৩. শেষের পরে

শেষের পরে

খবর কাগজটা মুড়ে রাখল নেড়ু পাগলা। খারাপ খবরে ভরতি। প্রথম পাতাতেই বোমায় আহত বাচ্চাদের ছবি। দেখলেই গা জ্বলে যায়। একটা মন খারাপের গন্ধ এসে ঠোক্কর মারে নাকে। কারা তোলে এসব ছবি? কারা ছাপায়? ভাল ছবি ছাপাতে পারে না? এই যেমন ওই ক্যামেরা হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ানো ছেলেটাকে সুন্দর মতো মেয়েটা যে জড়িয়ে ধরল, তার ছবি ছাপানো যায় না? ওই যে মেয়েটা বলল, “তুমি যতক্ষণ না আসছ, ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি, সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকতাম তোমার জন্য।” সেটুকু ছাপানো যায় না? কী সব ছাপায় এরা? মানুষ মানুষকে মারছে, বাচ্চারা কাঁদছে, ন্যাংটো মেয়েদের দেখে নাল পড়ছে সবার, এ কোন দেশ? এ কোথায় আছে ও? এরা কারা ওর চারপাশে? সবসময় সবাই কথা বলছে, চিৎকার করে নিজের মতটা অন্যকে গিলিয়ে দিতে চাইছে, এই কি মানুষ? এই যে একপাল লোক একসঙ্গে ভীষণ চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। ওরা কি কোনও যুদ্ধে যাচ্ছে? কোনও দেশ জয় করতে যাচ্ছে? সবাই তা হলে অমন চিৎকার করছে কেন? ওদের জন্য যে এত লোক আটকে আছে রাস্তায়, সেটা নিয়ে ওদের হুঁশ নেই? কেউ কি কারও সুবিধে অসুবিধে বুঝবে না? কষ্টটা বুঝবে না?

নেড়ু পাগলা উঠল। মেয়েটার পায়ের দিকে তাকাল একবার। আরে, এখানেও লাল-কালো জুতো! কে জানি আজ ওকে বলেছে গতকাল একটা লাল-কালো জুতো কিনে দেবে! কে জানে সত্যি দেবে কি না? কিন্তু কে বলল ওকে কথাটা? কিছুতেই মনে পড়ছে না। মনে পড়ে না। সব আবছা লাগে কেমন। খাওয়ার কথাটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছু মনে থাকে না কেন ওর?

শেষবারের মতো ছেলে আর মেয়েটার দিকে তাকাল ও। চেনা মনে হল কি? কে জানে? মেয়েটাকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে! চোখের ভেজা পলকগুলো ছাপিয়ে উঠছে হাসি। রোদ আর বৃষ্টি। হঠাৎ ভারী আনন্দ হল ওর। সিনেমার শো ভেঙেছে। লোকজনের ভিড় নড়াচড়া করছে। ছেলেটা আর মেয়েটা সেই ভিড় ভেঙে হেঁটে চলে গেল। কোথায় গেল? নেড়ু পাগলার খুব ইচ্ছে হল ওদের সঙ্গে যায়। কিন্তু গেল না ও। অন্য দিকে হাঁটতে লাগল। হাওয়া দিচ্ছে খুব। হাত দুটো ছেঁড়া পাজামার পকেটে ঢোকাল ও। আরে এক টাকার কয়েন! কে দিল এটা ওকে? আনমনে ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামল ও। এখানে সার সার গাড়িরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরে এই গোলাপি বড় গাড়িটা কার? ওই ফরসা লম্বা লোকটার? আচ্ছা লোকটা অমন করে কার সঙ্গে ফোনে চেঁচাচ্ছে? কী বলছে লোকটা?

নেড়ু পাগলা চুপচাপ গিয়ে দাঁড়াল লোকটার পেছনে। শুনল লোকটা বলছে, “কিষণ আবার ভুল করেছ? সুটকেস দুটো কেন পাঠাওনি সুরিন্দরকে? ইউ ইডিয়ট। লাথ মেরে বের করে দেব তোমায়। সকালে এক টাকার হিসেব গন্ডগোল করেছ, এখন সুটকেস নিয়েও গন্ডগোল? কী করছ কী তুমি? মন নেহি হ্যায় ক্যা কাম মে? কী হল, বলো?”

নেড়ু দেখল এক টাকা আর সুটকেসের জন্য লোকটা ভীষণ রেগে গিয়েছে, খুব চিৎকার করছে। ওর মনে হল, কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কী করবে ও? সুটকেস তো দিতে পারবে না, তা হলে? আরে, এটা তো আছে। পকেট থেকে এক টাকার কয়েনটা বের করল নেড়ু। তারপর লোকটার কাঁধে টোকা দিল, “এই যে, শোনো।”

লম্বা লোকটা ফোন হাতে ওর দিকে ফিরল, রাগে গোলাপি হয়ে যাওয়া মুখে হতভম্ব ভাব। নেড়ু পাগলার মজা লাগল খুব। ও বলল, “রাগ করে কী হবে? সুটকেসটা গতকাল পেয়ে যাবে ঠিক। আর এখনকার মতো এটা রাখো। কেমন?” লোকটার হাত ধরে এক টাকা গুঁজে দিল ও। তারপর লোকটার দিকে আর না তাকিয়ে এগিয়ে গেল।

বিকেলের রোদে মরচে ধরছে এখন, হাওয়ার বেগটাও সামান্য বাড়ল। দু’পাশের গাছ থেকে সবুজ হলুদ পাতারা ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে। পথে। নেড়ু পাগলা দেখল গোলাপি গাড়িটার সামনে একটা চকচকে মূর্তি। আরে হনুমানজি! বজরঙ্গবলী! নেড়ু পাগলা হাঁটু মুড়ে বসল গাড়িটার সামনে, তারপর জোড়হাত করে বলল, “আমায় একটা লাল-কালো জুতো দিয়ো ভগবান। নরম একটা জুতো।”

আচ্ছা, ওরও একটা নরম জুতো ছিল না? একটা বিরাট বড় মাঠ, অনেক পায়রায় ভরা ছাদ, বড় ঝিল, এক জোড়া সোনার বালা-পরা হাত, বই-ঘেরা মানুষ, লাল ওয়াটার বটল হাতে দৌড়ে আসা ছোট্ট একটা মেয়ে—ছিল না ওর? কী জানি! কিচ্ছু মনে পড়ে না!

নেড়ু পাগলা টালুমালু চোখে আকাশের দিকে তাকাল একবার। বড় বড় গাছের থেকে সবুজ হলুদ পাতারা ঝরে পড়ছে। ও, সেই মরচে-পড়া রোদ, সেই ঝরে-পড়া পাতা আর দামাল হাওয়ার কানে কানে বলল, “যে যেখানে আছে, সবাই সুখে থাকুক, আনন্দে থাকুক, ভাল থাকুক। ভগবান নয়, মানুষই মানুষের ভাল করুক।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *