বিস্ফোরণের একটু আগে

বিস্ফোরণের একটু আগে

ছাত্রছাত্রীদের ভিড় আর চিৎকার, হুল্লোড়-ভরা করিডর থেকে সে পাশের একটা নির্জন করিডরে ঢুকে গেল। এই করিডরটা অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। আজ তার পরনে একটা বিখ্যাত কুরিয়ার কোম্পানির পোশাক। কাঁধে তাদেরই ব্যাগ। আর ওই ব্যাগের মধ্যেই রাখা আছে সেই জিনিসটা। এই নির্জন করিডরের শেষ প্রান্তেই বায়োসেরামিক ল্যাব। আর ব্যাগের মধ্যের জিনিসটা প্রোফেসর সোমের জন্য। প্রোফেসর হৃদয়নাথ সোম। ডক্টরেট ইন বায়োসেরামিক রেডিয়েশন। দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন বায়োসেরামিক রেডিয়েশন দিয়ে কারসিনোজেনিক বা ক্যান্সারের গ্রোথ কীভাবে বন্ধ করা যায়। প্রোফেসর সোম এখন ক্লাস নিচ্ছেন তিনতলায়। দোতলায় তাঁর ল্যাব এখন ফাঁকা। চাবি দেওয়া। ক্লাসের পর তিনি এখানে আসবেন। সে জানে। তাই সে এইসময়েই এসেছে। কারণ, সে জানে এই সময় তাকে দেখে ফেলার এখানে কেউ থাকবে না।

সে গিয়ে দাঁড়াল ল্যাবের বন্ধ দরজার সামনে। পকেট থেকে বের করল ইঞ্চি ছয়েক লম্বা একটা খাঁজকাটা রড। রডটা সে তালার গর্তে ঢুকিয়ে আলতো করে চাপ দিল। খুট। তালা খুলে গেল। সহজ, ভীষণ সহজ এইসব কাজ। সে একবার নির্জন করিডরের দিকে তাকাল। না, কেউ নেই। সে ঢুকে পড়ল ল্যাবে। এই ল্যাব তার ভীষণ চেনা। বিভিন্ন সময় সে কখনও সাংবাদিক, কখনও ছাত্র সেজে প্রোফেসর সোমের থেকে জানার চেষ্টা করেছে বায়োসেরামিক অক্সাইড থেকে নির্গত ইফ্রারেড দিয়ে কীভাবে ক্যান্সার ঠেকানো যায়। না, সে পারেনি। পরে লুকিয়ে সে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে প্রোফেসরের ফর্মুলা। তাও সে পায়নি। তাই গেব্রিয়েল ফার্মাসিউটিক্যালের নির্দেশে আজ সে এসেছে এর শেষ দেখতে। প্রোফেসর সোমের টেবিলে গিয়ে সে ব্যাগ থেকে বের করল তার প্যাকেট। চৌকো, সুন্দরভাবে প্যাক করা একটা বাক্স। তার উপর রাখা একটা নতুন মোবাইল ফোন। বাক্স ও তার উপরে রাখা মোবাইল ফোনটা সে টেবিলে রাখল। ফোনটা বাক্সের উপর সেলোটেপ দিয়ে আটকানো ছিল। সে সাবধানে খুলে নিল সেলোটেপটা। তারপর বাক্সের নীচে এক জায়গায় ছোট্ট একটা বোতামে চাপ দিল। খুট শব্দ শুনে বুঝল গোটা সিস্টেমটা সক্রিয় হয়ে গিয়েছে। একে বলে সিস্টেম আর্মড। গোটা সিস্টেম এমনভাবে তৈরি, যাতে একবার আর্ম হয়ে গেলে একে ডিজ়আর্ম করা যাবে না অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় করা যাবে না।

সে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রোফেসরের ক্লাসের সময় দেখে নিল একবার। তারপর দ্রুত বেরিয়ে এল ল্যাব থেকে। খানিকটা হেঁটে সে পার করল কলেজ ক্যাম্পাস। একটু দূরেই স্ট্যান্ড করা আছে তার মোটরবাইক। আর মিনিটখানেক বাকি আছে প্রোফেসরের ক্লাস শেষ হতে। উপরের ক্লাস থেকে ল্যাবে আসতে তাঁর সময় লাগবে আরও মিনিট চারেক। তারপর বাক্সটার সামনে দাঁড়াতে তাঁর সময় লাগবে এক-দু’মিনিট। অর্থাৎ মোটামুটি সাত-আট মিনিট সময় আছে। সে তার বাইক স্টার্ট করল। পৌনে এক কিলোমিটার দূরত্বে গিয়ে সে পকেট থেকে নিজের মোবাইল বের করল। তারপর ডায়াল করল একটা নম্বর। সে মনে মনে দেখতে পেল একটা মোবাইল বাজছে বায়োসেরামিক ল্যাবে। আর অবাক হয়ে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন প্রোফেসর সোম। সে জানে, গিফ্ট প্যাক আর তার উপর রাখা মোবাইল ফোন দেখে প্রোফেসর অবাক হবেন। তার ফলে তিনি ফোনটা ধরবেনই। আর তিনি বাক্সের উপর রাখা ফোন তুললেই…

সে বিস্ফোরণটা শুনল এত দূর থেকেও। সে জানে, এই ল্যাব সমেত ক্যাম্পাসের নর্থ ব্লক এখন ‘আছে’ নয়, ‘ছিল’ হয়ে গেছে। সে অজান্তেই হেসে ফেলল। বুল্স আই। টার্গেট অ্যাচিভ্ড। বাক্সের ভিতরে ছিল দুটো ব্যাটারির সঙ্গে জোড়া একটা ডেটোনেটর, যা লাগানো থাকবে আর ডি এক্স-এর সঙ্গে। মোবাইল ফোনটা ছিল ট্রিগার। ফোন তুলতেই বাক্সের উপর চাপ কমে যাবে। এবং একটা বোতাম উঠে আসবে। ফলে ব্যাটারির পজিটিভ ও নেগেটিভ সংযুক্ত হবে, সার্কিট কমপ্লিট। বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পৌঁছোবে ডেটোনেটরে। একটি মৃদু বিস্ফোরণ আর তার তাপে ও চাপে প্রবলভাবে বার্স্ট করবে আর ডি এক্স। ভেঙে পড়বে নর্থ ব্লক। আবিষ্কার নিয়ে নিশ্চিন্তে পরপারে চলে যাবেন প্রোফেসর সোম। গেব্রিয়েল ফার্মাসিউটিক্যাল সেই স্বত্ব না পেলে আর কেউ পাবে না। সে ভাবল, প্রোফেসর সোম ফালতু সেন্টিমেন্ট বজায় রাখতে গিয়ে প্রাণটা খোয়ালেন!

কিন্তু আর কিছু করার নেই। সে অদ্ভুত এক তৃপ্তি বোধ করল। মিশন অ্যাকমপ্লিশড। হয়তো তার বয়স বাইশ বছর কিন্তু নৈপুণ্যে সে অসাধারণ। সে জানে, প্রোফেসর সোমের সঙ্গে অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছে। কিন্তু সে নিরুপায়। তার কাজ তাকে করতেই হবে। এর প্রাপ্য হিসেবে সে জানে, কাল সন্ধের মধ্যে বিদেশি এক ব্যাঙ্কে তার অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে পঁয়ত্রিশ হাজার মার্কিন ডলার। সে সবসময় ডলারে পেমেন্ট নেয়। কারণ ডলার অনেক অনেক ভারী টাকার চেয়ে।

“মাইক্রোবায়োলজির ক্লাস শুরু হওয়ার সাতদিন পর যে জয়েন করলাম। এতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ার কোনও আশঙ্কা নেই তো? মানে এমনিতেই মাস্টার ডিগ্রি, তার উপর সাতদিন লেট হয়ে গেল…”

আমাকে আর কথা শেষ করতে দিল না শুভ। নিজেই হ্যা হ্যা করে হেসে আমাকে থামিয়ে দিল। এই ইউনিভার্সিটিতে ভরতি হওয়ার পর যে ক’জনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, শুভব্রত দে, মানে শুভ তাদের একজন। শুভ বেশ হাসিখুশি, প্রাণখোলা টাইপ।

হাসি থামিয়ে শুভ বলল “শোন অমিত, অদম্য কী বলছে।”

অমিত দেবরায় গম্ভীর প্রকৃতির। একটু চুপচাপ থাকে। আর মেজাজটাও তার ট্যারাব্যাঁকা। স্বভাবতই ও কোনও উত্তর দিল না। মুখ দিয়ে হুঃ টাইপের একটা শব্দ বের করল শুধু।

শুভ বলল, “দূর, মাস্টার ডিগ্রিতে কোনও কিছুই কঠিন নয়। মন দিয়ে একটু ল্যাবে প্র্যাকটিক্যালটা করবি, ব্যস।”

আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বলতে পারলাম না। একটা মেয়ে দৌড়ে এল আমাদের সামনে। মেয়েটা বেশ, ফরসা চোখে চশমা কিন্তু দারুণ সুন্দরী। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফিগার। একদম বালি ঘড়ির মতো। ক্লাসে ক’দিন ওকে দেখেছি, মানে না দেখে উপায় ছিল না আর কী, কিন্তু আলাপ করার সাহস হয়নি। দমবন্ধ করা সুন্দরীর সামনে কথা বলা খুব মুশকিল।

মেয়েটা এসেই বলল, “তোদের মধ্যে কার ব্লাডগ্রুপ ও-নেগেটিভ বল। আমাদের ক্লাসের রেশমির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গেছে। রক্ত চাই।”

শুভ বলল, “অমিত, তোর তো ও-নেগেটিভ। চল, রক্ত দিবি চল।”

অমিত সামান্য মুখ বাঁকাল, “কে না কে, রক্ত দিচ্ছে! আমার রক্ত অত সস্তা নয়, ভাগ।”

মেয়েটা আবার বলল, “প্লিজ অমিত। লাইফ অ্যান্ড ডেথ ব্যাপার। ও-নেগেটিভ এমনিতেই খুব রেয়ার গ্রুপ। প্লিজ চল।”

অমিত গোঁজ হয়ে বসে রইল। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল ঋতম চট্টরাজ। শুনেছি একজন ভাল ফুটবলার। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে এই ক’দিনেই যথেষ্ট নাম করেছে নিজের রগচটা মেজাজের জন্য। ঋতম যেখানে সেখানে ঝামেলা বাধিয়ে দেয়। অমিত চুপ করে আছে দেখে ও লাফিয়ে উঠে অমিতের কলার চেপে ধরল, “এই জানোয়ার, তিন চড় খাবি, চল।”

অমিত আরও তেরিয়া হয়ে উঠল। একটা ঝামেলা যখন পাকিয়ে উঠেছে ঠিক তখনই আমি বললাম, “আমারও ও-নেগেটিভ রক্ত। চল।”

ঋতম অমিতকে ছেড়ে আমার দিকে ঘুরে বলল, “এতক্ষণ ঘাপটি মেরে বসেছিলি কেন? চল।”

রক্ত দিয়ে ফেরার পথে মেয়েটা আমার সঙ্গে এল। মেয়েটার নাম লিরিল রায়। ও আমাকে বলল, “যদিও তোর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ, কিন্তু ওইসব তুমিফুমির ন্যাকামো আমি করতে পারব না। বাই দ্য ওয়ে, তোর নামটা অদ্ভুত! অদম্য সেন! তবে উচ্চারণ করা মুশকিল। আজ থেকে তুই অ্যাডাম। কেমন?”

আমি আর কী বলব? বশ্যতা স্বীকার করে নিলাম। তবে ভাবলাম, বলি যে, লিরিল নামটাও খুব কমন কিছু নয়। কিন্তু বলতে পারলাম না। জিভ কেমন বিট্রে করতে শুরু করল।

সেইদিনের পর থেকে আমাদের, মানে আমি, লিরিল, শুভ আর ঋতম একটা গ্রুপ হয়ে গেলাম যেন। অমিত আমাদের মধ্যে থাকে না। থাকলেও লিরিলের দিকেই একটু ট্যান খাওয়া যেন। আর কথায় কথায় আমাকেও একটু খোঁচা দেয়। বুঝি লিরিলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যেন সহ্য করতে পারছে না। একদিন লিরিলের একটা জ্যাকেট দেখে বলেছি, ভাল। ব্যস, অমিত খচে লাল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, “জ্যাকেটটা ভাল, না তার নীচের জিনিসগুলো?”

আমি থতমত খেয়ে চুপ করে গেলাম। এই অমিতটুকু বাদ দিলে আর সব ভাল। আর সব ভাল চলছিলও। হঠাৎ সপ্তাহ তিনেকের মাথায় একটা ছোট্ট গন্ডগোল হয়ে গেল। সন্ধেবেলা হস্টেলে ফিরছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা চাপা হল্লা শুনে ফুটবল মাঠের পাশে দেবদারু গাছের তলায় একটা জটলার দিকে আমরা এগিয়ে গেলাম। দুটো ছেলে। সম্পূর্ণ নগ্ন। আর তাদের কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সুস্মিত, প্রকাশরা। বুঝলাম, ছেলে দুটো ফার্স্ট ইয়ার ফিজিক্স অনার্সের। সিনিয়ার হওয়ার জন্য প্রকাশরা ওদের র‍্যাগিং করছে। রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সগুলোতে এই এক সমস্যা।

আমরা কিছু বোঝার আগেই ঋতম চিৎকার করে উঠল, “প্রকাশ, ওদের ছেড়ে দে।”

প্রকাশ তাচ্ছিল্য করে বলল, “যা ভাগ। নিজের গোয়ালে ধোঁয়া দে।”

ঋতম আর কথা বলল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর। আধো অন্ধকারে দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। আমরা গিয়ে ঋতমকে ছাড়িয়ে আনতে আনতে দেখলাম, প্রকাশ আর সুস্মিত ঘাসে শুয়ে। ঋতমের নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের ছেলে দুটো এই সুযোগে ভেগেছে। ফেরার সময় শুনলাম সুস্মিত চিৎকার করছে, “এই মাইক্রোবের বাচ্চাগুলোকে একদিন এমন ঝাড় দেব…”

ঋতম কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমরা ওকে টেনে নিয়ে গেলাম। মাইক্রোবায়োলজির ব্লকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, এই সন্ধের সময়ও দোতলার ল্যাবে আলো জ্বলছে। আমি লিরিলকে জিজ্ঞেস করলাম, “কে আছে রে ওখানে এখন?”

লিরিল বলল, “স্যার আছেন। মানে প্রোফেসর রমানাথ দে। কীসব রিসার্চের কাজ করছেন।”

“কীসব রিসার্চ নয়, অত্যন্ত মূল্যবান রিসার্চ।” মুখ ফিরিয়ে দেখলাম একদম অন্যরকম গলায় শুভ আমাদের কথাগুলো বলছে। আর একদৃষ্টে ও তাকিয়ে আছে ল্যাবের দিকে। আধো আলোয় ওর চোখ দুটো অন্যরকম লাগল। এই শুভকে আমরা চিনি না।

“হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। সংক্ষেপে এইচ আই ভি। অর্থাৎ যে ভাইরাস এড্স রোগের কারক। এড্স-এর পুরো নাম হল অ্যাকোয়ার্ড ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম। এই এইচ আই ভি ভাইরাসটা মানুষের শরীরে ঢুকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। ফলে মানুষ খুবই সামান্য রোগে মারা যেতে পারে। সারা পৃথিবীতে এই রোগটার মতো বিভীষিকা আর কোনও রোগ নয়। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরি করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু কেউই বিশেষ সাফল্য লাভ করেননি।”

সামনের সারি থেকে একজন উঠে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, কীরকম ওষুধ বা ভ্যাকসিন তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে?”

প্রোফেসর রমানাথ দে বিরাট হলঘরের ডান দিকে তাকালেন। একটা মেয়ে প্রশ্নটা রেখেছে। তিনি ভাবলেন, কীভাবে এদের বলবেন কী কী ওষুধের বা ভ্যাকসিনের কথা ভাবা হচ্ছে। কোন কোন গ্রুপের উপর কাজ চলছে। সবই যে অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এই দশ-এগারো ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কীভাবে বোঝাবেন সব? এই স্কুলে তাঁকে আসতে হয়েছে নেহাত ভদ্রতাবশত। এড্স সচেতনতার উপর বক্তৃতা করতে। তাঁর ইউনিভার্সিটির এক প্রাক্তন ছাত্র এই স্কুলের টিচার। তাকে না বলতে পারেননি তিনি। তাই বাধ্য হয়ে এসেছেন। যদিও তাঁর হাতে সময় কম। অত্যন্ত কম। তাঁর গবেষণা প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পড়েছে। আর কয়েকটা দিন মাত্র, কয়েকটা দিন।

হলের মৃদু গুঞ্জনে তাঁর সংবিত্ ফিরল। তিনি আবার শুরু করলেন, “দ্যাখো, অনেকভাবে ওষুধ বের করার চেষ্টা চলছে। তবে সব তো আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমি দু’-একটা সংক্ষেপে, সহজ করে বলার চেষ্টা করছি। এইচ আই ভি প্রথমে শরীরে ঢুকে আক্রমণ করে ‘হেল্পার টি সেল’-কে। একে CD4+T সেলও বলা হয়। CD4+T সেল হল রক্তের এক ধরনের শ্বেত কণিকা, যা অন্যান্য শ্বেত কণিকাকে বিশেষ কেমিকাল সিগনাল পাঠায় তাদের নিজের নিজের কাজ করার জন্য। এখন এইচ আই ভি এই CD4+T সেলকে আক্রমণ করে তার গায়ে, অর্থাৎ কোষপ্রাচীরে আটকে যায়। তারপর এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় CD4+T এর কোষপ্রাচীর ভেদ করে এইচ আই ভি ঢুকে যায় কোষের ভিতরে। এর পর শুরু হয় ধ্বংসের পালা। এখন যদি এই কোষপ্রাচীর ভেদ করাটা আটকানো যায়, তবে একটা সমাধান বেরোতে পারে।”

প্রফেসর দে একটু থামলেন। দেখলেন, সারা হল চুপ করে আছে। তিনি বুঝলেন, সবাই ক্রমশ ইন্টারেস্ট পাচ্ছে। তিনি আবার শুরু করলেন, “কোষে ঢোকার পর সময়মতো ভাইরাসটা সক্রিয় হয়। এইচ আই ভি একটা রেট্রোভাইরাস অর্থাৎ আর এন এ ভাইরাস। আর এন এ হল রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। কিন্তু নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে দরকার ডি এন এ বা ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড। এখন এইচ আই ভি রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ এনজাইমের সাহায্যে নিজের আর এন এ-কে ডি এন এ-তে পরিণত করে। এই সময়েই অর্থাৎ এই পরিবর্তনের সময়েই বিভিন্ন স্ট্রেন বা বিভিন্ন জিন কম্বিনেশনের এইচ আই ভি তৈরি হয়। যার সব ক’টিকে ধ্বংস করা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বারা সম্ভব হয় না। এখন আর এন এ থেকে ডি এন এ-তে পরিণত হওয়া আটকানো গেলেও এই রোগের প্রতিরোধ সম্ভব।”

প্রোফেসর দে থামলেন। পাশ থেকে গ্লাস তুললেন জল খাওয়ার জন্য। ঠিক এই সময়ই ছাত্রছাত্রীদের গার্ডিয়ানদের মাঝখান থেকে উঠে গেলেন বছর পঞ্চাশেকের এক মানুষ। তিনি লম্বা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পরনে ছাই রঙের সুট। তিনি আর প্রোফেসর দে-র কথা শুনলেন না। কারণ, আর দরকার নেই। তিনি জানেন প্রোফেসর দে বড়জোর মিনিটপাঁচেক বলবেন আর। তিনি হলের বাইরে এসে হেঁটে গেলেন তাঁর কালো মার্সিডিজ় বেঞ্জ গাড়িটার দিকে। বারো মিনিটের মাথায় তিনি দেখলেন প্রোফেসর দে হল থেকে বেরিয়ে তাঁর স্যান্ট্রো গাড়িটার দিকে যাচ্ছেন। তিনি দ্রুতপায়ে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

“হ্যালো স্যার।” তিনি মৃদু হেসে হাত বাড়ালেন প্রোফেসর দে-র দিকে। বললেন, “আমি রাজীব আহুজা। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, গেব্রিয়েল ফার্মাসিউটিক্যাল।”

প্রোফেসর দে থমকালেন। একটু বিভ্রান্তও হলেন যেন। তারপর সামান্য রুক্ষভাবে বললেন, “আপনাদের তো বলেই দিয়েছি আপনাদের সঙ্গে আমি কাজ করব না।”

রাজীব আহুজা এবারও মৃদু হাসলেন। বললেন, “আমি জানি রোসিক্রুশিয়ান হেল্থকেয়ার আপনাকে মাসিক আট হাজার ডলার আর আপনার ড্রাগ রয়্যালটি হিসেবে টুয়েল্ভ পারসেন্ট দেবে। দেখুন প্রোফেসর দে, আমরা আপনাকে দেব ফিফ্টিন থাউজ্যান্ড ডলার আর টুয়েন্টি পারসেন্ট যা ওষুধ বিক্রি হবে তার উপর।”

প্রোফেসর দে হাত তুলে বললেন, “স্টপ ইট মিস্টার আহুজা। টাকাটা ব্যাপার নয়। আপনাদের সঙ্গে কাজ করব না, কারণ আপনারা আমার এইচ আই ভি প্রোটেক্টেড ওষুধটা ঠিকমতো পরীক্ষার আগেই বাজারে ছাড়তে চান। জানি না কীভাবে আপনারা এফ ডি এ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ড্রাগ রিভিউ বোর্ডকে ম্যানেজ করবেন। কিন্তু না, এটা ছোট প্রাণীদের উপর পরীক্ষা না করে আমি মানুষের উপর পরীক্ষা করব না। সম্ভব নয়।”

“কিন্তু ততক্ষণে প্রচুর দেরি হয়ে যাবে। এই রোগে কত মানুষ মারা যাবে ভাবুন তো।” রাজীব আহুজা এবার একটু উত্তেজিত হলেন।

“আর ওষুধটা যদি ফেল করে তবে তার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যাবে। প্লিজ, আপনারা মানুষের প্রাণ নিয়ে ব্যাবসা করবেন না। আমার ওষুধটা প্রথমে সাব-হিউম্যান অ্যানিম্যালের উপর পরীক্ষা হবে। তারপর হিউম্যান মডেলদের উপর প্রয়োগ করা হবে। আই অ্যাম সরি, আপনারা তা করতে যেহেতু রাজি নন, সেহেতু আমায় ক্ষমা করুন। পরীক্ষা করার আগে ওষুধ আমি বাজারে ছাড়তে পারব না। আমি আসি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

রাজীব আহুজা একটু দম ধরলেন। তারপর হিসহিসে গলায় বললেন, “আপনি তো ব্রাউন চামড়ায় মোড়া ডায়েরিতেই সব লিখে রাখেন না? আপনার টেবিলের ডানদিকের ড্রয়ারেই তো ওটা থাকে।”

গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে থমকালেন প্রোফেসর দে। তারপর হাসলেন, বললেন, “বাঃ, আপনাদের হোমওয়ার্ক তো খুব ভাল। কিন্তু আমার ওষুধের ফর্মুলা হাত করবেন তো? পারবেন না। চ্যালেঞ্জ। সবার চোখের সামনেই আছে, তবুও পাবেন না। বেস্ট অব লাক।”

রাজীব আহুজা দাঁড়িয়ে দেখলেন স্কুল ক্যাম্পাস থেকে সাদা স্যান্ট্রোটা বেরিয়ে গেল। তিনি খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর পকেট থেকে বের করলেন ডিম্বাকৃতি মোবাইল ফোন। ডায়াল করার পর চারটে রিং হল। ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠস্বর উত্তর দিল। রাজীব আহুজা কথা বলতে শুরু করলেন।

মোবাইল ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে অমিত বলল, “তোরা যা, আমি একটু আসছি।”

আমরা নিজেদের হস্টেলের দিকে ফিরতে লাগলাম। হঠাৎ লিরিল, শুভ আর ঋতমকে বলল, “তোরা একটু এগো। আমার অ্যাডামের সঙ্গে কিছু কথা আছে।”

ঋতম যাওয়ার আগে ফিক করে হেসে বলে গেল, “অ্যাডাম কিছু কথা বলিস, বেশি কিছু কথা বলিস না যেন!”

ওরা চলে যেতেই লিরিল বলল, “এই জ্যাকেটটা তোর, নে।”

দেখি সাইড ব্যাগ থেকে একটা প্লাসটিকের প্যাকেট বের করেছে লিরিল। জ্যাকেটটা দু’হাতে মেলে ধরে বলল, “সেদিন বলেছিলি, এটা ভাল লাগছে, তাই তোকে এনে দিলাম।”

দেখলাম হালকা নীল রঙের হাতকাটা একটা জ্যাকেট। তার বুকের কাছে চে গুয়েভারার ছবি। আসলে এই জ্যাকেটটা সুন্দর বলেই অমিতের কাছ থেকে গালাগাল খেয়েছিলাম। কী আশ্চর্য, একেবারে এনেই দিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “দাম কত?”

“ডোন্ট বি আ বোর। বেশি টাকা দেখাবি না। এটা গিফ্‌ট।” লিরিল এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল।

“বা রে, দাম নিবি না? গিফ্‌ট? তোকে কী দিই তবে বল?” আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম। লিরিল ফিক করে হেসে বলল, “ঠিক সময়ে আমি চেয়ে নেব।” ওর চোখ থেকে যে সংকেতটা পৌঁছোল তা হাজার হাজার বছর ধরে একই রকম আছে। স্বভাবতই সংকেতটা আমায় একটু লাল করল, আবার আনন্দও দিল।

কিন্তু আনন্দটা দু’-চারদিন পরে কিছুটা ফিকে হয়ে এল। বিকেলে আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম কাফেটেরিয়াতে। এমনিই এদিক-সেদিক কথা হচ্ছিল। হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই কোত্থেকে অমিত এসে উদয় হল। এসেই সটান লিরিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমার সেদিনের কথার উত্তর দিলি না তো!”

লিরিলের মুখ-চোখ দেখে বুঝলাম ব্যাপারটা সহজ নয়। তবু লিরিল স্মার্টলি বলল, “অমিত, দ্যাখ, ওসব প্রেম ট্রেম মাথা থেকে বের করে দে। তোর আমাকে ভাল লাগতেই পারে। কিন্তু আমারও তোকে ভাল লাগতে হবে তার তো কোনও মানে নেই। আর এসব প্রেম ট্রেম ফালতু। মানুষকে বেঁধে রাখে, সেন্টিমেন্টাল করে তোলে, এগোতে দেয় না। ওসব মাথা থেকে বাদ দে।”

অমিত ফোঁস করে উঠল, “এখন তো ওসব বলবিই। আমি জানি না ভেবেছিস কার দিকে তুই ট্যান খাচ্ছিস।” বলেই আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে যেভাবে হঠাৎ এসেছিল, সেভাবেই হঠাৎ কাফে থেকে বেরিয়ে গেল। ঋতম বলল, “পাগল নাম্বার টু।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নাম্বার ওয়ান কে? তুই?”

ঋতম পালটা উত্তর দিল, “কেন, প্রেফেসর দে। মাইরি লোকটা সারাদিন ল্যাবে কী করে বল তো? মাথার তার কাটা না হলে একগাদা যন্ত্রের মধ্যে সবসময় মাথা গুঁজে থাকে। এ ছাড়াও একটা ঘটনা ঘটেছে। সেদিন ল্যাবে দরকার ছিল। লিখতে গিয়ে দেখি আমার পেনে কালি নেই। দেখলাম, স্যারের টেবিলে একটা শেফার্স পেন আর একটা মোটা কালো পেন। শেফার্সটা দামি, তাই ওই কালো পেনটা নিয়ে লিখতে গেছি। ওমা, স্যার কী বকলেন। আমি কেন ওই পেনটা নিয়েছি, কেন শেফার্স দিয়ে লিখিনি। বোঝো! পরে লুকিয়ে দেখি কী, ওই কালো পেনটা দিয়ে কী সব জল জল বেরোয়। ওতে কালিটালি কিচ্ছু নেই। বোঝো তবে। ওই পেনের জন্য কী ঝামেলা! সত্যিই প্রোফেসর দে’র মাথার স্ক্রুগুলো না সব খুলে পড়ে গেছে।”

এতক্ষণ চুপ করে থাকা শুভ হঠাৎ ফোঁস করে বলল, “তুই পেন ধরেছিস কেন? পেন না নিয়ে তুই ল্যাব করতে গিয়েছিস কেন? আর কালো পেনটা হয়তো রিসার্চের দরকারি কোনও পেন। রিসার্চের তুই কিছু বুঝিস, গাধা?”

“কালি ছাড়া পেন দিয়ে রিসার্চ? তুই বোকা না লিভার দিয়ে চিন্তা করিস? আর তোর গায়ে ফোসকা পড়ছে কেন? শুভ, আমি লক্ষ করেছি, সময় পেলেই তুই ল্যাবের কাছে ঘুরঘুর করিস। কেন বল তো?” ঋতম চোখ পাকিয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে থাকল। শুভও হঠাৎ গুটিয়ে গেল যেন।

সেদিনের ঝামেলাটা এড়ানো গেলেও পরের দিনের ঝামেলাটা আর এড়ানো গেল না। আর সেটা এল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে।

সন্ধেবেলায় তিন তলার কমনরুম থেকে আমি আর ঋতম ফিরছিলাম। দোতলায় মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পাশের করিডরে একটা ঝাপটা-ঝাপটি শুনতে পেলাম। আমি আর ঋতম দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি, ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সুস্মিত লিরিলের হাত দুটো দেওয়ালে চেপে ধরে বলছে, “আজ তোমায় মেখে দেখব তুমি কেমন সাবান।” অন্যদিকে প্রকাশ মুখ চেপে ধরেছে লিরিলের। আর লিরিল দু’জনের থেকে নিজেকে ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

আমি কিছু বোঝার আগেই ঋতম প্রায় উড়ে গিয়ে লাথি মারল প্রকাশকে। আমিও দৌড়ে গেলাম সুস্মিতের দিকে। বেগতিক দেখে সুস্মিত সাবান মাখার ইচ্ছে ত্যাগ করে লিরিলকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দৌড় মারল। আমিও পা চালিয়েছিলাম, কিন্তু সুস্মিত ঠিক কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। মাটিতে পড়ে থাকা প্রকাশকে আরও দু’-চারটে লাথি মেরে ঋতম ওর কলার ধরে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় বলল, “অ্যাডাম, টেক কেয়ার অব লিরিল। আমি এই জানোয়ারটাকে নিউটনের থার্ড ল-টা বুঝিয়ে আসছি।”

লিরিল মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছিল। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় লেগেছে?”

লিরিল হাত দিয়ে কোমর দেখাল। আমি হাত ধরে ওকে তুললাম। দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে ও আমার দিকে তাকাল। করিডরের হলুদ আলোয় সব কেমন আরও বেশি করে নির্জন লাগছিল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কোমরে খুব লেগেছে?”

লিরিল এখন আর হাঁপাচ্ছে না। হঠাৎ ও আমার দিকে পিছন ফিরে কোমর থেকে গেঞ্জিটা তুলে বলল, “অ্যাডাম, দ্যাখ তো, কোমরটা ঠিক আছে কিনা।”

এই ঘোলাটে আলোতেও বালিঘড়ির মতো কোমরের খাঁজ দেখা গেল। ফরসা আর মসৃণ। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম, এই ফরসা কোমরে সবুজ লতাপাতার মধ্যে একটা লাল আপেল আঁকা, ট্যাটু। আজকাল মেয়েরা অনেকেই কোমরের ঠিক উপরে বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকায়। লিরিলের কোমরেও ওরকম ছবি আঁকা।

লিরিল ফিসফিস করে বলল, “অ্যাডাম, টাচ ইট। এটা তোর। শুধুমাত্র তোর।”

আমার সব কেমন গুলিয়ে গেল। বুঝলাম, এটা ঠিক নয়। কিন্তু আমার হাত যেন আমার কথা শুনছে না। আমার কাঁপা আঙুল যখন নিষিদ্ধ ফলটা প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে, তখনই কে জানি চিৎকার করে উঠল, “অ্যাডাম, ইউ স্কাউন্ড্রেল।” দেখি করিডরের যেদিকে মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, সেখানে অমিত দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আজ প্রোফেসর দে নেই, তা হলে অমিত এই সন্ধ্যায় ল্যাবের সামনে কী করছে।”

স্টাইলাস ফেল্ট মার্কার পেন। অ্যালকোহল বেস্ড এই কালি হল ফ্লুরোসেন্ট কালি। খালি চোখে দেখা যায় না। গভীর নীলচে আলো বা যাকে ব্ল্যাক লাইট বলে, তার তলায় একমাত্র এই কালি দৃশ্যমান হয়। সাধারণত মিউজিয়ামে, ম্যাজিক শো-তে বা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে এই ধরনের পেন ব্যবহার করা হয়।

সে জানে প্রোফেসর এই কালি ব্যবহার করেছেন। প্রোফেসর সবসময় কালো মোটা এই মার্কার পেন ব্যবহার করেন। সাধারণ লোক কিচ্ছু বুঝতে পারে না। সে এও জানে যে, কোনও ডায়েরি বা কাগজপত্রে নয়, প্রোফেসর ফর্মুলাটা লিখে রেখেছেন ল্যাবেরই জিনিসের গায়ে। কিন্তু কোথায় লিখে রেখেছেন তিনি? সে সহজেই ল্যাবের তালা খুলে ফেলল। আজই তার সুযোগ। আজ প্রোফেসর দে রাত্রে তাঁর ল্যাবে কাজ করছেন না।

সে তার ছোট ব্যাগ থেকে ব্ল্যাক লাইটটা বের করল। চারিদিকে খাতাপত্র, বিকার, বার্নার, বকযন্ত্র, ইকিউবিটার, আরও হাজারও রকম যন্ত্রপাতি। সে প্রথমেই মাটিতে লিখে রাখার সম্ভাবনা বাদ দিল। কারণ, সারাদিন এর উপর দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা হাঁটাহাঁটি করে। টেবিল চেয়ারগুলোও একই কারণে বাদ। এগুলোও ব্যবহার করা হয় রোজ। তবে কোথায়? সে ব্ল্যাক লাইট ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল তন্নতন্ন করে। না কোনও কাচের বিকার, না কোনও কাগজপত্র কোথাও কিচ্ছু নেই, যাতে গোপন লেখা ফুটে ওঠে। তবে কি তিনি নিজের বাড়িতে লিখে রেখেছেন কোথাও। না, তাও সম্ভব নয়। সে সব দেখে এসেছে। সেখানেও নেই।

ল্যাবের পাশেই আছে প্যান্ট্রিরুম বা খাবারদাবার রাখার ঘর। ল্যাব থেকে সেই ঘরে যাওয়ার একটা দরজা আছে। যদিও সেটা তালা দেওয়া। এই দরজার পাশে একটা অব্যবহৃত বেসিন আর তার উপরে ঝোলানো অর্ধেক পারা উঠে যাওয়া আয়না। সে গিয়ে দাঁড়াল সেখানে। ভাবল, তবে কি প্যান্ট্রির মধ্যেই প্রোফেসর কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন? কিন্তু তালাটা দেখে তো মনে হয় যে, ওটা বহুদিন খোলা হয়নি। আর প্যান্ট্রির আসল দরজা করিডরের অন্য প্রান্তে। তাই মনে হয় না তিনি প্যান্ট্রিতে কিছু লুকোবেন। অর্থাৎ এখানেই আছে। এই ল্যাবেই আছে। প্রোফেসর এখানে সারাদিন কাটান, ফলে চোখের সামনেই তিনি তাঁর দরকারি জিনিস রাখবেন। কিন্তু কোথায় সেটা?

হাতের ব্ল্যাক লাইটটা বেসিনে রেখে সে এগিয়ে গেল ঘরের আরেক কোনায়। আরে ওটা কী? সে থমকাল। ফিরে এল বেসিনের সামনে। ব্ল্যাক লাইটের আলো বেসিনের উপর ঝোলানো আয়নার নীচে অবধি পৌঁছোচ্ছে। আর সেখানেই ফুটে উঠেছে প্রচুর সংকেত। সে ধীরে ধীরে ব্ল্যাক লাইটটা তুলে ধরল আয়নার সামনে। পুরনো আয়না ভরতি ছোট ছোট হরফে অনেক সংকেত লেখা, যার মধ্যে বেশ কয়েকবার এইচ আই ভি শব্দটা সে দেখতে পেল। পাওয়া গেছে। সত্যিই সকলের চোখের সামনে ছিল। সে মুচকি হাসল। প্রোফেসর ভেবেছেন এটা সুরক্ষিত, কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, এ পৃথিবীতে কোনও কিছুই সুরক্ষিত নয়। সে দ্রুত পকেট থেকে মাইক্রোফিল্ম লোডেড ক্যামেরা বের করে ওই সমস্ত সংকেতের ছবি তুলতে শুরু করল।

রাজীব আহুজা সদ্য হাতে পাওয়া ছবির প্রিন্টগুলো কিছুক্ষণ আগে পাঠিয়েছেন তাঁদের চিফ কেমিস্টের কাছে। দেখে নেওয়া তো দরকার সব ঠিক আছে কিনা। তবে তিনি নিশ্চিত যে, তাঁর হাতেই আগামী পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কারের মশলা। তিনি ভাবলেন একটু মজা করা যাক। তিনি মোবাইলে ধরলেন প্রোফেসর দে-কে।

“গুডমর্নিং প্রোফেসর, ভাল আছেন তো?” আজ রাজীব আহুজার গলা দিয়ে প্রচুর আনন্দ ঝরে পড়ছে।

“হঠাৎ কী মনে করে?” প্রোফেসর দে জিজ্ঞেস করলেন।

রাজীব আহুজা কেটে কেটে বললেন, “আপনার ফর্মুলা আমার হাতের মুঠোয় প্রোফেসর। আমাদের আর আপনাকে দরকার হবে না।”

“ওই আয়নায় লেখা ফর্মুলা তো?” হো হো করে হেসে উঠলেন প্রোফেসর দে। তারপর বলেন, “ওটা দেখে কিচ্ছু বুঝবেন না। ওতে প্রচুর স্টেপ জাম্প আছে। অর্ধেক কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন ওতে লেখা নেই। ওটা বিষ ছাড়া সাপ বা বলতে পারেন অনেকটা আপনার মতো মগজহীন মানুষ। আসল ফর্মুলা সব আমার মাথায়, ওটা কিছুটা হিন্ট বলতে পারেন। যা একমাত্র আমিই বুঝব। আর কেউ নয়।” প্রোফেসর দে খিকখিক করে হাসতে লাগলেন।

রাজীব আহুজাকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। আর ঠিক সময় বেজে উঠল তাঁর টেবিলে রাখা ফোন। তিনি প্রোফেসরকে হোল্ড করতে বলে টেবিলের ফোনে সাড়া দিলেন। চিফ কেমিস্টের ফোন, কথাবার্তার শেষে তিনি আবার মোবাইল ধরলেন, “ইউ উইল পে দ্য প্রাইস ফর দিস।”

প্রোফেসর দে বললেন, “খবর পেয়েছেন তবে যে ফর্মুলাটা অসম্পূর্ণ। আর মূল্য দিতে হবে বলছেন? আপনাদের মতো লোকদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমি যে-কোনও মূল্য দিতে পারি।”

ফোনটা কেটে দিয়ে প্রোফেসর দে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। এমন সময় দরজার কাছে এক যুবককে দেখতে পেলেন তিনি। এই যুবককে দেখলেই তাঁর মন ভাল হয়ে যায়। বহু বছর পর এই যুবককে তিনি দেখলেন। শেষ যখন তাকে তিনি দেখেছিলেন, তখন এই যুবক নেহাতই বালক। এখন এই সংকটের মধ্যেও তিনি যুবককে দেখে হাসলেন এবং তাঁর চারদিকে ঘন হয়ে আসা অন্ধকারের মধ্যেও তিনি যেন আলো দেখতে পেলেন। এই একজন আছে, যাকে তিনি সব বলতে পারেন। তিনি মনস্থির করে নিলেন। যুবককে তিনি বসতে বললেন সামনের চেয়ারে।

চিফ কেমিস্টের কথাগুলো এখনও কানে বাজছে রাজীব আহুজার। এই ফর্মুলাগুলো দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কারণ, মূল কনভারশনগুলোই নেই। এখন কী করবেন তিনি? বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গেব্রিয়েলে না এলে প্রোফেসর দে রোশিক্রুশিয়ান হেল্থ কেয়ারেও জয়েন করতে পারবেন না। মানে, তাঁকে করতে দেওয়া হবে না।

রাজীব আহুজা কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন। তারপর তাঁর মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করলেন। ওপাশ থেকে সে ফোন তুলল। এবার তাকে দেওয়া হবে পঁচাত্তর হাজার মার্কিন ডলার। সে জানে এবারের কাজটা একটু বেশিই কঠিন। কারণ, যে সময়ে তাকে কাজটা করতে হবে তার আর মাত্র দু’দিন বাকি। অর্থাৎ সময় কম, খুবই কম।

কাল আমাদের এখানে ফাংশন আর আজ ফুটবল ম্যাচ। কাল অবশ্য আর-একটা অনুষ্ঠানও আছে। প্রোফেসর দে চলে যাচ্ছেন কোনও এক বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে। কাল ফাংশনের সঙ্গে তাঁর ফেয়ারওয়েল পার্টিও। ফাংশনের চিফগেস্ট হয়ে আসছেন এক মন্ত্রী। ফলে চারদিকে সাজ সাজ রব। আজ ফুটবল ম্যাচটা অবশ্য ইন্টার ডিপার্টমেন্ট খেলা। আমাদের সঙ্গে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের। টেন্টে আমি যখন ড্রেস করছি তখন দেখি ঋতম ঢুকছে। বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই ঋতমকে বললাম, “কী রে, কোথায় ছিলি? তাড়াতাড়ি ড্রেস কর।”

ঋতম ঘাড় নেড়ে ড্রেস করতে শুরু করল। ঋতম আমাদের স্ট্রাইকার। আর শুভ হল লেফ্ট ব্যাক। কিন্তু ও কোথায় কে জানে! আজকাল ক্লাসও তেমন অ্যাটেন্ড করছে না। আর গতকাল থেকে তো একদম বেপাত্তা। অমিতটারও সেম কেস। অবশ্য সেদিন আমাকে আর লিরিলকে করিডরে দেখে তো আমাকে এই মারে কি সেই মারে। শেষে লিরিল এসে যখন বলে যে, অমিত আমাদের মধ্যে কোনওভাবেই নেই, তখন মুখ গোঁজ করে চলে গিয়েছিল। অবশ্য তারপর আমার আর লিরিলের নামে যা তা রটিয়েছে। বলেছে, আমাদের মধ্যে নাকি খারাপ সম্পর্ক আছে। লিরিলকে সে কথা বলাতে ও বলেছে, “ভালই তো। আমাদের মধ্যে যে একটা সম্পর্ক আছে সেটা ভাল নয়?” কাকে কী বলব?

মাঠে নামার মুখে লিরিলের সঙ্গে দেখা। বলল, “আজ তোরা যে ক’টা গোল দিবি আমি তোকে সে ক’টা চুমু খাব। আর যে ক’টা গোল খাবি, তুই সে ক’টা চুমু আমায় খাবি।”

আমি হেসে বললাম, “যদি গোল-লেস ড্র হয়?”

“তবে তো আরও ভাল। দু’জনে দু’জনকে প্রচুর চুমু খাব।” লিরিল হেসে বলল। হাসলে মেয়েটার মুখে দুর্গাপুজোর মতো রোদ ওঠে যেন!

আর কী আশ্চর্য, ফার্স্ট হাফটা সত্যি শূন্য শূন্য রইল। মাঠ থেকে বেরোবার সময় ঋতম বলল, “মনে হচ্ছে লিরিলের ইচ্ছেই পূর্ণ হবে।”

আমি ঋতমকে ধাতানি দিলাম, “ফালতু কথা ছাড়, আমাদের জিততেই হবে।”

আর সেকেন্ড হাফটাও শুরু হল অন্যভাবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা কর্নার থেকে হেডে গোল করে আমাদের এগিয়ে দিল ঋতম। আর তার পরেই লাগল ঝামেলা। আমাদের একটা আক্রমণ আটকাতে ফিজিক্সের প্রকাশ লাথি মারল ঋতমকে। আর ঋতম পড়ে যেতেই প্রকাশ বুট দিয়ে মাড়িয়ে দিল ওর থাই। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ঋতম। আমরা সবাই ছুটে গেলাম। আমার পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রকাশ বলল, “মাইক্রোবের বাচ্চা, পা ভেঙে দেব।” আমি শুধু ওর দিকে ঘুরলাম, তারপর নিখুঁতভাবে লাথি মারলাম ওর পেটে। আঁক শব্দ করে প্রকাশ শুয়ে পড়ল মাটিতে। আর তারপরেই শুরু হল মারামারি। মিনিট পাঁচেক পর স্যারেরা, ছাত্ররা মিলে কোনওক্রমে মারামারি থামাল। রেফারি প্রকাশকে হলুদ কার্ড আর আমাকে লাল কার্ড দেখালেন। ফলে আমাকে বেরিয়ে আসতে হল মাঠ থেকে। সবাই এসে আমাকে রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে বলল। কিন্তু আমি বসলাম না, কিট গুছিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে এলাম। লিরিল আমার সঙ্গে আসতে চাইছিল। কিন্তু আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, “এখন আমায় একদম ডিস্টার্ব করবি না।” লিরিল কী বুঝল কে জানে, আবার চলে গেল মাঠের ধারে।

সে জানে আজ আর প্রোফেসর দে ল্যাবে আসবেন না। কাল তাঁর ফেয়ারওয়েল। ল্যাবের নীচেই হল বা বাঙ্কোয়েট রুম। সেখানেই কালকের অনুষ্ঠান। তা ছাড়া কাল মন্ত্রীর সিকিউরিটিরা সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে দেখবে নিরাপত্তার জন্য। মানে কাজের জন্য আজটুকুই শুধু আছে হাতের মধ্যে।

যদিও সে ইচ্ছে করলেই প্রোফেসর দে-কে অন্যভাবে সরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু সেটা হবে খুব ম্যাড়মেড়ে। তার চেয়ে ল্যাবসমেত, গোটা মাইক্রোবায়োলজি বিল্ডিং সমেত মন্ত্রীসহ প্রোফেসর দে-কে উড়িয়ে দিতে পারলে সেটা মজার ব্যাপার হবে।

এখানে তাই সে বোমা ব্যবহার করবে। আর বোমাটা সে প্ল্যান্ট করবে আজই। কারণ, কাল আর সময় নেই। কাল শুধু ঠিক সময়ে বোমাটা ফাটার অপেক্ষা।

এবারের বোমাটা একটু অন্য ধরনের। বোমাটা টেম্পারেচার কন্ট্রোলড বা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত। একমুখ বন্ধ একটা কাচের নল দশ ইঞ্চির মতো লম্বা। তার নীচের বন্ধ মুখের ইঞ্চি দেড়েক উপরে একটা ছোট্ট ফুটো, তার মধ্যে একটা সরু ধাতব তার ঢোকানো। নলের মধ্যে মাপমতো পারদ ঢালা থাকবে। কম তাপমাত্রায় নীচের তার পারদের মধ্যে ডোবানো থাকবে আর উপরের তারের থেকে তখন পারদের উপরিতলের দূরত্ব থাকবে ইঞ্চিখানেক। দুটো তারের সঙ্গে যোগ থাকবে ব্যাটারি ও ডেটনেটরের। আর ডেটনেটর লাগানো থাকবে আর ডি এক্স-এর সঙ্গে। এখন তাপমাত্রা বাড়লে পারদ প্রসারিত হয়ে উপরের তারে গিয়ে ঠেকবে। যেহেতু পারদ তরল ধাতু তাই সে বিদ্যুত্ পরিবাহী। ফলে গোটা সার্কিট কমপ্লিট হবে। ব্যাটারির পজিটিভ ও নেগেটিভ সংযুক্ত হবে এবং বিদ্যুত্ তার পারদ হয়ে ডেটনেটরে গিয়ে পৌঁছোবে। এরপর ডেটনেটরে মৃদু বিস্ফোরণ আর তার চাপে ও তাপে প্রবলভাবে ফেটে যাবে আর ডি এক্স। ধসে যাবে ল্যাব, বাঙ্কোয়েট, মায় গোটা মাইক্রোবায়োলজি উইং। আর আবিষ্কারসমেত পরপারে চলে যাবেন প্রোফেসর দে।

এখন তাপমাত্রা বাড়াবার জন্য ব্যবহার করা হবে ফ্রিজ, বোমার গোটা সিস্টেমটা একটা বড় জগের মধ্যে লুকিয়ে সাবধানে রাখতে হবে ফ্রিজের মধ্যে। আর ফ্রিজ খুললেই তাপমাত্রা বাড়বে, পারদ প্রসারিত হয়ে এগিয়ে যাবে উপরের তারের দিকে।

অবশ্য এখানে একটা ব্যাপার আছে। গোটা সিস্টেমে একটা সার্কিট কমপ্লিট সুইচ থাকবে। কারণ, ফ্রিজে ঢোকাবার আগে সাধারণ তাপমাত্রায় পারদ প্রসারিত হয়ে উপরের তার ছুঁয়ে থাকবে। ফলে তখন যাতে বিস্ফোরণ না ঘটে তার জন্য থাকবে একটা সুইচ। পুরো সিস্টেমটাকে ফ্রিজে রেখে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, যাতে পারদ সংকুচিত হয়ে নেমে যাওয়ার সময় পায়। তারপর ফ্রিজ খুলে পঞ্চাশ সেকেন্ডের মধ্যে সুইচ অন করে ফ্রিজ বন্ধ করে দিতে হবে। এই সুইচ অন করার পরই সিস্টেম কার্যকর হবে। অর্থাৎ এরপরই তাপমাত্রা বাড়লে বোমা ফাটবে।

সে হিসেব করে দেখেছে যে, তাপমাত্রা বাড়লে পঞ্চাশ সেকেন্ড সময় লাগবে পারদের উপরের তার ছুঁতে। অর্থাৎ ফ্রিজ পঞ্চাশ সেকেন্ড বা তার বেশি খোলা রাখলে বোমাটা ফাটবে। আর বোমাটা এমনভাবে তৈরি যে, এটা ইর্রিভারসিবল অর্থাৎ একবার বোমা আর্মড হয়ে গেলে তাকে আর বন্ধ করা যাবে না। কারণ, বন্ধ করতে গেলে ফ্রিজ পঞ্চাশ সেকেন্ডের বেশি খোলা রাখতে হবে অর্থাৎ বোমা ফাটবেই।

এখন ফ্রিজ রাখা আছে প্যান্ট্রিতে। বিশাল বড় ফ্রিজ। তাতে কালকের ফাংশন ও ফেয়ারওয়েল পার্টির কোল্ড ড্রিঙ্কস ও মিনারেল ওয়াটার রাখা আছে। তার মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে হবে বোমা। আর সেই লুকিয়ে রাখার জন্য শেষ সুযোগ আজ রাতে। সে জানে, এই ফ্রিজ কাল পার্টির সময়ই একমাত্র খোলা হবে, তার আগে নয়।

রাত দেড়টা নাগাদ সে বেরিয়ে এল প্যান্ট্রি থেকে। বোমাটা সে ফ্রিজের মাঝের তাকের সামনের দিকে রেখেছে একটা জগের মধ্যে। তার পিছনে রাখা আছে মিনারেল ওয়াটারের বেশ কিছু বড় বোতল। এখন মিনারেল ওয়াটারের বোতলগুলো বের করতে হলে জগটাকে টপকে বের করতে হবে এবং এতে প্রায় মিনিট চারেক সময় ফ্রিজটা খুলে রাখা দরকার। অর্থাৎ বোমা ফাটবেই।

ল্যাব থেকে বেরিয়ে সে দ্রুত ক্যাম্পাসের মাঠ পেরিয়ে যেতে লাগল। মাথার উপর কচ্ছপের পিঠের মতো রাতের আকাশ। দূরে আলো নেভা হস্টেল। শরতের নিঝুম রাত। সে জানে, কাল রাত আর এরকম থাকবে না। জীবন দ্রুত পরিবর্তনশীল। কোনও কিছুই স্থির নয়। নিরাপদ নয়। সে আর সময় নষ্ট করল না, দ্রুত মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

এই রাতেই অন্য এক জায়গায় নিজের বাড়িতে বসে আছেন প্রোফেসর রমানাথ দে। তাঁর চোখে ঘুম নেই। তিনি জানেন কালকের দিনটাই শুধু। তারপরই তিনি রোসিক্রুশিয়ান হেল্থ কেয়ারের সুরক্ষিত আশ্রয়ে। তিনি জানেন গেব্রিয়েল ফার্মাসিউটিক্যাল অনেক কিছু করতে পারে। সেই যুবকটা একজন স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের অফিসারকে নিয়ে এসেছিল তাঁর কাছে। তিনি বলেছেন শুধু কথার ভিত্তিতে গেব্রিয়েলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তবে প্রোফেসর দে-কে ওঁরা কাল যথাসাধ্য প্রোটেকশন দেবেন।

অফিসার চলে গেলেও যুবকটা আজ এখানে থেকে গেছে। আর এখন সে ঘুমিয়ে আছে পাশের ঘরে। প্রোফেসর দে ধীরে ধীরে সেই ঘরের দরজাটা ফাঁক করলেন। বিছানায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে যুবকটা। প্রোফেসর দে নিজের যুবক বয়সকেই যেন দেখলেন। স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার দশ বছর পর তিনি নিজের ছেলেকে দেখলেন। এই ইউনিভার্সিটিতে যুবকটা ভরতি হয়েছে। তাঁকে খুঁজতেই কি? কে জানে? প্রোফেসর দে দেখলেন, তাঁর ছেলে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। তিনি ভাবলেন, কালকের দিনটা শুধু কেটে যাক। তবেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

“অমিতকে দেখছি না, কী ব্যাপার বল তো?” ঋতম গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করল আমাকে। আমি কিছু বলার আগেই লিরিল বলল, “কী জানি কোথায়। কেন রে?”

এবার প্রশ্নটা এল ঋতমের পিছনে দাঁড়ানো মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোকের কাছ থেকে, “কারণ, সবাইকে দেখছি, তাকে দেখছি না।”

আমি বললাম, “তাতে কী হয়েছে?”

ঋতম গম্ভীর হয়ে বলল, “অ্যাডাম, ইনি স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ থেকে এসেছেন। প্রোফেসর দে-র প্রোটেকশনের জন্য।”

“প্রোটেকশনের জন্য?” লিরিল আর আমি একসঙ্গে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক হালকা কেশে শুরু করলেন, “হ্যাঁ, প্রোটেকশন। কারণ, প্রোফেসর দে ইজ ইন গ্রেভ ডেঞ্জার। এর চেয়ে বেশি আমি বলতে পারব না। বাই দ্য ওয়ে মিট মি, আই অ্যাম জয় ঘোষ। স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। আপনাদের নাম?”

আমরা আমাদের নাম বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম উনি অমিতকে খুঁজছেন কেন?

জয় ঘোষ খানিক চিন্তা করে বললেন, “দ্যাখো, আমি এক্ষুনি কিছু বলছি না। কিন্তু অমিতের না থাকাটা ভাল লাগছে না আমার। যাক গে, ওকে দেখলে আমাকে জানিয়ো।” জয় ঘোষ দ্রুত অনুষ্ঠান হলের দিকে চলে গেলেন।

“যাচ্চলে! কী কেস বল তো? শুভ গায়েব। অমিত গায়েব। কোত্থেকে জয় ঘোষ না কে একজন এলেন! আশ্চর্য, আজ অনুষ্ঠান না ধাঁধা প্রতিযোগিতা?” আমি লিরিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

লিরিল কিছু বলার আগেই ঋতম বলল, “আমি একটু আসছি বাথরুম থেকে।”

ও চলে যেতেই লিরিল ঘেঁষে এল আমার গায়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “খাবারদাবারের অ্যারেঞ্জমেন্ট ঋতম করছে, না রে?”

লিরিল ফিসফিস করে বলল, “সব তো মনে আছে দেখছি। আমাদের খাবারদাবারটা মনে নেই?”

“আমাদের খাবারদাবার?” আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

লিরিল মুচকি হেসে বলল, “সেই যে ফুটবল ম্যাচে এক গোলে জিতলি। একটা গোল একটা চুমু। মনে নেই? আজ ফাংশনের শেষে কিন্তু কিস্টা হবে, কেমন?”

ঘণ্টাখানেক বাদে মন্ত্রী এবং তাঁর লোকজন এসে পৌঁছোলেন কলেজে। মন্ত্রীমশাইকে নিয়ে যাওয়া হল স্টেজে। সেখানে তখন বিভিন্ন মাননীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রোফেসর দে-ও বসে। ভিড়ের মধ্যে কেমন একটা হুড়োহুড়ি ভাব মন্ত্রীকে দেখে। এর মধ্যে আমি হঠাৎ দেখলাম অমিতকে!

“কী রে, কোথায় ছিলি তুই?” আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

অমিত ভুরু কুঁচকে খেঁকিয়ে উঠল, “তোকে বলব কেন? তুই কে?”

“ঠিক আছে, আমাকে বলবি তো?” দেখি কখন জানি ঋতম এসে দাঁড়িয়েছে।

অমিত বলল, “একটু বাড়ি গিয়েছিলাম, দরকার ছিল। কেন কী হয়েছে?”

ঋতম বলল, “তোকে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসার খুঁজছেন।”

নিমেষে অমিতের তেজ উবে গেল। ধরা গলায় বলল, “কেন রে? আমি তো কিছু করিনি।”

আমি এর মধ্যে বললাম, “ওসব বাদ দে। শোন, আমি হস্টেলে যাচ্ছি ফেয়ারওয়েলে দেওয়ার মালাগুলো আনতে। তোরা অন্য বন্দোবস্ত কর।”

ঋতম আমাকে বলল, “তার চেয়ে তুই প্যান্ট্রি থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলগুলো নিয়ে আয়।”

আমি বললাম, “ভাগ।”

ঋতম অমিতের দিকে ঘুরে বলল, “অমিত, এই নে প্যান্ট্রির চাবি। তুই তবে নিয়ে আয়।”

অমিত চাবিটা হাতে নিয়ে বলল, “আমি কেন? লিরিলকে নয় শুভকে পাঠা। আমার একটা দরকার আছে একটু দোকানে যাব।” বলে অমিত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।

“কিন্তু আমি তো একটু আগেই লিরিলকে বাজারে পাঠিয়েছি পেস্ট্রি আনার জন্য।” আমি ঋতমকে বললাম।

ঋতম আশ্চর্য হল, “দূর, পেস্ট্রি তো ভরতি আছে।”

আমি বললাম, “শুভকে তবে বল।”

ঋতম মুচকি হাসল, “শুভ? সে এখন স্টেজ ছেড়ে নড়বে না।”

“মানে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

ঋতম খানিকক্ষণ দম ধরে বলল, “তুই জানিস না? স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চকে শুভই ডেকে এনেছে। হি ইজ প্রোফেসর দে’জ সন।”

আমার দম বন্ধ হয়ে গেল যেন। এক নিশ্বাসে মনে পড়ে গেল কেন ও প্রোফেসরের ল্যাবের কাছে ঘুরঘুর করত। কেন প্রোফেসরের নামে কেউ কিছু বললে ও রেগে যেত। আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে ঋতম অনুষ্ঠানের হল থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “তবে আমিই যাই প্যান্ট্রিতে।”

সে বেরিয়ে এল মাঠে। তারপর দৌড় শুরু করল। ক্যাম্পাসের একপাশে পান্থপাদপের একটা ঝোপমতো আছে। তার পাশেই দাঁড় করানো তার মোটরবাইক। বাইকের পাশে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা তার রুকস্যাক। সে প্রস্তুত হয়েই ছিল।

ঘড়ি দেখল সে। এতক্ষণে কেউ না কেউ প্যান্ট্রির দিকে গেছেই। আর দেরি নয়। মিনিট দশেকের মধ্যে বিস্ফোরণ হবে। বাইকে স্টার্ট দিয়ে সে বেরিয়ে এল ক্যাম্পাস থেকে। কিন্তু কেন জানি তার মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে সে কিছু ফেলে এসেছে। যাক গে, যা হওয়ার হয়েছে। সে স্পিড বাড়াল। আর ঠিক সেই সময়েই তার মোবাইল বেজে উঠল। বাইক থামিয়ে সে ফোনটা কানের কাছে তুলল, “হ্যালো।”

“কোথায় তুই? আমরা তোকে খুঁজছি। লিরিলও খুঁজছিল। কিন্তু এইমাত্র ও প্যান্ট্রিতে গেল মিনারেল ওয়াটার আনতে।”

ফোনের মধ্যে থেকে কেউ যেন তাকে গুলি করল, আর তার এইবার মনে পড়ে গেল যে, সে তার রুমে ফেলে এসেছে চে গুয়েভারার মুখ আঁকা একটা সুন্দর নীল জ্যাকেট। সে, অদম্য সেন টলে গেল। টলে গেলাম। বললাম, “ঋতম, তুই প্যান্ট্রিতে যাসনি?”

“না, লিরিলকে বাজারে যেতে হয়নি। ও খবর পেয়েছিল পেস্ট্রি আছে। আর আমাকেও জয় ঘোষ খুব আর্জেন্টলি তোকে খুঁজতে বলল। তাই লিরিলকে প্যান্ট্রিতে পাঠিয়ে আমি তোকে খুঁজছি। অমিতেরও বাজারে যাওয়া হয়নি, ও-ও তোকে খুঁজছে। তুই কোথায় অ্যাডাম? কী হচ্ছে এসব?” ঋতমের গলায় ভয় আর উদ্বেগ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথায় বিদ্যুত্ খেলে গেল যেন। গেব্রিয়েল তাদের প্রভাব খাটিয়ে এই ইউনিভার্সিটিতে ভরতি করে আমাকে। সত্যি পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়। আর তাদের কথামতো সব নিখুঁতভাবে করেছি আমি। পরিকল্পনা মাফিক লাল কার্ড দেখে ফাঁকা হস্টেল ঘরে বসে বানিয়ে নিয়েছি বোমা। না হলে যে একা সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপর সময়মতো সেটা রেখে এসেছি ফ্রিজে। সব ঠিক করেও শেষে এসে গোলমাল হয়ে গেল। ফোন কানে নিয়ে আমি থমকে গেলাম। স্পষ্ট যেন দেখতে পেলাম, আমার রেখে আসা বোমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লিরিল। যার সঙ্গে আমার একটা চুমু বাকি আছে। যার দেওয়া জ্যাকেট আমি ভুলে ফেলে এসেছি। আর-একটু পরেই উড়ে যাবে গোটা ল্যাব, প্রোফেসর দে আর বহু স্টুডেন্ট। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি মেয়ে মারা যাবে, যে আমাকে ভালবেসেছিল। আমি সত্যি চাইনি ও এভাবে মারা যাক। তাই তো কায়দা করে ওকে পাঠিয়েছিলাম বাজারে। কিন্তু আর কি সময় আছে? ঋতমের ফোনের লাইন কেটে আমি লিরিলের মোবাইলে রিং করলাম। শুনলাম রিং হচ্ছে। রিং হয়েই যাচ্ছে। ফোন তুলছে না কেন লিরিল? মেয়েটার বড় দোষ, মাঝে মাঝেই লিরিল মোবাইলটা হস্টেলে রেখে আসে। আজও কি রেখে এসেছে? ও এখন কোথায়? ও কি প্যান্ট্রির খুব কাছে? ওকে কি এখনও বাঁচানো যায়? গেব্রিয়েল, পঁচাত্তর হাজার ডলার সব উড়ে গেল মাথা থেকে। লিরিল, তুই ফোন তুলছিস না কেন? আমারই বা মনে এরকম হচ্ছে কেন? এই কি প্রেম? সত্যি কি প্রেম বেঁধে রাখে মানুষকে? জীবনে এগোতে দেয় না? ওকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা কি করব? পারব বাঁচাতে? আর কি সময় আছে? আমি বাইক স্টার্ট দিলাম। তারপর ফুল স্পিডে বাইকের মুখ ঘুরিয়ে দিলাম কলেজের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *