সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে…

সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পরে…

আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আছে, যাদের পেছন পাকা না বলে আঁতেল বলি আমি। আমার আঙুলের গোমেদ নিয়ে মসকরা করে। আমার বাবাকে মান্য করা নিয়ে প্যাঁক দেয়। আমার জ্যাঠামশাই মারা গেলেন বলে দাড়ি কাটছি না, মাথায় তেল না দিয়ে শ্যাম্পু করছি, এতেও ওরা খারাপ দেখছে। জ্যাঠামশাই যখন এখন-তখন ছিলেন, তখনই আড়াইশো দিয়ে একটা ফাইবার চটি কিনে নিয়েছি, আরে বাবা নিয়ম। বহুদিনের পূর্বপুরুষের তৈরি করা নিয়মগুলি ব্যঙ্গ করা হল আঁতলামি। এখানে দু-তিন জন কলেজ জীবনের বন্ধু আছে, মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। আমি গতকাল চিকেন ফিকেন খাইনি, শুধু চানাচুর দিয়ে খেয়েছিলাম অশৌচ তো, নিরামিষ খেতে হয়। তাইতে অজয় আর প্রতীক খুব হাসাহাসি করল। সত্যি বলতে কী বোতল আজকাল বাড়িতে রাখি। কখন কে আসে বলা যায় না তো। তবে বাবা থাকলে বোতল খোলা হয় না। আমি আমার বাবাকে খুব মান্য করি। বাবার সামনে সিগারেট খাই না। ঘরের অ্যাশট্রেও লুকিয়ে-টুকিয়ে রাখি। এখনও সিগারেটের প্যাকেট ওপেন ফেলে রাখি না। বউ যেমন ওর ছোট-জামা আলনায় রাখলেও ঢেকেঢুকে রাখে, ওরকম। আগে বাবার সামনে চা খেতেও সংকোচ হত। একবার ইস্কুলে পড়ার সময় চিরুনি দিয়ে চুলের সামনেটা উত্তমকুমার স্টাইলে একটু ফোলা-ফোলা করছিলাম, বাবা অ্যাইসা একটা থাবড়া মেরেছিলেন… সেই থেকে বহুদিন বাবার সামনে মাথাই আঁচড়াইনি আমি। আর এখন তো টাক–ফাক পড়ে মাথা আঁচড়ানোটাই সেকেন্ডারি হয়ে গেছে। কী দিন গেছে। পেছনের পকেটে চিরুনি থাকত আমার…

তো অজয় একটু আগে একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এল, আমার বোনের। ছেলেটি এম এ পাশ বলল, ফিলজফিতে। কাজ করে কেরানির। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে। আমি মনে মনে বলি— কেরানি তো ইনকাম ট্যাক্সে— সেলস ট্যাক্সে হতে পারল না? ইউনিভার্সিটির কেরানি কী হবে? ফিলজফি-ধোয়া হলে কী হবে? অজয় বলল, ফ্যামিলিটা ছোট। মা, ছেলে পৈতৃক বাড়ি। ছেলেটাও সৎ।

অজয়কে তখন ফুটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু বাবার সঙ্গে কথা না বলে আমি কিছু করি না। বাবাকে হেভি মান্য করি। বউকেও বলা আছে বাবাকে হেভি মান্য করতে। বলেছি ম্যাক্সি পরা অবস্থায় যেন কখনও বাবার সামনে না আসে। আমি ফ্রিজে জলের জন্য যে বোতল রেখেছি, একটাও খালি মালের বোতল রাখিনি। সবই স্কোয়াশের।

আমি এখন ঝুলবারান্দায়, সরি, ব্যালকনিতে বাবার সঙ্গে হিসেব নিয়ে বসেছি। কোম্পানির হিসেব। নিউ এজ এন্টারপ্রাইজ। বাবার কপাল এখনও কুঁচকে আছে। বাবার সামনে কাগজ। আমি বাবাকে হিসেব দাখিল করেছি। বাবাকে তো হিসেবটা দাখিল করতেই হবে। কোম্পানিটা তো বাবার। বাবাই প্রোপাইটার। আমি হলাম ম্যানেজার। বাবা মাইনে বাবদ আমায় বেশ কিছু দিচ্ছেন প্লাস এধার ওধার করে আমি কিছু ম্যানেজ করি। আমার চলে যায়। সংসার খরচের জন্য বাবাকে কিছু দিই।

এই যে কোম্পানিটা, বেশি দিনের নয়। বছর পাঁচেকের। বেশ চলছে কিন্তু। আর এই গোমেদ, ছ’বছর ধরে পরছি।

বি এস সি-টা ফেল করলাম। প্র্যাকটিকালে ব্যাক। তখনই আমার মামা এক জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গিয়ে এই আংটি পরিয়ে দিলেন। তার পরেরবার পরীক্ষায় ব্যাকটা ক্লিয়ার করে নিলাম। গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলাম। আমার ঘরের দেয়ালে আমার গ্র্যাজুয়েট হবার ছবি আছে। উকিলদের মতো গাউন পরা। স্টুডিয়োতে পাওয়া যায় শুনেছিলাম। পাড়ার স্টুডিয়োতে ওই গাউন ছিল না। সেই বিবেকানন্দ রোডের পুরনো স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলিয়ে এনেছিলাম। বিয়ের পর বউ বলল, এসব ছবি আজকাল কেউ রাখে নাকি? লোক হাসবে। এখন ওখানে আমার আর বউয়ের ছবি আছে। পিছনে তাজমহল। ওই তাজমহলটা অবশ্য রিয়েল নয়, স্টুডিয়োর। আমার ইচ্ছে ছিল পিছনে মারুতি রেখে ছবি তোলার, বউ বলল, না, তাজমহল। রিয়েল তাজমহলে যাওয়া হয়নি এখনও। পয়সার মুখ তো এখন দেখছি, গত কয়েক বছরে। আসলে বাবা ছিলেন একটা ইস্কুলের মাস্টার। খুব একটা টিউশনিও করতেন না। ছোটবেলায় দেখেছি যুব-উৎসব কমিটি, বন্যাত্ৰাণ, ব্লাড ডোনেশন এসবে থাকতেন। কাস্তে হাতুড়ি মার্কা বই-টই পড়তেন। আমাদের আলমারিতে রাশিয়ার সব বইটই আছে। আমার ওসব পড়তে ভাল লাগে না। তো, বাবা রিটায়ার করার আগে বললেন, কিছু একটা কর। আমি আঙুল মচকানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারিনি। এরপর বাবার সঙ্গে বাবার এক ছাত্রের কোথায় যেন দেখা হয়। বাবার সেই ছাত্র ইঞ্জিনিয়ার। আগে চাকরি করত, কিন্তু হালে ব্যবসা ধরেছে। ওই ছাত্রটি বাবাকে হেভি ইয়ে করত। বলল— স্যার, আপনি রিটায়ার করেছেন যখন, আমার ব্যবসায় আসুন। হিসেব-টিসেব দেখে দেবেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলবেন…। আসলে বাবা তো খুব সৎ ছিলেন, তাই ওই ছাত্রটা বাবাকে কাজ দিয়েছিল। ওই ব্যবসা আসলে হচ্ছে কনট্রাক্টরির ব্যবসা। বাবা মাঝে মাঝে বলতেন, কীসব কাণ্ড কারখানা চলছে, বিবেকে লাগে। আমার মতো মানুষ কীভাবে হিসাবে গরমিল করে, কীভাবে অফিসারদের ঘুষ দেয়…

তিন বছর আগে বাবা নিজেই টেন্ডার জমা দিলেন। কনট্রাক্ট পেলেন। বাবা বলেন ভাবতেও পারি না আমার মতো লোক এইসব ব্যবসা করতে পারে। কিন্তু সোভিয়েত নাই। আমার মেরুদণ্ডও নাই। আর, কিছুদিন আগে আমার বিয়ের সময় বাবা বলছিলেন পণটন দরকার নাই, যা পারবেন দেবেন। আমি— বলতে পারেন একজন আদর্শবাদী মানুষ। তো, সেদিন এক অফিসার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, উনি বলছিলেন আপনার সঙ্গে কাজ করা মুশকিল। আপনার কেমন যেন সেকেলে সেকেলে ভাব। বাবা বলেছিল— না–না। এখন মুক্ত। মুক্ত অর্থনীতি। নীতি মুক্ত। নীতি নেই। বলতে গিয়ে একটু গলা কাঁপিয়ে ফেলেছিলেন বাবা। তারপর আমাকে ডেকেছিলেন। ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে ওকে দিতে বলেছিলেন। আমি দিয়েছিলাম। তারপর ওই অফিসার চলে যাবার পর আমার চুলে বিলি কেটে বাবা বলেছিলেন, কীসব শেখাচ্ছি তোকে ছিঃ আমি না বাপ? আমার খুব লজ্জা লজ্জা করছিল। কতদিন পর বাবা আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন। বাবা এখন অবশ্য ওরকম করেন না। তবে মাঝে মাঝে কীসব পাগলামি করেন, কারণটা ধরতে পারি না আমি। আমার একজন মামা আছেন, একটা হাসপাতালের কর্মী। লিডার। বক্তৃতা দেয়। একদিন ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম আমি আর বাবা। একটা রিকশাওলাকে মামা কী যা-তা ভাবে কথা বলল। হাসপাতালের ক্যান্টিনের ছেলেকে মামা খুব হুকুম করছিল। বলছিল, যা সিগ্রেট নিয়ে আয়, যা পান নিয়ে আয়, যা জর্দা নিয়ে আয়, যা দেশলাই নিয়ে আয়… ছেলেটা বলল, একই দোকানে বারবার পাঠাচ্ছেন কেন, একবার বললেই তো হত। ওমনি মামা ছেলেটাকে মারল জোরে চড়…। বাবা চা খাচ্ছিলেন, উঠে গেলেন। আমিও পেছন পেছন গেলাম। বাবা গটগট করতে করতে হাঁটছেন আর বলছেন, এরা সব মানুষ? এই তো সব পেশা এদের আবার আত্মীয় পরিচয় দিতে হয়…।

এখন বাবার সঙ্গে হিসেব নিয়ে বসেছি। বাবার কপাল কুঁচকে রয়েছে। বাবা বলছেন, মিসলেনিয়াস সিক্স থাউজেন্ড? ডিটেলস দে।

আমি বাইরে তাকাই। মাধবীলতা দোতলার ব্যালকনি ছুঁয়েছে। এই দোতলাটা নতুন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময়কার।

মহা ঝামেলায় পড়লাম তো। বাবা মাঝে মাঝে এমন ভাব করেন যে…। বাইরে তাকাই ফের। পিলারটা পেল্লায় মোটা হয়েছে। মাধবীলতা কি পারবে ওটাকে জড়াতে। বাবা বললেন, মিসলেনিয়াসের কোনও মানে নেই। ডিটেল দে। একই দিনে ছ’ হাজার টাকা মিসলেনিয়াস? ইয়ারকি?

আমি একটা মাধবীফুল ছিঁড়ে নিলাম, লম্বা বোঁটাটা হাতে নিয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে বলি— ব্যানার্জি সাহেবের জন্য খরচ হয়েছে।

ব্যানার্জি কে? জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার?

হ্যাঁ।

ওকে আবার টাকা দেবার কী হল। এ ই-র সঙ্গেই কথাবার্তা হয়ে আছে।

মানে…

কোনও মানে নেই। এরকম খরচ করলে ভাত জুটবে না। আমি এইসব ছাইপাঁস ব্যবসা করছি শুধু তোদের জন্য। নিজের যদি কিছু করতে পারতিস এসব করতে হত না আমার…। আমার খুব রাগ হল। হাতের ফুলটা দু’আঙুলে পিষে ফেললাম আমি। বাবা দেখলেন।

বাবা বললেন— তবে এই টাকাটাকে মিসলেনিয়াস হেড-এ দেখালি? মি. ব্যানার্জি, J E সিক্স থাউজ্যান্ড দেখালেই পারতিস। এই হিসাব তো তোর-আমার মধ্যে। আসলে মিসলেনিয়াস দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যায়। মিসলেনিয়াসের মধ্যেই যত গণ্ডগোল।

…বড্ড ঘ্যান ঘ্যান করছেন বাবা। পৃথিবীতে কতরকম মিসলেনিয়াস হয়ে যাচ্ছে, অথচ এই একটা মিসলেনিয়াস নিয়ে সেই থেকে ঘ্যানঘ্যান। উঠে যেতে ইচ্ছে করছে। বাবার অসম্মান আমি চাই না। তাই বসে থাকি। কোম্পানিটা বাবার। আমি একমাত্র পুত্র হতে পারি, আরও দুটো কন্যাও রয়েছে বাবার। বুড়ো বয়সে মানুষের মতি স্থির থাকে না। আমি অনেক একজাম্পল জানি। বাবাকে খচাই না।

বাবা আবার বললেন, তা টাকাপয়সা নিয়ে ব্যানার্জি বিল-টিল ছাড়বে তো?

আমি বলি, ব্যানার্জি সাহেবকে তুমি তো চেনো৷ এসেছে এ বাড়িতে। ফরিদপুরের ফ্রিডম ফাইটার অবিনাশ ব্যানার্জির নাতি।

বাবার গলার স্বর পালটে গেল।

বাবা বললেন, ওকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলি?

আমি বললাম, ঠিক স্কোপ হয়নি এখনও।

বাবা বললেন, স্কোপ পাইনি বললে হয় না। করতে হয়। তোর দিদির বিয়ের জন্য তুই একটু চেষ্টাচরিত্র কর। আমি নিজে এখন বাসে-ট্রেনে আর পারি না। নইলে আমিই দেখতাম। ওই ব্যানার্জি, কী ব্যানার্জি যেন?

চঞ্চল।

হ্যাঁ, চঞ্চলের সঙ্গে অনুর ইয়েটা ভালই হয়। ছেলেটা লম্বা-টম্বা আছে। ফ্যামিলি ভাল। ওর দাদু ফ্রিডম ফাইটার। এক ডাকে সবাই চিনত। ওর বাবাও শুনেছি একজন দারুণ লোক। কমিউনিস্ট পার্টির লোক…

ঠিক এইসময় মোটর সাইকেলের ঘটঘট। দেখি ব্যানার্জি সাহেব। চঞ্চল ব্যানার্জি নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। স্টার্ট বন্ধ করেনি, আমায় ডাকছেন।

আমি দেখেই খুব খুশি হলাম। বললাম, অনেকদিন বাঁচবেন। এই এতক্ষণ আপনার কথাই হচ্ছিল। ব্যানার্জি সাহেব বললেন, খুব নিন্দে হচ্ছিল বুঝি?

আপনি কী যে বলেন, বলেই জিভ কামড়ালাম।

আমার জিভটা কামড়ানোই ছিল, তাই বাবাই বলল, কী সৌভাগ্য… আসুন, ওপরে আসুন।

আমি নীচে গেলাম রিসিভ করতে। ব্যানার্জি সাহেব মোটর সাইকেলের স্টার্টার বন্ধ করেছেন। আমি বললাম, ওপরে চলুন।

ব্যানার্জি সাহেব সিড়িতে উঠেই বললেন, মেয়েটা যা খায় না… দারুণ দিয়েছিলেন।

আমি বললাম, এই এসব পরে।

আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, রাস্তাটা স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তিন ইঞ্চি ডিপ করার কথা। দু’ ইঞ্চি করেছিলাম। ব্যানার্জি সাহেবকে ফিট করেছিলাম। ব্যানার্জি কী কী পছন্দ করে আমি জানি। একটা ফিট করে দিয়েছিলাম। চাঁদিপুরে হোটেল বুক করে দিয়েছিলাম দু’দিনের জন্য। মেয়েটা পাঁচ হাজার নিয়েছিল।

ব্যানার্জি সাহেব ওপরে গিয়ে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল৷ বাবা বললেন, থাক-থাক, সাহেব-সুবো মানুষ, প্রণাম করতে হয় না। তো এখানেই আসা হয়েছিল?

না, এধারে একটা জমি দেখতে এসেছিলাম, কিনব।

তোমাদের পৈতৃক বাড়ি আছে না?

আছে, কিন্তু নিজের একটা বাড়ি…

ভাল, ভাল। তা তোমার বাবা কেমন আছেন?

বাবা আজকাল একটু সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট হয়ে গেছেন।

মানে?

মানে, পার্টিটা ছেড়ে দিলেন, তবু পার্টি অফিসে গিয়ে নানারকম জ্ঞান-ট্যান দেন, ওরা পছন্দ করে না। বাড়িতে কেবল টিভি ঢুকতে দিচ্ছেন না। দাদার ছেলেটাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভরতি করানো নিয়ে সমস্যা করছেন…

আসলে খুব আদর্শবাদী তত…

বলেই আমার দিকে ইশারা করলেন বাবা। আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। আমার কানে কানে বললেন, অনুকে দেখানোর ব্যবস্থা কর।

আমি তো বাবাকে হেভি মান্য করি। বাবার কথা শুনতেই হবে। আমি ভেতরে যাই। অনুকে আমি বলতে পারব না— যা, সেজেগুজে চা নিয়ে যা। ও অনেকবার এসব করেছে। আর ভাল লাগে না ওর। ওকে কিছু বলতে গেলেই ও এমন অসহায় ভঙ্গিতে তাকাবে যে…। হয়তো শুয়ে পড়বে, নয়তো বাথরুমে ঢুকে বসে থাকবে।

আমার বউকে বলি। আমার বউয়ের সঙ্গে অনুর একটু ঝগড়া আছে। মাঝে-মাঝেই কথা বন্ধ থাকে। বউ হয়তো বলল, দামি সাবানটা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। অনু হয়তো ভাবল ওকে উদ্দেশ্য করে এটা বলা হয়েছে। অনু হয়তো একটা নতুন সাবান কিনে নিয়ে এল। তারপর কয়েকদিন কথা বন্ধ। কিংবা বাবা হয়তো বললেন— বউমা, এটা অনুকে দিয়ো। বউ বলল, ও কোথায় অন্ধকারে মিশে আছে, খুঁজে পাচ্ছি না। বউ কিন্তু বলতে চায়নি অনুর রং কালো, আসলে অনু আজকাল একা একা অন্ধকারে থাকা পছন্দ করে। কিন্তু অনু ভাবল ওর রং সম্পর্কে খোঁটা দেওয়া হচ্ছে। আবার হয়তো কথা বন্ধ। আবার ক’দিন পরেই ভাব। এখন যতদূর জানি ওদের কথা বন্ধ। কারণ কালই বউ বলেছিল, টাকা জমাও, যত পারো জমাও, ওই বোনটিকে পার করতে কত লাগবে কিছু ঠিকানা নেই। তো, আমি আমার বউকে বললাম— অনুকে নিয়ে বারান্দায় একটু এসো। একটা পাত্র আছে…

কে পাত্র?

ব্যানার্জি।

কোন ব্যানার্জি? যার কথা বলছিলে?

হ্যাঁ।

আসলে আমি বউকে সব বলি। ব্যানার্জি সাহেবকে চাঁদিপুরে ফিট করে দেবার গল্পটা বউকে করেছিলাম। ব্যানার্জি বলেছিল, দুটো ফিট করুন। একসঙ্গে যাই, দুটো ঘর। আমি বললুম, না। এটাও বউকে বলেছিলুম। জানাতে চেয়েছিলাম, দ্যাখো আমার চরিত্র কেমন পোক্ত, গেলাম না। মুনমুন সেন বললেও না।

বউ বলল, ওই ব্যানার্জির সঙ্গে তোমার বোনের বিয়ে দেবে? দিতে পারবে?

আমি মাথা চুলকোই।

বউ বলল, তোমার বাবা সব জানেন?

আমি বললুম, সব জানেন না। কিছুটা জানেন।

কিছুটা মানে?

ওই একটু ঘুষ-টুস।

এটা জেনেও তোমার বাবা রাজি?

আসলে, সোভিয়েত ইউনিয়নটা ভেঙে পড়ার পর থেকে না…

সোভিয়েত ভাঙুক। আমি ভাঙিনি। আমরা। মেয়েদের তোমরা কী মনে করো, অ্যাঁ?—

বিকেলে দেখি অনুর সঙ্গে আমার বউয়ের খুব ভাব।

আমার গোমেদটা ঠিক করছে, না ভুল করছে বুঝতে পারছি না।

নন্দন, ১৯৯৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *