১০. বাঙালি ব্রিগেড

১০

“তোমাদের নাকি বাঙালি ব্রিগেড তৈরি হয়েছে, সত্যি?” চোখের ওপর উড়ে আসা চুলগুলো সামলে নিয়ে প্রশ্ন করল বৈদভী।

“না তো, ম্যাম,” আমি ঘাবড়ে গেলাম। এসব কথা আসছে কোথা থেকে? কে ছড়াচ্ছে এসব?

“না তো?” বৈদভী হাসল, “কিন্তু আবির নাকি ক্যাপ্টেন আর তুমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। তাই?”

“না ম্যাম,” আমি জোরে ঘাড় নাড়ালাম, “এসব বাজে কথা।”

“ঠিক আছে, বাদ দাও। এখন কোথা থেকে ফিরছ?”

“ম্যাম, আজ কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল ছিল। তারপর ওই ক্লাস টেস্টগুলোর রেজ়াল্ট দিল।”

“অ্যান্ড হাউ ওয়াজ় দ্য রেজ়াল্ট?”

“হয়েছে ম্যাম, ওই প্রায় এইট্টি পারসেন্টের মতো।”

“ভালই তো? তুমি কি হায়েস্ট?”

“না, কল্যাণ সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, তার পরে বালার্ক।”

“ও। ঠিক আছে, চলো তা হলে। কাম উইথ মি। আমি টাউনে যাব। গিভ মি কম্প্যানি৷”

সেরেছে! আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। হঠাৎ যেন দেখতে পেলাম ফরসা একটা পা! চামড়ার গন্ধ এসে ঝাপটা মারল নাকে। বৈদভীর সঙ্গে যাওয়া মানে তো আবার তেমন কিছুর আশঙ্কা! সেদিন ভাগ্যিস তোড়ি আর শ্রীবিদ্যা এসে পড়েছিল। তাই রক্ষে পেয়েছিলাম। বৈদভী বলেছিল, “দিস রিমেন ইন দ্য ডিউ লিস্ট!”

আজই কি সেই ডিউ চোকানোর দিন? শ্রীপুরম বাজারে যাওয়ার নাম করে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে না তো? এখানে ফাঁকা জায়গা প্রচুর। ঝরনার ধার, পোস্টঅফিস মাঠের কোণ, জয়রাম পার্ক, জল ট্যাঙ্কির মোড়, রেলব্রিজ, সব ফাঁকা জায়গা। তেমন কোথাও নিয়ে গেলেই চিত্তির। তা ছাড়া সারা দিনের রগড়ানি খাওয়ার পর আর ভাল লাগছে না। কিন্তু কাটাই কীভাবে? বললেই বৈদভী কওশলের ভয় দেখাবে। তবু চেষ্টা করলাম, “ম্যাম, একটু ফ্রেশ হয়ে নিতাম। খুব টায়ার্ড লাগছে।”

“ফ্রেশ?” দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভুরু তুলল বৈদভী। বলল, দু’ ঘণ্টার জন্য রুম ভাড়া পাওয়া যায় টাউনে। চলো, ফ্রেশ থেকে টায়ার্ডনেস, সব পুষিয়ে যাবে। অ্যান্ড দেন উই উইল হ্যাভ বুজ়। লেট্‌স গো।”

ঘর ভাড়া? আমার শরীরের সমস্ত জল কে যেন এক টানে শুকিয়ে ফেলল। এ কী প্রস্তাব রে বাবা! আমার হাঁটুর বল্টু আবার ঢিলে হয়ে গেল যেন। যেন চোখের সামনে দুলে উঠল গোটা চরাচর। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। মনে হল স্বর্গে বসেও ঠাকুরদার হার্ট ফেল হবে এবার।

“কী হল? আর ইউ ডেফ অর হোয়াট?” বৈদভী ভুরু কুঁচকে তাকাল। সূর্যাস্তের আলোয় ওর ফরসা মুখটাও কেমন লালচে দেখাচ্ছে। ও কি সত্যিই আমায় অমন কথা বলল, না জাস্ট ভয় দেখাচ্ছে? আমি কী বলব বুঝতে না পেরে যখন ঢোঁক গিলছি ঠিক তখনই গলাটা শুনলাম, “কী ম্যাওম্যাও, আজকাল সবসময় মেয়েদের সঙ্গে পুটুর-পুটুর করিস যে! কী ব্যাপার?”

ডাঙার মাছ জল পেল। অন্ধজনে দৃষ্টি পেল। জুয়ারি তার জ্যাকপট পেল। আর আমি পেলাম আবিরদাকে। সঙ্গে আমাদের কল্যাণ!

কল্যাণ আবিরদার কথায় যা না হাসি পেল, তার পাঁচগুণ হাসল। বুঝলাম মাখন কম্পানির টেমপোরারি মালিক হয়েছে। যাতে র‍্যাগিং কম হয় তার জন্য তেড়ে মাখন ঢালছে।

বৈদভী বলল, “হাই আবির। আই ওয়ন্ট টু টেক দিস ব্লোক ফর আ রাইড।”

“তা কী করে সম্ভব? ও যে আমার সঙ্গে আন্টিস শপে যাবে। ওখানে সবাই ওর গান শুনবে। ও বলেনি?”

গান? আমার? ব্যাপারটা বুঝতে চার সেকেন্ড সময় লাগল আমার। আবিরদা প্রিন্সকে গর্ত থেকে বের করার উপায় করে ফেলেছে। আমি আবিরদার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্য আগ্রহের সঙ্গে বললাম, “চারটে গান আমি তৈরি করে ফেলেছি। একদম ফাটিয়ে গাইব। দুটো সোনু নিগম, একটা শান আর একটা কে কে।”

“ও, এখন তো বেশ গান বেরোবে গলা দিয়ে,” বৈদভী বাঁকা হাসল, “ঠিক আছে, পরে দেখা যাবে,” তারপর আবিরদার দিকে ফিরে বলল, “যাও ক্যাপ্টেন, বাঙালি ব্রিগেড নিয়ে গল্প করো।”

বৈদভী ওর স্কুটারে চড়ে চলে গেল। কিন্তু আমার মনটা খচখচ করতে লাগল। কেন যেন মনে হতে লাগল একটা ছোট্ট বিষের চারা বড় হচ্ছে। কিন্তু কোথায়, কীভাবে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি ভুরু কুঁচকে বৈদভীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকালাম। দূরে ওই বৈদভীর স্কুটার যাচ্ছে। পেছনে পড়ে রয়েছে গোখরো সাপের মতো তেলতেলে হাইওয়ে। এই সাপের গলায় কি বিষ জমছে? আচমকা ঠান্ডা লাগল আমার। শীতের আকাশ থেকে নিঃশব্দে শিশির ঝরছে। এ উষ্ণতাহীনতার সময়।

“শালা, চারটে গান! সোনু নিগম, শান, কে কে। মারব লাথি। ওভার অ্যাকটিংটা এবার কমা। শোন, বৈদভীর থেকে সামলে থাকবি। ও একটা ক্যানিবল,” আবিরদা মুচকি হেসে একটা চোখ বন্ধ করে ইঙ্গিত করল। তারপর হাঁটা দিতে-দিতে বলল, “যা, এখানে বেশি ঘুরিস না, লোকাল লোকগুলো একটু পরেই মদ খেয়ে হল্লা করবে এখানে।”

আবিরদা চলে যেতেই কল্যাণ ধরল আমায়, “এই খুব তো মেয়েদের বাগিয়ে নিচ্ছিস। আমার কেসটা কিছু করলি? আজও তো কেমিস্ট্রি ল্যাবে শ্রীবিদ্যার সঙ্গে খুব গুজগুজ করছিলি।”

“সে তো টাইট্রেশনের রেজাল্ট জিজ্ঞেস করছিলাম। আর পিপেটে মুখ লাগিয়ে যখন টানার বদলে ময়ুখ ফুঁ দিচ্ছিল, তখন ওকে শ্রীবিদ্যা আর আমি একটু হেল্প করছিলাম। সেসব তেমন কিছু নয়। আর দেখ কল্যাণ, তোকে তো বলেইছি তোর কেসটা তোকেই সামলাতে হবে। অবশ্য যদি তোর দম না থাকে তাহলে অন্য ব্যাপার,” শেষের কথাগুলো ইচ্ছে করে বললাম।

“দম নেই? মানে?” কল্যাণ চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল, “শালা এত দম আছে না যে পঁচিশটা দমকল খোলার পরও দম পড়ে থাকবে।”

“তো বল গিয়ে। ফালতু আমার পেছনে পড়ে আছিস কেন? শোন, শুকনো বাতেলায় কিছু হয় না। আন্টিস শপে শ্রীবিদ্যার থাকার কথা এখন। চল আমি দেখি কেমন তুই শ্রীবিদ্যাকে প্রোপোজ় করতে পারিস!”

“আমি বাতেলা করছি? ঠিক আছে, চল তাহলে। আর বালার্ক আছে ওখানে? থাকলে ওর সামনেই শালা আজ খেল দেখাব। রেজাল্টে মালটাকে হারিয়েছি, এবার অন্য খেলাতেও হারাব। চল, আজ খেল দেখাব চল,” কল্যাণ হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে আমায় টানতে-টানতে এগোতে লাগল আন্টিস শপের দিকে।

যখন আন্টিস শপে পৌঁছলাম, কল্যাণ তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে। ফরসা মুখটা লাল। দেখলাম একটা টিনের টেবিল ঘিরে বসে রয়েছে বসন্ত, তোড়ি, শ্রীবিদ্যা, রুচির আর বিকাশ। সবাই আমাদের দু’জনকে অমন উদ্‌ভ্রান্তের মতো অবস্থা দেখে অবাক। কিন্তু একটাই বাঁচোয়া, কাছাকাছি কোথাও বালার্ক নেই।

“বালার্ক কোথায় রে?” আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল কল্যাণ।

“টেনিস প্র্যাকটিসে গিয়েছে,” শ্রীবিদ্যা তড়বড় করে উত্তর দিল।

“ও,” কল্যাণ থামল একটু। তারপর জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, “শোনো, শ্রীবিদ্যা, তোমার সঙ্গে ভীষণ দরকারি কথা আছে।”

“কী কথা?” আন্টিস শপের দুর্বল টিউব লাইটের আলোয় শ্রীবিদ্যার মুখের বিরক্তিটা স্পষ্ট বোঝা গেল।

আমি দূরে পাহাড়ের দিকে তাকালাম। একটা-একটা করে আলো জ্বলছে পাহাড়ের ঢালের বাড়িগুলোয়। ওদিকে না হয় আলো জ্বলছে, কিন্তু এদিকে কল্যাণ কেলেঙ্কারি না করে ছাড়বে না।

কল্যাণ বলল, “দেখো, আমি সরাসরি একটা কথা বলতে চাই তোমাকে। ভেরি আর্জেন্ট।”

“কী কথা?”

কল্যাণ ঠোঁট চাটল। চুলে হাত বোলাল। তারপর বলল, “তুমি নিশ্চয়ই জানো, আজকে রেজ়াল্ট বেরিয়েছে আমাদের। অবশ্য তুমি তো জানবেই, তোমারও রেজ়াল্ট বেরিয়েছে। যদিও গোটাটাই ক্লাস টেস্ট, তবু আমি টপার। আর সেই টপার ছেলেটি আজ তোমায় প্রোপোজ় করছে। ইউ শুড বি অবলাইজড যে, আমি তোমায় ভালবাসি।”

“মানে? আর ইউ প্রোপোজ়িং মি, না আমায় অপমান করছ?” শ্রীবিদ্যার বিরক্তিটা এবার রাগে পরিণত হল।

“শোনো, আমি আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ব্রাইট ছেলে। অ্যান্ড ইউ শুড অ্যাকসেপ্ট মাই প্রোপোজ়াল,” কল্যাণ হাসল। বা বলা যায়, হাসার চেষ্টা করল।

শ্রীবিদ্যা উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারটা ঠেলে দিল পেছন দিকে তারপর বলল, “ড্যাম ইউ। গো টু শিট হোল। বালার্কর পাশে তুমি একটা বাফুন, একটা ইডিয়ট।”

“কিন্তু…’ কল্যাণ আরও কিছু বলতে চাইলেও শ্রীবিদ্যা না শুনে দু’- তিনটে কঠিন ইংরেজি তৎসম ও তদ্ভব শুনিয়ে চলে গেল। আর কল্যাণ ফাটা বেলুনের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

রুচির, বিকাশ আর বসন্তও উঠল। যাওয়ার আগে রুচির বলল, “কী ফার্স্ট বয়, একদম মেরে গেল যে!”

বিকাশ একধাপ এগোল, “শুধু মারেনি, একদম পুঁতে দিয়েছে। জানিস না ও বালার্ককে পছন্দ করে? কেন অন্যের খাবারে নোলা করিস? ডিসগাসটিং।”

কল্যাণ আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। শুধু যাওয়ার আগে আমায় প্রাণপণে হাসি চাপতে দেখে ও বলল, “হাসছিস? খুব হাসি পাচ্ছে, না? দাঁড়া, তোদের দেখছি।”

কল্যাণ চলে যাওয়ার পর ভাবলাম, আমিও যাই। কিন্তু পারলাম না। তোড়ি হাত চেপে ধরল আমার, “বোসো, তোমায় ডিম-পাউরুটি খাওয়াব।”

আমি ঠোঁট চাটলাম। মেয়েটা দেখছি আমায় বিপদে না ফেলে ছাড়বে না। আমার মনে পড়ে গেল তোড়ির সঙ্গে সেই বিকেলের দেখা হওয়াটুকু।।

তোড়ি খুব রেগেছিল সেদিন। চোর, বদমাশ, শয়তান, যা খুশি তাই বলে আপমান করার চেষ্টা করেছিল আমায়। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। কোনও কথা বলতে পারছিলাম না বিশেষ। তোড়ির রাগ হওয়া স্বাভাবিক। সেই ঝরনার ধারে যে অবস্থায় ও আমায় দেখেছিল! আমি নিচু স্বরে বলেছিলাম, “তোড়ি, সেদিন ঝরনার ধারে তুমি যা দেখেছিলে…”

“গাধা, তুমি সেই কথা বলছ কেন? আমি জানি না যে ওটা র‍্যাগিং চলছিল? ওটা নয়, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছ কেন?”

আমার বুকের থেকে বোঝা নেমেছিল যেন। বলেছিলাম, “রণবিজয় কওশল তোমায় পছন্দ করে। ও চায় না তোমার সঙ্গে আমি কথা বলি, তাই…”

“তাই তুমি বোকার মতো অ্যাভয়েড করছ আমায়? স্পাইনলেস। তুমি জান না… জান না…” আবার দুর্বোধ্য সব ব্ল্যাঙ্কস ‘ফিল’ হওয়ার আশায় ধেয়ে আসছিল আমার দিকে। আমি অসহায়ের মতো সেই গর্ত দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছিলাম নীচে। তোড়ি বলেছিল, “তুমি কিচ্ছু জান না কেন? কমন সেন্স নেই? যে যাই বলুক আমার সঙ্গে কথা বলবে তুমি, বুঝেছ?”

সেই বোঝার পরবর্তী ধাপই বোধহয় ডিমরুটি। আমি কিছু বলার আগেই অর্ডার দিয়ে দিল তোড়ি। তারপর কথা শুরু করল। ওর ছোটবেলার স্কুল, ডাক্তার বাবা-মা, ক্লাস টেন-এ পড়া ভাই, সব্বার কথা বলল। এমন কি এ-ও বলল যে, মুম্বইতে ওদের বাড়ির কাছেই নাকি অক্ষয়কুমার থাকেন।

গলা শুনতে-শুনতে আমি মোহিত হয়ে গেলাম। এমন একটা মেয়ে আমায় নিজের কথা বলছে! হঠাৎ মনে হল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। মনে হল এবার আলতো করে তোড়ির হাতটা…

“আবে শালা, তু ফির বাত কর রহা হ্যায়,” শব্দের চেয়ে ক্রিয়া সত্যিই আগে হয়। একটা বিদ্যুৎ গতির ধাক্কায় চেয়ার ছেড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর কথাগুলো শুনলাম আমি। আমার হাতে তোড়ির সুন্দর হাতের বদলে আঁকড়ে ধরা টেবিলের পায়া! আমি আতঙ্কে মুখ তুলে দেখলাম, রণবিজয়!

১১

“জায়গাটা খারাপ নয়, বুঝেছিস? বেশ ফাঁকা। পোয়েটিক। একটা সলিচুড আছে। বিশেষ করে এই সকাল আর তিন সন্ধের সময়টা। দেখ দেখ, ওই দূর দিয়ে কী সুন্দর ট্রেনটা যাচ্ছে। দেখ পাশের বড় গাছটা। মনে হচ্ছে না ঝুলনের শহর একটা? আর কেক। আন্টিস শপের পিছনের ওই লোকাল বেকারির হানি কেক খেয়েছিস? গত পরশু বিকালে খেলাম। মধু গড়িয়ে পড়ছিল। গ্রেট। কে জানে বেঙ্গালুরুতে এমন পাওয়া যাবে কিনা! ফ্রেশ কেক, পিওর ওয়েদার আর সলিচুড!”

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বালার্ক। একটু আগেই বাবাকে ফোন করে নিজেই মনে করিয়ে দিয়েছে ওর কলেজ ট্রান্সফারের কথাটা। আবার তারপরই এসব বলছে। কে জানে মাথায় কী আছে!

আজ ঠান্ডাটা ভালই পড়েছে। কলেজ ছুটি বলে সামনের মাঠটায় নেমেছিলাম ক্রিকেট খেলব বলে। কিন্তু সিনিয়ররা মাঠ দখল করে নিয়েছে। তাই ফিরে আসছিলাম। সিঁড়ির মুখে বালার্কর সঙ্গে দেখা হয়েছে। টেনিস প্র্যাকটিস সেরে ফিরছিল ও। আমায় দেখে টানতে- টানতে নিয়ে এসেছে মাঠে। আর তারপর মোবাইল বের করে বাবার সঙ্গে কথা এবং পরবর্তী ধাপে এই হা-হুতাশ ভরা কাব্য।

আমি বললাম, “হ্যাঁরে, প্র্যাকটিসে রণবিজয়ের সঙ্গে দেখা হল?”

“এই সকালে রণবিজয়? সারা রাতের বুজ়ের পর সকালে উঠবে কেমন করে? কেন?”

“না, মানে, সেদিন তোর সঙ্গে যা হল। তাই… ইয়ে… আবার যদি কোনও গন্ডগোল করে। বিশ্বাস তো নেই।”

“হুঁঃ,” কাঁধ ঝাঁকাল বালার্ক, “করলে আমি ছাড়ব নাকি? তা ছাড়া সেদিন প্রিন্সি কী বলল মনে নেই?”

তা ঠিক, সেদিন সন্ধের ব্যাপারটা প্রিন্সিপালের ঘর অবধি পৌঁছেছিল। ঠিক সময় রমন স্যার এসে না পৌঁছলে আরও ঝঞ্জাট হত।

আমাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে রণবিজয় বলেছিল, “তোড়ির সঙ্গে বসে ন্যাকামো হচ্ছে?”

আমি আতঙ্কে গিরিগিটির মতো রঙ পালটাতে-পালটাতে বলেছিলাম, “গুড মর্নিং স্যার, মানে ইভনিং স্যার। আমি তো স্যার কিছু করিনি স্যার।”

“হাত ধরছিলি কেন তোড়ির? আমার চেতাবনি মনে নেই? আজ ইয়েহিপর গাড় দেঙ্গে তুঝে,” কওশল আবার পা তুলেছিল।

আমি আতঙ্কে দেখছিলাম কওশলের পেছনে গুপ্তা ছাড়াও আরও পাঁচ ছ’টা মুখ। এরা হস্টেল বা কলেজের কেউ নয়। এরা লোকাল মাস্তান, লোকালাইট। এদের বেশিরভাগই নানা অন্ধকার কাজ-কারবারে যুক্ত। সকলে বলে এদের থেকে একটা দূরত্ব রাখা ভাল।

“দাঁড়াও,” তোড়ি চিৎকার করে উঠেছিল, “আর একবার ওকে মারলে আমি প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে তোমার নামে কমপ্লেন করব।”

“কর তো দেখি কত সাহস। শালি তোকে তুলে রেললাইনের ওদিকের ঝুপড়িতে নিয়ে যাব,” গুপ্তা চিৎকার করেছিল।

“গুপ্তা, চুপ হো যা,” কওশল তোড়িকে বলেছিল, “শোনো, তুমি এসবে থেকো না। এই ম্যাওম্যাওটা ভীষণ বদ। ওকে আজ…”

“কিচ্ছু করবে না,” তোড়ি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

কওশল তবু চুলের মুঠি ধরে তুলেছিল আমায়। মনে হচ্ছিল আমার মাথায় পঞ্চান্ন হাজার ফোঁড়া এক সঙ্গে ফাটছে। আমি অসহায়ভাবে হাত পা ছুড়ছিলাম। কিন্তু কওশলের মুঠো বড় শক্ত। আমায় বাধা দিতে দেখে কওশল হঠাৎ থাপ্পড় চালিয়েছিল একটা। গোটা কর্নাটক বোঁ-বোঁ করে ঘুরছিল আমার চোখের সামনে। কওশল আবার হাত তুলেছিল, কিন্তু সেটা গাল অবধি পৌঁছবার আগেই একটা গলা শুনেছিলাম, “ওকে নামিয়ে দাও, না হলে এই র‍্যাকেট দিয়ে মেরে মাথা আধখানা করে দেব!”

“কে বে?” একজন লোক ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

“তোর বাপ বে।”

আমি আধা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছিলাম দু’ হাতে একটা টেনিস র‍্যাকেট শক্ত করে ধরে চোয়াল চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে বালার্ক।

“শালা,” কওশল আমায় ফেলে ওর দিকে এগিয়েছিল।

নিমেষের মধ্যে হাওয়ায় র‍্যাকেট ঘুরিয়ে বালার্ক বলেছিল, “এসো তুমি, মাথা ফাঁক করে দেব শালা। আমার কোনও ব্যাপার নেই। এই জায়গাকে ঘেন্না হচ্ছে আমার। তোমাদের ঘেন্না হচ্ছে। মানুষ? মানুষ তোমরা?”

আমি মাটিতে বসে হতভম্ব হয়ে দেখেছিলাম কওশল হিংস্র বালার্ককে দেখে কেমন যেন স্থির হয়ে গেছে। যেন নড়তে পারছে না। হঠাৎ একজন লোকাল লোক বলেছিল, “শালাকে মারব। এমন মারব যে শ্রীপুরম তো দূর, ভারত ছেড়ে পালাবে।”

“অ্যাই কী হচ্ছে ওখানে?” একটা মিহি গলার ডাকে আমরা ফিরে তাকিয়ে ছিলাম। রমন স্যার। স্কুটার রেখে হন্তদন্ত হয়ে আমাদের দিকে আসছেন।

লোকাল লোকটা আবার বলেছিল, “মারব ব্যাটাকে? আমাদের র‍্যাকেট দেখাচ্ছে!”

“চোপ,” কওশল চেঁচিয়েছিল, “বলেছি না আমাদের কলেজের ব্যাপারে নাক গলাবি না। একসঙ্গে মাল খাচ্ছিস খা। তার বেশি রং দেখাবি না। বুঝলি? আমাদের কলেজের ব্যাপার আমরা সামলাব।”

ততক্ষণে রমন স্যার চলে এসেছিলেন। অদ্ভুত উচ্চারণে যা বলেছিলেন তার পঁচাত্তর শতাংশ বুঝতে পারছিলাম না। তোড়িও স্যারকে বলছিল সব ঘটনা। রমন স্যার আমাদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেছিলেন প্রিন্সিপালের বাংলোয়। প্রিন্সিপাল মন দিয়ে সব কথা শুনে খুব বকেছিলেন রণবিজয়কে। ওয়ার্নিং দিয়ে বলেছিলেন জুনিয়রদের যদি উত্যক্ত করে তা হলে কলেজ থেকে ওকে বের করে দেওয়া হবে। বাংলো থেকে বেরোবার মুখে রণবিজয় বলেছিল, “তোকে ছাড়ব না শালা।”

সেদিন থেকে রণবিজয় সত্যিই আর কোনও গন্ডগোল করছে না। তবু বলা তো যায় না। এই গতকালই তো আবিরদা বলছিল, “প্রিন্সির কাছে নালিশ করে তো খুব বালিশ পেলি তোরা। এদিকে শিবযোগী স্যার তো আমাদের এসে বলছেন র‍্যাগিং চালিয়ে যেতে। বলছে চিন্তার কিছু নেই। র‍্যাগিং করা নাকি দরকার। শোন, যা করবি, সাবধানে করবি, বুঝেছিস?”

বুঝতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু ঠিক যেন বুঝতে পারি না। সবসময় একটা চাপা অস্বস্তি নিয়ে ঘুরি আমরা। কী হবে আমাদের? কবে শেষ হবে এই র‍্যাগিং?

“চল সুরির দোকান থেকে লুচি তরকারি খেয়ে আসি। ওই মেসের মরার চামড়ার মতো ধোসা আর চাটনি খেতে ইচ্ছে করছে না,” বালার্ক হাতের র‍্যাকেটটা শূন্যে ঘোরাল।

আমি বললাম, “ধুর ভাল লাগছে না। পরে খাব। আগে চল কয়েকটা অঙ্ক তোকে দেখাবার আছে, দেখিয়ে নিই। মাত্র মাস দুয়েক বাকি আছে ফাস্ট সেমের।”

বালার্ক বলল, “ঠিক বলেছিস। তেলের জিনিস খেয়ে এখন আর কাজ নেই। তা ছাড়া আজ বিকেলে তো পড়া হবে না। কম্পিউটার এডেড ড্রয়িংয়ের স্পেশ্যাল সেশন আছে না। শালা, ছুটির দিনেও স্পেশ্যাল ক্লাস।”

আমরা হাঁটতে-হাঁটতে হস্টেলে ঢুকলাম। আগে নীচে যে ক’জন সিনিয়র থাকত, সকলেই পুরনো হস্টেলে শিফ্‌ট করে গিয়েছে। নীচটা ফাঁকাই থাকে। এই নীচের ঘরগুলোও বড়। এই একটা ঘর যদি পাওয়া যেত!

“সাবধান,” হঠাৎ বালার্ক হাত ধরে টানাল আমায়। থতমত খেয়ে কিছু বোঝার আগেই দেখলাম একটা বড় পাথরের টুকরো ঠক করে এসে লাগল পাশের দেওয়ালে। আর একটু হলেই আমার মাথায় লাগত। আমি ডানদিকে তাকালাম। ময়ূখ আর অরবিন্দ এগিয়ে এল আমার দিকে।

আমি বললাম, “কীরে, পাথর ছুড়ছিস কেন?”

ময়ূখ থতমত খেয়ে নড়তে শুরু করল। বুঝলাম টেনশন হয়েছে। বলল, “সরি সরসিজ। আমরা টিপ-টিপ খেলছিলাম, কিন্তু ফসকে গেছে, সরি ভাই।”

টিপ-টিপ খেলছে মানে? বয়স কত? আমি অবাক হয়ে দেখলাম ডানদিকের প্যাসেজের মাঝে যে থামটা রয়েছে তাতে টার্গেট এঁকেছে! এতেই ওরা ঢিল ছুড়ছে সেই টার্গেট লক্ষ করে! এ আবার কী ঢঙের খেলা? কেউ যদি গেট দিয়ে ঢেকে বা সিঁড়ি দিয়ে নামে তার লাগতে পারে যে। আমারই লাগছিল একটু হলে।

“তোদের এই খেলাটাই খেলতে হল? এটা কোনও খেলা?” আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বক্তার আসন দখল করল কল্যাণ। বলল, “এই যে ময়ূখ, কেলিয়ে না ময়ূর বানিয়ে দেব। ঢিল ছুড়ছিস কেন রে?”

ময়ূখ সাহস করে বলল, “তোর গায়ে তো লাগেনি।”

“এক লাথি মার শালা। মুখে-মুখে কথা বলছিস?” কল্যাণ খিঁচিয়ে উঠল, “অত নড়ছিস কেন? চলন্ত ট্রেনে জন্মেছিলি নাকি? কান ধর, কান ধর।”

আমার খারাপ লাগল। কল্যাণের সবটাতে বাড়াবাড়ি। ময়ূখকে দেখলেই ওর পেছনে লাগতে শুরু করে। ব্যাচমেট হয়েও কল্যাণ ময়ূখকে র‍্যাগ করে।

“কল্যাণ, বাড়াবাড়ি করিস না,” বালার্ক গম্ভীরভাবে বলল।

“কেন তোর কী?” কল্যাণ বালার্কর দিকে ঘুরল।

“রং নিবি না কল্যাণ। ময়ুখ আমাদের ব্যাচমেট। ওকে মুরগি করবি না বলে দিলাম।”

“বেশ করব। এটা তোর বাপের জমিদারি? শ্রীবিদ্যাকে পটাচ্ছিস, ময়ূখকে আগলাচ্ছিস, সরসিজকে ভেড়া বানাচ্ছিস? তোর বাপ…”

র‍্যাকেটটা বাঁ হাতে চালান করে ডান হাতটা সজোরে ঘোরাল বালার্ক। কল্যাণের কানের নীচে গিয়ে হাতটা আছড়ে পড়ল। কল্যাণ টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। আর শুধু পড়েই গেল না, ভ্যাঁ করে কেঁদেও ফেলল, “তু-তুই আবার মারলি, তোকে…তোর…আমি দেখে নেব শালা, তোকে…”

বালার্ক কল্যাণের হাত ধরে হ্যাঁচকা মেরে মাটি থেকে তুলে ফেলল। তারপর বলল, “লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম কলু, এরপর মেরে কিন্তু চোয়ালের কবজা খুলে দেব।”

কল্যাণ গালে হাত দিয়ে শুধু বলল, “দেখা যাবে।”

১২

দেখা গেল। তবে কল্যাণের তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। তবে কী দেখা গেল? স্ট্রাইক, হরতাল। কল্যাণ আর বালার্কর ঝামেলার দু’দিন পর এক বিকেলে, ওয়ার্কশপে মাইল্ড স্টিল প্লেট, বল পিন হ্যামার, ফ্ল্যাট চিসল, রাউন্ড ফাইল ও অন্যান্য প্রায় প্রস্তর-যুগের যন্ত্রপাতি নিয়ে যুদ্ধের শেষে বেরিয়ে এসে দেখলাম, মূল কলেজ বিল্ডিংয়ের বড় নোটিস বোর্ডের সামনে ব্যাপক ভিড়। কী কেস? না, প্রিন্সিপাল নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন। যে-যে স্টুডেন্টের অ্যাটেনডেন্স পঁচাত্তর শতাংশের কম, তাদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না। নোটিসের পাশেই বসতে-না-পারা ছাত্রদের লিস্টও ডটম্যাট্রিক্স প্রিন্টারে প্রিন্ট করে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে ইয়ার, স্ট্রিম আর সেকশন অনুযায়ী ভাগ করে স্টুডেন্টদের নাম আর রোল নম্বর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নোটিস বোর্ডের সামনের ভিড় সেই নামের লিস্টে নিজেদের খুঁজছে প্রাণপণ।

আমরা, মানে জুনিয়ররা হস্টেলে চলে এলেও, সিনিয়রদের ভিড় কিন্তু কমল না। বরং বাড়ল আরও। আমরা রুমের জানলা দিয়ে দেখলাম সিনিয়রদের মধ্যে যারা মাতব্বর, তারা গম্ভীর মুখে পায়চারি করছে। আট-ন’জন মিলে এক-একটা গ্রুপ বানিয়ে উত্তেজিতভাবে হাত পা নাড়ছে। আমাদের মনে হতে লাগল যে এবার ভয়ঙ্কর কিছু একটা হবে।

একসময় অভিষেক হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাদের খবর দিল যে মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রিন্সিপালের ঘরে স্টুডেন্টদের হয়ে রণবিজয়, চন্দরদীপ আর অরবিন্দর গিয়েছে। বাইরে নাকি চাপা গুঞ্জন যে, প্রিন্সিপাল ভাল কথায় না মানলে ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বারদের কাছে যাওয়া হবে। আর তারা না মানলে…

অভিষেকের অসম্পূর্ণ কথার বাকিটা এবার আর পূরণ করতে পারলাম না। কারণ আমি বুঝতে পারলাম না যে কী হতে পারে। আসলে ছোট থেকে স্কুলের স্যারেরা যা বলেছেন আমরা অক্ষরে- অক্ষরে পালন করেছি। পাশের ছেলেটার দুষ্টুমির জন্য আমাকে কান ধরে একশোবার ওঠবোস করতে হলেও কখনও স্যারকে বলিনি যে, “আমি না, ও।” আর সেখানে তিনজন স্টুডেন্ট একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে মিটিং করতে বসেছে। আর সেখানে কাজ না হলে যাবে ট্রাস্টিদের কাছে? একেবারে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস!

তবে মনে-মনে ভালও লাগল। ভাবলাম কলেজে এরকমই হয় তাহলে। যাক তাহলে আমরাও বড় হলাম এবার!

তবে রাতে এর বেশি আর কিছু জানা যায়নি। মেসে গিয়ে খাবার সময়ও শুধু গুজগুজ ফুসফুসই হয়েছে। সবাই ছাপান্নরকম অল্টারনেটিভও দিয়েছে। এমনকী জুনিয়রদের র‍্যাগিংয়ের ব্যাপারটাও ভুলে গেছে সবাই।

রাত কাটল। দিন হল। আমরা সবাই জুনিয়র হস্টেল থেকে বেরিয়ে ক্লাসেও গেলাম। প্রথম পিরিয়ড ছিল শিবযোগী স্যারের এম ই এস। তিনি পড়ালেন কম, জ্ঞান দিলেন বেশি। বললেন, আমরা জুনিয়ররা যেন ক্লাস না কামাই করি। যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করি। কারণ কাছেই ফার্স্ট সেমেস্টার। আর এও বললেন, সিনিয়রদের তালে যেন আমরা না নাচি। বসন্ত আমার পাশে বসেছিল। ও চাপা গলায় বলল, “আচ্ছা খচ্চর লোক তো! এখানে বলছে সিনিয়রদের কথায় না নাচতে আর সিনিয়রদের বলছে আমাদের যেন ঠিকঠাক র‍্যাগ করা হয়! দু’ মুখো সাপ একটা!”

পরের পিরিয়ড ছিল কেমিস্ট্রির। রোগা পাতলা শান্ত চেহারার নেহা ম্যাডাম খুব ভাল পড়ান। এবং ভাল পড়াচ্ছিলেনও, কিন্তু তখনই শুনলাম চিৎকার। একসঙ্গে অনেকগুলো গলা আকাশ ফুটো করে দেওয়ার মতো করে চেঁচাচ্ছে। আওয়াজটা ক্রমশ কাছে আসছে দেখে ম্যাডাম পড়া থামিয়ে দিলেন। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে আর ক্রমাগত র‍্যাগিংয়ের প্রকোপে দুর্বল হয়ে যাওয়া আমাদের মনে আতঙ্ক তৈরি হল। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গে-সঙ্গে প্রায় কুড়ি পঁচিশজন সিনিয়র এসে ঢুকল আমাদের ক্লাসে। তারা চিৎকার করতে লাগল, “লং লিভ এস আই টি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। লং লিভ দ্য ফাইটিং স্পিরিট। ডাউন ডাউন প্রিন্সি।”

সিনিয়ররা একপ্রকার গলা ধাক্কা দিয়ে আমাদের বের করে দিল ক্লাস থেকে। ঘোষণা করল, প্রিন্সিপালের ডিক্টেটরশিপের বিরুদ্ধে ইনডেফিনিট পিরিয়ডের জন্য স্ট্রাইক কল করা হয়েছে।

এর মধ্যে দু’ দিন মিছিলও বের করা হল। একটা গেল প্রিন্সিপালের বাড়ির দরজা পর্যন্ত আর অন্যটা গেল ট্রাস্টি বোর্ডের অফিসে। এইসব মিছিলে জুনিয়রদের কাটা সৈন্যদের মতো ভিড় বাড়াতে যেতে হল। এর মধ্যে একদিন আমায় মারও খেতে হল। অপরাধ, গুপ্তার মনে হয়েছিল আমি নাকি মন দিয়ে ‘নাড়া’ দিচ্ছি না। তাই ফেস্টুন তোলার লাঠি দিয়ে আমার নাড়ার ভলিউম বাড়ানো হয়েছিল।

তবে সমস্ত যোশ ঠান্ডা হয়ে গেল দু’দিনেই। ছাত্রদের জন্য একটা শামিয়ানা করা হল। তার তলায় কওশল, আবিরদাসহ চার পাঁচজন সিনিয়ার বসল অনশন ধর্মঘটে। তাদের সঙ্গে পঁচিশ তিরিশজনের দল রইল একটা। আর বাকিরা কখনও গাছের ছায়ায়, কখনও আন্টিস শপের সামনে বা কখনও সুরির দোকানের বেঞ্চে বসে আড্ডা মারতে লাগল। চারিদিকেই কেমন একটা ছুটি-ছুটি ভাব। চলন্ত ট্রেন সিগন্যাল না।পেয়ে অচেনা স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থা।

আমি এই হরতাল দেখার ফাঁকে-ফাঁকে পড়াশোনাও এগিয়ে রাখলাম অনেকটা। তার সঙ্গে ওয়ার্কশপের খাতা, ড্রয়িং অ্যাসাইনমেন্ট, কেমিস্ট্রি ল্যাবের এক্সপেরিমেন্টের নোট, যতটা সম্ভব তৈরি করে রাখলাম। এর মধ্যে অবশ্য র‍্যাগিংও চলল। বিড়াল হয়ে ম্যাওম্যাও করতে হল পঞ্চাশজন মেয়ের সামনে। হামাগুড়ি দিয়ে দেখাতে হল। হাইওয়ের ওপর বাঁদরদের সঙ্গে লাফালাফি করতে হল ঘণ্টাখানেক। বৈদভীর সঙ্গে বেরোতেও হল একবার টাউনে। তবে এবার আর বৈদভী তেমন সাংঘাতিক কিছু করেনি, শুধু আমার ঘাড় ভেঙে রেস্তরাঁয় তন্দুরি রুটি আর মাটন টিক্কা খেয়েছে।।

এসবের মধ্যেও বালার্কর টেনিস প্র্যাকটিস চলছে। কল্যাণ ময়ূখের সঙ্গে দাদাগিরি চালিয়ে যাচ্ছে আর ময়ূখ আর অরবিন্দের সেই অদ্ভুত ‘টিপ’ খেলা চলছে।

এরই মাঝে এক বিকেলে দূরের পাহাড়ের পাশে যে-ছাতিমগাছটা রয়েছে তার গোড়ায় বসে গল্প করছিলাম রুচির, কল্যাণ, বসন্ত আর আমি।

কল্যাণ ওর স্বভাবসিদ্ধ খোঁচানোর ভঙ্গিতে বলল, “কী রে তোর রুমি কই? পিট সাম্প্রস না ফেডেরার হতে গেছে? হুঁঃ, টেনিস খেলছে। গার্লস হস্টেলের সামনে তো টেনিসকোর্ট, কত যে টেনিস খেলছে জানা আছে। মালটা এমন যে শ্রীবিদ্যাকেও নাচাচ্ছে আবার অন্যদের সঙ্গেও ঝাড়ি করছে। শোন, সরসিজ ওকে বলে দিস এমন বাম্বু দেব না! আমার গায়ে হাত তোলা? আমার মালকে পটানো? শালা একদম হাওয়া বের করে দেব।”

রুচির বলল, “তুঝে পতা হ্যায়, কেন শ্রীবিদ্যা তোকে পছন্দ করে না? কারণ, তোর বিহেভিয়ারটা খুব স্পেস কনজ়িউমিং। সব ব্যাপারে ‘আমি-আমি’ করছিস। তার উপর শালা তুই হামবাগ। একদম পোলাইট নোস। আর ফাইনালি, এই যে তুই শ্রীবিদ্যাকে “মাল’ বললি না এতে তোর ক্লাসটা বোঝা গেল।”

“এঁঃ” কল্যাণ মুখ বাঁকাল, “এখানে আর ভাষা বা ক্লাস নিয়ে কথা বলিস না। সিনিয়ররা বাপ, মা তুলে ছাড়া কথা বলে না। ওয়ার্ডেন র‍্যাগিংয়ের জন্য উসকায়। শালা, ক্লাস দেখাচ্ছে! শোন, সারভাইভ করাটাই আসল। হুইচ আয়্যাম ডুইং। ক্লাসের ফার্স্ট বয় আমি, বুঝেছিস?”

আমি হাই তুললাম। বড় বোর করছে ছেলেটা। বেশ কয়েকমাস কেটে গেল! কিন্তু মনে হচ্ছে যেন গতকালের ব্যাপার। ফার্স্ট সেমের পর বাড়িতে যাব একবার। তবে বাড়ির জন্য মনখারাপ যেন ক্রমশ কমছে। কেমন রোবটের মতো লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে একটা ছাঁচের মধ্যে আটকে গিয়েছি।

আমি উঠলাম, “চল এবার ফিরি। খিদে পাচ্ছে। ওই হানি কেক খাই চল।”

ওরা উঠল। বসন্ত বলল, “আমি কেক খাব না। বরং আন্টিস শপ থেকে মশালা বাদাম খাব। এমন জিনিস মাইরি কলকাতায় খাইনি।”

হাঁটতে-হাঁটতে হাইওয়ের ধারে এসেই আমরা থমকে গেলাম। বালার্ক এখানে কী করছে?

বালার্ক গল্প করছে। ওর হাতে টেনিস র‍্যাকেট আর ওর সামনে স্কুটারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তোড়ি ও শ্রীবিদ্যা। সকলের মুখে হাসি। খেয়েছে। আমি ঢোঁক গিললাম। আমার সামনে মূর্তিমান দু’ পিস বিপদ। প্রথমটার নাম হল শ্রীবিদ্যা ও বালার্ক আর দ্বিতীয়টা হল ওই হাঁটুর নাটবন্টু ঢিলে করা সুন্দরী, তোড়ি!

আমি ঘাড়টা না ঘুরিয়ে আর চোখটা যত সম্ভব ঘুরিয়ে কল্যাণের মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। যা ভেবেছি তাই। ফরসা মুখ লাল। মনে হল যেন জ্যান্ত রকেট। পেছনে ইগনিশনও শুরু হয়ে গিয়েছে। যে- কোনও সময় লঞ্চ হয়ে যাবে। আর হলও তাই। তবে রকেট যায় চাঁদের দিকে ভার্টিক্যালি আর কল্যাণ গেল শ্রীবিদ্যার দিকে, হরাইজ়ন্টালি। একটা কেলেঙ্কারি হতে পারে সেই আশঙ্কায় আমরাও পিছু নিলাম।

কল্যাণের ঘুষিটা অনায়াসে বাঁ হাত দিয়ে আটকে ওকে ঠেলে লাল মাটির ওপর ফেলে দিল বালার্ক। আজ কিন্তু কল্যাণ দমল না। বরং পটাং করে উঠে দাঁড়িয়ে পালটা মারতে হাত তুলল। তবে মারটা কমপ্লিট করতে পারল না। হাওয়ায় আটকে গেল হাত। কারণ শ্রীবিদ্যা বালার্ককে গার্ড করে। বলল, “কী করছ তুমি? হোয়াট দ্য হেল ইউ থিঙ্ক ইউ আর ডুইং? এক থাপ্পড় মারব অসভ্য ছেলে।”

কল্যাণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। রকেটের লেজে কে যেন জল ঢেলে দিয়েছে। শ্রীবিদ্যার এমন মারমুখী মেজাজ দেখে আমরাও থ মেরে গিয়েছি। তবু কল্যাণ কোনওমতে বলল, “আই লাভ ইউ শ্ৰী। লাভ ইউ ভেরি মাচ। ও চলে যাবে এই সেমেস্টারের পর। কিন্তু আমি থাকব। তোমার যে-কোনও সাবজেক্ট আমি দেখিয়ে দেব। তুমি দেখো, ও এখানে নেই। আমি আছি। তোমার জন্য আছি।”

শ্রীবিদ্যা বলল, “চলে যাও তুমি। রাস্কেল। প্রেম করতে এসেছে!”

কল্যাণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর মাথা নিচু করে চলে গেল। গোটা ঘটনাটা ঘটতে পাঁচ মিনিট সময় লাগল বোধহয়, কিন্তু তখন কে জানত এই পাঁচ মিনিটের ঘটনাই শ্রীপুরমের বুকে আরও নতুন ঝামেলা ডেকে আনবে।

তবে ঝামেলার আগে অন্য যে-ঘটনাটা এরপর ঘটল, তা সংক্ষেপে বলে নিই। কল্যাণ চলে যাওয়ার পর তোড়ি হঠাৎ এগিয়ে এসে সবার সামনে আমার হাত জড়িয়ে ধরল। বলল, “লেট্স গো ফর আ ওয়াক।”

“ওয়াক?” আমি তোড়ি থেকে ছিটকে গেলাম। করছে কী মেয়েটা? আমায় মারবে নাকি?

“কী হল?” তোড়ি ভুরু কোঁচকাল।

“তুমি আমার সঙ্গে কথা বোলো না। যা অশান্তি হচ্ছে। সেদিন প্রিন্সিপাল পর্যন্ত কেসটা গড়িয়েছিল। দ্যাখো, আমি পড়াশোনা করতে এসেছি। ফালতু ঝঞ্ঝাট আমার ভাল লাগে না। প্লিজ় কিপ সেফ ডিস্ট্যান্স,” কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে আমি আর কারও দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হাঁটা দিলাম।

এর ফলটা ঘটল এক ঘণ্টা পর। আমরা সবাই অনশন মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ সেখানে ঝড়ের বেগে এসে উঠল তোড়ি। সকলেই একটু ঢিলেঢালা মেজাজে ছিল, কিন্তু কলেজের অন্যতম সুন্দরী মেয়ে অমনভাবে এন্ট্রি নেওয়াতে পাবলিক নড়েচড়ে বসল। তোড়ি মঞ্চে উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজল। আমায় দেখে যখন খোঁজা

থামাল, বুঝলাম আমাকেই খুঁজছিল। তারপর কঠিন একটা দৃষ্টি আমার দিকে ভাসিয়ে দিয়ে মঞ্চের কোনায় আধশোয়া হয়ে থাকা রণবিজয়ের কাছে গিয়ে আচমকা, সবার সামনে, চকাস করে ওর গালে চুমু খেল। তারপর প্রায় চিৎকার করে বলল, “ইউ আর দ্য ব্রেভেস্ট।”

পিঁপড়ে, ভীমরুল, বোলতা, শুঁয়োপোকা— একসঙ্গে আমার মাথার ভেতর নড়ে উঠল। দেওয়ালের হেলে যাওয়া ছবির মতো টাল খেয়ে গেল দৃশ্যপট। চোখের ভিতর বোমা ফাটল। তবে তা শোনা গেল না, কারণ আশপাশ থেকে হল্লা উঠল একটা। কে যেন চিৎকার করল, “লং লিভ স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। লং লিভ হাঙ্গার স্ট্রাইক।” হাততালি পড়ল খুব। সিটি বাজল।

আর আমি, ম্যাওম্যাও, দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে মাথা নামালাম। ভাবলাম, কীসের হাঙ্গার স্ট্রাইক? চুমু খেয়ে তো অনশন ভঙ্গ হয়েই গেছে!

১৩

স্ট্রাইকটা উঠল এক রোববার সকালে। দশদিনের মাথায়। প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি যে হঠাৎ স্ট্রাইক উঠে যাবে। কিন্তু ‘কীসের থেকে কী হইয়া গেল আর মোহন পলাইয়া গেল’-র মতো করেই প্রিন্সিপাল মেনে নিলেন যে অ্যাটেনডেন্স নিয়ে তিনি আর ঝঞ্জাট বাড়াতে চান না। বরং ক্লাস শুরু হোক ও ছাত্রদল পরীক্ষায় বসুক।

আমরা সকালের ব্রেকফাস্টে গতদিনের বাসি ভাতের সঙ্গে নেড়ে দেওয়া বেগুন ও গাজর খেয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎ পটকার আওয়াজ শুনলাম। ছাত্রদের সমবেত উল্লাস শুনলাম। ‘লং লিভ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ শুনলাম। এবং এতদ্বারা এই বোঝানো হল যে কলেজের স্ট্রাইক উঠে গেল। সিনিয়ররা এসে হঠাৎ আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। কেউ-কেউ জড়িয়েও দরল। গজা-টাইপের একটা মিষ্টি সকলের হাতে-হাতে ধরিয়েও দেওয়া হল। বলা হল জয়ের আনন্দেই এই মিষ্টিমুখ। তবে সকলের মনটাও যে মিষ্টি হয়ে গেল তা কিন্তু নয়।

হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে আবিরদা চাপা গলায় বলল, “শালা, আবার ক্লাস শুরু, ওঃ!” হস্টেলে ফিরে রুচিরও বলল, “বেশ ছুটি ছিল দশদিন, নাও আবার ভোর পাঁচটায় উঠে পায়খানার জন্য লাইন দাও। বড্ড তাড়াতাড়ি স্ট্রাইকটা শেষ হয়ে গেল রে!”

এবার ক্লাস শুরুর সঙ্গে-সঙ্গে আরম্ভ হয়ে গেল টেনিস টুর্নামেন্টও। ফলে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা ও খেলাধুলোয় মেতে রইল। আমিও অন্যান্যদের সঙ্গে খেলা দেখলাম। বালার্কর তেজে গুপ্তা আর রুচির পটাপট হেরে গেল। অন্যদিকে রণবিজয় আর আবিরদাও অপনেন্টদের হারিয়ে থার্ড রাউন্ডে উঠে পড়ল।

রুচিরের সঙ্গে ম্যাচের পর, সন্ধেবেলা রুমে ফিরে আমি আর বালার্ক একসঙ্গে চমকে উঠলাম।

আমার খাটে জুতো-পরা পা তুলে বসে রয়েছে রণবিজয়। আর টেবিল, চেয়ার, বালার্কর খাট জুড়ে বসে রয়েছে আরও ছ’জন।

নিমেষে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আবার রণবিজয়! কিন্তু আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। এমনকী সেদিন যখন তোড়ি ওয়ার্কশপে আমার থেকে ওয়েল্ডিং রড চাইল, তখনও আমি ওকে একটাও ইলেকট্রোড দিইনি। তা হলে? তা হলে হঠাৎ রণবিজয় আমার ঘরে এল কেন?

ভিতরের আর-একটা মন হঠাৎ গালি দিল আমায়। বলল, “ছিঃ, ভয় পাচ্ছিস? তোড়ি যে ওকে চুমু খেয়েছিল তা তো আসলে তোর গালে থাপ্পড়। এই ছেলেটা তোর প্রেমের পথে কাঁটা আর তুই কিনা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছিস? লড়ে যা, লড়ে যা,” আমার মন আমাকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলেও, রণবিজয়ের ওই সাড়ে ছ’ফুটি চেহারা, ডান হাতের মোটা কড়া আর রক্তবর্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুতেই উদ্বুদ্ধ হতে পারলাম না। বরং কান্না পেল হঠাৎ। নিজের অক্ষমতার জন্য, ভীরুতার জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। কিন্তু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় রইল না আমার।

বালার্ক বলল, “তোমরা ঘরে ঢুকলে কী করে? এভাবে অন্যের ঘরে ঢোকা কিন্তু বেআইনি। প্রিন্সিপাল স্যারকে বললে তোমাদের বিপদ হবে!”

আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। বালার্ক সবসময় হিরোগিরি করতে চায়। ভাবে ফাস্ট টার্মের পর চলে যাবে যখন তখন ওর আর ভয় কী? কিন্তু ওর জন্য তো আমরা বিপদে পড়ব!

রণবিজয় কিন্তু রাগল না, উলটে হাসল, বলল, “ও ট্রেন কা লড়কা পিসাব কর দেনে কি হালত মে থা। শালে, উস নৌটঙ্কিকে পাস অগর ঘর কা চাবি রাখ্‌খেগা তো অ্যায়সা হি হোগা না!আর বাচ্চাটার র‍্যাগিং নেব কী, আমি তো হেসেই খুন!”

বুঝলাম ময়ূখের কাজ। ওকে আমি চাবিটা দিয়ে গিয়েছিলাম। খেলা দেখতে গিয়ে লাফালাফি করে চাবি হারিয়ে ফেলতে পারি! আর মালটা শালা চাবি দিয়ে দিয়েছে! তোর কী বলার দরকার ছিল যে, আমাদের ঘরের চাবি তোর কাছে আছে? কিন্তু এরা এসেছে কেন? কী মতলব?

রণবিজয় আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী রে, তুই যে গুড বয় হয়ে গেলি!তোড়ির সঙ্গে তো আর কথাই বলিস না। বস্, আপনে আপকো অ্যায়সে হি রাখ্‌খিও। কোই গলত কাম না করিও, ঠিক হ্যায়? চল, একবার ম্যাওম্যাও করে দেখা।”

আমি দাঁতে দাঁত চিপলাম। তারপর হাত জোড় করে মাথা নামিয়ে বললাম, “ম্যাওম্যাও।”

“গুড। অব হিরো, তু কুছ কর,” রণবিজয় উঠে এসে কাছে দাঁড়াল আমাদের। এবার আমি নই, ওর লক্ষ্য বালার্ক।

“কী করব?”

“শুনছি তুই নাকি চলে যাবি অন্য কলেজে? কেন? আমাদের সমুদ্রম খারাপ, না আমরা?” রণবিজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরচ্ছে।

“সব খারাপ,” বালার্ক দাঁত চেপে বলল, “র‍্যাগিং করতে কষ্ট হয় না।তোমাদের? তাও সারা বছর ধরে? শুনেছি কয়েকদিন র‍্যাগিং হয়ে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়ে সব ঠিক হয়ে যায়। আর তোমরা সারাটা সময় ধরে আমাদের উপর নির্যাতন করো। কেন থাকব এখানে? কীসের জন্য থাকব?”

“বহুত বোলতা হ্যায় তু!” রণবিজয় খপ্ করে বালার্কর চুলের মুঠিটা ধরল, “শোন, চারটে বেলুন দেব। হার্ট শেপ্ড। ওগুলো ফুলিয়ে লাগিয়ে দিয়ে আয় গার্লস হোস্টেলের গেটে, যা।”

বালার্ক চোয়াল চেপে দাঁড়িয়ে রইল।

“যা বে শালে,” রণবিজয় পকেট থেকে বেলুন বের করে ওর সামনে ধরল, “যা বলছি।”

বালার্ক তবুও অনড়। আমাদের এখানে প্রথমেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে গার্লস হস্টেলের ভিতরে যেন না যাই আমরা। ওখানকার যিনি ওয়ার্ডেন ম্যাডাম, তিনি খুব কড়া। কেউ গেলে অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। আর এমনি গেলে এক সেমের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হবে তাকে। আর রণবিজয় কিনা সেখানেই বালার্ককে এই সন্ধের সময় ঠেলছে!

“কীরে? যা,” রণবিজয় ওর ঘাড় ধরল।

বালার্ক দৃঢ় গলায় বলল, “যাব না। যা করার করো।”

“ঠিক হ্যায়, চল ম্যাওম্যাও-এর জামা খোল,” রণবিজয় এবার আমার দিকে ঘুরল।

অ্যাঁ? জামা খুলবে? কেন? আমি তো গুড বয়। তোড়ির দিকে তাকাই না। নিজের মেরুদণ্ড খুলে সুটকেসে গুছিয়ে রেখেছি, সবসময় সিনিয়রদের আপনি, স্যার, গুড মর্নিং, গুড নাইট বলি। আর শেষে কিনা আমার জামাটাই পছন্দ হল ওদের?

আমি প্রতিবাদ করার আগেই জামাটা খোলা হয়ে গেল। তারপর ঘাড় ধরে আমায় মাথা নিচু করে বসানো হল। রণবিজয় বলল, “নে মোম জ্বালা।”

মোম? গলন্ত মোম? যা ‘ওয়্যাক্স টর্চার’ নামে ক্যাম্পাসে বিখ্যাত! এরা এমন করছে কেন? আমি কী করেছি?

“ওকে ছেড়ে দাও,” বালার্ক গম্ভীর গলায় বলল।

“দেব, তুই যা, রণবিজয় কওশল হাসছে।

“ছেড়ে দাও ওকে, না হলে…” বালার্ক শেষ করতে পারল না কথাটা, আচমকা পিছন থেকে একটা থাপ্পড় এসে পড়ল বালার্কের মাথায়। ও থতমত খেয়ে গেল। আমি মাটিতে নিল ডাউন অবস্থাতেও মাথা ঘোরালাম। আবিরদা!

“মুখে-মুখে তর্ক করছিস?” আবিরদা আর একটা থাপ্পড় বসাল। এবার পিঠে। বালার্ক কিছু বলার আগে কওশল বলল, “আবির, তুই এখানে?”

“আরে, চন্দরের শরীর খারাপ হয়েছে। তোকে খুঁজছে। চল তুই। এই গাধাগুলোর সঙ্গে সময় নষ্ট করছিস কেন?”

“চন্দর বিমার হ্যায়?” রণবিজয় হঠাৎ এলোমেলো হয়ে গেল। ক্যাম্পাসের, সকলেই জানে রণবিজয় চন্দরদীপকে ভাইয়ের মতো ভালবাসে।

আবিরদা বলল, “চল এসব পরে করিস। আগে চন্দরকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”

রণবিজয় আর অপেক্ষা করল না। ওয়্যাক্স টর্চার, বেলুন আর গার্লস হস্টেল পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল। শুধু যেতে-যেতে বলল, “হিসাব বাকি হ্যায়।”

এতক্ষণের হিউমিলিয়েশন, তোড়ির থেকে দূরে থাকার ফ্রাস্ট্রেশন আর ভয়, সব মিলিয়েই কি না জানি না, আচমকা আমার শরীর কাঁপিয়ে রাগ উঠে এল। মনে হল সারা ক্যাম্পাস মাথায় নিয়ে নাচি! মনে হল এক ঘুষিতে জুনিয়র হস্টেলকে ধুলোয় মিশিয়ে দিই একেবারে। কিন্তু সেসব না করে আমি দড়াম করে একটা ঘুষি মারলাম টেবিলে। আমার জল খাওয়ার স্টিলের গ্লাসটা আচমকা কম্পনে নড়ে, নেচে, গড়িয়ে ঠং- ঠং করে পড়ল মেঝের উপর।

“কী করছিস কী?” বালার্ক আমার দিকে ঘুরল।

“বেশ করছি শালা,” আমি চিৎকার করলাম, “তুই গেলি না কেন বেলুন টাঙাতে? আমায় ওরা গলন্ত মোম দিয়ে টর্চার করত।”

“বেশ করেছি যাইনি। তুই প্রতিবাদ করতে পারিস না? শালা ভেড়া।”

“আমি ভেড়া? আমি তোর বন্ধু না?” আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।

“হ্যাঁ তুই ভেড়া, তুই বন্ধু নোস। আসলে তোরা কেউ আমার বন্ধু নোস। বাবাকে তখন পইপই করে বললাম এখানে পড়ব না। দাদাভাইয়ের কলেজে আমায় ভর্তি করাও। কিন্তু শুনল? নেক্সট সেমে এখানে থাকবই না আমি। তোরা সব স্বার্থপর। নিজেরটা ছাড়া…”

“আর তুই? তুই স্বার্থপর নোস?” আমি ধাক্কা মারলাম ওকে, “গেলি? আজ আমার জন্য গেলি ওখানে? তোর রুমমেট বলে আমার আজ এই অবস্থা।”

আচমকা আমার গলা বুজে এল। কার উপর রাগ, কার উপর দুঃখ সব গুলিয়ে গিয়ে ভীষণ কান্না পেল আমার। এ কোথায় এসেছি আমি? বাবা, এ আমায় কোথায় পাঠালে? এই আমার রুমমেট? আজও আবিরদা বাঁচাল, না হলে যে কী হত!

“এই, কাঁদছিস কেন?” দরজার দিক থেকে গলা পেয়ে আমি সচেতন হলাম। আরে, কল্যাণ এখন কেন? মজা দেখতে এসেছে?

বালার্ক গম্ভীর গলায় বলল, “তুই এসেছিস কেন?”

কল্যাণ কাঁচুমাচু হয়ে গেল হঠাৎ। তারপর হাত কচলে, ঠোঁট চেটে যা বলল তাতে আমার সদ্যোজাত কান্না ঠিকমতো ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই অক্কা পেল। তার বদলে জন্ম নিল বিস্ময়। আমি এক সেকেন্ড আগের রাগ ভুলে বালার্ককে বললাম, “এই মালটা কী বলছে রে?”

মালটা মানে কল্যাণ, পুনরায় মাখন মোড়া স্বরে কেটে-কেটে বলল, “আমি তোদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি ভাই।”

ভাই! আমি এত আশ্চর্য হলাম যে আশ্চর্য হওয়ার এক্সপ্রেশন দিতেও ভুলে গেলাম।

১৪

হলুদ বলটা বেস লাইনের ইঞ্চিখানেক ভিতরে ড্রপ খেয়ে ক্লে কোর্টের লাল ধুলো ওড়াল একটু, তারপর বিকেলের রোদ চিরে বিদ্যুৎগতিতে আছড়ে পড়ল পিছনের লম্বা সবুজ স্ক্রিনে। জাজের লম্বা চেয়ার থেকে ঘোষণা করা হল, “গেম সেট অ্যান্ড ম্যাচ মিস্টার বালার্ক ভদ্র।”

“হি ক্যান ইভেন বিট রাফায়েল নাদাল। ইন বোথ গেম অ্যান্ড চার্ম,” শ্রীবিদ্যা চারদিকের হাততালির মাঝে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চিৎকার করল।

আমি বললাম, “অ্যাঁঃ, নাদাল! নাদানের মতো কথা বলিস না। তোর সবটাই বাড়াবাড়ি।”

“চুপ কর ম্যাওম্যাও,” শ্রীবিদ্যা আলতো করে ঘুষি মারল আমার হাতে, “চল।”

চলতে-চলতে এবার ছোট্ট করে দু’-চারটে কথা বলে নিই। এই যে অল্প করে একটা ম্যাচের ট্রেলার দেখলাম, সেটা ছিল সেমিফাইনাল ম্যাচ। অরবিন্দার ভার্সেস বালার্ক। তিন সেটের ম্যাচে বালার্ক জিতল ৪-৬, ৬-৪, ৭-৬ স্কোরে। তবে আমি আর ডিটেলে ম্যাচের বর্ণনায় গেলাম না। শুধু স্কোরটা বললাম কারণ, ম্যাচটা জিতে বালার্ক যে ফাইনালে রণবিজয়ের সামনে পড়ল সেটা পাঠকদের জানানো দরকার।

একটু হিন্দি সিনেমা হয়ে গেল কি? মানে নেগেটিভ ক্যারেকটার আর পজিটিভ ক্যারেকটারের ফাইনাল শোডাউনটা কি ফিল্মি হয়ে গেল? কিন্তু দু’জনেই যদি ফাইনালে ওঠে তাতে আমি কী করব? তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, ফাইনালটা শুধু খেলার হার-জিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তার চেয়েও বেশি কিছু হবে। আর আমার অনুমান যে সত্যি, গ্যালারি থেকে নেমে তা অরভিন্দের কথাতেই বুঝলাম।

পাঠক, অরবিন্দার আর অরবিন্দকে গুলিয়ে ফেলো না প্লিজ়। প্রথমজন আমাদের সিনিয়র, চণ্ডীগড়ের ছেলে আর দ্বিতীয়জন কর্নাটকের এবং আমাদের ব্যাচমেট।

অরবিন্দ বলল, “বালার্ক, ফাইনালে রণবিজয়কে হারিয়ে গত পরশুর শোধ তুলতে হবে কিন্তু।”

বালার্ক বলল, “শুধু ওটুকুই নয়, সব শোধ তুলব। জুনিয়রদের উপর যত র‍্যাগিং করেছে তার সবটুকু শোধ তুলব আমি।”

শ্রীবিদ্যা জানতে চাইল, “কেন, গত পরশু কী হয়েছিল? এই ম্যাওম্যাও, বল কী হয়েছিল?”

শ্রীবিদ্যা আজকাল আমাকে ‘তুই’ করে ডাকে। বলে তোড়ির পর আমিই নাকি ওর ভাল বন্ধু। তাই ভাল বন্ধুর মর্যাদা দিতে ওর সব কৌতূহলের নিরসন করতে হয় আমায়।

আমি ঘটনাটা বলব বলে মুখ খুললেও, বালার্ক ভুরু কুঁচকে বলল, “সব কথা সকলকে বলার দরকার নেই।”

“সবাইকে মানে?” শ্রীবিদ্যা আমায় সরিয়ে মুখোমুখি হল বালার্কর।

“শোনো, আমি আর কয়েক সপ্তাহ আছি এখানে। ফলে, ডোন্ট ট্রাই টু গেট পারসোনাল। চল অরবিন্দ।”

টেনিসের কিট গুছিয়ে অরবিন্দকে নিয়ে এগিয়ে গেল বালার্ক। সেই দিকে ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইল শ্রীবিদ্যা। চশমার ওপারে টলটল করছে চোখ। একটু স্পর্শেই জল গড়িয়ে নামবে। চোখের জল অন্যের জন্য কখন ফেলে মানুষ?

আমি বললাম, “কী রে কাঁদছিস? ধুর, বালার্কটা পাগল। ওর কথা ধরিস না।”

“ধরব না? আচ্ছা, এখান থেকে কেন চলে যাবে ও? আমরা এতটাই খারাপ? আর এখানের সব কাজেই তো ইনভল্‌ভড হয়ে গিয়েছে বেশ। তারপর ও যেতে পারবে? কষ্ট হবে না? ও বুঝতে পারছে না যে, প্রথম দিকে অহঙ্কারী আত্মমগ্ন ছেলেটা নিজের অজান্তেই সকলের হয়ে উঠেছে? এই কলেজই তো ওকে ট্রান্সফর্ম করল। আর এখান থেকেই ও চলে যাবে?”

আমি আর কী বলব? রামায়ণে লক্ষণের আর ক’টা ডায়ালগ ছিল? শ্রীবিদ্যা আর দাঁড়াল না। মাথা! নিচু করে হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ সত্যিই রাগ হল বালার্কর ওপর। কেন রণবিজয়কে হারিয়ে ও সকলের হয়ে শোধ তুলতে চায়? কে ও? ও আমাদের কে?

ওই দূরে চারটে গুলমোহর গাছ। তার মাঝ দিয়ে লাল রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। সেই রাস্তা দিয়ে অরবিন্দকে পাশে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বালার্ক। দৃশ্যটা দেখে রাগের ফাঁকফোঁকরে এসে জমা হতে লাগল দুঃখ। এই ক’মাসেই মানুষ এত আপন হয়ে যায়! নবাবপুত্তুর হয়ে যায় প্রিয় বন্ধু!

আমি বালার্ককে ধরব বলে দৌড় লাগালাম। আর এইখান থেকে ওর কাছে পৌঁছনোর ফাঁকে তোমাদের সংক্ষেপে বলে নিই গত পরশু ঠিক কী হয়েছিল।

মেসে আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে আমরা হস্টেলে ফিরে এলেও বালার্ক আমাদের সঙ্গে ফেরেনি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“একটু টাউনে যাব। প্র্যাকটিক্যাল খাতার পৃষ্ঠা ফুরিয়ে গেছে। তা ছাড়া ফোনের জন্য টপআপ কিনতে হবে।”

“আমার ফোন থেকে কথা বলে নিবি।”

“না, তোরা যা না। অটো ধরে যাব আর আসব।”

এমনিতেই শ্রীপুরম ফাঁকা। আর রাত হলে মনে হয় ফাঁকগুলোকে কারা যেন টেনে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হস্টেলে ফিরে আমার কেবল মনে হচ্ছিল গুপ্তা আর বালার্কর মারামারির সেই রাতটা। মনে হচ্ছিল, যদি আজও তেমন হয়?

ঘরে এসে পড়তে বসেছিলাম। বা বলা যায় পড়াতে বসেছিলাম বা আরো ক্লিয়ারলি বলতে গেলে, দেওয়ালে মাথা ঠুকতে বসেছিলাম। কারণ আমার ছাত্র ছিল ময়ূখ!

ওকে নিয়ে যুদ্ধ করতে-করতে রাত দশটা বেজে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ নীচে একটা গোলমাল শুনে আমি মুখ তুলেছিলাম। ছুটে নীচে গিয়ে দেখি, গেটের কাছে জন্মদিনের পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে বালার্ক। আর ওর থেকে একটু দূরে দুটো মোটর বাইকে রণবিজয় আর গুপ্তার সঙ্গে আরও দু’জন। ওই দু’জনের হাতে পোঁটলা করা বালার্কর জামাকাপড়।

বালার্কর মুখ অপমানে লাল হয়ে ছিল। জড়সড় হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল কোনওমতে। রণবিজয় আমার দিকে জামাকাপড় ছুড়ে দিয়ে বলেছিল, “আজ ইসকা সহি ইন্ট্রো হুয়া হ্যায়। মাঝরাস্তা থেকে এতটা হেঁটে আসতে আশা করি ভাল লেগেছে ওর। অব দেখতে হ্যায় তু কেয়া করতা হ্যায়। হস্টেলে থাকলে সকলের সঙ্গে এক হয়ে থাকতে হবে। তু ভিআইপি নহি হ্যায়, সমঝা?”

জামাকাপড়ের সঙ্গে টপ-আপ কার্ড আর কাগজও ফেরত দিয়েছিল ওরা। ওসব নিয়ে উপরে এসে বালার্ক চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। আমি আর ওকে ঘাঁটাইনি। তবে বুঝেছিলাম ফেরার পথেই কোথাও ওকে ধরেছিল কওশল।

মাঠের মাঝ বরাবর বালার্ককে এখন ধরলাম আমি। বললাম, “শোন সপ্তাহখানেক পরেই ফার্স্ট সেম শুরু হচ্ছে। আর আড্ডা নয়, পড়বি চল।”

অরবিন্দ বলল, “ঠিক বলেছিস টেনিস ফাইনাল তো শেষ পরীক্ষার পরের দিন। এখন ওসব বাদ দিয়ে মন দিয়ে শেষ পড়াটুকু করে নিই চল। শুনেছি, ম্যাথ্‌সের কোয়েশ্চন বেশ কঠিন হয়।”

কিন্তু ম্যাথ্‌সের চেয়েও কঠিন কিছু অপেক্ষা করেছিল আমাদের জন্য।

হস্টেলে প্রায় পৌঁছে গিয়েছি, হঠাৎ বসন্ত আর ময়ুখ এসে বলল, “এই তোদের চন্দরদীপ ওর ঘরে যেতে বলেছে। ও এখনই দু’দিনের জন্য বেঙ্গালুরু যাবে। তার আগে তোরা যে ছ’টা অঙ্ক কষতে দিয়েছিলি, সল্‌ভ হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দেবে। যা তাড়াতাড়ি।”

চন্দরদীপের এটা একটা ভাল গুণ। র‍্যাগিং-ট্যাগিং করলেও, সাহায্য করে। গত চারদিন আগে আমিই গিয়ে অঙ্কগুলো ধরিয়ে দিয়ে এসেছিলাম।

আমি অরবিন্দকে বালার্কর কিটটা দিয়ে বললাম, “তুই এটা উপরে রাখ, আমরা ঘুরে আসছি।”

বালার্ক ময়ূখকে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি ডেকেছে তো চন্দরদীপ, নাকি…”

“মাইরি বলছি… কল্যাণও আমাদের সঙ্গে ছিল। তুই ওকে জিজ্ঞেস করতে পারিস।”

আমরা সিনিয়র হস্টেলের দিকে হাঁটা দিলাম। কল্যাণকে জিজ্ঞেস করার কিছু নেই, ময়ূখ তো মিথ্যে বলবে না। তবে কল্যাণ হঠাৎ পালটে গিয়েছে এখন। সেই রাতে এসে আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিল, “তোরা আর মনে কিছু রাখিস না। বালার্ক, শ্রীবিদ্যা তোর। প্রেম তো আর জোর করে হয় না। যা হয়েছে, আমি তার জন্য দুঃখিত।”

সেই রাত থেকে এখন পর্যন্ত আচমকা এই ডিগবাজি খেয়ে দুঃখিত স্ট্যান্ডটা বজায় রেখেছে কল্যাণ। যদিও বুঝিনি কেসটা কী, তবু ‘মানুষে ভরসা হারানো পাপ’ নীতি অনুযায়ী কল্যাণ এখন আমাদের বন্ধু।

আমরা দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। চন্দরদীপকে ওয়েট করানো ঠিক হবে না ।

“কী রে? আবিরদার কাছে যাচ্ছিস?” পিছন থেকে আচমকা কল্যাণের গলা পেলাম।

“অ্যাাঁ, আবিরদা? চন্দরদীপ তো ডেকেছে,” আমি অবাক হলাম।

“আগে আবিরদার কাছে যা, খুব খুঁজছে তোদের। এখনই যা।”

“কিন্তু চন্দরদীপ তো বেঙ্গালুরুতে…”

“ধ্যাত্‌তেরি, যা না আবিরদার কাছে। হন্যে হয়ে খুঁজছে তোদের,” কল্যাণ হাত নাড়িয়ে সুরির দোকানের দিকে দেখাল।

আবিরদা আমার কাছে বরাবর স্পেশ্যাল। ভাবলাম দোকানে ঢুঁ মেরেই তো চন্দরদীপের কাছে যাব, দেরি আর কী হবে?

কিন্তু দেরি হল। সুরির দোকানে আবিরদা ছিল না। সৌগত নামে আর- এক সিনিয়র রিভেরিতে আবিরদার কাছে ধরে নিয়ে গেল আমাদের। আর সেটাই কাল হল। আবিরদা টালমাটাল অবস্থায় বসেছিল ওখানে। বলল, “ডেকেছিলাম তোদের? মনে নেই তা,” তবে আমাদের ছাড়ল না, বরং চেপে ধরল। আমার টাকা ফেরত দিল। আমাদের খাওয়াল। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেলল। বলল, ওর ছোট ভাই ছিল। সে নাকি আজকের দিনেই মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। বলল, “ম্যাওম্যাও তোকে একদম আমার ভাইয়ের মতো দেখতে।”

এসব নানা কথায় সন্ধে হয়ে গেল। আমরা ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে সিনিয়র হস্টেলে গিয়ে দেখলাম চন্দরদীপ চলে গিয়েছে। আর তারপর জুনিয়র হস্টেলে ফিরে যা শুনলাম তা যথেষ্ট উদ্বেগের। চন্দরদীপ খুঁজতে এসেছিল আমাদের। আর খুঁজে না পেয়ে ভীষণ রেগে গিয়েছে। বলে গিয়েছে, ওকে অপেক্ষা করানোর ফল পেতে হবে আমাদের। আবিরের সঙ্গে বাঙালি ব্রিগেড তৈরি করে গ্রুপবাজি করা বের করে দেবে।

তবে আসল খবরটা দিল রুচির। বলল, “চন্দরদীপ এখানে একা আসেনি কিন্তু, কওশলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। অব তুমলোগ বচকে রহিও বঙ্গালি।”

১৫

বচ কে রহিও বঙ্গালি! কিন্তু কে বাঁচাইবে বঙ্গালিরে? সকলেই যে নিজের-নিজের জান ও মান বাঁচাইতে ব্যস্ত। না, এবার আর সিনিয়রদের হাত নেই এই জান-মানের বিপন্নতায়। বরং হাত রয়েছে ইউনিভার্সিটির। কারণ প্রথম সেমেস্টার সমাগত। অর্থাৎ আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দৌড়ের প্রথম হার্ডল পেরতে হবে আমাদের।

গোটা ক্যাম্পাস হঠাৎ যেন শান্ত হয়ে গেল এক সঙ্গে। বন্ধ হয়ে গেল সেই আন্টিস শপের আড্ডা, সুরির দোকানের ভিড় বা রিভেরিতে মদের ঠেক, বন্ধ হয়ে গেল যখন-তখন ঘুরে বেড়ানো আর হইহল্লা। সিনিয়ররা সকলে হঠাৎ বদলে গেল যেন। যেন আমাদের চেনেই না তারা। যেন কোনও দিন দেখেইনি। গুড মর্নিং বললেও তারা উত্তর দিচ্ছে না। গুড মর্নিং না বললেও কিছু বলছে না। এমন ভাব করছে যেন আমরা ‘নেই’।

এতে সুবিধে হল একটা। আমরা নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করতে পারলাম। মেকানিক্স, কেমিস্ট্রি, ইলেকট্রনিক্স আরও নানা সাবজেক্টের ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগলাম প্রাণপণ। পরীক্ষায় ভাল ফল করতেই হবে সকলকে।

তারপর পরীক্ষা এল। সকাল আর দুপুর, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একদিন দু’ দিন অন্তর ধেয়ে আসতে লাগল এক-একটা পেপার। দিনরাত এক করে আত্মস্থ করা জ্ঞান উজাড় করার চেষ্টা করলাম আমরা।

কিন্তু রুচিরের সেই সাবধানবাণীর কী হল? চন্দরদীপের রাগ, বাঙালিদের নিয়ে গ্রুপবাজির অভিযোগ। তারই বা কী হল? পরীক্ষার তলায় সেসব কি চাপা পড়ে গেল একদম?

না, তেমন ভাগ্য আমাদের নয়। কারণ তলায়-তলায় আমাদের জুনিয়র হস্টেলে একটা কথা চাউর হল যে, বালার্ক আর সরসিজের দুর্দিন আসছে। আমাদের দু’জনের ওপর নাকি যখন তখন অ্যাকশন হতে পারে। আর যা অ্যাকশন হবে তা নাকি শ্রীপুরমের র‍্যাগিংয়ের ইতিহাসে অনন্য।

প্রপাগান্ডা চিরকালই এক শক্তিশালী অস্ত্র। আর তার ঘায়ে বালার্ক না টসকালেও আমি টসকালাম। একবার বসন্তকে একবার রুচিরকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, এসব কে বলেছে ওদের? ওরা সঠিকভাবে বলতে পারল না কে বলেছে, তবে বলল যে, এটা নাকি সকলে জানে। কিন্তু চন্দরদীপ বা রণবিজয় যদি সত্যি কিছু করবে ভাবে তা হলে করছে না কেন? মেসে খাবার সময় দেখা হলেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন? না, কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি।

ম্যাথ্‌স পরীক্ষার আগের রাতে বিকাশের কাছে শুনলাম, আমায় আর বালার্ককে নাকি আলাদা-আলাদা ভাবে মারা হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে বলল তোকে?”

“সকলেই জানে। তা ছাড়া আজ মেসে শুনলাম। ম্যাওম্যাও সাবধানে থাকিস।”

“হ্যাঁ সাবধানে থাকিস তোরা, কোথা থেকে যে কী হয়ে যাবে বলা যায় না,” কল্যাণ গম্ভীর মুখে বলল।

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, অঙ্ক গুলিয়ে ইতিহাসের মতো লাগছে। এমন ‘মার খেলাম’, ‘মার খেলাম’ অবস্থা নিয়ে কি আর পরের দিন সকালে পরীক্ষা দেওয়া যায়?

বললাম, “এই কল্যাণ, সিনিয়রদের সঙ্গে দেখা করে ঝামেলা মিটিয়ে নিলে হয় না?”

“যেচে ক্যালানি খেতে যাবি?” কল্যাণ মাথা নাড়ল, “যাস না, কওশল কিন্তু ব্যাপক খচে আছে। পুরো বাঁশ দিয়ে দেবে।”

“ভাগ’”, বালার্ক অঙ্কের খাতা মুড়ে রেখে বলল, “বাঁশ দেবে, না? আমাদের বাঁশ দেবে আর আমি দাঁড়িয়ে দেখব? আমিও বাঁশ দিয়ে রেসিপ্রোকেট করব। শালা।”

কিন্তু এসব শোনার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। সলিড জিওমেট্রি, লগ আর ইন্টিগ্রেশনের ফাঁক দিয়ে কওশল আর চন্দরদীপ উঁকি মারছিল।

রাতে শোয়ার আগে বালার্ক বলল, “ফালতু চাপ নিস না, আমি আছি।”

আমি বললাম, “আছিস মানে? থাকবি আমাদের সঙ্গে?”

“না না,” বিব্রত লাগল বালার্ককে, “ফাস্ট সেম পর্যন্ত থাকব, তার বেশি নয়। বেঙ্গালুরুর কলেজ কত ভাল। মানে… হঠাৎ থাকব কেন এখানে? কী আছে ….মানে..”

“কেন? আমরা আছি। এই কলেজও ভাল। শ্রীবিদ্যা আছে। তাও থাকবি না?”

বালার্ক নিজের মাথার কাছের আলো নিভিয়ে বলল, “টেনিস ফাইনালের সকালে বাবা আর মা আসবে। ট্রান্সফারের পেপার ওয়ার্কস কমপ্লিট করতে হবে। তবে, তোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে আমার।”

“কিন্তু শ্রীবিদ্যা? ও তোকে এত পছন্দ করে, তার কোনও গুরুত্ব নেই?”

বালার্ক দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে বলল, “রাত করিস না। কাল পরীক্ষায় গন্ডগোল হবে। ঘুমিয়ে পড়। ভাল-ভাল স্বপ্ন দ্যাখ।”

ঘুম তো আমার বাবার চাকর নয় যে হুকুম করব আর চোখে এসে থাল-পিঁড়ি পেতে বসবে। বরং একদিকে কওশলের ভয় আর অন্যদিকে বালার্কর চলে যাওয়া আমার মনের মধ্যে লন টেনিস খেলতে লাগল আর বেচারা অঙ্ক-পরীক্ষা সাইড লাইনে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সেই খেলা। রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম যে, পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছে, কওশলের রুট ওভার কত! আর বাঁশকে বালার্ক দিয়ে ভাগ করলে কত হয়!

তবে স্বপ্ন স্বপ্নই আর বাস্তব হল সঞ্জয় দত্তর ছবি। এসব পেরিয়ে অঙ্ক পরীক্ষা দিলাম। রমন স্যাররের ইলেকট্রনিক্সও দিলাম। এমনকী শেষ লিখিত পরীক্ষা, মানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স, তাও দিলাম।

পরীক্ষার পর হল থেকে বেরিয়ে দেখলাম, আকাশে মেঘ করে এসেছে বেশ। দূরের ছোট-ছোট পাহাড়ের পিছন থেকে মেঘের দঙ্গল এগিয়ে আসছে ক্যাম্পাসের উপরের আকাশের দখল নেবে বলে। ভাবলাম বৃষ্টি আসার আগেই হস্টেলে ফিরতে হবে। কিন্তু বাধা পেলাম। কলেজের বারান্দা থেকে মাঠে নামার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আবিরদা। পরণে লাল শার্ট আর জিন্‌স। ভুরুটা কুঁচকে রয়েছে। আমায় দেখে বলল, “কী রে আজকাল আমায় এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন?”

“এড়িয়ে যাচ্ছি? না তো?” আমি আবার অ্যাক্টিং শুরু করলাম। আসলে কথাটা ঠিক। রুচিরের সাবধানবাণীর পর থেকে আবিরদাকে একটু এড়িয়েই থাকতে শুরু করেছি আমি। আমাদের একসঙ্গে ঘুরতে দেখে যে বাঙালি ব্রিগেডের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে সেটা ঘোচাতেই আমার এই এড়িয়ে যাওয়া। আসলে, আমার পয়েন্টটা স্পষ্ট। পড়াশোনা করতে এসেছি আমি। আমার ফোকাস তাতেই সীমাবদ্ধ। তাই যত কষ্টই হোক, আবিরদার সঙ্গে দূরত্ব রাখাই শ্রেয়।

আবিরদা বলল, “আমায় তুই কী ভাবিস? শালা, সব ভুলে গিয়েছিস? কে কী বলছে তাই নিয়ে তুই আমায় দেখলে মুখ ঘোরাচ্ছিস! কেন? কেন এমন করছিস তুই?”

আমি উত্তর দেওয়ার আগে থমকালাম। দূরে দাঁড়িয়ে চন্দরদীপ এদিকে তাকিয়ে আমাদের দেখল একবার, তারপর হেঁটে গেল হস্টেলের দিকে। সেরেছে। আবিরদার সঙ্গে আর কথা বলা যাবে না।

আমি বললাম, “আসি আবিরদা।”

“উত্তর না দিয়ে যাবি না শালা,” আবিরদা আচমকা কলারটা ধরল আমার।

“ছাড়ো, আবিরদা,” আমি সরে আসতে চাইলাম।

আবিরদা হঠাৎ ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল গালে। মারের ওজনটা এমন যে, আমি সিঁড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আবিরদা দাঁত চেপে বলল, “স্যার বল আমাকে, স্যার। আয়্যাম ইওর সিনিয়র। আবিরদা বলবি না আর, বুঝেছিস?”

আমি মাথা না তুলেও বুঝলাম মেঘের দামাল জোট এসে দখল করেছে ক্যাম্পাসের উপরের আকাশ। আবিরদা চলে গেলে আমি উঠলাম সিঁড়ি থেকে। বাঁ গালটা এমন টনটন করছে যেন অ্যাটম বোমার পরীক্ষা হয়েছে ওখানে। আর মারটা গালের চেয়ে বেশি লেগেছে বুকে। আবিরদা তো নিজেও জুনিয়র ছিল একসময়। শাঁখের করাতের প্রবলেমটা কি একটুও বোঝে না? ।

মনমরা হয়ে মাঠে পা দিতেই শুনলাম আর-একটা গলা, “মেরে বদমাশটার অ্যানাটমি চেঞ্জ করে দিলে ভাল হত।”

আমি মুখ তুললাম। দেখলাম চার-পাঁচজন মেয়ের সঙ্গে তোড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে একটু দূরে। চোখ মুখ যেন জ্বলছে। পারলে অ্যানাটমি বদলের দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।

কিন্তু অমন মেঘের নীচে আগুনের মতো রূপ দেখে আমি জমে গেলাম। হৃদ্‌পিণ্ডের দু’-চারটে ভাল্‌ভ বন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণ। মাটিতে কম্পন দেখা দিল। কলেজ বিল্ডিং টলে গেল একটু।

তোড়ি বলল, “মিটমিটে শয়তান একটা। শয়তান আর ভিতু। কেন যে আরও মারল না! ইস৷”

আমি আবার মাথা নিচু করলাম। কী হবে ঝগড়া করে? রণবিজয় যে পরিখা কেটে দিয়েছে তোড়ির চারদিকে! আর তোড়ি তো নিজেও সকলের সামনে রণবিজয়কে…ধুর। হঠাৎ বড় রাগ হল আমার। অক্ষম লাগল নিজেকে। এ কীরকম বেঁচে থাকা? সবসময় ভয়, টেনশন। তার উপর দাদার মতো আবিরদা ভুল বুঝল, যাকে পছন্দ হয় সেই তোড়ি ভুল বুঝল। কপালে মার খাওয়ার ফাঁড়া নাচছে! এ কি বেঁচে থাকা? ভাবলাম বালার্ককে বলি, “ভাই, আমাকেও তোর সঙ্গে নিয়ে চল।”

আমি তোড়ির কথার উত্তর না দিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম হস্টেলের দিকে। শুনলাম আমায় শুনিয়ে তোড়ি বলছে, “রণবিজয় হচ্ছে রিয়েল ম্যান। হাঙ্ক। আর আর-একজন হল ডরপোক। আর শুধু ডরপোক নয়, মূর্খও। একটা প্রশ্ন করেছিলাম, তার উত্তর আজও দিতে পারেনি, রাবিশ।”

মানে আস্তাকুড়ের জিনিস। মানে বাজে। মানে…আমি। মনমরাভাবে দিনটা কাটল আমার। ঘরে বসে শুনলাম বিরাট আওয়াজে বাজ পড়ছে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে বাইরে। তবু জানলা খুলে বাইরে তাকালাম না। এর মাঝে অরবিন্দ এসে আমায় চিয়ার আপ করার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না । বসন্ত এসে দু’-চারটে জোক্‌স বলল, তাও ভাল লাগল না। ময়ূখ এসে বলল, “তোর কী ইচ্ছে, পরীক্ষায় প্রশ্ন কতটা সোজা হোক?”

আমি ভাবলাম বলি, আমার ইচ্ছে তোর গলা টিপে তোকে চুপ করাই। কিন্তু কিছু বললাম না।

ময়ূখ তখন বলল, “শোন না, আজ অরবিন্দের সঙ্গে টিপ-টিপ খেলায় আমিই জিতব। দ্যাখ, এই দুটো পাথর এনেছি।”

আমি অনিচ্ছার সঙ্গে দেখলাম ময়ূখের হাতে খুব সুন্দর দুটো গোলাপি পাথর। ও বলল, “ঝরনার ওখান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। আর-একটা কথা তোকে বলার ছিল, শুনবি?”

“ওফ,” আমি আর পারলাম না, “মারব শালা, তখন থেকে বোর করছিস! ভাগ এখান থেকে। একা থাকতে দে আমায়।”

ময়ূখ তবু বলল, “একবার শুনলে পারতিস। ঝরনার ধারে পাথর কুড়োতে গিয়ে…”

আমি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে মারমুখী হয়ে বললাম, “বেরো এখনই, না হলে শালা কেলিয়ে পাট করে দেব।”

ময়ূখ ভয় পেয়ে দরজার কাছে সরে গেল। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, “শুনলে ভাল করতিস। ওখানে যা…”

“ভাগ,” আমি টেবিল থেকে স্টিলের স্কেলটা তুললাম। ময়ুখ বেরিয়ে গেল।

কিন্তু ময়ুখের কথা না শুনে যে আমি ভুল করেছি সেটা বুঝলাম দু’ দিন পর।

১৬

ওয়েল্ডিং রডটা কোনায় ফেলে লোহার টুকরোটায় আমার নাম আর রোল নম্বরের ট্যাগ লাগিয়ে স্যারের সামনে জমা দিতে না দিতেই বেল পড়ে গেল।

আমার ছোটখাটো দুর্বল চেহারায় শেষ দু’ ঘণ্টা মনে হচ্ছিল দু’ হাজার বছর। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা তো নয়, যেন ষাঁড়ের লড়াই। তিন মিলিমিটার মোটা মাইল্ড স্টিলের প্লেট হ্যাকসো দিয়ে কাটা সোজা, ফাইল ঘষে পারফেক্ট ফিটিংটা সোজা? তারপর ওয়েল্ডিং। একটু অসাবধান হয়েছ কী ওয়েল্ডিং-এর ফ্ল্যাশ লেগে চোখের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। টেমপোরারি অন্ধ করে দেবে দু’ তিনদিন।

তাই পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার পর মনে হল ক্লান্তিতে এবার অজ্ঞান হয়ে যাব আমি। দুটো হাত ব্যথা হয়ে আছে আমার। মনে হচ্ছে জ্বরটা আবার ফিরে আসছে। আসলে গতকাল রাত থেকে সামান্য জ্বর এসেছে আমার। বৃষ্টির জন্য হঠাৎ দু’-একদিন ঠান্ডা পড়ায় কেলেঙ্কারিটা হয়েছে।

“তোমার জ্বর হয়েছে? দেখি,” ওয়ার্কশপ থেকে মাঠে নামামাত্র। তোড়ি এসে দাঁড়াল সামনে। আর শুধু দাঁড়ালই না হাত বাড়িয়ে আমার কপাল ছুঁয়ে দেখতে চাইল জ্বর রয়েছে কিনা!

কিন্তু সে সুযোগ আর তোড়িকে দিলাম না আমি। তড়াক করে পিছনে সরে গিয়ে বললাম, “প্লিজ়, তোমায় আর কনসার্নড হতে হবে না!”

“মানে?” তোড়ির সুন্দর মুখটা কঠিন হয়ে উঠল নিমেষে।

“কেন জিজ্ঞেস করছ আমি কেমন আছি? কী দরকার তোমার? সকলের সামনে এমন নাটক করার মানে কী?”

“কী বলছ তুমি?” তোড়ির ভুরুর উপর আরও মেঘ জমল।

আমি দেখলাম আমার পিছনে বালার্ক, রুচির, কল্যাণ, ময়ূখ বিকাশ, বিজয়, বিশ্বদীপ সব জমা হয়ে গিয়েছে। ভিড়টা দেখে হঠাৎ আমার ভিতরের রাগটা যেন উস্‌কে উঠল আরও। বললাম, “যাও না, যাও রণবিজয়ের কাছে, চুমু খাও, গলা ধরে ঝোলো। আমার জ্বর হল না কলেরা হল, তা দেখে তোমার কী লাভ? দ্যাখো তোড়ি, তুমি যথেষ্ট যন্ত্রণা দিয়েছ আমায়, আর নাটক কোরো না।”

“নাটক? তোড়ি অবাক হল।

“নাটকই তো। কে আমি? আমি ডরপোক, আমি মূর্খ। কেন আমার কাছে এসেছ? যাও, রণবিজয়ের কাছে যাও।”

তোড়ির দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টি ছুড়ে আমি হাঁটা দিলাম। তবে বুঝলাম, ভুরুর উপর জমা মেঘ থেকে বৃষ্টি নেমেছে ওর চোখে।

খুব দিয়েছি আজ তোড়িকে। সকলের সামনে প্রাণপণ কথা শুনিয়েছি। কিন্তু এ কী, আমার তো বুকের ভার নেমে যাওয়ার কথা, তা তো হল না, বরং কষ্টটা যেন বাড়ল আরও। এই শেষ বিকেলে, দেবদারু গাছের সবুজ সারি, পাহাড়ে ঢাল আর চকিত বসন্তের হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওই দুঃখী মুখের মেয়েটাকে অপমান করে মনটা তো রাগ মেটাতে পারল না ! এত কষ্ট হচ্ছে কেন আমার? ও তো জ্বর দেখতে চেয়েছিল আমার, আমি এমন….

“গাধার মতো কাজটা করলি তো!” আমার মনের ভিতরের শূন্যস্থানটা এবার বালার্ক পূরণ করে দিল।

আমি থমকে গেলাম। ভিতরের অস্বস্তিটা প্রকাশ করলাম না। বরং উলটে বললাম, “ফালতু জ্ঞান দিবি না বালার্ক।”

“একশোবার দেব। শালা তুই একটা জানোয়ার। মেয়েটাকে কাঁদালি তো। দ্যাখ তো দাঁড়িয়ে কাঁদছে। ছিঃ ছিঃ। যেসব ছেলেরা মেয়েদের দুঃখ দিয়ে কাঁদিয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করে তারা অমানুষ হয়। বুঝেছিস? কোনও সমস্যা থাকে দাঁড়িয়ে কথা বল। ফেস কর। না, তুই চিৎকার করে পালিয়ে এলি? পালিয়ে গেলে হবে?”

“তা হলে তুই পালাচ্ছিস কেন?” আমি বালার্কর দিকে সরাসরি প্রশ্নটা ছুড়লাম।

“মানে?”

“খুব কঠিন প্রশ্ন করলাম কি? এই যে বেঙ্গালুরু যাবি এই সমুদ্রম ইনস্টিটিউট ছেড়ে, তা পালানো নয়? আগে নিজের দিকে তাকা, তারপর অন্যকে পরামর্শ দিবি।”

“ছাড় তো, ফালতু লাফড়া কিঁউ করতে হো তুমলোগ? চল, টাউনে যাওয়া যাক আজ,” রুচির এসে আমাদের দু’জনের পিঠে হাত রাখল।

“আমি যাব না,” রাগের গলায় বললাম আমি, “আমার শরীর ভাল লাগছে না।”

“শুয়ে থাকলে আরও খারাপ লাগবে শরীর। চল না,” রুচির ঠেলল আমায়।

আমি বললাম, “ঠিক আছে চল। আমার মোবাইলে টাকাও নেই আর। মাকে একটা এসটিডি করে দিই আর টিকিটও নিয়ে আসি।”

প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে আমাদের। চারদিন পর শুধু কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিক্যালটা বাকি আছে। তার পরের দিন টেনিস ফাইনাল। ফাইনালের পরের সকালে বেঙ্গালুরু ফিরব আমরা। তারপর সেখান থেকে ট্রেন ধরব।

পোস্ট অফিস মাঠের পাশে একজন ট্রাভেল এজেন্ট আছে। তার কাছেই আমরা টিকিট কাটতে দিয়েছি। গতকাল ও ফোন করেছিল হস্টেলে, টিকিট হয়ে গেছে। যদি পরে আরও জ্বর বাড়ে তাহলে আর টিকিট আনা যাবে না। আজ যত ক্লান্তিই লাগুক টিকিটটা এনে রাখলে সুবিধেই হবে।

আমি রুচিরের সঙ্গে এগোলাম। ভেবেছিলাম বালার্কও যাবে, কিন্তু আমার কাছে ঝাড় খেয়েই বোধহয় আর গেল না। অবশ্য হস্টেলেও ফিরল না, দেখলাম পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।।

সূর্য এবার গড়াতে শুরু করেছে পাহাড়ের পিছনে। অদ্ভুত সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। দূরের দেবদারু বনের থেকে শব্দ ভেসে আসছে একটা। আচ্ছা, এটাকেই কি মর্মর বলে?

পোস্ট অফিসের কাছাকাছি পৌঁছনোর পরেই গন্ডগোলটা বাধল।

“ওয়ে ম্যাওম্যাও, শালে শুন ইহা পে,” বাঁজখাই গলার আওয়াজে সারা শরীর কেঁপে উঠল আমার। রণবিজয় কওশল।

আমরা হাইওয়ে ধরে হাঁটছিলাম। তারই বাঁদিকে বিশাল বড় একটা মাঠ। সেই মাঠের এক কোনায় বড় জলের ট্যাঙ্ক। এখান থেকে সারা শ্রীপুরমে জল সরবরাহ হয়। এই বিশাল জল-ট্যাঙ্কির তলায় সিনিয়ররা আড্ডা মারে। আমরা বিশেষ যাই না ওখানে। আজ সেখান থেকেই রণবিজয় ডাক দিয়েছে আমায়।

আমি ভয়ে-ভয়ে ওইদিকে পা বাড়ালাম। রুচিরও এল আমার সঙ্গে। কিন্তু রণবিজয়ের কড়া ধমকে চার পায়ের বেশি এগোতে পারল না। ওর গলায় এমন হিংস্রতা ছিল যে, রুচির দ্রুত অ্যাবাউট টার্ন করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অর্থাৎ, এবার আমি একা!

জল-ট্যাঙ্কির পায়ের কাছের কাঁটা ঝোপ পেরিয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের সামনে। ওদের মানে রণবিজয়, গুপ্তা, চন্দরদীপ, বৈদভী, মহেশবাবু আর দু’জন লোকাল ছেলের সামনে।

“কেয়া রে, শুনলাম তুই আর তোর বন্ধু নাকি দাদা হয়ে গিয়েছিস? আমাদের নাকি আর পাত্তা দিস না? আমাদের নাকি খিস্তি দিয়েছিস?”

“অ্যাঁ? নো স্যার,” আমার পায়ের তলার মাটি কাঁপতে লাগল। এই রে, জল-ট্যাঙ্কিটা ভেঙে আমার মাথায় পড়বে না তো!

“না স্যার!” কওশল উঠে এল আমার সামনে। কাঁচা মদের গন্ধ এসে ঝাপটা মারল আমার নাকে। কওশল বলল, “ঠিক হ্যায় ছোড়। কোই বাত নহি। দাদা যখন হয়েছিস তখন ডেয়ারিংওলা কাম তো করনা পড়েগা। কিঁউ?”

এই কিঁউ-এর লক্ষ্য কিন্তু আমি নই। ট্যাঙ্কির নীচে বসা ওর পারিষদরা সমস্বরে হীরক রাজার সভাসদদের মতো বলল, “ঠিক, ঠিক।”

আমি যেন শুনলাম ‘টিক-টিক’। কোথায় যেন টাইমবোমা রাখা আছে! কওশলের হাতেই যেন তার বিস্ফোরণের সময় বাঁধা!

“চড় যা ফির। নে উঠে পড়। দেখা, দাদা হওয়ার মতো দম আছে কি না,” কওশল এমনভাবে পিঠে মারল আমায়, মনে হল, পিঠ আর বুক নিজেদের জায়গা ইন্টারচেঞ্জ করে নেবে।

আমি কাঁপা গলায় বললাম, “কোথায় উঠব?”

“চনে কে ঝাড় পে নহি। এই ট্যাঙ্কের মাথায় ওঠ। একটা কাক বৈদভীর রুমাল নিয়ে গিয়ে এই জল ট্যাঙ্কির মাথায় ফেলেছে। যা উঠে গিয়ে নিয়ে আয়।”

আমি সিঁড়িটাকে দেখলাম। কমসে কম দশতলা উঁচু ট্যাঙ্কে ওঠার জন্য যে সিঁড়িটা রয়েছে তাকে সিঁড়ি না বলে সিঁড়ির স্মৃতি বলা ভাল। জং-ধরা, নাটবল্টু খোলা আর জায়গায় জায়গায় ভাঙা। এ জল-ট্যাঙ্কে ওঠার সিঁড়ি নয়, আমার স্বর্গে ওঠার সিঁড়ি। আমি কওশলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ও সিরিয়াস। “উঠ যা। ডরতা কাহে বে? ভয় পেলে হবে? তোর রুমির সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়েছে না? ওঠ শালা,” গুপ্তা একটা ছোট ইটের টুকরো ছুড়ে মারল আমার দিকে। আঃ। চোখের নীচে লাগল ইটটা। মনে হল মাথায় বোমা পড়েছে। যন্ত্রণায় মুখ ঢেকে বসে। পড়লাম আমি।

“কী করছিস গুপ্তা?” বৈদভী দৌড়ে এল আমার দিকে, “কী ম্যাওম্যাও ব্যথা লেগেছে?”

আমি কোনওমতে তাকালাম বৈদভীর দিকে। মায়াময় মুখ। যাক, ও অন্তত… কিন্তু না। মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে হঠাৎ বৈদভী সরু-সরু আঙুল দিয়ে খিমচে ধরল আমার চুল। হিসহিসে গলায় বলল, “ওঠ, না হলে আন্ডার প্যান্ট পরিয়ে গার্লস হস্টেল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে যাব,” তারপর আচমকা লাথি মারল আমার কোমরে, “আমার পায়ে চুমু খাবি না, না? আর তোড়ির পিছনে ঘুরে বেড়াবি?”

“উঠ যা, নয় তো এমন মারব,” কওশল কলার ধরে তুলল আমায়, “বঙ্গলি ব্রিগেড, এবার দ্যাখ কী করি তোর সঙ্গে। চল।”

চোখের নীচটা ফুলে গিয়েছে আমার। তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও এগোলাম আমি। নড়বড়ে সিড়িটাকে ধরলাম। মায়ের মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। বাবার কথা মনে পড়ল। দেখলাম ট্যাঙ্কের অনেক-অনেক উপরে চক্কর মারছে চিল। আমি বললাম, “বন আপেতি,” তারপর উঠতে লাগলাম। নড়বড়ে সিঁড়ি ঝনঝন করছে। মরচে খসে পড়ছে। মনে হচ্ছে, গোটা ট্যাঙ্কটাই দুলছে যেন। যেন মাথা নেড়ে উঠতে বারণ করছে। তবু অবাধ্য ছেলের মতো উঠতে লাগলাম আমি।

“নেমে আয় সরসিজ, উঠবি না। নেমে আয়,” ফুট দশেক ওঠার পর আচমকা চিৎকার শুনলাম একটা। আমি মুখ ঘুরিয়ে দেখতে গিয়ে ব্যালেন্স হারালাম। দুর্বল শরীর সামলাতে পারল না। ধপ করে নীচের ঝোপে পড়লাম। তার ভিতরেই দেখলাম, একটা সাইকেল নিয়ে প্রাণপণে এইদিকে আসছে বালার্ক।

প্রথম মারটা খেলাম গুপ্তার থেকে। তারপর মন্দিরের ঘণ্টা পেটার মতো করে মারল চন্দরদীপ, বৈদভী, মহেশবাবু আর কওশল। বালার্ক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এ তো আর ধর্মেন্দ্রর ছবি নয়, একা হাতে গব্বরের দলকে নিকেশ করবে। ফলে বালার্কও মার ভাগ করে নিতে লাগল আমার সঙ্গে।

হাত পা দিয়ে মার ঠেকাবার চেষ্টা করতে-করতে শুনলাম ওরা বলছে, “বঙ্গালি গ্রুপবাজি করছিস? আমরা ডাকলে আগে আবিরের কাছে যাচ্ছিস! চন্দর তোদের জন্য অঙ্ক করে রাখছে আর তোরা… দ্যাখ বালার্ক, আজ তোর রুমিকে কেমন ক্যালাই। দ্যাখ…” মারের চোটে একসময় সব আবছা হয়ে এল। আমার পাশে শুয়ে বালার্কও হাঁপাচ্ছে। আমি সব বুঝতে পারছি কিন্তু রিঅ্যাক্ট করতে পারছি না।

হঠাৎ দেখলাম, একটা লোকাল ছেলে এগিয়ে এসে আমার হাতের অনামিকার থেকে পান্নার আংটিটা খোলার চেষ্টা করছে। এ তো ডাকাতি। আমি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছেলেটা বুড়ো আঙুল দিয়ে চোখের নীচের ফোলা জায়গায় চেপে ধরল। জীবন কোথা দিয়ে বেরোয় তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমি।

“ছোড় ইসে,” কওশল ছেলেটাকে আচমকা ছাড়িয়ে নিল আমার থেকে। বলল, “তোরা হাত দিবি না ওদের গায়ে। খবরদার আমাদের কলেজের ছেলেদের গায়ে হাত দিবি না।”।

“আরে সোনার আংটি আর টাকাপয়সা নিতে দে,” ছেলেটা কওশলকে ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। ফলে আচমকা কওশলকে ধাক্কা মেরে আমার ওপর ঝাঁপাতে গেল ও। কওশল প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে ছেলেটাকে ধরে থাপ্পড় মারল একটা তারপর ঘাড় ধরে ঠেলে দিয়ে বলল, “তোরা দু’জন ভাগ। না হলে শালা জানে মেরে দেব। আমাদের কলেজের ছেলেদের গায়ে খবরদার বাইরের কেউ হাত দেবে না। ভাগ।”

লোকাল ছেলে দুটো দাঁত চেপে খুব খারাপ গালি দিল একটা। বলল, “দেখে নেব শালা,” তারপর চলে গেল।

এরপর আবার কয়েক ঘা পড়ল আমাদের ওপর। সবশেষে কওশল আমার কোমরে লাথি মেরে বলল, “ধেয়ান রাখ্‌খিও, কলেজে পলিটিক্স করবি না। গ্রুপবাজি করবি না। করলে শালা হাত পা ভেঙে রেখে দেব।”

আমার শরীরে কোনও জোর নেই। মনে হচ্ছে আমার শরীরই নেই। ওদের চলে যাওয়াটুকু ঘাসের ওপর শুয়ে দেখতে-দেখতে দৃশ্য ক্রমে ঝাপসা হয়ে এল। যন্ত্রণায় গুলিয়ে উঠল গা। উপরের চিলরা কি নেমে এল নীচে? কে তুলল আমায়? এটা কার গলা?

ঘুম? আমি কোথায়? কলকাতায়? এত অন্ধকার কেন? অন্ধকার… ভবিষ্যৎ অন্ধকার.. মামা… মা…

“ম্যাওম্যাও, কষ্ট হচ্ছে?” দূর, বহুদূর থেকে ভেসে আসা গলার স্বরে চোখ মেললাম আমি। আবছা ঘরে এটা কে? আবিরদা? আমি অস্ফুটে বললাম, “স্যার, আপনি আমায় বাড়ি নিয়ে যাবেন? স্যার…”

“স্যার নয়, আবিরদা বল। আমি তোর আবিরদা। চুপ কর, কথা বলিস না।”।

কথা? আমি আবার ডুবে যাচ্ছি। তবু শেষ মুহূর্তে আবছাভাবে শুনলাম কে যেন বলছে, “আমি এতবার কথাটা বলতে চাইলাম…কিন্তু শুনল না…এখন যে…” শূন্যস্থান পূরণ করল অন্ধকার। মামার ভবিষ্যৎবাণী।

১৭

জ্বর কমে গিয়েছিল আজ সকালেই কিন্তু ক’দিন পরে প্রথম এই সন্ধের মুখে আমি হস্টেল থেকে বেরোলাম। বাঁ হাতের সামনের দিকে এখনও ব্যান্ডেজ করা। ডান পায়ের গোড়ালিতেও ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা। হালকা একটা ফোলাও আছে তবু হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না। এই দু’-তিন দিন শুয়ে-শুয়ে মেরুদণ্ডে প্রায় বটগাছ বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল, তাই সকালে জ্বর কমে যাওয়ায় আজ আর থাকতে পারিনি, বালার্ক আর আবিরদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি। কাছের পাহাড়ি নদীর ওখান থেকে ঘুরে আসব একটু।

নদী অবধি পৌঁছনোর সময়টুকুর মধ্যে এই কয়েকটা দিনের কিছু হাইলাইট্‌স তোমাদের দিয়ে দিই। প্রথম ঘটনাটা ঘটে মার খাওয়ার পরদিন সকালে। আটটা নাগাদ হঠাৎ আমার ঘরে উপস্থিত হন শিবযোগী স্যার। আমার সঙ্গে তখন বসন্ত আর অরবিন্দ ছিল।

শিবযোগী আমার এই অবস্থা দেখে বলেছিলেন, “শুনলাম তুমি ট্যাঙ্কে না কোথায় যেন উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলে?”

“না স্যার…” অরবিন্দ উঠে দাঁড়িয়েছিল।

“ইউ শাট আপ,” অরবিন্দকে চুপ করিয়ে দিয়ে আমার দিকে ফিরেছিলেন শিবযোগী, “শোনো চক্রবর্তী, তোমার সার্কাস বন্ধ করো। জল-ট্যাঙ্কে উঠতে গিয়েছিলে কেন? এর চেয়েও বিরাট কিছু হতে পারত। তখন তো মিডিয়া-ফিডিয়া এসে র‍্যাগিং হচ্ছে বলে আমাদের ইনস্টিটিউশনের বদনাম করবে। আর কখনও এসব করবে না, বুঝেছ? ভাল করে রেস্ট নাও।”

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “কিন্তু স্যার, রণবিজয় আমার এমন অবস্থা করেছে। ওর সঙ্গে গুপ্তা, মহেশবাবু আর বৈদভীও ছিল।”

“চুপ করো,” শিবযোগী দাঁত চেপে বলেছিলেন, “শোনো, কী হয়েছে তা নিয়ে একটা কথা বলবে না। রণবিজয়দের সঙ্গে আমি কথা বলে নেব। আর ওরা এমন করবে না। এতদূরে পড়তে এসেছ, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। র‍্যাগিং নিয়ে হইচই একদম নয়। এতে না কলেজ, না তোমার, কারও ভাল হবে না। শোনো, ট্যাঙ্কে আর উঠো না। যা বললাম মাথায় রেখো।”

শিবযোগী চলে যাওয়ার পর অরবিন্দ আর বসন্ত হইচই করার চেষ্টা করলেও আমি বুঝেছিলাম লাভ হবে না কোনও। এই ধরনের কলেজগুলোয় এন্ট্রান্স টেস্ট দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হলেও, অনেক স্টুডেন্ট ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভর্তি হয়। তাই র‍্যাগিং নিয়ে যদি হইচই হয়ে একটা কেচ্ছা হয় তবে লাখ-লাখ টাকার লোকসান।

এরপর প্রিন্সিপাল স্যারও আসেন আমার ঘরে। শিবযোগী স্যারের মতো রূঢ়ভাবে না হলেও ওঁর বক্তব্যও ছিল এক, অর্থাৎ চেপে যাও বাবা। তবে তার সঙ্গে কনসোলেশন গিফটের মতো ছিল একটা আশ্বাস, “ইউ ডোন্ট ওরি, কওশল, গুপ্তা অ্যান্ড আদারস উইল বি ওয়ার্নড। ওদের আর্থিক জরিমানাও করব। টেন থাউজ়্যান্ড ইচ। ডোন্ট ওরি।”

টাকা জরিমানা? তাও তো ঢুকবে কলেজের পকেটে। কিন্তু প্রিন্সিপাল নিজে এসেছেন ফার্স্ট ইয়ারের একজন সামান্য স্টুডেন্টের ঘরে। তাতেই তো স্টুডেন্টটির কৃতজ্ঞ থাকার কথা, নুয়ে পড়ার কথা! ন্যায় বিচার হল কি হল না, সেটা তো জরুরি নয়, জরুরি হল প্রিন্সিপালের উপস্থিতিকে ভগবানের উপস্থিতি মেনে নিয়ে স্টুডেন্টটিকে আপ্লুত হয়ে ভুলে থাকতে হবে সবকিছু। ফলে হাওয়া বুঝে আমি আপ্লুত হয়েছিলাম।

অরবিন্দ বলেছিল, “বালার্কও মার খেল, কিন্তু ওকে একদম কাবু করতে পারেনি ওরা। তুই এত পলকা বলেই তোর এই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু রণবিজয় এতটা ক্ষেপল কেন বল তো?”

এই উত্তরটা জানা নেই আমার। তবে চিন্তা করে যে বের করব তার সুযোগও পেলাম না। কারণ তার খানিকক্ষণ পরে আমার ঘরে যারা এসেছিল তাদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম আমি। জ্বর আর সারা শরীরে হাজার ফোঁড়ার ব্যথা নিয়েও উঠে বসেছিলাম খাটে, “তোরা?”

শ্রীবিদ্যা চশমা ঠিক করে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়েছিল, “তোড়ি।”

“তোরা এখানে কেন? ওয়ার্ডেন দেখলে বকবেন।”

“ভাগ তো। তুই কেমন আছিস? দেখে তো মনে হচ্ছে সমতলভূমিকে পিটিয়ে পার্বত্য অঞ্চল বানিয়ে দিয়েছে।”

শ্রীবিদ্যা অনেক কথা বলছিল, কিন্তু আমার ট্যান হয়ে যাচ্ছিল সব। আমি শুধু দেখছিলাম, দরজার ধারে দাঁড়ানো মেয়েটিকে। ও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আমার দিকে হালকা বাদামি চোখে ও কীসের ছায়া? দেবদারু বনের? তোড়ি আসছিল না। চলেও যাচ্ছিল না। ও শুধু দাঁড়িয়েছিল। বারান্দা দিয়ে হাওয়া এসে এলোমেলো করে দিচ্ছিল ওর চুল। হঠাৎ পাঁজরের তলাকার পাম্পটায় বড্ড ব্যথা লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল কে যেন দু’ হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ওটা। ভাবছিলাম মারের চোট কি হৃদ্‌পিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেল?

শ্রীবিদ্যা কিছু বুঝেছিল হয়তো। ও অরবিন্দ আর বসন্তকে ইশারা করে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘর থেকে। পড়েছিলাম আমি আর সেই মেয়েটা।

তোড়ি এগিয়ে এসে বসেছিল আমার পাশে। তারপর গম্ভীরভাবে বলেছিল, “রণবিজয়ের সঙ্গে গন্ডগোল না করলেই নয়? ওই উঁচু ট্যাঙ্কে না উঠলেই নয়? যদি কিছু হয়ে যেত?”

“কিন্তু আমি তো কিছু…”

আচমকা তোড়ি এসে আমার ঠোট বন্ধ করে দিয়েছিল। উঁহু, হাত দিয়ে নয়…

হালকা লবঙ্গের গন্ধ। আমার ফোলা ঠোঁটে ব্যথা লাগছিল, কিন্তু তবুও আমি সরতে পারছিলাম না। কতক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলাম আমি জানি না। একসময় তোড়ি মুখ তুলেছিল, ডান হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলেছিল, “কোনও কথা বলবে না।”

কিন্তু কথা বলব না? এতবড় একটা ঘটনা ঘটল আর আমি কথা বলব না? আমার ভিতরটা টগবগ করে ফুটছিল। একটা প্রশ্ন উপচে উঠছিল আমার মুখ দিয়ে। আমি আর সামলাতে না পেরে বলেছিলাম, “এই চুমুটা কওশলের সেই চুমুর চেয়ে ভাল ছিল?”

‘ঠাস!’ আমার টাইমিং যে খুব খারাপ সেটা আর-একবার প্রমাণিত হয়েছিল।

এখন সামান্য ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে বললাম, “আবিরদা তুমি এই সন্ধেবেলা পাহাড়ি নদীর ধারে আনলে কেন আমাদের?”

“চল না, কাজ আছে।”

“কী কাজ?” বালার্ক জিজ্ঞেস করল।

“আছে। একজন কিছু সমস্যা করছে। তার সঙ্গে হিসেব বাকি আছে। আজ সেটা মেটাতে হবে।”

“কে আবিরদা?”

“চল না, দেখতে পাবি।”

অন্ধকারে ঘোলাটে হয়ে এসেছে চরাচর। পাথর মাড়িয়ে ছুটে চলা নদীর আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আমরা ছোট-ছোট বোল্ডার পেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। নদীর ওপারের দেবদারু বন যেন অন্ধকারে আরও ঘন হয়ে উঠেছে, আর তার মাথার উপর ভেসে রয়েছে নির্জন চাঁদ। জ্যোৎস্না জেগে উঠছে ধীরে-ধীরে। আর এর নীচে, ছুটন্ত নদীর পাড়ে পাথর টপকে হাঁটছি আমরা।

“আর কতদূর আবিরদা?” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।

এবার একটু থতমত খেল আবিরদা, বলল, “এখানেই তো থাকার কথা ছিল। কিন্তু…”

“কার থাকার কথা ছিল? রণবিজয়ের?” বালার্ক চোয়াল শক্ত করল।

ও, তা হলে রণবিজয়ের সঙ্গে হিসেব বাকি আছে? আমার শরীরও শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। আজ আমরা তিনজন আর রণবিজয় যদি একা আসে?

কিন্তু কোথায় রণবিজয়? আমরা এদিক-ওদিক তাকালাম। নদীর এপাশে বড় ইউক্যালিপটাসের বন, তার পাতার মর্মর শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। “রণবিজয়, রণবিজয়,” আবিরদা ডাকতে-ডাকতে এগিয়ে গেল ইউক্যালিপটাস বনের দিকে। তারপর হঠাৎই দেখলাম আবিরদা দৌড়ে গেল বনের ভিতরে। বেগতিক দেখে বালার্কও দৌড়ল। আমি ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দৌড়নোর চেষ্টা করতে লাগলাম।

আবিরদা চিৎকার করছে খুব, বালার্কও চ্যাঁচাচ্ছে। গাছেদের মধ্যে আবছায়া অন্ধকারে চোখ সামান্য সয়ে যেতেই বুঝলাম ব্যাপারটা। সাদা টি-শার্ট পরে রণবিজয় মাটিতে আধশোয়া হয়ে আছে আর ওর সামনে সেই দু’জন লোকাল ছেলে হাতে বড় ধারালো ছোরা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আর ওদের দিকে কোমরের বেল্ট খুলে ঘোরাতে-ঘোরাতে এগিয়ে যাচ্ছে আবির মজুমদার।

“আবির তু লফরে মে মত পড়, এই রণবিজয় সেদিন জুনিয়রগুলোর সামনে আমাদের মেরেছে, গালি দিয়েছে। আজ ইসকো দিখানা হ্যায়!”

“তোরা চলে যা, রণবিজয়কে ছেড়ে চলে যা বলছি। আমরা তিনজন আছি, ওর গায়ে হাত পড়লে কিন্তু তোদের দুটোর হাত ভেঙে দেব,” আবিরদার কথা শুনে ঘাবড়ে গেলাম। তৃতীয় জন আমি নাকি?

“চোপ শালা বঙ্গালি, আজ তোদেরও…” কথা শেষ করার আগেই আচমকা বালার্ক লাফিয়ে পড়ল ওদের উপর।

তারপর মারামারি। তবে বর্ণনা আর দেব না। শুধু মিনিট পাঁচেক পর আবিরদা বলে, “চলে আয় ম্যাওম্যাও, ওরা ভেগেছে।” এতক্ষণ ভয়ে গুটিয়ে থাকা কাল্পনিক লেজ তুলে ম্যাওম্যাও চলল।

আবিরদা রণবিজয়কে জিজ্ঞেস করল, “কী কেস? এসব কী করে হল?”

রণবিজয় ক্লান্ত গলায় বলল, “তোদের জন্য ওয়েট করছিলাম। হঠাৎ এই মাল দুটো এসে…তোকে তখনই বললাম যা বলার হস্টেলে বল। এমন নির্জন জায়গা সেফ নয়।”

আবিরদা বলল, “ভেবেছিলাম কলেজ বা ওই চত্বরে বললে ইন্টারফেয়ার করবে কেউ না কেউ। তাই এখানে নিরিবিলিতে…”

“তা কী বলবি বল,” রণবিজয় এবার আমাদের দিকে তাকাল।

আবিরদা বলল, “এই দুটো ছেলেকে, বিশেষ করে ম্যাওম্যাওকে যেভাবে মারলি সেই নিয়ে কয়েকটা কথা ছিল তোর সঙ্গে।”

“কী কথা?”

“তুই ওদের মারলি কেন এভাবে? শোন, মাথা ঠান্ডা রেখে উত্তর দে।”

“এই দুটো মাল গ্রুপবাজি করছে এখানে। চন্দর ওদের হেল্প করতে চেয়েছিল, আর ওর ডাক উপেক্ষা করে ওরা গিয়েছিল তোর কাছে। পলিটিক্স করতা হ্যায় ইয়ে দো হারামখোর।”

আমি বললাম, “সেদিন চন্দরদীপ স্যারের কাছেই যাচ্ছিলাম কিন্তু কল্যাণ বলল যে, আবিরদা ডেকেছে আগে। তাই…”

আবিরদা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রণবিজয়কে বলল, “কিন্তু আমি ওদের ডাকিনি। অর্থাৎ কে মিথ্যে বলেছে? কল্যাণ। ওরা তোদের নামে হাবিজাবি কথা বলেছে সেটা তোকে কে খবর দিয়েছে? সেও কল্যাণ। ঝরনার ধারে কল্যাণ যখন তোকে ওদের নামে আজেবাজে কথা বলছিল ময়ূখ শুনে ফ্যালে। ও ম্যাওম্যাওকে বলতেও চায়, কিন্তু ছেলেটা বোকাসোকা বলে বিশেষ কেউ পাত্তা দেয়নি ওকে। এখন বুঝতে পারছিস তো গন্ডগোলটা কোথায়?”

রণবিজয় বুঝতে পারার আগে আমার মাথায় টং করে শব্দ হল। এটা হল রেগে যাওয়ার টং। জানোয়ারটা এমন করতে পারল? শ্রীবিদ্যার ওকে পাত্তা না দেওয়া, বালার্কর মার, পড়াশোনোর রেষারেষির জেরটা এভাবে মেটাল? আমাদের বাঁশ দেবে বলেই হঠাৎ রাতারাতি সাধুপুরুষ হয়ে গিয়েছিল? দাঁড়াও শয়তান, আমাদের মার খাইয়ে, ময়ুখকে মেরে… তোমার সবটাতে শয়তানি। আজ ওর একদিন কি আমার… মানে ইয়ে… আমাদের একদিন!

বালার্ক দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমার সঙ্গে যা করেছে, করেছে। কিন্তু সরসিজ তো ওকে কিছু করেনি। তা হলে ওকে এমন করল কেন? আজ এর একটা…”

শূন্যস্থান পূরণ করল রণবিজয়, “বিহিত করতেই হবে। চল জুনিয়র হস্টেলে।”

ফেরার পথে আমি শুধু আলতো করে বালার্কর কানে-কানে বললাম, ‘ক’ দিন পরে চলে যাবি, ঝঞ্ঝাটে জড়াচ্ছিস কেন?”

বালার্ক শুধু বলল, “যখন যাব তখন যাব। কিন্তু যতক্ষণ আছি ততক্ষণ লড়ে যাব শালা।”

লড়াই যে কল্যাণের বিরুদ্ধে তা বিলক্ষণ বোঝা গেল। আমার মনেও চনমনে ভাব এল একটা। তবে সত্যিকারের সাহস, না দলে ভারী হওয়ার জন্য সাহস বুঝতে পারলাম না। তবে লড়াই যে হবে তা নিশ্চিত।

হস্টেলে পৌঁছে কিন্তু আমাদের সকলের ‘কল্যাণ পেটাও’ পরিকল্পনায় জল পড়ল। কারণ অলরেডি কল্যাণের অবস্থা টাইট। বসন্ত বলল, ময়ূখ আর অরবিন্দের গোলাপি পাথরের টিপ-টিপ খেলায় ময়ূখ টিপ মিস করে কল্যাণের মাথা ফাটিয়ে বসেছে! আঃ। রাগ হল আমার। ময়ূখটা চিরকাল গুবলেট করতে ওস্তাদ। ভেবেছিলাম আমরা ওকে প্যাঁদাব, কিন্তু সেটুকু সুযোগ দিল না। তবে ঠিকই আছে। একভাবে না হয়ে অন্যভাবে শাস্তি পেয়েছে ব্যাটা। নে, এখন বোঝ !

আবিরদা রণবিজয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “কল্যাণকে ছাড়, যা হওয়ার হয়েছে।”

রণবিজয় আবিরদার কথার উত্তর না দিয়ে বালার্কর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াল। বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, আজকের জন্য। তবে…”

“তবে?” আমি অবাক হলাম।

“ম্যাচে ছাড়ব না। অন্য কলেজে চলে যাবে এমন একটা ছেলেকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেব না আমি। তোর সঙ্গে হিসেব মেটাব টেনিস কোর্টে। বুঝেছিস?”

বালার্ক শুধু বলল, “দেখা যাবে,”তারপর লাইব্রেরির দিকে চলে গেল। আমিও ঘরের দিকে এগোলাম। কাল কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা। তার আগেই এত ঘটনা! তার ওপর গত কয়েকদিন বিশেষ পড়াই হয়নি। তাই রিঅ্যাকশনগুলো একবার দেখে নিতে হবে।

কিন্তু ময়ূখ থাকলে পড়বে কার বাবার সাধ্যি! ব্যাটা আমার সামনে এসে বলল, “সরসিজ তোকে একটা কথা বলার ছিল।”

ওফ, আমি জানি ও কী বলবে। আরে, আবিরদাকে তো কল্যাণের সেই চুকলিবাজির কথা বলেইছে। আমি বললাম, “জানি তুই কী বলবি।”

“জানিস?” ময়ূখ অবাক হল।

“হ্যাঁ, জানি। তুই এখন ভাগ। পড়তে দে,” আমি হাতে স্টিলের স্কেল তুলে বললাম।

“কিন্তু তাও শোন না। তোকে না বললে…”

“ভাগ। খালি ঘ্যান-ঘ্যান, না? পড়তে দে,” আমার এবার বিরক্ত লাগল।

“কিন্তু।”

“যাবি?” আমি চোখ পাকালাম।

ময়ূখ বেরিয়ে যেতে-যেতে বলল, “শুনলে পারতিস কিন্তু।”

১৮

তারপর বেস লাইনের দেড় সেন্টিমিটার ভিতরে হলুদ টেনিস বলটা ড্রপ খেয়ে যখন সাঁ করে বেরিয়ে গেল, আমার মনে হল, পেটের ভিতরের নাগরদোলা থামল এবার। চেয়ার আম্পায়ার ঘোষণা করলেন, “গেম অ্যান্ড সেট মিস্টার বালার্ক ভদ্র। স্কোর রণবিজয় কওশল—ওয়ান, বালার্ক ভদ্র—ওয়ান।”

অর্থাৎ ফাইনাল সেট এবার যে জিতবে, সেই হবে চ্যাম্পিয়ন। আমি তো গ্যালারিতে বসেও দেখতে পাচ্ছি শ্রীবিদ্যা, বসন্ত আর অরবিন্দ চেয়ারে বসে থাকা বালার্ককে হাত পা নেড়ে জ্ঞান দিচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি রণবিজয়কে হাত নাড়িয়ে কীভাবে বল মারতে হবে তা বোঝাচ্ছে অরবিন্দার আর আবিরদা। এও যেন জুনিয়র ভার্সেস সিনিয়র! আমার খুব ইচ্ছে করছে নেমে গিয়ে ওদের মাঝে দাঁড়াই। ওদের কথা শুনি। ইচ্ছে করছে বালার্ককে গিয়ে বলি, “ভাই, ম্যাচটা খেলে চলে যাস না, থেকে যাস এখানেই। কী হবে ওখানে গিয়ে? আমাদের এই ছোট্ট টাউন খারাপ? আমরাই বা কি খারাপ?”

কিন্তু ওই তো বসে আছে কাকু, মানে বালার্কর বাবা, বসে রয়েছে ওর মা। কাকু তো বলছিল, বালার্কর ট্রান্সফারের সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে গিয়েছে। এবার শুধু ইউনিভার্সিটির কী একটা পেপার প্রিন্সিপালকে দিয়ে সই করিয়ে নিতে হবে মাত্র। তা হলেই বালার্ক মার এই ইনস্টিটিউশনের কেউ থাকবে না।

কিন্তু শ্রীবিদ্যা কি তা জানে না? বসন্ত জানে না? অরবিন্দ? ও-ও কি জানে না? তা হলে কেন এত আপনভাবে বোঝাচ্ছে ওকে? ও হারলে আমাদের কী? বেঙ্গালুরুর কলেজে গিয়ে তো ভুলেই যাবে আমাদের। কিন্তু আমরা কি ভুলতে পারব লম্বা ছিপছিপে এই ছেলেটাকে? ভুলতে পারব, সমস্ত জুনিয়রের পক্ষ থেকে এত ভয়ঙ্কর রয়ের বিরুদ্ধে ওর রুখে দাঁড়ানো? ভুলতে পারব আমায় বাঁচাবার জন্য ওর ঝাঁপিয়ে পড়া? মানতে পারব আমার পাশের খাটে বসে কেউ আর গেম্‌স খেলবে না?

ময়ূখ আমায় কনুই দিয়ে খোঁচা মারল, “এই, কে জিতবে মনে হচ্ছে বল তো?”

আমি বললাম, “যে ভাল খেলবে সেই জিতবে।”

“তোর কী ইচ্ছে?” ময়ূখ আগ্রহ নিয়ে তাকাল।

“গলা টিপে তোকে চিরতরে চুপ করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”

ময়ূখ তবু অদম্য, বলল, “শোন না, সেই কথাটা কিন্তু…”।

“কোয়াটেট প্লিজ়, থ্যাঙ্ক ইউ,” চেয়ার আম্পায়ারের ঘোষণায় জনতার গুঞ্জন থেমে গেল।

ময়ূখ চাপা গলায় বলল, “হুঃ, উইম্বলডন হচ্ছে যেন!”

“চোপ,” কোর্টের দিকে চোখ রেখে বললাম আমি।

“চলে এসো ময়ুখ। কাম, সিট নেকস্ট টু মি,” আমি মাথা না ঘুরিয়েও বুঝতে পারলাম তোড়ি দেবীর হুকুম হয়েছে।

ময়ূখ সুড়সুড় করে চলে গেল আমার পিছনের সারিতে।

তোড়ি আমার সঙ্গে কথা বলছে না সেই ঘটনার পর থেকে। এমন কী দেখা হলেও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। এই গতকালের ঘটনাই তো। কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছিল। লটারি করে পাটর্নার ঠিক করার পর দেখা গেল যে তোড়ি উঠেছে আমার ভাগ্যে। আমার, সত্যি বলতে কী, ভালই লাগছিল। তোড়ির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে ভেবে মনে- মনে গদগদ হয়ে যাচ্ছিলাম একদম। সে গুড়ে বালি বা কেমিস্ট্রির সঙ্গে মিল রেখে বলা যায়, সে অ্যাসিডে অ্যালকালি। কারণ তোড়ি আচমকা ম্যাডামকে গিয়ে বলেছিল, “ম্যাম, ওর সঙ্গে আমি কাজ করব না।”

“কেন?” ম্যাডাম অবাক হয়েছিলেন খুব।

“হি ইজ় নট ফিট।”

আমি প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম, “নো ম্যাম, আমি এখন ফিট। হাতের ব্যথা প্রায় নেই।”

তোড়ি আমার কথার উপর গলা চড়িয়ে বলেছিল, “ফিজিক্যালি নয়, মেন্টালি। ম্যাম, প্লিজ় চেঞ্জ মাই পার্টনার।”

ম্যাডাম কী বুঝেছিলেন ভগবানই জানে, কিন্তু আমার পার্টনার করে দিয়েছিলেন রুচিরকে আর ময়ূখের সঙ্গে দিয়েছিলেন তোড়িকে। এক্সপেরিমেন্ট চলাকালীন আমি কয়েকবার কাতর চোখে তাকিয়েছিলাম তোড়ির দিকে। বোঝাতে চেয়েছিলাম যে, আমি অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছি আর ভাগ্য যখন আমাদের পাটর্নার মনোনীত করেছে তখন অন্য কারও উচিত নয় তার জায়গায় আসা। কিন্তু চোখ তো আর মুখ নয়, তাই হয়তো চাহনি দিয়ে অতগুলো কথা বোঝাতে পারিনি। তবু চেষ্টার খামতি ছিল না।

পরীক্ষা শেষে ল্যাব থেকে বেরবার সময় তোড়ি ময়ূখকে বলেছিল, “জানো, হ্যাংলাদের আমি সহ্য করতে পারি না একদম।”

সেই হ্যাংলাটাই এখন একদম একা বসে রয়েছে। মাথার উপর দুপুরের রোদ ধীরে-ধীরে হেলছে বিকেলের দিকে। মাটির কোর্টে খেলা চলছে জোর। হলুদ বলের বার-বার দিক বদলের সঙ্গে-সঙ্গে সকলের মাথাও ঘুরছে। যেন সকলে একসঙ্গে কোনও ব্যাপারে অসম্মতি জানাচ্ছে।

তোড়ির কথায় বেশ খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু আচমকা হই-হই শুনে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করলাম খেলার কোর্টে! সত্যি তো কতদূর এগোল ম্যাচ? শুনলাম চারদিকে চিৎকারের মাঝে চেয়ার আম্পায়ার বলছেন, “ফোর গেমস ইচ, থার্ড অ্যান্ড ফাইনাল সেট।”

অ্যাঁ, চার-চার ড্র! মানে পরের দু’-তিনটে সেটে ফয়সালা হয়ে যাবে! আমি নড়েচড়ে বসলাম। শুনলাম, পিছন থেকে তোড়ি চিৎকার করছে, “ফাটিয়ে দে, ফাটিয়ে দে।”

আমি চুপ করে খেলায় মন দিলাম। সার্ভ করছে রণবিজয়। সাড়ে ছ’ ফুটের শরীরটা শূন্যে হলুদ বল ছুড়ে দিয়ে ধনুকের মতো বেঁকে র‍্যাকেট দিয়ে পেল্লায় থাবড়াল বলটাকে। বালার্ক নড়তে পারল না একচুলও। বলটা টেক্কা দিল ওকে। ‘এস’। ফিফটিন লাভ।।

পরের সার্ভ। আবার টেক্কা। এবার বোধহয় রুইতনের। থার্টি লাভ। এবার ইস্কাবন, ফরটি-লাভ। ময়ূখ বলল, “আম্পায়ার নো ডাকতে পারছে না?”

ময়ুখের বর্তমান সাপোর্টার তোড়িও রেগে গেল এবার, “চুপ করো ময়ূখ। এটা কি ক্রিকেট?”

চতুর্থ ‘এস’-টা ঠেকাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল বালার্ক। গেম, রণবিজয়। সারা মাঠ এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে যে, হাততালি দিতে পৌনে চার সেকেন্ড লেট হল তাদের।

রণবিজয় র‍্যাকেটটা জুততায় ঠুকে অবজ্ঞার চোখে তাকাল বালার্কর দিকে। এতদূর থেকেও হঠাৎ গা শিরশির করে উঠল আমার। মনে পড়ে গেল সেই মাঠ। সেই জল-ট্যাঙ্কির সিঁড়ি।।

বালার্কর প্রথম সার্ভিসটাই ডবল ফল্ট। লাভ-ফিফটিন। অর্থাৎ পনেরো পয়েন্ট লাভ হল রণবিজয়ের। পরের সার্ভটা কোর্টের মধ্যে পড়লেও হাফভলি হয়ে এল, রণবিজয় চকিতে পিছনে সরে গিয়ে ফোরহ্যান্ড ক্রস কোর্ট চালাল। পিছনের লাইন আম্পায়ার ‘ইন’ কল করে প্রায় চেয়ার নিয়ে পড়লেন। বলটা দু’ চুলের জন্য ওঁর কান মিস করল। লাভ-থার্টি। আমার কাঁধ ঝুলে গেল। এইবার তৃতীয় সার্ভা বালার্কর র‍্যাকেট থেকে বেরিয়ে বলটা স্পিন করে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল, রণবিজয় ফুল স্ট্রেচ করে স্লাইস করল। বলটা লোপ্পা হয়ে উঠে গেল নেটের কাছে। এ হল, “এসো আমায় ক্যালাও” টাইপের চাপ। বালার্ক পড়িমড়ি করে নেটের কাছে লোভীর মতো ছুটে এসে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে র‍্যাকেট চালাল। নেটটা ভীষণ দুলে প্রতিবাদ জানাল, “এত জোরে আমার গায়ে বল মারা চলবে না।” কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া বালার্ককে দেখে মনে পড়ে গেল, “লোভে পাপ, পাপে পয়েন্ট লস।” লাভ-ফর্টি, রণবিজয়। ব্যস, হয়ে গেল। আর এক পয়েন্ট মাত্র। সেটা পেলেই রণবিজয়ের হাতে কাপ চলে আসবে। ধুস শালা, আর দেখে কী হবে? আমি মুখ গোমড়া করে বসে রইলাম। সূর্য আরও হেলে পড়েছে। যেন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ম্যাচ দেখছে। বালার্কর লম্বা ছায়া ওর কোর্ট ছাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে আমার মনের মধ্যে। আমি মনেপ্রাণে চাই বালার্ক জিতুক। চাই, চলে যাওয়ার আগে ও নিজের হয়ে, আমাদের হয়ে সমস্ত যন্ত্রণার সমুচিত জবাব দিয়ে যাক রণবিজয়কে।

কিন্তু পারবে কি বালার্ক? ওই তো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। বাঁ হাত দিয়ে ড্রপ খাওয়াচ্ছে বলটাকে। হঠাৎ আমি একদম সামনে বসা শ্রীবিদ্যাকে দেখলাম। মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে বসে রয়েছে। সত্যিই তো, কীভাবে দেখবে বালার্কর হেরে যাওয়া?

বালার্ক এবার বলটা তুলল। হলুদ বলটা নীল আকাশের গায়ে ভাসল খানিকক্ষণ, তারপর নেমে এল আর সঙ্গে-সঙ্গে বিদ্যুৎ ছিটকোল। লাইনের ভিতরে ড্রপ খেয়ে বলটা আছড়ে পড়ল পিছনের স্ক্রিনে। রণবিজয় নড়তে পারল না। ‘এস’ ফর সাবাস! আমি উত্তেজনায় প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। পরেরটা আরও নিখুঁত এস, যেন মিকেলাঞ্জেলোর ছেনি থেকে বেরিয়েছে। থার্টি-ফর্টি। ‘কাম অন’, নর্থ গ্যালারি থেকে চিৎকার উঠল হঠাৎ। শ্রীবিদ্যা চিৎকার করল, “ইউ ক্যান মেক ইট।” ময়ূখ চিৎকার করল, “এবার ‘টি’ মার।” তা মারল বালার্ক। পরপর তিনটে এস। ডিউস থেকে সোজা গেম। সারা মাঠ উত্তেজনায় ফেটে পড়ার উপক্রম হল। চেয়ারে এসে বসা বালার্কর দিকে দৌড়ে গেল বসন্ত, অরবিন্দ আর শ্রীবিদ্যা। হাত পা নেড়ে ওরা বোঝাতে লাগল কিছু। আমারও ইচ্ছে করল যেতে। কিন্তু মনে পড়ে গেল বালার্ক বলেছিল, “তুই গ্যালারি থেকে নামবি না। চুপ করে বসে থাকবি। তা হলেই ম্যাচ জিতব আমি। তুই আমার তুক।”

আমি দেখলাম, বালার্ক হাত মুঠো করে ঝাঁকাল শুধু। আর সেই দেখেই বোধহয় আকাশে সূর্যদেব সোজা হয়ে বসলেন। রোদটা যেন বেড়ে গেল একটু। আমি বুঝলাম বিকেলটা লম্বা হতে চলেছে।

সত্যিই লম্বা হল বিকেল। পরের দুটো সেটও রণবিজয় ও বালার্ক ভাগ করে নিল। ছয়-ছয় গেমে শুরু হল টাইব্রেকার।

নিমেষে স্কোর হয়ে গেল রণবিজয়-পাঁচ, বালার্ক-পাঁচ। এর পর যে দুটো পয়েন্ট নেবে সেই চ্যাম্পিয়ন। আমার কমে আসা ব্যথাগুলো আবার টনটন করতে শুরু করল। মনে হল, বিপি বেড়ে মাথাটা ফেটে যাবে। আমি পিছনে ফিরে ময়ূখকে বললাম, “কে জিতবে বল তো?”

ময়ুখ কিছু বলার আগে তোড়ি বলল, “কোয়ায়েট।”

আমি থতমত খেলাম। বুঝলাম চেয়ার আম্পায়ারের চেয়েও একজন কড়া মানুষ এরিনায় রয়েছে।

রণবিজয়ের একটা সার্ভ হয়ে গিয়েছিল, এবার দু’নম্বর সার্ভটা করল ও। ভীষণ জোরে একগুঁয়ে বাচ্চার মতো বলটা গোঁত্তা খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বালার্ক ঠিক সময় রিটার্ন করল। হাফভলিতে বলটা লাইনের পাশে পড়ামাত্র রণবিজয় চালাল। বলটা বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গেল। কিন্তু বেস লাইনে দাঁড়ানো বালার্ক দেখল, নেটের উপরের সাদা টেপে লেগে টুপ করে পাকা আমের মতো ওর সামনে পড়ল বলটা। ছয়-পাঁচ, রণবিজয়। বালার্ক মাথা নাড়ল। ব্যাড লাক। তবে ভরসা আছে আমাদের। খাদের কিনার থেকে বার-বার নায়করা জিতে ফিরে আসে। আমার বিশ্বাস বালার্কও পারবে।

বালার্ক চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াল। হঠাৎ ইউক্যালিপটাস বনের দিক থেকে হাওয়া দিল একটা। আমি যেন স্পষ্ট নদীর শব্দ শুনলাম। জ্যোৎস্নার ভিতর যেন দেখলাম, রণবিজয়কে বাঁচাতে ছুটে যাচ্ছে বালার্ক। সার্ভিসটা করে আচমকা নেটের দিকে ছুটে গেল ও। আমি একটু অবাক হলাম, সাধারণত, বেসলাইন থেকে বালার্ক খেলে, কিন্তু হঠাৎ এভাবে কাছে ছুটে যাওয়ার মানে? রণবিজয়কে ঘাবড়ে দিতে চায় ও?

রণবিজয় ঘাবড়াল না, বলটাকে নিখুঁতভাবে লব করে দিল। হলুদ গোলক আবার আকাশে নাক ঘষে বালার্কর মাথা টপকে গিয়ে পড়ল পিছনে। বালার্ক দ্রুত টার্ন করে বেস লাইনের দিকে দৌড়ল।ওই তো একটা ড্রপ খেল বলটা। ওই তো, আর-একটা ড্রপ খাবে বলে মাটির দিকে নামছে। বালার্ক গতি বাড়াল, পায়ের প্রতিটা পেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। স্ট্রেচ করা হাতের র‍্যাকেট এগিয়ে যাচ্ছে… এগিয়ে গেল… পৌঁছে গিয়েছে… আঃ!

পিছলে মাটিতে পড়ে যাওয়া বালার্ক দেখল, হলুদ বলটা দুটো, তিনটে, চারটে ড্রপ খেয়ে গড়িয়ে গিয়ে চলে গেল লাইন জাজদের দিকে। সিনিয়র গ্যালারি থেকে হল্লা উঠল। রণবিজয় হাঁটু গেড়ে বসে হাত ছুড়ে দিল আকাশে। শ্রীবিদ্যা চশমা খুলে চোখ মুছল। তোড়ি মুখ দিয়ে যন্ত্রণার শব্দ করল। ময়ূখ বলল, “রণবিজয় কি জিতে গেল?”

আর আমি এত হট্টগোল ছাপিয়েও নদীর শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম। যেন দেখতে পেলাম পাথরের বাধা টপকেও এগোতে চাইছে সে। বুঝতে পারলাম না, জয় না লড়াই, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ!

১৯

কিন্তু কল্যাণ? কল্যাণের কী হল? এই যে গত অধ্যায় জুড়ে এত কিছু লিখলাম, কিন্তু একবারও তো কল্যাণের কথা লিখলাম না। কেন লিখলাম না কল্যাণের কথা? কারণ বয়কট। কল্যাণকে সমস্ত জুনিয়র বয়কট করেছে। কেউ পারতপক্ষে কথা বলছে না ওর সঙ্গে। ও কথা বলতে চাইলে আমরা মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। এমনভাবে তাকাচ্ছি যেন সামনে কেউ নেই। এমনকী মেসে খেতে বসলে কল্যাণের পাশ থেকে থালা নিয়ে উঠে চলে আসছি আমরা।

হস্টেল পলিটিক্সের এ এক নতুন রূপ দেখলাম আমি। যদিও খুব একটা ভাল লাগছিল না, তবু আমিও অমন ব্যবহার শুরু করলাম।

তবে ঘটনাটা ঘটল ফাইনালের পরদিন সকালে। আজ আমরা সপ্তাহ তিনেকের জন্য যে যার বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি। প্রতিটা সেমেস্টারের পর এভাবেই স্টুডেন্টরা বাড়িতে ফেরে। সকাল থেকেই তাই গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছি। এমন সময় ঘরের দরজায় কে জানি নক করল। বালার্ক ওর হ্যাভারস্যাকটা ভাল করে বাঁধতে-বাঁধতে বলল, “দরজাটা খুলে দে তো।”

দরজা খুলেই থমকে গেলাম। মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে উসকোখুসকো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কল্যাণব্রত রায়। ফরসা গালে চার পাঁচ দিনের না কাটা দাড়ি।

নিয়মমতো আমরা কথা না বলে ওর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কথা, কিন্তু বিভিন্ন রকম নিয়ম ভাঙার মতো এটাও ভাঙলাম আমি। বললাম, “কী রে তুই? প্যাকিং হয়ে গিয়েছে?”

কল্যাণের স্থির হয়ে থাকা চোখের মণিটা নড়ল একটু। জল ছাপিয়ে উঠল পাতা। তারপর গালের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নামল। ও ভেজা গলায় কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। কাঁপা হাতে আমার দু’টো হাত ধরল ও।

“কী হল রে? শরীর খারাপ?” আমি আড়চোখে দেখলাম বালার্ক এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

“সরসিজ, বালার্ক আমায়… আমায় ক্ষমা করে দে ভাই।”

বালার্ক গম্ভীর গলায় বলল, “কীসের জন্য ক্ষমা? কী করেছিস তুই?”

“আমি খুব ভুল করেছি। আসলে, বুঝতে পারিনি যে সরসিজ আর তোকে এভাবে মারবে। আয়্যাম সরি, এক্সট্রিমলি সরি।”

আমি ওর হাত ধরে এনে ওকে খাটে বসালাম, “কেন তুই এমন করলি কলু? আমাদের মার খাইয়ে কী পেলি তুই?”

“হিংসেয় আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। শ্রীবিদ্যার অমন বিহেভিয়ার আমার… একদম…” কথা গোছাতে পারছে না কল্যাণ। তবু কীসব হাবিজাবি বলছে! এক-এক করে ছেলেরা ঘরে এসে জমছে। অরবিন্দ, রুচির, বিজয়, বিকাশ, চিট্টিবাবু, বসন্ত, ময়ূখ সকলেই অবাক হয়ে দেখছে কল্যাণকে। কোথায় সেই কথার ফুলঝুরি! কোথায় ঔদ্ধত্য! কোথায় অ্যাটিটিউড! সব যেন শেষ। কল্যাণ তোতলাচ্ছে, গোছাতে পারছে না কথা। শুধু বলছে, “আমায় মার তোরা। জুতো মুখে দৌড় করা। কিন্তু কথা বল। এভাবে একঘরে করে দিস না। প্লিজ়, তোদের সকলকে বলছি। ময়ুখ তোকেও বলছি, সরি… আয়্যাম সরি। তোরা…”

সকলেই প্রশ্ন করছে ওকে। গালাগালি করছে। হইচই-এ সকলের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কল্যাণ বিড়বিড় করছে, “তোরা…প্লিজ় ফরগিভ মি। প্লিজ়…”

“তোরা চুপ কর,” হঠাৎ বালার্ক চিৎকার করে থামিয়ে দিল ওদের। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, “সরসিজ, কওশল তোকে সবচেয়ে বেশি মেরেছিল। তুই কি কল্যাণকে ক্ষমা করবি? তুই বললে সব ব্যান তুলে নেব আমরা। এবার বল।”

আমি বলব? খুব ঘাবড়ে গেলাম। আমাদের ছোট্ট ঘরে ঠেসে আসা ছাত্রদের সম্মিলিত চোখগুলো আমার দিকে জুল-জুল করে তাকিয়ে রয়েছে। সকলের এমন ভাব যেন অ্যাটমবোমা ফেলব কী ফেলব না, তা ঠিক হবে আমার হ্যাঁ বা না-এর উপর। খুব অস্বস্তি হল আমার। কল্যাণের মুখের দিকে তাকিয়ে খারাপও লাগল। কিন্তু কওশল যা করেছে আমায়, তা এককথায় অকথ্য অত্যাচার। বালার্ককে টাইট দিতে গিয়ে, ওর উপর মানসিক চাপ বাড়াতে গিয়ে আমায় মেরেছে ওরা, আর এসবের পিছনে ছিল কল্যাণ। মারের কথা চিন্তা করলে সারা শরীরে রক্ত গরম হয়ে উঠছে। কিন্তু তারপরেই মনে হল কতদিন টানব এই শত্রুতা? ও তো ভুল স্বীকার করছেই, তা হলে আর কীসের রাগ?

আমি বললাম, “কল্যাণ, তোকে ক্ষমা করলাম। কিন্তু শোন, তুই যদি ভাবিস সব এখনই আবার আগের মতো হয়ে যাবে, তা হলে ভুল ভাবছিস। তুই যা করেছিস তা জঘন্য কাজ। মনে রাখিস, জঘন্য কাজ। ক্ষমা করেছি মানেই কিন্তু ভুলে যাইনি। ভুলতে সময় লাগবে। তবে দরকারে অবশ্য সবসময় তোর পাশে আছি আমরা। এবার যা, প্যাকিং সেরে নে।”

কল্যাণ উঠল। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরোতে গিয়েও থমকাল। অপ্রত্যাশিতভাবে বলল, “বালার্ক, এ কলেজ ছেড়ে যাস না। আমি হয়তো খারাপ, কিন্তু মন থেকে বলছি, তুই চলে গেলে এই জুনিয়রদের বন্ডিংটাই ভেঙে যাবে। যাস না প্লিজ়।”

কল্যাণ চলে যাওয়ার পর, এই “যাস না প্লিজ”-টা প্রায় কোরাসে পরিণত হল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সকলেই বলল বালার্ককে থেকে যেতে। শুধু আমি বললাম না। কেন বলব? কেন বলতে হবে ওকে? বেঙ্গলুরুতে ও এমন বন্ধুদের পাবে? এমন পাহাড় পাবে? নদী পাবে? অভিমানী রেললাইন পাবে? ঝরনা পাবে? পাবে না। জানি পাবে না। তা হলে কেন থাকতে বলতে হবে ওকে? কোন নবাবপুত্তুর ও? ।

বালার্কর মা মানে কাকিমা এসে ঘরে ঢোকায় ভিড়টা ছত্রভঙ্গ হল। বালার্ক মুখ গোঁজ করে প্যাকিং করতে শুরু করল। আমি খাটে বসে পুরনো একটা ম্যাগাজ়িনের পাতা উলটোতে লাগলাম। কথাই বলব না শালা বালার্কের সঙ্গে।

“এই সরসিজ, একটা কথা শুনবি?” আমি মুখ তুলে দেখলাম দরজায় দাঁড়িয়ে ময়ূখ কাতর চোখে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

“কী কথা?” আমার বিরক্ত লাগল। আবার শুরু করেছে।

“শোন না, একটু ঘরের বাইরে শোন না,” কাতর স্বরে বলল ময়ূখ।

“ভাগ, ভাঙা রেকর্ড… শালাটা বলতে গিয়েও আটকে গেল। ঘরে কাকিমা রয়েছে যে।

“শোন না প্লিজ়,” ময়ূখ এবার যেন পা ধরবে মনে হল।

“তখন থেকে ঝঞ্জাট করছিস। বলছি শুনব না। সেদিন থেকে পিছনে…”

“যাও না, কী বলছে শোন না,” কাকিমা এবার মধ্যস্থতায় ঢুকলেন।

“প্লিজ়, খুব ইম্পরট্যান্ট কথা,” ময়ুখ শেষ চেষ্টা করল।

আমি উঠলাম। ‘ওয়ান্স অ্যান্ড ফর অল’ সব কথা শুনব আজ, ওর জীবনের যাবতীয় গোপন কথা না শুনে ছাড়বই না।

করিডোরটা এখন ফাঁকা। আমি বেরোতেই ময়ূখ হাত ধরে টেনে করিডোরের এক প্রান্তে নিয়ে গেল আমায়। আমি বললাম, “কী হয়েছে? কল্যাণের দু’ নম্বরি করার ব্যাপারটা যে তুই আবিরদাকে বলেছিস, তা তো সকলেই জানে। সেটা নিয়ে আবার হ্যাজাচ্ছিস কেন? কল্যাণের সঙ্গেও তো সব চুকেবুকে গিয়েছে। ও তো সরি-ও বলল সকলের সামনে। তা হলে ফালতু কেন আমার মাথা খাচ্ছিস? তার চেয়ে যা, প্যাকিং করে নে।”

“তোকে একটা কনফেশন করার আছে আমার,” ময়ূখের গলার স্বর হঠাৎ পালটে গেল।।

“কনফেশন?” আমি ঘাবড়ে গেলাম।

“আমি…আমি কল্যাণকে ইচ্ছে করে পাথর ছুড়ে মেরেছিলাম।”

অ্যাঁ? আমি ময়ূখের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, “তবে যে সকলে বলল খেলতে গিয়ে ভুল করে পাথরটা মিস হিট হয়ে গিয়েছে?”

“না, ওটা মিস হিট নয়। গোটা আইডিয়াটাই ছিল কল্যাণকে শায়েস্তা করার, না হলে অমন বাচ্চাদের মতো একটা খেলা খেলব কেন? সবসময় কেমন হেনস্তা করত দেখেছিস তো? আসলে জানতাম সরাসরি তো কিছু করতে পারব না। তাই খেলার ছলে সুযোগ বুঝে… একদিন না একদিন তো সুযোগ আসবেই,” ময়ুখ মাথা নিচু করল।

আমার সত্যিই নিজেকে কনফেশন বক্সের মত নির্জীব মনে হল। ময়ূখ এমনটা করেছে? সত্যিই করেছে? যদি বড়সড় কেলেঙ্কারি হয়ে যেত? তা হলে তো… আমি আর চিন্তা করতে পারলাম না।

ময়ূখ বলল, “আচ্ছা, কল্যাণ যখন ক্ষমা চাইল, আমিও কি ওর কাছে গিয়ে সত্যি বলে ক্ষমা চেয়ে নেব?”

“ক্ষমা? পাগল নাকি? তুই যা করেছিস তা ক্রিমিন্যাল অফেন্স। খবরদার এসব করবি না। সব সত্যকে প্রকাশ করতে নেই। সমাজে ব্যালান্স রাখার জন্য একটু-আধটু মুখ বন্ধ করে রাখতে হয়। শোন, আমায় যা বললি তা ভুলে যা। খবরদার কারও কাছে আর এসব বলিস না। বুঝলি?”

ময়ূখ মাথা নাড়ল। তারপর চলে যেতে-যেতে করুণ গলায় বলল, “আমিও কিন্তু খারাপই হয়ে গেলাম,না? কল্যাণ যা করেছে, আমিও তো তাই করেছি!”

না, এবার আর আমি কিছু বললাম না। সবসময় গাণ্ডীব হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ভোকাল টনিক দেওয়ার দরকার নেই। তাই, যেতে দিলাম ময়ুখকে। সকলকে নিজের নিজের সত্য নিয়ে বাঁচতে হয়। আমি ঠিক করলাম, এটা দ্রুত ভুলে যাব।

নিজের রুমে ফিরে এসে দেখলাম আবার জমায়েত হয়েছে একটা। আর সেই পুরনো কোরাস ফিরে এসেছে। অরবিন্দ বালার্কর পাশে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, “চলে গিয়ে কী হবে? এখানে যখন সব জমে উঠছে, তখন তুই খেলা ভেঙে চলে যাবি?”

বসন্ত বলল, “থেকে যা। ট্রান্সফার তো আর নেওয়া হয়নি। এখানে তো তোর সিট পাকা। আমাদের ছেড়ে যেতে তোর কষ্ট হবে না?”

রুচির বলল, “আর শ্রী….”

“বিদ্যা বলছি,” কাকিমার সামনে রুচিরকে ম্যানেজ করল অরবিন্দ, “তু রহনে সে দিল খুশ হো যায়েগা। আর আমি বেঙ্গালুরুর ছেলে, ওখানে লাইফ খুব মেকানিক্যাল। এখানে নেচারের মধ্যে থাক। আমাদের সঙ্গে থাক।”

আমি কিছু বললাম না। হাতে সেই ম্যাগাজ়িনটা তুলে ওলটাতে লাগলাম। কিন্তু না তাকিয়েও বুঝলাম বালার্ক আমায় দেখছে। ওর মধ্যে তৈরি হওয়া দ্বিধা কি এবার ডিসিশনে বদলাচ্ছে? আমি চোখ তুললাম না। সেই অভিমানী রেললাইন জেগে উঠছে আমার মধ্যে। কষ্ট হচ্ছে একটা। প্রথম রাতের সেই রাগী, উদ্ধত ছেলেটা যে এখন প্রিয় বন্ধু। বন্ধু হারানোর মতো দুঃখ কি আর কিছু আছে?

কাকিমা হঠাৎ উঠল। বলল, “তোমরা কথা বলো, আমি ফোন করে খোঁজ নিই বালার্কর বাবা হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে কি না,” কাকিমা বালার্কর মোবাইল তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঢুকল আবিরদা আর রণবিজয়।

“কা রে, ইয়ে মেলা কাহে লাগা রাখ্‌খা হ্যায়?” রণবিজয়ের হাতে একটা প্যাকেট খেয়াল করলাম এবার।

“স্যার, বালার্ক চলে যাচ্ছে…” বসন্ত অস্ফুটে বলল।

“ভাগ রাহা হ্যায় তু? শালা ডরপোক। ভাগ কে কা ফায়দা? তুই যেই হেরো সেই হেরোই থাকবি। রানার্স। মানে জানিস তো? ওয়ান হু রান্‌স অ্যাওয়ে। ক্ষমতা থাকলে এখানে থাক। পরেরবার ফাইনালে আমায় হারিয়ে দেখা। দেখব কত দম তোর। এই নে, এটা নিয়ে খেলে যদি হারাতে পারিস আমায়, বুঝব তুই পুরুষ। আর না হলে… ” রণবিজয় প্যাকেটটা বালার্ককে দিয়ে হেসে আবিরদার পিঠে চাপড় মারল, “তুই আবির শালা এইসব বঙ্গালিগুলোকে নিয়ে গল্প করিস? গ্রুপ করিস? যে ভাগে সে শালা চুহা।”

রণবিজয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আবিরদা যাওয়ার আগে বলল, “বালার্ক, রণবিজয়কে পরেরবার হারাতে পারবি না?”

পারবে? কে পারবে? পারা কাকে বলে? কী পারতে হবে?

আমি আবিরদার দিকে তাকালাম। আবিরদা আমার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, “ম্যাওম্যাও, বন্ধু পালাচ্ছে?”

ওরা চলে গেলে অরবিন্দ বালার্কর হাত থেকে কেট নিয়ে খুলল। আরিব্বাস, খুব দামি একটা গ্রাফাইট র‍্যাকেট। বালার্ক র‍্যাকেটটা দেখল একপলক তারপর দরজায় এসে দাঁড়াননা ওর মাকে বলল, “প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে?”

“ফোনে জানলাম, তোর বাবা এইমাত্র ক্যাম্পাসে এসে নেমেছে অটো থেকে। এবার যাবে।”

“চল সরসিজ,” বালার্ক হঠাৎ ভিড় ঠেলে ছিটকে বেরল।

“কোথায়?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।

অরবিন্দ, রুচির, বসন্ত আর বাকিরা ওর পিছনে যেতে-যেতে বলল, “চল না শালা।”

কাকিমার সামনে “শালা” শব্দটা ঘুরতে-ঘুরতে এসে ধাক্কা মারল আমায়। আমিও ছিটকে বেরোলাম।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে দৌড়। মাঠ ভেঙে আমরা একঝাঁক ছেলে দৌড়তে লাগলাম। আশেপাশের সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছে। এরা যাচ্ছে কোথায়? অরবিন্দ চিৎকার করল, “প্রিন্সির ঘরের দিকে,” ঝাঁক বাঁক নিল।

“ওই তো,” রুচির আঙুল তুলল। দূরে সবুজ শার্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বালার্কর বাবা। দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? তবে কি কথা হয়ে গিয়েছে? আমরা আবার স্প্রিন্ট টানলাম। আরে পাশে শ্রীবিদ্যা কী করছে? সব কেমন গোল পাকিয়ে যাচ্ছে।

বালার্কর বাবা মানে কাকুর সামনে এই রোদে এতটা দৌড়ে এসে যখন দাঁড়ালাম মনে হল, যেন ফুসফুস দুটো মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়বে। তবুও তার ভিতরেও খাবি খেতে-খেতে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকু, কথা হয়ে গিয়েছে প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে? উনি রাজি?”

“কেন? রাজির প্রশ্ন আসছে কেন?”

“কিন্তু…” বালার্ক মুখ খুলল এবার, “আমি ভাবছিলাম, কোনও কিছুই তো এখনও হয়নি। শুধু মৌখিক কথা। তাই যদি…”

“যদি কী?” কাকু ভুরু কোঁচকালেন। বালার্ক শেষ সময়ে পালটি খাওয়ার চেষ্টা করছে দেখেই বোধহয় রাগ করছেন কাকু। স্বাভাবিক, কথার খেলাপ হবে যে!

তবু এবার আমি চেষ্টা করলাম, “ও যদি ট্রান্সফার না নেয়…”

কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, “যদি মানে?”

“বাবা, এখানেই থেকে যাব ভাবছি। বেঙ্গালুরুতে দাদাভাইকে তুমি বুঝিয়ে বলো। ঠিক আছে, আমিই বুঝিয়ে বলব। প্লিজ় বাবা…”

কাকু গম্ভীর, “যদি-টদি নয়, প্রিন্সিপাল বলেছেন…” তিনি থামলেন। আমরা স্থির। পাশের দেবদারু গাছের থেকে উড়ে যাওয়া পাখিটাও ফ্রিজ় করে গেল যেন। কাকু নিচুস্বরে বলল, “টিসি উনি দেবেন না। বালার্ককে এখানেই থাকতে হবে। আর যাওয়ার চেষ্টা করলে…”

না, বাকিটা আর শোনা হল না হুল্লোড়ে। কাকু হাসছেন। ছেলের ঝাঁক চিৎকার করছে। সকলের মুখ রোদের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল, তবুও তার মাঝে দেখলাম শ্রীবিদ্যা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বালার্কর দিকে। এক-একটা দৃষ্টি এক-একটা বন্ধন। কাকু এই স্থিরচিত্রের মধ্যে একমাত্র ‘মুভি’ হয়ে বালার্কর কানের কাছে চাপা গলায় বললেন, “রেজ়াল্ট যেন খারাপ না হয়। নইলে…”

ছাত্রদের হইচই, স্থিরচিত্রে বদ্ধ দুটি মানুষ আর এই সকালের রোদভেজা দেবদারুতলা ছেড়ে এবার এগিয়ে যেতে হবে আমায়। কারণ দূরে, অনেকটা দূরে একটা ছাতিম গাছের নীচে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার কাছে পৌঁছতে হবে আমার গল্পকে।

আমি ভিড় ছেড়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। হাইওয়ের পাশে কলেজ থেকে দেওয়া বাস এসে দাঁড়াচ্ছে এবার। ছাত্রছাত্রীদের নিজের-নিজের গন্তব্যে নিয়ে যাবে তারা। আমি ট্রেন ধরার জন্য যাব বেঙ্গালুরুর দিকে আর সে যাবে মহারাষ্ট্রের পথে।

“কী চাও?” জিজ্ঞেস করল তোড়ি।

তোমাকে, ভাবলাম বলি। কিন্তু জিভ পারল না। আমি বললাম, “তোমার কাছে সরি বলতে এলাম।”

“কেন? আমি কে তোমার?”

“তুমি…তুমি?” পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন এটা। কী জবাব দেব আমি এর? কী বলব যে তোড়ি, তুমি আমারই? আমি বললাম, “সেই রণবিজয় নিয়ে প্রশ্নটার জন্য আমি সরি। ফরগিভ মি।”

“ক্ষমা করব?” তোড়ির হাওয়ায় নুয়ে আসা চুল গালের উপর থেকে সরাল।

“প্লিজ়। না হলে… না হলে… আমার ছুটিটা একদম বাজে কাটবে।”

“কেন? আমার ফরগিভনেসের কী দাম?”

অমূল্য, অমূল্য। আমার সর্বান্তকরণ চিৎকার করে বলতে চাইলেও গলা দিয়ে ফ্যাঁসফ্যাঁসে পিন ঘষে যাওয়া গ্রামোফোনের শব্দ বেরোল শুধু। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম।

“আই ক্যান ফরগিভ ইউ। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তরটা যদি সঠিক দাও তবেই মাফ করব তোমায়।”

“প্রশ্ন?”

“কোথায় স্পর্শ করলে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি এক্সাইটেড হয়? পারবে বলতে?” তোড়ি যেন সাদা দস্তানা ছুড়ে আমায় ডুয়েলে আহ্বান করল, বলল, “এত মাস হয়ে গেল এর উত্তর তুমি দিতে পারনি। আজ দাও। পারবে? ক্যান ইউ?”

আমি তোড়ির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম এবার। এত সুন্দর কেন হয় মানুষ? এত ভালই বা কেন হয়? প্রায় তিন সপ্তাহ দেখতে পাব না ওকে। এই সময়টা কী করে থাকব আমি?

“কী হল, বলো?”

আমি হাসলাম। বললাম, “হার্ট-এ। হৃদয়ে।”

তোড়ির চোখের রোদ ঠান্ডা হয়ে এল হঠাৎ। হঠাৎ মৃদু-মন্দ হাওয়া বইতে লাগল পাহাড়ের দিকে থেকে। নদীর শব্দটা আবার স্পষ্ট শুনতে পেলাম আমি। মনে হল, বহুদিন এই মুহূর্তটুকুর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

তোড়ি এগিয়ে এল আমার দিকে। ডান হাতটা তুলে আমার বুকে রাখল আলগোছে। তারপর নদীর গুঞ্জন আর পাতার মর্মর বাঁচিয়ে ফুল খসে পড়ার শব্দে বলল, “তুমি আমায় এখানে, এই হৃদয়ে স্পর্শ করেছ!”

.

আমরা সকলেই তো এখানেই স্পর্শ করতে চাই। আজ সেই ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার এত বছর পরেও সকালবেলার সেই স্পর্শটুকু এখনও লেগে রয়েছে আমার বুকে, মনে। সেই স্পর্শ, সেই নদী, সেই ঝরনা আর অভিমানী রেললাইন, সেই সুরির পাগল ভাই, সেই সন্ধের মুখে আলোয় গাঁথা পাহাড়, সেই বন্ধুত্ব, প্রেম বা প্রেম থেকে ফেরত আসার সেই পথরেখা—পালটে দিয়েছিল আমার মতো অনেক সাধারণ ছেলের জীবন। বুঝিয়েছিল ‘আমি কে তোমার?’ বুঝিয়েছিল, বেঁচে থাকার অর্থ। বন্ধুত্বের অর্থ। বুঝিয়েছিল, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একটা করে আবিরদা থাকে, বালার্ক থাকে। থাকে পাথরের বাধা টপকে এগিয়ে যাওয়া নদীর মতো আজীবনের এক বন্ধুত্বের গল্প।

(আন্টিস শপ, জল-ট্যাঙ্কি ও অভিমানী রেললাইন ছাড়া, এ গল্পের আর সমস্ত কিছু কাল্পনিক)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *