নারী হওয়া

নারী হওয়া

এক

দরজা ধাক্কানোর শব্দে কালিদাসী বলল, এখন খোলা যাবে না।

বাইরে থেকে কথা এল—আমরা এসেছি ভ্যান রিকশা নিয়ে। ভোট দিতে যাবেনি?

কালিদাসী বলল—যাওয়া হবেনি।

কেন হবেনি। দু-দুটো ভোট নষ্ট হবে?

কালিদাসী বলল—তোরা কেউ দিয়ে দিস গে যা। আমরা পারব না। প্রসব করাচ্ছি। পুঁটুর বাচ্চা হবে এখন।

নতুন বেলেড, ষাঁড় গোবরের ছাই, রসুন তেল, উদাল লতার পাতা, বেগুইল পাতা ছ্যাঁচা রস, সব নিয়েই কালিদাসী রেডি। পুঁটুর জল ভেঙেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু খালাস হচ্ছে না। কালিদাসী বলে—অ পুঁটু, ঠ্যাংদুটা আরটু ছড়ায়ে দে দিকিলো, আর এট্টু এট্টু করে কোঁত মার।

তাই করল পুঁটু। কিন্তু হচ্ছে না। ব্যথা গতকাল থেকেই। কালিদাসী গতকালও জন খাটতে যায়নি। একদিন কামাই মানে ষাটটা টাকা লস। কিন্তু কী করবে কালিদাসী, এটাও তো ডিউটি, নাকি?

পুঁটুর যোনিদ্বারে হাত রাখে কালিদাসী। বাচ্চার মাথাটার কোনও আভাস পায় না। দু’হাতে দুটো করে আঙুল যোনিপথে চালান করে বাচ্চার মাথা ঠাহর করতে চেষ্টা করে, তাতেও পায় না—দেখ দিনি একুনো ভিতরে ঠেসে বসে আছে। বেরোচ্চে না। আরে আয় বাপধন, সোনা আমার, কইলজে আমার, মিঠু আমার, শাহরুক আমার, আরে আয়নারে…।

আসলে চিন্তায় পড়েছে কালিদাসী। দু’ ঘণ্টা হয়ে গেল জল ভেঙেছে। দেরি হলে বাচ্চা বাঁচবে না।

কেৎরে উঠল পুঁটু। একটু আগেও কেৎরে ছিল। বাচ্চা বেরুনোর সময় হলে মোচকানো ব্যথা ঘন ঘন হয়। এবারই হবে মনে হচ্ছে।

আড় বাঁধ সার বাঁধ

চোদ্দো গেরো একুশনাড়ি

মা ষষ্ঠীর দয়ায় জিন্দা ছাওল আয়

শূলের শূল গোলাম

পুঁটুর গভ্‌ভে শূল চালান।

মদনীরের আজ্ঞায় ষষ্ঠীর বর।

পুঁটুর ছাওল উল্টিয়া ভূমে পড়

কার আজ্ঞায়?

মদনপীরের আজ্ঞায়।

কালিদাসী হাতজোড় করে বসে থাকে।

দুই

কালিদাসী প্রকৃত অর্থে দাই নয়। দাইগিরি করে ওর পেট চলে না। ও জন খাটে। এ অঞ্চলে কালিদাসীর মতো অনেকেই জন খাটে। এই গাঁয়ের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে বাংলাদেশ বর্ডার। গ্রামটির নাম ডুমডুমা। ছেলেপিলের বয়স বছর বারো হলেই দু-এক বোঝা মোট বয়ে দেয়। কালিদাসীর এ রকম অনেক ছেলেপুলে আছে। এই পুঁটুও একজন জন। কালিদাসীর সঙ্গে থাকে। কালিদাসী পুঁটুরানির মাসি হয়। পাতানো মাসি হলেও আসল মাসির চেয়ে বেশিই করেছে। পুঁটুর মা যখন পুঁটুর বাপকে ছেড়ে শান্তিপুরে চলে গেল, বলে গিয়েছিল মেয়েকে দেখিস। পুঁটুর তখন ছ’বছর বয়েস। পুঁটুর বাপের নাম দুলাল। কাজ করে মুখুজ্যে বাড়িতে। বাঁধি কিষেন। ঢেঁকিঘরে বাপ মেয়েতে থাকে। বাঁধি মুনিষদের জন্য আই আর এট এর মোটা চাল, পাচ মিশেলি তরকারি। ফাল্গুনের শেষে বাঁধাকপি যখন আট আনা কেজি, তখন মুখুজ্যে বাড়ির জন-মুনিষগুলোর জন্য বাঁধাকপির তরকারি, মাঘ মাসে যখন বাজারে মুলো বিকোয় না, তখন মাঠের পড়ে থাকা মুলো দিয়ে জন-মুনিষদের জন্য তরকারি। মুখুজ্যে বাড়িতে পুঁটুও জন্মদাসী। মুখুজ্যেকত্তার বড়খোকার মেয়ে হৈমবতী পুঁটুরই বয়সি। পুঁটু যখন হাঁটতে শিখেছে, হৈমর হাত থেকে পড়ে যাওয়া ঝুমঝুমি কুড়িয়ে পুঁটুকে দিয়েছে, হৈম যখন একা দোক্কা খেলেছে, পুঁটু ওর সেফটিপিন খুঁজে দিয়েছে। হৈম যখন ওর পুতুলের বিয়ে দিয়েছে, পুঁটু তখন ভোজবাড়ির জন্য শালুক পাপড়ির লুচি ভেজেছে, তেঁতুল বিচির মাংস রেঁধেছে। পুঁটু পাঁচ বছর হতেই ঝাড়ু দেয়, পলাং সাফ করে, পুঁটু যখন গুনতে শিখেছে, তখনই হাঁসগুলিকে আয় আয় চই চই ডেকে গণ্ডা হিসেব করে হাঁসের ঘরে নিয়ে গেছে, পুকুরে কেটো গর্তে চোরা ডিম রয়েছে কি না খুঁজে এনে গিন্নিমাকে ফেরত দিয়েছে। পুঁটু যখন আরও বড় হয়েছে, কর্তাবাবুর পা টিপে দিয়েছে, হৈমর বাবার পাকাচুল বেছে দিয়েছে। কর্তাবাবু, গিন্নিমারা পুকুরে নাইতে গেলে যেন না পড়ে যায়, এজন্য ঝামা দিয়ে শ্যাওলা উঠিয়েছে। এমনি করতে করতে পুঁটু বড় হয়েছে।

পুঁটুর মা তরঙ্গিনী কালিদাসীকে বলে গেছিল মেয়েকে দেখিস, তাই তরঙ্গিনী মাঝে মাঝে মুখুজ্যে বাড়ি গিয়ে পুঁটুর খোজ নিয়েছে। যখন পুঁটুর পেট ডিং ডিং, কালিদাসী কালমেঘের বড়ি খাইয়ে কৃমি বার করিয়ে দিয়েছে, যেদিন পুঁটুর প্রথম মাসিক হল, তেনা বাঁধা শিখিয়ে দিয়েছে, আর সেইদিনই পুঁটুর বাপ দুলাল মরল।

দুলালের পিঠে একটু কুঁজ। বেঁটে বামন। হাত বাড়িয়ে হাইব্রিড পেঁপে গাছের পেঁপেও নাগাল পেত না, পুঁটুর মার কাঁধের কাছে পুঁটুর বাপের মাথা। পুঁটুর বাপ যখন হাঁটত, ওর পিঠের কুঁজ কাঁপত। দুলাল গোরুর খড় কাটত, জাবনা দিত। গোরুর গা চুলকে দেওয়া, স্নান করানো, এসব করত, বাগানের জংলা পরিষ্কার, মাঝে মাঝে ইউরিয়ার থলে নিয়ে ধানখেতে জয় লক্ষ্মী জয় লক্ষ্মী বলে ইউরিয়া ছড়ানো, এইসব করত। আর একটা কাজে খুব পটু ছিল দুলাল। নারকেলগাছে উঠে নারকেল পাড়ত আর পুঁটুর মায়ের কাজ ছিল এককাড়ি বাসন মাজা, মস্ত উঠোনটা গোবর নেতা করা, মাছ কুটে দেয়া, এইসব। তা ছাড়া মাঝে মধ্যে বানেশ্বরের সঙ্গে শুতে হত। বানেশ্বর, মুখুজ্যেদের কীরকম যেন জ্ঞাতি ভাই। ল্যাংড়া। বে থা করেনি। সব জন-মুনিষ খাটাত বানেশ্বর। মুখুজ্যেকত্তার বড়খোকার বনগাঁ বাজারে পাটের আড়ত। মেজখোকা ইস্কুল মাস্টার, ছোটখোকা বারাসতে চাকরি করে, ওদের জমি জিরেত দেখার সময় কোথায়, সবই বানেশ্বরের হাতে। গলায় মোটা পইতে, হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে লেংচে লেংচে জমির আলে আলে চলে বেড়ায়, দেখে কে ফাঁকি দিচ্ছে কে কাজ কচ্ছে—হেঁকে ওঠে—আবার বিড়ি ধরালি দুলাল। একটা বিড়ির টাইমে বিশটা ধান রোয়া হয়ে যায়। বানেশ্বর আবার বারোয়ারি দুর্গাপুজোও করে, লোক মরলে শ্রাদ্ধশান্তিও করে দেয়। ওই বানেশ্বরের ঘরে তরঙ্গিনীকে মাসে দু-একবার যেতে হত। পুজো করে পাওয়া লালপেড়ে শাড়ি বছরে দুটো করে পেত তরঙ্গিনী বানেশ্বরের কাছে। কালিদাসীই বলেছিল তরঙ্গিনীকে, দুটো শাড়ি দিয়ে এ রকমভাবে সারা বছর রাখা যায় না। ঠকাচ্ছে। তরঙ্গিনী ভাবল পরপুরুষের সঙ্গে যখন শুতেই হচ্ছে তা হলে বরং গতর বেচাই ভাল। ওর কে যেন জানাচেনা ছিল শান্তিপুরে। ওখানে চলে গেল তরঙ্গিনী।

কালিদাসীকে বলে গেছিল মেয়েকে দেখিস। কালিদাসী দেখছে। দুলাল যখন মরল, কালিদাসী তারপরই পুঁটুকে নিজের কাছেই রেখেছে।

তিন

দুলাল যখন গাছ থেকে পড়ল, ওর তখনও চোখে ছিল নীল চশমা।

ওই চশমা হাট থেকে কিনেছিল দুলাল। একটা লোক সারা গায়ে চশমা সেঁটে হাঁকছিল গগলস্ গগলস্। দুলাল একটু নেড়ে চেড়ে দেখছিল, একবার চোখেও দিল। ভয়ে ভয়ে, আর অমনি আকাশের সাদা মেঘ নীল বর্ণ হয়ে গেল। হাঁসের ছা গুলিও নীল, আমিনুদ্দিনর সাদা দাড়ি নীল। কালো চশমা খুলে ফেলল তাড়াতাড়ি। দামও জিজ্ঞাসা করল একবার। লোকটা বলল, পঞ্চাশ টাকা। দুলাল ফেরত দিল। লোকটা বলল, তুমি কত দেবে। কত আর দেবে দুলাল। ও সামনে বাড়ল। লোকটা এসে খপ করে দুলালের জামা—ওটা ছোটবাবুর পুরনোটা, ধরে বলল, পালাচ্ছ যে বড়, জিনিস দেখলে দাম শুধোলে…বলো কত দেবে।

দুলাল বলেছিল, পনেরো টাকা। ভেবেই বলেছিল। পঞ্চাশের মাল কখনও পনেরো হতে পারে না, এটা ভেবে। কী আশ্চর্য লোকটা বলল, কুড়ি টাকা দাও। দুলাল বলেছিল, কুড়ি নেই। লোকটা ঝাঁঝিয়ে বলেছিল দেখি কত আছে? ষোলো টাকা ছিল দুলালের কাছে। পুঁটুর খুব পাউডার মাখার শখ হয়েছে। ক’ মাস ধরে বলছিল পাউডার এনে দাও। দুলাল ভেবেছিল হাটের কোনায় যেখানে কম দামের সোনো পাউডার বিক্রি হয়, ওখান থেকে কিনে দেবে একটা। কিন্তু হল না। চশমাওলা বলেছিল, যোলোই দাও এখন, সামনের হাটে বাকি চার টাকা দিয়ে দিয়ো।

ঘরে ফিরল। ঘর মানে ঢেঁকিঘর। ওই ঘরে আগে ঢেঁকি ছিল, এখন আর ঢেঁকি নেই। এখন এই ঘরে থাকে মেটাসিড, ফলিডল, ইউরিয়ার বস্তা এইসব। ঘরের ভিতর ওষুধ ওষুধ গন্ধ। দুলাল ভেবেছিল মেয়ের সঙ্গে একটু রগড় করবে। চশমাটা পরে ঘরে ঢুকেছিল। নীল চশমায় দুলাল দেখেছিল ওর মেয়ের টেপ জামায় কালো দাগ। উরুতে কালো ফোটা। ওমনি চশমা খুলল। দেখল লাল। ওমা! রক্ত!

চার

পুঁটুর তখন পুকুরে স্নান সেরে ফিরে আসার সময় গামছার দরকার, গায়ে জড়াতে হয়। পুঁটুর আলাদা গামছা ছিল না। দুলালের গামছায় বিড়ির গন্ধ।

পুঁটুর বাবার ওই গামছাটা পুঁটু ছোয়নি। একটা চটের টুকরো দুই পায়ের মাঝখানে রেখে চেপে শুয়েছিল। আলাদা। ইউরিয়ার খালি বস্তা পেতে বাবার থেকে দূরে শুয়েছিল। পুঁটুর ভীষণ লজ্জা করছিল। মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। ও যে মেয়েছেলে হয়ে গেছে। ইউরিয়ার বস্তা ঠিকরে চাঁদের আলোর মহামারি। ঘুম আসছিল না। হৈমবতী বড় দাদাবাবুর মেয়ে। ক’মাস আগে ওরও এ-রকম হয়েছিল। হৈম তখন উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলছিল। রক্ত দেখতে পেয়েই কেঁদে উঠেছিল হৈমবতী। গিন্নিমা তখনই বেরিয়ে এসেছিল, হৈমবতীর হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরে। খাটে শুইয়ে দিল। গরম দুধ খাওয়াল, আর দুলালকে ডেকে দশটা টাকা দিয়ে বলেছিল—ক’টা আপেল নিয়ে এসো। বাক্সয় ভরে আপেল যায় বাংলাদেশে। যারা পাচার করে, ওদের দশটা টাকা দিলে দু-তিনটে আপেল হাতিয়ে বার করে দেয়।

পুঁটু সকাল সকাল উঠে গেল। ওর তেনা দরকার। একটু তেনা। চাইবে? লজ্জা করে। পুঁটু হাঁসের ঘরে যায়। মদ্দা হাঁস দুটোর পায়ে চিহ্ন দিতে হবে। হাঁস দুটো অন্য পুকুরে যায়। কেন যায় পুঁটু জানে। হাঁসগুলোর পায়ে দড়ি বেঁধে জলে ছেড়ে দিয়ে গোবর পরিষ্কার করতে যাবে, তখনই বড় বউদির সঙ্গে দেখা। বড় বউদি গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজছিল। বড় বউদি পুঁটুর দিকে চাইল, বলে উঠল সে কী লো পুঁটু, বাঁধিয়েছিস। এইখানে দাঁড়া। দুধের গোরুকে ছুঁসনি তো!

পুঁটুর খুব লজ্জা হয়। মাথা নিচু করে থাকে।

শোন, দুধের গোরু ছুঁবি না।

পটল খেতে যাবি না।

পান বরজে ঢুকবি না

তুলসীগাছ ছুঁবি না।

হেঁসেলে ঢুকবি না।

পুঁটু মাথা নিচু করে থাকে।

তেনা বাঁধা জানিস?

পুঁটুর মাথা নিচু।

গুণীর মা এলে পাঠিয়ে দেব। ঘরে গিয়ে চুপ মেরে বোস থাকগে যা।

চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল পুঁটু।

পাঁচ

ফ্রক জামা পরে কালিমাসির কাছে গেল পুঁটু। কালিমাসি বলেছিল, যেদিন মেয়েছেলে হওয়া হয়ে যাবে, আমায় বলবি। আমি শিখিয়ে দেব। কালিমাসিই বলে দিয়েছিল মেয়েছেলে হয়ে গেলে কী কী হয়। মাঝে দু-একবার খোঁজ নিয়ে গেছে, কীরে, হল? কালিমাসি বলেছিল—তোরে ওই মুকুজ্যে বাড়ির থে বার করি আনব। আমার লাইনে কাজ করবি, থাকবি ভাল, খাবি ভাল। ও বাড়ি থাকলি সারাজীবন দাসীবিত্তি।।

পুঁটু বলেছিল, মাসি, আমার হয়েছে।

কালিমাসি জড়িয়ে ধরল পুঁটুকে। আদর করল। বলল, এবার তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাব একদিন। আমার কর্তব্য। তোর মা যদি মায়ের লাইনে রাখতে চায় তো রাখুক, নইলে আমার লাইনে।

পুঁটু বলে, না মাসি মায়ের নাইন ভাল নয়।

পুঁটু জানত ওর মা বেবুশ্যে হয়ে গেছে। বেবুশ্যে মানে বোঝে পুঁটু। বড়খোকাবাবুর মেজখোকাবাবু সুবল, কলেজে পড়ে। একদিন পেয়ারা খেতে গিয়ে হঠাৎ বুকে হাত দিয়েছিল, ছোট্ট বুকটায়। তারপর ওকে দেখলেই লজ্জা। ওই খোকাবাবুদের গেঞ্জি জাঙিয়া পুঁটুকেই সাবান কাচা করতে হয়। একদিন সুবলের ছাপছাপ জাঙিয়া কাচছিল পুকুরে, এমন সময় সুবল এসেছিল, অমনি জাঙিয়াটা বালতিতে সেঁধিয়ে দিল। লজ্জা। একদিন স্বপ্ন দেখেছিল পুঁটু, সুবল দাদাবাবু ওর ঘরে ঢুকেছে। পুঁটু বলছে, কেন এয়েচ? দাদাবাবু তখন পাঁচটা টাকা দিচ্ছে। পুঁটু বলছে, টাকা দিচ্ছ কেন, আমি কি বেবুশ্যে? দাদাবাবু বলছে, তোর মা তো তাই। দাদাবাবু ওকে টানছে, তখন চিৎকার করে। ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল পুঁটু। দুলাল বলেছিল, কী হল। চিল্লাস কেন!

কালিদাসী পুঁটুকে ঘরে নিয়ে গেল। পান্তাভাত আর কলমির শাক ভাজা খেতে দিল৷ তেনা বাধা শেখাল, তেনা দিল কিছুটা। কীভাবে ধুতে হবে, কোথায় লুকিয়ে শুকোতে দিতে হবে। সব বলে দিল কালিদাসী। তারপর কালিদাসী বলেছে—এখন বাড়ি যা। তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব।

পুঁটু আবার বলে, না গো মাসি মায়ের নাইন ভাল নয়।

কালিদাসী বলেছিল—আমারও তাই মত। রোজ রোজ কি পুরুষ বসানো পোষায়? যখন ইচ্ছে হবে তখন বসানো ভাল।

পুঁটুর কান গরম হয়ে যায়। এ রকম কথা আগে কখনও কালিমাসী বলেনি। কালিমাসী পুঁটুকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দুপুরে খেয়ে গেলে পারতিস। পেঁয়াজ দে পাঁকাল মাছের কটকটে ঝোল রাঁধব ভাবছি।

পুটু বলেছিল, বলে আসিনি।

বাড়ি ফেরার পথে পুঁটু দেখেছিল বিশ্বাসবাড়ির উঠানে ভিড়। নারকোল গাছতলায় শুয়ে আছে। পুঁটুর বাপ। ঠোটের কোনায় রক্ত, নাকের তলায় রক্ত। মাছি।

বাপ গো, বলে ঝাপিয়ে পড়তে গেল পুঁটু। বড়গিন্নি হাত টেনে ধরল। কাছে টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ছুঁসনি ছুঁড়ি, আত্মার অমঙ্গল হবে। তুই আশুচি না! আত্মা শুনে কঁকিয়ে উঠেছিল পুঁটু। আত্মা? মানে মরে গেছে? নুন লাগা মাগুর মাছের মতো ছটফটায় পুঁটু। বড়গিন্নি হাত ধরে রেখেছে। বামুনবাড়িতে থেকে অনাচার চলবে না।

বিশ্বাসদের বাড়ি মুখুজ্যেদের কাছেই। দুটো টাকা দেবে বলে অনন্ত বিশ্বাস দুলালকে নারকেলগাছে উঠিয়েছিল ডাব পাড়ার জন্য। দুলাল নাকি নীল চশমা চোখে দিয়ে গাছে উঠেছিল। গাছে উঠে বলেছিল সব নীল। নীলবন্নের মেঘ। নীল কাশফুল, সব দেখা যাচ্ছে। বিশ্বাস কত্তা, আপনার ধুতিটাও নীল, কিন্তু ওই পঞ্চায়েত বাড়ি লাল ফেলাগের রংটা কালো।

হাত ফস্কে পড়ে গিয়েছিল দুলাল। অনন্ত বিশ্বাস শুনেছিল জ্ঞান হারাবার আগে দুলাল বলেছিল, আপেল, পুঁটুর জন্যি আপেল।

ছয়

শ্মশানে গিয়েছিল কালিদাসী। পুঁটু ছাড়া কান্নার আর কেউ নেই। শ্মশানের ধারে কাশফুল ফুটেছিল। বাঁশের মাচাটা কাশবনে নামানো। কাশের গোছা হাওয়া হেলে পড়ছে দুলালের মুখে। দুলালের চোখে সেই কালো চশমাটা। পুঁটু দিয়ে রেখেছিল। ও দেখেছে, অনন্ত বিশ্বাসের বাবা মারা যাবার পর ওর চোখে চশমাটা লাগানো ছিল।

বামুন এসেছিল। ঘাটের বামুন। বানেশ্বরের খোঁজ করেছিল। বানেশ্বরকে পাওয়া যায়নি। বামুন জিজ্ঞাসা করেছিল, মুখে আগুন দেবে কে? মেজখোকাবাবু বামুনের কানে কানে কী যেন বলল। বামুন পুঁটুর দিকে তাকাল। তারপর মাথা নাড়ল। বামুন বলল, কেউ একজন মুখে আগুন দিয়ে দিয়ো৷ পঞ্চানন এগিয়ে এল। বিশ্বাসবাড়ির কিষেন। কালিদাসী পুঁটুকে বলল, চশমাটা নিয়ে নে। কী হবে পুড়ে গিয়ে। চশমাটা পুঁটুর হাতে। চিতা নিভে গেলে কালিদাসী বলেছিল, পুঁটুকে নিয়ে যেতে চায়। সবাই রাজি। পুঁটু সোমত্ত হয়ে গেছে। সোমত্ত মেয়েকে ঘরে রাখা কম ঝামেলা!

সাত

অপমৃত্যুর কাজ চার দিনে।

চার দিনের দিন ডালা সাজিয়ে ভুজ্যি দিয়েছে ঘাটের বামুনকে। একপো চাল, কুমড়ো এক ফালি, দুটো আলু, পান সুপুরি। গোরুকে কাঁঠাল পাতা খাইয়েছে, আর আঁজলা করে বাঁওড়ের জল নিয়ে বলেছে, বাবাগো, যেখানে থাকো ভাল থেকো।

কালিদাসী নতুন ফ্রক কিনে দিয়েছিল পুঁটুকে। বনগাঁ থেকে ট্রেনে চেপে রানাঘাট, রানাঘাট থেকে শান্তিপুর। স্টেশনে চা খেয়ে রিকশা চেপে অনেক দূর। কালিদাসী ওই চশমাটা পরেছে। দুলালের চশমাটা। একটু সরু গলির সামনে রিকশা দাড় করাল কালিদাসী। গলিতে মেয়েরা সব ঘরের সামনে বসে গল্প করছে, পান খাচ্ছে, গাল দিচ্ছে। পুঁটুর ভয় করছিল, আবার আনন্দও। কতদিন পরে মাকে দেখবে।

একটা ঘরে কড়া নাড়া দিল কালিদাসী। ভেতর থেকে আওয়াজ এল লোক রয়েছে। কালিদাসী পুঁটুকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিল। গলির মোড়ে। কালিদাসী পান খেল। পানওলা বলল, নতুন? কালিদাসী বলল—মরণ। আধঘণ্টা এদিক ওদিক কাটিয়ে কালিদাসী ঘরে গিয়েছিল। দরজার বাইরেই দাড়িয়েছিল পুঁটুর মা। পুঁটু ঠিক চিনতে পারল কিন্তু অনেক পালটে গেছে। গালে কালচে ছোপ, চোখ ফুলোফুলো। স্বপ্নে ও এ রকম দেখেনি। পুঁটুর মা দু’হাতে জড়িয়ে পুঁটুকে চুমু খেল। মায়ের গায়ের গন্ধটা পুঁটুর ভাল লাগল না। ওরা ঘরে গিয়েছিল। ঘরে একটা তক্তাপোষ, ঘরের কোনায় জনতা স্টোভ, একটা ফাঁকা বোতল, দুটো গেলাস, দু-চারটে চানাচুরের ডাল মঝেয় পড়ে আছে।

কীরে কালি, খবর বল। পুঁটুর মায়ের প্রশ্ন। পুঁটুর মাথায় মায়ের হাত। কালী খবর বলল। পুঁটুর বাপের খবর বলল। পুঁটুর মা চোখের জল মুছল। তারপর পুঁটুর খবর শুনল, শুনেই বলল, কী সব্বোনাশ। বলেই পুঁটুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তুই মেয়েমানুষ হয়ে গেলি রে পুঁটু…

তারপর অনেক কথা হল দু’জনে। পুঁটু ঘরের চারদিকে চোখ ঘোরাচ্ছিল। মা কালীর ছবি, গোপীগণের বস্ত্রহরণ, ইলেকট্রিক লোশন, বহরের ননি—যে-কোনও রকম জ্বালা যন্ত্রণায়…।

চা হল। পুঁটুর মা পুঁটুর হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিল। বলল, মিষ্টি খাস। বলল, সোনা মেয়ে আমার, তুই কালির কাছেই থাক। আমার লাইন খুব খারাপ রে সোনা। এখন যা, সন্ধে হয়ে গেলেই বিপদ।

ওরা বাইরে। বিকেল।

কালিদাসী বলেছিল— তোর মায়ের পারমিশেন হয়ে গেল। তুই এখন আমার।

কালি ওর ব্যাগটা খুলল। কালো ব্যাগে ওই কালো চশমা। ও নিজে পরল না। পুঁটুকে পরাল।

আর ওই চশমাটা বিকেলকে অন্ধকার করে সন্ধে করে দিল।

আট

কালিদাসী বলেছিল, এবার তুই বুঝবি। পুরুষজাতির কার কোন দিকে নজর। কোন পুলিশ একটু ঢলানিতেই সন্তুষ্ট, কোন পুলিশের কাছে একটু গা ঘেঁষি দাঁড়াতি হবে। কোন পুলিশেরে বাবা-জ্যাঠা ডাকতি হবে। কোন পুলিশের পায়ে পড়তি হবে। কোন মস্তানেরে দাদা ডাকতি হবে, রাখির দিনে রাখি পরায়ে দিতি হবে এবার নিজিই বুঝতি পারবি। আমার শিখাতি হবে না।

কাজটা মাল পাচারের। বনগাঁ থেকে এখানে আসে শাড়ি, মশলা, চিনি, তেল, আপেল, আঙুর এইসব। গ্রামের ভিতরের রাস্তা চওড়া নয়। মেটাডোর কোনও মতে ঢুকতে পারে, নইলে ভ্যান রিকশা! ভ্যান রিকশায় বর্ডার পর্যন্ত। একই মাঠ, মাঠে একই ফসল, একই কাক-শালিখ, একই হাওয়া বাতাস। মাঠ বরাবর কাটাতার। দূর দুরে বি এস এফ চৌকি। কাচা রাস্তাও তৈরি হয়েছে, কিছু জায়গায় কাঁটাতার কাটা আছে। ওই ফাক দিয়ে মানুষ মোট বয়ে নিয়ে যায়। ওরাই জন। এ অঞ্চলের বালকরা এভাবেই ‘জন’ হয়ে যায়। জন খাটে। এই জনরা সিনিয়ার হয়ে গেলে জন খাটায়। কালিদাসী জন খাটায়।

ওপাশ থেকে পোস্ত আসে, আর আসে পুরনো পোশাকের বস্তা। কালিদাসী বলে, মরা সাহেব মেমের জামা। ওইসব পুরনো কাপড়-জামা মোট বয়ে সাইকেল ভ্যানে তুলে দিতে হয়। এইসব কাপড়-জামা হাবড়া, রানাঘাট, শান্তিপুর, মছলন্দপুরে যায়। ওখানে ধোলাই হয়, লাইনিং হয়, মেডিন থাইল্যান্ড, মেডিন তাইওয়ান শিলিপ লাগানো হয়, তারপর মার্কেটে আসে। ধর্মতলার ফুটপাতে, কৃষ্ণনগর-হাবড়া-নৈহাটির বাজারে চলে আসে। ওইসব মাল বর্ডার থেকে পৌছে দিতে হয় হাবড়া-মছলন্দপুর-রানাঘাট-শান্তিপুরে। কালিদাসী, মানে পুঁটুর কালিমাসী বলেছিল, ঝামেলির কিছু নেই রে পুঁটু, ট্রেনে বাবুদের ব্যাগের সঙ্গে ব্যাগ রেখে দিবি, স্টেশন এলি নামায়ে নিবি, ব্যাস। তোর মতো মেয়েরাও আছে, ছেলেরাও আছে। তোকে সবাই সাহায্য করবে, ভালবাসবে। একদিন বিয়েও হয়ে যাবে তোর। দু’জনে মিলে কাজ করবি। আমার মুক্তি।

নয়

এই আট-দশটা গ্রামে বেকারি নেই। সবাই জন খাটে। মাঠের কাজের জন্য লোক পাওয়া ভার। সরকারি রেট যা, তার চেয়ে বেশি দিতে হয়। ভিখিরি নেই। একজন জনখাটা ছেলে পণ ছাড়া বিয়ে করে না। মেয়ে বিয়ে দিতে মেয়ের বাপের খরচ এরকম—

পণ৫০০০্‌
সাইকেল১৫০০্‌
ঘড়ি৫০০্‌
গয়না৯০০০্‌ (দু’ভরি)
খাটবিছানা৩০০০্‌
লোক খাওয়ানো৫০০০্‌
অন্যান্য১০০০্‌
মোট২৫০০০্‌
(কমপক্ষে) 

এই টাকা হয়েও যায়। প্রেম করে বিয়ে হলেও মেয়ের বাপকে হাজার বিশেক টাকা খসাতেই হয়। এটাই দস্তুর।

গ্রামের মুদি দোকানে হরলিক্স, কমপ্ল্যান পাওয়া যায়। বিদেশি সাবান, বড় বোতলে কোকাকোলা পেপসি, আর ছবিওলা বিদেশি কনডোমও। গোটা তিনেক দেশি মদের ঠেক হয়েছে। বি এস এফ-র লোকজন মাঝে মাঝে ওই ঠেকে আসে, মাতব্বরদের কাছ থেকে মাসিক দক্ষিণা নিয়ে যায়। এ রকমই এক কমবয়েসি মাতব্বরের নাম সুখেন। চওড়া ছাতি, কোঁকড়া চুল, মাদ্রাজি বি এস এফ-এর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে। পুঁটুর সঙ্গে অন্য যেসব মেয়েরা কাজ করে, ওরা সুখেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুখেন যদি কাউকে ঝালমুড়ি খাওয়ায়, সে মেয়ে যেন বর্তে যায়। এই সুখেন একদিন গোবরডাঙ্গার ‘স্মৃতি’ হলে পুঁটুকে নিয়ে সিনেমায় গেল। হাতে হাত রাখল।

দশ

পুটু যখন সুখেনকে বিয়ে করল, তখন পুঁটুর বয়েস সতেরো। কালিদাসী নিষেধ করেছিল। বলেছিল সবকিছু কর, কিন্তু বিয়েটা এখন করিসনি। বিয়ে মানেই ফের দাসীবিত্তি। ঘর-সংসার ছেলেপুলে চাস তো পরে করলেও পাত্তিস। কিছুদিন মৌজ করে থাক। টাকাপয়সা জমা, নিজের একটা কালার টিভি হোক। হাজার দশেক টাকার নিজস্ব ব্যাংকের কাগজ হোক, তবে না! পুঁটু বায়না ধরল, না। মাসি, অমন কোরো না…। কালিদাসীর কিন্তু সুখেনকে মন্দ লাগত না। দাপুটে ছেলে। কিন্তু খেলুড়ে নয়। যতটা দেখেছে সুখেনকে, মনে হয়নি আলুর দোষ আছে। এ লাইনের অনেক ছেলেদের মধ্যে এই দোষ আছে। তা ছাড়া সুখেন কালিদাসীকে মান্যিগন্যি করে। সুখেন দেখতেও ভাল। লোমভরতি চওড়া বুক। চৌকো মুখ। খোকাপানা ভাব। ওকে সাইকেল দিতে হবে না, কারণ ওর মোটর সাইকেল আছে। ওকে পণের জন্য নগদ টাকা না দিলেও চলবে। ও থাকে চাঁদপাড়ার কাছে। এধারে কাজে আসে৷ মেটাডোর ভরতি মাল নিয়ে আসে আবার মেটাডোর ভরতি মাল নিয়ে চলে যায়। খোঁজখবর নিয়ে দেখেছে কালিদাসী। ওর রেকট ভাল। আগেও বিয়ে করেনি, কাউকে পেট করেছে, এমন কথাও কেউ বলেনি। চাঁদপাড়ায় নিজেদের একতলা পাকা বাড়ি, দশ বিঘে ধানী জমি, কালিদাসী আপত্তি করেনি। দশ হাজার টাকার ব্যাংকের কাগজ করতে এখনও অনেকদিন লেগে যাবে, সুখেন কি অ্যাদ্দিন বসে থাকবে? তার চে মনে যখন ধরেছে, বিয়েটা দিয়ে দেওয়াই ভাল। তরঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করতে তরঙ্গিনী বলেছিল, তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর।

বিয়েতে তরঙ্গিনী আসেনি। কালিদাসীই বিয়ে দিয়েছিল৷ একশো লোক খেল। এর মধ্যে অনেকেই বি এস এফ, তাতে কী আছে, কালির টাকা কী হবে। ছেলেপুলে নেই, স্বামী ছেড়ে গেছে, ব্যাংকের কাগজ যা আছে, মাস গেলে এক হাজার টাকা সুদ, এক পেট চালাতে ক’ টাকা লাগে।

সুখেনের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় কালিদাসীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল পুঁটু। বলেছিল—ছোটবেলায় মা পাইনি, বড়বেলায় পেয়েছিলাম। কালিদাসী বলেছিল, মা হওয়া কি সহজ কথা?

এগারো

পুটু একদিন এসে কেঁদে পড়ল। ছ’মাসও পেরোয়নি বিয়ে হয়েছে। বলল, মাসিগো, আমাকে বি এছ এফের সঙ্গে শুতে হয় গো মাসি, দু’বার এমন হয়েছে।

শখ করে না জোর করে? কালিদাসী জিজ্ঞাসা করে।

ছিঃ, শক কেন হবে, জোর করে। একদিন ওদের ক্যাম্পে রেখে দিল। আগে কিছু বলেনি। পরদিন নিয়ে গেল। আমার শাউড়ি জানে আমি তোমার কাছে ছিলাম।

সুখেনকে বললি না কিছু পরে?

বললাম, এমন কেন করলে, ও বলল—আমার ভালর জন্য একদিন না হয় একটু কষ্ট করলে, এটা তোমার আমার ব্যাপার।

তারপর সাত দিনের মাথায় আবার একদিন বনগাঁ নিয়ে গেল শাড়ি কিনবার নাম করে, তারপর শাড়ি কিনে একটা হোটেলে ঢোকাল। ওখানে ছিল একজন বিয়েছেপ। ও ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। বিয়েছেপ ব্যাটা বলল—আগেরদিন বড় ভাল লেগিছিল, তাই সুখেনকে বললাম আর একবার যদি হয়…। তা সুখেন বড় ভাল ছেলে। ও উন্নতি করবে।

তারপর?

দু’ঘণ্টা পর সুখেন নিতে এল। ওর সঙ্গে বাড়ি গেলাম। বাড়ি গিয়ে চ্যান করলাম। শাশুড়িকে কিচ্ছু বলিনি। আজ পালিয়ে এলাম মাসি। সুখেন নিতে এলে যাব না।

বারো

সুখেন নিতে এল না।

কালিদাসীর সঙ্গে সুখেনের দেখা হয়, সুখেন কথা বলে না। কালিদাসী একদিন সুখেনকে ডেকে বলল—সুখেন, কথা আছে, একদিন এসো। সুখেন বলল—কোনও কথা নেই। ওকে নেব না। ও বি এস এফ-এর সঙ্গে নষ্ট। কালিদাসী বলল, তুমি তো ওকে জোর করে…।

সুখেন বলেছ—ও তাই বলেছে বুঝি! মিছে কথা। আমি হাতে নাতে ধরেচি।

কালিদাসী পুঁটুকে বলল—সুখেন ভোল পালটেচে। সব পুরুষ যা করে। বলি হ্যারে, পেট বাঁধাসনি তো, পুঁটুর মাথা নিচু। বলে দু’ মাস মাসিক বন্ধ।

কালিদাসী বলেছিল—আগে বলিসনি কেন? তাড়াতড়ি খালাস করে নে।

পুঁটু বলেছিল, না মাসি, ওরকম বোলো না, ও থাক।

কালী বলেছিল, কিন্তু ওটা কার?

সুখেনের না বি এস এফ-এর?

পুঁটু বলেছিল, জানি না।

অনেক বলেছে কালিদাসী, অনেক বুঝিয়েছে, পুঁটু বলেছে, ও থাক মাসি, আমাকে মা ডাকবে।

এখন সুখেনও নেই। ও পাতাগুঁড়োর কাজ শুরু করেছিল। হেরোইন। এক সুটকেস মাল নিয়ে বম্বে গিয়েছিল, এই খবরটা কালিদাসী জানে। কিন্তু বম্বে থেকে আর ফেরেনি। পুঁটু কিন্তু মাথায় সিদুর দিয়ে যাচ্ছে।

তেরো

পুঁটুর পেটে একটু জল মালিশ করে কালিদাসী। অল্প চাপ দেয়। পুঁটু ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। পুঁটু, কোৎ দে, পা দুটো আর একটু ফাঁক কর, আর একটু ছেতরে দে। ষষ্ঠীঠাকুরকে ডাক। দুর্গা নাম কর।

পুঁটু বলে, বড্ড কষ্ট মাসি।।

কালিদাসী বলে, তুই যে মা হতে চেয়েছিস পুঁটু, মা হওয়া কি সহজ কথা।

কালিদাসী দেখে এখনও একটু করে জল চুয়ে পড়ছে। কালিদাসী জানে জল চোয়ানো বন্ধ হয়ে গেলে পেটের বাচ্চা মরে যায়। ওর হাতে গত পঁচিশ বছরে শ’ দুই বাচ্চার জন্ম হয়েছে। নিজের বাচ্চা নেই—বাচ্চা বিয়ানোর কষ্ট ও জানে না, আনন্দও জানে না কালিদাসী। অন্য মেয়েছেলের আনন্দ দেখতে ভাল লাগে।

পুঁটু এবার চিৎকার করে, যন্ত্রণায় বেঁকে যায়, কালিদাসী দু হাতে পুঁটুর ভাজ করা দুই হাঁটু ধরে থাকে। আসছে! আসছে! কালিদাসী মনে মনে উলু দিয়ে ওঠে।

একটা হাত বেরিয়ে আসছে। হাত। হাত নয়, মাথা চাই। মাথাটা বেরিয়ে এলে দু’হাতে আস্তে করে মাথা ধরে টেনে নিতে হয়। কিন্তু প্রথমে হাত বেরুলে মহা বিপদ। হাত ধরে টানতে গেলে ঘাড় আটকে যাবে। ক্রমশ হাতটা বেরিয়ে আসছে।

ও হাত, বেরুসনি, বেরুসনি, ও হাত, তোকে ভয় লাগে। কালিদাসীর দাই জীবনে এমনটা হয়নি আগে। শুনেছে কখনও কখনও এরকম হয়। এরকম হলে খুব খারাপ। রুইতন বিবি খুব ভাল দাই। রুইতনের কাছে ছুটে যাবে? বরং হাসপাতালই ভাল।

হাসপাতাল বলতে বনগাঁ। বনগাঁ এখান থেকে সাত কিলোমিটার। ভ্যান রিকশা ছাড়া কিচ্ছু নেই।।

পুঁটু জল খা। পুঁটুর জিভে জল দিয়ে, চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে বলল, একটু সবুর কর। কালিদাসী ঘরের বাইরে যায়। হাঁক মারে, ভজা, গিরিধারী, রুইতনরে…।

রাস্তায় কোনও ভ্যান রিকশা নেই। সব ভ্যান রিকশা ভোট খাটতে গেছে। সমস্ত জন খাটিয়েরা আজ জনগণ। ভোটার জনগণ। একটা ভ্যান রিকশা কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন লাগিয়ে ভ্যানভরতি জনগণ নিয়ে ভোটের বুথের দিকে যাচ্ছে। আর একটা ভ্যান রিকশাও পাটাতন ভরতি জনগণ নিয়ে হাত চিহ্ন লাগিয়ে ভোটের বুথের দিকে চলে গেল।

ঘরের ভিতরে একটা রক্তমাখা হাত পুঁটুর পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে কাঁপছে।

কালিদাসী ছুটে বেরিয়ে যায় আবার। বাইরে ভোটের সকাল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। একটা ভ্যান রিকশা দেখতে পেল রাস্তায়। ভরতি। ভোটের দিকে যাচ্ছে। আজ কোনও খালি ভ্যান রিকশা পাবে না, সব ভোটের জন্য নিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওই ভ্যান রিকশাটার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে কালিদাসী। বলে, হাসপাতালে চলো গো, আমার মেয়ের বাচ্চা হবে, হাসপাতালে চলো। বুকে ব্যাজ আঁটা একটা লোক বলল, এখন কী করে হাসপাতালে যাবে, এতগুলো লোক ভোট দিতে যাচ্ছে…।

কালিদাসী বলল, ভোট বড় না জীবন বড়, তোমরাই বলো।

লোকটা বলল—ভোট বড়।

একটা বুড়ি কাঁপা গলায় বলল, জেবন বড় জেবন বড়…।

কালিদাসী ভ্যানওয়ালাকে বলল চলো ভাই, হাসপাতালে, নইলে মেয়ে বাঁচবে না। ভ্যানওলা বলল—সকাল থেকে একদম ভোট পর্যন্ত আমি এদের কাছে বাঁধা। আমি কী করে যাব।

ব্যাচওলা লোকটা বলল, চল-চল-চল। কালিদাসী ছুটে গিয়ে ভ্যান রিকশার সামনে শুয়ে পড়ল।

বুড়িটা বলল, আমরা ভোট দিতি যাব না। ভাল লাগে না মোটে, বছর বছর ভোট হয় আর জোর করি নিয়ি যায়।

দু’জন-একজন করে ভ্যান রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশাওলা ব্যাজপরা লোকটাকে বলে, কী করব বাবু?

বুড়ি বলে কী আবার করবে, পোয়াতি নিয়ে হাসপাতালে যাবে।

ব্যাজওলা বলে, কতগুলো ভোট নষ্ট হল বলদিনি…।

বুড়িটাও নামতে যাচ্ছিল। ভ্যানওলা বলল, তুমি বোস থাকো, তোমায় বাড়ি পৌঁছে দোব বুড়িমা।

বুড়ির সঙ্গে ছিল বুড়ির দুই নাতিনাতনি। বুড়ি বলল, আমার নাতিনাতনি দুটোও আমার সঙ্গে বসুক খানে। আগে তোমার মেয়েকে চাপাও, বনগাঁ হাসপাতালে যাবার পথেই আমার বাড়ি। নামিয়ে দিওখনে।

ব্যাজওলা লোকটা বলল—তোমার নাতি-নাতনিকে ছাড়ছি না। ওদের অন্য গাড়িতে নিয়ে যাব। তুমি যাও।

শেষ অব্দি বুড়িটা একাই রয়ে যায়। ভ্যানটা ঘরের সামনে নিয়ে কালিদাসী পুঁটুকে নিয়ে আসে। হেঁটেই আসে পুঁটু। কালিদাসী রিকশাওলাকে বলে, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকো। কালিদাসী পুঁটুর শায়া গুটিয়ে ধরে থাকে তলপেটের উপরে। একটা হাত ঝুলছে।।

মাথায় একটা বালিশ দিয়ে পুঁটুকে শুইয়ে দেয় কালিদাসী। শায়াটা একটু নামিয়ে বেরিয়ে আসা হাতটা ঢাকা দেয়। বলে তাড়াতাড়ি চলো। বুড়ির মুখ গম্ভীর। বলে, কেরিমন দাই মরে গেছে, নইলে ও পারত হাতটা ঢুকিয়ে দিতে। বুড়িটা পুঁটুর মাথায় হাত বুলোচ্ছে।

কালিদাসীকে জিজ্ঞাসা করল, হিঁদু?

কালিদাসী মাথা নাড়ল৷

বুড়ি বলল, দুগ্‌গা নাম করো। পুঁটুর কানের কাছে, মুখ নিয়ে বুড়ি কী যেন বলল বিড়বিড় করে, তারপর ওর মাথায় ফু দিল।

আমিনপুরের মুসলমান পাড়ায় নেমে গেল বুড়ি। বলল, আল্লা করুন সব ঠিকভাবে হয়ে যায়। ভ্যানওলাকে বলল, সাবধানে যেয়ো। কালিদাসীকে বলল, দুগ্‌গা নাম জপতে জপতে যাও। বুড়ি দাড়িয়ে দাড়িয়ে বলতে লাগল, মা ফতেমা, মা ফতেমা, মা ফতেমা…।

হাসপাতালে ডাক্তার, ডেলিভারির নার্স, কেউ ছিল না, সব ভোট দিতে গেছে।

কালিদাসী শায়া উঠিয়ে দেখল রক্তমাখা হাতটা নিস্তেজ ন্যাতন্যাত করছে। কালিদাসী বুঝল আর নেই সে।

পুঁটুর হিক্কা শুরু হয়ে গেছে। সারা শরীর বেঁকে যাচ্ছে পুঁটুর। খিঁচুনি হচ্ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

কালিদাসী, হে বিশ্বনাথ হে বিশ্বনাথ করতে লাগল, হে কালী, হে দুর্গা, হে কাস্তে হাতুড়ি, হে পদ্মফুল, হে হাত করতে লাগল। হে ডাক্তার হে ডাক্তার করতে লাগল। তারপর চেঁচামিচি শুরু করল। এতদূর মেয়েকে নিয়ে এলাম কী কত্তে তবে? মেয়ে মরে যাচ্ছে কিছু একটা করুন…।

অন্য ডিপার্টমেন্টের নার্স এসে পুঁটুর নাকে অক্সিজেন দিল। শায়াটা তুলেই বলল—ওমা এ যে দেখি প্রতীক চিহ্ন।

ডাক্তার এল সিগারেট টানতে টানতে। এসে পুঁটুকে ভিতরে নিয়ে গেল।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরিয়ে দিল পুঁটুকে। সঙ্গে ডেথ সার্টিফিকেট। একজন ভবিষ্যতের ভোটার কমল।

ভ্যান রিকশাতেই পুঁটুকে নিয়ে ফিরছিল কালিদাসী। রিকশাওলা কোনও কথা বলছিল না। দমকা হাওয়া দিচ্ছিল। যে হাতটা পৃথিবী আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল, সেই হাতটা রক্তমাখা কাপড়ে ঢাকা। দমকা হাওয়া কাপড়টাকে কাঁপায়। নড়ায়। ইলেকট্রিকের খুঁটি থেকে খুঁটিতে ভোটের প্রতীক চিহ্নের শিকলি, সাজানো, তার তলা দিয়ে পুঁটুর ডেড বডি যায়।

একটু পরেই দেখে পুঁটুর বুকের কাছটা ভিজে গেছে। কালিদাসী মরা পুঁটুর বুকে হাত দেয়। ঠান্ডা, কিন্তু ভেজা। কালিদাসী বোঝে দুধ। শিশুটির জন্য নিজের শরীরে দুধের আয়োজন করে রেখেছিল পুঁটু।

সেই দুধ। কালিদাসী স্পর্শ করে। ছুঁলে পুণ্যি হয়।

রিকশা এগোয়। আমিনপুরের মুখে রাস্তায় দাড়িয়ে আছে লাঠি ভর দিয়ে ওই বুড়ি।

বুড়ি বলে, সেই থেকে দাইড়ে আছি। পোয়াতির খবর কী?

এই বুড়ি পুঁটুর কেউ না, কালিদাসীর কেউ না, শুধু একজন পুরনো মেয়েমানুষ কোনও নবীন মেয়েমানুষের খোঁজ নিচ্ছে।

এতক্ষণ কালিদাসী কাঁদেনি। এবার কাঁদল।

পুরশ্রী, ২০০২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *