকিয়েছিলাম নানিয়ার দিকে। তারপর বলেছিলাম, “তুই কি কথাগুলো আমায় বলছিস, না নিজেকে কনভিন্স করছিস? শোন, আমার তোর সঙ্গে কোনও মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট হয়নি। সেক্স হয়েছে, কিন্তু সেটা অ্যাক্সিডেন্ট।”

“তা হলে আমার সঙ্গে কথা বলিস না কেন?” নানিয়া রাগ করে তাকিয়েছিল আমার দিকে।

আমি বলেছিলাম, “তুই নিজেই পালাতিস। মুখ ঘুরিয়ে নিতিস৷ যেন আমি তোকে কী না কী করে দেব! আমার খারাপ লাগত। তাই কথা বলিনি।”

নানিয়া হেসেছিল এবার। তারপর বলেছিল, “আবার যদি কোনও দিন সেক্স হয়ে যায়, আবার এমন করবি?”

আমি তাকিয়েছিলাম ওর মুখের দিকে। বলে কী মেয়েটা!

নানিয়া হেসে চোখ টিপে বলেছিল, “তোর আফটারশেভটা ব্যাপক!”

তারপর থেকে নানিয়ার সঙ্গে আবার ভাব হয়ে গিয়েছে। তবে একটা জিনিস দেখছি। নানিয়া এখন খুব গায়ে হাত দিয়ে কথা বলে। কেন, সেটা জানি না! জীবনে বোধহয় সবটা জানতেও নেই। বুঝতেও নেই। কিছু-কিছু জিনিস অস্পষ্টভাবেই ছেড়ে দিতে হয়।

আমায় দেখে সামুদা ভুরু কুঁচকে বলল, “দেরি করলি কেন?”

আমি হাসলাম, “কফি নিয়ে এলাম তো৷ তাই।”

সামুদা কফিটা হাত থেকে নিয়ে রাখল টেবিলে। তারপর আচমকা কানটা ধরল। বলল, “তুই শালা খুব তালেবর হয়ে গিয়েছিস, না?”

আমি ঘাবড়ে গেলাম। সামুদা মারছে কেন আমায়?

“আরে, আরে, কী হয়েছে?” আমি মুখটা বিকৃত করে বললাম।

“গত এক সপ্তাহ কাকিমাকে ফোন করিসনি?”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। কথাটা ঠিক। মাকে ফোন করা হয়নি। কিন্তু মাকে তো বলেছিলাম এমনটা হবে। তবে!

সামুদা কানটা ছেড়ে আমায় এক ধাক্কায় সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল, “সবাই ভালবাসে বলে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? কেন ফোন করিসনি কাকিমাকে? আর কাকিমা যখন ফোন করেছে, তখন তুলিসনি? গতকাল কাকিমা আমাদের বাড়ি গিয়ে খুব কেঁদেছে! তুই নাকি ঠিকমতো ফোন করিস না। করলেও দু’মিনিট কথা বলে রেখে দিস!”

আমি মাথা নিচু করে নিলাম।

সামুদা বলল, “পোঁদে লাথি মেরে এই দেশ থেকে বের করে দেওয়া উচিত তোকে। জানোয়ার!”

আমি বললাম, “সামুদা, রাগ কোরো না প্লিজ়।”

সামুদা আমার সামনে বসে পড়ল। বলল, “ছোটবেলায় মাঞ্জা দিতে কে শিখিয়েছে তোকে? সিটি মারার কায়দা কে শিখিয়েছে? ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার কে বানিয়েছে? ফেলুদা কে পড়িয়েছে? হলিউড কে চিনিয়েছে? আমি, এই আমি। আমি তোর উপর রাগ করতেই পারি।”

আমার কেন জানি না আচমকা চোখে জল চলে এল। বললাম, “পারো তো সামুদা, তুমিই পারো। আমি কখনও অস্বীকার করেছি?”

“শোন, মুখে অস্বীকার করার ব্যাপার নয় রিয়ান। মুখে স্বীকার করার ব্যাপারটাই আসল। আমার কথা বলছি না। মায়ের কথা বলছি। তোর পরীক্ষা থাক, যা-ই থাক, মাকে ফোন করবি না? এখানে কী করতে এসেছিস? পড়তে? নাকি অমানুষ হতে?”

আমি বললাম, “আমার ভুল হয়ে গেছে সামুদা। আমার মাথার ভিতর সবসময় কী হয় তুমি জানো না। আমি কি শুধু নিজের জন্য এসেছি? মায়ের জন্য আসিনি কি? এদেশে আমি মাকে নিয়ে আসব। ওই দেশ কী দিয়েছে আমায়? আমার যা ছিল সবটাই তো…”

সামুদা কথা শেষ করতে দিল না। বলল, “শোন, তুই একা নোস যে, অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছে!”

আমি বললাম, “তুমি আমার সঙ্গে ছিলে সামুদা। ভুলে গেলে সেই দিনটা? আমতলার ওই…”

“চুপ কর!” সামুদা চিৎকার করল, “আর কত দিন মৃতদেহ গলায় ঝুলিয়ে ঘুরবি? শুধু মা, না? আর রাজিতা? ওর কী হবে?”

আমি কিছু না বলে চুপ করে গেলাম! সামুদা কফিটা নিয়ে এসে বসল আমার পাশে। বলল, “তুই জানিস না, না?”

আমি তাকালাম সামুদার দিকে।

সামুদা বলল, “আজ মা ফোন করেছিল আমায়। তখনই বলল। কাকিমার থেকে জেনেছে কথাটা।”

“কী জেনেছে?” আমি তাকালাম সামুদার দিকে।

সামুদা কফিতে চুমুক দিয়ে তাকাল আমার দিকে। তারপর কেটে-কেটে বলল, “রাজিতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের ফাল্গুনে সম্ভবত।”

আমি আচমকা স্থির হয়ে গেলাম। মনে হল শিরার ভিতর সমস্ত হিমোগ্লোবিন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কোষে-কোষে কাজ বন্ধ করে দিল মাইটোকনড্রিয়া। সমস্ত স্নায়ুর আদানপ্রদান থামিয়ে দিল নিউরন! আমি জড় বস্তুর মতো তাকিয়ে দেখলাম আমার সামনে সামুদা নেই, ডালাসের অ্যাপার্টমেন্ট নেই, বরং চরাচর জুড়ে একটা মাঠ জেগে আছে শুধু। আর সেই মাঠে বহুদিন আগের সেই বাচ্চা ছেলেটা পড়ে আছে মাটিতে। আজ তার আঙুল থেকে খুলে গিয়েছে সুতো। তার শেষ গ্যাস বেলুনটা তাকে ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে আকাশে! শীতকাল ছাড়িয়ে আরও দূর কোনও এক বসন্তের আকাশে!

তেরো

রাজিতা

“Even after you ruined me for any other,

I cannot regret you. Even as I cleave

the flesh of wanting from the bone,

I hope the night sky is pretty

wherever you are.”

আজ সব গুছিয়ে ফেলার দিন। জীবনে যা কিছু কষ্ট দেয়, যা কিছু ক্ষত তৈরি করে সেই সব জিনিসগুলোকে সরিয়ে ফেলার দিন। এই শহর একটা বড় চিলেকোঠা। তার মধ্যে আজ নিজস্ব আর-একটা চিলেকোঠা করার দিন। তারপর সব স্মৃতি গুনে-গেঁথে সেইখানে চাবি দিয়ে বন্ধ করে রেখে চাবিটা হারিয়ে ফেলার দিন।

আমি আবার খাতাটা উলটে দেখলাম। গোটা-গোটা হাতের লেখায় লেখা আছে কবিতাটা। এমন আরও অনেক কবিতাই আছে এই খাতায়। কিন্তু শেষবারের মতো উলটোতে গিয়ে কেন যে এই পাতাটাই সামনে খুলে গেল কে জানে!

রিয়ানের খাতাটা আমায় দিয়েছিল কলেজে পড়ার সময়। কোনও ভাল কোটেশন দেখলেই ও সেটা লিখে রাখত এই খাতায়।

সেবার আমার জন্মদিন ছিল। ওকে নেমন্তন্ন করেছিল মা। কিন্তু যথারীতি আসেনি। তাই বিকেলের দিকে আমি নিজেই টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে নিয়ে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি।

নিজের ঘরে বসে ছিল রিয়ান। দেখেছিলাম জানালা দিয়ে আসা অল্প আলোয় ও একটা বই খুলে কীসব হিজিবিজি দাগ কাটছিল তার পাতায়!

আমায় দেখেই কেমন যেন গম্ভীর আর বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। আমি জানি না কেন, কিন্তু ক্লাস টেন পাশ করার পর থেকেই রিয়ান আমার সামনে কেমন যেন কাঠ-কাঠ হয়ে থাকত। জিজ্ঞেস করলেও সরাসরি কিছু বলত না। বরং রাগ করে বলত, “আমার কাছে কেন থাকিস সবসময়? এত ছেলে ইট পেতে রয়েছে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দে!”

আমি গায়ে মাখতাম না। তাই সেই বিকেলেও গায়ে মাখিনি।

আমি বলেছিলাম, “জানতাম তুই ডুব মারবি, তাই আমি খাবার নিয়ে এসেছি।”

রিয়ান বলেছিল, “মা তোকে এঘরে আসতে বারণ করেনি? বলেনি, আমি কাজ করছি?”

আমি বলেছিলাম, “হ্যাঁ বলেছিল। কিন্তু আমি শুনিনি।”

“কেন শুনিসনি?” রিয়ান বিছানা থেকে রাগ করে উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে।

আমারও রাগ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। বলেছিলাম, “বেশ করেছি। কী করবি? মারবি? সাহস আছে আমার গায়ে হাত দেওয়ার! এত করি তো, তাই পাত্তা দিস না, না? কী ভাবিস নিজেকে?”

রিয়ান বলেছিল, “যা ভাবি তা তোকে বলব কেন? কে তুই?”

“আমি কে! জানিস না আমি কে?” আমার যে কী হয়েছিল সেদিন জানি না। মাথার ভিতর বোধহয় একটা ঘূর্ণি ঢুকে পড়েছিল।

রিয়ান চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিল আমার দিকে, “ঝগড়া করতে এসেছিস?”

আমি আচমকা ওর জামার বুকের কাছটা খামচে ধরে বলেছিলাম, “বেশ করব, ঝগড়া করব।”

ঘরের আলো আঁধারির ভিতর রিয়ান যেন কেমন পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর আচমকা আমায় কোমর ধরে টেনে নিয়েছিল নিজের কাছে। ঠোঁটের উপর চেপে ধরেছিল ওর ঠোঁট!

আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে। তারপর আমিও আঁকড়ে ধরেছিলাম ওকে। ওর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলাম নিজেকে। ওর আফটার শেভের গন্ধটা কেমন যেন অবশ করে দিয়েছিল আমায়। আর নিজের অজান্তেই রিয়ান আমার কোমর ধরে কিছুটা তুলে নিয়েছিল মাটি থেকে।

জানি না কতটা সময় আমরা এক হয়ে ছিলাম। তখন মনে হয়েছিল অনন্ত মুহূর্ত ঢুকে গিয়েছে ওই ছোট্ট বিকেলটুকুর মধ্যে! কিন্তু আজ মনে হয় বড় জোর দশ সেকেন্ড!

আচমকা যেন রিয়ান বুঝতে পেরেছিল কী হয়েছে। ও চট করে আমায় নামিয়ে দিয়েছিল মাটিতে। আমি তখনও ওর পিঠের কাছের জামাটাকে খামচে ধরে ছিলাম। ও আলতো করে ছাড়িয়ে দিয়েছিল আমার হাত।

আমি তাকিয়েছিলাম ওর চোখের দিকে। কিন্তু রিয়ান কিছুতেই আমার দিকে তাকাচ্ছিল না। আমি হাত দিয়ে ওর থুতনিটা ধরে আমার দিকে ফেরাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু রিয়ান ঘাড় শক্ত করে সরে গিয়েছিল দ্রুত।

আমি বলেছিলাম, “সরে যাচ্ছিস কেন?” রিয়ান সময় নিয়েছিল কিছুটা। তারপর বলেছিল, “নাথিং হ্যাপেন্ড। জানবি কিচ্ছু হয়নি। জাস্ট অ্যাক্সিডেন্ট মনে করে ভুলে যাবি।”

আমি বলেছিলাম, “কেন? কেন ভুলে যাব?”

রিয়ান অধৈর্য হয়ে বলেছিল, “যা বলছি, শোন। এসব আমার জন্য নয়। আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আর দুর্বলতা নেই। তুই এসব মনে রাখবি না। তোর গোটা জীবন পড়ে আছে। এসব ফালতু সেন্টিমেন্ট নিয়ে পড়ে থাকবি না।”

“ফালতু সেন্টিমেন্ট!” আমার বুকের ভিতর জ্বালা করছিল খুব। মনে হচ্ছিল রিয়ানের চুল ধরে টেনে, কিল-চড় মেরে জামা ছিড়ে দিতে! কী বলছে ও! কী ফালতু? ও বোঝে না কিছু? কেন একটা মেয়ে সারা জীবন ওর চারপাশে ঘোরে? কেন বারবার আসে? কেন কোনও অবহেলাকেই অবহেলা মনে করে না!

রিয়ান বলেছিল, “যা বলছি, শোন! একদম ফালতু জেদ দেখাবি না। জীবনে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এটাও তেমন। আর কিছু নয়। ডোন্ট মেক মাউন্টেন আউট অব আ মোল হিল।”

“তুই আমায় একটু…” আমার গলা ধরে এসেছিল হঠাৎ।

“রাজি,” রিয়ান ধমক দিয়েছিল, “কন্ট্রোল ইয়োরসেল্‌ফ! এসব নিয়ে পড়ে থাকিস না। আমার সময় নেই এসবের। আমার পড়া আছে। তুই এবার যা।”

আমি জলে ভেজা গলায় বলেছিলাম, “এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছিস? আজ আমার জন্মদিন রিয়ান!”

রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে ছিল এক মুহূর্ত। তারপর নিজের ডেস্কের থেকে একটা চামড়া বাঁধানো খাতা তুলে বলেছিল, “এই খাতাটা তোর পছন্দ না? এটা তুই রাখ। বার্থডে গিফ্ট।”

আমি বলেছিলাম, “লাগবে না। গিফ্ট আমি পেয়ে গিয়েছি।”

রিয়ান জোর করে আমার হাতে খাতাটা গুঁজে দিয়ে বলেছিল, “কিচ্ছু পাসনি। বলেছি না কিছু হয়নি। তোর ভ্রম ওটা। আমার ভুল। এটা রাখ। হ্যাপি বার্থডে।”

আজও আমার ঠোটে লেগে রয়েছে সেই শেষ বিকেলের আলোটুকু। আজও মনের ভিতর রয়ে গিয়েছে সেই গন্ধের স্মৃতি। আমার একাকী সময়ে আজও ওই বিকেলটুকুই সম্বল আমার!

সেদিন লিফ্টের সামনে সেই যে আচমকা আকাশ আমায় জড়িয়ে ধরেছিল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছিল। আমার কিন্তু তাতে কিছুই মনে হয়নি। আমার শুধু রিয়ানের মুখটা মনে পড়ছিল। সেই সার-সার ছবির ফ্রেমের মাঝে আমি যেন রিয়ানকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। রাগী, গম্ভীর আর বিরক্ত মুখের রিয়ানকে।

কতক্ষণ আকাশ আমায় ধরেছিল আমি জানি না। কিন্তু আমার থেকে সরে গিয়ে ও কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে। বলেছিল, “তুমি রেগে গেছ?”

আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “না।”

“তা হলে?” আকাশ এক পৃথিবী জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়েছিল আমার দিকে।

আমি বলেছিলাম, “কী তা হলে?”

“তা হলে এমন স্টিফ হয়ে ছিলে কেন? আমার মনে হচ্ছিল আয়াম কিসিং আ পোল!”

আমি কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিয়েছিলাম।

আকাশ আলতো করে আমার হাত ধরেছিল। বলেছিল, “আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টেক অ্যাডভান্টেজ। ডোন্ট ওয়ান্ট টু হার্ট ইউ। আই লাইক ইউ আ লট। আই থিঙ্ক আয়াম ফলিং ফর ইউ। তাই আজ নিজেকে আটকাতে পারিনি। ইউ স্মেল সো নাইস।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। আকাশ তো ভাল কথাই বলছিল। প্রশংসাই করছিল। কিন্তু আমি কিছুতেই খুশি হতে পারছিলাম না। আমি চাইছিলাম যে, কথাগুলো আমার মধ্যে ভাল কিছু অনুভূতি তৈরি করুক। আমায় আনন্দ দিক। কিন্তু কিছু আসছিল না। বরং কেমন একটা ক্লান্তি আসছিল। মনে হচ্ছিল এই আকাশকে আমায় বিয়ে করতে হবে? এই ছেলেটার সঙ্গে আমায় গোটা জীবন কাটাতে হবে? এখনও এর বাড়িতে ঢুকিনি কিন্তু এখনই এমন ক্লান্ত হয়ে পড়ছি? আমার মনে হচ্ছিল অদৃশ্য এক শেকল যেন বেঁধে ফেলছিল আমায়!

কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে আমার তো এমন মনে করার কথা নয়! এত ভাল ছেলে। ভাল চাকরি। ব্যবহার ভাল। দায়িত্ববান। দেখতে সুন্দর। কথা বলে ভাল। তার উপর বাড়ির সবাই রাজি। এমন ছেলেকে বিয়ে করলে তো জীবনে আর চিন্তাই থাকবে না। তা হলে? তা হলে আমার অমন হচ্ছিল কেন? কেন বারবার মনে হচ্ছিল দৌড়ে পালিয়ে যাই দমদম এয়ারপোর্ট! সপাটে বলে দিই আকাশকে যে ‘তুমি ভাই কাটো। সামনের ভাইফোঁটার আগে এসো না!’

সেদিন আকাশদের বাড়িতে বিকেল অবধি ছিলাম। ওর বাবা, মা সবার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। মা তো সত্যিই খুব অসুস্থ। টানা কথাও বলতে পারছিলেন না। তাও আমায় পাশে বসিয়ে আমার হাত ধরে রেখেছিলেন।

ফরসা মানুষটা কেমন যেন ছোট কুণ্ডলী পাকিয়ে গিয়েছিল! অল্প আলোয় বুঝতে পারছিলাম মানুষটার আর বিশেষ জীবন অবশিষ্ট নেই। ফরসা, নীলচে মুখের ভিতর কেমন একটা অসহায়তা!

উনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “তুমি মা আমার উপর রাগ করোনি তো?”

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

উনি আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বলেছিলেন, “আমার জন্যই তো তোমায় আসতে হল। আসলে আমাদের বাঙালিদের মধ্যে এমন রীতি তো নেই! তোমার বাড়ির লোকজন ভাল বলতে হবে যে, তোমায় আসতে দিয়েছেন!”

আমি বলেছিলেন, “না, না, তাতে কী!”

উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “ছেলেটা আমার পাগল! বিদেশে গিয়ে হুট করে না হলে কেউ বিয়ে করে নেয়! ওদের গায়ের রং, চোখের রং, মুখ-চোখ সুন্দর হতে পারে, কিন্তু শুধু সুন্দর দিয়ে তো জীবন কাটে না! একসঙ্গে থাকতে হলে অন্যকে জায়গা দিতে হয়। অন্যের ভাল-মন্দটা দেখতে হয়, সেটার যত্ন করতে হয়। তোমায় দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সুজাতাও খুব প্রশংসা করেছে। আকাশও খুব খুশি। ওর তো তোমায় একবার দেখেই ভাল লেগে গিয়েছিল। এখন তোমার যদি পছন্দ হয় আমার ছেলেকে, তা হলে নিশ্চিন্ত হই।”

আমি কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। এরা এত ভাল মানুষ! কী করে এদের বারণ করব? আর সত্যি বলতে কী, বারণ করব কার জন্য? কে আসবে আমার কাছে? কার জন্য অপেক্ষা করব আমি? আমার তো নিজের জীবনের দিকেও তাকানো উচিত। তবে! তবে কেন আমার মনের ভিতর লাল পিঁপড়েরা জড়ো হচ্ছিল?

আকাশের বাবা খুব ভাল গান করেন। সেদিন উনি বেশ কয়েকটা গান শুনিয়েছিলেন। আকাশ ছোট্ট একটা পিয়ানো বাজাচ্ছিল গানের সঙ্গে। বাইরে থেকে ওদের ভীষণ সুন্দর করে সাজানো বসার ঘরে আলো এসে পড়ছিল। সবটাই যে কী সুন্দর লাগছিল! মনে হচ্ছিল এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে!

কিন্তু আমার মধ্যের সত্যিকারের আমিটা কিছুতেই যেন এসব যুক্তি আর বুদ্ধি মানতে চাইছিল না। মনে হচ্ছিল সব কিছু ঘেঁটে দিয়ে চলে যাই।

সেদিন আকাশ আমায় নিজের গাড়ি করে বাড়ি অবধি ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই উপরে আসেনি। শুধু যাওয়ার আগে বলেছিল, “প্লিজ় আমায় ফিরিয়ো না।”

আমি কিছু বলতে পারিনি। শুধু দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে চারদিকের বাড়ির মাঝে কোনওমতে টিকে থাকা শেষ বিকেলের আকাশ দেখছিলাম! একটা তারা জ্বলজ্বল করছিল! মনে হয়েছিল, রিয়ান তোর ওখানের আকাশটাও যেন সুন্দর থাকে!

“কী রে, কী করছিস তখন থেকে? তোর বাবা তোকে খুঁজছিল।”

আমি দরজার দিকে তাকালাম। মা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

মা বলল, “সকালে পড়িয়ে এসেই এসব নিয়ে পড়েছিস! এইসব জিনিসগুলোকে এক জায়গায় করেছিস কেন?”

আমি বললাম, “চিলেকোঠায় রেখে দেব মা।”

মা ঘরের ভিতর এসে জিনিসগুলো দেখল। বই, পেন, কিছু নোট্স, পুতুল।

“রিয়ান দিয়েছিল না?” মা তাকাল আমার দিকে।

আমি কিছু না বলে আবার টেব্‌লের দিকে ফিরে কিছু কাজ করছি এমন ভান করলাম।

মা বলল, “ঠিক করছিস। আমি বলি কী, এসব চিলেকোঠাতে রেখেই বা কী করবি? বিক্রি করে দিই বরং!”

“না,” আমি তাকালাম মায়ের দিকে, “চিলেকোঠাতেই থাকবে।”

মা বসল আমার বিছানায়। গায়ের চাদরটা টেনে বলল, “সত্যি মানুষ চেনা যায় না! ওইটুকু বয়স থেকে রিয়ানকে দেখছি। কিন্তু আমরা কি বুঝেছিলাম এমন ছেলে ও? তোর জেঠিমা ঠিক বলেছে।”

আমি অবাক হলাম, “জেঠিমা আবার কী বলল?”

“বলেছে, আর যদি ও কোনও দিন এবাড়ির ত্রিসীমানায় আসে তো ওর বাপের বিয়ে দেখিয়ে ছাড়বে! আর জানিস তো, তোর জেঠিমা যা বলে সেটাই করে!” মা বলল, “রিয়ান এমন, ভাবতে পারিনি। আজ ওর মাকে ফোন করেছিলাম। রিয়ান নিজের মাকেও নাকি ফোন করে না! সময়ই নাকি পায় না! তা কী রাজকার্য করছে কে জানে! দেখ, কোন মেমের পাল্লায় পড়েছে!”

আমি তাকালাম মায়ের দিকে। রিয়ানের সম্বন্ধে এসব কী বলছে মা! কেনই বা বলছে!

মা তাকাল আমার দিকে, “তুই বড্ড ভাল আর বোকা। শোন, ওর কথা বাদ দে। আকাশ কত ভাল ছেলে বল তো! কত খবর নেয়। ও! ভাল কথা, ওঁরা আসছেন।”

“কারা?” আমি ঘাবড়ে গেলাম।

“আকাশরা। আকাশ, আকাশের বাবা আর আকাশের মাসি। তেরো তারিখ। রবিবার। সন্ধেবেলা।”

“কেন?” আমি অবাক হলাম।

“আঃ! বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে না?” মা বিরক্ত হল, “আমি তোর বাবাকে বলেছি, এই অবস্থায় কী করে বিয়ে দেব? ওদের কত ভাল অবস্থা! আর আমাদের কী দশা হয়েছে! তোর জেঠুর হাতে তোলা হয়ে থাকতে হচ্ছে।”

আমি চেয়ার টেনে বসলাম। তারপর টেব্‌লের উপর বাকি বইপত্তরগুলো গোছাতে-গোছাতে বললাম, “এখনই কী বিয়ে? আমি জানি না তো!”

মা বিছানায় রাখা জিনিসগুলোকে সাজিয়ে রাখতে-রাখতে বলল, “তোকে জানতে হবে না। একদম বাপের মতো হয়েছিস! আর শোন রাজি, ওসব রিয়ান-ফিয়ানের কথা ভুলে যা একদম।”

শেষ কথাটার আকস্মিকতায় আমার হাত থেকে বইগুলো পড়ে গেল!

মা তাকাল আমার দিকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের থেকে পড়ে যাওয়া চাদরটা ঠিক করতে-করতে বলল, “আমি বোকা নই। তোর বাবা বলছিল, এই বিয়েতে নাকি তোর মত নেই। আমি ওসব কিন্তু বরদাস্ত করব না রাজি। এমন ছেলে হাতছাড়া করব না। তার জীবনে এমন বিশাল কিছু তুই করছিস না। আর চাকরি পেলে বিয়ের পরও করতে পারবি। তোরা বাপ-বেটিতে মিলে কিছু যদি পণ্ড করতে চেয়েছিস তো দেখিস কী করি!”

আমি চোয়াল শক্ত করে বসে রইলাম। আমায় কেউ একবার জিজ্ঞেসও করল না আমি কী চাই! ওদের বাড়ি থেকে আসার পর আমায় হাজারটা প্রশ্ন করেছে মা আর জেঠিমা। কী খেয়েছি! ওদের বাড়িটা কেমন! বাবা-মা কেমন! বাড়ির দেওয়ালের রং কী! পরদার রং কী! মা কী বললেন! বাবা কেমন গান গাইলেন! আরও কত কী! কিন্তু আসলে যে প্রশ্নটা করা উচিত ছিল সেটা কেউ করেনি। আজ পর্যন্ত কেউ করেনি!

মা বলল, “নীচে যা একবার। জেঠিমা ডাকছে তোকে। আর যা বললাম, মনে রাখবি। তেরো তারিখ সন্ধেবেলা কোনও কাজ রাখবি না। বুঝলি?”

মা চলে যাওয়ার পর আমার বুকের ভিতর কেমন একটা করল যেন! তেরো তারিখ! আমি এখন জানলাম! তার মানে সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে! আমার জীবনকে একটা পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে? এবার আমি কী করব? রিয়ানকে তো ফোন করেছিলাম! ধরেনি। মেল করেছিলাম। উত্তর দেয়নি! এখন কী হবে? তবে কি আমি ঠিক করছি? আমার স্মৃতিগুলোকেও কি তবে এইসব জিনিসের সঙ্গে চিলেকোঠায় রেখে দেব?

আমি জানি জেঠিমার ডাক মানে সঙ্গে-সঙ্গে যেতে হবে।

বারান্দায় বেরিয়ে আমি সামনের দিকে তাকালাম। আজ ঠাকুরমার বারান্দা ফাঁকা। শুধু কুকি দেখলাম বারান্দার দিকের ওই সাঁকোটার মুখটায় একটা বাঁশের গেট শক্ত করে বাঁধছে।

আমি অবাক হলাম। এই সাঁকোটা আর ব্যবহার করা হয় না। মাঝে-মাঝে ভেঙেও গিয়েছে। কেউ আর যায় না। কথা হয়েছিল একবার দু’দিকেই দেওয়াল গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু আর হয়নি। এমনিই পড়ে আছে। তবে আজ হঠাৎ সাঁকোর মুখটায় অমন বাঁশের বেড়া দিচ্ছে কেন?

আমি একটু জোরে ডাকলাম, “কুকিদি, কী করছ গো? ঠাকুরমা কই?”

কুকি মুখ তুলে তাকাল। তারপর হাতের কাজটা থামিয়ে বলল, “ওই ঘরে আছে। বাচ্চাগুলো এসেছে। আজকাল ঠাকুরমার কাছেই পড়ে থাকে। খালি গল্প আর গল্প! ঠাকুরমাও পারে বটে! এই বয়সেও কত বকতে পারে।”

আমি হাসলাম। এটা ভাল হয়েছে। একা-একা বসে থাকত ঠাকুরমা! দেখে কী খারাপ লাগত! এই শেষ বয়সটায় মানুষ এত একা হয়ে যায়! যে আগে সবটা সামলাত তাকে কী করে ভুলে যায় সবাই! কার্যকারিতা ছাড়া কি মানুষের নিজের কোনও মূল্য নেই! আমরা সবাই কি আসলে রেসের ঘোড়া?

বললাম, “কিন্তু তুমি এটা কী করছ?”

কুকি বিরক্ত হয়েছে। এমন গলায় বলল, “আর বোলো না! ঠাকুরমা বলল এই সাঁকোর মুখটা যেন বাঁশের বেড়া দিয়ে বেঁধে দিই। বাচ্চাগুলো আসে তো! কখনও যদি সাঁকোতে উঠে পড়ে! সাঁকোটার যা অবস্থা! ভেঙে পড়তে পারে। তখন তো একটা কেলেঙ্কারি হবে! তাই এইটা বানিয়ে নিয়ে এসেছি।”

আমি ভাবলাম ভালই হয়েছে। সত্যি সাঁকোটার অবস্থা বিপজ্জনক। আমাদের বারান্দার দিকটায় সাঁকোর মুখে একটা পুরনো ভাঙা চেয়ার রাখা আছে। এদিকটাও গেঁথে দিলে হয়।

কুকি বলল, “তোমার নাকি বিয়ে?”

আমি চমকে গেলাম! এসব কী কথা! কে বলল এসব!

“আমার কানে এসেছে! তোমার জেঠিমা ফোন করেছিল ঠাকুরমাকে। আমি ঘর মুছছিলাম। ঠাকুরমার কথা শুনে আঁচ করলাম। ঠাকুরমাকে জিজ্ঞেস করলে তো আর বলবে না! তাই ঘোড়ার মুখের থেকেই জানতে চাইছি। সত্যি গো?” কুকি বারান্দার রেলিং-এর উপর ঝুঁকে পড়ে তাকাল আমার দিকে। ভঙ্গিটা দেখে মনে হল উপায় থাকলে বোধহয় ওই সাঁকো বেয়ে চলে আসত!

আমি বললাম, “ফাইনাল কিছু নয়। কথা হচ্ছে। যেমন হয়।”

কুকির যেন উত্তরটা পছন্দ হল না। আবার ওই গেটের দিকে মন দিল। তারপর বলল, “দেরি কোরো না আবার। এমন রূপ দিয়েছে ভগবান! সময় থাকতে কাজ গুছিয়ে নিয়ো।”

আমার কান গরম হয়ে গেল! কুকি হয়তো পড়াশোনা জানে না ভাল। তাই কথাটা এমন করে বলে দিল। কিন্তু আমি অনেক শিক্ষিত মানুষকেও দেখেছি এমন কথাটাই ঘুরিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে বলতে! রূপ ব্যাপারটা যেন খুব দরকারি! মাল্টিন্যাশনাল কনগ্লোমারেট থেকে বাড়ির পিসিমা, ছোটমামা সবার কাছে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেন কিছু নেই! রাস্তায় বেরোলেও বুঝতে পারি ব্যাপারটা। অল্পবয়সি থেকে বৃদ্ধ। সবার চোখের ভিতর যেন জিভ আছে! বাসে কত অসভ্যতা যে সামলাতে হয়! অটোয় বসলে পাশের লোকটার কনুই, আয়না দিয়ে আসা চালকের দৃষ্টি, কত কিছু যে কাটাতে হয়! এত কষ্ট লাগে মাঝে-মাঝে! শিক্ষার প্রধান অংশ যে, মেয়েদের মাংসের তাল হিসেবে না-দেখা, সেটা কেউ বোঝে না! জেঠিমা বসেছিল বারান্দায়। কমলালেবু ছাড়িয়ে জড়ো করছিল পাশে। আমায় দেখে হাসল। বলল, “মোড়াটা টেনে বোস তো। কথা আছে তোর সঙ্গে।”

টায়ার দিয়ে বাঁধানো প্লাস্টিকের সুতো লাগানো মোড়া। আমি টেনে বসলাম।

জেঠিমা আমার মুখে একটা কমলালেবু গুঁজে দিয়ে বলল, “তোর জন্য ঘরে কিছু জিনিস কিনে এনেছি। বিউটি প্রোডাক্ট। টিভিতে দেখায়। তোর জেঠুকে পরশু বলেছিলাম। গতকাল কিনে এনেছে। মাখবি। ফরসা হওয়া যায়। আর সানস্ক্রিনও আছে।”

আমি বললাম, “আমি তো মোটামুটি ফরসা জেঠিমা।”

জেঠিমা সামনের বড় জামবাটি ভর্তি কমলালেবু পাশে সরিয়ে খোসাগুলোকে খবর কাগজ দিয়ে মোড়াল, তারপর বলল, “তুই অনেক ফরসা ছিলি। কিন্তু রোদে বেরিয়ে-বেরিয়ে কী হাড়গিলে হয়েছিস! দেখ, আমার মায়ের পাল্লায় পড়লে তোকে রোজ মুলতানি মাটি, চন্দন, ডালবাটা, সরবাটা আরও কত কী মাখাত জানিস? বিয়ের আগে মা আমায় পুরো চার মাস প্রায় প্লাস্টার করে রাখত এসব দিয়ে।”

আমি কিছু বললাম না। বুঝতে পারছি কথা কোন দিকে এগোচ্ছে!

জেঠিমা বলল, “যে ক’দিন বাকি আছে ওসব মাখবি। আর হ্যাঁ, একটা কথা। তোর একটা চিঠি এসেছে। একটু আগে।”

“চিঠি?” আমি চমকে গেলাম, “এতক্ষণ বলেনি!”

জেঠিমা বলল, “এতক্ষণ বলিনি মানে? যেটা বেশি দরকার সেটা বলব না? ওসব চিঠি-চাপাটি সারা জীবন আসবে। তাতে কী!”

আমি জানি তর্ক করা বৃথা! মোড়া থেকে উঠে ঘরের ভিতর ঢুকলাম। সামনেই জেঠুর টেব্‌ল। তার উপরেই রাখা আছে চিঠিটা। ব্রাউন, মোটা খাম। আমি তুললাম। আর সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভিতর বাবুই পাখি ঝাপটে উঠল! স্কুলের মোনোগ্রাম করা খাম! এখানেই তো ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম!

আমি দ্রুত হাতে খামটা খুললাম। আমার হাত কাঁপছে। গলা শুকনো। কলকাতার ভিতরেই স্কুল৷ খুব বড় নয়। কিন্তু আবার একদম ছোটও কিছু নয়। সেখানে ইকোনমিক্স পড়ানোর জন্য আমায় বাছা হয়েছে! আমায়। ডাক পাঠিয়েছে স্কুল থেকে। এটা আমার নতুন চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার!

আমি দ্রুত বারান্দায় এলাম। বসে থাকা জেঠিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম দু’হাতে। আমি কাঁপছি, কান গরম হয়ে গিয়েছে! চোখে জল আসছে আবার!

জেঠিমা বলল, “আরে, কী হল?”

“জেঠিমা!” আমি কাঁপা গলায় চিৎকার করে বললাম, “আমি চাকরি পেয়েছি! স্কুলে! জানুয়ারিতে জয়েনিং!”

“তাই!” জেঠিমা আমায় হাত ধরে ঘুরিয়ে সামনে আনল। জেঠিমার ফরসা মুখটাও ঝলমল করছে, “দারুণ খবর! এটা তো হতই!”

আমি বললাম, “ব্যস, আর কিছু চাই না।”

জেঠিমা বলল, “ভালই হল। বিয়ে, চাকরি একসঙ্গে! খুব ভাল।”

আমি বললাম, “বিয়ে!”

জেঠিমা তাকাল আমার দিকে বলল, “তবে না তো কী? ওটাই আসল। বিয়ের পর চাকরি করবি। এটা সেকেন্ড বেস্ট খবর!”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।

জেঠিমা বলল, “তোর যা কাণ্ডজ্ঞান! চাকরি পেয়েছিস ভাল কথা, কিন্তু আসল ব্যাপারটা ভুললে চলবে না। শোন, একবার রিয়ানের ব্যাপারে গুবলেট করেছিস। আর করবি না। সামনেই তোর বিয়ে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে দেব। মনে থাকে যেন!”

শেষের দিন রিয়ানও আমায় এমন একটা কথা মনে রাখতে বলেছিল।

ও আমায় বলেছিল, “আমি তোর কেউ নই৷ তুইও আমার কেউ নোস। যা ভুলে যেতে বলেছিলাম, ভুলে যাসনি, সেটা তোর প্রবলেম, আমার নয়। কোনও আশা রাখিস না। আমার আর তোর গল্প এখানেই শেষ। মনে থাকে যেন!”

আমার মনে থাকে। আমার সব মনে থাকে। স্মৃতি আমার শত্রু! আমি কিছুই ভুলতে পারি না। আমার ছোটবেলার সেই তুষারপাত, সেই জন্মদিনের বিকেলের আবছা ঘর বা বেজেবেজে কেটে যাওয়া ফোন। কোনও কিছুই ভুলতে পারি না আমি। কিন্তু এখন আমায় ভুলতে হবে। সব কিছু মুছে ফেলতে হবে। ওই আমার ঘরে জড়ো করা জিনিসের মতো সব কিছু লুকিয়ে ফেলতে হবে কোনও এক গোপন চিলেকোঠায়। আর তার চাবিটা ফেলে দিতে হবে দূরের সেই আকাশগঙ্গায়!

আমি সিঁড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একতলা থেকে দোতলার দূরত্ব আজ হঠাৎ সেই আকাশগঙ্গা পেরোনোর মতো মনে হল আমার! এক হাতে চাকরির চিঠি, অন্য হাতে ক্রিমের প্যাকেট! আমার যদি দস্যু মোহনের মতো তৃতীয় একটা হাত থাকত! তা হলে? সেই হাত দিয়ে কাকে ধরতাম আমি? এই আকাশগঙ্গা পেরিয়ে কার কাছে পৌঁছোতে চাইতাম আমি! আমার জীবনের সবচেয়ে ভাল খবরটা নিয়ে কার কাছে পৌঁছোতে চাই আজ?

হে দোয়েল পাখি, তোমরা কোথায়? তোমরা কেন আজ সবাই মিলে ডানায় ডানা বেঁধে আমার জন্য সাঁকো তৈরি করছ না? কেন পার করতে দিচ্ছ না এই অসীম মিল্কি ওয়ে! কেন এপারে বেঁধে রাখতে চাইছ আমায়! কেন আজ আমার জন্যও সাঁকো বানিয়ে দিচ্ছ না? আমাদের মধ্যের জং-ধরা, পুরনো সাঁকোগুলো কি তবে ভেঙেই যাবে! সেসব কি শুধু নানা দিক থেকে বন্ধই করে দেওয়া হবে? কেউ কি নেই সে সব আবার খুলে দেওয়ার জন্য? ও দোয়েল পাখি, তোমরা কই? রূপকথা ছেড়ে একবারও কি আসবে না আমার জন্য? শুধু কি গল্পই শুনে যাব চিরকাল? কোনওদিন কি আমার জীবন গল্পের মতো হয়ে উঠবে না!

চোদ্দো

রিয়ান

আজবরফ পড়ছে চারদিকে। সারা শহরের উপর ভ্যানিলা আইসক্রিমের মতো বরফ জমে আছে। আমি তার উপরেই পায়ের ছাপ দেখলাম! সামনে দিগন্তর দিকে চলে গিয়েছে সেই চিহ্ন! আশপাশে কেউ নেই! শুধু আমি একা! জানি ওই পথেই বাবা চলে গিয়েছে! আমায় এখানে রেখে গিয়েছে একা!

আমি চারদিকে তাকালাম! ওই তো শহিদ মিনার দেখা যাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ার পরি দেখা যাচ্ছে! দেখা যাচ্ছে নেতাজির মূর্তি! কিন্তু মানুষজন কেউ নেই! শুধু একজোড়া পায়ের চিহ্ন পড়ে রয়েছে কেবল!

আমার ভয় লাগছে! আকাশের দিকে তাকালাম আমি। বড়-বড় গ্যাস বেলুন উড়ছে চারিদিকে! বেগুনি রঙের একটা আলো ছড়িয়ে আছে। আর আওয়াজ হচ্ছে! একটানা হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে কোথাও।

আমার বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে একটা! মনে হচ্ছে টন টন বরফের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে আমার বাড়ি! আমি আর ফিরতে পারব না সেখানে! শুধু সারা জীবন অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরতে হবে আমায়!

আমি পায়ের চিহ্ন ধরে দৌড়োতে শুরু করলাম। আকাশে বেলুন বাড়ছে আরও! বেগুনি রং গলে-গলে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে বরফের মতো। আমি সেই সব ছাড়িয়ে দৌড়োতে লাগলাম। আমায় পৌঁছোতে হবে! বাবার কাছে পৌঁছোতে হবে!

তারপর পথটা কেমন যেন ঢালু হয়ে এল। আর কী অবাক! পথের পাশে ছোট-ছোট বাড়ি! তাদের দেওয়ালে ঘাস জন্মে গিয়েছে। এসব কার বাড়ি? কারা থাকে এখানে! সামুদা থাকে? ওই তো সামুদা দাঁড়িয়ে রয়েছে জানালায়। আমি ‘সামুদা’ বলে চিৎকার করলাম! কিন্তু সামুদা শুনতেই পেল না। আমি পাশের বাড়িটা দেখলাম। ওই তো! ওর সামনেই গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে পায়ের ছাপ।

আমি দৌড়ে গেলাম সেদিকে। এই তো জুতো! বাবার জুতো! আমি দ্রুত দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। কিন্তু ঘর কী দেখব! চারদিকে তো গ্যাস বেলুন! সারা ঘরে বেলুন উড়ছে! আমি সেইসব বেলুন সরিয়ে এগোতে লাগলাম। হাতুড়ির শব্দটা বাড়ছে। মাথার ভিতর যন্ত্রণা হচ্ছে আমার! আমি বেলুনের ভিতর সাঁতার কাটার মতো করে এগিয়ে গেলাম সামনে। আর-একটা দরজা। বেগুনি রঙের! কী আছে ওপারে!

আমি আলতো হাতে ঠেললাম দরজাটা! শব্দ করে খুলে গেল কিছুটা। এগিয়ে গেলাম একটু। আর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম আমি। কে শুয়ে আছে বিছানায়? সাদা চাদর ঢাকা। আর ঘরের ছাদ থেকে কেন এমন বেগুনি রঙের তুষার ঝরে পড়ছে!

আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। তারপর এক টানে চাদরটা সরিয়ে দিলাম! সঙ্গে-সঙ্গে ছিটকে উঠলাম ভয়ে! বাবা! সাদা তুষার-ঢাকা মুখ! আর আচমকাই চোখ খুলে তাকাল বাবা! নীল চোখের মণি! আমি আতঙ্কে পিছিয়ে আসতে গেলাম কিন্তু পারলাম না! বাবা বরফের মতো একটা ঠান্ডা হাত দিয়ে ধরল আমার হাত! আর আমার সারা শরীর জমে গেল নিমেষে! মাথা ঘুরে গেল! আমি চোখ বন্ধ করে মাটিতে পড়ে যাচ্ছি যেন! শুধু চোখ বন্ধ করার আগের মুহূর্তে দেখলাম একটা হাত এসে ধরছে আমায়! খুব চেনা একটা হাত! দেখলাম আমায় ধরে রয়েছে রাজিতা!

“স্যার, স্যার!”

আমি মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। গাড়ির ড্রাইভার ভদ্রলোক তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। শিয়ালদা ফ্লাইওভারে আটকে আছে গাড়ি!

আসলে প্লেনে আসার সময় ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্নটা বারবার মাথার ভিতর ঘুরছে! পাক মারছে! কেন দেখলাম স্বপ্নটা? কী মানে এর? হঠাৎ দেখলাম কেন! তাই অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।

“স্যার, সামনে থেকে লেফ্ট টার্ন নিচ্ছি। অসুবিধে নেই তো!” ড্রাইভারটি তাকাল আমার দিকে।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না! অসুবিধে ব্যাপারটা আর আমায় মাথায় ঢুকছে না! আমি এতটা পথ এসেছি যে-কারণে সেটার সামনে আর কোনও অসুবিধেই তো অসুবিধে নয়!

সেদিন সামুদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না! রাজিতার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে! মানে রাজিতা এবার থেকে অন্য একজনের হয়ে যাবে বাকি জীবনটা! কিন্তু সে কী করে সম্ভব! ছোট থেকে তো ও আর কারও দিকে তাকায়নি! তবে!

আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব! ওকে ফোন করব একটা! কিন্তু কী বলব! আমি যে কথা বলে এসেছি সেটা কী করে ফেরাব! ও যে ইমেল করেছে, উত্তর দেইনি! ফোন করেছে, ধরিনি! রজতকাকুর অসুস্থতার খবর নিইনি! এসবের কী উত্তর দেব আমি!

আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না! পরীক্ষা চলছিল। কিন্তু কী পড়ছিলাম জানি না। কেবলই রাজির মুখটা মনে পড়ছিল! অমন বড় বড় চোখ, গালের টোল, সব মনে পড়ছিল! বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছিল আমার! বহুদিন আগের সেই শেষ বিকেলের আধো আলোর ঘরটায় ফিরে যেতে চাইছিলাম! শুধু মনে করার চেষ্টা করছিলাম, জীবনের কোন বিন্দু থেকে আমার ভুলের শুরু হল! কেন আমি রাজিকে এতটা ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ করে নিলাম! আর এখন আমি কী করব! কী করা উচিত আমার!

সামুদা শুধু বলেছিল, “এবার তুই বুঝবি মানুষ হারানো কাকে বলে!”

আমি জানি মানুষ হারানো কাকে বলে! চোদ্দো বছর বয়সে যাঁকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছিলাম, সেই বাবাকেই আমি হারিয়েছি! এখনও ঘুমে-জাগরণে সেই দৃশ্য বারবার আমার বুকের ভিতর চেপে বসে!

বাবা সেল্স-এ ছিল! কত জায়গায় যে যেত সেল্স কলে! সেবারও অফিসের কাজেই অসম যাবে বলেছিল বাবা। আমরাও জানতাম অসম গিয়েছে। কিন্তু একদিন সকালবেলার একটা কলিংবেলই সব পালটে দিয়েছিল!

আমি ক্লাস এইটে পড়ি তখন। আগস্ট মাস! টার্মিনাল এগজ়্যাম চলছিল স্কুলের। সেদিন ভূগোল পরীক্ষা ছিল। আমি সকাল-সকাল উঠে একটু বই খুলে দেখে নিচ্ছিলাম। আর ঠিক তখনই কলিং বেলটা বেজেছিল!

মা স্নান করে সেই সময়টা ঠাকুরকে পুজো দেয় আমি জানতাম। তাই আমি নিজেই উঠে গিয়েছিলাম দরজা খুলতে।

ছোট পিপ-হোল দিয়ে উঁকি দিয়ে চমকে উঠেছিলাম খুব। পুলিশ! নিমেষে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। দরজা খুলে আমি চিৎকার করে মাকে ডেকেছিলাম!

এক-একটা মুহূর্ত আর ঘটনা থাকে যা জীবনকে পালটে দেয় পুরো! সেই সকালবেলাটা যেমন আমার জীবনকে পালটে দিয়েছিল!

পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরটি যা বলেছিল শুনে মা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি! প্রায় এক রকম বসেই পড়েছিল মাটিতে!

আমতলার একটি হোটেলে বাবাকে পাওয়া গিয়েছে! এখনও গেলে নাকি আমরা দেখতে পাব! আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।

পুলিশ ভদ্রলোকটি বলেছিল, “আমরা আপনাদের নিয়ে যাব। আমাদের এখানে খবর এসেছে। তাই আপনাদের জানাতে আর নিতে এলাম! ম্যাডাম, আমরা চাই আপনি একবার স্পটেই শনাক্ত করুন বডি!”

মা তাকিয়েছিল আমার দিকে। কী বলবে বুঝতে পারছিলাম না! বাবাকে আমতলার হোটেলে পাওয়া গিয়েছে! কী করে? সেখানে কী করছিল বাবা? আচ্ছা, আমতলা জায়গাটা কোথায়? অসমে বলে তো মনে হয় না!

মা বলেছিল, “সামুকে একটু বলবি, আমাদের সঙ্গে যেতে? আমার শরীর খারাপ লাগছে!”

সাব ইন্সপেক্টরটির বয়স অল্প ছিল। আমাদের অবস্থা দেখে সে নিজেও খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিল। তাও ধীরে-ধীরে বলেছিল পুরো ব্যাপারটা!

বাবাকে পাওয়া গিয়েছিল খুবই বাজে অবস্থায়। সঙ্গে একটি মেয়েকেও পাওয়া গিয়েছে! সে কল-গার্ল! দু’জনকেই মেরে ফেলা হয়েছিল। গলা কেটে খুন করা হয়েছিল। বাবা আরও দু’জন লোকের সঙ্গে ওই মহিলাটিকে নিয়ে রাতে আমতলার ওই হোটেলে উঠেছিল। তারপর কী হয়েছে কেউ জানে না। শুধু সকালে বাবা আর ওই মহিলাকে পাওয়া গিয়েছে গলার নলি-কাটা অবস্থায়! বাকি দু’জন নিরুদ্দেশ!

সাব-ইন্সপেক্টরটি বলেছিল, এমন নাকি বাবা আগেও বহুবার গিয়েছে। হোটেলের ম্যানেজার লোকটি বাবাকে চিনত। প্রতিবারই নতুন-নতুন মহিলা নিয়ে যেত বাবা!

গাড়ি পার করছিল তারাতলা মোড়, বেহালা ম্যান্টন, বেহালা চৌরাস্তা! চোখে-মুখে জিপের জানালা দিয়ে আসা হাওয়ার ঝাপটা লাগছিল! আমি তত দিনে অবস্থাটা বোঝার মতো বড় হয়েছিলাম! লজ্জায় মায়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না! সামুদা পাশে বসে আমার হাতদুটো ধরে রেখেছিল শক্ত করে। আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না যা শুনছি তা সত্যি কি না! বাবা বলত, স্বপ্নের মতো হবে আমার জীবন! কিন্তু দুঃস্বপ্নও যে স্বপ্ন, সেটা বলে দেয়নি! আমি সেই চোদ্দো বছর বয়সে বুঝেছিলাম ব্যাপারটা।

ইন্সপেক্টরটি আরও নানান কথা বলছিল। কিন্তু আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল শুধু। গলার কাছে ব্যথা করছিল খুব। শুধু মনে পড়ছিল ছোটবেলায় বাবার পাশে শুয়ে থাকার সেই শীতকালগুলো। মনে পড়ছিল নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ‘আমার বাবা’ এই ভাবনাটার ওম! ভাবছিলাম, সবটাই কি তা হলে মিথ্যে ছিল!

হোটেলটা ছোট। কেমন যেন মেঘলা রঙের। আমরা জিপ থেকে নেমে দেখেছিলাম আরও কয়েকটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মা এবার ভেঙে পড়েছিল একদম! সোজা মাটিতে বসে পড়েছিল! একজন মহিলা পুলিশ এসে মাকে ধরেছিল।

আর হাতুড়ির শব্দ হচ্ছিল! কাছেই কোথাও কিছু একটা ভাঙা হচ্ছিল! শব্দটা আমার মাথার ভিতরটাকে যেন ছিঁড়ে ফেলছিল হিংস্র কুকুরের মতো!

সামুদা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিল, “নে, বড় হ এবার। চল।”

সরু বারান্দা পেরিয়ে একটা বেগুনি রঙের কাঠের দরজা। তার সামনে দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। আমাদের সঙ্গে ওখানের একজন ইন্সপেক্টরও ছিলেন।

দরজার কাছে দাঁড়ানো দু’জন পুলিশ আমাদের দেখে দরজা ছেড়ে দিয়েছিল। আমরা ঘরের ভিতর উঁকি দিয়েছিলাম।

বাবা শুয়েছিল। ঘরের ভিতর আরও দু’-তিনজন পুলিশের লোক কাজ করছিল। কিন্তু আমি আর কিছু দেখিনি। শুধু বাবার দিকে তাকিয়েছিলাম। সাদা চাদর ঢাকা! চোখ বন্ধ! আমার বুকের ভিতরটা আচমকা মুচড়ে উঠেছিল! মনে হয়েছিল কেউ ড্রিল মেশিন চালিয়ে দিয়েছে বুকে! আমি শূন্যের ভিতর একটা কিছু ধরার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি! তারপর আর কিছু মনে নেই!

পরের সময়গুলোয় কী যে হয়েছিল আমার আজও সব স্পষ্ট মনে আছে! প্রতিটা সেকেন্ডের ভিতর লুকিয়ে থাকা সময়ের আরও ছোট-ছোট গলি-উপগলি আর চোরা পকেট, সব মনে আছে। মনে আছে প্রত্যেকটা মানুষের মুখ। তাদের কথা। আর কথার পেটে লুকিয়ে থাকা সেইসব না-বলা কথা! মনে আছে সেই সব রগরগে মজা পাওয়া মুখগুলো ঢেকে রাখার জন্য তৈরি সহানুভূতির মুখোশগুলোকে!

খবরের কাগজে বেশ কিছু দিন এই খবরটা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হয়েছিল। আমি আর মা চিড়িয়াখানার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলাম। লোকে যেতে-আসতে আমাদের দিকে আঙুল তুলত! ফিসফিস করত! এখন মনে হয় ভাগ্যিস কেউ অটোগ্রাফ চেয়ে বসেনি!

আমরা ওই রজনী সেন রোডের বাড়ি ছেড়ে সেই সময়েই উঠে এসেছিলাম ভবানীপুরের মামার বাড়িতে! মামারা মাকে ভালবাসত খুব। কিন্তু যেহেতু মা বাবাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছিল তাই মনে-মনে একটু আড় হয়েও থাকত!

মামার বাড়িতে ওঠার পর আমি দেখতাম মামারা এসে মাকে যখন-তখন যা খুশি তাই বলত! মা কিছু না বলে মাথা নিচু করে শুনত শুধু। তারপর একা-একা কাঁদত। আমি কতবার বলতাম যাতে মা চুপ করে না শোনে। যেন কিছু বলে! কিন্তু মা বলত, “তোর বাপ যা করেছে আমায় তো শুনতেই হবে। সবার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছিলাম। এখন আর সংসার চলবে কী করে যদি দাদারা না টাকা দেয়! জানবি টাকার চেয়ে বড় শেকল আর কিছু হয় না।”

রাতে নিজের ঘরে শুয়ে ভাবতাম বাবা বেঁচে থাকতে যা শেখায়নি, মরে গিয়ে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে! তখন থেকেই কেবল মনে হত, এই শহরটা, এই সবার দৃষ্টি, মুখোশের তলায় লুকিয়ে থাকা বিনে পয়সার সার্কাস দেখা মুখগুলোর থেকে আমায় চলে যেতে হবে! আমি বুঝেছিলাম কেউ আমায় এ ব্যাপারে সাহায্য করবে না! যাকে সবচেয়ে ভরসা করেছিলাম সে-ই যখন এমন করতে পারে তখন বাকিরা তো আমায় নানাভাবে বিপর্যস্ত আর বিধ্বস্ত করবেই!

তাই আর কোনও দিকে তাকাইনি! রাজি যে সারাক্ষণ কাছে আসত! যত্ন করত! আমার দিকটা দেখত! সেটাও আমল দিইনি! আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, কাউকে বাঁধতে দেব না আমায়! আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম মাকে এই শহরটা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কাজ নেই কোনও!

আর তারপরই ‘ডালাস’ ঘটল আমার সঙ্গে!

ব্রিজের থেকে বাঁ দিক নিয়েও আবার আটকে গেল গাড়িটা! আমি চোয়াল শক্ত করলাম। চারটে বাজে! পাঁচটার মধ্যে পৌঁছোতে পারব? রাজির মুখটা মনে পড়ল! কী করছে রাজি এখন? সাজছে! বুকের ভিতর ভোমরা হুল ফোটাল যেন! আমি বুঝতে পারলাম বিষের অণু-পরমাণু আমার শরীরকে আক্রমণ করছে! মনে হল আমার মাথাটা ফেটে যাবে! হিংসেয় আমি ভিতরে-ভিতরে মরে যাব!

আমি যেদিন চলে গিয়েছিলাম সেদিন সকাল থেকে আমাদের বাড়িতেই ছিল রাজি। গোছগাছ করে দেওয়া থেকে শুরু করে রান্না, সবটা শেষ পর্যন্ত করে দিয়েছিল। মা যদিও মুখে দেখাচ্ছিল না, তাও ভিতরে ভিতরে কষ্ট হচ্ছিল তো, তাই কাজকম্ম কিছু করতে পারছিল না!

দুপুরে খেতে বসে মা বলেছিল, “রাজি, তুই আসা বন্ধ করে দিবি না তো?”

রাজি ডাল দিচ্ছিল হাতা দিয়ে। অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “কেন এমন বলছ?”

মা হেসে বলেছিল, “তুই জানিস কেন বলছি!”

রাজি আচমকা হেসে রাঙা হয়ে উঠেছিল। তারপর বলেছিল, “আমি তো আসবই।”

মায়ের চোখে জল চলে এসেছিল! ছোট্ট এক কুচি জল। মা কোনওমতে কষ্টটাকে ঢোক গিলে নিয়ে বলেছিল, “তবে না এলেই বা কী! আমি তো একাই থাকতে পারি!”

বিকেলের দিকে আমার ঘরে এসেছিল রাজি। আমি একটু চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলাম। রাজি পায়ে-পায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার কাছে। তারপর আলতো করে বলেছিল, “তোর মনখারাপ করছে, না?”

আমি তাকিয়েছিলাম রাজির দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বলেছিলাম, “সারা জীবন এটাই চেয়েছি। এই লক্ষ্যেই পড়াশোনা করেছি। মনখারাপ লাগবে কেন?”

রাজি ঠোঁট কামড়ে মাটির দিকে তাকিয়েছিল। যেন আটকাতে চাইছিল নিজেকে! তারপর কিছুটা সময় নিয়ে বলেছিল, “আমার খুব মনখারাপ করছে। আমি তোকে ছাড়া কী করে থাকব?”

আমি বিরক্ত হয়েছিলাম খুব। এসব কেন বলছে ও! জানে না এসব শোনা আমার বারণ! এত দিন তো আসে, ওই একদিন শেষ বিকেল ছাড়া আর কোনও দিন আমি ওর কাছে গিয়েছি। তবে আমার যাওয়ার সময় এসব কী শুরু করেছে?

রাজি ভেজা গলায় বলেছিল, “আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো তোকে দেখছি। তোর বকা খেয়ে বড় হয়েছি! তুই চলে গেলে আমার কী হবে রিয়ান?”

আমি উঠে বসে বলেছিলাম, “এসব বন্ধ কর।”

রাজি তাকিয়েছিল সোজা। তারপর আচমকা আমার মুখটা দু’হাতে ধরে বলেছিল, “তুই এমন কেন? আমার তোকে বলার কিছু থাকতে পারে না? তোর-আমার মধ্যে কোনও দোয়েল-সাঁকো নেই?”

আমি ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, “শোন, মিল্কি ওয়ে একটা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ব্যাপার! কিছু মহাজাগতিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। ওটা নদী নয়। কোনও দোয়েল-পাখি তার উপর সাঁকো বানায় না! জীবনটা রূপকথা নয় রাজি!”

রাজিকে যেন কেউ পিঠে ছুরি মেরেছিল! ও আমার দিকে এমন করে তাকিয়েছিল যেন কী বললাম, বুঝতে পারছে না। শুধু বিহ্বল গলায় বলেছিল, “কী বললি তুই? এমনটা বলতে পারলি? আমার কি তোর উপর কোনও জোর নেই? আমি কি তোর কেউ নই?”

আমি চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিলাম রাজির দিকে। স্পষ্ট গলায় কেটে-কেটে বলেছিলাম, “আমি তোর কেউ নই। তুইও আমার কেউ নোস! যা ভুলে যেতে বলেছিলাম, ভুলে যাসনি, সেটা তোর প্রবলেম, আমার নয়। কোনও আশা রাখিস না। আমার আর তোর গল্প এখানেই শেষ। মনে থাকে যেন!”

আসলে আমরা নিজেরাই অনেক সময় বুঝি না আমাদের জীবনে কে কোথায় বাঁধা রয়েছে! তাই আমরা তাকে অবহেলা করি! পাত্তা দিই না! ধরেই নিই যে সে তো থাকবেই! তার দিকে না তাকালেও চলে! কিন্তু তারপর সত্যি যখন একসময় সে ক্লান্ত হয়ে, আহত হয়ে সরে যায়, চলে যায়, তখন বুকের ভিতর অদৃশ্য সুতোয় টান পড়ে! তখন বোঝা যায় কার প্রাণ কোথায় বাঁধা!

শনিবার সামুদার কাছে গিয়েছিলাম আমি। সেখান থেকে ফেরার পথে আমার মাথা পুরো খারাপ হয়ে ছিল! রাজির বিয়ে হয়ে যাবে? এও সম্ভব! আমি এখন কী করব? ওকে ফোন করব? কিন্তু আমি যা করেছি তারপর…

আমি রাতে বাড়ি ফিরে আবার সামুদাকে ফোন করেছিলাম।

সামুদা ততক্ষণে মদ খেয়ে গলা জড়িয়ে ফেলেছিল। আমায় বলেছিল, “শোন, আমার আর এখন ভাট বকতে ভাল লাগছে না! তাও বলছি, আমি মিমিকে সারা জীবন ভালবাসলাম। ও নিজেও সারাটা সময় ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ বলে শেষে হঠাৎ বলল, আমায় নাকি ভালবাসেইনি কোনও দিন! আজও সেটা আমায় কোপায়! নিজেকে গান্ডু মনে হয়! মনে হয় কেউ আমার সবটা ঠকিয়ে নিয়ে নিয়েছে! আর সেখানে একটা মেয়ে তোকে ভালবেসেছে! সারা জীবন ধরে! আর আমায় জিজ্ঞেস করছিস কী করবি? তোকে শুধু বোকা বলব না, তারপরের দুটো অক্ষরও বলব?”

আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাথার ভিতর কেমন করছিল। এত একা আর অসহায় কোনও দিন লাগেনি আমার নিজেকে। আমি নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকার গাছটার দিকে তাকিয়েছিলাম। ওই সেই গাছের আদল আর আলো-ছায়ার কারসাজিতে তৈরি অপেক্ষমাণ অবয়বটা আর দেখতে পাচ্ছিলাম না! এ কেমন করে সম্ভব! আমি দরজা খুলে প্যাটিওতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকেও তো দেখতে পাচ্ছিলাম না! তবে? সৈনিক কি বাজি শেষ হওয়ার আগেই উঠে চলে গেল এবারও!

আমি শরথের ঘরের দিকে তাকিয়েছিলাম। দরজা বন্ধ করে ও পড়ছিল। মনে হচ্ছিল এটা সত্যি ডালাস তো! দক্ষিণমেরুর কোনও নির্জনতম বিন্দু নয় তো!

মা! শুধু মা আছে আমার! মনে হয়েছিল মা এত কাছে রইল, তবু তাকেও তো কোনও দিনও সেভাবে দেখলাম না!

চারটে রিং হওয়ার পর মা ধরেছিল ফোনটা। অবাক গলায় বলেছিল, “কী রে হঠাৎ?”

আমি সময় নষ্ট করিনি। প্রায় চিৎকার করে বলেছিলাম, “তুমি রাজিদের বাড়িতে যাও মা। বলো, এই বিয়ে-ফিয়ে ও যেন না করে!”

“তুই পাগল! আর আমি বলব কেন?” মা’র গলাটা কেমন নিস্পৃহ শুনিয়েছিল।

“তো কে বলবে? ও তোমার কথা শোনে।”

“কিন্তু জেনে শুনে ওর জীবন নষ্ট করব কেন আমি?” মা বলেছিল, “ভাল ছেলে। রাজিকে খুব পছন্দ! একদিন তো রাজিকে ওদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেও নিয়ে গিয়েছিল আকাশ! সেখানে কেন ‘না’ করব?”

আমি উত্তেজিত গলায় বলেছিলাম, “আরে, এটা বুঝতে পারছ না?”

মা সময় নিয়েছিল একটু, তারপর হালকা গলায় বলেছিল, “শোন, কেউ কিছু বোঝে না। অন্যকে বোঝা অত সহজ নয়। মেয়েটা তো বুঝত তুই ওকে পছন্দ করিস! কিন্তু কী বলেছিলি মনে আছে? তোর কি মনে হয় আমাদের এই ছোট বাড়িটায় এক ঘরের কথা অন্য ঘর থেকে শোনা যায় না? কিছু কাজ নিজেকেই করতে হয়।”

“কিন্তু আমার তো এখানে কাজ আছে!” আমি বাচ্চাদের মতো পা দাপিয়ে চিৎকার করেছিলাম আবার।

মা বলেছিল, “তবে কর কাজ। আমরা কেউ তোকে বিরক্ত করেছি? শুধু জানিস পুঁথিগত শিক্ষাটাই সব নয়! মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আমি রাখি।”

আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই আর কিছু ভাবনাচিন্তা না করে সোজা ফোন করেছিলাম রাজিকে। মনে হয়েছিল, ফোনটা তুললে ওকে আজ কথাই বলতে দেব না! গত এগারো বছরের জমে থাকা সব কিছু আজই বলে দেব! কিন্তু বেজে-বেজে কেটে গিয়েছিল কলটা! রাজি ফোন ধরেনি! আমি বোবা মোবাইলটা হাতে ধরে ভেবেছিলাম, তা হলে এখন উপায়!

আমি সোমবার পরীক্ষা শেষ করেই ছুটেছিলাম আমাদের ফ্যাকাল্টি হেড প্রফেসর জোন্‌সের কাছে। ভদ্রলোক আমেরিকান। পঞ্চাশ বছর মতো বয়স! আমায় দেখে একটু অবাক হয়েছিলেন। পরীক্ষা চলছে তো, সেখানে কী দরকার পড়তে পারে আমার?

আমি কোনও ভণিতা না করে বলেছিলাম, “প্রফেসর, আমি ওই ছুটির ক্লাসগুলো নিতে পারব না।”

আমার উদভ্রান্তের মতো মুখ দেখে উনি কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। শুধু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কেন? ইট ওয়াজ় আ চান্স ফর ইউ।”

আমি বলেছিলাম, “বাড়িতে এমার্জেন্সি। প্লিজ়!”

আমার মুখ দেখে কী মনে হয়েছিল ওঁর কে জানে! শুধু বলেছিলেন, “আই উইশ যে জন্য তুমি এই সুযোগটা ছাড়ছ, সেটা যেন অন্তত সফল হয়!”

সাফল্য এক অদ্ভুত বস্তু! কীসের উপর যে নির্ভর করে কেউ জানে না! আমরা শুধু আমাদের অংশটুকু করতে পারি! বাকিটা গীতার সবচেয়ে ব্যবহৃত কোটেশন! আর এখানে আমি নিজেই তো নিজের বারোটা বাজিয়ে রেখেছি!

পরীক্ষা শেষ হয়েছে ডিসেম্বরের পাঁচ তারিখ আর ফেরার টিকিট পেয়েছিলাম এগারো তারিখ রাতে। ছুটির সময় বলে দেরি হয়েছিল টিকিট পেতে! মানে কলকাতায় পৌঁছোতে-পৌঁছোতে তেরো তারিখ!

আমার হাতে টাকা ছিল না একদম। কিন্তু তাও টিকিটের টাকাটা সামুদার থেকে নিইনি আর! জানি না কেন। কিন্তু কোথায় যেন লাগছিল!

টাকাটা আমায় দিয়েছিল ইয়ানা! আমি একটা ছোট্ট কফিশপে বসে ওর কাছে আমার গোটা গল্পটা বলেছিলাম। বলতেই হয়েছিল!

সবটা শুনে ইয়ানা হেসেছিল খুব। তারপর বলেছিল, “আমি দিচ্ছি তোমায় টাকা। ডোন্ট ওরি! আর সত্যি তো কিছু টাকা ডিউ ছিল। বাকিটা অ্যাডভান্স হিসেবে দিলাম! সত্যি রিয়ান তুমি ইনকরিজিব্‌ল!”

“কেন?” আমি অবাক হয়েছিলাম।

ইয়ানা বলেছিল, “জিজ্ঞেস করছ কেন? কাছে থাকতে বুঝলে না! আর দূরে এসে কখন বুঝলে? না, যখন ওর ওর বিয়ে ঠিক!”

আমি মাথা নামিয়ে নিয়েছিলাম।

ইয়ানা বলেছিল, “কিন্তু রাজিতা কেন অন্যের পছন্দে বিয়ে করছে? নাকি ছেলেটাকে ওরও পছন্দ!”

বেনিয়াটোলা লেনের মুখে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ছেড়ে দিলাম আমি। তারপর ঘড়ি দেখলাম। সময় আছে। মাথা তুলে তাকালাম আকাশের দিকে। সরু রাস্তার মাথার উপর ছাই রঙের আকাশ! ওই দূরে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দুই বাড়ির মধ্যের সাঁকোটাকে! রাজিতার দোয়েল-সাঁকোটাকে!

মায়ের মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। আমি এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে ঢুকে শুধু ব্যাগটাই রেখেছি! বসিনি একটুও।

মা বলেছিল, “এমন পাগলামি করে কেউ! অত দূর থেকে এলি৷ আজ থাক। কাল যাবি!”

আমি বলেছিলাম, “আজ তেরো তারিখ না? ছেলের বাড়ির লোকরা তো সন্ধেবেলা আসবে। তুমিই তো বলেছিলে। আর সময় নেই মা!”

মা বলেছিল, “ওকে ফোন করিসনি?”

আমি বলেছিলাম, “গতকাল দুবাই থেকেও করেছিলাম। ধরেনি!”

মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “দেখ গিয়ে! সহজ জিনিসটাকে কী জটিল করলি ভাব! তুই এমন কেন বল তো?”

জানি না আমি কেমন! জানতে চাইও না। কী হবে জেনে? আমি শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, “আমার শেষ গ্যাস বেলুন মা! তুমি প্লিজ় নেগেটিভ কিছু বোলো না!”

“দেখা হবে না। বাড়ি যা তুই,” জেঠিমা দরজা আগলে দাঁড়িয়ে তাকাল আমার দিকে।

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমি তো কিছুই বলিনি। শুধু দরজার কড়া নেড়েছি। সেখানে জেঠিমা দরজা খুলেই এটা বলে কী করে?

আমি হাসার চেষ্টা করলাম, তারপর ঝুঁকে প্রণাম করতে গেলাম। জেঠিমা একটু রাগী, আমি জানি।

জেঠিমা সরে গেল সামান্য। কিন্তু দরজা থেকে হাত সরাল না। বলল, “ঢং করতে হবে না। দেখা হবে না মানে হবে না। তুই সরে যা।”

আমি বললাম, “আরে জেঠিমা, কেন এমন করছ? আমি কোথা থেকে এসেছি জানো?”

জেঠিমা একইরকম মুখ করে বলল, “চুলোর দোর থেকে এলেও যা, বিদেশ থেকে এলেও তাই! তুই চলে যা। আজ রাজির পাকা কথা আছে। সামনেই মল মাস। তাই আজই শেষ ভাল দিন। এটাকে আর নষ্ট করিস না। মেয়েটাকে তো শেষ করেইছিস! আর শত্রুতা করিস না। ওরা এল বলে।”

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। বললাম, “ওর জন্যই এসেছি আমি। সব কাজ ফেলে এসেছি জেঠিমা। প্লিজ় একবার দেখা করতে দাও।”

“জানোয়ার!” আচমকা জেঠিমা খেপে গেল, “তুই যাবি, না তোর জেঠুকে ডাকব? যাবি?”

আমি দেখলাম গোলমালের শব্দ শুনে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে কাকিমাও নেমে এসেছে।

আমি জেঠিমার দিকে না তাকিয়ে এবার কাকিমাকে বললাম, “প্লিজ় কাকিমা! দেখো না জেঠিমা কেমন করছে! রাজিকে বলো আমি এসেছি! ও আমার ফোন ধরছে না!”

“তুই আমার সঙ্গে কথা বল!” জেঠিমা আরও রেগে গেল, “আমি যা বলি তাই এখানে হয়! আর রাজি কেন ধরবে তোর ফোন? কোন লাটসাহেব তুই? দূর হ, দূর হয়ে যা। যা!”

আমি আর কিছু বলার আগেই জেঠিমা শব্দ করে মুখের উপর বন্ধ করে দিল দরজাটা!

পুরনো, রংচটা দরজা! মাথার উপর নকশা করা। একসময় এই দরজাটা যখন-তখন পেরোতাম। কাউকে জিজ্ঞেস করতে হত না। কেউ বাধা দিত না। আর এখন! কাকিমাও তো দেখল আমায়! তাও ঢুকতে দিল না! তবে কি ওরা সত্যি চায় না আমি আসি! আমার জন্য কি সত্যি নষ্ট হবে রাজির জীবন? আমি এখন কী করব?

বেনিয়াটোলা লেন আরও সরু হয়ে এসে আমায় যেন চেপে ধরল! চোখ জ্বালা করে উঠল! কী জন্য আমি এলাম এখানে তবে? বাড়িতে ঢুকতে দিল না! রাজি ফোন ধরছে না! এবার তবে কী করব? আমি মাথা তুলে প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকালাম।

আকাশ! ওখানেই আছে না সেই আকাশগঙ্গা! যার দুই পারে চিরকাল বসে থাকে দুই ভালবাসার মানুষ! আর তাদের মেলাতে কে আসে? কারা দল বাঁধে? বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে কারা পৃথিবী থেকে উড়ে যায় মহাকাশে?

আমি দ্রুত এগোলাম। সরু রাস্তার ওপাশেও এমন একটা পুরনো দরজা আছে। এই দরজাটাতেও একইরকম নকশা করা। আমি জানি এই দরজাটা ভিতর থেকে শুধু ভেজানো থাকে। রাতের আগে বন্ধ করা হয় না। ছোটবেলায় রাজির সঙ্গে এখানে আসতাম! আমি দরজাটা ঠেলে সটান ঢুকে পড়লাম।

বাড়ির ভিতর একটা ছোট্ট উঠোন। পাশ দিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি। আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলাম। একতলার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ! দোতলারও তাই! প্রতিটা ফ্ল্যাটে ঢুকতে হলে আলাদা করে বেল বাজাতে হয়! তাই হয়তো মেন গেট খোলা থাকলেও সমস্যা হয় না!

কিন্তু তিনতলার মুখে একটা কোলাপসিবল গেট বসানো! আগে তো ছিল না! আমি গিয়ে অধৈর্য হাতে বেল বাজালাম!

“কে?”

আমি জানি গলাটা কার। বললাম, “আমি।”

“কে আমি? শাহরুখ খান নাকি?” ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কোলাপসিবল গেটের সামনে দাঁড়াল কুকি, “আরে রিয়ান!” কুকি যেন ভূত দেখল!

আমি বললাম, “দরজা খোলো তাড়াতাড়ি!”

“কেন?” কুকির এখনও ঘোর কাটেনি!

“আরে খোলো দরজা,” আমি গেট ধরে ঝাঁকালাম জোরে!

কুকি দরজা খুলে দিতেই আমি ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

“কে রে?” ঠাকুরমার গলা পেলাম এবার।

আমি দ্রুত বারান্দায় গেলাম। ঠাকুরমা ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। ঠাকুরমা হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু আমায় দেখে ঠাকুরমাও চমকে গেল।

আমি সময় নষ্ট না করে ঠাকুরমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ঠাকুরমা তাকাল আমার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী রে তুই? এখানে? কবে এলি?”

আমি হাঁপাতে-হাঁপাতে বললাম, “আজ বিকেলে ঠাকুরমা। আমি একটু ওইখানে যেতে পারি?”

“কোথায়?” ঠাকুরমা বুঝতে পারল না।

আমি সামনের ওই বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো সাঁকোর মুখটা দেখালাম।

“কেন?” ঠাকুরমা অবাক হল।

আমি বললাম, “রাজির নাকি বিয়ে? ইয়ার্কি নাকি? বললেই হল! আমি যেতে গেলাম ওর কাছে। জেঠিমা আমায় যেতে দিল না। ঢুকতেই দিল না বাড়িতে!”

“কেন দেবে?” ঠাকুরমা শান্ত চোখে তাকাল আমার দিকে।

আমি বললাম, “আরে রাজির অন্যের সঙ্গে বিয়ে হতে পারে নাকি? তোমরা কী বলছ সবাই?”

ঠাকুরমা এবার আর কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল শুধু।

আমি বললাম, “আমি যাব রাজির কাছে। বিয়ে করবে মানে! দেখি, কে আমায় আটকায়?”

ঠাকুরমা বলল, “ওই সাঁকোটা তো মাঝে-মাঝে ভেঙে গেছে!”

আমি বললাম, “আরে, তলায় লোহার দুটো মোটা বিম আছে!”

ঠাকুরমা বলল, “তুই এমন করছিস কেন? পড়ে গেলে?”

আমি বললাম, “উপায় নেই ঠাকুরমা। কোনও দিন তো কিছুই করলাম না। আর এই সাঁকোটা তো করাই হয়েছিল দুই বাড়ির মধ্যে যাতে যাতায়াত করা যায় সেইজন্য! তোমরা কেউ ইউজ় করলে না। আমি একটু করি আজ। আমায় বড় কিছু তো একটা করতেই হবে! না হলে ও বিশ্বাস করবে কেন আমায়?”

আমি তাকালাম ওই বাড়ির দিকে। রাজির ঘরের আলো জ্বলছে! কিন্তু রাজিকে দেখা যাচ্ছে না! ও কি নেই তবে? আমি আরও একটু তাকিয়ে রইলাম। রাজি নেই ঘরে? নাকি… ওই তো!

আমি দেখতে পেলাম এবার। ঘরের ভিতর একটা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে রাজি। হাতে রুমাল। আরে, কী করছে ও? রুমাল দিয়ে চোখ মুছছে কেন? আর কেন অমন হঠাৎ বিছানায় বসে মুখ গুঁজল বালিশে। কী হয়েছে রাজির?

আমি ঠাকুরমাকে বললাম, “আমি যাই।”

ঠাকুরমা হাসল। বলল, “যাই বলতে নেই। আয়।”

আমি এগোলাম।

সন্ধে নেমে এসেছে। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র, গ্রহ ও গ্রহাণুপুঞ্জ আর তাদের মধ্যে দিয়ে এক জীবন থেকে অন্য জীবন পার করে বয়ে চলেছে আকাশগঙ্গা! কে লঙ্ঘন করবে এই অর্বুদ নক্ষত্রমালা? অশ্রুকণার ডাকে কারা আসবে আজ পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা নিয়ে? সাঁকো কি আজ পৌছে দিতে পারবে দু’জনকে দু’জনের কাছে?

আমি ঠাকুরমার দিকে তাকালাম আর-একবার। তারপর বাঁশের বেড়া টপকে নামলাম ভাঙা সাঁকোটায়। আর পৃথিবীর সমস্ত দোয়েল পাখি মাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে উঠে এল অসীম আকাশে! তারা একে অপরের ডানার সঙ্গে ডানা জুড়ে দিল প্রাণপণ! তৈরি করল সাঁকো! আমার থেকে আমার ভালবাসায় পৌঁছে যাওয়ার সাঁকো। তোমার থেকে তোমার ভালবাসায় পৌঁছে যাওয়ার সাঁকো! আমাদের সবার বুকের ভিতরের দোয়েল-সাঁকো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *