আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী

আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী

ঘষা হলদেটে আলোয় অদম্য দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই লোকটা! দেখেই মনে হল যেন পুড়ে যাওয়া অন্ধকার দিয়ে তৈরি একটা মানুষ! এই আবছায়াতেও লোকটার নীল চোখ দুটো যেন জ্বলছে! যেন সারাজীবন অদম্যর জন্যই এখানে নরক সাজিয়ে অপেক্ষা করছে! ও দেখল, লোকটার হাতের পিস্তল ওর মাথার দিকে তাক করা, ফণা-তোলা সাপের মতো অল্প নড়ছে…

একসপ্তাহ আগে। রাওয়াতভাটা।

সন্ধের আকাশের তারাগুলো ক্রমশ আবছা হয়ে আসছে চোখের সামনে। জয়সিংহ বুঝতে পারছে আর বেশি সময় নেই। বুঝতে পারছে একটু পরেই ও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এখানে শুয়ে উলটে যাওয়া ট্রাক আর তার সামনের দুমড়ে যাওয়া পুলিশের গাড়িটা দেখতে পাচ্ছে ও। দেখতে পাচ্ছে ছায়ার মতো একটা মানুষ ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওর দিকে। মানুষটার হাতে রকেট লঞ্চার!

এটা দিয়েই তা হলে রকেট প্রপেল্‌ড গ্রেনেডটা ছুড়েছিল! জয়সিংহ ডান হাতটা নাড়াল। আঃ, কী যন্ত্রণা! নিশ্চয়ই ভেঙেছে। কিন্তু উপায় নেই, কোমরে লাগানো ওয়াকিটকিটা ওকে নিতেই হবে। যা হয়েছে সেটা দ্রুত জানাতে হবে কন্ট্রোল রুমে। না হলে ট্রাকে রাখা দু’ব্যারেল নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট চলে যাবে এই ছায়াময় লোকটার হাতে!

ও চেষ্টা করল। হাতের যন্ত্রণা উপেক্ষা করে কোমর থেকে খুলে নিল ওয়াকিটকিটা। তারপর কানের কাছে নিয়ে এল।

“প্লিজ়, ডোন্ট।”

ঠান্ডা ফিসফিসে গলাটা শুনে থমকে গেল জয়সিংহ। দেখল ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে সাদা ফ্যাকাশে একটা মুখ।

জয়সিংহ তাও ওয়াকিটকিটা অন করতে গেল। কিচকিচ করে উঠল যন্ত্রটা। কিন্তু কোনও কথা বলার আগেই আচমকা তীব্র একটা যন্ত্রণা অবশ করে দিল জয়সিংহর সারা শরীর। কাঁপতে-কাঁপতে ও বুঝল ঠান্ডা একটা শলাকা ঢুকে গিয়েছে ওর শরীরের মধ্যে। ঢুকিয়ে দিয়েছে ওই ফ্যাকাশে লোকটা! জয়সিংহ কথা বলতে গেল। কিন্তু মুখ থেকে চলকে উঠল গরম রক্ত। ও হাত বাড়াল লোকটাকে ধরবে বলে। পারল না। ক্রমশ ওর চোখের সামনে নেমে এল এক নরক অন্ধকার। শুধু শেষমুহূর্তে জয়সিংহ শুনল লোকটা বরফের গলায় বলছে, “নাও দ্য গেম ইজ় অন!”

একদিন আগে। দুর্গাপঞ্চমী। কলকাতা।

সূর্য ডুবেছে একটু আগে। তবে তার ফেলে যাওয়া শেষ দু’-এক ফোঁটা আলো এখনও পড়ে রয়েছে আকাশে। আজ ওদের বাড়িতে না যাওয়ায় শাহিন রাগ করছিল। বলছিল, “বাড়ির সামনে এসে ভিতরে না গিয়ে চলে যাবে? করো তো নেভিতে ডেস্ক জব। অত কাজের তাড়া কীসের তোমার?”

আদিল হেসেছিল। আসলে এমন সময়গুলোয় ওর হাসি ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। শাহিনকে বা ওর বাড়ির লোককে মিথ্যে বলতে মোটেই ভাল লাগেনি আদিলের। কিন্তু ও যে ইন্ডিয়ান মেরিন কমান্ডোস বা মার্কোস, সেটা তো আর বলা যায় না!

শাহিনকে তো বলা যায় না যে, আজ মধ্যমগ্রামে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিল। মোসাদের এজেন্ট নোয়াম এসেছিল এর সঙ্গে দেখা করতে। নোয়াম ওকে একটা পেনড্রাইভ দিয়েছে। যাতে এমন কিছু তথ্য আছে, যা এই দেশের ম্যাপ পালটে দিতে পারে। আর আছে এক সপ্তাহ আগে রাজস্থানের রাওয়াতভাটা থেকে চুরি হওয়া এক ব্যারেল নিউক্লিয়ার ওয়েস্টের হদিশও। এই দুটোই খুব ক্রিটিক্যাল ইনফো। এটা নিয়ে ওর সোজা হেড কোয়ার্টার্সেই যাওয়ার ব্যাপার ছিল। কিন্তু শাহিন ফোন করে এমন করতে শুরু করল আজ যে, বসকে বলে আড়াই ঘণ্টার লিভ নিতেই হল।

আজ পর্যন্ত কখনও কাজে গাফিলতি বা দেরি করেনি আদিল। আজও করবে না। শাহিনকে ও যতই ভালবাসুক, কিছুতেই তাকে কাজে বাধা হতে দেবে না।

কাল সকালেই ওদের বাড়িতে চলে আসবে কথা দিয়ে অনেক কষ্টে শাহিনকে ঠান্ডা করে আদিল ছাড়া পেয়েছে আজ।

শাহিনদের বালিগঞ্জ প্লেসের সামনের গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে ভিড়টা আবার টের পেল আদিল। মানুষের ঠেলায় ভাল করে হাঁটাই মুশকিল।

দু’মিনিট হেঁটেই ঘেমে উঠল একদম। তাড়াতাড়ি হেড কোয়ার্টারে পৌঁছতে হবে। কিন্তু এই ভিড়ে যাবেটা কী করে?

তখনই ট্যাক্সিটাকে দেখল আদিল। সন্ধের ভিড়ের মাঝে যেন ভেসে-ভেসে আসছে!

“ট্যাক্সি!” আদিল হাত তুলে রাস্তার লোকজন ঠেলেই এগোল সামনে। সাদার উপর নীল বর্ডার দেওয়া এসি ট্যাক্সি। গায়ে লেখা ‘নো রিফিউজ়াল’।

আদিল গাড়িটার জানলায় টোকা দিল, “যাবেন? ফোর্ট উইলিয়াম।”

আদিল গাড়িতে ওঠার পর চালক বলল, “সামনের রাস্তায় স্যার খুব ভিড়। গলির মধ্যে দিয়ে শর্ট কাট করব?”

আদিল জানলার কাচ নামাতে-নামাতে বলল, “করুন। তবে একটু তাড়াতাড়ি।”

চালকটি বাঁদিকের একটা গলিতে গাড়িটা ঘুরিয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার। আর কাচ নামাতে হবে না। আমি এসি অন করছি। যা গরম!”

আদিল হেসে আবার তুলে দিল কাচটা। তারপর ভাল করে বসল। লোকটা হাত বাড়িয়ে অন করে দিল এসিটা।

আদিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। আর ঠিক তখনই চোখের কোণ দিয়ে দেখল, চালকটি সামনের গ্লভ কমপার্টমেন্ট খুলে কিছু একটা বের করে মুখে চাপা দিল। কী এটা! খটকা লাগল আদিলের। ও দ্রুত ঘুরতে গেল। কিন্তু তার আগেই মনে হল ওর হাত-পায়ে যেন কোনও জোরই নেই! সব যেন অসাড়!

চোখের পাতা ভারী হয়ে এল আদিলের। জিভ জড়িয়ে এল। মাথাটাও যেন সিসের তৈরি! সামনের আধো অন্ধকার পৃথিবীটা কেমন যেন লেপটে গেল ক্রমশ।

শুধু জ্ঞান হারাবার ঠিক আগে ওর মনে হল চালকটি যেন পিছনে ফিরে হাসল একবার। মনে হল চালকটি যেন হাত বাড়াল ওর দিকে!

ভিঙ্কা, সার্বিয়া। এক সপ্তাহ আগে।

ভিক্টর পপেস্কুর জীবনে দুটো স্বপ্ন ছিল। এক, ডায়নামো কিয়েভের হয়ে ফুটবল খেলবে। আর না হলে, ফাইটার বিমানের পাইলট হবে। কিন্তু কোনওটাই হল না জীবনে। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে গোড়ালির হাড় দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল ওর। ফলে ফুটবলে সেখানেই ফুলস্টপ পড়ে গিয়েছিল। তারপর যুদ্ধবিগ্রহ, বাবার মৃত্যু আর দারিদ্র কেড়ে নিয়েছিল আকাশে ওড়ার স্বপ্নটুকুও।

সামনে ঘন কালো রংয়ের হাইওয়ে দেখে ভিক্টরের মনে হল ওর জীবনটাও বোধ হয় এমনই। ও ট্রাকের রিক্লাইনিং সিটটা আর-একটু হেলিয়ে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিল। গাড়িটার গতি বাড়ল। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল পিছনে আসা বড় দুটো সিকিউরিটি ভ্যান ওর গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলছে। ও জানে ঠিক এমনই দেখতে আর-একটা ডিকয় ট্রাক অন্য এক রাস্তা দিয়ে অন্য কোথাও চলেছে এখন। ও পাশে তাকাল। চৌকো চোয়ালের সাড়ে ছ’ফুট লম্বা গার্ডটিকে দেখে মনে হচ্ছে লোহার তৈরি। গাড়িতে ওঠা থেকে একটা কথাও বলেনি। ভিক্টর কথা বলার চেষ্টা করেছে বেশ কয়েকবার, কিন্তু লোকটা সাড়া দেয়নি। এসব গার্ডকে এমনই হতে হয়। কারণ এ গাড়িতে যা জিনিস ও নিয়ে যাচ্ছে, তা ভুল হাতে পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

পৃথিবীতে ভিঙ্কা জায়গাটার গুরুত্ব অন্যরকম। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর বর্তমানে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। আর তার জন্য ওয়েপন গ্রেড অ্যাটমিক ফুয়েল প্রচুর জমা হয়ে গিয়েছে ভিঙ্কায়। তা ছাড়াও আছে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম ফুয়েল থেকে তৈরি হওয়া প্লুটোনিয়াম। আর সত্যি বলতে কী, এসব অ্যাটমিক ফুয়েলগুলো খুব একটা সুরক্ষিত অবস্থাতেও নেই।

ভিক্টর জানে, ভিঙ্কা আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থীদের কাছে খুব লোভনীয় জায়গা। এটাকে আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থীদের ‘ক্যান্ডি স্টোর’-ও বলা হয়।

ভিক্টর আবার চেষ্টা করল, “হ্যালো, তুমি কি জানো এই ট্রাকের প্লুটোনিয়াম স্টিকগুলোর এক-একটার দাম কত?”

লোকটা এবার তাকাল ওর দিকে। তারপর শান্ত গলায় বলল, “দ্রাইভ!”

ভিক্টর হাসল মনে-মনে। তারপর ঘড়ি দেখল। সময় হয়ে গিয়েছে। ওর কানের ভিতরে লাগানো ছোট্ট একটা রিসিভারে এসে গিয়েছে নির্দেশ। ও চট করে পিছনের সিকিউরিটি ট্রাকদুটোকে দেখে নিল একবার। তারপর আচমকা প্রচণ্ড গতিতে চলা আর্মারড ট্রাকটার ব্রেকটা চেপে ধরল প্রাণপণে। গাড়িটা থমকে গিয়ে লাফিয়ে উঠল হঠাৎ। তারপর ছিটকে পড়ল।

শেষ মুহূর্তে ভিক্টর ভাবল, যে টাকাটা ওর স্ত্রী পাবে, তাতে অন্তত ওর ছোট্ট ছেলেটার স্বপ্নগুলো বেঁচে থাকবে!

ধান্যদহ, উত্তর চব্বিশ পরগনা।
পাঁচ দিন আগে।

দৌড়তে-দৌড়তে আচমকা হাতের টানে থেমে গেল পোটা। কী হল আবার? বিএসএফ এসে পড়ল নাকি? ভয়ে ওর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বরফের বিছে নেমে গেল নিমেষে। ও জানে, বর্ডারে বিএসএফ-এর টহলটা এসময় বাড়ে। কারণ সামনেই দুর্গাপুজো।

পোটা এমনিতে রাজমিস্তিরির জোগাড়ের কাজ পায় না। তাই রোজগারের ধান্দায় বছরখানেক আগে ওর কাকা ওকে অন্য একটা কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কাজটা গোরু পাচারের। আর আয় বেশ ভালই। একটা গোরুকে পাচার করতে পারলে হাজার টাকা। মাসে এখন চার-পাঁচ দিন এই কাজেই যায় ও। একজন মুরুব্বি থাকে। সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। সে থামতে বললে ওরা থামে আর দৌড়তে বললে দৌড়য়।

আজও একটা গোরু নিয়ে গিয়েছিল ওপারে। কিন্তু তারপরই ওকে বলা হয় পিঠে ব্যাগের মতো একটা জিনিস বয়ে এই পারে নিয়ে আসতে হবে। ব্যাগ? কী আছে এতে? না, এসব জানে না পোটা। জানার দরকারও নেই। এটা নিয়ে এলে নাকি পাঁচ হাজার টাকা পাবে! ওঃ এত টাকা! ভাবলেই আনন্দ হচ্ছে।

বর্ডারের এখানটায় খুব বড় একটা বাঁশবাগান আছে। বিএসএফ মাঝে-মাঝে এখানে তরোয়াল নিয়ে ঘোরে। তাদের সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই! পোটা ভাবল, সেটাই হল নাকি?

পোটার গলা শুকিয়ে গেল। এই সতেরো বছর বয়সে বেঘোরে মরতে চায় না ও।

বাগানের ওপাশ থেকে এবার একটা শব্দ পেল পোটা। কেউ শুকনো পাতার উপর সাবধানে হেঁটে আসছে ওদের দিকে। সর্বনাশ! এ কে!

আচমকা সামনে একটা টর্চ জ্বলে উঠল দু’বার।

আর সঙ্গে-সঙ্গে মুরুব্বি চাপা গলায় বলল, “ওই পাটি এয়েচে।”

পোটা দেখল লোকটাকে। মাঝারি লম্বা। ছোট করে ছাঁটা চুল। আর এই আবছা অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে যে, লোকটার গায়ের রং ফ্যাকাশে।

“দিয়ে দে…” মুরুব্বি চাপা গলায় বলল।

পোটাও সময় নষ্ট করল না। পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে বাড়িয়ে দিল লোকটার দিকে। লোকটা ব্যাগটা নিয়ে ঝুলিয়ে নিল পিঠে। তারপর একটা খাম এগিয়ে দিল মুরুব্বিকে।

টাকা! পোটা জানে।

লোকটা পিছন ঘুরল চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু গেল না। আবার ফিরে তাকাল। তারপর দুটো ছোট-ছোট প্যাকেট এগিয়ে দিল, বলল, “চকোলেট।”

চকোলেট? লজেন! মুরুব্বি আর ও হাত পেতে নিল সেটা। তারপর দ্রুত র‍্যাপার খুলে মুখে দিল। আঃ, অমৃত! ধপ করে যখন শব্দটা শুনল পোটা, নিজেও তখন কথা বলার অবস্থায় নেই। মনে হচ্ছে সারা শরীরে যেন বিষাক্ত সাপ ছোবল বসিয়েছে। মনে হচ্ছে কে যেন চেপে ধরেছে ওর গলা! ও আবছা অন্ধকারে হাতে ধরা চকোলেটটা দেখল! তারপর জীবনের শেষ শ্বাসটুকু টানার চেষ্টা করতে-করতে শুনল শুকনো পাতার উপর ধীরে-ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে সেই পায়ের শব্দ!

উলান বাটোর। দশ দিন আগে।

মোবাইলটা বের করে উঠে দাঁড়াল নোয়াম। স্টেজের উপর ইতালীয় অপেরা সিঙ্গার গলা কাঁপিয়ে গান গেয়ে চলেছে। উলান বাটোর অপেরা হাউসের সমস্ত দর্শক সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে মুগ্ধ হয়ে।

কিন্তু না, ঠিক সবাই নয়। উপরের ড্রেস সার্কেলের ভিআইপি এনক্লোজার থেকে যে লোকটা এইমাত্র উঠে গেল, নোয়াম জানে সে কিন্তু গানের একটা নোটও শোনেনি। লোকটার নাম ঋগ।

ঋগকে বহুদিন ধরে ট্র্যাক করছে মোসাদের এজেন্ট নোয়াম। ঋগ একজন আন্তর্জাতিক ফিক্সার। গুপ্তচরবৃত্তির কাজে লোকটা ফ্রি এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। দু’দলের মধ্যে গো-বিটুইন হিসেবে ও ডিল করিয়ে দেয়। আজও তাই করেছে ঋগ। নোয়াম জানে। ভিআইপি বক্সে যে মেয়েটি ড্রিঙ্কস সার্ভ করছিল, সেই নাটালিয়া আসলে মোসাদের হয়ে কাজ করছে।

চিনের গুপ্তচর সংস্থার কর্নেল শ্যাং ওয়েইর সঙ্গে এই ড্রেস সার্কেলেই মিট করেছে ঋগ। সেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও হাত বদল হয়ে আসে ঋগের কাছে। সেটা ও পৌঁছে দেবে ইন্ডিয়ার এক বিশেষ মানুষকে।

একটা এইচডি মাইক্রোচিপ ঋগকে দিয়েছে শ্যাং। তাই কাজ শেষ বলে ঋগ বেরিয়ে যাচ্ছে। আর ঋগ সিট ছাড়া মাত্র নাটালিয়া নোয়ামকে সংকেত পাঠিয়েছে।

ড্রেস সার্কেলটা দোতলায়। সেখান থেকে নীচে নেমে বাইরে গাড়িতে উঠতে মিনিট চারেক মতো সময় লাগবে ঋগের।

নোয়াম দ্রুত হল থেকে বেরিয়ে বাইরের করিডরে এল। দু’পাশের কাঠের প্যানেলের মাঝে লাল কার্পেট পাতা মেঝে।

নোয়াম দেখল ঋগ দ্রুত নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে। ও নিজেও হাঁটার গতি বাড়াল। আর তার সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইলের মতো দেখতে একটা যন্ত্র বের করে মাথার ছোট্ট বোতামটা টিপে চালু করল সেটাকে। এটা রিমোট ডেটা রেকর্ডার।

অপেরা হাউসের বাইরে এখনও সন্ধে নামেনি। কমলা রংয়ের বিল্ডিং আর তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা ডোরিক থামগুলো তবু কৃত্রিম আলোয় ঝলমল করছে।

সামনে পার্ক করা কনভার্টিবলটার দিকে এগোল ঋগ।

“এক্সকিউজ় মি। ক্যান আই হ্যাভ আ লাইট প্লিজ়?” নোয়াম পিছন থেকে এগিয়ে গেল ঋগের দিকে। দ্রুত মেপে নিল ওর সঙ্গে ঋগের দূরত্ব তিন ফুটের মতো। যন্ত্রটা কাজ করতে হলে টার্গেটের থেকে কমপক্ষে দেড় ফুট দূরত্ব থাকা জরুরি। নোয়াম আরও এগিয়ে গেল।

ঋগ বিরক্ত হয়ে তাকাল ওর দিকে, “আই ডোন্ট স্মোক।”

“দেন ক্যান আই বরো ইয়োর ফোন?” নোয়াম আরও এগিয়ে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গে হাতে ধরা রেকর্ডারে মৃদু ঝাঁকুনি টের পেল ও। বুঝল কাজ শুরু হয়েছে। দশ সেকেন্ড মতো লাগবে কাজটা হতে।

“আরে পাগল নাকি?” ঋগ রেগে গেল এবার, “সরে যাও বলছি। সরো!”

“আমার ঠাকুমা অসুস্থ। প্লিজ়!” নোয়াম বাঁ হাত দিয়ে ঋগের হাতটা চেপে ধরল।

“গেট লস্ট! সরো!” ঋগ নোয়ামকে ঠেলে প্রায় ফেলে দিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। তারপর ওর মুখের উপর ধোঁয়া উড়িয়ে বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।

মাটিতে পড়ে হাসল নোয়াম। কারণ পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে রেকর্ডারের দ্বিতীয় মৃদু ঝাঁকুনিতে ও বুঝে গিয়েছে ঋগের মাইক্রোচিপের ডেটা কপি হয়ে গিয়েছে। এবার এই ডেটাকে একটা পেনড্রাইভে ট্রান্সফার করে নিলেই হবে।

নোয়াম ফুটপাথে বসল। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করে ডায়াল করল একটা নম্বর। তারপর বলল, “হ্যালো, আদিল। তোমার উপহার এখন আমার কাছে। আই অ্যাম কামিং টু ইন্ডিয়া।”

ফিস, অস্ট্রিয়া। পাঁচ দিন আগে।

জার্মানি ওয়র্ল্ড কাপ জিতেছে তো ওর কী? অস্ট্রিয়া তো পারেনি! ইয়েনসের খুব বাজে লাগে যখন অ্যাডাম ওকে এই নিয়ে খ্যাপায়। ও-ও তখন বলে, “তোমার ইন্ডিয়া কী করছে?”

অ্যাডাম এর উত্তরে শুধু হাসে, বলে, “আমরা ক্রিকেট খেলি। জেন্টলমেন্‌স গেম।”

ক্রিকেট একটা খেলা! বোরিং! টাইম ওয়েস্ট হয় শুধু। ইয়েনসের মনে হয় ঝগড়া করে অ্যাডামের সঙ্গে। কিন্তু পারে না। ফাদার ফ্রান্সিসের কথা মনে পড়ে যায়। ফাদার বলেন, দুর্বলরা ঝগড়া করে। প্রকৃত শক্তিমানদের ঝগড়া করতে হয় না।

সামনে বাগানে গাছেদের পরিচর্যা করছে অ্যাডাম। ইয়েনসের কাজ সেখানে অল্প-অল্প করে জল দেওয়া।

অ্যাডামকে দেখলে অবাক লাগে ইয়েনসের। ওদের এখানে কোথা থেকে যে এল! সারাবছরের কয়েকটা দিনই মাত্র অ্যাডাম আসে ফিস-এ। বাকি দিনগুলো কোথায় থাকে, কী করে, কে জানে!। তবে একটা জিনিস বোঝে, ফাদার ফ্রান্সিস খুব ভালবাসেন অ্যাডামকে।

“হেই বয়, আই ওয়ান্ত তু মিত উইথ এডাম। তুমি বলতে পারো ও কোথায়?”

অদ্ভুত ইংরেজি শুনে পিছন ফিরল ইয়েনস। দেখল পাহাড়ের মতো বড় একটা মানুষ। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল।

“ইয়েস আয়াম হিয়ার। আপনি?”

ইয়েনস কিছু বলার আগেই দেখল অ্যাডাম বাগান থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে।

“আমি চিরিচ,” লোকটা হাত বাড়াল সামনে, “সার্বিয়ার ভিঙ্ক অ্যাটমিক পাওয়ার জেনারেশনের তরফ থেকে একটা দরকারে আসছি। আমি ওদের সিকিউরিটি চিফ। তুমি কি অ্যাডাম? তোমার আর-একটা নাম আছে না? কী যেন? অড… অড…”

অ্যাডাম চিরিচের বাড়ানো হাতটা ধরে বলল, “ইয়েস, আমি সেন, অদম্য সেন।”

এখন। কলকাতা।

পুজোর এই মহাষষ্ঠীর সকালটা এলেই মন খারাপ হয়ে যায় ছকুর। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে ওদের গ্রামের নদীর ধারে পুজোর প্যান্ডেল। ছিট কাপড়ের নতুন জামা। রাত জেগে যাত্রা দেখা। বেণুর সঙ্গে কাঠের নাগরদোলায় চড়া!

কিন্তু কলকাতায় এসব কিছুই নেই। সেই যে বাবা মারা গেল, তারপর পেটের ধান্দায় এ-ঘাট ও-ঘাট ঘুরতে-ঘুরতে এসে এই ঠেকল কলকাতায় এক প্রোমোটারের অফিসে।

‘সানশাইন ল্যান্ড ডেভেলপার্স’-এ ওকে চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল ওদের গ্রামেরই এক চেনা লোক। তারপর থেকে এখানেই আছে ছকু।

ওদের মালিকের নাম টোটন রাউথ। খুব একটা সুবিধের লোক নয়। মানুষকে ভয় দেখিয়ে বাড়ি খালি করিয়ে মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং তোলে। ছকু সেইসব সাইটেই ফাইফরমাশ খাটে।

এখন যেমন নরেন্দ্রপুরের কাছে একটা সাইট চলছে ওদের। এই সাইটটা ছোট। কিন্তু ছকু জানে আসলে টোটনের চোখ ওদের সাইটের উলটোদিকের বড় বাড়িটায়।

অনেক বড় জায়গা নিয়ে ওই ঝুরঝুরে টাইপের বাড়িটায় এক বৃদ্ধা থাকেন। টোটন নানাভাবে চেষ্টা করেছে তাকে উঠিয়ে বাড়িটার দখল নিতে। কিন্তু এখনও পারেনি। গতকাল তো বুড়িকে রাস্তায় ধরে থ্রেটও করেছিল টোটন। খুব খারাপ লেগেছিল ছকুর। পুজোআচ্চার দিনে এমন কেউ করে!

ওই ঘটনার পর ভয়ে, গতকাল রাতেই বৃদ্ধা কোনও এক আত্মীয়ের বাড়িতে উঠে গিয়েছেন। টোটন বলেছে পুজোর পর বুড়ি না এলে জোর করে ঢুকে যাবে বাড়িটায়।

জঘন্য লোক এই টোটন। কবে যে চাকরিটা ছাড়বে ছকু!

হরেনদার দোকান থেকে এক কেটলি চা আর তিনটে কাচের গেলাস নিয়ে সাইটের দিকে পা বাড়াল ছকু। সাইটে টোটন আর ওর দুটো বদসঙ্গী এসে জুটেছে! নাও সারাদিন তাদের ফাইফরমাশ খাটো এবার!

ভোরবেলা বলে রাস্তা এখন ফাঁকা। দুধওয়ালা, ঠিকে কাজের লোক আর ঝাড়ুদার কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দূরে ওদের তৈরি হওয়া আধখানা বাড়িটাও।

দু’দিক দেখে রাস্তা পার হল ছকু। তারপর বড় কালভার্টটা টপকাতে পা বাড়াল, ঠিক তখনই বিকট শব্দটা শুনল ও! মনে হল মাথার উপর আকাশটা ভেঙে পড়েছে যেন! আর পরক্ষণেই একটা দমকা হাওয়া এসে বুলডোজ়ারের মতো ধাক্কা মারল ওকে। ছকুর হাতের জিনিসপত্র উড়ে গেল নিমেষে। ও নিজে ছিটকে গিয়ে পড়ল একটা গাছের গোড়ায়। ওর চোখের সামনে অন্ধকার। কানে তালা লেগে গিয়েছে। তবু, তার মধ্যেও ছকু দেখল চারপাশে কয়েকজন আধখাওয়া মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ছকু উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। মাথা ঘুরছে। ও নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল। তারপর তাকাল ভাল করে। আর তখনই ওর চোখে পড়ল সামনে পড়ে থাকা ছোট্ট বাটালির মতো হলুদ রংয়ের একটা জিনিসের উপর। কী এটা? ও ভাল করে দেখল জিনিসটাকে। তারপর খেয়াল করল সামনের রাস্তায় থ্যাঁতলানো মানুষের সঙ্গে আরও অনেকগুলো এমন হলুদ বাটালির মতো জিনিস পড়ে রয়েছে!

“আর ডি ডি!” সিএম অবাক হয়ে তাকালেন সামনে বসা পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থর দিকে।

সুরজিৎবাবু মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম। আর ডি ডি, রেডিয়োলজিক্যাল ডিসপারসাল ডিভাইস।”

চিফ সেক্রেটারি সঞ্জয় মিত্র গম্ভীর মুখে বললেন, “মানে ডার্টি বম্ব ম্যাডাম। নরেন্দ্রপুরের ওই আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে যেটা ফেটেছে সেটা ডার্টি বম্ব। এতে রেগুলার এক্সপ্লোসিভের সঙ্গে স্‌প্লিন্টার ছাড়াও নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট থেকে পাওয়া রেডিও অ্যাকটিভ সিজিয়াম-১৩৭ ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে চেচেন জঙ্গিরা এমনই বোমা ফাটাবার চেষ্টা করেছিল মস্কোর ইজমাইলভস্কি পার্কে। এখানে সেগুলোই গোটা জায়গায়…”

“কী বলছেন!” সঞ্জয়বাবুকে কথা শেষ করতে না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সিএম। ঘরে বসা সিভিল ডিফেন্স সেক্রেটারি পি রমেশকুমার, ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট সেক্রেটারি ইন্দীবর পাণ্ডে ও অন্যান্য পদস্থ পুলিশ অফিসারদের দিকে তাকালেন, “এ তো সাংঘাতিক!”

জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ পল্লবকান্তি ঘোষ বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম। গোটা জায়গাটা আমরা কোয়ারেনটিন করে ফেলেছি। কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দিচ্ছি না। অস্থায়ী মেডিকাল ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে রাজস্থানের রাওয়াতভাটা থেকে যে সিজিয়াম চুরি হয়েছিল, এখানে সেগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে। আমি নিজে ফিল্ডে যাব এবার।”

“কী-কী হতে পারে এতে?” সিএম পল্লববাবুর কথায় মাথা নেড়ে তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে।

সঞ্জয়বাবু বললেন, “আসলে ম্যাডাম, সিজিয়ামের আয়নাইজ়িং রেডিয়েশনটাই আসল সমস্যা। যে-কোনও এনার্জি সোর্সই কিছু না কিছু রেডিয়েট করে। সে সেলফোনই হোক বা বাল্‌ব। কিন্তু এই ডার্টি বম্বে ব্যবহৃত সিজিয়াম থেকে হয় আয়নাইজ়িং রেডিয়েশন। সব অণুতেই তার ইলেকট্রনগুলো লক্‌ড অবস্থায় থাকে। এই আয়নাইজ়িং রেডিয়েশন, যেমন গামা রে, অণু থেকে ইলেকট্রনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। আর তার ফলে অণুটি আনস্টেবল হয়ে পড়ে। আমাদের শরীরের কোষের মধ্যের অণুগুলোরও একই পরিণতি হয় এই তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে। ফলে তারা তখন রিঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে। দিস অ্যাটম্‌স দেন ওন্ট ফর্ম দ্য রাইট মলিকিউল্‌স। আর তার ফলে আমাদের শরীরের কোষ ক্রমশ মিউটেট করতে শুরু করে। আর তাতেই ডিএনএ চেঞ্জ থেকে শুরু করে নানা রকম ক্যান্সার দেখা দেয়। মানে ইমিউনো ডেফিশিয়েন্সির যে-কোনও রকম রোগই হতে পারে। হয়ও। তাই এই বোমার মাস-প্যানিক অনেক বেশি। একে তাই ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকশন না বলে ওয়েপন অফ মাস ডিসরাপশন বলা হয়!”

সিএম কী বলবেন যেন বুঝতে পারলেন না। চশমা খুলে জিজ্ঞেস করলেন, “দিল্লিকে জানানো হয়েছে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম,” জয়েন্ট কমিশনার দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “হোম মিনিস্ট্রি আর ডিফেন্স মিনিস্ট্রির সঙ্গে কথা হয়েছে। র-এর চায়না অ্যান্ড সাউথ এশিয়া উইংয়ের মিস্টার রাই কলকাতাতেই আছেন। উনি আসছেন।”

“আদিলকে এখানে চাই। সঞ্জয়বাবু ফোর্ট উইলিয়ামে যোগাযোগ করুন,” সিএম চশমাটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন আবার, “গত দুটো ক্রাইসিসে ও দারুণ কাজ করেছিল।”

সঞ্জয়বাবু কিছু বলার আগেই ফোন এল একটা। উনি ফোনটা ধরে সংক্ষেপে কথা সেরে নামিয়ে রাখলেন রিসিভার। বললেন, “ম্যাডাম, মিস্টার রাই এসে গিয়েছেন। সঙ্গে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের কয়েকজনও এসেছেন।”

সিএম জিজ্ঞেস করলেন, “দু’ঘণ্টা হয়ে গেল ঘটনার। কোনও ডিম্যান্ড কল এসেছে? কাউকে ধরা গিয়েছে?”

সুরজিৎবাবু ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়লেন, “না ম্যাডাম। তবে মনে হচ্ছে বোমাটা প্ল্যান্ট করা হয়েছে গতকাল রাতে। টাইমার ডিভাইস দিয়ে ডেটোনেট করা হয়েছে। তবে কেউ এখনও দায় স্বীকার করেনি।”

ঘরের দরজায় শব্দ হল এবার। সবাই ফিরে তাকালেন দরজার দিকে। দরজা খুলে মিস্টার জীবনরাম রাই ঢুকে এল ঘরে। সঙ্গে আরও কয়েকজন ঢুকল।

সুরজিৎবাবু উঠে সিএম-এর উদ্দেশ্যে বললেন, “ম্যাডাম, ইনি মিস্টার রাই।”

“প্লিজ় বসুন,” সিএম হাত দিয়ে বসার চেয়ার দেখালেন।

রাই বসল না। বাকিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের চিফ কুমারেশ শর্মা।”

“প্লিজ় আপনারা বসুন,” সিএম আবার বললেন।

রাই বলল, “আর এই দু’জন ম্যাডাম, আমাদের এই গোটা ব্যাপারটায় অ্যাকটিভলি হেলপ করতে এসেছে। টম, মানে টমাস ফার্নান্ডেজ় আর মিস নিকিতা সুদ।”

সিএম জিজ্ঞেস করলেন, “অ্যাকটিভলি মানে?”

এবার উত্তর দিল কুমারেশ। বলল, “ওরা ফিল্ড এজেন্ট। নিকি স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের হয়ে কাজ করে আর টম ইজ় ফ্রম মার্কোস, মেরিন কম্যান্ডোস।”

সিএম বললেন, “ও, আদিলের মতো! কিন্তু আদিল! মানে লাস্ট দু’বার ও খুব ভাল কাজ করেছিল। তাই, যদি ও আসত। ও কি ব্যস্ত?”

রাই চোয়াল শক্ত করল। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছল কপালটা। ধীরে-ধীরে বলল, “আয়াম সরি টু সে ম্যাডাম, আদিলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“মানে?” সিএম-এর সঙ্গে ঘরের বাকিরাও অবাক হয়ে তাকালেন রাইয়ের দিকে।

রাই বলল, “ওর সঙ্গে টপ সিক্রেট ইনফো ছিল। কিন্তু সেটা সমেত ও গতকাল সন্ধে থেকেই উধাও। জানি না, ওকে কেউ অপহরণ করেছে, নাকি ও কম্প্রোমাইজ় করছে কারও সঙ্গে!”

অফিসের গাড়িটা আসতে দেরি করায় জিনি পাড়ার মোড় থেকেই ট্যাক্সি নিয়ে নিয়েছে। মা একটু গাঁইগুঁই করছিল কিন্তু জিনি পাত্তা দেয়নি। গত একবছরে ওর জীবনটা যে এত পালটে গিয়েছে, সেটা মা এখনও বোঝে না! গতবছর কলকাতার উপর নেমে আসা সন্ত্রাসবাদী হানার ভয়ঙ্কর ঘটনায় জিনির কনট্রিবিউশনটা কতটা যে পালটে দিয়েছে ওর জীবন, ভাবা যায় না। এখন ওদের নিউজ় চ্যানেলে জিনির কদরই অন্যরকম! তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিডগুলোতে ওকেই পাঠানো হয়।

আজ সকালে ঘুমই ভেঙেছিল ওদের নতুন এডিটর নির্মলদার ফোনে। ও ঘুমোচ্ছে শুনে নির্মলদা বলেছিল, “তুই ঘুমোচ্ছিস! আর ওদিকে কলকাতায় ডার্টি বম্ব ফেটেছে জানিস? গেট রেডি। তাড়াতাড়ি বেরো বাড়ি থেকে। সিএমসহ সবাই লালবাজারে গিয়েছেন। গো দেয়ার। তুই তো জানিস, তোকে সিএম ম্যাডাম খুব ভালবাসেন। আই ওয়ান্ট এক্সক্লুসিভ। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। ইউ গেট রেডি।”

ডার্টি বম্ব! কলকাতায়! সকালে ঘুম চোখে জিনি বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা ঠিক শুনছে কিনা! ও বিছানায় শুয়েই রিমোট টিপে চালু করে দিয়েছিল টিভিটা।

চোখের পলক ফেলতে পারছিল না জিনি। কলকাতায় আবার টেররিস্ট অ্যাটাক! নরেন্দ্রপুরে একটা নির্মীয়মাণ বাড়ি উড়ে গিয়েছে ডার্টি বম্বে। মারা গিয়েছে ছ’জন। কিন্তু রেডিও অ্যাকটিভ সিজিয়াম ছড়িয়ে কতজন যে অ্যাফেকটেড হয়েছে, সেটা এখনও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না!

গাড়িটা রবীন্দ্র সদনের জ্যামে আটকে আছে। রাগ হচ্ছে ওর। ‘প্রেস’ লেখা গাড়ি থাকলে এই ভিড়টা এড়াতে পারত। কিন্তু গাড়িটাই তো এল না! এখন কী করবে? ওদিকে এক সেকেন্ড নষ্ট মানে অনেকটা নষ্ট। ও জানে লালবাজারে নিউজ় এজেন্সিগুলো ভেঙে পড়বে। তার মধ্যে এক্সক্লুসিভ নিতে না পারলে নির্মলদা রেগে যাবে খুব। একটা চুইংগাম মুখে দিল জিনি। স্ট্রেস হলেই এটা করে ও।

“লিফ্‌ট প্লিজ়!” পাশের জানলায় আচমকা একজন মানুষ ঝুঁকে পড়ল।

জিনি চমকে উঠল একটু। বিরক্তও হল। ঠিক লোক নয়। ইয়াং ছেলে একটা। বছর ছাব্বিশ-সাতাশ বয়স। গলাটা খ্যানখ্যানে। ও ভুরু কুঁচকে কুঁচকে বলল, “মানে?”

ছেলেটা বলল, “এমার্জেন্সি ম্যাডাম। প্লিজ়।”

“না না, আমি নিজেই…”

জিনি কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ড্রাইভার সিগন্যাল পেয়ে ছেড়ে দিল গাড়ি। আর সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেটাও দরজাটা খুলে চলন্ত গাড়িতেই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

“হোয়াদ্দা হেল?” জিনি চেঁচিয়ে উঠল।

“ম্যাডাম, দ্য জার্নি টু দ্য হেল হ্যাজ় জাস্ট বিগান।”

আচমকা ছেলেটার গলার স্বর পালটে গেল। সেই খ্যানখ্যানে গলার বদলে অদ্ভুত সুন্দর গলায় ছেলেটা বলল, “আপনি আমায় চিনতে পারেননি, না?”

জিনির গলা শুকিয়ে এল নিমেষে। তাই তো! এবার চিনতে পেরেছে! এই ছেলেটাই তো গতবার ওকে সাহায্য করেছিল। এর জন্যই তো আজ ওর এত সাফল্য! কিন্তু এবার অমন চাপ দাড়ি আর মোটা চশমার জন্যই বোধহয় অন্যরকম লাগছে!

ছেলেটা জিনির চোখের দিকে তাকাল একবার। জিনির বুকের ভিতরে কেমন যেন এক পাহাড় প্রজাপতি উড়তে শুরু করেছে। গত একবছর ধরে কত খুঁজেছে ও এই ছেলেটাকে! কিন্তু কোত্থাও পায়নি! আর আজ এমন দিনে আবার হঠাৎ কোথা থেকে ফিরে এল ও!

ছেলেটা বলল, “আপনাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। পারবেন তো?”

জিনি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনার আসল নামটা বলবেন প্লিজ়?”

ছেলেটা হাসল, বলল, “বলব। বাট ইন গুড টাইম। তবে তার আগে এই নরকটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর এতে আপনার হেলপ দরকার। জানবেন সামনে খুব বড় বিপদ আসছে। দ্য কার্সড ওয়ান হ্যাজ় অ্যারাইভড এগেন। আর সে সঙ্গে করে নরক নিয়ে এসেছে। যে করেই হোক আমাদের এই নরকটা আটকাতেই হবে।”

১০

“ডিয়ার ম্যাডাম, হাউ আর ইউ?”

টম পাশে দাঁড়ানো পুলিশটিকে চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল। পুলিশটা সঙ্গে-সঙ্গে কম্পিউটারে কয়েকটা বোতাম টিপে চালু করে দিল কল ট্রেসারটা। লোকটা কোথা থেকে ফোন করছে সেটা জানাটা জরুরি।

“আপনাদের পুজোর সকালবেলা এভাবে বিব্রত করার জন্য আমি দুঃখিত।”

লোকটার ইংরেজিতে ‘ত’ আর ‘র’-এর উচ্চাণটা শুনে টমের মনে হল লোকটা পূর্ব ইউরোপের বাসিন্দা।

সিএম জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কে? কী চাও?”

লোকটা হাসল, “কথা বলতে চাই ম্যাম। জাস্ট আ লিট্‌ল টক। কিন্তু আপনার সঙ্গে নয়। আপনাদের দেশের হোম মিনিস্টারের সঙ্গে।”

“মানে?” রাই ঝুঁকে পড়ল স্পিকারের উপর, “কী বলছ তুমি?”

“বলছি আপনাদের হোম মিনিস্টারকে ডাকুন এই লালবাজারে। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

“পাগল নাকি?” সুরজিৎবাবু আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না।

“না, পাগল নই। আমায় টর্চ বেয়ারার বলতে পারেন। বলতে পারেন হার্বিঞ্জার অফ লাইট। আপনাদের শহরে এসেছি কিছু কথা নিয়ে। যা আমি শেয়ার করব মিস্টার হোম মিনিস্টারের সঙ্গেই।”

টম তাকাল পুলিশটির দিকে। এখনও কল ট্রেস করা যায়নি! লোকটা নিজের লোকেশন ক্যামোফ্লাজ করে রেখেছে! সারা কলকাতা জুড়ে প্রায় দেড়শো লোকেশনে দেখা যাচ্ছে লোকটাকে! একটা লোক তো একসঙ্গে এত জায়গায় থাকতে পারে না!

“এভাবে হোম মিনিস্টারকে ডাকা যায় না,” কুমারেশ শক্ত গলায় বললেন।

“আপনারা তো দেখলেন আমি কী করতে পারি। আরও দেখতে চান?”

কুমারেশ বললেন, “ভেবো না তুমি পার পাবে। আমরা তোমায় খুঁজে বের করবই।”

লোকটা হাসল, “আর তারপর আমায় মারবেন, তাই তো? আমি অলরেডি ডাইং। তবে হ্যাঁ, হোম মিনিস্টার আসতে-আসতে একটা খেলা খেলা যাক। এই যে চেক রিপাবলিক থেকে আপনাদের এখানে একটা ডেলিগেশন এসেছে, তাদের একজন এখন কোথায় জানেন? খুঁজে দেখুন তো তাকে বাঁচাতে পারেন কিনা!”

সিএম উদ্বিগ্নভাবে সঞ্জয়বাবুর দিকে তাকালেন।

সঞ্জয়বাবু চাপা গলায় বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম, চেক রিপাবলিক থেকে একটা প্রতিনিধি দল এসেছে গতকাল রাতে। কিন্তু কেউ যে মিসিং সেটা তো জানি না।”

সিএম কড়া গলায় বললেন, “এটা ছেলেমানুষি হচ্ছে? কী চাও তুমি?”

লোকটার গলাটা আচমকা শক্ত হয়ে উঠল, “আমি চাই মিস্টার হোম মিনিস্টার অফ ইন্ডিয়া লালবাজারে এসে কথা বলুন আমার সঙ্গে। অন্য কোথাও থেকে নয়, লালবাজার থেকেই কথা বলুন। আর ততক্ষণে চেক লোকটিকে খুঁজুন। না হলে আপনাদের বেঙ্গলি পোয়েটের সেমেট্রিতে আর-একজনের কবর খুঁড়তে হবে। আপনাদের কাছে আর জাস্ট পনেরো মিনিট আছে।”

“কে তুমি? কে?” রাই মাইকের উপর উত্তেজনায় ঝুঁকে পড়লেন।

লোকটা কেটে-কেটে বলল, “আয়াম দ্য হার্বিঞ্জার অফ লাইট! আয়াম দ্য হিরো! কিন্তু কখনও-কখনও হিরোকেও সবার ভালর জন্য মনস্টার হয়ে যেতে হয়। যেমন হতে হয়েছিল প্রিন্স অফ ওয়ালাশিয়াকে। হ্যাঁ, আমি সেই প্রিন্স অফ ওয়ালাশিয়া, মেম্বার অফ দ্য হাউজ় অফ ড্রাকুলেস্টি। আমি ভ্লাদ দ্য ইমপেলার।”

১১

জিনি দেখল সামনের বড় বারান্দায় একটা প্রেস কর্নার মতো হয়েছে। উঁচু একটা টেবলে অনেকগুলো মাইক রাখা। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সিএম।

এত বড় ঘটনার পর এই প্রথম প্রেসকে কিছু জানানো হচ্ছে।

সিএম চশমাটা পরলেন একবার। তারপর হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে সময় নিলেন একটু। চারপাশের গুঞ্জনটা স্তব্ধ হয়ে গেল নিমেষে।

সিএম বললেন, “আজ আপনাদের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার আমাদের। কী করে এত বড় ঘটনা হল, সেটা আমরা যুদ্ধকালীন তত্পরতায় দেখছি। আমাদের স্পেশ্যাল টিম ইতিমধ্যেই দোষীকে ধরার চেষ্টা করছে। তবে আপনাদের মাধ্যমে আমি রাজ্যবাসীকে জানাতে চাই যে, আমরা সকলে মিলে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। আপনারা ভয় পাবেন না। আমি ও আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। এখন এর বেশি কিছু বলার নেই আপাতত। বুঝতেই পারছেন আমাদের মোডাস অপারেন্ডি আমরা শত্রুপক্ষকে জানতে দিতে চাই না। আর আপনারাও মাস-প্যানিক যাতে না ছড়ায়, তাতে আমাদের সাহায্য করুন।”

সিএম কথা শেষ করেই আর দাঁড়ালেন না। পিছনে আসা সাংবাদিকদের জট পাকানো চিৎকারে মিশে আসা হাজারো প্রশ্নের ঢেউ পেরিয়ে করিডরের শেষের একটা দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

জিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত ভিড়ে ও সামনে এগোতেই পারল না। এখন কী হবে?

“ম্যাডাম।”

পিছন থেকে একটা গলা শুনে তাকাল জিনি। একটা ছেলে, রোগা-পাতলা চেহারা। নিরীহ মুখ।

ছেলেটা বলল, “ম্যাডাম, আমি গোপাল। সিএম ম্যাডাম আপনাকে ডেকেছেন। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।”

জিনি অবাক হল। এত ভিড়ের মধ্যে এমন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেও সিএম ওকে দেখেছেন!

গোপাল বলল, “আমার সঙ্গে আসুন। পিছনের দরজা দিয়ে আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।”

জিনি সময় নষ্ট করল না। লম্বা বারান্দার পাশে বেশ কিছু পুলিশ যদিও রয়েছে, তাও এদিকটা নির্জন। জিনি দ্রুত দেখে নিল চারপাশটা। তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে বের করে মোবাইলের খাপে লুকিয়ে নিল খুব ছোট্ট একটা স্টিকারের মতো যন্ত্র। আর অন্য হাত দিয়ে বোতাম টিপে অন করে নিল আংটির মতো দেখতে বাটন মাইক্রোফোনটা। ছেলেটা ট্যাক্সি থেকে নামার আগে এগুলো দিয়ে গিয়েছে ওকে।

জিনির বুকটা কাঁপছে খুব। মনে হচ্ছে হৃত্পিণ্ডের ভিতরে এক হাজার ঘোড়া দৌড়চ্ছে এক সঙ্গে। ও ভাবল, আচ্ছা ওর বুকের এই আওয়াজ কি নিজের কানে লাগানো ছোট্ট ইয়ার পিসটায় শুনতে পাচ্ছে?

১২

একদিন আগে। কলকাতা।

আর্নস্ত সিভক এই প্রথমবার কলকাতায় এল। আসলে এই দেশটার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না আর্নস্ত। শুধু মাদার টেরেসার নামটাই জানে। তবে এখানে এসে ওর ধারণা বদলেছে। এই শহরের চারিদিকে কুষ্ঠ রোগী, নোংরা আর গোরু মোষ চরে বেড়ায় বলে যে বদনামটা শুনেছিল, সেটা যে পুরো ভুল এখন বুঝতে পারছে।

চেক প্রজাতন্ত্র থেকে আর্নস্তদের এখানে স্পোর্টস এনহ্যান্সমেন্টের জন্য ডেলিগেট হিসেবে পাঠানো হয়েছে।

পরশুদিন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আছে ওদের। যদিও শুনেছে পুজোর সময় মন্ত্রী খুব ব্যস্ত থাকেন। তাও ওরা এসেছে বলে দুপুরে এক ঘণ্টা সময় দিয়েছেন।

এখানে এখন পুজো চলছে। এয়ারপোর্ট থেকে আসতে-আসতেই চারিদিকে বড়-বড় টেন্ট দেখতে পেয়েছে আর্নস্ত। এরা বলে ‘প্যান্ডাল’। খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে ওর। তাই হোটেলের ঘরে বাকিরা বিশ্রাম নিলেও, ও নিজে জামাকাপড় পালটে ওর ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। এমন ফেস্টিভিটি আগে দেখেনি ও!

ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগল আর্নস্ত। ভিড় খুব বেশি। তাও ভালই লাগছে। সামনে একটা গলি চলে গিয়েছে। আলো ঝলমলে বড় রাস্তার পাশে গলিটা সামান্য অন্ধকার, বেমানান।

“হেই হেই, গট এনি মানি? মি হাংরি!” গলির ভিতর থেকে ময়লা জামাকাপড় পরা একটা লোক বেরিয়ে এল আচমকা।

থমকে গেল আর্নস্ত। কালিঝুলি মাখা লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে লোকটার মানসিক অবস্থা ভাল নয়। ও পকেট থেকে একটা নোট বের করল। লোকটা হঠাৎ পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

“টেক ইট!” আর্নস্ত অবাক হল। ও পায়ে-পায়ে গলিটার ভিতর এগিয়ে গেল।

লোকটা আরও একটু পিছিয়ে গেল। আর্নস্ত কী করবে বুঝতে না পেরে এগিয়ে গেল আরও কিছুটা।

আর ঠিক তখনই আচমকা লোকটা সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপর। আর সঙ্গে-সঙ্গে সূঁচ বিঁধে যাওয়ার মতো তীব্র একটা যন্ত্রণা হল আর্নস্তের হাতে। ওর সামনে পৃথিবীটা টলে উঠল যেন। যেন হাওয়া কমে এল চারিপাশে।

জ্ঞান হারানোর ঠিক আগে আর্নস্ত ক্ষীণভাবে বুঝল সেই ভিখিরিটা দু’হাত দিয়ে ধরে ফেলেছে ওকে।

১৩

এখন। কলকাতা।

টম জানে এই মহাষষ্ঠীতে কলকাতার যা অবস্থা, তাতে এই সময় পনেরো মিনিটে লালবাজার থেকে মল্লিকবাজারের সেমেট্রিতে যাওয়া সম্ভব নয়।

ভ্লাদ যেই বলেছে বেঙ্গলি পোয়েটের সেমেট্রি, তখনই টম বুঝেছে কোথাকার কথা বলছে লোকটা।

কে এই ভ্লাদ? কোথা থেকে এল? আদিল ওরই কোলিগ। গত দু’বারের ক্রাইসিসে এই শহরটাকে প্রায় একা হাতেই বাঁচিয়েছে আদিল। কিন্তু এবার কোথায় ও?

মার্কোসের লোককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা খুব একটা ভাল বার্তা নয়। তাই ব্যাপারটা খুব গোপন রাখা হয়েছে। শুধু জানা গিয়েছে আদিলকে কাল শেষ বালিগঞ্জের কাছে দেখা গিয়েছিল।

বাইকের গতি বাড়াল টম। ওর পিছনে নিকি বসে আছে। ওদের দু’জনকে যেতে হবে সেমেট্রিতে। যদিও লোকাল পুলিশকে ইতিমধ্যেই খবর দেওয়া হয়েছে।

লালবাজার থেকে রাজভবন একটুখানি দূরত্ব। তার সামনে রাস্তাতেই আর্মির হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। এটা করেই ওরা উড়ে যাবে।

বাইক থেকে নেমে হেলিকপ্টারে উঠতে ঠিক সাড়ে তিন মিনিট সময় নিল ওরা। আশেপাশের রাস্তা পুলিশ কর্ডন করে দিয়েছে। তাও দূর থেকে উৎসাহী মানুষজন দেখছে চপারটা। আসলে কলকাতার রাস্তায় এমন দৃশ্য তো দেখা যায় না!

আকাশে ওড়ার পর হাতঘড়ি দেখল টম। ভ্লাদের কথা শোনামাত্র ওরা বেরিয়ে গিয়েছে লালবাজারের কনফারেন্স রুম থেকে। কারণ আবার কিছু হলে শহর জুড়ে এমন প্যানিক হবে, যা সামলানো যাবে না।

তাই আসার আগে টম দেখেছিল যে সিএম-ও বেরোলেন প্রেসকে ব্রিফ করতে।

“মিনিট দু’-তিনেকের বেশি তো লাগার কথা নয়, না?” নিকি জিজ্ঞেস করল পাশ থেকে।

টম হাসার চেষ্টা করল। মেয়েটা ভাল। কথা কম বলে। স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সে নতুন হলেও কুমারেশ বলেছে যে, নিকি খুবই এফিশিয়েন্ট।

কুমারেশের কথা না বিশ্বাস করার কিছু নেই। নেভিতে থাকাকালীন কুমারেশকে চিনত টম। পরে ও মার্কোসে যায় আর কুমারেশকে নেওয়া হয় স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সে।

কুমারেশ ওদের টিম লিডার ছিল। খুব কড়া ধাতের মানুষ। হার্ড টাস্ক মাস্টার। তাই নিকিকে কুমারেশ যখন সার্টিফিকেট দিচ্ছে তখন নিশ্চয়ই মেয়েটা কাজের।

টম আকাশ থেকে দেখল সেমেট্রির সামনে বেশ কিছু পুলিশ জড়ো হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সও আছে কয়েকটা। আর তার থেকে একটু দূরে ব্যারিকেডের বাইরে সাধারণ মানুষও উপচে পড়ছে যেন। আশ্চর্য! এমন অবস্থাতেও মানুষের মজা দেখার লোভ গেল না!

হেলিকপ্টারকে নীচে নামিয়ে সেমেট্রির উপরে হোভার করাতে লাগল পাইলট। টম দেখল সেমেট্রির ভিতরেও পুলিশ রয়েছে।

ও দ্রুত রোপ ডাউন করল হেলিকপ্টার থেকে। নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি দড়ি বেয়ে নামতে পারবে তো?”

নিকি তাকাল ওর দিকে, তারপর উত্তর না দিয়ে দড়িটা ধরে দ্রুত নেমে গেল নীচে। টম হাসল নিজের মনে তারপর ও নিজেও ধরল দড়িটা।

বড় একটা ওবেলিস্কের পাশে কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সামনেই অদ্ভুত একটা যন্ত্রের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে একটা লোককে।

একজন অফিসার এগিয়ে এল ওদের দিকে। চোখে মুখে ভয়, “দেখুন স্যার। সারারাত বেঁধে রেখেছে ওকে। এমনিতেই পুজোর জন্য এখানে ভিড় নেই। তার উপর এমন কোণে এটা যে, কারও চোখেও পড়েনি। লোকটার নাম আর্নস্ত। চেক রিপাবলিকের মানুষ।”

টম এগিয়ে গেল। সি-স বা বাংলায় যাকে ঢেঁকি বলে, তেমন একটা জিনিসের একপ্রান্তে একটু উঁচুতে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে লোকটাকে। আর অন্য প্রান্তে একটা ভারি লোহার ওয়েট একটা গিয়ারের মতো যন্ত্রের সাহায্যে ধীরে ধীরে নেমে আসছে।

আর ঢেঁকির যে প্রান্তে লোকটাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, সে প্রান্তে একটা বড় ধাতব শূল মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ, লোহার ওয়েটটা একপ্রান্তে নেমে আসামাত্র অন্যপ্রান্তে শূলটা ঠেলে উঠে গেঁথে দেবে লোকটাকে!

টম নিজের মনেই বলে উঠল, “ভ্লাদ দ্য ইমপেলার!”

পুলিশ অফিসারটি বলল, “স্যার বম্ব স্কোয়াড না এলে হাত দেব না। যদি বম্ব থাকে!”

টম ঘড়ি দেখল। দু’মিনিট মতো সময় আছে। ও বলল, “না এতে বোমা নেই। তবে সাবধানে লোকটাকে আগে নামাতে হবে। কারণ আর একটু এদিক-ওদিক বা দেরি হলেই শূলটা গেঁথে দেবে লোকটাকে। আপনারা দু’জন ওইদিক দিয়ে যান। আর নিকি আর আমি এইদিকে যাচ্ছি।”

আর্নস্ত নেতিয়ে পড়েছে একদম। টম দেখেই বুঝল, “ড্রাগ্ড।”

ও দ্রুত এগোল। তারপর পাশের গাছে এক পা দিয়ে ভর রেখে উঠে পড়ল চট করে। নিকিকে বলল, “তুমি ওদিকে গিয়ে আর্নস্তকে ধাক্কা দিয়ে দোল খাওয়াও। আমি উপরের ওয়ারটা কাটছি। নীচে পড়ে গেলে এঁরা ধরবেন।”

নিকি কোনওমতে হাত বাড়িয়ে ধরল আর্নস্তের শরীরটাকে তারপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলল। অল্প দুলল শরীরটা আর তার ফাঁকেই উপরে বেঁধে রাখা তারটা মসৃণভাবে কেটে এক হাতে আর্নস্তকে জাপটে ধরল টম। নীচের থেকে দু’জন পুলিশও ঠেকা দিল কোনওমতে।

আর ঠিক তখনই লোহার ওয়েটটা টুপ করে খসে পড়ল নীচে ঢেঁকির একপ্রান্তে। আর অন্যপ্রান্তে লোহার সূঁচলো শলাকা তির বেগে উঠে গেল উপরের দিকে।

কপালের ঘাম মুছে টম দেখল দু’সেকেন্ড দেরি হলে আজ ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড হয়ে যেত!

***

সেমেট্রির উলটো ফুটপাথে, গাড়ির পার্টসের দোকানগুলো সব বন্ধ। তার সামনে মানুষ থিকথিক করছে।

ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভ্লাদ দেখল পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে অচৈতন্য আর্নস্তকে। পাশে সিভিল ড্রেসে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে।

ও হাসল। এবার লালবাজারের ওঁরা বুঝবেন। আশা করা যায়, ওর কথা মানতে আর ওঁরা আপত্তি করবেন না! ভ্লাদ পিছিয়ে গেল ধীরে-ধীরে। তারপর সামনের ভিড়টার ভিতরে মিলিয়ে গেল নিমেষে!

১৪

জিনি ফোন বের করে একটু সরে গেল ঘরের এক পাশে। এই কনফারেন্স রুমটা বেশ বড়। কিন্তু একটু আগে হোম মিনিস্টার এসে ঢুকেছেন এখানে। তাঁর সিকিউরিটির লোকজনে ঘরটা হঠাৎ যেন একটু ছোট হয়ে গিয়েছে।

জিনি দেখল হোম মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলার আগে সিএম একবার ওর দিকে তাকালেন।

প্রথমে সিএম যখন ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, ও বুঝতে পারেনি কেন সবার মধ্যে থেকে ওকে ডাকলেন উনি! তার উপর ট্যাক্সিতে সেই অদ্ভুত ছেলেটা ওকে দুটো জিনিস দিয়েছিল। একটা আংটির মতো বাটন সাউন্ড ট্রান্সমিটার আর অন্যটা ছোট্ট স্পিকারের মতো ডেটা ট্রান্সমিটার। প্রথমটা কনফারেন্স রুমের কোনও টেবিলের তলার আর দ্বিতীয়টা কমপিউটার কনট্রোল হচ্ছে যেখান থেকে, তার প্রসেসিং ইউনিটের গায়ে জিনিকে লাগিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিল ছেলেটা।

ঘরে ঢুকেই জিনি দেখেছিল যে কমপিউটার কনট্রোলটাও এই ঘরেই আছে। এটা একটা সুবিধে। কিন্তু এখনও কাজ দুটো করার সুযোগ পায়নি ও।

আসলে ঘরে ঢোকামাত্র সিএম এগিয়ে এসেছিলেন ওর দিকে। কোনওরকম ভণিতা না করে বলেছিলেন, “লাস্ট টাইম তোমার জন্য আমরা খুব জোর বেঁচে গিয়েছিলাম। এবার কি কোনও খবর আছে তোমার কাছে?”

“মানে ম্যাম?” জিনি ঘাবড়ে গিয়েছিল খুব।

সিএম বলেছিলেন, “আমি জানি জিনি তুমি সেই ঘটনা নিয়ে যতটা বলেছিলে, তার চেয়ে বেশি খবর তোমার কাছে আছে। তাই আমার মনে হচ্ছে এবারও তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারবে। গতবারের দু’-দুটো ক্রাইসিসে কেউ একজন আড়ালে থেকে হেলপ করেছিল আমাদের। আমার মনে হয় এবারও সে আসতে পারে।”

জিনি কী বলবে বুঝতে পারেনি।

সিএম বলেছিলেন, “আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারিনি। তুমি কাউকে আড়াল করছ বুঝতে পারি। শোনো, তুমি বাইরে একটু অপেক্ষা করো। তোমায় দরকার লাগতে পারে। আর…”

সিএম কথা শেষ করার আগেই সুরজিৎবাবু এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলেছিলেন, “ম্যাডাম, হোম মিনিস্টার পৌঁছে গিয়েছেন।”

জিনি দেখল, ঘরের সবাই হোম মিনিস্টারের দিকে তাকিয়ে। এটাই সুযোগ। ও ফোনটা বের করে কোনও নাম্বার ডায়াল করছে এমন ভান করে সরে এল ঘরের কোণে। এখানে কমপিউটার সিস্টেমে বসে রয়েছে চারজন পুলিশ অফিসার। ক্রমাগত ভ্লাদ নামে লোকটির লোকেশন ট্রেস করার চেষ্টা করছেন এঁরা।

কিন্তু এই চারজন অফিসারও এখন সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন হোম মিনিস্টারের দিকে। জিনি কথা বলার ভান করে সবার থেকে ঘুরে দ্রুত মোবাইলের খাপের থেকে ‘স্টিকার’টা বের করল। আর আঙুলের থেকে খুলল বাটন ট্রান্সমিটারটা। তারপর মুখের চুইংগামটা বের করে তাতে বাটনটা লাগিয়ে চট করে টেবিলের তলায় আটকে দিল। আর চারটে মনিটারের সঙ্গে লাগানো সেন্ট্রাল প্রসেসিং কনসোলটার পিছনে আটকে দিল ‘স্টিকার’টা। গোটা কাজটা করতে ও চার সেকেন্ডের বেশি সময় নিল না। কাজটা শেষ করে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জিনি। তারপর এদিক-ওদিক একবার দেখে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

***

আর ঠিক তখনই মাঝের টেবিলে রাখা স্পিকারটা সজীব হয়ে উঠল। শোনা গেল সেই শান্ত, বরফের মতো ঠান্ডা গলাটা। ভ্লাদ! চারজন অফিসার আবার ঘুরে বসল মনিটরের দিকে। ঘরের মাঝে সবাই একসঙ্গে ঝুঁকে পড়ল স্পিকারের উপর।

“গুড মর্নিং এভরিবডি। আয়াম হিয়ার এগেন।”

সিএম বললেন, “ভ্লাদ, এসবের মানে কী? প্রথমে ডার্টি বম্ব। তারপর একজন ফরেন ডেলিগেট। তুমি চাওটা কী?”

“হোম মিনিস্টার প্লিজ়।”

হোম মিনিস্টার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কুমারেশ আটকালেন। চাপা গলায় বললেন, “সরি স্যার,” তারপর ভ্লাদকে বললেন, “আমরা টেররিস্টদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করি না। হোম মিনিস্টার আসবেন না।”

ভ্লাদ হাসল, “সরি মিস্টার, বাট আই গেস, হি ইজ় স্ট্যান্ডিং অর সিটিং বিসাইড ইউ। শুনুন, এখনও সার্কাস অনেক বাকি। আমি এটা সারা পুজো টানতে পারি। কিন্তু যদি সমাধান চান, ওঁকে লাইন দিন। আর্নস্তকে আমি ইচ্ছে করলেই মারতে পারতাম। মারিনি। কিন্তু আরেকজনকে আমি এখনই মারতে পারি। বুঝেছেন?”

হোম মিনিস্টার আর সময় নষ্ট করলেন না। মাইকের সামনে ঝুঁকে বললেন, “আমি বলছি। বলো কী চাই তোমার? কাকে তুমি মারতে পার?”

ভ্লাদ হাসল, “আপনাদের সবার প্রিয় আদিলকে।”

“আদিল?” সিএম চোয়াল শক্ত করে বললেন, “তুমি ওকে…”

“ডিয়ার ম্যাডাম, ও এখন আমার অতিথি।”

হোম মিনিস্টার বললেন, “তুমি কী চাও? কেন এমন করছ?”

ভ্লাদ হাসল, “আমি কথা বলতে চাই।”

“ইয়েস আয়াম হিয়ার, বলো,” হোম মিনিস্টার ঠোঁট কামড়ালেন।

“কিন্তু আপনার সঙ্গে নয়। আমি কথা বলতে চাই আপনাদের ফাইন্যান্স আর ডিফেন্স মিনিস্টারের সঙ্গে। মানে একজনই তো এখন দুটো দায়িত্ব সামলাচ্ছেন, তাই না?”

“মানে?” হোম মিনিস্টার কী বলবেন বুঝতে পারলেন না।

ভ্লাদ হাসল, “আমি জানি আপনাদের ফাইন্যান্স কাম ডিফেন্স মিনিস্টার মিস্টার জেটলি আজ বিহারে এসেছেন। কল হিম। এখানে আসতে বলুন ওঁকে। আই নিড টু টক টু হিম।”

“ইমপসিবল!” রাই চিৎকার করে উঠল সব ভুলে।

“দ্যাটস আ ওয়র্ড ফ্রম ফুল্‌স ডিকশনারি,” ভ্লাদ হাসল। তারপর আচমকা গলার স্বর বদলে ফেলে বলল, “ওঁকে ডাকুন এখানে। না হলে বিপদ আছে। আর ততক্ষণে আপনাদের দুই হিরো-হিরোইনকে পাঠান কালিঘাট ট্রাম ডিপোতে। আমার কিছু দেওয়ার আছে ওদের। মনে রাখবেন, শুধু দু’জনকেই পাঠাবেন। আর ডিপোর আটশো মিটারের মধ্যে যেন কোনও পুলিশ না থাকে। থাকলে…”

“তুমি কী চাও? পাগল তুমি?” রাই অসহায় হয়ে প্রশ্ন করলেন।

“সব জিনিয়াসরাই একটু পাগল। আর সবসময় কি কিছু চাইতেই হবে? লোভ করতেই হবে? ধরে নিন আমি বোর হচ্ছিলাম। তাই জাস্ট টাইম পাস করতে এই খেলাটা খেলছি!” ভ্লাদ হাসল, “বাট ইউ নো, ম্যাডনেস ইজ় দ্য ডিম্যান্ড অফ দিস টাইম। যাই হোক, ওদের পাঠান। বাট প্লিজ় নো চপার দিস টাইম। কুড়ি মিনিট হাতে আছে আপনাদের। অ্যান্ড ইয়োর টাইম স্টার্টস নাও।”

১৫

বাইকে বসে ঘড়ি দেখল অদম্য। কুড়ি মিনিট! ওর ভাগ্য ভাল যে এক্সাইড মোড়ের কাছে আছে ও। ট্রাম ডিপোয় যেতে সময় লাগবে না। বাটন ট্রান্সমিটারের সাহায্যে ও সবই শুনেছে।

অদম্য হাতের ট্যাবটা খুলল। জিনি ‘স্টিকার’-টা ঠিক জায়গায় লাগিয়েছে। ওটা লালবাজারের কমপিউটারের সব সিগন্যাল খুব সহজেই ইন্টারসেপ্ট করে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর ট্যাবে।

এই ‘স্টিকার’-টা ও মিউনিখ থেকে নিয়েছিল। জার্মান মিলিটারির ‘আর অ্যান্ড ডি’ থেকে ওকে বের করে দিয়েছিল কাইজ়ার বলে একজন। আজ কাজে লাগল।

ট্যাবে ভ্লাদের ফোন থেকে পাওয়া মিরর্‌ড সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতার অসংখ্য লোকেশন দেখাচ্ছে এক সঙ্গে। হাসি পেল অদম্যর। ও নিজেও এমন একবার ব্যবহার করেছিল।

অদম্য স্ক্রিনের পাশে আরেকটা ছোট্ট উইন্ডো খুলে একটা নম্বর স্কাইপে ডায়াল করল।

চারটে রিংয়ের পর জনকে স্ক্রিনে দেখতে পেল অদম্য। জন ওর বন্ধু।

“হাই মাইট!” জন হাসল।

অদম্য সময় নষ্ট করল না। বলল, “জন, আমি তোমায় একটা লিঙ্ক আপলোড করে দিচ্ছি। একজন নিজের লোকেশন মাস্ক করে কথা বলছে। প্লিজ় ডিগ হিম আপ।”

লিঙ্ক আপলোড হতে মিনিটখানেক সময় নিল। জন নিজের স্ক্রিনে দেখল সেটা। তারপর বলল, “ওকেই মাইট। সি আ ইন নো টাইম।”

অদম্য ট্যাবটা অফ করে সামনে তাকাল। ভ্লাদ দ্য ইমপেলার! কী অদ্ভুত নাম নিয়েছে লোকটা! সত্যি সেমেট্রিতে ওই বিদেশিকে তো প্রায় ইমপেল, মানে শূলেই চড়িয়ে দিয়েছিল ও!

কিন্তু ভ্লাদ কী দিতে চায় টম আর নিকিকে? আর আদিলকেই বা ধরে রেখেছে কেন?

অদম্য শহরের হিজিবিজি ভিড়টার দিকে তাকাল। অসংখ্য পাজ়ল পিস যেন! কোথায় শুরু এর? শেষটাই বা কোথায়? আর কী আছে সেই শেষে?

১৬

সামনে দুটো এসকর্ট জিপ হুটার বাজাতে-বাজাতে চলেছে আর পিছনে বাইকে টমকে ধরে বসে রয়েছে নিকি।

মল্লিকবাজারের গোরস্থানের সামনেই অপেক্ষা করছিল ওরা। আর তখনই মিস্টার রাইয়ের থেকে জানতে পারে যে, ওদের যেতে হবে কালীঘাট ট্রাম ডিপোর কাছে। কিন্তু এবার আর হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যাবে না।

টম আর কথা বলছে না কোনও। বাইকের উপর ঝুঁকে একাগ্রভাবে তাকিয়ে রয়েছে রাস্তার দিকে। হুটারের শব্দে গোটা পথটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে মসৃণভাবে।

ঠিক দশ মিনিটের মাথায় হাজরা মোড়ের কাছে থামল এসকর্ট জিপটা। নিকি জানে এর বেশি আর ওরা যাবে না।

টম কিন্তু থামল না। সোজা বেরিয়ে গেল। যদিও দশ মিনিট লাগল ওদের এই মোড়ে পৌঁছতে, আসলে চার মিনিট আরও বেশি খরচ হয়েছে লালবাজার থেকে নিকিদের কাছে নির্দেশ পৌঁছতে। অর্থাৎ যা কিছু অনর্থ ঘটতে পারে, তা আটকাতে ওদের হাতে সময় আছে আর ছ’মিনিটের মতো।

ডিপোর সামনে এসে বাইকটাকে আস্তে করল টম। একদিকে হাজরা আর অন্যদিকে রাসবিহারী মোড়, দুটোই আটকে দিয়েছে পুলিশ। এই জায়গাটা একদম খাঁ খাঁ করছে।

ডিপোর বড় দরজাটা দেখতে পেল নিকি। সামনের রাস্তাটা অ্যাসফল্টে মোড়া। ডিপো থেকে ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ট্রাম লাইন।

বাইকটা রাস্তার পাশে রেখে ওরা নামল। টম পিস্তলটা বের করে ইশারায় নিকিকে বলল বড় দরজার অন্যপাশে যেতে।

ডিপোয় ঢোকার দরজাটা বড়। দু’পাল্লার। ওরা দু’জন দুটো পাশ দিয়ে ঢুকল ভিতরে।

পরপর বেশ কয়েকটা ট্রাম দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিকি কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে নিল এবার।

টম বলল, “আমার পিছনেই থাকো। জানি না কী খুঁজছি। তাই আনন্যাচারাল কিছু চোখে পড়লেই আমায় বলবে।”

নিকি কিছু বলার আগেই হঠাৎ ‘পিঁক পিঁক’ করে শব্দ শুনল একটা। আর সেই আওয়াজ লক্ষ করে ওরা দু’জনেই একসঙ্গে ঘুরল।

একটু দূরে একটা কাঠের গুমটি। আওয়াজটা সেই দিক থেকে আসছে।

টম সময় নষ্ট না করে দ্রুত এগিয়ে গেল সেই দিকে। নিকিও গেল পিছন-পিছন।

গুমটির কাঠের দরজাটা বন্ধ। ওর ভিতরে কি কেউ আছে? নিকি এগোতে গেল। কিন্তু টম হাত দিয়ে আটকাল ওকে। কারণ আবার শব্দটা হচ্ছে। আর সেটা গুমটির ভিতর থেকে হচ্ছে না। হচ্ছে গুমটির পিছন থেকে।

ওরা পিস্তল তাক করে গুমটির পিছনের দিকে এগোল। এদিকটায় কেউ নেই। চারিদিক আগাছায় ভর্তি। বড় লোহার থাম আছে পুরনো দিনের। আর এদিকটায় বেশ রোদ!

নিকি দেখল গুমটির গায়ে হলুদ রংয়ের পাবলিক পুশ-বাটন টেলিফোনের মতো একটা বাক্স ঝুলছে। আর ওই যান্ত্রিক শব্দটা সেখান থেকেই বেরোচ্ছে!

নিকি এগোতে গেল আবার। কিন্তু টম এবারও আটকাল ওকে। বলল, “তুমি বম্ব ডিফিউজ় করতে পার?”

“না,” মাথা নাড়ল নিকি।

“আমায় শিখতে হয়েছে। সো…” টম কথাটা শেষ না করে এগিয়ে গেল বাক্সটার সামনে।

হলুদ রংয়ের বাক্সটার গায়ে একটা ডায়ালের মতো। তার উপরে লাগানো এলসিডি প্যানেল দেখাচ্ছে ডিটোনেশন টাইম। আর ঠিক দেড় মিনিট বাকি!

টম নিকির দিকে তাকাল একবার। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে জামার হাতা গুটিয়ে সময় নিয়ে নিজেকে স্টেডি করল। তারপর ঝুঁকে পড়ল বাক্সটার উপর।

হঠাৎ ‘ক্লিক’ করে শব্দ হল একটা। আর টম কেমন যেন স্থির হয়ে গেল নিমেষের জন্য। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল বাক্সটার গায়ে। নিকি বুঝতে পারল না কী হল ব্যাপারটা।

“টম!” নিকি চিৎকার করে এগিয়ে যেতে গেল সামনে, কিন্তু ঠিক তখনই পিছন থেকে কে যেন এসে ওর কোমর ধরে এক টানে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেল ওই বাক্সটার সামনে থেকে।

নিকি প্রথমে থতমত খেয়ে গেলেও নিমেষের মধ্যে সামলে নিল নিজেকে। তারপর হাত-পা ছুড়ে ছিটকে বেরোতে চাইল লোকটার বাঁধন থেকে। কিন্তু পারল না। পিছন থেকে লোকটা অদ্ভুতভাবে চেপে ধরেছে ওকে। নিকি তাও প্রাণপণে ঝটকা দিল আর-একটা।

লোকটা কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বলল, “ইজ়ি, ইজ়ি। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। বরং বাঁচতে চাইলে এসো আমার সঙ্গে। অ্যান্ড ফরগেট টম। হি ইজ় ডেড।”

১৭

কুমারেশ কী বলবে বুঝতে পারল না। হাতের ফোনটা নামিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সবার দিকে।

“কী হয়েছে?” হোম মিনিস্টার টেনস্‌ড গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“স্যার, টমাস মারা গিয়েছে।”

“কী!” রাই ছিটকে উঠল সিট থেকে, “টম… টম…”

কুমারেশ বলল, “এইমাত্র খবর পাওয়া গিয়েছে। ওর বুকে স্ট্যাব করা হয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে মারা গিয়েছে!”

“কী করে?” সিএম ঝুঁকে পড়লেন সামনের দিকে।

কুমারেশ সামনে রাখা জলের গ্লাস থেকে জল খেল একটু। তারপর ধরা গলায় বলল, “স্পট থেকে জয়েন্ট কমিশনার অফ পুলিশ, ক্রাইম, মিস্টার পল্লবকান্তি ঘোষ ফোন করেছিলেন। উনি বললেন একটা ফোটো ইলেকট্রিক ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে।”

“মানে?” হোম মিনিস্টার অবাক হলেন।

“মানে, স্যার যে টেকনিকে অটোমেটিক ডোর খোলা-বন্ধ হয় সেই টুল ইউজ় করা হয়েছে। টম বাক্সটাকে বোমা ভেবে সামনে গিয়েছিল। ওর শ্যাডো পড়েছিল বাক্সর গায়ে। আর সেটাই বাক্সটার ভিতরের মেকানিজ়মকে ট্রিগার করে। ব্যস। একটা বারো ইঞ্চির শার্প টাইটেনিয়াম ব্লেড বাক্সর স্লট থেকে বেরিয়ে ঢুকে গিয়েছে ওর শরীরে!”

“আর নিকি?” সিএম উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“মিসিং!”

সিএম সুরজিৎবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শহরের প্রতিটা ইঞ্চি সার্চ করুন। সাউথ কলকাতা থেকে এখনও নিশ্চয়ই ওরা বেরোতে পারেনি। প্রথমে আদিল, তারপর নিকি! এদিকে টম মারা গেল! এটা হচ্ছেটা কী?”

সঞ্জয়বাবু চশমাটা খুলে রাখলেন টেবিলের উপর। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “ভ্লাদ দ্য ইমপেলার নাম নিয়ে লোকটা নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করছে।”

সবাই একসঙ্গে এবার তাকালেন সঞ্জয়বাবুর দিকে।

উনি একইরকম শান্ত গলায় বললেন, “ভ্লাদ দ্য ইমপেলার ওয়ালাশিয়ার প্রিন্স ছিলেন। তবে এই নামটা উনি মারা যাওয়ার পর ওঁকে দেওয়া হয়েছিল। আসলে উনি ভ্লাদ দ্য থার্ড। ওয়ালাশিয়া বর্তমানে রোমানিয়ার অন্তর্গত। ভ্লাদ দ্য থার্ড রোমানিয়ার ফোক হিরো হলেও, ইতিহাস বলে, তাঁর মতো নৃশংস রাজা খুব কম ছিলেন। কেউ-কেউ বলেন মানুষকে টর্চার করে মারাতে ভ্লাদ আনন্দ পেতেন। আর মানুষ মারার জন্য উনি ব্যবহার করতেন শূল। মানুষকে শূলে চড়িয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করানোটা ছিল ওঁর অ্যামিউজ়মেন্ট। বলা হয় প্রায় এক লাখ মানুষ উনি মেরেছিলেন এমন ইমপেল করে। তাই নাম দেওয়া হয়েছিল ভ্লাদ দ্য ইমপেলার! তবে সত্যি মিথ্যে যাই হোক, ইতিহাস জুড়ে ভ্লাদ দ্য থার্ডের নৃশংসতার অনেক গল্প ছড়ানো আছে। ব্রাম স্টোকার যে ড্রাকুলার গল্প লিখেছিলেন, তার পরোক্ষ ইন্সপিরেশনও ছিলেন এই হাউজ় অফ ড্রাকুলেস্টির প্রিন্সটি।”

“সে তো হল,” সিএম বললেন, “কিন্তু কী চায় এই লোকটা?”

কুমারেশ চোয়াল শক্ত করে বলল, “কী চায় জানি না, কিন্তু ওকে আমি ছাড়ব না। দরকার হলে ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে নিজে রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে খুঁজতে বেরোব।”

কুমারেশ হয়তো আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই সামনের স্পিকারটা জেগে উঠল আবার। আবার শোনা গেল সেই ঠান্ডা গলার স্বর।

“আশা করি, আপনারা এনজয় করছেন গেমটা। আমি একা আর আমায় ধরতে দু’জন পাঠিয়েছিলেন? ভেরি আনএথিকাল। তাই এক-এক করে দিলাম খেলাটা।”

সিএম কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “নিকি কোথায়? আর আদিল? কী চাও তুমি? স্পষ্ট করে বলো। কেন নিরীহ মানুষ মারছ?”

ভ্লাদ যেন থমকাল একটু। তারপর বলল, “আমি চাই আপনাদের ফাইন্যান্স কাম ডিফেন্স মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলতে। সেটা যত দেরি হবে, ততই আমার খেলা চলবে। আর আধঘণ্টা সময় দেব। তার মধ্যে যদি আমার ডিম্যান্ড ফুলফিল না হয়, তবে যা হবে তার দায়িত্ব আমার নয়। আপনাদের।”

লাইনটা কট করে কেটে গেল আবার।

সুরজিৎবাবু কম্পিউটারে বসা একজন অফিসারকে জিজ্ঞেস করলেন, “লোকেট করা যাচ্ছে না কিছুতেই!”

অফিসারটি শুধু মাথা নাড়লেন।

সুরজিৎবাবু আরও কিছু বলতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই কুমারেশের ফোন বেজে উঠল এবার। দ্রুত কলটা রিসিভ করল ও। তারপর কথা সেরে নিয়ে কী যেন পড়ল মোবাইলে। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “দুটো খবর আছে। এক, ফাইনান্স মিনিস্টার মিস্টার জেটলি আসছেন। উনি সবটা জেনে নিজেই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এইমাত্র ফোনে খবর পেলাম। আর দুই,” একটু থামল কুমারেশ, তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিকি আমায় এইমাত্র টেক্সট করেছে। শি ইজ় সেফ অ্যান্ড স্টিল অন দ্য জব।”

১৮

অকল্যান্ড। এখন।

এখন সেপ্টেম্বরের শেষ। শীত বড়জোর আর মাস দেড়েক থাকবে। জন কফির কাপটা নিয়ে এসে বড় কাচের জানলার সামনে বসল। সামনে তামাকি নদী। তার চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছবির মতো শহর।

কফিতে একটা চুমুক দিয়ে সামনের টেবিলে রাখল জন। তারপর কোলের উপর টেনে নিল ল্যাপটপটা।

একটু আগে অ্যাডাম ওকে আপলোড করেছে একটা লিঙ্ক। ভ্লাদ নামে একজন এই একটা নম্বর থেকেই ফোন করছে আপাতত। কিন্তু তাকে ট্রেস করতে গেলেই তার নির্দিষ্ট লোকেশনের বদলে সারা কলকাতা জুড়ে প্রায় দেড়শোটা জায়গা দেখাচ্ছে। এর মধ্যে থেকে ওকে খুঁজে বের করতে হবে আসল লোকেশন কোনটা!

কাজটা সহজ নয়। আর কেউ বললে জন এর জন্য কমপক্ষে ফিফটি গ্রান্ড নিত। কিন্তু অ্যাডামের সঙ্গে ওর অন্য সম্পর্ক। ছোট থেকে ফাদার ফ্রান্সিসের কাছে অ্যাডামের মতো ও নিজেও বড় হয়েছে। অ্যাডাম বরাবরই একটু অন্যরকম ছিল। কিন্তু তাতে ওদের বন্ধুত্ব হতে আটকায়নি।

জন স্ক্রিনের তাকাল। একটা প্রোগ্রাম ওপেন করে পকেট থেকে পেনড্রাইভের মতো দেখতে একটা ডঙ্গল বের করে লাগাল ল্যাপটপের পাশে। এটা স্যাটেলাইট কানেক্টর। ওই প্রোগ্রাম আর এই কানেক্টরের সাহায্যে জন পৃথিবীর চারিদিকে পাক খাওয়া যে-কোনও স্যাটেলাইটকে চুপিচুপি অ্যাকসেস করতে পারে।

ও হাসল। ভাবল এবারই আসল কাজ! যে এমন করে নিজের লোকেশন ঢেকে রাখতে চায়, সে আর সব পারলেও একটা জিনিস কিছুতেই ঢাকতে পারবে না। সেটা হল ‘হিট সিগনেচার’। কোনও মোবাইল যখন চালু থাকে, তার থেকে রেডিয়েশন হয়। যার ফলে তার তাপমাত্রা আশপাশের তুলনায় একটু বেশিই থাকে।

এখন আসল লোকেশনটাই কেবল সত্যিকারের ‘হিট সিগনেচার’ দেখাবে। নকল লোকেশনের ইন্ডিকেটরগুলো সব কিছু কপি করলেও এটা কপি করতে পারবে না। তাই এর মাধ্যমেই ধরে দেওয়া যায় লোকটা আসলে কোথা থেকে কল করছে!

আর-একবার কফিতে চুমুক দিয়ে একটা কমান্ড টাইপ করে এন্টার টিপল জন। আর সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল প্রতিটা লোকেশনের তাপমাত্রা।

স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে বসল জন। তারপর দ্রুত একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল ফোনটা।

দুটো রিং হতেই ফোনটা ওপাশ থেকে ধরল কেউ।

জন উত্তেজিত গলায় বলল, “অ্যাডাম, আই হ্যাভ গট ইট মাইট।”

১৯

কলকাতা। এখন।

ষষ্ঠীর সকালে অনুষ্টুপের কাজ থাকে অনেক। পাড়ার পুজোয় সেক্রেটারি বলে কথা। সে তো আর কেউ মুখ দেখে করেনি! ‘লেক বিশ্বজনীন’ ওদের খুব আদরের ক্লাব। তার হয়ে প্রতিবছর পুজো করে ওরা। সাদার্ন অ্যাভিনিউ থেকে শরৎ বোস রোডের দিকে যেতে দু’তিনটে গলি পরেই বাঁ হাতে পড়ে ওদের পুজোটা।

এবার পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির ঢঙে সাজানো হয়েছে মণ্ডপ। যদিও গতকালই সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাও আজ ফিনিশিং টাচটা বাকি আছে।

এদিকে আবার সন্ধে ছ’টা থেকে ফাংশন আছে। প্যান্ডেলের এক পাশে সেই স্টেজটা বাঁধার কাজও চলছে। কেমন যেন ভয় পাচ্ছে। আসলে এত ভিড়ের ভিতর পুলিশ আর কত কী করবে!

অনুষ্টুপ ঘড়ি দেখল। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। তাও কেটারিংয়ের লোকজন গদাইলস্করি চালে চলেছে। বিরক্ত লাগে ওর।

বাকিরা সব প্যান্ডেলের সামনে বসে আড্ডা মারছে, কারও খেয়াল আছে যে স্টেজ কমপ্লিট হয়নি! ফুলের সাজ পুরো হয়নি! দুপুরের খাওয়া বাকি! সব কি একে একে ওকেই দেখতে হবে?

“এক্সকিউজ় মি।”

অনুষ্টুপ পিছনে ঘুরল। একজন বিদেশি মানুষ।

আজকাল সারা কলকাতা জুড়ে এসব দেখা যায়। পুজোর সময় তো আরও বাড়ে।

লোকটা ফ্যাকাশে। মাঝারি লম্বা। আর মাথায় ছোট করে কাটা চুল। লোকটার হাতে ক্যামেরা আর পিঠে ব্যাগ। লোকটা খুব নরম গলায় বলল, “আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। এখানে কি কোনও ওয়শরুম আছে?”

অনুষ্টুপ দেখল লোকটা দরদর করে ঘামছে। সত্যি অসুস্থ মনে হচ্ছে।

“জাস্ট আ মিনিট,” অনুষ্টুপ চিৎকার করে ডাকল, “এই বুচাই, বুচাই। এদিকে আয় তো।”

বুচাই দৌড়ে এল, “কী টাবলুদা?”

অনুষ্টুপ বলল, “এঁকে মঞ্চের পিছন দিয়ে রিমিদিদের বাড়ির ওয়শরুমটায় নিয়ে যা,” তারপর লোকটার দিকে ফিরে বলল, “ইউ প্লিজ় গো উইথ হিম।”

লোকটা কৃতজ্ঞতায় মাথা নাড়ল। ধন্যবাদ দিয়ে বুচাইয়ের পিছনে গেল।

অনুষ্টুপ আর অপেক্ষা না করে যেখানে খাবারের বন্দোবস্ত হচ্ছে সেই দিকে হাঁটা দিল। তবে ও যদি পিছনে ঘুরত, তবে দেখতে পেত স্টেজের পিছনের নির্জন দিকটায় যাওয়ার আগে অসুস্থ বিদেশি লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করল একটা হলুদ তরল-ভরা সিরিঞ্জ।

২০

লেক রোড দিয়ে কিছুটা এগিয়ে তারপর বাঁদিকের গলিতে বাঁক নিল অদম্য। ব্লুটুথ হেড সেটটায় আঙুল চেপে জিজ্ঞেস করল, “আর কতটা জন?”

“ম্যাক্স সেভেনটি ফাইভ মিটার। লোকেশন তেমনই ইন্ডিকেট করছে।”

অদম্য দেখল সামনে ডানদিকে আর-একটা রাস্তা ঢুকে গিয়েছে। তবে সেই রাস্তাটা মাঝ বরাবর গিয়ে আটকে গিয়েছে প্যান্ডেলে।

অদম্য কোনওমতে বাইকটাকে রেখে লাফিয়ে নামল। ওর পিছন থেকে নিকিও নামল পিস্তল হাতে।

দ্রুত গলির দিকে তাকাল অদম্য। একজন ফিল্মস্টারের পুজো এটা। সামনের দিকে ভালই ভিড় কিন্তু পিছনের দিকটা ফাঁকা। এমন নির্জন জায়গায় কেউ যদি আরেকটা ডার্টি বম্ব লাগায় তবে…

চিন্তাটা শেষ করতে পারল না অদম্য। কারণ তখনই একটা জিনিস চোখে পড়ল ওর। সামনের প্যান্ডেলের পাশে আর-একটা ছোটমতো প্যান্ডেল করা হয়েছে। সেই প্যান্ডেলের ভিতর থেকে মাটিতে শোওয়ানো চটি-পরা দুটো পা বেরিয়ে আছে।

ও দ্রুত কোমর থেকে পিস্তলটা হাতে নিল। মাথা তুলে দেখল আশপাশের বাড়ি থেকে কৌতূহলী কিছু মুখ উঁকি দিচ্ছে। ও তাদের দিকে তাকিয়ে ইশারায় চুপচাপ সরে যেতে বলল।

আর ঠিক তখনই কাণ্ডটা ঘটল। অদম্য দেখল নিকি ওর পিছন থেকে ছিটকে বেরিয়ে দৌড়ে গেল প্যান্ডেলের দিকে। আরে করছে কী মেয়েটা! নিরুপায় হয়ে অদম্যও দৌড়ে গেল ওর পিছনে।

নিকি ছোট প্যান্ডেলটার মুখে গিয়ে দাঁড়াল না। বরং গতি বাড়িয়ে ঢুকে গেল ভিতরে।

“ফ্রিজ়!” নিকি চিৎকার করে উঠল সামনের দিকে পিস্তল তুলে।

অদম্য দরজার কাছ থেকে দেখল প্যান্ডেলের ভিতরে তিনজন মানুষ মাটিতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। আর ওদের সামনে এক মাঝারি লম্বা, ফ্যাকাশে একটা লোক ছোট ব্যাকপ্যাকের মতো জিনিসে ব্যাটারি লাগাতে ব্যস্ত। অদম্য বুঝল এই ভ্লাদ!

ব্যাকপ্যাকটা যে বোমা, বুঝতে অসুবিধে হল না অদম্যর। ও দেখল নিকি আর ওকে দেখে থমকে গিয়েছে ভ্লাদ।

ভ্লাদকে এবার ভাল করে দেখল অদম্য। বিদেশি। ফ্যাকাশে ফর্সা। মাথায় ছোট করে কাটা চুল। খুবই সাধারণ দেখতে। তবে চোখ দুটোর মধ্যে একটা অদ্ভুত অন্ধকার আছে। লোকটা ঘামছে খুব। যেন অসুস্থ।

“হাত তোলো, তোলো উপরে!” নিকি পিস্তলটা তাক করা অবস্থায় ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল ভ্লাদের দিকে, “সরে যাও বোমা থেকে। কী ভেবেছ তুমি? এসব করে পার পেয়ে যাবে? সরো!”

অদম্য বোমাটা দেখল। না, এখনও ডেটোনেটার দিয়ে আর্ম করা হয়নি। ও নিকিকে বলল, “কাছে যেয়ো না। তুমি হেড কোয়ার্টারে ফোন করো। ওরা ফোর্স পাঠাক। কাছে যেয়ো না নিকি।”

নিকি ভ্লাদের প্রায় কাছে পৌঁছে গিয়েও অদম্যর কথায় পিছন ফিরে রাগের গলায় বলল, “ইউ শাট আপ! আমায় কাজ করতে দাও। আজ ওকে আমি…”

আর নিকির এই পিছনে ফেরার ফাঁকটাই কাজে লাগাল ভ্লাদ। আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে পিছন থেকে গলা পেঁচিয়ে ধরল নিকির।

গোটা ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে অদম্য বুঝতেই পারল না কী হল ব্যাপারটা। ভ্লাদ নিকিকে ঢালের মতো ব্যবহার করছে। বাঁ হাতে নিকির গলা পেঁচিয়ে ডান হাতের পিস্তলটা ঠেকিয়ে রেখেছে নিকির কোমরের কাছে।

“লিভ হার!” অদম্য পিস্তল না নামিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল।

“ইউ ডোন্ট মুভ,” ভ্লাদও পূর্ব ইউরোপীয় উচ্চারণে কেটে-কেটে বলল, “এক পা এগোলে ইয়োর পার্টনার উইল ডাই।”

“ও আমার পার্টনার নয়। আই ডোন্ট কেয়ার।”

ভ্লাদ হাসল, “ইউ কেয়ার। আর সেটাই তোমার অ্যাকিলিসের হিল! না হলে তুমি ওকে ডিপো থেকে বাঁচাতে না। সো স্টে পুট। এক পা আর এগোবে না। না হলে…”

ভ্লাদ পিস্তলের হ্যামারটা টেনে নলটা দিয়ে নিকির পেটে খোঁচা দিল।

“ও কে!” অদম্য হাত তুলল, “ডোন্ট হার্ট হার।”

লোকটা হাসল। তারপর প্যান্ডেলের পাশের আলগা ত্রিপলটার দিকে সরে গেল। অর্থপূর্ণ গলায় বলল, “আমায় ফলো করবে না। করলে…”

নিকিকে নিয়ে ভ্লাদ দ্রুত বেরিয়ে গেল প্যান্ডেলের আলগা জায়গাটা দিয়ে।

অদম্য দৌড়ে গেল সামনে। তারপর ঝুঁকে মাটিতে পড়ে থাকা লোকগুলোকে দেখল। নাঃ মারা যায়নি। তবে খুব হাই ডোজ়ের সেডেটিভ দেওয়া হয়েছে ওদের।

লোকগুলোকে টপকে অদম্য প্যান্ডেলের বাইরে বেরোল। দেখল সামনে একটা ছাতিম গাছ। তার গোড়ায় বসে রয়েছে নিকি। হাত আর পা বাঁধা।

অদম্য এদিক ওদিক তাকাল। আশপাশে কিছু মানুষ এগিয়ে আসছে এবার। ও চট করে লুকিয়ে ফেলল পিস্তলটা। তারপর এগিয়ে গিয়ে নিকির পায়ের বাঁধনটা দেখল। প্লাস্টিকের মোটা স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকানো।

নিকির মাথা নামিয়ে বলল, “সরি। তুমি ঠিক বলেছিলে। আসলে আমি…”

অদম্য সময় নষ্ট না করে এগোল বাইকের দিকে। এসব ড্রামার এখন দরকার নেই। ও আবার ফোনে জনের নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল।

“ইয়েস অ্যাডাম?”

অদম্য বলল, “জন, ওকে আবার ট্রেস করতে হবে। ও পালিয়েছে।”

“সরি মাইট!” জনের গলায় হতাশা শুনতে পেল অদম্য। জন বলল, “হি ইজ় অফ দ্য গ্রিড নাও। ওকে আর ট্রেস করা যাচ্ছে না। ”

২১

অর্থমন্ত্রী টেবিল থেকে গ্লাসটা তুলে নিয়ে সিএম-কে বললেন, “সাউথ কলকাতায় একটা পুজো প্যান্ডেলে আর-একটা বোমা পাওয়া গিয়েছে?”

সিএম মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, তবে সেটা নিষ্ক্রিয় ছিল।”

“রাই, ওই নিকি বলে মেয়েটা কেন নিজের লোকেশন জানাচ্ছে না?”

“স্যার,” রাই বলল, “নিকি ‘র’ থেকে আসেনি। স্পেশ্যাল টাস্ক থেকে এসেছে।”

“তো?” অর্থমন্ত্রী বিরক্ত হলেন, “তা হলে ও কেন নিজের লোকেশন দিচ্ছে না? আমরা রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাতে পারি তো!”

“সরি স্যার,” কুমারেশ সামান্য সময় নিল। তারপর বলল, “আসলে স্যার এত বড় শহরে এমন একটা ফেস্টিভ্যালের মাঝে ভ্লাদের মতো কাউকে ট্রেস করা ইজ় টু ডিফিকাল্ট। তাই লোক বাড়ালেও স্যার সাকসেসফুল হওয়ার চান্স কম। বাট আই নো নিকি। খুব এফিশিয়েন্ট। ও মেসেজ করে মোবাইল সুইচ অফ করে দিয়েছে। নিশ্চয়ই তার কারণ আছে। আই নো হার। আমাদের ওর উপর ভরসা রাখা উচিত।”

সুরজিৎবাবু হাত তুলে থামালেন সবাইকে। কারণ টেবিলের মাঝে রাখা স্পিকারটা করকর করছে আবার।

ভ্লাদের গলাটা কেমন যেন ক্লান্ত শোনাল এবার। ও বলল, “থ্যাঙ্কস ফর কামিং মিস্টার জেটলি। আমি ভ্লাদ।”

অর্থমন্ত্রী সময় নিলেন একটু। মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলেন সবাইকে। তারপর বললেন, “কী চাও?”

ভ্লাদ হাসল, “আমি নিজের জন্য কিছু চাই না স্যার। শুধু চাই আপনাদের পিএম একবার যদি এই লালবাজারে এসে কথা বলেন আমার সঙ্গে।”

“কী?” সিএম রাগের গলায় বললেন, “এটা কি ইয়ার্কি পেয়েছ? এক-এক করে সবাইকে এখানে ডাকছ কেন? কী চাই তোমার?”

“ম্যাডাম, আমার কিছুই চাই না। শুধু চাই পিএম একবার আসুন এখানে।”

অর্থমন্ত্রী শান্ত গলায় বললেন, “শোনো, তুমি পিএম-এর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমি দিল্লিতে কানেক্ট করিয়ে দেব। ইউ ক্যান টক।”

“না স্যার, ওঁকে এখানেই আসতে হবে। উনি তো আজ মধ্যপ্রদেশ গিয়েছেন। ওঁকে বলুন সোজা লালবাজারে আসতে। আমার হাতে আর বেশি সময় নেই স্যার। সরি, ভুল বললাম, আপনাদের হাতে আর বেশি সময় নেই।”

“দেশের পিএম-কে এমনভাবে কম্যান্ড করা যায় না। আর আমরা টেররিস্টদের সঙ্গে এভাবে নেগোশিয়েটও করি না!” কুমারেশ রাগের গলায় বলে উঠল।

“আপনি কে?” ভ্লাদের গলাটা আরও ক্লান্ত শোনাল, “শুনুন, মানুষ যদি মারা যায়, তবে তার দায়িত্ব কিন্তু আমি নেব না। এখন আপনাদের ইচ্ছে। আমি আপনাকে এক ঘণ্টার মধ্যে আবার ফোন করব। ততক্ষণে পিএম এলে ভাল, না হলে…”

ফোনটা কেটে গেল আবার। ঘরের ভিতর অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা। যেন কী বলা হবে তাই কেউ বুঝতে পারছেন না।

নিস্তব্ধতা ভেঙে সিএম-ই প্রথম মুখ খুললেন। বললেন, “মিস্টার জেটলি, আপনি পিএম-কে ফোন করবেন না আমি করব?”

২২

রাস্তার পাশের দোকানটা ছোট। তার সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে মিনিটদশেক হল অপেক্ষা করছে অদম্য। আর বাইকের সামনে অস্থিরভাবে ছটফট করছে নিকি।

অদম্য জানে অস্থির হওয়া ছাড়া আর কারও কিছু করার নেই। ভ্লাদ এমন একজন অপরাধী যে, এমন শহরে তাকে ধরার চেষ্টা মানে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো। যতক্ষণ ওর লোকেশনটা জানা যাচ্ছিল, ততক্ষণ চেজ় করা গিয়েছে। কিন্তু লোকটা মাঝে বেশ কিছুক্ষণ ফোন অফ করার পরে আবার একটু আগে কল করেছিল লালবাজারে। তাও সেটা আর-একটা নতুন নাম্বার থেকে, যা আগের মতোই এনক্রিপ্ট করা! সেই এনক্রিপশন ভাঙতে একটু সময় নেবে জন। আর সেই সময়টুকুতে ওদের সবার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

“আয়াম সরি এগেন!” নিকি অদম্যর দিকে তাকাল, “আমি বুঝতে পারিনি ও আমায় এমন শিল্ড করে…”

“ওসব না ভাবাই ভাল,” অদম্য ছোট করে বলল।

“না, মানে হাতে এসেও… ওঃ।” নিকি বাইকের সিটে ঘুসি মারল একটা, “যদি আর-একবার হাতে পাই।”

অদম্য জিজ্ঞেস করল, “তুমি হেড কোয়ার্টার্সে ফিরে যাচ্ছ না কেন?”

নিকি বলল, “কুমারেশ স্যার জানেন আমায়। আর আমি একা ফিরে গিয়ে কী করব? ওখানে বসে ফোনে কথা বলব! পুলিশ, টাস্ক ফোর্স সব্বাই নিজের-নিজের সোর্স দিয়ে লোকেট করার চেষ্টা করছে লোকটাকে। তুমি ট্রাম ডিপোয় আমায় বাঁচিয়েছিলে। তোমায় না চিনলেও আই ট্রাস্ট ইউ। তাই আমি তোমার সঙ্গে থেকে চেষ্টা করছি আমার মতো করে। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কী করে ওখানের কথা শুনতে পারছ? তুমি কিন্তু নিজের পরিচয় দিলে না! কে তুমি?”

অদম্য বলল, “সেটা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। আসল ইম্পট্যার্ন্ট ব্যাপার হল…”

কথাটা শেষ করার আগেই ট্যাবটা কুঁক করে উঠল। অদম্য দ্রুত রিসিভ করল কলটা।

জনের গলা, “মাইট আই হ্যাভ গট হিম। আমি লোকেশনটা তোমায় ট্রান্সফার করছি। বাট হোল্ড ইয়োর হার্ট।”

কলটা কেটে জনের পাঠানো লোকেশনের লিঙ্কে ক্লিক করল অদম্য। সামনের স্ক্রিনে ম্যাপটা একটু সময় নিয়ে খুলল। অদম্য দেখল সেই ম্যাপে লাল একটা ডট ব্লিঙ্ক করছে। এটা ভ্লাদের এখনকার লোকেশন! এইটা!

অদম্যর মনে হল কে যেন ওর পিঠে বরফের ছুরি মেরেছে! মনে হল পেটের মধ্যে যেন ছিটকে উঠল ইল মাছ! ভ্লাদ এখানে! কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব! ওখানে তো… চিন্তাটা শেষ করতে পারল না অদম্য। আচমকা মনে পড়ে গেল একটা কথা। “আমার নাম ভ্লাদ দ্য ইমপেলার!” ইমপেলার! এইজন্য লোকটা এমন সময় নিচ্ছে! এইজন্য ডার্টি বম্ব, একবার আর্নস্তকে শূলে চড়ানো, প্যান্ডেলে বোমা রাখার মতো ব্যাপার ঘটিয়ে ব্ল্যাকমেল করে একে-একে দেশের মাথাদের ডাকছে লালবাজারে! সর্বনাশ!

অদম্য দ্রুত ট্যাবটা অফ করে সরে গেল একপাশে। তারপর নিকির অবাক চোখ থেকে নিজেকে ঘুরিয়ে বের করল ফোনটা। একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল। ওপাশে রিং হয়েই যাচ্ছে। অদম্য চোয়াল শক্ত করল। প্রতিটা মুহূর্ত এখন ভীষণ দামি!

“হ্যালো,” ওপাশের গলাটা শোনা গেল এবার।

“হ্যালো ফাদার।”

অদম্য চোয়াল শক্ত করল।

“ইয়েস ফ্রান্সিস হিয়ার। বলো অ্যাডাম। আমার প্রিমনিশন তবে ফলে গেল?”

২৩

ফিস, অস্ট্রিয়া। পাঁচদিন আগে।

ইয়েনস দেখল আধঘণ্টা পর চিরিচ বেরোল চার্চের পিছনের ছোট কোয়ার্টার থেকে। অ্যাডাম আর ফাদার হাঁটতে-হাঁটতে বড় গেট অবধি এল চিরিচের সঙ্গে। তারপর দু’জনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরাট চেহারার লোকটা গেটের বাইরে রাখা বড় এসইউভি-টাতে উঠে বেরিয়ে এল।

ইয়েনস ঠিক বুঝতে পারে না অ্যাডামের ব্যাপার-স্যাপার। মাসের পর মাস ফিসে দেখা যায় না ওকে। তারপর কোথা থেকে যেন উদয় হয়! থাকে কিছুদিন, তারপর আবার গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু যেটুকু সময় এখানে থাকে সবার সঙ্গে খুব হাসি-ঠাট্টা, মজা করে। অরফ্যানেজের বাচ্চাদের জন্য নানা জিনিস কিনে আনে! সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। ইয়েনস চার্চের কেউ না হলেও ওকেও ডেকে নেয়।

ইয়েনসের খুব ভাল লাগে অ্যাডামকে। কিন্তু ধরেও যেন ধরতে পারে না! খালি মনে হয়, অদ্ভুত এক ধাঁধার নাম এই অদম্য সেন!

ফাদার এগিয়ে এসে ইয়েনসকে বললেন, “যা, বাগানে আর জল দিতে হবে না। আজ অনেক কাজ করেছিস তুই।”

ইয়েনস মাথা নাড়ল। শুনল অ্যাডাম বলছে, “কিন্তু ফাদার, আপনিও যাবেন এবার? কেন?”

ফাদার অ্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মনে হচ্ছে, এবার তোর আমাকে দরকার হবে। ভিঙ্কা থেকে দুটো প্লুটোনিয়াম স্টিক গায়েব হয়েছে। সেটা খুব ভাল লক্ষণ নয়। কোটি সূর্যের তেজ, আলো আর ধ্বংস আনতে পারে এখান থেকে। এটা আমার প্রিমনিশন বলতে পারিস।”

“কিন্তু আপনি তো এসব কোনওদিন বলেননি! মানে এই মনে হওয়ার ব্যাপার-ট্যাপার। আপনার এসব হয় নাকি?” অ্যাডাম অবাক হয়ে তাকাল ফাদারের দিকে, “তা ছাড়া এসব অন্ধকারের কাজ ফাদার। এসবে জড়াবেন?”

ফাদার বললেন, “যতই হোক, আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ অ্যাডাম। হি ওয়র্কস ইন মিস্টিরিয়াস ওয়েজ়। উনিই আমায় বললেন, এবার হয়তো আমিও কাজে লাগতে পারি। চিরিচ যে জন্য এসেছিল সেটা খুব সহজ কাজ নয় অ্যাডাম। আর জানবি একজনের চেয়ে দু’জন সবসময় বেশি এফেক্টিভ। তবে আমি ছায়ার আড়ালে থাকব। একমাত্র তোর ইশারা পেলেই আমি বেরিয়ে আসব সেই ছায়া থেকে। আর অন্ধকারের কাজ বলছিস! মানুষের ভালর জন্য মাঝে-মাঝে অন্ধকারেও যে নামতে হয় অ্যাডাম।”

২৪

এখন। কলকাতা।

“ইয়ে ভ্লাদ হ্যায় কৌন?” চেয়ারটা টেনে বসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন পিএম।

সারা ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এল যেন। আসলে সত্যি তো, কে লোকটা! কী চায়? শুধু এক-এক করে দেশের সব বড় নেতাদের ডেকে এনেছে এই লালবাজারে। গোটা দেশের প্রেস থেকে শুরু করে মানুষ, সবাই অবাক হয়ে গিয়েছে। মহাষষ্ঠীর কলকাতার বিকেল যেন শ্মশান হয়ে গিয়েছে হঠাৎ। মানুষজন বাইরে বেরোতেই ভয় পাচ্ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার ওই পুজো প্যান্ডেলে বোমা পাওয়ার পর থেকে সেই ভয়টা আরও বেড়েছে।

মধ্যপ্রদেশ সফর মাঝপথে বন্ধ রেখে সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে একটু আগেই এসেছেন পিএম। গোটা লালবাজার চত্বরে পুলিশ, স্পেশাল টাস্ক ফোর্স আর এনএসজির লোকে গিজগিজ করছে। শহরে যেন যুদ্ধের পরিস্থিতি। কেউ জানে না এরপর কী হতে চলেছে।

সঞ্জয়বাবু বললেন, “স্যার, আমরা এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে স্টেশন, বাস টার্মিনাস সবকিছুর সিকিউরিটি ফুটেজ চেক করেছি। কিন্তু কিছুতেই কোনও খোঁজ পাইনি। আর এখন শহরে সারা বছরই প্রচুর বিদেশি আসা যাওয়া করে। তাদের সবাইকে ক্রসচেক করতে মিনিমাম দু’-তিনদিন লাগবে। কিন্তু অত সময় তো আর নেই! প্যান্ডেলে যে ছেলেটা এই ভ্লাদের সঙ্গে কথা বলেছিল তাকে আমরা নিয়ে এসেছি। স্কেচ আর্টিস্ট স্কেচ করছে। কিন্তু সেটা কতটা হেলপফুল হবে জানি না। লোকটা যেন উবে গিয়েছে পুরো!”

সিএম এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এবার বললেন, “গোটা শহরের প্রত্যেকটা জায়গায় আমরা যতটা পেরেছি পুলিশ পোস্টিং করিয়েছি। খোঁজও চলছে। সকালের ওই ডার্টি বম্বটা আবার যে কোথাও ফাটবে না তার তো গ্যারান্টি নেই। আপনাদের কি মনে হয় আর্মিকে ডাইরেক্ট ইনভলভ করতে হবে এবার?”

কুমারেশ বললেন, “স্যার, আপনি যদি বলেন আমি ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে পারি। গিয়ে…”

পিএম হাত তুললেন, “শিওর, আপনি যান। আমি বলে দিচ্ছি। টেক অল পসিবল মেজ়ারস। মানুষ ভয় পেয়েছে। আসলে ডার্টি বম্বটা যতটা না ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন, তার চেয়ে বেশি ওয়েপন অফ মাস ডিসরাপশন! তাই এটা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। পসিবল সব কিছু করুন। তবে ফাস্ট।”

কুমারেশ মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আর সঙ্গে-সঙ্গে টেবিলে রাখা স্পিকারটা জীবন্ত হয়ে উঠল আর একবার।

ভ্লাদের গলাটা যেন আরও শান্ত শোনাল এবার, “গুড আফটারনুন স্যার। থ্যাঙ্কস ফর কামিং।”

পিএম তাকালেন সবার দিকে। তারপর বললেন, “তুমি কে? আর ঠিক কী চাও? লুকোচুরি অনেক হয়েছে। এবার সত্যিটা বলে ফেল।”

ভ্লাদ হাসল, “স্যার, আমার ডিম্যান্ড সিম্পল। আপনি, দেশের প্রধান হিসেবে এটা করতেই পারেন।”

“কী চাও?” পি এম স্থির গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“দুশো মিলিয়ন ডলারস। জাস্ট দুশো মিলিয়ন ডলারস দিন আমায়। আর কিছু চাই না।”

“দুশো মিলিয়ন!” পি এম বললেন, “শেষ পর্যন্ত তা হলে টাকা চাই তোমার! এত যে ড্রামা করলে, তার শেষটা এই! টাকা! অর্থাৎ পেটি থিফ ছাড়া তুমি তবে আর কিছু নও!”

“সে আপনি যা ভাবুন। ওটা আমার চাই।”

“তুমি পাগল? এইজন্য তুমি মানুষ মারছ? এক-এক করে সবাইকে ডেকে আনছ!”

ভ্লাদ শান্ত গলায় বলল, “স্যার, আমি ডিবেট করব না। আমি কী করেছি, কেন করেছি, পরে বুঝবেন। ডিবেট করা আমার কাজ নয়। এখন তিরিশ মিনিট আছে আপনার হাতে। তিরিশ মিনিট পরে আপনাকে আবার ফোন করব। একটা অফশোর শেল কোম্পানির কোড দেব। তারপর আমার দেওয়া সময় হিসেবে আপনারা তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে দেবেন। কেমন?”

সি এম ঝুঁকে পড়ে বললেন, “তুমি কী ভেবেছ? এসব করে নিশ্চিন্তে ছাড় পেয়ে যাবে?”

ভ্লাদ ঠান্ডা গলায় বলল, “আপনারা তিরিশ মিনিটের দিকে কনসেনট্রেট করুন। আর আমি নিজের কথা ভাবছি না একটুও। কারণ, আয়াম অলরেডি ডাইং।”

২৫

এখন বিকেল। তবে আজ দিনটা যেহেতু অন্যান্য দিনের মতো নয়, তাই প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে সেই ভিড়টা নেই। তবু কয়েকজন ছেলে-মেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আর আছে পুলিশ।

ফাদার দু’জন পুলিশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাঁটার গতি বাড়ালেন না। বরং স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটতে-হাঁটতে এগোলেন সামনে। সাধারণ ট্যুরিস্টের পোশাকেই এসেছেন ফাদার। তার ওপর বয়স্ক মানুষ। তাই বোধহয় পুলিশগুলো তাঁকে দেখেও বিশেষ পাত্তা দিল না।

ফাদার চক্ররেলের লাইন টপকে সামনে এগোলেন। তারপর ডানদিকে মোড় নিয়ে এবার হাঁটার গতি বাড়ালেন। একবার ঘড়িটা দেখলেন। সময় বেশি নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

বাঁধানো রাস্তা দিয়ে এগোতে-এগোতে ফাদার চারপাশটা মেপে নিলেন দ্রুত। সেই অল্প বয়সে সেনাশিবিরে থাকার সময় পাওয়া ট্রেনিং এখনও কাজে লাগছে ওঁর! সেই যুদ্ধের উত্তেজনা যেন আজও টের পাচ্ছেন শরীরে!

বাঁদিকে বয়ে চলেছে গঙ্গা। অল্প হাওয়া দিচ্ছে। ঢেউ উঠেছে জলে। পাড়ে বাঁধা নেভির ছোট বোটটা দেখতে পেলেন ফাদার।

সামনে জালের দরজা। তালা দেওয়া। ভিতরে একজন বসে রয়েছে। সেই লোকটাই বোট অবধি যাওয়ার সরু পথটার রক্ষক।

ফাদার আর একবার দেখে নিলেন চারপাশ। এদিকটা আজ শুনশান। এটাই সুযোগ।

আচমকা ‘আঃ’ বলে চিৎকার করে ফাদার নিজের বুকটা চেপে শুয়ে পড়লেন বাঁধানো রাস্তার পাশে।

জালের ভিতর থেকে লোকটা ফিরে তাকাল। দেখল, একজন বৃদ্ধ বুক চেপে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন পথে। লোকটা দ্রুত নিজের জালের ঘরের চাবি খুলে বেরিয়ে এল। তারপর ফাদারের কাছে এসে উপুড় হয়ে বসল।

হাত দিয়ে ধাক্কা দিল ফাদারকে, “এই যে দাদা, এই যে।”

ফাদার হঠাৎ ছিটকে উঠে বসলেন তারপর হাতের আড়ালে ধরা একটা সিরিঞ্জ গেঁথে দিলেন লোকটার ঘাড়ে। লোকটা ভূত দেখার মতো থমকে তাকিয়ে রইল ফাদারের দিকে। পাঁচ সেকেন্ড। লোকটা ধীরে-ধীরে নেতিয়ে পড়ল পথে। ফাদার জানেন মোটামুটি এক ঘণ্টার আগে ঘুম ভাঙবে না।

“সরি মাই সন। ফরগিভ মি প্লিজ়!” ফাদার লোকটার মাথায় আলতো করে হাত বোলালেন, তারপর দুটো পা ধরে টেনে পাশের ঝোপের মধ্যে শুইয়ে দিলেন দ্রুত।

লোকটার কোমরের চাবির গোছাটা নিয়ে এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ফাদার। আজ বহু বছর পরে আবার মোটরবোট চালাবেন! পারবেন তো!

২৬

মাথায় লাগানো ছোট্ট আলোটায় সামনের পথটা দেখা যাচ্ছে। গোল সুড়ঙ্গ। উপর থেকে টিপটিপ করে জল পড়ছে।

নীচেও গোড়ালি-ডোবা জল। পিস্তলটা হাতে নিয়ে এগোচ্ছে অদম্য। ওর সামনে নিকি। অদম্যর শরীরের সমস্ত পেশি সজাগ হয়ে রয়েছে। ও ভাবতেই পারেনি এমন করে ওকে কলকাতার পেটের ভিতর ঢুকতে হবে।

জনের থেকে ভ্লাদের লোকেশনটা পেয়ে প্রথমে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল অদম্য। এটা কী করে সম্ভব! কারণ জনের লোকেশনটা দেখাচ্ছিল লালবাজার! ও ভেবেছিল, লালবাজারে সবার মধ্যে বসে রয়েছে ভ্লাদ? সবার চোখের সামনে? এটা কী করে হয়!

কিন্তু তারপরেই ভুল ভেঙেছিল ওর। ভ্লাদের মোবাইল থেকে আসা শব্দের ডেপথ অ্যানালিসিস গ্রাফটা দেখে চমকে উঠেছিল আর একবার। আর সঙ্গে-সঙ্গে গোটা দিন ধরে চলা এই লুকোচুরি খেলার পুরো ছকটা সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ওর!

ভ্লাদ বসে রয়েছে লালবাজারের মাটির নীচে দিয়ে যাওয়া স্যুয়ারের মধ্যে!

ভ্লাদ জানত ডার্টি বম্ব এক্সপ্লোড করলে দেশের সবার টনক নড়বে। আর তখন ওর কথার গুরুত্ব দেবে সবাই। ওর কথা শুনবে। আর সেটা হয়েওছে। লালবাজারে জড়োও হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। আসলে ভ্লাদের প্ল্যানটাই হল এটা। এবার লালবাজারের মাটির তলার এই আন্ডারগ্রাউন্ড স্যুয়ারে ধান্যদহের বর্ডার দিয়ে স্মাগল করে আনা পোর্টেবল নিউক্লিয়ার বোমাটা ফাটিয়ে সবাইকে এক সঙ্গে মেরে ফেলতে চায় ও! ভিঙ্কা থেকে আনা প্লুটোনিয়াম স্টিকটা যে এই নিউক্লিয়ার বম্ব বা নিউকটায় ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছে অদম্য! বুঝতে পারছে গোটা দেশে যদি এমন একটা কাণ্ড ঘটে, তবে এই ডামাডোলের সুযোগ নেবে দেশের শত্রুরা। আসলে দেশে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতেই ভ্লাদকে ব্যবহার করেছে শত্রুপক্ষ। তারা বোঝাতে চায় যে তাদের কথা না মানলে এই ফল হবে।

অদম্য বুঝতে পারছে হাতে আর সময় নেই। ও আর্ম-এ আটকানো ছোট ট্যাবটা দেখল। সামনের বাঁদিকে একটা গলি, ভ্লাদের লোকেশন ওখানেই দেখাচ্ছে।

অদম্য চোয়াল শক্ত করল। মাটির প্রায় ছ’মিটার নীচে এই ইটের তৈরি স্যুয়ার সুড়ঙ্গ। গোটা কলকাতা শহরের ময়লা এর সাহায্যেই সবার অলক্ষ্যে গিয়ে পড়ে নদীতে। সেই ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল। বর্তমানে এর বেশ কিছুটা রেনোভেট করা হয়েছে। ইটের উপর গ্লাস রি-এনফোর্সড পলিমার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাও পুরো কাজ হয়নি।

ভ্লাদ যে এভাবে এই মাটির তলার সুড়ঙ্গ পথকে ব্যবহার করবে সেটা ভাবতেই পারেনি অদম্য! লালবাজারের তলার স্যুয়ারে বোমা ফাটলে দু’তিন কিলোমিটার রেডিয়াস নিয়ে পুরো মাটি বসে যাবে। সঙ্গে তেজষ্ক্রিয়তা তো আছেই! ফলে আশেপাশের সবকিছু, এমনকী রাজভবনও রেহাই পাবে না। অদম্য নিজেকে স্টেডি করার চেষ্টা করল। সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ এখন। মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।

নিকি এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অদম্যও গতি বাড়িয়ে ধরল ওকে। তারপর একসঙ্গে ঘুরল বাঁদিকের সুড়ঙ্গ দিয়ে। আর ঘুরেই দু’জনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল একদম।

“কাম মাই ডিয়ার। কাম।”

মাথার হেলমেটে লাগানো ঘষা হলদেটে আলোয় অদম্য দেখল সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই লোকটা! দেখেই মনে হল যেন পুড়ে যাওয়া অন্ধকার দিয়ে তৈরি একটা মানুষ! এই আবছায়াতেও লোকটার নীল চোখ দুটো যেন জ্বলছে! যেন সারা জীবন অদম্যর জন্যই এখানে নরক সাজিয়ে অপেক্ষা করছে! ও দেখল হাতের পিস্তল ওর মাথার দিকে তাগ করে ফণা-তোলা সাপের মতো অল্প-অল্প নড়ছে ভ্লাদ!

ভ্লাদের পিছনেই একটা হুইলচেয়ার। সেখানে কে যেন বসে রয়েছে। আবছায়ার জন্য দেখা যাচ্ছে না মুখ। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে বসে থাকা মানুষটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে চেয়ারটার সঙ্গে।

ভ্লাদ হাসল, “অ্যাট লাস্ট আমাদের দেখা হল। তোমায় আমি অনেক আগেই মেরে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি চাইছিলাম তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে। প্যান্ডেলে তো সময়ই দিলে না!”

অদম্য চোয়াল শক্ত করল, বলল, “টাকাটা তো ডিকয়। তাই না? আসলে তো তুমি চাইছিলে এঁদের সবাইকে এক জায়গায়। তারপর এই স্যুয়ার থেকে বোমা মেরে…”

ভ্লাদ কথাটা শেষ করতে দিল না অদম্যকে। বলল, “ইয়েস আই উইল ইমপেল দেম ফ্রম বিনিথ! এতক্ষণে বুঝেছ তো আমার প্ল্যান কী! হ্যাঁ, দেশের মাথাদের এক জায়গায় জড়ো করেছি আমি। এক সঙ্গে মারব বলেই করেছি। এই টাকাটা ওঁরা দেবেন না, আমি জানি। কিন্তু আমার এই সময়টুকু দরকার ছিল বোমাটা আর্ম করার জন্য। এখন আমার কাজ কমপ্লিট। এখন ওঁদের নিজের প্রাণটা দিতে হবে!”

অদম্য কিছু না বলে তাকিয়ে রইল।

ভ্লাদ আবার বলল, “সবাইকে একসঙ্গে মারলে ইন্ডিয়া উইল বি আ হেডলেস নেশান। এই সুযোগে এই দেশের নর্থ, নর্থ-ইস্ট সব আমরা কেটে নেব। আজ কেক কাটার দিন! লাস্ট দু’বছর আগে চায়নার ডিম্যান্ড মতো ওঁরা নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের লঞ্চ কোডটা দেননি। কী ভেবেছিল সবাই, সেখানেই থেমে থাকবে? তখন জয়কুমারকে মেরে দিলেই সব সমাধান হয়ে যাবে! আজ দেখবে, গল্প কী করে শেষ হয়! তোমরা কি ভেবেছ যারা সাউথ-ইস্টের দখল চায় তারা ভারতকে ইকোয়েশান থেকে সরাতে চাইবে না?”

অদম্য নিকিকে দেখল। চোয়াল শক্ত। পিস্তলটা তাগ করে রয়েছে সামনে। আবার মেয়েটা দুম করে কিছু করে না বসে!

ও বলল, “কিন্তু কী হবে নিরীহ মানুষকে মেরে?”

“আমি জানি এই বেঁচে থাকায় কিছুতেই কিছু হয় না। জানি, লাইফ ইজ় আ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অফ সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি, সিগনিফাইং নাথিং,” ভ্লাদ হাসল, “কিন্তু মরার আগে কিছু তো করে যেতে হবে। আমি বড়জোর আর দু’মাস বাঁচব। আমার ব্রেনে টিউমার, ম্যালিগন্যান্ট। ইটস টিকিং লাইক আ টাইম বম্ব। তাই যাওয়ার আগে আমায় তো পরিবারের জন্য কিছু করে যেতে হবে! এই কাজের জন্য আমায় ওরা যত টাকা দিয়েছে তাতে আর কিছু ভাবতে হবে না আমায়। নাও আয়াম ফ্রি ব্রাদার।”

“আর ও?” নিকি হিসহিসে গলায় হুইলচেয়ারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

“আদিল নিউ টু মাচ। তাই ওকে তুলতে হল। তুমি কি ভাবছ ভেতরের হেলপ ছাড়া আমি এতটা এলাম? আমায় মোবাইল থেকে পুলিশ ট্রেস করতে পারল না কেন? কারণ ভেতর থেকেই ওদের সফটওয়্যার বাগ করে সেটা করতে দেওয়া হয়নি,” ভ্লাদ চোয়াল শক্ত করল, “আদিলের পিঠে ঝোলানো ব্যাগটায় পোর্টেবল নিউকটা রয়েছে। টাইমার দেওয়া। আর সময় আছে বড় জোর পাঁচ মিনিট।”

“প্লিজ়,” অদম্য এগোল দু’পা, “এটা কোরো না। প্লিজ়।”

ভ্লাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “ইটস ডান। আমার কাজও শেষ। আর এখান থেকে তোমরা বেরোবার সময় পাবে না। তোমায় যারা প্লুটোনিয়াম স্টিক দুটো উদ্ধার করতে পাঠিয়েছে তাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। ইউ হ্যাভ ফেইল্ড। আর আদিলের থেকে পাওয়া এই পেনড্রাইভটা আমি এই বুকপকেটে রখলাম। সবকিছুর সঙ্গে এটাও ধ্বংস হয়ে যাবে! মাঝে-মাঝে হিরোকে বড় কাজের জন্য রাক্ষস হতে হয়। সেই রাক্ষসটার গল্প এবার শেষ হল। বাই।”

আচমকা অদম্যকে কিছু করতে না দিয়ে নিজের থুতনির নিচে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টানল ভ্লাদ। ফট করে শব্দ হল একটা। তার সঙ্গে রক্ত আর মাংস ছিটকে গিয়ে লেপটে গেল স্যুয়ারের ছাদে। ও কাটা গাছের মতো উপুড় হয়ে পড়ে গেল মাটিতে!

ভ্লাদ সরে যাওয়ায় এবার আদিলকে স্পষ্ট দেখতে পেল অদম্য। দেখতে পেল ওর পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা!

ওটাকে আগে ডিফিউজ় করতে হবে। অদম্যর কাছে সার্কিট-ডেসট্রয়িং ট্রেজ়ার আছে। এই যন্ত্রটা দিয়ে হাই ভোল্টেজ কারেন্ট বেরোয়। যার সাহায্যে কোনও বম্বের ডিটোনেটিং সার্কিট পুড়িয়ে সেটাকে নষ্ট করে দেওয়া যায়। বোমাটা নষ্ট করে পেনড্রাইভটাও নিতে হবে।

ঘড়ি দেখল অদম্য। আর মিনিট তিনেক সময় আছে। ও এগোতে গেল। আদিলের দিকে।

“ডোন্ট!”

অদম্য থমকে তাকাল পাশে। দেখল আবছা আলোর ভেতরে নিকি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আর নিকির পিস্তলটা সোজাসুজি ওর মাথার দিকে তাক করা!

২৭

পিএম চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে রইলেন একটু। এসি চললেও সবার কপালেই ঘামের ফোঁটা!

“স্যার, আমার মনে হচ্ছে, লোকটার মোটিভটা কিন্তু আসলে টাকা নয়!” সুরজিৎবাবু আলতো করে বললেন।

পিএম চশমাটা পরে নিলেন আবার। তারপর বললেন, “আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু আর কী হতে পারে!”

হোম মিনিস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “কেন এমন মনে হচ্ছে আপনার?”

পিএম বললেন, “লোকটা এই যে গোটা একটা অ্যাটমোস্ফিয়ার ক্রিয়েট করল, তারপর জাস্ট টাকা চাইবে! ব্যাপারটা খুব প্রেডিকটেবল হয়ে গেল না?”

“তা হলে?” সঞ্জয়বাবু বললেন, “আর কী মোটিভ হতে পারে?”

“হয়তো ও আরও বড় কিছু প্ল্যান করছে! হয়তো…” এবার সিএম আচমকা দাঁড়িয়ে উঠে তাকালেন সুরজিৎবাবুর দিকে, “একটা জিনিস লক্ষ করলেন কি? নানা ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে। কিন্তু কেন? ও কেন আমাদের সবাইকে একসঙ্গে চাইছে এখানে? ওর উদ্দেশ্যটা কী? সুরজিৎবাবু আপনি দ্রুত সবাইকে এখান থেকে সরাবার বন্দোবস্ত করুন। আর দেখুন কোনও দিক থেকেই যেন লালবাজারের ওপর আক্রমণ না হয়! ব্যাপারটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না।”

২৮

পিস্তলটা অদম্যর দিকে তাক করে পায়ে পায়ে হুইলচেয়ারের দিকে পিছিয়ে গেল নিকি।

“তুমি!” অদম্য কী বলবে বুঝতে পারল না।

নিকি হাসল, “আ টুইস্ট অ্যাট দ্য টেল! তাই না! কী ভেবেছ তুমি হিরো হবে? তুমি বাঁচাবে সবাইকে? আমরা মরব বলেই এসেছি। কিন্তু তার আগে উই উইল ক্রিয়েট লাইট। এই দেশটাকে জ্বালিয়ে আমরা অন্য আলো তৈরি করব। আর মিনিটখানেক মাত্র। বুঝেছ?”

নিকি গিয়ে দাঁড়াল চেয়ারের পাশে। সামান্য হাসল। বলল, “ভ্লাদ একা নয়। আমরা আছি। শেষ অবধি আছি। টম যে মরবে সেটা জানতাম। কিন্তু তুমি যে আসবে… হিসেবটা একটু গুলিয়ে দিয়েছিলে তুমি, তাই তোমার সঙ্গে আমার থাকাটা জরুরি ছিল। তবে এবার তোমার কাজ শেষ হয়েছে। আমরা একসঙ্গে আলোয় মিশে যাব। কেমন?”

অদম্য বলল, “তাই তুমি পালাতে দিয়েছিলে ভ্লাদকে!”

নিকি বলল, “টিমগেম। তবে আর নয়। মাথার ওপর যাঁরা রয়েছেন তাঁরা সমেত এবার আমাদের সময় হয়ে এল। দু’ কিলোমিটার রেডিয়াসে মাটির ওপরের শহরটা আজকের পরে ‘নেই’ হয়ে যাবে। আজকের পরে…”

কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না নিকি। এই আবছা হলুদ আলো-ছায়ার মধ্যে আচমকা নিকির পেছনের হুইলচেয়ারটা নড়ে উঠল সামান্য। অদম্য দেখল বসে থাকা আদিল আচমকা একটা পা দিয়ে মারল নিকির গোড়ালিতে। হঠাৎ আঘাতে বেসামাল হয়ে গেল নিকি। এটাই সুযোগ। অদম্য পিস্তলটা তুলল দ্রুত।

টিউব। টিউব।

আগুন ঝলসে উঠল দু’বার। নিকি ফ্রিজ় করে গেল মুহূর্তের জন্য। যেন বিশ্বাস করতে পারল না কী হল।

তারপর ধীরে-ধীরে খসে পড়ল মাটিতে।

অদম্য দ্রুত নিজের পিঠের ব্যাগ থেকে ট্রেজ়ারটা বার করে এগিয়ে গেল সামনে। মাথার আলোয় এবার স্পষ্ট হল আদিলের মুখ। মার খেয়ে ফুলে নীল হয়ে আছে মুখটা। দুটো চোখ প্রায় বন্ধ। অদম্যর মাথায় লাগানো আলো চোখে পড়ায় মুখ কুঁচকে গেল আদিলের।

অদম্য দ্রুত চেয়ারের হাতল ধরে ঘোরাল আদিলকে। তারপর পিঠে ঝোলানো পোর্টেবল নিউকের ব্যাগের চেনটা সাবধানে টানল। দেখল ভেতরের ঘড়িটার সময় কমে আসছে দ্রুত। দেখল ওর হাতে আর কুড়ি সেকেন্ড মতো সময় পড়ে আছে!

২৯

লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল মিস্টার রাই। সঙ্গে আরও চারটে বোট আসছে। মাথার ওপর হোভার করছে হেলিকপ্টার। টেনশনে রাইয়ের মাথা দপদপ করছে। সত্যিই কি এমনটা হয়েছে?

দশ মিনিট আগে লালবাজারে একটা মেসেজ এসেছে। বলা হয়েছে ক্যানিং স্ট্রিট আর স্ট্র্যান্ড রোডের ক্রসিংয়ের পাশেই যে পেনস্টক আছে, মানে যে ভালভ লাগানো গেট দিয়ে মাটির তলার স্যুয়ার থেকে কলকাতার ময়লা জল নদীতে পড়ে, সেখানে আসতে। সেখানে ‘আসল’ জিনিস আছে!

লালবাজার থেকে গঙ্গার এই অংশটা কাছে। তাও বোট জোগাড় করে এতটা আসতে দশ মিনিটের মতো সময় লেগে গিয়েছে।

রাই দেখল সামনের নদীতে বেশ কিছু স্টিমার আর বার্জ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার ভেতরেই নেভির ছোট্ট সাদা একটা মোটরবোট দোল খাচ্ছে। সেই বোটে কেউ একজন বসে রয়েছে।

পাশে দাঁড়ানো সুরজিৎবাবুকে সেই দিকে হাত তুলে দেখাল রাই। বলল, “ওই দেখুন।”

সুরজিৎবাবু দূরবীন চোখে লাগিয়ে অস্ফুটে চিৎকার করে উঠলেন যেন, “মাই গড! আদিল!”

স্টিমারটা গিয়ে বোটের পাশে লাগানো মাত্র এন এস জি-র এক কম্যান্ডো ছোট্ট বোটটায় লাফ দিয়ে উঠল। রাই নিজে গেল পেছন পেছন।

সত্যি, আদিল! তবে হুঁশ প্রায় নেই। শুধু ঠোঁট নেড়ে কিছু বলতে চাইছে।

রাই ঝুঁকে পড়ল আদিলের ওপর, “কিছু বলবে?”

আদিল জড়ানো গলায় বলল, “স্যার, স্যুয়ারের ভেতর… বডি… টেররিস্ট…”

সুরজিৎবাবুও ঝুঁকে পড়েছিলেন। কথাটা শোনা মাত্র বললেন, “মাই গড! ম্যাডাম ঠিকই বলেছিলেন!”

আদিল কোনওমতে বলল, “এখন… এখন সব সেফ স্যার। ডেঞ্জার… ভ্লাদ ইজ় ওভার…”

রাই আদিলের পাশে রাখা ব্যাগটা দেখলেন এবার। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন ছিটকে উঠলেন। পোর্টেবল নিউক্লিয়ার বম্ব! সর্বনাশ। এটা ফাটাবার তালে ছিল ভ্লাদ! রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পর এমন অনেক নিউক সারা পৃথিবীর ব্ল্যাক মার্কেটে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা নিশ্চয়ই তারই একটা!

এটা কি এখনও জীবন্ত? রাই ঝুঁকে পড়ল। দ্রুত হাতে ব্যাগের চেনটা খুলল। আবার অবাক হওয়ার পালা। দেখল বোমাটার গায়ে ছোট্ট একটা স্টিকিং নোট। লেখা- “বম্ব ডিফিউজ়ড। বাট দ্য প্লুটোনিয়াম ইজ় গোয়িং ব্যাক টু ইটস ওনার।”

মিস্টার রাই চিরকুটটা নিয়ে তাকাল সুরজিৎবাবুর দিকে। সুরজিৎবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর নিজের মনেই বললেন, “এবারও কি সে এসেছিল? এবারও কি সেই বাঁচিয়ে দিয়ে গেল শহরটাকে?”

৩০

দু’দিন পর। জয়পুর।

ছোটবেলায় একবার জঙ্গলের ভেতরে একটা গুহায় ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছিল ও। অন্ধকারের মধ্যে বুঝতে পারছিল না কোন পথ দিয়ে বাড়ি ফিরবে! গোটা দিন ও পাগলের মতো খুঁজেছিল ফেরার পথ। শেষে হতোদ্যম হয়ে গুটিসুটি মেরে বসেছিল একটা পাথরের ওপর। আর ভেবেছিল, শেষে এভাবে মারা যাবে ও? জীবনে এত কিছু পাওয়ার আছে! এত কিছু আনন্দ করার আছে! সেসব কিছুই করতে পারবে না! ভেবেছিল, ও যদি আর-একটা সুযোগ পেত তবে পৃথিবীর সব ভাল জিনিস অভিজ্ঞতা করে নিত একবার!

আজও তাই-ই মনে হয় ওর। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও বোঝে, ভাল জিনিসগুলো একটা ঘরে বন্ধ হয়ে থাকে। সেই ঘরটা খুলতে গেলে একটা ম্যাজিক চাবি লাগে। আর সেই ম্যাজিক চাবির নাম হল টাকা! তাই সেটাই ও এখন রোজগার করছে সাদা-কালো নানা উপায়ে! এ জীবনে কোনও আফসোস রাখতে চায় না ও!

রেস্তরাঁটা বেশ বড়। তবে দুপুরের দিকটা ফাঁকাই থাকে। তাই এখানেই মিটিংটা ফিক্স করেছে ও। যদিও কলকাতায় অত বড় ঘটনার পরে-পরেই এমনভাবে ঋগের সঙ্গে দেখা করতে ও চায়নি। কিন্তু ঋগ-ই জোর দিয়েছে দেখা করার ব্যাপারে। কারণ কর্নেল শ্যাং ওয়েই আর অপেক্ষা করতে চায় না।

কলকাতায় ভ্লাদকে ওরা অ্যাপয়েন্ট করেছিল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনেতাদের এক জায়গায় জড়ো করে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ভ্লাদ গোটা কাজটা দারুণভাবে করলেও শেষ মুহূর্তে কী করে যে সব গন্ডগোল হল এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না ও!

তবে এবার যা প্ল্যান হয়েছে সেটা ফুল প্রুফ। এবার আর ভুল হবে না। সামনের দিওয়ালিতে দেশ নতুন রকম আলোয় সাজাবে!

“কী হল? তোমার ড্রিঙ্ক তো শেষ!” ঋগের কথায় মুখ তুলে তাকাল ও।

ঋগ বলল, “এবার লাস্ট চান্স কিন্তু। এই রাখো মেমরি স্টিক। এতে পুরো প্ল্যান বলা আছে। প্লাস টু মিলিয়ন ইউ এস ডলারের ট্রান্সফার কোডটাও দেওয়া আছে। কাজ শেষ করতে পারলে আরও…”

“ডু ইউ ওয়ন্ট টু হ্যাভ সাম মোর ওয়াইন স্যার?” একটি ওয়েটার হাতে ন্যাপকিন জড়ানো বোতল এনে দাঁড়াল সামনে।

ও বলল, “ইয়েস।”

ছেলেটা ঋগ, শ্যাং আর ওর গ্লাসে ঢেলে দিল ওয়াইন। তারপর সরে যেতে গিয়ে ওয়েটারটির হাতটা যেন কেঁপে গেল সামান্য। একটু ওয়াইন চলকে পড়ল টেবলে।

“হোয়াদ্দা হেল!” ঋগ বিরক্ত হল।

“এক্সট্রিমলি সরি স্যার।” ওয়েটারটি দ্রুত হাতে ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নিল তরলটুকু। তারপর মাথা নামিয়ে সরে গেল।

ও বলল, “কিন্তু মিস্টার ঋগ, এত তাড়াতাড়ি সেকেন্ড অ্যাটাক করতে গেলে…”

“কোনও কিন্তু নয়,” ঋগ রেগে গেল এবার, “তখন থেকে দেখছি তুমি ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করছ! আগের টাকাটা তো হজম করে ফেলেছ! মিস্টার ওয়েই কি তা ফেরত চেয়েছেন? তোমার লজ্জা করে না?”

“কিন্তু ওরা যদি এবার আমায় সন্দেহ করে?”

“আগে করেছে কি? তুমি তো গোটা সময়টা লালবাজারেই ছিলে ওদের সঙ্গে!”

“পুরো সময়টা ছিলাম না। ভ্লাদ যে সময়টা বোমাটা ফাটাবে তার একটু আগেই…” ও হাসল এবার।

কথাটা সত্যি! ওই একটু আগেই তো ও বেরিয়ে গিয়েছিল লালবাজার ছেড়ে। খুব যেন চিন্তিত এমন ভান করে ও তো পিএম-এর অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম যাবে বলে। কেউ তো বুঝতেই পারেনি গোটা অপারেশনটায় ভ্লাদকে আড়াল থেকে সাহায্য করে চলেছে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের চিফ মিস্টার কুমারেশ শর্মা!

কুমারেশই নিকিতাকে রিক্রুট করেছিল। একদম সুইসাইড স্কোয়াডের মেয়ে। সময়ে-সময়ে নিকিতা ঠিকই খবর পাঠাচ্ছিল ওকে। যদিও সেটা ও কাউকে বলেনি। কিন্তু ওই মাটির তলায় ঢোকার পর যে কী হল এখনও বুঝতে পারছে না।

আর-একটা ব্যাপার নিয়েও টেনশনে আছে কুমারেশ। ভ্লাদকে দিয়ে ওরাই আদিলকে কিডন্যাপ করিয়েছিল। কিন্তু এখন আদিলকে ফেরত পাওয়া গেলেও আদিলের কাছে থাকা পেনড্রাইভটা পাওয়া যাচ্ছে না! সেটা কোথায় গেল!

সেটাতে সত্যিই কি ওর, ঋগ আর শ্যাং ওয়েই-এর আগের কথোপকথনের প্রমাণ আছে?

ওয়াইনটা তুলে অনেকটা একেবারে খেয়ে নিল কুমারেশ। তারপর টেবিলে রাখা মেমরি স্টিকটা নেবে বলে হাত বাড়াল। আরে স্টিকটা কই! এখানেই তো ছিল একটু আগে। দ্রুত প্লেট, গ্লাস সরিয়ে দেখল কুমারেশ। নেই! আশ্চর্য! ঘেমে উঠল কুমারেশ।

শ্যাং বলল, “কী হয়েছে?”

“মেমরি স্টিক! এখানেই তো ছিল!” কুমারেশ ঠোঁট চাটল। গলাটায় কেমন একটা হচ্ছে!

“আরে তাই তো!” ঋগ অবাক হয়ে টেবিলের তলায় দেখবে বলে ঝুঁকল। কিন্তু আটকে গেল যেন! তারপর আচমকা উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল চেয়ার থেকে।

“আরে! হোয়াট হ্যাপেন্ড?” কুমারেশ ঝুঁকে পড়ে কাঁধটা ধরল ঋগের। কিন্তু কিছু বলার আগেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল ওর! গলায় যেন চেপে বসল ফাঁস! চোখের সামনে নেমে এল অন্ধকার! ছোটবেলার সেই গুহাটা যেন ফিরে এল আবার!

জ্ঞান হারাবার ঠিক আগে কুমারেশ যেন দেখতে পেল পাশের সিটে বসা শ্যাং সিলিংয়ের দিকে মুখ করে বসে রয়েছে পাথর হয়ে।

৩১

রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে মনে-মনে হাসল ও। পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল মেমরি স্টিকটা। ওয়াইনটা টেবিল থেকে মোছার সময় ওটা নিখুঁতভাবে তুলে নিয়েছিল ও। ওরা নিজেদের মধ্যে কথায় এতটাই মশগুল ছিল যে কেউ বুঝতেই পারেনি। টু মিলিয়ন ডলারটা কাজে লাগবে বাচ্চাদের!

পুরো ব্যাপারটায় যে ভেতরের কোনও মানুষের যোগ রয়েছে, সেটা বুঝতেই পেরেছিল ও। তারপর কুমারেশ যখন লালবাজার থেকে বেরিয়ে গেল তখনই ওকে সন্দেহ হয়েছিল। তাই এই ক’দিন চোখে চোখে রেখেছিল ওকে। তবে ভাবতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি লোকটা আবার শয়তানি শুরু করবে।

কিন্তু এখন কুমারেশ ও তার পার্টি সব কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে। ওই ওয়াইনটা খাওয়া ওদের ঠিক হয়নি!

এই রাস্তাটা নির্জন। ও হাসল নিজের মনে। এতক্ষণে রেস্তরাঁর ভেতরে দৌড়াদৌড়ি পড়ে গিয়েছে। ও সেই সুযোগে জামা পালটে প্যান্ট্রির দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে চুপিচুপি।

এখন মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ও মুক্ত।

“এঃ, তু কাহাঁ যা রহা হ্যায়?”

ও থমকে দাঁড়াল। দেখল কুমারেশের একটা সিকিউরিটি দৌড়ে এসে পথ আটকে দাঁড়াল ওর সামনে, “তুই চুপিচুপি কোথায় পালাচ্ছিস? তুই ভিতরে ড্রিংক সার্ভ করছিলি না? তুই কে? কোথায় পালাচ্ছিস?”

লোকটা দ্রুত কোমর থেকে পিস্তল বের করতে গেল। কিন্তু পারল না। তার আগেই ডান হাতটা আড়াআড়িভাবে লোকটার ঘাড়ে চালাল ও। লোকটা ঝুপ করে পড়ল মাটিতে!

ও নিথর লোকটার উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, “আমার কোনও নাম নেই। শুধু যারা ধ্বংসকে, মৃত্যুকে আলো বলে বিক্রি করতে চায়, আমি সেই আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র!”

৩২

দশমী। কলকাতা।

সামান্য সময় নিয়ে বিছানায় উঠে বসল আদিল। আজ শরীরটা আগের চেয়ে একটু ভাল লাগছে। তবে দুর্বলতা আছে এখনও। সেই ট্যাক্সির ভেতরে জ্ঞান হারাবার পরে ওর আধো-জ্ঞান হয়েছিল সুড়ঙ্গে। পরে বুঝেছে ও মাটির তলায় স্যুয়ারের মধ্যে ছিল। আর ওর পিঠেই ভ্লাদ ঝুলিয়ে রেখেছিল পোর্টেবল নিউকটা! আসলে সবটা স্পষ্ট মনে করতে পারছে না। মাঝে-মাঝে এক-একটা ঘটনা মনে পড়ছে। বাকিটা আবার ডুবে যাচ্ছে জলের তলায়।

আদিল দেখল সামনে সিএম বসে আছেন। পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহিন। ঘরে আরও কয়েকজন আছেন। সবই সরকারি লোকজন।

“এখন শরীর কেমন?” সিএম আলতো করে জিজ্ঞেস করলেন।

“আয়াম ওকে ম্যাম,” আদিল হাসল।

আসলে ও জানে ঠিক হতে আরেকটু সময় লাগবে। তবে সাধারণ মানুষের চেয়ে ওর এনডিওরেন্স অনেক বেশি! তাই অমন অর্ধ-চেতন অবস্থাতেও সেদিন ওই মেয়েটাকে পা দিয়ে মেরে বেসামাল করে দিতে পেরেছিল!

সিএম বললেন, “গতকাল সকালে আমাদের দপ্তরে দুটো পেনড্রাইভ এসেছে। কেউ একজন এসে দিয়ে গিয়েছে। তাকে আমরা লোকেট করতে পারিনি। তবে প্রথমটায় ষষ্ঠীর দিন ঘটে যাওয়া টেররিস্ট অ্যাটাকের ডিটেলটা আছে। মনে হয় এটাই তোমার কাছে ছিল। আর সেকেন্ডটায় রয়েছে দিওয়ালির সময়ে ঘটতে পারে এমন ভয়ঙ্কর আর-একটা কন্সপিরেসির ছক! দুটোতেই ওই কুমারেশ লোকটাও জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। আমরা দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কুমারেশ গত দু’দিন আগে জয়পুরে মারা গেছে। মানে ওকে মারা হয়েছে! সঙ্গে দু’জন বিদেশি গুপ্তচরও মারা পড়েছে। আমি তো ভাবতেই পারছি না গোটা ব্যাপারটা।”

তিনজনকে একসঙ্গে মারা হয়েছে! কে করল এমন? আদিল চোখ বন্ধ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মনের মধ্যে ঝলসে উঠল আধো অন্ধকার সুড়ঙ্গ! মাথায় হলুদ আলো লাগিয়ে এগিয়ে আসা একটা ছায়াময় মানুষ!

সিএম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার কিছু মনে পড়ছে আদিল? কে ছিল তোমার সঙ্গে সুড়ঙ্গে? কে তোমায় বের করে নিয়ে এসে বোটে রাখল! কিছু মনে করতে পারছ?”

আদিল ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করল আবার। আর আবার যেন দেখতে পেল সেই আলোটা। যেন জলের তলা থেকে ভেসে উঠল, ওকে ঠেলতে-ঠেলতে স্যুয়ারের সুড়ঙ্গ থেকে নদীর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন দৃশ্য। যেন দেখতে পেল লোকটা মোটরবোটে আদিলকে বসিয়ে কানের কাছে নিয়ে এল মুখ।

“আদিল,” সিএম ঝুঁকে পড়লেন, “কে ছিল লোকটা? মনে করতে পারছ? তার নাম বলেছিল কিছু?”

আদিল জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। সন্ধে নামছে এই শহরে। নিশ্চিন্ত একটা শহর। কিন্তু তারা জানবেও না কে এসেছিল তাদের বাঁচাতে! কে বারবার ফিরে আসে তাদের রক্ষা করতে!

“সে বলেছে, দরকারে আবার আসবে। বারবার আসবে অন্ধকার পেরিয়ে। যাওয়ার আগে সে বলে গেছে তার নাম…” আদিল তাকাল সিএম-এর দিকে। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, “তার নাম সেন, অদম্য সেন।”

(এই গল্পে ‘বিস্ফোরণের উত্সবে’ ও ‘অন্ধকারের রাজপুত্র’ গল্পের রেফারেন্স রয়েছে। এই গল্প পুরোটাই কাল্পনিক।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *