রামযতনের বাগান

রামযতনের বাগান

ওই এক কথা রোজ রোজ। ডাবুদা, অপিস চললেন? ও তো জানেই আমি অফিস যাচ্ছি, রোজই যাই, গত তিন মাস ধরে এ পথেই যাই। হেড অফিস থেকে বদলি হয়েছি গোডাউনে। গোডাউন কিপার, বলা যায় প্রমোশনই। বাস থেকে নেমে গ্যালিফ স্ট্রিটের খাল বরাবর হেঁটে গেলে চিৎপুর রোড। ওখানেই আমার গোডাউন। এটাই আমার পথ। আমি কোনওদিন চোঁ করে চলে যাই, ও দেখতে পায় না। রোদ্দুরে বা বর্ষায় ছাতা দিয়ে আড়াল করি মুখ, ও দেখতে পায় না। দেখতে পেলেই—

ডাবুদা, অপিস যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

ভাল আছ?

হ্যাঁ।

বউদি ভাল?

হ্যাঁ।

ছেলেটা?

হ্যাঁ।

আ-আ-চ ছা। ঘাড়টা বেশ খানিকটা কাত করে ও। আমার ভাল থাকার ইনফর্মেশনে ওর খুশির কারণ আমি বুঝি না, কিন্তু আমার ঝামেলা–ঝামেলা লাগে। কোনও কোনও দিন আবার দু’বেলাই দেখা হয়ে যায়। বাড়ি ফিরবার সময় ওই একই জিনিস, শুধু অপিস যাচ্ছেন-এর বদলে বাড়ি ফিরছেন?

এই স্বল্প সময়ের সংলাপ যখন চলে, তখন আমি কিন্তু দাঁড়াই না। চলতে-চলতেই উত্তর দিই। অনেকটা এগিয়ে গেলে শুনি— পরে একদিন অনেক গল্প করব, অ্যাঁ? ক্কচিৎ আমিই বলি— তুই ভাল আছিস তো জীবন?

জীবন তখন ওর জীবন–কাহিনি বলতে শুরু করে। যেমন, মেয়েটাকে নিয়ে তো জানোই কী ভুগছি, এদিকে আমারও গ্যাস্ট্রিক। কালো পায়খানা হল। এইসব পেট্রল-মবিলের গ্যাস পেটে যাচ্ছে না? গাঁদালি পাতার ঝোল খাচ্ছি ক’দিন। টিপিন কৌটো করে বউ এসে দুকুরবেলা দিয়ে যাবে। …আমি আস্তে আস্তে পা চালিয়ে চলে যাই। ও বলতে থাকে…।

সেদিন আমাদের অফিসে ছিল ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতা। ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, গ্যারেজটা আসতেই জীবন ধরল। আরে ব্বা বা–বা… তোমার ছেলে বুঝি? বলেই এগিয়ে এল। তেল কালি মাখা গেঞ্জি, কালিঝুলি মাখা হাত, আদর করে আর কী। এরপর থেকে শুরু হয়েছে প্রেজেন্টেশন। কোনওদিন একটা পাকা পেঁপে দিয়ে বলে, রামযতনের বাগানে হয়েছে, ছেলেকে খাওয়াবেন ডাবুদা, লিভারটা ভাল থাকে। কিংবা এক গোছা কাঁঠালি চাঁপা দিয়ে বলে, নিন ডাবুদা, রামযতনের বাগানের।

বাগান শুনলেই একবার এ দিকটায় তাকাতে হয়। দেখি কাঁঠালি চাঁপা গাছটা কত বড় হয়ে গেছে, দেখি ফুলভরতি করবী, জুবা, একঝাঁক কলাবতী গাছ। আমরা বলতাম রামযতনের বাগান। রামযতন ঢালু হয়ে জলের দিকে যাওয়া খালপাড়ে বেড়া বেঁধে ফুলগাছ লাগিয়েছিল। আমি ছোটবেলায় দেখেছি রামতন ভোরবেলায় ওর বাগানে খাটিয়া পেতে বসে থাকত। আমি ওর বুকের ঘড়ঘড় শুনতে পেতাম। রামতন ছিল হাঁপানি-রোগী। মাঝে মাঝে ওকে দেখতাম কীরকম হাঁটুমুড়ে উপুড় হয়ে অনেকটা প্রণাম করার কায়দায় পড়ে থাকত খাটিয়ায়, ওটাই ওর ঘুমোনো। ও থাকত খালধারের পাশে বস্তির একটা খুপরি ঘরে। একটা কালি তৈরির ছোট কারখানায় কাজ করত রামতন। ঠান্ডা লাগলে হাঁপানি বাড়ে বলে ঠিকমতো স্নান করত না। ফলে ওর পাকা গোঁফের রং কখনও দেখতাম সবুজ, কখনও লাল। ওই কারখানায় কখনও লাল কালি তৈরি হত, কখনও নীল বা সবুজ। রামযাতনের চুল আর গোঁফের রং-ও সেভাবে পালটে যেত, ওর গায়ের চামড়ারও একটা অদ্ভুত রং হয়ে গিয়েছিল। যখনই সময় পেত রামতন, খুটখুট করে বাগানের কাজ করত। ভোজপুরী না কী যেন ভাষায় গাছের সঙ্গে কথা বলত,— তোহার কা ভইল বা, তানি পানি লৈব? গাছে ফুল ফুটলে রামতন ফুলেদের সঙ্গে হাসত, আমার মা ফুল তুলতে যেত বাগানে, রামতন উঁচু গাছের ডাল নিচু করে দিত।

রামযতনের মরে যাওয়াটা এক রহস্য। আমার মা বিশ্বাস করতেন, ওর প্রাণ ছিল একটা স্থলপদ্ম গাছে। আমার বাবা ইসলামপুর থেকে এনে দিয়েছিলেন ওই ডাল। ওটা নিয়ে রামযাতনের কী যত্ন, দুপুরে ছাওয়া করে রাখা, রাতে শিশির খাওয়ানো, জল দেওয়া। একদিন ডাল থেকে নতুন পাতা বেরুবার খবর দিতে এল রামতন, সঙ্গে চারটে লাড্ডু। বাবার ইসলামপুরের ঠিকানা চেয়ে নিয়ে গেল, বাবাকে চিঠিতে জানাবে এই সুখবর। বাবা ওখানে বদলিতে ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই খুব ফুল ফুটতে শুরু করল, অনেক। রামতন মাঝে মাঝে একটা বড় কলাবতী গাছের পাতায় নিয়ে আসত দু-চারটে স্থলপদ্ম ফুল। মা লক্ষ্মীর আসনে দিতেন। কিছুদিন পর গাছটা শুকিয়ে যেতে লাগল আর রামযাতনের শরীরটাও। রামতন খেত না, খেলেই বমি হত, বস্তির ছেলেদের বলত, ধরাধরি করে বাগানে নিয়ে যেতে। জীবন ছিল রামযাতনের চ্যালার মতো। রামতনকে বাগানে পৌঁছে দেওয়া আর ঘরে নিয়ে যাওয়া ছিল ওর ডিউটির মধ্যে। একদিন ভোরবেলা ওর সারা গায়ে অনেক শেফালি ফুল ঝরে পড়েছিল। ও মরে গিয়েছিল। স্থলপদ্ম গাছটা কাঠ কাঠ। আমি দেখতাম, ওই নিষ্পত্র স্থলপদ্ম গাছটা আকাশের দিকে শুকনো ডালপালা মেলে কেবলই হায় হায় করত। জীবন মাঝে-মাঝেই ওই শুকনো গাছটার গায়ে হাত বুলোত, তন্ময় হয়ে গাছটার কী দেখত কে জানে। ও খাল থেকে মাটির হাঁড়িতে তুলে আনত পাঁক, ঢালত ওই শুকনো গাছের গোড়ায়, জল দিয়ে স্নান করাত, মাটি খোঁচাত, ট্রাম ডিপোর পাচিল থেকে ঘুঁটে চুরি করে এনে গুঁড়ো করে দিত। আমি তখন সবে সিগারেট খাওয়া শিখেছি। রামযতনের বাগানের নিমগাছ তলায় লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছি, জীবন হঠাৎ চ্যাঁচাল, দেখুন, দেখুন ডাবুদা, গাছটার জীবন এয়েচে ফের। দেখি, ছোট ছোট দুটো সবুজ পাতার কুঁড়ি বেরিয়েছে গাছটার গা থেকে। জীবন পরদিন কিশোরকুমারের ‘এক পলকে একটু দেখা, আর একটু বেশি হলে ক্ষেতি কী’, গাইল বাগানে নেচে নেচে, ক্রমশ আর একটু বেশি পাতা গজাল আর বর্ষা এলে নতুন নতুন পাতায় ভরে গেল ওই গাছ। এসময় জীবন রক্তবমি করে।

জীবনের মা আমাদের বাড়িতে কাজ করত। মোক্ষদা না কী যেন নাম ছিল। ও আমার মা–র কাছে এসে কেঁদে পড়ল। বউদি, আপনার পদ্ম গাছটা ডাইনি, আমার কচিকে খেল। জীবনের মায়ের ধারণা ছিল, জীবনের থেকে প্রাণ-পরমায়ু টেনে নিয়ে ওই মরা গাছটা বেঁচে উঠল। আর জি কর হাসপাতালে দেখানো হল। জীবনের মা একদিন এসে বলল, বুকের ফটোক তুলা হয়েছে। বুকের কাঠি পোকায় ধরেছে। মা আঁতকে ওঠে।— ওমা, যক্ষ্মা! পদ্ম গাছ তখন ফুলে ভরতি।

জীবনের মা তখন একদিন করল কী, রাত্তির থাকতে বাগানে গিয়ে পদ্ম গাছটার গোড়া থেকে কেটে দিল।

জীবন ওর মা-র সঙ্গে আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। ‘নাইলন শাড়ি আর পাইলট পেন উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন’ ওর কাছেই শিখেছিলাম। এক পলকে একটু দেখা আর একটু বেশি হলে ‘ক্ষেতি কী?’ ‘ক্ষেতি কী’ বলার সময় অনেকটা ঘাড় ঝুঁকিয়ে দিত জীবন। জীবনই বোধহয় বয়সে আমার চেয়ে বড়, তবু ও আমাকে দাদা ডাকত। মা জীবনের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেছিল আমাকে। ও বড় কাশত। আমাদের লক্ষ্মী-ঠাকুরকে দেওয়া কলার টুকরো, শশার টুকরো চেয়েচিন্তে নিয়ে যেত জীবনের মা, জীবনকে ফল-ফলাদি খেতে বলেছিল ডাক্তার। জীবনের মা প্রায়ই এসে কান্নাকাটি করত, পাঁচটা ট্যাকা ধার দেন গো বউদি, জেবনকে দুধ খাবাতে কয়েছে, ডিম খাবাতে কয়েছে, মাইনে থেকে কেটে নেবেন। মা বলতেন, কত আর কাটব বলো জীবনের মা, মাইনে তোমার কবেই শেষ হয়ে গেছে। জানোই তো জীবনের মা, ডাবুর বাপ বাইরে থেকে নিজে খেয়ে যা পাঠায়, তাতে হয় না, বাড়ি ভাড়া, ডাবু–বাবলির পড়াশুনো, অন্য কারুর কাছে চাও।

জীবনের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছি ভাল আছি বলতে বলতে যদি একটু দাঁড়িয়ে যাই, ও বলে আসুন না ডাবুদা, বাগানটা দেখবেন, কেমন জবা লাগিয়েছি, বেগুনি রং, সাদা রং, হলুদ রংয়ের জবা,… আমার সময় হয় না, যাবার সময় অফিসের তাড়া, ফিরবার সময় সন্ধে হয়ে যায়, ছ’টা পর্যন্ত অফিস, বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে সাতটা, আমি না গেলে ছেলেটা পড়তে বসতে চায় না। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, একগাদা হোমটাস্ক।

সেদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। খালধারের রাস্তায় কোনও দোকান-টোকান নেই যে একটু দাঁড়াব। আমরা যে বাড়িটাতে থাকতাম, সেটা ভেঙে এখন চারতলা বাড়ি, আটটা ফ্ল্যাট। ওদের কাউকেই চিনি না, বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে আসতেই ছুটে যাই জীবনের গ্যারেজে। এসো ডাবুদা, একটা বনেট খোলা অ্যাম্বাসাডার থেকে ডেকে নেয় জীবন। গেট খুলে দেয়, বহুদিন পর জীবনের পাশে বসি।

বাড়ি ফিরছ?

হ্যাঁ।

ভাল আছ?

হ্যাঁ।

বউদি ভাল তো?

হ্যাঁ।

ছেলেটা?

হ্যাঁ।

তুমার বুনটা কেমন আছে গো? বাবলিদি? কতদিন দেখতে পাইনি।

ওরা গাড়ি কিনেছে।

তুমিও কেনো একটা ডাবুদা, না হয় সেকেন্ডহ্যান্ড, এখানে মাঝে মাঝে আসে৷ মালিককে বলেকয়ে কম দামে করে দেব।

গাড়ি? ধুস। কী যে বলিস জীবন!

কেন, কত ভাল চাকরি করো…

কী আর ভাল।

ওইসময় যদি নকশালি না করতে তবে আরও ভাল চাকরি করতে, তাই না ডাবুদা? ইস্কুলে ফাস বয় ছিলে তুমি, পন্টুদাকে মনে পড়ে ডাবুদা?

মনে পড়ে, কিন্তু মনে না পড়লেই ভাল। তবে তুমি ধারধোর করে কিনে লাও একটা, মাঝে মাঝে বার কোরো যেমন এরকম বিষ্টির দিনে, বউদি ঝা খুশি হবে না, …বউদি তো এম এ পাশ, নয়?

হ্যাঁ।

হে-বি শিক্ষিত, নয়?

কে জানে।

কে জানে বলছ কেন? আই এ, বি এ, তারপর তো এম এ, সবার লাস্ট। হে-বি কঠিন নয়?

হ্যাঁ।

তোমার বাড়িটা মোজাইক পাথরের না ডাবুদা?

না রে, পুরোটা পারিনি।

তোমার বাড়িটা একদিন দেখতে যাব, অ্যাঁ?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

কী করে যাব ডাবুদা?

ওই তো, কামারহাটি নেমে একটা রিকশা নিবি, বলবি রবীন্দ্র কানন…

যাব একদিন রোববার দেখে। পরিবার নিয়ে যাব। তোমার বউ কথাটথা বলবে তো?

কেন বলবে না?

তবে বোধহয় অহংকার নেই মোটে।

তোর ছেলেটার খবর কী জীবন?

পাঁচ বছর চলছে। ক, খ–র বই কিনে দিয়েছি।

আমি খেতে পাই, না-পাই, ওকে ম্যাট্রিক পাশ করাব। মেয়েটাকে নিয়ে বড় ভুগছি ডাবুদা।

মেয়ে হল কবে?

সে–কী? জানো না? কতদিনি বলেছি তোমাকে, ওর মাথার খুলিতে জল জমেছে, ওর তো বয়েস এক বছর হয়ে গেল।

কই, বলিসনি তো?

তুমি ভুলে গেছ ডাবুদা, কত কাজে থাকো, হয়েছে কী, ওর ছ’ মাস বয়স থেকেই ওর মাথাটা বড় হতে শুরু করেছে। আর জি কর-এ দেখালাম, বলছে ম্যাড্রাস না কোথায় কী হাসপাতাল আছে, ওভেনে চিকিচ্ছা ভাল হয়। কী করে দেখাব ডাবুদা, মটোর গ্যারেজে কাজ করে ক’ পয়সা পাই বলো, মেয়েটা আর বেশিদিন বাঁচবে না গো, জানো, মেয়েটা বাবা ডাকতে শিকেছে।

আমি হাত বাড়িয়ে দেখি বৃষ্টির তেজ। বৃষ্টি ধরে এসেছে। জীবন বলে, দেরি হয়ে যাচ্ছে ডাবুদা? বউদি ভাবছে, নয়? এটু দাঁড়াও, তোমায় ক’টা বেলফুল তুলে দি। হেবি সুবাস গো, বালিশের পাশে রেখে দিয়ে।

জীবনের পিছু পিছু যাই আমি। ও বাগানে ঢোকে। আমি ঢুকি না। অন্ধকারে কী দরকার, সাপখোপ থাকতে পারে। কী বিশাল হয়ে গেছে নিমগাছটা, একটা কাঠবিড়ালি সুড়ুৎ পালাল। এই নিমগাছের ডালে দোলনা বানিয়েছিলাম। ওইখানে পল্টুদা রাখত মালপত্র। ওইখানে ছিল স্থলপদ্ম গাছটা।…জীবন ফিরে আসে। বলে, একদিন একটু সময় করে এসো, একটা জিনিস দেখাব। এখন এই নাও। একমুঠো বেলফুল দেয়। টাটকা। আমি পকেটে রেখে বলি, জীবন, একদিন তোর মা ছুটে এসেছিল, আমার মাকে বলল, সব্বোনাশ, জীবন আমার রামযতনকে স্বপ্ন দেখেছে। ও আর বাঁচবে না। …জীবন বলে এখনও দেখি, স্বপ্নে নয়, এমনিতে, এই ধরো ফুলটুল ফুটলে, হাওয়ায় গাছের পাতা ঝ্যাকন নড়ে…। ফুলগুলো আলটিমেটলি আমি ফেলে দি ঠিক বাস থেকে নেমেই। বড্ড খোঁচা দিচ্ছিল। আর পারছিলাম না। জীবনটা যে কী…

মারহাট্টা খাল মজে গেছে। আগে লঞ্চ চলত, সুন্দরবনের লঞ্চ। ওই লঞ্চে করেই একদিন সুন্দরবন থেকে এখানে এসেছিল জীবনের মা আর এই খালধারেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল কলমিশাক তুলতে গিয়ে। যে লোহার পাইপ দিয়ে গঙ্গার মাটি যেত সল্টলেক ভরাট করতে, সেগুলো সরানোর কাজ চলছিল তখন, এখানে ওখানে লোহা-লক্কড়, জীবনের মায়ের মাথা ঠুকে গিয়েছিল এরকম এক লোহার টুকরোয়। বাঁচেনি।

ঠিক তার আগের দিন, মা ওকে বিদেয় করে দিয়েছিল— তোমার আর মুখ দেখতে চাই না, এত বড় আস্পদ্দা তোমার, এত বড় কথা বলতে পারলে?

স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের ঘটনাটা। আমি কলেজে পড়ি। ১৯৭১ সাল। কবিতা লেখার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে আমি লিখছিলাম ডাক্তারবাবুদের উদ্দেশে সতর্কবাণী। যে সমস্ত ডাক্তার রাত্রে রুগি দেখতে যাবার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছেন, তাঁদের সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। যে সমস্ত ডাক্তারবাবু চার টাকার বেশি ফি নিচ্ছেন, তাঁদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে…

আমি তখন বিশ্বাস করতাম, সত্তরের দশক মুক্তির দশক। পন্টুদারা বুঝিয়েছিল কৃষক গেরিলারা আর কয়েক বছরের মধ্যে কলকাতার দখল নেবে। আর তখন জঙ্গলময় ওই রামযাতনের বাগানে গোপনে মজুত হচ্ছিল পাইপগান।

জীবনের মা সেদিন তিরিশটা টাকা দিল মাকে। বলল, বউদি এই ধরো তিরিশটা ট্যাকা, আমার বাসনটা দ্যাও। জীবন তোমাদের আশীর্বাদে মতি সাহার মটোর কারখানায় কাজ করতিছে। এবার আমার বাসনটা দ্যাও। বাসন? কোন বাসন? মা খুব অবাক! সেই যে কাঁসার থালাটা গো, জেবনের অসুখের সময় বাঁধা দিলামনি? জেবনের ঝকন অক্ত বমি হল, বুকের কাঠি পোকায় ধরল, তকন চিকিচ্ছের জন্য দিলামনি?

মা বলল, ও ব্বাবা, সেই পাঁচ বছর আগেকার কথা ভুলেই গেছিলাম গো, সেটা বাসনের বাক্সেই আছে।

ছাঁৎ করে উঠল আমার বুকটা।

মা তক্তাপোশের তলা থেকে কেরোসিন কাঠের বাক্সটা টেনে নিয়ে বাসনপত্র নামাল। ফিরে এসে বলল, কই নেই তো তুমি ওটা ঠিক রেখেছিলে তো?

জীবনের মা আঁতকে উঠেছিল। কী যে বলো বউদি, পষ্টো রেখেছি…

মা বলল, আমরা কাঁসার বাসন ব্যবহারই করি না, অ্যালমনির বাটি, কলাই করা থালা আর ক’টা স্টিলের বাসন। এই তো, কাঁসাপেতল যা সামান্য আছে, সব ওই বাক্সয় । থাকলে ওখানেই থাকত, তুমি বোধহয় দাওনি।

এ কী কতা বলছ বউদি, তুমি ঝ্যাকন বললে, আর কত ধার নেবে জীবনের মা, কী করে শুধবে, মাইনের টাকা কবে শেষ হয়ে গেছে, আমি তখন ঘর থে কাঁসাটা নে আসনু। বলনু এটা ধরো, জেবনের ওষুধের জন্য কুড়িটা ট্যাকা দিতিই হবে, তুমি তখন দিলে। মা বলল,— আমারও পষ্ট মনে আছে, আমি রাখতে চাইনি ওই থালা, বলেছিলাম, না, থালাবাটি বাঁধা দিতে হবে না।

মিথ্যে বলব নি। তুমি বলেছিলে ওকথা। আর বলেছিলে, আরও তো বাড়িতে কাজ করছ, সবার থেকেই নাও, আমি বলনু, সবাই কি তোমার মতো লরোম কলজের লোক? তুমি কুড়িটা ট্যাকা দিলে, বাসনটা সরিয়ে রাখলে। মা ওকে বসিয়ে রেখে আবার খুঁজল। চৌকির তলা, আলমারির পিছন, এখানে-ওখানে। তারপর বলল, শোনো জীবনের মা, থালাটা হয় দাওনি, নয়তো পরে নিয়ে গেছ। যাবে কোথায়?

আমি প্রাণপণে চেপে রাখি আমার আর্তনাদ। জীবনের মা বলল, একটা থালা মেরে দিয়ে কি তুমি বড়নোক হবে বউদি? আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, মা হঠাৎ রেগে গেল। টাকাটা ওর মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, এতবড় আস্পদ্দা? আমি থালা মেরে দিয়েছি? আমার কাজ করতে হবে না। যেন আর মুখ না দেখি।…

থালাটা আমি চুরি করেছিলাম। আমি। মাত্র দিন দশেক আগে। আমি যে জানতাম না ওটা জীবনের মায়ের রাখা থালা। আমার টাকার বড় দরকার হচ্ছিল। বিভিন্নরকম কমিটমেন্ট ছিল আমার, টাকার দরকার। ওই বাক্সে আমাদের কিছু পেতল-কাঁসার বাসন আছে জানতাম। একদিন দুপুরে বাক্সের ভিতরে হাত দিয়ে যেটা উপরেই পেলাম টেনে নিয়েছিলাম। আর কিছুদিন আগে বাবার জমানো ব্রিটিশ আমলের টাকা রুপোর দরে বিক্রি করে সুবিমলের জন্য ফলিক অ্যাসিড দেওয়া আয়রন টনিক কিনেছিলাম। সুবিমলের অ্যানিমিয়া হয়ে গিয়েছিল। ওই থালাটা যখন আমি ব্যাগে ঢোকাই এবং শ্যামবাজারের একটি দোকানে বিক্রি করে দিই, আমার বিবেক একটুও আহত হয়নি, কারণ একটা মহৎ কাজের জন্য আমি ওই কাজ করেছিলাম। থালা বিক্রির টাকায় আমি মাও সে তুং-এর নির্বাচিত রচনাগুচ্ছ কিনেছিলাম।

জীবনের মা ‘যখন সবই আমার অদেষ্ট, আমার পোড়াকপাল’ বলতে বলতে চলে যাচ্ছিল, আমি আমার মানসিক উত্তেজনা চাপবার জন্য মাও রচনার ‘শত ফুল ফুটুক’ খুলেছিলাম। পড়তে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম মাকে ব্যাপারটা বলে দেব, কিন্তু পরদিনই তো জীবনের মা মরে গেল।

জীবন তো এসব জানে না, কিচ্ছু জানে না। ও আমাকে পাকা পেঁপে দেয়, বেলফুল দেয়। আমি ভালবাসায় এত রিক্ত হয়ে যাই যে অসহ্য বোধ হয়। পুরনো অন্যায় খোঁচা মারে। সেই কারণেই বোধহয় ওকে আমার এড়িয়ে চলা।

বাড়িতে গাঁক গাঁক। টিভিতে কোল্ড ড্রিংকস ফেনা ছড়াচ্ছে। ছেলের সামনে হি-ম্যান কমিকস খোলা, ঝুমুর মুখে মুসুর ডাল বাটার আস্তরণ ফ্যানের হাওয়ায় শুকোচ্ছে। ঝুমু বলল, এত দেরি করলে, বিভাসবাবু এইমাত্র চলে গেলেন। আমি বললাম, কিছু কি বললেন উনি? ঝুমু বলল, কেস কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে। হেড মিস্ট্রেস এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জকে ইনফ্লুয়েন্স করে ফেলেছে। ওরাও অঞ্জলি বসু নামে একটা ক্যানডিডেট পাঠাবে— খবর আছে। এক্ষুনি দেখা করো। আমি তক্ষুনি রিকশা নিয়ে বিভাসবাবুর বাড়ি ছুটলাম।

বিভাসবাবু এখানকার স্থানীয় গার্লস স্কুলের সেক্রেটারি। আমার স্ত্রীর চাকরির ব্যাপারে ওঁকে ধরেছিলাম। আমার স্ত্রী এম এ পাশ। বি এ যদিও পাশ কোর্সেই, পরে রবীন্দ্রভারতী থেকে এম এ করে নিয়েছিল। স্কুলের চাকরি এখন বিশাল ব্যাপার, সোজাপথে হওয়া মুশকিল। বিভাসবাবুকে অনেকদিন ধরে বলছি, হাজার আষ্টেক টাকা খরচ করব কথাও দিয়েছিলাম। বিভাসবাবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একটা পোস্ট স্যাংশান করালেন। স্থানীয় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে রিকুইজিশন গেল। ওখানে আবার আমার বাল্যবন্ধু মধু রয়েছে, বাগবাজারের ছেলে। লাইন করলাম। কথা দিলাম দু’ হাজার খসাব। এদিকে বিভাসবাবুর কাছে জানলাম হেড মিস্ট্রেসের নাকি নিজস্ব ক্যানডিডেট আছে। হেড মিস্ট্রেসও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিভাসবাবু বললেন, কেস তো গড়বড় হয়ে যাচ্ছে মশাই। অঞ্জলি বসুর নাম যদি এক্সচেঞ্জ পাঠিয়ে দেয়, তবে কী করব আমি? ও তো আবার অনার্স, এম এ। এম এ-তে ফিফটি ওয়ান পার্সেন্ট।

আপনি চেনেন মেয়েটাকে?

পাড়ায় থাকি, সোস্যাল ওয়ার্ক করি, চিনব না? সব্বাইকে চিনি আমি। মেয়েটির বাবা রিসেন্টলি এক্সপায়ার করেছেন। ওর দাদা স্বরাজ মিলের গোডাউন কিপার বোধহয়, মিল তো বন্ধ। আরও বোন আছে দুটো। হেড মিস্ট্রেসের কেউ হয় নাকি?

কিছু রিলেশন নেই, তবে ওর উপর খুব সিমপ্যাথিটিক। আসলে ওই উইডো হেড মিস্ট্রেস বড় ইগোইস্টিক। আমি যা করব তার উলটোটা ও করবেই। ওই বুড়ি নাকি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জকে ইনফ্লুয়েন্স করেছে। ওই মেয়েটাও থ্রু এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে চলে এলে, বুঝতেই পারছেন, ওর সঙ্গে ফাইট করা খুব মুশকিল হয়ে যাবে।

হেভি ফাইটিং। বাড়ি ফিরে টিভির ওয়ার্লড নিউজে দেখি শ্রীলঙ্কার ফাইটিং, লেবাননের, ইরান-ইরাকের, সাউথ আফ্রিকার। এদিকে রামের সঙ্গে লব–কুশের ফাইটিং চলছে, কৌরবের সঙ্গে পাণ্ডবের। আলাদা আলাদা ফাইটিং কিন্তু একই ফেনোমেনান। স্বার্থ। আমি বেসিনের ঝাঁঝরিতে লেগে থাকা নডুলসের লম্বা ফিতে টেনে টেনে পরিষ্কার করি।

বাবা এসব কিছু দেখে যেতে পারেননি। এই বেসিন, শাওয়ার, বাথরুমের এই সাদা টালি, এসব কিচ্ছু না। কামারহাটির এই জমিটা আগেই কেনা ছিল। গ্যালিফ স্ট্রিটের পুরনো বাড়িটা যখন রামবিলাস কালোয়ার কিনে নিল, আমাদের সব ভাড়াটেকেই কিছু কিছু পয়সাকড়ি দিয়েছিল বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্য। ওই উৎকোচের সঙ্গে নিজের কিছু সঞ্চয় মিলিয়ে কোনওরকমে বাড়ি করেছিলেন বাবা। দেয়ালে প্লাস্টারও ছিল না। আমি চাকরি পাবার পর একটা বছরও বাবাকে সুখ দিতে পারিনি। হার্ট অ্যাটাকে চলে গেলেন বাবা। তবে মাকে করেছি, যতটা পেরেছি। মায়ের পছন্দমতো একটা সুন্দর ঠাকুরঘর করে দিলাম। বোনের বিয়েটাও দেখে গেলেন, সুখেই ছিলেন মা, শুধু ঝুমুর সঙ্গে খিটিমিটি ছাড়া।

কীগো, কিছু ব্যবস্থা করো, চাকরিটা বেহাত হয়ে যাবে নাকি? বউ ম্যাক্সির ফাঁক দিয়ে পাউডার ঢালছিল।

ভাবছি তো।

ভাববার আর কীই-বা আছে তেমন। হেড মিস্ট্রেসের ক্যানডিডেটকে আটকাতে হবে। সুতরাং মধুর বাড়ি যাই। বিশ টাকার ‘আবার খাব’ সন্দেশ কিনি, বলি, এই যে মধুসূদন, বিপদভঞ্জন, আবার নতুন ঝামেলা হয়েছে একটা। ঝামেলাটার কথা বিস্তারিত বলি। মধুসূদন বলল, হ্যাঁ, ও দেখেছে, ফরসা রোগা একজন বিধবা মহিলা ক’দিন ধরে এমপ্লয়মেন্ট অফিসারের সঙ্গে ফুসুর ফুসার করছে। দেখা যাক, কেসটা কোথায় আছে। দিনতিনেক পরে আয়।

গেলাম। মধু বলল, ওই অঞ্জলি বসুকে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যবস্থা পাকা। ওকে ইটিল্ডাঘাটে একটা স্কুলে ইন্টারভিউর জন্য পাঠানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে আবার নতুন ইন্টারভিউর জন্য নাম পাঠাননা চলবে না। আর তার পরের সপ্তাহে তোর মিসেসের ইস্কুলের কেসটা করা হবে। অঞ্জলি বসুর নাম অটোমেটিক বাদ পড়ে যাবে। অফিসার যদি অঞ্জলি বসুর কার্ড বের করতে বলে, আমরা আইন দেখিয়ে দেব। ওই কেসটা যে করে ওই ডিলিং ক্লার্কটা মহা ছ্যাঁচড়া। এক হাজারের কমে হবে না। রোববার দিন আয়।

রবিবার গেলাম। দাঁতে আটকে আছে মাংসের আঁশ, পকেটে টাকা। মধুসূদনের কাজের মেয়েটি বলল, ওনারা একটু ঘুমুচ্ছেন। বললাম, পাঁচটায় আসব। ঘণ্টাদেড়েক সময় রয়েছে হাতে। কী করব? তা হলে জীবনের গ্যারেজে যাই। দাঁতে সুড়সুড় করছে মাংস কুঁচি, পকেটে টাকা। অঞ্জলি বসুকে আটকাতে হবে।

অঞ্জলির বোধহয় চাকরিটা খুব দরকার। ওর দাদা বেকার। ওর দুটো বোন। ওর বাবা নেই। আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মচারী, হালে প্রমোশন পেয়েছি, গোডাউন কিপার। অঞ্জলিকে আমার আটকাতে হয় কেন?

জানি না। এটাই নিয়ম। আনি মানি জানি না পরের ছেলে মানি না। সবাই তাই করে! সব্বাইয়ের দোহাই দিয়ো না। একদিন তুমিই না বলতে…

ওসব মনে করতে চাই না আর। আপাতত একটাই কাজ। অঞ্জলি বসুকে আটকাতে হবে।

ঠিক করে বলতে পারো কেন?

ওকে না আটকালে আমার বউ স্লিম হবে না, হল? দুপুরে ঘুমিয়েই মোটা হয়। মেয়েদের কাগজ থেকে পড়েছে ঝুমু। অঞ্জলিকে না আটকালে আমাদের কত শখ অপূর্ণ থেকে যাবে। পৃথিবীতে কে কার জন্য ভাবে! এরকম কত অঞ্জলি পচে যাচ্ছে এ সমাজে।

জীবন গ্যারেজে ছিল না। দেখি বাগানে রয়েছে। বাগানে ঢুকলাম। কাঁঠালি চাঁপা গাছটার তলায় বসলাম অনেকদিন পরে। জীবন নিড়ানি দিয়ে গাছের গোড়া খোঁচাচ্ছিল। আমাকে দেখে আশ্চর্য হল জীবন।

কী ব্যাপার ডাবুদা?

এদিকে যাচ্ছিলাম একটা দরকারি কাজে, ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। অন্যদিন তো তাড়া থাকে, দুটো কথা বলতে পারি না। জীবন বড় খুশি হল।

ভাল আছ ডাবুদা?

হ্যাঁ।

ছেলেটা?

হ্যাঁ।

বউদি?

না।

কেন? না কেন?

না–না, ভাল আছে।

আচ্ছা জীবন, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি মোটামুটি কন্ডিশনে কীরকম দাম হয়?

জীবন আমার মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে রইল। গাছের পাতার শিরশির, শিরশির। তুমি কিনবে ডাবুদা?

না–না কিনব না, এমনি জিজ্ঞাসা করছি।

না–না, নিতে পারো, নেবেই তো, তোমরা সব পাড়ার ভাল ছেলে ছিলে। তোমরা কেন…

তোর মেয়েটা কেমন আছে রে জীবন?

খালি বমি করে। চোখটা বেরিয়ে পড়েছে গো।

কী করবি এবার?

কী আর করব, যদ্দিন থাকে…

মাটি তৈরি করছিস বুঝি? কিছু লাগাবি?

হ্যাঁ। ক’টা চন্দ্রমল্লিকা করব। এই রোববারটায় যা একটু টাইম পাই। অন্যদিন বড্ড খাটনি যায়। এত কাজ করি, মালিক সন্তুষ্ট নয়। বলে কাজ বুঝি না, যত ইসকুরুপ বল্টু খোলানো আর কিলিনিং পোস্কার সবই আমায় দিয়ে করায়। বড় ইচ্ছে করে গিয়ার বক্সের কাজ, ইঞ্জিন কারবুরেটারের কাজ করি।…

বাগানটা কিন্তু বেশ সুন্দর করেছিস জীবন।

আমি আর কী করেছি। এটা তো রামযতনের বাগান। ওর কাজটাই তো আমি করছি। আমি না হলে অন্য কেউ করত। একটা বিড়ি ধরায় জীবন। আমার পাশে বসে। বলে, অনেকদিন পর তোমায় এভাবে পেলাম ডাবুদা, কত কথা মনে পড়ছে। লালমুখো সাহেবগুলো, সল্টলেকের মাটি পাঠাত যারা, মনে আছে?

মোসিসো, পিচকোমাতে…ঘুড়ি ওড়াত…

হরি সা–র বাড়ির ঝুলন মনে আছে ডাবুদা?

কী বিরাট পুতনা রাক্ষসী!…

পল্টুদাকে মনে আছে? জয়ন্ত, মনা? মনার ওই আলগা হয়ে যাওয়া হাতটা নিয়ে জয়ন্ত ছুটল, মনা তোর হাত নিয়ে যা…

থাম জীবন।

একটা জিনিস দেখবে ডাবুদা? জানি না কী অবস্থায় আছে এটা…

একটা কোদাল তুলে নেয় হাতে। বাগানের কোনার দিকে, যেখানে স্থলপদ্ম গাছটা ছিল, সেখানে এখন একটা কামিনী ফুলের গাছ। তার গোড়ার দিকটার মাটি কোপাতে থাকে জীবন। একটু পরেই কোদালের ফলায় কেমন যেন শব্দ দু’ হাতে মাটি সরায় জীবন। একটা মরচে পড়া টিনের বাক্সের মতো কিছু বেরিয়ে আসে।

গুপ্তধন নাকি? এগিয়ে যাই। বাক্সটার চারপাশের মাটি তুলে নেয় জীবন। কী আছে রে জীবন? কী বের করছিস? জীবন কিছু বলে না। দু’হাত দিয়ে টেনে তুলতে গিয়ে বাক্সটা ভেঙে ভেঙে যায়। আসলে বাক্স নয়, একটা ছোট টিন, বিস্কুটের টিনের মতো। কোদালের আঘাত করতেই টিনের দেয়াল ভেঙে গেলে ভিতরে পলিথিনে মোড়া কয়েকটা বই দেখা যায়। কর্মযোগ, তরুণের স্বপ্ন, রাষ্ট্র ও বিপ্লব আর মাও সে তুং-এর নির্বাচিত রচনাগুচ্ছ।

বই খুলে দেখি বিবর্ণ কালিতে আমার নাম। পৃষ্ঠাগুলো ভেঙে যাচ্ছে, হলুদ হলুদ। আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে জীবনের মুখের দিকে তাকাই। নিমগাছের ডালে ডেকে ওঠে কাক। জীবনের মুখটা প্রশান্তিতে ভরে আছে। তোমার বইগুলো দিয়ে দিলাম ডাবুদা।

তখন ভীষণ গণ্ডগোল। উনিশশো একাত্তর। জয়ন্তর দেহ খালের জলে ভাসছিল। পুলিশ ঘিরছে পাড়া। বাবা আমাকে নিয়ে গেল মুর্শিদাবাদ। পুরো একটা বছর ওখানে কাটাতে হল। ফিরে এসে দেখি আমার বইপত্তর কিছু নেই। মা বললেন, পুলিশের ভয়ে সব নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের প্রাইজের বইগুলো, নেতাজি-বিবেকানন্দর বইও পুড়িয়ে দিয়েছেন মা। ভেবেছিলাম কিনে নেব আবার। আস্তে আস্তে বই হারানোর দুঃখ ধূসর হয়ে গেল। ওইসব বই আর কেনা হয়নি।

বইগুলো আঁকড়ে ধরি আমি। খামচে ধরি। খামচে ধরি হারানো ইচ্ছের দিন। সারা শরীর শিরশির করে। কান্না কান্না লাগে। সেই কচি কচি পাতা গজানোর পর শুকনো স্থলপদ্ম গাছটার আনন্দ আমি বুঝে যাই। আমার গায়ে শিরশির করছে পাতা, চোখে দুলদুল করছে জল। ওই অবস্থায় আমি জীবনের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকি।

জীবন বলে, তুমি ঝ্যাকন পালালে ডাবুদা, মাসিমা একদিন ডাকলেন। এক ব্যাগ বই দিয়ে বললেন, জ্বালিয়ে দিস। কাউকে বলিস না যেন, বই দেখলেই পুলিশ হেনস্থা করছে। একটু গাড়ির পেট্রোল ছিটিয়ে নিস। আমি বাগানে নিয়ে এলাম। বইগুলো নষ্ট করে দিতে খুব মায়া লাগল ডাবুদা, খুব কষ্ট হল। আমি তো লেখাপড়া জানি না ভাল, মলাটের ছবিতে দেখলাম স্বামীজির ছবি, নেতাজির ছবি, লেলিল, মাও। সারা দেওয়ালে দেওয়ালে তখন মাও সে তুং-এর ছবি গো ডাবুদা, পল্টুদারা তার নামে জিন্দাবাদ দিতে দিতে মরে গেল, আমি কি পারি পোড়াতে? ভাবলাম এসব থাক, পরে আবার একদিন ঠিক দরকার হবে। যে ক’টা আঁটল ওই ছোট টিনে, পেলাস্টিকে মুড়ে রেখে দিলাম। তারপর তো আর মওকাই পেলাম না যে তোমায় কথাটা ভেঙে বলব।

কী যে আতান্তরে পড়েছি আমি। আমার দাঁতে আটকে আছে মাংসকুচি, পকেটে খচখচ করছে টাকা, হাতে পলিথিন জড়ানো বইয়ের মমি।

মধুসূদন আমার বন্ধু। ও ঘুমোচ্ছিল। এতক্ষণে ওর ঘুম ভেঙে গেছে। ওর কাছে আমার যেতে হবে।

আজ আমি পারব না। কিছুতেই যাব না ওদিকে।

আমি টের পাই শুকনো গাছে নতুন পাতা গজানোর শিরশির। জীবন, জীবন রে….।

শারদীয় বসুমতী, ১৯৮৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *