অদৃশ্য যুবরাজ

অদৃশ্য যুবরাজ

কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক। মার্চ ৩, ২০১৫

ভাদিমের মনে হল, বুকের বাঁদিকটায় কে যেন গলন্ত লোহা ঢেলে দিয়েছে। চোখের সামনের সবকিছু ধীরে-ধীরে আবছা হয়ে আসছে। ও তা-ও চেষ্টা করল কোমরের হোলস্টার থেকে গ্লকটা বের করতে। কিন্তু পারল না। সেই কালো পোশাকে ঢাকা শরীরটা এগিয়ে এল আবার। মোটা রবারের জুতো দিয়ে জোরে চেপে ধরল ভাদিমের হাত। যন্ত্রণায় আরও যেন কিছুটা অন্ধকারে ঢুকে গেল ভাদিম। চোখের সামনে কে যেন আরও কয়েক পরত ঘষা কাচ নামিয়ে আনল।

কালো পোশাক পরা শরীরটা এবার ঝুঁকে পড়ল ওর উপর। তারপর মাথা থেকে বালাক্লাভটা খুলে তাকাল। ভাদিম অবসন্ন শরীর নিয়ে দেখল তাকে। সোনালি চুল, নীল বরফের মতো ঠান্ডা চোখ।

ভাদিম কিছু বলতে গেল, পারল না। ওর হাতের উপর বুটের চাপ বাড়ল আরও। দেখল একটা পিস্তল ধীরে-ধীরে ওর মাথার দিকে নেমে আসছে।

“ভেনলিস্ট,” ভাদিম দয়া ভিক্ষা করতে চাইল।

কিন্তু সামান্য হাসির শব্দ শুনল ও। শুনল একটা নরম মেয়েলি গলা বলছে, “ফরভেল।”

তারপর আগুনের ঝলকানি। চাপা ‘ফট’ শব্দ। অন্ধকার।

ল্যাঙ্কাশায়ার, ইংল্যান্ড। মার্চ ৩, ২০১৫

শেষ রাতের দিকে ফোনের রিংয়ে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল ন্যান্সির। মৃদু একঘেয়ে স্বরে ডেকে চলেছে ফোনটা। ন্যান্সি সময় নিলেন। এমনিতেই অনেক দেরি করে ঘুম এসেছিল আজ। তার উপর এমন আচমকা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় চোখটা ব্যথা করছে। ন্যান্সি জানেন, এখন চোখ খুললে মাথাতেও ছড়িয়ে যাবে ব্যথাটা।

ফোনটাকে আরেকটু বাজতে দিলেন ন্যান্সি। তারপর অন্ধকারের মধ্যে অভ্যস্ত হাতে পাশের টেবল থেকে তুলে নিলেন যন্ত্রটা। এবার চোখের আই প্যাচটা মাথার উপর তুলে আবছা নীল আলোয় ভরা স্ক্রিনটায় চোখ রাখলেন। প্রাইভেট নাম্বার। ন্যান্সি অবাক হলেন। এ আবার কে?

ফোনটা রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললেন, “হ্যালো।”

“আমি কি ডেম ন্যান্সি জেন রথওয়েলের সঙ্গে কথা বলছি?”

ওদিকের গলাটা শান্ত, ভারী। ন্যান্সির অচেনা লাগল। উনি বললেন, “বলছি, বলুন।”

“দিস ইজ় আলেক্সান্ডার উইলিয়াম ইয়াঙ্গার। চিফ, এম আই-সিক্স। এমন সময় ফোন করার জন্য দুঃখিত। ম্যাম, আই নিড টু টেল ইউ সামথিং।”

ন্যান্সি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেন, “বলুন।”

“আজ রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ আপনাদের কোপেনহেগেনের অপারেশনস ব্রাঞ্চের সিকিয়োরিটি পার্সোনেল ভাদিম জিমলিং খুন হয়েছে। খুব কাছ থেকে প্রথমে বুকে, তারপর মাথায় গুলি করা হয়েছে। এগজ়িকিউশন স্টাইল। তবে চিন্তার ব্যাপার হল, যে বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা নিয়ে। কারণ রাশিয়ান মব ‘ব্রাটভা’ এমন বুলেট ব্যবহার করে।”

“হোয়াট!” ন্যান্সির মাথাটা কট করে উঠল যন্ত্রণায়, “কী বলছেন! কেন?”

উইলিয়াম বললেন, “আই গেস ফর আ ফাইল। তবে ঠিক ফাইলও নয়, কয়েকটা পৃষ্ঠা। সেটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আপনি বলতে পারবেন।”

“কীসের পৃষ্ঠা?” ন্যান্সি অধৈর্য হলেন।

“আপনাদের সহযোগী কোম্পানি গ্র্যাফিনটেক-এর ফাইলের কিছু পৃষ্ঠা। ফাইলটায় লেখা, ‘কনফিডেনশিয়াল অপারেশনস-জেনারেল প্রোডাক্টস’। আপনি জানেন কী ছিল ওতে?”

ন্যান্সির মাথাটা ঘুরে গেল সামান্য। গ্র্যাফিনটেক-এর ওই ফাইলের পৃষ্ঠা চুরি হয়েছে? সর্বনাশ!

“ম্যাম,” আপনি শুনছেন?

“হ্যাঁ,” ন্যান্সির ঘোর ভাঙল, “একটা লিস্ট। কনফিডেনশিয়াল… কয়েকজনের নামের…খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে তারা।”

“ওটায় কি পরিচয় ছিল তাদের?”

“না,” ন্যান্সি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “জাস্ট সিকিয়োরিটি কোড। তাদের নাম ছিল না।”

উইলিয়াম যেন খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন, “ও, কারও নাম জানা যাবে না তাহলে?”

ন্যান্সি সময় নিলেন একটু। তারপর বললেন, “নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই চিফ। যারা একবার পিছনে লেগেছে, তার নামও জেনে ফেলবে।”

“আই সি,” উইলিয়াম বললেন, “তবে তো গোটাটাই আমাদের জানতে হবে। আমি এখন আসতে পারি আপনার ওখানে?”

“এখন?” ন্যান্সি অবাক হলেন।

“হ্যাঁ ম্যাম, এখন। আপনি চোখের আই প্যাচটা খুলে, চোখে মুখে একটু জল দিয়ে নিন। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।”

“আই প্যাচ! ন্যান্সি সামান্য ঘাবড়ে গেলেন, আপনি কোথায়? কী করে দেখতে পাচ্ছেন আমাকে?”

উইলিয়াম হাসলেন, “এম আই-সিক্স সর্বত্র পৌঁছে যায় ম্যাম। তবে যেটা ভয়, যারা আজ রাতে তাদের কাজ শুরু করল, অর্থাৎ ব্রাটভা, তারাও সর্বত্র পৌঁছে যেতে পারে। তাই আমাদের এক্ষুনি কাজে নামতে হবে। একটু দেরি হলেই ওই লিস্টে যাদের নাম রয়েছে, তাদের জীবন বিপন্ন হবে।”

ব্ল্যাক ডলফিন প্রিজ়ন, ওরেনবার্গ ওব্লাস্ট, রাশিয়া। সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫

এখান থেকে কালো ডলফিনটা দেখা যাচ্ছে। জেলের সীমানায় ঢোকার মুখে রাখা এই মূর্তিটার নাম অনুযায়ী রাশিয়ার অন্যতম কুখ্যাত জেলটির নামকরণ করা হয়েছে। কাজ়াখস্তানের সীমান্ত ঘেঁষা সলইলেট্স্ক শহরের কাছে এই জেলটিতে পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম অপরাধীদের আটকে রাখা হয়। খুনি, ড্রাগ-লর্ড, ধর্ষক থেকে শুরু করে নরখাদক পর্যন্ত এই জেলে আটকে আছে। এই জেল থেকে পালানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিন্তু ব্রাটভার হাত অনেক বড়। তাদের শেকড় বহুদূর প্রসারিত। বিশেষত সোভিয়েত সংঘ ভেঙে যাওয়ার পর বেশ কিছু কেজিবি অপারেটর এদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় ব্রাটভার শক্তি আরও বেড়েছে। বিশ্বাস করা কঠিন যে, সামান্য একটা ছোট আঞ্চলিক মাফিয়া গোষ্ঠী তিরিশ-পয়ত্রিশ বছরের মধ্যে সারা বিশ্বের ত্রাস হয়ে উঠেছে।

তাই ব্রাটভা কাউকে কোনও কাজ দিলে কেউ বারণ করে না। সবারই জীবনের মায়া রয়েছে যথেষ্ট।

আজ দিনটা মেঘলা। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাই সাধারণত বছরের এই সময় যা তাপমাত্রা থাকে, তার চেয়ে আজ ঠান্ডা পড়েছে বেশি। হাওয়াও দিচ্ছে। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের উপর থেকে হাত সরিয়ে কোটের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল বরিস। আজ একজন জেল থেকে ছাড়া পাবে। তাকে নিয়ে ফিরতে হবে শহরে।

ও রিয়ারভিউ মিররে দেখল পিছনের সিটটা। মানুষটা আবছা অন্ধকারে ডুবে বসে রয়েছে। গাড়ির ভিতরেও সানগ্লাস চোখে রাখার কী দরকার, কে জানে। ব্রাটভার নির্দেশে বরিস গত বছরদেড়েক এই লোকটির গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করছে।

চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাল বরিস। গাড়ির বনেটে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা। শহর থেকে এতটা সময় গাড়িতে করে এসেছে এই দু’জন। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলেনি। বরিস সামান্য কথা বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি। বরিসও তাই কথা বাড়ায়নি। এদের নিস্তব্ধতার মধ্যে অদ্ভুত একটা হিংস্রতা টের পাচ্ছিল ও।

মেয়েটাকে ভাল করে দেখল বরিস। কালো ড্রেস পরা। ছোট করে কাটা সোনালি চুল। পাশ ফিরছে যখন, নীল চোখটাও দেখা যাচ্ছে। খাড়া আপ-টার্ন নাক, রীতিমতো সুন্দরী। বরিসের ভাল লাগছে তাকিয়ে থাকতে। এমন আবহাওয়ায় এমন একজনকে যদি পাওয়া যেত!

“ডোন্ট স্টেয়ার!” আচমকা পিছন থেকে গম্ভীর গলা শোনা গেল, “হ্যানসেল যদি জানে তুমি গ্রেটেলকে ওভাবে দেখছ, তবে চোখদুটো আঙুল দিয়ে বের করে আনবে।”

“হ্যানসেল? সে কে?” বরিস পিছনে ফিরতে গেল।

“হ্যানসেল কে? জানবে। ক’দিন পর সবাই জানবে। লুক, হি ইজ় কামিং।”

বরিস দেখল সামনে জেলখানার মূল ফটক পেরিয়ে এগিয়ে আসছে একটা লোক। কালো চামড়ার জ্যাকেটের ভিতর দিয়েও ওর চাবুকের মতো শরীরটা দেখা যাচ্ছে। সোনালি লম্বা চুল হাওয়ায় উড়ছে। ওকে দেখে মেয়েটা দৌড়ে গেল সামনে।

পিছনের লোকটা বলল, “সাড়ে নয় বছর পর ভাইকে দেখতে পেল বোন। অবশ্য এর মূল্যও চোকাতে হবে ওদের।”

“মানে?” বরিস বলতে চায়নি, কিন্তু প্রশ্নটা যেন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল!

লোকটা গম্ভীর স্বরে বলল, “মানে ভবিষ্যতের সবচেয়ে দামি বস্তুটির জন্য ওদের হাত ডোবাতে হবে আগুনে।

গেইভলবর্গ কাউন্টি, সুইডেন। মার্চ ৬, ২০১৫

জেরার্ড লারসেন গাড়ি থেকে নেমে শব্দ করে বন্ধ করল দরজাটা। দেখল, গাড়ির অন্যদিক দিয়ে টমও নেমেছে। হাসল জেরার্ড। কতদিন পর টমের সঙ্গে দেখা! সেই যখন কিংস কলেজে পড়ত, তখন টম ছিল ওর ক্লাসমেট। পরে জীবিকার টানে দু’জন ছিটকে গিয়েছিল দু’দিকে। তারপর হঠাৎ গতকাল দেখা।

জেরার্ড নিজে সুইডিশ সিক্রেট সার্ভিস, যার নাম ‘সাকেরহেট্সপোলিসেন’ বা ‘স্যাপো’, তার এজেন্ট। আর টম কাজ করে এমআই-সিক্স-এর হয়ে।

টমকে ওদের অফিসের সামনে দেখে তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি জেরার্ড। সেই থিয়েটার পাগল ছেলেটা কিনা এম আই-সিক্স-এ যোগ দিয়েছে!

গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে তাকাল জেরার্ড। বল্টিক সাগরের তীরে এই গেইভলবর্গ জনপদটি শান্ত, সুন্দর। আর ওরা যেখানে এসে থামল, সেখানে তো গাছের পাতা নড়লেও দূর থেকে শোনা যায়।

সামনের বড় কাঠের বাড়িটার মাথা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। আজ ঠান্ডা পড়েছে বেশ। জেরার্ড ওভারকোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গাড়ির দিকে তাকাল। ঝাপসা কাচের ভিতর দিয়ে পিছনের সিটের মানুষটিকে আবছা দেখা যাচ্ছে।

টম বলল, “আরে, ভিতরে চল।”

জেরার্ড হাসল, “সে তো ঠিক আছে। কিন্তু আমার সত্যি খুব অবাক লাগছে। তুমি এই কাজে…”

টম হাসল, “ট্রুথ ইজ় স্ট্রেনজার দ্যান ফিকশন ব্রাদার। জীবন এক অনন্ত অনিশ্চিত ক্ষেত্র। কুয়াশাঢাকা এক প্রান্তর। যেখানে সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে অদৃশ্য এক জাদুকর। আমরা তো কেবল…”

“আচ্ছা, আচ্ছা,” জেরার্ড বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে হাসল, “তোমার থিয়েটার করার অভ্যেসটা গেল না দেখছি!

বেলটা বাজিয়ে একটু সরে দাঁড়াল দু’জন।

সামান্য সময় নিয়ে দরজাটা খুলে গেল। একজন মাঝারি উচ্চতার মানুষ দাঁড়িয়ে। গমের মতো গায়ের রং। পরিষ্কার করে দাঁড়ি গোঁফ কামানো।

“পাবক রয়?” জেরার্ড জানলেও নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, আপনারা?”

জেরার্ড আর টম নিজেদের আইকার্ড দেখাল। পাবকের চোখ-মুখ বদলে গেল নিমেষে। সরে দাঁড়িয়ে আসতে দিল ঘরের ভিতরে।

ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে।

পাবক জিজ্ঞেস করল, “আপনারা? কেন?”

টম কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জেরার্ড বাধা দিল। বলল, “আমি স্যাপো থেকে আসছি। আর টম উইলটোর্ড এম আই-সিক্স। আসলে আমরা এসেছি আপনার প্রোটেকশনের জন্য।”

“আমার!” পাবক ওদের হাত দেখিয়ে বসতে বলে নিজে একটা সিঙ্গল সোফা দখল করল।”

“কারণ আপনি গ্র্যাফিন নিয়ে কাজ করছেন, তাই।”

পাবক থমকে গেল সামান্য। অবাক হয়ে বলল, “আপনারা জানলেন কী করে? মানে, এটা তো খুব কম মানুষই জানেন! এটা তো টপ সিক্রেট প্রোজেক্ট!”

“খুব কম নন, জাস্ট তিনজন জানেন।” টম হাসল, “আসলে সত্য হল গন্ধের মতো, ধোঁয়ার মতো, গর্ভবতী রমণী…”

“আপনাদের কোম্পানি গ্র্যাফিনটেক-এর সিইও মিস্টার আর্চার, ডিরেক্টর অফ আর অ্যান্ড ডি মিস্টার ফাউলার আর দ্য ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাঞ্চেস্টার তথা ন্যাশনাল গ্র্যাফিন ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর ডেম ন্যান্সি রথওয়েল কেবল জানেন যে আপনারা গ্র্যাফিন নিয়ে কাজ করছেন। আর শুধু কাজই করছেন না, গ্র্যাফিনকে কমার্শিয়ালি ব্যবহার করার মতো অবস্থাতেও নিয়ে গিয়েছেন,” জেরার্ড হাসল।

পাবক অবাক হল খুব, “আপনি জানেন গ্র্যাফিন কী?”

এবার জেরার্ড কিছু বলার আগেই টম বলল, “ইয়েস, উই নো। মানুষের সভ্যতা সেই কবে প্রস্তর, তাম্র হয়ে লৌহ যুগও পার করে ফেলেছে। এখনকার পৃথিবীতে স্টিল, কার্বন, আর প্রায় নিখুঁত সিলিকন হল মানুষের পছন্দের জিনিস। এসবের মধ্যে কার্বন একটা অদ্ভুত বস্তু। এর অনেকগুলো অ্যালোট্রোপ পাওয়া যায়। যার মধ্যে মূল দু’টি হল গ্রাফাইট আর ডায়মন্ড।”

টম কথা থামিয়ে তাকাল পাবকের দিকে। পাবক বলল, “বলে যান। আমি শুনছি।”

টম বলল, “সেই গ্রাফাইট সম্বন্ধীয় ন্যানোস্ফিয়ার আর ন্যানোটিউব আসে প্রথমে। এরপর ২০১০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাঞ্চেস্টারের আন্দ্রে জেইম আর কনস্ট্যানটিন নোভোসেলভকে কেমিস্ট্রিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় পৃথিবীর প্রথম টু ডাইমেনশনাল জিনিস নিয়ে কাজ করার জন্য। এটাই গ্র্যাফিন।”

“ঠিক,” পাবক হাসল, “কিন্তু গ্র্যাফিন তৈরি করা খুব ব্যয়সাপেক্ষ। তাই আবিষ্কার করার পরেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছিল না। আমরা গ্র্যাফিনটেকের রিসার্চাররা ন্যাশনাল গ্র্যাফিন ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একযোগে এটাই কমার্শিয়ালভাবে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। এমনভাবে তৈরি করার চেষ্টা করছি, যাতে উত্পাদন খরচ কম হয়, আর রোজকার জিনিসে তা ব্যবহার করা যায়।”

“যেমন?” জেরার্ড জিজ্ঞেস করল।

“গ্র্যাফিন খুব পাতলা পদার্থ। যাকে বলে আলট্রাথিন। এটা জাস্ট ওয়ান মলিকিউল থিক। পৃথিবীর প্রথম টু ডাইমেনশনাল পদার্থ এটা। কেবল প্রোটন এর মধ্যে দিয়ে পাস করতে পারে। কিন্তু এটা স্টিলের চেয়েও ২০০ গুণ শক্ত। কমপোজ়িট কেভলারের চেয়েও দুর্ভেদ্য। এর এই ধর্মের জন্য একে প্রোটন ফিল্টার হিসেবে ব্যবহার করে হাইড্রোজেনকে বাতাস থেকে ছেঁকে নেওয়া যেতে পারে। সেটা দিয়ে ফুয়েল সেল তৈরি হতে পারে। এ ছাড়াও কিমোথেরাপিতে আরও প্রিসাইজ় ইউসেজ-এ এর ব্যবহার হতে পারে। এটা আবার পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল কনডাক্টর। ফলে একে বিদ্যুতের পরিবহনের কাজে লাগানো যাবে। আলট্রাথিন কন্ডোম তৈরি করা যাবে। এমন টেনিস র‍্যাকেট তৈরি করা যাবে, যা অনেকটাই হালকা আর অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। এটা দিয়ে লাইট বাল্ব তৈরি করা যাবে, যা অনেক বেশি চলবে। এ ছাড়াও ওয়াটার প্রুফিংয়ের কাজে, রাস্ট প্রুফিংয়ে, ফুড প্যাকেজিংয়েও ব্যবহার করা যাবে। এমন ট্যাবলেট বা পি সি তৈরি করা যাবে, যা আপনি খবরের কাগজের মতো গুটিয়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ প্লেন তৈরি থেকে পানীয় জল শুদ্ধিকরণ, হেন কাজ নেই যা এর সাহায্যে করা যাবে না। এটা আসলে আলাদিনের সেই জিনি,” কথা শেষ করে পাবক হাসল।

“আর এটাকে বাজারজাত করার ব্যবস্থা আপনারা করে ফেলেছেন, ঠিক?”

“সবটা ঠিক নয়,” পাবক বলল, “আরও মাসতিনেকের কাজ বাকি আছে। তারপর আমরা বাজারে একসঙ্গে বেশ কিছু জিনিস নিয়ে আসব। গ্র্যাফিন মানব সভ্যতাকে এক ধাক্কায় দু’শো বছর এগিয়ে দেবে।”

“দেবে, যদি আপনারা সুরক্ষিত থাকেন, তবেই।” জেরার্ড চোয়াল শক্ত করল, “কয়েকদিন আগে কোপেনহেগেনে ন্যাশনাল গ্র্যাফিন ইনস্টিটিউটের অফিস থেকে কিছু কাগজ চুরি গিয়েছে। যাতে আপনাদের, মানে আপনি পাবক রয় আর আপনার দুই সহকর্মী, গ্র্যাফিনটেকের মিস মারিয়া ক্যাপলান আর ম্যাঞ্চেস্টার এলটন হাঙ্কসের নাম ফাঁস হয়ে যেতে পারে।”

পাবক বলল, “কিন্তু কোথাও তো আমাদের নাম নেই! এটা টপ সিক্রেট একটা প্রোজেক্ট। আমাদের কিছু নাম্বার আছে মাত্র।”

জেরার্ড হাসল, “হাসালেন মিস্টার রয়, যারা চুরি করেছে, তারা বাচ্চা নয়। দে হ্যাভ দ্য বেস্ট গ্যাজেটস অ্যাট দেয়ার ডিসপোজ়াল। ওই কোড ব্রেক করতে ওদের সাতদিন সময় লাগবে। তারপর সময়মতো আপনাদের টুক করে তুলে নেবে। বুঝলেন?”

“অ্যাঁ!’” পাবক এবার ঘাবড়ে গেল, “কিন্তু তবে তো…”

“জানি,” বিপদ। ম্যাঞ্চেস্টার তথা ব্রিটেন আর গ্র্যাফিনটেক তথা সুইডেনেরও বিপদ হবে। সামনের ট্রিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রির কন্ট্রোল যদি মাফিয়াদের হাতে চলে যায়, তবে কী হবে ভাবতে পারছেন?

“হোয়াট ডু ইউ প্রোপোজ়? আমরা তো অক্টোবরের শেষে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জিনিসগুলো লঞ্চ করব! আমি, বিয়িং অ্যান ইন্ডিয়ান, ইন্ডিয়াতে যাব সেই সময়। আমাদের এখন কেউ চেনে না। কিন্তু আর কয়েক মাসের মধ্যেই উই উইল বি বিগার দ্যান স্টিভ জোবস। উই আর দ্য নিউ লিওনার্দোজ়।”

“ভিঞ্চি?” হাসল টম, “যদি বেঁচে থাকেন, তবেই তো!”

“তাহলে?”

টম বলল, “উই উইল প্রোটেক্ট ইউ টিল দ্য লঞ্চ। আর শুধু তাই নয়, যারা এই কুমতলবের পিছনে রয়েছে, তাদেরও ধরার চেষ্টা করব।”

“কিন্তু কী করে? আপনি তো বললেন, সেটা খুব কঠিন! আপনাদের কোনও প্ল্যান আছে?” পাবক জিজ্ঞেস করল।

জেরার্ড হাসল সামান্য। তারপর বলল, “কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আপনাদের পরিচয় জানতে-জানতে মিনিমাম ১০ তারিখ হয়ে যাবে ওদের। মানে, আপনাদের নামের জটিল কোডটা ব্রেক করতে যে-কোনও মেনফ্রেম কম্পিউটারের এক সপ্তাহ সময় তো লাগবেই! অর্থাৎ আমাদের হাতে এই সময়ের উইন্ডোটুকু আছে। সেটারই অ্যাডভান্টেজ নিতে হবে আমাদের। অ্যান্ড মিস্টার রয় উই ডু হ্যাভ আ প্ল্যান।”

ফিস, অস্ট্রিয়া। মার্চ ৪, ২০১৫

“তুমি আর কেক খাবে?” ইয়েনস তাকাল অদম্যর দিকে।

অদম্য হাতের গিটারটা পাশে রেখে বলল, “নাঃ, তবে খুব লোভ হচ্ছে কিন্তু! এত ভাল কাপকেক কতদিন খাইনি।”

“কী কতদিন?” ইয়েনস ভুরু কোঁচকাল, “গত উইকেই তো এনে দিলাম! মা বানালেই তো তোমার জন্য পাঠিয়ে দেয়!”

অদম্য হাসল, “গত সপ্তাহ তো সে অনেকদিন আগে ছিল! আরে, আমার গতকালই মনে হয় একবছর আগে।”

ইয়েনস হাসল, “খালি বাজে কথা! মা তো প্রায়ই বানায় এটা! কিন্তু তুমি থাকই না। ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার যেন! কখন যে আসবে, তার ঠিক নেই! আর ফাদার ফ্রান্সিসও বলেন না কিছু। তোমার কথা জানতে চাইলে শুধু হাসেন। আচ্ছা, তুমি কোথায় গায়েব হয়ে যাও বলো তো মাঝে-মাঝে?”

অদম্য কিছু বলতে গিয়েও পারল না। ঘরের দরজাটা খুলে ফাদার ফ্রান্সিস ঢুকলেন।

অদম্য উঠে দাঁড়াল, “কিছু বলবেন?”

ফাদার বললেন, “একজন এসেছে তোর কাছে। বলছে তুই ওকে চিনিস।”

“আমার কাছে? কে?” অবাক হল অদম্য।

ফাদার কিছু বলার আগেই রোগা, লম্বা, ডিগডিগে লোকটা এগিয়ে এল ফাদারের পিছন থেকে। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “হাই অ্যাডাম! রিমেমবার মি?”

অদম্যর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ফায়ার প্লেসের কাঁপা হলুদ আলোয় ও দেখল লোকটাকে। বুঝল, সামনে আবার প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার সময় অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

কলকাতা, মহাসপ্তমী। অক্টোবর ২০, ২০১৫। এখন

গাড়িতে উঠে পাবক তাড়াতাড়ি করে কাঁধে ঝোলানো স্লিং ব্যাগটা খুলে পাশে রাখল। তারপর নিচু হয়ে তাকাল জানলা দিয়ে। মাথার উপর দিয়ে ট্রেন চলছে। ফ্লাইওভার আকাশটাকে পেঁচিয়ে আছে মাফলারের মতো।

“স্যার, কেমন লাগছে?” জিনি তাকাল পাবকের দিকে।

বেশ অল্প বয়স পাবকের। পরিষ্কার করে কামানো দাঁড়ি গোঁফ। ছোট করে কাটা চুল। শ্যামলা, লাজুক মুখ। টিভিতে বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে পাবক আর ওর দুই সঙ্গীকে। পৃথিবীতে হইচই পড়ে গিয়েছে ওদের নিয়ে। গ্র্যাফিন নামে একটা অদ্ভুত জিনিস দিয়ে ওরা কত কী যে বানিয়ে ফেলেছে! বলা হচ্ছে, আগুন, চাকা আর লোহা আবিষ্কারের মতোই এর গুরুত্ব।

ওদের চিফ এডিটর নির্মলদা বলছিল, “জিনি, পাবক রয় আসছে কলকাতায়। যে করে হোক, এক্সক্লুসিভ চাই ওর। জানি, খুব স্ট্রিক্ট সিকিয়োরিটি থাকবে ওর। কিন্তু তুই নবান্নতে গিয়ে একবার বল না! ম্যাডাম তো তোকে ভালবাসেন খুব!”

জিনির অনুমতি পেতে অসুবিধে হয়নি। আগের দুটো ঘটনার পর থেকে জিনির পরিচিতি আর কদর, দুটোই বেড়েছে। নির্মলদা বলেছে, জিনি যেন পাবকের গোটা টুরটাই কভার করে।

পাবক তাকাল জিনির দিকে, “আপনাকে আমার কেমন চেনা-চেনা লাগছে। কেন বলুন তো?”

জিনি ঘাবড়ে গেল একটু, “সেটা কী করে সম্ভব স্যার? আপনি ২০ বছর পর দেশে এলেন! আর আমি কোনওদিন ইউরোপ যাইনি। তাই…”

“শিওর?” জিনির দিকে পাবক তাকিয়ে রইল একটু। তারপর সামান্য হেসে বলল, “গেছিলাম যখন, তখন ছ’বছর বয়স ছিল। আর এখন ২৬। শহরটাকে আবছা মনে আছে। বাট ফিলিং নাইস।”

জিনি সামনে বসা সরকারি প্রতিনিধিকে দেখল। ভদ্রলোকের নাম জহর সরকার। নবান্ন থেকে পাঠানো হয়েছে পাবককে রিসিভ করার জন্য। ও জানে পিছনে একটা গাড়ি আসছে। তাতে পাবকের জন্য তিনজন বডিগার্ড রয়েছে।

“আপনার জন্য এমন বডিগার্ড কেন?” জিনি জিজ্ঞেস করল।

পাবক হাসল, “কে জানে। কাল বিকেলে প্রোডাক্ট লঞ্চ আছে মুম্বইতে। কাল সকালেই বেরিয়ে যাব এখান থেকে। আমি যে কাজে এসেছি, সেটা খুবই ভ্যালুয়েবল। তাই হয়তো এই রুটিন সিকিরোরিটি!”

“তা স্যার আপনি কি কলকাতায় জাস্ট নস্ট্যালজিয়ার টানে এলেন?”

পাবক বাইরের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল একটু। তারপর বলল, “আমার পৈতৃক বাড়ি শ্যামবাজারে। ওখানে শুনেছি খুব বড় দুর্গাপুজো হয়। মানে, বাবার কাছ থেকে ছোটবেলাতেই শুনেছি। তাই ভাবলাম পুজোয় এসে পড়েছি যখন, তখন একদিন আগে কলকাতায় পৌঁছে একটু ঢুঁ মেরে যাই। ওরাও বড় হওয়ার পর আমাকে প্রথম দেখবে। আসলে ঠাকুরমা বহুবার ফোনে বলেছেন আমাকে আসতে। তাই আর কী।”

জিনি হাসল, “স্যার, আপনাদের গবেষণা নিয়ে যদি…”

“প্লিজ়, এখন নয়। আপনি তো আছেন। লেট মি সি দ্য সিটি,” পাবক মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখতে শুরু করল আবার।

শ্যামবাজারে পৌঁছতে যেটুকু সময় লাগল, তার মধ্যে ‘গ্রেট’, ‘হরিবল ট্র্যাফিক!’, ‘এমন রাস্তা আটকে প্যান্ডালস!’ ছাড়া আর কিছু বলেনি পাবক।

শ্যামবাজারে যে বাড়িটার সামনে গাড়িটা দাঁড়াল, সেটা কমপক্ষে ২৫০ বছরের পুরনো। পাবক দরজা খুলে নামল। জিনি আর সরকারবাবুও নামলেন।

বাড়ির দরজার সামনে বেশ ভিড়। জিনি বুঝল, এত বছর পরে বংশের ছেলে ফিরেছে। তাও আবার বিখ্যাত ছেলে। তাই এত আয়োজন!

পাবক জিনিকে বলল, “আমাদের এই পুজোটা পৌনে দুশো বছরের পুরনো। আই হার্ড দ্যাট ব্রিটিশ ভাইসরয়রাও আসতেন এখানে। কাম।”

এবার সরকারবাবু বললেন, “মিস্টার রয়, এখানে বেশি সময় নেবেন না। ম্যাডাম নবান্ন-য় আপনার জন্য ওয়েট করছেন। ওখানেও আপনাকে নিয়ে ছোট একটা অনুষ্ঠান হবে। তাই বলছিলাম, বিকেলে তো এখানে ফিরে আসছেনই। তখন না হয়…”

“শিওর,” পাবক হাসল, “জাস্ট ঠাকুরমাকে একবার দেখেই চলে যাব। অনেক করে বলেছেন উনি।”

সিংহদরজা পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে সকলে ঢুকল। সাবেক কলকাতার পেল্লায় বাড়ি। মাঝখানের শ্বেতপাথরের উঠোন ঘিরে তিনতলা উঁচু কোঠা। একপাশে ঠাকুরদালান।

বাড়ির ভিতরে থিকথিক করছে লোক। জিনি বুঝল, এর মধ্যে বাইরের মানুষও রয়েছে। বেশ কয়েকজন বিদেশিকেও দেখা যাচ্ছে ছবি তুলতে। পাবক নিজের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে গেল। সবাই জিনিদেরও ভিতরে যেতে বলেছিল। কিন্তু জিনি গেল না। এ বাড়ির লোকেদের ইন্টারভিউ বিকেলবেলা করবে। এখন নাতি ঠাকুরমার মধ্যে হাড্ডি হয়ে লাভ নেই।

জিনি সরে এসে ঠাকুরদালানের সামনে দাঁড়াল। আজকাল কলকাতায় সাবেক পুজো দেখার ক্রেজ় বেড়েছে বেশ। এই ঠাকুরটি ছোট, একচালার। রাংতার সাজ! ভারী টলটলে মুখ প্রতিমার। জিনি তাকিয়ে রইল।

কতক্ষণ হয়েছে বুঝতে পারল না, হঠাৎ একটা দৌড়োদৌড়ি দেখতে পেল জিনি। কী হল? জিনি অবাক হল খুব। হাতঘড়িতে দেখল ২০ মিনিট কেটে গিয়েছে।

সিকিয়োরিটির তিনজনও নীচেই দাঁড়িয়েছিল। তারাও গণ্ডগোল কিছু একটা হয়েছে বুঝে দৌড়ে ঢুকে গেল বাড়ির ভিতরের দিকে। জিনি সরকারবাবুর দিকে তাকাল। সরকারবাবুর মুখেও বিস্ময়।

“চলুন তো দেখি,” জিনিও জমে থাকা ভিড় ঠেলে দৌড়ল।

একতলার বড় ঘরে থমকে থাকা কতগুলো মুখ দেখল জিনি। চিনতে পারল এরাই পাবকের আত্মীয়। এদের সঙ্গেই পাবক ছিল।

সরকারবাবু বললেন, “কী হল, মিস্টার রয় কই?”

একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “আরে, মায়ের ঘরেই তো গিয়েছিল। বলল বাথরুমে যাবে। গেলও…তারপর…”

“তারপর?”

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, “আর দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় যে গেল!”

সিকিয়োরিটির ছেলেগুলো এর মধ্যে ফিরে এসেছে।

সরকারবাবু ওদের বললেন, “আরে তোমরা দেখো। কোথায় গেলেন উনি?”

একটি ছেলে বলল, “আমরা দেখলাম। উনি কোথাও নেই। শুধু ওঁর ফোনটা বাড়ির পিছনের গলিতে স্ম্যাশড অবস্থায় পড়ে রয়েছে।”

জিনি দেখল থ্যাঁতলানো একটা মোবাইল।

সরকারবাবুর মুখ ঝুলে গেল, “তবে এখন?”

বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “কী হয়েছে বলুন তো?”

সরকারবাবু ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, “আই বি-র রিপোর্টই তবে ঠিক! পাবক রয়কে সত্যিই কিডন্যাপ করা হল!”

নবান্নের কনফারেন্স রুমের ডিম্বাকৃতি সাদা রঙের টেবিলটার একপ্রান্তে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সিএম, “কিডন্যাপ? মানে? অত লোকের মাঝখান থেকে কিডন্যাপ? সুরজিৎবাবু, এ কী করে সম্ভব?”

পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ ঠোঁট টিপে ভাবলেন একটু, তারপর বললেন, “ম্যাডাম, আমি সিকিয়োরিটি পার্সোনেলদের জিজ্ঞেস করেছি। মিস্টার রয় ওদের সঙ্গে নিয়ে ভিতরে যাননি। তবে ওঁর ভাঙা ফোনটা দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, বাড়ির পিছনের দরজা দিয়েই উনি বেরিয়েছেন।”

চিফ সেক্রেটারি সঞ্জয় মিত্র এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার ভাবলেশহীন মুখে বললেন, “ওই রাস্তার পাশের লোকজনদের জিজ্ঞেস করা হয়েছে কিছু?”

“হয়েছে স্যার,” স্পেশ্যাল অ্যাডিশনাল অ্যান্ড জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ, ক্রাইম, পল্লবকান্তি ঘোষ বললেন, “ওটা খিড়কির দরজা। টিপিক্যাল সরু গলি। সেখান থেকে বেরোলে পাড়ার রাস্তা। সেখানে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তাতে যা বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে, তা রীতিমতো কনফিউজ়িং।”

“মানে?” সিএম চশমাটা খুলে সামনের টেবিলে রাখলেন।

“মানে ম্যাডাম, ওখানে দু’-তিনজন পাবক রয়ের চেহারার ডেসক্রিপশন দিয়েছেন। কিন্তু এও বলেছেন যে পাবক নিজেই হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছেন! মানে কেউ তাঁকে জোর করেনি। তবে দু’-একজন বলছেন সঙ্গে নাকি আরও একজন ছিল!”

“সে কী!” সিএম উঠে দাঁড়িয়ে পাশে বসা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে তাকালেন, “কিডন্যাপ করলে কেউ নিজে হেঁটে বেরিয়ে যায়?”

পার্থবাবু ভুরু তুললেন অবাক হয়ে।

সিএম এবার একটু দূরে দেওয়াল ঘেঁষে রাখা সাদা চেয়ারগুলোর একটায় বসা জিনির দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো ওঁর সঙ্গে গাড়িতে ছিলে। উনি কি এমন কিছু করতে পারেন, তার হিন্ট দিয়েছেন? আসলে জিনিয়াসদের কতরকম ইচ্ছেই…”

“না ম্যাডাম,” জিনি সংক্ষেপে বলল।

সিএম চোয়াল শক্ত করে চিন্তা করলেন একটু। তারপর বললেন, “এমন পুজোর সময়, এই ভিড়ে, সকাল সাড়ে দশটায় একটা জলজ্যান্ত লোক, নিজের ফোনটা ভেঙে রেখে যাবে কোথায়, আশ্চর্য! সবার চোখ এইভাবে ফাঁকি দিল? আপনারা তা হলে কীভাবে ভাবছেন যে এটা কিডন্যাপিংয়ের কেস?”

“ওঁর ভাঙা ফোন ম্যাডাম। তা ছাড়া, এম আই-সিক্স আর আমাদের আইবি-র খবর ছিল। তাই তো তিনজন গার্ডও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উনি প্রোটোকল মানবেন না…” সুরজিৎবাবু মাথা নাড়লেন।

সঞ্জয়বাবু বললেন, “এখন কী করবেন? স্ট্যান্ডার্ড মেজ়ারস তো নিয়েইছেন জানি। কিন্তু আর কী করছেন?”

সুরজিৎবাবু কিছু বলার আগেই সিএম উঠে দাঁড়ালেন, “আদিলকে যোগাযোগ করুন। পুজোর সময় ও তো কলকাতায় আসে। দেখুন কোথায় আছে ও! কাল এত বড় একটা ইভেন্ট মুম্বইতে। সেখানে আজ এমন কিছু হলে…সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে তো। আপাতত প্রেসকে কিছু জানাবেন না। আমি চাই না, কোনও প্যানিক হোক। সুরজিৎবাবু আপনি যা স্পেশ্যাল মেজ়ারস নেওয়ার, নিন। কিন্তু ডাকুন আদিলকে। সঞ্জয়বাবু, দরকার হলে দিল্লিতে ফোন করুন। আই ওয়ান্ট ইমিডিয়েট অ্যাকশন।”

ফোনটা পেয়েই উঠে দাঁড়াল আদিল।

বালিগঞ্জের শাহিনদের বাড়িতে একটু আগেই এসেছে ও। শাহিনের বাবা মা ওর সঙ্গে শাহিনের বিয়ের ব্যবস্থা নিয়েই আলোচনা করছিলেন। ঠিক তখনই ফোনটা আসে। ওর কম্যান্ডিং অফিসার ফোন করেছিলেন আন্দামানের বেস থেকে। ওকে বলা হয়েছে এক্ষুনি যেন নবান্নতে রিপোর্ট করে।

অবাক লাগছে আদিলের। শাহিনদের বসার ঘরে নিচু স্বরে টিভি চলছে। কিন্তু সেখানে তো তেমন কোনও ক্রাইসিস দেখাচ্ছে না! তবে হঠাৎ এমন তলব কেন?

“আরে বেটা, তুমি উঠছ?” শাহিনের মা অবাক হয়ে গেলেন।

আদিল শাহিনের দিকে তাকাল। মেঘ করে এসেছে শাহিনের মুখে।

আদিল হাসার চেষ্টা করল। বলল, “অফিসের ডাক পড়েছে আন্টি। বোঝেনই তো আর্মি…”

“করো তো ডেস্ক জব।” শাহিন তড়বড় করে উঠল, “নেভিতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই?”

আদিল হাসল, “আমি কাজটা সেরেই ফিরে আসছি।”

শাহিন বলল, “গতবারও তো এমনটাই বলে গিয়েছিলে। শেষে প্রাণটাই যেতে বসেছিল। সত্যি করে বলো তো আদিল তুমি কী কর? আর ছুটিতে এলেই তোমায় ডাকে কেন ওরা?”

আদিল দীর্ঘশ্বাসটা লুকিয়ে ফেলল। কাউকে বলা যায় না ও কী করে। মার্কোসের কম্যান্ডোদের জীবন সবার জানার জন্য নয়। এ বড় একাকী বেঁচে থাকা।

বেলঘরিয়া। এখন।

মোরগ রোজ অন্য পথ দিয়ে ভ্যান নিয়ে যায়। নানারকমের শাক সবজি নিয়ে পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে ‘সবজি-সবজি’ বলে হাঁক পাড়ে। তা খারাপ বিক্রি হয় না। দাশবাবুর বউ, রমা কাকিমা, সুজাতা ম্যাডাম ছাড়াও অনেকেই কেনে। আজকাল সবাই আর বাজারে যেতে চায় না। চায়, বাজারই তাদের কাছে চলে আসুক।

কিন্তু আজ দেরি হয়ে গিয়েছে। গতকাল রাতে বার্সেলোনার খেলা ছিল। দেখতে গিয়ে ঘুমতে দেরি হয়ে গিয়েছে। ব্যস, সকালে চোখ মেলেই দেখে, সূর্য মাথার উপর চড়ে বসেছে।

মোরগ প্যাডেলে চাপ দিল। সন্তোষ বলে একটা ছেলেও আজকাল সবজির ভ্যান নিয়ে ঘুরঘুর করছে। একদিন সুযোগ পেলেই ওর কাস্টমারে ভাগ বসাবে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না।

সামনে একটা রাস্তা ডানদিকে ঢুকে গিয়েছে। ভাঙা মিলের রাস্তা সেটা। আগে সুতো তৈরি হত মিলে। এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

মোরগ ভ্যানটা ওই রাস্তায় ঢুকিয়ে দিল। এটা দিয়ে শর্টকাট হয়।

রাস্তাটা এবড়ো খেবড়ো। ভ্যানটা লাফাচ্ছে। তাও মোরগ জোরে প্যাডেল করল। এই মিলের গেট পেরিয়ে একটু গেলেই ডান হাতে…দুম!

চিন্তাটা শেষ হল না মোরগের। তার আগেই প্রচণ্ড জোরে পৃথিবীটা নড়ে উঠল যেন। ও কিছু বোঝার আগেই ভ্যান থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের অশ্বত্থ গাছটার গায়ে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে ওর। চোখের সামনের পৃথিবীটা নিভে আসছে ক্রমশ। ভ্যানটা কোথায় গেল কে জানে।

কী যে হল, বুঝতে পারল না মোরগ। শুধু জ্ঞান হারাবার আগে মনে হল, সন্তোষের আজ পোয়া বারো!

১০

“বেলঘরিয়া!” সিএম তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে।

“হ্যাঁ ম্যাডাম,” সঞ্জয়বাবু নির্লিপ্তমুখে বললেন, “একটা বন্ধ ডিল্যাপিডেটেড স্পিনিং মিলে বিস্ফোরণ হয়েছে। ক্যাজ়ুয়্যালিটি বলতে, একজন ভেজিটেবল ভেন্ডার ইনজিওর্ড হয়েছে। আর কারখানাটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”

“কিন্তু কেন? এমন জায়গায় বিস্ফোরণ কেন?” সি এম এবার পল্লববাবুর দিকে তাকালেন, “কী দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে?”

“সেমটেক্স,” পল্লববাবু বললেন, “গোটা জায়গাটা কর্ডন করা হয়েছে। ফরেনসিকের লোকজনও গিয়েছে। যে ডিভাইসটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বেশ অন্যরকম।”

“মানে?”

“মানে ম্যাডাম, ডিটোনেটরটা রেগুলার জিনিস নয়। আমরা সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কোথা থেকে এমন একটা জিনিস এল, জানতে পারলে দোষীকে ধরতে সুবিধে হবে। কী বলো আদিল?”

আদিল সময় নিল একটু। তারপর বলল, “ম্যাডাম আমাকে ওখানে যেতে হবে। আমার মনে হয় চপার এসে গিয়েছে। রিসেন্টলি ইন্ডিয়ান আর্মির একটা অংশকে ইজ়রায়েলে স্পেশ্যাল অপারেশনের ট্রেনিং নিতে পাঠানো হয়েছিল। আই ওয়াজ় ইন দ্য টিম টু। আমার এক্সপ্লোসিভ নিয়ে ওখানে ভাল এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে। তাই…”

“তুমি যাও আদিল,” সিএম পাশে বসা সুরজিৎবাবুকে বললেন, “আপনি ওর যা হেলপ লাগে, অ্যারেঞ্জ করুন।”

সুরজিৎবাবু মাথা নাড়লেন, “ম্যাডাম, দুটো টিম বানিয়েছি। একটা পাবক রয়ের জন্য। অন্যটা এর জন্য। তবে আদিলের ইচ্ছেমতো, ও একাই অপারেট করবে। ওকে শ্যাডো করবে চারজন কম্যান্ডো।”

আদিল উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত নিজের আর্মস চেক করে নিল। তারপর বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, “আমার মনে হয় ম্যাডাম, অপারেটর একজনই। আর বিদেশি যোগ তো আছেই। না হলে সেমটেক্স ব্যবহার করা হত না। শুধু খটকা একটাই, পরিত্যক্ত মিল কেন?”

সি এম চুপ করে থাকলেন একটু। তারপর পার্থবাবুকে বললেন, “এই স্পিনিং মিলটা কাদের? তাদের কি আসতে বলেছেন? তাদের আসা দরকার। জানা দরকার, তাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে কি না। একই দিনে এমন দুটো ঘটনা? আশ্চর্য!”

১১

গাড়িটা এগোচ্ছে বেশ আস্তেই। পুজোর কলকাতায় সকাল থেকেই ভিড় লেগে আছে। তার উপর অনেক রাস্তাই বন্ধ। পাবক স্থির চোখে তাকিয়ে দেখল পাশে বসা মেয়েটিকে। ভাবলেশহীন মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন এই রাস্তাতেই গাড়ি চালিয়ে অভ্যস্ত।

গাড়ির কালো কাচ তোলা। তাই বাইরে থেকে ওদের দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য দেখা গেলেও মেয়েটার তাতে কিছু যেত আসত বলে মনে হয় না।

পাবক চোখ বন্ধ করল। শ্যামবাজারের বাড়িতে পুরো ব্যাপারটাই এত আচমকা ঘটল যে এখনও ভাবতে অবাক লাগছে।

ঠাকুরমার ঘর থেকে বেরিয়ে শুধু বাথরুমে গিয়েছিল একটু। স্বাভাবিকভাবেই কেউ আসেনি ওর সঙ্গে। বাড়ির একপাশে পুরনো দিনের বাথরুম। বড়, কিন্তু অন্ধকার মতো। বাথরুম থেকে বের হয়ে সবে দু’পা এসেছিল, তখনই থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছিল এই মেয়েটা। পাবক কিছু বোঝার আগেই মেয়েটা দ্রুত নিচু হয়ে একটা বালার মতো যন্ত্র ছুড়ে দিয়েছিল পাবকের গোড়ালি লক্ষ করে। নিমেষে যন্ত্রটা ক্লিক শব্দে পাবকের পায়ে আটকে গিয়েছিল। ভয়ে পাবক ছিটকে উঠেছিল। মেয়েটা দক্ষ হাতে ওকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে বলেছিল, “এটা একটা এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস। এর রিমোট সিগন্যালটা আমার সঙ্গে রয়েছে। যদি আমার থেকে দশ ফিটের বেশি দূরত্বে তুমি সরে যাও, তা হলে আপনা থেকেই এটা ফেটে যাবে। আর যদি চিৎকার করে হেলপ চাও, আমি নিজেই এটা ডিটোনেট করে দেব।”

পাবক কী বলবে, বুঝতে পারেনি। নীল রঙের চোখের মেয়েটির উচ্চারণে বলকান প্রদেশের ছাপ স্পষ্ট। মেয়েটা বলেছিল, “নাও, ফলো মি। বেঁচে থাকতে গেলে এখন আমার সঙ্গে আসতেই হবে তোমাকে। ঠিক না?”

পাবক বলেছিল, “আমার সিকিয়োরিটিরা তোমাকে ঠিক…”

“ধরতে পারবে না,” মেয়েটা এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে পাবককে আবার ঢুকিয়ে দিয়েছিল বাথরুমের ভিতর। বাথরুমের পিছনের দিকে জমাদারের ওঠার সিঁড়ি আছে।

মেয়েটা সেদিকে এগিয়ে দ্রুত দরজা খুলে নেমে গিয়েছিল প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে। বলেছিল, “মনে রেখো, দশ ফিট। নাও ইউ ডিসাইড।”

পাবকও পা চালিয়ে নেমে গিয়েছিল ওর সঙ্গে। পিছনের গলিটা নির্জন। মেয়েটা খুব অনায়াসে হাঁটছিল। হঠাৎ গলির মাঝে দাঁড়িয়ে হাত পেতেছিল, “তোমার মোবাইল?”

পাবক কাঁপা হাতে মোবাইলটা দিয়েছিল। মেয়েটা মোবাইলটা মাটিতে ফেলে জুতোর হিল দিয়ে চুরমার করে দিয়েছিল একদম। তারপর বলেছিল, “নাও ফলো মি ডিয়ার।”

পাবক চোখ খুলল না। কিন্তু শুনল, মেয়েটা ফোন বের করে কথা বলছে কারও সঙ্গে। ভাষাটা চিনতে পারল পাবক। স্টোকাভিয়েন! বসনিয়া অ্যান্ড হার্জ়েগোভিনার প্রেস্টিজ ল্যাঙ্গোয়েজ এটা। পাবক জানে ওর এখন কিছু করার নেই। ওকে এখন শুধু অপেক্ষা করতে হবে। মাথা ঠান্ডা রেখে এই জাল কেটে বেরোনোর পথ খুঁজতে হবে।

১২

নেউম। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জ়েগোভিনা। ২০ অক্টোবর

বরিস গাড়ির দরজা খুলে সামনের সিটে রাখা সানগ্লাসটা নিতে ঝুঁকল। আজ রোদ আছে বেশ। সামনের বিচ থেকে সুন্দর হাওয়া আসছে।

বরিস শুনল পিছনের সিটে বসা মানুষটি ফোনটা কানের থেকে সরাবার আগে বলছে, “গুড গ্রেটেল। ফেজ় ওয়ান কমপ্লিটেড। নাও দ্য মোস্ট ডিফিকাল্ট পার্ট। দ্য ট্রান্সপোর্টেশন। গডস্পিড।”

বরিস সানগ্লাসটা হাতে নিয়ে বেরোতে পারল না। তার আগেই শুনল পিছন থেকে বলা হল ওকে, “ড্রাইভ। হোটেলে চলো।”

বরিস গাড়ি স্টার্ট করে দিল।

সমুদ্রের পাড় দিয়ে রাস্তা সামনে বেঁকে গিয়েছে। নেউম বিখ্যাত টুরিস্ট স্পট। বরিস এর আগেও এসেছে এখানে। ও আয়না দিয়ে দেখল পিছনের আবছায়ায় বসে রয়েছেন মানুষটা। মাথাটা সামনে ঝুঁকে রয়েছে।

“স্যার, সব ঠিক আছে?”

“ঠিক?” গলায় বিষণ্ণতা মানুষটার, “নাহ্, ঠিক নেই। আগুনের মধ্যে হাত ডুবিয়েছি। জানি না কী হবে। কিন্তু এমন জিনিস, যা পৃথিবীকে এক ধাক্কায় দুশো বছর এগিয়ে দেবে, সেটা কী করে শুধু একটা অর্থলোভী মাল্টিন্যাশনালের হাতে থাকতে দিই? নলেজ মাস্ট বি ফ্রি। টেকনোলজি থেকে সবার সমান অ্যাডভান্টেজ পাওয়া উচিত। আর সেটা আনতে পারে শুধুমাত্র ব্রাটভাই। কিন্তু সেটা না হওয়া অবধি…”

বরিস জানে আর প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। ও রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে দেখল আবার ফোন বের করল মানুষটি। তারপর একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগিয়ে বলল, “কানেক্ট মি টু হ্যানসেল। বলো, গোর্কি কথা বলতে চাইছে।”

গোর্কি! ব্যস, এইটুকুই। মানুষটার পুরো নামটা আজও জানতে পারল না বরিস।

১৩

নবান্ন। এখন

কনফারেন্স রুমের এসি-তে বসেও সবাই দরদর করে ঘামছেন। এমন অদ্ভুত সমস্যায় একসঙ্গে পড়েননি কেউ। একদিকে বিজ্ঞানী কিডন্যাপড, অন্যদিকে পরিত্যক্ত মিলে বিস্ফোরণ! তাও সেমটেক্সের মতো উন্নতমানের বিস্ফোরক দিয়ে!

জিনি ঘড়ি দেখল। দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। বিস্ফোরণের পর আর প্রেসের থেকে কিছু লুকনো যায়নি। ও কি একবার ফোন করবে নির্মলদাকে? কিন্তু সিএম ম্যাডাম বলেছেন জিনিকে এখানে থাকতে। ফোন করলে তো ঘরের বাইরে যেতে হবে।

জিনি কী করবে ভাবতে-ভাবতেই ঘরের দরজা খুলে দু’জন ঢুকলেন। অক্টোবরের শেষ হলেও কলকাতায় বেশ গরম। তাও দু’জনে সুট পরে এসেছেন। একজন বাঙালি, আর একজন শিখ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

তাঁদের সঙ্গে ফিরহাদ হাকিম সাহেবও ছিলেন। উনিই এগিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিলেন “দিদি, এঁরা টু ডি কর্প থেকে এসেছেন। মিস্টার সুজন বোস এবং মিস্টার রোহিত বেদী।”

দু’জনেই হাত জোর করে নমস্কার করলেন।

সি এম হাত দিয়ে দু’জনকে বসতে বললেন সামনে। তারপর সুরজিৎবাবুর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন।

সুরজিৎবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “স্পিনিং মিলের ব্যাপারটা আশা করি শুনেছেন?”

বেদী তাকাল সুজনের দিকে। সুজন বলল, “স্যার, উই হ্যাভ নো ক্লু। একই দিনে দু’-দুটো মিসহ্যাপ!”

“দুটো!” সিএম অবাক হলেন।

সঞ্জয়বাবু শান্ত গলায় বললেন, “ম্যাডাম, ওই পাবক রয় যে কোম্পানি থেকে এসেছেন, তারা সাউথ ইস্ট এশিয়ায় টু ডি কর্পের সঙ্গেই টাই আপ করেছে। এই রিজিয়নে তাদের প্রোডাক্টের প্রোডাকশন আর সেলের জন্য। তাই ইটস আ ডবল ব্লো।”

সুজন বলল, “লাস্ট ফাইভ ইয়ারস আমাদের লালওয়ানি গ্রুপের সময়টা ভাল যাচ্ছে না। তাই এই টু-ডি কর্প গঠন করে আমরা গ্র্যাফিনটেকের সঙ্গে একটা জে ভি-তে গিয়েছি। কিন্তু সেখানেও…”

পল্লববাবু সামনে রাখা গ্লাস থেকে একটু জল খেয়ে নিয়ে বললেন, “আপনাদের কারও সঙ্গে রাইভ্যালরি আছে?”

বেদী টাইটা ঠিক করে সামান্য হাসল, “এত বড় বিজ়নেস হাউজ়! এত ভ্যারাইটি অফ প্রোডাক্টস! রাইভ্যালরি তো থাকবেই! কিন্তু আমাদের ফাঁকা ফ্যাক্টরিতে…”

“হ্যাঁ, ফাঁকা মিলে কেন বিস্ফোরণ করা হল?” সিএম যেন কতকটা নিজের মনেই বললেন।

“একটা কারণ থাকতে পারে,” সুজনের যেন কিছু মনে পড়ে গিয়েছে এমন করে তাকাল।

“কী?”

জিনি দেখল সুজন সময় নিল একটু। তারপর বলল, “রিয়েল এস্টেট!”

১৪

বেলঘরিয়া। এখন

মিলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সামনের লন্ডভন্ড লোহার স্ট্রাকচারটার দিকে তাকাল আদিল।

বেশ বড় এরিয়া নিয়ে মিল। এর ভিতরেই বড় মাঠের মতো অংশটায় ও হেলিকপ্টার নিয়ে নেমেছে।

আকাশ থেকে বোঝা যায়নি, কিন্তু মাটিতে নেমে সামনে দাঁড়িয়ে আদিল অবাক হয়ে গেল! ভাবল, মিলটা চালু থাকলে আজ কত লোক মারা যেত! এভাবে লোহা দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে! কত কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়েছে এখানে?

ও দ্রুত ফোন বের করে ডায়াল করল। ওদিকে রিং হচ্ছে। আদিল জানে নবান্নর কনফারেন্স রুমটাকেই আজ কন্ট্রোল সেন্টার করা হয়েছে। ওখানে ফোন করলেই সবার সঙ্গে কথা হয়ে যাবে।

“হ্যাঁ, আদিল,” সুরজিৎবাবুর গলা।

আদিল বলল, “স্যার, ইটস রিয়েলি ডেভাসটেটিং। অ্যালার্মিং-ও। খুব বড় ব্লাস্ট হয়েছে। মিলের শেড বলে আর কিছু নেই! আচ্ছা, আপনারা কোনও ডিমান্ড কল পেয়েছেন? বা ওইদিক থেকে কোনও র‍্যানসাম কল?”

“এখনও না,” সুরজিৎবাবুর গলাটা চিন্তিত শোনাল, “কেউ দায় স্বীকারও করেনি। সেন্টার বলছে এমন কোনও সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের ইঙ্গিতও ছিল না! সবটাই খুব অদ্ভুত!”

আদিল চোয়াল শক্ত করল, “স্যার, একটা লিড না পেলে কোথায় যাব?”

“ঠিক,” এবার সিএম-এর কথা শোনা গেল, “তবে একটা তথ্য তোমায় জানাই। গ্র্যাফিনটেক এই টু-ডি-র সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধে ব্যবসা করতে এসেছে। মানে একদিকে ওদের অ্যাসোসিয়েটের একজন বিজ্ঞানী কিডন্যাপ হল আর অন্যদিকে ওদের বন্ধ কারখানায় বিস্ফোরণ!”

আদিল কী বলবে বুঝতে পারল না। শুধু বলল, “কিন্তু এই বিস্ফোরণ কেন হল?”

সিএম বললেন, “সেটাই তো প্রশ্ন! তোমার কী মনে হয় আদিল, আরও বিস্ফোরণ হবে?”

আদিল চোয়াল শক্ত করল। সামনে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, “হ্যাঁ ম্যাম। যখন এখনও কেউ কোনও কিছু বলছে না, তখন আই গেস, হবে।”

১৫

খড়দা। এখন

মুনিয়া এই পথ দিয়ে গেলেই রামপ্রবেশের মনখারাপ করে। আঁচলটা কোমরে গুঁজে গোড়ালির সামান্য উপরে শাড়িটা উঠিয়ে মুনিয়া এই পথে গেলে রামপ্রবেশের মনে হয় একমাত্র দুপুরের এই মুহূর্তটার জন্যই ও এই পোড়া ফ্যাক্টরি আগলে পড়ে রয়েছে।

আজ মুনিয়া আকাশি রঙের শাড়ি পরেছিল। দুপুরের রোদে মনে হচ্ছিল মাছরাঙা নেমে এসেছে ওর সামনে। দূর থেকে চণ্ডীমঙ্গল ক্লাবের দুর্গাপুজোর ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু এই খুচরো গলিটা ফাঁকাই।

খড়দার এই বড় ফ্যাক্টরিটা ভাঙা জাহাজের মতো পড়ে রয়েছে বহুবছর। সারাদিন ছ’টা কাঠবেড়ালি আর কাক-চড়াই ছাড়া রামপ্রবেশের সঙ্গী থাকে না কেউ। শুধু দুপুর হলে মুনিয়া এই পথ দিয়ে ব্যানার্জিবাবুদের বাড়ি কাজ সেরে মিত্তিরবাবুদের বাড়ির দিকে যায়।

রামপ্রবেশ ভাবল, আজ পুজো, তা-ও মেয়েটার ছুটি নেই! ঠিক ওরই মতো!

রামপ্রবেশ আজ ফ্যাক্টরির এই ছোট গেটটা ছেড়ে মুনিয়ার পিছনে গিয়েছিল একটু। যদিও ওর গেট ছাড়া বারণ, তা-ও ছেড়েছিল। এই ভূতের ফ্যাক্টরিতে আছেটা কী? জংধরা মেশিন আর দশ বছরের ধুলো বৈ তো কিছু নেই!

মুনিয়া একবার শুধু তাকিয়েছিল পিছনে, তারপর আর তাকায়নি। মুনিয়া চলে যাওয়ার পর পথটা কেমন যেন বাতিল শহরের মতো নির্জন লাগছে ওর।

রামপ্রবেশ দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ফেরার রাস্তা ধরল! আর ঠিক তখনই দেখল লোকটাকে। লম্বা, ছিপছিপে। এক মাথা সোনালি চুল। চোখে নীল রঙের সানগ্লাস। লোকটা বাইক নিয়ে বেরিয়ে এল ফ্যাক্টরির গেট দিয়ে। তারপর রামপ্রবেশকে দেখে বাইকটায় রেস তুলে বেরিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে।

“হেই…হেই…” রামপ্রবেশ দৌড়ল। কে লোকটা! কী করছিল ফ্যাক্টরির ভিতর? এখানে ঢুকল কোন পথ দিয়ে? পিছনের ভাঙা পাঁচিল দিয়ে নাকি?

রামপ্রবেশ ফ্যাক্টরির ভিতর ঢুকে দেখল চারপাশটা। সামনের ফ্যাক্টরির বিশাল শেডের ভিতর আবছায়ায়। রামপ্রবেশ সেইদিকে এগতে গিয়ে থমকে গেল! আরে, অন্ধকারের ভিতর ছোট্ট একটা আলোর ফুলকি ঝলসে উঠল কেন!

***

মিত্তিরবাবুদের বাড়ির গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠল মুনিয়া। মনে হল পায়ের তলার মাটিটা কে যেন ধরে নাড়িয়ে দিল জোরে! যেন পাহাড় ভেঙে পড়ল কোথাও! এমন হাড়-হিম করা শব্দ কোনওদিন শোনেনি মুনিয়া। কীসের শব্দ এটা? বোমার?

১৬

কলকাতা। এখন

টিভির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সিএম। ব্রেকিং নিউজ়ে দেখাচ্ছে, খড়দায় লালওয়ানিদের বন্ধ হওয়া কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছে। পুলিশ, দমকল ছেয়ে আছে চারদিক। ফ্যাক্টরির দারোয়ান রামপ্রবেশ শর্মা ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছে!

“ম্যাডাম, আদিল,” সুরজিৎবাবু টেবিলে রাখা ফোনের স্পিকারটা অন করে দিলেন।

সিএম সময় নিলেন একটু। চশমাটা পরে নিয়ে ঝুঁকে বসে বললেন, “তুমিও তো পৌঁছে গিয়েছ! কী দেখলে?”

আদিল বলল, “নাথিং মাচ, ম্যাডাম। জাস্ট ডেভাস্টেশান। নো ক্লু, নাথিং!”

সি এম বললেন, “আমাদের সঙ্গে টু-ডি কর্পের দু’জন ডিরেক্টর আছেন। তাঁরা কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে।”

সুজন নিজের হাতঘড়িটা একবার দেখল, তারপর সিএম-এর দিকে তাকিয়ে অনুমতি নিয়ে বলল, “আমি সুজন বোস। টু-ডি কর্প থেকে এসেছি। আগেরটার মতো এটাও আমাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা ফ্যাক্টরি। এই ব্যাপারে আই হ্যাভ আ থিয়োরি।”

“প্লিজ় বলুন,” আদিল বলল, “আমি কিছু লিড না পেলে কী করে এগোব?”

সুজন একবার বেদীর দিকে তাকাল এক ঝলক। তারপর বলল, “আমি এই কোম্পানিতে বছর দুয়েক এসেছি। সেই সময় থেকেই কিছু বিদেশি কোম্পানি আমাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্যাক্টরিগুলো কিনতে চায় ফর রিয়েল এস্টেট। কিন্তু আমরা দিতে চাই না। আমরা চাই গ্র্যাফিনটেকের সঙ্গে বিজ়নেস করে যে প্রফিট হবে তা দিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলি রিভাইভ করতে। উই হ্যাভ আ লং টার্ম প্ল্যান। কিন্তু কেউ তা চায় না। সামবডি ইজ় আফটার আস। আমাদের কাল গ্র্যাফিনটেকের সঙ্গে প্রোডাক্ট লঞ্চ আছে। ঠিক তার আগের দিনই পাবককে কিডন্যাপ, আমাদের ফ্যাক্টরিগুলোয় ব্লাস্ট! বুঝতে পারছেন?”

আদিল সময় নষ্ট করল না, “প্রথমে বেলঘরিয়া, তারপর এই খড়দা। আর আপনাদের কোথায় আছে এমন অ্যাবানডন্ড জমি?”

“ও নো!” বেদীর কপালে ঘাম দেখা গেল।

সঞ্জয়বাবু সামান্য ভুরু তুললেন, “কী?”

সুজন বলল, “ব্যারাকপুর। চিড়িয়া মোড়ের কাছে আমাদের একটা বড় জমি আছে। মানে ওতে আমাদের কিছু ওয়ার্কারদের কোয়ার্টার আছে। যদিও বেশিরভাগই খালি। তাও একশোটা পরিবার আছে এখনও! ওটা কিন্তু ফ্যাক্টরি নয়। তবে স্পট হিসেবে বেশ লুক্রেটিভ!”

“মাই গড!” পল্লববাবু দ্রুত ফোন তুললেন, “আরে এখন বলছেন এসব! আমি এক্ষুনি নর্থ চব্বিশ পরগনার এস পি-কে ফোন করছি।”

আদিল ফোনের ওপার থেকে বলল, “ঠিক আছে। আয়াম গোয়িং অ্যাট ওয়ান্স। তবে…”

“কী?” সিএম জিজ্ঞেস করলেন।

“ম্যাডাম, এখনও কোনও কল আসেনি, কোনও র‍্যানসাম ডিমান্ড আসেনি, তাই না? আমার মনে হচ্ছে কিডন্যাপিং আর ব্লাস্ট কানেক্টেড!”

“কী রকম?”

“আমার মনে হচ্ছে এই ব্লাস্টগুলো গোটাটাই ডিকয়। আমাদের দৃষ্টি ঘোরাবার জন্য করা। এক্ষুনি বর্ডার অঞ্চলে সার্ভেলেন্স বাড়ানো উচিত। বর্ডার সিল করা উচিত। কারণ পাবক রয়কে নিয়ে নিশ্চয়ই বর্ডার পার করার চেষ্টা হবে।”

সিএম তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে, “ঠিক বলেছে আদিল। আপনি দেখুন ব্যাপারটা। সেন্টারে মিস্টার অরুণ জেটলির সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলুন। দরকার হলে আমাকে মোদীজির সঙ্গে ফোনে কথা বলান। কুইক।”

“আমি আসছি ম্যাডাম,” আদিল ফোনটা কাটতে গেল।

“এক মিনিট,” সিএম থামলেন সামান্য, তারপর বললেন, “এবার সে আসেনি?”

“কে ম্যাডাম?” আদিল অবাক হল।

“গতবার যে তোমায় বাঁচাল? যে বাঁচাল এই শহরটাকে,” সিএম স্থির গলায় বললেন, “সেই অদম্য সেন? সে আসেনি? আসবে না?”

আদিল নিজেও থমকে গেল সামান্য। তারপর বলল, “জানি না ম্যাডাম। আমি জানি না সে কোথায় আছে। জানি না সে আসবে কিনা!”

১৭

হেমনগর। এখন।

“ক্লেভার, টু ক্লেভার,” গাড়িটা একটা বড় গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে বলল গ্রেটেল। ড্রাইভারের সিটে বসেই পাবকের হ্যান্ড-কাফটা খুলে দিল এবার, “ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান তো! ঠিক ধরেছে!”

পাবক একবার দেখল গ্রেটেলকে, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জায়গাটা। ফাঁকা, বড়-বড় গাছে ঢাকা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে আসার সময় কয়েকটা দোকান দেখেছে। সাইনবোর্ডে পড়েছে জায়গাটার নাম হেমনগর!

গ্রেটেল গাড়ি থেকে নেমে বলল, “নাও, এসো আমার সঙ্গে। আর মনে আছে তো? আমার থেকে কতটা দূরে তুমি যেতে পার?”

পাবক নামল গাড়ি থেকে। গোড়ালির কাছে লোহার বালাটা চেপে রয়েছে। মেয়েটার প্ল্যানটা ভালই। পায়ের সঙ্গে রিমোট-সেনসিং এক্সপ্লোসিভ বেঁধে দিয়ে একটা অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে দিয়েছে। দশ ফিটের বেশি দূরে গেলেই বোমাটা আপনা থেকে ফেটে যাবে!

টুপির ফাঁক দিয়ে মেয়েটার সোনালি চুলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পাবক হাঁটতে-হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, “কে বুদ্ধিমান?”

গ্রেটেল বলল, “যারা তোমায় খোঁজার চেষ্টা করছে। যারা বম ব্লাস্টের কারণ জানার চেষ্টা করছে, তাদের ওই আদিল বলে ছেলেটা। ভেরি ক্লেভার।”

পাবক তাকাল গ্রেটেলের দিকে। তারপর চোয়াল শক্ত করল।

বড়-বড় গাছপালার মধ্যে দিয়ে সরু পায়ে হাঁটা পথ গিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সামনে খাঁড়িমতো কিছু আছে।

পাবক বলল, “তুমি জানতে পারছ কী করে?”

গ্রেটেল হাসল, “আমাদের সহস্র হাত আর লক্ষাধিক চোখ-কান। আমি সবটাই জানি।”

“আমায় নিয়ে কি সুন্দরবনের খাঁড়ি হয়ে তুমি ইন্ডিয়া ছাড়বে?”

“ইয়েস,” গ্রেটেল হাসল, “ঠিক ধরেছ। সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে আছে। স্পিড বোট, কনট্যাক্ট, সব। এখান থেকে একটা নৌকো করে আসল জায়গায় যেতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে। তারপর সেখান থেকে স্পিড বোটে করে…জাস্ট গন!”

“তুমি পালাতে পারবে সবাইকে…” পাবক কথাটা শেষ করতে পারল না, এবড়ো-খেবড়ো জমিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল হঠাৎ।

গ্রেটেল দ্রুত ঘুরে তাকাল পাবকের দিকে। নিমেষে কোমরের থেকে ছোট অটোমেটিক গ্লকটা বের করে তাক করল, “ডোন্ট ট্রাই এনি ট্রিকস। এসব পড়ে যাওয়া-টাওয়ার নাটক করে লাভ নেই। তুমি আমার কাছে প্যাকেজ মাত্র। ডেলিভারি দিতে হবে। তেমন হলে পায়ে গুলি করে টানতে-টানতে নিয়ে যাব।”

পাবক হাঁটু গেড়ে বসে হাত তুলল, “আরে পড়ে গেলাম তো! এখনও পর্যন্ত কিছু করেছি? আমি পড়াশোনার মানুষ। প্লিজ় মুভ ইয়োর গান।”

গ্রেটেল হাসল। পিস্তলটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আছে। এই কাজটা নিলাম বলেই আমার ভাই হ্যানসেলকে জেল থেকে বের করতে পারলাম। প্লাস টু মিলিয়ন ইউরো বোনাস!”

“সেইজন্য এত কিছু!”

“হ্যানসেল ইজ় নিট। বিস্ফোরণ করিয়ে প্রেস, পুলিশ, প্রশাসন সবার মন ওইদিকে ঘুরিয়ে দিল। তোমায় খোঁজার জন্য যে টিম তৈরি হয়েছে তার দিকটা কমজোরি হয়ে গেল। একজন সায়েন্টিস্ট উধাও। এমন তো কত হয়! কিন্তু ব্লাস্ট, তাও উত্সবের দিনে! কত লোকের মৃত্যু হতে পারে বলো তো! সবাই তো ওদিকেই মন দেবে। তাই না?”

পাবক উঠে দাঁড়াল। তারপর হাসল সামান্য।

“হাসছ কেন?” গ্রেটেল ভুরু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে।

“কিছু না।”

“হেসে নাও। শেষবারের মতো হেসে নাও,” গ্রেটেল কথাটা বলে ওকে হাঁটতে নির্দেশ করল, “গ্র্যাফিনটেককে ধ্বংস করব আমরা।”

গ্রেটেল নিশ্চিন্তে হাঁটতে থাকল সামনের ছোট খাঁড়িতে রাখা নৌকোটার দিকে। আসলে ও জানতেও পারল না একটু আগে মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময় পাবক প্যান্টের নিচের দিকে লুকনো খোপে রাখা ছোট্ট একটা ওয়াই-ফাই স্ক্যানার-কাম-ট্রান্সমিটার অন করে দিয়েছে! আর অদৃশ্য তরঙ্গ গ্রেটেলের মোবাইলটার ছাপ নিতে শুরু করে দিয়েছে!

১৮

কলকাতা। এখন।

আদিলের সঙ্গে কথা শেষ করে সিএম সামনে রাখা গ্লাস থেকে এক চুমুক জল খেলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “সঞ্জয়বাবু, সুরজিৎবাবু কি প্রেসকে ব্রিফ করতে গিয়েছেন?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম, বোধহয় হয়েও গিয়েছে এতক্ষণে।”

সঞ্জয়বাবু কথা শেষ করতেই সুরজিৎবাবু এসে ঢুকলেন ঘরে, “ম্যাডাম, আমি লালবাজারের সঙ্গে কথা বলেছি। পাবকের কোনও ট্রেস নেই। এমন কী আমাদের সোর্সদেরও জিজ্ঞেস করেছি! কিন্তু কেউ কোনও হিন্ট দিতে পারছে না।”

সিএম ভুরু কুঁচকে বসে ভাবলেন একটু। তারপর বললেন, “আর সঞ্জয়বাবু, সেন্টারে কথা হয়েছে?”

“হয়েছে ম্যাডাম,” সঞ্জয়বাবু শান্ত স্বরে বললেন, “ওরা বর্ডারে জানাচ্ছে। দে আর টেকিং মেজ়ারস।”

সিএম আরও কিছু বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু এবার বেদী উঠে দাঁড়াল, “ম্যাডাম, আমাদের যেতে হবে, ইফ ইউ প্লিজ় এক্সকিউজ় আস। আমাদের মিটিং আছে। পুজো বলে তো ছুটি নেই। প্লাস এমন ক্রাইসিস!”

সুজন বলল, “ইয়েস ম্যাডাম, কাল লঞ্চ, আজ বিজ্ঞানী বেপাত্তা, ওদিকে বোমা! আরও কী হবে জানি না। আমাদের কোম্পানির যা রেপুটেশন দাঁড়াচ্ছে, শেয়ার ইনডেক্স যে কোথায় পড়বে!”

সিএম তাকালেন সুরজিৎবাবুর দিকে, “ওঁদের কি দরকার আছে?”

সুরজিৎবাবু একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “না, তবে দরকার হলে…”

“ইউ ক্যান কল আস অ্যাট এনি টাইম স্যার, আমরা আসব।” সুজন দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “পুজোয় সবাই আনন্দে করবে কোথায়, তা না…কী যে হল! এখন ভাবছি অন্য প্লটগুলোয় কী হবে! বিশেষ করে ব্যারাকপুরের ওই…স্যার, প্লিজ় আপনাদের ফুল ফোর্স ডিপ্লয় করুন। ওখানে কিছু হলে অনেকে মারা পড়বে। প্লিজ়!”

সুজনরা আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল।

১৯

ব্যারাকপুর। এখন।

লালওয়ানিদের কোয়ার্টার কমপ্লেক্সটা বেশ বড়। কিন্তু অগোছালো। কোয়ার্টারগুলোয় বহুদিন রং হয়নি। শ্যাওলা-জমা দেওয়াল। ফাটা কার্নিশ। ব্যারাকপুরের এই অঞ্চলটা ঘিঞ্জি! পুরনোও। কমপ্লেক্সে ঢোকার মুখে একটা তোরণ ধরনের গেটও আছে। যদিও তার কিছুটা ভাঙা।

আদিল সামান্য এগিয়ে তোরণের একটা ভাঙা পিলারের সামনে দাঁড়াল। মিলিটারি ব্যারাকের কাছে চপার থেকে নেমে ও বাইকে এসেছে এতটা। সঙ্গে সোয়্যাট-এর চারজনের একটা টিম আছে। এই টিমের সবাই ওর চেনা। ইজ়রায়েলের ট্রেনিং ক্যাম্পে ওরা ছিল একসঙ্গে!

আদিলরা এখানে সাধারণ পোশাকে এসেছে। যাতে সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। কমপ্লেক্সের ভিতর একটা দুর্গাপুজো হচ্ছে। মাইকের আওয়াজে পাশের লোকের কথাও শোনা যাচ্ছে না ভাল করে!

তার মধ্যেই মোবাইলটা কানে চেপে আদিল বলল, “স্যার প্লিজ়, এখনই এখানে সব ফোর্স ডিপ্লয় করবেন না। আমি একটা হাশ্ড অপারেশন চাই। ফোর্স দেখলে যদি টার্গেট কিছু করে ফেলে তো খুব সমস্যা হবে!”

সুরজিৎবাবু বললেন, “কিন্তু রিস্ক হয়ে যাবে না?”

আদিল বলল, “আমি রিস্ক নিচ্ছি স্যার। প্লিজ়। ২০ মিনিট সময় দিন আমাদের।”

“২০ মিনিট। ডান।” ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।

আদিল দ্রুত সবাইকে জড়ো করল। তারপর বলল, “আমরা পাঁচজন আছি। আমি মিডল পোরশনটায় সার্চ করছি, তোমরা নর্থ, সাউথ, ইস্ট আর ওয়েস্ট উইংগুলো দেখো। আর যদি ওকে পাও, ট্রাই টু ক্যাচ হিম অ্যালাইভ।”

সবাই ছড়িয়ে পড়ল দ্রুত। আদিল নিজেও কোয়ার্টার কমপ্লেক্সের মাঝবরাবর এগোতে লাগল। ও জানে না, সত্যি এখানে কাউকে পাবে কিনা। কিন্তু হিসেব বলছে এখানেই আছে। তা ছাড়া সুজন বোসও তো এমনটাই জানিয়েছে যে এই কোয়ার্টারের প্লটটাতেও বিদেশি কোম্পানির নজর আছে।

পুজোটা হচ্ছে একটু দূরে, একটা ছোট মাঠের মধ্যে। আদিল ভেবে নিল এক মুহূর্ত। এখনও পর্যন্ত যতগুলো বিস্ফোরণ হয়েছে তাতে মাত্র একজন লোক মারা গিয়েছে। অর্থাৎ যে লোকটা এগুলো করছে, তার আসল উদ্দেশ্য মানুষ মারা নয়। ওর মনে হয় তার আসল উদ্দেশ্য ডাইভারশন তৈরি করা।

সামনে দুটো বারো-তেরো বছরের ছেলে হাতে ক্যাপ ফাটানো পিস্তল নিয়ে খেলছে। আদিল ওদের দিকে গিয়ে দাঁড়াল।

“এখানে কোনও ফাঁকা বাড়ি আছে?”

“অ্যাঁ?” একটা ছেলে অবাক হল, “আছে তো। কেন?”

“কোনদিকে?”

ছেলেটা বলল, “একটু সামনে। জিম সাহেবের ভূতবাংলো।”

“মানে?” আদিল অবাক হল।

ছেলেটা বলল, “কোয়ার্টারের সবাই বলে ওই বড় বাড়িটা নাকি এখানে মিউটিনির সময় থেকে আছে। খুব বড় বাড়ি। তবে ভাঙা। জিম সাহেবের ভূত থাকে ওখানে।”

আদিল আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত এগোল। কমপ্লেক্সটা বেশ বড়, কিন্তু মাঝখানে যে এমন একটা বাড়ি আছে, তা বোঝা যায় না। কিছুটা যেতেই ডানদিকে একটা গলির ভিতর সামান্য ঝোপঝাড় দেখতে পেল আদিল। বুঝল এই পথে কেউ যায় না।

ও ডানদিকে বাঁক নিল। গলিটা সরু। নোংরা। আগাছা আর দুর্গন্ধে ভর্তি। কিন্তু গলিতে ঢুকেই বুঝল, খুব সম্প্রতি এখানে কেউ এসেছে। আগাছাগুলো মাড়ানো অবস্থায় নেতিয়ে আছে। আদিল দ্রুত হাতে পিস্তলটা নিল। তারপর সাবধানে এগোল।

জিম সাহেবের বাড়িটা বড়। ভাঙা। বোঝাই যাচ্ছে বহু পুরনো। চারিদিক আগাছায় ভর্তি।

আদিল মাটির দিকে তাকাল। ছোট-ছোট গাছপালাগুলো একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে দুমড়ে আছে। একদিকের নরম মাটিতে বুটের আংশিক ছাপও রয়েছে। ও এগিয়ে গেল বাড়িটার ভিতরে।

একতলায় বেশ অনেকগুলো ঘর। যদিও একটাতেও জানলা-দরজা নেই। দেওয়ালও ভেঙে পড়েছে বিভিন্ন জায়গায়। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটাও মাঝখানে ভাঙা।

মাইকের আওয়াজে কিছু শোনা যাচ্ছে না। আদিল চোয়াল শক্ত করে একটা থামের আড়ালে কভার নিয়ে ভাল করে দেখল চারিদিকটা। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। ভাঙা ছাদের একটা অংশ থেকে নেমে আসা আলোয় একটা ছায়া নড়ে উঠল যেন!

আদিল জানে, ও নিজে সামনে এগিয়ে গেলে ধরা পড়ে যাবে। কোমরের পাউচ থেকে একটা ছোট আয়না আর ছোরা বের করল। তারপর মুখের চিউয়িংগামটা ছোরার মাথায় লাগিয়ে তাতে আয়নাটা আটকে দিল। এবার হাত বাড়িয়ে আয়নাটা থামের আড়াল থেকে বের করল একটু। প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। আরে ওই তো ছায়াটা নড়ল আবার। আদিল ভাল করে পিস্তলটা ধরল।

ফট। চাপা শব্দটা শোনামাত্র হাতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল আদিলের। আর ছুরিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। আদিল দ্রুত বসে পড়ল। ওকেও দেখে ফেলেছে প্রতিপক্ষ। তাই গুলি করছে। ও চোয়াল শক্ত করল, ওর অনুমান তবে ঠিক!

র‍্যাট-ট্যাট-ট্যাট। এবার অটোম্যাটিক উজ়ি-র আওয়াজ শুনল আদিল। থামের দিকে গুলি চালাচ্ছে মানুষটা। দেওয়ালের চোকলা উঠে ছড়িয়ে পড়ছে। আদিল ভাবল ওর সঙ্গে কেবল দুটো নাইন এম এম রয়েছে। আসলে অটোম্যাটিক রাইফেল নিয়ে কোয়ার্টার কমপ্লেক্সে ঢুকলে প্যানিক ছড়াবে ভেবেই আর ও ওসব নেয়নি।

মানুষটা গুলি চালাচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু মাজ়লে সাইলেন্সার লাগানো। তাই চাপা শব্দ হচ্ছে। আদিল জানে থামের আড়াল থেকে বেরোলেই ঝাঁঝরা হয়ে যাবে। এই অটোম্যাটিক উজ়িগুলো সাংঘাতিক। বুলেট শুট করে না, স্প্রে করে।

নাইন এম এম দিয়ে এর সঙ্গে পারা যাবে না। আদিল দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। কোমর থেকে একটা ইয়েলো স্মোক গ্রেনেড বের করে দ্রুত পিনটা খুলে থামের আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে ছুড়ে দিল মানুষটার দিকে। নিমেষের মধ্যে সারা ঘর ঘন হলুদ ধোঁয়ায় ভরে গেল। উজ়ি থামল এক মুহূর্তের জন্য। এই সুযোগে আদিল বেরোতে গেল থামের আড়াল থেকে। কিন্তু তখনই আবার গুলিবৃষ্টি শুরু হল। আদিলও হাত বাড়িয়ে এবার এলোপাথাড়ি গুলি চালাল কিছুটা। উঁকিও দিল রিস্ক নিয়ে। আর দেখল হলুদ ঘন ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মানুষটা। মুখে গ্যাস-মাস্ক!

তার ভিতর থেকে গমগমে গলা শোনা গেল এবার, “ইউ গাইজ় আর ফিনিশড নাও।”

লোকটার উচ্চারণে পূর্ব-ইউরোপীয় টান স্পষ্ট। লোকটা আবার বলল, “উই হ্যাভ ডান ইট। ইউ ক্যান ডু নাথিং নাও।”

লোকটা আবার তার গুলি চালানো শুরু করল। আদিল আর সময় নিল না। মনে-মনে হিসেব করে দেখল লোকটার চালানো গুলি মাটি থেকে তিন ফুটের মতো উচ্চতায় আসছে। এই সুযোগটাই নিতে হবে। ও দ্রুত শুয়ে পড়ল চিত হয়ে। তারপর দু’হাতে দুটো পিস্তল নিল। সামান্য ভুল হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু রিস্ক না নিলেও মরবে। কারণ লোকটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

পা দুটোকে গুটিয়ে থামের গায়ে ধাক্কা মেরে মাটিতে ঘষটে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আদিল। সারা ঘরে হলুদ ধোঁয়া।

আদিল আচমকা অমন করে ছিটকে আসায় লোকটা ঘাবড়ে গেল একটু। কয়েক মুহূর্তের জন্য ট্রিগারে থমকে গেল ওর আঙুল। এলিমেন্ট অফ সারপ্রাইজ়! এটাই আদিলের অস্ত্র। এই কয়েক মুহূর্তটাই কাজে লাগাল ও। লোকটাকে লক্ষ করে দু’ম্যাগাজ়িন গুলি খালি করে দিল নিমেষে।

লোকটা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটু। তারপর ভাঙা মূর্তির মতো মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আদিল উঠে দাঁড়াল। হাঁপাচ্ছে সামান্য। ঘাম জমেছে কপালে। ও এগিয়ে গিয়ে পা দিয়ে সরিয়ে দিল উজ়ি-টা। তারপরে এক টানে খুলে ফেলল গ্যাসমাস্ক। লম্বা সোনালি চুলের মানুষ। ঘাড়ের কাছে কালো মাকড়সার ট্যাটু। আদিল বসে পড়ে ওর পরনের জামাটাও টেনে ছিঁড়ে দিল। দেখল লোকটার সারা গায়ে বুলেটের ক্ষত থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। আর রক্তের ধারা বুক জুড়ে থাকা ট্যাটুগুলোকে লাল রঙে চুবিয়ে দিচ্ছে!

আদিল বুঝল, লোকটা রাশিয়ার জেলে ছিল। কয়েদিদের গায়ে এ ধরনের ট্যাটু রাশিয়ার জেলেই করা হয়।

ও বসে পড়ে লোকটার সারা দেহ খুঁজল। একটা মোবাইল পেল শুধু! কিন্তু পাসওয়র্ড প্রোটেকটেড। ও মাথা নাড়ল। লোকটাকে জ্যান্ত ধরা গেল না! এখন তবে কী করবে?

পিং পিং। আচমকা আদিলের মোবাইলটা বেজে উঠল। মেসেজ টোন! এখন কে? আদিল দ্রুত মোবাইলটা তুলে নিল হাতে। এম এম এস এসেছে একটা। গুগল ম্যাপের স্ক্রিনশট!

আদিল অবাক হয়ে গেল। দেখল ম্যাপের তলায় কো-অর্ডিনেট লেখা। আর লেখা, ‘সার্চ ইট অ্যান্ড ফলো ইট। নাও।’

আদিল সেন্ডারের নম্বরটা দেখল। প্রাইভেট নম্বর! এটা কে পাঠাল ওকে? কী আছে এই লোকেশনে? ও ভাল করে ম্যাপটা দেখল। সুন্দরবন অঞ্চলের খাঁড়ি দেখা যাচ্ছে। ম্যাপে নাম নেই খাঁড়িটার। কাছাকাছি একটাই নাম দেখা যাচ্ছে। বোধহয় কোনও গ্রাম। হেমনগর!

সুন্দরবনের খাঁড়ি! আদিল চমকে উঠল। তাই তো! এটা তো বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে। অনায়াসে এটা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাওয়া যায়! তার মানে এখানেই কি…কিন্তু এটা কে পাঠাল ওকে?

আদিল উঠে দাঁড়াল। ও যে চপারটায় এসেছে, সেটা লেটেস্ট মডেলের। গতিবেগ ঘণ্টায় তিনশো মাইল। মানে এখান থেকে ওই হেমনগর পৌঁছতে ওর ১৫ মিনিটের একটু কম সময় লাগবে। নট আ মোমেন্ট টু লুজ়!

ও দ্রুত পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। তারপর দৌড়ে গেল ভাঙা বাড়িটার বাইরে।

২০

নেউম। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জ়েগোভিনা। অক্টোবর ২০, ২০১৫।

গোর্কি ফোনটা রেখে হাসল। ড্রাইভারের সিটে বসা বরিসের দিকে তাকিয়ে বলল, “গেট মি ওয়ান বোজ়া। অ্যান্ড ফর ইউ টু।”

বরিস বুঝল বসের মুড ভাল। তাই এই পানীয়টি আনতে বলছে। পূর্ব ইউরোপ তথা বলকান অঞ্চলে এই বোজ়া পানীয়টি বিখ্যাত। ভুট্টা আর গম থেকে তৈরি করা হয় এটি।

ও গাড়ি থেকে নেমে সামনের দোকানের থেকে দুটো বোতল কিনে আবার গাড়িতে উঠে এল। হাত বাড়িয়ে গোর্কিকে একটা বোতল দিয়ে আবার সামনে ঘুরে বসল।

গোর্কি সামান্য সময় নিল। তারপর বলল, “পৃথিবীর সমস্যা কী জান? অসাম্য। সারা পৃথিবীর ধনী দেশগুলো যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেয়, তা দিয়ে সাব-সাহারান আফ্রিকাকে সারা বছর খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। ভাবতে পারো? ধনীরা জিনিস মিসইউজ় করে। সেখানে গ্র্যাফিনের মতো জিনিস যদি একজনের হাতে জমা পড়ে থাকে, তবে তো…আমরা কিন্তু আসলে দেশের ও দশের উপকারই করছি। তবে উইথ আ লিট্ল প্রফিট! যারা এই ব্যালেন্স মেনটেন করতে চায়, তারা ব্রাটভাকে জাস্ট পারিশ্রমিকটা দেবে তাদের হাতে পাবক রয়কে তুলে দেওয়ার জন্য। আর গুড নিউজ় হল, সেটা পাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।”

বরিস অবাক হল। গোর্কি কখনও এত কথা বলে না ওকে। কিন্তু আজ যেন খুব খুশি! হবেও বা। ও রিয়ার-ভিউ মিররে দেখল পিছনের কালো কাচের আবছায়ায় গোর্কির চোখদুটো যেন জ্বলছে!

২১

সুন্দরবন। ভারত। এখন।

সাপের মতো এঁকে-বেঁকে খাঁড়িটা বয়ে গিয়েছে। দু’পাশে সবুজ গাছপালা ঝুঁকে এসেছে জলে। চপারের দরজায় ঝুলন্ত অবস্থায় আদিল এবার দেখতে পেল বোটটাকে। সবুজ জলটাকে কেটে তিরবেগে এগোচ্ছে! ও দূরবিনটা চোখে লাগাল। পাশে বসা সোয়্যাটের রকি বলে ছেলেটা বলল, “আদিল, আমি কি শুট করব ওকে?”

আদিল দেখল রকি ওর স্নাইপার রাইফেলটা চপারের আরেকদিকের দরজা দিয়ে বের করে তাক করে রেখেছে।

“ডোন্ট,” আদিল বলল, “আমরা জানি না ওই বোটে কে কী অবস্থায় আছে। প্লাস বোটটা খুব কাঁপছে। চপারটাও। এমন সারপেন্টাইন ওয়াটার বডি, নট দ্যাট ইজ়ি। যদি মিস হয় ও যে কী করবে!”

চপারটা ক্রমশ দূরত্ব কমিয়ে ফেলছে। এবার বোট চালাচ্ছে যে সেই টুপি-পরা মানুষটা পিছনে ফিরল আচমকা। আর আদিল অবাক হয়ে চোখ থেকে সরিয়ে নিল দূরবিন। একটা মেয়ে! একটা মেয়ে পাবককে কিডন্যাপ করেছে!

আদিল চোয়াল শক্ত করল, “ক্লোজ়, আরও ক্লোজ়।”

চপারটা একগুঁয়ে ফড়িঙের মতো গোঁত্তা মেরে এগিয়ে গেল।

আচমকা ফট ফট শব্দ শুনল আদিল। সর্বনাশ! বোট থেকে গুলি চালাচ্ছে মেয়েটা। চপারের সামনের গ্লাসটা বুলেটপ্রুফ। নোজ়টাও তা-ই। কিন্তু গুলি যদি মাথার উপর পাখা ঘোরাবার রোটরে লাগে!

সামনে খাঁড়িটা আবার ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। এবার চপারটা আর বোটটাকে তাড়া না করে জঙ্গলের মাথা দিয়ে শর্টকাট করে নিমেষে বোটের মুখোমুখি হল। আদিল দেখল এতে মেয়েটা এতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছে! বোটটার মাথার উপর এসে পড়েছে চপারটা! আদিল আর সময় নষ্ট না করে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপর থেকে বোট লক্ষ করে লাফ দিল!

মেয়েটাও পালটা গুলি চালাল। ভোমরার মতো শব্দ তুলে দুটো বুলেট বেরিয়ে গেল আদিলের শরীর ঘেঁষে! আদিল দুটো পা জড়ো করে সর্বশক্তি দিয়ে আছড়ে পড়ল মেয়েটার উপর। কিন্তু মেয়েটাকে মারতে পারল না। মেয়েটা দ্রুততার সঙ্গে ছিটকে গেল বোটের অন্যদিকে। পাবকের দিকে। মেয়েটার আচমকা ধাক্কায় পাবকও পড়ে গেল। বোটটা কেঁপে উঠল প্রচণ্ড। আদিল দ্রুত উঠে দাঁড়াল। দেখল, খাঁড়িটা সামনে অনেকখানি সোজা।

আদিল দ্রুতহাতে পিস্তল বের করে তাক করল সামনের দিকে। কিন্তু মেয়েটা এক ঝটকায় পাবককে সামনে এনে ঢালের মতো ধরল। পাবকের গলার কাছে পিস্তলটা ঠেকিয়ে তাকাল। চোখে যেন নীল রঙের আগুন!

আদিল চোয়াল শক্ত করে বলল, “ইওর গেম ইজ় আপ।”

“নো। গ্রেটেলরা ইমরটাল হয়, জান না?” কথাটা শেষ করেই আচমকা আদিলকে লক্ষ করে ট্রিগার টানল গ্রেটেল।

আদিলের মনে হল বুকে কে বল-পিন হ্যামার দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল ওকে। ভারসাম্য রাখতে না পেরে ও পড়ে গেল জলে। কিন্তু পড়তে-পড়তেও দেখল, পাবক প্রচণ্ড একটা মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল গ্রেটেলের কাছ থেকে। তারপর গ্রেটেলকে ঠেলে ফেলে দিতে গেল। গ্রেটেল কোনওমতে নিজের ভারসাম্য রেখে পাবককে গুলি করল। পাবক স্থির হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য, তারপর টুপ করে খসে পড়ল জলে!

আদিল জলের ভিতর ডুবতে থাকা অবস্থাতেও দেখল, ছুটন্ত বোটের কিনারায় দাঁড়িয়ে গ্রেটেল চিৎকার করছে, “দশ ফিট! মনে নেই? নাও ডাই!”

পাবক অবসন্ন শরীর নিয়েও এবার হাতটা তুলল। একটা রিমোট কন্ট্রোল ওর হাতে!

এটা কী? আদিল ভাসতে-ভাসতে দেখল, বোটের কিনারায় দাঁড়ানো গ্রেটেলের মুখটা নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ও দ্রুত নিজের পায়ের দিকে তাকাল। আদিল দেখল, গ্রেটেলের পায়ের গোড়ালিতে বালার মতো আটকানো জিনিস, যাতে লাল আলো দপদপ করছে!

“ইউ…কখন তুমি…কী করে…”

গ্রেটেল চিৎকার করে কিছু বলতে গেল, কিন্তু পারল না। সামনে এগোতে থাকা বোটটার কিনারায় দাঁড়ানো গ্রেটেলের শরীরটা আচমকা বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল চারিদিকে। আর তার ধাক্কায় আদিল আর পাবক দু’জনেই জলের আরও গভীরে চলে গেল।

ঘোলাটে আর নোনতা অন্ধকার চারদিকে! আদিল নিজের জামার ভিতর থেকে কেভলার বডি-আর্মারটা খুলতে-খুলতে ভাবল, পাবকের কোথায় গুলি লেগেছে? জলের তলায় তলিয়ে যায়নি তো ছেলেটা?

আদিল কেভলারটা খুলে ভেসে উঠল আবার। দূরে একটা পাড়ের গায়ে বোমায় থেঁতলে যাওয়া মোটরবোটের ধ্বংসাবশেষটা জ্বলছে এখনও। চপারটা জলের উপরে এসে হোভার করছে। চারটে নেভির বোট দ্রুতবেগে ছুটে আসছে ওদের দিকে।

কিন্তু পাবক? আদিল জলের মধ্যে ভাসতে-ভাসতে এদিক-ওদিক তাকাল। দেখল পাবকের কোনও চিহ্ন নেই কোথাও! গুলি লেগে তবে কি…আদিল চোখ বন্ধ করল! পারল না তবে ওকে বাঁচাতে! চোখের সামনে এভাবে মারা গেল ছেলেটা?

২২

নবান্ন। কলকাতা। এখন।

আদিলের সামনে কফির কাপটা সিএম নিজেই এগিয়ে দিলেন, “ব্যাড লাক আদিল। কিন্তু তুমি খুব ভাল এফর্ট দিয়েছ। এক্সেলেন্ট!”

আদিল কাপটা নিয়ে মাথা নাড়ল শুধু। কিন্তু কিছু বলল না। ও জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনটা খারাপ লাগছে খুব। পুজোর কলকাতায় সন্ধে নেমে গিয়েছে। বিদ্যাসাগর সেতুটা ঝলমল করছে আলোয়। ও জানে লক্ষ-লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছে রাস্তায়।

ও চোখ সরিয়ে নিল। পাবকের শেষবারের মুখটুকু ও দেখেছে। জলের তলায় তলিয়ে যাওয়ার আগের মুখ!

সুরজিৎবাবু বললেন, “কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, প্রায় চার ঘণ্টা হল সার্চ চলছে, কিন্তু পাবক রয়কে পাওয়াই গেল না! জলের তলায় কোথায় যে তলিয়ে গেল!”

“আসলে,” সঞ্জয়বাবু বললেন, “ভাঁটার টানে হয়তো সমুদ্রে চলে গিয়েছে।”

“কী যেন নাম বললে মেয়েটার?” সিএম জিজ্ঞেস করলেন আদিলকে।

আদিল বলল, “গ্রেটেল, ম্যাডাম। আর ওই ব্যারাকপুরে যে মারা গিয়েছে, তার শরীরে অনেক ট্যাটুর মধ্যে একটা নাম ছিল, হ্যানসেল!”

“সে কী!” সিএম চমকে উঠলেন, “তবে তো এরা কানেক্টেড!”

“হ্যাঁ ম্যাডাম, ওই সুজন বোস ঠিকই বলেছেন ব্যারাকপুরের ওই প্লটটা সম্বন্ধে। হ্যানসেলের এই বিস্ফোরণগুলি ডিকয় ছিল। একদিকে পাবককে নিয়ে পালাবে আর আমাদের দৃষ্টি ঘোরাতে এই ভরা পুজোর মরশুমে একটার পর একটা বিস্ফোরণ ঘটানো হবে,” পল্লববাবু বললেন।

“কিন্তু পাবককে…” পার্থবাবু কথা শেষ করতে পারলেন না। ঘরের কোনায় মোবাইল নিয়ে বসে থাকা জিনি এবার ছিটকে উঠল। প্রায় দৌড়ে গিয়ে টেবিলে রাখা রিমোট তুলে ‘অন’ করে দিল টিভিটা। সবাই অবাক হয়ে তাকাল জিনির দিকে।

জিনি বলল, “সরি ম্যাডাম। বাট বিগেস্ট ব্রেকিং নিউজ়। প্লিজ় দেখুন।”

কফির কাপটা নিয়ে আদিল ঝুঁকে বসল সামনে। সামনের ৫৬ ইঞ্চি টিভিতে মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দৃশ্য দেখাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, একজন বিদেশির সঙ্গে ছোটখাটো চেহারার একজন ভারতীয় গটগট করে হেঁটে আসছে। চারদিকে বেশ কয়েকজন কম্যান্ডো তাদের আগলে নিয়ে আসছে। নিচে স্ক্রল যাচ্ছে-‘সবার সামনে এলেন এবার আসল পাবক রয়! কাল প্রোডাক্ট লঞ্চের জন্য এইমাত্র মুম্বই এসে পৌঁছলেন পাবক রয়!”

আদিল দেখল শুধু ওর নয়, সবার মুখ হাঁ হয়ে আছে।

“আসল পাবক রায় মানে?” পার্থবাবু চশমার আড়ালে চোখ বড়-বড় করে তাকালেন সবার দিকে, “তবে যে এল, যাকে কিডন্যাপ করা হল, যার খোঁজ চলছে, সে কে?”

আদিল কিছু ভাবতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে ডুবন্ত মানুষটার মুখ মনে করার চেষ্টা করল। স্পষ্ট হল না মুখটা। ওই অস্থিরতার মধ্যে কিছু স্পষ্ট মনে পড়ছে না। আচমকা ওর একটা কথা মনে পড়াতে ও নিজের মোবাইলটা বের করল। সেই মেসেজ! ‘সার্চ ইট অ্যান্ড ফলো ইট, নাও।’ এটাই বা কে পাঠাল ওকে? ওর মোবাইল নম্বর কে জানে!

আদিল সিএম-এর দিকে তাকাল। দেখল সিএম-ও ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন। চোখে হাজারো প্রশ্ন! আদিল চোখ নামিয়ে নিল। ও জানে, সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর ওর নিজের কাছেও নেই। হয়তো কোনওদিন থাকবেও না।

২৩

নেউম। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জ়েগোভিনা। নভেম্বর ১৮, ২০১৫।

চশমাটা খুলে সামনে ঝুঁকে বসল গোর্কি। গাড়ির কালো কাচ তোলা। সন্ধের অন্ধকারে গাড়ির ভিতরটা তাই আরও অন্ধকার হয়ে আছে।

সামনে বসা মানুষটার চোখে চোখ রাখল গোর্কি। লোকটা কাঁপছে সামান্য। ভয় পেয়েছে। অন্ধকারে গোর্কির একটা চোখের এই হলদেটে মণিটা দেখে অনেকেই ভয় পায়।

“আয়্যাম ভেরি সরি মিস্টার গোর্কি। আমি…আমি প্রথম স্টেজে পারিনি। কিন্তু…বিলিভ মি, এবার আর ভুল হবে না। প্রোডাক্ট লঞ্চ হয়ে গিয়েছে। ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশনও স্টার্ট হয়ে গিয়েছে। এবার গ্র্যাফিন সিনথেসিসের ব্লু-প্রিন্টটা বের করা আমার কাছে কোনও ব্যাপারই হবে না। আপনি প্লিজ় বিশ্বাস করুন।”

গোর্কি সামনের সিটের দিকে তাকাল। বরিস আজ আসেনি। অসুস্থ। তার জায়গায় নতুন একটা ছেলেকে পাঠানো হয়েছে। তাকে বোজ়া পানীয়টি আনতে পাঠিয়েছে গোর্কি।

গোর্কি শক্ত গলায় বলল, “আয়্যাম ডিসঅ্যাপয়েন্টেড। তুমি ঠিকমতো কাজ করনি। তোমার হঠকারিতার জন্য ওই প্ল্যানটা বানচাল হয়েছে।”

“আমার?”

“তোমার।” চাপা গর্জন করল গোর্কি, “কে তোমায় সাজেস্ট করতে বলেছিল হ্যানসেলের মুভমেন্ট? ব্যারাকপুরের কথা কে বলতে বলেছিল? কে বলেছিল সাধু সাজতে? কী কথা ছিল? হ্যানসেল আরও কিছুক্ষণ বাউন্স করাবে সবাইকে। কিন্তু তুমি? তুমি কেন আগে থেকেই…”

“আ…আমি,” এবার গলা কেঁপে গেল সুজনের!

“কী আমি?” গোর্কি আরও ঝুঁকে সুজনের কোটের লেপেলটা ধরল, “তুমি কী করেছ জান? ব্রাটভার কত ক্ষতি হল জান? আর সেখানে সরি?”

সুজন কাঁপা গলায় বলল, “স্যার, প্লিজ়। সবাই ঘিরে ধরেছিল আমায়। খালি মনে হচ্ছিল ওরা যদি একটু ডিগ করে, তবে জেনে যাবে আমি গত কয়েক মাসে কার-কার সঙ্গে কোথায় দেখা করেছি। আচমকা কত টাকা আমার হাতে এসেছে। আমার উপরে যাতে কেউ সন্দেহ না করে, তাই আমি ওদের ব্যারাকপুরের ওখানের কথাটা বলেছি। আমি ঘড়ি দেখে সময়টাও ক্যালকুলেট করেছিলাম। মনে হয়েছিল ওটা সেফ। তাই…”

“স্যার,” গোর্কি আরও কিছু বলত, কিন্তু এবার জানলায় টোকা পড়ল। আস্তে করে কাচটা নামাল গোর্কি। ড্রাইভারটি। হাতে দুটো বোজ়ার বোতল।

গোর্কি তাকালও না ভাল করে। সামনে বসা এই সুজন ইডিয়টটাকে নিয়ে কী করা যায় সেটাই ভাবছে। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দুটো বোতল দু’জনকে দিল।

“আমি…” ছেলেটা কিছু বলতে গেল, কিন্তু তার আগেই গোর্কি তুলে দিল কাচটা।

“ড্রিঙ্ক,” গোর্কি চাপা গলায় বলল।

সুজন কোনওমতে বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢোঁক দিল। রাগের মধ্যেও হাসি পেল গোর্কির। এখনও কেউ সামনে বসে ভয়ে কাঁপছে দেখলে ভিতরে-ভিতরে একটা মজা পায় গোর্কি। ও নিজেও বোতলে চুমুক দিল।

হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে সুজন বলল, “স্যার, আর ভুল হবে না। এবার আমি নিজে টেক কেয়ার করব। আমি নিজে আর অ্যান্ড ডি-তে গিয়ে…”

গোর্কি দেখল সুজন কেমন যেন চুপ করে গেল আচমকা। যেন কথা আটকে গিয়েছে! তারপর হঠাৎ ঝাঁকুনি উঠল সুজনের। মুখ দিয়ে ফেনা গড়াতে লাগল!

“আরে,” গোর্কি সামনে ঝুঁকে ঠেলা দিতে গেল সুজনকে, কিন্তু পারল না। তার আগেই বুকের বাঁদিকে কে যেন কাঁটা গেঁথে দিয়েছে, এমন ব্যথা করে উঠল ওর। মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল গোর্কির। সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে গেল সেই ব্যথার কর্কট! ও আবছা চোখে দেখল, সামনে ঢলে পড়ল সুজন।

গোর্কি দ্রুত জানলাটা নামিয়ে দিল সুইচ টিপে। হাওয়া কমে আসছে দ্রুত। গলায় ফাঁস চেপে বসছে যেন। ও হাত বাড়িয়ে সামনের সিটের পিছনে রাখা এমার্জেন্সি কিটটা খুঁজতে গেল। এতে অ্যান্টি-পয়জ়ন ইঞ্জেকশন থাকে। হৃত্পিণ্ডে নিতে হয়।

নেই! কিটটা নেই! গোর্কি শেষবারের মতো শ্বাস নেবে বলে নামতে গেল গাড়ির দরজা খুলে। কিন্তু পারল না। দেখল দরজাটা বাইরে থেকে চেপে ধরে দাঁড়িয়েছে একজন! কে এটা? একে তো…

গোর্কি আর পারল না। নিজেও এবার নিস্তেজ হয়ে এল ক্রমশ। তারপর গড়িয়ে পড়ল সিট থেকে। শুধু অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার আগে মনে হল, এ ছেলেটা কি ওর নতুন ড্রাইভারটি?

২৪

গেইভেলবার্গ কাউন্টি, সুইডেন। মার্চ ৬, ২০১৫।

জেরার্ড হাসল সামান্য। তারপর বলল, “কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আপনাদের পরিচয় জানতে-জানতে মিনিমাম দশ তারিখ হয়ে যাবে ওদের। মানে, আপনাদের নামের জটিল কোডটা ব্রেক করাতে যে-কোনও মেনফ্রেম কম্পিউটারের এক সপ্তাহ তো লাগবেই। অর্থাৎ এই সময়ের উইন্ডোটুকু আছে। সেটারই অ্যাডভান্টেজ নিতে হবে আমাদের। অ্যান্ড মিস্টার রয়, উই ডু হ্যাভ আ প্ল্যান।”

“কী করবেন?” পাবক অবাক হল।

জেরার্ড কথা না বাড়িয়ে কোমরে রাখা ম্যানপ্যাকটা বের করে কাউকে একটা বলল, “ইটস ইওর টাইম। কাম।”

মিনিটখানেকের মধ্যে একজন এসে ঢুকল ঘরে। মাঝারি উচ্চতা। গায়ে ফারের কোট। মাথায় উলের টুপি।

জেরার্ড বলল, “ও আপনার জায়গা নেবে। বাই বার্থ, ও নিজেও ভারতীয়!”

“আমার জায়গা? ভারতীয়!” পাবক অবাক হয়ে তাকাল।

“হ্যাঁ, আপনাকে এখনও কেউ চেনে না। কেউ-ই না। তাই আমরা সারা পৃথিবীর সামনে ওকে আপনি বলে হাজির করব। মানে টিল দ্য ডে অফ দ্য লঞ্চ!”

“সেটা সম্ভব? এখনকার ডিজিটাল এজে এসব…”

টম হাসল, “সম্ভব মিস্টার রয়। দ্য রিয়েলিটি ইজ় ফার মোর মেসমেরাইজ়িং!”

“মানে, আমরা আপনার সব অতীত রেকর্ড পালটে দেব ডিজিটালি। আপনার ফোটো আইডেন্টিটি পালটে দেব। পাবক রয় বললে লোকে একেই বুঝবে। আপনার বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর, সবটা আমরা নতুন করে তৈরি করে দেব। আসল পাবক রয়কে লোকে দেখবে একদম লঞ্চের সময়, ততদিন আমরা আপনাকে ডিজিটালি মুছে দেব পুরো।”

পাবক কী বলবে বুঝতে পারল না।

জেরার্ড বলল, “তার সঙ্গে ও আমাদের হয়ে আপনার উপর আসা থ্রেটেরও মোকাবিলা করবে। আর প্রয়োজনে যারা এর পিছনে আছে, তাদের নিকেশ করে ছাড়বে।”

পাবক তাকাল সামনে। ওর মতোই অল্প বয়স ছেলেটার। গায়ের রংও ওর মতো। খুবই সাধারণ একটা ছেলে! এ পারবে!

জেরার্ড বলল, “এটা আপনার তথা সবার সুরক্ষার জন্য দরকার। কারণ আপনাদের গবেষণার জিনিস যদি ভুল হাতে পড়ে তবে…”

পাবক বলল, “কিন্তু এ কে? ইজ় হি কেপেবল? কী নাম ওর?”

“ও, কে?” টম নাটকীয় গলায় বলল, “ও অন্ধকারের চেয়েও অন্ধকার। আলোর চেয়েও আলো! উন্মাদের চেয়েও উন্মাদ! পাহাড়ের চেয়েও স্থির! ও পালকের চেয়েও হালকা। পারদের চেয়েও ভারী! ও আগুনের চেয়েও দাহ্য আর বরফের চেয়েও শীতল। আসলে ও…”

ছেলেটা মাথার উলের টুপিটা খুলে হাসল। হাত দিয়ে থামিয়ে দিল চমকে, “স্যার, আপনি না, সত্যি!” তারপর এগিয়ে এসে হাত বাড়াল পাবকের দিকে। বলল, “হ্যালো স্যার, আমি সেন, অদম্য সেন।”

(কাহিনিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোনও মিল থাকলে তা আকস্মিক ও অনিচ্ছাকৃত)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *