মধুদার বাড়ি যাব

মধুদার বাড়ি যাব

মধুদাকে দেখতে যাব।

রোজই ভাবি মধুদাকে দেখতে যাব, সময় হয় না। খেলা যেদিন থাকে না শুনিটং থাকে, নয়তো পার্টি থাকে, নয়তো মন্দিরা…। আজ ঠিক করেছি যাবই। আজ দুপুরে খেয়ে দেয়ে চিঠির উত্তর দিতে বসলাম। ফ্যান লেটার। রোজই দু-তিনটে করে চিঠি আসে। আমার মাঠের ফুটবল খেলা নিয়ে প্রশংসার চিঠি আসে, তবে খুব বেশি একটা আসে না, সিরিয়ালের ফুটবল খেলা নিয়েই চিঠি আসে বেশি। একজন লিখেছে মাঠে আপনার খেলা দেখেছি। বাইনাকুলার দিয়েও দেখেছি, কিন্তু টিভির পর্দায় আপনাকে আরও ভাল লাগে। চার নম্বর এপিসোডে যখন আপনি খেলার পর বৈশাখী মিত্রর সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি করে গোষ্ঠ পালের মূর্তির পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ঘোড়ার গাড়ির চালকের সিটে বসে গিয়ে ঘোড়াকে চালনা করতে লাগলেন তখন দারুণ লাগছিল। আপনি কি ঘোড়ার গাড়ি চালাতে পারেন? আপনি উত্তর দেবেন কিন্তু। না উত্তর দিলে ভীষণ ভীষণ মন খারাপ করব। আর একটা অনুরোধ। আপনার অটোগ্রাফওলা একটা ছবি পাঠিয়ে দেবেন? আমি স্ট্যাম্প লাগানো খাম ভরে দিলাম…।

আমিও এরকম চিঠি লিখতাম ক্লাস টেনে পড়ার সময়, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়। ঠিকানা জোগাড় করতাম। সৌমিত্র চ্যাটার্জি কোনও উত্তর দেননি। মিঠুন পাঠিয়ে ছিল সই করা ছবি, রাজেশ খান্না, উষা উথুপ… আমি কি জিন্দেগিতে ভেবেছিলাম আমার কাছেও এরকম চিঠিপত্র আসবে? অনেক সময় চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে বানান নিয়ে কনফিউশন হয়। টি আই ও এন আর এস এস আই ও এন এর গণ্ডগোল হত। হয়তো লিখব আমার সাজেশন হল লেখায় আরও ডিভোশন দাও, তখনই গণ্ডগোল। তারপর, ‘র’ আর ‘ড়’ নিয়েও সমস্যা। বই পড়ব, কিন্তু জার্সি পরব। একবার জঘন্য লিখতে গিয়ে জঘন্ব লিখেছিলাম। আমার কী দোষ! কণ্ব মুনি যদি নয় বয় হয়, জঘন্য কেন নয় বয় হবে না? এটা যে ‘ণ্ব’, এ নিয়ে আমার কোনও কনফিউশন ছিল না। কিন্তু অভিনিবেশ বানানটায় তালব্য শ হবে না মূর্ধন্য ষ হবে দেখাতে গিয়ে ভুলটা ধরা পড়ল। মন্দিরাকে দেখাচ্ছিলাম। ওর কাছে আমার কোনও লজ্জা নেই। ও জিভ কেটে বলেছিল এ-মা চানুদা, জঘন্যরকম ভুল।

মধুদাকে দেখতে যাব, রেডি, এমন সময় মন্দিরার ফোন। বদমাশ আছে, গলাটা চেঞ্জ করে বলছে, আমি বৈশাখী বলছি, ঘোড়ার গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে খুব লেগেছে, এসে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে যাও। আমিও তো অ্যাকচুয়ালি নৈহাটির ছেলে, কম খচ্চর নাকি, বললাম—কেন, কাল যে এত করে হাত বুলোলাম, কমেনি বুঝি। আবার কাল বুলিয়ে দেব। আজ হবে না, কারণ এখন আমাকে মন্দিরার গায়ে হাত বুলোতে যেতে হবে।

মন্দিরা তখন নিজের গলায় বলে, সত্যি? আমি হেসে ফেলি। বলি, মন্দিরা, এখন আমি একটু মধুদার কাছে যাচ্ছি। মধুদা মানে আমার গুরু। যিনি আমাকে হাতে ধরে ছোটবেলায় ফুটবল খেলা শিখিয়েছিলেন। নৈহাটির রেলের মাঠে প্র্যাক্টিসে যেতে হত—মধুদার কাছে। কলকাতায় ফ্ল্যাট নেবার পর মধুদার সঙ্গে দেখা হয়নি।

বেশ তো, আমিও যাই না নৈহাটি, ট্রেনে করে যাব বেশ, ট্রেনে চড়তে খুব ভাল লাগে আমার।

মধুদা তো হাসপাতালে। এন আর এস-এ।

ওমা, কেন কী হয়েছে?

পায়ে কিছু একটা হয়েছে।

ও। এন আর এস-এর গেট-এর সামনে দাড়াব? তোমার মধুদাকে দেখতাম।

না। থাক। অসুবিধে হবে। অনেকগুলো গেট। কোথায় দাঁড়াবে?

ওভারব্রিজের মুখটার সামনে যে গেট…

না, দেরি হয়ে যাবে। আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছিলাম।

আমিও তো…।

না, অন্য একদিন, অ্যাঁ?

নেওয়া যায়? কী বলতাম মধুদাকে? আমার গার্লফ্রেন্ড? লজ্জা করে। কতদিন কান মুলে দিয়েছেন মধুদা। সকালে যখন প্র্যাকটিসে যেতাম, তখনই নিস্তারিণী ইস্কুলের মেয়েরা হলদে-সাদা, জার্সি, সরি, স্কুল ড্রেস পরে ইস্কুল যেত। অ্যাই, ওদিকে কী দেখছিস, এদিকে দ্যাখ। হেড-এ ভুল করে কতদিন চড় থাপ্পড় খেয়েছি। বলের দিকে চোখ রাখতে বলি, মন রাখতে বলি,—চোখ এদিক-ওদিক যায় কেন? মেরে লাড্ডু বানিয়ে দেব। মন্দিরার কেসটা মধুদা হয়তো কিছু কিছু জানে। গতবার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কারটা নিতে গেলাম, মধুদাকে দেখেছিলাম, এসেছিল, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার ইচ্ছে হচ্ছিল। কাছে যাব কী করে, খেলার সাথী, খেলার কাগজ, ময়দান, স্পোর্টসওয়ার্লড, খেল সমাচার— সব কাগজের রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরেছে, ফটোগ্রাফাররা ছবি ওঠাচ্ছে। ওদের কাটিয়ে সামনে গিয়ে আর মধুদাকে পেলাম না। মন্দিরাকে আগেই মধুদা দেখেছে। ফটোগ্রাফাররা যখন ছবি তুলছিল, ও সেঁটে ছিল। খেলার কাগজগুলিতে মন্দিরা আর আমাকে নিয়ে বেশ গল্প ফেঁদেছিল। ‘এ বছরের শ্রেষ্ঠ গোলদাতা চঞ্চল সরখেলের সাফল্যের পিছনে’—এই ক্যাপশনে মন্দিরার ছবি। মধুদা কি দেখেনি? আজ মন্দিরাকে ফুটিয়ে ভালই করেছি।

টুলের উপরে কমলালেবুর খোসা একা একা। ফ্যান ঘুরছে, মধুদা চোখ খুলে চুপচাপ। আমি ঢুকতেই মধুদার মুখে হাসির রেখা। টুলটা দেখিয়ে দিলেন। কমলার খোসা সরিয়ে বসলাম। ছোট আলমারিটার উপরে একটা ছোট সন্দেশের বাক্স। উৎসব। অভিজাত মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কয়েকটা মাছি বসে আছে। একটা বিস্কুটের প্যাকেট। ট্যাবলেটের রুপোলি পাতা।

তোর বাঁ পায়ের কাজগুলো খুব ইমপ্রুভ করছে রে চানু। একদম কৃশানু দে-র মতন। টিভিতে সেদিন দেখলাম।

আপনার আশীর্বাদ মধুদা।

ধুর। এইসব গ্যালারি মারানো কথা। তুই খাটছস, প্র্যাকটিস করছস, তোর রিফ্লেক্স ভাল, তোর হয়েছে। কিন্তু আরও স্পিড চাই চানু। দশটা হরিণ মইরা একটা স্ট্রাইকার পয়দা হয়। সাদামাঠা ভাবে এগিয়ে গেলে হবে না চানু, একটা চুক্কি-টুক্কি দরকার। স্কুইজ করতে হয়। জোহান ক্রুয়েফ-এর খেলা দেখিসনি? সরি সরি, আমার এই অইভ্যাস আর গেল না। তুই অখন সব বড় বড় কোচের কাছে ট্রেনিং পাস, আমি জ্ঞান দিবার কে? হরিদাস পাল।

খেলার কথা ছাড়ুন মধুদা, কেমন আছেন বলুন।

কী যে কস চানু, খেলা তো ছাইড়াই দিয়ছি, খেলার কথাও ছাইড়া দিলে আমার আর কী থাকল। ক’টা বাজেরে?

আমি আমার কোয়ার্টজ ঘড়িতে তাকিয়ে বলি, চারটে পনেরো।

খুব আর্লি আর্লি আসছস চানু আমার লোকজন সব পাঁচটা নাগাদ আসে। আমারে একটু ধরবি চানু? একটু দেখা কইরা আসি। আজ না গেলে আর হবে না রে। আমারে একটু নেফ্রলজিতে নিয়া যাইতে পারস? একটু আড্ডা দিয়া আসি।

ওখানে কে আছে মধুদা?

আমার পিসাতো ভাই। বাংলাদেশ থিকা এসেছে। বড়পিসার ছেলে।

বাংলাদেশ থেকে এন আর এসে এসেছেন ট্রিটমেন্টের জন্য?

হ্যাঁ। আমার আর এক পিসামশাই, মানে ছোট পিসামশাইয়ের ছেলে অনির্বাণ এই হাসপাতালের ডাক্তার। অর ব্যাকিঙেই আমার এই কেবিন। অনির্বাণের ভরসাতেই বাংলাদেশের ভাই এখানে ভরতি।

নেফ্রলজি ডিপার্টমেন্ট বেশি দূরে নয়। একই ফ্লোরে। মধুদার হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে। ঠিক কী হয়েছে আমি জানি না। নানান কথা শুনছি। মধুদাকে, ডাইরেক্ট জিজ্ঞাসা করা যায় না। এগারো নম্বর কেবিনের দরজা ফাঁক করেই মধুদা বলল, হেরি ও ফরাইন্যা ফরাইন্যারে, এক্কারে ভুলছস নি, বেতুরিব্যাত। বিছানায় শুয়ে থাকা লোকটার মুখে হাসি। মুখটা ফুলে থাকায় সেই হাসি পুরোটা ফুটল না। দু’ হাত দু’পাশে বাড়াল লোকটা। মধু নি তুই? হাচা নি? বেদ্দপ। আয়, ইয়ানো আয়।

মধুদা বলল, কাইল আইতাম পাত্তাম না, আঁয়ার একখান পা ফালাইয়া দিব কাইল।

কী কস মধু? বয়, ইয়ানো বয়।

মধু ওই লোকটার বিছানায় বসল। লোকটার পা ফুলে আছে। লোকটা মধুদার গায়ে হাত দিল। বলল, মধু, কী কইলিরে।

ঠিকই কইলাম। কাইল আমার একখানা পা কাইট্যা ফালাইয়া দিব। একপায়ে, এতদূর আইতে পাত্তাম না। আইজই আইলাম।

ক্যান? পা কাটব ক্যান? কী হইছে?

কয়তো ক্যানসার।

কস কী?

কী আর কই। রেফারি ঘুষ খাইছে।

কোন রেফারি?

ভগবান।

কোন পা?

বাম পা।

কী ভাল শট আছিল তার বাম পায়ে।

কাছারির হেই মাঠখান আর আছে নিরে ফরাইন্যা।

হ। হ। এক্কারে সেম সেম আছে।

কত্ত বড় মাঠ, ক’চাই। এক কিনার দি কাছারি, আর এক কিনারে মকবুলের পরটার দোকান, দোকান খান আছেনি রে ফরান ভাই।

ব্যাবাক আছে। মক্‌বুলের পোলা চালায়। মকবুলের ইন্তেকাল হইছে। দোকানে সাইনবোর্ড দিছে খুশির ফোয়ারা।

খেলার পরে পরটা খাইতাম মকবুলের দোকানে।

ব্যাবাক মনে আছে তর মধু।

কিচ্ছু ভুলি নাই। কাছারি মাঠের পুব দিকে জোড়া কদমগাছ। এক কিনার দি কাছারি, অন্য কিনারে বাস রাস্তা মাঝে মাঠ। মাঠের উপর দিয়া পায়ে চলার সরু রাস্তা খান। আছে, অখনো আছে? হালদারবাড়ির ছাত থিক্যা হালদারগর তিন ভইন খেলা দেখত। আছে, হালদারবাড়ি আছে? স্বপ্নে তোগো মাঠে খেলি। কাঁচা রাস্তাটার ধারে বল পাইয়া ড্রিবলিং করতে করতে ছুটি, হালদারবাড়ির মাইয়ারা আমার খেলা দ্যাহে। বামপায়ে শট মাইরা গোল দি, গোলকিপার ইরফান ভোদার মতো দাঁড়াইয়া থাকে। গোলপোস্টের ভিতর দিয়া বল গিয়া কাছারিবাড়ির দেয়ালে লাগে। দেয়ালে ল্যাখা ইয়াহিয়া সাবধান।

ওরা দু’জন কথা বলে, আমি বাংলাদেশ দেখতে পাই। নোয়াখালি শহরের ওই মাঠ, মাঠ চিরে যাওয়া পায়ে চলার পথ, কদমগাছ। মকবুলের দোকানের পরটার গল্পও পেয়ে যাই। আমি কোনও দিন বাংলাদেশ যাইনি। গতবার আমাদের টিম ঢাকায় গিয়েছিল, আমি যেতে পারিনি। ওই মধুদা আর পরানদা, মামাতো-পিসতুতো দুই ভাই ওদের যে জীবনে ফিরে গেছে—সেটা আমার এই বয়েস। ওরা ঢাকার উয়াড়ির কথা বলছে, খুলনার মিলনপন্থী সংঘর কথা। আয়ুব খাঁর কথাও বলছে।

মধুদা বলছে, কত দিন পর প্রাণ ভইরা নোয়াখালি কথা কইলাম, ক ফরাইন্যা?

পরানদা বলল, নোয়াখালি কস ক্যান, নোয়াহালি ক।

মধুদা বলল, তগো নারায়ণ ছিল না ঘরে, পূজা করসনি অখনো?

পরানদা বলল, পূজার ব্রাহ্মণ নাই। মন্ত্রপইড়া হয় না আর। সিংহাসন আছে। নারায়ণও আছে। আমাদের পাশের অবনী ভট্টাচার্যের বাড়িখান কিন্যা নিচ্ছে জাকির মিঞা। জাকিরের নাতনির নাম শ্রাবণী। আর দেখ আমার মুসাত ভাই অনির্বাণের মাইয়ার নামও শ্রাবণী। ভট্টাচার্যবাড়ির জবাগাছ-টগরগাছ চাঁপাগাছগুলি তো জাকিরের গাছেও একই রকম ফুল দেয়। শ্রাবণী সাঁজি ভইরা রোজ ফুল নিয়া আসে। নারায়ণ মন্ত্র পায় না, ফুল পায়। ইন্ডিয়ায় পাঠাইয়া দিমু ভাবি। মা কয় থাক। নারায়ণ থাক। তর তো ফাউল হইয়া গেছে গা। তর কথা ক। পায়ে এই রোগ বাধাইলি ক্যামনে।

তর কথা ক। কিডনি রোগ বাধাইনি ক্যামনে।

জানি না।

আমিও জানি না।

পা ফুলে নেফ্রাইটিসের রোগী আর পায়ের হাড়ের ক্যানসার হওয়া রোগি দু’জন হাহা করে হেসে ওঠে। পরানদার মুখ ফুলে থাকায় চোখ দুটো এমনিতেই ছোট লাগছে। হাসছে, তাই চোখ দুটো আরও ছোট হয়ে যায়। আমি ঠিক বুঝতে পারি না এই সময় আমারও হেসে ওঠা উচিত কি না। আমি বলি, আপনারা হাসছেন?

মধুদা বলে, হাসুম না কি কাঁদুম নিকি? হঠাৎই যেন মধুদার সম্বিত হয়। বলে, আরে পরান, এই ছ্যামড়াডার লগে পরিচয় কইর‍্যা দি নাই এতক্ষণ। এর নাম চানু। চঞ্চল সরখেল। মোহনবাগানে খেলে।

পরানদা উঠে বসতে গেলেন, ঠিক পারলেন না। আবার বালিশে মাথা দিয়ে দু’ হাত সামনে বাড়িয়ে বলেন তুমিই চঞ্চল, আরে আরে। হাইয়েস্ট স্কোর করছ। তোমার খেলা তো টিভিতে দেখছি বাংলাদ্যাশে বইস্যা। বড় ভাল খেল।

আমি পরানদার এগিয়ে আসা হাতটা ধরি।

শীতল হাতের কম্পন টের পাই।

মধুদা বলল, আমার হাতেরই তৈয়ার।

পরানদা বলল, বাম পায়ের কাজ দেইখ্যাই বুঝন যায়।

পরানদা বলল, মনে আছে মধু, তোর সেই বাইসাইকেল ভলি, বাম পায়ে, শাঁখারিটোলা ক্লাব ভার্সেস আমাগোর নোয়াখালি একাদশ। তোর গোলে জিতলাম। ‘একুশে’ ট্রফি পাইলাম আমরা। একুইশারী ফ্রেব্রুয়ারি ভুলব না, ভুলব না—কী আওয়াজ, সইফুদ্দিন তোর বাম পা মাথায় নিল, কইল দ্যাশ স্বাধীন হইলে তোর পা রুপায় মুড়াইয়া দিবে…

সইফুদ্দিন কেমন আছেরে?

রাজাকারে মাইরা ফালাইছে।

পরানদা আমার হাতটা ধরেই রেখেছে।

দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সাতটার সময় প্রডিউসারের বাড়ি যাবার কথা। নেক্সট এপিসোডের স্ক্রিপ্ট দেবে। রাত ন’টায় সুমিতা হক ফোন করবে। অ্যাড এজেন্সির। সে আবার একটু জ্ঞানদা পিসি। বড় বকর বকর করে। শচীন তেন্ডুলকর যে ভাবে অ্যাডে গ্যালারি মারায়, আমি পারি না, আমি কম স্মার্ট, সুমিতা হক বোঝায়। বাঁ পায়ে শট মেরে বল গোলে চালান করার পর খেলোয়াড়রা আমাকে কোলে তুলে নেবে, তারপর আমি একটা চুনকাম—সরি, চুইংগাম মুখে দেব। পায়ের স্টেপটাই পালটে যাবে, আর, তখনই চুইংগামটার ফেলে দেয়া পাউচটা উড়ে উড়ে পর্দায় নাচবে। আমার নাকি পায়ের স্টেপিংটাই হচ্ছে না। ফুটবল প্লেয়াররা নাকি যথেষ্ট স্মার্ট নয়। গিজোড়।

মধুদাকে যখন ওর নিজের কেবিনে নিয়ে যাচ্ছি মধুদা আমার হাতটা শক্ত করে আছে। নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে বললেন, চানু, তোকে নিয়া আমার গর্ব। আই ফিল প্রাউড…

আমি বললাম, ক্যানসারটা কবে ধরা পড়ল মধুদা।

মধুদা বলল, মাসখানেক আগে। শোন চানু, ওই সব বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন বাদ দে। খেলার ক্ষতি হয়। কী করবি এত টাকা দিয়া। ন্যাশনালে গোল পাওয়া চাই। আমি হয়তো তখন আউট অব দি ফিল্ড। রেডকার্ড দেখাইয়া দিছে অলরেডি। চানু, আমার কোনও ছাত্ৰই ন্যাশনালে খেলে নাই। আমি বললাম, পা-টা অপারেশনের পর… আমাকে থামিয়ে দিয়ে মধুদা বলল, অপারেশন নয়, অ্যাম্পুট, অ্যাম্পুট…। পা খান ফালাইয়া দিব কাইল। বড় ইচ্ছা হয় চানু, আইজ শ্যাষবারের মতন বাম পায়ে একটা শট মারি।

আমি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলি, পা-টা কাটার পরই তো ভাল হয়ে যাবেন, অত ভাবছেন কেন, রেডকার্ড-ফেডকার্ড সব আজেবাজে ভাবছেন।

মধুদা আবার হেসে উঠল। বলল, সব জানি। ঠ্যাং কাটার পর আবার আর এক জায়গায় উদয় হবে। ক্যানসার। বেকেনবাওয়ার। নিমেষের মধ্যে পেনাল্টি এরিয়ায়।

মধুদার কেবিনের কাছে চলে এলাম। মধুদা আমার হাতটা ছাড়লেন। বললেন, ঠ্যাংটা কাটার পর ক’দিন কেমোথেরাপি হবে। আবার আসতে হবে। তখন আসিস হাসপাতালে।

আমি বললাম, তখন কেন, নৈহাটি যাব। অপারেশনের পর নৈহাটি ফিরবেন না?

তা ছাড়া কোথায় ফিরব?

তা হলে নৈহাটি যাব।

কথা রাখতে পারবি? আফটার অল ইউ আর এ বিজি পারসন।

আমি মাথা নিচু করি। ওর কেবিনের সামনে চলে এসেছি। অনেকেই বসে আছে। বলি, খুব খরচ হচ্ছে, না মধুদা?

তা তো হচ্ছেই।

যদি আমি কিছু…

তুই কিছু দিলে আমি কি নিষেধ করতে পারি? সত্যি কথা বলি? সবার ডোনেশনেই আমার চিকিৎসা চলতাছে। আমার তো নিজের কিছু নাই। তোরাই আমার সম্পদ।

ঘরে যারা বসে আছে, তাদের অনেকেই আমাকে হিংসে করে, নিন্দে করে, আমি জানি। ওদের সবার দিকে তাকিয়ে দাঁত ক্যালাই। কে একজন বলল, এতদিন পর সময় হল? মধুদা রোজ তোর কথা বলত।

তারপর মধুদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। আগামিকাল একটা পা থাকবে না। মধুদা বলল, চানু, দম বাড়াইবার ব্যায়ামটা করস তো যেটা শিখাইয়া দিছিলাম…।

করি।

মধুদা ভাবেন আমার পুরো স্কিল মধুদার দেওয়া। ভেবে আনন্দ পান। চানুদার পর চার জন কোচ পেয়েছি। স্পেন থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা কোচ অতনুদার কাছে খেলা শিখেছি। দম বাড়ানোর জন্য মধুদা আদ্যিকালের ওই আস্তে আস্তে নিশ্বাস নেওয়া আর আস্তে আস্তে ছাড়ার প্রাণায়াম করতে বলতেন, সেই ধরে রেখেছেন এখনও। দম বাড়ানোর জন্য কত কায়দা বেরিয়েছে আজকাল। পেঙ্গুয়িন স্টেপিং, হগ প্রসেস, কত কী, মধুদা খবরই রাখেন না। কাগজে ছবি বেরলেই মধুদা চিঠি লেখেন। অমুক কাগজে ছবি দেখলাম। খুব খুশি হয়েছি। তোর জন্য গর্ব হয়। মনে হয় এত পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। যেন আমার জন্য এক্সট্রা লেবার দিয়েছ তুমি। তিমির সাহার জন্য কম খেটেছ? ভোর ছ’টার সময় তিমিরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে মাঠে নাওনি? হাফ বয়েল ডিম পকেটে করে নিয়ে আসতে তিমিরের জন্য। কী হল? তিমির তো ফাস্ট ডিভিশনেও খেলতে পারল না। মধুদা একদিন লিখল, সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলে তুই খেলছিস। তোকে অভিনন্দন। তুই আমার মানসপুত্র। তোকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি চানু। সন্তোষ ট্রফিতে প্রথম গোলটা করে একবার আমার নাম করিস। সেই দিনগুলির কথা মনে করিস, যেদিন নৈহাটির কদমতলার ছোট্ট মাঠে…

হ্যাঁ, কদমতলার ছোট্ট মাঠে ফাইভ টু হাইটের ম্যাচ। আমার হাইট পাঁচ ফুট দু ইঞ্চির অনেক কম তখন। ক্লাস এইটে পড়ি। ফাইনালে হ্যাট্রিক করলাম। মধুদা ছিল ওই ম্যাচের অরগাইনাজার। ম্যাচের পর মধুদা আমার নামধাম, বাড়ির খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বলেছিলাম আমার বাবা রেলের গ্যাংম্যান। বলে দিলাম খেলতে দেখলে বাবা প্যাঁদায়। বাবা বলছে বড় হয়ে স্টেশনমাস্টার হতে হবে। বললাম বাবা মদ খায়, মাকে মারে। বললাম দু’ বেলা পেট ভরা…।

মধুদা রেলের মাঠে খেলতে আসতেন, বলেছিলেন, রেলের মাঠে আয়। বাবার কাছে গেল মধুদা। সেটা বছর বারো হয়ে গেল।

মধুদা নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন উনিশশো একাত্তরে। আমার তখন জন্মই হয়নি। একটা টেলারিং-এর দোকান করেছিলেন, টেলার মাস্টারও রেখেছিলেন। পরে ওই টেলার মাস্টারের কাছেই মধুদাদের দোকানটাকে বিক্রি করে দিতে হয়। মধুদা নৈহাটি অ্যাথলেটিক্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন, এখনও বোধহয় তাই। নিজেই ফুটবল খেলার রেফারি। নিজেই কোচ। আবার ফুটবল টুর্নামেন্ট অ্যারেঞ্জ করতেন।

আমাদের ইস্কুল, সুব্রত কাপে এন্ট্রি নেয় মধুদার চেষ্টাতেই। আমি স্কুলের হয়ে খেলেছিলাম। আমাদের খেলার স্যার যিনি ছিলেন, তিনি সাবধান/ আ-রাম/ ডাইনে মুড়/ বাঁয়ে মুড় করাতেন। ফুটবল-টুটবল হার্গিস খেলাতেন না। মধুদাই আমাদের ইস্কুলের ফুটবল ট্রেনার হয়েছিলেন। আমাদের ইস্কুল কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম। তখন ক্লাস টেনে। সেই সময় মধুদার কাছে সকাল-বিকেল গিয়েছি। ঋষি বঙ্কিমে পড়ার সময়েই এরিয়ানস ক্লাবে চান্স পাই। ভোর পাঁচটা দশ-এর ট্রেনে কলকাতা যেতাম। মধুদার সঙ্গে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক তখনই শেষ। মাঝে মাঝে দেখা হত, দাঁড়িয়ে দুটো কথা হত, ব্যস, এইটুকুই। তারপর এরিয়ানস থেকে স্পোর্টিং ইউনিয়ন, তারপর এই ক্লাব। সন্তোষ ট্রফির প্লেয়ার। ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেল। দমদমে ফ্ল্যাট হয়ে গেল একটা। নৈহাটি থেকে দমদম। গুড মর্নিং গ্ল্যাড টু মিট ইউ—বাআই রপ্ত হয়ে গেল। ভেবেছিলাম, আমি যখন একা একা বল নিয়ে এগিয়ে যেতাম, নিজে নিজে রিলে করতাম—বল নিয়ে এগুচ্ছেন রোমারিও, গুলিটকে কাটালেন, সামনে ফাঁকা গোল…। স্বপ্নেও ভাবিনি আমার খেলাও রিলে হবে… চানু রে, শোন শোন। কাল রিলে শোনলাম। বল নিয়ে এগুচ্ছেন চঞ্চল সরখেল…কী যে ভাল লাগছিল চানু… মধুদা প্রথম প্রথম বলতেন। যখন নৈহাটি থাকতাম। উৎসাহ পেতাম। কিন্তু মধুদা যেটা বলতে চান—উনিই আমাকে তৈরি করেছেন। আমার যা কিছু স্কিল মধুদার দেওয়া—দ্যাট ইজ নট ট্রু।

দুই

কে পয়সা পিটছে না? শচীন পিটছে না? কাম্বলি পিটছে না? মাধুরী ক’দিনে কোটিপতি হল? মিঠুন? আমি চান্স পেয়েছি, পিটব। একটা কোল্ড ড্রিংক্স-এর নাম ছাপ গেঞ্জি পরলেই টাকা পাই। একটা কোম্পানির বুট পরে ছুটলে টাকা পাই। কেন করব না? যার চোখ টাটাচ্ছে টাটাক। মন্দিরা বলছে টিভিতে আমাকে নাকি হেবি সুন্দর লাগে। ফুটবল খেলা বেশি দিন স্টে করে না। খেলা চলে গেলেই পাবলিক ভুলে যায়। এ বছর হাইয়েস্ট গোল দিয়েছি, আগামী বছর যদি সত্য কিংবা সুচুং স্টার হয়ে যায়—গেঞ্জি জাঙিয়ার কোম্পানিগুলো ওদের দিয়েই ছবি তোলাবে সুতরাং খেপ এলে ওয়েলকাম। পরে আক্ষেপ করার মধ্যে আমি নেই। মন্দিরা তো আমাদের মতো ফ্যামিলির মেয়ে নয়, ছোটবেলা থেকেই ফ্রিজের জল খেয়ে বড়। আমার তো ব্যবস্থা রাখতেই হবে। মাঝে মাঝে এখানে ওখানে পাঁচ-দশ হাজার ডোনেশন করা ভাল। যেমন স্প্যাসটিক সোসাইটি, থ্যালাসেমিয়া সোসাইটি, এরকম। এতে গ্যালারি হয়। আগামী বছর মালয়েশিয়াতে একটা সফর হওয়ার কথা। মালয়েশিয়া এখন ইলেকট্রনিকস-এ বহুত অ্যাডভানস্‌। কিছু মাল কিনব। একটা সি ডি প্লেয়ার কিনে মন্দিরাকে দেব। ক’দিন আগে মন্দিরাকে সঙ্গে নিয়ে একটা মিক্সি কিনে আনলাম। মা তো কিছুতেই ওটায় মশলা করবে না। মা সেই শিল নোড়াতে মশলা বাটে। মিক্সিটা এমনি এমনি পড়ে আছে। মন্দিরার এখানে পোযাবে না। আর একটা ফ্ল্যাট দেখতে হবে। খরচ কি কম, মধুদাকেও কিছু টাকা দিতে হবে। ওয়াদা করা আছে। দিস ইজ ডিউটি। যাব, একদিন নৈহাটি যাব। ক’দিন আগে মধুদার খবর পেয়েছি। ওর নাকি একটা অদ্ভুত ব্যথা হচ্ছে। যে পা-টা ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেই পায়েরই হাঁটুতে, গোড়ালিতে। হাঁটু নেই, গোড়ালি নেই অথচ ব্যথা আছে। মধুদার একটা পোস্টকার্ড পেয়েছি তিন-চার দিন হল। একটু যেন অভিমান। কষ্ট করে তোকে নৈহাটি আসতে হবে না। একটা দরকারে এই চিঠি। আমার পিসতুতো ভাই পরান কলকাতায় আছে। ওর ঠিকানা দিলাম। ওর কাছে একদিন যাস। ওর তোকে খুব ভাল লেগেছে। প্লিজ যাস।

ঠিকানা দেখলাম শান্তি ঘোষ স্ট্রিট। আমি চিনি। শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছেই। মেট্রোর কাছাকাছি বাড়িটারি থাকলে অসুবিধে নেই। মেট্রোকে বলি ফুটোস্কোপ। ফুটো দিয়ে ঢোকো, ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যাও। দমদমে আমার ফ্ল্যাট থেকে সাত-আট মিনিট হেঁটে গেলেই মেট্রো রেল। মেট্রো রেলের একটা বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছিল সুনীল গাঙ্গুলি, মৃণাল সেন, পি কে ব্যানার্জি…। না, আমি ওরকম স্বপ্ন দেখি না। তবে আমাকেও তো টিভিতে দেখায়।

শান্তি ঘোষ স্ট্রিটে গেলাম। সিক্স বাই বি। দরজায় লেখা ডা. অনির্বাণ চ্যাটার্জি। ডাক্তারের বাড়িতেই আছেন পরানদা। চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হওয়ার কথা নয়। মধুদার বড়পিসির ছেলে হচ্ছেন পরানদা, আর ছোটপিসির ছেলে অনির্বাণ। ওরা দু’জন মাসতুতো ভাই।

পরানদার মুখচোখ আরও ফুলে গেছে। পরানদা বলল, সো কাইন্ড অফ ইউ।

কেমন আছেন পরানদা।

ডেটোরিয়েটিং। কামিং উইকে পিজিতে ভরতি হব। ডায়ালিসিস হবে। আলটিমেটলি হয়তো ভেলোর যেতে হবে। কিডনি পালটাতে হবে। বাট আই মাস্ট ডু ইট। আমার এখনও অনেক কাজ বাকি। আই মাস্ট সারভাইভ।

পরানদার কথায় কোনও রকম টান পর্যন্ত নেই এখন। মধুদার সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, অর্ধেক কথাই বুঝতে পারছিলাম না। পরানদা বললেন, শোনো চানু, তোমারে একটা প্রোগোজাল দিমু। দুই দিন চিন্তা করবা, তারপর ইয়েস অর নো বলবা।

একটু বাংলাদেশি টান এসেছে এবার। আন্তরিক হয়ে গেলে এরকম হয়। মধুদারও হয়।

আমিও একজন ফুটবল প্রোমোটার, তোমার মধুদার মতো। কিন্তু অর মতন আমি খোদার খিদমতগার না। আমার বিজনেস আছে। বুঝলা?

হুঁ।

আমার একটা নোয়াখালি বেসড ক্লাব আছে। নাম দুরন্ত দল। গত কয়েক বছর ফার্স্ট ডিভিশনে খেলছে, ঢাকায়। গত বছর লিগে থার্ড পজিশনে। টিমটারে তৈয়ার করতে চাই, বুজলা।

সামনের লিগে আমার ক্লাব লিগ চ্যাম্পিয়ান। দিস ইজ মাই মটো। বুঝলা। আমি আমার ক্লাবের প্লেয়ারদের কিছু ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করছি। আগামী মাসেই—অরা কলকাতায় আসতাছে। কয়েকটা খেলার কথাবার্তা চলছে। কিছুদিন পরে টিমটারে সিঙ্গাপুর নেবার ইচ্ছা আছে। সবার হাতে কিছু ডলার দিয়া বাজারে ছাইড়া দিমু। দিস ইজ ইনসেনটিভ। আই নিড ইট। তুমি আমার টিমের স্ট্রাইকার হও। এক বছরের কনট্রাক্ট। বলো কত টাকা চাও। আওয়ার ক্লাব হ্যাজ ইটস ফান্ড।

বাংলাদেশ যেতে হবে?

কী হয়েছে। কতক্ষণের রাস্তা? তোমাদের বাইচুং, বিজয়ন—সব কোথাকার? ওদের ঘর কোথায়?

না মানে বাংলাদেশের অবস্থা…

খুব ভাল। তোমায় মাথায় করে রাখবে। জোরাজোরি কিছু নয়। চিন্তা হয়।

টাকার অঙ্কটা…

তুমি এখন যা পাও তার দেড় গুণ তো হবেই। ওদের লোক আসবে। ইউ গেট ইট।

আমার ব্যাংকের চাকরি।

সেটা কোনও প্রবলেমই নয়। এক বছর উইদাউট পে ছুটি পাওয়া যায়।

কিন্তু মাইনেটা?

সে আমরা পুষিয়ে দেব। সব পোষাইয়া দিমু। গেইন ছাড়া লস নাই।

চিন্তা করে দেখি।

প্লিজ। অনেক কথা বললাম। ফিলিং টায়ার্ড।

মন্দিরা বলল, ভালই তো। খবর হবে, পাবলিসিটি হবে। সবাই জানবে তুমি বিদেশে যাচ্ছ খেলতে। ফিফটি পার্সেন্ট টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে নাও, নিয়ে একটা ফ্ল্যাট বুক করে দাও।

আমি বললাম, এক বছর তোমাকে দেখতে পাব না যে।

মন্দিরা বলল, কেন পাবে না। মাঝে মাঝে আসবে। যাবার আগে রেজিস্ট্রিটা করে নিয়ো। তা হলে তোমার সঙ্গে গিয়েও থাকতে পারব।

এই সব ব্যাপারে বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলে কোনও লাভ হয় না। কাকেই বা জিজ্ঞাসা করি। মধুদাকে জিজ্ঞাসা করব?

যাব। মধুদার বাড়ি যাব। আগামী বৃহস্পতিবার মন্দিরার জন্মদিন। শুক্রবার খেলা। শনিবার প্র্যাকটিসে যেতেই হবে। রবিবার খেলার কাগজের সাংবাদিক আসবে। আমাকে নিয়ে একটা ফটো ফিচার করবে। সোমবার কী যেন…

ইতিমধ্যে একদিন ফোনে অ্যাপয়েন্ট চাইলেন সামশের আনোয়ার খান নামে এক ভদ্রলোক। পরানদার রেফারেন্স দিলেন। একটা ডেট করলাম।

আনোয়ার সাহেব পাজামার সঙ্গে একটা লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরেছেন। গায়ের মিষ্টি মিষ্টি গন্ধটা আমি চিনি। ওডিকোলন। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। আঙুলে একটা আংটি। পাথরটা হেভি চমকাচ্ছে। হিরে? কে জানে। আনোয়ার সাহেবের সঙ্গে আর একজন।

বাড়ি চিনতে অসুবিধা হয়নি?

জি না।

বলুন!

আপনি বলুন।

আমার কিছু বলার নেই। আপনিই বলুন…।

ওরা যা অফার করল তাতে এমন কিছু লাভ হবে বলে মনে হল না। অঙ্কে আমি ভাল ছিলাম না কখনও। পাঁচ অঙ্কের/ছয় অঙ্কের সংখ্যাগুলি নিয়ে ডিল করতে হচ্ছে। সংখ্যাগুলিকে বারো দিয়ে ভাগ করতে হচ্ছে মাসে কত হয় বুঝে নিতে। তার সঙ্গে এখন কী পাচ্ছি সেটা হিসেব করে কম্পেয়ার করা, ভেরি টাফ। ক্যালকুলেটার নিয়েও ভুল হয়। বেশ ভজকট ব্যাপার। এটুকু বুঝলাম—এমন কিছু লাভ হচ্ছে না। আমি বললাম, যাচ্ছি না।

ফাইনাল?

হ্যাঁ।

আমরা আরও বিশ হাজার বাড়াতে পারি।

বড় মক্ষীচুষ আপনারা।

জি?

কিচ্ছু না।

কন কিছু।

যাব না।

ফাইনাল?

ইয়েস।

আনোয়ার সাহেব রথম্যান ধরালেন। বললেন, তা হলে অন্য একটা প্রস্তাব।

বলুন৷

আনোয়ার সাহেব সঙ্গের ছেলেটিকে বললেন, কাইন্ডালি একটু বাইরে যান।

ছেলেটা বাইরে গেলে আনোয়ার সাহেব বললেন, আমাদের ক্লাবের সঙ্গে আপনাদের ক্লাব একটা ম্যাচ খেলবে। ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা যদি ম্যাচ জিততে পারি তবে আমাদের ক্লাবকে ভাল টাকা ডোনেশন দেবার ওয়াদা করেছেন আমাদের দ্যাশের একটা জাহাজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। আমাদের ছেলেদেরও কিছু কিছু টাকা দেবে। আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী বিভিন্ন রকম ইনসেনটিভের কথা কবুল করেছে। এই ম্যাচ জিততেই হবে আমাদের।

তো?

ইউ প্লিজ হেল্প মি৷

হাউ?

আপনি আমাদের গোল দেবেন না। খেলা ছেড়ে দেবেন। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব।

ইমপসিবল।

আপনি হেল্প করলে আমার ক্লাবটা দাঁড়ায়। জাহাজ কোম্পানির অনেক টাকা পাব আমরা।

সে হয় নাকি?

কেউ জানতে পারবে না। নট ইভেন পরানদা।

না-না। এরকম ভাবে…

টাকার দরকার নেই আপনার?

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এভাবে

ক্লাবটা বাঁচে। আমাদের ছেলেগুলো বাঁচে…

মধুদার কাছে যাচ্ছি। ক্যাশ দশ হাজার। মধুদার কেমোথেরাপিতে অনেক টাকা লাগছে। এটা কোনও গুরুদক্ষিণা নয়। জাস্ট হেল্প। টাকাটা কী ভাবে রোজগার করেছি সেটা কোনও ভাববার ব্যাপারই নয়। এসব নিয়ে ভাবনা এলে লং কিক করে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দি। একজন রিপোর্টার বলেছিল লিখে যেমন টাকা পাওয়া যায়, না লিখেও টাকা পাওয়া যায়। একজন বড় ক্লাবের এক কর্মকর্তার কিছু কিছু কাজ কারবার ও জানে। ও সেইসব ডকুমেন্ট ফাস করে যে টাকা পেয়েছে, লিখে সে তুলনায় কিছুই পেত না। টাকা হল গঙ্গাজল। গঙ্গাজলে পাপ নেই।

মধুদার জন্য ফল কিনেছি। পলিথিন ব্যাগের ভিতরে আপেলের লাল আভাস। আঙুর উঁচিয়ে আছে, মুসাম্বি লেবুগুলো গাঢ় সবুজ। মধুদার বাড়ি গেলাম।

টিনের ঘর, ঠিক তেমনই। তক্তপোশ। একটা ছোট্ট টেবিল। দেয়ালে পেলের পোস্টার। সব একরকম। শুধু দেয়ালে হেলান দিয়ে আছে একটা ক্রাচ। আগে ছিল না। মধুদার সব চুল উঠে গেছে। অল্প কয়েকটা চুল যা আছে পুরো সাদা। গায়ের চামড়া কেমন যেন কুঁচকে গেছে কালচে। একটা গেঞ্জি আর পাজামা পরে আছেন। পাজামার বাঁ দিকটা অবলম্বনহীন, শূন্য। নেতিয়ে পড়ে আছে। মধুদা গম্ভীর। হয়তো রোগের কারণেই। পলিথিনের ব্যাগটা রাখলাম। মধুদা ওদিকে তাকালেন না।

কেমন আছেন মধুদা।

ভাল নয়।

কেন?

এক কথায় বলা যায়?

মাঠে যান আর?

যাই। রিকশায়। কিছুক্ষণ থাকি।

মধুদার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বেশ বুঝতে পারি আমি। মধুদার মুখের দিকে তাকাই। হেরে যাওয়া ক্যাপ্টেনের মতো মুখ। যদি আমার অনেক টাকা হয়, নৈহাটিতে মধুদার নামে একটা টুর্নামেন্ট চালু করে দেব।

মধুদাকে নমস্কার করি আমি। এক পায়ে। আর একটা পা যেখানে থাকতে পারত, সেই শূন্যে, মহাশূন্যে একটা একশো টাকার একটা বান্ডিল রাখি।

এটা কী?

আপনার চিকিৎসার জন্য।

মধুদার কাটা পা নড়ে ওঠে। পুরো পাজামাটার শূন্য শরীর নেচে ওঠে। মধুদার বাঁ পাটা বাদ পড়ার আগেই একটা কিক চেয়েছিল। লাথি। মধুদা বলল, গ্যালারি মারাচ্ছিস?

অ্যাঁ?

পরানের ওই দুরন্ত দলের সঙ্গে তোদের ক্লাবের খেলাটা আমি টিভিতে দেখেছি। পেনাল্টি বক্সের ভিতরে যখন অবিনাশ তোকে বলটা পাস করল, তুই বাইসাইকেল ভলি মেরে চিতপটাং হয়ে গেলি। গ্যালারি মারালি। গ্যালারির সব লোক হাততালি মারল। আহা কী অ্যাটেমপ্ট। বলটা বারের উপর দিয়ে চলে গেল। ওই বল তোর বাঁ পায়ে জলভাত। সেকেন্ড হাফে পেনাল্টির ছ’ গজের মধ্যে অচিন্ত্য বল দিল তোকে। সেম বল। সিজারিয়ান মারলি। বল বাইরে চলে গেল। আর একবার একটা সিম্পল হেড দরকার ছিল, ব্যাকভলি করলি। খেলা শেষ হবার এক মিনিট আগে তোল্লাই বলটা বাঁ পায়ে ঠেলে দিলেই গোল, তুই হেড মারতে গেলি। বুঝি না কিছু?

আমি চুপ।

তোর ক্লাব এক গোলে হারল।

আমি চুপ।

তোর ক্লাবের সার্পোটার আমি না। কিন্তু আমি দুঃখ পেলাম খুব। চানু, আমি কোনও দিন সন্তোষ ট্রফিতে চান্স পাইনি। ন্যাশনালে খেলার স্বপ্ন দেখিনি। তোর মধ্যেই আমি ছিলাম। এখন আমি আর নাই। কোথাও নাই। আই অ্যাম ডেড।

আমি চুপ।

বুঝি না কিছু?

আমি, মধুদা আমি মানে…

সরা, সরা ওই টাকার বান্ডিল… নিয়া যা, অখনি নিয়া যা।

হাঁটুর উপর থেমে থাকা মধুদার বাঁ পা নড়ে উঠল। পদাঘাত। পদাঘাত। মধুদার পাজামার শূন্যতা জয়ধ্বজার মতো নড়ছে।

একটু জল হবে মধুদা, খাব।

তিন

আমি মধুদার বাড়ি যাচ্ছি। মধুদার শ্রাদ্ধ। ক্যানসার বেকেনবাওয়ার হয়ে পেনাল্টি এ বিষয়ে এসে গিয়েছিল ফের।

মধুদার ছবিতে মালা। মধুদা দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে বল।

পিণ্ডদান হল। মধুদার ভাইপো মন্ত্র পড়ছে। পুরোহিত বলছে, ওঁ মধুবাতা ঋতয়তে মধু ক্ষ্যরন্তি সৈন্ধবঃ। মাধ্বীর্ণ সন্তোষধিঃ মধুনক্ত মুতোষবা… ওঁ মধু ওঁ মধু ওঁ মধু। পুরোহিত বলল, ওই কথাটার অর্থ বুঝলেন। পৃথিবী মধুময় হোক। মধু ঝরে পড়ুক নদী-বৃক্ষে-সমুদ্রে… এটা জাস্ট মন্ত্র। এই মধু মানে মধুদা নয়।

মধুদার বাঁ পা-টা বাদ পড়ার আগে একটা কিক চেয়েছিল। কিক। লাথি।

আমি পালাই।

শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *