পরির বাড়ি

পরির বাড়ি

“আই অ্যাম রেডি। প্লিজ় ডোন্ট হার্ট হিম,” একটা বিশেষ নম্বরে এই মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকাল ছেলেটা।

একটু দূরেই মেন রোড। সন্ধের অন্ধকারে ছোট ছোট পুঁতির মতো আলো জ্বেলে সশব্দে চলে যাচ্ছে গাড়ির মিছিল। হাসিখুশি নিশ্চিন্ত শহরের চলমান ছবি।

কাল পালটে যাবে সব। এই শহর কাল আবার বুঝবে সন্ত্রাস কাকে বলে!

ছেলেটা ভাল করে একবার দূর থেকে নব-নির্মিত “এঞ্জেলস অ্যাবোড’- এর দিকে তাকাল। বিল্ডিং-এর পেছন দিকে খানিকটা তফাতে বেশ কিছু ঘন গাছের সারি, অন্ধকার যেন ঘাপটি মেরে রয়েছে সেখানে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। তারপর নিজের উদ্দেশে বলল, “এই সন্ত্রাসের থেকে তোমার শহরকে, তোমার দেশকে কেমন করে তুমি বাঁচাবে অদম্য সেন?”

কয়েকমাস আগে…

১৫ ফেব্রুয়ারি। কোরো, ভেনেজুয়েলা।

(ক)

কাসা দ্য লাস ভেনতানাস দ্য হিয়েরো-র সাদা লম্বা পাঁচিলের সামনে থাকা কালো সুট পরা লোকটাকে পুরনো দিনের সিনেমার থেকে উঠে আসা চরিত্র বলে মনে হল অদম্যর। লোকটা মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে। হাতের ছোট্ট ব্যাগটা একটু বেশিই যত্নের সঙ্গে ধরে রেখেছে যেন।

হাসি পেয়ে গেল অদম্যর। বুকের কাছে আঁকড়ে ধরলেই কি আর জিনিস নিজের থাকে? অনেকক্ষণ ধরে লোকটাকে ফলো করে আসছে ও। কিন্তু আর দূরে থাকার মানে হয় না। সামনে একটা গলি আসছে। ওই গলি দিয়ে ক্লাব বলিভারের দিকে এগিয়ে যাবে লোকটা। তার আগেই ধরতে হবে ওকে।

কোরো শহরটা ছোট। লোকজনও বেশি নেই। রাস্তাঘাটে ভিড় কম।

‘ওকে ওই সামনেই ধরতে হবে,’ কানে লাগানো ইয়ারফোনে লুইয়ের ফিসফিসে গলা পাওয়া গেল।

অদম্য জানে ঠিকই বলেছে লুই। ক্লাবের কাছে চলে গেলে বিপদ আছে।

ও দ্রুত পকেট থেকে একটা ছোট হুইস্কির বোতল বের করে মুখের মধ্যে ঢেলে নিল কিছুটা। হুইস্কিটা মুখের মধ্যে গিয়ে জ্বালা ধরাল। কুলকুচি করে সেটা ফেলে দিল অদম্য। তারপর বাকি হুইস্কিটা গায়ের ছেঁড়াখোড়া কোটের ওপর ছিটিয়ে নিল।

জঘন্য গন্ধ! আসলে ফ্লেভার যোগ করা হয়েছে। মদ না খেয়েও মদ্যপের মতো বমি করতে হলে তেমন গন্ধও তো চাই!

বোতলটা ফেলে দিয়ে টলতে টলতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল অদম্য। তীব্র গন্ধে সত্যি বমি আসছে ওর।

লোকটা সামনের গলিতে বাঁক নিয়ে দু’পা এগোল। আর তখনই পেছন থেকে এসে লোকটার ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ‘ওয়াক’ শব্দে বমি করে দিল অদম্য।

“শিট!” লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে সরে গেলেও বমির থেকে এড়াতে পারল না। অদম্য লোকটাকে ধরে শব্দ তুলে আরও বমি করতে লাগল।

লোকটা ছিটকে সরে যেতে গিয়েও পারল না। পেছনের ফুটপাথের কোনায় ঠোক্কর খেয়ে উলটে পড়ে গেল মাটিতে। হাতের থেকে ছিটকে গেল সুটকেসটা।

মাতালের মতো টলমল করতে করতে অদম্য লোকটার হাত ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলল, “লো সিয়েন্তো, লো সিয়েন্তো!”

লোকটা অদম্যকে অগ্রাহ্য করে উঠতে গিয়েও পারল না। অদম্য চেপে বসেছে লোকটার গায়ে।

ঠিক তখনই লুইয়ের বাইকটা পেছন থেকে এসে সামান্য গতি কমিয়ে নিচু হয়ে রাস্তা থেকে তুলে নিল সুটকেসটা। আর সেই সুযোগে অদম্যও লাফিয়ে চড়ে বসল বাইকের পেছনে। চোখের নিমেষে বাইকটা বাঁক খেয়ে বেরিয়ে গেল গলি দিয়ে।

নিরুপায় লোকটা শূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু!

(খ)

শহরের মূল অংশ ছাড়ানোর পরে বাইকের গতি কমাল লুই। এদিকটা নির্জন। সামান্য দুঃস্থও। অপরাধপ্রবণ বলেও বদনাম আছে।

পেছনে বসা অদম্যর দিকে মাথাটা সামান্য ফিরিয়ে লুই বলল, “যাক, বিপদ কাটল মনে হচ্ছে। সামনের বাঁকে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি সুটকেসটা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি। কেমন?”

অদম্য বলল, “এই জায়গাটা ভাল না। চারিদিকে ছিঁচকে চোর ডাকাতের উপদ্রব। তুমি আমায় এই জায়গাটা পার করে তারপর নামাও।”

“কিন্তু এই বইটা নিয়ে… মানে…” লুই কথাটা শেষ করার আগেই কী একটা ঘটে গেল যেন। কিছু একটা জিনিসে বাধা পেয়ে বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। লুই চাপা পড়ে গেল বাইকের তলায় আর অদম্য ছিটকে পড়ল রাস্তার ওপর।

কী হয়েছে বোঝার আগেই ওরা দেখল ছ’জন অল্প বয়সি ছেলে এসে ঘিরে ধরেছে ওদের। হাতে খুব সরু একটা তার।

দলের ভেতরের লম্বা ছেলেটা অদম্যকে বলল, “কী খোকা, জানো না এখান দিয়ে যেতে গেলে ট্যাক্স লাগে? সেটা না দিয়েই কেটে পড়ার ধান্দা!”

লুই বাইকটাকে ঠেলে সরিয়ে উঠতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা ছেলে এসে বসে পড়ল বাইকের ওপর। খিকখিক করে হেসে বলল, “আরে চোট লেগেছে তো তোমার! এমন ছটফট করতে আছে, শুয়ে থাকো বুড়ো খোকা!”

লম্বা ছেলেটা এবার একটা পিস্তল বের করে তাগ করল অদম্যর দিকে। তারপর এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা সুটকেসটা তুলে নিয়ে বলল, “চুপ করে শুয়ে থাকো। নড়লে তোমরা গেছ! বুঝলে?”

“সান অব আ…” লুই বাইকের তলায় চাপা পড়া অবস্থাতেই বলতে গেল কথাটা। কিন্তু তার আগেই একজন আচমকা এগিয়ে এসে বেসবল ব্যাট দিয়ে মারল লুইয়ের মাথায়। ভোঁতা শব্দের সঙ্গে এক ঝলক রক্ত ছিটকে পড়ল মাটিতে।

লম্বা ছেলেটা অদম্যর দিকে পিস্তল নাচিয়ে ওকে মাটিতেই শুয়ে থাকতে বলে দৌড়ে পাশের গলিতে ঢুকে গেল।

অদম্য চোয়াল শক্ত করে দেখল সুটকেস-সহ কোপারনিকাসের বইটা অদৃশ্য হয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে।

(গ)

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল অদম্য। মেঘ করে আসছে। বৃষ্টি হবে কি?

সামান্য খুঁড়িয়ে ও সামনের দিকে এগোল। লুই এখনও হাসপাতালে। অদম্যর পায়ে লেগেছে, তবে খুব একটা সাংঘাতিক নয় ওর আঘাত।

এদিকটায় মানুষজন আছে। একটা বাজার বসেছে রাস্তার ওপর। তাদের কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল অদম্য।

এখানে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। ডান দিকের অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তায় পা বাড়াল ও। সামনেই একটা পুরনো বাড়ি। শ’খানেক বছরের বেশি বয়স তো হবেই!

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল অদম্য। এই বাড়িটায় অনেক পরিবারের বাস। কেমন একটা মাছের বাজারের মতো পরিস্থিতি চারিদিকে।

দোতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল ও। তারপর একটা দরজায় সামান্য টোকা দিল।

“আদেলান্তে।”

ঘরের ভেতরে ঢুকতে বলায় অদম্য এদিক ওদিক দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে গেল।

একটা পিস্তল তাগ করে আছে ওর দিকে। লম্বা ছেলেটার চোখ স্থির। এবার ছেলেটা আচমকা হেসে উঠে পিস্তল নামিয়ে বলল, “তোমার বন্ধুর খুব বেশি লাগেনি তো?”

অদম্য হেসে একটা খাম বাড়িয়ে দিল ছেলেটার দিকে। ছেলেটা সোফার নীচের থেকে টেনে বের করে অদম্যর দিকে এগিয়ে দিল কালো রঙের সুটকেসটা।

(ঘ)

ঘরের ভেতরে চারজন লোক বসে আছে। অদম্যকে দেখে এদেল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

অদম্য এগিয়ে গিয়ে সুটকেসটা রাখল সামনের টেবিলে। এদেল সুটকেসটা খুলে দেখল। বইটা ঠিক আছে।

অদম্য বলল, “সরি এদেল, অমন করে বমি না করলে পুরো ব্যাপারটা জমত না!”

এদেল হাসল, “আমি বুঝতে পেরেছি। ইন্টারপোলের লুই বলে লোকটি কেমন আছে? চোট বেশি লাগেনি তো? আর ওই তোমাদের বাইক থেকে ফেলে দেওয়া ব্যাপারটাকে পেটি ছিনতাই বলে ধরেছে তো?”

“কিন্তু এত ড্রামার দরকার কী?” পাশের থেকে বেঁটে মতো একটা লোক বিরক্তির সঙ্গে ঘোঁৎ করে শব্দ করল একটা, “এদেল, একবার তোমার থেকে ছিনতাই! তারপর আবার ওদের থেকে ছিনতাই করে সেই মাল নানা হাত ঘুরে আমাদের হাতে আসা! কেন?”

এদেল বিরক্ত হল, “হোসে, তুই চিরকাল গোরুই রয়ে গেলি! ইন্টারপোল আমাদের পেছনে লেগেছে। এমনটা না করলে, আমি যদি সটান এখানে এই বইটা নিয়ে আসতাম ওরা বামাল সমেত আমাদের সবাইকে একসঙ্গে ধরে ফেলত। ফেরিস জানলে আমরা বাঁচতাম?”

অদম্য হাত তুলে এদেলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আমার বাকি টাকাটা ট্রান্সফার করে দিয়েছ?”

“বাকি টাকা?” হাসল এদেল, “যা দিয়েছি যথেষ্ট। একটা বই আনতে কেউ এক মিলিয়ন ইউরো চায়? লোভী ছেলে!”

অদম্য কঠিন গলায় বলল, “কথা তো এমন ছিল না! তোমরা কি ভেবেছ আমি জানি না, এই কোপারনিকাসের বইটা আসলে সিয়েরা লিয়নে তোমাদের পৌঁছে দেওয়া একটা ইললিগাল আর্মস কনসাইমেন্টের পেমেন্ট। ইন্টারপোল কি এমনই তোমাদের পেছনে লেগেছে?”

এদেলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল এবার। বলল, “আমরাও কিন্তু জানি ফিস গ্রামে একটা চার্চে অনেক ছোট বাচ্চারা থাকে। আর তাদের সঙ্গে থাকে ফাদার ফ্রান্সিস। ফেরিস বলেছে তুই বেগড়বাই করলে ওই সবকটাকে একসঙ্গে পুড়িয়ে মারবে!”

অদম্য ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল এদেলের দিকে, তারপর বলল, “কথা হয়েছিল এক মিলিয়নের। কথার খেলাপ কোরো না। মনে রাখবে আমি কিন্তু লোকসান পছন্দ করি না।”

এদেল হাসল, “তোকে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে দিচ্ছি, কনসিডার দিস অ্যাজ় ইয়োর পেমেন্ট। একা কী করবি তুই? কিচ্ছু করতে পারবি না। নাউ ফাক অফ, ইউ জোকার!”

অদম্য ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল। তারপর কানে একটা আঙুল দিয়ে বলল, “ওকে ইউ হ্যাভ হার্ড দিস লুই। কাম অন ইন।”

এদেল কিছু বোঝার আগেই, সামনের দরজাটা ছোট্ট বিস্ফোরণে ভেঙে পড়ল আর সেখান দিয়ে এস এ ৮০ অ্যাসল্ট রাইফেল উঁচিয়ে পিলপিল করে ঢুকে এল ইন্টারপোল আর বলিভারিয়ান ন্যাশনাল পোলিস।

“তুই, তুই…” থতমত এদেল কী যে বলবে যেন বুঝতে পারল না।

অদম্য পিছিয়ে যেতে যেতে ডান হাতের দুটো আঙুল বন্দুকের মতো করে এদেলের দিকে তাগ করে বলল, “ইয়েস আই অ্যাম দ্য জোকার! দ্য আউটসাইডার। তাই তোমাদের প্রচলিত নিয়মে আমাকে বাঁধতে যেয়ো না! নেভার এভার প্রেডিক্ট আ জোকার!”

সাড়ে চার মাস পর

এক

১ জুলাই। নিউ দিল্লি, ভারত।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রীঅরুণ জেটলির অফিসটা বেশ বড়। উড প্যানেল দিয়ে সবটা মোড়া। থার্ড ব্র্যাকেটের মতো সেগুন কাঠের বড় টেবিলের ওই দিকে জেটলিজি বসে আছেন। নিখুঁতভাবে কামানো গাল। মুখে সামান্য হাসি।

লেফট্যানেন্ট জেনারেল সুদীপ বকশি কী বলবেন ভেবে পেলেন না। নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর চেয়ারের পেছনের দেওয়ালে ঝোলানো গাঁধীজির উড গ্রেভিং ছবিটার দিকে তাকালেন খানিকক্ষণ। কী করে বোঝাবেন জেটলিজিকে যে, আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রয়োজন।

জেটলিজি লেফট্যান্যান্ট জেনারেলের পাশে বসা মেজর জেনারেল বিক্রম সুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিক্রম আপনি কিছু বলুন সুদীপকে। এই তো সেদিন থ্রি বিলিয়ন ডলার্সের আর্মস কেনার চুক্তি হল রাশিয়ার সঙ্গে। সেখানে আবার কী করে আমরা নতুন আর্মস কিনব? ইজ় ইট পসিব্‌ল? তাই আপনাদের সাজেস্টেড আর্মসের জন্য গ্লোবাল টেন্ডার আমরা আপাতত অন হোল্ড রাখছি।”

বকশি বললেন, “বাট স্যার, চায়না ইজ় আ গ্রেট থ্রেট! আমাদের আরও আর্মস দরকার।”

জেটলিজি মাথা নাড়লেন, “আপনি জানেন তো আমাদের একটা লিমিট আছে। এমার্জেন্সি সিচুয়েশন ছাড়া আমরা নতুন ফান্ডিং বের করতে পারব না।”

“স্যার, মে আই হাম্বলি আস্ক হোয়াই? ‘র’-এর ইন্টেল অনুযায়ী, আমাদের প্রতিবেশীরা আর্মস এস্কালেশনে নেমে পড়েছে। আমি জানি সবাই বলছে যে, আমাদের এমন অস্ত্র কেনা নাকি গোটা উপমহাদেশের পক্ষে খারাপ। বলছে আমরা যেন কিছুতেই ইজ়রায়েলের থেকে কোনও অস্ত্র না কিনি। সেই জন্য কি স্যার আপনি আমাদের সাজেস্টেড আর্মসের টেন্ডারটা পোস্টপন করলেন?”

জেটলিজি এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন, “না সুদীপ, সেসব নয়। কিন্তু এই আর্মস এস্কালেশন একটা ফিউটাইল রেস। নেভার-এন্ডিং একটা লুপ। আমাদের ডিফেন্স যথেষ্ট মজবুত। রাশিয়ান অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, টি-নাইন্টি ট্যাঙ্ক ইঞ্জিন, মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার সমেত আরও যা কেনা হচ্ছে সেটা মনে হয় এখনকার মতো যথেষ্ট।”

লেফট্যান্যান্ট জেনারেল বকশি আর মেজর জেনারেল সুদও উঠে পড়লেন। বকশি বললেন, “কিন্তু স্যার ইন্টেল ঠিক হলে আমাদের সামনে বেশ বড় কিছু অপেক্ষা করছে। তাই…”

জেটলিজি হেসে সুদীপ বকশির পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “আগে দেখি কী হয়। তেমন প্যানিকের কিছু হলে উই উইল টেক অ্যাকশন। কেমন?”

প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে সুদীপ তাকালেন বিক্রমের দিকে, “তুমি পুরো চুপ করে গেলে কেন? তুমি জানো না এই আর্মস এস্কালেশনের ব্যাপারটা? স্যারকে বললে না কেন?”

বিক্রম বললেন, “স্যার বারণ করছেন… মানে খুবই দরকার আমি জানি… কিন্তু…”

সুদীপ মাথা নেড়ে বললেন, “যদি ভুলভাল কিছু হয়ে যায় তা হলে… কিছু হওয়ার পরে আর্মসটা না কিনে যদি আগে কেনা হত… আমার চিন্তা হচ্ছে বিক্রম, খুব চিন্তা হচ্ছে।”

দুই

৫ জুলাই। পান্জ, তাজিকিস্তান।

উঁচু নিচু পাহাড়, তার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা ছিপছিপে নদী, আর মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাজিকিস্তানের ছোট্ট জনপদ, পান্জ।

নদীর পাশের এই কাঠের কটেজটায় বসে আছে ওরা। ওরা মানে, ফেরিস আর নিক্তো।

রাশিয়ার সেই কুখ্যাত ব্ল্যাক ডলফিন প্রিজ়নে থাকার সময় থেকে ফেরিসকে চেনে নিক্তো। ফেরিস নিজেও ব্ল্যাক ডলফিনে বন্দি ছিল। কিন্তু ফেরিসকে বেশিদিন সেখানে আটকে রাখা যায়নি।

পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্টর বোউট জেলে যাওয়ার পরে লিও ফেরিস সারা পৃথিবীর বেআইনি অস্ত্র বাজারের পঁচাত্তর শতাংশ দখল করে রেখেছে।

ফেরিস কেফিরের বোতলটা থেকে এক চুমুক খেয়ে সেটা রাখল সামনের টেবিলে। তারপর তাকাল নিক্তোর দিকে।

এই ঘন দুধ জাতীয় জিনিসের তৈরি কেফির ড্রিঙ্কটা ভাল লাগে না নিক্তোর। কিন্তু ফেরিস বলেছে বলে ও নিতে বাধ্য হয়েছে!

ফেরিস বলল, “তুমি বুঝেছ তো কী কাজ করতে হবে? জাস্ট দু’জন। তার বেশি নয়। আর খুব দরকার না হলে কিন্তু তাদের মারবেও না। এটা মনে থাকে যেন!’

নিক্তো বলল, “আমায় যদি অন্য কাজটা দিতেন তা হলে আরও মজা লাগত!”

ফেরিস চোয়াল শক্ত করে তাকাল নিক্তোর দিকে তারপর বলল, “আমি কিন্তু মজা করতে ব্যাবসা করি না। ভিক্টর ধরা পড়েছিল কেন জানো? কারণ, ও একদিকে ইললিগাল আর্মসের কারবার করত, আর অন্যদিকে সেটাকে ঢাকার জন্য চাটার্ড প্লেনের ব্যাবসাটা রাখত সামনে। সেই প্লেনেই নিজের অস্ত্র পাচার করত। কিন্তু তেল আর জল কি মিশ খায়? খায় না। তাই আমি অন্যভাবে কাজ করি। আমার ফ্রন্ট বিজ়নেসটা হল আইনসিদ্ধ অস্ত্র ব্যাবসার। কিন্তু তার আড়ালে আমি প্রচুর বেআইনি অস্ত্র চালান করি! বিভিন্ন দেশের সরকারকে যেমন করি তেমন আবার ইনসারজেন্ট ও টেররিস্টদেরও করি! আমার ব্যাবসার দুটোই জল। নাও এবার আলাদা করো!”

নিক্তো হাসল। কথাটা ঠিক। রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পরে গোটা ইউরেশিয়া জুড়ে অস্ত্রের কালোবাজারের রমরমা। তাই ফেরিস নিজের আইনসিদ্ধ ব্যাবসার কনসাইনমেন্টের মধ্যে চোরা বাজারের থেকে পাওয়া কম দামের আর পুরনো অস্ত্র মিশিয়ে দিয়ে নিজের মুনাফা বহুগুণ বাড়িয়ে নেয়।

ফেরিস বলল, “তোমার যেটুকু কাজ সেটুকু করবে। আর ধরা পড়ে যাওয়া কিন্তু কোনও অপশন নয়।”

নিক্তো হাসল। তারপর ভাঙা ইংরিজিতে বলল, “আমি নিক্তো। মানে জানেন তো? রাশিয়ানে নিক্তো মানে নো ওয়ান। আমি তো কেউ নই! আমাকে ধরবে কে?”

“গুড?” ফেরিস হাসল, তারপর শান্ত গলায় বললেন, “লেটস ক্রিয়েট সাম প্যানিক!”

তিন

১৮ জুলাই, কলকাতা, ভারত।

ফোনটা রেখে সামনের দিকে তাকালেন সি এম। তাঁর সামনের অর্ধবৃত্তাকার টেবলের ওপারে মেয়র তথা মন্ত্রী শ্রীশোভন চট্টোপাধ্যায়, শ্রীফিরহাদ হাকিম, শ্রীসুব্রত মুখোপাধ্যায়, শ্রীপার্থ চট্টোপাধ্যায় ও চিফ সেক্রেটারি শ্রীমলয় দে বসে রয়েছেন।

সিএম বললেন, “আর কাল সন্ধের অনুষ্ঠানের সব আয়োজন হয়ে গেছে তো? এটা কিন্তু আমাদের একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। ময়দানের এই জায়গাটায় এমন একটা সৌধ তৈরি করার জন্য সেনাবাহিনী যে আমাদের অনুমতি দিয়েছেন সেটা খুবই প্রশংসার ব্যাপার। একটা সভ্য শহরে বিউটিফিকেশন অত্যন্ত জরুরি। কালকের ওই অনুষ্ঠানের যেন কোনও ত্রুটি না হয়। বিদেশ থেকে ডেলিগেটরা আসছেন। ব্রিটেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার স্যার পিটার রায়ান বিশেষ অতিথি হিসেবে আসছেন। আমাদের সেনাবাহিনীর পদস্থ অফিসারেরা থাকবেন। দেখবেন, যেন কোনও অসুবিধে না হয় কারও।”

পার্থবাবু চশমার আড়ালে চোখ বড় বড় করে বললেন, “সব বন্দোবস্ত কমপ্লিট। এখন বৃষ্টি না হলেই হয়। এমন একটা সময়ে কাজটা শেষ হল! অবশ্য ওয়াটার প্রুফ প্যান্ডেল করা হয়েছে। তাই না ববি?”

ফিরহাদ সাহেব মাথা নাড়লেন, “সব ঠিক আছে দিদি। আমি কমিশনার সাহেবের সঙ্গেও কথা বলে নিয়েছি। সিকিউরিটির দিক থেকেও সবাই সজাগ আছে। আগের বারের মতো কোনও ঝামেলা হবে না।”

সিএম মাথা নাড়লেন। তারপর চোখ থেকে চশমাটা খুলে বললেন, “আমার তরফ থেকে আদিলকে আসতে বলে দিয়েছেন?”

সুব্রতবাবু মাথা নাড়লেন, সামান্য হেসে বললেন, “আমি নিজে ফোন করেছি। সাধারণত বছরের এই সময় ছুটি নেয় ও। তাই কলকাতাতেই আছে। ও আসবে।”

সিএম হাসলেন তারপর মলয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “যে যাই বলুক, তাও সিকিউরিটির ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু আপনি রাজীববাবুর সঙ্গে আর একবার কথা বলবেন। কোনও চান্স কিন্তু নেওয়া যাবে না। বুঝলেন?”

চার

৭ জুলাই। ফিস, অস্ট্রিয়া।

টেলিফোনের আওয়াজটা চার্চের পুরনো পাথরে ধাক্কা খেয়ে কাচের মতো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ফাদার ফ্রান্সিস নিজের ঘরে বসে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি দেখছিলেন। টেলিফোনের শব্দে ওঁর সংবিৎ ফিরল।

পাণ্ডুলিপিটা ভাঁজ করে রেখে ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন অফিস রুমের দিকে। ওইখানেই ফোনটা রাখা থাকে।

আজ চার্চ ফাঁকা। অদম্য অরফ্যানেজের বাচ্চাদের কাছের সামার ফান পার্কে নিয়ে গেছে। শুধু কয়েকজন ক্লেরিক ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক।

ফোনটা তুলে কানে লাগালেন ফ্রান্সিস, “ইয়েস।”

“ফাদার ফ্রান্সিস?”

ওপার থেকে ভেসে আসা গলাটা পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন ফ্রান্সিস। অস্ট্রিয়ান মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ারস থেকে পল ফোন করেছে।

ওই ডিপার্টমেন্টে সেক্রেটারি র‍্যাঙ্কে কাজ করে পল। “বলো পল। কী খবর?”

“ফাদার আপনার শরীর কেমন আছে?”

“ভালই! কেন?” ফ্রান্সিস সামান্য অবাক হলেন।

পল বলল, “আসলে আমি ভাবছিলাম, এই বয়সে আপনি কি প্লেন জার্নির ধকল নিতে পারবেন?”

“মানে?” ফ্রান্সিস বললেন, “তোমার সেই ঘুরিয়ে কথা বলার অভ্যেস আর গেল না!”

হা হা করে হাসল পল। তারপর বলল, “এগারো তারিখ আপনাকে কলকাতায় যেতে হবে। ওখানের একটা নন প্রফিটেব্‌ল সংস্থার সেমিনার আছে। ওরা বিশেষভাবে আপনাকে চাইছে। আপনার সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগের ব্যাপারটা ওরা জানে। তাই আমাদের সঙ্গে ওরা কথা বলেছে যাতে আমরা আপনাকে ব্যাপারটা বলি। যদি রাজি থাকেন তা হলে ওরা আজ সন্ধেবেলা আপনাকে ফর্মালি নেমন্তন্ন করবে। সব খরচ কিন্তু ওদের!”

ফ্রান্সিস ভাবলেন একবার। অদম্য জানলেই রাগ করবে। বলবে এই বয়সে অত ঝক্কি নিতে হবে না! কিন্তু কলকাতা শহরটার প্রতি একটা টান আছে ফ্রান্সিসের। উনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না অ্যাডাম বা অদম্যকে এই শহরটার থেকেই একদিন পেয়েছিলেন।

ফ্রান্সিস শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “আমি যাব।”

পাঁচ

১৩ জুলাই। কলকাতা। ভারত।

টাইটা ঠিক করে সামনের দিকে এগোল কিশোর। আজ কলকাতার আকাশ বর্ষার মেঘে টইটম্বুর হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ আকাশটাকে একটু কাত করে দিলেই ঝরঝর করে জল ঝরে পড়বে শহরটার মাথায়!

সামনে দাঁড়ানো গাড়িটা থেকে যে-লোকটা নামল তাকে রিসিভ করতেই কনস্ট্রাকশন সাইটের বড় স্ক্যাফোল্ড থেকে নেমে এসেছে কিশোর।

ওদের কোম্পানি ‘সানশাইন মেকার্স’ ময়দানে ক্যাজুয়ারিনা রোডের ওপর এই সৌধটি তৈরির অর্ডার পেয়েছে। ফ্রান্সের একটি কোম্পানির সঙ্গে কোলাবোরেশনে কাজটা করছে কিশোরদের সংস্থা।

সৌধটি আসলে গোল থামওয়ালা একটা বাড়ি। মাথার ওপর গোলাপি পাথরের ডোম আর তার চূড়ায় একটা দেড় টনের পরি বসানো।

গোটা ডিজ়াইন ফ্রান্সের কোম্পানিটি করেছে। আর ওই পরিটা যাতে সারাক্ষণ ঘোরে তার ডিজ়াইন আর মেকানিজ়মও ইনস্টল করেছে ওই কোম্পানিরই লোকজন।

আজ ফাইনাল ইনস্পেকশনে এসেছে ওদের রিপ্রেজ়েনটেটিভ।

কিশোর এগিয়ে গেল সামনে। লোকটা ভারতীয়। এই মেঘলা দিনেও চোখে সানগ্লাস। মাথার চুলটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরচুলা। মোটা গোঁফ। চট করে দেখলে তামিল ছবির চরিত্র মনে হয়!

“আমার নাম গিরিশ অপ্রমেয়।”

কিশোর হাসল। এই লোকটা প্যারিসে থাকে। লোকটার সঙ্গে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে ওর।

“প্লিজ় আসুন,” কিশোর এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

সৌধের কাজ প্রায় শেষ। এখন, ওই যাকে বলে ফিনিশিং টাচ, সেটা চলছে!

“এঞ্জেলস অ্যাবোড! পরির বাড়ি! গুড নেম,” গিরিশ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে হাসল।

“হ্যাঁ, এটাই নাম রাখা হয়েছে।” কিশোর গিরিশকে সঙ্গে নিয়ে মূল বাড়ির ভেতরের হলটায় গিয়ে দাঁড়াল।

কিশোর বলল, “আপনি একটু দাঁড়ান আমি ড্রইং নিয়ে আসছি।”

গিরিশ মাথা তুলে সিলিংটা দেখল। উলটানো বাটি যেন! ওই ওপরে দেখা যাচ্ছে, পরি যে ঘুরবে তার নীচের যন্ত্রপাতি। মোটর। গিয়ার।

হলের মাঝ বরাবর অটোম্যাটিক ল্যাডার গোটানো আছে। ওটার সুইচ টিপলে কোলাপসিব্‌ল গেটের মতো গোটানো ল্যাডারটা খুলে উঠে যায় ওপরে। ল্যাডারের মাথায় লাগানো প্ল্যাটফর্মটার যদি কেউ দাঁড়ায় সে সহজেই পৌঁছে যেতে পারে পরিটির পায়ের নীচের ওই যন্ত্রপাতির নাগালে। এখন যেমন ওখানে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে পায়ের নীচের ওই রোটারি মেকানিজ়মটার বাক্সটা বন্ধ করছে।

কিশোর দ্রুত গিয়ে বাইরে তাঁবু দিয়ে তৈরি তাদের অস্থায়ী অফিস থেকে কিছু ড্রইং শিট নিয়ে এল।

আর সেই হলটায় ঢুকে অবাক হয়ে দেখল গিরিশ কখন যেন ল্যাডারে চড়ে উঠে গেছে ওপরে। আর যন্ত্রপাতি নিয়ে নিজেই ওই রোটেটিং মেকানিজ়মের বাক্সটায় কী যেন একটা করছে। ওই ছেলেটা আর নেই!

কিশোরকে নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গিরিশ ওপর থেকে তার দক্ষিণ ভারতীয় উচ্চারণে বলল, “ফিক্সিং দ্য এঞ্জেল মাইসেলফ। না হলে অত দূর থেকে শুধু কয়েকটা ড্রইং দেখব বলে এলাম নাকি? পরি ঠিক না থাকলে পরির বাড়ি ঠিক থাকবে কেমন করে?”

ছয়

৭ জুলাই। ফিস, অস্ট্রিয়া।

“তুমি যাবে?” অদম্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, “তোমায় বললাম না এখন বেশ কিছুদিন ফিসের বাইরে যেয়ো না! তুমি কথা শুনবে না আমার?”

ফ্রান্সিস হাসলেন। অদম্যর পাশে বসে বললেন, “বড্ড বাজে চিন্তা করিস তুই, আমার কিচ্ছু হবে না। কলকাতা তো আমার ঘর রে!”

“সেই শহরটা আর নেই ফাদার!” অদম্য উঠে বসে মাথা নাড়ল।

“আমি কথা দিয়েছি!” ফ্রান্সিস স্থির গলায় বললেন।

“তোমরা সবাই এক-একজন ভীষ্ম! কথা দিয়ে যেন কেউ কথার খেলাপ করেনি কোনওদিন!” অদম্য নিজের বিরক্তিটা লুকোল না।

ফ্রান্সিস বললেন, “অমানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে তার লয়ালটি আর কথা রাখার প্রবণতা, বুঝলি।”

অদম্য বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখল। সাদা দাড়ি গোঁফ, মাথায় সাদা হয়ে যাওয়া চুল। কানে হিয়ারিং-এড। বয়স এটুকুই ছাপ ফেলেছে। কিন্তু ছ’ ফুটের ওপর লম্বা, ছিপছিপে শরীরটা এখনও সোজা। আর সোজা মেরুদণ্ডটা! সেই ছোট্টবেলা ট্রেনের সামনে থেকে যে-মানুষটা ওকে বাঁচিয়েছিলেন, ওকে সারাজীবন সন্তানের মতো পালন করেছেন তাঁকে চিনতে তো আর বাকি নেই কিছু! তাই অদম্য জানে ফাদার যা ঠিক করেছেন সেটা না করে শান্ত হবেন না।

“ঠিক আছে যাও। কিন্তু…”

ফ্রান্সিস অদম্যকে কথা বলতে না দিয়ে গলার ক্রসটা হাতে নিয়ে বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি, জিসাস ঠিক তোকে জানিয়ে দেবেন আমি কোথায় আছি।”

সাত

১৮ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

“কী রে, হল?” অজয় সামন্ত পানটা ডান গাল থেকে বাঁ গালে নিয়ে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ স্যার,” ছেলেটা হাসল।

অজয় মাথা নাড়ল। ছেলেটা ভাল। কয়েকদিন হল কাজে লেগেছে। কাল সন্ধেবেলা অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল, লাইট সব কিছু করার দায়িত্ব পেয়েছে অজয়। কলকাতার এই নতুন ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’ খুব প্রেস্টিজিয়াস প্রজেক্ট। অজয়কে বারবার করে বলা হয়েছে এতে যেন কোনও গাফিলতি না হয়। সামনের গোল বাড়িটার মাথায় ডোমের গায়ে আলো লাগানো শেষ। কাল সুইচ টিপে পরি ঘোরানো হবে! চারিপাশে মিউজ়িকের সঙ্গে লাইট জ্বলবে আর নিভবে, রং পালটাবে। মূলত আলোর এই নানান রকম খেলার জন্যই সন্ধেবেলা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে।

এই ছেলেটাকে ইলেক্ট্রিকের কাজের জন্য নেওয়া হয়েছে। মাথার ওই বড় ডোমটার গায়ে লম্বালম্বি করে আলো লাগাতে ছেলেটা উঠেছিল ওপরে। কাজ শেষ হয়ে গেছে। আলোগুলো জ্বলছে। অদ্ভুত সুন্দর দেখতে লাগছে!

অজয় বলল, “ঠিক আছে তুই আয় এখন। কাল দুপুরে চলে আসবি। সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান। তার আগে আমরা একবার সব চেক করে নেব। তারপর পেমেন্ট পেয়ে যাবি। দেরি করবি না।”

ছেলেটা মাথা নেড়ে মেন রোডের দিকে এগিয়ে গেল। অজয় একবার দেখল সেদিকে তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বিরাট বড় যে প্যান্ডেল করা হয়েছে তার ওয়াটার প্রুফিংটা ঠিক হয়েছে কিনা দেখতে হবে। ওর কাল অবধি মরার সময় নেই!

***

ছেলেটা কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে অন করল। আর সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিন জুড়ে চার ভাগে চারটে ছবি ফুটে উঠল। ডোমের মাথায় আলো লাগানোর সময় বিল্ডিংটার চার কোনায় চারটে মাইক্রো হাই রেজ়োলিউশন ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে। এই নতুন সৌধটা কেন্দ্র করে পুরো তিনশো ষাট ডিগ্রির ছবি দেখা যাবে।

ক্যামেরাগুলো ছোট। মাটি থেকে দাঁড়িয়ে দেখা যাবে না। তা ছাড়া মার্বেলের রঙের সঙ্গে মিশে আছে একদম। এ ছাড়াও বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ক্যানিস্টারও লুকিয়ে আটকে রেখেছে ওই নানান ইলেকট্রিকাল বক্সের গায়ে, বাইরের থামের গায়ে! যথা সময়ে সেগুলো কাজে লাগাবে ও।

“আই অ্যাম রেডি। প্লিজ় ডোন্ট হার্ট হিম,” একটা বিশেষ নম্বরে এই মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকাল ছেলেটা।

একটু দূরেই মেন রোড। সন্ধের অন্ধকারে ছোট ছোট পুঁতির মতো আলো জ্বেলে সশব্দে চলে যাচ্ছে গাড়ির মিছিল। হাসিখুশি নিশ্চিন্ত শহরের চলমান ছবি!

কিন্তু কাল পালটে যাবে সব। এই শহর কাল আবার বুঝবে সন্ত্রাস কাকে বলে!

ছেলেটা ভাল করে একবার দূর থেকে নব-নির্মিত ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’- এর দিকে তাকাল। বিল্ডিং-এর পেছন দিকে খানিকটা তফাতে বেশ কিছু ঘন গাছের সারি। অন্ধকার যেন ঘাপটি মেরে রয়েছে সেখানে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও। তারপর নিজের উদ্দেশে বলল, ‘এই সন্ত্রাসের থেকে তোমার শহরকে, তোমার দেশকে কেমন করে তুমি বাঁচাবে অদম্য সেন?

আট

১৮ জুলাই। ডেভনপোর্ট, নিউ জ়িল্যান্ড।

ডেভনপোর্ট শান্ত হয়ে ঢলে পড়েছে ঘুমে। শুধু জন এখনও, এই রাত তিনটের সময়ও জেগে। সামনের কমপিউটার স্ক্রিনটা একদম নিথর।

জন মাথা নাড়ল হতাশায়। তারপর স্পিকারটা মুখের কাছে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না অ্যাডাম, নো ট্রেস! ফাদারের কোনও সিগনাল নেই! তা ছাড়া তোমার দেওয়া ওই আননোন ফোন নম্বরটাও ট্রেস করা যাচ্ছে না! ওটা মিলিটারি গ্রেড এনক্রিপশন দিয়ে ক্যামোফ্লাজ করা আছে। অনেকটা ‘দি অনিয়ন নেটওয়ার্কের’ মতো।”

ফোনের ওপার থেকে অদম্য বলল, “তাও তুমি মনিটারিং বন্ধ করবে না। ফাদার একবার না একবার ভিজিবল হবেনই। তখন সেই লোকেশনটা আমার চাই! না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে জন। বিরাট সর্বনাশ হয়ে যাবে!”

নয়

১৮ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

লেকের কাছে এই ফ্ল্যাটটা নতুন। জেনি কেনেনি এটা। এক বান্ধবীর। কিন্তু সে কয়েক মাসের জন্য আমেরিকায় গেছে। তাই ফ্ল্যাটের চাবিটা দিয়ে গেছে জেনিকে।

মা খুব রাগ করছিল কেন জেনি বাড়ি ছেড়ে ওখানে গিয়ে থাকবে। কিন্তু জেনি জেদ করেছে। আরে বাবা, বাড়িতে তো যাবেই। কিন্তু এই তিন মাস না হয় একটু বাড়ির থেকে দূরে থাকলই। আর জেনি তো একা থাকছে না। কুমু থাকছে ওর সঙ্গে। দুই বান্ধবী মিলে দারুণ কাটাবে সময়টা।

জেনি এবিপি আনন্দ-এ চাকরি পেয়েছে নতুন। কাজের চাপ একটু বেড়েছে। কিন্তু ভাল লাগছে ওর।

কাল অফ ডে ওর। আজ তাই রাত করে ঘুমোলেও অসুবিধে নেই।

কুমু এখনও ফেরেনি। ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে গেছে। ছেলেটাকে চেনে জেনি। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। ভাল ছেলে। কুমুকে নিয়ে মাঝে মাঝে লং ড্রাইভে যায়। আজও গেছে। ওকে বলেছিল ওদের সঙ্গে যেতে। ও যায়নি। কাবাব মে হাড্ডি হয়ে কী লাভ!

কুমু রাগ করছিল যদিও। কিন্তু জেনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। কুমুটা পাগলি আছে। নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়!

ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। আজ হাওয়া দিচ্ছে খুব। কাচের জানালা খুলে একটু রেড ওয়াইন নিয়ে বসেছে জেনি। বাড়িতে থাকলে খেতে পারে না মন খুলে। মা খুব রাগ করে।

আজ ফোন-টোন সব বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে হালকা করে জগজিৎ সিংহ চালিয়ে বসেছে এই জানালার ধারে। গোটা পরিবেশটা স্বর্গ না হলেও স্বর্গের কাছাকাছি একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে।

“ফোনটা বন্ধ কেন?” জানালার বাইরে কার্নিশের কাছ থেকে আচমকা একটা গলা ভেসে এল।

চমকে উঠল জেনি। হাতের গ্লাসের থেকে সামান্য ওয়াইন চলকে পড়ে গেল। এত চেনা গলা! ও এখানে এল কী করে?

“ডোন্ট প্যানিক। ফোনটা অন রাখবে। বিগ থিংস মে কাম অ্যাট এনি টাইম?”

“তুমি? তু…” জেনি গ্লাসটা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে ঝুঁকতে গেল।

“প্লিজ, জায়গা থেকে নোড়ো না। শুধু মাথায় রেখো যখন বলব তখন ট্রান্সমিশন আর রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। রেকর্ডেড জিনিস ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে!”

“কেন? কোনও বিপদ আসছে?” জেনির গলা কেঁপে গেল সামান্য।

“আসছে। ইউ বি রেডি।”

জেনি সময় নিল একটু। তারপর বলল, “একটা রিকোয়েস্ট। আমি আমাদের চ্যানেলের জন্য তোমার একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ করতে চাই। আমাদের এডিটর সুমনদাকে বলব আমি। তুমি কি প্লিজ় একটা টাইম দেবে? প্লিজ়?”

কথাটা বলে জেনি চুপ করে রইল। বাইরে ঝিঁঝি ডাক, হাওয়ার শব্দ, দূরের থেকে ভেসে আসা গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছে।

“কী হল?” জেনি এবার আর থাকতে না পেরে জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিল।

জানালার নীচেই কার্নিশ। সেটা এখন ফাঁকা! কোথায় গেল ও!

জেনি এদিক ওদিক তাকাল! কোথাও কেউ নেই! লোকটা কি হাওয়া দিয়ে তৈরি!

***

নীচের বড় দেবদারু গাছটার পাতার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকাল অদম্য। জেনি জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে খুঁজছে ওকে! ওর ইন্টারভিউ নেবে! এখন কি এসবের সময়? ফাদার যে কোথায় গেলেন? এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে ফাদারকে হোটেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিন্তু তারপর আর খবর নেই! শুধু ইমেল পেয়েছিল একটা৷ তাতে বলা হয়েছিল একটা ফোন নম্বরে ফোন করতে। সেই নম্বরে ফোন করায় অদম্যকে বলা হয়েছিল, ভেনেজুয়েলার কাজের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ওকে। বলা হয়েছিল ঠিক কী করতে হবে! আর না করলে…

শূন্যস্থান পূরণ করাটা এ ব্যাপারে কঠিন নয়!

কাল উনিশ তারিখ। অদম্য চোয়াল শক্ত করল। কালকের দিনটার ওপর ফাদার-সহ আরও অনেকের অনেক কিছু নির্ভর করে আছে।

দশ

১৯ জুলাই। পান্জ, তাজিকিস্তান।

ফেরিস নিজের মনে মনে হাসল। অনেক ক্ষতি হয়েছে ওর, আর নয়। ভেনেজুয়েলার ওই ডিলটায় অস্ত্রের বদলে ওর পাওয়ার কথা ছিল অ্যান্টিক পিস একটা বই। হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে কোপারনিকাসের লেখা একটা বইয়ের ফার্স্ট এডিশনের কপি চুরি গেছে জেনেই অস্ত্রের দাম হিসেবে ওটা চেয়েছিল ও। আর পার্টি দিয়েছিল সেটা।

অদম্য বলে ছেলেটাকে নেওয়া হয়েছিল বইটার সেফ প্যাসেজের জন্য। কারণ ইন্টারপোল যে ওদের পেছনে পড়ে আছে সেটা তো জানতই। কিন্তু সেখানে ওই জানোয়ারটা যেভাবে ওকে ডাবল ক্রস করল তার ফল তো ভোগ করতেই হবে ওকে। অদম্য কি ভেবেছিল এত মাস কেটে গেছে বলে ফেরিস সব ভুলে গেছে? ফেরিস কিছু ভোলে না!

আজ রাতে ঘুম আসছে না ফেরিসের। শরীরের ভেতরে কেমন একটা পাগলা ঘোড়া দৌড়োচ্ছে!

ও হাতঘড়িতে সময় দেখল একবার, তারপর ফোনটা তুলল। একটা কল করা দরকার। সারা দেশের টনক নড়ার আগে একবার উঁকি মেরে দেখা দরকার কলকাতার সেই অনুষ্ঠানের কেমন তোড়জোড় চলছে।

এগারো

১১ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

ফাদার ফ্রান্সিস ঘড়ি দেখলেন। কলকাতায় আজ বেশ মেঘ করে আছে। ভরা বর্ষা চলছে এখন। অষ্ট্রিয়ায় সামার চললেও যা তাপমাত্রা তা এখানের শীতের মতোই প্রায়। তাই কলকাতার এই ভ্যাপসা, কম্বল চাপা গরমে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে! ভাগ্যিস গাড়িটা এসি!

এমনিতেই শরীরটা ভাল লাগছে না। প্লেনের খাবারে নিশ্চয় কিছু ছিল। শরীরটা ঝিম হয়ে আছে। গা গুলোচ্ছে। চোখ বুজে আসছে।

“ভাই এসি-টা একটু বাড়িয়ে দেবেন?” ফ্রান্সিস কথাটা বলে জামার বোতামটা এক ঘর খুলে দিলেন।

“জল খাবেন স্যার?” গাড়ির চালক সামনের সিট থেকে বাড়িয়ে দিলেন একটা জলের বোতল।

ফ্রান্সিস দেখলেন নতুন বোতল। মুখটা সিল করা। জল খাওয়া নিয়ে ওঁর সামান্য খুঁতখুঁতানি আছে। কিন্তু এই জলের বোতলটা নতুন।

চালক ছেলেটি বলল, “আপনার জন্যই রাখা স্যার। নিন।”

জলের বোতলটা নিয়ে ছিপির সিল ভেঙে গলায় ঢাললেন ফ্রান্সিস। প্রথম ঢোঁকটা খেয়েই কেমন একটা লাগল ওঁর। মনে হল দ্রুত শরীরের সমস্ত আলো নিভে আসছে। কী হল এটা! কিন্তু কী হল বোঝার আগেই বোতলটা হাতের থেকে খসে পড়ে গেল। সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলেন ফ্রান্সিস। কিন্তু পারলেন না। গাঢ় একটা অন্ধকার নিমেষে মুড়ে ফেলল ফাদার ফ্রান্সিসকে। তিনি গাড়ির পেছনের সিটে ঢলে পড়লেন।

গাড়ির চালক ছেলেটি দেখল সবটা। তারপর একটা মোবাইল বের করে নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল।

ওপারে ফোন ধরল কেউ।

চালকটি ভাঙা ইংরিজিতে বলল, “ওয়ার্ক কমপ্লিট স্যার! আই অ্যাম কামিং ফর ডেলিভারি।”

ফোনটা কেটে চলন্ত গাড়িতেই ফোনের পেছনের ঢাকনাটা খুলে সিম কার্ডটা বের করে ফেলল চালকটি। তারপর দাঁতের চাপে সেটাকে ভেঙে গাড়ির কাচ নামিয়ে ফেলে দিল রাস্তায়।

যাক, হাসল ছেলেটা। পকেটে কড়কড়ে দু’লাখ ঢুকে যাবে আজ! সোজা মন্দারমণি কেটে পড়বে!

বারো

১৯ জুলাই। কলকাতা, ভারত। এখন।

পৃথা বলেছে সকালের শো-তে আজ সিনেমায় যাবে। দীপ ঘড়ি দেখল। এই হরিশ মুখার্জি রোড থেকে হেঁটে রবীন্দ্র সদন স্টেশন থেকে মেট্রো ধরতে হবে। কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হেঁটে গেলেই লেক মল। পৃথা সেখানেই অপেক্ষা করবে। দেরি হলে খুব রেগে যায় পৃথা। আর সবচেয়ে মুশকিল হল, রেগে গেলে একদম কথা বলতে চায় না মেয়েটা। মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফোন ধরে না। মেসেজের রিপ্লাই করে না। সেই রাগ ভাঙাতে দশদিন কেটে যায়!

হরিশ মুখার্জির গুরুদ্বোয়ারার মোড় থেকে ডানদিকে বাঁক নিল দীপ। আর তখনই ফোনটা বাজল। এই সেরেছে! ফোনটা বের করে দীপ দেখল পৃথা রিং করেছে!

“হ্যাঁ বল।”

পৃথা বলল, “আমি এই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি!তুই এখনও মেট্রো ধরিসনি?”

দীপ আমতা আমতা করে কিছু বলতে গেল, কিন্তু পারল না। একটা লোক উলটো দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে ধাক্কা মারল ওকে। আর ওর হাতের মোবাইলটা ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তায়।।

“আরে, আচ্ছা পাবলিক তো!” মোবাইলটার ব্যাক কভার, ব্যাটারি সব খুলে ছড়িয়ে পড়েছে। দীপ সেগুলো কুড়ানোর জন্য রাস্তায় উবু হয়ে বসে সামনে তাকাল। দেখল, লোকটার কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই! সামনে হেঁটে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো। লোকটার পরনে ঢোলা মিলিটারি পোশাক। পিঠে ঢাউস একটা ব্যাগ।

তেরো

চিফ সেক্রেটারি শ্রীমলয় দে গাড়িতে বসেই ফোনটা পেলেন। পুলিশ কমিশনার শ্রীরাজীব কুমারের গলাটা ফোনের মধ্যেই কেমন যেন টেনস্ড শোনাল!

রাজীববাবু টেনশন করলেও খুব একটা প্রকাশ করেন না। কিন্তু আজকে সেই মানুষটাও যেন নড়ে গেছেন কোথাও।

মলয়বাবু ফোনটা কানে ধরে সবটা শুনলেন মন দিয়ে। শুনতে শুনতেই বুঝলেন একটা বিব্রত ঘামের ফোঁটা কপাল বেঁয়ে নামছে।

গতকাল সিএম ম্যাডাম বলেছিলেন অনুষ্ঠানে কোনও ঝামেলা যেন না হয় কিন্তু সেটা আর আটকানো গেল কই!

ফোনটা রাখার আগে মলয়বাবু বললেন, “আপনি প্লিজ় নবান্নে আসুন। ম্যাডামের সঙ্গে আমি কথা বলে নিচ্ছি।”

নবান্নে গাড়ি থেকে নেমে লিফটে করে সিএম-এর ঘর অবধি যেতে প্রায় দৌড়োলেন মলয়বাবু। আজ সন্ধেবেলা অনুষ্ঠান আর সকালেই এমনটা হতে হল!

মলয়বাবুকে আর ঘরে ঢুকতে হল না। সিএম নিজেই বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সামনে মলয়বাবুকে দেখতে পেয়ে বললেন, “আপনি খবর পেয়েছেন?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম,” মলয়বাবু রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “রাজীববাবু আসছেন এখানে।”

সিএম চশমাটা খুলে ভুরু কুঁচকে বললেন, “সবাইকে কনফারেন্স রুমে জড়ো হতে বলুন। আর ব্রিটিশ হাই কমিশনে খবর পাঠান! সেন্টারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে বলুন।”

“শিয়োর ম্যাডাম,” মলয়বাবু পেছন ফিরে নিজের ঘরের দিকে এগোতে গেলেন।

“শুনুন,” সিএম পেছন থেকে ডাকলেন আবার, “আদিল তো শুনলাম ছুটিতে কলকাতাতেই আছে। ওর নেমন্তন্ন তো ছিলই, এবারে ডিফেন্স মিনিস্ট্রির সঙ্গে কথা বলে ওকে ডেকে আনুন। সামনে আমাদের কঠিন সময় আসছে! সমস্ত রকম রিসোর্স আমাদের দরকার।”

চোদ্দো

১৯ জুলাই। কলকাতা, ভারত। কয়েক ঘণ্টা আগে। ভোরবেলা।

জেট ল্যাগের জন্য ভাল ঘুম হয়নি রাতে। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। তাই হাত-পায়ের আড়ষ্ট ভাব ছাড়াতে পিটার সকালে উঠেই হাঁটতে বেরিয়েছেন। একটু তফাতে দু’জন নিরাপত্তারক্ষী হাঁটছে। এভাবে রাস্তায় হাঁটতে নেমে যাওয়া হয়তো প্রোটোকল নয়, কিন্তু প্রোটোকলের ধার পিটার কোনওদিনও ধারেননি। ওঁর কেবলই মনে হয়, কোনও জায়গায় গিয়ে হেঁটে না বেড়ালে কিছুই দেখা হয় না।

কলকাতা পিটারের বিশেষ প্রিয়। ওঁর ঠাকুরদা ব্রিটিশ রাজের সময় এখানে ছিলেন। এমনকী, ওঁর এক পূর্বপুরুষ মিউটিনির সময়ে ব্যারাকপুরের সেনা ছাউনিতে পোস্টেড ছিলেন। পরে মেরঠে সিপাহিদের হাতে মারা পড়েন। তাই এই শহরটার সঙ্গে পিটারের অন্যরকম একটা সম্পর্ক আছে! কোথাও একটা শ্লাঘাও আছে যে, এই শহরটা ব্রিটিশদের হাতেই তৈরি!

গাড়ি থেকে ময়দানেই নেমেছেন পিটার। কী সুন্দর বিশাল একটা মাঠ! চারিদিকে গাছপালা। শহরের মাঝে এই মাঠটা থাকা খুব দরকার ছিল। এই মাঠেরই অন্য এক প্রান্তে আজ সন্ধেবেলা একটা অনুষ্ঠান আছে। পিটার সেখানে নিমন্ত্রিত। আর তারপর কাল চলে যাবেন দিল্লি। সেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও সেনা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ অফিসারদের সঙ্গে ভারত ও ব্রিটেনের সেনা বাহিনীর যৌথ মহড়ার তারিখ নিয়ে আলোচনা হবে।

মাঠে নেমে পিটার একটু ফ্রি হ্যান্ড করে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা একটু পিছিয়ে আছে।

একটু দূরে একটা লোক বসে আছে পিতলের বড় জার ধরনের জিনিস নিয়ে। সামনে দাঁড়ানো দু’জন মাটির ছোট কাপের মতো জিনিসে কিছু একটা খাচ্ছে। চা। এটা পিটার জানে।

আচমকা পিটারের মনে হল চা খেলে হয়।

পিটার রাস্তা থেকে মাঠের দিকে নামতে গেলেন আর ঠিক তখনই পেছনে একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন!

শব্দটার ভেতরে এমন কিছু একটা ছিল যে, রিফ্লেক্স-এ পেছনে ঘুরলেন পিটার।

দেখলেন, একটা লোক। বিদেশি। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করে রয়েছে। আর হাতে ধরা আছে একটা বেরেটা পিস্তল!

নিরাপত্তারক্ষী দু’জন বিপদ বুঝে কোমর থেকে নিজেদের পিস্তল বের করতে গেল। কিন্তু তার আগেই গাড়ির থেকে ‘টিউব, টিউব’ শব্দে গুলি চলল দু’বার। ছেলে দুটো লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। পিটার কী করবেন বোঝার আগেই গাড়িটা এসে থামল ওঁর সামনে।

পিটার পালাতে গেলেও পারলেন না। বিরাট চেহারার লোকটা পিস্তল তাগ করে গাড়ির থেকে দ্রুত নেমে এসে আচমকা একটা ইঞ্জেকশনের সুচ বিঁধিয়ে দিল পিটারের হাতে। নিমেষে পিটারের শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে এল।

লোকটা পিটারের কোমরটা ধরে অনায়াসে ঢুকিয়ে দিল গাড়ির ভেতর! তারপর সকালের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে মিলিয়ে গেল!

আশেপাশের ছড়ানো ছিটানো কয়েকজন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দেখল গুলিতে মৃত দু’জন পড়ে রয়েছে কলকাতার রাস্তায়!

পনেরো

১২ জুলাই। মুম্বই, ভারত।

বেঞ্চের থেকে উঠে এগিয়ে গেল অদম্য। গিরিশ অপ্রমেয় ওর সামনে দিয়ে হোটেলের দিকে গেল এইমাত্র।

এতক্ষণ রাস্তার পাশের এই বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিল অদম্য। ও জানত লোকটা এই সামনের হোটেলে উঠেছে। ছোট্ট হোটেল। রিসেপশনে একটা মেয়ে বসেছিল। ও তার থেকে জেনেছে গিরিশ এখনও ফেরেনি নিজের রুমে।

মনে মনে বিরক্ত হয়েছিল অদম্য। মানুষ যদি মোবাইল অফ রাখে তাকে ট্র্যাক করা খুব সমস্যার। গিরিশকে ও প্যারিস থেকে ফলো করছে। অদম্য ভেবেছিল, মুম্বইতে এসে ভাল কোনও হোটেলে উঠবে, কিন্তু এমন একটা ঘুপচি মতো জায়গায় লোকটা উঠবে ভাবতে পারেনি!

ফাদারকে ছাড়ানোর বিনিময়ে কী করতে হবে জেনে ফোনটা কেটে একটু থমকে গিয়েছিল অদম্য। তারপর দ্রুত ফাদারের নম্বরে ফোন করেছিল কিন্তু ফোন সুইচড অফ পাচ্ছিল! শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল অদম্যর। ও নিজের ট্যাবটা বের করে ট্র্যাকিং অ্যাপটা খুলেছিল। নাহ্, সেখানেও ফাদারকে পায়নি! রাগ হচ্ছিল অদম্যর। ফাদারকে পইপই করে বলেছিল বাইরে গেলে ট্র্যাকারটা অন করে রাখতে। কিন্তু মানুষটা কথা শুনবেন না কিছুতেই!

চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল অদম্যর। ও বুঝতে পারছিল সামনে আবার কঠিন কিছু আসছে! ও আর অপেক্ষা না করে দ্রুত জনকে ফোন করেছিল নিউজ়িল্যান্ডে। জনের সাহায্য সামনের দিনগুলোতে ওর কাজে লাগবে।

অদম্য জানে কাজটা বিপজ্জনক। কাজের শেষে বেঁচে বেরোবার চান্স নেই বললেই চলে! কিন্তু উপায়ও নেই! ফাদারকে বাঁচাতেই হবে।

‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’-এর কাছে যেতে হলে ওকে গিরিশের সাহায্য নিতে হবে। ও নানারকম পন্থা ভেবে দেখেছে। তারপর বুঝেছে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই!

বেঞ্চের থেকে উঠে এগিয়ে গেল অদম্য, “এক্সকিউজ় মি মিস্টার অপ্রমেয়। আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউ।”

“ফর মি!” গিরিশ অবাক হয়ে তাকাল।

অদম্য দেখল লোকটাকে। ওর মতোই হাইট। গায়ের রং চাপা। মাথায় একটা উইগ। আর চোখে এই সন্ধেবেলাতেও সানগ্লাস! অদম্য বুঝল এর মতো সাজতে অসুবিধে হবে না!

“হোয়াই?” গিরিশ আবার জিজ্ঞেস করল।

অদম্য পকেট থেকে একটা আই কার্ড বের করে বলল, “স্যার আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্টের থেকে এসেছি। আমরা আজ একটা ডিনার রেখেছি। আপনি তো আমাদের ওখানেই যাচ্ছেন। আসলে আমরা আপনার সেলে ট্রাই করছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। তাই আমায় পাঠানো হয়েছে আপনাকে নিতে?”

নকল আই কার্ডটা ঠিকমতো দেখল না গিরিশ। বলল, “কিন্তু এখানে আপনারা ডিনার দিচ্ছেন! কেন?”

অদম্য হেসে বলল, “স্যার ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আমি কী বলব! আমি স্যার আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তাই হোটেলের সামনে ওয়েট করছিলাম!”

দূরে দাঁড় করানো গাড়িটা দেখাল অদম্য।

“ওক্কে,” সামান্য টান মেশানো উচ্চারণে কথাটা বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল গিরিশ। অদম্য হাসল নিজের মনে। গিরিশ জানে না ও কয়েকদিনের জন্য বন্দি হতে যাচ্ছে! প্রথম ধাপে পেরোল! গিরিশ সেজে এবার ও পৌঁছবে কলকাতায়! তারপর দেখা যাক!

ষোলো

১৯ জুলাই। নবান্ন, হাওড়া, ভারত।

সাদা ডিম্বাকৃতি টেবল ঘিরে কালো রিভলভিং চেয়ারগুলো সাজানো আছে। মাথার ওপরে এল ই ডি লাইটগুলো জ্বলছে। আদিল ঘরে ঢুকেই বুঝল পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো। সবার মুখ থমথমে।

“আদিল,” সিএম একটা চেয়ার দেখালেন।

আদিল সামান্য ইতস্তত করে বসল।

সিএম বললেন, “তোমায় ডেকে পাঠানো হয়েছে কেন শুনেছ তো?”

“না ম্যাডাম, আসলে আমি ঘুমিয়েছিলাম যখন ফোন করা হয়েছিল আমায়। আমি জাস্ট ফ্রেশ হয়েই চলে এসেছি।”

সিএম মলয়বাবুর দিকে তাকালেন।

মলয়বাবু সামনে রাখা গ্লাসের থেকে জল খেয়ে সময় নিলেন একটু। তারপর বললেন, “আজ সকালে একটা ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার স্যার পিটার রায়ান ময়দানের কাছ থেকে কিডন্যাপড হয়েছেন।”

“সে কী?” আদিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

পুলিশ কমিশনার শ্রীরাজীব কুমার বললেন, “হ্যাঁ। তাঁর দু’জন নিরাপত্তারক্ষীকে গুলি করা হয়েছে। মাথায় গুলি লেগেছে দু’জনের। একদম কিল শট!ক্রাইম সিনে আমাদের লোক গেছে। গাড়ির টায়ারের ড্র্যাগ মার্ক ছাড়া পাওয়া গেছে দুটো বুলেটের স্লাগ! সেগুলো ফরেনসিকে পাঠানো হয়েছে।”

“কোনও আই উইটনেস?”

“রাস্তায় লোক কম ছিল। সকাল তো। পাসিং ভিইকেল্‌স… ওই ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়াগুলোকে মাঠে চরাতে আসা কিছু ছেলে ছিল। আর একটা চা- ওয়ালা ছিল। সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। মোটামুটি যা জানা গেছে তা হল, একজন বড় চেহারার বিদেশি গাড়ি করে এসে গুলি করেছে। মাথার চুল সোনালি৷ সে-ই স্যার পিটারকে তুলে নিয়ে গেছে।”

“উনি রেজ়িস্ট করেননি? মানে যারা দেখেছে তারা কিছু বলেনি?”

রাজীববাবু বললেন, “চা-ওয়ালা লোকটি বলেছিল যে, কিছু একটা ফোটানো হয়েছিল বোধহয় স্যার পিটারের শরীরে। কারণ সাডেনলি হি ওয়েন্ট লিম্প!”

সিএম বললেন, “ভিআইপি-দের কতবার বলা হয় যে, সিকিউরিটি প্রোটোকল যেন মেনে চলেন। কিন্তু এমন হাই প্রোফাইল মানুষজন… কথাও শোনেন না!”

আদিল রাজীববাবুকে জিজ্ঞেস করল, “রাস্তার সিসিটিভিতে কিছু ধরা পড়েছে?”

“সেটাও দেখেছি আমরা। গাড়ির ডেসক্রিপশন শুনে সময় মিলিয়ে আমরা ফুটেজ চেক করেছি! গাড়িটাও পাওয়া গেছে! নিউ টাউনে! বাট…”

আদিল বলল, “নিশ্চয় স্টোলেন কার! আচ্ছা, কোনও র‍্যানসাম কল এসেছে?”

এবার কথা বললেন, ফিরহাদ সাহেব, “কিচ্ছু না! সেটাই তো আশ্চর্য! প্রায় ঘণ্টা তিনেক হতে চলল কিন্তু কোনও কিছু নেই?”

শ্রীপার্থ চট্টোপাধ্যায় বসেছিলেন পাশে। এবার মোটা কাচের আড়ালে চোখগুলো বড় বড় করে বললেন, “একটাও লিড নেই! ওদিকে ব্রিটিশ হাই কমিশন থেকে ফোন আসছে। এমআইসিক্স-কে নাকি পাঠাবে ওরা!”

সিএম বললেন, “সারা পৃথিবীতে যা অরাজকতা চলছে তাতে কেউ আর কোথাও সেফ নয়। এখানে ঝামেলা এস্কালেট করার আগে আমাদের এটাকে শেষ করতেই হবে। আমরা কেউ চাই না এমআইসিক্সের মতো একটা সংস্থা এখানে এসে দাপিয়ে বেড়াক!”

সিএম আরও কিছু বলতেন, কিন্তু তার আগেই একটা মেয়ে ঝড়ের বেগে কনফারেন্স রুমে ঢুকে পড়ল।

সবাই ঘুরে তাকাল ওই দিকে।

মেয়েটা বেশ লম্বা। একটা কালো ফুল প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে।

রাজীববাবু বললেন, “এসো শ্রীতমা।”

সিএম ভুরু তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন রাজীববাবুর দিকে।

“শ্রী আমাদের সিআইডি-তে আছে,” রাজীববাবু ছোট্ট করে বললেন।

“স্যার, ম্যাম,” শ্রী সামান্য হাঁপাচ্ছে, “প্লিজ় টিভিটা চালান।”

শ্রীতমার কথার ভেতরে এমন কিছু একটা ছিল যে, পাশে দাঁড়ানো একজন ইন্সপেক্টর আর সময় নষ্ট না করে দ্রুত রিমোট টিপে টিভিটা চালিয়ে দিল। আর সবাই অবাক হয়ে দেখল সামনের নিউজ চ্যানেলে লাইভ ফিড যাচ্ছে একটা। সেলফি স্টিকে মোবাইল লাগিয়ে ভিডিয়ো তোলা হচ্ছে। একটা মুখ। প্লাস্টিকের মুখোশে ঢাকা। গায়ে মিলিটারি ছাপের ইউনিফর্ম। পিঠে ব্যাগ!

ছবিটা স্টেডি নয়। বেশ নড়ছে।

“কোথায় এটা?” সিএম জিজ্ঞেস করলেন।

কিন্তু কেউ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই দেখা গেল লোকটা স্টিকটাকে এবার নিজের থেকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফোকাস করল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল!

টিভির স্ক্রিনে কাঁপা হাতে ধরা ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে জায়গাটা। দেখা যাচ্ছে ওই বড় গোলাকার ডোম। দেখা যাচ্ছে তার মাথায় পাখা মেলে এই উড়ে যাবে ধরনের পরিটিকে! দেখা যাচ্ছে, ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’!

এবার শোনা গেল গলার স্বর। ধাতব শব্দের মতো স্বর। লোকটা বলল, “নাউ, মে আই হ্যাভ ইয়োর অ্যাটেনশন প্লিজ়!”

সতেরো

অনেক ওপরের একটা স্কাইলাইট দিয়ে সামান্য আলো আসছে। আলো মানে আলোর রেখার মতো। যেন পলকা কাচের স্কেল কেউ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই আলোর পাতের মধ্যে সোনালি ধুলোর গুঁড়ো ভাসছে।

ফাদার ফ্রান্সিস ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। আগে যেসব ধকল শরীর সহজেই সহ্য করে নিত এখন সেসব যেন পাহাড়ের মতো চেপে বসে শরীরে!

আটদিন, আজ আটদিন হল এখানে আটকে আছেন ফ্রান্সিস। ওঁকে বারবার ঘুম পাড়ানো ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। দিন রাতের হিসেব গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবু ফ্রান্সিস নিজেকে ঠিক রেখেছেন। পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে ওঁকে। মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হয়েছে অধিকাংশ সময়। তবু দিনের হিসেব গোলায়নি ওঁর।

ফ্রান্সিস ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ধরা পড়েছিলেন একবার। প্রিজ়নার অব ওয়ার-দের ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল ওঁকে। আমেরিকানরা যেমন অত্যাচার করত ভিয়েতনামিদের। তেমন ভিয়েতনামি সৈন্যরাও আমেরিকান সৈন্যদের ধরতে পারলে চূড়ান্ত কষ্ট দিত!

ফ্রান্সিস তেমনই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন একবার। আর তারপর বুঝেছিলেন নরক কাকে বলে! ছোট্ট একটা খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছিল ফ্রান্সিসকে। কাঁটাওলা চাবুক দিয়ে মারা হত। যে কেউ এসে থুতু দিয়ে যেত। জল দেওয়া হত না! খাবার দেওয়া হত না। মারের চোটে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন ফ্রান্সিস। কিন্তু তারপরে জেগেও উঠতেন। আর নিজের নখ দিয়ে হাতের মধ্যে আঁচড় কেটে দিনের হিসেব রাখতেন।

এখনও নিজের হাতে নখ দিয়ে গভীর আঁচড় কেটে দিনের হিসেব রাখছেন ফ্রান্সিস।

এবার ওপরের দিকে তাকালেন উনি। আলোটা রোজ আসে। কিন্তু তাতে পুরনো ইটের আলো-আঁধারি ঘর ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না! তবে আজ ওই আলোর নরম আভার মধ্যেই দূরে কিছু একটা নড়তে দেখলেন ফ্রান্সিস।

কী ওটা? কে ওটা? নিজের মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করলেন। নিজেকে মনে মনেই ‘স্টেডি স্টেডি’ বললেন। গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলেন কয়েকবার। তারপর আবার মনসংযোগ করলেন।

ওই তো নড়ছে। আরে একটা মানুষ! একেও ধরে এনেছে! কেন এনেছে? কী চায় লোকটা?

লোকটার কথা মনে পড়তেই লম্বা, সোনালি চুলের আবছা অবয়বটা মনে পড়ল ফ্রান্সিসের। আবছায়া অন্ধকারে লোকটা এলেও ওই স্কাইলাইটের আলোয় চকচক করে ওর মাথার চুলগুলো!

নতুন বন্দি লোকটা কিছু বলছে। কিন্তু হিয়ারিং এডটা কানে লাগানো নেই, তাই বোঝা যাচ্ছে না ভাল করে।

ফ্রান্সিস উঠে বসলেন এবার। আজ সকালে বাথরুমে যাওয়ার সময় লোকটা হাতের বাঁধনটা খুলে দিয়েছিল। তারপর আবার যখন বেঁধেছে তখন খুব একটা শক্ত করে লাগায়নি!না, তাই বলে টান মেরে হাতের বাঁধন খোলা যাবে না। কিন্তু যেটা করা যাবে, সেটাও অনেক।

ফ্রান্সিস আলতো করে কোমরটা উঁচু করে হাত দুটোকে কোমরের তলা দিয়ে গলিয়ে থাইয়ের নীচে আনলেন। ছোটবেলায় স্কাউটের সময় শেখা। পেছনে হাত বাঁধা থাকলে কী করে সামনে আনা যায়।

এবার পা দুটোকে সংকুচিত করে হাত দুটো হাঁটুর তলা দিয়ে নিয়ে সামনে এনে ফেললেন!

আর ঠিক তখনই শব্দ করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল! ফ্রান্সিস দেখলেন সময় কম। দ্রুত প্যান্টের পকেটের ভেতরে হাত দিলেন। সেলাইয়ের মধ্যে আটকে রাখা আছে একটা ক্যাপসুল আকারের ট্রান্সমিটার।

সোনালি চুলের লোকটা ঘরে পা দেওয়ার মুহূর্তে সেটায় চাপ দিলেন ফাদার ফ্রান্সিস!

আঠারো

১৯ জুলাই। ডেভনপোর্ট, নিউ জ়িল্যান্ড।

ভিক্টোরিয়া রোডের ওপর ডিক্সি ব্রাউন রেস্টুরেন্টটা জনের প্রিয়। ডেভনে এলেই এখান থেকে স্টেক খায় জন।

আজও নিয়েছে একটা পারসেল করে। বড় মাংসের স্টেকের সঙ্গে গাজর, ব্রকোলি, সবুজ মটরশুটির একটা স্যালাড দেয়। আর পাশে ম্যাশ্ড পোট্যাটো আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। দারুণ খেতে!

আজ লিসা এসেছে অকল্যান্ড থেকে। লিসার সঙ্গে মাস খানেক হল ডেট করা শুরু করেছে জন। কিন্তু সত্যি বলতে কী এখনও একটু-আধটু চুমুর বেশি কিছু এগোয়নি। আসলে লিসাকে খুব ভাল লাগছে ওর। তাই হুড়োহুড়ি করতে চায় না। ভয় লাগছে তাড়াহুড়ো করলে লিসা যদি ‘ডেসপো’ ভেবে ওকে ছেড়ে চলে যায়!

আজ লিসাকে দেখে তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, ও এসেছে!

দরজা খুলে একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল জন!

লিসা চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “এখানে ঘাপটি মেরে বসে আছ কেন? নতুন গার্লফ্রেন্ড জুটেছে?”

লিসা স্নানে গেছে। জন বলে এসেছে যে, ডেভনের সবচেয়ে ভাল স্টেক খাওয়াবে ওকে।

ভিক্টোরিয়া রোড থেকে ওর ফ্ল্যাটটা কাছেই। হেঁটে মিনিট পাঁচেক লাগে।

জন একটু সময় নিয়ে হাঁটতে লাগল। ডেভন জায়গাটা খুব সুন্দর, ফাঁকা। হাঁটতে ভাল লাগে বেশ।

বড় রাস্তার থেকে একটা গলি ধরে সামান্য গেলে ওর বাড়ি। বাড়ির সামনে বেশ ঝাঁকড়া একটা ফুলের গাছ আছে। কী গাছ জন জানে না।

চার ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠল জন। তারপর পকেট থেকে চাবিটা বের করে দরজাটা খুলল। ঘরের ভেতরটা নিস্তব্ধ! ওর কেমন যেন মনে হল। এদিক ওদিক তাকাল ভাল করে। স্নানঘর থেকে জলের আওয়াজ এখনও আসছে। লিসা তার মানে বাথরুম থেকে বেরোয়নি!

জন ঘরের ভেতর পা বাড়াল। দরজাটাকে পেছনে বন্ধ করে ঘুরেই চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা দেখল ও! ছায়া মতো কী যেন একটা এগিয়ে আসছে!

রিফ্লেক্সে ঘুরতে গিয়েও পারল না জন। পেছন থেকে কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। টাল সামলাতে না পেরে কাঠের মেঝেতে পড়ে গেল ও।

আর তখনই কামড় লাগল কানে। জন সামান্য থতমত খেলেও সামলে নিল! বড় বড় চুলগুলো থেকে শ্যাম্পুর সুন্দর গন্ধ আসছে! ও বুঝল লিসা পেছন থেকে জাপটে ধরেছে ওকে।

জনের টি শার্টটা ভিজে গেছে পেছনে। লিসা স্নানঘর থেকে যে কিছু না পরেই ভেজা গায়ে চলে এসেছে সেটা বেশ বুঝতে পারল জন!

হাতের প্যাকেটটা পড়ে আছে মেঝেতে! লিসা অল্প অল্প করে কামড়াচ্ছে জনের কাঁধে, ঘাড়ে। জন এবার শরীরটা মোচড় মেরে সোজা হল আর লিসাকে টেনে নিল বুকের ওপরে।

লিসা তাকিয়ে আছে জনের দিকে। বাদামি চোখের মণি! গরম বালির মতো শ্বাস পড়ছে ওর! জন আর নিজেকে আটকাল না। দু’ হাত দিয়ে লিসার কোমরটা আঁকড়ে ধরল ও। তারপর টেনে নিয়ে ঠোঁটে ডুবিয়ে দিল ঠোঁট।

লিসাও পালটা কামড়াল জনের ঠোঁটে। তারপর টেনে খুলে দিল ওর টি- শার্ট। আর ঠিক তখনই শব্দটা শুনল জন।

পিঁকপিঁক করে শব্দটা হচ্ছে পাশের ঘর থেকে!জন স্থির হয়ে গেল! আটদিন যে শব্দটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল সেটাকে এখনই বেজে উঠতে হল!

“সরি, বাট আই মাস্ট…” কথাটা শেষ না করে জন ওর ওপরে বসে থাকা লিসার কোমর ধরে ওকে পুতুলের মতো তুলে মেঝেতে বসিয়ে দিল। তারপর উঠে প্রায় দৌড়ে চলে গেল পাশের ঘরে!

লিসা প্রচণ্ড অবাক হয়ে মেঝেতে বসে চিৎকার করে উঠল, “হোয়াট দ্য ফাক!”

জন উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল নানান যন্ত্রের ভেতর রাখা মনিটারের দিকে।

মনিটারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটা জায়গা। কলকাতা। খিদিরপুর! আর তার মধ্যে একটা লাল রঙের ডট্ জ্বলে আছে!

জন বুঝল ফাদার ফ্রান্সিসের ট্রান্সমিটারটা জেগে উঠেছে!

আর এক মুহূর্ত দেরি না করে জন মোবাইলটা তুলে নিল। লোকেশনটা ফরওয়ার্ড করতে হবে একটা নম্বরে! অদম্য বলেছিল ওর নম্বরের সঙ্গে এই নম্বরটাতেও যেন জন ফাদারের হোয়্যার-আবাউটস জানিয়ে দেয়!

নম্বরটা কার অদম্য বলেনি জনকে। কিন্তু জনের সেটা জানতে আর কতটুকু সময় লাগবে!

“গেট ইয়োর অ্যাশ ডাউন হিয়ার কুইক!” লিসা চিৎকার করল আবার।

জন মেসেজটা ফরওয়ার্ড করতে করতে বলল, “উইল বি রাইট দেয়ার ডার্লিং। জাস্ট লেট মি রেসকিউ সামওয়ান।”

উনিশ

১৯ জুলাই। নবান্ন, হাওড়া। ভারত।

আদিল-সহ কনফারেন্স রুমের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে! এটা কী দেখছে ওরা সামনে! এটা হচ্ছেটা কী!

লোকটার মুখ মুখোশে ঢাকা। গায়ে ঢলঢলে আর্মির পোশাক!পিঠে একটা বড় ব্যাগ!

লোকটা ওই জায়গায় ঢুকল কী করে? অমন করে ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’- এর সামনে পৌঁছে গেল কী করে? ওখানে তো চারজন সিকিউরিটি ছিল! হ্যাঁ, তারা কেউ সশস্ত্র ছিল না, কিন্তু তা হলেও চারজনকে টপকে এমন একটা মুখোশ পরা লোক কী করে পৌঁছে গেল ওখানে!

সিএম বললেন, “এটা কী! কে ওটা! টিভিতে এল কী করে?”

লোকটা বাঁ হাত দিয়ে সেলফি স্টিকটার একটা অংশে চাপ দিল আর সেটা নিমেষে খুলে গিয়ে ট্রাইপডের আকার নিয়ে নিল! লোকটা সেটাকে মাটিতে পুঁতে দিয়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। স্ক্রিনে গোটা দৃশ্যটা ফুটে উঠল এবার।

লোকটা হাত তুলে ‘ওয়েভ’ করল, তারপর যান্ত্রিক গলায় বলল, “আমি আশা করছি আমায় সবাই দেখতে পাচ্ছেন। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন! আমি এখানে এসেছি সামান্য একটা কথা বলতে। এটাকে আর্জিও বলতে পারেন!”

লোকটা শুরু করল আবার, “আমার নাম ধরে নিন এক্স। সেই ছোটবেলার অঙ্ক করার মতো! তবে এখানে আপনাদের এক্সের মান বের করতে হবে না। শুধু এক্স কী চাইছে সেটা মেনে নিলেই হবে। আপাতত আমি একতরফা কথা বলব। পরে কথা হবে দু’তরফা! আগে আমি একটা জরুরি কথা বলে নিই। এই বিল্ডিং-এর চারিধারে কী হচ্ছে আমি দেখতে পাচ্ছি। মানে সেভাবে আমি ব্যবস্থা করে রেখেছি! আমার গায়ে আর মাথায় কেভলার আছে। ফলে স্নাইপার দিয়ে আমায় মেরে লাভ নেই! আর মারলেও আমার বাঁ হাতে ধরা এই ট্রিগারটা আমি টিপে দেব। তাতে আপনাদের ওই সাধের পরির বাড়িটি পরি সমেত উড়ে যাবে! আপনারা বিশ্বাস নাও করতে পারেন! তাই চলুন সেটা দেখানো যাক।’

লোকটা মাটিতে গাঁথা স্টিকটা তুলে ঢুকে গেল অ্যাবোডের ভেতরে! হলের মাঝে দাঁড়িয়ে স্টিকটা তাগ করল সিলিং-এর দিকে। ওই উঁচু সিলিং। বাইরে ডোমটা আছে বলে ভেতরটা বাটির মতো হয়ে আছে।

লোকটা এবার ক্যামেরাটা জ়ুম করল। ডোমের চূড়ার তলাটা দেখা গেল। ওই তো পরির পায়ের কাছটা। ওটা কী?

“আশা করি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন!” এক্সের গলা শোনা গেল আবার, “চিনতে পারছেন।

“সেমটেক্স!” আদিলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল!

ঘরের সবাই ঘুরে তাকাল আদিলের দিকে!

লোকটা আবার বলল, “আমার বাঁ-হাতে ধরা এই সুইচটা পুশ করলেই আপনাদের পরি বাড়ি সমেত আকাশে উড়ে যাবে! আর…” লোকটা থামল। হাসি শোনা গেল ওর, “আর আপনাদের যদি মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি তবে পরীক্ষা করতেই পারেন! ও আর একটা কথা। আমার আপনাদের আর একটা জিনিস দেখানোর আছে! একটা ছোট্ট ভিডিয়ো ক্লিপ। বেশি না, কুড়ি সেকেন্ডের! দেখুন।”

স্ক্রিনে এবার ফুটে উঠল আধো অন্ধকার একটা ঘর। শুধু আলো আসছে ওপর থেকে। ঘরটার দেওয়াল ইটের। ঘরের ভেতর দু’জন বসে রয়েছে মাটিতে। না ঠিক বসে নয়। তাদের শুইয়ে রাখা হয়েছে। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। একজন বয়স্ক মানুষ। সাদা চুল দাড়ি। আর অন্যজন প্রৌঢ়। এর মুখটার ওপর আলো ফেলা হয়েছে!

“গুডনেস”! কনফারেন্স রুমে আচমকা পার্থবাবুর গলা পাওয়া গেল। সবাই সচকিত হয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। পার্থবাবু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন স্ক্রিনের দিকে। তারপর বললেন, “স্যার পিটার রায়ান!”

লোকটা এবার বেরিয়ে এল বাইরে। আবার স্টিকটা পুঁতে দিল মাটিতে। তারপর বলল, “ব্যবস্থা দেখে নিলেন আমার! আমায় গুলি করতে চান এখনও? আচ্ছা, এবার তবে ডিমান্ডের কথা বলি কেমন? মন দিয়ে শুনবেন কিন্তু। আর টাইম মতো মেনেও নেবেন। না হলে এই পরির বাড়ির সঙ্গে ওই বৃদ্ধ যাজক আর ব্রিটেনের সম্মাননীয় অতিথির প্রকৃত সৎকার হয়ে যাবে, বুঝলেন?”

কুড়ি

১৯ জুলাই। কলাইকুণ্ডা, ভারত।

এয়ার ভাইস মার্শাল শ্রীপবন নেগি স্তব্ধ হয়ে টিভির সামনে বসে রইলেন কিছুক্ষণ! তারপর পাশে বসা লেফটান্যান্ট জেনারেল সুদীপ বকশি আর মেজর জেনারেল বিক্রম সুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এসব কী?”

বিক্রম অপলক তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে! মুখে কথা সরছে না যেন।

“হোয়াদ্দা হেল!’ সুদীপ দাঁড়িয়ে পড়লেন, “আমাদের তো ওই অনুষ্ঠানে ইনভিটেশন আছে সন্ধেবেলা। সেখানে… স্যার পিটারকে অমন করে মাটিতে ফেলে রেখেছে! দিনের আলোয় এভাবে থ্রেট করছে!”

বিক্রম দাঁড়িয়ে পড়লেন, “স্যার, নো টাইম ফর ডিসকোর্স! আমাদের এক্ষুনি কলকাতায় যেতে হবে। নট আ মোমেন্ট টু লুজ়! ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কাছে আমাদের মুখ দেখানোর উপায় রইল না!”

“কিন্তু লাঞ্চ?” কথাটা বলেই নেগি নিজেকে আটকালেন। বললেন, “আমি কী বোকার মতো বলছি। নেমন্তন্ন পরে হবে। তোমরা কীভাবে কলকাতা যেতে চাও?”

“চপারের ব্যবস্থা করা যাবে?” বিক্রম জিজ্ঞেস করল।

“শিয়ার,” নেগি আর কথা না বাড়িয়ে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন বাইরে।

সুদীপ তাকালেন বিক্রমের দিকে। তারপর বললেন, “জেটলি স্যারকে ফোন করো। পিএমও-তেও খবর দাও। উই নিড এনএসজি ইমিডিয়েটলি অ্যাট দ্য স্পট। আমি ততক্ষণে অন্য দিকটা দেখছি।”

সুদীপ আর কিছু না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন ঘরের বাইরে!

বিক্রম সময় নিলেন একটু, তারপর ফোনের টাচ স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেন।

একুশ

১৯ জুলাই। পান্জ, তাজিকিস্তান।

ফোনটা রেখে মনে মনে খুব হাসল ফেরিস। ও এত প্ল্যান করে ইন্ডিয়ার কিছু প্রভাবশালী মানুষকে ‘ফিট’ করে নতুন আর্মসের টেন্ডারটা সাজিয়েছিল! আর সেটাই কিনা বাতিল করে দেওয়া! আর দে কিডিং অর হোয়াট!

ফেরিসের কোম্পানি যাতে কাজটা পায় সেটার পুরো বন্দবস্ত করে ফেলেছিল!

কুখ্যাত বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্টর বোউট যে ভুল করে আমেরিকার হাতে ধরা পড়েছিল সেই ভুলটা করেনি ফেরিস। ও ইজ়রায়েলে একটা লেজিটিমেট আর্মসের ব্যাবসা খুলেছে। দরকার মতো ওর বেআইনি অস্ত্র ব্যাবসার জন্য মুখোশ হিসেবে সেই কোম্পানিকে ব্যবহার করা হয়!

ভারতের এই আর্মস ডিলটা হত প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের! আর এতে বেআইনিভাবে সংগ্রহ সেকেন্ড হ্যান্ড বা আরও পুরনো অস্ত্র ঢুকিয়ে দিয়ে ও মুনাফা বাড়িয়ে নিত কয়েক গুণ! আর সেখানে টেন্ডার বাতিল করে দেওয়া হল! ওঁরা আর্মস এস্কালেশন চায় না! তা হলে রাশিয়ার থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনল কেন ভারত!

আজ আর ঘুম হবে না। ফেরিস হাসল। না হোক ঘুম। সামনে যদি এমন ঘটনা চলে তা হলে ঘুমোতে চায় কে!

বাইশ

১৯ জুলাই। নবান্ন, হাওড়া, ভারত।

লোকটা সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “এই জায়গার চারশো মিটারের বৃত্তের মধ্যে কেউ যেন না আসে। তা হলে ওই পাদরি আর স্যার পিটারের জান-মালের দায়িত্ব আমার না, আপনাদের। এটা আমার প্রথম শর্ত!’

সিএম তাকালেন কমিশনার শ্রীরাজীব কুমারের দিকে।

রাজীববাবু বললেন, “আমরা গোটা জায়গা কর্ডন করে রেখেছি ম্যাডাম। আমির যে-আর্মার্ড ভিকেলটা ভিক্টোরিয়ার সামনে দাঁড়ানো থাকে সেটাও পৌঁছে গেছে! কিন্তু আমরা চারশো মিটার দূরত্বই বজায় রাখছি! কাছে যাব না।”

লোকটা আবার বলল, “সেকেন্ডলি, রাশিয়ার থেকে যে-অস্ত্র কেনার চুক্তি হয়েছে সেটা বাতিল করতে হবে। আর সামনে দশ বছর ভারত কোনও অস্ত্র কিনতে পারবে না। আর আমার শেষ শর্ত হল এসব কিছু প্রধানমন্ত্রীজিকে আজ সন্ধে ছ’টার মধ্যে ঘোষণা করতে হবে।”

কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইভ ফিড বন্ধ হয়ে গেল।

সিএম কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন টিভির দিকে। সংবাদ পাঠিকা আবার ফিরে এসেছেন স্ক্রিনে! বলছেন লাইভ ফিড এলে আবার দেখানো হবে।

সিএম এবার তাকালেন মলয়বাবুর দিকে, “কী সাংঘাতিক! লোকটা পাগল!”

মলয়বাবু বললেন, “ম্যাডাম চ্যানেলের লোকজন ফোন করে বলছিল ওরা ফিড বন্ধ করে দেবে কিনা?”

সিএম বললেন, “নেটেও তো শুনলাম দেখাচ্ছে। সব কীভাবে বন্ধ করবেন? তার চেয়ে আপনারা চ্যানেলে বলুন যে, বিপদ হলেও আমরা তার মোকাবিলা করছি। কেউ যেন প্যানিক না করে! আর সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম,” মলয়বাবু মাথা নাড়লেন।

সিএম বললেন, “রাজীববাবু যে-চ্যানেলে এটা টেলিকাস্ট হল তাদের সঙ্গে কথা বলুন।”

“আমি বলেছি ম্যাডাম,” শ্রীতমা বলল, “জেনি বলে একটা মেয়ে! ওর মাধ্যমে এটা চ্যানেলের কাছে গেছে। আর অদ্ভুত ব্যাপার হল আমরা লোকেশনে ওই উন্মাদ লোকটার সঙ্গে মাইক নিয়ে কথা বলতে চাইলেও, লোকটা বলছে না।”

“জেনি!” সিএম বাকি কথাটা পাত্তা না দিয়ে বললেন, “আমি চিনি ওকে। ওর মাধ্যমে লোকটা যোগাযোগ করেছে। স্ট্রেঞ্জ?”

সুব্রতবাবু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এবার একটা চেয়ারে বসে বললেন, “স্যার পিটার আর ওই পাদরি ভদ্রলোকটিকে কী করে রেসকিউ করা যায় সন্ধের আগে, সেটা ভাবা জরুরি!”

“কিন্তু ও পালাতে পারবে না,” পার্থবাবু চোয়াল শক্ত করে বললেন।

আদিল কিছু না বললেও এতক্ষণ শুনছিল সব। এবার বলল, “ম্যাডাম বৃদ্ধ পাদরি ভদ্রলোকটিকে মনে হয় আমি চিনতে পেরেছি।”

“মানে?” সবাই একসঙ্গে ঘুরে তাকাল ওর দিকে।

আদিল কিছু বলার আগেই ওর পকেটে মোবাইলটা পিঁকপিঁক করে ডেকে উঠল। ও মোবাইলটা বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! এটা কী?

একটা হাইপারলিঙ্ক। আদিল ক্লিক করল ওটায়। আর সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে ফুটে উঠল একটা লাইভ জিপিএস ফিড! একটা লোকেশন পাঠানো হয়েছে ওকে! তলায় লেখা, “ফলো ইট।”

“ম্যাডাম,” আদিল সিএম-এর সামনে বাড়িয়ে দিল মোবাইলটা।

সিএম বললেন, “এটা কী? কে পাঠাল? বৃদ্ধ পাদরিটিই বা কে?”

আদিল বলল, “আমায় যেতে হবে ম্যাডাম। এটা কে পাঠাতে পারে বুঝতে পারছেন না?”

সিএম চশমাটা খুলে তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে। তারপর বললেন, “সে এসেছে! এবারও! কিন্তু কোথায়?”

আদিল বলল, “জানি না ম্যাডাম। কিন্তু সে আছে। কাছেই আছে কোথাও। কারণ ওই বৃদ্ধ পাদরিটি ওর সব কিছু! আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমি একটা জিনিস বুঝেছি, প্রিয় মানুষের গায়ে হাত পড়লে ছেড়ে কথা বলে না অদম্য সেন!

তেইশ

১৯ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

উদ্বিগ্নভাবে বাইরের দিকে তাকালেন মেজর জেনারেল বিক্রম সুদ। চড়া রোদ উঠেছে। কিন্তু গাড়ির ভেতর বসে ওঁরা বুঝতে পারছেন না। তাও যা পরিস্থিতি তাতে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি হচ্ছে!

লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুদীপ বকশি নিজের ফোনটা কানের থেকে নামিয়ে বললেন, “বিক্রম, আমার সঙ্গে এইমাত্র ওয়েস্ট বেঙ্গলের চিফ সেক্রেটারি মিস্টার মলয় দে-র কথা হল। উনি বললেন যে, স্যার পিটারের খবর পেয়েছেন ওঁরা। একটা জায়গা থেকে ওদের লোকেশন ট্রেস করা গেছে। মার্কোসের একজন কম্যান্ডো, আদিল, ইজ় টেকিং অ্যাকশন!”

“মানে?” বিক্রম অবাক হল, “লোকেশন পেয়েছে! কেমন করে? আর সেটা কতটা রিলায়েব্‌ল? পেল কী করে?”

“আরে, কলকাতা পুলিশ তো খোঁজ করছিল। সেভাবেই পেয়েছে নিশ্চয়! তুমি এমন করছ কেন?” সুদীপ অবাক হয়ে তাকালেন বিক্রমের দিকে।

বিক্রম দাঁত চেপে নিজেকে সংযত করে নিয়ে বললেন, “আসলে আয়াম কনসার্নড। মানে… এভাবে তো পাওয়া যায় না লিড! তাই মানে…”

সুদীপ গাড়ির জানালা দিয়ে বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আই হোপ আদিল উইল বি সাকসেসফুল!স্যার পিটারকে না পাওয়া গেলে খুব বিপদ হবে। আর ওই টেররিস্টের থ্রেটটা নিউট্রালাইজ় করা যাবে না!”

বিক্রম চোয়াল শক্ত করে তাকালেন সুদীপের দিকে।

সুদীপ সেটা খেয়াল না করে বললেন, “এরা দেশটাকে ছিঁড়ে টুকরো করে দিতে চায়!কিন্তু সেটা যে সহজ হবে না তা বুঝতে পারে না! এনএসজি এসে পৌঁছে গেছে ওই জায়গাটার কাছে। আমি দেখতে চাই ওই জানোয়ারটা কী করে ওখান থেকে এসকেপ করবে! ওর কথামতো কেউ চারশো মিটারের কাছে যাচ্ছে না! কিন্তু এনএসজি আর কলকাতা পুলিশ গোল করে বাকি জায়গাটা কর্ডন করে রেখেছে! আমি নিজে দাঁড়িয়ে দেখব কী করে ও পালায়। আর যে স্যার পিটারকে কিডন্যাপ করেছে লেভারেজ হিসেবে তাকেও নিজের হাতে গুলি করে মারব?”

“উত্তেজিত হবেন না।” বিক্ৰম কথাটা বলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করলেন। তারপর সুদীপকে বললেন, “বাড়িতে একটা মেসেজ করে দিই।”

সুদীপ সামান্য অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বিক্রমের দিকে। বললেন, “বাড়িতে! এই অবস্থার মধ্যে বাড়িতে?”

মেসেজ করতে করতে অন্যমনস্কভাবে শুধু মাথা নাড়ল বিক্রম!

চব্বিশ

মেঘ করে আসছে। রেসকোর্সের ওপর দিয়ে একটা মেঘের জটলা এগিয়ে আসছে ময়দানের দিকে।

গরম লাগছে খুব। ভ্যাপসা একটা গরম প্রায় দমবন্ধ করে দিচ্ছে ওর। কিন্তু ও জানে এসব নিয়ে ভাবলে হবে না! যদি বৃষ্টি আসে তা হলে ওর প্ল্যান বানচাল হয়ে যেতেই পারে! কাঁধটা টনটন করছে ওর! পিঠের ব্যাগটা খুব ভারী না হলেও এতক্ষণ বইছে বলেই বোধহয় কাঁধ থেকে ছিঁড়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছে!

ব্যাগের পাশের থেকে বোতল বের করে এক চুমুক জল খেল অদম্য।

নিজেকেই অদ্ভুত লাগছে ওর! সৈনিকদের ঢলঢলে পোশাক, মুখোশ, মাথায় হেলমেট। পিঠে ব্যাগ! সামনে মাটিতে রাখা ট্রাইপডের ওপর লাগানো মোবাইল!

ও জানে সারা দেশ তথা পৃথিবীর একটা বড় অংশ আজ তাকিয়ে আছে ওর দিকে! সবাই জানছে কলকাতার বুকে প্রকাশ্যে একজন আতঙ্কবাদী নতুন তৈরি হওয়া এই পরির বাড়িটি উড়িয়ে দিতে চাইছে! চাইছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর থেকে কিছু ঘোষণা। লোকে জানছে যে, সেই কারণে একজন বৃদ্ধ পাদরি আর একজন গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অতিথিকে পণবন্দি করে রাখা হয়েছে!

অদম্য চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে সামনে। এই বাড়িটির মাথায় চারিদিকে লাগানো ক্যামেরায় যে-ছবি উঠছে সেটা ওর ডান বাহুতে লাগানো একটা ছোট মনিটারে দেখা যাচ্ছে। তাতে ও দেখতে পাচ্ছে ওর গণ্ডি কেটে দেওয়া দূরত্বের বাইরে গোল করে কালো পোশাকে সারা শরীর ঢাকা এনএসজি কম্যান্ডো আর কলকাতা পুলিশের ফোর্স ঘিরে রেখেছে গোটা জায়গাটা। ঠিক চক্রব্যুহ যেন! এই চক্রব্যুহে ঢুকে তো পড়েছে অদম্য কিন্তু এখান থেকে বেরোবে কী করে?

ফাদারকে ও কতবার বলেছিল যেন না বেরোয় বাড়ি থেকে। কিন্তু সেটা যদি ফাদার শুনতেন! মানুষটা শোনেন না কোনও কথা।

আসলে ভেনেজুয়েলায় ওই ঘটনাটা ঘটার পরেই ও বুঝতে পারছিল যে, কিছু একটা হতে যাচ্ছে! ফেরিস ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়!

আর যে-ভয়টা পেয়েছে সেটাই হল! আর তাই তো ওদের কথামতো এমন একটা কাজে ঢুকতে হল ওকে!

প্রথমে গিরিশকে মুম্বই থেকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় এখানে এসে পরির পায়ের কাছের ওই রোটর যন্ত্রটায় “দরকারি জিনিস” ফিট করেছে। তারপর নিজের ভোল বদলে নিয়ে আবার ইলেকট্রিকের মিস্তিরি সেজে এসে এই বাড়িটার ভেতরে আর ডোমের মাথায় আলো লাগানোর নাম করে ক্যামেরা-সহ কিছু ক্যানিস্টার স্ট্র্যাটেজিক পজ়িশনে রেখে গেছে।

সকালে এই বাড়িটার দখল নিতেও ঝামেলা পোহাতে হয়নি! চারজন সিকিউরিটি গার্ডকে শূন্যে গুলি ছুড়ে ভয় দেখানো কী আর কঠিন কাজ! লোকগুলো পড়ি কি মরি করে দৌড়ে পালিয়েছিল! হ্যাঁ, পুলিশ ছিল কিন্তু ওর হাতের ট্রিগার দেখে মানব বোমার ভয়ে আর কেউ কিছু করেনি!

এখন বাকিটা হিসেব মতো করতে পারলে হয়!

অদম্য জানে আদিলের কাছে ফাদারের লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে জন। ওর ওই ছোট মনিটারেও সেটা দেখাচ্ছে! খিদিরপুরের কাছে নদীর কাছাকাছি জায়গাটা। ওর মনিটারটা একটা রিসিভিং ডিভাইস। এনক্রিপ্ট করা! ট্রেস বা বাগ করা যায় না। ফেরিস এতে আড়ি পাততে পারবে না! এতে শুধু ছবি আসে। পাঠানো যায় না তাই জন ওকে ছবি পাঠালেও এটার মাধ্যমে ও কারও সঙ্গে কথা বলতে পারবে না! যোগাযোগ করতে পারবে না!

অদম্য চোয়াল শক্ত করল। একবার আদিল ফাদারকে রেসকিউ করে নিক তারপর ও আসল খেলা দেখাবে! তবে যদি সব হিসেব মতো হয়!

আচমকা সামনে মাটিতে দাঁড় করানো মোবাইল ফোনটা চিরিপ চিরিপ করে বেজে উঠল।

সতর্ক হল অদম্য। নবান্নর সঙ্গে কমিউনিকেশনের লাইনটা ও খুলে দিয়েছে। সকালে জেনির মোবাইলে এখানের লাইভ ফিড পাঠিয়ে চ্যানেলে সেটা লাইভ টেলেকাস্ট করিয়েছে! আর এখন তো দেখতেই পাচ্ছে ওর বলে দেওয়া বাউন্ডারির বাইরে যেমন সিকিউরিটি ফোর্স জমা হয়েছে তেমন সংবাদ মাধ্যমও জড়ো হয়েছে!

ডান হাত দিয়ে কানে লাগানো ব্লু-টুথটা অন করল অদম্য, “ইয়েস!”

“তোমার ওই ডিমান্ড আমরা জানিয়েছি। কিন্তু টাইম লাগবে।”

“প্লিজ আইডেন্টিফাই ইয়োরসেলফ!”

ওপারে সামান্য নিস্তব্ধতা। তারপর ভেসে এল, ‘আমি লেফটানেন্ট জেনারেল সুদীপ বকশি। তুমি কি ভেবেছ এত লোকের মাঝে থেকে পার পেয়ে যাবে?”

“আপনি আমার সম্বন্ধে কনসার্নড হবেন না।”

“মাথার ওপর হেলিকপ্টার। চারিদিকে সিকিয়রিটির লোকজন! হাউ ডু ইউ প্রোপোজ় টু এসকেপ?”

“ধরে নিন এটা একটা খেলা। সেখানে আপনি কী করে ভাবছেন যে, আমি সব বলে দেব! তার চেয়ে যা লিস্ট দিয়েছি সেই অনুযায়ী ঘোষণাগুলো করে দিন। সেভ লাইফ ফর আ চেঞ্জ!”

“আমরা আর্মিতে আছি কেন! আমরা কী করি মনে হয়?” সুদীপের গলায় তীব্র রাগ বুঝতে পারল অদম্য।

“কুল ইট মিস্টার!” অদম্য জানে ওকে এভাবেই কথা বলতে হবে। কারণ ফেরিসের লোকজন ওর এই কথা শুনছে! এই কমিউনিকেটিং ডিভাইসটা ফেরিসের দেওয়া। ফাদারের কিডন্যাপিং-এর বদলে এই সব ওকে দিয়ে যে করানো হচ্ছে তার ফাঁকে অদম্য যাতে কিছু অন্য কথা বলতে না পারে, তাই এমন আড়িপাতার ব্যবস্থা!

তাই অদম্যকে এমন করেই আচরণ করতে হবে যতক্ষণ না ফাদার মুক্ত হচ্ছেন। তবে সন্ধে ছ’টার মধ্যেও যদি ফাদার মুক্ত না হন, তা হলে…

অদম্য আর ভাবল না কিছু!

“তুমি এটা কার নির্দেশে করছ?” এবার সিএম-এর গলা পাওয়া গেল।

“কার নির্দেশে?” হাসল অদম্য, “আপনাদের দেশের শত্রু কিছু কম আছে বলে আপনার মনে হয় ম্যাডাম! ধরে নিন চিন করাচ্ছে! বা পাকিস্তান!”

“না, তারা করাচ্ছে না! তারা সবাই কনডেম করছে এটা,” এবার নতুন একটা গলা পাওয়া গেল।

“আইডেন্টিফাই ইয়োরসেলফ!” অদম্য বলল।

“অরুণ জেটলি হিয়ার!”

এবার শব্দ করে হাসল অদম্য, “আরে স্যার আপনি এসে গেছেন! গ্রেট! আমি আদিলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

আচমকা সব চুপ হয়ে গেল। অদম্য জানতে চায় যে, আদিল আসলে ওখানে আছে না বেরিয়ে পড়েছে! মানে ওই লোকেশনটা কি সিরিয়াসলি নিয়েছে ওরা?

“কী হল?” অদম্য অধৈর্য হল এবার।

“আদিল মানে… ও এখন নেই…”

“থ্যাঙ্কস। সন্ধে ছ’টা,” কথাটা বলে ফোন কেটে দিল অদম্য।

বাড়িটার সিঁড়িতে এসে বসল এবার। দূরে এনএসজি-দের কালো পুতুলের মতো লাগছে! শুধু রেসকোর্সের মাথার ওপর দিয়ে মেঘের জটলা এগিয়ে আসছে! বৃষ্টি হবে কি? আদিল পারবে কি ফাদারকে বাঁচাতে? এই দিনটার শেষে আজ কী আছে?

পঁচিশ

সারা শরীর জ্বলছে নিক্তোর। এ কী করে সম্ভব! ওর লোকেশন ট্রেসড হয়ে গেছে! কী করে ট্রেসড হল? কে ট্রেস করল ওকে? এখানে যে-দু’জনকে লুকিয়ে রেখেছে সেটা কী করে জানল ওরা?

কিন্তু আর সময় নেই। নিক্তো ওর মোবাইল থেকে মেসেজটা ডিলিট করে দিল এবার। তারপর দ্রুত পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলল।

এই জায়গাটা খুব নির্জন। কাছেই ডক। বহুদিনের পুরনো কিছু বাতিল ওয়্যারহাউজ় আছে এখানে। তার মধ্যে এই ওয়্যারহাউজ়টার পেছনের দিকের অংশটা তাও ভাল আছে। বেশ বড় একটা ঘরের সঙ্গে লাগোয়া আর একটা ছোট ঘর। বড় ঘরটার সেভাবে কোনও জানালা নেই। মাথার ওপর কয়েকটা স্কাইলাইট ছিল। কিন্তু একটা রেখে অন্যগুলোকে ও ঢেকে দিয়েছে! সেই ঘরেই আটকে রেখেছে দু’জনকে।

বহু পুরনো এই বাড়িটার আর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মাটির তলার সুড়ঙ্গ! হ্যাঁ, ওই বড় ঘরটার থেকে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে দূরের একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে! ব্রিটিশ আমলের বাড়ি এগুলো, কিন্তু তারা কেন সুড়ঙ্গ তৈরি করে রেখেছিল কে জানে! তবে সেই সুড়ঙ্গটা আজ কাজে লাগবে।

নিক্তো নিজে ওই সুড়ঙ্গটায় নেমে আগে দেখে এসেছে। অনেকখানি জায়গায় জঙ্গল হয়েছিল। ও নিজে পরিষ্কার করে রেখেছে সুড়ঙ্গটা। যদি কাজে লাগে!

আসলে নিক্তো যেখানেই যায় পালানোর সমস্ত কৌশল আগে থেকেই ভেবে রাখে! লাইভ টিভির ওই বোকাটার মতো না, যে কিনা নিজে গিয়ে ঢুকেছে সিংহের গুহায়! অবশ্য ওর উপায়ই বা কী!

কিন্তু পালানোর আগে এই ব্যাপারটা মেটাতে হবে। কে পাঠাল এই জায়গার কো-অর্ডিনেট? ট্রান্সমিটার আছে কারও কাছে!

দরজা খুলে বড় ঘরটায় গিয়ে দাঁড়াল নিক্তো। আবছা অন্ধকার পাতলা সেলোফেনের মতো জড়িয়ে আছে ঘরের ভেতরে! তার মধ্যেও মানুষ দু’জনকে দেখতে পেল ও। দু’জনেই শুয়ে আছে! কিন্তু বয়স্ক পাদরিটাকে যেভাবে রেখে গিয়েছিল সেভাবে তো নেই। তবে কি ও-ই কোনওভাবে লুকোনো ট্রান্সমিটার থেকে সিগনাল পাঠিয়েছে?

নিক্তো হাত বাড়িয়ে দেওয়ালে লাগানো ছোট সুইচটা অন করল! এখানে দু’জনকে এনে তোলার কিছুদিন আগে থেকেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে নিক্তো!

আলো জ্বালতেই মাটিতে পড়ে থাকা দু’জন চোখ কুঁচকে অস্ফুটে শব্দ করে উঠল!

নিক্তো ভাল করে মাটির দিকে তাকাল। বহুদিনের পুরনো বাড়ির মেঝে যেমন হয় এইখানেও তেমনই অবস্থা! ধুলোময়লা ভরতি! তাই মাটিতে পড়ে থাকা পাদরি ফ্রান্সিস আর স্যার পিটারের জামা কাপড়ের অবস্থাও খুব খারাপ!

কিন্তু দু’জন যে জায়গায় শুয়ে আছে সেই জায়গা দুটোর মেঝের অবস্থার ফারাক আছে!

স্যার পিটারের জায়গার মেঝেটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু, পাদরি ফ্রান্সিসের জায়গার মেঝের ধুলো ময়লায় ড্র্যাগ মার্ক স্পষ্ট! বোঝা যাচ্ছে লোকটা মাটিতে বসে বেশ নড়াচড়া করেছে!

নিক্তো আর অপেক্ষা না করে সটান গিয়ে দাঁড়াল ফ্রান্সিসের সামনে! তারপর এক হাতে ওর পিস্তলটা বের করে নিজের বড় শরীরটা ঝুঁকিয়ে এক হ্যাঁচকায় টেনে তুলল মানুষটাকে। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “ট্রান্সমিটারটা কোথায়? বলো না হলে আই উইল শুট পিটার!”

থতমত ফ্রান্সিস কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই আচমকা পিস্তল থেকে গুলি চালাল নিক্তো। স্যার পিটারকে ঘেঁষে বিকট শব্দে গুলিটা গিয়ে লাগল পাশের দেওয়ালে। ইটের টুকরো ছিটকে গেল চারিদিকে। পিটার কুঁকড়ে গেলেন ভয়ে। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করলেন।

ফ্রান্সিস আতঙ্কের সঙ্গে তাকালেন নিক্তোর দিকে।

নিক্তো চাপা কিন্তু কর্কশ গলায় বলল, “বলো কোথায় ওটা? না হলে পরের বার ইটের টুকরো নয় পিটারের রক্তের ছিটে উড়বে!”

ছাব্বিশ

যে-কোনও গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের মূল কথা হল গোপনীয়তা আর দ্রুততা।

আদিল চারিদিকে তাকাল! ওরা চারজন এসেছে এখানে! আদিলের সঙ্গে আরও তিনজন এনএসজি কম্যান্ডোকে পাঠানো হয়েছে!

এই জায়গাটায় বড় বড় কিছু বহু পুরনো ওয়্যারহাউজ আছে। তাও চারিদিকটা কেমন যেন নিস্তব্ধ, পরিত্যক্ত আর আগাছায় ঢাকা!

হাতের নাইন এমএম ‘ওয়ান-এ’ পিস্তলটা সোজা করে ধরে পায়ে পায়ে এগোতে লাগল আদিল। ওর পেছনে তিনজন কম্যান্ডো তাদের ‘কর্নার শট’ রাইফেল তুলে এগিয়ে আসছে।

হাতের মোবাইলে লাল ডটটা দপদপ করছে। আর মাত্র পঁচিশ মিটার।

আদিল বুঝল সবার শেষের ওই ওয়্যার হাউজের ভেতরের থেকেই ট্রান্সমিনশনটা আসছে। কী আছে ওই ঘরে! এই চিহ্ন ধরে এসে কি সত্যি স্যার পিটার বা ফাদার ফ্রান্সিসকে খুঁজে পাবে!

আদিল পেছনে তাকিয়ে বাকি তিনজনকে ইশারা করল। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন সামান্য ঝুঁকে এগিয়ে গিয়ে বাড়িটার তিনদিক ঘিরে ফেলল।

আদিল সময় নিল একটু। যে-লোকটা কিডন্যাপ করেছে সে কতটা প্রিপেয়ার্ড সেটা তো জানে না! সে যদি এই ওয়্যারহাউজ়ের বাইরে ক্যামেরা বা মোশান ডিটেক্টার লাগিয়ে রাখে তা হলে ওদের গতিবিধি বুঝে ফেলবে।

কিন্তু আদিল অবাক হয়ে দেখল, কিছুই হল না! ও ইশারা করে বাকিদের বাইরেই থাকতে বলল তারপর ওয়্যারহাউজের পেছনের দরজার দিকে নিয়ে গেল। আরে, এত পুরনো ওয়ারহাউজের পেছনের এই দরজাটা এমন নতুন কেন!

হাতের পিস্তলটা দিয়ে দরজাটা ঠেলল সামান্য। নিঃশব্দে খুলে গেল দরজা। আদিল নিশ্চিত হল দরজাটা একদম নতুন!

ও ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল! আরে, আলো আসছে!

আদিল পাশের থেকে একটা ছোট্ট পাথরের টুকরো তুলে ছুড়ে মারল ওই আলো জ্বলা ঘরটার দিকে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল!মনে মনে গুনতে শুরু করল, এক, দুই, তিন…

কুড়ি গোনার পরেও কিছু হল না! আদিল এবার দ্রুত এগোল সামনে। ওই তো ঘরটা! কিন্তু এটা কী? আরে, পাশে আর একটা ঘর!

আদিল উঁকি দিল সেই ঘরে। ফাঁকা। শুধু একটা চেয়ার টেবিল রাখা। আর টেবিলে রাখা আছে কাগজের গ্লাস। আদিল হাতে তুলে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল কাপটা। কফি! এখনও সামান্য তরল আছে কাগজের কাপের তলানিতে! মানে খুব বেশি সময় যায়নি কফি খাওয়ার পরে!

ও এবার দ্রুত বড় ঘরে ঢুকল। কেউ নেই! শুধু একটা আলো জ্বলছে! আদিল এদিক ওদিক তাকাল। মাথার ওপরে স্কাইলাইট আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু একটা ছাড়া বাকিগুলো সব ঢাকা দেওয়া! এক দিকের ইট বের করা পাঁচিলও চোখে পড়ল। চিনতে পারল আদিল! এটাই দেখিয়েছিল সেই ভিডিয়ো ক্লিপিং-এ! এবার মেঝের দিকে নজর দিল ও। দেখল মেঝের ধুলোয় কে যেন পা দিয়ে এলোমেলো দাগ টেনে দিয়েছে।

ও বুঝল লিড ফলো করে ঠিকই এসেছে ওরা। তবে ওদের আসার খবর পেয়ে কালপ্রিট পালিয়েছে এখান থেকে! কিন্তু এত দ্রুত দু’জন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে পালাল কী করে! কোন পথেই বা পালাল?

আদিল ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে তাকাল মাটির দিকে। পায়ের স্পষ্ট কোনওরকম ছাপ যদি ধুলোর থেকে উদ্ধার করতে পারে! আর তখনই নজরে এল জিনিসটা। ঘরের কোনায় চকচক করছে! কী ওটা! আদিল এগিয়ে গিয়ে জিনিসটা তুলে নিল হাতে! আরে একটা ছোট্ট ক্রস। রোজারির শেষে যেমন থাকে, তেমন! ও উলটে দেখল ক্রসটা। ছোট ছোট করে কিছু লেখা!

আলোর কাছে গিয়ে এবার ভাল করে দেখল আদিল। দেখল লেখা আছে ‘ফ্রান্সিস’!

ও এবার এদিক ওদিক তাকাল। এখনও কী করে ট্রান্সমিশনের সিগনাল আসছে?

এবার আর একটা জিনিস চোখে পড়ল ওর! দেওয়ালে ওটা কী?

বুলেট হোল! আর আদিল অবাক হয়ে দেখল তার মধ্যে গুঁজে রাখা আছে ছোট্ট ক্যাপসুলের মতো দেখতে একটা ট্রান্সমিটার!

মানে কিডন্যাপার এটা জেনে গেছে? নাকি ওদের মিসগাইড করার জন্য এমন করে ভুয়ো সিগনাল পাঠিয়েছে?

আদিল দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। হাতে সময় কম। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি! তা হলে কি এবার নেগোশিয়েট করতে হবে? নাকি মেনে নিতে হবে সব দাবি!

আদিল চোয়াল শক্ত করে নবান্নর কন্ট্রোল রুমের নম্বরটা ডায়াল করল।

সাতাশ

ফোন কলটা টেবিলের ওপর রাখা স্পিকারে ট্রান্সফার করে দিলেন পুলিশ কমিশনার শ্রীরাজীব কুমার।

সিএম চেয়ারটা টেনে বসে বললেন, “হ্যাঁ আদিল, বলো?”

“ম্যাডাম, সাইট ফাঁকা। তবে আমি এনাফ এভিডেন্স পেয়েছি যাতে বুঝতে পারছি যে, এখানে স্যার পিটার আর ফাদার ফ্রান্সিস ছিলেন।”

“আর ইউ শিয়োর?” জেটলিজি জিজ্ঞেস করলেন।

“পজিটিভ স্যার।”

বিক্রম বললেন, “তুমি তা হলে ফিরে আসবে? এখান থেকে আমরা ফরেন্সিক দল পাঠাচ্ছি!”

আদিল উত্তর দেওয়ার আগেই এবার সুদীপ বললেন, “ডোন্ট কাম ব্যাক। আমি আসছি ওখানে। আমার এখানে এমনভাবে থাকার কোনও মানে হয় না! বিক্রম ইজ় গোয়িং টু ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’। আর তোমরা ওখানে পজ়িটিভ কিছু পেয়েছ কি?”

“স্যার, একটা কথা বলতে পারি, ওরা বেশি দূর যায়নি। তাই আমি চাইছিলাম আপনারা যদি তিন কিলোমিটার রেডিয়াসে গোটা জায়গাটা কর্ডন করেন! আমি চারিদিকে দেখছি এখন। বর্ষাকাল, মাটি নরম। কিন্তু আমাদের ছাড়া আর এক জোড়া ফুট প্রিন্ট আছে। কিন্তু হিসেব মতো এখান থেকে পালাতে গেলে আরও দু’ জোড়া ফুট প্রিন্ট পাওয়ার কথা! প্লাস গাড়ির টায়ারের কোনও দাগ নেই। তাই অন্য কোনওভাবে এখান থেকে ওরা গেছে! আর যেহেতু গাড়ি নেই আর এখানে পাওয়া কাপের তলানিতে এখনও তরল কফি আছে সামান্য, তাই আই গেস ওরা বেশিদূরে যেতে পারেনি!”

“ইউ প্রসিড আই অ্যাম অন মাই ওয়ে,” সুদীপ কথাটা বললেন।

আদিল ফোন কেটে দেওয়ার পরে জেটলিজি বললেন, “সুদীপ তোমার যাওয়া নেসেসারি? মার্কোসের আদিল আছে, ওর সঙ্গে এনএসজি-র তিনজন আছে, আমরা আরও জনা দশেক এনএসজি কম্যান্ডো পাঠাব। তাই বলছি তুমি যাচ্ছ কেন?”

“হ্যাঁ হোয়াই?” পাশের থেকে বিক্রম একই কথা জিজ্ঞেস করলেন।

সুদীপ বললেন, “উপায় নেই। দেশের মান-সম্মানের ব্যাপার! আমি তো বলেইছিলাম যে, আমাদের দেশে আমরা বড্ড সফট মেন্টালিটি নিই। সেটার সুবিধে তোলে এই জাতীয় লোকজন। ওই লোকটা সারা পৃথিবীর সামনে বোমা নিয়ে ভয় দেখাচ্ছে যে, আমাদের ওই রাশিয়ার থেকে অস্ত্র কেনার চুক্তি বাতিল করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যতের সবরকমের অস্ত্র কেনা বন্ধ করতে হবে। এইভাবে কেউ দেশের প্রতিরক্ষাকে হস্টেজ় বানাতে পারে? সঙ্গে আমাদের দেশের অতিথিকে কিডন্যাপ করেছে! দিস ইজ় দ্য লিমিট। উই মাস্ট প্রসিড নাউ। না হলে সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের কোনও শিরদাঁড়া থাকবে না! আমি এটা হতে দিতে পারি না।”

জেটলিজি বললেন, “ওকে ইউ প্রসিড সুদীপ। এটাকে থামাতেই হবে বিফোর ইট ইজ় টু লেট।”

আঠাশ

পথটা নিচু হয়ে গিয়ে আবার ওপর দিকে উঠেছে! দু’পাশের স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালে সামান্য অন্যমনস্ক হলেই ঘষা লেগে যাচ্ছে হাতে! ওর সামনের পিটার নামের মানুষটা টলতে টলতে যাচ্ছে কোনওমতে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটাকে অনেকটা পরিমাণ ড্রাগ দেওয়া হয়েছে!

আর ওর পেছনের দশাসই চেহারার নিক্তো এক হাতে পিস্তল আর অন্য হাতে একটা জোরালো টর্চ জ্বেলে রেখেছে।

বেশ অনেকক্ষণ হাঁটছেন ওঁরা। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে পথ শেষ হয়ে আসছে সামনে। ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আলোও বাড়ছে।

‘কুইক!’ বন্দুকের নল পিঠে ঠেকিয়ে নিক্তো আবার ঠেলল ওঁকে।

কোনওমতে শরীরের ভার ডান পায়ের ওপর রেখে নিজের টাল সামলালেন ফ্রান্সিস।

পায়ে ব্যথা লেগেছে। নিক্তো ওঁকে প্রায় শূন্যে তুলে ছুড়ে ফেলেছিল মাটিতে। প্যান্টের সেলাইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা ট্রান্সমিটারটা বের করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ফ্রান্সিস।

লোকটা ওই গুলি চালানোর পরে আবার বলেছিল, “আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করবে না! জানবে আমার থেকে বাঁচতে পারবে না তুমি! সত্যি বলার জন্য তোমায় একটা চান্স দিয়েছি। আর দেব না। এবার আমি নিজে বাগ সুইপার দিয়ে তোমায় চেক করব। আর একটাও যদি ট্রান্সমিটার পাই তোমার কাছে তবে ওই পিটারের আজই শেষ বিকেল! মনে রাখবে আমার নাম নিক্তো! আই নেভার লাই?”

পকেট থেকে ছোট্ট একটা যন্ত্র বের করে ফ্রান্সিসের সর্বাঙ্গে বুলিয়েছিল ও। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বলেছিল, “গুড। আর শোনো পাদরি, সিগনাল পাঠিয়েও কোনও লাভ নেই। আমি সব খবর পেয়ে যাব। আমাদের লোক সব জায়গায় আছে। উই হ্যাভ ইনফিলট্রেটেড এভরিহোয়্যার।”

তারপর কোনওমতে পিটারকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করিয়েছিল নিক্তো। বলেছিল, “আমাদের এখান থেকে যেতে হবে!”

এবার ফ্রান্সিসের থেকে নেওয়া ওই ট্রান্সমিটারটা নিক্তো দেওয়ালে গুলির গর্তে গুঁজে দিয়েছিল। তারপর চট করে ওদের দুজনের চোখ বেঁধে দিয়ে, “আমি আসছি। দাঁড়াও এখানে।” বলে নিজে চলে গিয়েছিল একটু দূরে। এই সুযোগটা নিয়েছিলেন ফ্রান্সিস। হাতে চেনের মতো করে পরে থাকা একটা রিস্টলেট থেকে টান মেরে খুলে নিয়েছিলেন একটা ছোট্ট ধাতুর ক্রস। তারপর সেটাকে আঙুলের টোকায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ঘরের কোনায়।

একটু পরে নিক্তো এসে ওঁদের দু’জনকে সামান্য টান মেরে বলেছিল, “চলো সামনে। নো ফানি মুভ্স!”

সুড়ঙ্গে ঢুকে ওঁদের চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল নিক্তো।

মাটির নীচে থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সেটা দিয়ে ওরা উঠে এল একটা ঘরের মধ্যে।

এই ঘরটা বেশ বড়। কিন্তু জরাজীর্ণ। যদিও দরজা জানালা আছে। মাথার অনেক ওপরে ঘুলঘুলি। তাতে কিছু পায়রাও বসে রয়েছে। আলো দেখে বোঝা যাচ্ছে দিনের অনেকটা কেটে গেছে। চকচকে রোদে মরচে ধরতে শুরু করেছে!

নিক্তো ওদের বসিয়ে দিল একটা দেওয়াল ঘেঁষে। ফ্রান্সিস দেখলেন পিটার শুয়ে পড়েছেন আবার। মানুষটাকে খুব হাই ডোজের কোনও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারছেন না!

নিক্তো সময় নষ্ট না করে দেওয়ালের একটা আংটার থেকে লাগানো লোহার শেকলের সঙ্গে বেঁধে দিল দু’জনের পা। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত সামনে এনে আবার বেঁধে দিয়ে বলল, “নাউ ফাদার, স্টার্ট প্রেয়িং। সন্ধে ছ’টার পরে ইউ নেভার নো হোয়াট উইল হ্যাপেন?”

ফ্রান্সিস বুকের কাছে ঝোলানো ক্রসটা ধরে তাকালেন নিক্তোর দিকে।

নিক্তো একটা চোখ টিপে “প্রে, প্রে,” বলে হেসে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ফ্রান্সিস তাকালেন চারিদিকে। না, কোনও ক্যামেরা নেই! তারপর ক্রসটার ছোট আর্ম দুটো চাপ দিলেন সামান্য। পিং শব্দে ওপরের দিকে একটা বোতাম উঠে এল। হাসলেন ফ্রান্সিস। এই ট্রান্সমিটারটা মোসাদ-এর গুপ্তচরেরা ব্যবহার করে। বাগ সুইপার দিয়ে ট্রেস করা যায় না এগুলো। আর এর আরেকটা ব্যবহারও আছে। ডিসট্রেস কল পাঠানো যায় এটা দিয়ে। তবে মাত্র কয়েকটা শব্দই।

ফ্রান্সিস ইচ্ছে করেই প্রথমবার এটা ব্যবহার করেননি। কারণ ওঁর দেখার ছিল নিক্তো জানতে পারছে কি না ওঁর কাছে ট্রান্সমিটার আছে! কারণ সাধারণত এমন কাজ ভেতরের সাহায্য ছাড়া করা যায় না! নিক্তো যদি জানতে না পারে তা হলে তো এমনিতেই রেসকিউ টিম চলে আসবে। আর জেনে গেলে ওই ট্রান্সমিটারটা ধরা পড়বে মাত্র!

কোনও জিনিস লুকিয়ে রাখতে গেলে, আগে কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিসকে সামনে এনে দিতে হয়। ভাব দেখাতে হয় যে, ধরা পড়ে গেলাম! এতে বিপক্ষ সামান্য হলেও রিল্যাক্সড হয়ে যায়। যেমন হয়েছে নিক্তো!

ফ্রান্সিস আবার দরজাটা একবার দেখে নিলেন। তারপর ক্রসটাতে মন দিলেন।

উনত্রিশ

টিভির থেকে চোখ সরিয়ে সিএম বললেন, “লেফট্যানেন্ট জেনারেল বকশি তো বেরিয়ে গেলেন। মেজর জেনারেল সুদও কি পৌঁছে গেছেন ময়দানে?”

মলয়বাবু রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, “ম্যাডাম উনি বেরিয়ে পড়েছেন, কিন্তু এখনও পৌঁছননি! শ্রীতমা ওখান থেকে আমাদের আপডেট দিলেন। আর হ্যাঁ, রাজীববাবুও পৌঁছে গেছেন।”

জেটলিজি এবার টেবিলে রাখা গ্লাস থেকে জল খেলেন একটু। তারপর বললেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীজির সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বলেছেন যতটা সময় ঠেকিয়ে রাখা যায় লোকটিকে। আমাদের রেসকিউ টিম তো কাজে লেগেছে। যদি ওঁদের পাওয়া যায়, তা হলে ওই টেররিস্টটির অপশন কমে যাবে। ওকে তখন ডিফিউজ় করা সুবিধেজনক হবে।”

সুব্রতবাবু বললেন, “কিন্তু দেখলেন তো একটু আগে ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন, ও বলল ছ’টার সময় সব কথা হবে। ধরুন আমরা ক্যাপটিভদের যদি রেসকিউ করেও নিই তারপরেও যদি স্ট্যান্ড ডাউন না করে?”

জেটলিজি বললেন, “তা হলে তো…”

“তা হলে তো একটাই পথ খোলা থাকে,” সিএম থামলেন সামান্য, “আমরা কিছুতেই ওর কাছে মাথা নোয়াব না।”

পার্থবাবু বললেন, “কিন্তু তা হলে তো ওই বাড়িটা…”

সিএম মাথা নাড়লেন, “যা হওয়ার হবে। আমরা একটা সন্ত্রাসবাদীর কাছে মাথা নোয়াতে পারি না। আমার মনে হয় ওই বাড়িটা যদি ও উড়িয়ে দিতে চায়, দিক। কিন্তু আমরা মাথা নোয়াব না কিছুতেই। আমায় রাজীবজির সঙ্গে কথা বলিয়ে দিন। এবার আমাদের কড়া স্টেপ নিতেই হবে। অনেক হয়েছে, আর নয়। ছ’টার সময় ও পজ়িটিভ কিছু না বললে ওকে শিক্ষা দিতে হবে আমাদের। উচিত শিক্ষা।”

ত্রিশ

১৯ জুলাই। ডেভনপোর্ট, নিউ জ়িল্যান্ড।

ঘরের ভেতরে রুম হিটার চলে তাই ঠান্ডা নেই। লিসা অঘোরে ঘুমোচ্ছে এখন! কিন্তু জনের চোখে ঘুম নেই একটুও। ও বুঝতে পারছে যে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ ফাদারের ওই কো-অর্ডিনেট-এর আলোটা জ্বলেছিল, তারপর নিভে গেছে! কিন্তু ইন্টারনেটে কলকাতার যা খবর পড়ছে তাতে এখনও অবস্থার উন্নতি হয়নি! সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে ফাদারের ট্রান্সমিশনটা ধরা পড়ে গেছে! ফাদারের কিছু হয়নি তো!

লিসা আজকে বারেবারে আদর করতে চাইছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কী, জনের মন বসছে না!ফাদারের কাছে ও নিজেও মানুষ হয়েছে। তাই মানুষটার কিছু হলে ও নিজেও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে!

ট্রান্সমিশনের সিগনালটা অফ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কিন্তু তাও মনিটারের সামনে ঠায় জেগে বসে রয়েছে জন। যতটুকু ও ফাদার ফ্রান্সিসকে জানে হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক উনি নন। মাঝ রাত পেরিয়ে গেছে সময়, কিন্তু জেগে রয়েছে জন তাও। ফাদার কী করছেন এখন! আর অ্যাডাম! অদম্য! সে কই?

ফিসে থাকার সেই দিনগুলো হঠাৎ মনে পড়ে গেল জনের! একসঙ্গে স্কি করা থেকে ট্রেকিং! কী না করত ওরা! ওর সাহস একটু কম ছিল। কিন্তু অদম্য…

আচমকা একটা বিপ্‌ শব্দ হল। সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল জন। এবার সচকিত হয়ে উঠল! আরে মনিটারে ওটা কী!

আগের সেই জায়গার থেকে আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে আড়াই কিলোমিটার মতো দূরে সিগনালটা পাওয়া যাচ্ছে এবার! কিন্তু সিগনালটা আগের মতো স্থির নয়। কেমন একটা প্যাটার্নে দপদপ করছে!

জনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল! আরে এ যে ডিসট্রেস কল! ফাদার যে মর্স কোডে সংকেত পাঠাচ্ছেন! জন ভাল করে দেখল। ফাদার লিখছেন ‘হেলপ!’ আরে ওটা কী লিখলেন!

জন ভাল করে তাকিয়ে দেখল মনিটারে আলো দপদপ করছে। মর্স কোডে ভেসে আসছে অক্ষর! ‘মোল’! মানে আগের বারের সংকেতটা কেউ ফাঁস করে দিয়েছে!

জন তাকিয়ে দেখল ভাল করে। তারপর দ্রুত লিঙ্কটা পাঠিয়ে দিল নির্দিষ্ট জায়গায়।

মার্কোসের কম্যান্ডো, ওই আদিল লোকটি নিশ্চয় এবার আগের মতো আর বিফল হবে না।

একত্রিশ

১৯ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

সামনের দিকে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল আদিল! জায়গাটা আগাছায় ভরতি! পুরনো বড়, প্রায় ভেঙে পড়বে এমন অনেকগুলো বাড়ি বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। এগুলো আসলে কোয়ার্টার। ব্রিটিশদের তৈরি করা।

ওর মোবাইলে আসা লোকেশন ইন্ডিকেটরে যে জায়গাটা দেখাচ্ছে সেটা এই সামনের বাড়িটা। পুরনো দিনের বাড়ির দেওয়ালে একটা নম্বর লেখা। কোয়ার্টার নম্বর, ৬/৯। আদিল দেখেছে সব ক’টা বাড়ির গায়েই এমন নম্বর দেওয়া আছে।

কে পাঠাচ্ছে ওকে এই লোকেশন সেটা মোটামুটি বুঝতে পারছে আদিল! কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না ফাদারের এমন বিপদ সত্ত্বেও অদম্য নিজে আসছে না কেন? কেন দূর থেকে ওকে এমন লোকেশন পাঠাচ্ছে! অদম্য কোথায়?

আগের তিনজন এনএসজি-র সঙ্গে আরও দশজন এসে জড়ো হয়েছে। আদিল নিজের সঙ্গে রেখেছে দু’জনকে। বাকিদের ছড়িয়ে দিয়েছে বাড়িটার আশেপাশে। পেছনের দিকেও রেখেছে কয়েকজনকে। এসকেপ রুট আর দেওয়া যাবে না।

বাড়িটার সামনে আর একটা ভাঙা বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়ে এবার ফোনটা বের করল আদিল।

“স্যার, আমরা লোকেশন পেয়ে গিয়েছি! চারিপাশে কর্ডন করা হয়ে গেছে! আমরা কি…”

আদিল কথা শেষ করার আগেই সুদীপ বললেন, “কোথায় আছ তোমরা? আমি এসে গেছি প্রায়! ওর কি পালাবার কোনও উপায় আছে?”

“না নেই,” আদিল সংক্ষেপে বলল।

“আমায় ছাড়া এগোবে না। বলো কোথায় আছ?”

আদিল বলল, “গঙ্গার পাশে যে-পরিত্যক্ত কোয়ার্টার আছে সেখানে। ৯/৬ স্যার। প্লিজ়। কুইক।”

আরও মিনিট পাঁচেক পরে আলতো পায়ের শব্দে পেছনে ফিরে তাকাল আদিল। সুদীপ এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ভাঙা বাড়িটার থামের আড়ালে।

আদিলের সঙ্গে চোখে ইশারা করলেন সুদীপ। হাতের ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন যে, বাকিদের স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে দাঁড় করিয়ে রেখে সুদীপ আর আদিল এগোবে!

আদিল বলল, “স্যার আপনি এখানে থাকুন। আমি দেরি করলে ভেতরে আসবেন। আমাদের একসঙ্গে যাওয়াটা ঠিক হবে না।”

“কিন্তু…”

“প্লিজ় স্যার,” আদিল বলল, “দু’জনের ভালনারেবল পজ়িশনে পড়াটা ঠিক হবে না। কে জানে ও ভেতরে কী ট্র্যাপ পেতে রেখেছে?”

সুদীপ আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির সামনের একটা ঝোপের আড়ালে পজ়িশন নিলেন।

আদিল মাথা নিচু করে ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে!

বাড়ির ভেতরটা আবছা অন্ধকার। সামান্য চোখ সয়ে যাওয়ার পরে আদিল ডান দিকে বাঁক নিল। কারণ বাকি বাড়িটার দরজা জানালা বলে কিছু না থাকলেও ওই ডানদিকের দূরের ঘরটায় নতুন একটা দরজা লাগানো আছে।

আদিল জানে তাড়াহুড়ো করলে বিপদ আছে। ঘরটায় একটাই ঢোকার দরজা।

চারিদিক নিস্তব্ধ। নিজের শ্বাসের শব্দটাও শোনা যাচ্ছে যেন! আদিল দেখল দরজার পাল্লাটা সামান্য খোলা! ও বুঝল এটাই সুযোগ! যে-কোনও লড়াইতে এলিমেন্ট অব সারপ্রাইজ় খুব প্রয়োজনীয় একটা কৌশল।

আদিল চোয়াল শক্ত করল তারপর দ্রুত গতিতে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে ঢুকে পড়ল ঘরে!

কিন্তু ঘরে ঢুকে কীসে যেন একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ও পড়ে যাওয়া অবস্থা থেকে দ্রুত ঘুরে উঠতে গেল, কিন্তু পারল না।

একটা পা ওর বুক চেপে ধরেছে! লোকটা লম্বা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে গায়ে ভীষণ জোর। মাথার চুলগুলো সোনালি। লোকটার মুখে অদ্ভুত হাসি! ডান হাতের পিস্তলটা ওর দিকে তাগ করা আর বাঁ হাতেরটা তাগ করা ঘরের অন্য পাশে দেওয়ালের সঙ্গে বেঁধে রাখা দু’জন মানুষের দিকে!

আদিল বুঝল, দরজাটা খুলে ওকে ট্র্যাপ করেই এখানে আনা হয়েছে! হোঁচট বলে যেটা মনে হচ্ছে সেটা আর কিছু না, এই লোকটাই দরজার আড়াল থেকে ওকে পা দিয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে মাটিতে!

“ইডিয়ট!” লোকটা হাসল, “আমি কি জানি না তোমরা এখানে এসে ভিড় করেছ! কিন্তু তুমি এমন বোকা হবে বুঝতে পারিনি। তবে আমার ভালই হল। তোমাকেও আটকে রাখব এদের সঙ্গে! আর যতক্ষণ না এখান থেকে বাকি লোকজনকে ক্লিয়ার করবে তোমার শরীরের একটা একটা করে অংশ কেটে আমি তোমার গভর্নমেন্টের কাছে পাঠাব!’

“তুমি পার পাবে ভেবেছ? পালাবে ভেবেছ?” আদিল মাটিতে শুয়ে তাকাল লোকটার দিকে। দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে আছে শয়তানটা!

“পালাব!” লোকটা হাসল, “কেন পালাব জানো? কারণ মোল!”

আদিলের বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল। ওই লোকেশন ইন্ডিকেটারের সঙ্গে মেসেজও এসেছে একটা। তাতেও লেখা ছিল মোল! ওদের ভেতরে কোনও স্পাই আছে!

লোকটা বলল, “মোল যেখানে থাকে সেই জায়গাকে ভেতর থেকেই কাটে, জানো তো! তেমন তোমাদের সরকারের ভেতরেই…”

কথাটা শেষ করতে পারল না লোকটা আচমকা পেছনের দিকে ‘টিউব’ ‘টিউব’ করে শব্দ হল দুটো। আদিল রিফ্লেক্সে কুঁকড়ে গেল! আর লোকটা স্তম্ভিত হয়ে গেল যেন মুহূর্তের জন্য। তারপর সোজা মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে।

আদিল দেখল দরজার কাছে সুদীপ দাঁড়িয়ে রয়েছেন!

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!” আদিল মাটি থেকে উঠল এবার। দুটো বুলেট লোকটার গলা ফুঁড়ে চলে গেছে!

সুদীপ বললেন, “আমি কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি ওভাবে! তুমি এখুনি জানিয়ে দাও হস্টেজেস আর ফ্রি!”

আদিল দেখল ঘরের কোনার দু’জন মানুষকে। তাঁরা তাকিয়ে রয়েছেন। ফাদারকে চিনতে অসুবিধে হল না ওর। বৃদ্ধ মানুষটি হাতে একটা ক্রস চেপে বসে রয়েছেন! আদিল হাসল। তারপর ফোনটা বের করে ডায়াল করল। বলল, “মিশন অ্যাকমপ্লিশড।”

ও দেখল সুদীপ এগিয়ে যাচ্ছেন দু’জন হতভম্ব মানুষের দিকে! আদিল মনে মনে আবার বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

বত্রিশ

এনএসজি-র অপারেশনাল কমান্ডার কপিল যাদব অবাক হয়ে তাকালেন মেজর জেনারেল বিক্রম সুদের দিকে! কী বলছেন কী উনি! হামলা করতে হবে? ওই পাগল লোকটা ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’-এ বোমা লাগিয়ে রেখেছে! সেটা দেখিয়েওছে সবাইকে! বলেছে ওর ওপর হামলা করতে এলে সব কিছু উড়িয়ে দেবে! আর সেখানে কিনা ওকে অর্ডার দেওয়া হচ্ছে চারিদিক দিয়ে হামলা করতে!

কপিল কী বলবে বুঝতে পারল না প্রথমে। তারপর বলল, “স্যার, লোকটা কিন্তু লাস্ট দু’ ঘণ্টা আর বাইরে এসে দাঁড়ায়নি! ওই অ্যাবোডেই আছে। আমাদের জওয়ানরা কাছে যাওয়ার পর যদি বম্ব ডিটোনেট করে! তা হলে…”

বিক্রম মাথা নাড়লেন, “আমার কিছু করার নেই। নেশান আন্ডার থ্রেট। ডিফেন্স মিনিস্ট্রি থেকে এই নিয়ে নির্দেশ এসেছে! স্টেটের সিএম বলেছেন টেররিস্টকে থামাতে হলে যে-কোনও স্টেপ নিতে হবে। পিএম নিজে গ্রিন সিগনাল দিয়েছেন! এই থ্রেটকে নিউট্রলাইজ় করতেই হবে!’

“ওকে স্যার,” কপিল আর সময় নষ্ট করল না। ঘড়িতে এখন ছ’টা বাজতে দশ। আর মিনিট দশেক বাকি আছে ডেড লাইনের।

মাইন প্রোটেকটেড ভিইকেল বা এমপিভি সকালেই আনা হয়েছিল। এবার ওই দুটোকে দ্রুত নির্দেশ দিল কপিল। সামনে এবং পেছন দু’দিক দিয়ে দুটো এগিয়ে যাবে অ্যাবোডের দিকে। আর তার থেকে কিছুটা দূরে থাকবে চল্লিশজন করে মোট আশিজন এনএসজি কম্যান্ডো! আর সবার পেছনে দমকলের গাড়ি। অ্যাবোডের সিঁড়ির কাছে গিয়ে ভিকেলের ভেতর থেকে গুলি করে লোকটাকে জখম করে দিতে হবে। তার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটালে অ্যাবোডের ক্ষতি হবে, কিন্তু মানুষ মারা যাবে না। কারণ গাড়িগুলো বোমার থেকে যাতে সুরক্ষিত থাকে তেমন করেই বানানো!

কপিল একবার বিক্রমের দিকে তাকাল, বলল, “উই আর গুড টু গো।”

বিক্রম কী একটা চিন্তা করে ঘড়িটা দেখে নিলেন। মাথা নেড়ে এবার বললেন, ‘গো।’

অ্যাবোডের বিপরীত দিক থেকে দুটো ভিকেল এগোতে লাগল। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে এনএসজি-র দুটো টিমও এগোচ্ছে! একটা টিমের সামনে কপিল নিজে আছে! কালো পোশাক, কালো হেলমেট পরে হাতে ‘উজি এসএমজি’ অটোমেটিক বন্দুক নিয়ে এগোচ্ছে কপিলরা!

কপিল চোয়াল শক্ত করে একবার মাথা ঘুড়িয়ে দেখল। বিকেল থেকে আরও মেঘ করে এসেছে! বৃষ্টি কি আসবে? ওই দূরে আবছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে পরির বাড়ি! আজ কী লেখা আছে পরির কপালে!

সামনের গাড়িটা এবার গতি বাড়াল। কপিলও ওর টিম নিয়ে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে!

তেত্রিশ

অদম্য শেষের দু’ ঘণ্টা বেরোয়নি এই অ্যাবোড থেকে! কিন্তু এখন নিশ্চিন্ত ও! ফাদার বিপদ মুক্ত! ঠিক সময়ে আদিল বাঁচিয়ে দিয়েছে! খবরটা জনের থেকে পাওয়ামাত্র ও ফেরিসের দেওয়া ডিভাইসটা অকেজো করে দিয়েছে! এখন ওকে আর ফেরিস কিছু করতে পারবে না!কিন্তু বিপদটা অন্য জায়গায়! এখান থেকে এবার বেরোবে কী করে ও! সত্যিটা বললে এখন আর কেউ মানবে না! ওকে নিজের ওপরই ভরসা করতে হবে।

অদম্য মাথা তুলে ডোমের ভেতরের সিলিংটার দিকে তাকাল। ওই ওপরে পরির পায়ের কাছটা দেখা যাচ্ছে। তার সঙ্গে বাইরে কয়েকটা ক্যানিস্টার লাগানো আছে থামের গায়ে! ইলেকট্রিকাল বক্সের ভেতরে। আর এই অ্যাবোডের ভেতরেও এই দু’ঘণ্টার মধ্যে বেশ কিছু ক্যানিস্টার লাগিয়ে রেখেছে ও। এখন দেখা যাক কী হয়!

বাঁ হাতের রিমোটটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে তাকাল অদম্য। ওই গাড়ি আসছে! এটাই স্বাভাবিক! কিডন্যাপড মানুষ যখন উদ্ধার হয়ে গেছে তখন তো ওরা আসবেই! অদম্যর গোটা প্ল্যানিংটা তো এমন সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করেই তৈরি!

ও জানে এবার কী হবে? ওই গাড়িটা কাছে এসে হয় অজ্ঞান করার বোমা ছুড়বে, নয়তো ব্রাশ ফায়ার শুরু করবে! পেছনে পেছনে চলে আসবে এনএসজি। এখান থেকে বেরোনো তাই খুব কঠিন! অদম্য একাগ্রভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল।

গাড়িটা এগিয়ে আসছে। ওই চলে এল প্রায় অ্যাবোডের কাছে! আর সময় নেই! যা করার এবার করতে হবে! হয় এসপার নয় ওসপার! বাঁ হাতে ধরা রিমোটের বোতামটা টিপে দিল ও!

চৌত্রিশ

এমপিভি-টা আচমকা থেমে গেল অ্যাবোডের সিঁড়ির কাছে! কপিল অবাক হয়ে দেখল হঠাৎ ফট ফট করে কিছু শব্দ হল অ্যাবোডের ভেতরে আর বাইরের থামগুলোর থেকে। গুলি চালাচ্ছে নাকি লোকটা? কিন্তু না! কপিল কিছু বোঝার আগেই অ্যাবোডের ভেতরে, বাইরে, সবদিক নিমেষে ভরতি হয়ে গেল ঘন কালো ধোঁয়ায়।

কপিল বুঝল ভেতরের লোকটার অন্য কোনও প্ল্যান আছে। ও দ্রুত হেলমেটের সঙ্গে লাগানো মাইকে নির্দেশ দিল, ‘ডোন্ট শুট। ইনভেড।’

আর সঙ্গে সঙ্গে দু’দিক থেকে আসা আশিজন এনএসজি ঢুকে পড়ল ‘এঞ্জেলস অ্যাবোড’-এ।

কালো ঘন ধোঁয়া। কিছুই দেখা যাচ্ছে না! শুধু পায়ের আওয়াজ! অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো! এভাবে কিছু পাওয়া যাবে না। বরং কাশি হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।

কপিল কাশির দমকের মধ্যে দমকলের গাড়িকে নির্দেশ দিল ওয়াটার ক্যানন চালাতে। জলই একমাত্র উপায় এখন।

আর নির্দেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দু’ দিক থেকে জলের তোড় এসে ভাসিয়ে দিতে লাগল অ্যাবোডের ভেতরটা।

ধোঁয়া কাটতে লাগল ক্রমে। আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে লাগল দৃশ্য। আর মিনিট পাঁচেক পরে যখন সবটা পরিষ্কার হয়ে গেল, বাইরে থেকে বড় আলো ফেলা হল বাড়ির ভেতরে। দেখা গেল জল থইথই ঘরে এনএসজি-র কম্যান্ডোরা ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে একটা চেন খোলা খালি পিঠের ব্যাগ, ঢোলা সেনাদের ইউনিফর্ম আর একটা মুখোশ।

কপিল অবাক হয়ে তাকাল সেই দিকে। সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কম্যান্ডোদের মুখেও অবাক ভাব! কী হল ব্যাপারটা! একটা গোটা মানুষ কি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! এটা কি ম্যাজিক!

কপিল কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকাল এদিক ওদিক! পকেট থেকে টর্চ বের করে ওপরের দিকে এবার ফোকাস করল! পরির পায়ের দিকে যেখানে সেমটেক্স লাগানো ছিল সেখান থেকেও ওই কালো ধোঁয়াই বেরিয়েছে! যেমন ঘরের ভেতরের ক্যানিস্টার থেকে বেরিয়েছে বা বাইরের থামে লাগানো ক্যানিস্টার থেকে বেরিয়েছে!

হতাশ হয়ে কপিল মাথা নাড়ল। তারপর কোমর থেকে ম্যান প্যাক বের করে বলল, “এঞ্জেল ইজ় সিকিয়োর্ড। বাট দ্য টার্গেট ডিসঅ্যাপিয়ার্ড!”

কথা শেষ করে সামান্য চেঁচিয়ে বাকি কম্যান্ডোদের উদ্দেশে কপিল বলল, “লেটস গো ব্যাক। কলকাতা পুলিশ লোকেশন সিকিয়োর করবে। মুভ।”

আর একবার ঘরের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে কপিল বেরিয়ে এল মাঠে। বাকি কম্যান্ডোরাও অনুসরণ করল কপিলকে। আর তখনই কালো মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামল কলকাতায়!

পঁয়ত্রিশ

২২ জুলাই। কলকাতা, ভারত।

ডিনার পার্টি থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িটা খুঁজছিল আদিল। ঠিক তখনই ভ্যালে ছেলেটা এগিয়ে এল।

আজ সন্ধেবেলা উদ্বোধন হয়েছে পরির বাড়িটি! আর তারপর স্যার পিটার রায়ানের সম্মানে ডিনার দেওয়া হয়েছে।

সিএম আদিলের খুবই প্রশংসা করেছেন। কিন্তু আদিল সবিনয়ে বলেছে যে, লেফট্যানেন্ট জেনারেল সুদীপ বকশি না থাকলে ও মারাই যেত!

সুদীপ মানতে চাননি! বারবার বলেছেন, “আদিল যদি না লোকেশন খুঁজে বের করত, যদি ওঁকে না ঠিকানাটা জানাত কিছু হত না!”

ওখানে থাকতে থাকতেই আর একটা খবরও পাওয়া গেল যে, ভারতের ডিফেন্স মিনিস্ট্রি স্থগিত হয়ে যাওয়া আর্মস কেনার টেন্ডার আবার কার্যকর করেছে! কারও চাপে দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টিকে কম্প্রোমাইজ় করা হবে না।

শাহিন অপেক্ষা করছে আজ আদিলের। শাহিনকে তো একটুও সময় দিতে পারে না ও! তাই সবার থেকে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু গাড়িটা যে কোথায় গেল!

“স্যার? গাড়ির নম্বরটা বলবেন, আমরা কল করে দিচ্ছি!”

আদিল বলল, “ডব্লিউ বি জিরো ফোর টু সিক্স টু এইট।”

ভ্যালে ছেলেটি মাইকে বলল, “কার নম্বর ডব্লিউ বি জিরো ফোর টু এইট টু সিক্স। প্লিজ় কাম টু দ্য ফ্রন্ট এন্ট্রান্স।”

“টু সিক্স টু এইট। টু এইট টু সিক্স নয়,” আদিল বলল।

“সরি স্যার!” ছেলেটি আবার মাইকের দিকে ফিরল।

আদিল হাসতে গিয়েও হঠাৎ পাথর হয়ে গেল! কী হল ব্যাপারটা! তাই তো! এটা কী করে হল?

আদিল দ্রুত পেছনের দিকে তাকাল, সারা শরীর কাঁপছে ওর। মনে পড়ছে সার দেওয়া পুরনো বাড়ি। মনে পড়ছে ফোন কল। সেই মেসেজ।মোল! ভেতরে থেকে যে সব কিছু কেটে দেয়! সত্যি তো, এটা কী করে হল! এটা কী করে এড়িয়ে গেল ওর চোখ।

পেছনে তাকাল আদিল। দরজা বন্ধ। দরজার ওপারে অনেক লোকজন আর তার মধ্যে আছে সে। কিন্তু তাকে কে ধরবে, কে শাস্তি দেবে তার! আদিল মাথা নিচু করে নিল। বুঝল দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কোস কম্যান্ডো হয়েও আসলে ওর ক্ষমতা নেই কোনও।

গাড়িটা এসে দাঁড়াল সামনে। আদিল যন্ত্রের মতো উঠে গেল। মাথা কাজ করছে না। ভ্যালে ছেলেটা দরজা বন্ধ করে জানালা দিয়ে একটা বড় প্যাকেট দিল ওকে। বলল, কে যেন দিয়ে গেছে! কে দিয়েছে? কী ওটা। আদিলের জিজ্ঞেস করার মতো অবস্থায় নেই! ও কোনওমতে নিল প্যাকেটটা!

গাড়িটা রাতের কলকাতা দিয়ে ছুটছে। আদিল অন্যমনস্কভাবে এবার বড় প্যাকেটটা খুলল। আরে এটা কী?

ও দেখল বড় প্যাকেটের মধ্যে অনেকগুলো আপেল! আর তার মাঝে ছোট প্লাস্টিকের খাপের ভেতর একটা চাকতির মতো জিনিস৷ লেন্স! ক্যামেরা!

একটা ছোট্ট কাগজ আছে সঙ্গে! লেখা— ‘কনট্যাক্ট জেনি, রিপোর্টার! ইউজ় দিস! দিন আর সময় জানিয়ে দেওয়া হবে।’

এটা কে দিল ওকে! কী মানে এর! আদিল আবার দেখল কাগজটা। প্যাকেটে এত আপেল! আদিল সচকিত হয়ে উঠল হঠাৎ। আপেল মানে? অ্যাডাম! অদম্য!

ছত্রিশ

২৫ সেপ্টেম্বর। আলওয়ার, রাজস্থান, ভারত।

“আজ হঠাৎ!”

প্রশ্নটা শুনে চোয়াল শক্ত করল আদিল, “এই মিস্টার ফেরিস আজ আসবেন জানতাম। জানতাম আপনার সঙ্গে ওর দেখা হবে।”

“কীভাবে? আর হলেও বা কী! টেন্ডারে পার্টিসিপেট করছেন মিস্টার ফেরিস। আসতেই পারেন।”

“আমি কিন্তু জেনে গিয়েছি। সবটা জেনে গিয়েছি!” আদিল নিজেকে সংযত করল। হোটেলের ঘরটা বেশ বড়। এসি চলছে। মিস্টার ফেরিস বসে রয়েছে একপাশে।

“তো তুমি জেনে ফেলেছ।” এবার হা হা করে হাসলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুদীপ বকশি, “কী জেনেছ?”

আদিল শক্ত গলায় বলল, “আমি তাড়াহুড়োয় সেদিন আপনাকে বাড়ির ভুল ঠিকানাটা বলেছিলাম। আপনি কী করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেলেন? যে আড়াল থেকে আমায় সব জানাচ্ছিল সে বলেছিল মোল আছে এর মধ্যে! ওই কিডন্যাপার লোকটি সেই কথাটা বলতেও যাচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই কেন আপনি ওকে মেরে ফেললেন? আহতও তো করা যেত! আর কেন আমায় অপেক্ষা করতে বললেন আপনার আসার জন্য! এ ছাড়া আমি খবর নিয়ে দেখলাম আপনি সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন আর্মস কেনা নিয়ে! কেন?”

“এসব ফালতু যুক্তি!কাজের নয়,” সুদীপ হাসলেন, “বোকা ছেলে! আরে সলিড প্রুফ আনতে হয়! ঠিক আছে, আমিই বলছি। কাট মানি৷ কাট মানি বোঝো? জানো ফেরিস কত দিচ্ছে আমায়! ফেরিস কত কামাবে জানো? ইট্স বিজ়নেস! আর দেখো নো হার্ম ডান! কিচ্ছু হল না! ম্মুথলি বেরিয়ে গেল সবটা।”

“এটা করে পার পেয়ে যাবেন ভেবেছেন?”

“যাব তো। ইন ফ্যাক্ট গেছি! ফিউচারে আরও এমন অনেক কিছু করব। মানি ইজ় ফ্লোইং! একটা দেশের চারিদিকে যখন এত শত্ৰু, তখন আর্মস তার লাক্সারি নয়, নেসেসিটি,” হাসলেন সুদীপ, “ইউ ক্যান্ট প্রুভ এনিথিং। সো, মাথা গরম না করে কাটো বাছা! নাহলে এমন জায়গায় ট্রান্সফার করব যে, বাপ মায়ের মুখ দেখতে পারবে না ছ’মাস! কাটো।”

আদিল হাসল। কোটের লেপেল পিনটা ঠিক করে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। হ্যাভ আ নাইস লাইফ।”

রুম থেকে বেরিয়ে ফোনটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করল আদিল। কানে লাগিয়ে বলল, “ঠিক এসেছে তো জেনি?”

জেনি বলল, “ইয়েস। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার! গোটা জিনিসটা জেটলি স্যারের কাছে চলে যাবে। আমি সিএম ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি।”

আদিল হাসল। করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখল একটা রুমের বাইরে খাবারের ট্রে রাখা। তাতে একটা আধখাওয়া আপেল পড়ে আছে। আদিল হাসল। অদৃশ্য জাদুকর!

সাঁইত্রিশ

গাড়িটা আচমকা থেমে গেল মাঝপথে। চারিদিকে ফাঁকা জমি। হাইওয়ে! গাড়িটা এমন করে থামল কেন?

“হোয়াট হ্যাপেন্ড?” পাশের থেকে ফেরিস জিজ্ঞেস করল।

সুদীপ গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় নামলেন। গাড়ির পেছনের দিকে দেখে নিয়ে বললেন, “আরে তেল লিক করেছে! কী করে হল কে জানে! ডিসগাস্টিং!”

ফেরিসও নামল রাস্তায়!এদিক ওদিক তাকাল!লম্বা সাপের মতো হাইওয়ে। তেলের দাগ! কেউ কোথাও নেই! শুধু ওই দূরে একটা বাইক আসছে। ফ্যাট ফ্যাট শব্দ হচ্ছে তার।

“যাঃ দেরি হয়ে যাবে?” মাথা নাড়ল সুদীপ, “পোলো ম্যাচটা স্টার্ট হয়ে যাবে! একে তো হোটেলে ওই গাধাটা এসেছিল আর এখন…”

ফেরিস বলল, “ওই বাইকটাকে থামাও। পে হিম। ওর সঙ্গে চলে যাই। পরে লোক নিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে যাবে।”

“ঠিক আছে!” হাসল সুদীপ।

কাছে এসে গেছে বাইকটা। হাত তুলে থামাল ওটাকে। বাইকে বসা লোকটার গায়ে রাজস্থানি পোশাক। মাথায় লাল পাগড়ি!

সুদীপ বলল, “আমাদের কাছের টাউনে নিয়ে চলো। গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে! টাকা দেব! যাবে?”

“তেল নেই!” লোকটা গাড়ি থেকে নেমে এসে পাশে ঝোলানো একটা জ্যারিকেন নামিয়ে বলল, “আমার কাছে আছে! নিয়ে এসেছি আমি!”

“তেল?” সুদীপ হেসে তাকাল ফেরিসের দিকে, “হি হ্যাজ় ফুয়েল। লাকি ডে ফর আস!”

“ইনডিড!” কথাটা বলেই লোকটা আচমকা বিদ্যুৎ গতিতে এসে একটা হিঞ্জড হ্যান্ডকাফ ফেরিসের হাতে পরিয়ে তার আর একটা দিক আটকে দিল সুদীপের হাতে। তারপর এক ধাক্কায় দু’জনকে মাটিতে ফেলে দিল। সুদীপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ঘটনার আকস্মিকতায়! ফেরিসও ঘাবড়ে গেছে। ওরা কিছু করার আগেই এবার লোকটা দ্রুত মাথার পাগড়ির কাপড় দিয়ে ফেরিসের আর একটা হাত জড়িয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল গাড়ির দরজার সঙ্গে।

সবটা ঘটে যেতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল মাত্র!

ফেরিস মাটিতে পড়ে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। আকাশে গনগনে রোদ। সূর্য এসে ধাক্কা মারছে চোখে! কিছু ভাল করে দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেটা হাতের জ্যারিকেনের ঢাকনাটা খুলে ধীরে ধীরে সাবধানে ঢালল ফেরিসের গায়ে। বলল, “অস্ত্র বিক্রি করে পৃথিবীকে পোড়াতে খুব ভাল লাগে, না? আর কাকে কাকে যেন পোড়াবে বলেছিলে ফিস গ্রামের চার্চে?”

“আ-আমায় ছেড়ে দাও… আমি কিছু করিনি…” সুদীপ আরও কিছু বলতে গিয়েছিলেন কিন্তু পারলেন না।

ছেলেটি বলল, “চুপ! আপনি কাছের থেকে দেখবেন বন-ফায়ার কাকে বলে! আপনাকে পোড়াব না, আপনার অন্য ব্যবস্থা হয়ে গেছে!”

“কত টাকা চাও?” এবার ফেরিস জিজ্ঞেস করল কাঁপা গলায়।

“টাকা লাগবে না!” ছেলেটা বলল, “তুমি পুড়বে আর সুদীপ দেখবে। বক্স সিট থেকে দেখবে! সব সময় টাকা ইমপরট্যান্ট নয়। তুমি ভুল জায়গায় হাত দিয়েছিলে! ফাদারকে টাচ করা তোমার উচিত হয়নি।”

“ফা…” ভয়ে ফেরিসের চোখটা বেরিয়ে এল যেন, “জোকার! এদেল বলেছিল… তুমি অ্যাবোড থেকে বাঁচলে কী করে?”

“ম্যাজিকের ট্রিক জানতে চাইছ? লাস্ট উইশ?” দেশলাই জ্বালিয়ে ছেলেটা হাসল, “স্মোক স্ক্রিন! রিমোট কন্ট্রোলড ধোঁয়া তৈরির ক্যানিস্টার! ঢিলে আর্মির পোশাকের তলায় পরে থাকা এনএসজি-র পোশাক। পিঠের ব্যাগে হেলমেট! স্মোকের আড়ালে ঢিলে পোশাক ছেড়ে এনএসজি-র পোশাক পরা অবস্থায় ওদের সঙ্গে মিশে যাওয়া কী আর কঠিন! ওই আবছায়া অন্ধকারে, টেন্সড সময়ে এটা তো কঠিন নয়! আর শোনো, জোকার নয়। এটা গোথাম নয়! আমি ফিস গ্রামের সামান্য একটা ছেলে। ফাদার আমায় নতুন জীবন দিয়েছেন! নতুন নাম দিয়েছেন। শেষ কয়েক মুহূর্ত সেই নামটা মনে রাখার চেষ্টা কোরো!”

ফেরিস ভীত চোখে তাকিয়ে রইল।

ছেলেটা জ্বলন্ত দেশলাই নিয়ে ঝুঁকে পড়ল সামনে। তারপর হিসহিসে গলায় বলল, “আমার নাম সেন, অদম্য সেন।”

(এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল থাকলে আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *