১১ই সেপ্টেম্বর

১১ই সেপ্টেম্বর

দুটো কাজ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। পাশপোর্ট আর ইউরিন রিপোর্ট। দুটোই পজিটিভ।

আমাদের বিদেশে যাওয়া হয়নি। এমনকী বাংলাদেশেও নয়। ভূটানকে যদি বিদেশ বলা যায় তো একবার আলিপুরদুয়ার থেকে ফেরার পথে ফুন্টসেলিং গিয়েছিলাম, আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে গেছে, ছবি তুলে এনে দেখিয়েছে, সেন্ট উপহার দিয়েছে,—ওহো, সেন্ট নয়, পারফিউম। ওমলেটকে মামলেট বলা ছেড়েছি, মানিব্যাগকে পার্স বলি, কিন্তু সেন্ট বলা ছাড়তে পারিনি এখনও, দিল্লি গেলেও কচৌড়ি না বলে কচুরি। খুব দামি, সাজানো, ঝলমলে দোকানে ঢুকতে আজও ভয় পাই, তবু মাঝে মাঝে ঢুকে যাই তবে অভ্যাস হয়নি এখনও, মাঝে মাঝে বাড়িতে চিজ আনি, কর্নফ্লেকস আনি, ভালবাসি না খেতে, আমার এখনও দুধমুড়ি বেটার লাগে, দই চিঁড়েও, তবু ওসব এমনি এমনি খাই। ছেলেটা অবশ্য ভালই বাসে, রচনা ততটা নয়। বোঝাই যাচ্ছে, রচনা আমার বউ-এর নাম। ক’দিন আগে রচনার জন্য একটা ক্রিম এনেছিলাম, বিদেশি, সাড়ে সাতশো টাকা দাম। আসলে গছিয়ে ছিল অফিসের সহমর্মী, সহকর্মীর চেয়েও বেশি। বস। উনি ‘অ্যাময়’ করেন। কে জানে কেন করেন, ওঁর তো অনেক টাকা। ওদের ডাবল ইঞ্জিন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে চাকরি করেন। গাড়িও আছে। গাড়িটা ওদের অফিসে পৌঁছে দিয়েই ভাড়া খাটাতে চলে যায়। গাড়ি থেকেও আয় আছে, প্লাস ‘অ্যাময়’-এর আয়। আমাদের অফিসের অনেকেই এখন ওঁর টিমে আছে। অফিসটা অ্যাময়ময় হয়ে গেল। আমাকেও বলেছিলেন উনি ‘অ্যাময়’ করতে। অ্যাময় করানোর টুপি পরানোর নাম হচ্ছে কার্বনগেসিং আমাকে কার্বনগেসিং করানোর সময় আমার বস আমাকে ওদের সিঙ্গাপুর ভ্রমণের ছবিগুলো দেখিয়েছিল। বোধ হয় তখনই—আমার মনের গর্ভে বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছেটার গর্ভ সঞ্চার হয়। ভাবলাম বাংলাদেশ তো যাওয়াই যেতে পারে, এমন কী খরচা। থাইল্যান্ডও যাওয়া যায়। ব্যাংককের প্লেন ভাড়া দিল্লির মতোই তো। খুব ইন্দোনেশিয়া যেতে ইচ্ছে করে। ট্যুরিজম কোম্পানিগুলির বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করি। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ছবিগুলো বিজ্ঞাপনে ‘অ্যামাজিং আমেরিকা’ দেখি। না, তাই বলে অ্যাময় করতে পারব না। এখনও আমি মাঝে মাঝেই বিড়ি খাই, বিশেষত যখন ফি বাজেটে সিগারেটের দাম বাড়ে। দাম বাড়লেই আমি সাধারণত এক বান্ডিল বিড়ি কিনে ফেলি, ভাবি ধূমপানের খরচটা মানে বাজে খরচটা কিছুতেই বাড়তে দেব না। কিন্তু সত্যি কথা বলছি ভাই, বেশি দিন হয়ে ওঠে না। আমাদের ডিএ-টাও বাড়ে কিনা, প্রাইস ইনডেকস এর সঙ্গে সঙ্গে তাই আর বিড়িতে বেশি দিন স্টে করা হয়ে ওঠে না। ছেলের হাত ধরে রাস্তায় বের হলে ভিখিরি পয়সা চাইলে পয়সা দি, ওর হাত দিয়েই দেয়াই। ও না থাকলে অবশ্য দিই না তেমন। জানি চার আনা আট আনা দিয়ে কোনও সমস্যার সমাধান হবে না বরং ভিক্ষাবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়া হবে। তাই বলে আমি জ্ঞান দিতেও যাই না—খেটে খেতে পারো না? আমাদের বাড়িতে এখন কাজের লোক আছে। যে ভাবে আমি মামলেট না বলে ওমলেট বলি, সেন্টের বদলে পারফিউম শিখেছি, বেশ্যার বদলে যৌনকর্মী শিখেছি, সে ভাবেই ঝি-চাকরের বদলে কাজের লোক শিখেছি। সে একটা বাচ্চা ছেলে। বছর দশেক বয়স। যদি বলেন শিশু শ্রমিক, আমি বলব হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আমরা না দেখলে ছেলেটা শেষ হয়ে যেত। মেদিনীপুরের ছেলে কেশপুর অঞ্চলের, ওদের গণ্ডগোলের ফল তো সবাই জানে। ছেলেটির মা ছিল না। কারও সঙ্গে ভেসে গিয়েছিল। বাবা আর জ্যাঠা এক রাতে এক সঙ্গে খুন হয়ে গিয়েছিল। ওই অনাথ ছেলেটিকে আমি দেখি। আমার বউ ওকে পড়ায়, আমার ছেলে যে আইসক্রিম খেয়েছে, ছেলেটিও সেই আইসক্রিম খেয়েছে। ও যদি আমাদের কাছে থাকে, ওকে পড়াব। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে ও। সামনের বছর স্কুলে ভরতি করিয়ে দেব। ছেলেটিকে দিয়েছিল আমাদের অফিসের এক গ্রুপ ডি স্টাফ। বলেছিল, স্যার, আমাদের দেশের হাল খুবই খারাপ। কাগজে যা দেখেছেন তা কিছুই না। একটা ছেলে স্যার, মা–বাপ-জ্যাঠা কেউ নেই, ছেলেটাকে রাখবেন? বলেছিলাম, আনো। ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া হল। কেমন অপু অপু দেখতে। হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার বাবাও আগে ফুল পাট্টি ছিল, এখন মিচুল করে লাল পাট্টি হয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি, আমার বাবাও ফুল পার্টি ছিল বলতে কী বোঝাচ্ছে? আমাকে কি তৃণমূল ভাবল নাকি? জেরা করায় বুঝলাম আমার লিভিং রুমে উইপ্রো কোম্পানির ক্যালেন্ডারে জোড়া সূর্যমুখীর ছবি দেখেছে। আর ‘মিচুল’ করতে হয়েছিল বলেই— ওদের খুন হতে হয়েছিল, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে। সত্যপ্রিয় ঘোষ আমাকে একটা গল্প বলেছিলেন। হ্যাঁ, লেখক, প্রাবন্ধিক সত্যপ্রিয় ঘোষ। এই লেভেলের কিছু লোকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল, এখনও দেখা হলে কথা হয়। ধীরেন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। থাকগে। সত্যপ্রিয় ঘোষ একটু গল্প বলছিলেন। ওদের বাড়িতে একটি কাজের মেয়ে এসেছে, কেউ নিয়ে এসেছে। ওর দেশে খুব গণ্ডগোল। কেশপুর অঞ্চলেই ওদের ঘর। ওর রেকসিনের ব্যাগে দুটো ফ্রক ছিল। একটার রং লাল, অন্যটা সবুজ। ও জিজ্ঞাসা করেছিল কোন জামাটা পরলে ওকে কেউ মারবে না। থাকগে যাক। আমাদের ঘরে এখন যে-ছেলেটা থাকে কাজের লোক বলছি, হ্যাঁ, ও ঘর মোছে, আমার ফাইফরমাশ খাটে, আমার ছেলের তো কোনও বন্ধু নেই, একটাই তো ছেলে। গতবার মাধ্যমিক পাশ করেছে। ভালই করেছিল। তো ভীষণ ব্যস্ত। হায়ার সেকেন্ডারিতে যা প্রেসার। তবু যা হোক ছেলেটার সঙ্গে টুকটাক গল্প করে। ও, ছেলেটার নাম বলিনি এখনও,—অর্জুন। নামটা বেশ। কোথাও বেড়াতে গেলে ওকেও নিয়ে যাই। আমার ছেলেটা ভালই হয়েছে বলতে হবে। কমপ্লেক্স নেই। ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশে। সেদিন আমরা সবাই মিলে একটা বিয়েবাড়ি গিয়েছিলাম, বারুইপুরে। রাস্তায় একটা অদ্ভুত ধরনের গাছের ডাল কুড়িয়ে পেয়েছিল ছেলেটা। ও বাড়ি নিয়ে এসেছিল। অনেকটা সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো দেখতে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কী হবে এটা? কিছু বলে না, মানে আমার ছেলের কিন্তু খুব আর্টিস্টিক সেন্স। ও ওই ডালটার সঙ্গে প্লাস্টিকের ফুলটুল মিশিয়ে দিব্যি একটা ‘ইকেবানা’ করে ফুলদানিতে রেখে দিল। ইকেবানা জাপানি ব্যাপার। জাপান কখনও যাওয়া হবে না। ওখানে হোটেলের অনেক চার্জ। যখন হবে তো হবে, পাশপোর্টটা তো করি, এই ভেবে পাশপোর্টটা-এর জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম। হয়ে গেল। তার পরই দুরু দুরু বক্ষে আইডিয়াল প্যাথোলজিক্যাল ল্যাব এর কাঠের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলাম। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার শব্দটা বুকের ধুকপুকির শব্দের সঙ্গে বেশ মানিয়ে যায়। কাউন্টার থেকে মৃদু হেসে এক মহিলা খামটা দিল। দেখলাম পজিটিভ। প্রেগনেনসির কানফার্মেশনের জন্য ওই পেচ্ছাব পরীক্ষাটা দরকার ছিল। পেচ্ছাপ বললে খুব খারাপ শোনায়, আর প্রস্রাব তো বলাই মুশকিল। লেখাও। দেয়ালের নিষেধে প্রস্রাব বানান দেখেছেন? পস্রাব, প্রস্বাপ, প্রসাব এরকম নানারকম। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে ছিলেন, হ্যাঁ, লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই বলছি, উনি হঠাৎ একজন কর্তব্যরতা নার্সকে বলতে শুনলাম—তুমি গতকাল আমার কাছ থেকে পেচ্ছাপ চেয়েছিলে? নার্সটি বলল—সে তো ইউরিন। টেস্টের জন্য।—ওই একই হল। আর তোমার বন্ধু ডলি আমার কাছ থেকে কী চেয়েছিল জানো? গল্প। একটা গল্প শুনতে চেয়েছিল তা হলে, তোমাদের দু’জনের তফাতটা বোঝ।

এখন আমি এরকম লাইট টক করছি বটে, কিন্তু এরকম গল্প করার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। আমার স্ত্রী প্রেগন্যান্ট। আমার বয়েস এখন পঞ্চাশ, ছেলের আঠারো। এই বয়সে আমি বাবা হতে চলেছি। রচনা, মানে বউ বলেছিল ইউরিন টেস্টে কী হল ফোন করে জানিয়ে দিতে। আমি ফোন করিনি। ফোনে খারাপ খবর দেয় কেউ? ইউরিন রিপোর্টটা জামার পকেটে। পাশপোর্টের পাশে। আচ্ছা, এটা ভুল হতে পারে না? কতই তো শুনি প্যাথলজিকাল টেস্টে ভুল হয়। আর এক বার করাব? কী ঝামেলাতেই না পড়লাম। আমার বউ এর বয়েস এখন পঁয়তাল্লিশ। ওর চুলে পাক ধরেছে। মেহেন্দি করেছে। আমার অফিসের অবস্থাও ভাল নয়। রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, একটা দাঁত পড়ে গেছে, দুটো নড়ছে। ব্যাপারটা এমন যে ও নিয়ে কারুর সঙ্গে পরামর্শও করা যায় না। আমার সেরকম বন্ধু নেই। ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই আর তেমন যোগাযোগ নেই। অফিসের কলিগদের মধ্যে এ ব্যাপারে পরামর্শ করার মতো সম্পর্ক কারুর সঙ্গেই তৈরি হয়নি। পাড়ায় যেসব পড়শিদের সঙ্গে জঞ্জাল ফেলা কোথায় হবে, কিংবা বিজয়া সম্মিলনীতে আশাকণ্ঠী ডাকা হবে নাকি বাংলা ব্যান্ড ডাকা হবে নিয়ে আলোচনা করা যায়, তাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার বাবা হওয়া উচিত কি না আলোচনা করা যায় না। ওই যে সত্যপ্রিয় ঘোষের কথা বলেছি, তাঁকে শ্রদ্ধা করি, অনেক উপদেশও নিই, যেমন ছেলেকে কোন স্ট্রিমে পড়াব, অ্যালোপাথি ভাল না আয়ুর্বেদ ভাল। এই যে ১১ই সেপ্টেম্বর ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টারকে ভেঙে দিল, এর ইমপ্যাক্ট কী হতে পারে এ নিয়ে আলোচনা করেছি, কিন্তু এখন আমি বাবা হলে কী এর ইমপ্যাক্ট এ নিয়ে ওঁর মতো লোকের সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। আমার মেজ শ্যালকের সঙ্গে ইদানীং আমার ভাব হয়েছে। এক সঙ্গে রাজস্থান ট্যুর করে এলাম। ওর সঙ্গে দেশি মুরগি ভাল না কি ব্রয়লার তাই নিয়ে আলোচনা করা যায় কিন্তু ওর বড়দির এ বয়সে মা হওয়া উচিত কি না আলোচনা করা যায়? ছেলেটা আমার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট। আসলে এরকম কোনও কথা ছিল না। আমরা বহুদিন ভাইবোন জীবন কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল। এ জন্য আমি দায়ী নই। দায়ী ১১ই সেপ্টেম্বর। যে দিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভেঙে পড়েছিল। রাত নটা নাগাদ খুলেছিলাম টিভি। তখনই দেখলাম আমেরিকা আক্রান্ত। বলে কী? আমেরিকা আক্রান্ত? সি এন এন, বি বি সি, সব চ্যানেলে দেখাচ্ছে কী ভাবে ধসে পড়ছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। ছবিগুলোর তলায় ক্যাপশান আমেরিকা অ্যাটাকড। পেন্টাগনের উপরেও বিমান হানা হয়েছে। পেন্টাগনেও। সেই পেন্টাগন? সি আই এর সদর দপ্তর? আমরা যে বলতাম সদর দপ্তরে কামান দাগো, পেন্টাগন উড়িয়ে দাও। ওগুলো তো সব আঠারো বছর বয়সের স্বপ্ন ছিল। আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি। তখন আত্মাকে স্বপনে সঁপেছিলাম। ভূপেশ, মানিক, পল্টু, বরেন, শ্যামল….। ভূপেশটা মারা গেছে। তখনই। বরেন ছিল জেলে, চার বছর। ওর হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে দিয়েছিল মেরে। এখনও খুঁড়িয়ে হাঁটে। ছোট্ট স্টেশনারি দোকান আছে। বরেনের কাছে যাই এখনও কখনও সখনও। এখন আর পুরনো দিনের কথা তোলে না। আমি তো আরও নয়। ভেবেছি এতদিনে সব চুকে টুকে গেছে।… সেই পেন্টাগনে বিমান হানা? কারা? কারা রে বরেন? মনে মনে বলি। আল–কায়দার কথা তখনও বলছে না। টিভিতে ওই দৃশ্যটা বার বার দেখাচ্ছে। একটা এরোপ্লেন এল, জয়ধ্বজার মতো মাথা উঁচুনো বাড়িটার গায়ে ধাক্কা মারল, আগুন, ধোঁয়া এবং বাড়িটা ধসে পড়ল। তখন মুখে ‘ইশ’ বলেছিলাম, কিন্তু আমার সত্তার ভিতর থেকে আঠারো বছর বয়সটা হাততালি দিচ্ছিল বেশ বুঝতে পারছিলাম। আঠারো বছর তো কবে শেষ হয়ে গেছে তবু কেন আসে, মাইরি তবু কেন আসে? ওই যে বিমানটা, যেন স্বপ্নের যেন রূপকথার। সেই তিরিশ-বত্রিশ বছর আগেকার পোষা স্বপ্নটাকে বয়ে নিয়ে এল যেন। বার বার দেখাচ্ছে সেই অলৌকিক বিমান। আমি দেখছি। রচনা বলেছিল, ইশ, কতলোক মারা গেল…। আমি বলেছিলাম, কতলোক মারা গেছে ভিয়েতনামে, চিলি-পেরু–বলিভিয়া-আর্জেন্তিনা-ইরাকে? রচনা বলেছিল, তাই বলে নিরপরাধ এই সব লোকগুলোকে…। ভিয়েতনামের লোকরাও তো নিরপরাধ ছিল। আমি বলি। বলেই ভাবলাম এটা কোনও যুক্তি নয়। অন্যায়ের বদলে অন্যায় নয়। খুনের বদলা খুন নয়। রক্তরাজনীতি থেকে বহুদূরে সরে এসেছি তো। তবু আমার বুকের ভিতরে লুকোনো কোন কন্দহরের গুহায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা আঠারো বছরের দুষ্ট ছেলে ঘাড় নাচিয়ে হাততালি দিয়ে বলে—বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে। আর পঞ্চাশ বছরের আমি শশব্যস্ত হয়ে ওকে বলি, অ্যাই, কী হচ্ছে, চুপ, চুপ। বারবার সেই—অলৌকিক বিমানটিকে দেখাচ্ছে টিভির পর্দায়, যে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল আমেরিকার জয়ধ্বজা। কে রয়েছে? কে চালাচ্ছে ওই আত্মঘাতী বিমান? ওখানে ভূপেশ রয়েছে, ভূপেশ। সেই ভূপেশ, আমার বন্ধু। কলেজ হোস্টেল থেকে তুলে নিয়ে খুন করা হয়েছিল ওকে। সেদিন মানে ১১ই সেপ্টেম্বর বেশ রাত্রি পর্যন্ত টিভি দেখেছিলাম। দেখলাম বিধ্বস্ত পেন্টাগন, দেখলাম আমেরিকা প্রেসিডেন্টের ফ্যাকাশে মুখ তখন শরীর জুড়ে বয়ঃসন্ধির হাততালি। রচনাকে আদর করতে ইচ্ছে করল। খুব বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করল। বিধ্বস্ত আমেরিকার সামনে সেদিন আমাদের বিরল সঙ্গম। সম্ভবত সেই রাত্রেই গর্ভবতী হয় রচনা। সম্ভবত কেন বলছি, ইউরিন টেস্ট তো পজিটিভ। কিন্তু রচনা যে এ ভাবে এ বয়সে গর্ভবতী হয়ে যাবে আমি ভাবতেই পারিনি। ও গত এক বছর ধরেই মাঝে মাঝে হঠাৎ ঘেমে উঠত। মাঝে মাঝেই বলত খুব গরম লাগছে। আমি তো জানি, ওসব হচ্ছে প্রি-মেনোপজ সিনড্রোম। রচনাও জানত এসব বন্ধ হয়ে আসছে। এমনিতেই বোধ হয় পিরিওড কিছুটা অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল, তাই পিরিওড মিস করাটাকে আমল দেয়নি। মুশকিলটা হল বমি শুরু হবার পর। সকালবেলার বমি। মর্নিং সিকনেস। রচনা বলেছিল, ব্যাপারটা যে অন্যরকম লাগছে। অন্যরকম বলতে যে ও প্রেগন্যানসি বোঝাতে চাইবে সেটা আমি আদৌ ভাবিনি। কিন্তু রচনাই বলল—না গো, আমার কিন্তু ভাল মনে হচ্ছে না, সেই রকম মনে হচ্ছে। সেই রকম মানে? আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। রচনা বলল— আঠারো বছর আগে, খোকন হবার সময় যেরকম লেগেছিল। এমা, আমার এবার কী হবে…। এরপর যা হয়,— ডাক্তার দেখানো, ইউরিন টেস্টের অ্যাডভাইস…। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে দেখাইনি। লজ্জা করেছিল। একটু দূরের এক অচেনা ডাক্তারকে দেখিয়ে ছিলাম। ওই ছোকরা ডাক্তার খুব মুখ টিপে হাসছিল। সেই হাসির মধ্যে লেখা ছিল এখনও বেশ রসে বশে আছেন দেখছি…। ডাক্তার কিছু জিজ্ঞাসা করেনি, আমিই আগ বাড়িয়ে বলেছিলাম—এখন আর আমাদের ওই সব হয় টয় না, হলেও মাসে দু’মাসে এক আধ বার—। আসলে ওর তো থেমেই গেছে…। ডাক্তারটা একবার আমাকে দেখছে, একবার রচনাকে, আর মুচকি হাসছে। তারপর বলল—থেমে গেছে মনে হয়, কিন্তু থামে না। থেকে যায়। ইউরিনটা করিয়ে নিন। সেই ইউরিন করিয়েছি, এটা নিয়ে বাড়ি যাব। এখন যেখানে থাকি, জায়গাটার আগে নাম ছিল সুরের মাঠ। মানে সুরদের মাঠ। সুর পদবিওলা পরিবারের অনেকটা নাবালে জমি ছিল এখানে। অনেকটাই ডোবা, কচুরিপানার জঙ্গল, ঘাস জঙ্গল, এইসব। শামুক-ঝিনুক খুব হত বলে শামুক খেতে পাখি আসত, আরও সব শীতের পাখি। অনেক সাদা সাদা বক। এখন ডোবা ভরাট হয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি উঠেছে। ঘাস জঙ্গল নেই। লাইটপোস্ট। শুকনা ঘাস দ্বারা শৌখিন দ্রব্য তৈরি শিক্ষা দেয়া হয়। বিজ্ঞাপন। এখানে এখন জিম, সাইবার কাফে, পিৎসা কর্নার, লাফিং ক্লাব। যারা বাড়িতে, আপিসে কখনও হাসেন না, ভোরবেলায় ওয়ান টু থ্রি বলে হাসেন। এখন ওই সুরের মাঠের নাম হয়ে গেছে সুরবিহার। সুরবিহারে ঢুকতে গেলেই একটা আর্ট কলেজ। ইনডিয়ান আর্ট কলেজ। আগে এই আর্ট কলেজটা ছিল ধর্মতলা স্ট্রিটে, আর এই বাড়িটা ছিল দমদম মতিঝিল কলেজের হোস্টেল। হোস্টেলটা উঠে যাবার পর আর্ট কলেজটি এই বাড়িতে চলে আসে। আমি ছিলাম দমদম মতিঝিল কলেজের ছাত্র। ওই হোস্টেলে আসতাম। বন্ধুরা ছিল। ওখানে অনেকেই হোস্টেলের দেয়ালে পোস্টার মারত গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো, কৃষি বিপ্লব জিন্দাবাদ, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, পেন্টাগণের সদর দপ্তরে কামান দাগো। ওখানে ভূপেশ ছিল, শ্যামল ছিল, বরেন ছিল। ওই হোস্টেলে অনেক সময় কাটিয়েছি আমি। টেবিল বাজিয়ে গান করেছি হেই সামালো ধান হো কাস্তেটা দাও শান হো। সেই সঙ্গে আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি কিংবা নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়। ভূপেশটা বেশ গাইত। ওই সত্তরের দশকটা এক আশ্চর্য দশক। যত সব দারুণ প্রেমের গান, এ সময়েই দারুণ সব নাটক, সিনেমা, আবার ওই সময়েই সাঁইবাবা, পাড়ায় পাড়ায় শনি পূজার ঠেক, জীবন যৌবন, সুন্দর জীবন, এইসব পত্রিকা। মতিঝিল হোস্টেলেই ওই ধরনের পত্রিকা দেখি। দেশব্রতীও। মতিঝিল কলেজের ওই হোস্টেলের দক্ষিণের জানালা দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসত, আর জানালা দিয়ে দেখা যেত কচুরিপানাময় জলা জমি। হোস্টেলের কয়েকটা ছেলে ওই জলা জমিতে কেন যেন যেত। ওখানে পুলিশ দুটো বন্দুক খুঁজে পেয়েছিল। সি আর পি-র কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া বন্দুক। হোস্টেল রেট হয়েছিল। বরেন তখনই ধরা পরে। ভূপেশ ছিল না। এরপরই হোস্টেলটা বন্ধ করে দেয়া হয়। ভূপেশ কিন্তু দমদম অঞ্চলেই থাকত। একটা বাড়ি ভাড়া করেছিল৷ ওর আসল বাড়ি ছিল তমলুক। ভূপেশ বি এস সি পরীক্ষাটা দিল না। ওই অঞ্চলের সংগঠনের দায়িত্বটা অনেকটাই ছিল ভূপেশের উপর। ভূপেশ গোপনে দেখা করত আমার সঙ্গে। ভূপেশ একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিল। খুব সুন্দর একটা সমাজের। এজন্য একটু কষ্ট, একটু রক্তক্ষয়। সে তো সব যুগেই হয়ে এসেছে। আমিও স্বপ্নে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। তখনই বাবা আমাকে দিল্লি পাঠিয়ে দিল মামার কাছে। ভূপেশ দিল্লির ঠিকানাটা জানতে পেরেছিল, আমাকে চিঠিতে লিখেছিল—দিল্লিতেই কাজ কর। লাল কিল্লা পর লাল নিশান মাঙ্গ রহা হায় হিন্দুস্থান।

ঠিকানা দেয়নি, তাই শ্যামলকে একটা উত্তর দিয়েছিলাম। এর কিছুদিন পরই একটা মিটিং হয় কবরডাঙায়। যেসব ডাক্তারবাবুরা বেশি ফি নিচ্ছেন তাদের কী করা হবে তাই নিয়ে। এইসব পরে শ্যামলের কাছেই শুনেছি। শ্যামল বলেছিল ভূপেশ আমার পাঠানো চিঠিটার উত্তরে আমাকে নাকি একটা চিঠি লিখেছিল, তাতে দিল্লির কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য কিছু নাম ঠিকানা ছিল। চিঠিটা ওর পকেটেই ছিল। মিটিং থেকে ফেরার সময় পুলিশ ওদের ধরে। ভূপেশ তক্ষুনি ওর পকেট থেকে আমাকে লেখা চিঠিটি খেয়ে নেয়। এ ভাবেই ভূপেশ আমাকে বাঁচায়। এরপর পুলিশ ওকে নিয়ে যায় সুরের মাঠে। শ্যামল পালিয়েছিল, কিন্তু ভূপেশ আর ফেরেনি। সে সময় সুরের মাঠ ছিল বধ্যভূমি। এরপর তো বহুদিন কেটে গেছে। অনেক শহিদ বেদির ফলকের অক্ষরমালা বিবর্ণ হয়ে গেছে। রাজা গেছে রাজা এসেছে। মতিঝিল কলেজের ওই হোস্টেল এখন আর্ট কলেজ। পিছনের সুরের মাঠ ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে সেজে এখন সুরবিহার। এই সুরবিহারেই আমার বাড়ি। ফ্ল্যাট নয়, বাড়ি, একতলা। ৮০০ স্কোয়ার ফিট। ওখানে জমি কিনি বেশ কয়েক বছর আগে। তখন সদ্য সদ্য ডোবা ভরাট চলছে। আমি দু’ কাঠা জমি কিনি। এখনকার দামের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হয় সস্তাতেই জমিটা কিনেছিলাম। আমাদের সবার পেটে তখন চর্বি জমতে শুরু করে দিয়েছে। বিপ্লব করতে যাওয়া একদা তরুণদের ক্ষত চিহ্নগুলি মসৃণ হয়ে গেছে ততদিনে, নন্দনও হয়ে গেছে, ওখানে চোয়াল ঝুলিয়ে বিদেশি সিনেমা দেখছি আমরা, তখনই অফিস থেকে লোন টোন নিয়ে বাড়ি করতে শুরু করি। হ্যাঁ, ছোট করে ভিত পুজোও করতে হয়েছিল। আর ভিত খোঁড়ার সময় একটা কঙ্কাল উঠে এসেছিল। হঁ, কঙ্কাল। কঙ্কাল! না-না, ওটা ভূপেশের নয়, ভূপেশের কেন হতে যাবে? এই মাঠে আরও কত মার্ডার হয়েছে। মজুরেরা গোটা কঙ্কালটা উঠিয়ে একটা বাবলাগাছের তলায় রেখে ছিল। কাঁটা সাজানো বাবলাগাছের চারিপাশে তখন অনেক প্রজাপতি। ওই কঙ্কালটাকে দেখব না ভেবেও দেখেছিলাম। ওর চোখ ছিল না। ওখানে তীব্র শূন্যতা ছিল। ও কি ভূপেশ? আমাকে লেখা চিঠিটা ও খেয়ে ফেলেছিল। তারপর ও মরে গেছে। আমাকে লেখা না পাঠানো চিঠিটা ওই কঙ্কাল শরীরের ধূসরে লেখা আছে। সারা কঙ্কাল জুড়ে চিঠি। ওঃ। কাউকে বলিনি সে কথা। বউকে তো নয়ই। কঙ্কালটাকে কারা যেন নিয়ে গেল ডাক্তারি ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে দেবে বলে। ওই কঙ্কালের কথা মাথায় আসতেই, ও কিছু না ও কিছু না, ভূপেশের কেন হতে যাবে ভাবতে ভাবতে বাড়ি করে ফেললাম, হোয়াইট সিমেন্ট, বাথরুমে মার্বেল, কমোড, গ্লেজড টাইলস, রান্নাঘরে একজস্ট ফ্যান, ব্যালকনি, বার। দিব্যি কাটছিল। ভালই ছিলাম। সুরের মাঠের নাম পালটে সুরবিহার বানিয়ে, ফ্ল্যাট অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করে, দেবদারু লাগিয়ে, দোলনা লাগিয়ে মর্নিংওয়াক করে দিব্যি আছি। গাড়ি কিনবার কথাও ভাবছি। ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াব। ক্যাপিটেশন ফি যদি না দিতে হয় তবে গাড়িটা কিনেই ফেলব। কম্পিউটার কিনেছি। কম্পিউটারের আমি সামান্য কিছু জানি। ছেলে আমার চেয়ে বেশি জানে। মাঝে মাঝে আমরা দু’জনে ইন্টারনেটে ঢুকি। একটা ভ্যান হুসেনের জামাও কিনে ফেলেছি হুট করে। বউ সেদিন চুল ছোট করে কেটে এল। হকার উচ্ছেদে আমার সায় আছে। বুদ্ধবাবু বেশ চালাচ্ছেন মনে হয়। কাশ্মীরে পাকিস্তানিরা সন্ত্রাস চালাচ্ছে এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া উচিত। এরই মধ্যে ওয়ার্লড ট্রেড সেন্টার টেঁসে গেল, পেন্টাগনে বিমান হানা, আমার বউএর ইউরিন টেস্ট পজিটিভ।

আমি কী করব এবার?

এই বয়সে রচনার গর্ভ আবার নতুন করে কিছু রচনা করতে যাবে নাকি। মাথা খারাপ? ওটাকে অ্যাবরেট করতে হবে। এখন তো বেআইনি নয়, একটা ভাল নার্সিংহোম ঠিক করতে হবে, আর একজন ভাল গাইনি। কোনও রিস্ক নেয়ার সিন নেই।

আমি বুক পকেটে পজিটিভ নিয়ে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি পায়চারি করছি, বাড়িতে ঢুকছি না। গেলেই রচনা জিজ্ঞাসা করবে, তখন কী বলব? তারপরই ফিসফাস হবে কিছুক্ষণ। ছেলেকে তো এসব বুঝতে দেয়া যায় না। ঢুকলেই রচনা জিজ্ঞাসা করলে আমি বলব পরে পরে। আমাদের দুটো ঘর। এক ঘরে আমরা, অন্য ঘরে ছেলে। আর অর্জুন থাকে লিভিংরুমে। ছেলে রাত বারোটা সাড়ে–বারোটা অব্দি পড়াশুনা করে। আমরা অনেক দিন ধরেই আমাদের ঘরের দরজা আটকাই না। কোনও গুহ্য কথা বললে ব্যাটাচ্ছেলে ঠিকই শুনতে পাবে। কাল বলব। সকালে ছেলে কোচিং-এ যায়।

একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবছি কোন নার্সিংহোমে যাব। ছেলেকে কী গুল দেব। যদি বলি একটা ছোট্ট টিউমার হয়েছে, অপারেশন হবে। কোথায়? না ইউটেরাসে। ছেলে কি বুঝে যাবে? কী ফ্যাসাদেই না পড়লাম। স্রেফ একটা বিমান হানা আমার বউকে গর্ভবতী করে দিল? ভাবছি, আর পায়চারি করছি। এমন সময় দেখি আমাদের কম্যুনিটি হলের সামনে লাল কালিতে লেখা একটা পোস্টার: ‘অন্ধ্র, বিহার আর নেপালের কমরেড, লাল সেলাম’। সে কী? আমাদের কলোনিতে নকশাল? থামেনি এসব? ডাক্তারটা বলেছিল থেকে গেছে মনে হয়, থামে না। আবার আর একটা। মাও সে তুং জিন্দাবাদ। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। একটা গ্যারেজের গায়ে আরও। অন্ধ্র আর বিহারের কৃষক সংগ্রাম দিকে দিকে ছড়িয়ে দাও। আবার ওই ভিতরের কন্দহরে লুকিয়ে থাকা আঠারো বছর হাততালি দিয়ে ওঠে। আমি বলি, এসব সন্ত্রাস! সন্ত্রাস! বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এখানেই POTA আসছে, POCA আসছে। আঠারো বছর বলে, তোদের বাঁধন যতই শক্ত হবে…। আমি ওকে বলি ঝামেলা করিস না, তুই যা, তোরা এখন সন্ত্রাস। ওই আল কায়দা, হিজবুল, লস্কর-ই তৈবার মতন। ভুল ছিল, ভূপেশ, তোরা ভুল ছিলিস।

এখন কাগজে প্রায়ই নকশালদের খবর। এম সি সি। জনযুদ্ধ..। থানা দখল, রাইফেল লুঠ এইসব খবর। হিজবুল, লস্কর-ই-তৈবা, জৈস-এ-মহম্মদ—আল কায়দার সঙ্গে মিশিয়ে। নেপালে কোকাকোলার কারখানা ধ্বংস করল মাওবাদীরা। আমি সন্ত্রাস চাই না। শান্তিতেই আছি। নিজের বাড়ি। আমার খাবার জলে আর্সেনিক নেই, আমার ছেলে এইট্টি এইট পার্সেন্ট নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে, আমার অফিস চিকিৎসার সব খরচ দেয়। টাকাও জমেছে। ফরেন যাব। দিব্যি আছি। গাড়িও কিনব। আগে এই উটকো ঝামেলাটা মিটিয়ে নিই।

বাড়ি যাই। বউয়ের চোখ উৎসুক। আমি মুখে আঙুল দিই। রচনা জিজ্ঞাসা মাখিয়ে একটাই শব্দ উচ্চারণ করল—খারাপ?

আমি মৃদু মাথা নাড়ি। সব কিছু গম্ভীর হয়ে যায়। টিউবটার আলো, ভারী পর্দা, এমনকী ফুলদানিতে রাখা প্লাস্টিকের রজনীগন্ধাও তখন গম্ভীর। সুখের ডাইনিং টেবিলে কোনও কথা নেই। ছেলে বলল, এবার বোধ হয় টেরোরিজম খুব ইম্পরট্যান্ট। এসে কম্পোজিশন বইতে টেরোরিজম নেই।

আমি কোনও জবাব দিই না। ছেলে বলল, বাপি, ক্ষুদিরাম কি টেররিস্ট ছিল? জবাব দিই না। এসময়ের আঠারো বছর জবাব খোঁজে। শুয়ে পড়লাম। নীল আলোটা কী গম্ভীর। রচনা আমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলে, আমার কী হবে? আমি মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, খুব ভাল জায়গা থেকে করিয়ে আনব। যা লাগে লাগবে। এক দিনের তো মামলা। ঘুমোও। আমি ঘুমোতে চেষ্টা করি। রচনাও করে বোধ হয়। একটু পরেই কান্নার শব্দ শুনি। ওর মুখে হাত চাপা দিই। থামো কান্না থামো। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি, খোকন শুনে ফেলবে। ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম ভাঙাল ভূপেশ।

দেখি হাঁটুর উপর ধুতি, খালি গায়। অনেকটা বালক বীরের মতো দেখতে। হাতে তির-ধনুক। বলে—কীরে শালা ভুঁড়িওয়ালা ভেবেছিস সব থেমে গেছে? আমি আসছি আবার। আমি এখন তোর বউএর গর্ভে আছিরে।

উঠে পড়ি। জল খাই। গম্ভীর নীলে রচনা ঘুমোচ্ছ।

ও রচনা, পুনর্জন্ম বিশ্বাস করো তুমি?

রচনা চোখ খোলে।

ঘুমোওনি বুঝি? আমিও না।

রচনার মাথায় হাত রাখি। বলি, বলো না, পুনর্জন্ম হয়?

রচনা কিছু বলে না। গম্ভীর নীলে দেখি রচনার চোখের কোনায় চিকচিক জ্বলে জানি না জানি না জানি না। রচনার মাথায় হাত রাখি। বলি, বড্ড ভাবছ তুমি। বলছি তো কিছু না। কিউরেটিং মেশিন বেরিয়েছে। অ্যাবরশন করিয়ে দেব। খোকন স্কুলে যাক, কালই প্ল্যান করব সব। একদম মাথা ঠান্ডা করে।

রচনা বলে, এত দিন পর যে আসছে ওকে আমরা মারব, প্ল্যান করে মেরে ফেলব। এটা কোনও সন্ত্রাস নয় তো? বলো?

বলি, ঘুমোও। দীর্ঘশ্বাস। আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সন্ত্রাস।

সকাল হলে ছাদে যাই। দেখি ভোরের রোদ্দুর মেলে ধনুক পড়ে আছে একটা। ছোট্ট একটা ধনুক। বালক বীরের বাহুর মাপে তৈরি। খুব ভয় পেয়ে সরে আসি। দূর থেকে দেখি। হ্যাঁ। ধনুক। সেই সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো কাঠটা। বারুইপুরের রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল অর্জুন। খোকন ওটাকে ইকেবানা করেছিল। এখন ওই কাঠের দু’পাশ কাপড়ের পাড় দিয়ে জুড়ে ধনুক করেছে কে?

শারদ অনুষ্টুপ, ২০০২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *