একটি সামাজিক পালার নামকরণের সমস্যা

একটি সামাজিক পালার নামকরণের সমস্যা

দশ টাকায় ব্যাগ ভরতি। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, পালং শাক, বিট-গাজর। আহা শীতঋতু তুমি যেয়ো না, যেয়ো না, তিষ্ঠ কিছু কাল। শেয়ালদা থেকে বাজার করে সন্ধ্যা ছ’টা ছাপ্পান্নর বনগাঁ লোকালে উঠলেন গদাধর। আগের ট্রেনটা লেট করে এইমাত্র ছেড়েছে বলে ভিড় নেই বেশি। সবজি তরকারির ব্যাগটা বাংকে উঠিয়ে রাখলেন। বেশ ভারী। আহা শীত ঋতু তুমি যেয়ো না যেয়ো না। সিটে বেশ করে জাঁকিয়ে বসলেন। চাদরটাকে বেশ করে পেঁচিয়ে নিলেন। ভিতরে ফুলহাতা সোয়েটার আছে, তার ওপরে খদ্দরের পাঞ্জাবি, তার ওপর চাদর। মনে হচ্ছে আরও একটু কিছু হলে আরাম হত। চাদরটা মাথায় ঘোমটার মতো উঠিয়ে নিলেন। এবার আর কানে ঠান্ডা লাগবে না। একটা বিড়ি ধরিয়ে চোখ বুজল গদাধর।

ফুলকপি আনিয়াছি প্রিয়ে, পুরুষ্টু, নধর। কই মৎস্য সঙ্গে দিলে অমৃত সমান। কিন্তু প্রিয়া মোর, কই মাছ দুর্মূল্য ভীষণ, তাই পারি নাই আনিতে। সঙ্গে দিয়ো তাই—সবুজ কড়াইশুটি। হাঃ হাঃ হাঃ।

আ-মরণ মিনসের কতা শোনো। বলে ফুলকপি খাবে। শখ কত, জানো, ফুলকপি কেমন তেল টানে, তেল তো আনবে না। আনতে বললেই মেজাজ, মুখখিস্তি। অমন ফুলকপি খাবার শখের মুখে ঝ্যাঁটা মারি।।

এই ডায়লগটা বেশ জুতসই মনে হল গদাধরের। ‘গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে’ নামে যে সামাজিক পালাটা লিখছে গদাধর, তাতে এই ডায়লগটা ফিট করিয়ে দেবে। আর দিন পনেরোর মধ্যে পালাটা লিখে ফেলতে হবে। এরপর রিহার্সাল আছে। সরস্বতী পুজোর দিন পালাটা নামবে। মছলন্দপুর রামকৃষ্ণ যাত্রা সমাজ। গতবার ভৈরব গাঙ্গুলির লেখা পালা করেছিল, এবার নিজেই লিখছে। এর আগেও তিনটে পালা লিখেছে গদাধর। ‘প্রহ্লাদ’, ‘দশরথের কান্না’, আর ‘অহল্যার স্বপ্ন’। সবাই বলল, এবার সামাজিক পালা লেখো গদাধর। সমাজে যা হচ্ছে তা প্র্যাকটিকাল করে লেখো৷ সব মুখোশ খুলে দাও। গদাধর লিখছে। সব রিয়েল ঘটনা লিখছে। অফিসের মজুমদার সাহেবের মুখোশ খুলে দেবে গদাধর। শালা, সাপ্লায়ারের কাছ থেকে টাকা পেয়ে আজেবাজে জিনিস কেনে। গণেশ ড্রাইভার, জিপ গাড়িটার পার্টস খারাপ করে দেয়, তারপর সারাতে দেয়, কমিশন পায়। তেল চুরি তো আছেই। ভজনবাবু, কেরানি, গড়িয়ায় দোতলা বাড়ি করেছে, একতলায় গুজরাতি ভাড়াটে বসিয়েছে। কী করে করেছে গদাধর ঠিকই জানে। গদাধর পিয়োন হতে পারে, ক্লাস ফোর স্টাফ হতে পারে, কিন্তু সবই জানে, বোঝে। ‘গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে’-তে সব ফাস করে দেবে। নৃপেন সামন্ত তিনটে বিয়ে করেছে। পরান হালদার ওর বিধবা বোনটাকে স্থান দেয়নি বাড়িতে, তাড়িয়ে দিয়েছে। ওর বোন এখন বেশ্যা। বিমল দাস, শালা মোদো মাতাল, ওর বউয়ের গয়না বেচে মাল খায়, ওকেও দেখে নেবে গদাধর। পালাটার নামটা চেঞ্জ করতে পারলে হত। এখনও পোস্টার পড়েনি। ‘গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে’ নাম শুনে মনে হয় যে একটা কালো মেয়ের কাহিনি। যার বিয়ে হচ্ছে না, পণ হাঁকছে সবাই, তার দুঃখ-জ্বালা-অন্তরের কষ্ট নিয়েই শুধু এই পালা। তা তো নয়, সবার মুখোশ খুলে ফেলে দেবে গদাধর। প্রথমে অবশ্য অভিশপ্ত নারী জাতির হৃদয় বেদনার কথা। ক্লাবের সেক্রেটারি এইরকমই বলেছিল। ক্লাবের সেক্রেটারি পূর্ণবাবু। প্রাইমারি মাস্টার। বলেছিল এবার আর পৌরাণিক পালা নয় গদাধর। সামাজিক পালা লেখো। আমাদের মা-বোনদের কথা লেখো। পণপ্রথার অভিশাপের কথা লেখো। আঠেরো পাতা লিখেছে গদাধর। পণপ্রথার অভিশাপের বলি তেইশ বছরের কন্যা মালিনীর কথা বলতে গিয়ে ভজনবাবুর কথা এসে যাচ্ছে, গণেশ ড্রাইভারের কথা এসে যাচ্ছে, বিমল দাস, পরান হালদার, সবাই চলে আসছে ক্রমশ। কাউকে আটাতে পারছে না গদাধর। এবার একটু হাল ধরতে হবে, নইলে সামলানো যাবে না। একবার চোখ খুলল গদাধর। বাংকটা দেখে নিল। একবার চোট খেয়েছে। বাংকের ওপর ইলিশ মাছ রেখেছিল। একটু চোখ বুজেছিল, চোখ খুলতেই দেখেছিল ইলিশ মাছটা নেই। এখন দেখল ব্যাগের বাইরের কপি-ডাঁটার সবুজ রং। গদাধর দেখল বাংকের ঠিক কপি-ডাঁটার তলার সিটে একটা ছেলে খালি গায়ে বসে আছে। সম্পূর্ণ খালি গায়ে। ছেলেটার বয়স এগারো-বারো বছর হবে। দু’ হাত দিয়ে ওর নিজের বুকটা জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে। ছেলেটার ডান পাশে একটা লোক সাদা শাল গায়ে বসে বসে সান্ধ্য পত্রিকা পড়ছে, ছেলেটার বাঁ দিকে একটি পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের ছেলে এইয়া মোটা জ্যাকেট চাপিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ছেলেটার গা এক্কেবারে খালি। প্যান্ট আছে পরনে, হাফ প্যান্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। এই শীতের মধ্যে ছেলেটার গায়ে জামা নেই। গদাধর ওর সবজির ব্যাগটা বাংকে ঠিকমতো আছে জেনেও চোখ বুজতে পারল না। ছেলেটার খালি গায়ের দিকে চোখ আটকে গেল। ছেলেটা শাল গায়ে লোকটার দিকে ঘেঁষে বসে আছে। ইতিমধ্যে দুটো স্টেশন পার হয়ে এসেছে ট্রেনটা। ছেলেটা কোত্থেকে উঠেছে? গদাধর ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল—তোর শীত করছে না?

খুব।

জামা দিসনি কেন গায়ে? জামা নেই?

আছে।

তবে?

জামা খুলে রাকিচে।

কে?

মালিক।

কোন মালিক?

মোর মালিক।

কেন?

কাজ করিনি দেকে।

কাজ করিসনি কেন?

করিচি তো।

তবে?

সনঝে অব্দি করিচি। মালিক বলল আরও কর। করিনি। তাই জামা খুলে রাকিচে।

কোথায় কাজ করিস?

উল্টোডাঙ্গায়।

কীসের কাজ?

উলের। উল সুতো আছে না? ঝা দিয়ি ছোয়েটার হয়…।

তোর নাম কী?

ইউসুফ।

তোর মালিকের নাম কী?

ইয়াকুব মিঞা।

উলের কী কাজ হয়?

পেটিতে উল সুতো আসে। তা দিয়ি বল বানাই, বল বানিয়ি পেলাস্টিকির প্যাকেটি ভরতি করি।

কতক্ষণ কাজ করতে হয়?

সকাল আটটা সে সনঝে ছ’টা।

কত আসে।

ডেলি বারো টাকা।

আজ বেশি কাজ করতে বলল কেন?

হেভি ডিমান।

এমনি এমনি করবি?

উভার টাইম। ঘন্টায় এক টাকা দেয়।

তা হলে করলি না কেন? টাকা পেতিস।

আজ যি আমার দিদির আসার কতা? দিদির শাদি হয়েছে মুশশিদেবাদ। ছ’ মাস পরে আজ আসতিছে। মন হাকুপাকু হতিচে।

তোর জামাইবাবু কী করে?

বিড়ি-কারিকর।

তোর দিদির বিয়ের সময় পণ-টন দিয়েছিলি?

পণ কী ছার?

যৌতুক।

না, ওসব নয়। খালি টেপরেকট আর ছাইকেলের টাকা। আব্বা দেনা করিলো, আর আমি উল কারখানায় ঢুকিলাম।

গদাধর চোখ বোজে। ট্রেন চলে। উল কারখানা দেখতে পায়।

দশ বছরের, এগারো বছরের, বারো বছরের ছেলেরা সব কাজ করছে।

ইয়াকুব ॥ শোন সবাই শোন। আজ কেউ ছ’ টার সময় বাড়ি যাবি না। যেতে পারবি না কাজ আছে। ওভারটাইম করবি। পয়সা পাবি।

ইউসুফ ॥ আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। আমি আজ পারব না। কিছুতেই পারব না।

ইয়াকুব ॥ পারবি না? অসম্ভব। আমার মুখের ওপর কথা? পারতেই হবে।

ইউসুফ ॥ আমার বাড়িতে আজ মেহমান আসবে। দিদি আর জামাইবাবু (জামাইবাবুকে ওরা কী বলে?) আল্লার কিরে।

ইয়াকুব ॥ নিমকহারাম। খোল তবে জামাখানি তোর। এই জামা দিয়েছি আমি। খুলে ফ্যাল। কাল হতে আসবি না আর। বরখাস্ত করিলাম তোরে। মিউজিক—ঝনন…

এবার বিবেকের প্রবেশ।

বিবেক। এই বাচ্চা, এই, আমার চাদরটা তুই নে।।

গদাধর চোখ খুলে ছেলেটাকে বলল ওই চাদরটা নেবার কথা। আশেপাশের লোকগুলো গদাধরকে দেখছে। গদাধর বলল, কোথায় থাকিস? ছেলেটা বলল, মছলন্দপুর। গদাধর বলল, আমি বিড়ায় নেমে যাব। ততক্ষণ চাদরটা জড়িয়ে থাক। আমি নামবার সময় নিয়ে নেব। ছেলেটা বলল, না থাক। আমার শীত লাগতিছে না। গদাধর বলল, নে বলছি, পেঁচিয়ে রাখ, আমার তো সোয়েটার আছে। গদাধর ছেলেটার গায়ে ওর চাদরটা জড়িয়ে দেয়। চোখ বোজে। আমি তোর পিতৃসম। ওরে বাছা মোর। মোর উত্তরীয়খানি করিলাম দান। দান নয়। দান নয়। বিড়া পর্যন্ত। তখন খুলে নেব। চোখ খোলে গদাধর। বেশ মানিয়েছে ছেলেটাকে। ওর মাথা নিচু। কেমন লজ্জা লজ্জা ভাবখানা। শোন বলি বালক। এ পৃথিবীতে ইয়াকুব রয়েছে যেমন, অন্যদিকে আছে গদাধর। পঞ্চাশ গ্রাম চিনেবাদাম কিনল গদাধর। আর দু’ পুরিয়া ঝাল-নুন চেয়ে নিল। একটা পুরিয়া ছেলেটাকে দিয়ে বলল, বাদাম খা।

গদাধর জিজ্ঞাসা করল—শোন, ওই শালা ইয়াকুব কী করল তোকে?

কখুন? ওই যখন তুই বললি যে উভারটাইম করবি না?

বলল, বানচোৎ ছেলে।

তারপর?

তারপর বলিলো যে রাত ন’টা পর্যন্ত থাক।

তারপর।

আমি বলিলাম, বাড়ি যাব। তখন মালিক বলিলো, এই ভজা, ওর জামা-প্যান্ট খুলে নে। ভজার গায়ে হেভি জোর। ও জামা প্যান্ট খুলে নিল। মালিক বলল, এবার যা। আমি কান্নাকাটি করতে প্যান্টটা দিল।

এ তো মহা ফ্যাসাদ। এত কিছু সামলাবে কী করে গদাধর। এবার যদি ইয়াকুব ক্যারেকটারটাও ঢুকে যায়? আড়াই ঘণ্টার সামাজিক পালায় এত ক্যারেকটার এসে ভিড় করছে। কাউকেই বাদ দিতে পারছে না গদাধর। ইয়াকুবের মেকাপটা মনে মনে চিন্তা করে নেয় গদাধর। উপেন পরামানিককে এই পার্টটা দেওয়া যায়।

এই ইউসুফ। তোর দিদির নাম কীরে?

কোন দিদি।

ওই তো যে দিদির জন্য তুই ওভারটাইম করলি না সেই দিদির শাদিতে সাইকেল আর টেপরেকর্ড দিতে গিয়ে তোর বাপ দেনা করল।

আমিনা।

আমিনার বিয়ে হয়েছে কিন্তু মালিনীর বিয়ে হয়নি। মালিনীর বিয়ে হওয়া নিয়েই সমস্যা। মালিনীর বাবা পণের টাকা জোগাড় করতে পারছে না। শেষকালে মালিনীর বাবা চুরি করেছে এটা জানতে পেরে মালিনী আত্মহত্যা করে। এইভাবে কাহিনিটা ঠিক করেছিল গদাধর। খাতায় প্রথম পাতায় এইভাবে চরিত্রলিপি ঠিক করেছিল।

মালিনী ॥ অবিবাহিতা কন্যা।

হরিহর ॥ ঐ পিতা।

বসন্ত ॥ ঘটক।

জীবন ॥ জনৈক পাত্র।

উপেন্দ্র ॥ পিতা।

বলহরি ॥ ঐ পিতা।

দারোগা, প্রতিবেশীগণ।

ক্রমশ ক্রমশ চরিত্র বেড়ে যাচ্ছে। স্ত্রী চরিত্র পাওয়া যাবে না ভেবে মালিনীর মা অর্থাৎ হরিহরের বউকে পর্যন্ত নেপথ্যে রাখতে হয়েছে। এর মধ্যে আবার আমিনা-টামিনা এসে ঝামেলা করে তবে তো মহা মুশকিল।

পালার নাম ‘গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে’ যদি বাংলা মায়ের শ্যামলা মেয়ে রাখত তবে শুনতে একটু ভাল হত। দু-একজন বলেছিল। কিন্তু গদাধর রাজি হয়নি। বাংলা মায়ের শ্যামলা মেয়ের যে সমস্যা, উড়িষ্যা-মায়ের কিংবা বিহার-মায়েরও সেই একই সমস্যা। ওই জন্যই গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে করেছে।

ও ইউসুফ।

ছার।

তোমার দিদি দেখতে কেমন বলো তো?

সোন্দর।

রং।

ফরসা।।

আবার চিন্তায় পড়ল গদাধর। আমিনা ফরসা তবু সমস্যা। তবে গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ের ‘শ্যামলা’ কথাটা থাকে কেন? গরিব ঘরের মেয়ে রাখলেই হয়। শ্যামলা না হলেও তো সমস্যা।

চোখ বোজে গদাধর।

আচ্ছা এই সমস্যাটা কীসের?

পণপ্রথা। যৌতুক।

তবে আমার এই পালার মধ্যে ওরা ঢুকছে কেন?

ঘুষখোর মজুমদার সাহেব, ভজনবাবু, দুশ্চরিত্র নৃপেন, মদোমাতাল বিমল দাস এরা? পণপ্রথার সঙ্গে কী সম্পর্ক?

লোভ।

ইয়াকুব মিঁয়া আসে কেন তবে?

ওই যে লোভ।

লোকের কাছে সব হ্যা-হ্যা করে বিকিয়ে দিয়েছে।

কেন?

জোর যার মুলুক তার। লোভের এখন বড় জোর।

তা হলে গদাধরের সামাজিক পালায় পণপ্রথার অভিশাপের কথা বলতে গিয়ে আরও অনেক কথা বলতে হচ্ছে। একটার সঙ্গে অন্যটা শিকলির মতো আঁটা। এই সামাজিক পালাটার নাম গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে না হয়ে শুধু গরিব ঘরের মেয়ে হতে পারে, কিংবা মেয়ে শব্দটা বাদ দিয়ে গরিব ঘর হলেও ক্ষতি নেই। কিংবা শুধু ‘ঘর’? হতেই পারে। কত কী নাম হতে পারে। নাম যা হোক পরে ভাবা যাবে, কিন্তু যে চরিত্ররা আসতে চায়, তাদের আসতে দেবে গদাধর। কাউকে বাদ দেবে না। পরে দেখা যাবে। চোখ খোলে গদাধর। ছেলেটা ঝিমুচ্ছে। চাদরের গরমে ওর আরাম লাগছে। বামনগাছি পার হল। সামনেই বিড়া। ছেলেটার কাছ থেকে চাদরটা কেড়ে নিতে হবে এবার। এরপর আরও কয়েকটা স্টেশন যেতে হবে ছেলেটাকে। ছেলেটার গায়ে হাত দিল গদাধর। ‘চাদর নিয়ো না কেড়ে’। একটা নতুন পালার নাম হতে পারে। গদাধর ছেলেটার চাদরে হাত দেয়। টানে। ছেলেটা ছটপটিয়ে চাদরটা খুলে দিতে চায়। গদাধর বলে, আমার সঙ্গে চল।

ক’নে?

আমার ঘরে এই চাদরটা গায়ে দিয়েই চল। আমি তোকে একটা জামা দেব। জামাটা গায়ে দিয়ে পরে আপ ট্রেনে বাড়ি যাস। ছেলেটা ততক্ষণে চাদরটা ওর গা থেকে খুলে ফেলেছে। গদাধর ধমক মেরে ওঠে। কাণ্ডজ্ঞানখানা কীরকম তোর, অ্যাঁ, গায়ে দে ওটা।

যাত্রীদের একজন বলল, লোকটা টুপি খেয়ে গেল মাইরি। আর কে যেন বলল, ছেলেটা ভালই ঢপ দিয়েছে। গদাধর ভাবল লোকে যে যা বলে বলুক ওদের কথায় কী আসে যায়। ছেলেটার হাত ধরে গদাধর। রাত্রি অন্ধকার। তীব্র শীতে শিহরিছে আকাশের চাঁদ। চল বালক দীন কুটিরে মোর। মলিন সে গৃহ। কিন্তু সে গৃহমধ্যে বিরাজে নারায়ণ। নরনারায়ণ। বিড়া স্টেশন এসে গেল।

ভীষণ শীত। জোনাকিও নেই। চাদর ছাড়া বেশ শীত শীত করছে গদাধরের। গদাধরের বাঁ হাতে একটি পলিথিনের ব্যাগে একটা চাণক্যশ্লোকের বই, বিড়ি, টিফিন ডিব্বা এবং ডান হাতে সবজির ব্যাগ। কাছাকাছি এসে ছেলেটার কাছ থেকে চাদরটা চেয়ে নেয়। গায়ে মুড়ি দিয়ে নেয়। ছেলেটাকে বলে তুই এইখানে দাঁড়া। আমি এখুনি আসছি। বাড়িতে ঢোকে। টিনের চালার বাড়ি, ভিতরে হ্যারিকেনের আলো। বিবিধ ভারতী বাজছিল। গদাধর ঘরে ঢুকতেই বিবিধ ভারতী থেমে গেল। ভারতী আর আরতির গলা শোনা যেতে লাগল। জুলিয়াস সিজার। জুলিয়াস সিজার। তিনি জন্মিয়াছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। অল্প বয়স থেকে তিনি ক্ষমতার স্বপ্ন দেখিতেন। দরিদ্র রোমবাসীদের তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না, কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনসাধারণকে ব্যবহার করিয়া নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা। এই কারণে তিনি দরিদ্রদের বিনামুল্যে খাদ্য বিতরণের দাবি জানান। সিজার কনসুল পদে নির্বাচিত হন এবং ৫৮ খ্রি. পূর্বাব্দে ৫৮ খ্রি. পূর্বাব্দ ৫৮ খ্রি… পূর্বাব্দ…

ভারতী উচ্চ মাধ্যমিকে দু’বার ফেল করতে আরতির সঙ্গে পরীক্ষা দেবে। জুলিয়াস সিজার বোধহয় এবার ইমপর্ট্যান্ট। গদাধরেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। গদাধর ওর সামাজিক পালার নায়িকা মালিনীর মুখে যেসব ডায়লগ দিয়েছে তার সঙ্গে কিন্তু ভারতীর ডায়লগের মিল আছে। গদাধর ঘরে ঢুকল। বারান্দার পাশের হারুর তক্তাপোশ। ওর ছেলে সবচেয়ে বড়। রাত দশটার আগে আড্ডা থেকে ফেরে না, দড়িতে ঝুলছে ওর জামা প্যান্ট। একটা টেনে নেবে নাকি? নাকি নিজের পাঞ্জাবিটা দিয়ে দেবে। সেটা অবশ্য অনেক বড় হয়ে যাবে। পায়ের গোড়ালি ছাড়িয়ে যাবে ওর। তবু হ্যারিকেন উঁচু করে দড়িতে ঝোলা জামাগুলো দেখে। জামার গায়ে লেখা—ওলিম্পিক, ডগ লাভার, ব্লাডপ্রেসার। কোনটা বাতিল আর কোনটা না পেলে কুরুক্ষেত্র—কে জানে। গদাধর ভারতীকে বলে, হ্যাঁরে স্টিলের বাসনপত্তর কেনার জন্য জামাকাপড়ের পুঁটলিটা মা কোথায় রেখেছে রে? ভারতী বলে, কেন বাবা? গদাধর বলে, এমনি, একটু দেখতাম। আরতি বলে কাউকে দেবে বুঝি? গদাধর সত্যি কথাটাই বলে। আরতি বলে, মা জানলে আবার রাগ করবে। বাসন নেবে বলে জমিয়েছে কিনা। গদাধর বলে, সে আমি বুঝব। তুই বার কর। খাটের তলা থেকে একটা পুঁটলি বার করে আরতি। গদাধরের বউ রান্নাঘরে রুটি করছে। গদাধর একটা বুক খোলা সোয়েটার বার করে। ওটা গদাধরেরই। কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে, পোকাতেও কেটেছে। ঠিক আছে। কারওর কিছু বলার রইল না। নিজের জিনিস। সোয়েটারটা নিয়ে গিয়ে রাতের অন্ধকারে ছেলেটার গায়ে পরিয়ে দিল গদাধর। একটু ঢোলা, তবু গরম তো বটে। যা, বাড়ি যা…তাড়াতাড়ি যা। এখুনি ট্রেন। পালা…

পরের দিন সকাল সকাল বেরোতে হয়েছিল গদাধরকে। নীলরতনে অর্শ দেখায়। ট্রেনে উঠে দেখে খালি গায়ে হাত দুটো বুকে জড়িয়ে সেই এক কায়দায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে ইউসুফ। গা খালি। ওর ডান পাশে খাকি কোট পরা পুলিশের লোক বিড়ি ফুকছে। ডান দিকে শাল জড়ানো ভদ্রলোক খবর কাগজ পড়ছে। ওর উলটো দিকের একটা লোক ওর সঙ্গে কথা বলছে।

খালি গা কেন?

এমনি।

জামা নেই?

আছে।

পরিসনি কেন?

মালিক খুলি রাকিচে।

গদাধর দেখল আর এক গদাধর এই ছেলেটার সামনে। সেই গদাধর চুকচুক শব্দ করল জিভ দিয়ে।

একজন না একজন গদাধর ঠিকই থেকে যায় বলে পৃথিবীটা চলছে…গদাধর ভাবল। কিন্তু এই ছেলেটা ঢপ দিচ্ছে না তো? টুপি পরাচ্ছে না তো? সহানুভূতি আদায় করে কামাবার ধান্ধা। এই পৃথিবীটা বড়ই বিচিত্র। গদাধর এগিয়ে যায়। কী রে ইউসুফ।

ইউসুফ হাসল।

কাজে যাচ্ছিস?

জে।

সোয়েটারটা কই?

ঘরে।

কাউকে দিয়েছিস বুঝি?

না।

তবে পরিসনি কেন?

ইউসুফ চুপ করে রইল।

বল ইউসুফ, তোকে বলতেই হবে, এই শীতের মধ্যে খালি গায়ে চলেছিস কেন, যখন তোর গরমজামা আছে।

ইউসুফ চুপ।

বল, ঢোলা হয়েছে বলে পরিসনি?

না।

তবে?

জামা পরি গেলে মালিক রাগ করবে।

রাগ করবে? কেন রাগ করবে…?

মালিক তো আমায় জব্দ করতি চেয়েছিল। ঝদি বোঝে আমি জব্দ হইনি, তবে তিনি বেজার হবেন। আর ঝদি বোঝে আমি খুব জব্দ হয়েছি তবে তিনি খুশি হবেন।

হারমোনিয়াম আর সারেঙ্গিতে একটা অদ্ভুত বাজনা বেজে উঠল এই ডায়লগের পেছনে। ইউসুফ চুপ করার পরও বাজনাটা চলতে থাকল। এবারই বিবেকের গান এবং পালাটা শেষ হয়ে যাবার কথা।

কিন্তু গদাধর কিছুতেই এই সামাজিক পালার নাম দিতে পারছে না। ‘গরিব ঘরের শ্যামলা মেয়ে’, নাকি ‘গরিব ঘরের মেয়ে’, নাকি ‘গরিবের ঘর’, নাকি ‘দেশ’, নাকি ‘ভারতবর্ষ’?

শারদীয় বসুমতী, ১৯৯০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *