ডাকিনিতন্ত্র

ডাকিনিতন্ত্র

স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছে সরসিজ পণ্ডা। লোধাশুলির চরণ দাস সিংহ উচ্চ বিদ্যালয়ে পোস্টিং। সরসিজের দেশের ঘর বালিচক-এ। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স-এ এম এস সি।

বালিচক অঞ্চলে গণবিজ্ঞান আন্দোলন করে, এমন যে কয়েকটি সংগঠন আছে। একটি সংগঠনই ভেঙে এখন তিন-চারটি হয়েছে। প্রথম সংগঠনটি যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল, তার নাম ষড়ানন পণ্ডা। সরসিজের জ্যাঠামশাই তিনি।

ষড়ানন পণ্ডা নিজে পইতে ছেড়েছিলেন, বাড়ির শালগ্রাম শিলার গায়ে মুরগির মাংস ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন। পবিত্র শালগ্রামটির সংস্কার হয়নি আর। ম্লেচ্ছস্পর্শে কী করে শালগ্রামের সংস্কার হয়, তার বিধান জানা থাকলেও নিষিদ্ধ মাংস স্পর্শে কী ভাবে ভগবানের শোধন হবে তার বিধান ওই অঞ্চলের ব্রাহ্মণকুলের জানা ছিল না। শিলাটিকে কংসাবতীতে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। সরসিজের বাবা মারা গিয়েছিলেন সরসিজের বাল্যবয়সে। জ্যাঠামশাই ষড়ানন তাই ছিলেন বাড়ির কর্তা। সরসিজের পইতে দেওয়া হয়নি। ষড়ানন পণ্ডা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। এখন রিটায়ার করেছেন। চক্ষুদান এবং দেহদানের অঙ্গীকার করা আছে। এরকম বাড়ির ছেলে সরসিজ।

সরসিজ সে ভাবে অ্যাকটিভিস্ট নয়। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার মানসিকতা খুব একটা প্রশ্রয় দেয় না। ভেবেছিল, এম এস সি পাশ করে পিএইচডি করবে, তারপর বিদেশে পাড়ি দেবে। এন আর আই হবে। তারপর মাঝে মধ্যে দেশের বাড়িতে ফিরে গ্যারেজ-কমোড– ব্যালকনি-ম্যাজেনাইন-লন শোভিত বাড়িতে ডলারগর্বে গ্রাম্য শোভা দেখবে। জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নামে লাইব্রেরি করবে, বিজ্ঞান ক্লাবগুলিকে ডোনেশন দেবে। কিন্তু অনার্সের রেজাল্ট খুব একটা ভাল হল না। কোনও রকমে এম এস সি হল যদিও, ফার্স্ট ক্লাস হল না। এম এস সির পর আই টি বা কম্পিউটারে হায়ার স্টাডিও করতে পারত হয়তো, কিন্তু এস এসসি-টা দিয়ে দিল এবং লেগেও গেল। মাইনেপত্রও খারাপ নয়। আপাতত এটাই চলুক, ডব্লু বি সি এস-টায় বসতে হবে। ‘পাত্রী চাই’-এর বিজ্ঞাপনে এমএসসি, ডব্ল বি সি এস, উদার মনের সুদর্শন পাত্রের জন্য প্রকৃত সুন্দরী যে-কোনও বর্ণের উপযুক্ত পাত্রী চাই। কোনওরকম পণ বা যৌতুকের প্রশ্ন নেই— “এরকমও খুব খারাপ লাগবে না।” ব্যাংক কর্মচারী বা স্কুল শিক্ষক পাত্র চাই”-এর চেয়ে অনেক ভাল। তবে ‘আমেরিকায় কর্মরত’–র সঙ্গে তুলনা হয় না। স্কুল শিক্ষক থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

একটা দুই ঘরের বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে সরসিজ। প্রাচীর ঘেরা বাড়িটা একটু নির্জনে। ভালই লাগে ওর। কিছু গাছ আছে। বাড়িওলা এখানে থাকে না। বোধহয় বাগানবাড়ি করবে ভেবেছিল। ওপরে টিনের চাল। শিক্ষকরা বেশির ভাগই স্থানীয়। সাইকেলেই যাওয়া আসা করে। দু’জনের মোটর সাইকেল আছে। এস এস সি–র মাধ্যমে সরসিজই প্রথম এই স্কুলে। সরসিজ রান্নাবান্না করেই খায়। রান্নাবান্না জানত না। এখানে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে রান্না করে। রান্নাঘর তো একটা ল্যাবরেটরিই। এক্সপেরিমেন্ট, অবজার্ভেশন এবং কনক্লশন।

একবার হাট থেকে দু’কেজি চাল কিনেছিল এমন, তাতে বড্ড কাঁকর। ভাত রান্নার পর দাঁতে বার বার কাঁকর পড়ছে। খাওয়াই গেল না। বাকি চালের কাঁকর বাছার সময় নেই, ধৈর্যও নেই। স্কুলের পিয়োন সোনারামকে ঘরে ডেকে নিয়ে বলে— চালগুলো নিয়ে যাও, বড় কাঁকর। সোনারাম বলে, কাঁংকর তো অসুবিধা কাঁই? হান্ডিয়া বনা করেন আইজ্ঞা। সোনারামের দেশ এক্কেবারে ময়ূরভঞ্জ লাগায়ো একটা গ্রামে। লোধাশুলি থেকে ষোলো কিলোমিটার দূরে। ওখানে ওড়িয়া কথাবার্তাই চালু। লোধাশুলির কথ্য বাংলার সঙ্গে ওড়িয়ার তফাত খুব বেশি নেই।

সরসিজ বলে—হান্ডিয়া? কিন্তু আমি তো হান্ডিয়া করতে পারি না।

সোনারাম বলে— পারুনান্তি? মু আপনাকু দেখাই দিবি। খুব সহজ বটে আইজ্ঞা। আপনার ঘরে হউনি? মা বহিন সঙ্কু জানি থিব।

না সোনারাম। আমাদের ওধারে হান্ডিয়া চলে না।

সোনারাম আশ্চর্য হয়।

হান্ডিয়া মানে হল হাড়িয়া। ভাতের পচাই। এধারে হাড়িয়ার বেশ চল। লোধাশুলির দক্ষিণে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ, পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলা। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। সাঁওতাল, ভূমিজ, সর্দার, মাহাতোরাও আছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে মেয়েরা চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি নিয়ে বসে থাকে। হাড়িয়া বিক্রি করে। হাটেও পর পর হাড়িয়ার পসরা। একদিন খেয়েছিল সরসিজ। হাড়িয়া নয়। রসি। হাড়িয়ার ওপরের অংশটা। বেশ লেগেছিল। বিয়ারের মতন। কিন্তু রাস্তা ঘাটে খেতে পারে না সরসিজ। স্কুল শিক্ষক কিনা।

সোনারাম হল সাঁওতাল। সোনারাম মুর্মু। বয়স পঁয়তিরিশের মতো। ও স্কুলের ঘণ্টা বাজায়। নোটিস বিলি করে। গেটেও বসে। স্কুলেরই একটা ঘরে ও থাকে। রান্না করে খায়। সোনারাম যখন বলল, হাড়িয়া তৈরির কায়দা ও দেখিয়ে দেবে, সরসিজ রাজি হয়ে গেল।

কিলোখানেক চালের ভাত হল। ভাতকে ঠান্ডা করে বাখরগুলির গুঁড়ো মাখিয়ে, ঝাঁকিয়ে সামান্য জলের ছিটে দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে বলল, তিন দিন পরে খুলি দিবে আইজ্ঞা।

পরদিন সরসিজ দেখল, হাঁড়িটা বেশ গরম। দ্বিতীয় দিন ততটা গরম নয়। তৃতীয় দিন ঢাকনি খুলল। ভাতের ওপর কিছুটা জল। জলের মধ্যে বুটবুটি কাটছে এবং একটা মিষ্টি গন্ধ।

সরসিজ তো জানে কার্বোহাইড্রেট যদি ফারমেন্ট করে তা হলে জল, অ্যালকোহল আর কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। ভাতের ওপর এই যে জলীয় অংশ, এতে আছে অ্যালকোহল আর জল। আর বুটবুটি কাটছে যেটা, সেটা হল কার্বন ডাই-অক্সাইড। আর বাখরগুলিটা নিশ্চয়ই ইস্ট। ফার্মেন্টিং এজেন্ট। ভাতগুলো একদম নরম হয়ে থাকে। ওই জলীয় অংশের সঙ্গে মেখে নিলে হয়ে যায় সোনারামদের হান্ডিয়া। খাদ্যও হল, নেশাও হল।

সোনারামই খোঁজ নিয়েছিল। বলেছিল, দেখিলে কি স্যার? মনে হউচি পকাই গেছে। সরসিজ বলেছিল— হ্যাঁ। সন্ধ্যার পর এসো।

সরসিজ খেয়েছিল রসি। ওপরের অংশটা। সোনারাম হান্ডিয়া। সরসিজ বলল— ই সব ইস্কুলে আবার বাখান করিস না। সোনারাম বলে, কাহিকি? আদিবাসী সব্ব খাউছন্তি স্যার। খাইলে দোষ নাহি। ইটা খাইদ্যটা বটে। খালি ডিউটি টাইমে ন খাইলেই হব স্যার।

সরসিজ বলেছিল— তবুও। বলিস না কাউকে। এটা তোর আমার মধ্যেই থাক।

সরসিজ গোপন কথা বলে সোনারামকে। বলে, আমার জ্যাঠা বিয়ে করলনি। সংসার করলনি আমাদের ভাইবোনদের দেখে গেল। আমাকে পড়াল। বিড়ি সিগারেট পান মদ তাড়ি হাড়িয়া কিছো ছুঁলোনি, আর আমি পাষণ্ডটা ভাবছি জ্যাঠা মরলে সম্পত্তি বেচে মটরসাইকিল হাঁকড়াব, ফ্রিজ কিনব, খাটের ওপর স্পঞ্জের গদি রাখব। কারণ, আমি তো বিহা করার সময় পণ-দহেজ লিব না, তাই সব আগে করে লিব। জ্যাঠার সম্পত্তি বিকে। জ্যাঠার মরণ চাই মনে মনে হে। হায় রে হায়। মোকে মার। মোর গায়ে মুতে দে।

সোনারামও গোপন কথা বলে। বলে, মোর গোটে হিলি অছি। মা যেমতি। বড়দাদার স্তিরি। দাদা মরি গলা বাহাঘর পরে পরে। হিলি রহিগলা।

সোনারাম ওর বউদির কথা বলছে। ওরা বউদিকে বলে হিলি। সোনারামের দাদার মৃত্যুর পর ওর বউদি ওদের সংসারেই আছে। সোনারামের আরও এক দাদা আছে। চাষবাস ওই দাদাই দেখে। বড়দাদা মৃত্যুর পর বউদি দাদার অংশটুকু পেয়েছে। কিন্তু সাঁওতালদের প্রচলিত নিয়মে ওই সম্পত্তির ভোগ দখলের অধিকারটুকু যতদিন সে বেঁচে থাকবে, ততদিন। সম্পত্তি হস্তান্তর করার অধিকার নেই, বিক্রি করার অধিকার নেই। কাউকে দান করারও অধিকার নেই। মৃত্যুর পর বউদির সম্পত্তি ভাইদের হয়ে যাবে।

সোনারাম বলে, মু আইজ্ঞা পাপিষ্ঠ। মোর মা যেমতি, সেমতি মোর হিলি কিন্তু। মু মঝরে মঝরে তার মৃত্যু চাহে। ছিঃ। তার মরণ পরে তার জমি জাগা মু বেচি দেই কিরি কোঠা ঘর বানাইবি ভাবে। মু পাপিষ্ঠ। মুকে সাসপেন্ড করি দিয়ন্তু। চাবুক মারো। চাবুক! মু ছুকা হড়াম টা…।

সোনারাম মুর্মু আর সরসিজ পণ্ডার মধ্যে একটা বেশ বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সোনারাম মাঝে মাঝে সরসিজের ঘরে আসে, ঘরের হাঁড়িতে কেমিস্ট্রি হয়, আর মনের কথা বিনিময় হয়।

দুই

দুটো কুড়ি বেজে গেল, তবু ঘণ্টা পড়ল না। দুটো দশ-এ ঘণ্টা পড়ার কথা। গতকালও ছুটির ঘণ্টা পনেরো মিনিট আগে মেরে দিয়েছে সোনারাম। সরসিজ ক্লাস থেকে বেরিয়ে দেখল, সোনারাম গালে হাত দিয়ে কিছু ভাবছে। সরসিজ ওকে ডেকে হাতের ঘড়িটা দেখাল।

কিছু দিন হল সোনারামের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে না। আসলে সরসিজই নিষেধ করেছে। আসলে জানাজানি হয়ে গেছে। ইংলিশ স্যার হাতছানি দিয়ে একদিন কাছে ডেকে কানে কানে বললেন, শুনলাম আপনি রসিক লোক। আমি তো কাছেই থাকি। আই অলসো লাইক। ঘরে চলে না। প্লিজ কল মি আইজ্ঞা, সামটাইমস। বাট হান্ডিয়া ইজ ভেরি ব্যাড। ইংলিশ ইজ গুড। আই অলসো শেয়ার করিবি, হেঁ হেঁ।

পরের দিনই অঙ্কের স্যার বললেন— সোনারামের খুব আস্কারা হঞিছি। তাকু মু গোটে সামান্য কাজের জন্য বজার যেতে বললাম— ও রিফিউজ করে দিল। ওর খুব রস হইচি। আমাদের স্যারেরাই যদি উর সঙ্গে মদ খাবে, তবে উ তো গাছে চড়বেই….

সোনারামকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিল সরসিজ— ওরা সব জানল কী করে? তুমি নিশ্চয়ই সব রটিয়েছ।

সোনারাম ঠোঁট ওলটায়। বলে, কাউকে বলেনি ও। হয়তো কেউ ঘরে ঢুকতে বেরোতে দেখে থাকবে।

এরপর থেকে সোনারামের সঙ্গে একটু দূরত্বেই থাকে সরসিজ। কাঁকর চালের সদ্‌ব্যবহার হয় না আর।

সোনারাম গত ক’দিন ধরে কীরকম মন মরা। কাজে ভুল হচ্ছে, ঘণ্টা দিতে ভুলে যাচ্ছে। সরসিজ ছুটির পর জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে সোনারাম? সোনারাম বলল— স্যার, বড় বিপদ। আপনাকে বলব ভাবছি ক’দিন ধরে। আজি যাইবি স্যার, ছুটির পর? সরসিজ বলে, এসো….।

সোনারাম আসে। বলে, বড় বিপদ আইজ্ঞা!

কী বিপদ?

সোনারাম যা বাখান করে তা হল— ওর হিলি, মানে বউদিকে ওর গ্রামের লোকেরা ডাইন সাব্যস্ত করেছে এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেছে।

ওর দাদা বলেছে, ও এত টাকা কোথায় পাবে। এই টাকা সোনারামকেই জোগাড় করে দিতে হবে আগামী সাত দিনের মধ্যে।

জরিমানার টাকা না দিতে পারলে সমাজ থেকে একঘরে করে দেবে। গিরা করে দেবে।

তা তুমি এখন কী চাও? সরসিজ জিজ্ঞাসা করে।

সিটাই তো ভাবুচি। এত্তে টংকা…! যদি বুঝাই সুঝাই কিছু কম হেই পারে…।

যদি কিছু কমে হয় টাকাটা দিয়ে দেবে?

হ।

তা হলে তো তুমি স্বীকার করে নিচ্ছ যে, তোমার বউদি ডাইন।

হ।

হ মানে? তুমি মানছ তোমার বউদি ডাইনি?

আইজ্ঞা।

আইজ্ঞা মানে? তুমি বিশ্বাস করো ডাইনি আছে?

হ।

এবং মানছ তোমার বউদিও ডাইনি?

মানি কী উপায়?

কেন?

সবু একা কথা কহুচি যে। ডাউরা বিৎ করা হেইচি, তেলখড়ি হেইচি, ওঝা, জান, সব্ব কহুচি মোর হিলি ফুল মতি ডাইন। মোর তো গোটে সমাজ অছি…।

ওইসব ডাউরা বিৎ ব্যাপারটা কী বুঝতে পারে না সরসিজ। জিজ্ঞাসা করে।

সোনারাম অবাক হয় এই সহজ ব্যাপারটা জানে না বলে। সোনারাম বোঝায়—ঢাউরা বিৎ, তেলখড়ি,—এইসব।

সরসিজ যা বোঝে তা হল—কে ডাইনি সেটা নিশ্চিন্ত করার জন্য কোনও জলাশয়ের ধারে গাঁয়ের প্রতি পরিবারের নাম করে একটা করে কুসুম গাছের ডাল পোঁতা হয়। প্রতি ডালে তেল-সিঁদুরের ফোঁটা দেয়া হয়। তারপর চাল ছড়িয়ে মন্ত্র পড়া হয়। কয়েক ঘণ্টা পর দেখা হয় কোন ডালের পাতা শুকিয়ে গেছে। সেই শুনকনো হয়ে যাওয়া ডালটা যে পরিবারের নামে পোঁতা হয়েছিল সেই পরিবারেই ডাইনি আছে,— এরকমই ভাবা হয়।

যদি দুটো ডালই শুকিয়ে যায়? বা তিনটে?

কেন তেল খড়ি? সোনারাম বলে। ও জানায়— জানগুরুরা কাঁঠালপাতায় মুখ দেখতে পায়।

ও। সরসিজ এবার কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। কম ভোল্টেজের আলোয় সরসিজের নাকের ডগায় একবিন্দু ঘামে বিস্ময় ফুটে আছে।

সরসিজ বলে, আচ্ছা, তোমার বউদি যদি ডাইনই হয়, তবে জরিমানা দিয়ে দিলে ও কি আর ডাইন থাকবে না?

সোনারাম বোঝায়, জরিমানাটা হল যা যা ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, সে জন্য। যেমন, গাঁয়ের হড়-হপনের অসুখ-বিসুখ, কোড়াকুড়িগুলোর পেটখারাপ, দুটো গরু মরে গেছে। এর তো ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। এইসব ক্ষতি হচ্ছিল বলেই তো জানগুরুর কাছে খড়িতেলা করা হইল। সে পষ্ট দেখল ফুলমতি। বলল ফুলমতিই গরু খাইছে।

সরসিজ বলে— তুমি যে বললে তোমার বউদি তোমার মায়ের মতো যত্ন করেছে…

সোনারামের কপাল কুঁচকে যায়। সরসিজ যেন খারাপ ছাত্র, বোঝালেও বোঝে না। বলে, চাঁদেরও পূর্ণিমা-অমাবস্যা আছে, জানেন না?

তিন

সরসিজদের গ্রাম বালিচকে আদিবাসীর সংখ্যা কম। বিজ্ঞান ক্লাব-ট্‌লাব থাকলেও নানাবিধ কুসংস্কার আছে। কিন্তু বালিচক এলাকায় ডাইন টাইন নেই।

এই যে কুসংস্কারের কথা উঠল, এটা থেকে বেরিয়ে আসাটা সহজ নয়। সরসিজের জ্যাঠামশাই যেমন। উনি নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশের কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান করেননি। কিছু বিজ্ঞানকর্মীকে খাইয়েছিলেন। গৃহপ্রবেশ করলেন, যাত্রা নাস্তি, ত্রয়হোস্পর্শ, অকাল যোগ ইত্যাদি যাবতীয় অশুভ যোগ দেখে। সেই তো পঞ্জিকা দেখতেই হল।

এ ঘটনা জ্যাঠামশাই জানলে চোঙা টোঙা নিয়ে ছুটতেন। থানায় জানাতেন। বাড়ি গিয়ে এই ঘটনাটা বলবে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু জ্যাঠামশাই যখন জিজ্ঞাসা করবে, তখন তুই কী করলি, কী বলবে? বলবে, এক হাজার টাকা ধার দিয়ে দিলাম, জরিমানার টাকা।

কিন্তু কী-ই বা করতে পারে সরসিজ? ওর তো পার্টি নেই। পেছনে মানুষ নেই। একমাত্র প্রশাসনকে জানাতে পারে। ঝাড়গ্রাম বার্তায় চিঠি লিখতে পারে, নিজে একটা ডায়েরি লিখতে পারে।

সোনারাম কিন্তু বিশ্বাস করে বসে আছে, ওর হিলি ডাইন। কারণ ওঝারা নানান পরীক্ষা করেই এই রায় দিয়েছে। এখন যে জরিমানাটা দিতে হবে, সেটা কৃতকার্যর খেসারত হিসেবে। ওই মহিলাকে সাবধান করে দেবে যেন আর কখনও এসব না করে।

কিন্তু এরপরও যদি আবার কিছু হয়? যদি গোরু মরে? মানুষের যক্ষা হয়? গোরু গাভীন না হয়? বাচ্চাদের তড়কা হয়? তা হলে কি আবার ডাইন সাব্যস্ত হবে সোনারামের বউদি? তখন কী শাস্তি হবে?

সরসিজ হেডমাস্টারমশাইকে বলে ঘটনাটা।

হেডমাস্টারমশাইয়ের নাম নিত্যানন্দ মাইতি।

উনি বলেন, ওদের সমাজে তো এইসব আছেই…। সরসিজ বলে— আছে বলেই থাকবে?

আপনি কী করতে চান তবে?

সরসিজও ঠিক জানে না, ও কী করতে চায়? আসলে ও এ নিয়ে আলোচনা চায়। কিন্তু হেডস্যারের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে উনি এসব নিয়ে তেমন কিছু বলতেও চান না।

সরসিজ দু’বার আঙুল মটকে বলল— স্যার, একবার প্রেসিডেন্টকে বললে হয়।

স্কুলের প্রেসিডেন্ট? উনি কী করবেন?

শুনেছি, উনি ভাল লোক। তা ছাড়া ওনার যত হোন্ড, যদি বিডিওকে বলে দেন, থানাকে বলে দেন, যদি সোনারামের গ্রাম পঞ্চায়েতের থ্রুতে ওই সব ওঝা টোঝাদের হুমকি দিয়ে দেন…।

ওনার আর খাই দাই কাজ নাই, ইসব ব্যাপারে ঢুকবেন। আমি বলতে পারব না।

আমি যাব?

যান না, কে নিষেধ করেছে?

আমাকে তো চিনে না…

চিনিয়ে দিবেন আপনি। এস এস সি–র পাঠানো মাস্টার। আপনার স্পেশাল ইজ্জত।

আর একটা কথা স্যার।

হুঁ।

বলছিলাম কী, আমাদের স্কুলে তো আদিবাসীরাই বেশি, আমরা যদি মাঝে মধ্যে অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম করি, এইসব ওঝা, জানগুরু, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে—

কী বলবেন? বলবেন, ‘ওঝা ভলা নুয়ে, ডাকতর ‘ভলা’ এইসব তো? দেখুন, সোনারামদের গাঁয়ে গিয়ে কি বলবেন— কেরোসিনের আলোয় পড়লে চোখের ক্ষতি, ইলেকট্রিকের লাইটে চোখ ভাল থাকবে? এটা তখনই বলা চলে, যখন মানুষ বিদ্যুৎ পেয়ে গেছে এবং কিনতে পারছে। ব্যাপারটা বুঝলেন?

সরসিজ কিছুটা মাথা নাড়ে। পুরোটা নয়।

স্কুলের প্রেসিডেন্টের নাম সুকদেব সিং। ক্ষত্রিয়। সম্ভবত বিহারে আদিবাড়ি। এখানে কয়েক পুরুষ আছেন। পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন। সাদা চুল। অনেকটা জর্জ ফার্নাল্ডাজের মতো দেখতে। একটা দোতলা লম্বা ধাঁচের বাড়ি। যাঁর নামে স্কুল, সেই চরণদাস সিংহ তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন। ওদের এখন ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা। একতলায় অফিস।

অফিসঘরে স্বামী বিবেকানন্দের একটা ছবি। সরসিজ নিজের পরিচয় দিল।

প্রেসিডেন্ট বললেন, কী হল? স্কুলের কিছি গড়বড় হল?

সরসিজ বলল— না স্যার। সেইজন্য আসিনি। সরসিজ কারণটা বলল। প্রেসিডেন্ট শুনলেন। তারপর বললেন, বিডিও বা থানাকে বললে কিছি লাভ নাই। ইসব ব্যাপারে উরা মাথা ঘামায় না৷ যতক্ষণ খুন না হচ্ছে, ততক্ষণ উরা কুন অ্যাকশান নিবে না। ইসব অঞ্চল প্রধান কিংবা গ্রাম প্রধানের কাজ। ইসব নিয়ে কেউ কিছি ভাবে না। আপনি ইসব ভাবছেন বলে বহুত ভাল লাগছে। কাল একবার আসেন। পরেশবাবু আসবেন একটা কাজে। আমার গেস্ট হাউসেই থাকবেন। আঙুলটা ওপরের দিকে দেখালেন প্রেসিডেন্টজি। পরেশবাবু কে চিনেন তো? পরেশ কিসকু। পার্টির জেলা কমিটির লোক। খুব ইনফুলুয়েন্স আছে। কুন গ্রাম হচ্ছে উটা?

পত্রাশোল।

উ। আচ্ছা একেবারে উড়িষ্যা বর্ডার।

পরেশ কিসকুর পরনে অফ হোয়াইট সাফারি সুট। ঝাড়খণ্ডের মন্ত্রীরা যেমন পরেনা চোখে গগলস। এই ভাদ্রের গরম কালে সাফারি স্যুট পরে ঘামছেন। প্রেসিডেন্ট বলছিলেন, ছ’ মাসের মধ্যেই একটা এ সি লাগিয়ে দেবেন।

গেস্টরুমেই দেখা করেছিল সরসিজ। সঙ্গে প্রেসিডেন্টজিও ছিলেন। প্রেসিডেন্ট বললেন, ইনি আমাদের স্কুলের নতুন মাস্টারজি। ডাইন-টাইন নিয়ে আপনাকে কিছি কথা বলতে চান।

সমস্যাটার কথা বলেছিল সরসিজ। সবিস্তারে। পরেশবাবু হাসছিলেন।

শেষকালে সরসিজ যখন বলল— সোনারাম কেন দেবে জরিমানা? জুলুম? কোন সংবিধানে আছে এই শাস্তি? ঠিক তখনই ডান হাতটা সামনে দু’বার নাড়িয়ে কথাটা থামান পরেশ কিসকু। বলেন—হ। আদিবাসীদের সংবিধানে আছে ই সব। আদিবাসী গুলানের পরম্পরায় আছে। ট্র্যাডিশনে আছে।

পরেশবাবু কেমন যেন উত্তেজিত।

পরেশবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করলেন। গর্দানের ঘাম মুছলেন। একটু হাসলেন। উত্তেজনা চেক করলেন। বললেন— আমাদিগের ও ধরম কথা আছে। একটা কাহিনি শুনেন তবে। আমাদিগের বড় দেবতা হলেন মারাং বুরু। একবার কী হল, আদি যুগে স্ত্রীজাতির অত্যাচারে কাহিল হয়ে সব সাঁওতাল বেটাছেলেগুলা মারাংবুরুর কাছে গেল। বলল মেয়েছেলেরা বড় অতাচার করছে, কিছু অ্যাকশন লেন। মারাংবুরু সি সময় বড় বিজি ছিলেন। বুলেন পরের পূর্ণিমার রাতে তুরা আয়, সব শুনব। কিন্তু মেয়েছেলেরা সব জেনে গেল। পূর্ণিমার দিনে তারা উদের মরদগুলাকে দিন ভর হাড়িয়া পিয়াল। ভাল ভাল চাখনা বেঁধে দিল। পুরুষ হড়গুলি সারা দিন পাওয়া পিয়া করে বেহুঁশ হয়ে গেল। আর সব মেয়েগুলান করল কী, সব পুরুষের পোশাক পরে নিল, কালো ছাগলের দাড়ি কেটে গোঁপ তৈরি করল, মাথায় পাগড়ি বাধল। তারপর সব মারাংবুরুর কাছে গেল। মারাংবুরু উদের ব্যাটাছেলে মনে ভেবে ত্রাণমন্ত্র শিক্ষা দিয়ে দিল। মেয়েরা ওই মন্ত্র পেয়ে গিয়ে পুরুষদিগের উপর অ্যাপ্লাই করতে থাকল। পুরুষরা আরও বেশি করে টর্চার হতে থাকল। তখন উদের মনে পড়ল আরে, মারাংবুরুর কাছে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু উরা তো যায়নি, মহা ভুল হয়ে গেছে। তারপর পুরুষরা সবাই মিলে আবার মারাংবুরুর কাছে গেল। মারাংবুরু বহুত আশ্চর্যিত হল। বলেন, আরে আবার কী হল রে। হামি তো তুদের ত্রাণমন্ত্র দিই সারিচি। আবার এলি কেন? পুরুষরা বলে, সেদিন আমরা আসতে পারি নাই, অনেক হাড়িয়া পিয়ে লিয়েছিলম, অন্যায় হয়েছে, ক্ষমা করেন, হামাদিগকে ত্রাণমন্ত্র দান করেন। মারাংবুরু তখন বুঝতে পারেন, মেয়েছেলেরা সব চাতুরী করে গেছে। মারাংবুরু তখন নারীসমাজের উপর বহুত গোঁসা করেন। আর প্রতিকার হিসাবে পুরুষদের জান বিদ্যা দান করেন।

সেই থেকে নারী ডাকিনিদের বিরুদ্ধে পুরুষ জান বিদ্যা অ্যাপ্লাই করছে।

পরেশবাবু হাসতে থাকেন।

সুকদেব সিং উঠে দাঁড়ান। বলেন, ইসব গল্প কথা আপনি ভি বিশোয়াস করেন?

পরেশবাবু বলেন, আমি করি কি না করি সিটা বড়ো কথা নয়। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভেতরে এই বিশ্বাস আছে। আদিবাসীদের তো সব গেছে। আপনারা আপনাদিগের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছেন উদের ওপরে। তাই যেটুকু আছে, তা উরা ছাড়বে কেন? সহজে ছাড়বে নাই। আর সংবিধান কথা কহিছেন? মুসলমানদিগের জন্য যদি পারসোনাল ল বোর্ড থাকতে পারে, তবে আদিবাসীদেরও থাকতে হবে।

তার মানে পরেশবাবু, আপনি ডাইনতন্ত্রের বিরোধিতা করেন না? সুকদেববাবুর কাতর প্রশ্ন।

বললাম তো, আমি ইসব মানি না। কিন্তু আমার কথার দাম ইতো টুকু হে, ইতো টুকু।

বাঁ হাতের আঙুলের মুদ্রায় ক্ষুদ্রতা বোঝানোর চেষ্টা করেন পরেশবাবু।

নিজেকে ছোট ভাবতে নাই, স্বামী বিবেকানন্দজি বলেছিলেন। আপনি আপনার নিজের মতো চেষ্টা করেন। উটা আপনার ধরম হবে।

বিবেকানন্দজি এ ভি বলেছিলেন, খালি পেট মে ধরম নেহি হোতা হ্যায়।

আপনার আবার খালি পেট কোথায়? হে হে—

ব্যাপারটা লঘু করার চেষ্টা করলেন প্রেসিডেন্ট।

না। ভুল করছেন, আমি আমার পার্সোনাল কথা বলছি না। আমাদের আদিবাসীদের কথা বলছি। রিফর্ম করার চেষ্টা অনেক হয়েছে। সারদাপ্রসাদ কিসকু, মহাদেব মাহাতো, এরকম অনেকে বহুত করেছে। কী হয়েছে? কুসংস্কার সবার আছে। সাহেবদিগেরও আছে। বিলাত আমেরিকাতেও আছে।

সুকদেব সিং সহজে ছাড়ছেন না। উনি আবার বললেন, আছে, কিন্তু থাকাটা তো ঠিক নয়। ইসব দেখলে অন্তত প্রটেস্ট উঠানো উচিত। বন্ধ করা উচিত। এই যে আমাদের মাস্টারজি, ইয়ংম্যান। ইনিও তো নিজে এগিয়ে আসছেন। উকে মদত করুন। কম সেকম উদের পঞ্চায়েতকে একটা চিঠি দিয়ে দিন, পঞ্চায়েতকে বলে দিন যা অ্যাকশন করার করতে। থানাকে একটা চিঠি দিন। যা দৌড়ঝাঁপ করার এই মাস্টারজিই করবে।

পরেশবাবু শুনলেন। একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, আপনি আমাদের নিজেদের লোক সিং সাব। বুঝেন না? সামনে ইলেকশন আসছে। ই সময় উদের পরম্পরার বিরুদ্ধে, উদের প্রাচীন রীতির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিলে উরা সব পটান হই যাবে না? ঝাড়খণ্ড পার্টির সুবিধা হই যাবে না? ওই অঞ্চলে কেবল দুই-তিনটা গ্রামেই আমাদিগের পঞ্চায়েত। আশেপাশে ঝাড়খণ্ড পার্টি। আর তা ছাড়া, পত্রাশোলের গাঁয়ের যে মাঝি, সে নিজেই গ্রাম প্রধান। ই কথা ইবার থাক। ইবার অন্য কথা কহেন।

সরসিজ হাল ছেড়ে দিল। এটুকু যে করেছে, এ জন্যই ভেতরে ভেতরে সে একটা শ্লাঘা অনুভব করল। নিজের অ্যাকাউন্টে কিছু ভাল কাজ জমা পড়ল। জ্যাঠামশাইকে বলা যাবে। আর জ্যাঠামশাইয়ের প্রপার্টির উত্তরাধিকারই শুধু নয়, কাজেরও তো কিছু উত্তরাধিকার দরকার। এই যে চেষ্টাটুকু হল, এইটুকুই বা ক’জন করত?

চার

সোনারামের পরিবার জরিমানার টাকা দিয়ে দিয়েছে। এক হাজার টাকা ধার দিয়েছে সরসিজ। মাসে দুশো করে শোধ করে দেবে।

জরিমানার টাকায় গাঁয়ের সবাই মিলে ভোজ খায়। মদ খায়।

সরসিজ ডাইন সম্পর্কিত বহু তথ্য সংগ্রহ করে। ঝাড়গ্রাম থেকে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা বের করে সরসিজের বন্ধু তরুণ ষড়ঙ্গী। ওই পত্রিকায় একটা লেখা দেওয়া যাবে। সরসিজ ওর ডায়ারিতে বিভিন্ন সময়ে লেখে:—

শুধু অশিক্ষিত নয়, শিক্ষিতরাও অনেকেই ডাইনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। আমাদের স্কুলের ক্লার্কের নাম সিংরাই মুর্ম। বি কম পাশ। তার বক্তব্য এরকম— ডাইনি হল আমাদের মহা জ্বালা। ডাইনের জন্য লোকে শত্রু হচ্ছে, কুটুমের দুয়ার বন্ধ হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীতে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে। ডাইনি না থাকলে আমাদের অনেক সুখ থাকত। আমাদের সরকারি অফিসাররা তো অনেক পড়াশোনা করে ডব্লু বি সি এস পাশ করেছে। ওরা যে কী করে ডাইনি সম্পর্কে এত ভুল বুঝে কে জানে। এইসব হাকিমরা বলে, ডাইন নাকি নেই। ডাইন যে আমাদের খায়, ওরা বিশ্বাস করে না। বলে—কই, দেখি, আমার আঙুলটা খাক, তবে তো বিশ্বাস করব। ওদের কী করে বুঝাই ছুরি বঁটি দিয়ে তো ডাইন খাচ্ছে না। ওরা রক্ত শুষে নিচ্ছে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ডাইনরা রাতে জমা হয় জাহির স্থানে, কিংবা কোনও বনে। যাবার সময় নিজের পুরুষের কাছে একটা ঝাঁটা রেখে চলে যায়। পুরুষমানুষ ওই ঝাঁটাকেই নিজের মেয়েমানুষ ভাবে। ডাইন…

স্কুলের অঙ্কের স্যারের নাম নিরঞ্জন মাহাতো উনি ভাবেন, ডাইনরা রক্ত শুষে খেতে না পারলেও নজর দিতে পারে। উনি বলছেন, চোখ একটা লেন্স। লেন্সের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো যদি এক নির্দিষ্ট কেন্দ্রবিন্দুতে ফেলা যায়, তবে আগুন জ্বলে ওঠে। ঠিক তেমনি করেই যদি কোনও শিশুর ওপর চোখ দিয়ে ফোকাস করা যায়, যদি দৃষ্টিশক্তিকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফেলা যায়, তবে সেক্ষেত্রেও অলৌকিক ফল দেবে। ডাইনি, ওঝা, গুনিনরা প্রতিদিন নিজেদের দৃষ্টিশক্তি নানা উপায় বাড়ায়। মাঝে মাঝে ওরা টেস্ট করে কেমন হল। গাছের লাউ বা কুমড়োর ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে। যদি লাউ বা কুমড়ো পচতে শুরু করে, তখন সে বুঝতে পারে, ওর কিছুটা সাকসেস হয়েছে। তারপর মানুষের ওপর প্রয়োগ করে। একেই বলে নজর লাগা।

আমি বলি— লেন্স, মানে কনভেক্স লেন্স আলোকে কনসেনট্রেট করে, এটা ঠিক। কিন্তু চোখ তো আলোকে কনসেনট্রেট করে সামনে নয়, পেছনে। রেটিনায়। ওটা চোখের মণির পেছনে থাকে। চোখ তো আলোকে সামনের দিকে ফেলতে পারে না, কারণ চোখ কোনও আলোর উৎস নয়…

বলে জীবনবিজ্ঞানের স্যারের দিকে তাকাই। সমর্থন চাই। উনি চুপ করে থাকেন।

জান বিদ্যা কী করে এল সেই গল্প পরেশবাবুর কাছ থেকে শুনেছিল সরসিজ।

যারা জানবিদ্যায় পারদর্শী তারাই জানগুরু। জান, ভকত, সখা, মাতি, দেওড়াদের জনসাধারণ থেকে কিছুটা বেশি জ্ঞানী বলে মনে করা হয়। দেওড়া বা দেহুরা হচ্ছেন ধর্মীয় পুরোহিত। ওঝারা রোগব্যাধি সারান।

সাঁওতাল সমাজের প্রধান হলেন মাঝি। জগমাঝি হলেন নৈতিকতার রক্ষক, পারাণিক হলেন মাঝির সহকারী। দোহুড়া বা নাইকে হলেন পূজারি। ওঝা হলেন চিকিৎসক। সখা হলেন ওঝার সহকারী। জানগুরু মন্ত্র ইত্যাদির প্রয়োগ করেন।

কোনও মানুষের অসুখ বিসুখ হলে ওঝার কাছে যাওয়াই নিয়ম। ওঝা তাঁর জ্ঞানমতো গাছগাছড়ার ওষুধ দিলেন। যদি ভাল হল তো ভাল। যদি না ভাল হল তো, শালপাতায় তেল পড়া করে বুঝলেন কোনও বঁগা (বোংগা) অনিষ্ট করছে কি না, বা নজর লেগেছে কি না। অপদেবতা বা বঁগা ছড়ানোর ক্ষমতা গাছগাছড়ার নেই। নিজের জানা মন্ত্রে ওই বঁগা ছাড়ানোর চেষ্টা হল। যদি এর পরও রোগ না সারে, তবে ওঝার অধ্যায় শেষ। তখন জানগুরুর কাছে যাওয়া হয়।

জানগুরুর কাছে যাওয়ার সময় নিয়ে যেতে হয় সরষের তেল। জানগুরু দুটি শালপাতাতে তেল মাখাবে, আর মন্ত্র পড়বে।

জেলা গেজেটিয়ারে উদাহরণ হিসেবে এরকম একটা মন্ত্র আছে। ‘তেল তেল রায়ে তেল, মাম তেল, কুসুম তেল, ই তেল পড় হায়েতে, কী উঠো, ডান উঠো, ভূত উঠো, ফু সিন উঠো, বিষ উঠো, কে পড়হে, গুরু পড়হে, গুরু আগতা মন্ত্র পড়হে।’ এলাকা এবং জানগুরু ভেদে মন্ত্র পালটে যায়। এবং মন্ত্র সাধারণত গুপ্ত থাকে। বংশ পরম্পরায় ওই মন্ত্র চলতে থাকে।

জানগুরু মন্ত্র পড়ে, পাতাটাকে ভাঁজ করে কিছুক্ষণ মাটিতে রাখে। তারপর খুলে দেখে। তাই দেখে বলে—নজর, না বঁগা, না বাস্তু দেবতা নাকি ডাইন। যদি বঁগা হয়, তবে দেখে নেয় কোন বঁগা। যদি জজম বঁগা হয়, তবে তার জন্য মুরগির রক্ত দিয়ে পুজো করে মানত করতে হয়, আর জান মন্ত্র পড়ে জজম ছাড়ায়। বাঁখেড় করে। বাঁখেড় মানে মিনতি। যদি কালনা বঁগা হয়, তাকে ছাড়ানোর কায়দা আলাদা। যদি বাস্তু দেবতা হয় তবে চাল ছিটিয়ে পুজো করতে হয়। যদি ডাইনি হয়, তখন খোঁজ করতে হয় কে ডাইনি। গ্রামে যদি একাধিক অসুখ-বিসুখ-অঘটন হয়, তখন বহু ক্ষেত্রেই ডাইনের কাজ ভাবা হয়। তেল মাখানো শালপাতার গায়ে নাকি ডাইনের ছবি ফুটে ওঠে। জানগুরু সেই ছবির একটা বর্ণনা দেয়। এই থেকে একটা ধারণা করে গ্রামের লোকেরা।

এরপর আরও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য একটা ক্রিয়া আছে। তার নাম ‘ঢাউরা বিৎ’ বা ডাল পোঁতা।

ডাইন সম্পর্কিত লোকবিশ্বাসটা এইরকম—কেউ কেউ ডাইনি হয়েই জন্মায়, কেউবা জন্মের সময় ডাইনি না হয়েও অন্য ডাইনির কাছ থেকে ডাইনি বিদ্যা শিক্ষা নেয়। কিংবা কোনও মেয়ে অমাবস্যা রাত্রে বঁগা আহ্ণান করে ডাকিনি হবার প্রার্থনা জানায়। যদি জমম বা ছিপাড়ি বঁগা কৃপা করে, তো ডাইনি বিদ্যা পাওয়া যায়। একবার দীক্ষা হয়ে গেলে অমাবস্যার রাত্রে এলো চুলে উলঙ্গ অবস্থায় ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে বঁগার সঙ্গে মিলিত হতে পারলে ডাইনদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।

পাঁচ

সোনারাম ইচ্ছে করলেই প্রতি শনিবার দেশে যেতে পারে না। কারণ স্কুল পাহারাও ওর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবু মাঝে মধ্যে যায়। সোমবার স্কুল শুরু হবার আগেই চলে আসে। এই শনিবার ও দেশে গেছে। দেশে ওর বউ আছে, দুটো ছেলে আছে। সোমবার চলে গেল, সোনারাম ফেরেনি। মঙ্গলবারও ফিরল না। হেড মাস্টারমশাই সরসিজকেই জিজ্ঞাসা করল— কী ব্যাপার? আপনার সোনারামের কী হল? আসছে না কেন? যেন সোনারামকে জিম্ম নিয়েছে সরসিজ৷

মঙ্গলবার রাত এগারোটা নাগাদ সরসিজের দরজায় ধাক্কা। দরজা খোলার আগে জানলা দিয়ে টর্চ মারল সরসিজ। দেখল সোনারাম।

দরজা খুলতেই সোনারাম লুটিয়ে পড়ল সরসিজের পায়ে।

স্যার, বঁচাই দেন। মোর হিলিকু মারি দিবে।

কী হয়েছে ঠিক করে বললা। সরসিজ সোনারামকে ওঠায়। ওর মুখ থেকে, সারা শরীর থেকে মদের গন্ধ। মহুয়া।

মু পাপিষ্ঠাটা…।

জানি তো তুমি পাপিষ্ঠ। কী হয়েছে বলো।

সোনারাম যা বলল, তা সংক্ষেপে দাঁড়ায়— আগামীকালই ওর বউদিকে মেরে ফেলা হবে। কারণ ওদের গ্রামে দুটো গোরুর বাঁট থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। একজন রক্তপায়খানা করে মারা গেছে, আর কুমোর ঘরের একজন লোকের কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছে। আবার জানগুরুর কাছে গিয়েছিল গাঁয়ের লোক, একই কথা বলেছে। আবার ঢাউড়া বিৎ করা হয়েছিল। ওদের পরিবারের নামে যে ডালটা, সেটাই শুকিয়ে গিয়েছিল। তারপর কেবল ফুলমতীর নামে আলাদা ঢাউড়া বিৎ করা হয়েছিল। ওই ডালটাও শুকিয়ে গেছে। সুতরাং অকাট্য প্রমাণ। এবার দশ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছিল।

তখন সোনারামের ওপরের দাদা আর সোনারাম পরামর্শ করে ঠিক করল, এর চেয়ে ফুলমতীকে মেরে ফেলাই ভাল। গাঁ মাঝি বলল, আরও একজন জানগুরুর পরামর্শ নেওয়া হোক। জামডি গ্রামে অন্য এক জানগুরুর কাছে যাওয়া হল। কিন্তু ওই জানগুরুর ফুলবাড়িয়াকে আগেই বলে রেখেছিল সোনারামের ওপরের দাদা। ওই জানগুরুও তেলখড়ি করে বলে দেয়— গোলমুখ, বিধবা, কেন্দু গাছের পাশে ঘর। বয়স দুই কুড়ি।

সুতরাং ফুলমতী না হয়ে যায় না। দু’জন জানগুরু একই কথা বলেছে, এরপর আর কথা হয় না। কালই মারা হবে। সুতরাং ওকে যে ভাবেই হোক বাঁচান। বউদি আমার জন্য অনেক করেছে।

সরসিজ বলে, তুমিই তো বলেছিলে তুমি ওর মৃত্যু কামনা করো। ও মরে গেলে ওর জমি তোমরা দু’ভাই বিক্রি করবে…। সোনারাম বলে, কহিথিলি, কহিথিলি। ভুল কহিথিলি। পাপ কথা কহিথিলি…. মারাংবুরু জানে ওর বউদি কত ভাল। মুরগি রান্না হলে সবাইকে ভাল মাংস দিয়ে ও শুধু গলাটা খেয়েছে। সোনারামের বিয়ের পরপর সোনারামকে চুপি চুপি মুরগির ডিম খাইয়েছে বলেচে, তোমার এখন দরকার…। এই বউদির মরণের মিটিং-এ সায় দিয়েছে সোনারাম।

সোনারামের চোখের জলে মাঝরাত্তিরের তারার আলো পড়েছে। ও বলছে—স্যার, মু পাপিষ্ঠ। মু খারাপ। ইবার আমার হিলিটারে বাঁচান স্যার।

সরসিজ বলে, আমি কী করে বাঁচাব? তা হলে তো পুলিশকে বলতে হয়।

যা ভাল বুঝেন।

ঠিক আছে। বাড়ি যাও।

সরসিজ এরপর জল খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারত, কিন্তু ঘুম এল না। মাথার মধ্যে ওর জ্যাঠামশাই ষড়ানন পণ্ডা কেবল বলতে লাগল—এবার দেখি তুই কী করিস। আমার সম্পত্তি নিবি, বিছানায় স্পঞ্জ লাগাবি, মোটর সাইকেল হাঁকড়াবি। বদলে কিছু দিবি না? কিছু না?

সকালবেলা স্কুলে গিয়ে সোনারামের সঙ্গে দেখা করল সরসিজ। বলল, থানায় চলো।

কাল রাত্রের সোনারাম এখন আর নেই। পেটের মহুয়া এতক্ষণে মূত্র হয়ে গেছে। সরসিজ বলল—চলো সোনারাম, থানায় চলো।

সোনারাম বলে—মু যাইবিনি স্যার, মু থানায় নালিশ করিচি শুনিলে সব্বু মোকে মারি পকাই দিবে। আমি বললাম, ওসব হবে না। তোমার বউদির কেস। তোমাকে যেতেই হবে। এফ আই আর হয় আমিই করব।

থানায় গেল ঠিকই। কিন্তু পথে কোনও কথা বলল না সোনারাম। আবার এটাও বলল না যে, থানায় যাবার দরকার নেই। ও সি তখন জিলিপি খাচ্ছিলেন। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। বয়েস বেশি নয়। তিরিশের ঘরেই যেন। সরসিজ বলল, অসময়ে এসে ডিস্টার্ব করলাম স্যার। কিন্তু কিছু করার নেই, আসতেই হল। আমি এখানকার স্কুলের শিক্ষক। আজই একটা ডাইনি হত্যার কথা আছে, প্লিজ কিছু করুন।

কোথায়?

পত্রাশোল গ্রামে।

জামডি হিলাডি পত্রাশোল?

সরসিজ সোনারামের দিকে তাকায়। সে মাথা নাড়ে।

সরসিজ বলে—এর বউদিকেই ডাইন করা হয়েছে।

ওসি জিজ্ঞেস করে—খড়িতেলা হয়ে গেছে?

সোনারাম মাথা নাড়ে।

ওসি-র নাম লেখা আছে ঘরের সামনে। সঞ্জয় প্রামাণিক।

ওসি বলে, বাঘমুণ্ডি থানায় আমার যখন পোস্টিং ছিল, একজনকে বাঁচিয়েছিলাম। পরে ওই মেয়েটার অঙ্গনবাড়িতে চাকরি হয়েছে।

তা হলে একেও বাঁচান। সরসিজ বলে।

এই কাজগুলিই তো পুলিশ জীবনের বোনাস। এখানে এসেছি আট মাস হল। এ ধরনের কেস এই প্রথম। একটা এফ আই আর করতে হবে।

সরসিজ লেখে— বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল, পত্রশোল গ্রামের হীরারাম মুর্মর বিধবা স্ত্রী ফুলমতী মুমুকে ডাইনি সন্দেহে… সইটা সরসিজই করে। সোনারামকে দেখিয়ে বলে, ওকে ইনভলভ করছি না। ওর বিপদ হবে।

ওসি দু-একটা ফোন সেরে নেয়। ইউনিফর্ম পরে নেয়। ড্রাইভারকে ডেকে পাঠায়। পনেরো মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে যায় সঞ্জয়বাবু। সঙ্গে আরও দু’জন কনস্টেবল।

জঙ্গল, পাহাড়, উঁচু-নিচু লাল পথ।

সরসিজ বলল, আপনাকে দারুণ লাগল। এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বেন ভাবতেও পারিনি।

ওসি বলল, আপনাকেও দারুণ লাগল স্যার। একজন গ্রুপ ডি স্টাফের ফ্যামিলির জন্য এভাবে এগিয়ে আসা…

আমি নিজে না এসে যদি সোনারাম আপনার কাছে আসত, এ ভাবে অ্যাকশন নিতেন?

অন্যরা কী করত জানি না, আমার কথা বলতে পারি, আমি একই ব্যবহার করতাম। বুঝলেন না? নাপিতের ছেলে। এই ফার্স্ট জেনারেশন ক্ষৌরকর্ম ছেড়ে পুলিশে এসেছি। উৎসাহটা একটু বেশি। আরে বাবা, পুলিশে ঢুকেছি যখন কামাই হবেই। কিন্তু এসব কাজে না বেরোলে নিজের দেশটাকে জানা হয় না। গভর্নমেন্ট থেকে ঘন ঘন সার্কুলার আসছে—মাওবাদীদের সম্পর্কে অ্যালার্ট থাকো। জানগুরুদের ব্যাপারে অ্যালার্ট থাকো, ডাইনি মারার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নাও—এসব কিন্তু আসে না…। আমি একবার একটা জানগুরুকে ধরে, ওদের মন্ত্রগুলো স্টাডি করেছিলাম। কী আশ্চর্য জানেন, ওই মন্ত্রের মধ্যে সাঁওতালি শব্দের চেয়ে বাংলা শব্দ বেশি। এসব নিয়ে বোধহয় কোনও রিসার্চ হয়নি, বুঝলেন…।

একটা নুড়ি ভরা নদী পার হল জিপ। নুড়ি খুঁড়ে বালি, বালি খুঁড়ে জল বের করছে বালক–বালিকা। ওসি বলছেন, সব সময়েই যে সম্পত্তির জন্য ডাইন মারে, তা কিন্তু নয়। এমনি বিশ্বাস থেকেই এটা করে। অসুখ বিসুখ না সারলে। অসুখ বিসুখ রোগব্যাধি হলে আগে তো ওষুধই খায়। জড়িবুটির ওষুধ। ওষুধে কাজ হলে তো ডাইনির প্রশ্নই আসে না। আসলে কী জানেন, আমাদের দেশে রোগেরও অভাব নেই— রোগীরও অভাবে নেই। অভাব শুধু ডাক্তার আর ওষুধের।

মাথা বোঝাই শুকনো ডালপালা নিয়ে বুড়োবুড়ি চলেছে লোধাশুলি। হোটেলে বেচবে। জ্বালানি। বারো দু’ গুণে চব্বিশ কিলোমিটার হাঁটতে হবে।

ওসি বলছে—পুলিশের গাড়ি দেখলেই কিন্তু গ্রামের লোকজন পালিয়ে যাবে। খুঁজে পেতে জানগুরুকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে, কিন্তু লাভ হবে না। কেস দেওয়া যাবে না। খুন হলে কেস দেওয়া যায়। থ্রি হান্ড্রেড টুতে ফেলা যায়। পুলিশ চলে গেলেই মেয়েটাকে ওরা মেরে ফেলবে। মেয়েটাকে বাঁচাতে গেলে ওকে আগে সরিয়ে ফেলতে হবে। ওকে নিয়ে আগে একটা ভাল জায়গায় রাখুন। তারপর জানগুরুকে ধরে ওকে ভয় দেখিয়ে অন্যরকম তেলখড়ি করাতে হবে। জানগুরু বলবে, ও এখন আর ডাইন নয়।

পত্রাশোল পৌঁছল গাড়ি। পরিপাটি করে নিকোনো মাটির বাড়ি। বাড়ির বাইরে রং, ভিতরে বিবর্ণ।

পুলিশের গাড়ি দেখে কেউ পালাল না। ওদের ভয় কী? গাঁ মাঝি নিজেই যখন নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধি। গ্রাম প্রধান বেরিয়ে এল। নাম ধানুকা মাঝি। অকুতোভয়। আরও দু-একজন বেরিয়ে এল—কড় হেলা?

এরা ওড়িয়াই বলে। সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় বাংলা, বিহারে হিন্দি, ওড়িষ্যাতে ওড়িয়াই বলতে হয় ওদের।

ওসি-র সেভাবে ওড়িয়া রপ্ত হয়নি এখনও। ও বাংলাতেই বলে— এখানে নাকি আপনারা একজনকে ডাইনি সাব্যস্ত করেছেন।

ওরা চুপ। এ ওর দিকে চায়।

একজন বলতে চাইল, ডাইনকে তো ডাইন বলতেই হবে। এর মধ্যে আর আশ্চর্যের কী আছে?

গাঁ মাঝি বলছে, আমরা এমনি এমনি ডাইনি বলিনি। ঢাউড়া বিৎ হয়েছে। ওই দেখুন। একটা জলজমা নাবাল জমির দিকে আঙুল। কতগুলো ডাল পোঁতা। বলে, দেখ ফুলমতীর নামে সাকেৎ করা ডাল ঝুঁকাই যাইচি।

ওসি বলে, এসব বুজরুকি ছাড়ো। এসব ডাইন করা চলবে না। দেশে আইন আছে। পুলিশ আছে। সব ক’টাকে ধরে নিয়ে যাব।

ওরা কোনও কথা বলে না।

ফুলমতীর ঘর কোনটা দেখাও। সঙ্গে চলো।

ওরা ঘর দেখিয়ে দেয়।

ঘরে সোনারামের বড়ভাই মোতিরাম নেই। ও বোধ হয় পালিয়েছে।

কোথায় ফুলমতী?

ফুলমতী ঘরেই ছিল। ফ্যাকাসে সিন্থেটিক শাড়ি পরা। বিমর্ষ।

ওসি বলে, একে তোমরা ডাইনি বলছ? কেন? তোমাদের ঘরের বউ না ও?

একজন বলল, ও অমাবস্যার রাত্রে একা একা জঙ্গলে যায়। আমরা দেখেছি।

থামো। যতসব আজগুবি। যাদের অসুখ বিসুখ করেছে, তারা হাসপাতালে যাও। ঠিক মতো ডাক্তার দেখাও। ফুলমতীকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। কদিন পর ফেরত দেব। তখন যেন কোনও অসম্মান না হয়।

ফুলমতীকে বলল— যাও। প্রাণে বাঁচতে চাও তো গাড়িতে ওঠো।

ছয়

ইস্কুল ঘরে মেয়েছেলে একা কী করে থাকবে? তাই সরসিজের বাড়িতেই রইল ফুলমতী। জ্যাঠামশাইকে একটা জম্পেশ করে চিঠি লিখল সরসিজ। সব কীর্তি সবিস্তারে লিখল। বেশ গর্ব অনুভব করছে সরসিজ। জ্যাঠামশাইয়ের যদি বয়েস কিছু কম হত, একটা বিয়ে লাগিয়ে দেওয়া যেত। ডাইনি বিয়ে করতে জ্যাঠামশাই সাগ্রহে রাজি হয়ে যেত। জ্যাঠামশাইয়ের জীবনে একটা বড় অ্যাচিভমেন্ট হয়ে যেত। সব খবরের কাগজে একটি বড় নিউজ হত। সরসিজও একটা বলার মতো কথা পেত— জানেন, আমার জেঠিমা একজন ডাইনি…।

আজ পাঁচ দিন। পাশের ঘরে ফুলমতী থাকে। সোনারাম চাল ডাল এনে দিয়েছে। একটা কেরোসিন স্টোভও। ফুলমতী নিজেই রান্না করে খায়। দরজা সারাদিন বন্ধই রাখে। কারুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে না। সরসিজ কান পেতে কান্না-টান্না শোনার চেষ্টা করেছে। তাও শোনেনি। স্নান-টান কখন করে, সরসিজ জানে না। সরসিজ স্কুলে গেলে হয়তো করে নেয়। বাইরে একটা কুয়ো আছে। কিন্তু এখানে ক’দিন রাখা যাবে? একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। বিডিওকে চিঠি লিখেছেন সঞ্জয় প্রামাণিক। স্কুলের প্রেসিডেন্টকে ভাল লোক মনে হয়েছিল সরসিজের। ওঁকে জানিয়েছিল ঘটনাটা। উনি বললেন, কাজটা তো থিয়োরিটিক্যালি ভাল। কিন্তু প্রাকটিকাল হল না। নিজে এভাবে ইনভলভ হলেন, ভাল কথা, কিন্তু নিজের বাসায় কেন রাখলেন? গভর্নমেন্টের ঘাড়ে দিয়ে দিন।

সরসিজ বলল, আপনিও একটু চেষ্টা করুন।

রাত্রে ঘুম আসছিল না সরসিজের। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আর কতদিন এভাবে রাখা যাবে? ফুলমতীর বয়স এমন কিছু বেশি নয়। সন্তান-টন্তান হয়নি। পাশের ঘরে একা। কে কী ভাবে ফাঁসিয়ে দেবে ঠিক নেই। প্রেসিডেন্ট ঠিকই বলেছিলেন। কাজটা ঠিক হয়নি। সোনারামও এখন অন্যরকম। গম্ভীর। আনমনা। গত পাঁচ দিনে দু’দিন মাত্র এসেছে। কী করা উচিত? সোনারামকে কি কালই বলে দেবে তোমার হিলিকে নিয়ে যাও, যা করার করো।

আচ্ছা, মেয়েটার যদি বয়েসটা আরও কম হত, কুড়ি-বাইশ হত এবং ডাইন ডিক্লেয়ার্ড হত, তা হলে কি ওকে পার্মানেন্টলি বাঁচাবার জন্য বিয়ে করতে পারত সরসিজ? নিজেকেই প্রশ্ন করে ও।

পাগল—না মাথাখারাপ? নিজেই উত্তর দেয়। দূর থেকে ট্রাকের হর্নের শব্দ আসছে ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে মিশে। প্যাঁচার ডাকও শোনা যায় মাঝে মাঝে। কয়েক দিন রাত্রে শেয়ালের ডাকও শুনতে পেয়েছে সরসিজ।

বিছানার পাশে জানলাটা খোলা। জানলা দিয়ে অন্ধকার আসছে গলগল করে। গাঢ় অন্ধকারে কয়েকটা তারা যেন দিশেহারা। আজ কি অমাবস্যা? নিঝুম সরসিজ আকাশ তারার দিকে তাকিয়ে থাকে।

একটা শব্দ হল। দরজার কবজার। পাশের ঘরের দরজাটির ব্যবহার হত না বলে দরজায় শব্দ হয়। ফুলমতী দরজা খুলেছে? দরজার পাল্লা বন্ধ করার শব্দটাও শোনা গেল। ফুলমতীও বুঝি নির্ঘুম? ও কি এখন বারান্দায় একা বসে থাকবে?

জানলার পাশ দিয়ে একটা শরীর চলে গেল। ছায়ামূর্তি। ফুলমতীই। একটিই বাথরুম রয়েছে বাড়িতে। তবে ওরা বাথরুমে অভ্যস্ত নয় বলে বাইরেই যায়।

জানলা দিয়ে অন্ধকার আসে, আর নৈঃশব্দ্য। ভাদ্র বাতাস থম মেরে আছে।

আর কোনও শব্দ নেই। পায়ের আওয়াজ নেই, পাতার খসখস নেই, অনেকক্ষণ হয়ে গেল। ফুলমতী ফিরছে না কেন?

সরসিজ বিছানা ছেড়ে উঠল। জানলার শিক ধরে দাঁড়াল। মনে হল অন্ধকারের ভেতরে আরও একটা অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে।

সরসিজ টর্চটা নেয়। আস্তে আস্তে দরজা খোলে। টর্চটা জ্বালায় না। পাশের ঘরের দরজা খোলা। ও আস্তে আস্তে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। পায়ের তলায় পরে নেয় রহস্য নৈঃশব্দ্য। চরাচর অন্ধকার।

প্রাচীরের ধারে চারখানি বড় শালগাছ ডালে ডালে অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই আর একটি ছোট গাছ যেন। সরসিজ টর্চের বোতাম টেপো আলোয় কেঁপে ওঠে একটা মনুষ্য শরীর। নিরাবরণ। দু’হাত আকাশের তারার দিকে তোলা। টর্চ নিভিয়ে দেয় সরসিজ। ডেকে ওঠে— ফুলমতী! এই প্রথম নাম ধরে ডাকল সরসিজ।

থম মারা ভাদ্র হাওয়ায় হালকা হিম। বনজ গন্ধ। প্যাঁচার ডাক। সরসিজ শাল গাছগুলির দিকে এগিয়ে যায়। আবার টর্চের আলো ফেলে।

দু’ হাতে শরীর ঢেকে শাল গাছতলে বসে আছে উলঙ্গিনী ফুলমতী।

সরসিজ বলে, তুমি কি সত্যিই ডাইনি, ফুলমতী?

ফুলমতী কান্না থামিয়ে বলে, ডাকিনিটিও হই পারিলি নি যে… ডাকিনিটি ও হই পারিলি নি যে…

আলো নেভায় সরসিজ।

অন্ধকারের মধ্যে আরও এক অন্ধকার উঠে দাঁড়ায়। কেবল বলে— দয়া নাই।

সরসিজ বলে— যাও, কাপড় পরে নাও।

একটু পরে সরসিজ ফুলমতীর ঘরের সামনে দাঁড়ায়। বলে, তুমি ডাইন হতে চেয়েছিলে?

হ।

কেন?

না হেলে কন করিবি মু? মোর তো কিছি নাই। কেহ নাই। কিছি করিবার নাই যে…।

ও বলতে চাইছিল, ও যদি সত্যিই ডাইনি হতে পারত, তবে, তবু তো কিছু ক্ষমতা পেত, শক্তি পেত, বাঁচার একটা মানে পেত, কিছুই পায়নি যে সারাজীবন। কোনও অধিকার। সবাই যখন ডাইনি বলছেই ওকে, তা হলে সত্যি-সত্যিই ডাইনিই হয়ে উঠুক না কেন।

সেই প্রার্থনাই করছিল এই ভাদ্র অমাবস্যায়— জজম বঁগা, ছিপাড়ি বঁগার কাছে, মাঝ আকাশের তারার কাছে, থম মারা বাতাসের কাছে।

গল্পগুচ্ছ, শারদ ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *