২. দ্বিতীয় সূত্র

দ্বিতীয় সূত্র

ইরা : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল সোয়া আটটা

“শোনো ইরা, প্লিজ রাগ কোরো না। শোনো…”

ইরা কঠিন গলায় বলল, “ঠিক তিনটে, প্রিয়ার সামনে।”

আর্চিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইরা জোরে হাঁটতে লাগল। সামনে একটা এসডি-ফোর বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইরা সোজা গিয়ে উঠে পড়ল বাসটায়। লেডিস সিটটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সেখানে গিয়ে বসল ও। সত্যিই, আর্চি ইনকরিজিবল। ও পাগলের মতো কথা বলে যাচ্ছিল, আর আর্চি? কখনও বিস্কিট খাচ্ছে, কখনও ক্যামেরা নিয়ে ভিখিরিদের ছবি তুলছে। এ ছেলেটা সত্যিই এত ক্যাজুয়াল যে, মাঝে মাঝে আর পারা যায় না। কী ভাবে ও? সবটাই ইয়ারকি? সবটাই কি বাচ্চাদের খেলা? এই যে বাবা আজ আর্চির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছে, তার জন্য কি কম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ওকে? এসব বোঝে না কেন ও? দিনকে দিন ওর ক্যালাসনেস যেন বাড়ছে।

বাসটা ছেড়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউ থেকে এস পি মুখার্জি রোডের দিকে বাঁক নিল। জানলার পাশে বসে ইরা দেখল ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ভীষণ বিরক্ত মুখে কার সঙ্গে জানি ফোনে কথা বলছে আর্চি। ইরা, যতক্ষণ পারা যায় তাকিয়ে রইল, কিন্তু আর্চি একবারও তাকাল না বাসের দিকে।

গতকাল থেকে মন খারাপ হয়ে আছে ইরার। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। আজকের বিকেলটার ওপর জীবনের অনেক কিছুই নির্ভর করছে ওর। অনেক বার আর্চিকে ক্ষমা করে দিয়েছে ইরা। কিন্তু আর নয়। আজ যদি এক মিনিটও দেরি করে তা হলে আর আর্চির সঙ্গে সম্পর্ক নয়। ভীষণ রাগ হচ্ছে ইরার। ছেলেটা কি একটুও সিরিয়াস নয়! সত্যিই ওকে ভালবাসে তো?

বাসের জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসছে একটা। দুর্বল রোদ সেই হাওয়া ভেঙে এখনও নিজের গুরুত্ব বোঝাতে পারেনি। ইরা দেখল পেছনের গেটের রোগা মতো কনডাক্টরটা এগিয়ে এল ওর দিকে, “দিদি, টিকিট”।

ইরা বলল, “নিউ আলিপুর, গোল চক্করটার ওখানে।”

ইরার বাড়িয়ে দেওয়া কুড়ি টাকার নোটটা দেখে ভুরু কোঁচকাল লোকটা। বিরক্ত গলায় বলল, “সকালবেলাতেই এত বড় নোট দিলেন? খুচরো কোথায় পাব?”

“বড় নোট মানে?” ভুরু কুঁচকে গেল ইরার, “কুড়ি টাকা বড় নোট?”

“আপনারা বড়লোক, আপনাদের কাছে এটা ছোট হলেও আমাদের কাছে বড়। আপনি খুচরো দিন।”

ইরা শক্ত মুখে বলল, “খুচরো নেই। ওখান থেকেই টিকিট দিন।”

“আচ্ছা মুশকিল”, লোকটা হঠাৎ গলা চড়াল, “খুচরো না দিতে পারলে নেমে যান, যত্ত সব।”

“মানে? হোয়াট ননসেন্স?” ইরাও দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে মনে ঠিক করল আর একটা বাজে কথা বললে ও থাপ্পড় মারবে লোকটাকে। রাগটা আর আয়ত্তে থাকছে না ওর।

কিন্তু অত অবধি আর গড়াল না ঘটনাটা। সামনের গেটের বয়স্ক কনডাক্টরটা এসে কুড়ি টাকার নোটটা ছিনিয়ে নিল লোকটার হাত থেকে। তারপর টিকিট কেটে, বাকি টাকাটা টিকিট সমেত ফেরত দিল ইরার হাতে। লোকটা বলল, “দিদি কিছু মনে করবেন না। ভুল হয়ে গেছে।”

ইরা একবার কটমট করে তাকাল রোগা কনডাক্টরটার দিকে, তারপর জানলা ঘেঁষে বসে পড়ল আবার।

ফালতু ঝামেলা, ইরা ভাবল, আজকাল দিনগুলো যা যাচ্ছে তাতে গন্ডগোল হাড়া আর কোনও ঘটনাই নেই। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল ও। রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো পেরিয়ে ছুটে চলেছে বাস। রাস্তায় লোকজন বাড়ছে আস্তে আস্তে। এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহটা এলেই সবার ভেতরে কেমন একটা ছুটির আমেজ চলে আসে। মানুষ শ্লথ হয়ে পড়ে, তারা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম চোখে তাকিয়ে থাকে কলকাতার দিকে। গাড়ি ভরতি করে থালাবাসন বাজিয়ে যায় পিকনিক করতে। ব্যস্ততা আর দায়িত্বের টানটান সুতোটা কেমন যেন ঢিলে হয়ে যায় হঠাৎ। কাজের দিক থেকে মনটা ঘুরে যায়। এ-সময়টা বড় আলসে করে দেয় মানুষকে। ছোটবেলার কথা মনে আছে ইরার। এ সময় পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত ওদের। বাবা ঘুরতে নিয়ে যেত নানা জায়গায়। পিকনিকেও বহু বার গেছে বছরের এই সময়টায়। শীতকাল বরাবর প্রিয় ইরার। বিশেষ করে ডিসেম্বরের এই শেষ সপ্তাহের শীতটুকু। ওর মনে পড়ল এরকম একটা শীতের দিনেই তো আলাপ হয়েছিল আর্চির সঙ্গে। দিনটা এখনও মনে আছে ওর, একত্রিশে ডিসেম্বর।

বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটা ফ্লাওয়ার শো-তে গিয়েছিল ইরা। এসব শো-টো যে ওর খুব একটা ভাল লাগে তা নয়, কিন্তু যেতে হয়েছিল, ও ভেবেছিল, গিয়ে অন্তত বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মজা তো হবে।

চারিদিকে নানা মাপের, নানা ধরনের ফুল সাজানো। চেনাশুনো ফুল ছাড়াও অচেনা অনেক ফুল রাখা ছিল সেখানে। প্রতিটা ফুলের পরিচিতি, তাদের ল্যাটিন নাম, ইত্যাদি নানান তথ্য লিখে ফুলগুলোর পাশে পাশে টাঙানো ছিল।

ইরা সাজানো ফুলের ভেতর দিয়ে একা একাই হাঁটছিল। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে, পড়ে নিচ্ছিল ওইসব ছোট ছোট ফুলের বৃত্তান্ত। অনেক লোকের মাঝে বেশ কয়েক জন ফোটোগ্রাফারও ছিল। অনবরত তাদের শাটার টেপার শব্দ আসছিল আশপাশ থেকে।

খানিকক্ষণ এখানে ওখানে ঘোরার পর, ওর মনে হতে লাগল কে যেন ওকে লক্ষ করছে। এক জোড়া চোখ যেন অনবরত পেছনে পেছনে ফলো করে যাচ্ছে ওকে। দু’-একবার এ-দিক ও-দিক তাকালেও ও বুঝতে পারছিল না কে লক্ষ করছে। তারপর হঠাৎ একবার মুখ তুলেছিল ও আর তখনই দেখেছিল ঘটনাটা।

একটা ছেলে ওর দিকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলছে। এ কী অসভ্যতা। ওকে না জিজ্ঞেস করে ছবি তুলছে কেন? ভীষণ রাগ হয়ে গিয়েছিল ইরার। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল ছেলেটার দিকে। ওকে অমন মারমুখিভাবে আসতে দেখেও ছেলেটা ঘাবড়ে না গিয়ে একটার পর একটা স্ন্যাপ নিচ্ছিল। ক্যামেরার খচ খচ শব্দটা কাঁটার মতো বিঁধছিল ওর মাথায়। আচ্ছা বেয়াড়া ছেলে তো।

ছেলেটার কাছে গিয়ে ইরা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্যামেরাটা কাড়তে গিয়েছিল ওর। কিন্তু ছেলেটা চট করে সরে গিয়ে বলেছিল, “সিক্সটিন পয়েন্ট ওয়ান মেগা পিক্সেল ক্যামেরা। খুব কস্টলি, প্লিজ হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার।”

ইরার মাথা আরও গরম হয়ে গিয়েছিল, ও চিৎকার করে বলেছিল, “হাউ ডেয়ার ইউ টেক মাই পিকচার! কাকে বলে তুমি ছবি তুলছ আমার?” কোনও আপনি-টাপনির ধার ধারেনি ইরা।

“কাউকে বলিনি তো। আর তোমার গায়ে তো লেখা নেই– ফোটোগ্রাফি প্রোহিবিটেড। আমার ভাল লাগল, তাই তুললাম।”

“ভাল লাগল?” রাগে বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলছিল ইরা।

“হ্যাঁ, ভালকে খারাপ বলব কোন যুক্তিতে?”

ছেলেটার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিল ইরা। ও কি বুঝতে পারছে না যে, একটা ভীষণ গর্হিত কাজ করেছে? না বলে অন্যের ছবি তোলা চুরি করার সমান। একে কি বাবা-মা শিক্ষা দেয়নি? ইরা বলেছিল, “এখনও এত কথা বলছ? অশিক্ষিত নাকি?”

“খানিকটা তাই। ইংলিশে অনার্স করার পর আর পড়াশুনো করিনি। এই থার্ড আই-টা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি।”

“আমি জানতে চেয়েছি? জানতে চেয়েছি এত কথা?” ইরা চিৎকার শুরু করেছিল।

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলছিল, “কী জানি? মনে তো হচ্ছে জানতে চেয়েছ। বাই দ্য ওয়ে আমি অর্চিষ্মান, কমপ্রেস করে আর্চি। তুমি?”

ইরা মাথা ঘুরিয়ে দেখেছিল আশেপাশে বেশ কিছু লোক জমা হয়ে গেছে। বন্ধুরাও চলে এসেছে পাশে। ও শেষ চেষ্টা করেছিল, “তুমি আর্চি না অ্যাস্টেরিক্স না টিনটিন তা জেনে আমার লাভ?”

এবার ইরার পাশ থেকে ওর বান্ধবী পলি বলেছিল, “আপনি না বলে ছবি তুলছেন কেন? জানেন আপনাকে পুলিশে দিতে পারি?”

আর্চি ঠান্ডা গলায় বলেছিল, “তা পারো তোমরা, তবে তার আগে দেখে নাও কেমন ছবি উঠল।” বলেই পাশে রাখা মোটা ব্যাগটা খুলে একটা ল্যাপটপ আর ছোট বাক্স মতো জিনিস বার করেছিল।

ইরা বলেছিল, “দেখব না ওসব। আমরা কেউ দেখতে চাই না।”

আর্চি হেসেছিল, “তুমি দেখো না কিন্তু অন্যদের দেখতে দাও।” তারপর ইরার বন্ধুবান্ধবদের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তোমরা দেখবে তো?”

বন্ধুরা কী উত্তর দিয়েছিল তা আন্দাজ করার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।

একটু দূরের একটা টেবিলে ল্যাপটপটা রেখে সেটাকে চালু করেছিল আর্চি। তারপর একটা তার দিয়ে ছোট বাক্সটা কানেক্ট করেছিল ল্যাপটপের সঙ্গে। এরপর ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে তার ভেতর থেকে একটা ছোট্ট চৌকো চ্যাপটা মতো মেমরি স্টিক বের করে গুঁজে দিয়েছিল ওই বাক্সটায়। কম্পিউটার স্ক্রিনে ডাকটিকিট মাপের প্রায় দশ-বারোটা ছবি ভেসে উঠেছিল। সবক’টাই ছিল ইরার। আর্চি, ল্যাপটপের টাচ প্যাডে আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে একটা একটা করে ছবি বড় করে দেখাচ্ছিল ওদের। দেখব না দেখব না করেও ইরা দেখেছিল ছবিগুলো। ফুলের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নেওয়া ওর ছবি। ইরা কোনওদিন নিজের এতটা ন্যাচারাল আর সুন্দর ছবি দেখেনি।

পলি তো বলেই ফেলেছিল, “ইরা তোকে তো দারুণ লাগছে দেখছি। এত সুন্দর ছবি তুলেছে তোর, আর তুই রাগ করছিস?”

সবার মধ্যে দাঁড়িয়েও, শুধু ইরা শুনতে পায়, এমন গলায় আর্চি বলেছিল, “আমি তেমন তুলতে পারিনি। দ্য সাবজেক্ট ইজ মোর বিউটিফুল।”

ছবিগুলো দেখার সময়ই রাগ চলে গিয়েছিল ইরার। আর এই শেষের কথাটায় হঠাৎই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল ওর। রোদের রংটা পালটে গিয়েছিল যেন। ফুলগুলোর পাপড়ি যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল হঠাৎ। আশপাশের সমস্ত কোলাহল যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল নিমেষের মধ্যে।

ফ্লাওয়ার শো থেকে বেরোবার সময় আর্চি জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার ছবিগুলো পৌঁছে দেব কী করে?”

ইরা খুব নরম স্বরে নিজের মোবাইল নম্বরটা জানিয়ে দিয়েছিল ওকে।

এরপর দিন চারেকের মাথায় ফোন করেছিল আর্চি। ইরা ওকে বিকেলের দিকে সময় দিয়েছিল দেখা করার। সেদিন মাত্র দুটো ছবি সঙ্গে করে এনেছিল আর্চি। তারপর ইরার অবাক মুখ দেখে কাঁচুমাচু হয়ে বলেছিল, “বাকিগুলো আনতে ভুলে গিয়েছি। আর এক দিন যদি…”।

আর এক দিনও সময় দিয়েছিল ইরা। সেদিনও মাত্র দুটো ছবি নিয়ে এসেছিল আর্চি। এরকম করে ছ’দিনের দিন ও বলেছিল, “সব ছবি তো দিয়ে দিলাম, এবার?”

ইরা মুখ টিপে হেসে বলেছিল, “আমি সব ছবি ফেরত দিয়ে দিচ্ছি। পরের দিন আবার প্রথম থেকে শুরু কোরো।”

আর্চি এগিয়ে এসে হাত ধরেছিল ওর। আর গঙ্গার ধারে অল্প হাওয়া, নেমে আসা সন্ধে আর বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর জ্বলে ওঠা আলোর সামনে ইরা আলতো করে মাথা রেখেছিল আর্চির বুকে। আর্চি নিচু স্বরে বলেছিল, “দিস ইজ আ কোড্যাক মোমেন্ট, দ্য মোমেন্ট অব মাই লাইফ।”

কথাটা সত্যি কি না কে জানে? মাঝে মাঝে মনে হয় আর্চির জীবনে ও ছাড়া আর কেউ নেই। আবার মাঝে মাঝে আর্চিকে চিনতে পারে না ও। ইদানীং এই দ্বিতীয় ব্যাপারটাই যেন বেশি করে মনে হচ্ছে ইরার।

আর্চির কথা মাকে বলায়, মা প্রথমে খুব রাগারাগি করেছিল। কিন্তু অনেক সাধ্যসাধনা করে মাকে রাজি করিয়েছিল ইরা। মা তখন বলেছিল, “এবার তোর বাবাকে বল, ও যদি না করে দেয়, তা হলে কিন্তু আমি তোর জন্য ছেলে দেখব।”

বাবা না করেনি। বলেছিল, “তুই যখন পছন্দ করেছিস, আমি জানি সে ভাল হবেই। আর এখনকার দিনে ফোটোগ্রাফি ইজ আ ভেরি গুড প্রফেশন। তুই ওকে নিয়ে আয় একদিন।”

“কবে আনব?” উজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করেছিল ইরা।

অক্টোবরে একটা দিন সময় দিয়েছিল বাবা। আনন্দে লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরোবার সময় ইরা দেখেছিল মায়ের মুখটা গোমড়া হয়ে আছে। অর্থাৎ মা সত্যি সত্যি রাজি হয়নি তা হলে!

কিন্তু দিনটা মিস করেছিল আর্চি। বাবা অপেক্ষা করতে করতে সামান্য বিরক্ত হয়েছিল আর সেই সুযোগে মা নিজের অপছন্দের ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেছিল। আর্চি যে ইরেসপনসিবল এবং ইরাও যে ভুল পছন্দ করেছে, সেটা বিভিন্ন ভাবে বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল মা। কিন্তু আর্চি যে অমন নয়, সেটা কী করে বোঝাবে ইরা? ওর টেনশন হয়েছিল খুব। বাবা আবার মায়ের কথায় কনভিন্সড হয়ে যাবে না তো? আর্চির সঙ্গে বাবার দেখা হওয়াটা খুব জরুরি। তাই অনেক বলেকয়ে ইরা নভেম্বরের আর একটা দিন আর্চির সঙ্গে দেখা করার জন্য রাজি করিয়েছিল বাবাকে। বাবা রাজিও হয়েছিল। কিন্তু সে-দিনও বাবা সারাটা সকাল ঠায় বসে থাকলেও আর্চির টিকিও দেখা যায়নি। বাবাও এবার রেগে গিয়েছিল ভীষণ। আর মা তাতে ঘি ঢেলেছিল ক্রমাগত। সেদিন এয়ারপোর্টে আর্চির সঙ্গে মিনিট পনেরোর জন্য দেখা করেছিল ইরা। একটা কথাও ওকে বলতে দেয়নি সেদিন। যা খুশি বলে অপমান করেছিল আর্চিকে। আর্চি মাথা নত করে শুনেছিল শুধু।

রাত্রে নিজের ঘরে শুয়ে খুব কেঁদেছিল ইরা। ভেবেছিল আর্চি কত দূর চলে গেল। সেই কাশ্মীর। ওকে এভাবে না বললেই পারত কথাগুলো। কিন্তু এই যে ওর দুঃখ হচ্ছে, সেটুকুও কি বোঝে আর্চি? তাই কাশ্মীরে আর ওকে ফোন করেনি ইরা।

এর পরের এক মাস মা পাগলের মতো পাত্র দেখেছে ওর জন্য। অবশেষে মিলন সেন নামে এক ডাক্তার পাত্রকে পছন্দ হয়েছে মায়ের। বাবা অবশ্য এখনও কোনও কংক্রিট মতামত দেয়নি। তবে মা ফুল সুইংয়ে মিলন সেনের হয়ে ক্যাম্পেন করে যাচ্ছে বাবার কাছে। কে জানে বাবা কী ভেবে রেখেছে?

কুড়ি তারিখ যে আর্চি ফিরছে, সেটা ও জানত। আর্চি দু’বার ফোনও করেছিল ওকে। কিন্তু ও কোনও ফোনই রিসিভ করেনি। তারপর গতকাল সকালবেলা সাহসে ভর করে বাবার কাছে গিয়েছিল ও। অনেক অনুনয় করে বাবাকে আর একবার চান্স দিতে বলেছিল আর্চিকে। ও বলেছিল, “দেখো, এবার নিশ্চয়ই আসবে ও।”

বাবা গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছিল, “তুমি এত করে বলছ যখন তখন ঠিক আছে, কাল বিকেল ঠিক সোয়া তিনটের সময় আমার অফিসে নিয়ে এসো ওকে। তবে আমার মনে হচ্ছে হি ইজ নট সিরিয়াস অ্যাবাউট ইউ। শোনো, এবার যদি তোমার আর্চি না ম্যানড্রেক, না আসে তা হলে মায়ের কথা অনুযায়ী মিলনের সঙ্গেই তোমার বিয়ে দিয়ে দেব। মাইন্ড ইট, দিস ইজ আর্চিস লাস্ট চান্স।”

লাস্ট চান্স! বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে ইরার। আর্চি যদি না আসে আজও? যে, ওর সঙ্গে বহুদিন পর দেখার পরেও বিস্কিট খায় অন্যমনস্ক হয়ে, রাস্তার পাগল ভিখিরিদের ছবি তোলে, সে কি সত্যিই ওর প্রতি সিরিয়াস? কিন্তু এত কিছুর পরেও আর্চির মুখটা, ওর অন্যমনস্ক চোখ দুটো, ওর হঠাৎ হেসে ওঠাটা মনে পড়লে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায় ইরার। প্রতি বার আর্চিকে চুমু খাওয়ার সময় লবঙ্গের গন্ধ পায় ও, সেটা হঠাৎ স্মৃতিতে ফিরে আসে। ওর মনে পড়ে নানা রঙের ফুলের ভেতর থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। মনে পড়ে সেই পড়ন্ত আলোর গঙ্গার পাড়। ওদের কোড্যাক মোমেন্ট। এসব কি মা কোনওদিন বুঝবে? বুঝবে বাবা? সেই মিলন ডাক্তার কি অমন সুন্দর ছবি তুলে দিতে পারবে ওর। জড়িয়ে ধরে বলতে পারবে— “মোমেন্ট অব মাই লাইফ”? জীবনে মানুষ মাত্র একবারই ঠিক মানুষকে খুঁজে পায়। আর কোনও কারণে যদি সে চলে যায়, মানুষ বাকি জীবনটা অন্য কেউ হয়ে বাঁচে। তার নিজস্ব কিছু থাকে না আর। ইরা ভাবল, আজকের পরে ও নিজেও কি অন্য কেউ হয়ে যাবে?

নিউ আলিপুরের গোল চক্করটায় বাস থামামাত্র নেমে পড়ল ইরা। এবার মামার বাড়ি যেতে হবে ওকে। ও জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখল একবার। নাঃ, আছে কৌটোটা। এতে এক জোড়া সোনার বালা আছে। মামি গত সপ্তাহে ফেলে এসেছিল ওদের বাড়িতে। আজ মামাদের কীসের একটা নেমন্তন্ন আছে। মা তাই বালাজোড়া দিয়ে পাঠিয়েছে ইরাকে। সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন হলেও, ইরার সারাদিন আর সময় হবে না বলেই সকালে এসেছে ও। আর ইচ্ছে করেই আর্চিকেও সকালে ডেকে পাঠিয়েছিল। ইরা চেয়েছিল যে, সকাল সকাল আর্চিকে বিকেলে ‘দেখা করার’ কথাটা বললে ও সারাদিনের কাজটা সেইমতো গুছিয়ে নিতে পারবে। এখন দেখা যাক আর্চি কী করে!

টুং টুং করে শব্দ হল ব্যাগের ভেতর। ইরা ব্যাগটা খুলে মোবাইলটা বের করল। একটা মেসেজ এসেছে। রিনিদি। লিখেছে—DONT B LATE, CU @ 1.30। নিজের মনে হাসল ইরা। রিনিদি নেমন্তন্নের অ্যালার্ট দিচ্ছে, যেমন আজ সকালে আর্চিকে দিয়েছিল ও নিজে।

মোবাইলটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে আবার হাঁটতে লাগল ইরা। ওই তো সামনে গলি। অবশ্য গলি বললেও রাস্তাটা বেশ চওড়া। নানারকম দোকান রয়েছে। ওই তো সামনের নামকরা কেক-পেস্ট্রির দোকানটা খুলছে এখন। এখানেই ওর মামার বাড়ি। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখতে পেল ইরা। দেখল দোতলার বারান্দায় মামা দাঁড়িয়ে রয়েছে। মামাকে এক লক্ষ লোকের মধ্যেও এক বারে চেনা যায় শীতকালে। কারণ পৃথিবীর কেউই বোধহয় এরকম ক্যাটক্যাটে কচি কলাপাতা রঙের মাঙ্কি টুপি পরে না।

মামা বারান্দা থেকেই দেখেছিল ইরাকে। তাই বেল বাজাবার আগেই মামাদের দোতলার ফ্ল্যাটের দরজাটা খুলে গেল। ওদের বাড়িতে যে-মেয়েটা কাজ করে সেই খুলে দিল দরজাটা। ইরা ভেতরে ঢুকল।

মামাদের এই ফ্ল্যাটের ঘরগুলোয় আলো ঢোকে না বিশেষ। সবসময় আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয়। শীতকাল বলেই ঘরটাকে আরও ঠান্ডা আর স্যাঁতস্যাঁতে লাগল ইরার। ও দেখল, ওর মামাতো বোন বাইরে যাবার ড্রেস করে চেয়ারে বসে মোজা পরছে। ইরা জিজ্ঞেস করল, “কী রে কোথায় যাচ্ছিস? কলেজ?”

বোন বলল, “হ্যাঁ। সোমবার থেকে ফেস্ট শুরু হচ্ছে তো, তাই কাজ আছে অনেক।” ইরা কিছু বলার আগেই বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়ানো মামা বলল, “ফেস্ট না ছাই। আরে সব ইয়ং ছেলে-মেয়ে, বছরের শেষে একটু দেখাসাক্ষাৎ না হলে চলে? ওই যে তোরা বলিস না, ঝাড়ি, তাই আর কী!”

বোন রেগে গিয়ে বলল, “সবসময় বাজে কথা। সব যেন তোমাদের মতো হবে।”

মামা মুখ ব্যাজার করে বলল, “আমাদের আর কিছুই হবে না। এই যে এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম, কত মেয়েই তো গেল রাস্তা দিয়ে, কিন্তু কেউ তো তাকাল না!” বোন কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। ইরাও হাসল। সত্যিই মামাটা একই রকম রয়ে গেল? কে বলবে মেয়ে কলেজে পড়ে? বাবা আর মেয়ের এরকম কথোপকথন আর কোথাও হয় বলে ওর জানা নেই।

বোন আর কথা বাড়াল না। ‘আসি’ বলে বেরিয়ে গেল। ইরা দেখল রান্নাঘর থেকে একটা বাটি হাতে বেরিয়ে এল মামি। তারপর ইরাকে বলল, “এটা খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।”

ইরা বাটিটা হাতে নিয়ে বসল। জিজ্ঞেস করল, “কী এটা? আর তুমি বুঝলে কী করে আমি এসেছি?”

মামি হাসল, “তোর গলা পেলাম যে। এখন নে, খা। পুলিপিঠে করেছি।”

ইয়াক। সকাল সকাল মিষ্টি? গা গুলিয়ে উঠল ইরার। মিষ্টি একদম পছন্দ করে না ও। তা ছাড়া আজকাল কোমরের কাছটায় হালকা ফ্যাট হচ্ছে। তাই সতর্ক হয়েছে ইরা। মিষ্টি আর তেল জাতীয় জিনিস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে একদম। এখনও বাটিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল ইরা। খেতে ইচ্ছে করছে না।

মামা বলল, “দু’চামচ খেয়ে বাকিটা আমায় দে। আর সত্যিই তো,” মামা এবার মামির দিকে তাকাল, “সকালে কারও এসব খেতে ভাল লাগে?”

মামি বলল, “তা হলে তুমি খেতে চাইছ কেন? তোমার তো দিব্বি ভাল লাগে দেখছি!”

মামা হাসল, “আমি তো পিঁপড়ের জাত। মিষ্টি দেখলে কি সকাল রাত্রি খেয়াল থাকে আমার? দে ইরু, একটু মুখে ছুঁয়ে, পিঠেটা আমায় দে।”

ইরা যেন হাঁফ ছাড়ল। কোনওমতে দু’চামচ মুখে দিয়ে মামার হাতে ধরিয়ে দিল বাটিটা। তারপর পকেট থেকে সোনার বালার কৌটোটা বের করে মামির হাতে দিল।

মামি কৌটোটা হাতে নিয়ে বলল, “পিঠেটা খেলি না যখন, তখন দিয়ে দিচ্ছি নিয়ে যা বাড়িতে।”

“বাড়িতে? পাগল? আমায় এখন রাজ্যের জায়গায় যেতে হবে নেমন্তন্ন করতে। ও পরে নেব।”

মামা বলল, “খুব বড় করে হচ্ছে তো অনুষ্ঠান? ইয়ে ড্রিঙ্কস্ থাকবে তো পার্টিতে?”

ইরা কিছু বলার আগেই মামি ঝাঁঝিয়ে উঠল, “আর ওসব ছাইপাঁশ খেয়ে কাজ নেই। দু’ফোটা পেটে পড়লেই তো গণ্ডগোল করো।”

মামা বলল, “সে-দিন তো ট্রিপল অনুষ্ঠান, আমি খাব না!”

“ট্রিপল! মানে?” ইরা হকচকিয়ে গেল।

হ্যাঁ, বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিন আর তোর এনগেজমেন্টের অ্যানাউন্সমেন্ট। ট্রিপল!”

“কী?” তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল ইরা, “আমার কী বললে?”

মামি ঘাবড়ে গেল, “তুই জানিস না? দিদি যে আমাদের বলল, ডক্টর মিলন সেন, তোর হবু বর। তিরিশ তারিখে তোদের এনগেজমেন্ট ডেট অ্যানাউন্স করবে!”

“মা বলেছে?” মামার গোটা ফ্ল্যাটটা যেন হঠাৎ দুলে উঠল মুহূর্তের জন্য। কই ও তো জানে না কিচ্ছু। বাবাও তো ওকে কিছু বলেনি! তা হলে? এসব কী হচ্ছে ওর আড়ালে? ইরা আর বসল না।

মামা জিজ্ঞেস করল, “কী রে এর মধ্যেই চললি?”

“হ্যাঁ, আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে তো।” ইরা দরজার কাছে গিয়ে জুতো পরতে লাগল। মামা মাথার থেকে মাঙ্কি ক্যাপটা খুলে চেয়ারে রেখে এসে দাঁড়াল ওর পাশে, তারপর ওর মাথায় হাত দিতে বলল, “বিয়েটায় তোর আপত্তি আছে? দিদির সঙ্গে কথা বলব আমি?”

ইরা ছলছলে চোখে তাকাল মামার দিকে। কোনও কথা বলতে পারল না। মামা বাঁ হাতে ধরা পিঠের বাটিটা টেবিলে রেখে বলল, “চিন্তা করিস না। জামাইবাবুর সঙ্গে কথা বল তুই। দরকার হলে আমিও বলব। জোর করে তোকে বিয়ে দেওয়া হবে না, বুঝলি?”

ইরা কোনওমতে হাসল, তারপর বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট থেকে। শুনল মামা বলছে, “কোনও দরকার পড়লে ফোন করিস আমায়, কেমন?”

সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়েই ইরা বাবার মোবাইলে রিং করল। এখনই বাবার সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলা দরকার। চার বার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরল বাবা, “বল।”

“তোমরা আমার এনগেজমেন্ট অ্যানাউন্স করছ তিরিশ তারিখ? আমায় বলোনি তো? আমায় না জানিয়ে এসব কী হচ্ছে? তুমি… তুমি…” গলা বুজে আসছে ইরার।

বাবা বলল, “এখনও ফাইনাল কিছু হয়নি। মিস্টার সেনদের বলাও হয়নি। তবে তোর টিনটিন যদি আজ ঠিক সময়ে না আসে তা হলে আজ সন্ধেবেলাতেই সেনদের সঙ্গে কথা ফাইনাল করব। শোন এখনও বলছি, ইয়োর ম্যান স্টিল হ্যাজ দ্য লাস্ট চান্স? আমি এমন কারও সঙ্গে তোর বিয়ে দেব না, যে তোকে ইগনোর করে।”

ইরা কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল বাবা।

লাস্ট চান্স! এখনও সুযোগ আছে তা হলে? ইরা ভাবল, আর্চি আজ আর না করবে না তো? ওর হাতে ধরা মোবাইলটা কুঁক শব্দ করল একবার। ব্যাটারি শেষের দিকে। পাত্তা দিল না ইরা। ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল ফোনটা। তারপর নীচে নেমে গেল। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা। আর্চি।

“এখানে কি প্রতাপ দে থাকেন?” সামনে থেকে আসা প্রশ্নে চিন্তাটা ছিঁড়ল ইরার। ও মুখ তুলে তাকাল। একজন ভীষণ সুন্দর দেখতে মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওর সামনে। কে ভদ্রলোক?

মহেশ : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল ন’টা পাঁচ

মহেশ আবার জিজ্ঞেস করল, “এখানে কি প্রতাপ দে থাকেন? অ্যাডভোকেট প্রতাপ দে?”

মেয়েটা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান। টু ‘এ’ ফ্ল্যাট। দরজায় নাম লেখা আছে।”

মহেশ হাসল, “ধন্যবাদ”।

মেয়েটা বলল, “না, না, ধন্যবাদের কী আছে? আমার মামা হন। আপনি চলে যান ওপরে।”

“মামা হন?” মহেশ দ্বিধা করল মুহূর্ত তারপর বলল, “আমি গেলে এখন দেখা করবেন নিশ্চয়ই?”

মেয়েটা ঠোঁট চাটল, ঘড়ি দেখল একবার, একবার ব্যাগটা কাঁধ বদল করল। মহেশের মনে হল মেয়েটা কোনও কারণে টেনসড আছে বোধহয়। এভাবে ওকে আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না একদম। ও আবার, “সরি, আপনাকে আটকে রেখেছি।”

মেয়েটা হাসল এবার, বলল, “না, না, আপনি ওপরে চলে যান, মামা আছে বাড়িতে। নিশ্চয়ই দেখা করবেন।”

মহেশ আর দাঁড়াল না। ধন্যবাদ দিয়ে ওপরে উঠে গেল। মেয়েটাও চলে গেল বড় রাস্তার দিকে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা কাঠের দরজার সামনে দাঁড়াল মহেশ। দরজার গায়ে নেমপ্লেটে লেখা আছে প্রতাপ দে-র নাম।

মহেশ পাশের কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল। ভেতরের সুরেলা শব্দটা বাইরে থেকেও শুনতে পেল মহেশ। ভাবল, ওকে কি চিনতে পারবেন প্রতাপবাবু?

খটাং শব্দে দরজাটা ফাঁক হল একটু। একটা অল্পবয়সি মেয়ের মুখ উকি দিল, “কাকে চাই?”

“প্রতাপবাবু আছেন?”

“আপনার নাম?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

“মহেশ চট্টরাজ।”

“একটু দাঁড়ান”, বলে মেয়েটা আবার দরজাটা বন্ধ করে দিল। মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজার দিকে তাকিয়ে মহেশ ভাবল, এখন সত্যিই কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। বিশ্বাস! গত রাতের কথা মনে পড়তেই নিজের ওপর ঘৃণা হল ওর। মনে মনে দরজা বন্ধ করে দেওয়া মেয়েটাকে বলল, “ঠিক করেছ তুমি, আমায় বিশ্বাস কোরো না।”

কিছুক্ষণ পরে দরজাটা খুলল আবার। মহেশ দেখল সামনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রতাপ দে। ভদ্রলোককে দেখে হাসল মহেশ, নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “চিনতে পেরেছেন আমায়?”

প্রতাপ হাসলেন, “বিলক্ষণ। ভেতরে আসুন।”

একটু অবাক হল মহেশ, “চিনতে পেরেছেন?”

প্রতাপ সরে দাঁড়িয়ে মহেশকে ভেতরে ঢোকার মতো জায়গা করে দিয়ে বললেন, “আপনার মতো রূপবান পুরুষকে ভোলা অত সহজ নাকি। আসুন, ওইখানটায় বসুন।”

রূপবান? মনে মনে হাসল মহেশ। প্রতাপ তো জানেন না ভেতরটা কত কদর্য ওর! ও প্রতাপের দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারটা থেকে একটা কচি কলাপাতা রঙের মাঙ্কি টুপি পাশের চেয়ারে সরিয়ে রেখে বসল।

প্রতাপ নিজে মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে, তারপর মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “তা বলুন, হঠাৎ, কী মনে করে?”

মহেশ একটু গুছিয়ে বসল। ও জানে, যে-কথাটা জিজ্ঞেস করতে ও এসেছে সেটা এই ভদ্রলোকের কাছে অবান্তর, পাগলের প্রলাপের মতো মনে হলেও, ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজ ভোর রাতের দিকে হঠাৎ এই কথাটা মনে পড়েছে ওর।

ও বলল, “আজ থেকে পাঁচ-ছ’ বছর আগে আমাদের বিমা কোম্পানি নদিয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছোট ছেলের ইনশিয়োরেন্স করেছিল না? মনে আছে আপনার? ছোট ছেলে হঠাৎ এক রাতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার বেশ অনেক মাস পরে ওর দাদা, ভাইয়ের হয়ে টাকাটা ক্লেম করেছিল, কিন্তু বডি পাওয়া যায়নি বলে, আমরা ওর প্লি রিজেক্ট করেছিলাম। তাই কেস করেছিল ওর দাদা। মনে পড়ে?”

প্রতাপ ভুরু কুঁচকে মাটির দিকে তাকালেন। মহেশ বুঝল ভদ্রলোক দ্রুত অতীতে ফিরে চলেছেন। ও অপেক্ষা করল। মনে মনে বলল, “প্রতাপবাবু, আপনি সময় নিন। মনে করুন, মনে করাটা খুব জরুরি।”

প্রতাপ মুখ তুললেন, “শেঠ পরিবারের ঘটনাটা? পরে যে-মামলাটা অন্য দিকে মোড় নিল?” উজ্জ্বল হয়ে উঠল মহেশের চোখ। যাক ওঁর মনে পড়েছে তা হলে।

ও বলল, “হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন। ক্লেমের মামলাটা তো ঘুরে গিয়েছিল অন্য দিকে, না?”

প্রতাপ বললেন “হ্যাঁ নিরুদ্দিষ্ট লোকটির স্ত্রী এসে তো একদিন কোর্টে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তারপর নালিশ করেছিলেন যে, ভাসুরই ওর স্বামীকে মেরে ফেলেছে। ভাসুরের সঙ্গে নাকি দৈহিক সম্পর্ক ছিল মহিলার। আমার তো মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল। বলেন কী ভদ্রমহিলা? তবে হ্যাঁ, বডির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য যায়নি, না টাকা পয়সা দিয়ে ওই ভাসুরটি গোটা ঘটনাটাকে চেপে দিয়েছিল, বলা মুশকিল। ভদ্রমহিলার কথার ভিত্তিতে তো আটক করা হয়েছিল ভাসুর ভদ্রলোককে। তার ওপর মামলাও তো চলে।”

মহেশ হেলান দিয়ে বসল, তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আপনি জানেন কী হয়েছে সেই মামলার?”

প্রতাপ ঠোঁট ওলটালেন, “কী জানি। তবে বোধহয় কেসের নিষ্পত্তি হয়নি এখনও। এ-দেশে ক’টা কেস দ্রুত মেটে বলুন? তা, আপনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করছেন? আপনি জানেন না? আপনি তো অনেক বার কোর্টে এসেছিলেন তখন বিমা কোম্পানির তরফ থেকে। আপনারা খোঁজ রাখেননি আর?”

মহেশ বলল, “না, আমার তো অন্য ডিপার্টমেন্টে ট্রান্সফার হয়ে যায়!”

প্রতাপ বললেন, “সত্যিই জীবন খুব অদ্ভুত। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে শুতে হল? তা হঠাৎ আপনি এত দিন পর এ ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড হলেন?”

মহেশ হাসল, “হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আচ্ছা আপনার কী মনে হয়? ওর দাদার কি শাস্তি হওয়া উচিত?”

“শাস্তি?” প্রতাপ নাক টানলেন একটু, তারপর বললেন, “আমি শাস্তি দেবার কে বলুন? তবে এরকম খারাপ লোকদের বেঁচে থাকার কী দরকার? আমার মতে বিশ্বাসভঙ্গের মতো ঘৃণ্য কাজ খুব কম হয়।”

“বেঁচে থাকার কী দরকার?” কথাটা মহেশের শরীরের ভেতর ধাক্কা খেয়ে বেড়াতে লাগল। এটাই তো ও চিন্তা করে এসেছে গতকাল সারাটা রাত। ওরও মনে হয়েছে বিশ্বাসভঙ্গের মতো ঘৃণ্য কাজ খুব কম হয়। মহেশ মাথা নিচু করে বসে রইল। ওই দাদা লোকটার কী হয়েছে সেটাই জানতে এসেছিল ও। কিন্তু তা জানতে পারল না। অবশ্য নিজের অজান্তেই প্রতাপ বলে দিয়েছেন মহেশের সমস্যার সমাধান। মহেশ ভাবল, মৃত্যুই একমাত্র উপায়। ও বুকে হাত দিল একবার। ফুসফুসের ভেতর কর্কটকুল নিদ্রিত এখনও। তবে ওরা মহেশকে শেষ করার আগে, মহেশ নিজেই সরে যাবে। আর যাবে, আজই। আজ, চব্বিশে ডিসেম্বর, ওর জন্মদিনে।

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখনও ওইখানেই চাকরি করছেন?”

মহেশ বলল, “না এখন আর ওখানে নেই আমি।”

“ও”। প্রতাপ আর আগ্রহ দেখালেন না। বরং দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ঘড়ি দেখলেন একবার, অর্থাৎ এবার উঠতে হবে।

ইঙ্গিতটা বুঝে মহেশ উঠে দাঁড়াল। সত্যিই অনেক সময় নিয়েছে ও ভদ্রলোকের। তা ছাড়া ওর এরকম হঠাৎ আগমনে ভদ্রলোক কী ভাবলেন কে জানে। ও বলল, “অনেক ধন্যবাদ, আপনি অনেকখানি সময় নষ্ট করলেন আমর জন্য।”

প্রতাপ হাসলেন, “সে ঠিক আছে। পারলে আসবেন আর এক দিন। পুরনো লোকেদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হলে ভাল লাগে খুব।”

“আচ্ছা, আসি!” হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল মহেশ।

বড় রাস্তায় এসে দেখল রোদটা বেড়েছে একটু। কিন্তু হাওয়া দিচ্ছে খুব। শীত শীত করছে মহেশের। ও-পাশে তাকাল। নাম করা এক কেকের দোকান। তার কাচের দরজার গায়ে ক্রিসমাস উপলক্ষে নানারকম স্টিকার লাগানো। দরজাটার পাশে ইয়াব্বড় একটা স্যান্টাক্লসের মূর্তি রাখা। কাল বড়দিন। উৎসবের দিন। কিন্তু না, ওর মতো লোকের এই উৎসবে যোগ দেবার অধিকার নেই কোনও।

ও দেখল একটা বাচ্চা মেয়ে মায়ের হাত ধরে ওই কেকের দোকানটায় ঢুকছে। চোখে চোখ পড়ায় বাচ্চা মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসল একটু, তারপর হাত নাড়ল। মহেশও পালটা হাত নাড়ল একবার। মেয়েটা দোকানে ঢুকে গেল।

হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল সেই বাচ্চা মেয়েটার কথা। বিমা কোম্পানির থেকে ওকে পাঠানো হয়েছিল নদিয়ায় সেই শেঠবাড়িতে। এখনও চোখের সামনে ছবির মতো ভাসে বাড়িটা। বিরাট বড় ঝিলের পাশে প্রকাণ্ড বড় একটা বাড়ি। সামনে বড় মাঠ। সুন্দর করে ছাঁটা লন। তার মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের রাস্তা চলে গেছে। লনে সাদা টেবিল ঘিরে একই রঙের কয়েকটা চেয়ার।

বাড়ির বয়স্ক এক ভৃত্য মহেশকে নিয়ে গিয়েছিল বড় ভাই ত্রিদিবেন্দ্র শেঠের কাছে। বিশাল বড় দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল মহেশ। তারপর শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, অনেক পায়রায় ভরা ছাদ পেরিয়ে একটা বড় স্টাডিতে গিয়ে থেমেছিল মহেশ। প্রচুর বই-ভরতি ঘরের মাঝখানে বসেছিলেন ত্রিদিবেন্দ্র শেঠ। সেখানেই ওঁর ছোট ভাইয়ের ছবি দেখেছিল মহেশ। সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো হাসিখুশি মানুষের ছবি একটা। মাথায় চুল খুব কম হলেও হাসিখুশি উজ্জ্বল চোখের এক মানুষ। সৌমেন্দ্র শেঠ।

কথা বলে চলে আসার সময় ছোট্ট মেয়েটাকে দেখেছিল মহেশ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল একা। ওকে দেখে হেসে হাত নেড়েছিল। এখনও সব ছবির মতো মনে আছে মহেশের। মনে আছে, ওর সামনেই এক ভদ্রমহিলা এসে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল মেয়েটিকে। অপূর্ব সুন্দরী সেই মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মহেশ। সাদা পোশাকের ঔজ্জ্বল্য ছাপিয়ে যেন ঠিকরে আসছিল হাতে পরে থাকা এক জোড়া সোনার বালা। চিনতে পেরেছিল মহেশ। সৌমেন্দ্র শেঠের স্ত্রী।

মহেশ বড় রাস্তার দিকে এগোল। আজ খানিকক্ষণ এখানে ওখানে ঘুরবে ও। যা ইচ্ছে তাই করবে, তারপর সুযোগ বুঝে গিয়ে দাঁড়াবে চলন্ত বাসের সামনে। এভাবেই ও নিজেকে শেষ করবে, ঠিক করেছে ও। কিন্তু এখনও তার দেরি আছে কিছু ঘণ্টা। ততক্ষণ আর একটু বেঁচে নেবে মহেশ আর একটু সময় কাটিয়ে নেবে পৃথিবীতে। ও বুকের ওপর হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “ওহে কর্কটকুল আর একটু সবুর করো। তারপর একসঙ্গেই শেষ হব আমরা।”

বহুদিন লেকে গিয়ে বসা হয় না মহেশের। ও ভাবল এখান থেকে অটো করে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে লেকের দিকে। জলের কাছে বসবে একটু।

বড় রাস্তায় গিয়েই অটো পেয়ে গেল মহেশ। পেছনের কোনার সিটে উঠে বসল ও। পাশের খোলা অংশ দিয়ে হুহু করে হাওয়া ঢুকছে। শরীর শিরশীর করছে ওর। ঠান্ডা লাগলে বুকের ব্যথাটা শুরু হয়। মহেশ হাত দুটোকে জড়ো করে রাখল বুকের কাছে। আরও লোক উঠছে অটোয়। ওর পাশে মোটা মতো একটা লোক উঠে ওকে প্রায় চেপটেই দিল। মহেশ কিছু বলল না। ও সরে বসল যথাসম্ভব। হঠাৎ মনে পড়ে গেল গত রাতের কথা। লালি বলেছিল, “আপনি সবসময় সরে সরে থাকেন কেন?”

লালি। ভাইকে বিয়ে দিয়ে যখন লালিকে নিয়ে এসেছিল মহেশ তখন বুঝতেই পারেনি মেয়েটার মনে কী আছে।

বিয়ের প্রথম থেকে মহেশ দেখত লালি ওর সঙ্গে একটু বেশি কথা বলে, বেশি খেয়াল রাখে ওর। ও ভাবত বাচ্চা মেয়ে তাই নতুন সংসার পেয়ে হয়তো উৎসাহ বেশি। কিন্তু মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়াত লালি। ভাই না থাকলে, স্নান করে শায়াটা বুকের কাছে বেঁধে চলে আসত ওপরে। মহেশের ঘরের সামনের বারান্দায় মেলে রাখত জামাকাপড়, শাড়ি, প্যান্টি, ব্রা। লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিত মহেশ। লালি মাখনের মতো কাঁধের ওপর দানা দানা জলের ফোঁটাকে টোকা মেরে ফেলতে ফেলতে অদ্ভুত সংকেতময় চোখে তাকাত ওর দিকে।

ভাইকে কিছু বলতেও পারত না মহেশ। লালির থেকে দূরত্ব রেখে ও শুধু পিছলে পিছলে থাকত। তবু মাঝে মাঝেই রাতে এটা ওটা দেবার নাম করে ওপরে উঠে আসত লালি। একবার তো শুধু শাড়িটা গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে ওপরে উঠে এসেছিল। কী? না ভাইয়ের পেট ব্যাথা করছে, ওষুধ চাই। মহেশ জিজ্ঞেস করেছিল, “পেটের কোথায় ব্যথা করছে?”

হঠাৎ নিজের পেটের কাছ থেকে শাড়িটা সরিয়ে লালি আলতো করে নিজের আঙুলটা পেটের নীচের দিকে বুলিয়ে দেখিয়েছিল, “এইখানে।”

দিনকে দিন মহেশের বিপদ বাড়ছিল। বুকের ভেতর রোগের দাপাদাপি, লালির ইঙ্গিত, সমস্তটাই খুব গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল ওকে। তাই, ভাই যখন বলল যে, ওকে অফিসের কাজে কোয়েম্বাটুর যেতে হচ্ছে, তখন মনে মনে প্রমাদ গুনেছিল মহেশ। ও ভাইকে বলেছিল, “এই ক’দিন তোর শাশুড়িকে এনে রাখ এখানে। লালি ছোট মেয়ে, ওর ভালও লাগবে, তা ছাড়া মায়ের কাছে থাকলে সেফ থাকবে।”

ভাই বলেছিল, “দাদা, তুই তো আছিস!”

মহেশ হেসে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল ভাইয়ের মাথায়। তারপর বলেছিল, “শোন, আমি ওপরে থাকি একা। লালি নীচে থাকবে। ওর ভয় লাগবে না? তা ছাড়া মা সঙ্গে থাকলে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ থাকে।”

ভাই আর কথা বাড়ায়নি। নিয়ে এসেছিল শাশুড়িকে। তবু যাওয়ার সময় বলেছিল, “লালিকে একটু দেখিস তো দাদা।”

মহেশ বলেছিল, “সে দেখব। কিন্তু তুই চিন্তা করছিস কেন? তোর শাশুড়িও তো রয়েছেন।”

ভাই হেসে বলেছিল, “তাও তুই দেখিস। না হলে আমার ঠিক শান্তি হয় না।”

গতকাল মহেশের শরীরটা ভাল ছিল না দুপুরের দিকে। তাই ঘুমিয়ে পড়েছিল একটু। রাত্রে আর কিছুতেই ঘুম আসছিল না ওর। একটা ইংরেজি থ্রিলার নিয়ে পড়ছিল খাটে শুয়ে, হঠাৎ খটখট শব্দ করে খুলে গিয়েছিল দরজাটা। মহেশ চমকে উঠে দেখেছিল একটা চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে লালি!

“তুমি? এখন?” মহেশ তাকিয়েছিল ঘড়ির দিকে। সোয়া এগারোটা পেরিয়ে রাত আরও গভীরের দিকে এগোচ্ছিল। লালি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে, তারপর বলেছিল, “কী বলেছেন আপনি আপনার ভাইকে?”

“ক-কী বলেছি?” ভয়ে জিভ জড়িয়ে আসছিল মহেশের।

“আমি ছোট মেয়ে? আমি ছোট? ছোট মেয়েদের কোনওদিন এরকম থাকে?” বলে আচমকা চাদরটা খুলে ফেলেছিল লালি। আর ভয়ে, বিস্ময়ে মহেশ দেখেছিল লালি শুধু সায়া পরে এসেছে, গায়ে কিচ্ছু নেই। গায়ে আবরণ না থাকায় ডিসেম্বরের ঠান্ডায় শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল লালির, বাদামি বৃন্ত দুটো উদ্ধত হয়েছিল ভয়ংকরভাবে। ভয়ে সরে গিয়েছিল মহেশ। অস্ফুটে বলেছিল, “না, তুমি চলে যাও।”

সায়ার দড়ি খুলতে খুলতে লালি যেন ফুঁসছিল। বলছিল, “আপনি সবসময় সরে সরে থাকেন কেন? কেন কাছে আসতে দেন না আমায়।” সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে লালি উঠে পড়েছিল খাটে, তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ওর দিকে এগোতে এগোতে বলছিল, “কোনও ভয় নেই, কেউ জানতে পারবে না। মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। আপনি আজ আমায় নিন।”

মহেশ সিঁটিয়ে বসেছিল খাটের কোনায়। তবু অবাক হয়ে মহেশ দেখেছিল ওর অসুস্থ শরীরও সাড়া দিচ্ছে লালিকে দেখে। মহেশ শেষ চেষ্টা করে বলেছিল, “আমার ভাইটাকে কী বলব আমি?”

লালি একদম ঘন হয়ে এসেছিল ওর কাছে, পাজামার ওপর দিয়ে ওর উত্তেজনাকে ধরে বলেছিল, “কিচ্ছু বলার দরকার নেই। সব কিছু সবাইকে বলতে নেই।” তারপর ওর পাজামার দড়ি খুলতে খুলতে বলেছিল, “দেখি আপনার এইটাও আপনার মতো সুন্দর কি না!”

লালি যখন ওর ঊরুর মাঝে উপুড় হয়ে ওকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছিল মহেশের চোখের সামনে দুলে উঠেছিল ওই ঘর, বারান্দা, ওই রাত্রি। ক্রমশ রাত্রির অন্ধকার এসে প্রবেশ করছিল মহেশের মধ্যে। আরামে অবশ হয়ে আসছিল ওর শরীর। নিজের অজান্তেই লালিকে টেনে নিয়েছিল ও। লালির মাথাটা ও চেপে ধরেছিল প্রাণপণ। তার পরের ঘটনা আর স্পষ্ট মনে নেই। শুধু চিত হয়ে শোয়া মহেশের ওপর প্রাণপণে ওঠাপড়া করা লালির ছবির টুকরো দৃশ্য মনে আছে ওর। মনে আছে লালির থুতনি থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম পড়ছিল মহেশের ঠোঁটে। চোখের জলের মতো তার স্বাদও লোনা।

কখন লালি চলে গিয়েছিল মনে নেই মহেশের। শুধু লালির শরীরের গন্ধ, ওর ঘাম লেগেছিল মহেশের গায়ে। ওর মনে হয়েছিল অনেক দূরে ভাই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে এখন।

সারারাত আর ঘুম আসেনি ওর। বুকের খাঁচার থেকে কর্কটকুল বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছিল ওর অবসন্ন শরীরে। অসুস্থ ফুসফুস যৌন উত্তেজনার অতিরিক্ত বায়ু বহন করার পর প্রতিবাদ জানাচ্ছিল তীব্র স্বরে। ওর মন ওকে বিদ্ধ করছিল ক্রমাগত। ও ভাবছিল, এটা কী করল ও? কেন করল এমন? ওর ভাইয়ের বিশ্বাসকে ভেঙে দিল এভাবে? ও তো ফিরিয়ে দিতে পারত লালিকে, দিল না কেন? কেন ওর শরীর সাড়া দিচ্ছিল লালিকে দেখে? তা হলে কি এতদিন ধরে অবচেতনে এই দিনটার প্রতীক্ষাতেই ছিল ও? ও কি নিজের অজান্তেই লালির শরীরের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল? কেন যৌনতার শীর্ষে পৌঁছে ও আঁকড়ে ধরেছিল লালিকে? কেন ও লালির বৃন্তে মুখ দিয়েছিল? তা হলে কি যৌনতাই মানুষের বেঁচে থাকার শেষ কথা? আর ক’দিনই বা বাঁচবে ও? আর যত দিন বাঁচবে তত দিন কি ভাইয়ের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবে ও? নিজের প্রতি তীব্র ঘৃণায় ও স্থির করেছিল, আর নয়, এবার ওর চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। মনের কর্কট নিয়ে বাঁচার সাহস ওর নেই। আর তখনই ওর মনে পড়ছিল ত্রিদিবেন্দ্র শেঠের কথা।

ঠিকই বলেছেন প্রতাপবাবু, বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার কী দরকার? আজ তাই সরে যাওয়ার সময়।

“কী দাদা নামবেন না?” অটোওলার খড়খড়ে গলায় মুখ ফেরাল মহেশ। টালিগঞ্জ ফাঁড়ি এসে গেছে। ও ভাড়া দিয়ে নামল। ও ভাবল এই আলো, এই আকাশ ছেড়ে চলে যেতে হবে? হ্যাঁ, যেতে হবে, দোষীদের যেতেই হয়।

মাহেশ হাঁটতে লাগল। হঠাৎ সব শূন্য লাগছে ওর। উৎসবের কলকাতায় এই শেষ বারের মতো হাঁটছে ও। সামনের একটা বাস থেকে হুড়মুড় করে কিছু মানুষজন নামল। তাদের একজনের সঙ্গে ধাক্কাও লাগল মহেশের। মহেশ তাকাল না। শুধু মানুষটার থেকে ভেসে আসা ‘সরি’র পরিবর্তে বলল, “নো প্রবলেম”।

আর কোনও প্রবলেম নেই জীবনে। ডেথ সলভস্ অল।

সাইমন : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল ন’টা আটত্রিশ

কাঁধের থেকে খসে পড়া ড্রইংহোল্ডারটা কোনওমতে ধরল সাইমন। আর একটু হলেই পড়ে যেত। অবশ্য লোকটার কোনও দোষ নেই। ধাক্কাটা লেগেছিল ওর নিজের তাড়াহুড়োর জন্যই। বাসের থেকে এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে নেমেছিল যে, খেয়াল করতে পারেনি। ভাগ্যিস ভদ্রলোক কিছু বলেননি।

পাশেই একটা বড় পানের দোকান। সেখানে তারস্বরে গান বাজছে রেডিয়োতে। হিমেশ রেশস্মিয়া এই সকালবেলাতেই ছড়িয়ে পড়ছে চারিপাশে। দোকানটার বড় আয়নায় মুখ দেখল সাইমন। গালে সামান্য দাড়ি বেড়েছে। অন্য দিন হলে না কামালেও চলত, কিন্তু আজ কামাতেই হবে। ক্যামাক স্ট্রিটে অ্যাডগ্ল্যাম কোম্পানিতে যেতে হবে। ওই কোম্পানির প্রপাইটর শতানিক বাসু ডেকেছেন ওকে। একটা সফট ড্রিঙ্কস্ কোম্পানির অ্যাড ক্যাম্পেনের কাজের জন্য প্রেজেন্টেশন লে-আউট তৈরি করার কথা ছিল। ভদ্রলোক একদম আনকোরা ছেলে খুঁজছিলেন। খবর পেয়ে যোগাযোগ করেছিল সাইমন। শতানিক ওকে অ্যাডভান্স হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি একটা লে-আউট করো। যদি পছন্দ হয়, ইউ উইল ডু ইট ফর মি। শোনো, গোটা ব্যাপারটা হবে অ্যানিমেশন বেসড। সিম্পল ইয়েট ফানি হবে। আর দেখো, তৈরি করাটা যেন কস্ট এফেক্টিভ হয়। বাইরে নিকি বসে রয়েছে, ইউ গেট দ্য ডিটেল ফ্রম হার।”

সাইমন জিজ্ঞেস করেছিল, “কবের মধ্যে আনব স্যার?”

শতানিক বলেছিলেন, “টোয়েন্টি ফোর্থ ডিসেম্বর আনবে। সকাল সাড়ে দশটা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে চলে আসবে এখানে। ডোন্ট বি লেট। আর হ্যাঁ, কম্পিউটার অ্যানিমেশন জানো?”

হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়েছিল সাইমন।

“ব্যস, তা হলে তো দারুণ। লে-আউট পছন্দ হলে, তুমি আমার এখানকার সেট-আপ-এ বসেই করে নেবে কাজটা। মাথায় রেখো, দিস প্রজেক্ট ইজ টু ইমপরট্যান্ট। এরকম কাজ রোজ রোজ পাওয়া যায় না। তা, বলো কত টাকা নেবে তুমি?”

একটু সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল সাইমন। কত নেবে ও? যদিও ওর একটা ধারণা আছে কেমন টাকাপয়সা নেওয়া হয়। তবু চিন্তা করেছিল একবার। এটা তো জাস্ট একটা প্রপোজালের মতো দিতে হবে সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের কোম্পানিটাকে। পরে ফাইনালাইজ হলে তো অনেক কাটাছেঁড়া হবে এর ওপর। এর জন্য কত আর দাম চাইবে এখন?

সাইমন জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, কাজটা যদি আপনারা পান, তা হলে আমায় দিয়ে কাজটা করাবেন তো?”

শতানিক হেসেছিলেন, “এটা কোনও প্রশ্ন হল? হ্যাঁ, বললাম তো তোমাকেই করতে হবে। আর কে করবে? বলো কত নেবে তুমি?”

সাইমন থেমে থেমে বলেছিল, “ওই স্যার… ইয়ে… আট হাজার।”

“আট হাজার?” ভুরু তুলে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন শতানিক। অস্বস্তি লাগছিল সাইমনের। এমনিতেই অমন কোট পরা, চুরুট চিবোনো মানুষটাকে দেখলেই পেটের ভেতর কেমন করে। আর সে যখন ওরকমভাবে তাকিয়ে থাকে, তখন তো অস্বস্তি হবেই। শতানিক হেসেছিলেন, বলেছিলেন, “ঠিক আছে, তাই হবে, বাট দ্যা জব শুড বি গুড। কেমন?”

“ঠিক আছে স্যার!” উঠে দাঁড়িয়েছিল সাইমন।

“ও, ওয়ান থিং, শতানিক হাত তুলেছিলেন, “এরকম শ্যাবি ড্রেসে এখানে এসো না। ওয়্যার সামথিং গুড অ্যান্ড গেট আ শেভ। পরের বার ভালভাবে আসবে। কেমন? নাও, মার্চ।”

আয়নায় মুখটা আবার দেখল সাইমন। ওর গায়ের লোমের ভাব কম। দাড়িও খুব বেশি ঘন নয়। তবু শ্যাওলার মতো থুতনিতে আর গালে একটু একটু লেগে রয়েছে। এটাকে কামাতে হবে এখন।

সাধারণত দশ টাকার একটা ছোট্ট রেজার দিয়ে বাড়িতেই দাড়ি কামিয়ে নেয় ও। কিন্তু ওর দেরি হয়ে গেছে খুব। বাড়ি যেতে গেলে আর ঠিক সময়ে অ্যাডগ্ল্যামে পৌঁছোতে পারবে না ও। এখানেই কোথাও দাড়ি কামিয়ে নিতে হবে ওকে। পানের দোকানের তাকে একটা ছোট্ট ঘড়ি রাখা আছে। ন’টা চল্লিশ বাজে। দাড়ি কামিয়ে বাস ধরবে সাইমন। সাড়ে দশটার মধ্যে ঠিক পৌঁছে যাবে।

দূরে একটা সেলুন দেখা যাচ্ছে! পা চালিয়ে সেখানে গেল সাইমন। তিনটে আয়নার সামনে তিনটে চেয়ার। আর তার প্রত্যেকটাতেই লোক বসে রয়েছে। পেছনের লম্বা বেঞ্চটায় আরও পাঁচ জন বসে রয়েছে। সাইমন বুঝল, এখানে দাড়ি কামাতে গেলে কালকে গিয়ে পৌঁছোবে ক্যামাক স্ট্রিটে। এখন কী করবে ও? কোথায় যাবে? এ-দিক ও-দিক দেখল সাইমন। কোথাও কোনও নাপিতের দোকান নেই আর। ও ভাবল তা হলে কি এভাবেই চলে যাবে? আসল তো হচ্ছে ওর কাজ। সেটা তো শেষ করেছে ও। দাড়ি কামানো, না কমানোর ওপর কী আসে যায়? কিন্তু পরক্ষণেই শতানিকের মুখটা মনে পড়ল সাইমনের। মনে পড়ল নিখুঁত আঁচড়ানো চুল, কামড়ে ধরা চুরুট, দামি সুট আর ওই ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি। লোকটা নিজে খুব নিখুঁত হয়ে থাকেন। ওঁর কথা অমান্য করা ঠিক হবে না একদম।

সাইমন এ-দিক ও-দিক তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগল। কোথাও তো পাবে একটা সেলুন। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল রাস্তার ধারের একটা বড় বটগাছের গোড়ায় একজন মানুষ ছোট্ট টিনের সুটকেস নিয়ে বসে রয়েছে। ও পা চালিয়ে এগিয়ে গেল সে দিকে। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছে ও। গাছের গোড়ায় বসে থাকা মানুষটিকেই খুঁজছিল ও।

সাইমন ভাল করে দেখল লোকটাকে। কাঁচা-পাকা চুল মানুষটার মাথায়। একটা চোখ নুড়ি পাথরের মতো ঘোলাটে। কিন্তু গোঁফটা ইয়াব্বড়। সাইমন ভাবল, এর কাছে দাড়ি কামাতে বসতে হবে? গালের সঙ্গে গলা নামিয়ে দেবে না তো? কিন্তু এর চেয়ে বেটার চয়েস কি আছে এই মুহুর্তে? সাইমন দেখল লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখেমুখে একটা চাপা প্রত্যাশা ও। ভাবল, ওর সানসাইন স্টুডিয়োর সামনে যখন কোনও লোক এসে দাঁড়ায়, ওর মুখটাও কি তখন অমন হয়ে ওঠে?

ও লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদু, দাড়ি কামাব, হবে?”

লোকটার ঘষা পাথরের চোখেও আলো জ্বলে উঠল, “হবে বাবু। বসুন।” সাইমন দেখল লোকটার সামনে একটা বড় ভাঙা ব্যাটারি উলটো করে রাখা আছে। ও বুঝল, এটাই বসার আসন। সাইমন, ক্লিপবোর্ডটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে বসে পড়ল ভাঙা ব্যাটারির ওপর। হঠাৎ হাসি পেল ওর। কোটি কোটি টাকার সফট ড্রিঙ্কস্‌ কোম্পানির জন্য যে অ্যাড লে-আউট করছে, সে ভাঙা ব্যাটারির ওপর বসে দাড়ি কামাচ্ছে। দেশ সত্যিই উন্নতি করছে। হাতির সঙ্গে মিলিয়ে দিচ্ছে পিঁপড়েকে। অন্ধ মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে টেলিস্কোপ। সফ্‌ট ড্রিঙ্কস্ খেতে গেলে যে-মানুষ দু’বার ভাবে, তাকে দিয়ে সেই সফট ড্রিঙ্কস্-এরই বিজ্ঞাপন আঁকাচ্ছে!

সাইমন জিজ্ঞেস করল, “দাদু, ব্লেডটা নতুন তো?”

লোকটা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ বাবু, নতুন। চিন্তা নেই। এখুনি হয়ে যাবে।”

ওই অদ্ভুত ঘষা চোখটার দিকে তাকিয়ে ও ভাবল চিন্তা নেই বললেই কি সব চিন্তার সমাধান হয়ে যায়? গালে সাবান লাগানোর সময় শরীরটা ঠান্ডায় শিরশির করে উঠল। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। উত্তর দিক থেকে লুঠেরার মতো হাওয়া হইহই করে ঢুকে পড়ছে কলকাতায়।

চোখ বন্ধ করল সাইমন। ভাবল, বোনটা কী করছে এখন? ওই ছোট্ট ঘরটায় শুয়ে কি ওর আসার প্রতীক্ষা করছে? যেতে কি পারবে সাইমন? আজ যদি ওর কাজ পছন্দ হয় শতানিকের, উনি আট হাজার টাকা দেবেন। যদিও তারপরও কয়েক দিন কাজ করে দিতে হবে, তবু আট হাজার টাকা বলে কথা। বোনের জন্য একটা ছোট এফ এম রেডিয়ো কিনে নিয়ে যাবে ও চাঁদনিতে দেখেছে। ষাট টাকা দাম। ছোট্ট দেশলাই বাক্সের মতো দেখতে। গায়ে দুটো সুইচ আছে। কানে হেডফোন দিয়ে শুনতে হয়। বোনটা সারাদিন একা একা শুয়ে থাকে বিছানায়। ওকে দিলে, ও শুনতে পারবে। বোনটার জন্য কিছুই করতে পারে না ও। মাঝে মাঝে ভাবে, সমস্ত জীবনটাই ওলট পালট হয়ে গেল ওর মায়ের জন্য। কে এমন সেই মানুষ যার জন্য সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে চলে যায় মা? এই কি প্রেম?

“হয়ে গেছে বাবু, দেখে নিন।” লোকটা ছোট্ট কাঠ বাঁধানো আয়না হাতে ধরিয়ে দিল সাইমনের। সাইমন আয়নায় দেখল নিজেকে। গালের শ্যাওলা পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুখটা আরও ফরসা লাগছে এখন। বোন দেখলে বলত বড়লোকের মতো লাগছে। ও টাকা মিটিয়ে বোর্ড নিয়ে উঠে পড়ল। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দাদু, কত সময় হল?”

লোকটা বাঁ কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখে বলল, “ন’টা পঞ্চাশ বাবু।”

ন’টা পঞ্চাশ! সর্বনাশ! সাইমন এ-দিক ও-দিক তাকাল। এখান থেকে ক্যামাক স্ট্রিটের উত্তর দিকের মোড়ে যাবার বাস পাবে কোনও? ও শুনেছে একটা নতুন বাস চালু হয়েছে আজকাল। এখন মাঝে মাঝেই নানা রকম বাস চালু হয় কলকাতায়! কত ফ্লাইওভার বাড়ছে কলকাতায়, ফলে অনেক নতুন নতুন রুট খুলছে। বাস যে বাড়বে, স্বাভাবিক!

সামনেই একটা বাস স্ট্যান্ড। সেখানেই গিয়ে দাঁড়াল সাইমন। এখানের থেকে কিছু একটা পেয়ে যাবে নিশ্চয়ই। সাইমন অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু তেমন কিছুই আসছে না। সাইমন ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হতে লাগল। শতানিক বাসু ওর শেষ লাইফ লাইন। এটাকে মিস করা যাবে না একদম। তা হলে বিপদ হবে। অসহায় বোনটাকে নিয়ে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। ও দেখল বাস আসছে একটা, কিন্তু এটা পার্ক স্ট্রিট মোড় অবধি যাবে। নিমেষে কর্তব্য স্থির করে নিল ও। তাই সই, সাইমন উঠে পড়ল বাসে। আর অপেক্ষা করা যাবে না। ও চায় না শতানিক বাসু ওর জন্য অপেক্ষা করুন।

একটা সিট জুটে গেল সাইমনের। বোর্ডটা কোলে নিয়ে বসে পড়ল ও। ভেতরে ভেতরে একটু টেনশন হচ্ছে ওর। রাত জেগে বিজ্ঞাপনের লে-আউটের কাজটা করেছে সাইমন। শতানিকের দেওয়া হাজার টাকার পরেও ওর নিজের পঞ্চাশ টাকার মতো রং, তুলি, আর কাগজের পেছনে বেরিয়ে গেছে। এখন কে জানে শতানিকের পছন্দ হবে কি না! মাঝে মাঝে সাইমন ভাবে কী দরকার ছিল ওর এই লাইনে আসার?

ছোটবেলা থেকেই একাচোরা থাকত সাইমন। ওদের অঞ্চলের কোনও বাচ্চাই ওর সঙ্গে বিশেষ মিশত না। বরং মাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলত ওকে। এমনকী পাড়ার বড়দেরও বলতে শুনেছে যে, ওর মা দারুণ ‘মাল’ ছিল। বড়রা আফশোস করে বলত যে, তাদের কপাল খারাপ যে, কেউ তারা ওর মাকে বিছানায় নিতে পারেনি। তাই এইসব নোংরামোর থেকে দূরে থাকার জন্য স্কুল ছুটির পরে, গ্রামের শেষে ভাঙা গড়ে, একা একাই যেত সাইমন। সেই শেষ বিকেল, সেই ভাঙাচোরা স্থাপত্য আর নির্জনতায় বসে নিজের মনে গোমরাত ও। এত কিছু বলার ছিল ওর, এত কিছু জানাবার ছিল অন্যদের, কিন্তু কেউ আমলই দিত না ওকে। এই রকমই এক বিকেলবেলা সেই নির্জন গড়ে বসে পেনসিল দিয়ে অঙ্ক খাতার পেছনে ছবি এঁকে ফেলেছিল সাইমন। এঁকেছিল, সূর্যাস্তের নীচে ভাঙা গড়ের মাথার ওপর শকুন উড়ছে। দু’দিনের পরে অঙ্ক স্যারের চোখে আঁকাটা পড়ে। টিফিনের সময় উনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন সাইমনকে। খুব ভয় হয়েছিল সাইমনের। ভেবেছিল, এবার নির্ঘাত মার খাবে ও। নিশ্চয়ই অঙ্ক ভুল করেছে। দুর্বল হাঁটু নিয়ে টিচার্স রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সাইমন। স্যার অঙ্ক খাতার শেষ পাতাটা খুলে ধরে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এটা তোমার আঁকা?”

ভয় পেয়ে সাইমন বলেছিল, “স্যার, আর আঁকব না আমি।”

স্যার হেসেছিলেন। বলেছিলেন, “না না অবশ্যই আঁকবে তুমি। একশো বার আঁকবে। আমি জানতে চাইছি এই ভাঙা গড়টার মাথায় তুমি শকুন উড়তে দেখেছ?”

এতক্ষণে সাহস এসেছিল সাইমনের। ও বলেছিল, “না দেখিনি, কিন্তু মনে হল তাই আঁকলাম।”

“কী মনে হল?” স্যার জানতে চেয়েছিলেন।

“মনে হল গড়টা তো মরে গেছে, শকুন উড়ছে তার মাথায়। রেল মাঠে মোষ মরে গেলে যেমন শকুন ওড়ে না স্যার? তেমন।”

স্যার বলেছিলেন, “দিস ইজ আর্ট। সবাই যা দেখছে, তুমিও সেটাই দেখছ, কিন্তু এমনভাবে যে, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। বুঝলে কিছু?”

“না স্যার।” মাথা নেড়েছিল সাইমন।

স্যার বলেছিলেন, “বোঝার দরকারও নেই। বরং বেশি বুঝলে তার দ্বারা আর বিশেষ কিছু হয় না। তুমি এঁকে যাও, যা খুশি আঁকো। আর মাঝে মাঝে আমায় দেখিও। কেমন?”

এর পরের দিনই স্যার ক্লিপবোর্ড, খাতা, পেনসিল আর রং কিনে এনে দিয়েছিলেন সাইমনকে। সে-দিন থেকে সাদা পৃষ্ঠাই হয়ে গিয়েছে সাইমনের পৃথিবী আর রং হয়ে উঠেছে ওর ঋতু। সেই অঙ্কের স্যার এখন কোথায় কে জানে? ও ক্লাস টেনে উঠতে উঠতেই স্যার স্কুল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ও বুঝতে পারে ওর ভেতরের আর্টিস্ট সাইমনকে জাগিয়ে গিয়েছিলেন উনিই।

“এই যে দাদা, টিকিটটা।” সাইমন মুখ তুলল। কনডাক্টর। বাঁ হাতের আঙুলের মধ্যে টাকাগুলোকে লম্বা করে ভাঁজ করে জড়িয়ে রেখেছে। আর বুড়ো আঙুল দিয়ে মুঠোয় ধরে থাকা টিকিটগুলোর মাথায় ঘষে ছিড়িক শব্দ করছে। সাইমন পকেট থেকে টাকা বের করে স্টপেজের নাম বলল। টিকিট দিয়ে কনডাক্টর ছিড়িক ছিড়িক করতে করতে অন্য দিকে চলে গেল।

জানলা দিয়ে দেখল সাইমন। ভবানীপুর। এখানেই তো থাকে ও। হঠাৎ ওর প্ল্যানেটোরিয়ামের কথা মনে পড়ে গেল। বাড়িওলা বলেছে একত্রিশ তারিখের মধ্যে গত কয়েক মাসের ভাড়া বাবদ দু’হাজার টাকা দিতে হবে। ও জানে এর পেছনে দোতলার ওই মোহন সেন লোকটার উসকানি আছে। লোকটা একটা আস্ত শয়তান। কত বয়স হবে? তিরিশ, একত্রিশ, কিন্তু এর মধ্যে লোকটার ভেতরটা পচে গেছে। লোকটা বাড়িওলাকে বুঝিয়েছে যে, সাইমন উঠে গেলে কোম্পানিকে বলে অনেক বেশি টাকায় ওপরের ওই ঘরটা ভাড়া নিয়ে নেবে ও। আর শুধু তাই নয়, ঘরটা মেরামত করে ছাদ ঢালাইও করে দেবে। এটাকে নাকি ও গেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করবে। সেই থেকে ওর পেছনে পড়ে আছে বাড়িওলা।

অবশ্য সাইমন জানে ওসব গেস্টরুম, ছাদ ঢালাই সব ঢপের কেত্তন। ওকে বের করে দেবার জন্যই এইসব করছে মোহন সেন। ও চলে গেলে ওই বদমাশটা মোটেও আর ওই শতছিন্ন চিলেকোঠা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। কেন মোহন সেন সাইমনকে তাড়াতে চায়? এ-রহস্য কেবলমাত্র সাইমন জানে।

রাত জেগে ছবি আঁকার সময় প্রায়ই দোতলায় হুটোপাটি, চিৎকার আর চাপা কান্না শুনত ও। বিরক্ত লাগলেও তেমন আমল দিত না সাইমন। ভাবত অন্যের ব্যাপারে নাক না গলানোই ভাল। কিন্তু এক রাতে ব্যাপারটা চরমে ওঠে। সেই চিৎকার আর কান্নাটা মাত্রা ছাড়িয়ে উপচে পড়ছিল চারিদিকে। তার সঙ্গে অদ্ভুত ভোঁতা শব্দও আসছিল মাঝে মাঝে। সাইমন রং-তুলি ছেড়ে চুপ করে বসেছিল। মাথার ভেতরে টোকা মারছিল রাগ। কাঁহাতক আর রোজ রাতে এই বউ পেটানোর চিৎকার সহ্য করা যায়!

হঠাৎ সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ একটা শব্দ বেয়ে উঠছিল ওপরে। তার সঙ্গে ‘বাবা গো বাঁচাও’ বলে চিৎকার আসছিল নারী কণ্ঠে। চেয়ার ছেড়ে উঠে হাতের পাশের বড় স্টিলের স্কেলটা নিয়ে ছাদে বেরিয়ে এসেছিল সাইমন। রাতের আবছা অন্ধকারে ও দেখেছিল নাইটি পরা শ্রেয়াবউদি কুঁকড়ে বসে আছে ছাদের মেঝেতে আর মোহন সেন চিৎকার করে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে এলোপাথাড়ি লাথি মারছে তাকে। এই দৃশ্যের সামনে আর রাগ সামলাতে পারেনি সাইমন। সোজা গিয়ে ধাক্কা মেরে মোহন সেনকে ফেলে দিয়েছিল মেঝেতে তারপর হাতের স্কেল দিয়ে বেধড়ক মার দিয়েছিল। মার খেয়ে নীচে পালাতে পালাতে মোহন বলেছিল, “শুয়োরের বাচ্চা দেখে নেব তোকে।”

সাইমন পালটা বলেছিল, “পোঁদে বাঁশ দিয়ে শহিদ মিনারে টাঙিয়ে দেব তোমায়। বউ পেটাচ্ছ? পুলিশকে বললে আস্ত নারকোল গাছ পেছন দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে। ফারদার যদি নোংরামো করো বাঞ্চোত, বুঝিয়ে ছাড়ব সাইমন রুপেন মণ্ডল কে?”

সেদিন অতগুলো কথা কীভাবে বলেছিল আজও ভাবলে অবাক লাগে সাইমনের। হয়তো সারাজীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, কষ্টগুলোই বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। মোহনকে পেটানোর পর অদ্ভুত এক শান্তি পেয়েছিল সাইমন। এখন ও বোঝে মানুষের ভেতরের হিংস্র প্রাণীটা মাঝে মাঝে মারামারি করতে চায়। আহার, নিদ্রা, মৈথুনের মতো লড়াইটাও, অপ্রিয় হলেও মানুষের জান্তবতার প্রমাণ। জানলা দিয়ে মাথা নিচু করে দেওয়ালে বিশ্বশান্তির পোস্টার দেখল সাইমন। হাস্যকর! জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যুদ্ধ ছাড়া গতি নেই আর মৃত্যু ছাড়া শান্তি নেই কোথাও।

সেই ঘটনাটা নিয়ে মোহন সেন হইচই করেনি একদম। কারণ ও বুঝেছিল যে, এতে ওর নিজের বিপদটাই বেশি হবে। কিন্তু ও অন্য একটা পন্থা ধরেছিল। বাড়িওলাকে ক্রমান্বয়ে তাতাচ্ছিল সাইমনকে তুলে দেবার জন্য। এত দিনে মওকা পেয়েছে। আর মাত্র সাতটা দিন সময় আছে। তার মধ্যে দু’হাজার টাকা দিতে না পারলে ওকে বের করে দেওয়া হবে রাস্তায়। জিতে যাবে বউ-পেটানো মোহন সেন।

পার্ক স্ট্রিটে নেমেই একজনকে সময় জিজ্ঞেস করল সাইমন। দশটা পঁচিশ। ও প্রাণপণে হাঁটতে লাগল। এই রাস্তাটা সবসময়ই কেমন স্যাঁতস্যাঁতে থাকে। চারিদিকে বড় বড় বাড়িঘরের মধ্যে কেমন ড্যাম্প ধরা রাস্তা একটা। ফুটপাথে বেশ ভিড়। তার মধ্যে দিয়ে দ্রুত পা চালাতে লাগল সাইমন। ঠিক সময়ে পৌঁছোতে না পারলে খুব খারাপ ইমপ্রেশন পড়বে।

পার্ক স্ট্রিট থেকে ক্যামাক স্ট্রিটে ঢুকেই কয়েকটা বাড়ি পরে অ্যাডগ্ল্যাম। সেখানে যখন পা দিল সাইমন তখন দশটা পঁয়ত্রিশ বাজে। সামনের রিসেপশনে আজ একটা নতুন মেয়ে বসে রয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলল সাইমন। বলল, “মিস্টার শতানিক বাসুর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আমার।”

মেয়েটা সুরেলা ইংরেজি তুলল গলায়, “জাস্ট আ সেকেন্ড প্লিজ।” তারপর পাশে রাখা ইন্টারকমটা তুলে সাইমনের উপস্থিতি জানিয়ে দিল শতানিককে। শতানিকের উত্তর শুনে ফোনটা নামিয়ে রাখল মেয়েটা, তারপর সাইমনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ মে গো ইনসাইড, মিস্টার বাসু ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল সাইমন। চকচকে কাঠের টেবিলের ও-পাশে বসে রয়েছেন শতানিক। আজও জামাকাপড় নিখুঁত। চুল পাট করে আঁচড়ানো। দাঁতে কামড়ে ধরা চুরুট। সাইমনকে হাত দিয়ে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন উনি। সাইমন সংকুচিত হয়ে বসল। শতানিক হাত বাড়ালেন, “দেখি।”

ড্রইংহোল্ডারটা খুলে একটা রোল বের করল সাইমন, তারপর এগিয়ে দিল শতানিকের দিকে। শতানিক টেবিলের ওপর জায়গা করে ড্রইংগুলো খুললেন, “এ কী! এ কী করেছ?”

সাইমন বুঝতে পারল না ঠিক, “কেন স্যার?”

“এ তো স্কেচ। ফাইনাল জিনিস কই?”

“স্যার স্কেচই তো করব। কনসেপ্টটা তো এতেই আছে, এইবার গোটা ব্যাপারটাকে কম্পিউটারে বসে অ্যানিমেশনে ট্রান্সফার করে দেব।”

“সে কী, তোমায় তো আমি সম্পূর্ণটা পেপারে করে দিতে বলেছিলাম। বলেছিলাম এজন্য তোমায় দু’হাজার টাকা দেব।”

“দু’হাজার?” সাইমনের মুখ হাঁ হয়ে গেল।

“হ্যাঁ। না তো কি দু’ লক্ষ নাকি? এসব কী করেছ তুমি?”

“স্যার, আপনি তো জিজ্ঞেস করেছিলেন আমায় যে, আমি কম্পিউটারে অ্যানিমেশন জানি কি না।”

“অ্যানিমেশন? আমি বলেছিলাম?”

“হ্যাঁ স্যার, বললেন এখানকার সেট-আপ-এ বসে কাজ করতে হবে। আট হাজার টাকা দেবেন পুরো কাজটা করে দিলে।”

“আর ইউ ড্রিমিং অর হোয়াট? শোনো, এই কাজের জন্য দু’হাজার দিতে পারি আমি। ইউ ডু ওয়ান থিং, এগুলো রেখে যাও। টাকাটা দিয়ে দিচ্ছি আমি।”

সাইমন উত্তর না দিয়ে শতানিকের সামনে বিছানো ড্রইংগুলো টেনে নিল নিজের দিকে। তারপর গোল করে গুটিয়ে ভরে নিল ড্রইংহোল্ডারে। এগুলো রেখে যাওয়ার মানে তো গোটা কাজটাই করে দেওয়া। এরপর যে কেউ তো এই কাজটাকে অ্যানিমেট করে দেবে।

শতানিক বললেন, “ভেবে দেখো কী করবে। বড়জোর টোয়েন্টি সিক্সথ অবধি সময় দেব আমি। যদি মত পালটাও তা হলে এসো। বাট টু থাউজেন্ড ইট ইজ। নট আ পেনি মোর।”

একটা রাগ দপদপ করছে সাইমনের মাথায়। মাথা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। এটা সুট-পরা জানোয়ার একটা। সবাই মিলে কী পেয়েছে এরা? যা খুশি তাই করবে? গ্রামে জেঠু জেঠিমা, বাড়িতে মোহন সেন, এখানে শতানিক বাসু, সব কি শয়তানের ঔরসজাত? কেন এরা করে এমন? ও কী করবে? একত্রিশ তারিখের মধ্যে বাড়িওয়ালাকে টাকা জমা দিতে হবে। এখানে যে-টাকার কথা বলছে তাতে সেটা হলেও, তারপর? বোনটার জন্য বাড়িতে কী পাঠাবে? পরের মাসের বাড়িভাড়া কী করে দেবে? সারামাসটা কী খাবে ও? তা ছাড়া কথার খেলাপ করে কম টাকায় কাজ করতে রাজি হবে কেন? সম্মান বলে কি জীবনে কিছু নেই? সব জায়গায় কি মাথা নামিয়ে বাঁচতে হবে?

রাস্তায় এসে দাঁড়াল সাইমন। হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে মাথার চুল। রোদ মিটিমিটি হাসছে ওর অবস্থা দেখে।

দূরে বড় একটা দোকানের বাইরে দু’জন মানুষ সান্টাক্লজ সেজে দাঁড়িয়ে নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে। সাইমন ছোটবেলায় শুনত সান্টাক্লজ, ক্রিসমাসের আগে সবার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে নেমে আসে সাধারণ মানুষের মধ্যে। অন্য মানুষদের কথা জানে না কিন্তু ওর জন্য কোনও স্যান্টাক্লজ কোনওদিন নেমে আসেনি। ওর মা ফিরে আসেনি, বাবা মুক্ত হতে পারেনি বিষণ্ণতা থেকে, বোন কোনওদিন খাট থেকে নেমে আসতে পারেনি এক মাঠ প্রজাপতির মধ্যে। স্যান্টাক্লজ চিরকাল গল্পের বইয়ের পাতায়, টেলিভিশনের স্ক্রিনে আর বড় দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে রইল। বোনটা কী করছে এখন? ওর জন্য খাটের মধ্যে জড় বস্তুর মতো শুয়ে অপেক্ষা করছে? কী ভাবছে বোন? সাইমন কি জাদুদণ্ড নিয়ে এসে আমূল বদলে দেবে ওদের এই ভাঙাচোরা জীবনটাকে! কী ক্ষমতা আছে ওর? এই কলকাতা শহরে কে ও?

ও, সাইমন রুপেন মন্ডল, শিল্পী। শিল্পী না ভিখিরি? ভিক্ষে দিতে চান শতানিক বাসু? ও দেখল শতানিক বাসু অফিস থেকে বেরিয়ে এসে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের গাড়ির দিকে।

শতানিক: ২৪ ডিসেম্বর, সকাল পৌনে এগারোটা

গাড়ির দরজাটা খুলে একবার ফুটপাথে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে তাকাল শতানিক। ফরসা ছেলেটার মুখচোখ লাল হয়ে আছে। হওয়ারই কথা, মনে মনে হাসল ও, যা প্যাঁচ দিয়েছে। হুঁঃ, আট হাজার টাকা? ওর বাবা কোনওদিন অত টাকা দেখেছে একসঙ্গে? চাইলেই হল, না? অমনি যেন টাকাটা দিয়ে দেবে ও! টাকা যেন খোলামকুচি, যেন বাড়ির দেওয়ালের নয়নতারা। শালা, মনে মনে গাল দিল শতানিক।

তবে একটা ব্যাপার ঠিক। ছেলেটার হাতের কাজ ভাল। যথেষ্ট ভাল কাজটা করেছে ও। কিন্তু তা হলেও কি ওর কথা মানা যায় নাকি? এ পৃথিবীতে একটা জিনিসই চলে। তা হল অর্থ। যার হাতে অর্থের পরিমাণ বেশি, তার জোর, প্রতিপত্তি, সব বেশি। মানি কন্ট্রোলস। এই সাইমন ছেলেটাকে দেখেই একটা হা-ঘরের ছেলে মনে হয়। শতানিক তো দু’হাজার বেশি বলেছে। ওর তো হাজার টাকা বলার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার পরে মন বদলায়। যদিও হাতে সময় কম, তা হলেও ও জানে ছেলেটা ফিরে আসবে। এদের কাছে দু’হাজার টাকাও কম নয়।

গাড়ির মধ্যে বসে রিয়ার-ভিউ-মিররে আবার ছেলেটাকে দেখল শতানিক। মুখটা এখনও লাল হয়ে আছে। ও বুঝল, দু’হাজার টাকাটা কম হলেও, সেটার লোভও ছাড়তে পারছে না সাইমন। কাম অন, নিজের মনে বলল ও, ছাব্বিশ তারিখ রোববার এসো অফিসে। হ্যাঁ, রোববার অফিস খোলা রাখে শতানিক।

ও গাড়িটা স্টার্ট করল। এবার একবার রাসবিহারী মোড়ে যেতে হবে। ওর ডেনটিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। দাঁতে সুড়ঙ্গ কাটছে জীবাণু। গাড়িটা নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকল শতানিক। সামনের দিনটার কথা ভেবে মনে মনে এক্সাইটেড হল ও। ডেনটিস্টের ওখানে আধ ঘণ্টার মতো কাজ আছে। তারপর ও যাবে এক্সাইড মোড়ে। মেহের বলে একটা মেয়ে অপেক্ষা করছে। ওয়ান্নাবি মডেল। ইজি প্রে। নিজের মনে হাসল শতানিক। দারুণ ফিগার মেয়েটার, গ্রেট বুব্‌স। আজ মেয়েটার সঙ্গে সেটিং করবে ও। উত্তেজিত হয়ে উঠল একটু। গাড়ি চালাতে চালাতেই কোটের পকেটে হাত দিল শতানিক। ছোট্ট কৌটোটা আছে তো? আছে। খুব দামি ওষুধ। বিদেশ থেকে আনানো সেক্সুয়াল পোটেন্সি বাড়ায়। মেহের উইল ফিল ইট টুডে।

মেয়েটা একটু বোকাটে ধরনের। একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। শতানিকের অ্যাড এজেন্সি আছে শুনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, “এই যে আমার প্রোফাইল আছে এতে, একটু দেখবেন?”

“শিয়োর।” বলে হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নিয়েছিল শতানিক। মেয়েটা দুর্দান্ত সুন্দরী, ও ভেবেছিল দেখা যাক এর ছবি কেমন ওঠে। ফাইলটা খুলে কিছুক্ষণ ছবিগুলো দেখেছিল শতানিক। সবই সাদামাটা ছবি। তবে মেয়েটা সুন্দরী বলেই উতরে গেছে। ও বলেছিল, “দেখো, এসব দিয়ে কিন্তু হবে না। এতে সেই পাঞ্চটা নেই। জানো তো এখনকার মেয়েরা অনেক বোল্ড। অনেক সাহসী ছবি তোলে তারা। তোমার একটা ড্রেসও অফ-শোল্ডার নয়। সব কটার লেন্থ হাঁটুর নীচে। ইউ মাস্ট প্রেজেন্ট ইওরসেল্ফ ইন আ স্টাইল। আর একটা সমস্যা আছে, এতে তোমার ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্সটা লেখা নেই। সেটা তো লিখতে হবে।”

মেয়েটার মুখটা লাল হয়েছিল সামান্য। ও জিজ্ঞেস করেছিল, “ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্সটা দিতে হবে?”

“বাঃ, দেবে না? সেটা তো মেজর পয়েন্ট একটা। তা কত তোমার মাপ?”

মেহের ঠোঁট কামড়ে বসেছিল খানিকক্ষণ। শতানিক মনে মনে বলেছিল, চৌত্রিশ, আঠাশ, ছত্রিশ। মেহের বলেছিল, “চৌত্রিশ, উনত্রিশ, ছত্রিশ।”

“উনত্রিশ?” ভুরু তুলেছিল শতানিক, “এটা কমাতে হবে। এখনও সবাই ‘আওয়ার গ্লাস’ ফিগার খোঁজে। ইউ শুড জয়েন আ জিম। ঠিক আছে, আমি বলে দেব। আমার চেনাশুনো জিম আছে কয়েকটা।”

মেহের কৃতজ্ঞ হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে, বলেছিল, “থ্যাঙ্ক ইউ। আর কী করতে হবে।”

পকেট থেকে চুরুট বের করে মুখে দিয়েছিল শতানিক, তারপর বলেছিল, “একটা এক্সক্লসিভ ফোটো শুট করতে হবে। না, এসব হাবিজাবি ড্রেসে নয়। সুইমওয়্যারে।”

“মানে বিকিনি?” একটু থমকে গিয়েছিল মেহের।

“এনি অবজেকশন? দেখো, এইসব মিডলক্লাসনেস বাদ দাও। ইউ হ্যাভ আ গুড ফিগার। ফ্লন্ট ইট। আর এটা তো পার্ট অব ইয়োর জব। এর মানে তো এই নয় যে, তোমায় সুইমওয়্যারে দেখে লোকে তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। উই আর অল প্রফেশনালস হিয়ার। আমাদের ন্যুড শুটও করতে হয়। ইটস অল ইন বিজনেস মাই ডিয়ার। ডোন্ট গেট স্কেয়ারড। আসলে তোমার জন্য একটা প্ল্যান এসেছে মাথায়। তাই এই শুটটা জরুরি।”

“প্ল্যান?” এগিয়ে বসেছিল মেহের, “কী রকম?”

“আমার হাতে একটা ভীষণ বড় ক্যাম্পেন আছে। একটা সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের। সেটা নিয়েই একটা আইডিয়া আছে আমার!” সরাসরি মেহেরের বুকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল শতানিক। ও লক্ষ করছিল, মেহেরের চাপা গেঞ্জির ওপর দিয়ে জেগে উঠেছে স্তনবৃন্ত। মনে মনে হেসেছিল শতানিক, মেয়েটা ভেতরে ভেতরে এক্সাইটেড হয়ে উঠেছে।

মেহের জিজ্ঞেস করেছিল, “কী আইডিয়া?”

“এই অ্যাড ফিল্‌মে বলিউড থেকে একজন নামকরা নায়িকাকে আমরা সাইন করছি। ভাবছি তোমাকেও নিই। একদম প্যারালাল ইমপরট্যান্স। আসলে তোমার লুকসটা এখানে ভাইটাল। পুরোটাই শুট হবে ক্যারাবিয়ানসে। সান, স্যান্ড অ্যান্ড সার্ফ। বিচ শুটিং। বিকিনি তো পরতেই হবে। তাই যদি একটা ফটো শুট আমরা ওইরকম টু-পিসে না করি, তা হলে বুঝব কী করে যে, তোমায় মানাচ্ছে কি না? আমার মুখের কথায় তো সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের কর্তারা তোমায় নেবে না। এখন ইউ ডিসাইড। কী করবে?”

শতানিক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল। অপেক্ষা করছিল মেয়েটাকে চিন্তা করতে দিয়ে। মনে মনে হাসি পাচ্ছিল ওর। বলিউড? ক্যারাবিয়ানস? সান, স্যান্ড অ্যান্ড সার্ফ? নিজের মিথ্যে বলার পারদর্শিতায় নিজেই চমকে উঠছিল। ক্যাম্পেনটার কিছুই হয়নি আর ও অতগুলো কথা বলে দিল? অবশ্য নিরুপায় ছিল শতানিক। মেহেরের গেঞ্জির ভেতরে ওই দুটো মাখনের তাল খুব টানছিল ওকে। আসলে যৌনতা আর টাকা, এই দুটোই শতানিকের দুর্বলতা। ও ভাবছিল মেয়েটাকে বিছানায় নিয়ে যাবার পথ অনেকটা মসৃণ হয়ে গেছে।

মেহের মাথা তুলেছিল এবার, বলেছিল, “ওকে, আমি রাজি। কবে তুলতে হবে ছবি?”

“কবে?” ছদ্মচিন্তার ভান করেছিল শতানিক। তারপর বলেছিল, “দেখো, আমায় একটু ফিক্সচারটা দেখে নিতে দাও। এক কাজ করো, চব্বিশে ডিসেম্বর, এই বারোটা নাগাদ এক্সাইড মোড়ে যে বড় রেস্টুরেন্টটা আছে, তাতে আসতে পারবে? আই উইল মিট ইউ দেয়ার। সেখানেই আমি তোমায় ডেটটা জানিয়ে দিতে পারব আশা করছি। তবে আমাকে তার আগে অন্যান্যদের সঙ্গেও একটু কথা বলতে হবে। আমি বললেই তো সবসময় ক্লায়েন্ট মেনে নেবে এমন নয়।”

“মানে? নাও হতে পারে?” মেহেরের মুখের আলোটা নিভে গিয়েছিল একটু।

মনে মনে হেসেছিল শতানিক। এটা ওর পুরনো ট্যাকটিক্স। সবসময় অন্যকে দোলাচলে রাখতে হয়। কক্ষণও তাদের কামফর্ট জোনে যেতে দিতে নেই। কর্পোরেট দুনিয়ার এই হচ্ছে নিয়ম। তুমি দেবে কি দেবে না, সেটা শেষ অবধি বুঝতে দিয়ো না প্রতিপক্ষকে। ও জানত যে, চব্বিশ তারিখে দেখা করে, সেই দিনটা ফটোশুট করতে হবে বলে ও চাপ দেবে মেহেরকে। বলবে, না হলে চান্স মিস করবে মেহের। ও জানে ‘সফল হতে হবে’ এই লোভটা নতুনদের দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেয়। ও বোঝে মেহের আচমকা পাওয়া এই প্রস্তাব ফেরাতে পারবে না। মেহেরকে নিয়ে মৌলালির কাছে ওর খালি ফ্ল্যাটটায় যাবে ও। তারপর, হি উইল টেস্ট দোজ গ্রেট বুব্‌স।

নিজের মনেই হাসল শতানিক। ও বরাবর স্মুথ-টকার। মেয়েদের বিছানায় নিয়ে যেতে কোনও সমস্যাই হয় না ওর। সেই এগারো ক্লাসে পড়ার সময় মায়ের বান্ধবী থেকে শুরু করে কলেজ লাইফে ওদের মিসেস সেনগুপ্তা, কেমিস্ট্রি টিচার, সবার সঙ্গে বিছানায় গিয়েছে ও। মিসেস সেনগুপ্তার ব্যাপারটা তো কলেজে কয়েক জন বন্ধুকেও বলেছিল ও। প্রমাণ স্বরূপ দেখিয়েছিল লুকিয়ে নিয়ে আসা মিসেস সেনগুপ্তার পারপ্‌ল কালারের প্যান্টি। বন্ধুরা ওর নাম রেখেছিল, স্যাটানিক।

তবে মেহেরকে চারটের মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে। কারণ তারপর ওকে যেতে হবে মিস্টার মোহন সেনের সঙ্গে দেখা করতে। বিশেষ বয়স না লোকটার কিন্তু এরই মধ্যে উন্নত প্রজাতির খচ্চর হয়ে উঠেছে। ওর সঙ্গে সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের এই ক্যাম্পেনটা নিয়ে একটা বন্দোবস্ত করেছে ও। এই ক্যাম্পেনে অ্যাডগ্ল্যামের প্রতিপক্ষ হিসেবে আছে বিটা অ্যাড। শতানিক জানে প্রাইস এখানে একটা ফ্যাক্টর হলেও, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে কনসেপ্ট। ক্লায়েন্ট তিন জনের একটা রিভিউ বোর্ড তৈরি করেছে। তারাই দু’পক্ষের অ্যাড ক্যাম্পেনটা স্ক্রুটিনি করবে। মোহন সেন এ-সবের কো-অর্ডিনেটর। ও বলেছে, বোর্ডের দু’জন মেম্বারকে হাত করতে পারলেই নাকি কাজ পেয়ে যাবে শতানিক। তবে তার জন্য আড়াই লাখ টাকা লাগবে। এর মধ্যে বোর্ডের দু’জন কত নেবে আর মোহন সেন নিজে কত নেবে সেটা বলেনি। যেমন, মোহন সেন ওকে ‘ঘুষ’ কথাটাও বলেনি, বলেছিল, “এটা সার্ভিস চার্জ মাত্র।”

সেই সার্ভিস চার্জের একটা অ্যাডভান্স, পঞ্চাশ হাজার টাকা, আজকে তুলে দিতে হবে মোহন সেনের হাতে। লোকটা নাকি আজ ছুটি নিয়েছে অফিস। শুধু শতানিকের সঙ্গে দেখা করার জন্যই বাড়ি থেকে বেরোবে আজ। আসলে এর আগে একদিন টাকাটা দেবার কথা ছিল, কিন্তু শতানিক দেয়নি, ঘুরিয়েছে। মোহন সেন বলেছে আজ টাকা না পেলে নাকি এই ক্যাম্পেনটা লুজ করবে ও। বোর্ডের দু’জন নাকি রেগে গেছে খুব। শতানিক তাই চান্স নেবে না আর। মোহন সেন পার্ক স্ট্রিটের ম্যাগসে আসবে। সেখানে টাকাটা দিয়ে দেবে ওকে। এই কাজটা ওর চাই।

ও আজ সকালবেলায় একবার বিটা অ্যাড-এ ফোন করেছিল। ও চাইছিল ওদের অহন রয়ের সঙ্গে কথা বলে একবার। ফোনটা তুলেছিলেন প্রতুলবাবু। লোকটাকে দু’-একবার দেখেছিল শতানিক। বুড়ো, খেঁকুরে ধরনের চেহারা। ওর ইচ্ছে ছিল অহনকে এই কাজটা নিয়ে একটা প্রস্তাব দেওয়ার। কিন্তু প্রতুলবাবু ফোন ধরায়, ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছিল। প্রতুলবাবুকে ম্যানেজ করলে কেমন হয়? ও তাই ভণিতা না করে সরাসরি বলেছিল, “আমি আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে একটু দেখা করতে চাই।”

“আমার সঙ্গে?” অবাক হয়েছিলেন প্রতুলবাবু।

“হ্যাঁ, ওই অ্যাড ক্যাম্পেনটার ব্যাপারে। আমার একটা প্রস্তাব আছে। আপনার জন্য। শুনলে আপনি আগ্রহ বোধ করতে পারেন।”

টেলিফোনের ওপারটা নিস্তব্ধ হয়েছিল খানিকক্ষণ। তারপর প্রতুলবাবু বলেছিলেন, “আমি কোনওরকম আগ্রহই বোধ করছি না। এবং করবও না। আপনি ভুল জায়গায়, ভুল লোককে, ভুল প্রস্তাব দিচ্ছেন।”

একটু দমে গিয়েছিল শতানিক, ব্যাক ফায়ার করেছে ওর চালটা। লোকটা অমন নয় তা হলে। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটাকে সামাল দিতে ও বলেছিল, “আপনি ভুল বুঝছেন আমায়। আমার প্রস্তাবটা হল এই, যে, এই ক্যাম্পেনটা আপনারা আমার জন্য ছেড়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনাদের অন্য একটা কাজ পাইয়ে দেব আমি। আর জে গ্রুপ, নতুন একটা সুটিং-শার্টিং লঞ্চ করবে বাজারে। সেটার অ্যাড ক্যাম্পেন আপনাদের বন্দোবস্ত করে দেব। জাস্ট এখান থেকে শুধু শেষ মুহুর্তে সরে দাঁড়ান আপনারা।”

প্রতুলবাবু একই রকম গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “অহন এখনও অফিসে আসেননি। ও এলে ওর সঙ্গে কথা বলবেন আপনি। আয়াম নট দ্য ডিসিশন মেকার হিয়ার।”

শতানিক বলেছিল, “মিস্টার রয় এলে আমাকে একটা ফোন করতে বলবেন কাইন্ডলি?”

“বলব।” সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিলেন প্রতুলবাবু।

কিন্তু অহন রয় ফোন করেনি। অহন রয়ের সঙ্গে আলাপ আছে শতানিকের। অহনের বয়স বছর তিরিশেক কিন্তু দেখলে আরও ইয়ং মনে হয়। লোকটাকে কেমন ভিতু বলে মনে হয়েছে ওর। ভিতু আর একটু মুখচোরা। পার্টিতে দেখলে মনে হয়, যেন আসার ইচ্ছে পর্যন্ত নেই এসব জায়গায়। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে যেন আনা হয়েছে ওকে। পার্টিতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ কোল্ড ড্রিঙ্কে চুমুক দেয় লোকটা। এমন ঠান্ডা, ম্যাদামারা লোক কী করে ব্যাবসা সামলায় কে জানে?

দশটা তিরিশ নাগাদ আবার ফোন করেছিল শতানিক। ভেবেছিল অহন রয়কে ম্যানেজ করতে পারলে আড়াই লাখ টাকা বেঁচে যাবে ওর। ফোনটা এবার একটা পিয়োন গোছের লোক ধরেছিল। শতানিক নিজের পরিচয় দিয়ে চেয়েছিল অহনকে। কিছুক্ষণ পরে ফোন ধরেছিল অহন রয়।

“মিষ্টার রয় বলছেন? আমি অ্যাডগ্ল্যামার থেকে শতানিক বসু বলছি।”

“হ্যাঁ বলুন।” শতানিকের মনে হয়েছিল অহনের কিশোর গলায় নার্ভাসনেস আছে একটা।

ও বলেছিল, “আয়াম ডাইরেক্টলি কামিং টু দ্য পয়েন্ট। আমি আপনাকে সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের ক্যাম্পেন সম্বন্ধে একটা অফার দিতে চাই। ভেরি সিম্পল ইয়েট প্রফিটেবল অফার।”

“কী অফার?” অহন জানতে চেয়েছিল।

প্রতুলবাবুকে বলা কথাগুলোই আবার অহনের কাছে আরও গুছিয়ে বলেছিল শতানিক। সব শুনে একটু থমকে গিয়েছিল অহন। মনে মনে সময় গুনছিল শতানিক। ভাবছিল অহন কি টোপটা গিলল? টেলিফোনের প্রধান সমস্যা হল অন্যের মুখ দেখা যায় না। শতানিক ভাবছিল, অহনের মুখটা দেখতে পেলে ভাল হয়। মুখোমুখি কথা বলা সব সময়ই প্রফিটেবল। নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা শুরু করেছিল অহন, “আর জে গ্রুপ? সেটা কী? নাম শুনিনি তো কোনওদিন।”

একটু থমকে গিয়েছিল শতানিক। ঘটনাটা ঠিক। এমন কোনও গ্রুপ নেই। এই রে, ওর মিথ্যেটা কি ধরে ফেলল অহন? মিথ্যেটাকে সামলাতে ও বলেছিল, “এটা পঞ্জাবের নতুন গ্রুপ অব কোম্পানিজ। এন আর আই-দের টাকাও আছে এখানে। দে আর কামিং ইন আওয়ার কান্ট্রি ইন আ ভেরি বিগ ওয়ে। আপনি মাসখানেকের মধ্যেই ওদের কথা শুনবেন। আর শুধু আপনি কেন? সবাই শুনবে। এখন আপনি রাজি থাকলেই হয়। উই ক্যান অল হ্যাভ আওয়ার শেয়ার অব মিট।”

“না মিস্টার বাসু, আমি এটা পারব না। সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের ক্যাম্পেনটা পেতে আমরা ট্রাই করব।”

শতানিক শেষ চেষ্টা করেছিল, “শুনুন মিস্টার রয়, আমি জানি আপনার মনে হচ্ছে ভবিষ্যতের কাজের আশায় আপনি এখনকার কাজ ছাড়বেন কেন! আমি হলেও এরকমই ভাবতাম। আপনি আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র হলেও আই রেসপেক্ট ইয়োর থট, ইয়োর লজিক। আমিও আপনার সমস্যাটা বুঝি। তাই এ ব্যাপারে আমার একটা লেভেল টু প্রস্তাব আছে। হুইচ, অ্যাকর্ডিং টু মি, ইজ হাইলি এনটাইসিং অ্যান্ড হার্ড টু রেজিস্ট। আমি হলে তো অ্যাকসেপ্টই করে নিতাম।”

অহন জিজ্ঞেস করেছিল, “কী বলতে চাইছেন?”

একটা পজ নিয়েছিল শতানিক। তারপর নাটকীয়ভাবে বলেছিল, “ওয়ান ল্যাখ। এক লক্ষ টাকা। আপনি এই ক্যাম্পেন থেকে নিজেকে উইথড্র করে নিন আপনাকে এক লক্ষ টাকা দেব আমি। বুঝতে পারছেন তো? কোনও কাজ না করে প্রফিট? হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক অ্যাবাউট দ্যাট?”

অহন এক মুহূর্ত সময় নেয়নি আর “নো থ্যাঙ্কস” বলে অত্যন্ত অনাটকীয়ভাবে কেটে দিয়েছিল লাইনটা। যান্ত্রিক টুঁ টুঁ শব্দটা মাথায় এসে ধাক্কা মারছিল শতানিকের। ও ভেবেছিল, আড়াই লাখের বদলে এক লাখ দিলে কাজ হয়ে যাবে, কিন্তু না, সেই ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। হাত দিয়ে মাথার চুলটা ঠিক করেছিল শতানিক। রাগ হচ্ছিল ওর, ভাবছিল আড়াই লাখ টাকা তা হলে দিতেই হবে! আর তখনই পাশের ইন্টারকমটা বেজে উঠেছিল শব্দ করে। রিসিভার তুলেছিল শতানিক। রিসেপশন থেকে জানিয়েছিল যে, ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সাইমন রুপেন মণ্ডল।

এগারোটা দশ। রাসবিহারী মোড় এসে গেছে প্রায়। মাড়ির ভেতরের দিকে দুটো দাঁত ভোগাচ্ছে খুব। শতানিকের দাঁতের সমস্যা চিরকালের। ডাক্তার বলেছেন চুরুট খাওয়া বন্ধ করতে, নিকোটিন নষ্ট করে দিচ্ছে দাঁত। জীবাণুরা পাতাল রেল বসাচ্ছে দাঁতে। কিন্তু ও শোনেনি। এখন মাঝে মাঝে দাঁতগুলোর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি লাগে ওর। মাঝরাতে ব্যথাও করে। তখন ওর স্ত্রী সর্বাণী ওষুধ লাগিয়ে দেয়। সর্বাণীর কথা মনে পড়তেই মনটা খিঁচড়ে গেল শতানিকের। ফ্রিজ একটা। যেমন মোটা তেমন ঠান্ডা। ওর বাপের পয়সা না থাকলে কে বিয়ে করত ওকে? সর্বাণীর সঙ্গে বিয়ে হওয়াতেই তো শ্বশুরের এই ব্যাবসাটা পেয়েছে ও। সর্বাণী বোকাসোকা মানুষ। মাঝেমধ্যে জিনিসপত্র কিনে দিলেই খুশি। আর বিশেষ কিছু চায় না। শতানিক বাইরে কী করছে সে ব্যাপারে সর্বাণী মাথা ঘামায় না একটুও। সর্বাণীর কথা মনে পড়তেই হঠাৎ মেহেরের শরীরটা মনে ভেসে উঠল ওর। মেহের, দ্য গার্ল হু উইল স্যাটিসফাই হিম। শরীর কঠিন হয়ে উঠছে শতানিকের। কতক্ষণে যে মেহেরকে নিয়ে ওর মৌলালির ফ্ল্যাটে যাবে।

মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল এবার। ও ফোনটা তুলল। এঃ, মোহন সেন ফোন করেছে। লোকটা চাইনিজ জোঁকের বংশধর। ও ফোনটা কানে লাগাল, “হ্যাঁ বলছি?”

“আজ আসছেন তো?” জোঁকের গলায় মধু ঝরছে।

রাসবিহারী মোড়ের সিগনালটা খোলা। শতানিক রিয়ার ভিউ মিররে দেখল পেছন থেকে দুটো বাস রেষারেষি করে এগিয়ে আসছে খুব জোরে। হর্নও দিচ্ছে তারস্বরে। শতানিক দ্রুত বাঁ দিকে কাটাতে কাটাতে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আসব।”

মোহন কিছু বলছে আরও, কিন্তু পেছনের বাস দুটোর রেষারেষি আর হর্নের শব্দে কিছু শুনতে পাচ্ছে না ও। তবু ভাল করে শোনার জন্য ফোনটা কানে চেপে ধরতে গিয়ে সামান্য অন্যমনস্ক হল শতানিক। বাঁ দিকে টার্ন নিতে গিয়ে দেখল সামনে একটা বুড়ি পড়ে গেছে। বাস দুটোও প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে এসেছে। শতানিক প্রাণপণে বুড়িটাকে কাটাতে গেল। হাত থেকে ফসকে যাওয়া মোবাইল সামলাতে গিয়ে গাড়ির পাওয়ার স্টিয়ারিং এক ঝটকায় ঘুরে গেল বেশি। ওর গাড়িটা টাল সামলাতে না পেরে সোজা গিয়ে ধাক্কা মারল সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অটোর পেছনে। দুটো অটো কাত হয়ে পড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। আর ধাক্কার চোটে শতানিকের মুখটা গিয়ে লাগল স্টিয়ারিং হুইলে। ওর মনে হল, চোখের নীচের হাড়টা যেন বোমা মেরে উড়িয়ে দিল কেউ। কেউ যেন চোখের ওপর টেনে দিল কালো একটা পরদা। মুহূর্তের নিকষ অন্ধকারে ওর সব তালগোল পাকিয়ে গেল। বুকেও ব্যথা করছে ভীষণ। শরীর অবশ হয়ে আসছে ক্রমশ। তার মধ্যেও তোবড়ানো গাড়ি থেকে বেরোবার চেষ্টা করল শতানিক। দেখল ডান পায়েও অসহ্য যন্ত্রণা করছে। গোড়ালির থেকে পায়ের পাতাটা লটপট করছে। হঠাৎ কারা জানি গাড়ির দরজা খুলে টেনে বের করল ওকে। তারপর ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। “শুয়োরের বাচ্চা”, “বাঞ্চোত”, “হারামি”, ইত্যাদির সঙ্গে বৃষ্টির মতো লাথি আর ঘুসি পড়ছে। শতানিক হাত তুলে বোঝাবার চেষ্টা করল যে, ওর দোষ নেই, একটা বুড়ি সামনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কেউ শুনছে না। চোখের তলার হাড়টায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে, মনে হচ্ছে পা-টা নেই। তার ওপর মার পড়ছে দমাদম। মাথার ওপর ছোট্ট আকাশটা আরও ছোট হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ওর। তারপর একসময় মারটা বন্ধ হয়ে গেল আপনা থেকেই। ফোলা চোখ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে, শেষ বারের মতো খুলে শতানিক দেখল একটা লোক ওর ওপর ঝুকে পড়ে জল ছেটাচ্ছে মুখে।

বোম : ২৪ ডিসেম্বর, সকাল এগারোটা আঠেরো

লোকটার চোখটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে এল। চোখের তলাটা থেঁতলে গেছে একদম। মারের চোটে মুখটা ফুলে কামরাঙার মতো হয়ে আছে। লোকটার পরনে দামি কোট, প্যান্ট। বোম একবার গাড়িটার দিকে দেখল। গাড়ির সামনেটা একটা কোলাপসিবল গেটের মতো ভাঁজ খেয়ে গেছে। দুটো অটো ছাড়াও ফুটপাথের পাশে বসানো নতুন রেলিংটাতেও ধাক্কা মেরেছিল গাড়িটা। একটা অটো সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল আর অন্যটায় লোক বসেছিল দু’জন। তাদেরও বেশ চোট লেগেছে, এক জন তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একটা স্বার্থপরের মতো চিন্তা এল বোমের মাথায়। দুটো অটো যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই জায়গায় একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল ওর নিজের অটোটা। ভাগ্যিস…

আবার একবার গাড়িটাকে দেখল বোম। হাল ফ্যাশনের গাড়ি। ছোট্ট, দেখতে খুব ভাল, পেট্রোলও টানে কম, কিন্তু বড্ড পলকা। দেশলাই বাক্স ছুড়ে মারলে ট্যাপ খেয়ে যায়। যেভাবে ধাক্কা লেগেছে, মনে হচ্ছে ইঞ্জিনটা গেছে একদম। লোকটাও এই গাড়িটার মতো। মুখটা একদম রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। জল ছেটানোর পরে কপালের দিকটায় পরিষ্কার হয়েছে একটু।

বোম তো বাড়ি যাবে বলে রাস্তা পার হয়ে ট্রাম লাইনের ওপর ছিল। হঠাৎ একটা হইচই শোনে ও। দৌড়ে এসে দেখে সব ছত্রাখান অবস্থা আর এই লোকটা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে। নেহাত সার্জেন্ট এসে পড়েছিল তাড়াতাড়ি। তাই রেহাই পেয়েছিল লোকটা। তবে এখনও প্রচুর লোকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জায়গাটা।

সার্জেন্টটা বয়সে তরুণ। মাঝে মাঝেই ওর ডিউটি পড়ে এখানে। বোম চেনে ওকে। নাম ইশাক। সবাই ইশাভাই বলে। মার থামার পর পাশের একটা ছোট দোকান থেকে জলের বোতল এনে লোকটার মুখে জল ছিটিয়েছে বোম।

পাবলিক এখনও রাগে গরগর করছে। অটোর থেকে পড়ে যাওয়া দু’জনের মধ্যে যে অজ্ঞান হয়ে গেছে, তাকেও পাশের একটা বেঞ্চে শোয়ানো হয়েছে। পড়ে যাওয়া অটো দুটোকে সোজা করেছে কয়েকজন মিলে।

বোমের পাশ থেকে কানাই চিৎকার করল, “মুতে দে শুয়োরের বাচ্চাটার মুখে। মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাচ্ছে! শালা কোন রেন্ডির সঙ্গে গল্প করছিলি রে?” অন্যান্য লোকজনও ওর সঙ্গে হইহই করে উঠল। কানাই আবার বলল, “দিলি তো শালা আমার গাড়ির পাইনটা মেরে?”

বোম দেখল, ইশাভাই হাতের ওয়াকিটকিতে কথা বলছে। পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স আনা যে জরুরি, সেটাই বোঝাচ্ছে। বোম ভাবল লোকটা বাঁচবে তো? মুখে বীভৎস চোট লেগেছে, ডান পা-টা দেখে মনে হচ্ছে, গোড়ালির কাছটা ভেঙে গেছে নির্ঘাত। এ হসপিটাল কেস। কে জানে বুকের হাড়গোড় ভেঙেছে কি না! তবে লোকটাকে দেখে কষ্ট লাগল বোমের। কেউ কি ইচ্ছে করে অ্যাক্সিডেন্ট করে? কিন্তু আজকাল কী যে হয়েছে মানুষজনের। সবাই সবসময় রেগে আছে যেন। একটুতেই এ ওকে কামড়ে দেবার জন্য লাফাচ্ছে। এই লোকটা এমনিতেই প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিল তার ওপর এভাবে কি না মারলে চলছিল না?

বোমের নিজেরও একবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। ওর অটোর গায়ে ধাক্কা মেরেছিল একটা মোটরবাইক। অটোয় একাই ছিল বোম। ব্যালেন্স হারিয়ে ফুটপাথে উঠে গিয়েছিল ওর অটো। একটা কাপড়ের পুতুল বিক্রেতার দোকানের ক্ষতি হয়েছিল। অটোটা ফুটপাথে উঠে কাত হয়ে পড়ে গিয়েছিল। বাঁ হাতটা ভেঙে গিয়েছিল বোমের। আজও কনুইয়ের কাছে একটা দাগ আছে। তখনও বিয়ে হয়নি বোমের। সেই প্রথম রেণু ওদের বাড়িতে এসেছিল ওকে দেখতে। ওদের সেই ছোট্ট ঘর, ভাঙা মেঝে আর ফাটা দেওয়ালও যেন ভেসে গিয়েছিল আলোয়। রেণু বলেছিল, “হাতের দাগটা থেকে যাবে তোমার।” তা, দাগ থেকে গেছে। তবে শুধু হাতের নয়। মানুষ তো শরীরের দাগ, জখমগুলোই দেখে শুধু, মনের খবর আর কে কবে রেখেছে। তবে এত দিন পরেও যন্ত্রণাটার কথা মনে পড়লে গা শিরশির করে ওঠে ওর। ব্যথায় টনটন করে কনুইটা। বুকটাও।

জলের বোতলটা পাশের একজনের হাতে দিয়ে ধীরে ধীরে ভিড় থেকে বেরিয়ে এল বোম। প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। সোনাইটা অপেক্ষা করছে বাড়িতে। ও দ্রুত হাঁটতে লাগল। এখান থেকে বাড়ি যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না ওর। তবে গিয়ে রুচির কাছে ঝাড় খাবে নিশ্চিত। ও ভাবল, সোনাইটাও খুব টেনশনে থাকবে। ভাববে, দাদা এখনও এল না কেন? তবে একটা বাঁচোয়া। এখানে কালু ছিল না। থাকলে, বোম নিশ্চিত, কালু সব কিছু ছেড়ে লোকটাকে নিয়ে যেত হসপিটালে। ছেলেটা ওরকমই। কারও বিপদে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এইজন্যই ভাল লাগে ওকে। বোম জানে কালু হয়তো রোজগার কম করে, কিন্তু মনটা খুব ভাল ছেলেটার। একদম সাচ্চা ছেলে। ছেলেটার দিকে ও যত তাকায় ততই শ্রদ্ধা আসে। এমন সহজ মনের অকপট ছেলে ও কোনওদিন দেখেনি। না হলে অমন একটা কথা ও কোনওদিন বলতে পারত বোমকে!

লক্ষ্মী পুজোর পরের দিন ছিল সেটা। স্ট্যান্ডে এসে সারাদিন মনমরা হয়ে বসেছিল কালু। বিশেষ কথা বলছিল না ও। ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। বোম। ভেবেছিল, গতকাল রাতে, যখন ওদের বাড়ির পুজোতে গিয়েছিল কালু, তখন তো ঠিকই ছিল ছেলেটা, হঠাৎ কী হল? কালু অমন করে বসে রয়েছে কেন?

রাতে গাড়ি রেখে ঘরে ফেরার সময় কালুকে গিয়ে ধরেছিল বোম। জিজ্ঞেস করেছিল, “এই, তোর কী হয়েছে রে? সারাদিন অমন গোমড়া মুখে আছিস কেন?”

কালু মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। উত্তর দেয়নি কোনও।

আবার জিজ্ঞেস করেছিল বোম, “কী রে চুপ করে আছিস কেন? কী হয়েছে?”

কালু করুণ মুখে তাকিয়েছিল ওর দিকে। রাস্তার হলুদ আলোয়, বোম দেখেছিল, কালুর চোখ দিয়ে সরু জলের রেখা পড়ছে।

“কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?” ঝাঁপ বন্ধ হওয়া একটা দোকানের সিঁড়িতে কালুকে ধরে বসিয়েছিল বোম।

কালু দু’হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে বসেছিল। হালকা ফোঁপানির শব্দ পাচ্ছিল বোম। কালুর চওড়া পিঠটা মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ওর পিঠে হাত রেখে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল বোম। কী হল ছেলেটার?

কালুকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দিয়েছিল বোম। ভেবেছিল, বাড়িতে হয়তো ভয়ংকর কিছু একটা হয়েছে। সময় দিলে নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। রাত বাড়ছিল একটু একটু করে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমে আসছিল ক্রমশ। সিগনালের লাল-সবুজ আলো বদলে হলুদ হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনের ধুলোবালি ক্রমে ক্রমে থিতিয়ে আসছিল শহরের ওপর।

একসময় কান্না থামিয়ে চোখ তুলেছিল কালু। এমন বিপন্ন, দুঃখিত চোখ কোনওদিন দেখেনি বোম। ও মাথায় হাত দিয়েছিল ছেলেটার, নরম স্বরে জিজ্ঞেস করেছিল, “এবার বল, কী হয়েছে?”

কালু হাতটা চেপে ধরেছিল ওর, কাঁপা গলায় বলেছিল, “খুব অন্যায় হয়েছে আমার, তুমি ক্ষমা করবে কি?”

“অন্যায়? আমি ক্ষমা করব?” এবার বোম অবাক হয়েছিল। অজানা আশঙ্কায় কাঁপছিল ওর বুক। বুঝতে পারছিল না, কী বলছে কালু।

কালু বলেছিল, “বউদি…”

“রুচি? কী হয়েছে?” বোম স্থিরভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

“গতকাল তোমাদের বাড়িতে যাবার পর বউদি আমায় বলেছিল যে আশেপাশের বাড়িতে প্রসাদ দিতে…”

“জানি তো। তুই আর রুচি, দু’জনেই তো বেরিয়েছিলি। কী বলতে চাইছিস বল না, এদিক ওদিক কথা ঘোরাস না।” অধৈর্য লাগছিল বোমের।

“প্ৰসাদ দিয়ে ফেরার সময়,” কালু থেমেছিল এক মুহূর্ত, “বউদি আমায়… তোমাদের বাড়ির পেছনের অন্ধকার জায়গাটায়… আমায়… চু… চুমু… খেয়েছে।”

জ্বলা-নেভা হলুদ আলো, রাস্তায় চলন্ত গাড়ি, মানুষের ইতস্তত শরীর, কলকাতার ওপর নেমে আসা ধুলোর চাদর সব থেমে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। রুচি? চুমু? কালুকে? বোম কালুর দিকে তাকিয়েছিল নিষ্পলক দৃষ্টিতে। কী বলবে ও? কী বলার থাকতে পারে? জীবনে অদ্ভুত ঘটনার কি কোনও শেষ নেই?

বোমকে চুপ থাকতে দেখে কালু বলেছিল, “আমি চাইনি বোমদা। আমি ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিলাম বউদিকে, কিন্তু বউদি আমায় আঁকড়ে…”

ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হাত তুলে থামিয়ে দিয়েছিল বোম। বলেছিল, “আমায় বলছিস কেন? এসব আমায় বলছিস কেন?”

কালু নিচু হয়ে পা ধরেছিল ওর। বলেছিল, “আমি ঘুমোতে পারিনি কাল সারারাত। কষ্ট হয়েছে ভীষণ, এখনও হচ্ছে। তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও বোমদা। আমি খুব ভুল করেছি।”

বোম বলেছিল, “তুই তো ভুল করিসনি। তোকে কিছু বলার নেই আমার। ঠান্ডা মাথায় বাড়ি যা তুই।”

সে রাতে বোমের ভেতরের অবশিষ্ট মানুষটুকুও ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গিয়েছিল। একটা পাগলাটে রাগ মাথার মধ্যে ঢুকে তছনছ করে দিচ্ছিল সব কিছু। সারারাত ছটফট করেছিল বিছানায়। ঘরের ছোট্ট আলোয় ঘুমন্ত রুচির দিকে তাকিয়ে গা গুলোচ্ছিল ওর। মনে হচ্ছিল, এই তো বালিশ রয়েছে। এটাকে ওই মেয়েছেলেটার মুখের ওপর চাপা দিয়ে শেষ করে দিই একেবারে। ওর চামড়ার তলায় লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে হাঁটছিল, পেটের ভেতরে পাক দিচ্ছিল সাপ। খুব ইচ্ছে করছিল বালিশটা রুচির মুখের ওপর চেপে ধরতে। মনে হচ্ছিল, এই মেয়েছেলেটার বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই।

ভোররাতের দিকে বিছানার থেকে উঠে জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বোম। অল্প অল্প আলো-ফোটা শহর, দু’-চারটে উঁচু বাড়ির গায়ে দু’-এক পোঁচ রোদের রং, ধীরে ধীরে জেগে ওঠা পাখিরা, বোমের মনে হচ্ছিল, হয়তো রুচির এমন ব্যবহারের পেছনে ওর নিজের অপদার্থতাও রয়েছে। হয়তো ও সক্ষম নয় বলেই রুচি অন্য দিকে গিয়েছে। তবু ঘটনাটা ভুলতে পারছিল না বোম। ভোরের আলো ওকে ওর মানসিক সাম্য ফিরিয়ে দিয়েছিল মাত্র। কিন্তু রুচিকে ও ক্ষমা করতে পারেনি। ঠিক করেছিল ধীরে ধীরে সরে আসবে রুচির থেকে।

এর বেশ কিছু দিন পরে রুচিই একদিন রাতে, হঠাৎ ওর শরীর নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করেছিল। অনিচ্ছার সঙ্গে মরা গাছের মতো শুয়েছিল বোম। কিন্তু তবু রুচি চেষ্টা চালাচ্ছিল। শরীরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ঘষছিল ওর মুখ। জৈবিক নিয়মে মরা গাছের ডালেও পাতা বেরোচ্ছিল ধীরে ধীরে। রুচি বোমকে টেনে নিয়েছিল বুকের ওপর। প্রাণপণে ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট রাখার চেষ্টা করছিল রুচি। কিন্তু মুখ সরিয়ে নিচ্ছিল বোম। ওর মনঃসংযোগ সরে যাচ্ছিল। ও তবু দ্রুত শরীর নাড়াচ্ছিল। তেতো ওষুধের মতো শেষ করতে চাইছিল গোটা ব্যাপারটা। চোখ বন্ধ করে সমস্ত নগ্ন মেয়েদের কথা চিন্তা করার চেষ্টা করছিল ও। নিজেকে নিংড়ে বের করার চেষ্টা করছিল প্রাণপণ। তারপর একসময় হঠাৎ ছোট্ট বিস্ফোরণ হয়েছিল একটা। হাঁপাতে থাকা শরীরটা থেমে গিয়েছিল বোমের। রুচি তবু চেষ্টা করছিল। নীচের থেকে চাপ দিচ্ছিল ক্রমাগত। কিন্তু এবার বোম লাটাই গুটিয়ে নিচ্ছিল দ্রুত। এই মহিলার সঙ্গে শুয়েছে চিন্তা করেই বমি পাচ্ছিল ওর। রুচি বোমের নিষ্ক্রিয়তার মানে বুঝতে পেরেছিল। ও বোমকে বুকের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, “এরই মধ্যে বেরিয়ে গেল? আমার তো গরমই হয়নি এখনও। তুমি পুরুষ মানুষ? না চেহারা, না কিছু। আমার সারাজীবন কাটবে কীভাবে বলো তো? এর চেয়ে কালুর সঙ্গে শুলে বোধহয় আরাম পেতাম।”

এই কথার কোনওরকম ব্যাখ্যা বা কারণ জানতে চায়নি বোম। ওর হঠাৎ মনে হয়েছিল, রুচির কাছ থেকে কোনও কিছু জানার বা ওকে কিছু জানাবার আর নেই। বোম সে রাত থেকে বুঝেছিল ও সম্পূর্ণ একা।

বাড়িতে ঢোকার মুখে ও দেখল সোনাই দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, “দাদা, এত দেরি করলি কেন? প্রায় পৌনে বারোটা বাজে যে?”

সোনাইয়ের পেছনেই বেরিয়ে এল রুচি, “কী হল, এত দেরি করলে কেন? সবসময় একটা ক্যালানেগিরি না করলেই নয় তোমার, না?”

বোম মাথা নিচু করে বলল, “চল সোনাই। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।”

সোনাই কিছু বলার আগেই রুচি বলল, “শোনো, সোনাইকে দুটোর মধ্যে বাড়ি নিয়ে আসবে। ওকে নিয়ে স্যাকরার কাছে যাব। ওর চুড়ি বানাতে হবে। মনে থাকে যেন, দুটোর মধ্যে।”

বোম মাথা নাড়ল। মনে মনে একটা চাপা আনন্দ হচ্ছে ওর। স্যাকরার কাছে যাবে? যাও। কিন্তু তোমার সমস্ত আয়োজন আজ পণ্ড করে দেব আমি। ওই গোরাচাঁদকে রকেট ছাড়াই চাঁদে পাঠাবার বন্দোবস্ত করছি দাঁড়াও। সবসময় সবার ওপর খবরদারি, না? আজ সব খবরদারির মুখে লাথি মারব আমি।

বড় রাস্তায় এসে সোনাই বলল, “দাদা, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সেই এক্সাইড মোড় অবধি যেতে হবে। বাস পাব তো?”

বাস? মনে মনে হাসল ও। তারপর হাত তুলে চলন্ত একটা ট্যাক্সিকে থামাল। পেছনের দরজাটা খুলে সোনাইকে বলল, “উঠে পড় তাড়াতাড়ি।” সোনাই বিস্মিত মুখে উঠে বসল ট্যাক্সির পিছনে। বোম সোনাইয়ের পাশে উঠে ট্যাক্সিওলার উদ্দেশে বলল, “বারোটার মধ্যে এক্সাইড মোড়ে পৌঁছোতে পারলে দশটাকা এক্সট্রা দেব তোমায়।”

ছুটন্ত গাড়ির জানলার কাচ তুলে দিল বোম। হুহু করে হাওয়া ঢুকছে। আজ সকাল থেকেই হাওয়া দিচ্ছে খুব। শীত করছে বোমের। শীতকাল একদম ভাল লাগে না ওর।

সোনাই বলল, “রেজিষ্ট্রির পর কালুর সঙ্গে একটু ঘুরব রে?”

বোম হাসল, বলল, “আজ না। লেখাপড়া করে হলেও, আজ বিয়ে তো, আজ একদম ঘোরাঘুরি নয়। তা ছাড়া দেখলি না রুচি বলল দুটোর মধ্যে ফিরতে! জানিসই তো কী অশান্তি করে ও। তা ছাড়া আজ মহামিছিল আছে। ঘুরতে গিয়ে আটকে যাবি কোথাও। তার চেয়ে অন্য দিন ঘোরাঘুরি করিস। এখন তো সারাজীবন পড়ে রইল।”

সোনাই আবার বলল, “জানিস দাদা, এভাবে বিয়ে করতে একদম ইচ্ছে করছে না আমার। কিন্তু কী করব বল?”

সোনাইয়ের গলায় কান্নার রেশ। বোম হাত দিল বোনের মাথায়, বলল, “এসব ছাড়। এখন আর পিছিয়ে গেলে চলে? তা ছাড়া কালু খুব ভাল ছেলে।”

“আচ্ছা দাদা, পৌষ মাসে বিয়ে করছি, অমঙ্গল হবে না তো?”

বোমের হাসি পেল খুব। ভাবল বলে, “এই সময়ে, এই শহরে জন্মেছিস। এর চেয়ে অমঙ্গল আর কী হতে পারে?” ও বলল, “পাগলি একটা, সে-দিন যে বললি, এসব মানিস না? শোন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আর বেরিয়েই যখন পড়েছিস তখন আর এসব চিন্তা করিস না।”

সোনাই বলল, “আজ না হয় বাড়ি ফিরে যাব, কিন্তু পরে যখন এ-খবর জানাজানি হবে? তখন? তখন কী হবে?”

বোম হাসল, “যা হওয়ার হবে। এখন এসব চিন্তা না করে একটু হাসি হাসি মুখ কর। অমন ছলছলে চোখ নিয়ে বিয়ে করে কেউ?”

ঠিক এগারোটা আটান্নয় ড্রাইভার ট্যাক্সিটাকে পৌঁছে দিল এক্সাইড মোড়ের বড় কাচের রেস্টুরেন্টের সামনে। মনে মনে খুশি হল বোম। মিটারে যত টাকা উঠেছিল তার সঙ্গে বাড়তি দশ টাকা এগিয়ে দিল লোকটার দিকে। লোকটা হেসে টাকা নিল, তারপর দশ টাকা বোমের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “এটার দরকার নেই। আপনি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছেন, এটাই যথেষ্ট।”

বোম টাকা হাতে ধরে অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, সবাই যে বলে, সব শেষ হয়ে গেছে, গলে, পচে, নষ্ট হয়ে গেছে, তা কি ঠিক নয়? এখনও কি আশা আছে তা হলে? এখনও কি কিছু মানুষ বেঁচে রয়েছে?

কিন্তু কালু কই? ওর তো এখানে দাঁড়ানোর কথা। বোম সোনাইয়ের কনুইটা ধরে ভিড় ফুটপাথ দিয়ে দু’-এক পা করে এগোতে লাগল।

“ক’টা বাজে?”

“অ্যাঁ?” অপ্রস্তুত বোম একটু চমকে গেল। ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ফরসা ছেলে। চোখটা অদ্ভুত রকম সবুজ। বোমের মনে হল ঠিক যেন একটা বিড়াল তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

ছেলেটা সোনাইয়ের দিকে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “ক’টা বাজে?”

“বারোটা, বারোটা বাজে।” ঘড়ি দেখে সংক্ষেপে বলল সোনাই।

“থ্যাঙ্ক ইউ।” ছেলেটা চলে গেল।

কিন্তু কালুর দেখা নেই যে। কোথায় কালু? বোম বলল, “কী রে সোনাই, কালু তো এল না এখনও! কী হবে?”

সোনাই চিন্তিত মুখে বলল, “চিন্তা করিস না, ঠিক আসবে।”

এ-দিক ও-দিক তাকাল বোম। এখানেই আসবে তো কালু? ঠিক জানে তো সোনাই? ভিড়ের মধ্যে কি দেখতে পাচ্ছে না ওকে? শেষ মুহূর্তে কোনও বিপদে পড়ল না তো? আড় চোখে সোনাইয়ের দিকে তাকাল বোম। হঠাৎ মনে হল কালু মিথ্যে কথা বলেনি তো সোনাইকে?

টিং টিং শব্দে পকেটের মোবাইল ফোনটা বাজল হঠাৎ। মুখটা বিকৃত হয়ে গেল বোমের। ওঃ, দিনের মধ্যে দশ বার রুচি ফোন করে! বিরক্ত হয়ে ফোনটা বের করে দেখল ও। আরে, না তো, এটা তো রুচি নয়। এটা তো অচেনা নম্বর। ফোনটা ধরল বোম, “হ্যালো।”

“আরে বোমদা, তোমরা পৌঁছে গেছ?”

ধড়ে প্রাণ এল বোমের, “কালু, তুই কোথায়? আমরা অপেক্ষা করছি যে।” ও দেখল সোনাই উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে।

কালু বলল, “তোমরা হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এসো মিন্টো পার্কের দিকে। তবে এতটা হাঁটতে হবে না। তার আগেই বাঁ হাতে উড স্ট্রিট আছে। সেখানে অপেক্ষা করছি আমি। আমার বন্ধুরা রেজিস্ট্রারকে নিয়ে এখানেই আসবে। তাড়াতাড়ি এসো।”

ফোনটা কেটে সংক্ষেপে সোনাইকে পুরো ব্যাপারটা বলল বোম। সোনাই বলল, “তুই চিনিস তো রাস্তাটা?”

“আমি?” ঠোঁট চাটল বোম, “ঠিক চিনি না। তবে চল না জিজ্ঞেস করে নেব।”

সোনাই কতকটা নিজের মনেই বলল, “শুনেছিলাম বটে ওর কাছে। এই নামটাই বলেছিল মনে হয়। ওর বন্ধু না কে একটা অফিসে চাকরি করে এখানে। তার পেছনেই একটা এক কামরার ঘরে থাকে বন্ধুটা। সেখানেই কি সই-সাবুদ হবে?”

বোম সোনাইয়ের সঙ্গে হাঁটতে লাগল দ্রুত। ফুটপাথে বেশ ভিড়। কাল বড়দিন বলে আশেপাশের দোকানগুলো সেজেছে খুব। বোমের মনে হল, সব ঠিকঠাক মিটে যাবে তো? ওর যা কপাল, সব ভেস্তে না যায় শেষ মুহূর্তে! এই বিয়েটা হওয়া জরুরি। রুচিকে বোঝানো দরকার, ওর মর্জি মতো সব ঘটবে না পৃথিবীতে। একবার, অন্তত একবার হলেও দান পালটে দেবার ক্ষমতা রাখে বোম। ও ভাবল, তুমি যাকে চুমু খেয়েছিলে, যার সঙ্গে তুমি শুতে চেয়েছিলে, সে আসলে তোমার নয়। সে ভালবাসে সোনাইকে। রুচি, এখানে জিততে পারোনি তুমি। সবসময় তুমি জিততে পারো না।

একটা চওড়া রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল ওরা। বাঁ দিকে একটা রেস্টুরেন্ট, তবে বন্ধ। এটাই কি উড স্ট্রিট? আশেপাশে তাকাল বোম। জিজ্ঞেস করা যাক কাউকে। সামনে একজন ভদ্রলোক আসছেন। বেশ সুন্দর দেখতে। এঁকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। বোম সোনাইয়ের কনুইয়ের কাছটা ধরে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে, “দাদা, উড স্ট্রিট কোথায়?”

লোকটা হাসল। ভারী সুন্দর দাঁতগুলো। লোকটা বলল, “এটাই তো উড স্ট্রিট। আপনি কত নম্বর খুঁজছেন?”

কিন্তু বোমকে উত্তর দিতে হল না, তার আগেই শুনল, “ও বোমদা এই যে, চলে এসো, চলে এসো।” কালু চিৎকার করে ডাকছে ওদের।

বোম কোনও উত্তর দেবার আগেই, সোনাই বোমের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গেল কালুর দিকে। দৌড়ে যাওয়া সোনাইয়ের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল বোম। দেখল কালুও দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সোনাইয়ের দিকে। এই হাত, যা একদিন ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিল রুচিকে। মনে মনে একবার রুচির মুখটা দেখল বোম। পরাজিত একটা মুখ। বোম ভাবল সবাই তোমার হাতের পুতুল নয়। সবাইকে তুমি হারাতে পারো না। সবাইকে ব্যবহার করতে পারো না খুশি মতো। বোম পকেট থেকে বের করল মোবাইল ফোনটা, তারপর নিচু হয়ে ঝাঁঝরিওলা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিল যন্ত্রটাকে। যাও লাটাই, নিজের মনে বাজো। ও দেখল সুন্দর দাঁতের লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে অবাক হয়ে। বোম হাসল। হাওয়া বাড়ছে কলকাতায়। চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ওর। শীত করছে। তবু, খারাপ লাগছে না বোমের। ও বুঝতে পারছে, শীতকাল ঠিক ততটা খারাপ নয়।

অহন : ২৪ ডিসেম্বর, দুপুর সোয়া বারোটা

এ কী করল লোকটা? মোবাইলটা ফেলে দিল? এরকম কোনও কাজ কাউকে কখনও করতে দেখেনি ও। একটু আগে যখন লোকটা ওকে ‘উড স্ট্রিট কোথায়’ জিজ্ঞেস করছিল, তখন তো ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, এর পরে এরকম কিছু একটা ঘটতে চলেছে! ওই দেখো, লোকটা হাসছে আবার। পাগল নাকি? কিন্তু দেখে তো মনে হয় না যে পাগল! তা হলে? সকাল থেকে কী ঘটছে আজ? সবই কি আজ নিয়মের বাইরে যাবে? ও নিজেও তো অদ্ভুত একটা কাজ করেছে অফিসে। কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল এমনটা ও বলতে পারবে? কোনওদিনের কথা বাদ দাও, আজ সকালেও কি বুঝতে পেরেছিল ও?

সামনের বড় বাড়ির গেটটা দিয়ে এবার ঢুকল অহন। সিঁড়ির মুখে সিকিউরিটির লোক বসে রয়েছে দু’জন। খাতা খোলা, তার পাশে পেন। অর্থাৎ নাম-ধাম লিখতে হবে। অহন এগিয়ে গিয়ে খাতায় নিজের নাম আর ও যে সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের অফিসে যাবে সেটা লিখল। তারপর এগিয়ে গেল বিল্ডিংটার দিকে।

প্রায় দশতলা উঁচু এই বাড়িটা। সামনেটা পুরো প্লেক্সিগ্লাস দিয়ে মোড়া। সফ্‌ট ড্রিঙ্কস্ ছাড়াও এরা নানা রকম স্ন্যাক্‌স তৈরি করে। লোককে খাইয়ে যে কত টাকা রোজগার করা যায়, তা এদের না দেখলে অহন জানতেই পারত না কোনওদিন। তবে ভারতবর্ষের মতো দেশে হয়তো যায়। একশো কোটির ওপর জনসংখ্যা যেখানে, সেখানে এরকম সামগ্রী বিক্রি করাই বোধহয় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। যদি সারা বছরে এক শতাংশ মানুষও এইসব খায়, তা হলেই তো কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিশ্চিত। বাবা কেন যে ভুল ব্যবসায় নামতে গেল! নিদেন পক্ষে মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করলেও তো হত! অ্যাডভার্টাইজিং বড় ঝঞ্ঝাটের কাজ।

লিফটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল অহন। পাশের ডিজিটাল প্যানেলে দেখল, লিফটটা চারতলা থেকে নীচে নামছে। আশেপাশে ভিড় আছে একটু। এই পাঁচ-ছ’জন। ও ঘড়ি দেখল একবার। বারোটা পনেরো ছাড়িয়ে বড় কাঁটা কুড়ির দিকে এগোচ্ছে। এদের জেনারেল ম্যানেজার, মার্কেটিং, মিস্টার সাহা সোয়া বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে দেখা করতে বলেছেন। অবশ্য দেখা করার কথা ছিল না। অহনই আজ এগারোটা নাগাদ ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিল।

লিফটের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল সামনে। অহন অন্যান্যদের সঙ্গে পা বাড়াল ভেতরে। ফিফথ ফ্লোরের বোতাম টিপে এক কোণ ঘেঁষে দাঁড়াল ও। চারিদিকে স্টেনলেস স্টিলের দেওয়াল চকচক করছে। স্পষ্ট নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। অহন চট করে একবার এ-দিক ও-দিক তাকাল। না, ওকে কেউ লক্ষ করছে না। ও স্টেনলেস স্টিলের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ‘ই’ করে দাঁত দেখে নিল নিজের। নাঃ, ঠিক আছে। মুখ বন্ধ করে একবার জিভ বুলিয়ে নিল দাঁতের ওপর।

শতানিকের ফোনটা কেটে দেওয়ার পর দুটো বিস্কিট খেয়েছিল অহন। তারপরে মুখটা ধুলেও ঠিক মনের মতো করে ধুতে পারেনি। প্রতুলকাকা এসে গন্ডগোল লাগিয়েছিল ঘরে।

শতানিক লোকটাকে এমনিতেই ভাল লাগে না ওর। তাই লোকটা দ্বিতীয় বার ফোন করায় বেশ বিব্রত হয়েছিল অহন। কিন্তু তবু ধরেছিল ফোনটা। লোকটা ওকে চাপ দিচ্ছিল। কোথাকার কোন এক আর জে না কী সব গ্রুপ, তাদের অ্যাড ক্যাম্পেনটা নাকি ও পাইয়ে দেবে বিটা অ্যাডকে। তার জন্য নাকি এই সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের ক্যাম্পেন থেকে নাম তুলে নিতে হবে! মামার বাড়ির আবদার আর কী! তারপর যখন অহন রাজি হল না, তখন যে-প্রস্তাবটা দিয়েছিল শতানিক, তাতে ভীষণ মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ওর। বলে কিনা টাকা দেবে এই কাজটা ছেড়ে দেবার জন্য! কী সাহস? ও কি সবাইকে নিজের মতো ছোটলোক ভেবেছে নাকি, যে টাকা দিয়ে যা খুশি তাই কাজ করিয়ে নেবে? অহনের মাথা এত গরম হয়েছিল যে, ও সংক্ষেপে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করে ফোন কেটে দিয়েছিল। ওর ইচ্ছে করছিল ভীষণ খারাপ খারাপ কথা বলে লোকটাকে। ইচ্ছে করছিল ফোনের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে ঘুসি মারে লোকটার নাকে। কিন্তু প্রতি বারের মতো এবারেও ওর সমস্ত ইচ্ছেগুলো মাথার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ঘরের লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে মুখেচোখে জল দিয়েছিল অহন। তারপর নিজের চেয়ারে ফিরে এসে ড্রয়ার খুলে বের করেছিল এক প্যাকেট বিস্কিট। সেখান থেকে একটা বিস্কিট মুখে দিয়ে মনটা অন্য দিকে ঘোরাবার চেষ্টা করেছিল ও। দুটো বিস্কিট শেষ করে আবার বাথরুমে গিয়েছিল অহন। কল খুলে মুখ ধুচ্ছিল। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে। মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে অহন শুনেছিল বাইরে প্রতুলকাকার গলা। বেশ চেঁচিয়েই অহনকে উদ্দেশ করে বলছেন, “কী সবসময় মেয়েদের মতো বাথরুমে পড়ে থাকো? বাইরে এসো। কথা আছে।”

‘মেয়েদের মতো’ মানে? আগাপাশতলা জ্বলে গিয়েছিল অহনের। বুড়োটার বড্ড বাড় বেড়েছে তো! ভারী অসভ্য তো লোকটা! ঋ একটা কথা বলত, যে-সব মানুষ মেয়েদের সম্পর্কে ডেরোগেটারি মন্তব্য করে, তারা আসলে অশিক্ষিত এবং অমানুষ। রাগটা আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল মাথায়। কিন্তু তবু রাগটা চেপে কোনওমতে মুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল অহন, কারণ প্রতুলকাকা চেঁচিয়েই যাচ্ছিলেন।

প্রতুলকাকা চেয়ারে বসে গোমড়া মুখে তাকিয়েছিলেন বাথরুমের দরজার দিকে। অহনকে দেখেই বলেছিলেন, “এবার সঙ্গে করে স্নো, পাউডার, পমেটম এনো। দিনে দুশো বার বাথরুম যাও কেন?”

অহনের রাগ শেষ ক’ধাপ সিঁড়ি ভাঙছিল দ্রুত। লোকটা বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। একে একটা মুখের মতো জবাব দিতে হবে। কিন্তু মাথার ডিকশনারি ঘেঁটেও কোনও কঠিন শব্দ মাথায় আসছিল না ওর। ও প্রাণপণে ওর ডিকশনারি লেখককে ডাকছিল, একটা অন্তত শব্দ দাও যেটা এই বুড়োটার মুখে ছুড়ে মারতে পারি।

প্রতুলকাকা আবারও বলেছিলেন, “বাথরুমে গিয়ে বসে থাকলে ব্যাবসা চলবে? তা এসেছিল ফোন? অ্যাডগ্ল্যাম ফোন করেছিল?”

অহন বুঝতে পারছিল যে, লোকটা খুব ভাল জানে ফোন এসেছিল কি আসেনি, তবু অ্যাক্টিং করছে। ও নিজের চেয়ারে বসে সংযতভাবে বলেছিল, “হ্যাঁ, শতানিক বাসু ফোন করেছিল।”

“শুনেছ ও কী বলল?” প্রতুলকাকা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন অহনের দিকে।

অহন সংক্ষেপে বলেছিল, শতানিক বাসুর দুটো প্রস্তাব।

“এক লাখ টাকা? এটা তো জানতাম না?” প্রতুলকাকা সত্যি সত্যি আশ্চর্য হয়েছিলেন এবার। অহন বুঝেছিল যে, প্রথম প্রস্তাবটা তা হলে প্রতুলকাকা জানতেন।

ও বলেছিল, “হ্যাঁ, এক লাখ টাকা দিতে চেয়েছিল শতানিক।”

“তুমি কী বললে?” প্রতুলকাকার গলায় সামান্য উত্তেজনা।

অহন টেবিলে রাখা পেঙ্গুইন পেপার ওয়েটের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আমি না করে দিয়েছি একদম।”

“তুমি রিফিউজ করেছ? পাগল নাকি?” তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিলেন প্রতুলকাকা।

“হ্যাঁ, আমি স্ট্রেট না করে দিয়েছি। আর জে গ্রুপ বলে কিছু আছে বলে তো আমি জানি না। শতানিক আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করছে।”

প্রতুলকাকা আবার বসে পড়েছিলেন চেয়ারে। বলেছিলেন, “আর দ্বিতীয় অফারটা, মানে এক লাখ টাকার ব্যাপারটা? সেটা তো ভালই ছিল। সেটা না করলে কেন?”

অহন বলেছিল, “বিটা অ্যাডের সম্মান এক লাখে বিক্রি করে দেব? তা ছাড়া এই কাজটা করতে চাই আমি। এদের অ্যাড ক্যাম্পেন পাওয়া মানে বিশাল বড় ক্রেডেনশিয়াল। ভবিষ্যতে কাজ পেতে সুবিধে হবে অনেক।”

“সে তো কাজ পেলে। আর যদি কাজটা না পাও? বুঝতে পারছ, কত টাকা। গচ্চা যাবে? টাকাটা নিয়ে রফা করলে আর ঝামেলাই হত না। একদম মূর্খের মতো কাজ করেছ তুমি!” প্রতুলকাকা অসহিষ্ণুভাবে হাত ছুড়লেন।

মূর্খ। অহন অবাক হয়ে গেল। লোকটা তো মাথায় উঠেইছিল এবার যে সেখানে বসে চুল ছিঁড়ছে! ও প্রাণপণে ওর ডিকশনারি লেখককে ডাকছিল। একটা, অন্তত একটা মুখের মতো জবাব যদি দিতে পারত।

প্রতুলকাকা বলেছিলেন, “সব ডোবাবে তুমি। যার পেছনে দৌড়োচ্ছ তা মরীচিকা। কিন্তু তুমি এমন নির্বোধ যে বুঝতে পারছ না, পায়ে কুড়ল মারছ তুমি। বোধগম্যি সব হারিয়েছে তোমার। ঠিক আছে। আমি আর কী বলব? যা ভাল বোঝো করো। তোমার বাবার…”

“হ্যাঁ”, নিজের চিৎকারে নিজেই চমকে গিয়েছিল অহন। ও বুঝতে পারছিল, ওর মাথার ভেতর কেউ একজন এসে বসেছে। আর সে ওর নির্বীজ ডিকশনারির পাতায় দুটো-চারটে করে কঠিন শব্দ লিখছে এবার। অহন প্রতুলকাকার দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, “আমার বাবার টাকা যখন, আমি যা খুশি করব। আপনি প্লিজ চুপ করুন। কাজটা আমার, আমি দেখব। আপনি একদম এ-ব্যাপারে মাথা গলাবেন না। বুঝেছেন?” প্রতুলকাকাকে দেখে মনে হচ্ছিল মাদাম ত্যুঁসো’র মিউজিয়াম থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। ভদ্রলোক এতটা অবাক হয়তো কোনওদিন হননি। চোয়াল খুলে প্রায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল ওঁর। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল। যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না উনি। হয়তো ভাবছিলেন, এ কি সেই অহন? উনি এই অবস্থায় আরও কিছুক্ষণ বসেছিলেন। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অহনের ঘর থেকে।

নিজের কথায় অহন নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এ কে ঢুকে পড়েছে ওর ভেতরে? এই ছেলেটা কে? কখনও তো দেখা হয়নি এর সঙ্গে? তবে কি এতদিন ধরে ঘাপটি মেরে বসে ছিল ওর ভেতর? আরও কি কেউ বসে রয়েছে? সবাই যে বলে মুড শিফটিং, এটাও কি এর অন্তর্গত? কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে চেয়ারে বসেছিল অহন। অন্যান্য সময় রাগ হওয়ার পর একটা অনুশোচনা হয়, এবার কিন্তু সেটা হচ্ছিল না। বরং হঠাৎ যেন শান্তি পাচ্ছিল ও। অন্য ধরনের এক শান্তি। কিন্তু সেটা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একটা চিন্তা এসেছিল মাথায়। উর্নি তো এখনও কোনও খবর দিল না! কী করছে মেয়েটা? সোয়া দশটা নাগাদ যখন ফোনটা করেছিল, তখন তো বলল যে, সুগতটা শুনল না। কিন্তু তারপর তো ওর মুকুলদার কাছে যাবার কথা। গিয়েছে কি ওখানে? গেলে কী করছে ও? কাজ হল কিছু?

তারপর বেশ কয়েক বার উর্নিকে ফোনে ট্রাই করেছে অহন। পায়নি। তা হলে কি লাস্ট ডেটটা এক্সটেন্ড করতে হবে? সময় নষ্ট না করে ও তাড়াতাড়ি ফোন করেছিল মিস্টার সাহাকে। তখনই উনি বলেছেন, দেখা করতে। দেখা যাক, অহন ভদ্রলোককে বলে প্রেজেন্টেশনের জন্য আরও কয়েকটা অতিরিক্ত দিন নিতে পারে কি না?

লিফটের ভেতরের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে পাঁচ সংখ্যাটা দেখিয়ে লোহার বাক্সটা থামল। দরজাটা খুলে গেল মসৃণভাবে। অহন লিফটের বাইরে পা দিয়ে গলায় আলগা হওয়া টাইয়ের নটটাকে শক্ত করল। সামনেই কাচের বড় দরজা, তার ওপরে কোম্পানির লোগো আঁকা। দরজা ঠেলে ঢুকল অহন। অফিসের ভেতরটা ঝকঝক করছে। সামনের রিসেপশনে রোগা মতো রিসেপশনিস্ট মেয়েটা কিছু লিখছে। অহন গিয়ে দাঁড়াল মেয়েটার সামনে। মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল। চোখে জিজ্ঞাসা।

অহন বলল, “মিস্টার রণদেব সাহা, আই হ্যাভ অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট।”

মেয়েটা পাশের সোফাটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “ইউ প্লিজ ওয়েট হিয়ার।” তারপর ইন্টারকম তুলে চাপা গলায় কথা বলল।

অহন বসল না। রিসেপশনের চারিদিকে খুব ভাল কিছু ফোটোগ্রাফ ঝোলানো রয়েছে। অহন ছবিগুলোর দিকে তাকাল। সবই ল্যান্ডস্কেপ। তার মধ্যে বরফ মোড়া উপত্যকার ছবিও রয়েছে কয়েকটা। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল আর্চির তোলা কাশ্মীরের ছবিগুলো। এবার শীতের শুরুতেই নাকি বরফ পড়েছে ওখানে। ছবিগুলো কেমন যেন ভৌতিক লেগেছিল ওর। আর্চির কথা মনে পড়াতেই হঠাৎ ওর খেয়াল হল চেকের কথা। গোরাটাকে তো পাঠিয়েছে জমা দিতে। এর মধ্যে কি ফিরে এসেছে ও? ছেলেটা এত স্লো, এত কুঁড়ে যে, মাঝে মাঝে বিরক্ত ধরে যায় অহনের। চেকটা ফাস্ট ক্লিয়ারিংয়ে চলে গেলেই ভাল।

“ইউ প্লিজ গো।” অহন দেখল, মেয়েটা ওকে কোথায় যেতে হবে হাত দিয়ে দেখাচ্ছে।

এ-অফিসে অনেক বার এসেছে অহন। ও জানে। অহন হেসে, ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেল ভেতরের দিকে।

রণদেব সাহার ঘর করিডোরের একদম শেষ প্রান্তে। ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল অহন। “কাম ইন?” রণদেব সাহার গলা।

অহন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতরটা পুরো সবুজ। সিলিং থেকে শুরু করে কার্পেট, টেবিল থেকে শুরু করে বসার জায়গা, সব সবুজ। তবে বিভিন্ন ধরনের সবুজ। ওকে দেখে রণদেব বললেন, “আসুন মিস্টার রয় বসুন। তারপর, হঠাৎ?”

অহন হাসল, “স্যার, একটা রিকোয়েস্ট নিয়ে এসেছি।”

“রিকোয়েস্ট?” রণদেব ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে শুনছি। আগে বলুন কোল্ড ড্রিঙ্ক খাবেন?”

“না, থ্যাঙ্ক ইউ।”

“সে কী মশাই? যার হয়ে ক্যাম্পেন করবেন, তা খেয়ে দেখবেন না? না হলে ড্রিঙ্কটার স্পিরিটটাই তো ধরতে পারবেন না।”

অহন হাসল, “না, আমি খাই না!”

শ্রাগ করলেন রণদেব। বললেন, “ঠিক আছে। বলুন তা হলে।”

অহন আর সময় নিল না। বলল, “স্যার, প্রেজেন্টেশনের জন্য আর দশটা দিন সময় দিন। একটা পয়েন্টে আটকে গিয়েছি আমরা।”

“দশ দিন?” রণদেব চোখ গোল গোল করলেন, “বলেন কী? আমার চাকরিটা খাবেন নাকি? এই বুড়ো বয়সে ছেলে-বউ নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াব যে।”

“কিন্তু স্যার, খুব দরকার ছিল সময়টা। মাত্র দশটা দিন, প্লিজ।”

“দেখুন মিস্টার রয়। সামনের ভ্যাল্টোইনস ডে-তে আমরা প্রোডাক্টটা লঞ্চ করব। জানেনই তো, এটা একদম নতুন ফ্লেভার। স্ট্রবেরি উইথ আ হিন্ট অব্‌ মিন্ট। দশ দিন পেছোনো মানে সব পিছিয়ে দেওয়া। এটা সম্ভবই নয়। উই আর অলরেডি লেট। ইউ এস থেকে এমনিতেই রোজ গালাগালি-সমৃদ্ধ মেল আসছে। বাই ফিফটিন্থ অব জানুয়ারি অ্যাড শুড বি আউট ইন পাবলিক। অলরেডি টিজার ছাড়ব কি না ভাবছি আমরা। টাইম দেওয়া আউট অব্‌ কোয়েশ্চেন। প্লিজ আন্ডারস্ট্যান্ড। তেমন হলে আপনারা উইথড্র করুন। নেকস্ট টাইম ট্রাই করবেন। কিন্তু এবার জমা দিতে হলে টোয়েন্টি এইটথ্‌-ই দিতে হবে। গট ইট?”

মাথা নিচু করল অহন। সুগতটা এমন ঝোলাবে ভাবেনি। কাজটা শেষ না করে চলে গেল কোন বুদ্ধিতে? এভাবে বিপদে ফেলল কেন? ছেলেটা ট্যালেন্টেড বলেই অহন ওকে রেখেছে। কিন্তু, ট্যালেন্ট উইথআউট সিনসিয়ারিটি ইজ আ বিগ জিরো। নাঃ, আর রাখবে না সুগতকে। নতুন ছেলে খুঁজতে হবে।

রণদেব বললেন, “শুনুন, এখনও তো সময় আছে। ক্রিসমাস-টিসমাস ভুলে গিয়ে চেপে কাজ করুন, হয়ে যাবে। বেস্ট অব্‌ লাক।”

অহন হাসল। তারপর উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। দরজার বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার আগে শুনল রণদেব বলছেন, “মিস্টার রয়, আমাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ সবাই পায় না। ইউ মাস্ট গ্র্যাব ইট।”

রাস্তায় বেরিয়ে ঘড়ি দেখল অহন। বারোটা আটত্রিশ। খিদে পাচ্ছে বেশ। এখন আর অফিসে যাবে না, এখানেই খেয়ে নেবে কোথাও। এদিকে উর্নিটা যে কী করছে, এতবার ফোন করছে কিন্তু মেয়েটা আর ফোনই ধরছে না। বিরক্ত লাগল অহনের। ও ভাবল ফালতু চিন্তা করে আর লাভ নেই। যা হবার হবে। ওসব বাদ দিয়ে এখন খেতে হবে আগে। উড স্ট্রিটের মোড়েই একটা রেস্টুরেন্ট। কিন্তু সেটা বন্ধ। অবশ্য অহন সেখানে খেতও না। আজ ওর ভেজিটেরিয়ান খাবার খেতে ইচ্ছে করছে। ও ভাবল এখান থেকে এক্সাইড মোড় খুব একটা দূর নয়, সেখানে যাওয়া যাক। ওই রেস্টুরেন্টটায় ভেজিটেরিয়ান ডিশ পাওয়া যায়।

দ্রুত হাঁটতে লাগল অহন। বহুদিন এভাবে কলকাতার রাস্তায় একা হাঁটেনি ও। এখন তো হয় গাড়ি, নয় ট্যাক্সি করে ঘোরে সবসময়। তার বাইরে তো অন্য ভাবে থাকাই হয় না। ওর এখনও মনে আছে ঋ-এর সঙ্গে সম্পর্কের সময় ওরা দু’জনে খুব হাঁটত। আর সারাটা পথ বকবক করত ঋ। যার বেশির ভাগটাই স্যাটার ডে রিভিউ। ঋ-এর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অহনের দুঃখ হয়েছিল বেশ, কিন্তু কিছু সময় কেটে যাবার পর ও বুঝেছিল দুঃখের চেয়ে যেন স্বস্তিটাই বেশি পেয়েছে ও। যেন একটা হাঁপ-ছাড়া ভাব, যাক কেউ তো আর সবসময় খুঁত ধরবে না, বোঝাবে না যে, ও কতটা অপদার্থ। সত্যি কথা বলতে কী এখন ওর কাছে ঋ-এর স্মৃতি তেমন জোরদার নেই আর। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় ও কি সত্যিই ঋ-কে ভালবেসেছিল?

রেস্টুরেন্টের কাচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অহন। খুব বেশি সিট খালি নেই। তবে কোনার দিকে একটা টেবিল খালি রয়েছে। ও গিয়ে বসল সেখানে। ওর সামনের চেয়ারটা খালি। একটু হাঁপাচ্ছে অহন। আজকাল সামান্য হাঁটলেই জিভ বেরিয়ে যায় ওর। বুঝল, অনভ্যাস। ও পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। এবার উর্নিকে একটা মেসেজ পাঠাবে। কি-প্যাড অ্যাক্টিভ করে মেসেজটা লিখল ও : WHERE R U? GOT ANY NEWS? IM : (।

মেসেজটা পাঠিয়ে মোবাইলটা টেবিলে রেখে চোখ তুলল অহন আর সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা খেল। কে ওটা? এত সুন্দর! এত আলোময়! অবাক হয়ে একটু কোনাকুনি বসে থাকা মেয়েটার দিকে ও তাকিয়ে রইল। এত সুন্দর যেন জীবনে দেখেনি অহন। এ মেয়ে কোথায় ছিল এই তিরিশ বছর ধরে? অহনের মনে হল এর জন্যই এতদিন বেঁচে ছিল ও। এমন একজনের জন্যই অপেক্ষা করছিল এতদিন। প্রথম দেখায়, সম্পূর্ণ অজানা কারও প্রেমে কোনওদিন পড়তে পারে কেউ? কিন্তু অহন পড়ল— আকাশ থেকে মেঘে পড়ল, মেঘ থেকে রামধনুতে পড়ল, রামধনু থেকে নদীর জলে পড়ল। তারপর অহন ভাসতে লাগল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। ওর কি শরীর খারাপ করছে? স্রোত কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওকে? এ যাত্রার গন্তব্য কোথায়? এ স্রোত কি ওকে আবার ওর কিশোরবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? সময় কি উলটো দিকে বইতে শুরু করল? নাকি এই তিরিশ বছরেও ওর কৈশোর শেষ হল না!

কতক্ষণ অহন তাকিয়ে ছিল মেয়েটার দিকে মনে নেই কিন্তু এবার হুঁশ হল। ওয়েটার ডাকছে। ও থতমত খেয়ে মুখ ফেরাল পাশে। “স্যার, আপনার অর্ডারটা?”

অহনের মনে পড়ল এখানে খেতে এসেছে ও। কিন্তু কী খাবার? ও, ভেজিটেরিয়ান। ও আরও সেকেন্ড দশেক সময় নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে, তারপর বলল, “একটা মিক্সড চাট দেবেন।”

“আর কিছু?” ওয়েটারটা অহনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে মনে হল। এ বাবা, ও কী আদেখলার মতো তাকিয়েছিল? অহন নিজেকে সংযত করল, বলল, “না, আর কিছু নয়।”

ওয়েটারটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবার দিয়ে গেল। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই অহন প্রায় বার দশেক তাকিয়েছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটাও দেখেছে কয়েক বার। ও ঠিক করল আর তাকাবে না। বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে। দ্রুত খাবার শেষ করায় মন দিল অহন। কিন্তু ওর অবাধ্য চোখ বারবার মেয়েটাকে দেখতে চাইছে। এ কী হল রে ভাই? জীবনে এমন তো কোনওদিন হয়নি! জলের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে জল খেল অহন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিষম খেল জোরে। নাকে জল ঢুকে গেছে ওর। চোখ, নাক জ্বালাও করছে খুব। তবু তাই নিয়েও ও দেখল মেয়েটা এসে দাঁড়িয়েছে ওর সামনে। প্লেটের তলার থেকে পেপার টাওয়েল বের করে কোনওমতে মুখটা মুছল অহন। ভাবল, এই রে মেয়েটা আবার উলটোপালটা কিছু বলবে না তো? কিন্তু অহনকে আশ্চর্য করে দিয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার মোবাইল থেকে একটা ফোন করতে দেবেন? দেখুন না, আমারটা ভেঙে গেছে।”

অহন ব্যাপারটা বুঝতে সময় নিল একটু, তারপর হুড়োহুড়ি করে টেবিলে রাখা নিজের মোবাইলটা তুলতে গিয়ে উলটে ফেলল জলের গ্লাস। ইডিয়ট। কী হয়েছে ওর? এমন টিনএজারদের মতো ব্যবহার করছে কেন? কোনওমতে ও মেয়েটার হাতে মোবাইলটা তুলে দিয়ে হাসল। গবেট। আবার নিজেকে ধমক দিল অহন। বোকার মতো হাসছে কেন? দাঁতে যদি খাবারের টুকরো লেগে থাকে?

মেয়েটা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, অনেককে বলেছিলাম, কেউ দেয়নি। তার দেখুন না বাইরে গিয়ে যে ফোন করব, তারও উপায় নেই। যার সঙ্গে দেখা করব সে যদি ততক্ষণে চলে আসে! প্রায় ঘণ্টাখানেক ওয়েট করছি।” মেয়েটা অন্যের জন্য ওয়েট করছে! কোনও ছেলের জন্য কি? ছোট্ট করে একটা কাঁটা ফুল অহনের বুকে। ও কিছু বলার আগেই শুনল পাশের টেবিলের দুটো ছেলে হাসছে। এবং এক জন অন্য জনকে বলছে, “সবুরে মেওয়া ফলে। অনেকক্ষণ ঝাড়ির ফল, ফোন। চামকি জিনিস দেখে জল ফেলে একসা…”

অহন বুঝল উদ্দেশ্যটা ও। খুব রাগ হয়ে গেল ওর। ভাবল কিছু একটা বলে, কিন্তু তার আগেই ঘটনাটা ঘটল। ওর মোবাইল নিয়ে ডায়াল করতে থাকা মেয়েটা সটান ঘুরল ছেলেগুলোর দিকে তারপর কঠিন গলায় বলল, “এক থাপ্পড় মারব ইডিয়ট। আমি এখানে আসা থেকে অসভ্যতা করছ। নোংরা কথা বলা? আর একটা কথা বলেছ কি পায়ের জুতো দিয়ে মারব।”

ছেলে দুটো থতমত খেয়ে গেছে একদম। হট্টগোলে ম্যানেজারও ছুটে এসেছে। অহন দাঁড়িয়ে পড়েছে অবাক হয়ে। মেয়েটা আবার বলল, “রাস্কেল কোথাকার। দামি জামা কাপড়ই পরেছ, ছোটলোকামো যায়নি, না?”

ছেলে দুটো ঘাবড়ে গিয়ে হাত তুলে থামতে বলছে মেয়েটাকে। কিন্তু মেয়েটা বলেই যাচ্ছে। অহন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। রাগলেও কাউকে এত সুন্দর দেখায়! ম্যানেজার এবার বলল, “ম্যাডাম, প্লিজ কাম ডাউন। প্লিজ।”

তারপর ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্লিজ, আপনারা আসুন। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি প্রবলেম।”

মেয়েটা এবার অহনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন এখান থেকে। যত সব সিক পিপল।”

অহন কোনওমতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট টেবিলে রেখে বাইরে বেরিয়ে এল মেয়েটার সঙ্গে। ফুটপাথের এক কোণে দাঁড়াল ওরা। অহন মুগ্ধ চোখে দাঁড়িয়ে দেখল মেয়েটা ফোনে ট্রাই করছে কোনও নম্বর। এই দুপুরের এক্সাইড মোড়, এই গাড়ির জটলা, এই লক্ষ লক্ষ মানুষ সব হঠাৎ ভীষণ সুন্দর লাগাল অহনের। ওর মনে হল এই ধুলো-মলিন শহরটা বহু দিন পরে বেঁচে উঠেছে যেন। এই দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনেক দিন পর নিজেকে জীবিত লাগছে ওর। মনে হচ্ছে অ্যাডের টেনশন সম্পূর্ণ ভ্যানিশ! এই কি মুড শিফটিং?

“নাঃ, পাচ্ছি না, আউট অব অর্ডার। বোধহয় আসবেন না আর। আমার কপালটাই খারাপ। বাই দ্য ওয়ে থ্যাঙ্ক ইউ।” হেসে ফোনটা ফেরত দিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরল মেয়েটা।

“ইয়ে… মানে…” কে জানি পেট টিপে অহনের ভেতর থেকে টুথপেস্টের মতো বের করে আনল কথাগুলো। ডিকশনারির লেখক কি?

“কিছু বলবেন?” মেয়েটা আবার তাকাল ওর দিকে।

“আমি ইয়ে… ভদ্রবাড়ির ছেলে… মানে…” জিভ কাঁপছে অহনের। অনেক কথা একসঙ্গে বেরোতে চাইছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মারামারি করে জট পাকিয়ে ফেলছে তারা। তাও চেষ্টা করে ও বলল, “আমি… আপনি…”

মেয়েটা হাসল, “বলুন না। কী বলবেন?”

“আপনি আমার সঙ্গে একদিন কফি খাবেন?” অহনের পা কাঁপছে থরথর করে। প্রাণপণে ও নিজের জিভকে আটকাতে চাইছে, পারছে না। এসব কী বলছে ও? কে বলাচ্ছে ওকে?

“কফি?” মেয়েটার ভুরু বাঁকছে এবার। এই রে খেপে গেল নাকি? ওকেও ওইসব গালাগাল খেতে হবে নাকি এখন?

“হ্যাঁ মানে… যবে খুশি। কাল, পরশু, পরের মাসে, তার পরের মাসে, যখন খুশি। খাবেন?” অহন হতাশ হয়ে বুঝল ওর জিভের ব্রেক ফেল করেছে।

মেয়েটাও শক্ত মুখে তাকিয়ে আছে।

অহন বলল, “প্লিজ, নাও খেতে পারেন, কিন্তু রাগ করবেন না। আমার তা হলে… ইয়ে… মানে…”

মেয়েটা এবার হাসল। অসাধারণ দাঁত। অহন অবশ হয়ে এল প্রায়।

মেয়েটা বলল, “ঠিক আছে খাব। এত টেনশড হচ্ছেন কেন?”

অহন বোকার মতো মুখ করে হাসল। কিছু বলা দরকার। কিন্তু কী বলবে? ব্রেক আবার কাজ করতে শুরু করেছে এখন। মাথার ভেতরের লোকটা চম্পট দিয়েছে কোথাও। এবার হঠাৎ ওর হাতে ধরা ফোনটা বেজে উঠল টুং টাং করে। অহন দেখল, উর্নি। ও সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “ফোনটা ধরি?”

মেয়েটা হাসল, “ধরুন, আমি ওয়েট করছি। বাই দ্য ওয়ে আমি মেহের!”

অহন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল মেহেরের দিকে। সেই দৃষ্টির মধ্যে কি শীতকাল আরও সুন্দর হয়ে উঠল? অজানা সব পাখিরা কি ফিরে এল কলকাতায়? ভোরবেলায় শিশির কি আবার জমতে লাগল ফুলের পাপড়িতে? কী হল কে জানে? শুধু খুব গোপনভাবে ওর মনে হল একদিন না একদিন নিজের থেকে মেহেরকে চুমু খাবে ও। ওর হাতের ফোনটা বেজে চলল— বেজেই চলল… অহনের আবছাভাবে মনে পড়ল অ্যাড ক্যাম্পেন না কী নিয়ে একটা ঝামেলা আছে না?

উর্নি : ২৪ ডিসেম্বর, দুপুর একটা পঁচিশ

ফোনটা ধরছে না কেন অহন? এতক্ষণ রিং হচ্ছে, তবু ধরছে না কেন? উর্নি ফোনটা কানে লাগিয়ে রাখল। গানটা বাজছে। কলার টিউন। অহনের মোবাইলে ফোন করলেই এই গানটা বাজে। উর্নি কানে ফোনটা ধরে চুলের মধ্যে হাত ডোবাল। I M : ( মানে খুব চিন্তিত। অহন সব সময় চিন্তা করে। অবশ্য চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক। আর উর্নি নিজেও কম চিন্তিত নয়।

মুকুলদা তো সকালেই ভাগিয়ে দিয়েছিল ওকে। লোকটা ভীষণ উলটোপালটা কথা বলে। সকালে উর্নিকে বলেছিল, “আমি বাজারের কাঁচা আম নাকি, যে আমায় নিয়ে গিয়ে চাটনি বানিয়ে দেবে? এ নুডলস্‌-এর যুগে সবই কি টু মিনিটস-এ হয়? আর আমি কি বেশ্যা নাকি, যে অন্যের বিছানায় গিয়ে শোব? কে হাফ-ডান কাজ করে গেছে তা শেষ করব আমি? আমার এখন এই অবস্থা হয়েছে? অহনের সাহস হল কী করে তোমায় আমার কাছে পাঠায়?”

উর্নি অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, ভদ্রলোক শোনেনি। বলেছিল, “আমায় আজ যা অপমান করল বিটা অ্যাড তা জীবনেও ভুলব না আমি। তুমি বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”

“হ্যালো?” আশ্বস্ত হল উর্নি, যাক, ফোনটা ধরেছে তা হলে শেষ পর্যন্ত।

ও বলল, “অহনদা, আবার টেনশন করছেন? অমন মেসেজ পাঠিয়েছেন কেন? আমি বলছি তো একটা ব্যবস্থা ঠিক হবে।”

“না না ঠিক আছে। ইউ ক্যারি অন।”

ভুরু কুঁচকে গেল উর্নির। অহনের গলায় টেনশন নেই তো তেমন। বরং যেন ফোনে কথা শেষ করতে পারলে বাঁচে। এ কী রে ভাই! ও বলল, “কী অহনদা সব ঠিক আছে তো? আপনি টেনশন করছেন না তো?”

অহন বলল, “টেনশন করে লাভ হবে কিছু? তার চেয়ে, ডু হোয়ট এভার ইউ ক্যান।”

উর্নি বলল, “ঠিক আছে অহনদা, ডোন্ট ওয়রি।”

“বাই।” টুক করে ফোনটা কেটে দিল অহন।

যাঃ বাবা! এ কী হল? যে-মানুষটা এই কাজটা নিয়ে এতটা নার্ভাস ছিল সে হঠাৎ এমন তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে দিল কেন? তা হলে কি এর চেয়েও জরুরি কোনও কাজ করছে অহন? না কি হাল ছেড়ে দিল? আশ্চর্য, অহনের কেসটা কী? নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যায়নি তো? হতেই পারে, মানুষ খুব নরমসরম তো। নরমসরম আর ভাল। এ মানুষটাই কিন্তু বিপদে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে।

রৌনক ফ্রি স্পিরিটের বাহানা দেখিয়ে চলে যাওয়ার পর, মেন্টাল ব্রেক ডাউন হয়ে গিয়েছিল উর্নির। দিনের পর দিন নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রাখত ও। কারও সঙ্গে কথা বলত না। মায়ের মৃত্যুর পর যে বাবা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, চাকরি থেকে ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়িতেই থাকত, উর্নির এই অবস্থায় সেই নৈর্ব্যক্তিক বাবাও বিচলিত হয়েছিল খুব।

সেই সময় দিনগুলো কেমন যেন কালো কাপড়ে মোড়ানো ছিল। উর্নি কিছুতেই বুঝতে পারত না কেন রৌনক ওকে ছেড়ে গিয়েছিল। কী দোষ করেছিল ও? ও তো সর্বস্ব দিয়ে ভালবেসেছিল রৌনককে। ওর মনে হত রৌনক ছাড়া ওর জীবনে কিছু নেই, কেউ নেই। তা হলে? কী হয়েছিল ওদের সম্পর্কে?

ওর ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা কিন্তু বারবার ওকে বারণ করত রৌনকের সঙ্গে মিশতে। রৌনক থিয়েটার করত। আর সে সময় প্রচুর থিয়েটার দেখতে উর্নিরা। সে রকমই এক শো’য়ে রৌনকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল উর্নির। আলাপ হওয়ার পর রৌনক বলেছিল, “তোমার নাম উর্নি? স্ট্রেঞ্জ, আমি তো ভাবলাম কিয়েরা নাইটলি। অবশ্য ইউ হ্যাভ আ লং হেয়ার।” তখন সত্যিই ও বড় চুল রাখত। কিন্তু ওইটুকু কথাতেই কোথাও নদীর মুখ খুলেছিল একটা।

তারপর দেখাসাক্ষাৎ বাড়তে লাগল দু’জনের। লম্বা, ছাই-রঙা চুলের রৌনককে দেখলেই শরীরের ভেতরে কেমন করত ওর। মনে হত ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই বুকের মধ্যে। ওর বন্ধুরা ওকে সাবধান করত। বলত, “উর্নি, বুঝেশুনে পা ফেল কিন্তু।”

কিন্তু কোথায় পা ফেলবে উর্নি? ও তো তখন আকাশে।

একদিন ট্যাক্সি করে যেতে যেতে উর্নি প্রথম সাহস দেখিয়েছিল। গা ঘেঁষে বসেছিল রৌনকের। তারপর আলতো করে মাথা রেখেছিল ওর কাঁধে। আচমকাই রৌনক টেনে নিয়েছিল ওকে। গভীর আশ্লেষে ও মুখ উঁচু করে চুমু খেয়েছিল রৌনকের খাঁজ-কাটা থুতনিতে। তারপর আলতো স্বরে বলেছিল, “আমায় তুমি নেবে না?”

তারপর কী হয়েছিল আজও ঠিক মনে করতে পারে না উর্নি। সময় যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল একদম। শুধু, অনেক অনেক পরে, ও দেখেছিল রৌনকের নগ্ন শরীরের ওপর ও গুটিসুটি মেরে শুয়ে রয়েছে।

যৌনতা কী, রৌনকই শিখিয়েছিল ওকে। বিস্ময়ে, আরামে আর নিরাপত্তায় ও একদম মিশে থাকত রৌনকের সঙ্গে। অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়েছিল যে, ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেয় ও। ওর সমস্ত অস্তিত্ব রৌনক ছাড়া কিছু জানত না। বাবা শুধু তাকিয়ে দেখত। কিছু বলত না। একা একটা রকিং চেয়ারে বসে বই পড়ত সারাদিন।

উর্নি এর মধ্যে রৌনকের কথায় চুল কেটে ফেলেছিল ছোট করে। রৌনক ওকে, চুল কাটার পর, দেখে “এভাবে নয়, এভাবে” বলে হাত দিয়ে ওর মাথার চুলটা ঘেঁটে দিয়েছিল একটু। তারপর বলেছিল, “ইউ লুক ড্যাম সেক্সি ইন দিস হেয়ার। আই হ্যাভ আ হার্ড অন, হোয়েন ইউ লুক লাইক দিস।”

“‘হোয়েন’ মানে?” উর্নি অবাক হয়েছিল।

রৌনক বলেছিল, “আমি সবসময় কল্পনায় তোমাকে এভাবে দেখতাম।”

নিজের জীবনের সমস্ত গোপন কথা ও বলেছিল রৌনককে। এমনকী মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটাও নিজের থেকে রৌনককে বলেছিল ও। আর সেই দিনটাও ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর। রৌনক নিজের ওই দূষিত আকাশ-রঙা ফ্ল্যাটে উর্নিকে নিয়ে বড়দিন পালন করতে চেয়েছিল। সঙ্গমের পর একটা পেস্ট্রির টুকরো নিয়ে এসে ওর মুখের সামনে ধরেছিল রৌনক। বলেছিল, “মেরি ক্রিসমাস, উর্নি।” উর্নি দেখেছিল মোটা করে চকোলেট ক্রিম লাগানো পেস্ট্রি। চকোলেট ক্রিম। মা খুব ভালবাসত। হঠাৎ আবার বুকের ভেতর গভীর কুয়োয় সরসর করে নেমে যাচ্ছিল একটা বালতি। গলার কাছে অজানা এক ভয় এসে আঁকড়ে ধরছিল ওকে। তবু বালতিটা নামছিল, নেমেই যাচ্ছিল। পেস্ট্রিটা খেতে পারছিল না উর্নি। শুধু খটখটে শুকনো চোখ নিয়ে ও তাকিয়েছিল টুকরোটার দিকে। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছিল, যেভাবে অল্প হাওয়ায় ঘাসের ফলক কঁপে। ওর দিকে স্থির হয়ে তাকিয়েছিল রৌনক। তারপর আলতো করে ওকে টেনে নিয়েছিল বুকে। ছলাত শব্দে বালতি পড়েছিল জলে। মাটির গভীর থেকে জল উঠে এসেছিল। বহু দিন পর শুকনো চোখে জল এসেছিল উর্নির। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে, রৌনকের বুকের সঙ্গে লেগে খুব কেঁদেছিল ও।

আর সেই রৌনক কিনা চলে গেল? উর্নি কী বলেছিল এমন?

শুধু বলেছিল, “আমায় এবার বিয়ে করো তুমি।”

রৌনক শুনে হেসেছিল খুব। কিন্তু উর্নি জেদ ধরায় প্রথমে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল ওকে, তারপর রাগারাগিও করেছিল ও। বলেছিল ও বাঁধা পড়তে চায় না। বাঁধতেও চায় না কাউকে। ও ফ্রি স্পিরিট।

রৌনকের প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি উর্নি। এক অখণ্ড শূন্যতা এসে ঢুকে গিয়েছিল ওর মাথায়। আস্তে আস্তে চারিদিকটা কালো চাদরে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ক্রমশ। শূন্যতা কী, সময় থেমে যায় কখন, অন্ধকার কীভাবে কথা বলে, সব বুঝতে পেরেছিল উর্নি। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ চিকিৎসা। এবং কাউনসেলিংয়ের পর সুস্থ হয়েছিল ও। কিন্তু মাঝের ওই শূন্য দিনগুলো হারিয়ে গিয়েছিল ওর স্মৃতি থেকে।

লোকে আড়ালে ওকে পাগলি বলত। তবে আড়ালে বলা সমস্ত কথাই কখনও না কখনও প্রকাশ পায়। উর্নিও জানতে পেরেছিল। কিন্তু ওর তখনও মনে হত, আর এখনও মনে হয়, পাগলামো যাকে বলে, তা অস্বাভাবিক নয়। এই সাড়ে সাত, আট হাজার বছরের তথাকথিত মানব সভ্যতা, মানুষকে যা ভাবতে শিখিয়েছে, তার বিপরীতে বা সেই স্পেকট্রামের বাইরের সমস্ত কিছুই পাগলামো বলে ধরা হয়। তাই নতুন কোনও তত্ত্বের কথা যখন প্রথম কেউ বলে তাকে পাগল বলে উড়িয়ে দেয় লোকে। আর সেই পাগলই যখন হাতেকলমে তার পাগলামোকে প্রমাণ করে দেয় তখন পৃথিবী তাকে জিনিয়াস বলে। আসলে সব কিছুই একটা ইলিউশন। সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে হয়তো এই ইলিউশনের দরকার হয়। সবাই তাতেই বিশ্বাস করে, বিশ্বাস করে অক্সিজেন ছাড়া কোনও জীব বাঁচতে পারে না। তারা ভুলে যায় এত বড় গ্যালাক্সিতে কোথাও হয়তো মিথেন নিয়ে বেঁচে থাকা জীবকুল সভ্যতা তৈরি করেছে। উর্নির মনে হয়, সমাজের অ্যাকসেপটেড ফ্রিকোয়েন্সি থেকে যখন কোনও মানুষের মস্তিষ্ক অন্য ফ্রিকোয়েন্সিতে জাম্প করে, তখন সবাই তাকে পাগল বলে। ও নিজেও হয়তো সে রকম কোনও ফ্রিকোয়েন্সিতেই ছিল কিছু দিন।

সমাজের অ্যাকসেপটেড ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিরে আসার পর উর্নি বুঝেছিল প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে গেছে। ওর জীবনের একটা অংশ ভেঙে গেছে সম্পূর্ণ। তার ওপর বাড়ির অবস্থাও ভাল নয়। ওর চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। ও হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছিল। সেই সময় খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ও এসেছিল বিটা অ্যাডে। ইন্টারভিউতে প্রতুলস্যার প্রচুর প্রশ্ন করলেও অহন বিশেষ প্রশ্ন করেনি। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

চাকরিটা পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিল উর্নি। ওর চেয়েও তো ভাল ক্যান্ডিডেট ছিল। ও পেল কী করে কাজটা? মাস চারেকের মাথায় একদিন কথায় কথায় প্রশ্নটা ও করেই ফেলেছিল অহনকে। তত দিনে ও বুঝে গিয়েছিল অহন কেমন মানুষ।

অহন মৃদু হেসে বলেছিল, “আসলে কী জানো, তোমার মধ্যে এমন দুটো শব্দ আছে যা আমার ডিকশনারিতে নেই।”

“মানে?” বুঝতে পারেনি উর্নি।

অহন বলেছিল, “অ্যাগ্রেশন আর কনফিডেন্স।”

“আপনার মধ্যে যে এ দুটো নেই, কে বলল?”

অহন হেসেছিল তারপর, অনেক দূরে তাকিয়ে আছে, এমনভাবে বলেছিল, “সে ছিল একজন।”

তবু মাঝে মাঝে রৌনকের ভূত এসে চাপত ওর ঘাড়ে। আবার টলমল করত মাথা। এক অশেষ শূন্যতা ঘুরে বেড়াত ওর মাথার চার পাশ দিয়ে। এরকমই একদিন সুগতর ঘুলঘুলিতে দু’পেগ জিন খেয়ে ‘রৌনক রৌনক’ করে চিৎকার করেছিল উর্নি। সুগতর একটা ঘড়ি ভেঙে দিয়েছিল, ওর ইজেল ভেঙে দিয়েছিল, তারপর ঘরের মেঝেতে শুয়ে অনেক কথা বলেছিল ও। কেঁদেও ছিল খুব। ভাগ্যিস সুগতর রিনিদি আর জামাইবাবু বাড়ি ছিল না তখন। থাকলে যাচ্ছেতাই ব্যাপার হত।

সুগত খুব বেগ পেয়েছিল সেদিন। লেবু-জল থেকে ব্ল্যাক কফি সব কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল উর্নিকে। পারেনি। তারপর কোনওরকমে ওকে ধরে নিয়ে য়ে বমি করিয়েছিল বাথরুমে। পরদিন অফিসে সুগত বলেছিল, “কেন মাল খেতে যাস? পুরো লেডি দেবদাস! কাল আমায় পুরো টাইট দিয়ে ছেড়েছিলি। আর শালা কোনওদিন মাল খাবি না। তোর ওসব সহ্য হয় না।”

সুগত ছেলেটা ভাল। কিন্তু একটুও দায়িত্ববোধ নেই। এই যে আজ চলে গেল, এর কোনও মনে আছে? আশ্চর্য ছেলে! কে জানে এর পর ওর চাকরিটা থাকবে কি না!

প্রায় দেড়টা বাজে, এবার একবার দেখা যেতে পারে। গ্রিক চার্চের গলিটা ধরে ভেতরে ঢুকে গেল উর্নি। চার্চের পাশের এই রাস্তাটা সরু তবে পরিষ্কার। চারিদিকে গাছে ঢাকা। এই গলির শেষ বাড়িটা রূপা বাগচির নতুন স্টুডিয়ো। চেতলায় গিয়ে এই ঠিকানাটা পেয়েছে ও। ওখানে আর রূপা বাগচির স্টুডিয়ো নেই।

খানিকক্ষণ আগে এই স্টুডিয়োটায় গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে উর্নি। এখনও আসেননি রূপাদি। দেড়টা নাগাদ আসতে পারেন। কে জানে এখন এসেছেন কি না? ও তো গলির সামনেই দাঁড়িয়েছিল এতক্ষণ! অবশ্য গলির অন্য কোনও এট্রান্সও থাকতে পারে। কিন্তু রূপাদি যদি না করে দেন তা হলে ভীষণ বিপদ হবে। কারণ, রাজ গুহকেও পায়নি উর্নি। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে ওর। এখানে ব্যর্থ হলে কী করবে ও?

স্টুডিয়োর বাইরে ছোট্ট মোড়ায় ছেলেটা বসে রয়েছে। এই ছেলেটার কাছেই উর্নি শুনেছে যে, রূপাদি দেড়টা নাগাদ আসতে পারেন। উর্নি গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটার সামনে। একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল ছেলেটা। উর্নিকে দেখে উঠে দাঁড়াল ও, বলল, “দিদি আজ আসবেন না। সল্টলেক থেকে বেরোতে পারছে না। একটু আগেই ফোন করেছিলেন। আমি তো খুঁজলাম আপনাকে, ভাবলাম, জানিয়ে দিই। কোথায় ছিলেন আপনি?”

উর্নি ঠোঁট কামড়াল। আজ কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কী হয়েছে আজ? ও ভাবল একবার নিজে ফোনে কথা বলে, কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবল, তাতে লাভ হবে না। কারণ, সল্টলেক থেকে যদি এখন না-ই আসতে পারেন তা হলে কাজ ত এখন শুরু করতে পারবেন না। ও ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “রূপাদিকে রাতে পাওয়া যাবে ?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল, “আজ তো পাওয়াই যাবে না আর। ওঁরা তো রাতেই গাড়ি করে শান্তিনিকেতন চলে যাচ্ছেন। সামনে লম্বা হলিডে।”

উর্নির ইচ্ছে হল নিজের মাথার চুলগুলো টেনে টেনে ছেঁড়ে। কী শুরু করেছে এরা ? সবাই একসঙ্গে কলকাতা ছেড়ে পালাচ্ছে নাকি? এক্সোডাস শুরু হল? বছরের শেষে কী যে হয়, লোকেরা সব কুঁড়ের হদ্দ! কই, ওর তো কিছু মনে হয় না! মানুষের কাজ না-করার একটু অজুহাত পেলেই যেন হল।

ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, “আপনার কি খুব দরকার ছিল ম্যাডাম? সল্টলেকের ঠিকানাটা দেব?”

মাথা নাড়ল উর্নি, “না”, তারপর বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ভাই”। ছেলেটা আবার মোড়ায় বসে ম্যাগাজিন খুলল।

স্টুডিয়োর কাচের দরজায় নিজের মুখটা দেখল উর্নি। রোদে চশমাটা কালো হয়ে আছে, মাথার চুলগুলোও এলোমেলো। ও কি তা হলে অহনের দেওয়া এই কাজটা করতে পারবে না? আচ্ছা, অহনই বা অমন করে কথা বলল কেন? তবে কি অহনও হাল ছেড়ে দিল? কী যে হবে কে জানে?

নিজের চিন্তার অস্থিরতায়, নিজেরই বিরক্ত লাগাল উর্নির। ও আবার গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল। হাওয়া দিচ্ছে বেশ। সারা কলকাতা জুড়ে আজ ওলট-পালট হাওয়া দিচ্ছে। আগে, এইসব হাওয়ার দিনে চুপচাপ বাড়ির ছাদে গিয়ে বসে থাকত উর্নি। তখন মা বেঁচে ছিল। পাশের বড় হলুদ রঙের চাৰ্চটা দেখে হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ল উর্নির। আচ্ছা, মা যখন ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়েছিল ঠিক তার আগের মুহূর্তে কি ওর কথা মনে আসেনি মায়ের? কীসের দুঃখ ছিল মায়ের? কেন অবসন্ন হয়ে পড়েছিল শেষের দিনগুলোয়? কাল বড়দিন, সবার আনন্দের দিন। কিন্তু উর্নির? ওর মনে পড়ল বাবার জন্য ফ্রুট কেক কিনে নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে। রাতে যিশুর পায়ের তলায় জ্বালিয়ে রাখতে হবে কাচের পাত্রে রাখা ছোট্ট মোম।

এ-সময় অফিসে থাকলে লাঞ্চ করে উর্নি। তাই শরীর জানান দিচ্ছে এখন। খিদে পাচ্ছে ওর। সামনেই একটা বড় ঠ্যালা।

খাবার বিক্রি করছে একজন। এখানেই যা হোক কিছু খেয়ে নিতে হবে ওকে। তারপর নতুন করে চিন্তা করতে হবে কী করা যায়!

বড় ঠ্যালাটার পাশে খাবারের চার্ট ঝোলানো। চশমাটা খুলে ব্যাগের মধ্যে রাখল উর্নি। কে জানে কেন, খাওয়ার সময় চশমা চোখে রাখতে পারে না উর্নি। ও চার্টটা দেখে এক প্লেট চাউমিন অর্ডার দিল। ও জানে রাস্তার ধারে এইসব জায়গায় জঘন্য খাবার বানায়, তবু এখন তো খাওয়ার কথা চিন্তা করলে হবে না। এখন যা হোক খেয়ে নিতে হবে, কারণ, সামনে অনিশ্চিত সময় পড়ে রয়েছে, কাজ পড়ে রয়েছে অনেক।

অর্ডারটা দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল উর্নি। কতগুলো চ্যাংড়া ধরনের ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে ঠ্যালার সামনে। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলল, “ন্যাপাদা, চটপট ডিম টোস্ট করে দাও তো ছ’টা। আমাদের বিশ্বে শান্তি আনতে যেতে হবে।”

“মানে?” তাওয়ার ওপর চাউমিন নাড়তে নাড়তে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল ন্যাপাদা।

“আরে আজ মিছিল আছে না? আমাদের সব যেতে বলেছে। দেশপ্রিয় পার্ক টু ময়দান। তুমি তাড়াতাড়ি করে দাও গুরু, না হলে কিন্তু বিশ্বশান্তির আগেই অশান্তি শুরু হয়ে যাবে।”

উর্নি দেখল ছেলেগুলো ন্যাপাদা নামক লোকটার সঙ্গে কথা বললেও ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখের দৃষ্টিটা ভাল লাগল না উর্নির। বদ ছেলের দল। ও অন্য দিকে মুখ ঘোরাল। আরে ওটা কী?

উর্নি দেখল কয়েক হাত দূরে চার্চ-ঘেঁষা রেলিংয়ের গায়ে কতগুলো ছবি ঝোলানো রয়েছে। আর তার সামনে ছোট্ট টুলের ওপর একটা বেঁটে ফরসা ছেলে বসে আছে। সামনেই ফুটপাথে দাঁড় করানো একটা সাইনবোর্ড। তাতে লেখা, পোর্ট্রের্ট ও কার্টুন আঁকা হয়। ছেলেটা হাঁটুর ওপর রাখা ক্লিপ বোর্ডে একটা ড্রইং শিট বিছিয়ে কী সব দেখছে। কৌতুহল হল উর্নির। এমন তো দেখেনি কলকাতায়!

“দিদি, আপনার চাউমিন”। ন্যাপাদার ডাকে মুখ ফেরাল উর্নি। একটা প্লাস্টিকের প্লেটে চাউমিন দেওয়া হয়েছে। আর তার ওপর ছড়ানো শশা আর পেঁয়াজ কুচির মধ্যে একটা ফর্ক গাঁথা। উর্নি প্লেটটা নিয়ে সরে এল ওই ছবিগুলোর সামনে।

দেওয়ালে ছ’টা ছবি টাঙানো রয়েছে। তার মধ্যে একটা ছবি দেখে থমকে গেল ও। ভাল করে দেখবার জন্য আরও একটু কাছে এগিয়ে গেল উর্নি। বিরাট বড় একটা মাঠের মধ্যে একটা মেয়ে ভেসে আছে। মেয়েটার পিঠে প্রজাপতির মতো ডানা, আর মেয়েটাকে ঘিরেও রয়েছে প্রচুর প্রজাপতি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটার কোমর অবধি রয়েছে আর বাকিটা গাছের শিকড়ের মতো। তবে ছবিটা উর্নির অদ্ভুত লাগল, কারণ ছবিটা এমনভাবে আঁকা রয়েছে যেন মনে হচ্ছে, কেউ ঢিল মেরে ভেঙে দিয়েছে গোটা ছবিটাকে। উর্নি দেখল ছবিটার তলায় নাম লেখা রয়েছে—‘বাট, ড্রিমস’। অ্যাডভার্টাইজিংয়ে কাজ করতে করতে নানা রকম শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে হয় উর্নির, তা ছাড়া বরাবরই ছবি সম্বন্ধে ওর একটা ভাল লাগার থেকে তৈরি ধারণা রয়েছে। ও বুঝল, ছেলেটার হাত ভাল।

পেছন ফিরে উর্নি দেখল শিল্পী ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর সবুজ চোখ দুটোয় নানান জিজ্ঞাসা। উর্নি হাসল ওকে দেখে। আর তখনই ছেলেটার কোলের ওপর পেতে রাখা ড্রইং বোর্ডটায় নজরে গেল উর্নির। কী ওটা? উর্নি শক খেল যেন। এ কী দেখছে ও? সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের বোতল, কোম্পানির লোগো, দুটো মেয়ের শরীর… এগুলো এই ছেলেটার কোলে কী করছে? উর্নি ছেলেটার সামনে রাখা টুলে বসে পড়ল ধপ্‌ করে। এ তো সেই সফ্‌ট ড্রিঙ্কসের বিজ্ঞাপনের লে-আউট যার জন্য আর্টিস্ট খুঁজতে সকাল থেকে হন্যে হয়ে ঘুরছে ও। লোগোটা চিনতে পারা যাচ্ছে দূর থেকেও।

“আপনি কিছু বলবেন?” ছেলেটার প্রশ্নে মুখ তুলল উর্নি। আধখাওয়া চাউমিনের প্লেটটা নামিয়ে রাখল ফুটপাথে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “এটা আপনি কী এঁকেছেন?”

ছেলেটা হাসল বিষন্নভাবে, বলল, “এঁকেছি আর কোথায়? ওই তো একটা স্কেচের মতো। একটা বিজ্ঞাপনের জন্য করেছিলাম। একজন করতে বলেছিল। আর কী, কিন্তু…”

ছেলেটাকে কথা শেষ না করতে দিয়ে উর্নি জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি কমার্শিয়াল আর্টিস্ট? বিজ্ঞাপনের কাজ করেন?”

মাথা নাড়ল ছেলেটা, “হ্যাঁ, কমার্শিয়াল আর্টিস্ট বলতে পারেন। আর বিজ্ঞাপনের কাজ পেলে করি।”

উর্নির হাত কঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। ও আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি এই ছবিটা কি অ্যাডগ্ল্যামের জন্য এঁকেছেন?”

ছেলেটা চমকে গেল এবার, “আপনি জানলেন কী করে?”

উর্নি বুঝল, আন্দাজের ঢিলটা ঠিক জায়গায় লেগেছে। কিন্তু এখনও সবচেয়ে ভাইটাল প্রশ্নটাই বাকি। একটা ছোট্ট সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে উর্নি। কিন্তু তা বাস্তবে কতটা ফলবে তার জন্য এই প্রশ্নটা জরুরি। ও জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি অ্যাডগ্ল্যামের হয়ে কাজ করছেন? মানে আপনি কি ওদের এই…”

উর্নি কথা শেষ করার আগেই ছেলেটা মাথা নাড়ল জোরে, বলল, “তা আর হল কই! ওঁরা এমন শর্ত দিলেন, তাতে সম্ভব নয় কাজ করা। আমার পরিশ্রমটাই জলে গেল।”

উর্নির শরীরটা হঠাৎ, হালকা লাগল খুব। মনে হল ওর পিঠেও কেউ প্রজাপতির পাখনা লাগিয়ে দিয়েছে। মনে হল, এবার উড়তে পারবে ও। শতানিক বাসু যখন ছেলেটাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছিল তখন ছেলেটার মধ্যে যে কোয়ালিটি আছে, মানতেই হবে। উত্তেজনায় ওর হাত কাঁপছে। তবে, এবার দু’কোটি টাকার জন্য শেষ প্রশ্ন। উর্নি জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাদের হয়ে কাজ করবেন?”

“আঁ?” ছেলেটার মুখ হাঁ হয়ে গেল।

“আমি বিটা অ্যাডে আছি। আপনি যদি রাজি থাকেন, তা হলে এক্ষুনি আপনাকে যেতে হবে আমার সঙ্গে। উই আর রানিং আউট অব টাইম।”

ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কোনওমতে বলল, “কিন্তু..”

“ও আপনি টাকার কথা ভাবছেন? সে নিয়ে চিন্তা করবেন না। হাজার দশেক পাবেনই। আর ভাল কথা, কম্পিউটারে অ্যানিমেশন জানেন?”

“জানি।” ছেলেটা মাথা নাড়ল।

“তা হলে এখানে বসে কী করছেন? চলুন আমার সঙ্গে। আমাদের হাতে সময় নেই একদম!”

ছেলেটা থতমত খেয়ে গেছে একদম। ও বলল, “বিটা অ্যাড তো বেশ নামকরা, সেখানে আমাকে…”

উর্নি উঠে দাঁড়িয়ে রেলিং থেকে ছবি খুলতে শুরু করল, ধমক দিয়ে বলল, “আচ্ছা লোক তো আপনি, বলছি চলুন।”

ছেলেটা থতমত খেলেও এবার উঠল। দ্রুত হাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল বড় ঠ্যালাটার সামনে। উর্নি দেখল ন্যাপাদার হাতে সব জিনিসপত্র দিয়ে দিল ছেলেটা। ন্যাপাদা জিজ্ঞেস করল, “আরে তোর কী হল? গুটিয়ে ফেললি? শরীর খারাপ নাকি?”

উর্নি চাউমিনের প্লেটটা ফেরত দিয়ে বলল, “একে আমরা নিয়ে যাচ্ছি।”

ন্যাপাদা থমকে গেল মুহূর্তের জন্য, তারপর হাসল, “কী, চাকরি?”

ছেলেটা বলল, “বুঝতে পারছি না।”

উর্নি ন্যাপাদার দিকে টাকা বাড়িয়ে ছেলেটাকে বলল, “দেখুন আমাদের ক্যাম্পেনটা মোটামুটি করা আছে এবার সেট মঙ্গলবারের মধ্যে কমপ্লিট করে ফেলতে হবে। আসলে সুগত বলে আমাদের যে অর্টিস্ট কাজটা শেষ করেনি তো, তাই…”

“সুগত সিনহা?” হাসল ছেলেটা।

উর্নিও হাসল, চোখ বড় বড় করে বলল, “আচ্ছা, রাস্তায় বসে কী করছেন আপনি?”

আনন্দে হাত-পা কাঁপছে উর্নির। ও চার্চের দিকে তাকাল। বড় বড় থাম, হলুদ রঙের দেওয়াল। বাল্‌বের, রিবনে সব সুন্দর ভাবে সাজানো ওপরে একটা ক্রস। ক্রিসমাস। মা বলত, “বেস্ট টাইম অব দ্য ইয়ার।”

উর্নি ভাবল অহনকে আর ফোন করবে না, একদম অফিসে গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে। ও ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাই দ্য ওয়ে আপনার নামটা? ”

সবুজ চোখ তুলে ছেলেটা তাকাল ওর দিকে, বলল, “সাইমন রুপেন মণ্ডল।”

“ট্যাক্সি” হাত তুলল উর্নি। কিন্তু শুনল আরেকজনও চিৎকার করেছে। কিন্তু ট্যাক্সিটা ওরই বেশি দরকার। কারণ, সময় নেই আর। সাইমনকে আসতে বলে আবার ট্যাক্সি ধরতে দৌড়োল উর্নি। কিন্তু ট্যাক্সির হাতলে হাত দেবার আগেই দেখল আরেকটা হাত ধরে ফেলেছে হাতলটা। মুখ তুলল বেস্ট। আরে আর্চি।

উর্নি বলল, “থ্যাঙ্ক গড আর্চিদা। ট্যাক্সিটা খুব দরকার আমার।”

আর্চি বলল, “আরে উর্নি! আমাকেও তো যেতে হবে।”

উর্নি বলল, “প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ।” তারপর আর্চির উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে বসল ট্যাক্সিতে। হাত দিয়ে ডেকে নিল সাইমনকে। আর্চিকে তার পাত্তা না দিয়ে ও ট্যাক্সিওলাকে বলল, “দাদা, পার্ক স্ট্রিট চালুন।”।

ট্যাক্সিওলা বয়স্ক লোক। উর্নি দিকে তাকিয়ে বলল, “দেশপ্রিয়র ওখান দিয়ে ঘুরিয়ে মিন্টো পার্ক হয়ে যাব। এদিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। রবীন্দ্র সদনের ওখানে বিশাল জ্যাম!”

উর্নি ঠোঁট কামড়াল, ঘুর হচ্ছে অনেকটা। কিন্তু কুছ পরোয়া নেহি। ও বলল, “তাই চলুন দাদা। আমাদের সময় নেই আর।”

চলন্ত ট্যাক্সির পেছনের কাচ দিয়ে ও দেখল রাস্তায় কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর্চি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নাকের ডগা দিয়ে ট্যাক্সি ছিনতাই হয়ে যাওয়ায় বেশ বিরক্ত। তবে কিছুটা অবাকও হয়তো। অন্য সময় হলে উর্নি দাঁড়িয়ে গল্প করত খানিকক্ষণ। কিন্তু আজ নয়। সামনে অনেক কাজ। ওকে কাজ করতে হবে। যে-গর্তের মধ্যে থেকে ওর জীবন কাটছিল সেখান থেকে খানিকটা উঠেছে ও। এবার আরও উঠতে হবে। পেছনের দিকে তাকানোর আর সময় নেই। ও দেখল সাইমন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরে দুপুর বেলার রোদ। এই রোদের মতো রাখতে হবে মনটাকে। উর্নি ব্যাগ খুলে ছোট্ট একটা আয়না বের করল, তারপর সেটা দেখে ঠিক করতে লাগল এলোমেলো চুলগুলোকে। এলোমেলো থাকার দিন শেষ। এবার গুছিয়ে নিতে হবে জীবনকে।

অর্চিষ্মান : ২৪ ডিসেম্বর, দুপুর দুটো দুই

হাতের ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে তাকাল আর্চি। শালা, সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। উর্নি নাকের ডগা থেকে ট্যাক্সিটা নিয়ে গেল! কী এমন দরকার ওর? আশ্চর্য মেয়ে একটা। কিন্তু এমনভাবে ট্যাক্সিটা ছিনতাই করে নিল যে, মেয়েটাকে কিছু বলার স্কোপই পেল না আর্চি। হিসেব মতো এখন তো ওর নানুর বাড়িতে থাকার কথা। কিন্তু দেরিটা হল জনিদার জন্য। আসলে, জনিদা এমনভাবে বলল যে, ও আসতে বাধ্য হল নার্সিংহোমটায়। ওর দাদা শতানিক বাসুর খুব বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের এক নার্সিংহোমে ভরতি। জনিদা অনেক কাজকর্ম দেয় আর্চিকে। তাই ও না করতে পারেনি। জনিদার এই এক ব্যাপার, আর্চিকে দেখলেই বগলদাবা করে ‘এখানে চল, ওখানে চল’ বলে। আর্চিই বা কী করবে? তেতো ওষুধ গেলার মতো মুখ করে যায় জনিদার সঙ্গে। আসলে ওদের লাইনে, জনিদা, মানে জনার্দন বাসু একটা গুরুত্বপূর্ণ নাম।

অ্যাক্সিডেন্টটা আজকেই হয়েছে, রাসবিহারী মোড়ে। জনিদার কাছে যখন খবরটা পোঁছোয় তখন আর্চি জনিদার সামনেই বসে ছিল। ও লাঞ্চ করছিল জনিদার সঙ্গে। কিন্তু খবরটা পৌঁছোতেই খাওয়া-দাওয়া সব মাথায় ওঠে ওদের। আর তারপর যা প্রতিবার হয়, এবারেও তাই হয়েছে। জনিদা ধরে নিয়ে এসেছে আর্চিকে। তবে শতানিকের চোট ভালই লেগেছে। আর্চি যখন বেরিয়ে আসছিল নার্সিংহোম থেকে তখনও ভদ্রলোক অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। ওঁর স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছিল। পুলিশও ছিল দু’-তিন জন। ভদ্রলোক অ্যাক্সিডেন্ট করার পর ওঁকে নাকি পাবলিক মারধরও করেছে। ফলে, অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। কখনও কখনও আর্চি ভাবে যে, মানুষের মধ্যে বোধহয় একমাত্র গণধোলাইয়ের সময়েই ঐক্য আসে!

একটু আগেই নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে এসেছে আর্চি। নানুর ঝামেলা মিটিয়ে ওকে তো যেতে হবে প্রিয়া সিনেমার সামনে। ইরা অপেক্ষা করবে। ওর ইচ্ছে আছে পৌনে তিনটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ওখানে। ইরাকে অপেক্ষা করাবে না আজ। আসলে ইরা যতই ভাবুক আর্চি ইরার প্রতি উদাসীন, আসলে কিন্তু তা নয়। ওর এই ফোটোগ্রাফির কাজটাই এমন যে, যখন-তখন যেখানে-সেখানে চলে যেতে হয়। আর্চি জানে ইরাকে কতটা ভালবাসে ও। ইরাকে ছাড়া ওর যে কী অবস্থা হবে, সেটাও ও ভাল করেই জানে। আজ যেভাবে ইরা বলেছে তাতে বেশ ভয়ই লাগছে। মেয়েটা যদি সত্যিই জেদের বসে আর সম্পর্ক না রাখে ওর সঙ্গে! নাঃ, আজ সময় মতো পৌঁছোবেই আর্চি।

নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে ও ভেবেছিল মেট্রো করে নেতাজি ভবন চলে যাবে। নানুদের বাড়ি সেখান থেকে কাছেই। কিন্তু মেট্রোয় ঢুকে ওর চোখ কপালে উঠে গিয়েছে আজ। সমস্ত কলকাতার লোক যেন ঢুকে পড়েছে। মাটির তলায়। এটা যে মিছিলের প্রভাব, বুঝতে পারছিল আর্চি। হাবিজাবি কারণে মিছিল করলেই যেন হল। সারা কলকাতাকে স্তব্ধ করে বিশ্বের কোথায় শান্তি আসবে কে জানে!

মেট্রোতে টিকিটের লাইন প্রায় স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে মাটির ওপরে উঠে এসেছে। আর্চি বুঝেছিল, এভাবে যেতে গেলে সন্ধেবেলা গিয়ে পৌঁছোবে নেতাজি ভবন। ও তাই ট্যাক্সি খুঁজছিল। দুটো ট্যাক্সিওলা ভবানীপুর শুনে যেতে চায়নি। তাই ভেবেছিল পরেরটাতে কিছু না বলে একদম উঠে বসে পড়বে। কিন্তু সুযোগই পেল না। শুধুমাত্র ওই পাগলি মেয়েটার জন্য।

উর্নিকে দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছি আর্চি। এখানে এখন কী করছে ও? অফিস নেই? আর সঙ্গের ছেলেটাকে দেখে কেমন চেনা মনে হল। আরে! এই ছেলেটাই সকালে ওর কাছ থেকে সময় জানতে চেয়েছিল না! অত তাড়াহুড়ো করে ট্যাক্সি ধরে কোথায় গেল মেয়েটা? দেখেই বোঝা যাচ্ছিল খুব একসাইটেড হয়ে আছে। মাথার চুল এলোমেলো, চোখেমুখে উত্তেজনা। এমনিতে আর্চির সঙ্গে দেখা হলে খুব বকবক করে। কিন্তু আজ যেন ‘হাই’ বলার সময়টুকুও ছিল না। সত্যি দাদাদের অফিস তো নয়, চিড়িয়াখানা। যেমন এই উর্নি, তেমন প্রতুলকাকা আর তেমন দাদা নিজে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এরা একসঙ্গে কাজকর্ম করে কী করে! কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে ট্যাক্সিটা ছিনতাই করল যে, এখন আর্চির বিপদ হল। কী করবে ও?

আর্চি সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। কাছেই হাজরা মোড়। কিছু একটা পেতেই হবে। হুহু করে গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। ও ভাবল, রাস্তা পার হয়ে অন্য দিকে যাবে। অন্তত বাস তো পাবে। অবশ্য সেটা লাস্ট অপশন। বাসে উঠতে একদম ভাল লাগে না আর্চির। তবু এখন যা অবস্থা, তাতে আর চয়েসই বা কী আছে ওর? অবশ্য বাসে না উঠতে চাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ওর ক্যামেরার ব্যাগ। কে কখন ঠুকে ভেঙে দেয় কে জানে। রাস্তা পার হওয়ার জন্য পা বাড়াল আর্চি আর তখনই ওর চোখে পড়ল ঘটনাটা।

হুহু করে একটা লাল বাস এগিয়ে আসছে আর তার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন ভদ্রলোক। কী করছেন ভদ্রলোক? উনি কি পাগল না মাতাল? ওভাবে কেউ চলন্ত বাসের মুখোমুখি এগোয় নাকি? আরে মারা পড়বেন তো উনি! উনি কি বুঝতে পারছেন না কী করতে চলেছেন? আর্চি দেখল বাসটা প্রায় এসে পড়েছে। ভদ্রলোকও পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বাসের দিকে। আর্চি আর পারল না। “ও দাদা, আরে ও দাদা,” চিৎকার করে ভদ্রলোককে ডাকার চেষ্টা করল ও। কিন্তু কী মুশকিল! ভদ্রলোক তো শুনছেনই না কিছু। ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো এগিয়ে যাচ্ছেন বাসের দিকে। নিমেষে কর্তব্য স্থির করে নিল আর্চি। ও দৌড়োল। বাসের দিকে এগোচ্ছেন ভদ্রলোক, আশেপাশে কয়েকজনও ব্যাপারটা দেখেছে এবার। তারাও চিৎকার করছে। লাল বাসটা বিন্দুমাত্র গতি না কমিয়ে ছুটে আসছে সামনের থেকে। আর্চি নিজের গতি বাড়াল। ভদ্রলোক আর কয়েক পা এগোলেন। বাসটা দশ হাতের মধ্যে চলে এসেছে। আর্চি ভুলে গেল যে, ওর পিঠে ক্যামেরার ব্যাগ রয়েছে। ও প্রায় লাফিয়ে পড়ে ভদ্রলোকের হাত ধরে টান মারল। হ্যাঁচকা টানে ভদ্রলোক পড়ে গেলেন আর্চির ওপর। লাল বাসটা প্রায় ওদের চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল। দরজা থেকে কনডাক্টরটা চিৎকার করল, “অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা”।

মাটিতে, ভদ্রলোকের তলায় শুয়ে আর্চির প্রথমেই মনে হল, ক্যামেরা ঠিক আছে তো ওর! মাথা ঘোরাল আর্চি। ব্যাগটা মাথার কাছে পড়ে আছে। দু’-দুটো ক্যামেরা রয়েছে এর মধ্যে। লেন্স ভেঙে যায়নি তো? গেলে সর্বনাশ হবে। এতক্ষণে অন্যান্য মানুষজন এসে উঠিয়ে বসাল দু’জনকে।

এবার ভদ্রলোককে ভাল করে দেখল আর্চি। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে মানুষটাকে। মানুষটা কেমন বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন সামনের দিকে। যেন উনি এখানে নেই। যেন কিছুই স্পর্শ করছে না ওঁকে। চারিপাশ থেকে উড়ে আসা প্রশ্নগুলোও যেন অন্য কাউকে করা হচ্ছে। লোকজন ইতিমধ্যে আশেপাশের থেকে জল ধরিয়ে দিয়েছে ওদের হাতে। আর্চির বাঁ দিকের কনুইটা জ্বালা জ্বালা করছে। ও দেখল রক্ত বেরোচ্ছে একটু। জল দিয়ে কনুইটা ধুয়ে ফেলল ও।

আর্চি দেখল সবাই ভদ্রলোককে নিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন রকম উপদেশ দেওয়া হচ্ছে ওঁকে। ভদ্রলোক বিভ্রান্ত চোখে শুধু এ-দিক ও-দিক দেখছেন। আচ্ছা, উনি এভাবে বাসের সামনে এগোচ্ছিলেন কেন? আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন কি? কিন্তু বাসের সামনে পড়ে কেউ মরতে চায় নাকি? ও শুনল সবার নানান উপদেশের মাঝে ভদ্রলোক বিড়বিড় করছেন। আর্চি ঝুঁকল লোকটার দিকে। “কিছু বলছেন?” লোকটা এখনও বিহ্বল। শুধু ফিসফিস করে বললেন, “আমার পাপ, আমি… আমি পাপী…”

আর্চি ভদ্রলোকের কাঁধ ধরল, হালকাভাবে বলল, “আর এমন করবেন না। কী হবে এভাবে মরে গিয়ে? দেখুন তো, আমার দেরি করিয়ে দিলেন।” আর্চির শেষের কথাগুলোয় ভদ্রলোক হাসলেন এবার। দুর্বল হাসি। তারপর ধীর গলায় বললেন, “সরি ভাই”।

“আর করবেন না তো এমন?” আর্চি দেখল আশেপাশের সবাই ওদের কথা শুনছে।

“নাঃ, আর সাহস নেই।”

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মুসলমান ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। দেখে চিনতে পারল আর্চি। নুরচাচা। সর্দার শঙ্কর রায় রোডের মুখে দোকান আছে ভদ্রলোকের। উনি বললেন, “বাঁচতে সাহস লাগে ভাই, মরতে নয়, বুঝেছ?”

মানুষটা সবার মধ্যে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। কেন এমন করলেন ভদ্রলোক?

দুটো তিরিশ। আজ একটা কেলেঙ্কারি হবেই। দেখতে দেখতে আধ ঘণ্টা কেটে গেছে। এখন, কখন ভবানীপুর যাবে আর কখনই বা প্রিয়া সিনেমার সামনে যাবে? আর্চি বিভ্রান্ত মানুষটার দিকে তাকাল আর একবার। হঠাৎ কাশ্মীরের একটা ঘটনা মনে পড়ল ওর।

একদিন নিজের ঘরে বসে জায়েদের সঙ্গে কথা বলছিল আর্চি। সে দিন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। সারা কাশ্মীর ঠান্ডায় জবুথবু হয়েছিল একেবারে। টেররিজম নিয়ে কথা বলছিল জায়েদ। ও বলেছিল, “সাব, একবার অগর আপ ঠান লেতে হো কি মরনা হ্যয়, তো মরনা হয়। অগর উসমে একবার ভি রুকাবট আ যায়ে না, ফির মরনা মুশকিল হ্যয়। মোটিভেশন চলা যাতা হ্যয়। টেররিস্ট লোগো কো ইসকে পরে জানে কি হি ট্রেনিং দি জাতি হ্যয়। খুদ কো মার ডালনা আসান নেহি হ্যয় সাব।”

আর্চি দেখল মানুষটা এখনও কাঁপছেন, হয়তো নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। আচ্ছা, কী পাপ করেছেন ভদ্রলোক? কীসের জন্য নিজেকে এভাবে বাসের তলায় নিয়ে যাচ্ছিলেন? আর্চি ব্যাগটা খুলল। নাঃ, ক্যামেরা ঠিক আছে। একটা ব্যাপার নিশ্চিন্ত হল অন্তত।

কিন্তু, এখন কী করবে ও? ভবানীপুর গিয়ে আর লাভ হবে না। নানুর পিসিরা নিশ্চয়ই চলে গেছে এতক্ষণে। ইস্‌, কথার খেলাপ হয়ে গেল। এসব অনুরোধের ফোটো-টোটো তুলতে বিশ্রী লাগে আর্চির। কিন্তু, তা হলেও কথা দিয়েছিল তো! সেটা রাখা গেল না। ধ্যাত। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল পকেটে। কে ফোন করছে? ইরা? আর্চির মনে সামান্য আশার সঞ্চার হল।

তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরল আর্চি, “হ্যালো? ইরা?”

“না রে শালা পিঙ্গলা, কেলিয়ে তোমার সুসুম্না পর্যন্ত নাড়িয়ে দেব। এলি না কেন?”

নানু, ইঃ, ব্যাটা খেপে গেছে। নিমেষে আলো ফিউজ। আর্চি বলল, “ব্যাপক আটকেছি রে!”

“ঢপ মেরো না। কী এমন কাজ তোর? কোনও মরণাপন্নকে বাঁচাচ্ছিলি? আমার প্রেস্টিজে একদম গ্যামাক্সিন মেরে দিলি? শালা, বন্ধুর নামে কলঙ্ক তুই।”

‘মরণাপন্নকে বাঁচাচ্ছিলি’ অবাক হয়ে গেল আর্চি, “তুই জানলি কী করে?”

“শোন, নাটক করবি না। পিসিরা অপেক্ষা করতে করতে চলে গেল। আমার বোনটার ফোটো তোলা হল না! সত্যিই তোর কথার কোনও দাম নেই।”

আর্চি বলল, “সরি ভাই, সত্যি ফেঁসে গিয়েছিলাম।”

নানু দম নিল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, “ঠিক আছে, শোন আর একটা কাজ করে দিতে হবে।”

“আবার কাজ?” বিরক্ত হল আর্চি।

“তোর দাদা তো অ্যাড এজেন্সি চালায়। একটা মেয়েকে মডেল হিসেবে চান্স করিয়ে দিতে হবে। দারুণ মেয়ে। একদম কাঁপাকাঁপি। ওকে কথা দিয়ে দিয়েছি আমি। দেখিস যেন হয়। অহনদার সঙ্গে কথা বলে আমায় জানাবি। কালকেই জানাবি। তারপর মেয়েটাকে নিয়ে আসব আমি। বুঝলি?”

“কে রে মেয়েটা? কে আবার তোর ওপর বিশ্বাস করল?”

নানু হাসল, “আছে, আছে। যখন দেখবি না, একদম হিংসেয় শুকনোলঙ্কা হয়ে যাবি।”

“প্রেম করছিস নাকি?” আর্চি না জিজ্ঞেস করে পারল না।

“করছি না, করব। যাক, কাজটা যেন হয়। কাল ফোন করব আবার।” নানু কেটে দিল লাইনটা। মোবাইলে বেশিক্ষণ কথাই বলে না ও। দরকার শেষ হওয়ামাত্র রেখে দেয় ফোন। ব্যাটা খুব কিপটে।

অবাক লাগল আর্চির। নানু আর প্রেম? তাও মডেলের সঙ্গে? আজ হচ্ছেটা কী? আবার ঘড়ি দেখল আর্চি। দুটো চল্লিশ। আর না, এবার যেতেই হবে। ও দেখল, একটু দূরে বসে থাকা লোকটার চারিদিকে আর ভিড় নেই। শুধু নুরচাচা বসে কিছু বোঝাচ্ছেন। দৃশ্যটা দেখে ভাল লাগল আর্চির। এমন একটা দিনে মৃত্যুর কোনও স্থান নেই। ওঁর জীবনে যাই ঘটে থাকুক না কেন, তার সমাধান মৃত্যু হতে পারে না।

“ট্যাক্সি”। সামনে দিয়ে যাওয়া একটা ট্যাক্সিকে হাত দেখাল আর্চি। ট্যাক্সিটা থেমে গেল। আর্চি জানলার মধ্যে মাথা গলিয়ে বলল, “জায়েগা?”

“উঠে বসুন। আর দেখুন আমায় বিহারির মতো দেখতে হলেও আমি বিহারি নই। আমার সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলবেন না। বাংলায় দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের ভাষায় কথা বলুন।”

আর্চি উঠে বসল, “অন্যায় হয়ে গেছে দাদা, দেশপ্রিয় পার্ক যাব।”

“দেশপ্রিয় পার্ক? এখন? না, না। ওখানে একটু পরেই বা… ইয়ে মিছিল বেরুবে। আমি রাসবিহারী অবধি পৌঁছে দিতে পারি, তার বেশি নয়।”

“তাই চলুন। কিন্তু তাড়াতাড়ি।”

ড্রাইভারটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি? তাড়াতাড়ি করতে নেই। তাতে গাঁ… ইয়ে হয়। আমার মা বলত, তাড়াতাড়িতে সব নষ্ট হয়। তাড়াতাড়ি হল শয়তানের পন্থা। তা ছাড়া শহরের রাস্তা তো আমার নয় যে, বললাম আর পৌঁছে গেলাম। এখানে গাড়ি আছে, ট্রাম আছে, বাস আছে, দুমদাম রাস্তা পেরোনো বো…মানে লোক আছে, এদের পেরিয়েই তো যাব। তাড়াতাড়ি বললে হবে? হ্যাঁ, যদি আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কলকাতা হত, তা হলে দেখিয়ে দিতাম তাড়াতাড়ি কাকে বলে!”

আর্চির ইচ্ছে করল লোকটার গলা টিপে ধরতে। না হলে বোধহয় লোকটা থামবে না। কিছু লোক আছে যারা, কোথায় থামতে হয়, জানে না। তবে বেশিক্ষণ এই অত্যাচার সহ্য করতে হল না আর্চিকে। এখান থেকে রাসবিহারী মোড় খুব কাছে। তাই বেশি সময় লাগল না পৌঁছোতে।

রাসবিহারী মোড়ে নেমে আর্চি একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল ড্রাইভারের দিকে।

ড্রাইভারটা বলল, “খুচরো দিন। হয়েছে কুড়ি আর দিচ্ছেন পঞ্চাশ!”

“আরে চেঞ্জ নেই আপনার কাছে?”

“চেঞ্জ? না নেই”, ড্রাইভারটা হাসল, “চেঞ্জ সবাই চায়, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো বো… মানে কেউ দিতে পেরেছে কি? এত বিপ্লব হল, মানুষ মারা গেল, এত হিন্দি সিনেমা হল, বাংলা সিনেমা হল, কিন্তু চেঞ্জ হল কি কিছু? কিচ্ছু হল না, চেঞ্জ, সে সমাজ বা নোট, কারওই হয় না। আমি তুচ্ছ ড্রাইভার আমার কাছে চেঞ্জ কোথায় থাকবে?”

সময় থাকলে এর একটা ছবি তুলে রাখত আর্চি। ও বলল, “দাদা, দোহাই আপনি পঞ্চাশ টাকাই রাখুন।” ঘড়ি দেখল আর্চি, আর মিনিট দশেক সময় আছে।

ড্রাইভারটা বলল “তা কেন? এই নিন, কুড়ি টাকা ফেরত দিতে পারব আমি। আসলে জানেন তো, মা বলত…”

আর্চি আর পারল না, বলল, “দাদা, প্লিজ কুড়ি টাকাই দিন। আর আপনার মায়ের কথা পরে শুনব।”

লোকটা তোম্বা মুখে দুটো দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল? আর্চি আর দাঁড়াল না। তবে ও যেতে যেতে শুনল লোকটা নিজের মনে বলছে, “এই সমাজ মায়ের কথা না শুনেই উচ্ছন্নে গেল। গেলে যাক। মা… ইয়ে আমার কী? আমার গাড়ি করে তো আর যাচ্ছে না।”

রাসবিহারী মোড়ে অটো দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটে। কী হল, অটো কম কেন? ওই অ্যাক্সিডেন্টের পরেই কি? বিরক্ত লাগল আর্চির, আননেসেসারিলি এতটা দৌড়ঝাঁপ করল। এই রাসবিহারী মোড়ের ওপর দিয়ে গিয়ে আবার এখানেই ফিরে আসতে হল। জনিদাই সব গোলমাল করে দিয়েছে।

ও এগিয়ে গেল একটা অটোর দিকে, “দাদা, যাবেন?”

“না, এখন লাইন বন্ধ। মিছিল পাস করার পর আবার লাইন চালু হবে।” রুক্ষভাবে উত্তর দিল অটোওলা।

“দাদা, প্লিজ চলুন না, ভীষণ জরুরি।” আর্চি অনুনয় করল।

“দেখুন, যাওয়া যাবে না এখন। অন্য পথ দেখুন।” আরও চোয়াড়েভাবে বলল অটোওলাটা।

আর্চি দাঁতে দাঁত ঘষল। আর মিনিট সাতেক আছে। ও ফোনটা বের করল। ইরাকে বলতে হবে কী অবস্থায় রয়েছে ও। ইরার নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল আর্চি। বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। ইরার রাগী মুখটা মনে পড়ছে ওর। ভীষণ সুন্দর রাগী একটা মুখ।

“দ্য নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইজ কারেন্টলি নট অ্যাভেলেবল।”

দুটো ভাষায় একই কথা শুনল আর্চি। শিট্‌! হাতের মোবাইলটাকে ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করল ওর। ইরা সত্যিই মোবাইল অফ করে রেখেছে তা হলে। মেয়েটা ভীষণ রেগে আছে ওর ওপর। নিজেকে গালাগালি দিল আর্চি। সব ওর জন্য। সত্যিই তো, মেয়েটার বাবা যে কী ভেবেছে ওর সম্বন্ধে! আর তার ওপর আজ ও যদি পৌঁছোতে না পারে? সারাজীবন আপশোসের শেষ থাকবে না।

এ-দিক ও-দিক দেখল আর্চি। আজ কপালটাই খারাপ। একটা ট্রামও নেই। তবে কি বাস ধরবে? সে তো স্টপেজ মারতে মারতে যাবে। ও ভাবল শেষ চেষ্টা করবে একবার। আবার অটোর কাছে গেল, “দাদা, প্লিজ দাদা। খুব প্রয়োজন।”

লোকটা তেরিয়াভাবে বলল, “তাতে আমার কী? ফুটুন তো। ফালতু কিচাইন করবেন না।”

আর্চি কিছু বলার আগেই শুনল, পেছন থেকে একজন ডাকল, “আমারটায় বসুন, পৌঁছে দিচ্ছি।”

ঘুরে তাকাল ও। সাধারণ চেহারার একজন অটোচালক। কিন্তু আর্চির মনে হল সাক্ষাৎ দেবদূত। লোকটা আবার বলল, “কী হল দাদা, আসুন, পৌঁছে দিচ্ছি।” আর্চি আর দ্বিধা না করে উঠে বসল অটোর পেছনে। লোকটা অটোয় স্টার্ট দিল। পাশ থেকে একটা ছেলে এগিয়ে এসে বলল, “বোমদা, ফালতু লাফড়া নিচ্ছ। দেশপ্রিয়তে ক্যাচাল আছে। আর এক্ষুনি তো ফিরলে তুমি সোনাইকে ডাক্তার দেখিয়ে, একটু রেস্ট নিলে পারতে। কী দরকার উপকার করার?”

বোম অটোর ক্লাচ ছেড়ে বলল, “জাসু, চেপে যা। ফালতু ফ্যাচকাবি না।”

অটোর ভেতর থেকে আর্চি দেখল জাসু নামক ছেলেটা ঝাড় খেয়ে বেশ দমে গেছে।

অটো ছুটছে হুহু করে। এই লেক মার্কেট পেরোল। রোদের রং কমলা হতে শুরু করেছে এখন। হাওয়া দিচ্ছে খুব। আর্চির হাওয়াটা ভাল লাগলেও, টেনশন হচ্ছে। দেশপ্রিয় পার্কের দিকে এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। একটা ছোট্ট বরফের শুঁয়োপোকা শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে আর্চির। পারবে তো ঠিক সময়ে পৌঁছোতে?

“দাদা, আর তো যাবে না। দেখুন রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে।”

বোমের কথা শুনে আর্চি দেখল, সামনে সার দিয়ে অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর মোড়ের কাছে কিছু লোক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ট্রাফিক আর্চি আর অপেক্ষা করল না। বোমের হাতে ভাড়া দিয়ে নেমে পড়ল রাস্তায়। এখন একটাই উপায় আছে। দৌড়। ও ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করল একটা তারপর তার স্ট্র্যাপটাকে হাতে পেঁচিয়ে দৌড়োতে শুরু করল ফুটপাথ দিয়ে। মিছিল বেরোবার আগে যে করেই হোক ওকে দেশপ্রিয় পার্কটাকে পার করতে হবে। দৌড়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকের গায়ে ধাক্কা লাগছে। গালাগালি করছে তারা, তবু আমল দিল না আর্চি। ফুটপাথের দোকান, মোটা ভদ্রলোক, বয়স্কা দিদিমা, জিনস-পরা তরুণী, সবাইকে কাটিয়ে মরিয়া আর্চি পৌঁছে গেল মোড়ে। ট্র্যাফিক থামানো লোকগুলো লাঠি তুলে হইহই করে দৌড়ে এল ওর দিকে। আর্চি হাতের ক্যামেরা দেখিয়ে চিৎকার করল, “প্রেস, প্রেস।” চিচিং ফাঁক। রাস্তা পেরিয়ে ওই দিকে গিয়ে উঠল আর্চি। মিছিলও এসে গেছে দেশপ্রিয় পার্কের গেটের কাছে। আর্চি জানে মিছিল একবার বেরিয়ে পড়লে, ওকে আর মিছিলের ভেতর দিয়ে যেতে দেবে না কেউ। মিছিল শেষ না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তা প্রায় আধ ঘণ্টার মতো ব্যাপার। যেটা অসম্ভব। ও প্রাণপণে দৌড়োতে লাগল। মিছিলটা প্রায় গেট দিয়ে বেরুচ্ছে। আর্চিও পৌঁছে গেছে গেটের মুখে। একটু, আর মাত্র একটুখানি, পা ছিঁড়ে যাচ্ছে ওর। কাঁধের ভারী ব্যাগটা কেটে বসছে শরীরে। তবু ওকে পৌঁছোতে হবে, ইরা অপেক্ষা করছে। ইরাকে হারাতে পারে না ও। ইরাকে হারানো মানে ওর জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল অংশ, যেটা কোডাক মোমেন্ট, সেটা হারিয়ে ফেলা। ও দেখল গেট দিয়ে একটা দুটো লোক বেরুচ্ছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, হাতে ধরে থাকা ফেস্টুনও নাড়ছে খুব। আর চার-পাঁচ পা। মিছিল বেরোবার আগেই এই গেটের সামনেটা পেরিয়ে যেতে হবে আর্চিকে। ইরার কাছে যেতে হবে। মিছিল আসছে, মিছিল প্রায় এসে গেল। আর কয়েক পা। নিজের শেষটুকু দিয়ে দৌড়োতে লাগল আর্চি…

দ্বিতীয় সূত্র সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *