বরফের তরোয়াল

বরফের তরোয়াল

ও লোকটার কলার ধরে টেনে তুলল। লোকটার চোখ স্থির। শরীরের পাঁচ- ছ’টা ক্ষত থেকে উপচে পড়ছে রক্ত।

আদিল লোকটার উপর ঝুঁকে বলল, কে তুমি? কে?

লোকটা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু শব্দের বদলে মুখ দিয়ে উঠে এল রক্ত। তবু তার মধ্যেও লোকটা আবছা গলায় বলল…

এক

২ এপ্রিল, ২০১৬ পেতারে, ভেনেজুয়েলা।

চার্চের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালেন লিয়াম। আজ হাওয়া দিচ্ছে বেশ। ঠান্ডা চলে গেলেও তার ফেলে যাওয়া দু’-চারটে শীতের কুচি এখনও যেন ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। কোটের সামনের বোতামগুলো ভাল করে আটকে সিঁড়িতে পা দিলেন লিয়াম। আর-একবার ইচ্ছে হল পিছনে ফিরে তাকানোর, কিন্তু বারণ আছে। লিয়াম জানেন যে, এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে ওঁকে। আর কাউকে বুঝতে দিলে চলবে না, আজ এই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা। বুঝতে দেওয়া যাবে না বন্ধুর হাতে কী তুলে দিলেন আজ।

চার্চটার নাম ডালচে নম্নে হেসুস দ্য পেতারে। খুব সুন্দর দেখতে এই উপাসনালয়টি। হালকা গোলাপি রঙের দেওয়াল। চারদিকে সাদা বর্ডার দেওয়া। বড় টানা বারান্দা থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে রাস্তা অবধি। সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে একবার আকাশের দিকে তাকালেন লিয়াম। নীল আকাশ, সাদা মেঘের কমা-দাঁড়ি আর সেমিকোলন নিয়ে ঝলমল করছে!

আহা, ওঁর জীবনটাও যদি এমন শান্ত আর নির্বিঘ্ন হত! কিন্তু হবে না। লিয়াম জানেন, ওঁর জীবনটা আর আগের মতো থাকবে না। প্রায় চার দশক আগে শেষ করা একটা কাজ আবার ভূতের মতো জেগে উঠেছে এখন। সেই অশরীরী এখন তাড়া করবে ওঁকে। ঈশ্বরের উপর মানুষ যখনই কলম চালাতে গিয়েছে, এমনটা হয়েছে। প্যান্ডোরার বাক্স খুলে বেরিয়ে এসেছে বিপদ। গত আঠারোই অক্টোবর সেটা বুঝতে পেরেছেন ভালভাবে।

লিয়াম নিজের কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে প্রভু যিশুর ছোট্ট কাঠের ক্রসটা ধরলেন একবার। আজ বন্ধু এটা ওঁকে দিয়েছেন। লিয়াম হাতের মুঠোয় ওই ক্রসটা ধরে মনে-মনে ডাকলেন সর্বশক্তিমানকে। বললেন, আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করার জন্য প্রভু যেন শক্তি আর সাহস দেন ওঁকে। তারপর এগিয়ে গেলেন চার্চের পাশের গলিটা দিয়ে।

গলিটা বেশ লম্বা, নির্জন আর সামান্য ছায়া-ছায়া। দু’পাশের বাড়ি-ঘরগুলো কেমন যেন উপচে এসে ঢেকে ফেলতে চাইছে গলিটাকে। লিয়াম হাঁটতে লাগলেন। তাড়া নেই। কাজও তো নেই। এখন এই অনন্ত অবসর-জীবন। ভেনেজুয়েলার এই ছোট্ট পেতারে শহরে ভালই কাটছে ওঁর দিন। ভাল কাটছে? সত্যি! কনফেশন বক্সের আড়ালে একঝলক মুখটা আবার সামনে ভেসে উঠল। বন্ধুর মুখ। মানুষের আসন্ন বিপদ জেনে, বহুদূর থেকে উড়ে আসা বন্ধুর মুখ।

লিয়াম এগিয়ে গেলেন। আজ শুক্রবার। তাই চার্চ ফাঁকা। আর পাশের রাস্তাটা যেন আরও ফাঁকা। আশপাশে দু’-একটা গাড়ি পার্ক করা আছে। সামনের হলুদ বাড়িটার উপরের টালির ছাদে দুটো পাখি বসে রয়েছে। একটা বেলুন বাঁধা রয়েছে বাড়িটার নীল রঙের জানালায়, বেলুনটা অস্থিরভাবে নাচছে হাওয়ায়। আচমকা লিয়ামের কেমন যেন অস্বস্তি হল। উনি চট করে পিছনে ফিরলেন। লম্বা রাস্তাটার ওই প্রান্ত থেকে একটা গাঢ় নীল রঙের ভ্যান বাঁক নিয়ে এগিয়ে আসছে এই দিকে। লিয়াম এবার দ্রুত পা চালালেন একটু। আবার পিছনে তাকালেন। ভ্যানটা আসছে। কিন্তু খুব ঢিমে গতিতে, যেন তাড়া নেই কোনও। লিয়ামের অবাক লাগল।

উনি হাঁটার গতি আরও বাড়ালেন। কিন্তু ঠিক তখনই সামনের গলি থেকে বেরিয়ে এল একটি লোক। দোহারা চেহারা লোকটার। লম্বা। ছোট করে কাটা চুল।

আচমকা লোকটা সামনে এসে যাওয়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন লিয়াম। তাকালেন লোকটার দিকে। লোকটা হাসল। তারপর চোখের সানগ্লাসটা খুলে পালটা তাকাল লিয়ামের দিকে। আর সঙ্গে-সঙ্গে শিউরে উঠলেন লিয়াম। খুব সাধারণ দেখতে লোকটার মুখটায় একটা অদ্ভুত বীভৎসতা আছে। দেখলেন, লোকটার একটা চোখ নেই! বাঁ দিকের অক্ষিকোটরটি শূন্য! অন্ধকার! আর এই অন্ধকারটুকুই নিরীহ মুখটাকে ভয়ংকর করে তুলেছে!

“হ্যালো প্রোফেসর!” লোকটি নরম গলায় বলল।

“হ্যালো,” লিয়ামও যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করলেন।

“আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। আপনার গাড়ি এসে গিয়েছে,” লোকটা হাত দিয়ে নির্দেশ করল লিয়ামের পিছনের রাস্তার দিকে।

লিয়াম দেখলেন, গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে কাছে।

লোকটি ভদ্রগলায় বলল, “চলুন, প্রোফেসর। সামনে অনেক কাজ। আমাদের দেরি করা ঠিক হবে না, প্লিজ।”

লিয়াম জানেন কথা না শুনে উপায় নেই ওঁর। আর এই আশঙ্কার কথা তো বন্ধুকে উনি বলেইছিলেন। লিয়াম পকেটে হাত ঢোকালেন।

“না, কোনও ফানি বিজনেস নয়,” নিমেষে লোকটার হাতে বেরিয়ে এল একটা গ্লক পিস্তল।

লিয়াম পকেট থেকে হাতটা বের করে দেখালেন। সেই ছোট্ট কাঠের ক্রস। তার উপর ধাতুর তৈরি যিশুর একটা মূর্তি!

লোকটার হাতটা শিথিল হল। তারপর সামান্য হাসিও ফুটল মুখে। লোকটা বলল, “আপনার কোনও ক্ষতি আমরা করব না প্রোফেসর। আমাদের কথা শুনে দেখুন, আপনার লাভই হবে। আসুন।”

লিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর পিছনে ফিরে এগোলেন ওই গাঢ় নীল ভ্যানটার দিকে।

লোকটি পাশে যেতে-যেতে বলল, “তবে আমাদের কথা না শুনলে যিশুও রক্ষা করতে পারবে না আপনাকে। বা নিউ জার্সির অ্যানভিলে বসবাস করা আপনার পুত্রের পরিবারকে।”

লিয়াম আবার শিউরে উঠলেন। ওঁর সন্তানের কথাও এরা জানে! উনি বুঝলেন, অক্ষিকোটরের অন্ধকারের চেয়ে লোকটির মনের ভিতরকার অন্ধকার আরও গভীর! আরও গহন!

দুই

২ এপ্রিল, পেতারে, ভেনেজুয়েলা।

ইটরঙা বাড়িটার আড়াল থেকে সবটা দেখতে পেলেন উনি। কিন্তু সামনের বড় মুসান্ডা গাছের আড়ালে থাকায় আর কেউ নজর করতে পারল না ওঁকে।

ওঁর আশঙ্কাই ঠিক। আর একদিন দেরি করলে কী যে সর্বনাশ হয়ে যেত!

হাতের মুঠোয় ছোট্ট নীল শিশিটাকে ভাল করে আবার দেখলেন একবার! সত্যি কি এই শিশির ভিতর লুকিয়ে আছে মারণ বাণের ওষুধ? লিয়াম মিথ্যে বলার লোক নন। সেই ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে ওঁদের আলাপ। তারপর থেকে এত বছর কোনওদিন লিয়াম ওঁকে মিথ্যে বলেননি। তাই এবারও যে বলবেন না সেটাই স্বাভাবিক। বড় করে শ্বাস নিলেন উনি। তারপর পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন। একটা নাম্বার ডায়াল করে কানে লাগালেন। চারটে রিং-এর পর ফোন তোলা হল ওদিক থেকে।

উনি বললেন, আমার হাতে এসে গিয়েছে ওষুধ। তবে প্রোফেসর লিয়াম ব্রাইটকে ওরা তুলে নিয়ে গিয়েছে।

ফোনটা কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে কেটে গেল।

ভাল করে আবার শিশিটা দেখলেন উনি। তারপর চোয়াল শক্ত করে মুসান্ডার ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে এগোলেন। এই শিশিটা এবার জায়গামতো পৌঁছে দিতে হবে। তবেই আপাতত কাজ শেষ! যদিও অন্যজনের কাজের সবে শুরু।

হে প্রভু রক্ষা করো! ওকে সফল কোরো, চার্চের গোলাপি চূড়ার দিকে তাকিয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে মনে-মনে প্রার্থনা করলেন ফাদার এডওয়ার্ড ফ্রান্সিস।

তিন

১ মার্চ, বার্সেলোনা, স্পেন।

মানুষটা লম্বা। দোহারা চেহারা। ছোট করে কাটা চুল। নীল একটা ওভারকোট পরে লোকটা বসে রয়েছে সামনে। এই সন্ধের আধো অন্ধকারের ভিতরেও লোকটার চোখে কালো চশমা।

ইগর অবাক হল সামান্য। এই লোকটা করবে অমন একটা কাজ! পারবে? ইগর ভাল করে দেখল লোকটার হাতটা। শিরা-ওঠা হাত দুটো টেবিলের উপর জড়ো হয়ে আছে। ওর সামনে দিয়ে যাওয়া এসকালিভাডা-র প্লেটটা একবারও ছুঁয়ে দেখেনি।

এই স্যালাডের মতো জিনিসটা খেতে খুব ভাল লাগে ইগরের। তাই লোকটা আসামাত্র কিছু জিজ্ঞেস না করেই অর্ডার করে দিয়েছিল। ভেবেছিল, কাতালুনিয়ার মানুষ যখন, তখন এখানকার বিখ্যাত ডিশটা খেতেও নিশ্চয়ই পছন্দ করবে। কিন্তু লোকটা তো নেড়েও দেখছে না!

ইগর বলল, “আপনি খাচ্ছেন না কেন?”

“আমি!” হাসল লোকটা, “খাবার খাওয়ার জন্য কি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন আপনার বস?”

সামান্য ঘাবড়ে গেল ইগর। লোকটার গলার স্বরে একটা অদ্ভুত ভদ্রতা রয়েছে। কিন্তু তার তলায় রয়েছে হাড় হিম করা একটা ব্যাপার!

“আপনার নামটা? মানে…” ইগর আমতা-আমতা করে বলল, “আসলে যাঁর রেফারেন্সে এসেছি, সে শুধু বলেছে ইউ আর গড!”

লোকটা হাসল এবার, বলল, “আমার নাম দিয়স।”

ও, ইগর মাথা নাড়ল, “আপনি জানেন তো কী কাজ করতে হবে?”

দিয়স আবারও হাসল শুধু।

ইগর বলল, “তা হলে পেমেন্ট টার্মসটা যদি..”

“ফিফটি অ্যাডভান্স। ফিফটি আফটার কমপ্লিশন।”

“কিন্তু থ্রি মিলিয়ন ইউরো বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না?”

“বেশি?” হাসল ইগর, “ইজিপ্টের যে মানুষটি কাজটা কমিশন করেছেন আপনার বসকে, তাঁর কত টাকা আছে আমি জানি। তা ছাড়া দিয়সকে কাজে লাগাতে গেলে এটুকু দিতেই হবে।”

ইগর বুঝল, দরদাম করে লাভ নেই। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কাজটা কিন্তু খুব কঠিন। রিস্ক আছে। কেউ জেনে ফেললে…”

“দিয়স ভুল করে না।”

“তাই?” ইগর ইচ্ছে না করলেও অবিশ্বাসটা বেরিয়েই পড়ল গলা দিয়ে।

দিয়স এবার ঝুঁকে পড়ল সামনে। তারপর চশমাটা খুলে তাকাল ইগরের দিকে। ইগর চমকে উঠল। বাঁ চোখটা নেই লোকটার। তার জায়গায় গহন অন্ধকার!

“দিয়স মানে জানো?” অন্ধকার চোখ তুলে ইগরের দিকে তাকাল লোকটা, তারপর বলল, “দিয়স মানে গড। ভগবান। জানবে, ভগবান ভুল করেন না!”

চার

২৬ ফেব্রুয়ারি, ফিস, অষ্ট্রিয়া।

কটেজটা খুব-একটা বড় না হলেও সুন্দর করে সাজানো। কাঠের তৈরি কটেজটার সামনে একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। সুন্দর ওক কাঠের রেলিং ঘেরা। শীতের এই সময়টা গোটা ফিস জুড়ে সারা পৃথিবী থেকে আসা মানুষের ভিড় লেগে থাকে। স্কি করার জন্য প্রচুর মানুষ জড়ো হয় এখানে।

ছোট থেকে ফাদার ফ্রান্সিসের সঙ্গে এখানে আসছে অদম্য। চারদিকে বরফ-মোড়া প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এইসব স্কি-হাট দেখতে খুব ভাল লাগে ওর।

এই ছোট বাড়িটার নাম ‘চিপমাঙ্ক ট্রেল।’ বাড়িটার মাথার উপরে একটা বড় কাঠবিড়ালির মূর্তি আছে। কাঠবিড়ালিটার গায়ে লাল জামা, পরনে নীল প্যান্ট। তবে শুধু স্কি নয়, স্নো বোর্ডিং করতেও লোকজন আসে এই ফিস-এ।

কটেজের ভিতরে লোকজন স্কি করার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত। বাইরে বারান্দার রেলিং-এর গায়ে ঠেস দিয়ে ঘড়িটা দেখল অদম্য। সাড়ে দশটা বাজে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আজ দুপুরের দিকে তুষারপাতের পূর্বাভাস করা হয়েছে। চার সেন্টিমিটার মতো তুষারপাত হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। চারপাশে লোকজনের উৎসাহ দেখার মতো।

ডিসেম্বরের শুরুতে স্কি-র সিজন শুরু হয়। চলে এপ্রিলের শেষ অবধি। বিশেষ কাজ না থাকলে অদম্য নিজেও স্কি করে। কিন্তু আজ তার সময় নেই। ওর সামনে দাঁড়ানো রাইকার অন্য একটা কাজের খোঁজ এনেছে। রাইকার নিজে একজন আর্টিস্ট, বা সত্যি কথা বললে ও আসলে ফরজার। দুষ্প্রাপ্য আর্টকে নকল করতে ওর মতো ওস্তাদ পৃথিবীতে কমই আছে! সাধারণত তেমন কোনও কাজ থাকলে অদম্য রাইকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ডেনমার্কের ছোট্ট একটা স্টুডিয়োয় থাকে লোকটা।

আজ রাইকারের সঙ্গে দেখা করতেই এই ‘চিপমাঙ্ক ট্রেল’-এ এসেছে অদম্য। রাইকার যে ওর সঙ্গে দেখা করতে আসবে, সেটা যেন কিছুটা জানতই ও। রাইকার মাথায় পরা উলের চুলোটা ঠিক করতে-করতে বলল, “অনেকদিন এখানে আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সুযোগ হয়নি। এবার হল।”

অদম্য হেসে মাথা নাড়ল। ওর সঙ্গে ওদের চার্চের কাছে থাকা ইয়েনস নামে বাচ্চা ছেলেটাও এসেছে। ইয়েনস আজকাল ছবি তোলা শুরু করেছে। ছোট্ট ডিজিটাল ক্যামেরাটা নিয়ে টুরিস্টদের ছবি তুলছে ও। সেইদিকে তাকিয়েই অদম্য বলল, “সে না হয় হল। কিন্তু তুমি হঠাৎ এত আর্জেন্ট বেসিসে আমার কাছে এলে?”

রাইকার হাসল। ওর সোনালি রঙের দাড়ি সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ও বলল, “আমি তোমার কাছে এমনি আসিনি সেটা তো জানোই। একটা কাজ নিয়ে এসেছি।”

“কী কাজ?” অদম্য তাকাল রাইকারের দিকে।

রাইকার বলল, “ফাবার্জ়ে এগ-এর কথা জানো?”

অদম্য জানে ব্যাপারটা। পিটার কার্ল ফাবার্জ়ে একজন স্বর্ণকার ছিলেন। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত পঞ্চাশটি ‘ডিম’ তৈরি করেছিলেন এই শিল্পী মানুষটি।

রাশিয়ার রোমানভ ডাইনেস্টির সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডার, ইস্টার উপলক্ষে নিজের স্ত্রী মারিয়া ফেডোরভ্নাকে একটি সোনার ইস্টার এগ দিতে চেয়েছিলেন। আর সেটা তৈরির ভার পড়েছিল পিটার কার্ল ফাবার্জ়ের উপর।

সেই থেকে ইস্টার উপলক্ষে এমন সোনার ডিম তৈরি করা শুরু করেন ফাবার্জ়ে। এক-একটা ডিম খুবই দামি। আর সত্যি বলতে কী, বস্তুগত দামের চেয়ে ঐতিহাসিক মূল্য এগুলোর অনেক বেশি।

তা, হঠাৎ রাইকার এসবের কথা বলছে কেন?

অদম্য বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ?”

রাইকার সামান্য কাছে সরে এসে বলল, “রাশিয়ান একটি ডেলিগেশন ইন্ডিয়ায় যাবে। এই ধরো সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের শুরুতে। সেখানে সৌজন্য হিসেবে ফাবার্জ়ের তৈরি করা দশটা ডিম প্রদর্শন করা হবে দিন তিনেকের জন্য।”

“তো?” অদম্য স্থির চোখে তাকিয়ে রইল রাইকারের দিকে।

রাইকার বলল, “মেমরি অব আজ়ভ এগ।”

“হোয়াট!” অদম্য ভুরু কোঁচকাল।

“এটা একটা জুয়েল ইস্টার এগ। ফাবার্জ়ের তৈরি। ১৮৯১ সালে জ়ার আলেকজ়ান্ডার দ্য থার্ড নিজের স্ত্রীকে দিয়েছিলেন। বর্তমানে এটা ক্রেমলিনের আর্মারি মিউজ়িয়ামে আছে। এটাও ওই প্রদর্শনীতে আনা হবে। আর এটাই তোমায় সরাতে হবে।”

“কোথায় হবে এগজ়িবিশনটা?” অদম্য কথাটা শুনেও কোনও উত্তেজনা না দেখিয়ে ধীরে-ধীরে প্রশ্নটা করল।

“কলকাতায়,” ছোট্ট করে বলল রাইকার।

“ও নো!” অদম্য মাথা নাড়ল।

“ও ইয়েস,” হাসল রাইকার, “সোভিয়েত ডেলিগেশন যাচ্ছে ওই দেশে, বিশেষ করে ওয়েস্ট বেঙ্গলে বিজ়নেস প্রসপেক্ট নিয়ে। তাই গুড উইল জেস্চার হিসেবে ওরা ওই ফাবার্জ়ের ডিম নিয়ে প্রদর্শনী করবে। প্রধানমন্ত্রীও আসবেন অনুষ্ঠানে।”

“তো, টাইট সিকিয়োরিটি থাকবে…”

“ওয়েট,” অদম্যকে কথা শেষ করতে দিল না রাইকার, “তোমাকে ওই ডেলিগেশনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে দোভাষী হিসেবে। তুমি তো রাশিয়ান জানো। ফলে টিমের সঙ্গেই থাকবে তুমি।”

অদম্য তাকাল রাইকারের দিকে। বলল, “ওরে বাবা! আমায় টিমে ঢুকিয়ে নেবে! বাই দ্য ওয়ে, তুমি এর মধ্যে আসছ কী করে?”

রাইকার হাসল, “ইস্টার এগটা তো আর শুধু চুরি করা যাবে না। ওটাকে রিপ্লেস করতে হবে। আসলটা সরিয়ে নকলটা বসাতে হবে তার জায়গায়। ফলে নকলটা তো…”

“বানাতে হবে, আর বানাবে তুমি!” অদম্য হাসল।

“গুড জব ম্যান। আর আমি তোমায় চিনি বলে আমায় পাঠানো হয়েছে। ভাল টাকা পাবে তুমি,” রাইকার বলল, “হাতে এখনও সময় আছে, কিন্তু তোমার জন্য পেপার ট্রেল তৈরি করতে হবে। তাই তোমার ফেক আইডি বানানো হবে। পরশু তোমায় পৌঁছতে হবে প্রাগ-এ। আমি তোমার ই-টিকিট করে দিয়েছি। ওখানেই সব হয়ে যাবে।”

অদম্য বলল, “কিন্তু সিকিয়োরিটি তো খুব বেশি থাকবে। তার মধ্যে থেকে কী করে করব? মানে ব্লু প্রিন্ট তো তৈরি করতে হবে একটা।”

রাইকার মাথা নেড়ে বলল, “ডু হোয়াট ইউ হ্যাভ টু ডু। তোমার যা ইনফো লাগবে দেওয়া হবে। কাজের জন্য সহযোগিতা পাবে। কিন্তু তোমায় কাজটা সম্পূর্ণ করতে হবে। এটা মাথায় রেখো।”

ডেলিগেশনের মধ্যে আমি! অদম্য আকাশের দিকে তাকাল। নীল আকাশের রং পালটাতে শুরু করেছে। ছায়া ঘনিয়ে আসছে চারদিকে। তুষারপাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে ছোট্ট জনপদ।

রাইকার বলল, “জানো অ্যাডাম, প্রতিটা ফাবার্জ়ে এগ খোলা যায়। মানে, ঢাকনার মতো বা দরজার মতো খুলে ফেলা যায় ডিমগুলোকে। আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে মিনিয়েচার আর্টিফ্যাক্টস। সোনার ময়ূর, জাহাজ, হাতের দাঁতের তৈরি মুখের অবয়ব, সোনার ঘড়ি, দামি পাথরের মুকুটের প্রতিলিপির মতো নানা জিনিস। ফাবার্জ়ে ভদ্রলোকটি এই ডিমের ভিতরে কী লুকোনো থাকবে সেটা জ়ারকেও জানাতেন না। ডিমটা তৈরি শেষ হওয়ার পরে সেটা জ়ারের সামনে যখন নিয়ে যেতেন ফাবার্জ়ে, জ়ার খুব আগ্রহের সঙ্গে ডিমটা খুলে ফেলতেন। আর ভিতরের ওই মিনিয়েচার আর্টিফ্যাক্ট দেখে অবাক হয়ে যেতেন। ওই ছোট ছোট আর্টিফ্যাক্টগুলোকে বলা হত ‘সারপ্রাইজ’। অ্যাডাম, তুমি হবে ওই ডেলিগেশন টিমের সারপ্রাইজ!”

পাঁচ

১৯ মার্চ, বালি, ইন্দোনেশিয়া।

রাস্তাটা আধো অন্ধকার। অসময়ের বৃষ্টিতে প্রায় ঝাপসা। পাপ্পাচান দ্রুত এগোতে লাগল। ওর কালো বর্ষাতি এই আলোছায়ার সঙ্গে মিশে গিয়েছে প্রায়।

সামনেই একটা ছোট বাসস্টপ। ছাউনি। ওই আচ্ছাদনটা দরকার। এক্ষুনি একটা মেসেজ পাঠাতে হবে। গত কয়েক মাস ধরে এখানকার ‘প্রাইম সি ভিউ’ হোটেলে কাজ করার ফলটা আজ পেয়েছে সবে।

রুম নাম্বার দুশো একের উপর অনেকদিন ধরে ওর নজর ছিল। ‘বাগ’ করেছিল গোটা ঘরটা। তার ফলই আজ পেয়েছে। স্পষ্ট শুনেছে সব আলোচনা। পেয়েছে সব তথ্য! আর কী ভয়ংকর সেই সব তথ্য!

‘র’-এর হয়ে সাউথ এশিয়ান ডেস্কে কাজ করে পাপ্পাচান। কেরলে ওর বাড়ি। সেখানে মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই আছে। কিন্তু সব ছেড়ে এই হোটেলে পড়ে রয়েছে ও।

দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হতে পারে এই খবরের টিপ ‘র’-এর সাউথ এশিয়ান ডেস্ক পেয়েছিল গতবছর ডিসেম্বরে।

এমন নানান খবর তো পেতেই থাকে ওরা। কিন্তু এই খবরটার সেনসিটিভিটি আর গুরুত্ব বুঝেছিল ওদের অ্যানালিস্ট টিম। তাই তথ্য জোগাড় করতে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে পাপ্পাচানকে পাঠানো হয় এখানে। কিন্তু কিচ্ছু পায়নি পাপ্পাচান। প্রথম এক মাস সব শান্ত ছিল। একসময় তো ওর মনে হচ্ছিল যে, গোটাটাই কি তবে হোক্স! কিন্তু তারপরেই ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রথম টনক নড়ে ওর। এই হোটেলে এসে ওঠে জেমস চেজ়। কুখ্যাত এক সন্ত্রাসবাদী দলের নেতা। রেড কর্নার নোটিশ জারি করা আছে এর নামে। কিন্তু পাপ্পাচান জানত, এভাবে একে ধরা যাবে না। বরং একেই নজরে রেখে জানতে হবে কী চলছে তলায়-তলায়। আর আজ জেনেছে সেটাই। বিকেলে মানাক নামে একজন এসেছিল জেমসের সঙ্গে কথা বলতে। ওদের কথোপকথন তখনই শুনেছে ও। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে সেই তথ্য ভারতে পাঠাতে পারেনি! কারণ, তখন শিফ্ট চলছিল ওর। কাজের মাঝখানে আচমকা বেরিয়ে গেলে ওর উপর সন্দেহ করা হতে পারে!

আসলে পাপ্পাচানদের সব সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই যে-তথ্য ওরা অফিসকে জানাতে চায়, তা আলাদা করে সংকেতের মাধ্যমে লুকিয়ে রাখে প্রথমে। অর্থাৎ খবর জানানোর আগে ওর কিছু হয়ে গেলে, পরে সেই সংকেত উদ্ধার করে যেন খবরটা জানতে পারে ‘র’। ওর শিফ্ট শেষ হয়ে যাওয়ার পরে পাপ্পাচানও তাই করেছিল।

ও দ্রুত গিয়ে দাঁড়াল বাসস্ট্যান্ডের ছাউনির তলায়। বর্ষাতির সামনের বোতামটা খুলে পকেট থেকে বের করল মোবাইলটা। তারপর দ্রুত ডায়াল করল ভারতের একটা নাম্বার। হোটেলে যে কথা বলা সেফ নয় সেটা ও জানে। কারণ, ইদানীং মনে হচ্ছিল কেউ ওর গতিবিধির উপর নজর রাখছে। তাই নির্জন বাসস্টপই সবচেয়ে ভাল।

ফোনটা চারবার রিং হতেই ওপাশ থেকে ধরা হল।

পাপ্পাচান বলল, “স্যার, আই হ্যাভ নিউজ়। অ্যান অ্যাটাক অন পিএম…” কিন্তু কথাটা আর শেষ করতে পারল না ও। আচমকা সেই বৃষ্টি আর আবছায়ার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা অবয়ব।

পাপ্পাচান চমকে উঠল। কিন্তু কিছু করার আগেই লোকটা আচমকা এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিল ওর মোবাইল। আর অন্য হাতে নিখুঁতভাবে পেটে ঢুকিয়ে দিল ছোট বাঁকানো কারামবিট।

পাপ্পাচান বুঝল, ছোট্ট বাঁকানো এই কমব্যাট ছুরিটা ওর পেটের ভিতরটাকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। ও প্রাণপণে সরে আসতে গেল। কিন্তু তা-ও পারল না। লোকটা ওকে বাসস্ট্যান্ডের দেওয়ালে ঠেসে ধরেছে। শরীরের সব শক্তি রক্তের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে পাপ্পাচানের। যন্ত্রণায় আবছা হয়ে আসছে দেহ, চোখের দৃষ্টি। তার মধ্যেও হাত বাড়াল পাপ্পাচান। লোকটা অন্ধকারেও একটা কালো চশমা পরে রয়েছে! ও হাত বাড়িয়ে লোকটাকে ধরতে গেল। সামান্য সরে গেল লোকটা। পাপ্পাচানের হাতে শুধু খুলে এল ওই কালো চশমাটা। আর শেষ ঘুমে নিভে যেতে-যেতে পাপ্পাচান ওই আবছায়া আলোয় দেখল, সামনের লোকটার বাঁ চোখ আসলে একটা কোটর কেবল। আর তাতে নরকের সমস্ত অন্ধকার এসে জমা হয়েছে!

ছয়

১৫ অগস্ট, ভোপাল, ভারত।

বলটা এসে ঠক করে লাগল নীতিনের হাতে ঝোলানো ব্যাগে। নীতিন ঘুরে তাকাল। পাড়ার ছেলেগুলো তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। একজনের হাতে ব্যাট। অন্যরা উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে। নীতিন ঘুরে তাকাতেই ওদের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছে।

নীতিনের মজা লাগল। এই পাড়ার সকলে ভয় পায় ওকে। কেউ সামনে আসে না। এমনকী, গণেশ পুজোর চাঁদা নিতে পর্যন্ত আসে না। লোকের এই ভয় পাওয়াটা মনে-মনে উপভোগ করে নীতিন। ভাবে, পাক ভয়। ওকে তো ভয় পাবেই, পেতেই হবে! দেশের হয়ে যা করেছে ও, তাতে ওকে শ্রদ্ধা করা আর ভয় পাওয়ারই কথা!

কার্গিল যুদ্ধের সময় একা খালি হাতে লড়াই করে শত্রুপক্ষের দশজনকে মেরেছিল নীতিন। চারটে গুলি লেগেছিল ওর গায়ে। পিঠে আর পেটে ছ’বার স্ট্যাব করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও নীতিনকে আটকানো যায়নি। ওর ছ’ফুট ন’ইঞ্চির শরীরটাকে শত্রুপক্ষের সৈন্যগুলো শেষ করতে পারেনি। দশজনকে মেরে ওই অবস্থায় দেড়দিন পড়ে ছিল পাহাড়ের খাঁজে। তারপর ওকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ডান পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। তাই কেটে বাদ দিতে হয়। পুরস্কার পেয়েছিল নীতিন। আর তার সঙ্গে ক্ষতিপূরণও। কিন্তু ব্যস, ওখানেই শেষ। নীতিনের চাকরিও শেষ হয়ে গিয়েছিল তারপর থেকে। একটা পেনশন, নকল পা আর পদক দিয়েই পৃথিবী যেন ভুলে গিয়েছিল ওকে।

এখন পঞ্চাশ বছর বয়স নীতিনের। অসুস্থ ছোটভাই এবং এক পিসি ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা-মা ছোটবেলাতেই মারা গিয়েছিলেন। আর পা হারিয়ে চাকরি চলে যাওয়ার পর বিয়েও হয়নি ওর। নীতিন মাঝে-মাঝে ভাবে, গোটা জীবনে কী পেল ও? এই যে ভাইটার কিডনি খারাপ হয়ে গিয়েছে, কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অত টাকা লাগবে, সেটা কে দেবে ওকে?

ও নিজে ওর ব্যাটালিয়ানের হায়ার অথরিটির কাছে গিয়েছিল অর্থসাহায্যের জন্য। কিন্তু বিশেষ সুবিধে হয়নি। এখন সব মিলিয়ে প্রায় পনেরো লাখ টাকা লাগবে ওর। কীভাবে জোগাড় করবে সেটা? চোখের সামনে কি ভাইটা মারা যাবে? দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখবে নীতিন? ভাবলেই মাথাটা পাগল পাগল লাগে ওর। এই দেশের জন্য সব করল আর প্রতিদানে কী পেল?

এখন নিজের দুটো দোকান আছে নীতিনের। একটা স্টেশনারি শপ আর- একটা খাবারের দোকান। তাতেই চলে যায়। কিন্তু ভাইয়ের রোগটা ধরা পড়ার পর থেকে খুব টানাটানি চলছে। অতিরিক্ত কিছু রোজগারের জন্য চেষ্টা করছিল ও।

তখনই খবরটা পায়। গাঁধী জয়ন্তীর দিন কলকাতায় প্রধানমন্ত্রীজি যাচ্ছেন। সেখানে রাশিয়া থেকে আসা শিল্পপতিদের একটা কনফারেন্স হবে। সঙ্গে কিছু মূল্যবান জিনিসের প্রদর্শনী চলবে। তার সিকিয়োরিটির কাজে ডাকা হয়েছে নীতিনকে! যে ভ্যানে ওই মূল্যবান সামগ্রী থাকবে, তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ওকে। ভ্যানের বাইরে থাকবে সিকিয়োরিটি। কিন্তু ভ্যানের ভিতরে থাকবে শুধু নীতিন।

কিছুই কঠিন কাজ নয়। সোজাই। আসলে গোটা ঘটনার সিকিয়োরিটির ব্যাপারটা দেখছে এক বিদেশি সংস্থা। তারা ওদের ব্যাটালিয়ানের কাছে কিছু এক্স মিলিটারির ডিটেল চেয়েছিল এই কাজের জন্য। নীতিনের নামও তাই রেকমেন্ড করা হয়েছে।

বেশ অবাক লেগেছিল নীতিনের! ওর নাম! কেন? আর সঙ্গে একটু সংশয়ও। ওর পায়ের সমস্যার জন্য বাতিল না করে দেয়। কিন্তু দেয়নি। আসলে ওর কাজ তো বসেই করা সম্ভব। তা ছাড়া এই পা নিয়ে হাঁটতে নীতিনের সমস্যা হয় না। চট করে কেউ দেখলে বোঝেও না যে, ওর পায়ে সমস্যা আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা এখনও নীতিন চার-পাঁচজনের মহড়া নিয়ে নিতে পারে।

না, খুব বেশি টাকাপয়সা পাওয়া যাবে না কাজটা করে, কিন্তু এই দমবন্ধ করা জীবন থেকে দু’-চারদিন একটু ভাল থাকবে ও।

নীতিন নিচু হয়ে বলটা তুলে ছুড়ে দিল বাচ্চাগুলোর দিকে। তারপর হাসল সামান্য। কেন কে জানে ওদের ভয় পাওয়া মুখগুলো দেখে আজ হাসি পেয়ে গেল নীতিনের।

ওর ফ্ল্যাটটা দোতলায়। পিসি দরজাটা খুলে হাতের ব্যাগটা নিয়ে বলল, “একজন এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।”

আমার সঙ্গে! নীতিন অবাক হল। কেউ তো আসে না বিশেষ ওর কাছে। নীতিন জুতোটা খুলে ছোট্ট বসার ঘরটায় গিয়ে থমকে দাঁড়াল। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। কে লোকটা?

লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যালো মিস্টার নীতিন শর্মা!”

“আপনি?” নীতিন অবাক হয়ে গেল।

“বলছি। তবে তার আগে বলে নিই আমি এখানে একটা ব্যাবসার কাজে এসেছি। আর আপনাকে তাতে পার্টনার করতে চাই।”

“আমাকে!”

লোকটা হাসল।

নীতিন জিজ্ঞেস করল, “কীসের ব্যাবসার কথা বলছেন আপনি?”

“আলোর,” লোকটা হাসল আবার। তারপর বলল, “আমার কথা একটু মন দিয়ে শুনুন। আই হোপ ইউ ক্যান সি দ্য লাইট ইউ আর ডেসপারেটলি সিকিং ফর এজেস। আমি জানি আপনার আলোর প্রয়োজন।”

সাত

৩ জুন, কিয়েভ, ইউক্রেন।

আবছা ঘরটার একপাশে যে মানুষটি বসে রয়েছে, তার গলার স্বর শুনলে ভিতরটা কেঁপে ওঠে ইগরের। এমন অদ্ভুত শান্ত আর নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে মানুষ?

গত দশ বছর ধরে ইগর কাজ করছে মানুষটার সঙ্গে। কাছ থেকে দেখেছে। তাই ভয়টাও বেড়েছে। নিজের জন্য হেন কাজ নেই লোকটা করতে পারে না। রাশিয়ান মব ব্রাটভার সঙ্গে টক্কর নিতেও পিছপা হয় না। আর বর্তমানে তো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটানোর কাজও নিচ্ছে মানুষটা! ইগরের ভাবলে অবাক লাগে, কী করে এত সাংঘাতিক কাজ লোকটা করতে পারে এত ঠান্ডা মাথায়?

ইগর বলল, “স্যার, অল ইজ় সেট। তবে আর-একবার ভাবুন। এমন একটা কাজ করা যাবে? একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে…”

লোকটা নিখুঁত ইংরেজিতে বলল, “ডোন্ট ইউ ওয়ারি। সারা পৃথিবীতে যে-অবস্থা চলছে, তাতে আমাদের কাজ হল ক্যাটালিস্টের। প্লাস আমরা এই কাজটা করতে পারলে ভারত মহাসাগর দিয়ে হওয়া আর্মস স্মাগলিং-এর ক্ষেত্রে আমাদের অনেক সুবিধে হবে। যে-ফ্যাকশানটা এই আর্মস স্মাগলিংটা কন্ট্রোল করে, তারাই তো এই কাজটা করাচ্ছে। ইন্ডিয়াকে তারা শিক্ষা দিতে চায়। আর সারা পৃথিবীকে এই খবরটাই দিতে চায় যে, তাদের আটকানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়! তা ছাড়া ওই সাবকনটিনেন্টকে ক্রমশ ওয়েস্ট আফ্রিকার মতো করে তুলতে হবে। যাতে সেখানে গোলমাল কখনও না থামে। আর্মস বিক্রি হওয়া জরুরি। আমি এই কাজটা নিয়েছি এই কারণেই। এক, এই কাজ থেকে অনেক ডলার আসবে। আর দুই, আর্মস ডিলিং-এর ক্ষেত্রেও পরোক্ষ লাভ হবে। তবে আর-একটা কারণও তো আছে। অবশ্য সেটা শুধু আমি জানি!”

ইগর বলল, “কিন্তু স্যার, এত টাইট গার্ডের মধ্যে দিয়ে কী করে সম্ভব?”

“প্রোফেসার লিয়াম কী করতে আছেন?”

ইগর বলল, “কিন্তু স্যার, উনি কি…”

“ভেরি মাচ কমপিটেন্ট। সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির মাইন্ড কন্ট্রোল ডিভিশনের চিফ ছিলেন। হি নোজ় হিজ় জব। আর ওঁর কাছের মানুষজন আমাদের কবজায়। কাজ না করে ওঁর উপায় আছে?”

“স্যার, সত্যি কি মাইন্ড কন্ট্রোল সম্ভব?আর যদি ধরা পড়ে যান?”

“আরে বাবা, ধরা পড়ার জন্য তো অন্য লোক আছে। তার বন্দোবস্ত তো করেছি। আর মাইন্ড কন্ট্রোল সম্ভব কি না? হোরেশিও, পৃথিবীতে কত কী হয়, তুমি কি জানো?” আবছায়া মানুষটি হাসল জোরে, তারপর বলল, “ইটস লাইক রিমোট কন্ট্রোল। ইউ উইল সি। সারা পৃথিবী দেখবে। আমরা নিউ এজ কমব্যাটে ঢুকে গিয়েছি। গেরিলা কমব্যাট। আরও ইন্টিমেট, আরও ডেডলি। জাস্ট ওয়েট অ্যাড ওয়চ। ইউ হ্যাভ দ্য বেস্ট সিট ইন দি অডিটরিয়াম। অ্যান্ড ডোন্ট ফরগেট টু ব্রিং ইয়োর পপকর্ন সানি?”

আট

১ অক্টোবর। ঘটনার একদিন আগে। কলকাতা, ভারত।

নিজের রুমে ঢুকে আলগা করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অদম্য। কাল সারাদিন কাজ। তার আগে আজকের রাতটুকু একটু নিজের জন্য চাই ওর।

বাইপাসের ধারের এই বড় হোটেলের তিনতলায় রুম দেওয়া হয়েছে ওকে। খুব ভাল রুম। এই গরমে সামনের মিনি-বারে রাখা কোলা ডাকছে যেন ওকে। কিন্তু ওদিকে গেলে হবে না। কিছুতেই হবে না। কারণ, এখন ওকে বেরোতে হবে। পার্ক সার্কাসের একটা ছোট্ট হোটেলে যেতে হবে। কাজ আছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ!

ছোট একটা সুটকেস নিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল অদম্য। রাত সাড়ে দশটা বাজে। কাজ শেষ করে যে করেই হোক ওকে বারোটার মধ্যে ফিরতে হবে। বারোটায় একটা সিকিয়োরিটি ব্রিফিং আছে। সেটায় থাকতে হবে ওকে। না হলে সন্দেহ হতে পারে ওদের!

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল অদম্য। ঢিলে নীল টি-শার্ট আর একই রঙের ট্র্যাক-প্যান্ট। কিন্তু বাথরুমের বাইরে পা দিয়েই থমকে গেল ও। ঘরের ভিতর গন্ধের একটা তারতম্য ধরা পড়েছে। আলতো একটা গন্ধ যেন প্রায় অদৃশ্য হয়ে ভেসে আছে হাওয়ায়।

ও সাবধানি পায়ে এগিয়ে গেল। তারপর বলল, “এত দেরি করলে?”

“সিকিয়োরিটি,” ঘরের উলটো দিকের আবছা কোনা থেকে উত্তর দিল রাইকার। তারপর উঠে এসে একটা কাঠের ডিম্বাকার ‘কেস’ এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও ‘মেমরি অব আজ়ভ’। সাবধানে।”

অদম্য জানে, সাবধান হতে বলার একটাই কারণ হল জিনিসটা, নকল হলেও, একবার ক্ষতি হয়ে গেলে পুরো প্ল্যান বানচাল হয়ে যাবে।

অদম্য ছোট্ট কথায় বলল, “ঠিক আছে, তুমি এসো।”

রাইকার দাঁড়িয়ে রইল একটু। তারপর বলল, “বাকি কথা তবে কে বলবে?”

“মানে!”

রাইকার অদম্যর খাটে বসে বলল, “শোনো, কাজটা কিন্তু অত সহজ নয়। সিকিয়োরিটিরা প্রাইভেট কোম্পানি দ্বারা বাছা হলেও তারা খুবই রেপুটেড। রুথলেস। তাই তারা কিন্তু কোনও জমি ছাড়বে না। সুতরাং ভেবো না বিকেলে তুমি পার্কে ঘুরতে বেরিয়েছ! তোমার একটা তাগড়া ডাইভারশন দরকার। যাতে করে সিকিয়োরিটির লোকজনও কিছুক্ষণের জন্য ঘাবড়ে যায়। আর তুমি একটা উইন্ডো পাও।”

“কী করবে তোমরা?”

“আমি নই। আমি জাস্ট অ্যান আর্টিস্ট অ্যাডাম। করবে অন্য লোক। ম্যাসাকার করবে।”

এই কাজের জন্য অদম্য কী বলবে বুঝতে পারল না।

“আর-একটা কথা, এই ডেলিগেশনের মাথা যিনি, মিস্টার বরিস আভেরিন। ওঁর কিন্তু রোমানভ ব্লাড আছে গায়ে। দূর সম্পর্কের হলেও উনিও জ়ারের বংশধর। এক-একটা ডিম তাই ওঁর কাছে খুব দামি। এটা মাথায় রেখো।”

অদম্য মাথা নাড়ল। এটা ও জানে। বরিস আভেরিনের ব্যক্তিগত সচিব ইলিয়ানা আজ সারা দিন ওর সঙ্গে খুব কথা বলেছে। হেসেছে। দু’-একবার সকলের চোখ এড়িয়ে ওর হাতটাও ধরেছে। ওর কাছ থেকেই জেনেছে, বরিস কে। তবে এটাও বুঝেছে, বরিস এক অক্ষরও ইংরেজি বলতে পারেন না। অদম্যকে সারাক্ষণ ওঁর সঙ্গেই থাকতে হচ্ছিল দোভাষী হিসেবে।

রাইকার যাওয়ার সময় আর কিছু বলল না। শুধু হেসে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

রাইকার বেরিয়ে যেতেই অদম্য কাঠের কেসটাকে পিঠের ব্যাগে ভরে নিল। তারপর সারা ঘরটায় চোখ বুলিয়ে দরজার দিকে এগোল। কিন্তু ডোর নবে হাত দেওয়ার আগেই খটখট করে উঠল দরজাটা! এখন কে আবার! ও দ্রুত পিঠের ব্যাগটা দূরের সোফায় রেখে দিয়ে এসে, দরজার ‘কি-হোল’-এ চোখ রাখল।

চমকে উঠল অদম্য। ইলিয়ানা!

নয়

৩০ সেপ্টেম্বর, ডোঙ্গারিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, ভারত।

ঝামেলা বলে ঝামেলা! গোপালের মনে হয়, পাপ না করলে কেউ এমন চাকরি করে না! ভোররাতে পৌনে চারটের সময় মফিজুলভাই ফোন করে বলেছে, কাল থেকে প্রোডাকশন চালু করতে হবে। অক্টোবরের দু’তারিখে নেতাজি ইন্ডোরে অনুষ্ঠান। পনেরো হাজার পাউচ জল চাই-ই চাই!

আরে বাবা, পনেরো হাজার পাউচ এমন কিছু বড় ব্যাপারই নয়। কিন্তু মফিজুল ভাইকে কে বোঝাবে? সে সব সময় টেনশন করে। না হলে কেউ ওরকম সময় ফোন করে জ্বালায়! কিন্তু এদিকে আর-এক ঝামেলা হয়েছে আজ। সবে প্ল্যান্ট চালাতে যাবে, এক পার্টি এসে হাজির। যদিও সরকারি সম্পত্তি, তা-ও যেহেতু গোপালদের কোম্পানি এর অ্যানুয়াল মেন্টেন্যান্স করে, তাই বাইরের চেনাজানা পার্টি ওদের এই মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্টটা দেখতে আসে। আসলে এমন প্ল্যান্ট বসানোর আগে সবাই একবার একটা সচল ইউনিট দেখে নিতে চায়।

আজও এসেছে। চারজন লোক। দু’জন ভারতীয় আর দু’জন সাহেব। সাহেব দু’জনের মধ্যে লম্বা, রোগা ফরসাপানা লোকটার যেন আগ্রহ বেশি। মাঝে-মাঝেই প্ল্যান্টের কাছে চলে যাচ্ছে। ওই, ওই আবার যাচ্ছে।

গোপাল দৌড়ে গেল লোকটার কাছে, “স্যার, ডোন্ট গো।”

লোকটা দাঁড়াল। চোখে কালো চশমা। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা চকোলেট!

“প্লিজ তেক।”

বিদেশি চকোলেট! লম্বা, সিলিন্ডারের মতো। গোপাল থমকে গেল। নেবে? নিলে ক্ষতি নেই তো! কী ক্ষতি আর হবে? ও হাত বাড়িয়ে নিতে গেল। লোকটাও দিল। কিন্তু গোপাল ধরার আগেই চকোলেটটা মাটিতে পড়ে গড়িয়ে গেল বেশ কিছুটা! গোপাল দ্রুত ঝুঁকে পড়ে মুরগি ধরতে যাওয়ার মতো করে ছুটল চকোলেটটা ধরতে। তারপর চকোলেটটা তুলে ঘুরে তাকাল, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। বাট ডোন্ট গো নিয়ার প্লিজ।”

সাহেব দু’হাত তুলে হাসল। অর্থাৎ, একেবারেই যাচ্ছে না!

গোপাল যখন দৌড়ে যাচ্ছিল সিলিন্ডারের মতো চকোলেটের পিছনে, দিওস আর দেরি না করে দ্রুত ঘুরে পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে পলি-প্রপিলিন পাইপের একটা জয়েন্টে পুশ করে দিয়েছিল। তারপর দ্রুত ঘুরে পকেটে সিরিঞ্জটা ভরে দাঁড়িয়েছিল। দেখেছিল, গোপাল সবেমাত্র চকোলেটটা তুলে দাঁড়িয়েছে।

দিওস জানে, বাকিরা কেউ দেখেনি ওকে। সবাই অন্য দিকে তাকিয়ে। ওরা একটা নতুন মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্ট বসাতে চায় বলে এই কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল সপ্তাহখানেক আগে। তারপর তাদের সঙ্গেই এসেছে প্ল্যান্ট দেখার নাম করে। ওর সঙ্গের তিনজন যদিও ভাড়া করা অ্যাক্টর। তবে ওদের কাজ এখানকার লোকের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা।

শুধু এই গোপাল বলে লোকটাই ওর পিছনে টিকটিক করছিল। তাই এমনটা করতে হল। মানুষকে এমন করে খাবারের পিছনে দৌড় করাতে ভাল লাগে না দিওসের! নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় কী কী করতে হয়েছে ওকে শুধু একটু রুটির জন্য! কিন্তু ও নিরুপায়! কাজ আগে।

দিওস ঘরে ঢুকেই দেখেছিল গোটা ইনস্টলেশনের এই একটা জায়গার পাইপ দিয়েই জল টপটপ করে পড়ছিল। অর্থাৎ লিক আছে। তাই এখানেই ইনজেক্ট করেছে বিষটা! নেট্রাসায়ান। নতুন একটা সায়ানাইড বিষ! খুব সামান্য মাত্রায় ব্যবহারে এটা প্রচুর মানুষ মারতে পারে। তা-ও নিমেষের ভিতরে!

গোপাল চকোলেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখছে। দিওস হাসল। ওর কাজ শেষ। এখন এই বিষ মিশবে জলে। আর সেই জল পাউচ প্যাকে ভরে পরশুদিন বিতরণ করা হবে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দর্শকদের মধ্যে।

দশ

২ অক্টোবর, রাত দেড়টা, কলকাতা, ভারত।

নিজের বিছানায় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল অদম্য। এটা কী শুনল ও! এটাও হতে পারে! সামান্য একটা ডিমের জন্য এতটা হতে পারে! রাইকার বলছিল বটে, কিন্তু তা বলে এতটা!

ওর খুব আফশোস হচ্ছে। পুরোটা শুনতে পেল না। তখনই জোরে বৃষ্টি এল যে। আর লোকটা নিজের ঘরের জানালার কাছে চলে গেল ফোন নিয়ে। সব ঝাপসা হয়ে গেল! শুধু মাস মার্ডার আর ডাইভারশন কথাটা শুনতে পেয়েছে!

এখন কী করবে? লোকটাকে ধরিয়ে দেবে? কিন্তু সেটা কতটা ঠিক হবে? আর তা হলে তো ও নিজেও ধরা পড়ে যাবে! কিন্তু নেপথ্যে থেকে যে ঘটাবে এমন একটা কাণ্ড, তার নাম কী? কীভাবে তাকে পাওয়া যাবে? আর কীভাবে এখানকার সিকিয়োরিটিকে জানাবে সেটা? কী প্রমাণ আছে যে, অদম্য যা বলছে তা সত্যি!

মাথা নিচু করল ও। সেই কাজটাতেও বেরোতে পারেনি এখনও। ইলিয়ানা বড্ড সময় নিয়েছে। তারপর ব্রিফিং ছিল। এদিকে এখন রাত দেড়টা বাজে। বিদেশি মতে দু’তারিখ পড়ে গিয়েছে। কী করা যায়! কে সাহায্য করতে পারে ওকে! কে… তাই তো!

চমকে উঠল অদম্য! এই নামটাই তো মনে আসছিল না! ও সোজা হয়ে বসে মোবাইলটা নিল হাতে। তারপর একটা নাম্বার ডায়াল করল।

এগারো

২ অক্টোবর। অকল্যান্ড, নিউজ়িল্যান্ড।

ফোনের নাম্বারটা দেখেই অবাক হয়ে গেল জন। এই সকাল ন’টায় হঠাৎ অ্যাডাম! এখন! নিশ্চয়ই আবার কোনও দরকার আছে ওর!

সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে জন। কাল অনেক রাত অবধি পার্টি করেছে। একটু বেশিই মদ খেয়ে ফেলেছিল। ঘুম থেকে উঠে আজ আধঘণ্টা ধরে স্নান করেছে। তা-ও মাথা টলমল করছে। মনে হচ্ছে এখনও যেন তামাকি নদীতে কেউ ওকে নিয়ে নৌকায় ঘুরতে বেরিয়েছে।

“ইয়াপ,” ফোনটা ধরে ছোট্ট করে বলল জন।

অদম্য সময় নিল মাত্র বিয়াল্লিশ সেকেন্ড। কিন্তু তার মধ্যেই জন বুঝে গেল ওকে কী করতে হবে। অদম্যর ফোন নাম্বারটা ওকে মাস্ক করে দিতে হবে, আর অন্য একটা ফোন ট্যাপ করতে হবে।

এই হয়েছে এক ছেলে, কী যে করে বেড়ায়! জন হাসল নিজের মনে। একই সঙ্গে ফিস-এর অনাথ আশ্রমে ফাদার ফ্রান্সিসের কাছে বড় হয়েছে ওরা। খুব ভাল চেনে অ্যাডামকে। কিন্তু তাও যেন চেনে না। শুধু আচমকা কোত্থেকে এসে উদয় হয়! আর বলে, এটা করে দে, ওটা করে দে। করে দেয় জন। কারণ, কিছুদিনের মধ্যেই মোটা টাকা এসে কে বা কারা রেখে যায় ওর ঘরের ভেতর, কাচের টেবলে।

অদম্য কথা শেষ করার পর জন বলল, “প্লিজ অ্যাডাম, আজ শরীর ভাল নেই। তুই মোবাইল থেকে নেটের মাধ্যমে ফোন কর, যাকে কল করবি। আমি মাস্ক করে দেব নাম্বার। শুধু তোর মোবাইলের আইপি অ্যাড্রেসটা… থাক, ওটাও আমি করে নিচ্ছি। কাজটা হয়ে গেলে জাস্ট আমি তোকে জানিয়ে দেব। দেন মেক ইয়োর কল। আর অন্য নাম্বারটাও আমি নজরে রাখছি! ও হ্যাঁ, আর শোন…”

কিন্তু কথা শেষ করার আগেই লাইনটা কেটে দিল অদম্য। নিজের মনে হাসল জন। তারপর টলমল মাথা নিয়ে এগিয়ে গেল পাশের ঘরের দিকে। এটা ওর ওয়ার্কিং প্যাড। আপাতত দশ মিনিট এখানেই কাটবে ওর। মাথাটা আচমকা টনটন করে উঠল আবার! জন মুখ বিকৃত করে ফেলল। তারপর ভাবল, ইস, কাল রাতে অতটা না খেলেই হত!

বারো

২ অক্টোবর, গভীর রাত। জম্মু-কাশ্মীর, ভারত।

নিজের ঘরে ফিরে সবে ব্যাগটা রেখেছে, এমন সময় আচমকা বেজে উঠল ফোনটা। বিরক্ত লাগল আদিলের। সারাদিনের পর ভেবেছিল রাতে একটু ঘুমোবে, কিন্তু তার কি উপায় আছে? ঘড়ি বলছে রাত পৌনে দুটো বাজে। হিসেব মতো দু’তারিখ পড়ে গিয়েছে। ওর ছুটি। গাঁধী বার্থডে। শাহিন বাবা- মায়ের সঙ্গে এসেছে কাশ্মীর ঘুরতে। কাল গোটা দিনটা ওকে ঘুরতে হবে ওদের সঙ্গেই। ভালই লাগবে। কতদিন ছুটি পায়নি আদিল, এবার পেয়েছে। তা-ও সেটা আবার কাটাতে পারবে শাহিনের সঙ্গে, এই ভূস্বর্গে!

কিন্তু এমন সময়ই ফোনটা এল। এই সময়গুলোয় ফোন এলে মনে একটা কু-ডাক দেয়। কে ফোন করল এখন?

আদিল ফোনটা হাতে নিয়ে ভুরু কোঁচকাল, আননোন নাম্বার!

“হ্যালো?” আদিল কানে ধরল ফোনটা।

“আমি। খুব জরুরি দরকার।”

আদিলের পিঠ দিয়ে নিমেষে বরফের গিরগিটি হেঁটে গেল যেন! ও ফোন করেছে। হঠাৎ!

আদিল বিস্মিত গলায় শুধু বলল, “অদম্য!”

তেরো

২ অক্টোবর। কলকাতা, ভারত।

সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে যোগব্যয়াম করা বরিসের অভ্যেস। সারা জীবন করে এসেছে। তাই এই পঞ্চান্ন বছর বয়সেও শরীরটা একদম চাবুকের মতো করে রাখতে পেরেছে। ঘড়িতে সোয়া ছ’টা বাজে। মাটিতে ম্যাট পেতে এতক্ষণ ব্যায়াম করছিল বরিস। সেটা শেষ করেই ঘড়িতে চোখ রাখল। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আজও কি হবে? তবে না হলেই ভাল।

আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। ভারতের সঙ্গে ওদের একটা চুক্তি হবে। আমেরিকা যেভাবে ভারতকে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একটা বড় মার্কেট হিসেবে ব্যবহার করছে, রাশিয়া তেমন কিছুই পারেনি। কিন্তু সারা জীবন তো এমন চলতে দেওয়া যায় না। বরং এখন সময় পালটেছে। তার সঙ্গে ওদেরও পালটাতে হবে।

রাশিয়ার গাড়ি, মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদির জন্য এই দেশকে টার্গেট করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করা হবে এই সব কারখানার কাজ। সেই জন্য ওদের দেশ থেকে এখানে বড় একটা ডেলিগেশন পাঠানো হয়েছে। সঙ্গে একজন মন্ত্রীও এসেছেন। আর এসেছে বরিস ও তার মতো আরও বেশ কয়েকজন শিল্পপতি। যদিও বরিসকেই এই ডেলিগেশনের চিফ হিসেবে পাঠানো হয়েছে। তার কারণ বরিসের রেকর্ড। রাশিয়ার প্রথম পাঁচজন ধনকুবেরের মধ্যে একজন হল বরিস আভেরিন। তার সঙ্গে আবার রোমানভ বংশের রক্তও আছে ওর শরীরে। বহু আগে একসময় রোমানভদের খারাপ চোখে দেখা হত। কিন্তু দিন পালটেছে। পালটে যাওয়া দেশে নতুনভাবে সব কিছুর মূল্যায়ন চলছে।

বরিস উঠে দাঁড়াল। এবার স্নান করে নেবে। ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে থাকতে হবে। যদিও অনুষ্ঠান দুপুরবেলা। তাও তার আগে দু’-একটা মিটিং রয়েছে। ইলিয়ানা সাতটায় আসবে। মেয়েটা খুব এফিশিয়েন্ট। তবে সমস্যা একটাই। হাই সুগার আছে মেয়েটার। দিনে দু’বার ইনসুলিন নিতে হয়।

বরিস তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোল। কিন্তু দরজা অবধি পৌঁছতে পারার আগেই বেল বেজে উঠল ঘরের।

এখন কে?

বরিস এগিয়ে গিয়ে দরজার পিপ হোলে চোখ রাখল। আর অবাক হল। আরে, সেই দোভাষী ছেলেটা, এখন!

দরজাটা খুলে দিল বরিস।

চোদ্দো

নবান্নর করিডর দিয়ে দৌড়োতে লাগল আদিল। আশপাশের সবাই অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। এমন তো করা যায় না! পুলিশ আছে, গার্ডরা রয়েছে। কিন্তু তা-ও ও দৌড়োচ্ছে! আদিল জানে, যে যা খুশি ভাবুক, সময় নষ্ট করা যাবে না একটুও। গতকাল ফোনটা পেয়ে আর শোয়নি আদিল। সঙ্গে-সঙ্গে ওদের কমান্ডার জসবির সাইনির সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিল। জসবির তখন নিজেই ঘুমোনোর তোড়জোড় করছিলেন। ওকে দেখে ঘাবড়েই গিয়েছিলেন একটু! বলেছিলেন, “আরে, তুমি! কী হয়েছে?”

আদিল বলেছিল, “স্যার, খুব সমস্যা। প্লিজ, যদি আমার কথাটা শোনেন।”

ওদের যা কাজ তাতে যখন-তখন সমস্যা হতেই পারে। আদিলের মুখ-চোখ লাল। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। জসবির বুঝেছিলেন ব্যাপারটা গুরুতর। আদিল বাজে কথা বলার ছেলে নয়।

“কী হয়েছে?”

আদিল সময় নিয়েছিল একটু। আসলে কীভাবে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তাই মনে-মনে গুছিয়ে নিয়েছিল। তারপর বলেছিল পুরো ব্যাপারটা।

জসবির মন দিয়ে শুনেছিলেন সবটুকু। তারপর বলেছিলেন, “এটা তো হোক্স কলও হতে পারে।”

“না স্যার, যে কল করেছিল সে আজ পর্যন্ত কোনও বাজে কথা বলেনি।”

জসবির কী বলবেন বুঝতে পারেননি। আসলে খবরটাই এমন আর আদিল এমন করে বলছে যে, জসবির আর প্রশ্ন করেননি। হেড কোয়ার্টারে ফোন করেছিলেন সঙ্গে-সঙ্গে। অনুমতি পেতে অসুবিধে হয়নি। স্যাটেলাইট ফোন থেকে আদিল তখনই ফোন করেছিল লালবাজারে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল আদিল। অন্য কেউ হলে হয়তো অসুবিধে হত, কিন্তু কলকাতা পুলিশের ভেতর আদিল এখন পরিচিত নাম। তাই অসুবিধে হয়নি রাজীবজির প্রাইভেট নাম্বার পেতে। রাজীব কুমার নিজের রেসিডেন্স থেকে ফোনটা ধরেছিলেন।

আদিল কনফারেন্স রুমের সামনে পৌঁছে সামান্য দাঁড়াল। দরজা আটকে চারজন কমান্ডো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদিলকে তারাও চেনে। তাও আদিল নিজের আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে দেখাল।

দরজা খুলে ওরা আদিলকে ভিতরে যেতে বলল।

আজ ছুটির দিন। গাঁধী বার্থডে। তাও নবান্নে পুলিশ গিজগিজ করছে। স্বাভাবিক। দুপুরে অনুষ্ঠান আছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীজিও আসবেন।

সিএম বড় টেবলটার একপাশে একটা মাখন রঙের রিক্লাইনারে বসেছিলেন। হাতে একটা ট্যাব। তাতে দেখছিলেন কিছু। আদিলকে দেখেই সোজা হয়ে বসলেন।

আদিল সামনে গিয়ে স্যালুট করল। সিএম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আদিল, এসব কী বলছেন রাজীবজি? তুমি গতকাল ওঁকে ফোন করেছিলে রাতে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম,” আদিল মাথা নাড়ল, “খবরটা পেয়েই আমি জম্মু থেকে হেলিকপ্টারে করে এসেছি দিল্লি। সেখান থেকে প্লেনে এখানে।”

“কথাটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?” সিএম চশমা খুলে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন আদিলের দিকে, “দ্যাখো, সব বড় অনুষ্ঠানের আগেই এমন থ্রেট কল্স এসে থাকে। আইবি থেকে শুরু করে ‘র’, সবাই কিছু না-কিছু খবর দেয়। তারপর আমরা সেগুলোর মোকাবিলা করি। তুমি যে-খবরটার কথা বলছ, সেটা কতটা অ্যাকিউরেট? এবারও দশ-বারোটা থ্রেট আছে। কিন্তু আমাদের অ্যানালিসিস টিম সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছে, দু’-তিনটেকে ফলো করা যেতে পারে। তাও সেগুলো সাংঘাতিক কিছুও নয়। সেখানে তুমি জাস্ট একটা কল পেয়ে মানে, কতটা বিশ্বাসযোগ্য এই কল? পিএম সাহেব আসবেন, বিদেশি অতিথিরা আসবেন। আমাদের মান-সম্মানের ব্যাপার। ব্যাপারটা একটু বুঝে বলো।”

আদিল মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “ম্যাডাম, অদম্য ফোন করেছিল।”

“হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু সে কি নিজের নাম বলেছিল? ডেফিনিট কিছু বলেছিল?”

“না, ম্যাডাম। শুধু বলেছে, আজ একটা গন্ডগোল হবে। মাস মার্ডার হবে ডাইভারশনের জন্য। তাই আমরা যেন অ্যালার্ট থাকি।”

সিএম-এর পাশে শ্ৰীফিরহাদ হাকিম আর পার্থ চট্টোপাধ্যায় বসেছিলেন।

ফিরহাদ সাহেব বললেন, “এসব তো আমরা শুনেছি। কিন্তু তুমি যে কথায় ভরসা করে এভাবে এলে, সেটা কতটা ঠিক?”

রাজীবজি এতক্ষণ কথা বলেননি, শুনছিলেন। এবার বললেন, “কাল তোমার ফোন পাওয়ার পর আমরা শহরটাকে ইঞ্চিতে-ইঞ্চিতে খুঁজেছি। এমনকী, নেতাজি ইন্ডোরকেও ভাল করে সার্চ করেছি। কিন্তু কিছু পাইনি। আর মাস মার্ডার করতে হলে বড় ওয়েপন অথবা সেমটেক্স জাতীয় কোনও বড় বিস্ফোরক লাগে। তেমনও কিছু শহরে ঢোকেনি। আজ ছুটির দিন। সব অফিস-কাছারি বন্ধ। তাও প্রতিটি শপিং মল আর এন্টারটেনমেন্টের জায়গায় আমরা আধা-সামরিক বাহিনী ডিপ্লয় করে রেখেছি। সব দিক দিয়ে আমরা প্রিপেয়ার্ড। এবার আমাদের আরও কিছু দাও, যাতে আমরা নেক্সট লেভলে যেতে পারি।”

‘র’-এর সাউথ-ইস্ট রিজিয়নের ডেস্কের গুলাম আহমেদ আজ সকালেই এসে পৌঁছেছেন কলকাতায়। উনি বললেন, “ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ডরা রয়েছে। পিএম স্যার আসছেন। নিরাপত্তা পুরো আঁটসাঁট। তুমি এমন প্যানিক করে চলে এলে একটা ফোন কল পেয়ে!”

আদিল চোয়াল শক্ত করল। তারপর সবাইকে একবার দেখে নিয়ে সিএম— এর দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, থ্রেট তো আছেই। অদম্য সেন বাজে কথা বলার মানুষ নয়। কিন্তু আমার কথা হল, ডাইভারশন মানে কী? ও বলল, মাস মার্ডার করা হবে বোধহয় ডাইভারশনের জন্য। কিন্তু ম্যাডাম, কীসের জন্য ডাইভারশন?”

“তুমি বলো,” সিএম বললেন, “আজ ওই অনুষ্ঠান ছাড়া আর তো কিছু ঘটছে না শহরে।”

আদিল বলল, “আজ অনুষ্ঠানটায় আপনি থাকবেন, পিএম স্যার থাকবেন সঙ্গে বিদেশি অতিথিরা আসবেন। সেখানে কিছু হবে না তো?”

“সবাইকে আমরা চেক করে ঢোকাব। বারো হাজার আসন আছে স্টেডিয়ামে। লোক আসবে। উদ্বোধনের পর রাশিয়ান ব্যালে হবে। ম্যাজিক হবে। তবে গ্যালারিতে গার্ড থাকবে। তার সঙ্গে আরও এক হাজার মতো নানারকম সিকিয়োরিটি ফোর্স আমরা বাইরে ও স্টেডিয়ামের ভিতরে ডিপ্লয় করব। ঝামেলা করব বললেই হল?” রাজীববাবু তাকালেন আদিলের দিকে।

আদিল বুঝতে পারছে, এমন একটা ফোনের উপর নির্ভর করে ওর আসাটাকে কেউ ঠিক ভরসা করতে পারছে না।

সিএম বললেন, “আমি নিজে পিএম-এর সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁকে বললাম, এমন কিছু হতে পারে। অনুষ্ঠান কি পোস্টপন করব? শুনে উনি বললেন, এমন থ্রেট তো থাকেই। সেটাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তবে আমরা যেন বেস্ট প্রিকশন্স নিয়ে রাখি। কিন্তু অনুষ্ঠান হবেই।”

আদিল মাথা নাড়াল, “সরি ম্যাডাম, আমি জানি এমন একটা উটকো ফোন কলের উপর ভরসা করা যায় না। কিন্তু আমি কিছুতেই আগের চারবারের কথা ভুলতে পারছি না। অদম্য ওয়জ় নেভার রং। তাই আমি ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিয়েছি।”

“ভাল তো,”সিএম হাসলেন, “তুমিও থাকো। তেমন কিছু হলে অ্যাকশন নেবে। তা, কোথায় তোমার অদম্য সেন? নিজের লোকেশান নিয়ে কিছু বলেছে?”

আদিল মাথা নাড়ল, “না ম্যাডাম। জাস্ট দুটো সেনটেন্স বলেছে ও। আর কিছু বলেনি।”

রাজীবজি বললেন, “কিন্তু”…

সিএম হাত তুলে থামালেন রাজীবজিকে। তারপর আদিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু কোনও কারণ আর ক্লু-ও তো নেই আদিল। তাই সবাই এত কিন্তু কিন্তু করছেন। তুমি থাকো এখানে। আমাদের সঙ্গে। তবে একটা ব্যক্তিগত মতের কথা বলি। আমিও কিন্তু উদ্বিগ্ন। আগের ঘটনাগুলো থেকে আমরা শিখেছি। তাই এমন ফোন আমায় ভাবাচ্ছে! জানি না আবার আমাদের সামনে কী বিপদ আসতে চলেছে!”

পনেরো

বুধনের আজ কাজে আসার ইচ্ছে ছিল না একটুও। ছুটির দিন কোথায় একটু সুনিতাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোবে, না ডিউটি যাও। মালিক গোপুবাবু একটা আস্ত খচ্চর! আজেবাজে টাইমে কাজ পড়লেই বুধনকে ডাকে। পাবলিক হেল্থ ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে গোপুবাবুর বেশ কিছু গাড়ি খাটে। ডোঙারিয়ার জল প্রকল্পতেও গাড়ি যায়। যখন জলের সাপ্লাই থাকে, গোপুবাবু বুধনকে দিয়েই গাড়ি পাঠায়। আজ বুধন সকালে একটু বেগড়বাই করেছিল। সুনিতাকে বলা আছে সাউথ সিটিতে নিয়ে যাবে। ও অপেক্ষা করবে। আর সেখানে কাজে বেরোতে হচ্ছে!

ও বলেছিল, “স্যার, আজ ছেড়ে দিন। লম্বু বা ঢপুকে পাঠান। আমার গা ম্যাজম্যাজ করছে।”

গোপুবাবু বলেছিল, “শোন, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী আর নানা মানুষজন আসছেন। একদম ফালতুগিরি করবি না। তোকেই যেতে হবে। সে না হয় ওভারটাইম যা দিই তার চেয়ে আজ দুশো বেশি দেব।”

“দূর, আপনি মাইরি…”

বুধনকে কথা শেষ করতে দেয়নি, গোপুবাবু বলেছিল, “শোন, আজ স্পেশ্যাল ডে। ঝোলাবি না। চাকরি রাখতে চাইলে গাড়ি নিয়ে সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবি। মনে থাকে যেন।”

বুধন একটা চুয়িংগাম মুখে দিয়ে রাস্তার দিকে চোখ রাখল। গাড়ির পিছনে পাউচ জলের কার্টনগুলো রাখা। নেতাজি ইন্ডোরে পৌঁছে দিতে হবে। সুনিতা হেভি খচে গিয়েছে। ও বলেছে মাল পৌঁছে দিয়ে দেড়টার মধ্যে তিলজলায় সুনিতাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে যাবে। জানে, সুনিতা মুখ করবে। কিন্তু কী আর করা যাবে।

সামনের বাখরাহাট রোড এঁকেবেঁকে সাপের মতো পড়ে রয়েছে সকালের রোদে। বুধন অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল।

কিছুটা দূরে বাইকে বসে গাড়িটার সঙ্গে দূরত্ব রেখে এগোচ্ছে দিওস। সকাল থেকে ডোঙারিয়া মোড়ে অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষা কাজে লেগেছে। এবার গাড়িটাকে ফলো করে বা একরকম গার্ড দিয়েও বলা যায়, ওকে যেতে হবে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম অবধি। তারপর সাংবাদিক সেজে ঢুকে পড়তে হবে ভিতরে। ওর একটাই আফশোস, এই জল শুধু বিতরণ করা হবে দর্শকদের মধ্যে। ভিআইপি-দের জন্য অন্য জায়গা থেকে বোতলের জল আনানো হয়েছে। যাই হোক, এই-বা মন্দ কী!

জল যতক্ষণ না সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে ততক্ষণ ওকে থাকতে হবে স্টেডিয়ামের ভিতরে। কোনও গন্ডগোল হলে আটকাতে হবে। আর ওকে সাক্ষী হতে হবে একে একে ঢলে পড়া মানুষগুলোর মৃত্যুর। সাক্ষী হতে হবে এই দেশের ইতিহাসে অন্ধকারতম দিনটির!

ষোলো

২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫। সান হোসে, আমেরিকা।

লোকটার নাম মানাক। কোনদেশি সেটা বুঝতে পারছে না ইগর। কথা শুনেও বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা সামনের কফির কাপের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছে। মুখটা ছায়াময়। গম্ভীর।

ইগর বলল, “আপনি যা বলছেন তা ভেবে বলছেন?”

মানাক এবার মুখ তুলল, “আজ ভারতের পিএম-এর স্পিচটা শুনেছেন? টেররিজ়ম নিয়ে কী বলেছেন বুঝতে পেরেছেন? আমরা টেররিস্ট? আমাদের ঝাড়ে-বংশে শেষ করবেন? আর আমরা শেষ হয়ে যাব চুপিচুপি? হয়? আমরাও তো পালটা দেব। দেবই। তার জন্য তোমার বসের সাহায্য দরকার। সোজা পথে নয়। এমন করে ওদের মারতে হবে যাতে লোকে মনে রাখবে কয়েকশো বছর।”

ইগর বলল, “কিন্তু রিস্ক হয়ে যাবে না?”

“রিস্ক না নিলে মানুষের ইতিহাস আজও স্টোন এজে পড়ে থাকত। তা ছাড়া কঠিন কাজ বলেই তো এত পয়সা। না হলে তোমার বস কি টম ক্রুজ় নাকি যে, মুখ দেখে টাকা দেব? আর যাঁর কথা বলছি, তাঁকে যদি তুলতে পারেন, তা হলে দেখবেন সামনে না এসেও কাজটা নিখুঁতভাবে করতে পারছেন!”

“মানে! কার কথা বলছেন?”

মানাক তাকাল। তারপর বলল, “প্রোফেসর লিয়াম ব্রাইট। আমি ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম এই বছর অক্টোবরে। জাস্ট লিফ্ট হিম। উনি জানেন মানুষের রিমোট কন্ট্রোল কীভাবে তৈরি করা যায়। আচ্ছা, তোমাদের টাকা দেব, প্ল্যান করে দেব। তারপর আর বাকি সব কিছুও কি আমাকেই বলে দিতে হবে?”

ইগর হাসল।

“ডোন্ট লাফ,” মানাক চোয়াল শক্ত করল এবার, “হাসির দিন নয় এখন। হাসি মোছার দিন। ভারতবর্ষের মুখ থেকে হাসি মুছে দেওয়ার দিন। অল্টারনেট থিয়োরি আনতে হবে পৃথিবীতে। প্যারিস, ব্রাসেলস, এমনি এমনি হয়নি! একটা ইতিহাস আছে এর। আমরাও তেমন একটা দিন আনব কলকাতায়। সারা পৃথিবী এই দিনটার জন্য মনে রাখবে আমাদের।”

সতেরো

২ অক্টোবর, কলকাতা, ভারত।

হোটেলের সামনে সার-সার গাড়ি দাঁড় করানো আছে। চিরিচ টাই-টা ঠিক করে নিয়ে তাকাল দূরের দিকে। ওই তো বরিস আভেরিন দাঁড়িয়ে রয়েছে লবিতে। লাল টাই আর নীল পিনস্ট্রাইপ সুট পরে। গা জ্বলে গেল চিরিচের। রোমানভ ব্লাড না ছাই! যত্তসব বোগাস ব্যাপার! আসল হল টাকা, যে যত ওড়াতে পারবে সে তত নামী আর গুরুত্বপূর্ণ হবে! এই ডেলিগেশনের হয়ে চিরিচও তো এসেছে। ও নিজেই একজন সফল উদ্যোগপতি। মস্কোতে ওর প্রভাবও যথেষ্ট। কিন্তু তাও বরিসের মতো নয়! সেখানে চিরিচ যেন সেকেন্ড ক্লাস সিটিজ়েন হয়েই আছে! এখনও কথায় কথায় ওকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, ওরা পোলিশ উদ্বাস্তু ছিল।

ওর সব কাজে বরিস নাক গলায়। যেন বরিস ওর লোকাল গার্ডিয়ান!ইচ্ছে না হলেও বরিসকে মাখন লাগিয়ে চলতে হয় ওকে। মাঝে-মাঝে আর নিতে পারে না চিরিচ। মনে হয় উচিত শিক্ষা দেবে!

এই ডেলিগেশনেরও মাথা হয়ে এসেছে বরিস। ওকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চিরিচ চোয়াল শক্ত করল। সব জায়গায় বরিসের মাতব্বরি ওর ভাল লাগে না। এমনকী, ওই ইস্টার এগ-এর প্রদর্শনীটাও এমন করে প্রোজেক্ট করা হচ্ছে, যেন বরিসের বাপের সম্পত্তি! হতে পারে ওর গায়ে রোমানভদের রক্ত আছে, হতে পারে ইস্টার এগগুলো রোমানভদের ছিল এককালে, কিন্তু সেটা আঁকড়ে এখনও পড়ে থাকতে হবে? একটা সুযোগ পাক, চিরিচ দেখিয়ে দেবে বরিসকে যে, কত ধানে কত চাল হয়! এই ডেলিগেশনের মাথা হয়ে আসা বের করে দেবে!

আঠারো

আদিল ইডেন গার্ডেনের সামনে নেমে গেল গাড়ি থেকে। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও কিছুটা সময় আছে। কিন্তু নিরাপত্তা জোরদার। দুপুর দুটোয় শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। এক ঘণ্টা মতো সময় লাগবে। তারপর শুরু হবে ব্যালে আর ম্যাজিক। আর ইস্টার এগ-এর প্রদর্শনী শুরু কাল থেকে। ন্যাশনাল লাইব্রেরির একটা হলে।

ঘড়ি দেখল আদিল। পৌনে একটা বাজে। আর কোনও ফোন আসেনি। কোনও মেসেজ আসেনি অদম্যর কাছ থেকে। ব্যাপারটা কী! তবে কি সবাই ঠিক, অদম্য ওকে ভুল খবর দিল! কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? এতে অদম্যর লাভ কী?

ও মাথা ঘুরিয়ে আশপাশ দেখল। সারা জায়গায় পুলিশ আর আধা- সামরিক বাহিনী দিয়ে মোড়া। দেশের প্রধানমন্ত্রী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আসছেন, সঙ্গে বিদেশের ডেলিগেশন। নতুন শিল্প হবে এই রাজ্যে। তারপর দেশের বাকি জায়গাতেও। ফলে আজকের অনুষ্ঠানের গুরুত্বই আলাদা।

আদিল ধীরে-ধীরে হাঁটতে লাগল স্ক্র্যান্ড রোডের দিকে। কয়েকবার ওকে আইডেনটিটি কার্ড দেখাতে হয়েছে।

আদিল ভাল করে চারদিক দেখতে লাগল। খুব নিঃশব্দে কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিরাপত্তা বাড়ানো হয়ে গিয়েছে। বড়-বড় মলগুলোর সিসি টিভি ফুটেজ চেক করা হচ্ছে। প্যানিক যাতে তৈরি না হয় তেমনভাবেই নিরবে বম্ব স্কোয়াড সন্দেহজনক জায়গাগুলো তল্লাশি করছে।

আদিল ভাবল, মাস মার্ডার আর ডাইভারশন কথাটা নিশ্চিতভাবে এক সুতোয় গাঁথা। কিন্তু কীভাবে? মাস মার্ডার হলে সেইদিকে মন চলে যাবে প্রশাসন ও নিরাপত্তারক্ষীদের। কিন্তু তারপর? তারপর কী হবে?

ইডেন গার্ডেনের পাশে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র। তার পাশেই নেতাজি ইন্ডোর। সব নিখুঁতভাবে মোড়া। তা হলে? তা হলে কেন এমন বলল অদম্য? আচ্ছা, ওর নিজের কোনও অ্যাজেন্ডা নেই তো? ও নিজে ভাবনাটা শেষ করতে পারল না তার আগেই পকেটের মোবাইলটা নড়ে উঠল। কে এখন? অদম্য?

দ্রুত মোবাইলটা বের করল আদিল। দেখল, কমান্ডার জসবির সাইনি!

“ইয়েস স্যার,” আদিল কানে ফোনটা ধরে সোজা হল।

জসবির সময় নিলেন একটু। তারপর বললেন, “আদিল, ইউ আর রাইট। দেয়ার ইজ সামথিং, সামথিং বিগ।”

উনিশ

২ অক্টোবর, দিল্লি, ভারত।

নীলেশ মলহোত্র ডেস্কের দিকে তাকালেন। গত সাড়ে ছ’মাস ধরে চেষ্টা করছেন। তা-ও বুঝতে পারেননি। কিন্তু আজ সকালে কী যে হল! এমন একটা ফিল্মের কথা মনে পড়ল যে, সব যেন এক নিমেষে মিলে গেল।

নীলেশ কফি হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে আসছিলেন সকালে। তখন পাশ দিয়ে দু’জন সহকর্মী হাঁটছিল। তাদের একজন বলল ফিল্মটার নাম, ‘দি আনইউজু়য়াল সাসপেক্টস’। আর সঙ্গে-সঙ্গে যেন চমকে উঠেছিলেন নীলেশ।

পাপ্পাচান নামে ‘র’-এর এক এজেন্ট খুন হয় বালিতে। এই বছর মার্চ মাসের ঘটনা সেটা। কিন্তু তার ঘরে তেমন কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায়নি। ‘র’ সন্দেহ করেছিল যে, পাপ্পাচানের ঘরে যা ছিল সব সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নীলেশ নিজে ইনভেস্টিগেশনের জন্য গিয়েছিলেন বালিতে। চারদিন ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছিলেন পাপ্পাচান যে ঘরে থাকত সেটা। কিন্তু কিছুই পাননি। শুধু চলে আসার দিন সকালে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল একটি ছেলে। সে ওই হোটেলেরই প্যান্ট্রিতে কাজ করত। ছেলেটির নাম সুলেমান। সুলেমান নীলেশের হাতে তিনটে ম্যাগাজিন দিয়ে বলেছিল, “স্যার, এগুলো পাপ্পাচান যেদিন মারা যায় সেদিন বিকেলে আমায় রাখতে দিয়েছিল। বলেছিল, ওর কিছু হয়ে গেলে যদি কেউ খোঁজ করতে আসে, তা হলে যেন তাকে দিই।”

নীলেশ অবাক হয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন, “তা এতদিন বলোনি কেন?”

সুলেমান মাথা নিচু করে নিয়েছিল। তারপর ভয়ের গলায় বলেছিল, “পাপ্পাচান খুন হয়। ওর ঘরের জিনিসপত্র সব উধাও হয়ে যায়। তাই সাহস পাইনি স্যার। কিন্তু কাল রাতে মনে হল, এটুকু আমি করতে পারব না? পাপ্পাচান খুব ভাল ছেলে ছিল। আমায় বেশ কয়েকবার টাকা ধার দিয়েছে মায়ের চিকিৎসার জন্য। তাই ভাবলাম এটুকু আমিও কি পারি না?”

ম্যাগাজ়িনগুলো নিয়েছিলেন নীলেশ।

তারপর থেকে ম্যাগাজ়িনগুলো সব উলটেপালটে দেখেছেন। পাপ্পাচান মৃত্যুর ঠিক আগে বলতে গিয়েছিল পিএম-এর উপর অ্যাটাক হবে। কিন্তু কবে? দিনটা জানা যায়নি।

মোট তিনটে ম্যাগাজিন। কিন্তু তার দুটোয় নানারকম আর্টিকেলে দাগ দেওয়া। পিএম-এর নানা দেশে ঘোরার ছবি। শান্তি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বক্তৃতার সংবাদে দাগ দেওয়া। এমনকী, কয়েকটা ছবিতে তো পিএম-এর ছবিতে টার্গেট আঁকা! অর্থাৎ তাঁকে হত্যার চক্রান্ত চলছে।

কিন্তু কবে? কবে সেটা? কবে পিএম-কে টার্গেট করছে সন্ত্রাসবাদীরা?

কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না নীলেশ। তারপর হঠাৎ ফিল্মটার নাম শুনলেন। পুরো একটা বানানো গল্প চলে এল সামনে। বুঝতে পারলেন, মোট তিনটে ম্যাগাজ়িনের দুটোয় ছবিতে আর খবরে দাগ দেওয়া আর বাকি একটা? সেটা? সেটা এমন পরিচ্ছন্ন কেন? তবে কি যেটা পরিচ্ছন্ন লাগছে, ইনোসেন্ট লাগছে সেটাতেই কিছু আছে?

তারপরেই ঘরে ঢুকে কফির কাপটা রেখে দিয়ে সেই ম্যাগাজিনটা খুলে দেখেছেন যে, তাতে কিছু না থাকলেও আবছাভাবে কয়েকটা পাতার কোণে মোড়ানোর দাগ! কেন এমন? কী আছে সেই পাতাগুলোয়? কেন এমন চিহ্ন দেওয়া?

প্রথম মোড়ানো পাতাটা খুব সাধারণ সূচিপত্র। দ্বিতীয়টা একটা মোবাইলের বিজ্ঞাপন। আর সব শেষের মোড়ানো পাতাটায় কয়েকটি মেয়ের ছবি।

কী সম্পর্ক এর? তখনই মাথায় এসেছিল, ‘দি আনইউজুয়াল সাসপেক্টস’ যা দেখা যাচ্ছে তা নয়! তবে?

এবার পাতার শেষের দিকে চোখ দিয়েছিলেন নীলেশ। কোন পাতা মোড়ানো? প্রথমটা দু’নম্বর পাতা। তার পরেরটা দশ নম্বর পাতা আর শেষেরটা ষোলো!

অর্থাৎ, ০২.১০.১৬। মানে আজ! চমকে উঠেছিলেন নীলেশ।

পাপ্পাচান সকলের চোখ এড়িয়ে এভাবে রেখে গিয়েছে ওর খবর।

নীলেশ ডেস্কের দিকে তাকালেন। তারপর ছিটকে উঠে দরজা খুলে দৌড়োলেন বসের ঘরের দিকে। সোয়া বারোটা বাজে। বসকে বলে এক্ষুনি খবর পাঠাতে হবে সকালবেলা কলকাতায় পৌঁছে যাওয়া গুলাম আহমেদ স্যারকে। আদিল নামে মার্কোসের কমান্ডোটি যে খবর পেয়েছে সেটা ঠিক।

কমান্ডার জসবির সাইনি খুব বন্ধু নীলেশের। আজ ভোরে জসবির ফোন করেছিলেন ওঁকে। এই আদিলের ব্যাপারে কথা বলার জন্য। নীলেশ ঠিক করলেন এবার এমন একটা খবর জসবিরকে দিতেই হবে। না, অন্য কেউ হলে নীলেশ তাকে খবরটা দিতেন না। কিন্তু জসবির অন্য মানুষ! ব্যাটালিক সেক্টরে জসবির না থাকলে মারাই পড়তেন নীলেশ। তাই নীলেশ ভাবলেন, জসবিরকে আন-অফিশিয়ালি বলাই যায়। বসের ঘরে ঢোকার আগেই তাই থমকে দাঁড়ালেন নীলেশ। তারপর পকেট থেকে বের করলেন ফোনটা।

কুড়ি

২ অক্টোবর, কলকাতা, ভারত।

আদিল ফোনটা কেটে, কী করবে ভাবল। তবে তো অদম্য ঠিক। এখন? এখন কী করবে ও? ওর তো এখনই সিএম-এর সঙ্গে কথা বলা দরকার। এখনই! তেমন হলে পিএম যাতে না আসেন সেটাও বলতে হবে।

আদিল এদিক-ওদিক তাকাল। সবই তো নিচ্ছিদ্র মনে হচ্ছে? কিন্তু কোথাও তো একটা ফুটো আছে। একটা মারণ ফাঁক আছে। আর সেটা দিয়েই কি ঢুকবে কিছু? কী ঢুকবে? আদিল দেখতে পাচ্ছে না কেন?

আচমকা পিছনে প্যাঁক প্যাঁক করে হর্ন শুনতে পেল ও। দ্রুত ঘুরে তাকাল আদিল। একটা নীল রঙের ছোট ম্যাটাডোর ধরনের গাড়ি আসছে। অল্পবয়সি একটা ছেলে চালাচ্ছে।

গাড়িটা সামনের ব্যারিকেডে আটকে গিয়েছে। পুলিশ সার্চ করছে। ওদের কথাবার্তা দূর থেকেও শুনতে পেল আদিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের জন্য জল এসেছে। ছেলেটা কাগজ দেখাচ্ছে। পুলিশের লোকজন গাড়িটার তলায় আয়না লাগানো লাঠি দিয়ে দেখছে। পিছনের ডালা খুলে দেখছে, রুটিন চেকিং!

আদিল মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর মোবাইলটা থেকে একটা নাম্বার ডায়াল করল। সিএম আজ নিজের মোবাইলের নাম্বার দিয়েছেন আদিলকে। বলেছেন তাঁকেই সরাসরি যোগাযোগ করতে দরকারমতো।

আদিল সেই নাম্বারেই রিং করল। রিং হয়ে চলেছে। আদিল দেখল গাড়িটা সিকিয়োরিটি পার করে চলে গেল নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের দিকে।

আদিলের টেনশন হচ্ছে। সবই তো স্বাভাবিক! তবে কোথা দিয়ে ঢুকবে শয়তান? কোন রন্ধ্র সামনে থেকেও এখনও অদৃশ্য!

দূরে মোটরবাইকটা পার্ক করে একটু হেঁটে এসেছে দিওস। দেখেছে নীল ছোট গাড়িটাকে তল্লাশি করা হচ্ছে। হাসি পেয়েছে ওর, খোঁজ, ভাল করে খোঁজ!কিচ্ছু পাবিনা। গাড়িটা বেরিয়ে যাওয়ার পর দিওস ঘড়ি দেখল। এখনও সময় আছে। পোশাক বদলে সাংবাদিকের কার্ড, ক্যামেরা আর ধড়াচুড়ো পরতে হবে। আর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ হল ওই ফাঁকা চোখটায় পরতে হবে একটা চোখ, নকল চোখ! স্বাভাবিক দেখতে হওয়া চাই ওকে। কোথাও যেন কোনওভাবেই কারও চোখে না ও পড়ে যায়।

একুশ

১৮ অক্টোবর ২০১৫। চেলসি, ইংল্যান্ড।

সাদা ওল্ড টাউন হলের ভিতরটায় আগেও কয়েকবার এসেছিলেন লিয়াম। কিন্তু এবারের আসাটা স্পেশ্যাল। কারণ, বহুদিনের বন্ধু প্যাট্রিকের মেয়ের বিয়ে আজ এখানে। আজকাল আর এসবে আসেন না লিয়াম। নেহাত প্যাট্রিক আমেরিকায় উড়ে গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছিল বলে আসতে হয়েছে। আর সত্যি বলতে কী, এসে ভালই লাগছে। বহুবছর পরে দেখা হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে। এখনও বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। প্যাট্রিক দৌড়োদৌড়ি করছে আয়োজন দেখার জন্য। এই সুযোগে সকলের কাছ থেকে সরে গিয়ে একটু বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন লিয়াম। ওল্ড টাউন হলের ভিতরে বসে তো আর চুরুট খাওয়া যায় না!

টাউন হলের নীল দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন লিয়াম। দু’পাশে দুটো বড় গাছ। কী গাছ জানেন না তিনি। কিন্তু ভালই ছায়া দিয়েছে। তারই একটার তলায় দাঁড়িয়ে লিয়াম চুরুট বের করে মুখে দিলেন। পাশ ফিরে একবার দেখেও নিলেন কমলা আর সাদা রঙের ওল্ড টাউন হলের লম্বা দেওয়াল আর তার লম্বাটে কাচের জানালাগুলোকে। আকাশের নীল রং কাচের গায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে। এখনও বেশ কিছু সময় আছে হাতে।

লিয়াম বুকপকেটে হাত দিলেন। যাঃ, দেশলাই কোথায়? প্যান্টের পকেটও হাতড়ালেন। নেই। চুরুটটা দাঁতে কামড়ে ধরে এদিক-ওদিক তাকালেন লিয়াম। আচ্ছা জ্বালাতন! বয়স হচ্ছে বলেই কি আজকাল সব ভুল হয়? কিন্তু আর কিছু করার আগেই হঠাৎ লাইটার জ্বালানো একটা হাত এগিয়ে এল ওঁর দিকে। লিয়াম মুখটা না দেখেই আগুনটা নিলেন। চুরুট দিয়ে যতটা পারলেন আগুনটা শুষে নিলেন নিজের মধ্যে। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে তাকালেন লোকটার দিকে। ঠিক লোক নয়, বরং অল্পবয়সি একটা ছেলে। সামান্য বাদামি চামড়া, খাড়া নাক, লম্বাটে মুখ, ঘন ভুরু।

“থ্যাঙ্কস,” লিয়াম মাথা নাড়লেন।

“মাই প্লেজ়ার প্রোফেসর ব্রাইট,”ছেলেটি হাসল।

লিয়াম অবাক হলেন, “আমায় চেনো?”

ছেলেটি সামান্য সরে এল। তারপর বলল, “স্যার, আমি আপনাকে চিনি। আসলে আমার যে ফিল্ডে ইন্টারেস্ট, সেই ফিল্ডের সবাই আপনাকে চেনে।”

“মানে?” লিয়াম অবাক হলেন।

ছেলেটি বলল, “প্রোজেক্ট এম কে-আল্টা স্যার। যাকে কেউ-কেউ ‘ইলিউমিনাত্তি প্রোজেক্ট’-ও বলে। যা সিআইএ শুরু করেছিল ১৯৫০-এর দশকের প্রথম ভাগে আর থামিয়ে দিয়েছিল ১৯৭৩-এ। এমনকী, তার প্রচুর নথিও পুড়িয়ে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল।”

লিয়াম হেসে ছেলেটির দিকে তাকালেন। উনি জানেন। এই সবই উনি জানেন। কারণ, ওই প্রোজেক্টে লিয়াম নিজেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সে তো বহু আগের ব্যাপার।

ছেলেটিও হাসল, “আমি জানি স্যার। সিআইএ মাইন্ড কন্ট্রোলের উপর পরীক্ষা করছিল।”

লিয়াম চুরুটে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওসব বোকামো। প্যারানইয়া অফ আ কান্ট্রি! কোল্ড ওয়ার চলার সময় ওরকম অনেক কিছু হত। আর সত্যি বলো তো, তুমি এসবে বিশ্বাস করো?”

ছেলেটি বলল, “আসলে স্যার, বিশ্বাস একটা অদ্ভুত বস্তু! যার সঙ্গে হয়েছে সে বিশ্বাস করে, যার সঙ্গে হয়নি সে লজিক দেখায়। গোটা ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন রিলিজিয়াস গ্রুপ, শামান, মেডিসিন মেন, অ্যাপোথেকারিস, বিভিন্ন কাল্ট, উইচ ইত্যাদিরা মাইন্ড কন্ট্রোল করার জন্য ওষুধ ব্যবহার করে এসেছে।”

“আর সবাই মিজ়ারেবলি ফেল করেছে,” লিয়াম হাসলেন, “যেমন সিআইএ-ও করেছিল।”

“সিআইএ ইলিউমিনাত্তি প্রোগ্রামে তো হাইতির স্যাটানিক ভোডোউন কাল্ট-কেও ব্যবহার করেছিল। ওদের মধ্যে ওই ওঝা ধরনের লোক, যাদের ওরা ‘বকরস’ বলত, তাদেরও সাহায্য নিয়েছিল সিআইএ। ধুতরো ফলের সঙ্গে আরও নানা কিছু মিশিয়ে ওরা তৈরি করেছিল একটা ওষুধ। যা ‘জোম্বি কিউকাম্বার’ নামে বিখ্যাত বা কুখ্যাত। মানুষ এতে মরত না কিন্তু দেয়ার মাইন্ড ওয়জ় শাট অফ!”

লিয়াম মাথা নাড়লেন। এবার বিরক্ত লাগছে। কী চায় ছোকরা? উনি বললেন, “ভাই রে, কী চাও? এসব ইতিহাস কি এই বয়সে ভাল লাগে?”

ছেলেটি হাসল আবার। বলল, “সরি স্যার। আসলে আয়াম ইয়োর ফ্যান। আপনাকে ইমপ্রেস করতে এত কিছু বললাম।”

“আর কীসের ফ্যান?”লিয়াম অলস চোখে তাকালেন ছেলেটির দিকে, আমি তো ফেল্ড সায়েন্টিস্ট! ওই প্রোজেক্ট বন্ধ হওয়ার পর ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে পেট চালিয়েছি।”

“আপনি খুব হাম্বল স্যার,”ছেলেটি হাসল, “নিজের অ্যাচিভমেন্টকে ছোট করে দেখছেন?”

“মানে?”

ছেলেটি তাকাল লিয়ামের দিকে। তারপর বলল, “প্রোফেসর ব্রাইট। কিছুই কোনওদিন চিরতরে শাট ডাউন হয় না। যে সিআইএ ওটা সবার সামনে বন্ধ করে দিয়েছিল, সেটাই তলায়-তলায় টেক আপ করেন একজন বিলিয়নেয়ার আর আপনি সেখানে আজও কাজ করেন। আর শুধু করেনই না, আপনারা সেই এল ডোরাডো ড্রাগটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যা মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দিলে তাকে দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। মানে ধরুন, আপনার স্মার্ট ফোনকে আপনি যেমন ভয়েস কমান্ড দিয়ে কাজ করাতে পারেন, তেমনই কাউকে ওই ওষুধ ইনজেক্ট করিয়ে আপনি তাকে দিয়েও ইচ্ছেমতো কাজ করিয়ে নিতে পারেন।”

“তাই?” লিয়াম হাসলেন, “আষাঢ়ে গপ্পো ভালই লেখো তো?”

“আমি আর কী লিখি স্যার,” ছেলেটি হাসল, “আমি তো জাস্ট খবর সংগ্রহ করি। ঠিক জায়গায় ঠিক লোকের ঠিক জিনিসে প্রেশার দিলে সব খবর পাওয়া যায়।”

“যাক, তুমি থাকো তোমার গপ্পো নিয়ে,” লিয়াম এবার কাটাতে চাইলেন ছেলেটিকে। মুখে যতই হাসি দেখান না কেন, মনের ভিতরে একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছে। ছেলেটা এসব জানল কী করে? কে ছেলেটা?

ছেলেটা আবার বলল, “স্যার, আপনারা হিউম্যান ফেরোমোন সিন্থেসিস করে ওষুধটা তৈরি করেছেন। মানে ধরুন, আমার শরীর থেকে আমার ফেরোমোন নিয়ে সেটা দিয়ে ওই ওষুধ তৈরি করে যদি অন্য কাউকে সেটা ইনজেক্ট করা হয়, তবে সে আমার ভয়েস কমান্ডে চলা স্মার্ট ফোন হয়ে যাবে। আমার ফেরোমোন সিগনেচার তাকে কন্ট্রোল করবে।”

লিয়াম এবার শক্ত গলায় বললেন, “তুমি উন্মাদ!”

“স্যার, আমি ইনফো কালেক্ট করি মাত্র। আপনারা যেটা করেছেন সেটাই শুধু আমি জেনেছি!”

“পাগল! বদ্ধ পাগল!” লিয়াম আর না দাঁড়িয়ে চুরুটটা মাটিতে ফেলে সেটাকে পা দিয়ে পিষে ওল্ড টাউন হলের ভিতরের দিকে হাঁটতে লাগলেন।

ছেলেটি বাইরে দাঁড়িয়ে হাসল। তারপর সামান্য গলা তুলে বলল, “আরে, পালাচ্ছেন যে!কিন্তু স্যার, যে পালায় তার জন্য তো পৃথিবী ছোট হয়ে পড়ে। উই উইল মিট আগেন স্যার। ইন আ বেটার প্লেস অ্যান্ড ইন আ বেটার টাইম। বাই দ্য ওয়ে, আমি তো নিজের পরিচয়টাই দিলাম না। স্যার, আমি আপনার একজন সত্যিকারের গুণগ্রাহী, আমার নাম মানাক।”

বাইশ

২ অক্টোবর, ২০১৬ কলকাতা, ভারত।

ফোনটা কেটে গুলাম আহমেদ তাকালেন সবার দিকে। দেখলেন, সিএম নিজেও একটা ফোন শেষ করে ফোনটা টেবলে রাখলেন।

তবে আদিল সত্যি বলছিল! গুলাম কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।

সিএম বললেন, “আদিল বাজে কথা বলার ছেলে নয়। আর ওকে যে খবর দিয়েছে সে তো নয়ই। মিস্টার আহমেদ, আপনি প্লিজ় ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ডকে অ্যালার্ট করুন। আপনাদের চিফের সঙ্গে কথা বলুন। দেখুন প্রধানমন্ত্রীজিকে বলে। আমরা কিন্তু কোনও রিস্ক নেব না।”

গুলাম বললেন, “দিল্লি থেকেও পিএম-এর সঙ্গে কথা হয়েছে। আমারও কথা হয়েছে ওঁর চিফ অফ সিকিয়োরিটির সঙ্গে। কিন্তু উনি বললেন, এমন থ্রেট থাকেই। তা বলে বিদেশি ডেলিগেটদের প্রোগ্রাম বাতিল করবেন না। এটা একটা সৌজন্যের ব্যাপার। আর সামনে যেখানে শিল্পের সম্ভাবনা আছে সেখানে অনুষ্ঠান হবেই। পিএম ল্যান্ড করলেন বলে দমদমে।”

সিএম এবার পাশে বসা মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে তাকালেন। বললেন, “দেখবেন, কোথাও যেন কোনও ত্রুটি না হয়।”

বাসুদেববাবু বললেন, “সব প্রপারলি অ্যারেঞ্জড ম্যাডাম। অমিতবাবু পিএম-কে রিসিভ করতে গিয়েছেন।”

“রাজীবজি আপনি নিরাপত্তাটা আরও বাড়ান,” সিএম চশমাটা হাতে নিয়ে ঘোরালেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার বললেন, “প্রধানমন্ত্রীজি তো সোজা স্টেডিয়ামে যাবেন, না? পথে যদি…”

রাজীবজি বললেন, “ম্যাডাম, আমরা সব দিক লক্ষ রেখেছি। ডামি কার যাবে। পিএম স্যারের কনভয়কে ট্র্যাক করা সম্ভব হবে না।”

সিএম এতক্ষণ হাঁটছিলেন। এবার বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। তারপর কিছুটা যেন নিজের মনেই বললেন, “আপাতদৃষ্টিতে সব শান্ত। সব ঠিকঠাক। কিন্তু আচমকা আদিলের আসা! ‘র’-এর খবর ডিসাইফার করা! বিদেশি ডেলিগেট! সব কেমন জটিল হয়ে যাচ্ছে। আর সব কিছুর মধ্যে সেই অদম্যর মেসেজ! কী হচ্ছে এসব? কোথায় শেষ হবে আজকের দিনটা?”

তেইশ

গাড়িতে বসে ঘড়ি দেখল অদম্য। একটা বাজে। আর বেশি সময় নেই। ওদিকে সবাই নাকি প্রায় প্রস্তুত। তাই ওদেরও বেরিয়ে পড়তে হয়েছে নেতাজি ইন্ডোরের উদ্দেশে।

কলকাতার যানজট বিখ্যাত। কিন্তু আজ যেহেতু ছুটির দিন, তাই রাস্তাঘাট অতটা গাড়ি-বহুল নয়। তাও ওদের কনভয়ের সামনে আর পিছনে দুটো পাইলট ভ্যান চলছে। ফলে গাড়ি আরও দ্রুত এগোচ্ছে।

গাড়িতে ওর পাশে বসে রয়েছে ইলিয়ানা। আর সামনে আর-একটি লোক। বিদেশি একজন সিকিয়োরিটি।

সকলের চোখ এড়িয়ে ইলিয়ানা আলতো করে হাত ধরেছে অদম্যর। অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সামনের লোকজন বুঝলে বাজে ব্যাপার হবে। যদিও অদম্য জানে এসব নিয়ে কারও হয়তো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু তা হলেও ওর নিজের এসব ভাল লাগছে না। সামনে কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে! ওই একটা ফোন কল ইন্টারসেপ্ট করেছে ও। আর কিছু নয়। এর মধ্যে অকল্যান্ডে জনকে যোগাযোগ করেছিল একবার। ওই মোবাইল ফোনটার গতিবিধি নিয়ে প্রশ্ন করেছিল।

জন বলেছিল, সেই যে একটা কলের পর মোবাইল অফ হয়েছে আর কানেকশন ফিরে আসেনি।

এটাই চিন্তায় ফেলছে অদ্যমকে। কী হতে পারে? ম্যাসাকার বলতে কী বলা হচ্ছে? আর ডাইভারশন, সেটাই বা কী?

আবার ইলিয়ানা আলতো করে হাত ধরল ওর। অদম্য সরিয়ে নিল হাতটা। ইলিয়ানা চাপা গলায় বলল, “কাল রাতে ভাল লাগেনি? এমন স্ট্রেঞ্জলি বিহেভ করছ কেন?”

অদম্য বলল, “আমরা এখন অন ডিউটি তো।”

ইলিয়ানা শ্রাগ করল, “ইউ ওয়্যার গ্রেট লাস্ট নাইট। আসলে আই ওয়জ় সো হাই তাও আই রিমেমবার ইউ ওয়্যার ভেরি গুড।”

অদম্য জানালার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করল। সঙ্গে-সঙ্গে মনে ভেসে উঠল রাতটা। ইলিয়ানার মোমের মতো শরীর। নখের আঁচড়। ভেসে উঠল ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলা কথাগুলো।

কথাগুলো যে সত্যি, এখন বুঝতে পারছে অদম্য।

ও কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “তোমার শরীর ভাল আছে তো?”

ইলিয়ানা হাসল, “ফিট। আই উইল শো ইউ।”

“আর ইনসুলিন?”

ইলিয়ানা বলল, “সে আমি নিয়ে নেব। ওখানে অনুষ্ঠানের পর তো লাঞ্চ আছে। তার আগেই নিয়ে নেব এক ফাঁকে।”

অদম্য আর বিশেষ কিছু বলার আগেই গাড়ির কনভয় এসে দাঁড়াল নেতাজি ইন্ডোরের সামনে। ইলিয়ানা ওর দিকে চোখ টিপে নেমে গেল। অদম্যও নামল। তারপর ইলিয়ানার পিছনে এগোতে গেল। কিন্তু তখনই সামনে বসা সিকিয়োরিটির লোকটি হাসিমুখে এগিয়ে এল ওর দিকে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বলল, “নিজের কাজে মন দাও। মনে আছে তো মেমরি অফ আজ়ভ। না পারলে কিন্তু কেউ রক্ষা পাবে না।”

চব্বিশ

আদিল স্টেজের নীচে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। সব কিছুই স্বাভাবিক। লোকজনে স্টেডিয়াম পূর্ণ। স্টেজটা একপাশে করা হয়েছে। দু’মানুষ সমান উঁচু স্টেজ। পিছন দিয়ে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। পুলিশ আর কমান্ডোয় থিকথিক করছে। লোকজনও উসখুস করছে। অতিথিদের জন্য মঞ্চের সামনে চেয়ার পাতা হয়েছে। তাতে দেশের বিভিন্ন শিল্পপতি, মন্ত্রী ও আমলা রয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী এসে গিয়েছেন। একটা ঘরে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সচিবস্তরের মানুষদের সঙ্গে শেষ পরামর্শটুকু করে নিচ্ছেন।

মঞ্চের সামনে প্রেস আর টিভির লোকজনও রয়েছেন। বেশ কয়েকজন রিপোর্টারকে চেনে আদিল। কিন্তু বিদেশি প্রেস থেকে আসা রিপোর্টারদের চেনে না। আদিল ওর অভ্যস্ত চোখে চারদিকটা মেপে নিল। সব শান্ত।

“কী আদিল? ইজ়়এভরিথিং অলরাইট?”

আদিল দেখল, ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন গুলাম আহমেদ।

আদিল বলল, “সেটাই তো স্যার বুঝতে পারছি না।”

গুলাম চিন্তিত মুখে বললেন, “নীলেশ সকাল থেকে আরও নানা সোর্সে পাওয়া খবরও ক্রস চেক করছে। হ্যাঁ, সেখানে একটা অ্যাসাসিনেশন অ্যাটেম্পটের কথা বলা হয়েছে বটে, কিন্তু ডেট বলতে ওইটুকুই পাওয়া গিয়েছে। আসলে সবটাই তো অ্যানালিসিসের উপর নির্ভর করে! হয়তো ক্লু হিসেবে ও যেটা দেখছে, সেটা নিছকই কোয়েন্সিডেন্স।”

আদিল বলল, স্যার, “এতটা কোয়েন্সিডেন্স হবে? পাপ্পাচান নামে যে- মানুষটি মারা গিয়েছিলেন, তাঁর শেষ কথা তো ছিল ওই পিএম স্যারের উপর অ্যাটাকের নিউজ়়। তাঁর রেখে যাওয়া বইগুলোতে যা পাওয়া গিয়েছে, সেগুলো তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

গুলাম বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই জানো, সারা মাসে কতগুলো এমন খবর আমরা পাই? সাধারণ লোক জানে না। কিন্তু আসলে কত থ্রেট কল বা কত ষড়যন্ত্রের কথা আমরা জানতে পারি, সেটা কি তুমি জানো না? কিন্তু তা-ও যেখানে দেশের মাথার নিরাপত্তা জড়িত, সেখানে আমাদের তো সতর্ক হতেই হবে। কিন্তু সব তো ভীষণ নর্মাল। কোআয়েট!”

আদিল বলল, “হতে পারে তারা প্ল্যান বাতিল করেছে। তাও আমাদের তো সতর্ক হতেই হবে।”

গুলাম আদিলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “আমি ওদিকটা দেখি। দুটো বাজে। এবার অনুষ্ঠান শুরু হবে।”

আদিল দেখল, গুলাম আহমেদ ধীরে-ধীরে চলে গেলেন মঞ্চের পিছন দিকে। ও চোয়াল শক্ত করল। ডাইভারশন! মাস মার্ডার! কী মানে কথাগুলোর? সামনে যে এত হাজার মানুষ বসে রয়েছেন, সেটাই কি মাস মার্ডারের টার্গেট?

ও দেখল দূরে কয়েকটা ছেলে ঢুকছে। কেটারিং-এর পোশাক পরা। হাতে বড় ব্রাউন রঙের প্যাকেট! অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর দেওয়া হবে জল।

মঞ্চের দিকে ফিরল আদিল। সঞ্চালিকা এসে গিয়েছেন। মাইকে তিনি বলছেন, “প্লিজ, গিভ আ ওয়ার্ম রাউন্ড অফ অ্যাপ্লজ় টু আওয়ার অনারেব্‌ল গেস্টস।”

মানুষজন উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন। আদিল দেখল, বিদেশি ডেলিগেটদের সঙ্গে মঞ্চে এলেন প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রী। এত ভিড়ের ভিতরও আদিল লক্ষ করল, মুখ্যমন্ত্রী তাকালেন ওর দিকে, তারপর ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, সব ঠিক আছে তো?

পঁচিশ

২ অক্টোবর ভোররাত। কলকাতা, ভারত।

ভাই বল হাতে দৌড়ে আসছে। ছোট্ট মাঠটার চারধারে গিজগিজ করছে লোকজন। রোগা লম্বা ভাই বাঁ হাতে বলটা ধরে কোনাকুনিভাবে দৌড়ে আসছে পিচের দিকে। ব্যাটসম্যানটি দু’পা ফাঁক করে স্টান্স নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উইকেট থেকে বেশ কিছুটা দূরে উইকেট-কিপার। দুটো স্লিপ, একটা গালি আর একটা কভার রেখে বল করছে ভাই।

আকাশে খুব রোদ। কিন্তু তাও গরম নেই একটুও। শুধু হাওয়া দিচ্ছে আজ। খুব হাওয়া দিচ্ছে। ভাইয়ের লম্বা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। ম্যাচের শেষ ওভার, উত্তেজনায় সবাই টান টান হয়েছে। আর দু’বল বাকি। ভাই কি পারবে তিনটে রান আটকে দিতে? লোকজন চিৎকার করছে। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডের ব্যাটসম্যানটি এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছে। আর ভাই এগিয়ে আসছে। বাঁ হাতে ধরা লাল টুকটুকে চেরি ফলের মতো বল। সেলাই বরাবর দু’আঙুল দিয়ে বলটা গ্রিপ করেছে ভাই। বলের চকচকে দিকটা বাইরের দিকে। শেষবেলার রোদ পড়ে ঝিকোচ্ছে লাল গোলক!

ভাই এগিয়ে আসছে। ব্যাটসম্যানটি ব্যাট তুলে সামনে তাকিয়ে। ওই ভাই পপিং ক্রিজ়ে এসে পড়ল। লাফিয়ে উঠল। তারপর হাত ঘুরিয়ে বলটা ছাড়তে যাবে ঠিক তখনই কীসের যেন একটা শব্দ হল ঝনঝন করে। আর ঘুম ভেঙে চোখ খুলে তাকাল নীতিন!

অন্ধকার ঘরের এক কোণ দিয়ে আবছা আলো আসছে। ঘরের এসিটা চললেও তেমন ঠান্ডা হচ্ছে না তো!

হোটেলের ঘরটা ছোট। তার মধ্যে প্রথম রাত। তাই ফার্নিচারগুলোর প্লেসমেন্ট এখনও ঠাহর করে উঠতে পারেনি নীতিন। এমন একটা স্বপ্ন দেখছিল যে, এখনও বুকের মধ্যে কেমন করছে। তার ভিতর আচমকা ঘুমটা ভাঙল।

ভাইটা ভাল ক্রিকেট খেলত। রঞ্জিতে রাজ্যের হয়ে চান্সও পেয়েছিল। কিন্তু কী যে হল! সব ভেঙে গেল একসঙ্গে! এমন একটা অসুখে ধরেছে, চোখের সামনে আস্তে-আস্তে যেন হাত ছেড়ে জলের ভিতর তলিয়ে যাচ্ছে ভাই। নীতিন নিতে পারে না এই দৃশ্য। ভাই যখন ওর দিকে তাকায়, মনে হয় ভাইয়ের সঙ্গে ও নিজেও মরে যাচ্ছে।

যদি নীতিনের কিডনি ম্যাচ করত, তবে তো কবেই দিয়ে দিত। কিন্তু ঈশ্বর সেখানেও বাধ সেধেছেন। এখন দরকার টাকা! লক্ষ লক্ষ টাকা।

নীতিন হাত বাড়িয়ে দু’-তিনবারের চেষ্টায় পাশের সুইচটা জ্বালাল। তারপর খাটের পাশে রাখা লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এমনিতে নকল পা পরলেও রাতে শোওয়ার সময় সেটা খুলে রাখে নীতিন। আর রাতে ওঠার দরকার হলে একটা লাঠি ব্যবহার করে। লাঠিটা নিয়ে উঠে পাশের টেবলে রাখা বোতল থেকে একটু জল খেল নীতিন। তারপর ভাল করে তাকাল। দেখল, এসি চললেও দূরের একটা কাচের জানালা খোলা।

ছ’তলার উপরে ঘর, তাই জানালায় গ্রিল নেই। নীতিন লাঠিতে ভর দিয়ে জানালাটার কাছে গেল। উঁকি মেরে দেখল রাস্তা ভেজা, বৃষ্টি হয়েছে।

নীতিন মাথা বাড়িয়ে হালকা ঠান্ডা ভাবটা বুঝতে পারল। তারপর জানালাটা টানল বন্ধ করার জন্য। আর তখনই অবাক হল। একটা পাল্লার কাচের নীচটা কাটা!

চট করে নীতিন নিজের শরীরটাকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়াল। পাশেই একটা ছোট টেবল। তাতে ফুলদানি রাখা ছিল। এবার দেখল, ফুলদানিটা মাটিতে পড়ে গিয়েছে। এই শব্দেই কি ঘুম ভাঙল?কিন্তু ওটা কী?

একটা কালো কালো প্যাকেট রাখা আছে টেবলের উপর! নীতিন চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল টেবলটার দিকে। এমনভাবে লুকিয়ে এল কেন লোকটা? বাইরে কড়া সিকিয়োরিটি বলেই কি? নীতিন গভীর শ্বাস নিল একটা। তারপর চোখ বন্ধ করল আর দেখল স্বপ্নের ভিতরে পপিং ক্রিজ়ের কাছে দাঁড়িয়ে ভাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

ছাব্বিশ

২ অক্টোবর। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, কলকাতা, ভারত

ব্যাগটা পিছন দিকে ঘুরিয়ে ক্যামেরাটা হাতে নিল দিওস। ক্যামেরার নীচের কমপার্টমেন্টে লুকোনো একটা পলিমারের পিস্তল আছে। কোনও ঝামেলা হলেই সেটা ব্যবহার করবে। যখন ওকে চেক করা হচ্ছিল তখন এই পিস্তলটা সিকিয়োরিটিরা পায়নি। স্বাভাবিক, কারণ ক্যামেরার সঙ্গে এটা এমনভাবে লাগানো যে, আলাদা করে বোঝা সম্ভব নয়। এগুলো হল ইনকগনিটো ফায়ার আর্মস! দেখলে বোঝা যায় না।

দিওস দেখল, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক জলের পাউচগুলো নিয়ে ধীরে-ধীরে জড়ো করছে এক পাশে। একটু পরেই সেগুলো বিতরণ করা হবে। মনে-মনে হাসল দিওস। জলের ভিতর যে মারণ বিষ রয়েছে সেগুলো একটু পরেই কাজ শুরু করবে।

জলের পাউচ বিতরণ শুরু করা হলেই ও বেরিয়ে যাবে। সামনে অ্যানাউন্সমেন্ট চলছে। দিওস মোবাইলটা বের করল। তারপর একটা নাম্বার ডায়াল করে কানে লাগাল। কাজ শেষের খবরটা দিয়ে দিতে হবে এবার।

সাতাশ

২ অক্টোবর, অকল্যান্ড, নিউজ়িল্যান্ড।

লিসার গায়ে আপেলের গন্ধ। সামনের বিছানায় এতক্ষণ লিসার শরীরে মুখ ডুবিয়ে শুয়েছিল জন। ঘরটা নরম আলোয় ভরে আছে এখন। লিসাকে দেখে মনে হচ্ছে কতদিন যেন ঘুমোয়নি মেয়েটা!

জন তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে আলতো পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মনখারাপ করে লিসাকে দেখল। এত ভালবাসে জন, কিন্তু লিসা যেন কেমন! যেন কোনও টান, কোনও মায়া নেই! এই এল, সাতদিন থাকল, উদ্দাম ভালবাসাবাসি করল, তারপর আবার ছ’মাস পাত্তা নেই।

কতবার লিসাকে বিয়ে করতে চেয়েছে জন। কিন্তু লিসা পাত্তাই দেয়নি! বরং উলটে মুখ করেছে। খারাপ কথা বলেছে। এমনকী, মেরেওছে। আবার যখন আচমকা আসে, তখন এমন ভাব করে যেন জন ছাড়া আর কেউ নেই ওর জীবনে।

আজই তো তেমনভাবেই বিকেলে এসেছিল। দরজা খোলার পরে একদম লাফিয়ে কোলে উঠে পড়েছিল জনের। অপ্রস্তুত হয়েছিল জন। কিন্তু ভালও লেগেছিল। লিসাকে নিয়ে এসে ও বসেছিল বিছানায়। লিসা কিন্তু বসেনি। বরং জনকে টেনে নিয়েছিল গভীরভাবে।

জন বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল। বাইরে অন্ধকার। গাড়ির আবছা শব্দ আসছে। মোবাইলটা দেখল একবার। লিসা এখন ঘুমোবে অনেকক্ষণ। ও তো চেনে লিসাকে। এমন আচমকা সেক্সের পর অনেকক্ষণ ঘুমোয় লিসা।

ফ্রিজ খুলে হুইস্কির বোতলটা বের করল জন। শীতের শেষ এখন। কিন্তু ঘরের ভিতর তো এয়ার কন্ডিশনার চলছে। তাই বোঝার উপায় নেই।

একটা গ্লাসে সামান্য পানীয় ঢেলে রান্নার জায়গায় গেল জন। পাস্তা করে নেবে। সঙ্গে চিকেন আছে। গরম করে নেবে। লিসা ইওগার্ট খেতে পছন্দ করে। সেটাও আছে। কে জানে মেয়েটা কতদিন থাকবে এবার? জন ভাবল, লিসাকে জাগিয়ে দেবে। এখন এত ঘুমোলে রাতে তো ঘুমোবে না।

ও একটা গ্লাসে ওয়াইন ঢালল। এটা লিসার জন্য। তারপর এগোল ঘরের দিকে। কিন্তু ঠিক তখনই শব্দটা শুনল জন। জোরালো বেলের শব্দ! অ্যালার্ম!

চমকে উঠে পিছনে ঘুরল জন। তারপর হাতের গ্লাসটা পাশের পিয়ানোটার উপরে রেখে দৌড়ে ঢুকল কাজের ঘরে। অ্যাডামের কথাই ঠিক। আবার অ্যাক্টিভেটেড হয়েছে মোবাইলটা। একটা মেসেজ গিয়েছে, অ্যাডাম বলেছিল, আবার মেসেজ বা কল যাবে এই মোবাইল থেকে। জন যেন একটা অ্যালার্ম সেট করে রাখে। যদিও জন অ্যাডামের কথাটা বিশ্বাস করেনি। কারণ, ক্রিমিনালরা চট করে একটা নম্বর রিপিট করে না। কিন্তু তাও অ্যালার্মটা সেট করে রেখেছিল। আর সেই অ্যালার্মের ঘণ্টিটাই বেজেছে।

জন চুলের ভিতর আঙুল চালাল। তারপর দ্রুত কি-বোর্ডে কতগুলো কমান্ড টাইপ করে এন্টার মারল। আর ওর বৈদ্যুতিন সংকেত বহু হাজার মাইল পেরিয়ে টুং টুং করে বেজে উঠল অদম্যর মোবাইলে।

আঠাশ

২ অক্টোবর। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, কলকাতা, ভারত।

সিকিয়োরিটির মধ্যে দিয়ে সিএম-কে আসতে দেখল অদম্য। পাশেই পিএম আর বরিসও রয়েছে। পিছনে বাকি সব ডেলিগেট। তার মধ্যে চিরিচকেও দেখতে পেল ও। আর দেখল, সবার পাশ দিয়ে একটা কাচের বাক্সে নিয়ে আসা হচ্ছে ওই বিখ্যাত ইস্টার এগ, ‘মেমরি অব আজ়ভ’। পরে আরও কয়েকটা ইস্টার এগ-এর সঙ্গে এটাকে ডিসপ্লেতে রাখা হবে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে।

ইলিয়ানা ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেয়েটা অকারণে হাসছে। গতকাল রাতের ঘনিষ্ঠতাটা এখনও বয়ে নিয়ে বেরোচ্ছে মনে। খারাপ লাগছে অদম্যর। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। ইলিয়ানা নিচু স্বরে কী একটা বলে যাচ্ছে। কিন্তু অদম্যর কানে কিছুই ঢুকছে না। ও শুধু তাকিয়ে রয়েছে কাচের বাক্সটার দিকে।

সিকিয়োরিটির লোকজন দ্রুত এগিয়ে এল মঞ্চের দিকে। আর অদম্য সকলকে জায়গা দিতে সরে দাঁড়াল সামান্য। আর ঠিক তখনই পকেটের ফোনটা নড়ে উঠল। দ্রুত ফোনটা বের করল ও। দেখল, একটা মেসেজ। জনের মোবাইল থেকে এসেছে।

অদম্য পড়ল মেসেজটা। ‘দ্যাট গিভেথ লাইফ, টেকেথ লাইফ।’

মানে! অদম্য দ্রুত তাকাল মঞ্চের দিকে। দেখল, অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে, আর সিএম তাকিয়ে একটা ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করছেন আদিলকে। আর তারপরই ও তাকাল স্টেডিয়ামের দিকে। দেখল, কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক জল নিয়ে এগোচ্ছে গ্যালারির দিকে। জল, জীবন দেয়। তা হলে সেটাই কি এবার জীবন নেবে? অদম্যর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সময় নষ্ট করা যাবে না একটুও।

ও একপাশে সরে গেল মঞ্চের। তারপর দ্রুত হাতে ডায়াল করল একটা নাম্বার।

উনত্রিশ

মানুষজন উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। আদিল দেখল বিদেশি ডেলিগেটদের সঙ্গে মঞ্চে এলেন প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রী। এত ভিড়ের ভিতরও আদিল দেখল, মুখ্যমন্ত্রী তাকালেন ওর দিকে। তারপর ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন, সব ঠিক আছে তো?

সিএম-এর কথার উত্তর দেওয়ার আগেই পিংপিং করে ফোনটা বেজে উঠল। আদিল দ্রুত মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে চোখ রাখল। আননোন নাম্বার!

“হ্যালো?” আদিল চোয়াল শক্ত করে তাকাল এদিক-ওদিক।

“জল। জলের পাউচের মধ্যে কিছু আছে। মাস মার্ডার। কুইক।”

আদিল কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল অপর প্রান্ত থেকে। ও মোবাইলটা পকেটে রেখে পিস্তলটা বের করল দ্রুত। তারপর তাকাল গ্যালারির দিকে। স্বেচ্ছাসেবকরা পাউচের বড় কার্টনগুলো নিয়ে এগোচ্ছে গ্যালারির সকলের মধ্যে বিলি করবে বলে।

“ওয়েট, স্টপ। স্টপ,” আদিল প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে দৌড়ে গেল সামনে। আশপাশের সকলে থতমত খেয়ে গিয়েছে চিৎকার শুনে। মঞ্চের সামনে রাখা ভিআইপি, চেয়ারে বসা লোকজনও আচমকা ভয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। পুলিশ আর কমান্ডোদের একটা অংশ ছুটে গেল আদিলের দিকে।

আদিল দ্রুত চেয়ার টপকে, মানুষজনকে পেরিয়ে দৌড়ে গেল গ্যালারির কাছে। চিৎকার করে বলল, “স্টপ, জলের পাউচগুলো ফেলে দাও। দাও বলছি।”

ব্যাজপরা স্বেচ্ছাসেবক ছেলে চারজন থতমত খেয়ে হাত থেকে পিসবোর্ডের কার্টন ফেলে দিল। আদিল পিছনে ঘুরল, অন্য প্রান্তেও তো জল দেওয়া হচ্ছে। কয়েক জায়গায় তো বেশ কয়েকটা পাউচ দেওয়াও হয়ে গিয়েছে।

আদিল এবার সেদিকে ছুটল। সঙ্গে পাশের পুলিশ ও কমান্ডোদের উদ্দেশে বলল, “স্টপ দেম। জল যেন কেউ না খায়! স্টপ।”

সামনেই সাংবাদিকদের দাঁড়ানোর জায়গা। অনেক ক্যামেরা ট্রাইপডে লাগানো রয়েছে। এদের পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ভদ্রতার সময় নেই। আদিল তাদের ধাক্কা মেরে এগোতে গেল, কিন্তু তখনই বিপদটা ঘটল। পায়ে কী যেন একটা লাগল ওর। আর সঙ্গে-সঙ্গে বাধা পেয়ে আদিল ছিটকে পড়ল মাটিতে। তবু সেই অবস্থাতেও ও দেখল সামনের গ্যালারিতে কয়েকজন পাউচ খুলে মুখে ঢালছে!

“নো,” আদিল চিৎকার করে হাত থেকে ছিটকে পড়ে যাওয়া ওর পিস্তলটা তুলতে গেল। কিন্তু পারল না। ভিড়ের ভিতর থেকে একটা পা লাথি মেরে সরিয়ে দিল পিস্তলটা। আদিল মুখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটা লম্বা। রোগা। মাখনের মতো গায়ের রং। লোকটা সামান্য হাসল ওকে দেখে। আর ওই এক মুহূর্তের মধ্যেই লোকটার চোখ দুটো দেখে অস্বস্তি লাগল আদিলের।

লোকটা হাসল সামান্য, তারপর আচমকা দ্রুত ‘এগজিট’ লেখা গেটটার দিকে দৌড় দিল। আদিল হামাগুড়ি দিয়ে পিস্তলটা তুলে উঠে দাঁড়াল এবার। দেখল, স্টেডিয়ামের চারদিকে পুলিশ আর কমান্ডোরা ছড়িয়ে পড়েছে। আর সামনের গ্যালারির কয়েকজন কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে রয়েছে! তাদের ঘিরে হইচই শুরু হয়ে গিয়েছে! আদিল বুঝল অদম্যই ঠিক। জলের মধ্যে বিষ! মাস মার্ডার।

গোটা স্টেডিয়াম জোড়া চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যে মঞ্চের দিকে তাকাল আদিল। দেখল, মঞ্চ খালি করে দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে। সবাইকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আদিল চোয়াল শক্ত করে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ‘এগজ়িট’ লেখা দরজাটা দিয়ে। ওই অদ্ভুত চোখের লোকটার নিশ্চয়ই কিছু গল্প আছে!

সোজা রাস্তায় গিয়ে উঠল আদিল। ভিতরের ঝামেলার রেশ বাইরেও এসে পড়েছে। স্টেডিয়ামের বাইরেও পুলিশ আর নিরাপত্তারক্ষীরা ছোটাছুটি করছে।

আদিল এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল লোকটাকে। দৌড়ে যাচ্ছে স্ট্যান্ড রোডের দিকে। দৌড়ের গতি আর ভঙ্গি দেখে ও বুঝতে পারল লোকটা যেমন-তেমন নয়। যথেষ্ট ট্রেন্ড।

আদিল সময় নষ্ট না করে ওর পিছু নিল।

ছুটির দিনে স্ট্র্যান্ড রোড বেশ ফাঁকা। তা-ও কিছু ঠেলা, ম্যাটাডোর ধরনের গাড়ি আর কিছু ট্যাক্সি পার্ক করা আছে। লোকটা তার মধ্যে দিয়ে দ্রুতগতিতে দৌড়ে যাচ্ছে।

আদিল দেখল লোকটার গতি ভাল। ওদের মধ্যেকার দূরত্বও বেশ অনেকটা। ও এদিক-ওদিক তাকাল। আর তখনই দেখল একটা বাস আসছে। নীল-হলুদ প্রাইভেট বাস। ও কিছু না ভেবে বাসের পিছনের দরজায় এক লাফে উঠে পড়ল। বাসের লোকজন ঘাবড়ে গেল একটু। একজন মানুষ এমন খোলা পিস্তল হাতে বাসে ঝুলছে!

বাসটা দ্রুত সামনের দিকে এগোচ্ছে! আদিল ডান হাতে বাসের হাতলটা ধরে ঝুঁকে পড়ল। রাস্তায় লোকজন হইহই করে উঠল আদিলকে দেখে। আর তাতেই লোকটা পিছনে ফিরল। দেখল, আদিল প্রায় এসে পড়েছে ওর কাছে।

বিপদ বুঝে লোকটা আচমকা গতিপথ বদলে ডান দিকের একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। আদিলও বাস থেকে লাফ মেরে নেমে গলিতে ঢুকল।

দু’পাশে বন্ধ দোকানের সারি। শাটার নামানো, কাঠের পাল্লা বন্ধ করা নিস্তব্ধ সব দোকান। গলিটার মাথার উপর টিনের ছাউনি দেওয়া।

গলিটা সোজা চলে গিয়েছে। তবে সরু গলিতেও নানা বস্তা আর কাঠের বাক্স ডাঁই করা আছে।

গলির অন্য দিক থেকে আলো আসছে। আদিল বুঝল সামনের দিকে গলির মাথায় কিছুটা হলেও ছাউনি নেই। ও দ্রুত এগোতে লাগল।

গলির একপাশে বেশ কয়েকটা নীল ড্রাম দাঁড় করানো। ওই পর্যন্ত পৌঁছনোমাত্র গুলির শব্দ শুনল আদিল। আর একটা বুলেট ভোমরার মতো গুঞ্জন করে প্রায় গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল ওর।

আদিল বসে পড়ে ড্রামের আড়ালে কভার নিল। তারপর পালটা গুলি চালাল। তার উত্তরে আরও দুটো গুলি ছুটে এল। সঙ্গে দৌড়ে যাওয়া পায়ের একটা ক্ষীণ শব্দ পেল আদিল। লোকটা পালাচ্ছে! আদিল ড্রামের আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড়োল সামনে।

গলির মাঝখানে সত্যি-সত্যি ছাউনির একটা অংশ ভাঙা। মাথার উপর স্পটলাইটের মতো আলো নেমে আসছে। আর সেই ভাঙা অংশ দিয়ে আশপাশের বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ভাঙা অংশটার সামনে কয়েকটা কাঠের প্যাকিং-বাক্স রাখা। আদিল বুঝল, এটাতে চড়েই লোকটা উঠেছে ওই ছাউনির মাথায়।

ছাউনির টিনের উপর বুটের শব্দও শোনা যাচ্ছে! আদিল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। তারপর ছাউনির উপরে না উঠে সামনের গলি দিয়ে লোকটার পালানোর শব্দটাকে অনুসরণ করে এগোতে লাগল।

টিনের ছাউনিটা পুরনো। জায়গায় জায়গায় ভাঙা। আলোর লাঠি ঠিকরে আসছে নীচে। আদিল বুঝল, লোকটা ছাউনির উপর গতি পাচ্ছে না।

ও আরও গতি বাড়াল। সামনেই শোনা যাচ্ছে পায়ের আওয়াজ। আদিল দাঁড়িয়ে পড়ল এবার। তারপর আর সময় নষ্ট না করে সোজা পিস্তল তুলে গুলি চালাল। এক ম্যাগাজ়িন গুলি শেষ করে দিল!

পুরনো টিনের পাত ভেদ করে ছিটকে গেল গুলি। আচমকা মাথার উপর থেমে গেল দৌড়! আদিল স্থিরভাবে তাকাল উপরে। কয়েক সেকেন্ডের নিস্তব্ধতা। তারপরেই দেখল, মড়মড় করে টিন ভেঙে নীচে গলিতে আছড়ে পড়ল একটা লোক। ফরসা, লম্বা। মাখনের মতো গায়ের রঙের একটা লোক।

আদিল ঝুঁকে দেখল লোকটাকে। কাঁপছে লোকটা। গলার কাছটা অদ্ভুতভাবে নড়ছে! চোখ দুটোও অদ্ভুত। এবার বুঝল আদিল। লোকটার বাঁ দিকের চোখটা পাথরের!

ও লোকটার কলার ধরে টেনে তুলল। লোকটার চোখ স্থির। শরীরের পাঁচ- ছ’টা ক্ষত থেকে উপচে পড়ছে রক্ত।

আদিল লোকটার ওপর ঝুঁকে বলল, “কে তুমি? কে?”

লোকটা হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু শব্দের বদলে মুখ দিয়ে উঠে এল রক্ত। তবু তার মধ্যেও লোকটা আবছা গলায় বলল, “আমি দি-ও-স! গড।”

“কী চাও? কী চাও তোমরা?”

দিওস হাসল। তারপর জীবনের শেষ অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে পালকের মতো গলায় বলল, “ডাইভারশন?”

তিরিশ

অদম্য দেখল, আদিল দৌড়ে গেল গ্যালারির দিকে। আর ঝামেলার আঁচ পেয়ে পিএম আর সিএম-এর নিরাপত্তারক্ষীরা চারদিক দিয়ে সবাইকে দ্রুত ঘিরে ধরে নামিয়ে নিয়ে গেল মঞ্চ থেকে। অদম্য নিজেও গেল ওদের সঙ্গে।

মঞ্চের সরু সিঁড়ি থেকে নেমে পিছনের হলের দিকে দ্রুত দৌড়োল সবাই আর ঠিক তখনই হুড়োহুড়ির মধ্যে সামনের এক কমান্ডোর সঙ্গে কেমন করে যেন ধাক্কা লাগল চিরিচের। লোকটা আচমকা ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে। আর তার সঙ্গে চিরিচের উপর পড়ে গেল ওর পিছনে থাকা বরিস, গোলাম আহমেদ-সহ আরও কয়েকজন।

অদম্য দ্রুত সরে গেল একপাশে। পিছনের হইচই শব্দে সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ঘুরলেন কী হয়েছে দেখার জন্য।

চিরিচ সময় নিল একটু। তারপর আচমকা সামনে মাটিতে পড়ে থাকা কমান্ডোটির কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তলটা বের করে সটান তাগ করল প্রধানমন্ত্রীর দিকে।

অদম্য চোয়াল শক্ত করল! এই তবে ডাইভারশন! সবার মন বিক্ষিপ্ত করে দিয়ে এমন এলোমেলো সময়ে অ্যাসাসিনেশন প্লট করা!

ও চোখের নিমেষে সামান্য পিছিয়ে নিজের মোমেন্টাম তৈরি করে আচমকা লাফিয়ে গিয়ে পড়ল চিরিচের উপর! তাক করা পিস্তলটা ছিটকে উঠল হাওয়ায়। অদম্য একই গতিতে সেটা লুফে নিল।

“কিল হিম।”

চাপা গলাটা শুনতে পেল অদম্য। দেখল চিরিচ মাটি থেকে যন্ত্রচালিতের মতো উঠে এবার ওর দিকে লাফাচ্ছে। অদম্য পিস্তলটা তাক করল চিরিচের দিকে। কিন্তু তার আগেই একজন কমান্ডো অদম্যর হাতে লাথি মারল। পিস্তলটা অদম্যর হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।

“ক্যাচ দ্য কিলার। ডোন্ট লেট হিম গো?” বরিস চিৎকার করে উঠল।

অদম্য বুঝল জটলার মধ্যে চিরিচের সঙ্গে ওকেও এরা ধরবে। ও দ্রুত মেপে নিল চারপাশ। ওর পিছনে দু’জন পুলিশ। তারপর লম্বা করিডরের শেষে একটা বাথরুম।

ও নিখুঁতভাবে রিভার্স সামারসল্ট খেয়ে দু’জন পুলিশের মধ্যে দিয়ে গলে ছিটকে বেরিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। আর যেতে যেতে চোখের আড়ে যেন দেখল চিরিচকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে আর ওর দিকে দৌড়ে আসছে পাঁচ-ছ’জন কমান্ডোসহ গোলাম আহমেদ নিজে। অদম্য দৌড় দিল। তারপর সামনের বাথরুমের ভিতর ঢুকে গেল।

একত্রিশ

আকাশের অনেক উপরে একটা চিল উড়ছে। একটা চিল। একলা। বন্ধুহীন। তার উপরে চাঁদটা দেখা যাচ্ছে। সকালের আকাশে চাঁদ দেখলে কেমন আলো নেভা বাল্‌বের মতো লাগে নীতিনের।

ও আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এই চাঁদটা তো ওর বাড়ির মাথাতেও আছে। ভাই কি জানালা দিয়ে শুয়ে দেখছে চাঁদটা?

ওর সঙ্গে ভ্যানের ভিতরে পাভেল বলে আর-একটি ছেলের থাকার কথা। প্রথমে ওর একাই থাকার কথা ছিল। কিন্তু পরে একে যোগ করা হয়েছে।

পাভেল এখন ভ্যানের সামনে স্বদেশীয় একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। নীতিন ঘড়িটা দেখল। তারপর চোয়াল শক্ত করল। নিচু হয়ে নকল পায়ের উপরে থাইটা চুলকে নিল একটু। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক তখনই শব্দটা শুনতে পেল ও।

ওদের ভ্যানটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করানো ছিল। তার কাছেই স্টেডিয়ামের পিছনের দরজা। সেটা আচমকা দড়াম শব্দে খুলে গেল। নীতিন দেখল, পাঁচ-ছ’জন দৌড়ে আসছে কাচের একটা বাক্স নিয়ে। আর বাক্সের ভিতরে ইস্টার এগ: ‘মেমরি অব আজভ’!

নীতিন সময় নষ্ট করল না একটুও। দ্রুত ভ্যানের ভিতর ঢুকে গেল। তারপর হাত বাড়াল। বাক্সটা ওর কাছে দিয়ে, লোকগুলো চটপট বন্ধ করে দিল ভ্যানের পিছনের দরজা। তারপর আটকে দিল তালা। বাইরের শব্দে পরের ব্যাপারটা বুঝতে পারল নীতিন। আর ও এ-ও বুঝল যে, ঝামেলাটা হয়েছে! তাই দ্রুততার সঙ্গে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সময় নষ্ট যাতে না হয় তাই পাভেলের সামনেই ড্রাইভারের পাশে উঠে বসল।

গাড়িটা দ্রুত এগোতে লাগল গন্তব্যের দিকে। নীতিন পাথরের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। ভ্যানের পিছন দিকে আর কেউ নেই। ও একা। বাইরের দিক থেকেও তালাবন্ধ! এবার?

নীতিন চোখ বন্ধ করল। ভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠল সামনে। ভাই জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। আলো-নেভা একটা বাল্‌ব উঁকি দিচ্ছে আকাশে।

নীতিন চোখ খুলল। তারপর প্যান্ট গুটিয়ে একটানে খুলে ফেলল নকল পা-টা।

বত্রিশ।

১৫ অগস্ট, ভোপাল, ভারত।

লোকটা হাসল।

নীতিন জিজ্ঞেস করল, “কীসের ব্যাবসার কথা বলছেন আপনি?”

“আলোর,”লোকটা হাসল আবার। তারপর বলল, “আমার কথা একটু মন দিয়ে শুনুন। আই হোপ ইউ ক্যান সি দ্য লাইট ইউ আর ডেসপারেটলি সিকিং ফর এজেস। আমি জানি আপনার আলোর প্রয়োজন।”

নীতিন কী বলবে বুঝতে পারল না। ও এসে বসল লোকটার সামনে। আসলে ঠিক লোকও নয়। ছেলেই বলা যায়।

নীতিন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

ছেলেটা সময় নিল একটু, তারপর বলল, “আমি জানি আপনার টাকার দরকার! আমি আপনাকে টাকা জোগাড় করে দিতে পারব। তিরিশ লাখ টাকা।”

নীতিনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, “কেন আপনি আমায় টাকা দেবেন?”

ছেলেটা বলল, “কারণ, আপনি আমার একটা কাজ করে দেবেন।”

“কী কাজ?”

“একটা এগ। মানে ডিম। ইস্টার এগ। কলকাতায় আসছে। সেটা আপনি আমায় এনে দেবেন।”

নীতিনের শরীর দিয়ে একনিমেষে বিদ্যুৎ দৌড়ে গেল যেন। কী বলছে ছেলেটা?

“রাগ করবেন না। একশো বছরের পুরনো একটা আর্টিফ্যাক্ট। সেটা থাকল কি থাকল না, তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না। এখন যেমন জিনিসটা বাক্স-বন্দি হয়ে আছে, তেমনই যে লোকটা জিনিসটা চায়, তার কাছেও বাক্স-বন্দি হয়েই থাকবে। আপনি শুধু আসল জিনিসটা নকলের সঙ্গে পালটে দেবেন।”

নীতিন বলল, “আর যদি না করি?”

ছেলেটা হাসল, “অন্য কেউ করবে। শুনুন, আপনি কি ভেবেছেন আপনাকে এই ডিসএবিলিটি থাকা সত্ত্বেও কেন সিলেক্ট করা হয়েছে? আপনি না করলে আপনি এই কাজটাতেও থাকবেন না। অন্য কেউ আসবে। সে করবে। টাকার দরকার সবার আছে ভাইয়া। আপনি যদি করেন, টাকা আপনি পাবেন। আপনার ভাই লাইফ পাবে। তা ছাড়া ডিমটা এই দেশের জিনিস নয়। আর বললাম তো জাস্ট আ পিস অফ জাঙ্ক আর্ট! দেশের ক্ষতি করছেন না। কোনওদিন কেউ জানতে পারবে না। আপনি কী ভাবেন, পৃথিবীর আর্ট গ্যালারিগুলোয় যেসব আর্ট পিস ঝোলে সব অরিজিনাল? আমাদের বলা হয় ওগুলো অরিজিনাল। যাক গে, আমরা ঠিক সময় জিনিসটা আপনার কাছে পৌঁছে দেব। আপনি আপনার নকল পায়ের মধ্যে সেটাকে নিয়ে যাবেন। উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পায়ের মধ্যে থেকে বের করে এনে সেটা পালটে দেবেন। ব্যস।”

নীতিন কী বলবে বুঝতে পারল না।

“সহজ, খুব সহজ। ডোন্ট ইউ ওয়ারি। আমি যখন বলছি তখন জানবেন সব সহজ। আমি কঠিন কাজ সহজ করে দিই তো! ছেলেটা হাসল, তারপর হাতের ব্যাগ থেকে একটা আপেল বের করে রাখল নীতিনের সামনে, আপেল খাবেন? খান। আমি আবার কনট্যাক্ট করব।”

নীতিন বিহ্বল গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”

ছেলেটা বলল, “আপেল দেখেও বুঝলেন না? আমার নাম অ্যাডাম!”

তেত্রিশ

২ অক্টোবর। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম, কলকাতা, ভারত।

গোলাম আহমেদ ইশারা করলেন পাশে দাঁড়ানো কমান্ডোদের। সামনের বাথরুমের দরজাটা বন্ধ। এবার? একটু আগে চিরিচ মিসির নামে লোকটা পিএম-কে মারার জন্য বন্দুক তুলেছিল। এই দোভাষী লোকটা চিরিচের উপর লাফিয়ে পড়ে ওকে নিরস্ত্র করেও এমন করে ছিটকে পালাল কেন? লোকটা কে? চিরিচের সঙ্গী না ওদের বন্ধু! একে ধরতেই হবে। না হলে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। আজ খুব জোর বেঁচে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীজি! নীলেশের খবর ঠিক। তেমনই আদিলের খবরও একশো শতাংশ ঠিক!

গোলাম নিজের পিস্তলের সেফটি চেক করলেন। আরও বেশ কয়েকজন কমান্ডো এসে পড়েছে। একজনের হাতে দরজা ভাঙার জন্য স্তম্ভের মতো একটা যন্ত্র, ব্যাটারিং র‍্যাম।

ভিতরের লোকটার সঙ্গে কি পিস্তল আছে? একা বাথরুমে কী করবে লোকটা? নিজেকে মেরে ফেলবে না তো?

গোলাম দেখলেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না। যারা দরজা ভাঙবে তাদের যথেষ্ট প্রোটেকশন আছে। উনি ইশারা করলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে চারজন মিলে ব্যাটারিং র‍্যাম দিয়ে ভেঙে দিল দরজা। আর বাকিরা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ভিতরে। সকলের পিছনে ঢুকলেন গোলাম।

সকলে চারদিকে তাকাল। আরে, কেউ নেই! পুরো বাথরুম খালি! সে কী! এটা কী করে সম্ভব!

গোলাম এদিক-ওদিক তাকালেন। তারপর থমকে গেলেন একটু। ওটা কী?

এবার ঘরের এক কোণে দৌড়ে গেলেন গোলাম। দেখলেন, মাটির একপাশের চৌকো ঝাঁঝরির একটা ম্যানহোল সামান্য উঠে আছে। গোলাম দেখলেন ভাল করে। তারপর বুঝলেন ওটা খোলা হয়েছে। তারপর তাড়াহুড়োয় হয়তো ভাল করে আর লাগানো হয়নি।

ঝাঁঝরিটার তলাতেই বড় ড্রেন চলে গিয়েছে গঙ্গা অবধি। এই পথেই তবে পালিয়েছে। দ্রুত কোমর থেকে ম্যানপ্যাক বের করলেন গোলাম। এই সুয়্যারটা যেখানে গঙ্গায় মিশেছে সেখানে এক্ষুনি পুলিশ পাঠাতে হবে। এই লোকটা কে? এর পরিচয় জানতেই হবে। কেন লোকটা আটকাল চিরিচকে? তারপর পালালই-বা কেন?

বাথরুমের উপরের এয়ার ডাক্ট থেকে সবটাই দেখল অদম্য। তারপর হাসল মনে-মনে। ম্যানহোলটা খুলে ওই অবস্থায় রেখে দিতে বিশেষ কসরত করতে হয়নি ওকে। জানত, এটা ঠিক খেয়ে নেবে নিরাপত্তারক্ষীরা। তাই হয়েছে।

ও ধীরে-ধীরে এয়ার ডাক্ট বেয়ে বেরিয়ে এল স্টেডিয়ামের মেনটেন্যান্স এরিয়ার দিকে। তারপর একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকে দ্রুত নিজের পোশাক বদলে পরে নিল এক কোণে রাখা নীল রঙের মেনটেন্যান্স রক্ষীদের ইউনিফর্ম! সবশেষে টুপিটা পরে এগিয়ে গেল মূল দরজার দিকে। লোকজন পুলিশের তত্ত্বাবধানে বেরোচ্ছে স্টেডিয়াম থেকে। অদম্য তার ভিতর মিশে গেল নিমেষে। মনে-মনে হাসল। খুঁজুক। নদীতে ওকে খুঁজুক ওরা!

আদিল দৌড়ে ঢুকল মেন গেট দিয়ে। লোকজন হু হু করে বেরোচ্ছে। তার মধ্যে স্রোতের উলটো দিকে দৌড়োনো খুব সহজ নয়। তবু আদিল দৌড়োল। লোকজন কাটিয়ে দৌড়োল। শুধু সামনে দিয়ে আসা একজন মেনটেন্যান্সের লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগল ওর। লোকটা পড়ে গেল মাটিতে। আদিল তাকাল না। এখন দেখার সময় নেই। ভিতরে কী হয়েছে কে জানে!

আদিল ভিড়টা কাটিয়ে মূল স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ল। স্টেডিয়াম এখন প্রায় ফাঁকা। ও দেখল, গোলাম আহমেদ হন্তদন্ত হয়ে আসছেন এদিকে। আদিলকে দেখে হাত তুলে দাঁড়াতে বললেন। আদিল দাঁড়াল। আর ঠিক তখনই পকেটে কী যেন একটা নড়ে উঠল, বেজে উঠল ফোন।

আদিল বের করল ফোনটা। আরে, এটা কার ফোন? ওরটা তো নয়! এটা কখন এল পকেটে? আদিল কী বলবে বুঝতে না পেরে তাকাল গোলামের দিকে। তারপর দেখল, একটা মেসেজ ডিসপ্লেতে দেখাচ্ছে।

গোলাম আহমেদ এসে কিছু বলতে গেলেন। কিন্তু আদিল হাত দিয়ে আটকাল ওকে। তারপর বলল, “দেখুন স্যার।”

গোলাম আহমেদ ঝুঁকে পড়ে দেখলেন মেসেজটায় লেখা আছে, ‘গুড জব ব্রো! সি ইউ আগেন।’

চৌত্রিশ

২ নভেম্বর। নবান্ন, কলকাতা, ভারত।

প্রধানমন্ত্রীজি বেরিয়ে গিয়েছেন একটু আগে। সারা দেশে জারি করা হয়েছে সর্তকতা৷ চতুর্দিকে এই খবর ছড়িয়ে গিয়েছে, কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপর হামলা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই হামলা ব্যর্থ হয়েছে। এ-ও খবর হয়েছে যে, হামলাকারী বিদেশি ডেলিগেশন টিম থেকে আসা একজন মানুষ। নাম চিরিচ মিসির।

টিভিটা বন্ধ করে মুখ্যসচিব বাসুদেববাবু তাকালেন সিএম-এর দিকে। বললেন, “ম্যাডাম, সব তো ভেস্তে গেল। গ্যালারিতে ওই বিষ জল খেয়ে চারজন মারা গিয়েছে। আমি ভাবছি কত বিশাল ডিজ়াস্টার হতে পারত”।

সিএম সময় নিলেন একটু। তারপর গোলাম আহমেদকে বললেন, “এটা কী হল! কীভাবে হল এটা? ওই দিওস কে? আর চিরিচ একজন শিল্পপতি, উনি কেন এমন করলেন? আর এখন ধরা পড়ার পর তো এমন ভাব করছেন যেন উনি কিছু বুঝতে পারছেন না। যেন ঘুম থেকে উঠেছেন এইমাত্র!”

গোলাম আহমেদ ঘরের বাকি মানুষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরাও বুঝতে পারছি না ম্যাডাম! উনি বলছেন যে, কী করেছেন, কেন করেছেন বুঝতে পারছেন না। মনে করতে পারছেন না। তবে দিওস কে আমরা জেনে যাব।”

রাজীবজি বললেন, “কিন্তু ম্যাডাম, একদম না বুঝে কেউ এমন করবে? চিরিচ শুধু এটাই বলছেন, কী যেন একটা ফুটল কোমরে! তারপর আর কিছু মনে নেই। আমি নিশ্চিত, চিরিচ মিথ্যে বলছেন! তবে আমার ভয় অন্য জায়গায়। যে পালিয়েছে তাকে নিয়ে। সে কী করবে এখন এটাই দেখার। কেন চিরিচকে আটকাল সে? তারপর কেনই-বা পালিয়ে গেল! আর গেল কোথায়? গঙ্গায় তো নেই! এমনকী, পরে আমরা দেখেছি এয়ার ডাক্টটা। সেখানেও কিছু নেই! তবে আমরা ওকে ঠিক ধরতে পারব। ওর ছবি তো আছে। ঠিক পারব?”

“তুমি কী বলো?” সিএম এবার তাকালেন আদিলের দিকে, “পারবে ধরতে?”

আদিল ঠোঁট টিপে তাকাল সিএম-এর দিকে। তারপর সামান্য হাসল। বিষন্ন হাসি। বলল, “ও বারবার আসে ম্যাডাম। তারপর কীভাবে যেন চলেও যায়! আমি জানি না ম্যাডাম, এবার ধরতে পারব কি না! কিন্তু একদিন না-একদিন আমি ওর সামনে যাব। ওকে ঠিক ধরব। অদম্য সেনের আড়ালে বসে থাকা আসল মানুষটা যে কে সেটা জানতেই হবে আমাকে?”

পঁয়ত্রিশ

২৫ অক্টোবর, ২০১৫। ফিস, অস্ট্রিয়া।

মোবাইলটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন ফাদার ফ্রান্সিস। লিয়াম এটা কী বললেন? সত্যি কি এটা সম্ভব? একজনের শরীরের ফেরোমন নিয়ে এমন ওষুধ তৈরি সম্ভব, যার দ্বারা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? সত্যি কি মাইন্ড কন্ট্রোল সম্ভব?

লিয়াম বললেন এমন কাজ ওঁরা সিআইএ-তে থাকার সময় করেছেন। আর এখন এক প্রাইভেট ফান্ডিং-এ কাজ করছেন ওঁরা। কিন্তু সেখানেই নাকি সমস্যা। আন্তর্জাতিক চক্রের কিছু লোক ওঁর পিছনে পড়েছে। তাই ফাদারের সাহায্য চান লিয়াম।

চার্চের লম্বা আইল পেরিয়ে পিছনের বারান্দার দিকে গেলেন ফাদার। আজ বরফ পড়ছে। চারদিকে বরফ পড়ার পাতলা ফড়িং-পাখার শব্দ। পাথরের মেঝের উপর নিজের বুটের আওয়াজটাকে নিজেরই কেমন যেন লাগল ফাদারের। উনি দেখলেন, বারান্দার শেষের ছোট্ট ঘরটা থেকে গিটারের শব্দ আসছে। আর তার তালে গান গাইছে ইয়েনস।

অ্যাডাম বাড়ি ফিরলেই ইয়েনস এসে বসে পড়ে অ্যাডামের কাছে।

ফাদার গিয়ে নক করলেন দরজায়। তারপর ভিতরে ঢুকলেন।

ছোট্ট ফায়ার প্লেসে আলো জ্বলছে। আর তার কাঁপা-কাঁপা হলুদ আলো ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরময়।

ফাদার অ্যাডামের বিছানার পাশের নরম সোফাটায় বসে বললেন, “একটা সমস্যা হয়েছে অ্যাডাম। তোর সাহায্য চাই। থিংস ক্যান গেট আগলি ইন দ্য ফিউচার। তাই তার জন্য এখনই প্রিভেন্টিভ মেজ়ার নিতে হবে। তোর হেল্‌প দরকার।”

অ্যাডাম গিটারটা নামিয়ে ইয়েনসকে চোখের ইশারা করল। ইয়েনস কিছু না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

অ্যাডাম বলল, “কী হয়েছে ফাদার?”

“জানিস অ্যাডাম, মানুষের ইতিহাস অদ্ভুত কাণ্ডকারখানায় ভরতি! সাধারণ মানুষ বোঝেই না এগুলো। তারা খুব লিমিটেড একটা ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকে। যেমন, শাংগ্রিলার কথা শুনেছিস তো? জানিস, নাতসিরা সেটা খুঁজতে তাদের দল পাঠিয়েছিল হিমালয়ে,” ফাদার থামলেন, তারপর আবার বললেন, “সিআইএ কোল্ড ওয়ারের সময় থেকে শত্রুকে পর্যুদস্ত করার জন্য নানা টেকনিক ব্যবহার করেছে। নানা টেকনিক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে, তবে সব সফল হয়নি। তার মধ্যে একটা হল, মাইন্ড কন্ট্রোল। তার জন্য অনেক রকম ওষুধ ওরা বের করেছিল। কিন্তু পরে সেটা বন্ধ করে দিতে হয়।

“আমার বন্ধু লিয়াম ব্রাইট এই কাজে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সরকারিভাবে এই উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেলেও বেসরকারিভাবে তা সচল আছে আজও। আর লিয়ামরা সেই ওষুধ বের করতে সফলও হয়েছেন আংশিক। তবে সেই ওষুধ প্রয়োগ করলে অন্য মানুষকে মিনিট পাঁচেকের জন্য নিজের বশে আনা যায়। যে বশ করতে চায়, তার শরীরের ফেরোমোনের সঙ্গে আরও কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে ওরা একটা ইনজেকশন বের করেছে, যা অপর কোনও ব্যক্তিকে দিলে লোকটি প্রথম লোকটির বশ হয়ে যাবে। প্রথম ব্যক্তির শরীর থেকে নির্গত ফেরোমোন দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সামান্য সময়ের জন্য হলেও নিজের বশে আনবে। মানে, কাছে দাঁড়িয়ে তাকে কোনও নির্দেশ দিলে, বশীভূত মানুষটা প্রথম মানুষটার শরীর থেকে নির্গত ফেরোমোনের প্রভাবে রোবটের মতো তার কথা মেনে চলবে। এক্ষেত্রে শরীরে আগে থেকে ইনজেক্ট করা ওষুধ রিসেপটার হিসেবে কাজ করবে। তখন তাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে।

“লিয়াম চায় একটা লিভারেজ রাখতে। যদি ওর কিছু হয়, তা হলে পালটা একটা মার দেওয়ার আইডিয়াও ওর মাথায় এসেছে। অ্যাডাম, ও চায় তোর শরীরের ফেরোমোন ব্যবহার করতে চায় তোর ফেরোমোন দিয়ে একটা ওষুধ তৈরি করতে! চায়, তুই সেটা উপযুক্ত সময়ে ব্যবহার করবি?”

অ্যাডাম চুপ করে তাকাল ফাদারের দিকে।

ফাদার বললেন, “আমিই তোর কথা ওকে বলেছি। ও দ্বিধা করছিল। বলছিল, কোনও প্রমাণ ও রাখতে চায় না। কিন্তু আমি ওকে বলেছি, আমার এক বরফের তরোয়াল রয়েছে। বলেছি, আই বিলিভ ইন মাই সন, অ্যাডাম।”

ছত্রিশ

১২ নভেম্বর ২০১৬। ডুসেলড, জার্মানি।

মানাক তাকাল সামনের দিকে। রাগে মাথার শিরা দপদপ করছে ওর। এটা কী করল লোকটা? প্রোফেসরকে এনে দিল! ওষুধ তৈরি করে দিল। তারপর ডাইভারশন তৈরির জন্য দিওসকে আনা হল। অ্যাডাম বলে একজনকে দলে ঢোকানো হল তার ঘাড়ে প্রধানমন্ত্রীর খুনের দায় চাপানো হবে বলে, কিন্তু সব যে মাঠে মারা গেল! সারা পৃথিবীকে তো একটা বার্তা দেওয়া যেত যে, ওরা যখন খুশি যা খুশি করতে পারে। স্বাধীনতার যুদ্ধকে সন্ত্রাসবাদ বলে তাকে অত সহজে মুছে দেওয়া যায় না। কিন্তু সেটাও হল না! আর তাতে লোকটার কোনও হেলদোল নেই!

মানাক বলল, “আপনি এটা কী করলেন? আপনি আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসভঙ্গ করলেন? অ্যাডামকে ইনজেক্ট না করে আপনি…”

“চিরিচকে ইনজেক্ট করেছি! কারণ, অ্যাডামকে অন্য কাজে দরকার ছিল আমার। প্লাস চিরিচ ওয়জ় সারপ্লাস! মালটাকে কাটাতে চেয়েছিলাম। তা ছাড়া এইসব কাজে ফেলিওর রেটপঞ্চাশ শতাংশ। আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারপর পারিনি। হতেই পারে।” পরিষ্কার ইংলিশে কথাটা বললেন বরিস আভেরিন।

মানাক চোয়াল শক্ত করল, “আপনি ঠিকমতো…”

“আমি হুড়োহুড়ির মধ্যে চিরিচকে মোক্ষম সময়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তারপর ওর উপর পড়ে গিয়ে আমার শরীরের নির্যাস থেকে বানানো ইনজেকশনটাও দিয়েছিলাম। আর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেওছিলাম কী করতে হবে। কিন্তু গোরুটা যে গুলিয়ে দেবে কী করে জানব?” বরিস আরও কিছু বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বললেন না। একটা লোক ঢুকেছে ঘরে। গায়ে নকল ফারের কোট। উলোঝুলো দাড়িগোঁফ।

লোকটা ঢুকেই বলল, “স্যার, মেনটেন্যান্স! ইয়োর ফোন। নট ওয়ার্কিং। ক্যান আই লুক?”

“ইয়েস,” বরিস উঠে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন টেবলে রাখা ফোনটা। লোকটা নিচু হয়ে টেবলের তলায় কানেকশন দেখতে লাগল।

বরিস তাকালেন মানাকের দিকে, তারপর বললেন, “কিন্তু আমার কাজ হয়ে গিয়েছে। না-ই বা তোমার কাজ হল, ইস্টার এগ এখন আমার কাছে। রাইকার এসে দিয়ে গিয়েছে। আমি প্ল্যানই করেছিলাম যদি অ্যাসাসিনেশন না-ও হয়, তা হলেও যেন এগটা আমার হাতে আসে। রোমানভদের জিনিস ফিরে এসেছে রোমানভের কাছে। ওই দ্যাখো সামনের শোকেসে। আমার জিনিস আমার সামনে!”

মানাক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু লোকটা টেবলের তলা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “প্লিজ় চেক স্যার।”

বরিস যেন এতক্ষণ খেয়ালই করেননি লোকটাকে। এবার সামান্য হুঁশ হল। তারপর হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুললেন ক্রেড্ল থেকে আর তখনই আচমকা বিদ্যুৎগতিতে লোকটা কোটের ভিতর থেকে এক হাতে একটা সিরিঞ্জ বের করে গেঁথে দিল বরিসের বাড়ানো হাতে। আর অন্য হাতে একটা বন্দুক বের করে প্যারালাইজ়ড ডার্ট শুট করল মানাককে!

বরিসের শরীরে যেন কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছে! আর মানাকের গলায় ফুটে থাকা ছোট্ট ডার্টটা ওকে অবশ করে দিয়েছে নিমেষের মধ্যে!

লোকটা তাকাল দু’জনের দিকে। তারপর একটা পিস্তল বের করে বরিসের হাতে দিয়ে কাছে ঝুঁকে পড়ে বলল, “দু’মিনিট পরে তুমি মানাককে গুলি করবে। তারপর নিজের মুখে পিস্তলের নলটা ঢুকিয়ে ট্রিগার টানবে। মনে থাকে যেন, দু’মিনিট!”

বরিস রোবটের মতো পিস্তলটা নিয়ে সোজা তাক করল মানাকের দিকে। লোকটা সামনে এগিয়ে কাচের সুদৃশ্য শোকেসের ভিতর থেকে বের করল ইস্টার এগ-টা। তারপর সেটা নিজের ব্যাগে ভরে, বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

সাঁইত্রিশ

১ অক্টোবর, কলকাতা, ভারত।

ইলিয়ানা নিজের নরম শরীরটা চেপে ধরল অদম্যর শরীরের সঙ্গে। হাতের নখ গেঁথে দিল ওর পিঠে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আই ওয়ান্ট ইউ।” অদম্য ইলিয়ানার শ্বেতপাথরের মতো কোমরটা জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। তারপর আচমকা ঘুরিয়ে বিছানায় শুইয়ে নিজে উঠে এল ওর উপরে। বলল, তুমি এসেছ যদি বরিস জানতে পারে? এক্ষুনি তো রাশিয়ানে চেঁচিয়ে মাথায় তুলবে হোটেল।”

ইলিয়ানা অদম্যর চুলের ভিতর হাত দিয়ে নিজের আরও কাছে টেনে এনে বলল, “রাশিয়ান নয়, ইংলিশ। হি ইজ় আ লাইং বাস্টার্ড! সব সময় ডিসেপশন। ও ইংলিশ খুব ভালই জানে।”

থমকে গেল অদম্য। আর সঙ্গে-সঙ্গে যেন মিলে গেল সব, বরিস আভেরিন! রোমানভ! ইস্টার এগ!রাইকার! ইউরোপ কানেকশন! ও নিমেষে ঠিক করে নিল, লোকটার ঘরে ‘বাগ’ বসাবে। কার সঙ্গে কী কথা বলে সেটা জানবে ও। সন্দেহটা সত্য দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। অদম্য ঠিক করল, একটু পরে যে ব্রিফিং আছে, সেটায় গিয়ে একফাঁকে বেরিয়ে এসে বরিসের ঘরে ঢুকে ‘বাগ’-টা বসাবে। তারপর আবার পরের দিন সকালে কোনও একটা ছুতোয় গিয়ে নিয়ে আসবে ‘বাগ’-টা।

ওর কাছে সেই ইনজেকশনটা আছে। কিন্তু বরিসকে ধরলে শুধু হবে না। এর পিছনে আর কে আছে তাকেও ধরতে হবে। শেষ করতে হবে।

“কী হল?” ইলিয়ানা নিজের দিকে আবার টানল অদম্যকে।

অদম্য হাসল। তারপর আলতো করে ঠোঁট রাখল ইলিয়ানার ঠোঁটে।

ইলিয়ানা অস্ফুটে বলল, “নাউ লেটস নক ইনসাইড?”

আটত্রিশ

১২ নভেম্বর। ডুসেলসডর্ফ, জার্মানি।

ইগর সামনের ডেস্ক থেকে দেখল মেনটেন্যান্সের লোকটা এগিয়ে আসছে ঘর থেকে। লোকটাকে আগে দেখেনি ইগর। এ কে? যে-লোকটা নিয়মিত আসে সেই মেসুট তো আসেনি! ব্যাপার কী!

লোকটার দিকে দৌড়ে গেল ইগর। লোকটা ক্লান্ত চোখ তুলে যেন কষ্ট করে তাকাল ওর দিকে।

“কে তুমি? কী নাম?” ইগর ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “আগে তো দেখিনি?”

লোকটা থমকাল একটু। শান্ত মুখে একবার হাতঘড়ি দেখল। তারপর সামান্য হেসে নরম গলায় বলল, “বুম, বুম?”

আর সঙ্গে-সঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে ফট ফট করে দুটো শব্দ হল। গুলির শব্দ! চমকে উঠল ইগর! কী হল! বরিসের ঘরের ভিতর থেকে গুলির শব্দ কেন?

ইগর দৌড়ে গেল বরিসের ঘরের দিকে। শুধু যেতে-যেতে শুনল, লোকটা বলছে, “আরে, আমার নামটা শুনবেন না? প্লিজ শুনুন, আমার নামটা শুনুন। অ্যান্ড রিমেমবার মি। আমি সেন, অদম্য সেন।”

(এই কাহিনির সমস্ত ঘটনাই কাল্পনিক। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কোনও মিল থাকলে তা আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *