বিস্ফোরণের উৎসবে

বিস্ফোরণের উৎসবে (উপন্যাস)

ডক ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আদিল। এদিকটা শুনশান। দূরে ডকের জাহাজ, আর বড় বড় ক্রেনগুলোকে দৈত্যের হাতের মতো লাগছে। পুজোর রোশনাইয়ের শহরে এই দিকটা কেমন যেন অন্ধকার আর নির্জন। ঝিঁঝির ডাকও এখানে স্পষ্ট। আদিল জানে না, সামনে কী আছে। শুধু জানে ওকে এগোতে হবে। এই শহর আর এই দেশের জন্য ওকে এগোতেই হবে সামনে।

এর কিছুদিন আগে…

মুজাফফরাবাদ, পাক অধিকৃত কাশ্মীর

কর্নেল শ্যাঙ ওয়েই সোজা হয়ে বসলেন। সামনের টেবিলে রাখা টুপিটা তুলে নিলেন হাতে। যা কথা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এবার উঠলেই হয়।

“আপনি কি উঠবেন?” আই এস আই কোর কমান্ডার লতিফ শেখ জিজ্ঞেস করলেন, “আমাদের প্রশ্নের উত্তরটা না দিয়েই উঠবেন? গিলগিট-বালটিস্তানে যে রেললাইন তৈরি করছেন আপনারা, তাতে বাইশটা গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করাচ্ছেন। আমাদের দেশে এই কাজটা করছেন আর আমাদেরই সেখানে ঢুকতে দিচ্ছেন না! কেন করছেন এটা?”

শ্যাঙ ঠান্ডা চোখে তাকালেন লতিফের দিকে। তারপর কেটে কেটে ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “আপনাদের যে কাজটা দিলাম, সেটা করে দিন। কথামতো ডলার পেয়ে যাবেন। ডোন্ট আস্ক ফর মোর।”

লতিফ হাসলেন, “মোর ইজ লেস। আমাদের কী চাই, আমরা জানি। সকলকে আপনারা বলছেন যে, সুড়ঙ্গ আপনারা তৈরি করাচ্ছেন ইরান থেকে পাইপে করে তেল আনাবেন বলে। কিন্তু আমরা জানি, তা নয়। ওতে আপনারা অন্য কিছু করবেন। সম্ভবত, ওতে কোনও নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড রাখবেন। আমাদের সেটার অ্যাকসেস চাই।”

শ্যাঙ ছোট চোখদুটো নামিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোয়াল শক্ত। মুজাফফরাবাদের আবহাওয়া এই অক্টোবরে বেশ ঠান্ডা থাকে। মুজাফফরাবাদ হল আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী। পাকিস্তানিরা আজাদ কাশ্মীর বললেও ভারতীয়রা কিন্তু বলে পাক অধিকৃত কাশ্মীর। তবে কে কী বলল তাতে বেজিং-এর যে কিচ্ছু এসে যায় না, সেটা কর্নেল শ্যাঙ ওয়েই ভালই জানেন। বেজিং শুধু নিজেরটা বোঝে। বোঝে, সামনের দিনগুলোয় পৃথিবীতে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই তাকে মুঠোয় রাখতে পারলে এত জনসংখ্যার ভার নিয়েও চিন নত হয়ে পড়বে না। ফলে যে-কোনও উপায়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে নিজের হাতের মধ্যে রাখতেই হবে বেজিঙকে। আর এই পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল ভারত। তাই বেজিং থেকে ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-র মাথারা একটা দায়িত্ব দিয়েছেন কর্নেল শ্যাঙকে। সেই কাজেই ওঁর আসা লতিফ শেখের কাছে।

“এটা কি ঠিক বিজনেস টার্মস হল?” শ্যাঙ তাকালেন লতিফের দিকে।

লতিফ হাসলেন, “আপনাদের মনের মতো না হলেই কি সেটা ভুল? ডলার প্লাস ইনফো। তবেই কাজ হবে। না হলে…”

শ্যাঙ চোয়াল শক্ত করে বললেন, “আবার টোয়েন্টি সিক্স-ইলেভেন মুম্বইয়ের মতো সব ছড়াবেন না তো? তা হলে কিন্তু….”

লতিফ হাসলেন, “সবটা ছড়াইনি কিন্তু। তবে এবার অনেক ছোট, কিন্তু এফেক্টিভ গ্রুপ নিয়ে কাজ করব। শুধু আপনি আমাদের শর্তে…”

“ওকে। ডান,” শ্যাঙ উঠে হাত বাড়িয়ে দিলেন লতিফের দিকে।

লতিফ হাতটা ঝাঁকিয়ে বললেন, “ব্যস। কাজ হয়ে যাবে। তেওহার কি শহর নয়া রওশনি দেখেগি।”

আই এস আই-এর অফিস থেকে বেরিয়ে কর্নেল শ্যাঙ নিজের মোবাইলটা বের করে একটা নম্বর টিপে স্পিড ডায়াল করলেন। বেজিঙের একটা উঁচু বাড়ির কুড়ি তলায় বেজে উঠল আর-একটা ফোন।

সেলটা কানে লাগিয়ে শ্যাঙ বললেন, “কাজ হয়েছে। দ্য বল ইজ রোলিং।”

ফিস, অস্ট্রিয়া

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে চার হাজার ফিটেরও বেশি উচ্চতায় অবস্থিত ফিস একটা ছোট্ট অস্ট্রিয়ান গ্রাম। বরফ, পাহাড় আর অদ্ভুত সুন্দর এক পৃথিবী যেন এসে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ফিসে। সাধারণত এটা টুরিস্ট স্পট হিসেবেই লোকে দেখে। স্কিয়িং-এর জন্য ইয়োরোপের নানা প্রান্ত থেকে লোক আসে এই ফিস গ্রামে।

গ্রামটা ছোট্ট। ঢেউ খেলানো পাহাড় আর উপত্যকায় ছড়িয়ে আছে ছোট্ট সুন্দর গ্রামের কাঠের বাড়িগুলো। গ্রামের শেষপ্রান্তে একটা পাহাড়ের ধারে রয়েছে এখানকার একমাত্র ক্যাথলিক চার্চ। সেখানে একটা ছোট্ট অরফ্যানেজ আর স্কুল আছে। চার্চের মাথায় আটকানো বিশাল ঘণ্টা সন্ধেবেলায় একবার করে বেজে ওঠে আর ফিসের লোকদের জানান দেয় যে, প্রভু যিশুর কথা শোনার সময় হয়ে এল।

বিশাল ঘণ্টার ধ্বনি পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। আর সন্ধের ঠিক পরেই মানুষেরা হাতে ছোট্ট তেলের কুপি নিয়ে সার বেঁধে চলে আসে চার্চে।

ইয়েনসকেও রোজ মায়ের সঙ্গে যেতে হয় চার্চে। ওর ভাল লাগে না খুব একটা। তবু মা বকবে বলে ও যায়। শুধু রোববারে ওর চার্চে যেতে ভাল লাগে। সেদিন সারমনের পর ফাদার সব বাচ্চাদের পেস্ট্রি দেন।

আজ রোববার। সকাল থেকে মেঘ করে আছে খুব। মেঘলা দিনে ওদের ফিসে সারাদিন খুব হাওয়া বয়। আজও তেমন একটা পাগল হাওয়ার দিন।

মা, আন্ট এম্মালিনার কাছ থেকে সোজা চলে যাবে চার্চে। আর ইয়েনসকে বলে গিয়েছে যেন সময়মতো চলে আসে ওখানে।

আজ বিকেলে ফুটবল ম্যাচ আছে। তাই চার্চের প্রেয়ার সেরেই ইয়েনস চলে যাবে ক্লাবে। খেলার কিট গুছিয়ে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে ওর। চার্চে সময়মতো না পৌঁছোলে মা খুব বকবে।

বড়রাস্তা দিয়ে সাইকেলটা জোরে ছুটিয়ে দিল ইয়েনস। চার্চে সময়মতো পৌঁছোতে হলে একটু জোরেই চালাতে হবে সাইকেল।

আচমকা পিছন থেকে একটা এস ইউ ভি হুড়মুড় করে এসে থামল ওর পাশে। কোনও হর্ন দেয়নি গাড়িটা। ইয়েনস খুব চমকে গিয়েছে। ও সাইকেল থামিয়ে দেখল দু’জন বসে রয়েছে সামনের সিটে।

ড্রাইভারটা পাশে বসা বিশাল চেহারার লোকটাকে বলল, “ব্রুনো, জিজ্ঞেস করো চার্চটা কোথায়?”

ব্রুনো কোনও কথা না বলে ইয়েনসের দিকে তাকিয়ে ভুরু তুলল শুধু।

ইয়েনস বলল, “এই রাস্তায় সোজা গিয়ে বাঁদিকে গেলেই চার্চ।”

লোকগুলো মাথা নাড়িয়ে আবার হুস করে বেরিয়ে গেল। ইয়েনস অবাক হয়ে দেখল, লোকগুলো একটা থ্যাঙ্কস পর্যন্ত জানাল না!

ইয়েনস আবার সাইকেল চালাতে শুরু করল।

চার্চের কাছে এসে দেখল, সেই এস ইউ ভি-টা উলটোদিক দিয়ে ঝড়ের বেগে এসে ওকে পার করে চলে গেল গ্রামের অন্যদিকে। তবে এবার ড্রাইভারটাই আছে একা। পাশের সেই ব্রুনো বলে লোকটা আর নেই।

ইয়েনস পিছন ফিরে গাড়িটাকে দেখল একটু, তারপর আবার ছুটিয়ে দিল সাইকেল। তবে তখনও ও জানে না যে, আজ চার্চে গিয়ে শুনবে প্রেয়ার হবে না। জানে না যে, সানডে পেস্ট্রিটা আজ মিস হয়ে গেল।

কলকাতা, মহাষষ্ঠী

ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল ও। রাস্তায় বেশ ভিড়। পুজোর কলকাতা বলে কথা। এমনটা তো হবেই। কত মানুষ ঘরে ফিরছে! নিশ্চিন্তে আনন্দ করতে ফিরছে যে যার প্রিয়জনের কাছে। মানুষগুলোর দিকে ও তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শরতের রোদে সবটাই কেমন যেন সুন্দর আর নতুন রং করা বাড়ির মতো লাগছে। ও ভাবল, এরা কি জানে ওদের জন্য সামনে কী অপেক্ষা করে রয়েছে? ওরা কি জানে, এই যে ও সকলের মধ্যে মিশে বহুদিন পরে ঘরে ফেরা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে, আসলে ও কে!

বহুদিন পরে পুজোর কলকাতায় ফিরল ও। তবে ভাবেনি, এমন অবস্থার মধ্যে ফিরবে। হাতের মুঠোটা শক্ত করে নিল ও। সামনে এখন অনেক কাজ।

দূরে একটা বছর বাইশের ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীল শার্ট আর জিন্‌স। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘প্রিমো উওমো।’ ও এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে।

“আস্‌সালাম ওয়ালেকুম। আমি প্রিমো,” ও হাত বাড়িয়ে দিল।

ছেলেটা একটু সন্দেহের চোখে তাকাল। প্রিমো হেসে পকেট থেকে পাসপোর্টটা বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা ভাল করে দেখল সেটা, তারপর হেসে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ওয়ালেকুম আস্সালাম। আসুন ভাইয়া। আমি মজিদ।”

দূরে একটা হ্যাচব্যাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। মজিদ প্রিমোকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। বলল, “ভাইয়া, আপনার সামান?”

প্রিমো হেসে বলল, “থাকব তো দু’-একদিন। তার জন্য সামান দরকার হবে কি? আর আমার এই ব্যাগটা তো রয়েছে।”

মজিদ গাড়িটাকে নজরুল ইসলাম সরণিতে তুলে পাশে তাকিয়ে বলল, “আপনার আসলি সামান আমরা রেডি করে রেখেছি। ওখানেই যাবেন তো?”

প্রিমো বাইরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল অল্প। তারপর বলল, “গোটা শহরটা তো বিয়েবাড়ির মতো সেজেছে! দারুণ ব্যাপার।”

মজিদ হেসে বলল, “বাঙ্গালি লোগ এমনই। কিছু পেলেই একদম জি তোড় হাঙ্গামা করে। তা ভাইয়া আপনার কাজটা কী, বলা যাবে?”

প্রিমো তাকাল মজিদের দিকে। তারপর সামান্য হেসে বলল, “দুর্গাপুজো দেখব। দিওয়ালি রোশনাই করব। আর সম্ভব হলে পরে একটু অঞ্জলিও দেব। বুঝলে মজিদ মিঞা?”

মজিদ কিছু না বুঝেই হাসল। তারপর জোরে গাড়িটা ছুটিয়ে দিল খিদিরপুরের দিকে।

কলকাতা, মহাসপ্তমী

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেক্রেটারি অফ সিভিল ডিফেন্স হৃদয়েশ মোহন কাঁপা হাতে ফোনটা রেখে চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এখন অক্টোবরের শেষ, তার উপর ঘরে এসি চলছে কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবু কপালে যে ঘাম জমছে, বুঝতে পারলেন তিনি। ঘাম জমাটা স্বাভাবিক। কারণ, ফোনের ওপার থেকে কমিশনার অফ পুলিশ পচনন্দাজি এমন একটা খবর দিয়েছেন, যেটা সত্যি হলে ভারতের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর অধ্যায় শুরু হতে চলেছে কলকাতায়।

হৃদয়েশ নিজের মোবাইলটা বের করে দ্রুত হাতে চিফ সেক্রেটারি সমর ঘোষকে ফোন করলেন। চারবার রিং হওয়ার পর ফোনটা ধরলেন সমরবাবু।

হৃদয়েশ খুব সংক্ষেপে গুছিয়ে গোটা ব্যাপারটা বললেন। তারপর যোগ করলেন, “স্যার, আমাদের ইমিডিয়েটলি একটা ডিসিশনে পৌঁছোতে হবে।”

সমরবাবু বললেন, “আপনি রাইটার্সে পৌঁছোন, কনসার্নড সকলকে আসতে বলুন। আমি সি এম ম্যাডামকে ফোন করছি।”

সপ্তমীর সকাল আটটার কলকাতা যেন উত্সবের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নানা থিমের প্যান্ডেল, মানুষের টুকরো টুকরো ভিড়, আর আনন্দের সব মুখ পেরিয়ে হৃদয়েশজির গাড়ি ছুটছে। পিছনের সিটে বসে গাড়ির ঠান্ডার ভিতরেও ঘামছেন হৃদয়েশজি। ভাবছেন, এত লোক জানেই না কলকাতায় কী সমূহ বিপদ উপস্থিত! এই উত্সবের শহর শ্মশান হতে এক সেকেন্ডও লাগবে না।

টিন্টেড গ্লাস দিয়ে বাইরের রোদটা দেখলেন উনি। এত সুন্দর পরিবেশে কী ভয়ংকর সমস্যা উপস্থিত হল ওদের সামনে!

গাড়িতে উঠেই জরুরি কিছু ফোন করে ফেলেছেন হৃদয়েশজি। সমরবাবুও ফোন করে জানিয়েছেন যে, পচনন্দাজির সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছে। ওদিকে সি এম অন দ্য ওয়ে। বাকি মন্ত্রীরাও আসছেন। এমনকী প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনিকে জানানো হয়েছে গোটা ঘটনা। দিল্লি থেকে বিশেষ বিমানে উড়ে আসছেন ডিফেন্স সেক্রেটারি শশীকান্ত শর্মা। হৃদয়েশ যেন দেরি না করেন!

রাইটার্সে ঢোকার আগেই হৃদয়েশ দেখলেন সি এম-এর কালো ছোট্ট হ্যাচব্যাকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘাম মুছতে মুছতে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে প্রায় দৌড়ে গেলেন হৃদয়েশজি।

ঘরটা বেশ বড়। একটা বিশাল বড় কাঠের টেবিলের চারিদিকে গোল করে সাজানো বেশ কিছু চেয়ার। টেবিলের মাঝে কয়েকটা টেলিফোন, মনিটর, আরও নানা যন্ত্রপাতি। সকালে খবর পাওয়ামাত্রই এই ঘরটাকে একটা কন্ট্রোলরুমে পরিণত করা হয়েছে।

সকলে জায়গায় বসার পর সি এম সমরবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “লালবাজারে না বসে এখানে জমায়েত করলেন কেন?”

সমরবাবু বললেন, “ম্যাডাম, আপনি রাইটার্সে আসতেই পারেন। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু লালবাজারে গেলেই প্রেস হাজারটা প্রশ্ন করবে। তাই মিডিয়ার নজর এড়াতে পচনন্দাজির সঙ্গে আলোচনা করে এখানে আয়োজন করেছি।”

সি এম গম্ভীরভাবে শুনলেন পুরো ঘটনাটা। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। তবে আপনি ফোনে যা বললেন, তা কতটা ঠিক? মানে এমন হোক্স কল তো সারা দিনই আসে। তা হলে এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?”

সমরবাবু সামনে রাখা গ্লাস থেকে জল খেলেন একটু। তারপর শান্ত গলায় বললেন, “আমি সকলের সঙ্গে কথা বলে যতটা জানতে পেরেছি, সেটা আপনাকে বলছি ম্যাডাম। লালবাজারে ফোনটা আসে সকাল ছ’টার সময়। বলা হয় যে কলকাতার তিনটে পুজো মণ্ডপে বম্ব প্ল্যান্ট করা আছে। যে ফোন করেছে, তার বক্তব্য হল, ওর দাবি না মানলে দুটো পুজোয় বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।”

“দুটোতে?” সি এম টেবিলে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়লেন, “আর বাকি একটা?”

এবার পচনন্দাজি বললেন, “সেটা ওই লোকটার হুমকি-প্রুফ ম্যাডাম।”

“প্রুফ?” সকলে ঘুরে তাকালেন কমিশনারের দিকে।

পচনন্দাজি বললেন, “হ্যাঁ, প্রুফ। প্রুফ ফর দ্য ক্লেম। লোকটি আমাদের বলেছে যে, প্রভাতফেরি সঙ্ঘের প্যান্ডেলের কাছে একটা বড় মূর্তি রয়েছে। তার পায়ের ভিতর একটা ছোট্ট বাক্সে আর ডি এক্স প্ল্যান্ট করা আছে। আমরা খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোক পাঠিয়ে দেখেছি যে, সত্যি ওখানে আর ডি এক্স রাখা আছে। তবে তাতে কোনও ডিটোনেটর নেই।”

“আর বাকি দুটো?”

পচনন্দাজি মাথা নাড়লেন, “আমরা কোথায় আছি জানি না ম্যাডাম। যেহেতু লোকটার কথামতো আমরা আর ডি এক্স খুঁজে পেয়েছি, তাই তাকে অবিশ্বাস করার আর জায়গা নেই। আর বাকি দুটো বম্ব খোঁজাও খুব ডিফিকাল্ট। এত এত পুজো চারিদিকে। এত প্যান্ডেল, আলো, এত স্ট্রাকচার। কোথায় খুঁজব! সিচুয়েশন ইজ গ্রেভ ম্যাডাম, ভেরি গ্রেভ।”

সি এম মাথা নাড়লেন, “সত্যি! মানুষ পশু হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এত অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে কেউ এমন করতে পারে! কলকাতায় এত পুজো হয়। এ তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো ব্যাপার। এত লক্ষ লক্ষ মানুষ, এদের কী হবে? তা, কে করছে এসব জানা গিয়েছে? মানে, বিদেশি কোনও শক্তি না দেশের ভিতরের মিসক্রিয়েন্টস? ফোনের ওপারের লোকটি নিজেকে আইডেনটিফাই করেছে?”

“নট ইয়েট ম্যাডাম,” পচনন্দাজি মাথা নাড়লেন।

“আপনারা কী স্টেপ নিচ্ছেন তবে? আমায় ডিফেন্স সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন। আর অ্যান্টনিজিও ফোন করেছিলেন। সকলে খুব চিন্তিত। ওঁরা আসছেনও।”

পচনন্দাজি বললেন, “ম্যাডাম, লোকটা প্রথমবার যখন ফোন করেছিল, তখন ওর লোকেশন ট্রেস করেছিলাম মোবাইল দেখে। সেটা ছিল প্রকৃতি পার্কের পুজো মণ্ডপের কাছে। কিন্তু কল শেষ হওয়ার পরে ও মোবাইল সুইচ অফ করে দেয়। কাছেই গড়িয়াহাট থানা। সেখানে বলে আমরা প্যান্ডেলে পুলিশ ডিপ্লয় করেছি।”

সি এম জিজ্ঞেস করলেন, “কোনও ডিম্যান্ড করেছে কি? মানে কীসের জন্য বম্ব প্ল্যান্ট করছে, তার কোনও কারণ বলেছে?”

“না, ম্যাডাম,” সমরবাবু মাথা নাড়লেন, “বলেছে ও নাকি সকাল দশটায় ফোন করবে। তখন কথা বলবে। তবে…”

“কী তবে?” সি এম জিজ্ঞেস করলেন।

“তবে শুধু ‘র’ (RAW)-এর জয়েন্ট ডিরেক্টর, জিডি পাকিস্তান ডেস্ক, মিস্টার জয় কুমারের সঙ্গেই নাকি কথা বলবে লোকটা।”

“জয় কুমার? ‘র’-এর? কেন?” সি এম অবাক হলেন, “আর চাইলেই বা পাওয়া যাচ্ছে কোথায় তাঁকে?”

“উনিও আসছেন স্পেশ্যাল ফ্লাইটে,” সমরবাবু ছোট করে বললেন।

সি এম টেবিলে রাখা মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। লেট হিম কাম। তবে আমরাও থাকব। আর মিস্টার ঘোষ, আপনি সব পসিবল হেল্পের ব্যবস্থা করুন। আমার শহরে কোনও বিপদ আমি ঘটতে দেব না। অ্যাট এনি কস্ট এটা আটকাতেই হবে। জয় কুমারকে সবরকম হেল্প করবেন। আর আপনাদের কাকে দরকার বলুন, আমি নিজে পি এম ও-র সঙ্গে কথা বলব। এমনিতেই মনমোহন সিংহজির সঙ্গে কথা বলতে হবেই আমায়। তখন বেস্ট পসিবল হেল্পের আমি বন্দোবস্ত করব। আর একটা কথা, খবরটা যেন কিছুতেই না ছড়ায়। কোনও প্যানিক যেন ক্রিয়েট করা না হয়। আর কিপ মিডিয়া আউট অফ ইট। ব্যাপারটা যেন এই ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে। বুঝলেন?”

সকলে একসঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

পাশে বসা একজন মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, “দিদি, আপনি কি এখানেই থাকবেন এখন? না…”

“এখানেই থাকব,” সি এম প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই বললেন, “যত সময়ই লাগুক, আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। গোটা রাজ্যের ভার আমার উপর। এদের সিকিয়োরিটির দায়িত্ব আমার। অন্য কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই নেই।” তারপর পচনন্দাজির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তা, মিস্টার কুমার তো আসছেন, আর কেউ আসছেন কি? কোনও কম্যান্ডো টিম? ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ড? কেউ আসছে?”

“আসছে ম্যাডাম। তাদের পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু যতক্ষণ না লোকটাকে লোকেট করতে পারছি, ততক্ষণ তো কিছুই করা যাবে না। সকলকে স্ট্যান্ড-বাইতে রাখছি। মিস্টার কুমার আমাদের তেমনই বলেছেন। আর…”

পচনন্দাজি থামলেন একটু। তারপর বললেন, “আরেকজন আসছে। ডিফেন্স সেক্রেটারি নিজে রেকমেন্ড করেছেন তাঁকে।”

“কে?” সি এম তাকালেন আগ্রহ নিয়ে।

“আমি জানি না সঠিক। তবে নাম শুনলাম আদিল,” সমরবাবু বললেন।

“আদিল? কে সে? পুরো নাম কী?”

সমরবাবু পচনন্দাজির দিকে তাকালেন। পচনন্দাজি সময় নিলেন একটু। তারপর থেমে থেমে বললেন, “তার ব্যাপারে আমাদের ইনফো লিমিটেড ম্যাডাম। আমরা শুধু জানি, যে আসছে সে একজন মার্কোস।”

আকাশ থেকে শহরটাকে খুব সুন্দর লাগছে। কে বলে কলকাতা ডায়িং সিটি? ব্রকোলির মতো সবুজ গাছের সারি, কালো সাপের মতো রাস্তা আর সব ছাড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, নিখুঁত পেস্ট্রির মতো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

এই শহরটাকে খুব ভাল করে চেনে আদিল। ওর জন্ম আর বেড়ে ওঠা তো এখানেই। ক্লাস টুয়েলভ অবধি এখানেই ছিল। পরে ইন্ডিয়ান নেভিতে জয়েন করে। আর সেখান থেকে একদম মার্কোস।

মার্কোস। পুরো কথাটা হল মেরিন কমান্ডোস। আগে এর নাম ছিল, মেরিন কমান্ডো ফোর্স। শুধু ভারতের নয়, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হল এই মার্কোস। এরা অ্যামফিবিয়ান কমব্যাট ফোর্স। জলে, মাটিতে, আকাশে সব জায়গায় লড়তে পারে। সবরকম অস্ত্র চালাতে পারে। প্যারাট্রুপিং থেকে ফ্রি-ফল বা আন্ডার ওয়াটার যে-কোনও জায়গায় এরা অপ্রতিরোধ্য।

আদিলের এখনও মনে পড়ে, সিলেকশনের সেই সময়গুলো। দুটো ভাগে হয় মার্কোসের সিলেকশন। প্রথমভাগে তিনদিন ধরে শারীরিক সক্ষমতা, ফিটনেস আর অ্যাপটিটিউড টেস্ট চলে। এতেই পঞ্চাশ শতাংশ ছেলে বাদ পড়ে যায়। আর এর পরে শুরু হয় পাঁচ সপ্তাহ ধরে সিলেকশন টেস্ট। এই পাঁচ সপ্তাহকে বলা হয় ‘হেল’স উইক’ বা ‘নরকের সপ্তাহ’।

এই সপ্তাহগুলোতে ঘুমোতে প্রায় দেওয়াই হয় না অ্যাপ্লিক্যান্টদের। আর তার সঙ্গে চলে চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা।

এতে পাশ করলে তবেই বছর দু’য়েকের মার্কোস হওয়ার ট্রেনিং শুরু হয়। আদিল শুধু পাশই করেনি, ওর র‍্যাঙ্ক উপরের দিকেই ছিল।

ট্রেনিং-এর দিনগুলোর কথা আদিল ভুলতে পারবে না কখনও। যে-কোনও অবস্থা থেকে ০.২৭ সেকেন্ডের রিঅ্যাকশন টাইমে গুলি ছুড়তে হত। তার সঙ্গে মরুভূমি থেকে গভীর সমুদ্র, সব জায়গায় ট্রেনিং হত ওদের। তবে সবচেয়ে সাংঘাতিক ছিল ‘ডেথ ক্রল’। থাই অবধি জমে থাকা কাদায় পঁচিশ কেজি ওজন নিয়ে শুরু হত। তারপর আড়াই কিলোমিটার পর্যন্ত নানা বাধা টপকে এগিয়ে যেতে হত। এর মধ্যে ছিল না-ঘুমোনো। আর সব শেষে সেই অবস্থায় পঁচিশ মিটার দূরে লক্ষ্যভেদ করতে হত বন্দুক দিয়ে। আর টার্গেটের পাশে তখন দাঁড়িয়ে থাকত ওদেরই কোনও কোলিগ!

আদিলের ব্যাচের নব্বই শতাংশ ছেলেই আর কমপ্লিট করতে পারেনি এই ট্রেনিং। শুনেছে এমনটাই হয়। তবে যারা পেরেছে, তারা লোহার তৈরি মানুষ হয়ে গিয়েছে। তারা শিখে গিয়েছে সবরকম কম্যান্ডো কমব্যাট, প্যারা ট্রেনিং, এক্সপ্লোসিভ টেকনোলজি, কাউন্টার টেররিজম, স্কাই ডাইভিং এবং আরও নানারকম যুদ্ধের মন্ত্র।

আদিলের মনে আছে ওদের ট্রেনিং কম্যান্ডার বলতেন, “উই আর মেকিং ওয়ার-মেশিন আউট অফ হিউম্যান।”

নিজেকে আদিলের এখন ওয়ার-মেশিনই মনে হয়।

আজ সকালে যখন কলাইকুন্ডায় ঘুম ভেঙেছিল ওর, তখনও জানত না স্পেশ্যাল কাজে ওকে আসতে হবে কলকাতায়। আসলে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মার্কোস বেসেই ওর পোস্টিং। তবে অফিসের একটা কাজে ওকে আসতে হয়েছিল কলাইকুন্ডায়। সেখান থেকে ওর কাছে অর্ডার আসে যে, কলকাতায় নাকি হস্টেজ সিচুয়েশন হয়েছে। সেটা কমব্যাট করতে যেতে হবে ওকে। এটা নতুন নয় আদিলের কাছে। মার্কোসদের জীবনে এমন ঘটনা লেগেই থাকে।

কলাইকুন্ডা থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে এই এখন কলকাতায় নামল আদিল। দেখল, সরকারি গাড়ি নিতে এসেছে ওকে। অক্টোবরের শেষ। তবে ঠান্ডা নেই তেমন। বরং হাওয়ায় একটা অদ্ভুত আনন্দ ভাসছে। আদিল জানে দুর্গাপুজোর সময় এই শহরটা ডিজনিল্যান্ড হয়ে ওঠে।

ঠিক পৌনে দশটার সময় আদিল এসে পৌঁছোল রাইটার্সে। লাল বাড়িটার ভিতরে ঢোকার সময় দেখল পরিবেশ থমথমে। অবস্থা কতটা গুরুতর, আদিল জানে না। ওকে বলা হয়েছে এখানেই সব ডিটেল দেওয়া হবে।

আদিল সানগ্লাসটা পকেটে ঢুকিয়ে সঙ্গের এসকর্টটির পাশে পাশে করিডর দিয়ে হাঁটতে লাগল।

আদিল যে ঘরটায় ঢুকল, সেটা বেশ বড়। একটা টেবিলের উপর নানা যন্ত্রপাতি ভরতি হয়ে আছে। ঘরে পুলিশের বেশ কিছু লোকের সঙ্গে আরও কিছু মানুষকে দেখল ও। তবে সি এম ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারল না ঠিক।

পচনন্দাজি এগিয়ে গেলেন আদিলের দিকে। তারপর হ্যান্ডশেক করে নিজের পরিচয় দিলেন। আর ঘরের সকলের সঙ্গে সংক্ষেপে পরিচয় করিয়েও দিলেন। সব শেষে যাঁর সঙ্গে পরিচয় করানো হল, তিনি এতক্ষণ আড়ালে থাকায় তাঁকে দেখতে পায়নি আদিল। এবার দেখে চমকে উঠল। আরে, জয় কুমার স্যার! এত সমস্যার ভিতরেও মনটা ভাল হয়ে গেল আদিলের। নেভির ট্রেনিং-এ ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল জয় স্যারের। স্যার এখন ‘র’-তে আছে জানত আদিল, কিন্তু এমন করে দেখা হয়ে যাবে, সেটা ভাবতে পারেনি।

“আরে আদিল,” জয় এগিয়ে এসে হাতটা ধরল আদিলের।

“স্যার আপ?” আদিল হাসল, “নাইস টু সি ইউ এগেন স্যার। কিন্তু দেখাটা আরও ভাল জায়গায় হতে পারত।”

জয় মাথা নাড়ল, “ঠিক। একটু আগেই এসেছি আমি। যা শুনলাম, তাতে বুঝেছি অবস্থা বেশ খারাপ। হস্টেজ সিচুয়েশন।”

আদিল মাথা নাড়ল। ঠিক কথা। এটা খুব বাজে জিনিস। এই ধরনের ঘটনায় নিরীহ মানুষদের মারা যাওয়ার চান্স বেশি থাকে।

ও জিজ্ঞেস করল, “ক’জন হস্টেজ স্যার?”

“ক’জন হস্টেজ?” জয় সকলের দিকে তাকাল একবার। তারপর গভীর গলায় বলল, “ক’জন নয় আদিল, দুর্গাপুজোর উত্সবে বিভোর এই গোটা শহরটাই এখন হস্টেজ, বন্দি।”

“আই ওয়ন্ট টু টক টু জয় কুমার,” প্রিমো কথাটা বলে অপেক্ষা করল একটু।

রাস্তায় বেশ ভিড় এখন। এসপ্ল্যানেডের এই বড় হোটেলের সামনে যে ফুটপাথ থেকে পার্কস্ট্রিটের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া ফ্লাইওভারের গোড়া পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। কত লোক যে আনন্দ করতে বেরিয়েছে!

“হ্যাঁ, জয় বলছি,” ওপার থেকে ভেসে এল একটা গলা।

“থ্যাঙ্কস ফর রেসপন্ডিং,” প্রিমো ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে সময় নিল একটু। তারপর বলল, “হোপ আপনারা আমার কথা রেকর্ড করছেন।”

“তুমি কী চাও?” জয় সময় নষ্ট করল না, “তোমার কল যে হোক্স নয়, তার প্রমাণ কী?”

“আর ডি এক্স প্যান্ডেল থেকে আমার কথামতোই তো খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, নাকি?” প্রিমো শব্দ করে হাসল, “তবে ওতে ডিটনেটর গোঁজা ছিল না। আমার কথা না মানলে পরেরগুলোতে ডিটনেটর থাকবে কিন্তু। আর আপনারা নর্থ টু সাউথ ছুটোছুটি করে লাশ কুড়োবেন, কেমন?”

“কাট দ্য ক্র্যাপ। কী চাস বল,” জয় সামান্য ধৈর্য হারাল।

“আরে,” প্রিমো হালকা গলায় বলল, “গিভ আ লিট্‌ল রেসপেক্ট ম্যান। তুমি থেকে একদম তুই! আমি আপনার সাব-অর্ডিনেট নই। যা বলছি শুনুন। এখন সকাল দশটা বাজে, এখন থেকে প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর ওয়ান মিলিয়ন ডলার করে আপনারা আমার দেওয়া একটা বিদেশি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করবেন। বুঝেছেন?”

জয় বলল, “বলে যাও, আমি শুনছি।”

“ওয়ান মিলিয়ন ডলার। নট আ পেনি লেস। অ্যাকাউন্ট নম্বরটা হল ১১.১৫.১২.১১.১.২০.১। আর ব্যাঙ্কের নাম ব্যাঙ্কা ইয়ানিক, জ়ুরিখ। তবে বুঝতেই পারছেন গোটাটাই কোডেড। ওই ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করে কিন্তু কিছু পাবেন না। ওটা ওখান থেকে অন্য জায়গায় ট্রান্সফার্ড হয়ে যাবে। ওরাও জানবে না।”

“তুমি সত্যি বলছ কি না, সেটা জানব কী করে? কী প্রমাণ আছে তুমি পাগল নও?” জয় গলাটা শক্ত রেখে প্রশ্ন করল।

হাসল প্রিমো। বলল, “একটা গল্প বলছি, শুনুন। মস্কোর দোমোদেদোভো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের সামনে একটা পাগল রাস্তায় বসে থাকত। আর মাঝে মাঝেই এয়ারপোর্টের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলত, “ওখানে বোমা আছে।” কেউ বিশ্বাস করত না তাকে। বরং সকলে হাসত। টিটকিরি করত। তারপর ২৪ জানুয়ারি ২০১১-র দুপুর থেকে পাগলটা আবার চিৎকার শুরু করল, ‘বোমা আছে, বোমা আছে।’ পুলিশ বিরক্ত হয়ে ওকে চ্যাংদোলা করে সরিয়ে দিল জায়গাটা থেকে। তার কিছু পরেই বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল মানুষজনে ভরতি এয়ারপোর্ট। পঁয়ত্রিশজন মৃত আর একশো তিরিশজন আহত।”

“তো?” জয় পালটা জিজ্ঞেস করল।

“পাগলটার কথা বিশ্বাস করা বা না করা আপনাদের প্রবলেম। আমি শুধু গল্পটা বললাম। শুনুন যদি বারোটার মধ্যে প্রথম কিস্তি জমা না পড়ে, তবে…” প্রিমো কথা শেষ না করে চুপ করে গেল।

“ও কে,” জয় হাসল হালকাভাবে, “টাকা চাই তোর? জাস্ট টাকা! আফটার অল ইউ আর আ পেটি থিফ!”

“আপনি কিন্তু আগে এমন ছিলেন না,” প্রিমো হাসল, “কাশ্মীর ভ্যালিতে জঙ্গিদের সঙ্গে কমব্যাটে আপনি কিন্তু অনেক কুল থাকতেন। এখন আপনি বড্ড তাড়াহুড়ো করছেন! কাশ্মীরে আপনি অনেক ভুগিয়েছেন। এবার আপনার ভোগার পালা। আর আমার কথা শেষ হয়নি কিন্তু। এখন থেকে রাত দশটা অবধি আপনাদের আমি সময় দিলাম। তার মধ্যে ডলার তো জমা দিচ্ছেনই, তার সঙ্গে রাত দশটা নাগাদ আপনারা আমায় আর-একটা জিনিসও দেবেন।”

“আর-একটা জিনিস? কী?”

“আই এন এস চক্র টু-র নিউক্লিয়ার মিসাইলের লঞ্চ কোড।”

“কী?” জয় নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না।

“আমি আবার বারোটায় ফোন করব। মনে রাখবেন, ডেড লাইন রাত দশটা।”

কুট করে কলটা কেটে ফোনটা একদম সুইচ অফ করে দিল প্রিমো। দেখল হাঁটতে হাঁটতে ও চলে এসেছে এসপ্ল্যানেড মেট্রোর সামনে। তবে সেখানেও খুব ভিড়। কিন্তু হোক না ভিড়, প্রিমোর তাড়া নেই কোনও। সামনে দু’ঘণ্টা সময়। এই দু’ঘন্টা কিচ্ছু করার নেই ওর। পকেট থেকে আরেকটা মোবাইল বের করল প্রিমো। মরিশাসের একটা নম্বর ডায়াল করে নিচু গলায় কাউকে নির্দেশ দিল কিছু। তারপর কথা শেষ করে ধীরে সুস্থে ঢুকে গেল মেট্রো স্টেশনের মধ্যে।

এদিকে কন্ট্রোল রুমে আদিল তাকিয়ে রইল অ্যাকাউন্ট নম্বরটার দিকে। তারপর বিস্ময়ের গলায় বলল, “দেখেছেন, নম্বরটা যেটা বেছেছে, সেটাকে অ্যালফাবেটে পরিণত করলে কী দাঁড়ায়?”

সকলে একসঙ্গে তাকালেন আদিলের দিকে।

আদিল নম্বরটার দিকে চোখ রেখে অস্ফুটে বলল, K-O-L-K-A-T-A!

সকলের চোখের সামনে লাল ডটটা নিভে গেল স্ক্রিনে।

আদিলের কথা শোনার পর স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ঘরের ভিতর একটা দীর্ঘশ্বাসের কোরাস শোনা গেল।

“লোকটা সুইচ অফ করে দিল!” সি এম উদ্বিগ্ন হয়ে তাকালেন জয় কুমারের দিকে।

জয় মাথা নাড়ল। তারপর মিনিট পনেরো আগে এসে পৌঁছোনো ডিফেন্স সেক্রেটারি মিস্টার শশীকান্ত শর্মার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, শুনলেন তো ডিম্যান্ড। এবার কী করবেন?”

শশীকান্তজি ঠোঁট কামড়ে বসে রইলেন একটু। তারপর বললেন, “টেররিস্টদের ডিম্যান্ড মেটানো আমাদের পলিসি বিরুদ্ধ।”

“কিন্তু স্যার আমাদের আর কী করার আছে?”

“তোমরা ট্র্যাক করে ধরতে পারবে না ওকে দু’ঘণ্টার মধ্যে? ওর লোকেশন তো দেখতে পেলে। এসপ্ল্যানেডের কাছে একটা জায়গা থেকে কল করেছিল। কাছের পুলিশ প্যাট্রোলকে বললে ধরা যেত না?”

জয় মাথা নাড়ল, “না স্যার যেত না। কলটা লোকেট করলাম না হয় এসপ্ল্যানেডের ফুটপাথে। কিন্তু পুজোর ভিড়ে কয়েক হাজার লোক ওখানে ঘুরছে। তাতে কয়েকশো লোক হয়তো ফোনে কথা বলছে। কাকে ছেড়ে কাকে অ্যারেস্ট করব আমরা? মাস অ্যারেস্ট করলে কী পরিমাণ প্যানিক ছড়াবে বুঝতে পারছেন? নট পসিবল স্যার। লোকটা খুব চালাক। ভিড়ের মধ্যে থেকে কল করছে যাতে ডেফিনিট করে ট্রেস করা না যায়। তারপর তো দেখলেন! অফ করে দিল মোবাইল।”

শশীকান্তজি সামনের টেবিলে রাখা জল খেলেন একটু। তারপর ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন। সি এম বললেন, “আমি মনমোহনজিকে ফোন করছি আবার। মন্ত্রীর মেয়ের জন্য সন্ত্রাসবাদীকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, আর সাধারণ নিরীহ লোকদের জন্য টাকা দেওয়া যাবে না? এ কী নিয়ম? গভর্নমেন্ট তো মানুষের জন্য, তা হলে তাদের প্রতি কি দায়বদ্ধতা নেই? টেররিস্টদের সঙ্গে আপস করার কথা নয়, এটা হল জীবন বাঁচানোর কথা।”

শশীকান্তজি মাথা নাড়লেন, “ঠিক বলেছেন ম্যাডাম। কিন্তু প্রোটোকল বলে একটা ব্যাপার আছে। দু’ঘণ্টার মধ্যে কি এভাবে টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব?”

“স্যার,” আদিল এবার কথা বলল, “আয়্যাম সরি টু ইনটারাপ্ট, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সেকেন্ড ডিম্যান্ডটা বেশি ডিসকাশন দাবি করে।”

শশীকান্তজি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “না, ওটা কোনও ডিসকাশন দাবিই করে না। কারণ ওটা দেওয়া সম্ভব নয়।”

“কোনটা?” সি এম জিজ্ঞেস করলেন।

“নিউক্লিয়ার লঞ্চ কোড,” সমরবাবু আস্তে বললেন কথাটা।

শশীকান্তজি বললেন, “ওটা দেওয়া আউট অফ কোয়েশ্চন। তাতে যা হওয়ার হবে।”

“যা হওয়ার হবে?” সি এম বললেন, “পুজোর ভিড়ে যা হওয়ার হবে, মানে বুঝতে পারছেন?”

শশীকান্তজি বললেন, “ম্যাডাম ওটা একটা সামান্য নিউক্লিয়ার লঞ্চ কোড নয়। ওটা আসলে ইন্ডিয়ান ওশনে আমাদের হার্ট।”

সি এম তাকালেন শশীকান্তজির দিকে। তারপর সমরবাবুকে বললেন, “মিস্টার ঘোষ, আপনি বুঝতে পারছেন কী বলছেন উনি?”

সমরবাবু বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম। ইন্ডিয়ান ওশন এখন পৃথিবীর অন্যতম ইম্পর্ট্যান্ট রিজিয়ন। আমি বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। এনার্জি রিসোর্স অর্থাৎ তেল, ন্যাচারাল গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি হল পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আর জানা গিয়েছে, পৃথিবীর জমে থাকা তেলের আশি শতাংশ ভারত মহাসাগরের মাটির তলায় আছে। আর আছে লিকুয়িফায়েড ন্যাচারাল গ্যাসের জমা অংশের সতেরো শতাংশ। তেলের ব্যবহারে চিন পৃথিবীর দ্বিতীয় স্থানে আছে। ওদের রোজ পচাঁশি লক্ষ ব্যারেলের বেশি তেল দরকার হয়। আর এর আশি শতাংশ আসে জাহাজে করে সমুদ্রপথ দিয়ে। আর আমরা সমুদ্র দিয়ে আনি আমাদের ব্যবহারের সত্তর শতাংশ তেল। অর্থাৎ ভারত মহাসাগর হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মেরিটাইম হাইওয়ে। এটা যে দখল করতে পারবে, তার হাতেই আগামী দুনিয়ার চাবিকাঠি।”

সমরবাবু থামলেন একটু। তারপর আবার শুরু করলেন, “তা ছাড়া আফ্রিকা যখন নিজেদের ছোট দেশগুলোকে শান্ত করে অনেক স্টেবল করে ফেলবে নিজেদের, তখন সেই মহাদেশে যে পরিমাণ ব্যাবসার সুযোগ বাড়বে, তাতে মুখ্য রুট হয়ে উঠবে ভারত মহাসাগর। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের খবর অনুযায়ী, চিন সামনের পনেরো বছরের মধ্যে এমন এক সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে বলে প্রস্তুত হচ্ছে, যা দিয়ে ওরা সামুদ্রিক অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর আমাদের দেশও অনেক টাকা খরচ করছে, যাতে সমুদ্র আর তার উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে আমরাও যে-কোনও শত্রুর মোকাবিলা করতে পারি।”

“সেইখানেই কি হিসেবের মধ্যে আসছে এই আই এন এস চক্র টু?” সি এম জিজ্ঞেস করলেন।

“ইয়েস ম্যাডাম,” সমরবাবু মাথা নাড়লেন, “এটা আমাদের একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড সাবমেরিন।”

“নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড?” একজন মন্ত্রী টেবিলের অন্যপ্রান্ত থেকে জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ,” জয় বলল এবার, “সাবমেরিন সাধারণত ডিজেল-ইলেকট্রিক চালিত হয়। এগুলোর প্রধান সমস্যা হল কিছু সময় পর-পরই এগুলোকে ভেসে উঠতে হয় ফুয়েল সংগ্রহ করতে। সেখানে নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড সাবমেরিন বহুদিন জলের তলায় থাকতে পারে। ট্যাকটিক্যাল দিক থেকে দেখতে গেলে এটা একটা বিশাল ব্যাপার। আমাদের হাতে এখন এই ধরনের সাবমেরিন আছে, যা সমুদ্র যুদ্ধ বা প্রতিরক্ষায় ভীষণ এফেক্টিভ। তাই তার নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেডের লঞ্চ কোড শত্রুপক্ষ যে চাইবে, তা আর আশ্চর্য কী!”

“এগজ্যাক্টলি,” সমরবাবু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, “তাই ওই অঞ্চলে ভারতের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড বা মিসাইলের লঞ্চ কোড যে-কোনও দেশ বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন চাইতে পারে । কারণ তাতে যেমন ভারতকে কোণঠাসা করা যাবে, তেমনই ভারত মহসাগরের উপর নিজের আধিপত্যও বজায় রাখা যাবে। তবে আর-একটা কারণও আছে,” সবাই তাকালেন সমরবাবুর দিকে। সমরবাবু বললেন, “আমাদের দেশের চারিদিক দিয়ে সন্ত্রাসবাদীরা ইনফিলট্রেট করতে চায় এবং করেও। ল্যান্ড বর্ডারস দিয়ে যেমন এই ইনফিলট্রেশন হয়, তেমন সি বর্ডারস দিয়েও হয়। যেমন কাসভরা সমুদ্রপথে ঢুকেছিল। এখন নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেডের কন্ট্রোল আমাদের শত্রুদের হাতে এসে গেলে ইন্ডিয়ান ওশন দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করা সন্ত্রাসবাদীদের একটা কভার দেওয়াও হতে পারে। তখন আমাদের সেটা ঠেকানো মুশকিল হবে।”

সমরবাবু কথা শেষ করার পর ঘরে কিছুক্ষণ সকলে চুপ করে থাকলেন। তারপর সি এম জিজ্ঞেস করলেন, “তা আমাদের এই লঞ্চ কোড পেতে কে চেষ্টা করছে বলে আপনি অনুমান করছেন?”

“ম্যাডাম,” এবার শশীকান্তজি বলেন “এটা বলা ডিফিকাল্ট। আওয়ার মেরিটাইম রাইভ্যাল ইন দিস জ়োন ইজ চায়না। কিন্তু পাকিস্তানও আছে, যে সব বিষয়ে বাগড়া দেয়। আবার এও হতে পারে, ইন্ডিয়ার সঙ্গে এদের টেনশন আছে জেনে সেটা অন্য কেউ এনক্যাশ করতে চাইছে। তবে যেই করতে চাইছে, সে চাইছে ইন্ডিয়ান ওশনের উপর আমাদের পাওয়ারটা কমজোর করে দিতে, আমাদের ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষতি করতে।”

সি এম চিন্তিত মুখে ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “আপনারা কী সাজেস্ট করছেন?”

সমরবাবু বললেন, “ম্যাডাম, এই মুহূর্তে আমাদের প্রায়রিটি হল ওয়ান মিলিয়ন ডলার জমা করা। সেটা কি করা সম্ভব?”

ডিফেন্স সেক্রেটারি শশীকান্তজি চিন্তিতমুখে বললেন, “আমি পি এম ও-র সঙ্গে কথা বলছি। তবে আর বেশি সময় তো নেই। কিন্তু টেররিস্টদের কাছে আমাদের কি এভাবে আত্মসমর্পণ করা ঠিক হবে? আমার মনে হয় টাকা দেওয়া যাবে না। আমাদের এখন কী করে এই থ্রেটটার মোকাবিলা করা যায়, সেটাই দেখতে হবে।”

“সরি টু ইন্টারাপ্ট স্যার ,” জয় কুমার চোয়াল শক্ত করে তাকালেন টেবিলের উপর রাখা টেলিফোনটার দিকে, তারপর বললেন, “টাকা দেওয়াটা কিছুতেই ঠিক হবে না। তার চেয়ে রাত দশটার আগে জানোয়ারটাকে ধরে ফেলাটাই একমাত্র সমাধান। এই ব্যাপারে আর দ্বিতীয় কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই স্যার, একদম নেই।”

শশীকান্তজি মাথা নাড়লেন, “এত অল্প সময়ে অত টাকা বের করে আনাও পসিবল নয়। সুতরাং ওকে খুঁজে বের করাটাই আমাদের একমাত্র অপশন।”

সত্যনারায়ণ দুবের দিনটা আজ ভালভাবে শুরু হয়নি। সকাল থেকেই নানা ঝামেলা লেগে আছে। আজ সপ্তমী, ট্রেনে প্রচুর ভিড় হবে সারাদিন। তার মধ্যে ওকে বন্দুক কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে টিকিট ঘরের সামনের কোলাপসিবল গেটে। আর চোখ রাখতে হবে কেউ সন্দেহজনক কিছু করছে কি না! স্টেশনে ও ছাড়া আরও দু’জন লাইট মেশিনগান নিয়ে পুলিশের লোক আছে। তাও ওকে ওর জায়গা থেকে নড়লে চলবে না।

যদিও ও জানে এটা রুটিন। কিছুই হবে না। সন্ত্রাসবাদীদের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে, সারা পৃথিবী পড়ে থাকতে ওরা এই মাঝেরহাট স্টেশনে এসে বোমা বা গুলি মারবে! তাও বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ওকে।

তবে হ্যাঁ, পুজোর ভিড়ে পকেটমার, ছিনতাই বা মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি ইত্যাদি চলেই। সেসব হলে ওকে অ্যাক্টিভ হতে হয়। আজও হবে। তবে সেসব ফালতু কাজ। সত্যনারায়ণের বিরক্ত লাগে। আর আজ তো আরও লাগছে। দিনটাই যে আজ ভালভাবে শুরু হয়নি!

সমস্যার নাম হল বাথরুম।

সত্যনারায়ণ যে মেসে থাকে, সেখানে বাথরুমের ছাদ সকালে ভেঙে পড়েছে। ফলে সেখানে বাথরুম ব্যবহার করতে পারেনি ও। তাড়াতাড়ি স্টেশনে এসেও দেখেছে স্টেশনের বাথরুমও যেন নরক হয়ে আছে। যে জমাদারটা আসে বাথরুম পরিষ্কার করতে, পুজো বলেই কি না কে জানে, আজ ডুব দিয়েছে। তখন থেকে শরীরে একটা অস্বস্তি হয়ে আছে। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা বাড়ছে, মেজাজও খারাপ হচ্ছে। তার উপর স্টেশনের অল্পবয়সি ফাজিল ছোঁড়াটা পিছনে লাগছে। বলছে, “কিঁউ দুবেজি গেটকে পাস খড়ে হোকে লড়কিয়া তাড় রহে হো?”

শয়তানটা সুযোগ পেলেই ওর পিছনে লাগে। দু’-একবার গালাগালিও দিয়েছে সত্যনারায়ণ, কিন্তু ছেলেটার হুঁশ নেই। খালি হাসে। একটু আগেও সত্যনারায়ণ রেগে যাওয়ায় হাসছিল ছেলেটা। কিন্তু আর সেদিকে মন দিতে পারেনি ও। পেটের ভিতরে যেন রাম-রাবণের যুদ্ধ লেগেছে। একবার বাথরুমে না গেলেই নয়।

সত্যনারায়ণ তাই এখন লোটা হাতে লাইন ধরে হাঁটছে মাঝেরহাট ব্রিজের তলা দিয়ে দূরের ঝোপের দিকে। গ্রামে থাকতে এসব মাঠে যাওয়া অভ্যেস ছিল, কিন্তু এখন কলকাতায় এসে আর এসব নেই। আসলে আজ দিনটাই যে গন্ডগোলের!

সাবধানে দু’দিক দেখে রেল লাইনটা পার করল সত্যনারায়ণ। ব্রিজের এই লাইনটা নিউ আলিপুরের দিকে চলে গিয়েছে। লাইনের মাঝে সামান্য ঝোপ আর সবুজ ঘাস। দূরে মাঝেরহাট স্টেশনটা দেখা যাচ্ছে। একদিকে বজবজ লাইন আর অন্যদিকে চক্ররেলের লাইন।

এই চক্র রেলের লাইনের দিকটা বেশ শুনশান। পাশের খালি লাইনে একটা ডিজেল ইঞ্জিন সমেত মালগাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন একা পড়ে থাকা একটা কেন্নো।

সত্যনারায়ণ দ্রুত পা চালাল। একবার বাঁ হাতের ঘড়িটা দেখে নিল। বারোটা বাজে। ওকে বলা হয়েছে যেন দেরি না করে। আরে বাবা, ও কি আর শখ করে এখানে এই ঝোপের মধ্যে এসেছে!

চারিদিক দেখে নিল সত্যনারায়ণ। না, সাপ খোপ নেই। যাক বাবা! ও হাতের লোটাটা রাখল মাটিতে। তারপর বসতে গেল। কিন্তু বসতে পারল না। চোখের কোণ দিয়ে ওই দূরে দাঁড়ানো মালগাড়িটায় কী যেন একটা ঝলসে উঠল মনে হল, আর সঙ্গে সঙ্গে রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ও তাকাল সেই দিকে। আর ভয়ের সঙ্গে দেখল, প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হল একটা। দূরের মালগাড়ির ডিজেল ইঞ্জিনটার তলায় যেন ঝলসে উঠল নরকের আগুন। অত ভারী ইঞ্জিনটা দেশলাই বাক্সের মতো ছিটকে উঠল হাওয়ায়! তারপর বিকট শব্দে আছড়ে পড়ল পিছনে দাঁড়ানো বগিগুলোর উপর।

কী করবে বুঝতে না পেরে ভয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল সত্যনারায়ণ।

চিফ সেক্রেটারি, ডিফেন্স সেক্রেটারি, সি এম, কয়েকজন মন্ত্রী আর পুলিশ কমিশনার প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বাইরে প্রেস এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনই সি এম-এর স্টেটমেন্ট চাই। মাঝেরহাটের কাছে যে বড় বিস্ফোরণটা হয়েছে, তাতে সারা রাজ্য নড়েচড়ে বসেছে। সপ্তমী পুজোর মধ্যে তবে কি জঙ্গি হানা হল কলকাতায়?

সব বাংলা নিউজ চ্যানেলই পুজোর আড্ডা আর গান গল্প থামিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রেকিং নিউজে। আমেরিকান কনসুলেটের সামনে গুলি চালানোর পরে আবার কি জঙ্গিরা নিশানা করল এই শহরকে?

সি এম দ্রুত প্রেস মিট ডেকেছেন। উনি কী বলবেন মোটামুটি ঠিক হয়ে গিয়েছে এই ঘরেই। বলা হবে যে, এটা শর্ট-সার্কিট থেকে বিস্ফোরণ। জঙ্গি-হানা টানা কিছুই নয়। মানুষের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর ডিফেন্স সেক্রেটারি এখন যে কলকাতায় রয়েছেন, সেটা জাস্ট কাকতালীয়। উনি কলকাতায় এসেছেন একটা ব্যক্তিগত কাজে। তাই সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন রাইটার্সে।

আসলে প্যানিক ছড়াতে দেওয়া চলবে না কিছুতেই।

সি এম-এর প্রেস মিটটা জয়, আদিল আর বাকিরা দেখল ঘরের ভিতরের লাইভ টি ভি-তে। সি.এম খুব সহজভাবেই ব্যাপারটা সামলে দিলেন। সামান্য দু’-একটা হাসি ঠাট্টা করে পরিবেশটা সহজও করে দিলেন। তারপর সকলকে পুজোর শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করলেন বক্তব্য। কেউ বুঝতেই পারল না, আসলে কী ঘটতে চলেছে এখন।

বড় ঘরে ফিরেই সি এম প্রশ্ন করলেন “ফোন এসেছিল?”

জয় নীরবে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল। তারপর যোগ করল, “জানি না ম্যাডাম, কেন এখনও ফোন করল না। সাড়ে বারোটা বাজে। এখনও কল এল না কেন, সেটাই ভাবছি!”

শশীকান্তজি বললেন, “এমন পিকিউলিয়ার সিচুয়েশন জীবনে দেখিনি। যদি কিছু জানা যেত! একটা লোক এরকমভাবে একা মুভ করছে, এর কোনও লিঙ্ক পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কে লোকটা? কার লোক? কোথা থেকে এল? নাম প্রিমো! এটা কেমন নাম? আর লোকটাই বা আসলে কে?”

একজন পুলিশ অফিসার দ্রুত দরজা ঠেলে ঢুকল ভিতরে। হাতে একগোছা পেপার। সকলে কথা থামিয়ে তাকালেন অফিসারটির দিকে।

পচনন্দাজি বললেন, “কেয়া খবর হ্যায়? কুছ মিলা?”

অফিসারটি সকলের দিকে তাকিয়ে সামান্য নড করে টেবিলে কাগজগুলো ছড়িয়ে দিল। বলল, “কলকাতায় আসার সমস্ত সম্ভাব্য ট্রেন, বাস আর এরোপ্লেনের প্যাসেঞ্জার ইনফো এখানে আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে প্রিমো উত্তমো বলে একজন প্যাসেঞ্জার গতকাল দমদমে নেমেছে। সিকিয়োরিটি ক্যামেরা থেকে তার ছবিটাও আমরা পেয়েছি।”

অফিসার পেনড্রাইভটা একটা ইউ এস বি পোর্টে গুঁজে দিল। তারপর দেওয়ালের বড় মনিটরে ভেসে উঠল পরপর কয়েকটা থাম্বনেল ছবি। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, সিকিয়োরিটি ক্যামেরায় তোলা। তবে লোকটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মাথার টুপিতে মুখের কিছুটা ঢাকা।

সি এম অবাক হয়ে বললেন, “আরে এ তো একদম ইয়ং একটা ছেলে। গায়ের রংও ভারতীয়দের মতো। কত বয়স হবে এর? হার্ডলি পঁচিশ! এরই নাম প্রিমো?”

“ইয়েস ম্যাডাম,” অফিসার মাথা নাড়ল, “গতকাল সকালে এসেছে ও। কিন্তু তারপর তো মিশে গিয়েছে শহরের ভিড়ে। তাই এখন ট্রেস করে…”

জয় বলল, “হ্যাঁ, ডিফিকাল্ট টু ট্রেস। তাও একটা লিড তো পাওয়া গেল।”

পচনন্দাজি অফিসারকে বললেন, “তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতার সমস্ত থানায় এই ছবি পাঠিয়ে দাও। কলকাতার রাস্তায় সিভিল ড্রেসে ঘুরে বেড়ানো আমাদের সমস্ত লোকেদের হাতে এর ছবি যেন থাকে। আর তোমাদের যত কনট্যাক্ট আছে সকলকে ট্যাপ করে দেখো, একে চেনে কিনা। মেটিয়াবুরুজ, তিলজলা, খিদিরপুর, নিউমার্কেট, টালিগঞ্জ, বারুইপুর সমস্ত জায়গায় দেখো, কেউ একে চিনতে পারে কি না।”

“ইয়েস স্যার,” অফিসার মাথা ঝোঁকাল। তারপর বলল “আমরা স্যার আমাদের রেকর্ড দেখেছি। এমন কারও নাম নেই। আমরা জানি না এ কে।”

“ঠিক আছে,” শশীকান্তজি বললেন, “ছবিটা দিল্লিতেও পাঠিয়ে দাও। আমরা সারা পৃথিবীতে খোঁজ করে দেখছি কেউ একে চেনে কিনা বা কোন দলের সঙ্গে লোকটা যুক্ত। আমি নিজে কথা বলছি দিল্লিতে। ইউ শুড হারি আপ। এত লোকের মাঝে কিছু যদি একটা কেলেঙ্কারি ঘটে যায়, তবে আর রক্ষা থাকবে না!”

অফিসার সকলকে স্যালুট করে বেরিয়ে গেলেন বাইরে।

“ক্যাব,” ছোট করে হঠাৎ বলে উঠল আদিল। সকলে ঘুরে তাকাল আদিলের দিকে। সমরবাবু জিজ্ঞেস করলেন “মানে?”

“ক্যাব, ট্যাক্সি, হেজেন, মারসিনারি, যে নামেই ডাকুন ব্যাপারটা এক। এই প্রিমো একজন হায়ার্ড গান। টাকা নিয়ে সে কাজ করে। আমার মনে হয় এটাই লোকটার পরিচয়। মনে হয় ও কোনও দলেরই সদস্য নয়। যে ওকে টাকা দেবে, ও তার। ও আসলে ফ্রিলান্সার। তাই ওর রেকর্ড নেই তেমন। এমনকী নামটাও যে ভুয়ো, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। লক্ষ করে দেখুন, ও কিন্তু ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কলকাতায় এসেছে। এখন খোঁজ নিতে হবে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে এরকম দেখতে কেউ ভারতে ঢুকেছে কি না! ঢুকলে কোন এয়ারপোর্ট দিয়ে ঢুকেছে, সেটা জানতে হবে। যদিও এটা বের করা সময়সাপেক্ষ। আর যদি বেআইনিভাবে বর্ডার ক্রস করে, তবে তো বলাই সম্ভব নয়,” আদিল মাথা নাড়ল।

“তবে কি কিছুই করা যায় না?” শশীকান্তজির গলাটা কেমন যেন অসহায় শোনাল।

এবার উত্তর দিল জয় কুমার। বলল, “লোকটার কোনও কানেকশন না পেলে তো খুব সমস্যা। এখন ওয়েট করা ছাড়া তো…”

জয় কুমার কথা শেষ করার আগেই টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। জয় হাত তুলে সকলকে চুপ করতে বলল, তারপর স্পিকারটা অন করে এল ই ডি স্ক্রিনে চোখ রাখল। দেখা গেল শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের কাছে ব্লিঙ্ক করছে মোবাইলের লোকেশন।

জয় হতাশায় মাথা নাড়ল। ও জানে, ওই সময়ে ওইখানে প্রচুর ভিড়। লোকটা খুব বুদ্ধি করে ভিড়ের মধ্যে থেকে ব্যবহার করছে মোবাইল।

“হ্যালো মিস্টার কুমার,” হাসল প্রিমো, “নেতাজির ঘোড়াটার মতো তেজ যদি গোটা দেশটার থাকত, তবে আপনারা সব বিষয়ে এমন বোকা বনতেন না।”

জয় কিছু বলার আগেই আদিল বলে উঠল, “ইন্ডিয়ানদের ভদ্রতাকে তাঁদের দুর্বলতা ভাববেন না মিস্টার প্রিমো উত্তমো।”

“প্রিমো উত্তমো!” প্রিমো হাসল, “সো ইউ হ্যাভ ফাউন্ড মি! গ্রেট। আপনারা ভালই কাজ করছেন। যদিও আমার কাজটা হচ্ছে না। এখনও টাকাটা পেলাম না তো! তাই তো ইঞ্জিনটার ওই দশা হল। আপনাদের কোনও লোকাল ট্রেন বা মেট্রোরও এমনটা হতে পারত। কিন্তু ভাবলাম, ওয়ার্নিং-এর জন্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একা মালগাড়ির ইঞ্জিনই এনাফ। তবে পরেরবার কিন্তু তা হবে না,” প্রিমোর গলাটা শক্ত হয়ে এল শেষের কথাগুলো বলার সময়।

“তুমি কী চাও?” সি এম জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি তো বলেইছি যে, জয় কুমারের সঙ্গে ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলব না। প্লিজ় একজনের মাধ্যমেই কথা বলুন।”

জয় বলল, “ওকে, আমি একই প্রশ্ন করছি, কী চাও তুমি?”

“কেন, ভুলে গেলেন? আই এন এস চক্র টু-র নিউক্লিয়ার মিসাইলের লঞ্চ কোড। জানি, ব্যাপারটা কঠিন। তাই আপনাদের আলোচনার জন্য আমি রাত দশটা অবধি টাইম দিয়েছি। আর সময় দেওয়ার মূল্য হিসেবে প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর ওয়ান মিলিয়ান ডলার। যেটা প্রথমবারে আপনারা দেননি।”

“বি সেনসিবল,” জয় ঠান্ডা গলায় বলল, “অত টাকা কি দেওয়া যায় হঠাৎ করে?”

“সেটা আপনাদের প্রবলেম। তবে পরেরবার না দিলে, মানে দুপুর দুটোয় আগের এক প্লাস এখনকার এক না দিলে পরের সাংবাদিক সম্মেলনটায় কিন্তু অন্য কিছু বলতে হবে,” প্রিমো হাসল, “বাই দ্য ওয়ে, ম্যাডাম খুব ভাল কথা বলেন। এটাও খুব ভাল সামলেছেন। তবে পরেরটা কিন্তু শর্ট সার্কিট বলে আর পার পাওয়া যাবে না। শুনুন আপনারা, পরের এক্সপ্লোশন উইল বি বিগ। প্লিজ় কিছু পেটি ডলারের জন্য মানুষকে কিন্তু মারবেন না। আই উইল ওয়েট টু হিয়ার দ্য ডলার রিং।”

সবার চোখের সামনে আবার আগের মতোই টুপ করে বন্ধ হয়ে গেল স্ক্রিনের মোবাইল লোকেশন। প্রিমো আবার ডুবে গেল কলকাতার মানুষের সমুদ্রে!

১০

ফোনটা কেটে প্রিমো অন্য মোবাইল বের করল। তারপর দ্রুত হাতে ডায়াল করল একটা নম্বর। আর এশিয়া মহাদেশ ছাড়িয়ে ইয়োরোপে ছড়িয়ে পড়ল সেই ডাক। অস্ট্রিয়ার শান্ত এক পাহাড়ের কোলে, এক গির্জায় বেজে উঠল মোবাইল। নিজের বড় ঘরে বসে থাকা ফাদার তাকালেন টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটার দিকে। দেখলেন চেনা নামটা। তারপর চোখ রাখলেন উলটোদিকে বসা সুট পরা শক্তপোক্ত লোকটার চোখে। লোকটার নাম ব্রুনো। চোখে চোখ পড়ায় ব্রুনো হাসল। তারপর জার্মান উচ্চারণে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, “ফোনটা ধরুন।”

ফাদার কানের হিয়ারিং-এডটা ঠিক করে ফোনটা ধরলেন, “আমি আর আমরা ঠিক আছি। আপাতত।”

ব্রুনো ওর নীল চোখ দুটো দিয়ে তাকাল ফাদারের দিকে। তারপর নরম গলায় বলল, “এবার রেখে দিন ফোনটা।”

১১

সি এম ফোনটা রেখে তাকালেন ঘরে বসা সকলের দিকে। তারপর টেবিল থেকে গ্লাস তুলে জল খেলেন একটু। বললেন, “টাকার বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছে। পি এম নিজে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। তারপর চিদাম্বরমজির সঙ্গে কথা বলে টাকার বন্দোবস্ত করতে বলেছেন। উই কান্ট টেক এনি রিস্ক।”

সারা ঘরে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। কে আগে কী বলবেন, সেটাই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ। একটু পরে চিফ সেক্রেটারি সমরবাবুই প্রথম কথা বললেন, “আই ফিল পাওয়ারলেস ম্যাডাম। একটা পেটি ক্রিমিনালের সামনে আমাদের এইভাবে নুয়ে পড়তে হচ্ছে! আনফরচুনেট বলাটা কম বলা হবে। এত বড় একটা শহর, পুজোর এমন ভিড়, তার মধ্যে কোথায় খুঁজব আমরা লোকটাকে! যত সময় যাচ্ছে, পুজোর ভিড় বাড়ছে! এই ভিড়ে কোথায় পাব তাকে। আর তাকে তো আইডেন্টিফাইও করা যাচ্ছে না! সে কার সঙ্গে যুক্ত, কী তার পাস্ট রেকর্ড, কিছুই জানা যাচ্ছে না! লোকটা যেন ফেসলেস ডেভিল! এখন না হয় ডলার দিয়ে মেটানো হল, কিন্তু তারপর লঞ্চ কোডের ব্যাপারটা? সেটা কি দেওয়া সম্ভব কখনও? দেশের সিকিয়োরিটি উইল বি অ্যাট স্টেক! আবার না দিলেও কত লোককে যে বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে, তার ঠিক নেই!”

জয় বলল, “স্যার, লোকটা আবার দুটোর সময় ফোন করবে, তখন আমি চেষ্টা করব অন্যভাবে ট্যাকল করতে, তারপর আদিলের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনও প্ল্যান আছে?”

আদিল মাথা নাড়ল “আছে।”

সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরের চোখ ঘুরে গেল আদিলের দিকে। শশীকান্তজি জিজ্ঞেস করলেন, “আছে তো বলছ না কেন? কী প্ল্যান তোমার?”

“একটা চপার বা হেলিকপ্টার লাগবে স্যার,” আদিল বলল ছোট্ট করে।

“হেলিকপ্টার?” হৃদয়েশ জিজ্ঞেস করলেন, “তার জন্য তো পারমিশন লাগবে।”

“হয়ে যাবে,” সি এম কথাটা বলেই তাকালেন আদিলের দিকে, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার প্ল্যানটা কী? হেলিকপ্টার দিয়ে কী হবে?”

আদিল বলল, “ম্যাডাম, খুব সিম্পল একটা মেথড। জিপিএস ট্র্যাকার নিয়ে আমি আকাশে উড়ব। প্রিমো যখন ফোন করবে, তখন ও কোন লোকেশনে আছে সেটা আপনাদের সঙ্গে আমিও দেখতে পারব। আর সেটা পেলেই চপার থেকে রাস্তায় নেমে আমি ট্র্যাক করতে করতে দেখব ওকে পাই কি না!”

“কিন্তু,” জয় বলল, “ও তো অফ করে দিচ্ছে ফোন।”

“স্যার, সেটা আপনাকে দেখতে হবে। দেখতে হবে, যাতে ও বেশি সময় লাইনে থাকে। মেক হিম টক। যা খুশি বলে ওকে যতটা সময় পারা যায়, আটকে রাখতে হবে লাইনে। আমায় সময় দেবেন, যাতে ওকে ট্যাপ করতে পারি।”

সি এম ঘড়ি দেখলেন। তারপর ডিফেন্স সেক্রেটারিকে বললেন, “শশীকান্তজি আপনি একটু আর্মিতে কথা বলুন, যাতে এখনই হেলিকপ্টার পাওয়া যায়। দেখবেন, প্রোটোকলে যেন না আটকায় কোথাও। ইটস অ্যান এমারজেন্সি!”

শশীকান্তজি নিজেই ফোনটা টেনে ডায়াল করতে লাগলেন।

সি এম জিজ্ঞেস করলেন, “আদিল তুমি প্যারাশুটে করে আকাশ থেকে নামবে?”

“দেখি ম্যাডাম। রোপেও নামতে পারি, ফ্রি ফলও হতে পারে।”

জয় বলল, “ম্যাডাম, এই মার্কোসরা এক-একজন এক-একটা জেমস বন্ড। দে আর দ্য বেস্ট কমান্ডোস।”

সি এম চিন্তিত মুখে বললেন, “যা সিচুয়েশন মনে হচ্ছে, উই নিড সামথিং মোর দ্যান জাস্ট বেস্ট। উই নিড এক্সট্রা-অর্ডিনারি।”

আদিল বলল, “আপনি ভরসা করতে পারেন ম্যাডাম। ক্রিমিনাল যতই লুনাটিক বা বুদ্ধিমান হোক না কেন, সে একটা চান্স দেবেই।”

শশীকান্তজি ফোনটা রেখে বললেন, “আমি কথা বলে নিয়েছি। চপার আসছে। এখন আমাদের চান্সটা তৈরি করে নিতে হবে। ইডেন গার্ডেনসে-এর সামনের মাঠে চপারটা থাকবে। ইউ জাস্ট মেক ইট ফাস্ট বয়। আমরা তোমার উপর নির্ভর করে আছি, এটা মনে রেখো।”

১২

পকেট থেকে অন্য ফোনটা বের করল প্রিমো। এটা অন করাই থাকে। তবে এটা ট্র্যাক করা যাবে না। সেভাবেই প্রোগ্রাম করা।

ফোনটা সাইলেন্ট থাকলেও ভাইব্রেট করায় বুঝল যে, কল এসেছে একটা। ও জানে এটা কার কল। না, সামনাসামনি চেনে না তাকে। যা কথা ফোনেই হয়েছে। তবে জানে, কলটা আসছে লাইন অফ কন্ট্রোলের ওপার থেকে।

প্রিমো ফোনটা কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ, বলো।”

“কলকাতার পুজো কেমন লাগছে?” ওপাশের গলাটা হালকাভাবে হাসল।

“ফাদারের যেন কিছু না হয়,” প্রিমো গম্ভীর গলায় বলল।

“তুমি তো কল করে কথা বললে। লঞ্চ কোডটা এনে দাও, ফাদার ঠিক থাকবে।”

“আমি চেষ্টা করছি,” প্রিমো চোয়াল শক্ত করল, “তবে এটা টাফ। কেউ নিজের নিউক্লিয়ার ওয়েপন অন্য কাউকে দিয়ে দেয় কি?”

“দ্যাট ইজ় নট আওয়ার কনসার্ন। তুমি তোমার কাজ করো। না হলে কিন্তু ফাদারের অবস্থা খারাপ হবে। আমাদের মাত্র একটা লোক ওর সামনে বসে আছে বটে, কিন্তু জেনো, একটা বুড়ো আর অরফ্যানেজের বাচ্চাগুলোকে মারতে ওই যথেষ্ট।”

“কিন্তু…” প্রিমো কথাটা শেষ করতে পারল না। তার আগেই কট করে কেটে গেল লাইনটা। চোয়াল শক্ত করে মুখে এসে যাওয়া খারাপ কথাটা আটকাল প্রিমো। তারপর চারদিকে দেখল। সামনেই পরীক্ষিত্ ব্যায়াম সমিতির পুজো প্যান্ডেল। খুব নাম করা পুজো। দুপুর দুটো বাজে এখন। ডলার নিশ্চয়ই চলে এসেছে। ও জানে, মরিশাস থেকে টনি ওকে যে-কোনও মুহূর্তে ফোন করে টাকা ট্রান্সফারের রিপোর্ট জানিয়ে দেবে।

চারদিকের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখল প্রিমো। কত নিশ্চিন্ত মানুষ! তারা জানেও না কী বিপদ ঘুরছে ওদের মাথায়। এতগুলো প্রাণ! আর ওইদিকে ফাদার আর বাচ্চারা! জীবন আর কতবার ওকে ফেলবে এমন অবস্থায়?

না, নিজেকে সামলাতে হবে। হাতের কাজটা শেষ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ও প্রফেশনাল।

ক্লিং করে ফোনটা বেজে উঠল আবার। মেসেজ। প্রিমো দেখল টনি পাঠিয়েছে। টু মিলিয়ন রিসিভড অ্যান্ড সেফলি ডেসপ্যাচড।

মনে মনে হাসল প্রিমো। অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকে গিয়েছে। তবে ওর টাকা নয়। অন্যের টাকা। কেন অন্যের টাকার জন্য এত খাটছে ও? ফাদার আর বাচ্চারা ছাড়া আর কী পাবে ও?

প্রিমো সুইচ্‌ড অফ হয়ে থাকা মোবাইল অন করল। তারপর সেখানে সেভ করা একটা মাত্র নম্বরই ডায়েল করে কানে লাগানো ব্লু-টুথ হেডসেটটা হাত দিয়ে অ্যাডজাস্ট করে নিল।

রিং হচ্ছে। প্রিমো নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে সামনে দিয়ে আসা এক ঢল মানুষের ভিড়ে গুঁজে দিল নিজেকে।

১৩

সামনের স্ক্রিনে মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ফুটে উঠল। জয় সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কোথায়? তারপর স্ক্রিনে রাস্তার নামটা পড়ে বলল, বিবেকানন্দ রোড! ও এখনও উত্তর কলকাতায় আছে!

“পরীক্ষিৎ ব্যায়াম সমিতি,” সমরবাবু চাপা গলায় বললেন, “ওই পুজো প্যান্ডেলের কাছাকাছি আছে লোকটা।”

জয় স্বাভাবিক গলায় বলল, “হ্যালো প্রিমো। তোমার টাকা চলে গিয়েছে।”

“জানি তো,” প্রিমো হাসল, “তা আমার পরের বায়নাটা?”

জয় চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল কমিশনার পচনন্দাজিকে। উনি পাশে দাঁড়ানো একজন অফিসারকে মাথা নেড়ে নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অফিসারটি কম্পিউটারে কয়েকটা কম্যান্ড টাইপ করল আর সামনের স্ক্রিনের মোবাইল টাওয়ার লোকেশনের ফিডটা ট্র্যান্সমিট হয়ে গেল হেলিকপ্টারে বসে থাকা আদিলের কাছে।

জয় বলল, “তুমি তো বিস্কিট বা লজেন্সের জন্য বায়না করছ না। জানোই তো, যেটা চাইছ, সেটা কোনও দেশই দেবে না। তার চেয়ে অন্য কিছু ভাবো।”

সি এম ঘড়ি দেখলেন। আকাশপথে ইডেন গার্ডেন্সের সামনের মাঠ থেকে বিবেকানন্দ রোড চার কিলোমিটার মতো। যেতে কয়েক সেকেন্ড লাগবে মাত্র। তবে কোথায় আর কীভাবে ল্যান্ড করবে আদিল, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তার লোকজনও খুব অবাক হবে হঠাৎ হেলিকপ্টার দেখে!

এতক্ষণে নিশ্চয়ই আদিলের হেলিকপ্টার পৌঁছে গিয়েছে বিবেকানন্দ রোডের মাথায়। ও কি খুঁজে পাবে কোথায় আছে শয়তানটা?

“আমি আর কী ভাবব? আমার তো ভাবাভাবি শেষ হয়ে গিয়েছে। শুনুন না,” প্রিমো বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় বলল, “বাবুঘাটের কাছে একটা বড় লঞ্চে সি-৪ মানে আর ডি এক্স-এর একটা ছোট্ট প্যাকেট রাখা আছে। তবে সেটা কিন্তু আগের মতো নির্বিষ নয়। বরং তাতে ডিটোনেটর গোঁজা আছে। আমি যদি রিমোট দিয়ে অন করি, তবে মিনিট দশেকের মধ্যে ফাটবে সেটা। আর ফাটলে আশপাশের আরও চার-পাঁচটা লঞ্চও উড়ে যাবে। আপনারা যখন বলছেন আমার বায়না মেটাবেন না, তখন আমি না হয় এটা ওটা ভাঙতে শুরু করি, বাচ্চারা যেমন করে আর কী! মনে রাখবেন, এরপর কিন্তু ভাঙব হাওড়া ব্রিজ। এই নিন অন করলাম বোমাটা। পারলে বাঁচান নিজেদের। আমি আবার পরে ফোন করব, কেমন?”

“প্রিমো, প্লিজ় প্রিমো, ডোন্ট ডু ইট। প্লিজ়,” জয় স্পিকারের উপর ঝুঁকে পড়ল।

“অন করে দিয়েছি তো। এটা ইররিভার্সিবল। ওখানে গিয়ে ডি-অ্যাক্টিভেট করতে পারলে করুন। না হলে ঠিক করুন আবার প্রেসকে শর্ট সার্কিট বলবেন কিনা! তবে, একটা হিন্ট দিই। ব্রাইড অফ দ্য সি-র হার্ট। দেখুন পারেন কিনা ধাঁধাটা বুঝতে।”

আর কেউ কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেল।

১৪

পরীক্ষিৎ ব্যায়াম সমিতির প্যান্ডেলের মাথার অনেকটা উপরে হেলিকপ্টারে বসে স্থির হয়ে গেল আদিল। ও প্যারাশুট দিয়ে ঝাঁপ দেবে বলে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ কথাটাতেই কেমন যেন আটকে গেল। আর-একটা বোমা! সর্বনাশ। আসলে আগেই হয়তো ঝাঁপ দিত ও, কিন্তু চারিদিকে এত বাঁশের স্ট্রাকচার, এতরকম প্যান্ডেলের লাইটিং পোস্ট আর ওভারহেড তার, যে প্যারাশুট নিয়ে নামা খুব একটা সহজ নয়।

আদিল দেখল, ওর সামনের স্ক্রিনে মোবাইলের লোকেশন নিভে গেল। মানে আবার হারিয়ে গেল প্রিমো!

“হ্যালো,” সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টারের স্পিকারে জয়ের গলা পেল আদিল, “মিস্টার পচনন্দা কিছু বলবেন তোমায়।”

পচনন্দাজি বললেন, “শুনলে তো। বাবুঘাট অঞ্চলে পুলিশ প্যাট্রোল আছে বটে, কিন্তু বম্ব ডিঅ্যাক্টিভেট করার মতো বম্ব স্কোয়াডের লোকেদের লালবাজার থেকে ভিড় ঠেলে ওখানে পৌঁছোতে অনেক সময় লাগবে। ইউ জাস্ট হ্যাভ দ্য এয়ার অ্যাডভান্টেজ।”

“ও কে, আমি যাচ্ছি,” আদিল পাশে বসা পাইলটকে ইঙ্গিত করল বাবুঘাটের দিকে যেতে। তারপর বলল, “কিন্তু ওখানে তো অনেক লঞ্চ থাকে, কোনটায় বোমা আছে কী করে বুঝব?”

জয় উত্তরে বলল, “জানি না। ইউ জাস্ট ট্রাই। ও তো বলল ব্রাইড অফ দ্য সি। জানি না, এর কী মানে। যাই করো, জাস্ট ওই লুনাটিকটাকে আটকাও।”

১৫

গঙ্গার উপর অনেকটা নেমে এসে হেলিকপ্টারটা জল থেকে পঞ্চাশ মিটারের মতো উচ্চতায় হোভার করতে লাগল। দরজা দিয়ে ঝুঁকে আদিল দেখল, সার সার লঞ্চ দাঁড় করানো আছে। এর মধ্যেই কি কোনও একটাতে লুকোনো আছে বোমা?

বোমা নিয়ে মার্কোসদের পড়াশোনা করতে হয়। এই সম্বন্ধে ডিটেল জানতেই হয় ওদের। তাই সি-৪ মানে আর ডি এক্স নিয়ে জ্ঞান আছে আদিলের।

এই সাবানের মতো জিনিসটা অদ্ভুত! যেমন খুশি আকার দেওয়া যায়। ছুড়ে মারলে বা আগুন লাগলে ফাটে না। কিন্তু কোনও ডিটোনেটর দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে পড়ে। এই কারণে এটাই এখন সন্ত্রাসবাদীদের সবচেয়ে পছন্দের অস্ত্র। লাইট, অ্যাডাপ্টেবল অ্যান্ড ডেডলি!

প্রায় দশটা লঞ্চ গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশাপাশি। আদিল হিসাব করে দেখল যে, সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, যদি মাঝখানের লঞ্চগুলোর একটায় আর ডি এক্স থাকে।

গঙ্গার পাশে এরই মধ্যে বেশ কিছু পুলিশ এসে জমা হয়েছে। আদিল বুঝল খবর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ লোকজনদের যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখছে। কাছেই ফোর্ট উইলিয়াম। তবে সৈন্যবাহিনীকে এখনও ইনভলভ করা হয়নি।

ঘড়ি দেখল আদিল। প্রায় আড়াই মিনিট হয়ে গিয়েছে। প্রিমো যদি সত্যি কোনও বোমা লুকিয়ে রাখে, তবে আর মাত্র সাড়ে সাত মিনিট বাকি। দশটা লঞ্চ আছে এখানে। কিছুটা দূরে আরও খানছয়েক লঞ্চ রাখা আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ওগুলোতে বোমা না থাকার চান্সই বেশি।

আদিল হেলিকপ্টার থেকে দড়ি ঝুলিয়ে তরতর করে নেমে এল মাঝের লঞ্চে।

পুরনো একটা লঞ্চ। খয়েরি রঙের। নাম পেয়ারি। এটা তো মিলছে না। ব্রাইড অফ দ্য সি তো নাম নয়! তবে?

আদিল দ্রুত একলাফে পাশের লঞ্চে গেল। এটার নাম বাহাদুর। নাহ্! এটাও তো মিলছে না। তবে? ব্রাইড অফ দ্য সি কি অন্য কিছু?

ঘেমে উঠল আদিল। তবে মাথা ঠান্ডা রাখল। ফোকাস ঠিক রাখাটাই মার্কোসদের ট্রেনিং-এর আসল কথা। মিনিট তিনেকের মধ্যে ও দশটা লঞ্চ ঘুরে দেখল। কোনওটার নামই ব্রাইড অফ দ্য সি নয়। তবে কি প্রিমো মিথ্যে কথা বলল? কিন্তু এমন ক্রিমিনালরা তো মিথ্যে বলে না। বরং এমন নানা হিন্ট দিয়ে লেজে খেলায় এরা। নিজেদের বুদ্ধি নিয়ে অদ্ভুত একটা অহংকার কাজ করে এদের।

আচমকা কোমরের কাছের ফোনটা বেজে উঠল। জয় কুমার।

“ইয়েস স্যর,” আদিল ফোনটা ধরে ঠোঁট কামড়াল। সময় নষ্ট হচ্ছে। জয় কি বুঝতে পারছে না?

“কিছু পেলে?” জয়ের গলায় টেনশন।

“স্যর, আয়্যাম লুকিং ফর ইট। টাইম ইজ রানিং আউট। আমি পরে রিপোর্ট করছি। রাখছি।”

জয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে পকেটে রাখল আদিল। তারপর বাঁদিকের কোমরে ঝোলানো দূরবিনটা নিয়ে চোখে লাগিয়ে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লঞ্চগুলো দেখল। সায়রা, জলি, ভেনিস, চণ্ডীমাতা, রূপসি আর জলপরি। নামগুলো দেখে হতাশ হল আদিল। ব্রাইড অফ দ্য সি তো নেই! তবে?

সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। হাতের ঘড়িতে মাইক্রো সেকেন্ড আর সেকেন্ডের ডিজিটাল কাউন্টডাউন যেন খুব দ্রুত হয়ে চলেছে।

আদিল চোখ বন্ধ করল। কী মানে হতে পারে এটার? কী মানে হতে পারে? আচমকা চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে ওঠায় যেন ছ্যাঁকা খেল ও। বছর দুয়েক আগে ইতালীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা জয়েন্ট এক্সারসাইজ হয়েছিল ওদের। সেটার শেষে আদিলরা একটু ঘুরে দেখেছিল দেশটা।

রবের্তো বলে একজন ইতালীয় কম্যান্ডোর সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওর। ঘুরে বেড়ানোর সময় একটা শহরে ঢোকার আগে বড় সাইনবোর্ডে লেখা ছিল, ‘Benvenuto alla sposa del mare’। আদিল সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “এটার মানে কী রবের্তো?”

রবের্তো হেসে ভাঙা ইংরিজিতে বলেছিল, “এটার মানে Welcome to the bride of the sea। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় শহর এটা। আদিল তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি ভেনিসে।”

ভেনিস! ব্রাইড অফ দ্য সি!

ওয়াকিটকিতে হেলিকপ্টারের পাইলটকে আদিল ছোট্ট করে বলল যে, দূরে দাঁড়ানো সবুজ রঙের লঞ্চের দিকে যেন নিয়ে যায় ওকে। তারপর হেলিকপ্টার থেকে ঝোলানো দড়িটা হাতে আর পায়ে পেঁচিয়ে ঝুলে রইল আদিল। নিমেষের মধ্যে ভেনিস নামের লঞ্চে পৌঁছে গেল ও।

এবার হার্ট! সেটা কী? আদিল ঘড়ি দেখল। আর তিন মিনিট বাকি। হার্ট খুঁজে বের করতে হবে ওকে। কিন্তু কী হতে পারে হার্ট? একটা যানের হৃত্পিণ্ড কী হতে পারে? ইঞ্জিন! নিশ্চয়ই ইঞ্জিন।

আদিল জানে, এমন লঞ্চের ইঞ্জিন কোথায় থাকতে পারে। ও পড়িমরি করে দৌড়োল। ইঞ্জিনরুমে পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকাল আদিল। আর মিনিট দু’য়েক বাকি। কোথায় বোমা?

লঞ্চটা কেমন যেন পরিত্যক্ত ধরনের! বাইরের দরজা দিয়ে বিকেলের চা-রঙের আলো ঢুকে আসছে। বাকিটা কেমন যেন সিপিয়া টোনের ছবির মতো!

আদিল ইঞ্জিনের আশপাশে খুঁজতে লাগল দ্রুত। সময় কমে আসছে। আর দেড় মিনিট। আদিল পাগলের মতো এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। সোয়া এক মিনিট। এক মিনিট। কোথায় বোমা? ইঞ্জিনের কাছে তো কিছু নেই! তবে?

আদিল বুঝল একটা ঘামের বুদবুদ দ্রুত নেমে আসছে কানের পিছন দিয়ে। আর পঞ্চাশ সেকেন্ড। তবে কি ইচ্ছে করে ছুটিয়ে মারল ওকে? আর তিরিশ সেকেন্ড। কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল আদিল। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঝুলন্ত কী একটা জিনিসে যেন ধাক্কা খেল! আধো অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারেনি আগে। কী এটা?

আদিল মোবাইলের স্ক্রিনের আলোয় দেখল জিনিসটা। সুতো দিয়ে একটা হার্ট শেপের কী যেন ঝুলছে! একটানে সেটা খুলে নিল আদিল। হাতে নিয়ে বুঝল, এটাই আর ডি এক্স। হৃত্পিণ্ডের মতো দেখতে ড্যাঙ্গলার বানানো হয়েছে। আর কুড়ি সেকেন্ড বাকি।

আদিল হাতের চাপে নরম জিনিসটাকে ভেঙে ফেলল। দেখল, ওর ভিতরে একটা ছোট্ট ডিজিটাল ঘড়িতে দ্রুত কমে আসছে সময়। ঘড়ির সঙ্গে দুটো ছোট ডিটোনেটর স্টিক গোঁজা। আর ছ’সেকেন্ড বাকি। আদিল দ্রুত কোমরের পাউচ থেকে একটা কাটার বের করে ডিটোনেটরের সবুজ আর হলুদ তার দুটো খুব সাবধানে কুচ করে কেটে দিল। দেখল, ঠিক দু’সেকেন্ড আগে থেমে গেল ঘড়িটা।

ঢোঁক গিলল আদিল। হাত দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। আর ডি এক্স দিয়ে যে এমন একটা হার্ট আকারের জিনিস বানিয়ে রাখবে লোকটা, বুঝতেই পারেনি। তবে এমন একটা আইসোলেটেড লঞ্চে কেন যে বোমাটা রাখল প্রিমো, সেটা বুঝতে পারছে না আদিল। এখানে বোমা ফাটলে তো লঞ্চ ছাড়া আর বিশেষ কিছুর ক্ষতিই হত না। তবে কি এটাও জাস্ট ওয়ার্নিং ছিল? আসল চালটা কি ও শেষের জন্য জমিয়ে রেখেছে?

ইঞ্জিন রুমের বাইরে এসে দাঁড়াল আদিল। দূরে সূর্য ক্রমশ গড়াচ্ছে পশ্চিম আকাশের দিকে। সামনের শহর আরও মেতে উঠছে উৎসবে। আরও বাড়িয়ে তুলছে তার রোশনাই। কিন্তু তারা বুঝতেই পারছে না, সর্বনাশের কত বড় একটা মেঘ এসে ঘিরে ধরেছে তাদের।

১৬

ব্রুনোর মুখটা যেন ঠিক বড়সড় একটা টার্কির মতো। লোকটা কথা বলে খুব কম। শুধু ফাদার যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানে ঘুরছে পিছন পিছন। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করছে না।

ফাদার চার্চের লম্বা বারান্দা দিয়ে হেঁটে সামনের বড় বাগানটায় নামলেন, সেখানেও সঙ্গে চলে এল ব্রুনো।

ফাদার হাসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আমাদের নিয়ে কী করতে চাও?”

ব্রুনো কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

ফাদার বললেন, “ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে তোমার? তার কাছে কী বলবে মৃত্যুর পরে?”

ব্রুনো কিছু না বলে তাকিয়ে রইল।

ফাদার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ব্রুনোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন দূরের মা মেরির মূর্তির দিকে। নরম একটা লেবু-হলুদ রোদ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। সেই আলোয় মা মেরির ছায়াটা কেমন যেন নীলচে লাগছে।

ফাদার ঘুরে তাকালেন ব্রুনোর দিকে। লম্বা রোবের পকেটের ভিতরে হাতের মুঠিটা শক্ত হয়ে উঠল আচমকা। ফাদার নিজেকে সামলালেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের স্মৃতি ফিরে আসছে। ভিয়েতনামি গ্রামে চারজন ভিয়েত কং-কে একা খালি হাতে মেরে ফেলাটা এত বছর পরেও মনে পড়ে যাচ্ছে আবার! হে ঈশ্বর! ফাদার চোখ বন্ধ করে প্রভু যিশুর কথা মনে করলেন। বললেন, “হে প্রভু, রক্তক্ষয় বন্ধ করো। আমায় শান্ত করো। মানুষের রক্ত বড় সাংঘাতিক। সহজে তা মোছে না। All the perfumes of Arabia will not sweeten this little hand।”

ফাদার দূরের পাহাড়ের দিকে তাকালেন। ভাবলেন, কিন্তু যদি প্রয়োজন হয়? তবে কি আবার ফাদারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সেই কুড়ি বছরের দামাল ছেলেটা?

১৭

সন্ধে ছ’টায় আর-এক কিস্তির টাকা পাঠানোর পরে শশীকান্তজি মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, “পি এম আমায় ফোন করেছিলেন। এখনও টাকা পাঠাতে হচ্ছে দেখে খুব দুশ্চিন্তা করছিলেন। আমরা কিছুই করতে পারছি না? মার্কোসকে যে আমি ডাকলাম, তাতে কী লাভ হল তবে?”

জয় বলল, “স্যার, আদিল না থাকলে কিন্তু খুব বড় একটা বিস্ফোরণ হতে পারত। ও কিন্তু ঠেকিয়ে দিয়েছে। আপনি স্যার ওঁকে ডেকে ঠিক করেছেন।”

“কিন্তু প্রিমো বলে ওই লোকটাকে কি ধরতে পেরেছে?” শশীকান্তজি সামান্য অধৈর্য হলেন, “আর মাত্র চার ঘণ্টা বাকি। যদি একটা কিছু হয়ে যায়, কত বড় সর্বনাশ হবে, সেটা কি কেউ বুঝতে পারছে না?”

সি এম নিজের চেয়ার থেকে উঠে শশীকান্তজির কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “আপনি উত্তেজিত হবেন না। আদিল ঠিক কিছু একটা বন্দোবস্ত করবেই।”

“কিন্তু কী করবে ম্যাডাম?” শশীকান্তজি সামান্য হতাশ গলায় বললেন, “একটা লোক এভাবে আমাদের নাচাচ্ছে!”

জয় বলল, “আর-একবার ফোন করলেই হবে। আওয়ার প্ল্যান ওয়াজ রাইট। শুধু লাস্ট মোমেন্টে যদি বম্ব ডিঅ্যাক্টিভেট করার ব্যাপারটা না থাকত, তবে এতক্ষণে বাছাধন ধরা পড়ে যেত।”

“কিন্তু অতটা সময় পাওয়ার পরেও কেন লাফাল না আদিল?” শশীকান্তজি জিজ্ঞেস করলেন।

জয় বলল, “স্যার, প্যারাশুট নিয়ে অমন কনজেস্টেড জায়গায় লাফানো খুব কঠিন।”

“কিন্তু আমরা কেন তৈরি করেছি মার্কোস? যা তুমি আমি পারব না, তা তো ওরাই করবে! তবে?”

জয় উত্তর না দিয়ে বলল, “কিন্তু লোকটা তো আর ফোন করছে না! কেন করছে না? আদিল তো হেলিকপ্টার নিয়ে অপেক্ষা করছে! তবে?”

সমরবাবু, সি এম-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ডিফেন্স মিনিস্টার যে-কোনও সময় চলে আসবেন। তবে খবরটা মিডিয়া থেকে দূরেই রেখেছি আমরা। জানি না নিউক্লিয়ার কম্যান্ড অথরিটি কী ঠিক করবেন লঞ্চ কোডের ব্যাপারে! এমনিতেই হেলিকপ্টার নিয়ে গঙ্গার বুকে কেন লোক নামানো হয়েছে, সেই নিয়ে বেশ কিছু ফোন আসছে।”

“সমরবাবু এসব নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি যে, মাত্র চার ঘণ্টা পরে কী হবে? আমি তো ডিফেন্স মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বললাম লঞ্চ কোড নিয়ে। উনি বললেন যে, এন সি এ হেড হিসেবে এই ব্যাপারে পি এম-ই ডিসিশন নেবেন।”

সি এম চিন্তিতমুখে পচনন্দাজিকে বললেন, “আপনি কতটা প্রিকশন নিলেন?”

পচনন্দাজি বললেন, “যতটা সম্ভব পুলিশ আমি ডিপ্লয় করে দিয়েছি। এ ছাড়া সি আর পি এফ আর র‍্যাফও বলেছি। কিন্তু আচমকা ফোর্স এসক্যালেশন করলে প্যানিক তৈরি হবে। আর ম্যাডাম, জেনারেল হিস্টিরিয়া হলে তো বুঝতেই পারছেন কী হতে পারে!”

সি এম কিছু বলতে যাবেন, ঠিক সেই সময়ে আবার ফোনটা বেজে উঠল সামনে। জয় হামলে পড়ে ফোনের স্পিকারটা অন করল।

“গুড ইভনিং, আপনারা খুব সুন্দরভাবে বোমাটা ডিফিউজ করেছেন। ব্রাভো! আর এইবারের ডলারটাও পেয়ে গিয়েছি। তবে লঞ্চ কোডটার কী হবে বলতে পারেন কি?”

জয় বলল, “বি সেনসিবল। কোনও দেশ কি নিজের পারমাণবিক অস্ত্র অন্যের হাতে তুলে দেয়? এটা সম্ভব? তার চেয়ে, আমরা আরও কিছু টাকা দিচ্ছি তোমায়, আর এই দেশ থেকে বেরোনোর জন্য সেফ প্যাসেজ দিচ্ছি। এই গোটা ঘটনাটা এখানেই শেষ হোক।”

“টাকাটা তো আপনাদের যে সময় দিলাম আলোচনার জন্য, সেই সময় দেওয়া বাবদ নিলাম। আপনারা এটা ভাববেন না যে, ওটা আমার লক্ষ্য। আসলে আমার চাই আই এন এস চক্র-টু-র নিউক্লিয়ার মিসাইলের কোড।”

“টাকাটা তা হলে লক্ষ্য ছিল না? টাকাটা নিলে কেন তবে?”

“কারণ তো বললাম। আর মনে রাখবেন, যে কাজটা আপনি ভাল পারেন, তা কখনও বিনি পয়সায় করতে নেই, বুঝেছেন?” প্রিমো হাসল, সাড়ে ছ’টা বাজে। আর সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় আছে।

জয় বলল, “এক সেকেন্ড, প্লিজ এক সেকেন্ড, ফোনটা কেটো না। তুমি কার জন্য করছ এটা? কে করাচ্ছে? এখনও তো কেউ দায় স্বীকার করে ফোন করল না!”

প্রিমো সময় নিল একটু, তারপর বলল, “আপনাদের কি শত্রুর অভাব আছে?”

জয় তাকাল পচনন্দাজির দিকে। চোখ দিয়ে ইঙ্গিত করল একটা। পচনন্দাজি মাথা নেড়ে বোঝালেন যে, আদিল পজিশন নিয়ে নিয়েছে।

জয় হাসল। তারপর কথা চালাতে বলল, “গত হাজার বছরের ইতিহাস বলে যে, ভারত কোনওদিন কাউকে নিজের থেকে আক্রমণ করেনি। তা হলে কেন আমাদের আক্রমণ করা হচ্ছে বারবার?”

প্রিমো হাসল, বলল, “আপনি কারও ক্ষতি করেননি বলে কেউ আপনার ক্ষতি করবে না? আপনি তো অদ্ভুত কথা বললেন! শুনুন, সময় কিন্তু আর নেই। অথরিটিকে বলুন যদি কয়েক হাজার মানুষ না মারতে চান, তবে কোডটা যেন দিয়ে দেন। কেমন?”

১৮

কলেজস্ট্রিটের বেশ কিছুটা উপরে হেলিকপ্টারের দরজায় ঝুলে শেষবারের মতো এল ই ডি স্ক্রিনটা দেখল আদিল। খুব ভুল না করলে কলেজ স্কোয়্যারের ভিড়েই লুকিয়ে আছে প্রিমো। ওর টাওয়ার লোকেশন তাই বলছে। আর অপেক্ষা করল না আদিল। কর্ড বেয়ে দ্রুত নেমে এল নীচে। তারপর ছোট্ট একটা লাফে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির ছাদে নেমে পড়ল। হাতের ঘড়িটা অন করে নিল ও। হেলিকপ্টারের ট্র্যাকিং-এর ফিড ভেসে উঠল ঘড়িতে। আদিলের লোকেশন থেকে মোটামুটি সাড়ে চারশো মিটার দূরে দেখা যাচ্ছে প্রিমোর অবস্থান। আর সময় নেই। আদিল ছাদের থেকে কার্নিশ, পাইপ আর গাছের ডাল ধরে ঝুলে নিমেষে নেমে এল মাটিতে। সামনে বড় লোহার গেটটা দেখা যাচ্ছে। ও দ্রুত এগোল গেটের দিকে। এবার আর প্রিমোকে পালাতে দেওয়া চলবে না।

১৯

মুজাফ্ফরাবাদ, পাক অধিকৃত কাশ্মীর

কর্নেল শ্যাঙ ওয়েই অধৈর্য হয়ে ঘড়ি দেখলেন। তারপর সামনে বসা লতিফ শেখকে জিজ্ঞেস করলেন, “এত সময় লাগছে কেন? আদৌ কি কোনও কাজ এগোচ্ছে?”

লতিফ হাসল, সামনে রাখা প্লেট থেকে কাবাবের একটা টুকরো তুলে নিয়ে বলল, “আপনি বড্ড তাড়াহুড়ো করছেন। কাজ ঠিক এগোচ্ছে। আমাদের লোক ঠিক নজর রাখছে সব কিছুর উপর। আপনি শুধু একটা ব্যাপার মাথায় রাখুন। ওই বাইশটা সুড়ঙ্গের অ্যাকসেস। আমাদের আজাদ কাশ্মীরে আপনারা সুড়ঙ্গ বানাবেন আর আমাদের তার অ্যাকসেস থাকবে না, তা কি হয়?”

ওয়েই হাসলেন ছোট করে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, আগে কাজটা হোক। দেখা যাক, আপনার লোক কতটা এফিশিয়েন্ট। আর মনে রাখবেন, কোনও প্রমাণ কিন্তু রাখবেন না এবার। ২৬/১১-র ভুল কিন্তু করবেন না। ইন্ডিয়া এবার সহজে ছেড়ে দেবে না। ওরা কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করবে ডিফেন্ড করার।

“কিন্তু ওরা পারবে না,” লতিফ আর-একটা কাবাবের টুকরো তুলল, “আমাদের প্ল্যান ফুল প্রুফ। জিনিসটা নিয়ে নদীপথে পালাবে আমাদের লোক। সুন্দরবনের খাঁড়িতে জলদস্যুরা অপেক্ষা করবে। ওরা ঠিক বাংলাদেশের সুন্দরবনের একটা ছোট্ট ব-দ্বীপে এনে রাখবে আমাদের লোকটিকে। সেখান থেকে আপনারা আমাদের ডিম্যান্ড মতো জিনিস দিয়ে নিয়ে নেবেন লঞ্চ কোড। আর হিন্দুস্থান লঞ্চকোড না দিলে, ওদের ওই উত্সব শোকে পরিণত হবে। ওরা জানবে, আমাদের কেপেবিলিটি কতটা। মুম্বইয়ে আমরা যা করেছি, কলকাতায় তার দশগুণ হবে। টুইন টাওয়ারের মতো এটাও মনে রাখবে সারা দুনিয়া।”

কর্নেল বললেন, “কোডটা পেয়ে আপনাদের আবার মত পালটে যাবে না তো?”

লতিফ হাসল, “আই এস আই-কে বোকা ভাবার কারণ আছে কি? কেন আমরা শুধু শুধু চিনের সঙ্গে ঝামেলা করব? আমাদের ওসব দরকার নেই। হিন্দুস্থানের থেকে আমাদের যা দরকার, তা আমরা এমনিই নিয়ে নেব।”

এর মিনিটদশেক পরে কর্নেল ওয়েই অফিস থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে এগোলেন। তারপর এদিক-ওদিক দেখে পকেট থেকে ফোনটা বের করে বেজিং-এর নম্বর ডায়াল করলেন, ছোট্ট করে বললেন, “ওয়র্ক ইন প্রগ্রেস।” তারপর ফোনটা বন্ধ করে হাসলেন নিজের মনে। ভাবলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এত ছোট্ট টিম নিয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন আর কোথাও হয়নি কোনওদিন।

২০

ফিস, অস্ট্রিয়া

বাচ্চারা দুপুরের খাবার খেয়ে নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছে এখন। ফাদার ঘড়ি দেখলেন। বিকেল সোয়া তিনটে বাজে প্রায়। মানে ভারতে এখন সন্ধে পৌনে সাতটা।

এখানে রোদের তেজ তেমন নেই। সবসময়ে কেমন যেন টুরিস্ট গোছের একটা আমুদে হলুদ আভা লেগে থাকে আল্পসের ঠান্ডা হাওয়ায়।

ফাদার দেখলেন, ব্রুনো চুপ করে বসে রয়েছে সামনে। লোকটা কেমন যেন রোবটের মতো। খুনি বলেই কি এমন? যাতে কোনও অ্যাটাচমেন্ট তৈরি না হয়, সেই জন্যই কি এমন চুপ করে দূরে সরিয়ে রাখছে নিজেকে?

ফাদার জানেন, ব্রুনোর কাছে এই বড় ওভারকোটের নীচে একটা ইউ জি সাব মেশিনগান ঝুলছে। তা ছাড়া গোটা চার্চটার বিভিন্ন জায়গায় ব্রুনো আর ডি এক্স লাগিয়ে তার ডিটোনেটরের রিমোট নিজের হাতে রেখেছে। ব্রুনো একা হলেও কতটা ভয়ংকর, সেটা ফাদার ভালই জানেন। জানেন, যারা ওকে পাঠিয়েছে, তারা জেনেই পাঠিয়েছে যে, ব্রুনো একাই একশো।

ফাদার বাইরের জানালা দিয়ে তাকালেন। এত সুন্দর সবুজ ঢেউ খেলানো মাঠ দেখে কে বলবে এইখানে এমন একজন খুনি এসে ঢুকেছে! কে বুঝবে নিরালা এই চার্চে পণবন্দি হয়ে রয়েছে কিছু মানুষ!

ফাদার নিজের জন্য চিন্তা করেন না। তাঁর চিন্তা ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর জন্য। আর চিন্তা বহুদূরের সেই ছেলেটার জন্যও। ফাদার কি কিছু করতে পারেন না?

ব্রুনো বসে রয়েছে চুপ করে। পাথরের তৈরি একটা মানুষ যেন! কিন্তু কী করতে পারেন ফাদার? বাইরে থেকে নিজেকে শান্ত করে রাখলেও ফাদারের ভিতরে গোটা একটা সমুদ্র উথাল-পাথাল করছে।

২১

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে দ্রুত এগোতে লাগল আদিল। হাতঘড়ির ট্র্যাকারে ও এখনও দেখতে পাচ্ছে প্রিমোর মোবাইল টাওয়ারের লোকেশন। জয় এখনও কথা বলে যাচ্ছে! মানে প্রিমোকে এখনও ‘লাইভ’ করে রাখছে!

আর পঞ্চাশ মিনিট দূরে প্রিমো। ওই জি পি এস লোকেটরগুলো মোটামুটি চার মিটারের মতো অ্যাকিউরেট। অর্থাৎ, যে লোকেশনটা দেখায় তার চার মিটারের মধ্যে লোকটি থাকে।

চারদিকে প্রচণ্ড ভিড়। মানুষ লাইন করে এগোচ্ছে প্যান্ডেলের দিকে। মিড্‌ল স্কোয়্যারের জলের মাঝে করা হয়েছে প্যান্ডেল। সেখানে পাটাতন ফেলে ব্রিজের মতো করে রাখা হয়েছে, যাতে মানুষে সেটা পেরিয়ে ঠাকুর দেখতে পারে। এত লোকের মধ্যে কি আদিল খুঁজে পাবে লোকটাকে?

ঘড়ির লোকেশন দেখে খুব দ্রুত এগোতে লাগল আদিল। মার্কোসের ট্রেনিং-এ পেরিফেরাল ভিউ কী করে তৈরি করতে হয়, তার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে ওদের। তাই চোখ না ঘুরিয়েও আশপাশটা যতটা সম্ভব মেপে নেওয়া আদিলের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়।

তাই এই ভিড়েও ও দেখে নিল, আশপাশের মধ্যে পাঁচজন মোবাইলে কথা বলছে। তার মধ্যে দু’জন মেয়ে আর বাকি তিনজনের একজন বৃদ্ধ আর দু’জন অল্পবয়সি ছেলে। তবে এরা কেউই নয়। কারণ, লোকেটরটা এখনও ওর থেকে পনেরো মিটার দূরে।

আচমকা একটা কথা ধাক্কা খেল আদিলের মনে। আচ্ছা, ও তো এগোচ্ছে, কিন্তু গত তিরিশ সেকেন্ড ধরে প্রিমোর লোকেশন তো বদলাচ্ছে না! কেন?

ভিড়ের ভিতরে যতটা দ্রুত এগোনো যায়, আদিল এগোল। মানুষকে বাঁচিয়ে তাদের ফাঁক দিয়ে ও দ্রুত চলে এল জি পি এস-এ দেখানো জায়গায়।

আশ্চর্য! কেউ তো নেই! এখানে কেউ তো মোবাইলে কথা বলছে না! আদিল দ্রুত ঘুরে নিল এক চক্কর। আরে! লোকেশন দেখাচ্ছে যে, এখানেই আছে প্রিমো, কিন্তু তা হলে কোথায়?

আদিল আর-এক চক্কর ঘুরতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। দু’হাত দূরে একটা ভিখিরি দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তার মানুষের ঢলের পাশের যে বাঁশের ব্যারিকেড দেওয়া থাকে, তার গায়ে হেলান দিয়ে লাঠিতে ভর দেওয়া একজন খোঁড়া ভিখিরি ফ্যালফ্যাল করে নিজের ভিক্ষের বাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

আদিল দ্রুত গিয়ে ঝুঁকে দেখল বাটিতে। একটা মোবাইল ফোন পড়ে আছে বাটির ভিতরে। তার মাথায় ছোট্ট একটা লাল আলো জ্বলছে। অর্থাৎ, মোবাইলটা অন আছে!

আদিল ভিখিরিটাকে দু’হাতে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “কে দিল এটা? কে দিল? বল?”

ভিখিরিটা ভয় পেয়ে ভিড়ের মধ্যে দেখাল, “ওই দিকে গেল ছেলেটা। কালো জামা পরে আছে।”

“কোনদিকে?” আদিল এদিক-ওদিক তাকাল।

ভিখিরিটা বলল, “ওই দিকে। ওই যে ভিড়ের ভিতর দেখা যাচ্ছে! ওই তো!”

আদিল দেখল কিছুটা দূরে একটা ছেলে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদের চেয়ে দ্রুতই এগোচ্ছে যেন। ও ভিখিরিটাকে ছেড়ে ভিড়ের ভিতর দৌড় লাগাল।

মানুষকে ঠেলে কিছুটা এগিয়ে গেল আদিল। সামনের ছেলেটাকে ভিড়ের ভিতর হারিয়ে ফেললে চলবে না! আর ঠিক তখনই পিছন থেকে একটা হইচই শুনল।

থমকে দাঁড়িয়ে আদিল পিছন ঘুরল। কী হল ব্যাপারটা? ও দেখল ভিখিরিটা দাঁড়িয়ে নেই আর। বরং রাস্তায় পড়ে রয়েছে মোবাইল, বাটি আর লাঠিটা। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাল আদিল। ওই তো! খোঁড়া ভিখিরিটা দক্ষতার সঙ্গে ভিড় কাটিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে!

আদিল আর সময় নষ্ট না করে ধাওয়া করল ভিখিরির ছদ্মবেশে থাকা প্রিমোকে। ছেলেটা খেলছে! ওদের সঙ্গে এমন করে কানামাছি খেলছে! কেন? দৌড়ের ভিতরেই প্রশ্নটা মাথায় এল আদিলের।

প্রিমো ভিড় কাটিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে। আদিল গতি বাড়াল। সামনে দাঁড়ানো চারজন ছেলেকে অবহেলায় ছিটকে দিয়ে ও অনায়াসে টপকে গেল বাঁশের ব্যারিকেড। প্রিমোও ব্যারিকেডের তলা দিয়ে গলে গিয়ে রাস্তায় চলে এল। সার দিয়ে দাঁড়ানো ট্যাক্সি, অটো আর বাসের ভিতর দিয়ে দৌড়োতে লাগল এঁকেবেঁকে। চারপাশের লোকজন দেখছে। সামনে দাঁড়ানো দু’জন পুলিশ ভিড়ের ভিতর এগিয়ে গিয়ে ধরতে গেল প্রিমোকে। প্রিমো শরীরটাকে আচমকা নিচু করে নিয়ে হাতটা ঘোরাল। দু’জন পুলিশ ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশে দাঁড়ানো একটা অটোর গায়ে।

আদিল দেখল এভাবে ধরা যাবে না প্রিমোকে। ও চট করে লাফিয়ে হলুদ ট্যাক্সির ডিকি বেয়ে উঠে গেল ছাদের উপর। তারপর এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে লাগল। বাসের হাতল ধরে ঝুলে, অটোর সামনের চাকার উপর ভর করে ছিটকে ট্যাক্সির মাথায় উঠে প্রিমোও এগোতে লাগল দ্রুত।

কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কাছে এসে আচমকা প্রিমো বাঁদিকের সরু গলিটায় ঢুকে গেল। পুজোর আলোর ভিতরে এই গলিটা বেশ অন্ধকার। প্রিমোকে সেখানে ঢুকতে দেখে আদিল ট্যাক্সির মাথা থেকে লাফিয়ে ফুটপাথ ঘিরে রাখা লোহার রেলিং টপকে দৌড়োল সেইদিকে। দু’জন মানুষ ছিটকে পড়ে গেল ওর ধাক্কায়। আশপাশের লোকজনও নিজেদের বাঁচাতে এ ওর গায়ে গিয়ে পড়ল। কেউ চিৎকার করে উঠল। গালাগালিও দিল কয়েকজন। আবার কেউ ‘চোর চোর’ বলে হল্লা করে উঠল। আদিল কান দিল না কিছুতেই।

সামনের গলিটা আবছা অন্ধকার। বড় রাস্তায় আলোর রোশনাই বেশি বলেই বোধহয় এই রাস্তাটা এমন আবছায়া লাগছে। আদিল দেখল, জমে থাকা নোংরা, স্ট্যান্ড করা ভ্যান, বন্ধ বইয়ের দোকান টপকে প্রিমো দৌড়োচ্ছে। রাস্তাটা সোজা। এটাই আদিলের সুযোগ। এখান থেকে আবার প্রিমোকে ধরা মুশকিল হয়ে যাবে।

আদিল স্প্রিন্ট টানল। দশ সেকেন্ডের কাছাকাছি সময়ে ও একশো মিটার টানতে পারে যে-কোনও অবস্থায়। এইখানেও দৌড়টা শুরু করল ও।

সামনে রাস্তাটা ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো হয়ে গিয়েছে। বাঁদিকে গেলে আরও গলির ভিতর ঢুকে গিয়েছে পথ আর ডানদিকে গেলে এম জি রোড।

প্রিমো প্রায় পৌঁছে গিয়েছে রাস্তার মুখে। আদিল গতি বাড়াল। দূরত্ব কমছে খুব তাড়াতাড়ি। রাস্তার মুখের কাছে চলে এসেছে প্রিমো। আদিলও আর হাতদুয়েক দূরে। প্রিমো শেষ চেষ্টাটা করল গতি বাড়ানোর। আদিল আরও কাছে এগিয়ে গেল। এবার একটু হাত বাড়ালেই ধরে ফেলবে।

রাস্তার মোড়ের থেকে ডানদিকে বাঁক নেওয়ার চেষ্টা করল প্রিমো। আদিল সামনে হাত বাড়িয়ে প্রায় ছুঁয়ে ফেলল ওর জামা। আর ঠিক তখনই রাস্তার বাঁদিক থেকে একটা সাইকেল আচমকা বেরিয়ে এসে ধাক্কা মারল আদিলকে।

ব্যাপারটা বুঝতে ওর সময় লাগল একটু। আদিল দেখল, হঠাৎ ওর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছে আর ও পড়ে যাচ্ছে রাস্তায়। ওর পাশে উলটে পড়ছে সাইকেল সমেত চালক ছেলেটা।

প্রিমো পিছনে তাকাল একবার, তারপর গতি বাড়িয়ে বড় রাস্তার দিকে দৌড়ে গেল। আদিল শোওয়া অবস্থাতেই কোমরের থেকে একটা জি পি এস ডট গান বের করে নিমেষের মধ্যে সেটা চালাল দূরের থেকে দূরে চলে যাওয়া প্রিমোর দিকে লক্ষ্য করে।

প্রিমো বুঝল না, কিন্তু একটা ঘড়ির ব্যাটারির মতো জি পি এস ডট ছিটকে গিয়ে আঠার সাহায্যে আটকে গেল ওর প্যান্টের ব্যাক পকেটের গায়ে।

আদিল মাথা নাড়ল। তারপর সাইকেলের ছেলেটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। সামনের রাস্তাটা ফাঁকা। প্রিমো আবার মিশে গিয়েছে কলকাতার ভিড়ে। কিন্তু এবার আর হারিয়ে যেতে পারবে না ও। ডুবে থাকতে পারবে না জনসমুদ্রে।

আদিল নিজের ঘড়িটাকে আবার অ্যাডজাস্ট করল। আর একটা বাসের ভিতর প্রিমোর ব্যাক পকেটের গায়ে আটকে থাকা ডটটা সচল হয়ে উঠল।

আদিল ওর ঘড়ির স্ক্রিনে দেখল, প্রিমো এগিয়ে যাচ্ছে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে। আদিল আর অপেক্ষা না করে মোবাইল বের করে কল করল জয়কে।

২২

আরাকাপারামবিল কুরিয়ান অ্যান্টনি তাকালেন শশীকান্তজির দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “মার্কোস কতটা রিলায়েবল?”

শশীকান্তজি ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে উত্তরে বললেন, “হি ইজ আওয়ার বেস্ট হোপ স্যার।”

“আমি পি এম-এর সঙ্গে কথা বলেছি। নিউক্লিয়ার কম্যান্ড অথরিটির উনিই চিফ। দেশের সব নিউক্লিয়ার ওয়েপন স্টকপাইলের ডিসিশন নেওয়ার অথরিটি উনি। পি এম বলেছেন যে, লঞ্চ কোডটা শেষমেশ যেন কিছুতেই না পৌঁছোয় শত্রুপক্ষের হাতে। আমাদের যে-কোনও মূল্যে বাঁচাতে হবে ওই কোডটা, তার সঙ্গে কলকাতাকেও। কোডটা শত্রুপক্ষের সামনে আনা মানেই কিন্তু তাকে দিয়ে দেওয়া নয়। এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।”

শশীকান্তজি বললেন, “আমাদের সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে আদিলের। ও প্রিমোকে একটুর জন্য মিস করেছে। তবে একটা জিপিএস ট্র্যাকার প্ল্যান্ট করতে পেরেছে প্রিমোর ক্লোদিং-এ।”

“স্যার,” জয় বলল, “ক্যান আই সে সামথিং?”

“শিয়োর,” অ্যান্টনিজি তাকালেন জয়ের দিকে, “ডু ইউ হ্যাভ এনি প্ল্যান?”

“লঞ্চ কোডটা আদিলকে দিলেও, ওর সঙ্গে যদি আমি যাই?” জয় তাকাল সকলের দিকে।

“শিয়োর,” শশীকান্তজি মাথা নাড়লেন, “তবে পি এম ও থেকে বলা হয়েছে কোডটা যেন মার্কোস ছাড়া আর কারও হাতে না দেওয়া হয়।”

জয় বলল, “শিয়োর স্যার। ওর কাছেই থাক। আমি একটু দূর থেকে ট্র্যাক করব। সেটা আদিলের জানার দরকারও নেই। আর ন্যাশনাল সিকিয়োরিটি গার্ডের যে লোকজন এসেছে, তারা আমার সিগন্যাল পেলেই গোটা জায়গাটা ঘিরে ফেলবে।”

শশীকান্তজি বললেন, “যেভাবেই হোক, কোডটা অন্যের হাতে পড়ার থেকে বাঁচাতে হবে। দেশ সকলের আগে। বুঝেছ?”

জয় বলল, “পড়বে না স্যার। আদিল ফেল করার মানুষ নয়। তাও যদি ফেল করে, আমি কাউকে ছাড়ব না। কোড উইল বি সেফ।”

শশীকান্তজি মাথা নাড়লেন, তারপর বললেন, “মুশকিল কী জানো? এমন একটা বিষয় যে, বেশি ছড়িয়ে অপারেট করা যাচ্ছে না। কারণ, তা হলেই মিডিয়া ইনভলভ্‌ড হয়ে যাবে আর প্যানিক তৈরি হবে। সেটা আরও ভয়ংকর হয়ে দেখা দেবে। তাই বলছি, ওয়র্ক লাইক আ শ্যাডো। আর কাজ হওয়ামাত্র তুমি আমাদের জানাবে। আমরা কোডটা সঙ্গে সঙ্গে পালটে দেব।”

জয় কিছু না বলে মাথা নাড়ল শুধু।

সি এম এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তা কোথায় আছে এখন আদিল?”

জয় বলল, “ওয়াটগঞ্জের দিকে এগোচ্ছে। হয়তো ওখানে গিয়েই ফোন করবে। কারণ, প্রায় রাত সাড়ে আটটা বাজে এখন। টাকাও সময়ে সময়ে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে। সামনে এখন শুধু লঞ্চ কোডটাই শত্রুদের লক্ষ্য।”

অ্যান্টনিজি বললেন, “জয়, ইউ মুভ নাও। আর রিস্ক নেওয়া যায় না। তুমি কি চপার নেবে?”

জয় বলল, “না স্যার। বাইক উইল বি ফাইন। চপারে প্রিমো সাবধান হয়ে যাবে। আমি পাশের ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে নিই স্যার। আর এখানে প্রিমো কল করলে তার ফিডটা আমার মোবাইলে যাতে পাঠানো যায়, সেটাও বলে যাচ্ছি।”

অ্যান্টনিজি বললেন, “দেখো জয়, যাই হোক না কেন, নিউক্লিয়ার কোড যেন অন্যের হাতে না পড়ে। মেক শিয়োর যে, আমাদের দেশের সুরক্ষা যেন ঠিক থাকে।”

জয় মাথা নেড়ে দরজার দিকে এগোতে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে টেবিলের উপর রাখা ফোনটা বেজে উঠল শব্দ করে।

২৩

ফোনটা কানে নিয়ে সামনের দিকে তাকাল প্রিমো। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যেই একজনের পকেট থেকে ও উঠিয়ে নিয়েছে ফোনটা।

নিজের ফোন আর ব্যবহার করতে চায় না প্রিমো। আর চায় না কোনও রিস্ক নিতে। কারণ ওর কাজের উপর অনেক বাচ্চার জীবন নির্ভর করে আছে।

“হ্যালো?” জয়ের গলাটা শুনতে পেল প্রিমো।

“হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল আমাকে ধরতে! আপনাদের সাহসে আমি মুগ্ধ। আবার ক্যালাসনেসেও অবাক!”

“শোনো প্রিমো, এই ক্যাট অ্যান্ড মাউসটা এবার বন্ধ হওয়া উচিত। তুমি বুঝতে পারছ, কী ভয়ানক পরিণতি হবে এতে?”

“শুনুন আপনারা আমায় ট্র্যাক করছেন জানি, কিন্তু আর পারবেন না। জাস্ট ওয়েট ফর মাই নেক্সট কল। আমি বলে দেব কী করে আর কোন নম্বরে লঞ্চ কোডটা আপনাদের পাঠাতে হবে। আর প্লিজ, নো মোর গেম্‌স। তবে আমি কিন্তু আর সহ্য করব না।”

ফোনটা কেটে পাশের ড্রেনে ফেলে দিল প্রিমো।

কলেজ স্ট্রিটের মাথায় হেলিকপ্টার দেখেই বুঝেছিল প্রিমো যে, ওকে লোকেট করে ফেলা হয়েছে। বুঝেছিল যে, ওকে খুঁজে পাওয়ার জন্যই ওর সঙ্গে বেশিক্ষণ ধরে কথা বলা হয়েছে। তাই দ্রুত নিজেকে লুকোনোর জন্য রাস্তার পাশের একটা ভিখিরিকে টাকা দিয়ে ওর লাঠি আর বাটিটা নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা আর হয়নি।

অনেকে কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে প্রিমো। কাজটা করতে হবে ওকে। একটা দেশ তার শত্রুদের থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য অনেক কিছু করতে পারে, কিন্তু নিরীহ একজন বৃদ্ধ আর কতগুলো বাচ্চাকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে ও ছাড়া তো আর কেউ নেই।

প্রিমো এগিয়ে গেল ভিড়ের দিকে। যবনিকা পড়ার সময় হয়ে এল প্রায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যাবে প্রিমো যে প্ল্যানে চলছে, তাতে মহাষ্টমীটা কেমন হবে কলকাতার!

২৪

ফিস, অস্ট্রিয়া

চার্চের ঘণ্টার টাইমার রিসেট করে, হাতঘড়ি দেখলেন ফাদার। বিকেল শেষ হয়ে আসছে প্রায়। সন্ধের সারমনের সময় জানাবার জন্য আর একটু পরেই বড় ঘণ্টাটা বাজবে।

ঘণ্টাটা বিশাল বড়। বিসমার্কের সময় থেকে আছে এই গির্জায়। গোটাটা ব্রোঞ্জের তৈরি। আর সঙ্গে দুটো হাতুড়ি আছে। একটা বড়, অন্যটা ছোট। ঘণ্টাটা আগে দড়ি টেনে বাজাতে হত। এখন অবশ্য টাইমার দিয়ে বাজানো হয়।

কোটের পকেটে হাত ভরে ব্রুনো ছায়ায় মতো লেগে রয়েছে পিছনে। ওর পকেটে ইউ জি, রিমোট আর মোবাইল ফোন রয়েছে। বাচ্চারা নিজেদের মতো আছে। তারা জানেও না যে, একজন আততায়ী ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের আশপাশে।

ফাদার জানেন ওইদিকের কাজে একটু গোলমাল হলেই ব্রুনো নিমেষে সাফ করে দেবে ওদের।

ফাদার লিফ্‌টের দিকে এগোলেন। এটা সোজা উঠে যায় ঘণ্টার কাছে প্রায় পাঁচ তলার উচ্চতায়।

ব্রুনো অবাক হল একটু। ও যে সময় ধরে এখানে আছে, তার মধ্যে এই প্রথম ফাদার এই লিফ্‌টের দিকে যাচ্ছেন।

ব্রুনো জিজ্ঞেস করল, “লিফ্‌টের দিকে যাচ্ছেন কেন?”

ফাদার হাসলেন। বললেন “ঘণ্টার টাইমারটা সেট করার পরেও উপরে একটা রিসেট বাটন আছে। ওটা ঠিক করতে হয়। তুমি তো আর কাউকে এই অংশে আসতে দিতে চাও না। তাই আমাকেই তো যেতে হবে, ওটা ঠিক করতে, তাই না?”

ব্রুনো মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, চলুন। তবে মনে রাখবেন, ফানি কিছু করতে গেলে কিন্তু আপনার সামনে সব ক’টা বাচ্চাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে মারব আমি। তারপর মারব আপনাকে।”

ফাদার হাসলেন, “জানি তো। আমার এই অশক্ত শরীর নিয়ে খালি হাতে ফানি আর কী করতে পারি আমি?”

ব্রুনো কিছু না বলে চুপচাপ ফাদারের সঙ্গে উঠে গেল লিফ্‌টে।

লোহার জাল লাগানো লিফ্‌ট। অপূর্ব সুন্দর ফিস গ্রামটাকে উপর থেকে আরও সুন্দর লাগছে।

উপরে লিফ্‌ট থামার পর ফাদার বেরিয়ে এলেন লিফ্‌টের থেকে। ব্রুনোও পিছন পিছন বেরোল।

সামনেই বিশাল বড় ঘণ্টা। প্রায় আঠারো ফুট উঁচু। দানবের মতো দেখতে। লিফ্‌ট থেকে ঘণ্টায় যাওয়ার রাস্তাটা একটু বিপজ্জনক। সরু একটা ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হয় ঘণ্টার দিকে। ঘণ্টার মাথার উপর ক্যানোপি আর চারপাশটা ফাঁকা। খুব সাবধানে যেতে হয় সেখানে।

ফাদার ব্রিজের দিকে এগোলেন।

ব্রুনো হঠাৎ পিছন থেকে টেনে ধরল ফাদারকে, “ওইখানে যাচ্ছেন কেন?”

“রিসেট বাটনটা তো ওইদিকেই আছে,” ফাদার বললেন, “তুমি কী ভাবছ? এই বুড়ো বয়সে আমি এইখানে কী করতে পারি? তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি বাটনটা রিসেট করে ফিরে আসছি।”

ব্রুনো ভুরু কুঁচকে বলল, “আমি আপনাকে একা ছাড়ছি না। নো ওয়ে। আপনি সামনে থাকুন, আমি পিছনেই আছি। আর তাড়াতাড়ি করুন।”

ব্রুনো পিছন থেকে আলতো ঠেলল ফাদারকে। ফাদার ধাক্কায় সামান্য টলে গেলেন। তারপর ব্রিজের রেলিংটা ধরে এগোলেন সামনে। হাতঘড়িটা দেখলেন আবার। তারপর আলতো করে খুলে নিলেন কানের হিয়ারিং-এডটা।

ঘণ্টার ক্যানোপি-র নীচে এসে দাঁড়ালেন ফাদার। চারটে পিলারের উপর ক্যানোপি। সেখান থেকে ঝুলে আছে বিশাল বড় ঘণ্টা। তার চারিদিকে ফাঁকা। কোনও দেওয়াল নেই।

ফাদার ঘুরে দেখলেন ব্রুনোও এসে দাঁড়িয়েছে ক্যানোপির তলায়। প্রচণ্ড হাওয়ায় ওর কোটটা উড়ছে। ফাদার হাসলেন। ব্রুনোর দিকে তাকিয়ে।

ব্রুনো কঠিন গলায় বলল, “তাড়াতাড়ি করুন।”

ফাদার কিছু না বলে হাসিমুখে আচমকা এগিয়ে এলেন ব্রুনোর দিকে। ব্রুনো বুঝতে পারল না, কী হচ্ছে। ও কোটের ভিতর থেকে ইউ জি-টা বের করে আনল। আর রিফ্লেক্সে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। ফাদার আরও এগিয়ে এলেন ব্রুনোর দিকে।

“আমি কিন্তু গুলি চালাব,” ব্রুনো আরও কয়েক পা পিছিয়ে বন্দুকটা তুলল। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দ করে বেজে উঠল ঘণ্টাটা।

ব্রুনো হকচকিয়ে গেল প্রচণ্ড শব্দে। তারপর অসহ্য যন্ত্রণায় চেপে ধরল নিজের দুটো কান। হাত থেকে বন্দুক পড়ে গেল ওর, ফাদার দ্রুত এগিয়ে এলেন ব্রুনোর দিকে। ব্রুনো হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে কান চেপে ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ফাদার তাকালেন একবার, তারপর একটা পা দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিলেন ব্রুনোকে। কিছু বোঝার আগেই ব্রুনো ছিটকে পড়ে গেল উপর থেকে। ফাদার পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন ক্যানোপির ধারে। মুখ বাড়িয়ে দেখলেন নীচের ছড়ানো বোল্ডারের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ব্রুনো দ্য কিলার!

২৫

ডক ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল আদিল। এদিকটা শুনশান। দূরে ডকের জাহাজ, আর বড় বড় ক্রেনগুলোকে দৈত্যের হাতের মতো লাগছে। পুজোর রোশনাইয়ের শহরে এই দিকটা কেমন যেন অন্ধকার আর নির্জন। ঝিঁঝির ডাকও এখানে স্পষ্ট। আদিল জানে না সামনে কী আছে। শুধু জানে, এই শহর আর দেশের জন্য ওকে এগোতে হবে সামনে। কারণ ওর ঘড়ির স্ক্রিন বলছে প্রিমো এখানেই এসেছে।

আদিল পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল ছোট্ট পেনড্রাইভের মতো দেখতে ইলেকট্রনিক ডেটা স্টিক ঠিক আছে কিনা। রাইটার্স ছেড়ে বেরোবার সময়ই এটা ওকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর কিছুক্ষণ আগে এটাতেই ছ’শো পঁচাত্তর ডিজিটের এনক্রিপটেড লঞ্চ কোড এসেছে। এটা ক্র্যাক করতে গেলে মাস্টার হ্যাকারদের কয়েকমাস লেগে যাবে। কারণ শুনেছে এগুলোয় কয়েক লেয়ারের এনক্রিপ্ট করা থাকে। তবে যারা এটা চাইছে, তাদের নিশ্চয় কোনও সুপার কম্পিউটারের অ্যাকসেস আছে, যা দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই এনক্রিপশনের সিকিয়োরিটি শিল্ড ভেঙে দেওয়া যাবে।

কোডটা ওকে পাঠানোর পর দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কড়া নির্দেশ দিয়েছেন যে, কোনও অবস্থাতেই যেন এটা শত্রুদের হাতে না পড়ে। এটা জাস্ট ওদের কথা শোনা হল, এমন ভান করার জন্য দেওয়া। আদিল জানে, ও নিজে মরে গেলেও এই যন্ত্রসমেত কোডটা শত্রুর হাতে তুলে দেবে না।

পিস্তলটা বের করে সামনের দিকে এগোল আদিল।

সামনেই গঙ্গা। পাড়ের এইদিকটা হাঁটু অবধি লম্বা ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে ভরতি। তবে মাঝে মাঝে দু’-একটা গাছও রয়েছে। জলের খুব আবছা শব্দ আসছে। দূরে ভেসে থাকা লঞ্চও দেখা যাচ্ছে। ঘড়ির লাল বিন্দুটা বলছে পঞ্চাশ মিটারের মতো দূরে আছে প্রিমো। সামনে বেশ অন্ধকার, তবু এগোতে লাগল আদিল।

হেলিকপ্টার নিয়ে ধাওয়া করা হয়তো সুবিধের দিক দিয়ে ঠিক ছিল, কিন্তু এর মূল অসুবিধেটা হল হেলিকপ্টার খুব সহজে দেখে ফেলা যায়। যতই ও দূরে নেমে যাক না কেন, কলেজস্ট্রিটে প্রিমো যে হেলিকপ্টার দেখে ওর উপস্থিতি বুঝে ফেলেছিল, সেটা ভালই বুঝতে পারছে আদিল। তাই তো হাতের কাছে পেয়েও ফসকে গেল প্রিমো!

এবার আর ভুল করেনি আদিল। ধীরে-সুস্থে ট্র্যাফিক সার্জেন্টের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে একটা বাইক নিয়ে এসেছে। আদিল জানে যে, রাত দশটার আগে কিছু করবে না প্রিমো। তাই হিসেব করে এখানে এসে পৌঁছেছে ও। এখন প্রশ্ন হল, সামনের অন্ধকারে প্রিমো কোথায়?

আর পঁচিশ মিটার। কিন্তু অন্ধকার বেশ জমাট এখানে। হাতঘড়ির আলোর বৃত্তটা বুদবুদের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে। একটু নিচু হয়ে এবার দ্রুত এগোল আদিল।

গঙ্গার দিক থেকে ভেসে আসা হাওয়া এসে ঝাপটা মারল আদিলের মুখে। পাড়ের কাছে এসে অবাক হল আদিল। সামনে পাড় আর জলের ধার ঘেঁষে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ রয়েছে। এতক্ষণ আড়াল ছিল বলে বুঝতে পারেনি, কিন্তু এবার আদিল দেখল গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা আছে ছোট্ট একটা মোটরবোট!

কার এটা? আদিল গুঁড়ি মেরে এগোল বোটের দিকে। তারপর সামনে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। বোটের ভিতরটা দেখবে বলে উঁচু করল পা।

“ফ্রিজ।”

পিছন না ফিরলেও আদিল বুঝল নিঃশব্দে প্রিমো এসে দাঁড়িয়েছে ওর পিছনে!

“ইটস ওনলি অক্টোবর মেট,” আদিল গলাটা স্বাভাবিক রেখে ঘুরল প্রিমোর দিকে, “উইন্টার ইজ কাপল অফ মান্থস আওয়ে।”

প্রিমো হাসল, “সেন্স অফ হিউমার! গুড। তবে তার আগে পিস্তলটা ফেলে দাও মাটিতে।”

আদিল পিস্তলটা ফেলে তাকাল সামনে। প্রিমোকে দেখা যাচ্ছে আবছা। অন্ধকারের ভিতর ছোটখাটো রোগা চেহারার মানুষটাকে দেখলে বোঝাই যাবে না, এ এমন একজন ক্রিমিনাল।

প্রিমো ধীরে ধীরে ঘুরে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর চট করে একবার বোটটা দেখে নিয়ে লাফিয়ে উঠল ওটায়। তবে পুরোটা সময় পিস্তলটা কিন্তু ঠিক তাগ করে রাখল আদিলের দিকে।

“এবার কাজের কথা,” প্রিমো বলল, “কোডটা দাও।”

“আগে বোমার রিমোট,” আদিল স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল প্রিমোর দিকে।

“তুমি কি দরাদরি করার মতো অবস্থায় আছ বলে মনে করো?”

“আগে রিমোট,” আদিল নিজের অবস্থান পালটাল না।

“শোনো,” প্রিমো বাঁ হাত দিয়ে একটা ছোট্ট জিনিস আদিলের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল, “এই নাও, তোমার জি পি এস ডট। একটু আগে এটার অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছি আমি। ভেবেছিলাম, কোডটা ইলেকট্রনিক্যালি ট্রান্সফার করতে বলব। কিন্তু সিনস ইউ আর হিয়ার, নিশ্চয়ই তুমি নিয়ে এসেছ। তাই আর সময় নষ্ট না করে ওটা দিয়ে দাও আমায়।”

আদিল চোয়াল শক্ত করল। এইভাবে নিরুপায় হয়ে ওকে কোডটা দিয়ে দিতে হবে!

প্রিমো আবার বলল, “শোনো তুমি না দিলে তোমার মাথায় গুলি করে আমি এমনিতেই তোমার পকেট থেকে কোডটা নিয়ে নেব।”

আদিল বলল, “আমার কাছে কোড নেই। তোমায় ফলো করতে করতে এখানে এসেছি। আমার কাছে ওটা থাকার কথা নয়।”

“তাই?” প্রিমোর গলার স্বরটা পালটে গেল হঠাৎ। তারপর হাতে একটা ছোট্ট মোবাইল ফোনের মতো জিনিস বের করে বলল, “তা হলে ঠিক আছে। আমি প্রথম বাজিটা ফাটাই। দেখা যাক, কত লোক রোস্ট হয়!”

“হোল্ড ইট,” আদিল চিৎকার করে উঠল, “এমন কোরো না প্লিজ। কত মানুষ মারা যাবে ভাবতে পারছ? এমন কেন করবে? বি হিউম্যান। মানুষের মতো ব্যবহার করো।”

“এটা তোমার পক্ষে বলা সহজ। কারণ তোমার কিছুই ফায়ারিং লাইনে নেই। আমি সাধু নই। যখন তোমার উপর অন্য জীবন নির্ভর করে থাকবে, তখন তুমি সাধু হওয়ার চেষ্টা কোরো।”

“মানে?” অবাক হল আদিল।

“মানে এবার দাও কোডটা, না হলে…” কথাটা শেষ না করে রিমোটের একটা বোতাম টিপে রিমোটটাকে অন করল প্রিমো।

“প্লিজ, এমন কোরো না, আমি দিচ্ছি”, আদিল হাত তুলে বারণ করল। তারপর পকেটে হাত ঢোকাতে গেল।

“সাবধান! বেশি ওস্তাদি করতে গেলে কিন্তু আমি সত্যি গোটা শহর তছনছ করে দেব।”

ধীরে ধীরে পকেট থেকে ছোট্ট ডেটা স্টিকটা বের করল আদিল। বলল, “এটায় আছে কোড।”

“তাই?” প্রিমো বলল, “ঠিক আছে ছুড়ে দাও ওটা আমার দিকে।”

“তুমি রিমোটটা ছুড়ে দাও। আমরা দুজনেই এক, দুই, তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ব, কেমন?” আদিল তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইল প্রিমোর দিকে।

“ওকে, আমি রেডি,” প্রিমো বলল, “এক, দুই, তিন।”

আদিল ছুড়ে দিল ডেটা স্টিকটা আর প্রিমোও ছুড়ল ওর হাতের রিমোট। আবছা অন্ধকারে দু’জনের দুটো জিনিস লুফে নিতে সমস্যা হল না!

আদিল দ্রুত রিমোটটা হাতে নিয়ে দেখল। এ কী!

ও বলল, “এটা কী? কী এটা?”

প্রিমো হাসল, “কেন? তুমি তো এটাই চাইলে!”

“এটা তো খেলনা একটা। আসল রিমোট কই?”

“আসল?” প্রিমো হাসল, “এটাই আসল। কারণ কোনও বোমা নেই। কোনও প্যান্ডেলে কোনও বোমা নেই।”

“মানে?”

“মানেটা খুব সোজা। প্যান্ডেলে কোনও বোমা নেই। স্টেশনের নির্জন প্রান্তে বা মাঝ-গঙ্গায় যে বোমা ছিল, কেবল সেই দুটোই আসল। আর নেই।” প্রিমো বলল, “আসল হচ্ছে তোমাদের বিশ্বাস করানো যে বোমা আছে। সেটা করাতে পেরেছি। তাই কোডটা এখন আমার হাতে। এই পৃথিবীতে বিশ্বাসই আসল, সত্যিটা নয়। বুঝলে? তবে যদি কোডটা নকল হয়, তবে আমি অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছি। সেটা পরে বুঝবে তোমরা।”

আদিল বোকার মতো তাকিয়ে রইল, “কী ব্যবস্থা?”

প্রিমো বলল, “আগে কোডটা ভেরিফাই করি, তারপর সেটা বলব। আমি এবার যাব। তুমি মাথার পিছনে হাত দিয়ে নিল ডাউন হও।”

আদিল চোয়াল শক্ত করে নিল ডাউন হতে গেল, আর ঠিক সেই সময়ে আচমকা ওর কানের পাশ দিয়ে গুলি চলল একটা। আদিল রিফ্লেক্স অ্যাকশনে পড়ে গেল মাটিতে। শুনল আরও গুলি চলল পিছন থেকে।

আর ওর চোখের সামনে বোটের উপর পড়ে গেল প্রিমো। নিমেষের মধ্যে কী হল বুঝতে পারল না আদিল। মাথা ঘুরিয়ে দেখল, পিছন থেকে বন্দুক তুলে এগিয়ে আসছে একজন। আবছা অন্ধকারে প্রথমটায় বুঝতে না পারলেও কাছে আসতেই মানুষটাকে চিনতে পারল আদিল। মানুষটা আর কেউ নয়, জয় কুমার।

আদিল উঠে দাঁড়াল।

জয় কাছে এসে বলল, “ইউ স্টে হিয়ার।”

তারপর বন্দুক তুলে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। আদিল দেখল মোটর বোটের এক কোণে পড়ে আছে প্রিমো। জয় সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ছোট্ট লাফে বোটে গিয়ে উঠল। পা দিয়ে দু’বার নাড়িয়ে দেখল প্রিমোকে। তারপর ঝুঁকে পড়ে ওর হাত থেকে নিয়ে নিল ডেটা স্টিকটা।

“গুড জব,” আদিল বলে উঠল, “এন এস জি-কে একবার ডাকুন স্যর।”

জয় মাথা নাড়ল ধীরে। তারপর হঠাৎ বন্দুকটা তুলে আদিলের দিকে তাগ করে বলল, “কেউ তো নেই, কাকে ডাকব? সকলকে তো বলেছি বাবুঘাটের কাছে জমা হতে। এখানে কে আসবে? তার বদলে তোকে মেরে আমি বেরিয়ে যাব।”

“স্যার?” আদিল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল জয়ের দিকে।

“কী হল, বোকা বনে গেলি তো আদিল?” জয় হাসল, “আমি জয় কুমার। গোটা প্ল্যানটা আমারই হ্যাচ করা, বুঝেছিস?”

“এটা কী করেছেন স্যার?”

“কী করছি মানে? দেশের হয়ে এত বছর খেটে কী পেলাম আমি? না টাকা, না সম্মান। সব সময় মন্ত্রীদের আর আমলাদের সামনে জো হুজুরি করতে করতে কী পেয়েছি আমি? কিন্তু কোন দিক থেকে আমি কম? গোটা দেশকে কেমন নাচিয়ে ছাড়লাম বল? আই এস আই-এর সঙ্গে খুব ক্লোজ কানেকশনে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়, আর মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে আমাদের দোস্তিও হয়ে যায়। আই এস আই-এর মুজাফফরাবাদের কমান্ডার লতিফ শেখ আমার বন্ধু। ওর থেকেই অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি আমি। লতিফরা ওকে কাজে লাগিয়েছে। তবে জানায়নি আমার কথা। ওকে দিয়েই বলিয়েছে যে, আমায় ছাড়া আর কারও সঙ্গে ও নেগোশিয়েট করবে না। যাতে আমি সবসময় ঘটনাকে কন্ট্রোল করতে পারি। কারণ কাজটা শেষ করার পর প্রিমোকে যে আমায় সরিয়ে দিতেই হত। কোনও ক্লু যে পিছনে রেখে যেতে নেই! আমাদের তো এটাই শেখানো হয়, তাই না? আর তাই সব শেষ করতে আমিই সকলের সম্মতি নিয়ে এসেছি এখানে। আমায় বলা হয়েছে, যে-কোনও উপায়েই যেন আমি কোডটা উদ্ধার করি,” হাসল জয়, “দ্যাখ, ঠিক উদ্ধার করলাম। তবে তোদের দেশের জন্য নয়। অন্যদের জন্য। এবার দ্যাখ, চায়না আর পাকিস্তান তোদের কী অবস্থাটা করে।”

“স্যার, আপনি এমন করবেন না। এখনও ফিরে চলুন। আমি কাউকে কিছু বলব না। কোডটা ফেরত দিয়ে দেবেন। ব্যস সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কিচ্ছু ঠিক হবে না। যা হওয়ার হয়েছে। অনেকদিন তোদের দাসবৃত্তি করেছি, আর না। এই লঞ্চটা নিয়ে আমি বেরিয়ে যাব নদীর মোহনা অবধি, সেখান থেকে বাংলাদেশি জলদস্যুরা আমায় পিক আপ করে নেবে আর তারপর সেখান থেকে সোজা বাংলাদেশের সুন্দরবনের কোনও দ্বীপে গিয়ে উঠব,” জয় পিস্তলটা শক্ত করে ধরে বলল,“ তোদের সকলের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাব আমি। ডলার সব ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে আমার অ্যাকাউন্টে। এখন এটা বেচেও আমি যা টাকা পাব…”

“ডলার ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে?” আচমকা পাশের থেকে বলে উঠল প্রিমো।

আদিল তো চমকে গেলই, তার সঙ্গে দেখল জয়ও চমকে গিয়েছে খুব।

প্রিমো কোনওমতে উঠে বোটের গায়ে হেলান দিয়ে বসল, “আপনি শিয়োর যে টাকা ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে?”

জয় থতমত খেয়ে বলল বোটের একটা ধারে পিছিয়ে গেল। বলল, “তুই…বেঁচে?”

প্রিমো হাসল, “হ্যাঁ, আমি কেভলার পরে আছি। বুলেট রেজিস্ট্যান্ট সুট। তা ডলার পেয়েছেন শিয়োর?”

জয় বলল, “আমরাই তো ট্রান্সফার করলাম। আমার সামনে ট্রান্সফার হয়েছে ওই অ্যাকাউন্টে।”

“হ্যাঁ, ঠিক, আপনাদের দেওয়া অ্যাকাউন্টেই তো আমি ট্রান্সফার করতে বলেছি, কিন্তু…” প্রিমো হাসল, “দেখুন তো ট্রান্সফার হয়েছে কিনা!”

কার দিকে পিস্তল তাগ করবে বুঝতে পারল না জয়, বলল, “জানোয়ার, তুই…তুই…”

“টাকাটা আপনার অ্যাকাউন্টে ওয়্যার করার আগেই ওটা আমার লোক সরিয়ে নিয়েছে অন্য জায়গায়,” প্রিমো হাসল।

“বিশ্বাসঘাতক,” জয় পিস্তলটা তুলল প্রিমোর দিকে, “ভুলে গিয়েছিস অস্ট্রিয়ার ফিস গ্রামে তোর প্রিয় ফাদার আর বাচ্চারা আমাদের লোকের কবলে…”

“ফাদারের চিন্তা আপনি করবেন না। উনি ভিয়েতনাম ভেট। আপনার লোকটি আর নেই। এখানে আসার পরই ফাদার খবর দিয়েছেন আমায়। আর বিশ্বাসঘাতক! কে কাকে বলছে? টাকাটা নেওয়াই আমার লক্ষ্য ছিল। কী ভেবেছেন উত্সবের শহরে আমি সত্যি বোমা রাখব? বোমা নেই। আর আপনার টাকাও নেই।”

“কিন্তু লঞ্চ কোড আছে,” হিসহিসে গলায় বলে উঠল জয়, “এটাই আমার আসল পাসপোর্ট। তবে তার আগে তোদের দুটোকে…”

জয় কথা শেষ না করেই পিস্তলটা তুলল আদিলের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে ওই বসা অবস্থা থেকে প্রিমো লাথি চালাল জয়ের হাঁটুর পাশটা লক্ষ্য করে। মুখ দিয়ে শব্দ করে জয় পড়ে গেলেও পিস্তলটা ফেলল না। বরং ঘুরে গিয়ে পিস্তলটা তুলল প্রিমোর দিকে। আর এই সুযোগটুকু খুঁজছিল আদিল। ও দ্রুত ডিগবাজি খেয়ে মাটি থেকে তুলে নিল ওর নিজের পিস্তলটা।

দুটো পরপর গুলির শব্দ হল।

আদিল দেখল বোটের থেকে জয়ের গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল প্রিমো। আর বোটের উপরে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে রইল জয়। তারপর কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে গেল বোটের ভিতরে।

আদিল পিস্তল তাগ করেই দৌড়ে গেল বোটের দিকে। জলের কাছে এসে দ্রুত এদিক-ওদিক দেখল। ও, নাহ্! জলে প্রিমোর কোনও চিহ্ন নেই। আদিল বোটের কিনারায় উঠল এবার। বোটের মেঝেতে পড়ে রয়েছে জয় কুমার। ওর নিথর দেহে আদিলের ছোড়া বুলেটের ক্ষত আর বাঁ হাতে ধরা নিউক্লিয়ার মিসাইলের লঞ্চ কোড সমেত ডেটা স্টিক!

২৬

মুজাফফরাবাদ, পাক অধিকৃত কাশ্মীর

লতিফ শেখ মাথা নামিয়ে নিল এবার।

কর্নেল শ্যাঙ ওয়েই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “অপদার্থ। দিলেন তো সব ছড়িয়ে! কোথায় এল কোড? হুঁ ছড়াবে না! নিউজ বলছে টেররিস্ট অ্যাটাক ঠেকিয়ে দিয়েছে ওরা। ইডিয়ট।”

লতিফ জানে, ওর বলার কিছু নেই।

কর্নেল রাগে গরগর করতে করতে ফোন করলেন বেজিং-এ, বললেন, “উই হ্যাভ ফেল্ড। আমাদের পরে আবার ট্রাই করতে হবে। এখন চুপ করে থাকাই ভাল কিছুদিন।”

সামনে পড়ে থাকা কাবাবটা কেমন মাটির মতো খেতে লাগল লতিফের। ও দেখল মাটিতে থুতু ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল শ্যাঙ ওয়েই।

২৭

মহাষ্টমী, কলকাতা

এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি থেকে নেমে আকাশের দিকে তাকাল আদিল। সকাল ন’টা বাজে। ন’টা পঞ্চাশের কলকাতা থেকে দিল্লির প্লেন ধরবে ও। গতকালের সাফল্যের পর আদিলকে পি এম ও থেকে বিশেষভাবে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

অনেক কঠিন মিশনে বেরিয়েছে আদিল, কিন্তু এমন একটা মিশন যে ওকে কলকাতায় এগজিকিউট করতে হবে, কোনওদিন ভাবেনি। ভাবেইনি ওর স্কুল জীবনের শহরটায় ওকে ফিরে আসতে হবে এমন একটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে।

তবে শেষটা যে ভালভাবে হয়েছে, এটাই আসল কথা।

বোটে জয়ের মৃতদেহ সামনে রেখেই রাইটার্সের কন্ট্রোলরুমে ফোন করেছিল আদিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এন এস জি থেকে শুরু করে পুলিশ সকলে এসে ঘিরে ফেলে জায়গাটাকে। দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বোট আর জয়ের মৃতদেহ। প্রিমোর মৃতদেহ খোঁজার জন্য ডাইভারদের সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল গঙ্গায়।

আদিলকে ওখানে আর না রেখে সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল রাইটার্সে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “জয়? জয়ের কী হল?”

আদিল চুপ করে থেকে শুধু বলেছিল, “সরি স্যর, হি ইজ় আ ট্রেটর। হি হ্যাজ বিট্রেড আওয়ার কান্ট্রি।”

সি এম অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন “মানে? কী হয়েছে?”

আদিল মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল সব কথা।

কথা শেষ হওয়ার পর সকলেই চুপ করে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর প্রথম কথা বলেছিলেন অ্যান্টনিজি। বলেছিলেন, “যা হয়েছে, এতে এবার মিডিয়াতে খবর বেরোবেই বেরোবে। এই মর্মে যে টেররিস্ট অ্যাটাক আমরা ঠেকিয়ে দিয়েছি। আমাদের দেশের সিকিয়োরিটি টপ ক্লাস। তবে জয়ের কথাটা কিন্তু আমাদের মধ্যেই থাকবে। এটা কিছুতেই আমরা বাইরে বেরোতে দেব না। লোকে জানবে যে, RAW এখনও অভেদ্য। মানুষের মনে এই বিশ্বাসটা আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আমাদের মধ্যে যে ডাবল এজেন্ট আছে, সেটা কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।”

সি এম বলেছিলেন, “ঠিক বলেছেন। সিকিয়োরিটি আসলে একটা সেন্স অফ ফিলিং। আমরা নিজেদের যতটা সিকিয়োর্ড ভাবি, আমরা ততটাই সুরক্ষিত।”

অ্যান্টনিজি বলেছিলেন “আমরা তদন্ত করে খুঁজে বের করব আর কোনও এমন রোগ এজেন্ট আছে কিনা। তবে বাইরের দুনিয়াতে জয়কে আমরা ম্যালাইন করতে পারি না। কারণ, তা হলে আমাদের সিস্টেম ম্যালাইনড হবে। আর একটা বাজে লোকের জন্য অনেক সৎ , নিষ্ঠাবান মানুষের ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আমরা বলব জয় ডাইড অন দ্য লাইন অফ ডিউটি। সত্যিটা জানার দরকার নেই কারও। ‘র’-এর উপর থেকে বিশ্বাস যেন না ভাঙে মানুষের।”

অ্যান্টনিজি আর শশীকান্তজি কাল রাতেই চলে গিয়েছেন দিল্লি। যাওয়ার আগে আদিলের প্রশংসা করেছেন। আর আজ আসার আগে সি এম নিজের আঁকা একটা ছবি ফ্রেম করে উপহার দিয়েছেন আদিলকে।

আদিল হাতের ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে গেল এয়ারপোর্টের গেটের দিকে। সামনে খুব ভিড়। ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম আসছে কলকাতায়। কী একটা ম্যাচ আছে একাদশীর দিন। তাই গেটের কাছে মানুষের সমুদ্র।

আদিল ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। সামনের দু’-তিন জনের সঙ্গে বেশ ধাক্কা লাগল ওর। একজন বয়স্ক মানুষ তো পড়েই যাচ্ছিলেন। আদিল কোনওমতে তাঁকে সামলে দাঁড় করিয়ে ভিড়টা ভেঙে ঢুকে গেল এয়ারপোর্টে।

বোর্ডিং পাস নিয়ে ও এগিয়ে গেল ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। সামান্য সময় আছে। একটা কফি খাওয়া দরকার।

ক্যাফেটেরিয়ার সামনে গিয়ে ব্ল্যাক কফি অর্ডার দিল আদিল। তারপর কোটের বাঁদিকের পকেটে বোর্ডিং কার্ডটা রাখার জন্য হাত ঢোকাল।

আরে! এটা কী? হাতে শক্তমতো কী একটা ঠেকল আদিলের। ও বের করে আনল জিনিসটা। একটা মোবাইল ফোন! এটা কার? আদিল দ্রুত এদিক-ওদিক তাকাল। কোত্থেকে এল এটা?

ও দ্রুত মোবাইলের টাচ স্ক্রিনে হাত বোলাল। স্ক্রিনে ফুটে উঠল, ‘কানেক্ট মি টু নেট।’

নেট কানেক্ট করে আর কিছু করতে হল না আদিলকে। ফোনটা নিজেই নানা রকম সাইটে ঢুকে বেরিয়ে শেষে একটা স্ক্রিন ডিসপ্লে করল। আদিল দেখল, তাতে একটা লিস্ট দেওয়া রয়েছে। বলা হয়েছে র‍্যানসাম বাবদ মোট জমা পড়েছে আট মিলিয়ন ইউ এস ডলার। আর সেই অর্থ এক মিলিয়ন ডলার হিসেবে ভাগ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আটটা অরফ্যানেজে জমা করা হয়েছে।

আদিল অবাক হয়ে তাকাল স্ক্রিনের দিকে। এটা কে ঢোকাল ওর পকেটে? কে? প্রিমো! তবে কি বেঁচে আছে ও? তবে কি গুলি লেগেও মরেনি? কেভলার-সুট কি এবারও বাঁচিয়ে দিয়েছে ওকে?

আর টাকাটা তবে ও নিজে নেয়নি! অনাথ শিশুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে! কেমন ক্রিমিনাল এই প্রিমো!

আদিল দেখল মোবাইলের স্ক্রিন আবার কালো হয়ে গিয়েছে। তারপর আচমকা সেখানে ফুটে উঠল, “আবার আমাদের দেখা হবে। আবার আমরা কাজ করব একসঙ্গে। কখনও, কোথাও।

আদিল হাসল নিজের মনে। তারপর ফোনটাকে অফ করে রেখে দিল পকেটে। বাইরের দিকে তাকাল। প্রচুর মানুষ অপেক্ষা করে আছে তাদের নায়কদের দেখার জন্য।

নায়ক! আদিল জানে সব নায়ককে সবসময় চোখে দেখা যায় না।

২৮

এয়ারপোর্ট চত্বরের গাছপালায় ঘেরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে নিল প্রিমো। তারপর পাশের ডাস্টবিনে কাগজে মোড়ানো নকল চুল আর দাড়িটা ফেলে দিল। এখন কেউ দেখলে বুঝবেই না, একটু আগে একটা বুড়ো লোক ঢুকেছিল বাথরুমে।

মনে মনে হাসল প্রিমো। আদিল বুঝতে পারেনি যে, ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া বুড়োটা আসলে কে? কেন সে পা জড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। আর পড়ে যেতে যেতে কখন সে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ওই প্রোগ্রামড মোবাইলটা।

পাশ দিয়ে একটা ট্যাক্সি যাচ্ছিল। প্রিমো হাত তুলে থামাল সেটাকে। তারপর বলল, “বারাসাত।”

ড্রাইভার বলল, “কুড়ি টাকা বেশি দেবেন দাদা। পুজোর সময়…”

হাসল প্রিমো, আট মিলিয়ন ডলার ভাগ করে যে দেয়, তার থেকে মাত্র কুড়ি টাকা বেশি চাইল! ও বলল, “চলো।”

হু হু করে ট্যাক্সি ছুটছে যশোর রোড দিয়ে। কোথায় যাচ্ছে ও? নিজেও ঠিক জানে না। শুধু জানে, ওকে ক’দিন গা-ঢাকা দিতে হবে। অত টাকা এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না ভারত সরকার। অমন ইঞ্জিন ওড়ানো আর ভয় দেখানো লোককে ছেড়ে দেবে না। তাই ওকে কিছুদিনের জন্য অদৃশ্য হতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে নেপাল বর্ডার দিয়ে বেরিয়ে যাবে ভারতের বাইরে।

অদৃশ্য হতে ওর মতো আর কে পারে! কাল গঙ্গার ধারে পৌঁছোবার পরেই ও ফাদারের ফোন পেয়েছিল। বুঝেছিল যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পোড় খাওয়া মানুষটা বুড়ো বয়সেও ভেলকি দেখিয়েছে। বুঝেছিল, ওর প্রিয়জনেরা সুরক্ষিত।

আসলে প্রথম থেকেই প্রিমোর মনে হয়েছিল, ওর উপর নজর রাখছে কেউ একজন। তাই নিজেকে বাঁচাতে ও বেরিয়ে এসেছিল আদিলের সামনে। জানত ও আদিলের সামনে কিছু ফাঁস করার আগেই শয়তানটা আসবে ওকে শেষ করতে। এইভাবে শয়তানটার মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছিল ও। পেরেছে প্রিমো। আর প্ল্যানমতো টাকাটাও বের করে এনেছে মরিশাসে বসে থাকা ওর হ্যাকার বন্ধুটির মাধ্যমে।

তবে দু’-দু’বার যে গুলি করা হবে ওকে, সেটা ঠিক বুঝতে পারেনি। কিন্তু কেভলার-সুট থাকতে চিন্তা কী! জলে পড়ে যাওয়ার পরে দ্রুত ডুব সাঁতারে অদৃশ্য হয়ে যায় ও। তারপর দূরে ভেসে থাকা একটা বয়ার আড়াল থেকে দেখেছিল ডাইভাররা জলে নেমে খুঁজছে ওকে।

কলকাতার পুজোর এমন সুন্দর আকাশ ওকে আল্পসের গ্রীষ্মকালের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে ওর বেড়ে ওঠা সেই চার্চের কথা।

শহর শেষ হয়ে এই জায়গাটা বেশ মফস্সলের মতো। একটু দূরে দূরে পুজো হচ্ছে। ছোট রঙিন প্যান্ডেল। মাইকে কী বলছে? অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া হবে?

“ভাই গাড়িটা একটু রাখুন তো!”

প্রিমো নেমে এগিয়ে গেল ছোট প্যান্ডেলটার দিকে। রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো সুন্দর প্যান্ডেল। সামনে নানা বয়সি মানুষজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রিমো তার ভিতর থেকে এগিয়ে গেল সামনে। পুরোহিতের সামনে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমায় ফুল দিন।”

পুরোহিত বললেন, “দেরি আছে অঞ্জলির।”

“তাড়া আছে, আমায় অনেকদূর যেতে হবে। কুড়ি বছর পর পুজোয় এসেছি, অঞ্জলি দিতে পারব না?”

উনি অবাক হয়ে তাকালেন। তারপর প্রিমোর হাতে ফুল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী নাম?”

“প্রিমো উওমো।”

“অ্যাঁ, বাঙালির এমন নাম হয় নাকি? মানে কী এর?”

প্রিমো বলল, “এটা ইতালিয়ান। মানে প্রথম মানব।”

“আরে বাবা, নামটা কী তোমার?” পুরুতমশাই অধৈর্য হলেন একটু।

প্রিমো হাসল। তারপর সহজ গলায় বলল, “প্রথম মানব কে জানেন না? সে অ্যাডাম। অবশ্য ওটা ডাকনাম। আসলে আমার নাম সেন, অদম্য সেন।”

(সমস্ত ঘটনাই কাল্পনিক ও গল্পের জন্য লেখা)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *