হাতির গল্প

হাতির গল্প

ছেলেটা পড়ে আছে। বাঁ হাতটা রক্তাক্ত। ছেলেটা ওকে বাঁচাতে না এলে দালির আজই হয়তো শেষদিন হত পৃথিবীতে। নাইটক্লাবের সামনে এত ভিড় যে, কে গুলিটা চালাল তা বোঝা যায়নি! দালি তবুও এদিক-ওদিক তাকাল। না, তেমন কেউ নেই। বরং গুলি লেগেছে বলে আহত ছেলেটির চারদিকে ভিড় বাড়ছে। দালি হাঁটু গেড়ে বসল ছেলেটির সামনে। যন্ত্রণায় নীল হয়ে আছে ছেলেটার মুখ। রোগা, ফরসা নরম মুখের একটা ছেলে। ওকে বাঁচাতে সামনে চলে এল? কে এই ছেলেটা? দালি ছেলেটার সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, “কী নাম তোমার?”

এক বছর পরে

পিটের কথা

অরেঞ্জ জুসের ছোট্ট পেট বোতলের ঢাকনাটা খুলে গলায় ঢালল দালি। তারপর হাতের উলটো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে বলল, “দুটো ট্রাক গিয়েছে, আর দুটো বাকি আছে। ক্যামোফ্লেজ র‍্যালিতে সময়টা বড্ড নষ্ট হয়।”

পিট হাসল, “দ্যাখো, ওই দুটো ট্রাকের একটায় না আবার জিনিসটা বেরিয়ে যায়!”

দালি গাড়ির সামনের সিট থেকে পিছন ফিরল, “তুমি নিজেই তো মিটার দিয়ে প্রথম দুটো ট্রাকের টায়ারের ডায়ামিটার মাপলে। দুটোই এক। নরম্যাল। লোড ছাড়া। জানো না যে, ট্রাকের ভিতরে লোড বেশি হলে টায়ারের উপর প্রেশার পড়ে আর তাতে টায়ারের ডায়ামিটার কমে যায়? প্রথম দুটো ট্রাকের চাকার তেমন কোনও ডিসটরশন তো ছিল না। তবে?”

পিট ফের হাসল, “তা ঠিক,” তারপর নিজেই আবার হাতের লম্বা দূরবিনের মতো যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বলল, “এটা একটা গ্রেট ইনভেনশন, দূর থেকে সবকিছু মেপে দেয়।”

দালি হাসল, “সব কি আর মাপতে পারে? পারে না। মানুষের মনের ভিতরটা মাপা সহজ নয়!”

পিট কিছু না বলে পিছনে একটু হেলিয়ে বসল, তারপর সামনের সিটে দালির পাশে বসা অল্প বয়সি ছেলেটির দিকে তাকাল। রোগা, সামান্য বেঁটে, আর ভিতু ভিতু মুখের এই ছেলেটাকে দালি কেন যে এই কাজটায় ঢোকাল! আসলে যে-কোনও ক্রাইমের মূল হল মন্ত্রগুপ্তি, যত বেশি সেই ঘটনার কথা লোকে জানবে, তত বেশি কাজটা পণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যাক গে। ওর কী দরকার! সুস্থমতো কাজটা সেরে মালের ভাগ নিয়ে চম্পট দেবে। সোজা হিসেব।

ঘড়ি দেখল পিট। দুটো ট্রাকের মধ্যে সময়ের গ্যাপ পনেরো মিনিটের মতো। দ্বিতীয় ট্রাকটা গিয়েছে মিনিট নয়েক হয়েছে। আরও একটু সময় আছে। গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তাটা দেখল ও। শুনশান রাস্তা। ইয়োরোপের দেশগুলোর এই এক মজা। এত লোকজন কম! শহর থেকে দূরের এই হাইওয়েগুলো একদম নির্জন থাকে। তাই তো এমন একটা কাজ করার জন্য এই স্পটটাকেই ওরা বেছেছে।

আসলে বেছেছে ফ্রেডি। ফ্রেডেরিখ লামহ্। ওদের প্ল্যানের পাণ্ডা। লোকটি জার্মান। রোগা পাকানো চেহারা। ‘ডি গ্যালাক্সি’ নামে একটা ডায়মন্ড মার্চেন্ট কোম্পানির ডিরেক্টর। ওই জোগাড় করেছে এই টিম। ওই বলেছে নানা মাপের হিরে মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার ক্যারেটের মতো ফিনিশড ডায়মন্ড, পোর্ট থেকে ডি গ্যালাক্সির ট্রেজ়ারিতে যায় এই পথ দিয়ে। আসলে যায় চারটে ট্রাক। যার একটায় থাকে হিরে আর চারজন সিকিয়োরিটি অফিসার। বাকি তিনটে ট্রাক ক্যামোফ্লেজ। কিন্তু ওই চারটে ট্রাকের কোনটায় যে হিরে যাবে তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোম্পানির ম্যানেজিং পার্টনার ছাড়া আর-কেউ জানতে পারে না। কিন্তু কোন পথে ট্রাক যাবে, সেটা ডিরেক্টর লেভেলের লোকজনই শুধু জানে। তাই ফ্রেডিও সেটা জেনে যায়। ফ্রেডি কেন নিজের কোম্পানির মাল লুঠ করতে চায়, সেটা শুনে প্রথমে তাজ্জব হয়েছিল পিট। ফ্রেডির প্রাপ্য প্রোমোশন নাকি দু’-দু’বার দিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর সহকর্মী ভিটরকে। তাই তার বদলা নিতে চায় ও। এই ডায়মন্ড নিয়ে যাওয়ার সেফ প্যাসেজের পুরো প্ল্যানটা নাকি ভিটরের। তাই হিরে লুঠ করে ও দেখিয়ে দিতে চায় যে, ভিটর কতটা ইনকম্পিটেন্ট! ওর প্ল্যানটা কতটা ফালতু!

ফ্রেডি ওদের জোগাড় করে গোটা কাজটার ক্যাপ্টেন করে দিয়েছে দালিকে। দালি একজন স্প্যানিশ। চুপচাপ, শান্ত। কিন্তু মাথাটা খুব পরিষ্কার। ও-ই চারটে ট্রাকের থেকে কোন ট্রাকে রক্ষীসমেত হিরে আছে, সেটা বোঝার জন্য এই অদ্ভুত যন্ত্রটা নিয়ে এসেছে। দূরবিনের মতো দেখতে যন্ত্রটা দিয়ে দূর থেকে কোনওকিছুর মাপ বোঝা যায়।

“ওই আসছে,” সামনের অল্পবয়সি ছেলেটা বলে উঠল হঠাৎ। আর সকলে একসঙ্গে নড়েচড়ে বসল। পিট বুঝল এই আসল সময়।

“দ্যাখ তাড়াতাড়ি,” পিটের পাশে এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ফ্রেডি সোজা হয়ে বসল হঠাৎ। বল, “যন্ত্রটা চোখে লাগাও। টায়ার দ্যাখো পিট, টায়ার।”

যন্ত্রটা চোখে লাগিয়ে পিট দূরবিনের চোঙের মতো অংশটার পাশে লাগানো একটা বোতাম চেপে যন্ত্রটা চালু করল। গাড়ির সামনে ড্যাশ বোর্ডের কাছে একটা এলসিডি স্ক্রিনে ফুটে উঠল ছবি। যন্ত্রটাতে যা দেখা যায় তা এই স্ক্রিনেও ফুটে ওঠে। সকলে স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে পড়ল একসঙ্গে। দালি শান্ত গলায় বলল, “পিছনের চাকার উপর ফোকাস রাখো।”

পিট আঙুল দিয়ে একটা নব ঘুরিয়ে কথামতো ফোকাস ঠিক করল। স্ক্রিনে তাও ফুটে উঠল স্পষ্টভাবে। এবার দালি স্ক্রিনের ফোকাস্ড অংশটাতে স্পর্শ করামাত্র একটা মেনু ফুটে উঠল। সেখান থেকে ‘মেজ়ার ডায়ামিটার’ কথাটা সিলেক্ট করল। সকলে আরও ঝুঁকে এল সামনে।

“ইয়েস,” দালি শিস দিয়ে উঠল, “আওয়ার টার্গেট। লেটস মুভ।”

পিট বুঝল এই গাড়িতেই আছে ওদের লক্ষ্যবস্তু। কারণ গাড়ির পিছনের টায়ারটার যে অবস্থায় থাকার কথা, তার চেয়ে সাড়ে চার সেমি বসে আছে।

রাস্তাটা নির্জন এখনও। দু’পাশে বড় ফাঁকা মাঠ আর মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। পিট জানে ওকে কী করতে হবে। ও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। তারপর পিছনের ডিকি থেকে বের করল লম্বামতো জিনিসটা। এটা ইজ়রায়েল থেকে আনা। পোর্টেবল রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড বা আরপিজি। অস্ত্রটাকে কাঁধে তুলে তার টার্গেট ফাইন্ডারে চোখ রেখে ট্রিগারে আঙুল রাখল পিট। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকে ঢাকা, বাক্সের মতো লাইট আরমার্ড ট্রাকটাকে। পিট জানে, এই আরপিজি ট্রাকের গায়ে আঁচড়ও কাটতে পারবে না। ট্রাকগুলো এমনভাবেই তৈরি। কিন্তু এই ট্রাকেরও দুর্বলতা রয়েছে। পিট চোখ রাখল সেই দুর্বলতায়। তারপর ট্রাকটা নির্দিষ্ট দূরত্বে আসামাত্র ট্রিগারে চাপ দিল। গ্রেনেডটা দ্রুতবেগে বেরিয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল ট্রাকের সামনের চাকার পাশে। নিমেষে ট্রাকটার সামনের অংশটা মাটি ছেড়ে ছিটকে উঠল। তারপর বিকট শব্দে কাত হয়ে পড়ে গেল এবং কিছুটা ঘষটে গেল রাস্তায়।

পিট এবং অন্যরা এবার দৌড়োল ট্রাকটার দিকে। দেরি করা যাবে না। সময় খুব কম। মাত্র পনেরো মিনিট। কারণ তারপর আরও একটা ক্যামোফ্লাজড এসে পড়বে।

কাত হয়ে পড়া ট্রাকের পিছনের দরজাটা ভিতর থেকে খুলে গেল এবার। পিট দেখল তিনজন রক্ষী পড়ে আছে অচৈতন্য অবস্থায়। শুধু একজন প্রায় অক্ষত!

“এই তিনটেকে নিয়ে আর-কিছু করতে হবে না,” ফ্রেডি গম্ভীরভাবে বলল। তারপর চতুর্থ রক্ষীটির দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বিশেষ লাগেনি তো মুসা?”

দশদিন আগে। ইন্টারপোল চিফের অফিস

একটা পেপার নিজের সেক্রেটারির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চিফ বললেন, “এত হিরে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এল আর তোমরা কেউ ব্যবস্থা নিলে না? এসব কনফ্লিক্ট ডায়মন্ডগুলো সস্তায় কিনে বড় বড় হিরে ব্যবসায়ীরা টেররিস্টদের হাতে ডলার তুলে দিচ্ছে। আর তাই দিয়ে ওরা সারা পৃথিবীতে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। তোমরা ঘুমোচ্ছিলে? সিআইএ এই নিয়ে চারবার নোটিশ পাঠাল। কেন আগে এর ব্যবস্থা নাওনি?”

সেক্রেটারি ছেলেটির নাম স্যামুয়েল। ও পেশাদার গোয়েন্দা নয়। আগে অ্যানালিস্ট ছিল আর এখন চিফের সেক্রেটারি পদে কাজ করছে। ও থতমত খেল একটু। তারপর বলল, “আগের তিনবার স্যার ইনফরমেশন ভুল ছিল। তাই…”

“ফালতু কথা বোলো না। জানো, কনফ্লিক্ট ডায়মন্ড কী? আফ্রিকার হিরের খনি থেকে ওখানকার ওয়ার লর্ডরা বেআইনিভাবে জোর করে মানুষদের দিয়ে হিরে তোলায়। তারপর তা বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ড্রাগস আর অস্ত্র কেনে। যা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সাদা বাজারে এই হিরে কেনা অপরাধ। কিন্তু তবু কিছু হিরে ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় কালোবাজার থেকে কম দামে এসব হিরে কেনে। এমনই একটা কনসাইনমেন্ট আসছে বেলজিয়ামে। সেটাকে থামাতেই হবে। আমি জানি, যে কোম্পানি এটা নিয়ে আসছে, সে বেশ প্রভাবশালী। সে এটাকে পেপারে ক্লিন ডায়মন্ড হিসেবে দেখিয়ে আনছে। কিন্তু তা তো আর সত্যি নয়। এটাকে আমাদের আটকাতেই হবে।”

স্যামুয়েল আমতা আমতা করে বলল, “তা, মানে… স্যার আসলে… লিগ্যালি তো আটকানো যাবে না। তাই ভাবছিলাম কীভাবে…”

চিফ ভুরু কুঁচকে বললেন, “ছোটবেলায় শুনেছিলাম, কুকুরের লেজ যদি সোজা না করতে পারো, তা হলে লেজটা কেটে বাদ দিয়ে দাও। বুঝেছ?”

স্যামুয়েল হাসল এবার। বলল, “ইয়েস স্যার, বুঝেছি। তা হলে কী করব?”

চিফ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “এটাও বলতে হবে? কুকুরের লেজ কাটতে হলে কী করতে হয়? বিশেষ করে কুকুরটা যদি পাগলা হয়?”

ফ্রেডির কথা

ওয়্যারহাউসটা বড় আর পুরনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা একটা হ্যাঙার ছিল। পরে ওয়্যারহাউস হয়। এখন এটা একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত গুদাম ছাড়া আর-কিছুই নয়। ফ্রেডি এটা খুঁজে রেখেছিল আগেই। এখন এখানে এসে হিরে ভরতি ব্যাগটা রেখে ওর মনে হল, এর চেয়ে ভাল জায়গা আর-কিছু হতে পারে না।

যাক, প্রথম ধাপের কাজ শেষ। হিরেগুলো ঠিকঠাক ভাবে হাতে এসে গিয়েছে। এবার দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু করতে হবে। ফ্রেডি সামনের প্যাকিং বক্সের উপর বসা দালি, পিট, মুসা আর অল্প বয়সি কিডোকে দেখল। মুসা প্রথম থেকেই ওর দলে। আর পিট কোনও সমস্যা নয়। ওর মূল লক্ষ্য হল দালি। দালি লোকটা দাগি আসামি। পৃথিবীর ছ’টা দেশে ওর বডি-ওয়ারেন্ট আছে। ইন্টারপোর্ট ওর নামে রেড কর্নার নোটিশ জারি করেছে। মানুষ মারতে দালির হাত কাঁপে না। কিন্তু কাজের ব্যাপারে খুব বিশ্বস্ত ও। তাই ফ্রেডি দালিকে মিশর থেকে যোগাযোগ করে এই কাজের জন্য এখানে এনেছে। কিন্তু এখন দালির সামনে থেকে ওর ভাগের মাল না দিয়ে ওকে কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়াটাই হবে আসল কাজ। ফ্রেডি মুসার দিকে তাকাল একবার। লোকটার বিশাল চেহারা। যেন ওক গাছ!

ট্রাক উলটে যাওয়াতে কিছু হয়নি ওর। আর সেকথা ভেবেই রক্ষী সাজিয়ে ওকে ট্রাকের ভিতরে প্ল্যান্ট করেছিল ফ্রেডি। কারণ ভিতর থেকে দরজাটা খুলে দেওয়ার জন্য একজনকে প্রয়োজন ছিল। ভিতরের রক্ষীদের বন্দুক ছাড়া আর-কিছু রাখা নিষেধ। মানে কোনওরকম ফোন বা ওয়াকি-টকি, কিচ্ছু রাখা যাবে না। যাতে ভিতরের কেউ বাইরের কাউকে ট্রাক সম্বন্ধে খবর না দিতে পারে, সেটা খুব ভাল করে লক্ষ রাখে কোম্পানি। তাই মুসাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, যখন-তখন ট্রাকের উপর হামলা করবে ওরা। ও যেন সবদিক থেকে সচেতন থাকে।

ফ্রেডির দিকে তাকিয়ে মুসা আলতো করে মাথা নাড়ল। ফ্রেডি হাসল সামান্য। কারণ মুসাকে ও আগেই নিজের দিকে নিয়ে নিয়েছে। দালির সঙ্গে পেরে উঠতে গেলে মুসাকে ওর দরকার।

ফ্রেডি নিজে একটা প্যাকিং বক্সের উপরে বসে এবার দালির দিকে তাকাল, “তা দালি, আমাদের কি সেলিব্রেট করা উচিত নয়? তুমি বলেছিলে শ্যাম্পেন আনবে? এনেছ?”

দালি হাসল মৃদু। বলল, “নিশ্চয়ই। আমরা অবশ্যই সেলিব্রেট করব,” তারপর অল্পবয়সি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিডো, ব্যাকপ্যাক থেকে শ্যাম্পেনের বোতলটা বের করো।”

ফ্রেডি হাসল, “গ্রেট। নাও খোলো তবে। আগে চুমুক দিই। তারপর না হয় কাজের কথায় আসা যাবে।”

অল্পবয়সি ছেলেটা বোতলটা খুলে তিনটে গেলাস বের করে পাশের একটা প্যাকিং বক্সের উপর সাজিয়ে তাতে সোনালি তরলটা ঢেলে দিল।

“এ কী, তিনটে গেলাস কেন?” ফ্রেডি হেসে জিজ্ঞেস করল।

“কিডো এসব খায় না। আর আমার তো অরেঞ্জ জুস হলেই হয়। কিডোর ব্যাগে আমার জুস থাকে সবসময়,” দালি শান্তভাবে উত্তর দিল।

ফ্রেডি হাসল, তারপর ধীরে ধীরে কেটে কেটে বলল, “জানো দালি, একটা আফশোস হচ্ছে। তুমি শ্যাম্পেনের টেস্ট না জেনেই পৃথিবী থেকে চলে যাবে!”

“মানে?” দালি অবাক হয়ে উঠে দাঁড়াল।

“মানে? এইটা…” ফ্রেডি নিমেষে নিজের লেদারের জ্যাকেটের ভিতর থেকে একটা ‘স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন’ পিস্তল বের করে সোজা তাগ করল দালির দিকে। একইসঙ্গে মুসাও একটা পিস্তল বের করে তাগ করল কিডোকে।

“এসবের মানে কী?” দালি বিভ্রান্ত মুখে তাকাল ফ্রেডির দিকে।

ফ্রেডি বলল, “মানেটা খুব সোজা। তোমার কাজ ফুরিয়েছে। এবার তোমায় এই রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যেতে হবে বন্ধু। তবে আফশোস এই যে, কিডোর মতো একটা বাচ্চা ছেলেকেও তোমার সঙ্গে চলে যেতে হবে। তখনই বলেছিলাম ওকে নিয়ো না। তোমার জুস ক্যারি করা ছাড়া আর কি কোনও কাজ আছে ওর?”

দালি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ফ্রেডির দিকে। ফ্রেডি দেখল অবস্থা খারাপ বুঝে পিটও এসে দাঁড়িয়েছে মুসার সঙ্গে। এটাই হয়। মনে মনে হাসল ফ্রেডি। অপরাধ জগতে দালির যতই নাম থাকুক না কেন, এই খেলায় দালির হার নিশ্চিত। তাই পিট নিজের থেকেই এসে গিয়েছে ওর দিকে। দালি শান্ত গলায় বলল, “এটা কি ঠিক হচ্ছে?” ফ্রেডি একহাতে শ্যাম্পেনের গেলাস তুলে নিয়ে অন্যহাতে পিস্তলটা ধরে বলল, “ভুল বলে কিছু হয় না বন্ধু। সবই আমাদের ধারণা মাত্র। আগে শ্যাম্পেন তারপর তুমি আর কিডো। কেমন?”

মুসা আর পিটও ফ্রেডির দেখাদেখি গেলাস তুলে নিল।

ফ্রেডি বাঁহাত দিয়ে গেলাসটা উপরের দিকে তুলে হাসল। তারপর বলল, ‘চিয়ার্স টু দ্য টিয়ার্স অফ ইয়োর হার্ট।”

ইন্টারপোলের অফিস। সাতদিন আগে।

স্যামুয়েল অবাক হয়ে চিফের দিকে তাকাল। ফরসা, মোটা মানুষটাকে ওরা সকলে পিছনে হাতি বলে ডাকে। তবু সকলে, বিশেষ করে স্যামুয়েল ওঁকে শ্রদ্ধা করে খুব। ইন্টারপোলের নতুন প্যানোপটিকোন সারভাইল্যান্সের ব্যাপারটা চিফেরই কীর্তি। ‘নজর না রেখেও নজর রাখছি’ এই ভয় যে মানুষের ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা এই দশকে নতুন করে বের করেছেন চিফ। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের পুরনো থিয়োরিকেই নতুন করে ইন্টারপোল ইন্টেলিজেন্সে কাজে লাগিয়েছেন চিফ। আর সেই মানুষটা এমন একটা কাজ করলেন! দালির মতো ইন্টারপোলের রেড কর্নার নোটিশ পাওয়া ক্রিমিন্যালকে যোগাযোগ করলেন ব্লাড ডায়মন্ডের পিছনে লাগানোর জন্য। ইন্টারপোল জানে, যাকে নিজেরা অ্যারেস্ট করতে পারছে না, তাকে এমনভাবে যোগাযোগ করাটা বেআইনি। তবু এই কাজ করলেন চিফ!

গতবছর তেল আভিনব-এ দালিকে ধরতে গিয়ে ইন্টারপোলের দু’জন খুন হয়েছিল। সন্দেহ করা হয় যে, দালিই আসলে এই খুনের পিছনে আছে। যদিও প্রমাণ নেই, তবু ওরা জানে যে, দালিই আসল লোক। আর সেই দালিকেই কাজে লাগাচ্ছে ইন্টারপোল! তাও কিনা এই আশ্বাস দিয়ে যে, দালিকে অ্যারেস্ট করা যাবে না! মানে ধরার চেষ্টা চলছে দেখানো হবে খাতায় কলমে, কিন্তু ধরা হবে না! তবে দালিকেও ক্রাইমের থেকে দূরে রাখতে হবে। দালি মেনে নিয়েছে এই শর্ত। আর তা মানবে না-ই বা কেন? ও নিজেও তো জানে যে, খুন, ড্রাগ, অস্ত্র ব্যাবসা থেকে আরও নানা যেসব কাণ্ড ও করে বেড়িয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর-কিছু সাজা হতেই পারে না। তাই ইন্টারপোলের সঙ্গে তলায় তলায় হাত মেলালে ওর লাভ বই ক্ষতি নেই। কিন্তু চিফ এটা কী করলেন! যে দালিকে ধরা যাচ্ছে না, তাকে একেবারে ফোন করে এমন একটা কাজ দিলেন!

স্যামুয়েল চোয়াল শক্ত করে চায়ের কাপটা চিফের সামনে রেখে সরে এল। আজ ওর হাতির দিকে তাকানোর ইচ্ছে নেই। একদম নেই। মানুষটার সম্বন্ধে ওর শ্রদ্ধা আজ টলে গিয়েছে।

“কী স্যাম, রাগ হচ্ছে?” চিফ হেসে চায়ের কাপটা তুলে নিলেন।

“স্যার, আমরা যা তিনদিনে পারলাম না, সেটা আপনি করে দিলেন! দালিকে খুঁজে বের করে এই কাজে লাগালেন! ও তো ক্রিমিন্যাল!”

চিফ ভুরু কুঁচকে তাকালেন স্যামুয়েলের দিকে, “তুমি আমায় প্রশ্ন করছ?”

স্যামুয়েল মাথা নিচু করল বটে, কিন্তু প্রশ্ন করা যে ভুল হয়েছে তা মানল না।

“ইনসাবরডিনেশন কাকে বলে জানো?” চিফ তাকিয়ে রইলেন স্যামুয়েলের দিকে।

“জানি স্যার,” ছোট্ট করে বলল স্যামুয়েল, “কিন্তু ও স্যার দাগি আসামি। ওর ফোন নম্বর আপনার কাছে আছে। কিন্তু তবু আমরা ওকে ধরতে পারছি না কেন? আমাদের লোককে ও খুন করেছে। আর সেখানে ওকে কাজের বিনিময়ে সেফ প্যাসেজ অফার করা হচ্ছে!”

চিফ এবার হাসলেন। স্যামুয়েলের বয়স অল্প। চিফ পছন্দও করেন ছেলেটাকে। তিনি বললেন, “দালি যে দেশে আছে সেখান থেকে ওকে ধরে আনা সম্ভব নয়। তাই ভাবলাম ওকে ধরা যখন যাচ্ছে না, তখন কাঁটা দিয়ে কাঁটাই তুলি।”

“কিন্তু স্যার…” স্যামুয়েল আরও কিছু বলতে গেল।

চিফ হাত তুলে বাধা দিলেন, “আমায় তোমরা কী বলে ডাকো আমার পিছনে?”

“অ্যাঁ!” স্যামুয়েল ঘাবড়ে গেল।

“কী বলে ডাকো আমায়?” চিফ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন স্যামুয়েলের দিকে, “ভয় পেয়ো না, বলো।”

স্যামুয়েল কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

“হাতি। আমি জানি,” চিফ হাসলেন, “তা হাতির সম্বন্ধে সেই কথাটা জানো না?”

“কোন কথাটা স্যার?” স্যামুয়েল অবাক হল।

চিফ এবার সারা শরীর কাঁপিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, “সময় হলেই জানবে।”

দালির কথা

দালি স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ফ্রেডি, পিট আর মুসার দিকে। তিনজনের চোখেই খুন দেখছে ও। দালি আড়চোখে কিডোকে দেখল। ছেলেটার মুখ-চোখ লাল হয়ে আছে ভয়ে। ঝড়ে গাছের পাতার মতো কাঁপছে ও। তবে কি… দালির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কিডো ভুল করেনি তো? ছেলেটা ভাল। বছরখানেক আগে নেপলসে দালির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কিডোর। না, কোনও ফরম্যাল আলাপ নয়, একটা নাইট ক্লাবের সামনে রীতিমতো নিজের শরীরে গুলি খেয়ে ওকে বাঁচিয়েছিল কিডো। ইন্টারপোলের দু’জন প্রায় সাবাড় করেই দিয়েছিল ওকে। কিডো যে কোথা থেকে এসে বাঁচিয়েছিল কে জানে! সেই থেকে কিডো ওর ছায়াসঙ্গী।

তবে ইন্টারপোলের সেই লোক দুটোকে দালি ছেড়ে দেয়নি। পরে তেল আভিভ-এ ওই দু’জনকেই মেরেছিল দালি। শত্রুর শেষ যে রাখতে নেই তা ও জানে। তবে ইন্টারপোলের চিফের সন্ধি প্রস্তাব একরকম মেনেই নিয়েছে ও। কিন্তু সবই গন্ডগোল হয়ে যাবে যদি কিডো ভুল করে। কিডোকে খোলা পিস্তলের সামনে ঘাবড়ে যেতে দেখে ঠিক ভরসা পেল না দালি। মনে হল, কিডো কি তবে ঠিকমতো কাজটা করেনি? দালি চোয়াল শক্ত করে তাকাল ফ্রেডির দিকে, “আমায় তুমি মারতে চাও?”

ফ্রেডি গেলাসটা ঠোঁটের কাছে নিল। হেসে, চোখ টিপে বলল, “এনি ডাউট?” তারপর পিট আর মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, “লেটস ফিনিশ দিস ড্রিঙ্ক অ্যান্ড দেন ফিনিশ দেম। চিয়ার্স।”

“চিয়ার্স!” বলে দালির চোখের সামনে তিনজনে একসঙ্গে গেলাস উপুড় করল গলায়। শেষ। দালি জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল। গুলির শব্দ কি আসবে এবার? নাকি…

ধপ, ধপ, ধপ। পরপর তিনটে ভোঁতা শব্দ হল একসঙ্গে। পিস্তলে সাইলেন্সর লাগানো ছিল কি? তবে কি ফ্রেডি কিডোকে মারল প্রথমে? চট করে চোখ খুলল দালি। আর সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে গেল নিমেষের জন্য। ফ্রেডি, পিট আর মুসা পড়ে আছে ছেঁড়া পুতুলের মতো। চোখ স্থির! মুখ খোলা! সাড় নেই শরীরে। দেখলেই বোঝা যায়, তারা মৃত।

দালি হাসল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে কিডোকে বলল, “গুড জব ব্রো। এবার স্কুটারটা বের করো।”

কিডো হাসল একমুখ। পিঠের ব্যাগটা সামলে নিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তারপর দৌড়ে গেল দরজার দিকে।

চারদিন আগে। দালির আস্তানায়।

“তোমার ভয় লাগছে না তো কিডো?” দালি জিজ্ঞেস করল।

“না তো,” কিডো হাসল।

দালি দেখল ওকে। কত বয়স হবে ছেলেটার? বড়জোর একুশ বা বাইশ! রোগা, বেঁটে। দেখতেও খুব সাধারণ। কিন্তু মনটা খুব ভাল। না হলে কেউ নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে? দালি ফের জিজ্ঞেস করল, “ভেবে দ্যাখো, আমার সঙ্গে কাজ করলে কিন্তু খুব সমস্যায় পড়তে হতে পারে। জীবনও বিপন্ন হবে। ভাল করে আর-একবার ভেবে নাও।” কিডো হাত নাড়িয়ে যেন মাছি তাড়াল, “ধুর, এসব নিয়ে আমি ভাবি না। তুমি যা করতে বললে আমি ঠিক করতে পারব দেখে নিয়ো। শুধু সায়ানাইডটা ঠিক কাজ করবে তো? মানে শ্যাম্পেনের কর্কের ভিতর দিয়ে ওটাকে ইনজেক্ট তো করে দেব তরলে, কিন্তু ভেজাল হয় যদি? যদি খেয়ে না মরে?”

কিডোর বলার ভঙ্গি দেখে হাসি পেল দালির। সত্যিই বাচ্চা ছেলে! দালি বলল, “সেসব তুমি ভেবো না। তুমি মিশিয়ে রেখো, আর যখন বলব বের করে দেবে। আর হ্যাঁ, একটা স্কুটার লুকিয়ে রেখো আশপাশে। কাজে আসবে।”

কিডো মাথা নাড়ল। বলল, “আমার কেমন যেন এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে!”

দালি হাসল, নরম গলায় বলল, “আসল সময়ের জন্য জমিয়ে রাখো ওটা। কাজে দেবে। কেমন?”

কিডোর কথা

স্কুটারটা একটা ভাঙা শেডের ভিতরে প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা ছিল। সেটা বের করে এনে সামনে রাখল কিডো। জায়গাটা শহর থেকে একটু দূরে আর খুবই নির্জন। তবু তাড়াতাড়ি করতে হবে। কিডো জানে নষ্ট করার মতো সময় ওর হাতে নেই। দালি ওয়্যার হাউসটা থেকে বেরিয়ে এল। কিডো দেখল ওর হাতে ওই ব্যাগটা। দালিকে দেখলে কখনওই মনে হয় না যে, ও এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে! শান্ত ভদ্র দেখতে মানুষটা! কিন্তু দালি কোন ধাতুতে গড়া সেটা কিডো জানে।

দালি কাছে এসে বলল, “আর সময় নষ্ট করব না। ব্যাগটাকে চিফের কথামতো আসল জায়গায় পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে পড়ব। কখন কে এসে যাবে কে জানে!”

“এক মিনিট,” কিডো হাত তুলল, “আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, ফ্রেডি আমাদের মারার মতো ভুল করতে যাচ্ছিল কেন? ও তো তোমার সঙ্গে এমন করার রিস্কটা না-ই নিতে পারত। হিরে তো পেয়েই গিয়েছিল। তবে?”

দালি হেসে কিডোর মাথার চুলটা ঘেঁটে দিল, “বোকা ছেলে। আরে, ও হিরে চুরি করেছিল কি বিক্রি করার জন্য নাকি? আর হিরেটাতে তো আমাদেরও শেয়ার ছিল! আমাদের শেয়ারটা দিতে চায়নি ও। এটা ব্লাড ডায়মন্ড। যদিও লিগ্যাল করে নেওয়া হয়েছিল কারচুপি করে। আর অনেক টাকার ইনশিয়োরেন্স করা ছিল এই হিরেগুলোর। ইনশিয়োরেন্সের টাকাটা কোম্পানিকে পাইয়ে দেওয়া আর হিরেগুলো নিয়ে কোম্পানির শ্যাডো ফান্ডে ফেরত দেওয়া… এই দুটো কাজ করতে চেয়েছিল ফ্রেডি। কোম্পানির কাছে টাকাও এল আবার হিরেটাও ফেরত পেয়ে গেল। ফ্রেডির প্রোমোশন কে আটকায়? আমাদের মারার পর ও পিট আর মুসাকেও মারত। কিন্তু ও বুঝতে পারেনি যে, দালিকে ওর দলে নেওয়া ঠিক হয়নি। একদম ঠিক হয়নি। তার উপর আমার শ্যাম্পেনটা খাওয়াও ওর মস্ত বড় ভুল হয়েছে। এই লাইনে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। বিশ্বাস মানেই এখানে মৃত্যু।”

কিডো হেসে ব্যাগ থেকে অরেঞ্জ জুসের বোতলটা বের করল। দালির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও অনেক চাপ গিয়েছে। এবার তোমার ড্রিঙ্কসটা খেয়ে, চলো, এই জায়গাটা ছেড়ে চলে যাই। কেউ যদি এসে পড়ে!”

দালি হেসে বোতলটা নিল। ঢাকনার প্যাঁচ খুলে বলল, “ডোন্ট ওরি, কেউ আসবে না। এটা গড ফরসেকেন প্লেস। তুমি স্কুটারটায় স্টার্ট দাও।”

কিডো পকেট থেকে চাবি বের করে স্কুটারের ইগনিশনে ঢুকিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে দেখল দালি গলায় ঢালল জুসটা। লম্বা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করল কিডো।

ধপ।

কিডো পিছনে ফিরল এবার। আকাশের দিকে স্থির চোখ করে মাটিতে পড়ে রয়েছে দালির নিথর দেহ। হাতের জুসের বোতলটা কাত হয়ে সায়ানাইড মেশানো জুস কমলা নদীর মতো বয়ে যাচ্ছে মাটিতে।

কিডো মাথা নাড়ল। মৃত্যু ভাল লাগে না ওর। কিন্তু উপায়ও নেই। দালির মতো মানুষকে বাঁচতে দেওয়া যায় না। অনেক কষ্ট করে এক বছর আগে দালির বিশ্বাস অর্জন করেছিল ও। কারণ দালিকে সরাতে হলে দালির ছায়া না হলে যে হবে না, সেটা ও বুঝেছিল।

বিশ্বাস! বিশ্বাস মানেই এখানেই মৃত্যু। দালি কেন যে এত বিশ্বাস করত কিডোকে! দালি বুঝতেই পারেনি যে, হিরে লুঠের সময় গাড়ির ভিতরে যে অরেঞ্জ জুসের বোতলটা বের করেছিল কিডো, ঠিক সেরকম আর একটা বোতলও ও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। শুধু পার্থক্য বলতে দ্বিতীয় বোতলটায় ছিল মৃত্যু!

কিডো দালির পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল। তারপর একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল।

ঘটনার দিন। চিফের ঘর।

ফোনটা বন্ধ করে হাসলেন চিফ। স্যামুয়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজ আর চা নয়। ব্রিং মি সাম ওয়াইন। উই শুড সেলিব্রেট।”

“মানে?” স্যামুয়েল থতমত খেয়ে গেল একটু। চিফকে এমন মুডে দেখা যায় না খুব-একটা। চিফ চা ছাড়া বিশেষ কিছুই খান না। আর আজ সেখানে ওয়াইন?

“মানেটা বুঝতে পারছ না? ওই ব্লাড ডায়মন্ডগুলো আসছে এবার আমাদের হাতে। আমার ছেলেটি ভাল কাজ করেছে,” চিফ উঠে দাঁড়ালেন।

“ও,” স্যামুয়েল বিষণ্ণ মুখে তাকাল চিফের দিকে, “দালি তা হলে ছাড়াই পেয়ে যাবে একরকম? আমাদের লোককে মেরেও পার পেয়ে যাবে? কয়েকটা হিরের বিনিময়ে ওর মতো এমন এক ক্রিমিন্যাল পার পেয়ে যাবে?”

চিফ এবার সোজা তাকালেন স্যামুয়েলের দিকে, “তোমায় কি আমি বেশি মাথায় তুলে ফেলেছি?”

স্যামুয়েল থমকে গেল, “সরি স্যার। কিন্তু যা মনে হল…”

“আমাদের দু’জনকে দালি মেরেছে, সেটা আমি ভুলে গিয়েছি কে বলল তোমায়? আমার ছেলেদের কেউ মারবে আর তাকে আমি ছেড়ে দেব?”

“মানে?” স্যামুয়েল থতমত খেয়ে গেল।

“দালি ইজ় ডেড। আর হিরেও চলে এসেছে হাতে। আমি আর-একজন ছেলে ফিট করেছিলাম ওর সঙ্গে। একবছর আগে ওকে দালির কাছে প্ল্যান্ট করেছিলাম আমি। একটা ফেক অ্যাটাক করা হয়েছিল দালিকে। আর সেটার থেকে ওই ছেলেটাই বাঁচিয়েছিল দালিকে। দালি ওকে বিশ্বাস করত খুব। আর সেই সুযোগ নিয়ে ও-ই দালিকে সরিয়ে দিয়েছে,” চিফ স্যামুয়েলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

“আর-একজন? এটা তো জানতাম না স্যার,” স্যামুয়েল অবাক হল।

“হাতি দেখেছ, সত্যিকারের হাতি? দেখলে জানতে ওদের দেখানোর দাঁত একরকম, কিন্তু খাওয়ার দাঁত অন্যরকম। আমায় যারা হাতি বলে তারা কিন্তু শুধু আমার এই শরীরের জন্য বলে না। সিনিয়র লোকজন আসলে হাতির গল্পটা জানে। তাই আমায় এমন নাম দিয়েছে। বুঝেছ?”

তারপর

স্কুটারটা একটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে পাশের ময়লা ফেলার জায়গায় চাবিটা ফেলে দিল কিডো। এটার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এটা ব্যবহার করা আর সেফ নয়। এবার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করবে ও। ওই শুনশান জায়গাটা থেকে শহরে আসতে প্রায় আধ ঘণ্টা মতো সময় লেগেছে কিডোর। ও ঘড়ি দেখল। চিফ, মিউজ়িয়ামের সামনে লোক পাঠাবেন ব্যাগটা তুলে নেওয়ার জন্য। আর দশ মিনিটের মতো সময় আছে।

কিডো দেখল সামনের বাসস্ট্যান্ডে একটা বাস এসে থামল। ওই দরজাটা খুলেছে। নম্বর দেখে বুঝল এটা মিউজ়িয়াম হয়েই যাবে। কপাল ভাল বাসটা ঠিক সময়ে এসে গিয়েছে। কিডো দৌড়ে গেল বাসটার দিকে। ড্রাইভার হাতল টেনে দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রায় কিন্তু তার ফাঁকেই রোগা পাতলা চেহারাটা নিয়ে দরজা গলে বাসে ঢুকে পড়ল ও। তারপর একদম পিছনে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল একটা হিসপানিক মেয়ের পাশে। তারপর একদম নিজের মনেই কিডো বলল, “ওঃ, খুবজোর পেয়ে গেলাম বাসটা, বাব্বা।”

পাশের হিসপানিক দেখতে মেয়েটা ভুরু কুঁচকে তাকাল কিডোর দিকে তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আপনি বাঙালি?”

কিডো চমকে উঠল, এখানেও বাঙালি! ও বলল, “আপনিও বাঙালি! আমি তো ভাবলাম হিসপানিক!”

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে বলল, “ওঃ, এমন হঠাৎ করে বিদেশে বাঙালিদের দেখলে যে কী ভাল লাগে! বাই দ্য ওয়ে, আমার নাম পারুল। পারুল রয়। এখানে এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছি। আপনি?

“কিডো,” ও হাসল।

পারুল বলল, “সে তো ডাকনাম। আপনার ভাল নাম কী?”

“ভাল নাম?” কিডো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসল সামান্য। তারপর নরম স্বরে বলল, “আমার নাম, সেন, অদম্য সেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *