দুলালচাঁদ

দুলালচাঁদ

দয়াময়ের দু’হাতে অনেক মাদুলি, হাঁটুর চারপাশে খোসপাঁচড়া। পাঁচড়া চুলকোলে মাদুলি বাজে ঝনঝন।

মায়ের সঙ্গে এসেছে সতীমায়ের থানে। এই আজকের দিনে মায়ের উত্থান। পরব মেলা, ফুলুরি মণ্ডা জিলিবি আর নাগরদোলা, আর বেলুনবাঁশি।

মা সেই আমগাছটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

ঘোষপাড়ার এই মাঠে কর্তাভজারা আমগাছ লাগায়। সেইসব আমগাছের তলায় মেলার সময় আসন করা হয়, সাধনভজন, ভাবের গান হয়।

পূর্বপুরুষ যে গাছটা লাগিয়েছিলেন সে গাছতলায় আসন হয়েছিল আট বছর আগে। দয়াময় তখন খুব ছোট। সেই গাছটা কই ?

‘হদিশ করতি পারতেছিনিরে দয়া, গাছের গায়ে কুড়ুলের তিনটি ঢ্যাড়া ছিল।’

দয়াময়ের বাঁ হাতের চেটো শুকনো৷ শিকনির কারণে খড়খড়ে, সেই হাতে চোখের উপর রেখে সুয্যি আড়াল করে গাছের গায়ে চিহ্ন দেখতে থাকে। আমের বকুল ফুঁড়ে ফেড়ে—গুড়গুড়ি ফুলকচি আম, কী মজা ! পাখির বাসা, কাঠবেড়ালি—এইসব।

মা এমন সময় চিল্লেন দিয়ে বলে, ‘গাছটা পেয়েছিরে দয়া,’…

ধপ করে কোলের বাচ্চাকে ভুঁয়ে ফেলে গড় হয় ময়নামতী।পরিপূর্ণ গড় হলে পেটে লাগে, কারণ পেটে বড় হচ্ছে আরেকটা।

দয়াময় চিহ্ন দেখতে গিয়ে দেখল—তিনটে কাটা দাগ, ক্লাস থ্রির দরমার বেড়ায় আলকাতরা মেরে তিনটে দাঁড়ি যেমন, আর দেখল টিনের পাত—‘গর্ভপাতে হোমিও ডোজ। ডা. মণ্ডল, কাঁচড়াপাড়া।’ গাছের গায়ে সাঁটা।

ময়নামতী লাল পাড়ের দড়িতে ঢিল বেঁধে দয়াময়কে দিল। দয়াময় ফড়ফড়িয়ে মগডালে উঠে দেখল—দুলালচাঁদের মন্দিরের লাল নিশেন সতীমায়ের ডালিম গাছ, পাঁপড়ওলা, জিলিপিওলা।

পাতার ঠান্ডা আরাম গালে গলায় লাগিয়ে দয়াময় যখন ঢিল বাঁধছিল, মা তখন গাছতলায় চোখ বুজে জোড় হাত করে কীসের বিড়বিড় করছে দয়াময় জানে। “হে সাঁই, হে দুলালচাঁদ। হে ছিরি গৌরাঙ্গ—দয়ার বাপডারে কোথায় নুইকে রেখিচ ? তেনারে ফিরি এনি দ্যাও।’

গাছ থেকে নেমে এসে দয়াময় বলল, ক’টা পয়সা দিবিনে মা, ঢিল বেঁধে এলাম, জিলিপির পয়সা দিবিনে মা ?

জিলিপি হাতে নিয়ে দয়াময়ের শালিখের মতো পা।

হরে কিষ্ণ বাবাজী

দশ পয়সার জিলেবী

জিলেবী খেতে মিষ্ট

পয়সা দিতে কষ্ট।

ময়নামতী ভাবের গীত গাইছিল। একজন লোক ওদের কাছে এসে শুধোল—‘কোন তরফের বরাতি ?’

ময়নামতী বলল—‘খেলারাম গুরুর মেজো তরফের।’ লোকটা বলল, ‘তবে আমিই তোমাদের মহাশয় হই।’ লোকটা বলল—‘চলোগো—গুরু থানে লিয়ে যাই।’

ময়নামতী লোকটার দিকে চেয়ে বলল—‘তিনি তো এমনি পানা নয়, মোদের মহাশয় ছ্যালো প্যাংপ্যাঙে, মুখি মায়ের দয়ার চিন্ন।’

লোকটা তখন দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল—‘তিনিই আমার পিতৃদেব ছিলেন’। হাতের ব্যাগের থেকে বের করল একটা বাঁধানো ছবি।

‘এনাকে চিনছ গো মা ?’

ময়নামতী ছবিকে পেন্নাম করল।

লোকটা আরেকটা বাঁধানো ছবি বের করল।

‘এই যে গো, আমার পিতার পদচিন্ন।’ ময়নামতী দয়াকে বলল, “আরে এই ছিমড়ে পেন্নাম কর।’

‘অদ্যাবধি নিত্যলীলা করে গোরারায়।

ভাগ্যবান সেই যেই দেখিবারে পায় ॥

চৈতন্যের নিরুপণ পাইবে স্বভাবে।…

‘বুঝলে গো দিদি, আমাদের খেলারাম গুরুর মধ্যে ছিল সাক্ষাৎ চৈতন্যের অংশ যা-তা গুরু তোমায় নয় তো মা,

‘খেলারাম ভোলানাড়া কিনু ব্ৰহ্মহরি।

দেদোকৃষ্ণ দোগাকৃষ্ণ বিশু পাঁচকড়ি ॥

হটুঘোষ গোবিন্দ নয়ান লক্ষ্মীকান্ত।

ইহারাই হরিপ্রেম অতিশয় শান্ত’।।

লম্বা দাওয়া। বাবুদের বারান্দায় সারবন্দি ফুলের টবের মতো গুরুরা বসে আছেন। মহাশয় একজন গুরুর কাছে এসে থামলেন, তাই দয়ার মা-ও থামল। আধো চোখ খোলা, মুখে আবির, স্মিতহাস্য, গলায় কাশীগ্যাঁদার মালা, সামনে থালায় টাকা পয়সা, রেকাবিতে আবির।

একমুঠো আবির নিয়ে গুরুপদে রাখেন দয়ার মা। সেই পা ছোঁয়ানো আবির নিজের মাথায় দিল, দয়াময়ের মাথায় দিল। আস্তে আস্তে বলল, খেয়েপরে গায়েগতরে থাকিস যেন গুরু দয়ায়।

গুরু নড়েচড়ে বসলেন। লুঙ্গির মতো করে পরা কাছাহীন কাপড়ের গিঁটে হাত দিলেন—এবং এ মুহুর্তের প্রয়োজনীয় কাজটি সারলেন—গিঁট বাঁধলেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—‘ছেলেকে মন্তর লেয়াবি ?’ ময়নামতী বলল, ‘ছেল্যা এখনও বুঝের হয়নি বাবা, ছিমড়ে বড্ড ফড়ফড়ে।’

গুরুর দুই হাত অসমান উচ্চতার দুই মাথার উপর নিবদ্ধ। ‘স্থির মতি হ, ভক্তিমান হ, ভক্তিবতী হ।’ রেকাবিতে কয়েকটি ঠং ঠং ঠং।

ময়নামতী পায়ের আবির নেয় পুনরায়। আর বলে, ‘আমার ওঁনারে ফিরি আসবার আশীর্বাদ দেন কর্তা।’

কর্তা কপাল কুঁচকে বলল—‘অ্যাঁ ?’

তখন ময়নামতী মেলার কলকোলাহল, বেলুনবাঁশি, মাইকের গান, ইত্যাদির শব্দের পরিমণ্ডলের মধ্যে গলা উঁচিয়ে বলল—‘আমার উনি…’

আর ‘আমার উনি’ শব্দটা কলকাকলিময় দ্রুত ঘুরপাক খাওয়া নাগরদোলার মতো চরাচর জুড়ে ঘুরপাক খায়, সেই অবস্থায় বলে—যেন ফিরি আসেন গ বাবা, আমি পাপিষ্টা…

মেলাতে সমস্ত বেলুনবাঁশির শব্দ, সমস্ত ভিখমাঙ্গাদের আকুলি-বিকুলি, মেলার সমস্ত এঁটো শালপাতাদের পড়ে থাকার কষ্ট এক সঙ্গে জড়ো হল ওর গলায়।

বিয়ের ক’দিন পরে আলতা পরাবার সময় ওর বড়জা বলেছিল, সে কী লো, তুই যে দেখি খড়মঠেঙি। খড়মঠেঙিরা বড় ভাতারখাগী হয়। তার পরবর্তীকালে ঝগড়াঝাঁটির গালিগালাজের মধ্যে পোড়ামুখী বারোভাতারির সঙ্গে খড়মঠেঙি কথাটাও শুনতে হয়েছে বহুবার।

বামুনবাড়ির পাঁচিলে ঘুঁটে দিতে গেলে বামুনগিন্নি নিকেশ নিয়েছিলেন—কী লো, সোয়ামি এল ? ময়নামতী মাথা নাড়লে বাবুগিন্নি বলেছিলেন—কী করে সোয়ামি রাখবি, তুই যে খড়মপেয়ে। তখন ইচ্ছে করে না, পা দুটো খচখচ করে কেটে ফেলতে ? লাজের কলঙ্ক। অলক্ষ্মী, অপয়া।

দেয়াল হেনস্তা হয় বলে, শুকোলে কয়েক গণ্ডা ঘুঁটে ময়নামতী বামুনবাড়িতে বিনি মাগনায় দিয়ে আসে। একদিন বামুনগিন্নি বললেন—তাঁর মামাশ্বশুর এয়েচেন, গনকঠাকুর তিনি। দয়ার মা ঘোমটা টেনে গাগতর মুড়ে, ঠাকুরমশাইয়ের কথামতো মেঝেতে খড়ির ছককাটার একটা ঘরে নখকুনিওলা আঙুলটা রাখলে, গণকঠাকুর নাকের থেকে বের করা ছোট বুটলিটা ফেলে দিয়ে বলেছিলেন— ‘পশ্চিমে গেছে।’

পশ্চিম ? দয়ার মা ভেবেছিল—গাঁয়ের পশ্চিমের পাকুড়গাছ ছাড়িয়ে শ্মশান, আরও পশ্চিমে কুড়মুনচণ্ডীর বিল, বিলের ওপারে কালিকাপুরের গাছ-গাছালির রেখা, তার পশ্চিমে সুয্যিদেব ডুবছেন। সেটাই কি শেষ পশ্চিম?—

গণকবামুন শুধোলেন, ‘যাবার আগে ঝগড়া হয়েছিল নাকি !’

দয়ার মা কিছু বলে না। হিঙ্গলগঞ্জের ভেড়িতে নাগাড়ে পাঁচ মাস কাজ করার পর যখন ফিরে এলেন উনি, ময়নামতীর তখন গা বমি গা বমি। গালে করমচা রাখলে ভাল। দয়ার বাপ ছেনাল হলে, সোহাগের রকম সকম বাড়ালে ময়নামতী বলেছিল, ‘এট্টু সামলে, পেটে আছে একটা।’

ঝাঁকি দিয়ে উঠল দয়ার বাপ, যেন গরম আঙার লেগেছে গায়ে। জলের ঘট হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।

বলল, ‘এবার কী গড়িয়েছিস, নত না দুল ?

ময়নামতী ডুকরে কেঁদে উঠল। ‘বিশ্বেস করো, তুমি যাবার পরেই মাসিক বন্ধ হয়েছে, কালীর কিরে।’

দয়ার বাপ বলল—‘আম্বলীমাসিকে খপর করি, দেখুক।’ ইঙ্গিত বুঝতে পারে ময়নামতী। ভয় পায়। ছ’মাসের গবভো খসানোর ঝক্কি সে জানে। হামিদাবিবি সেদিন মরল ছ’মাসের গবভো নষ্ট করতে গিয়ে।

আধপেটা খেয়ে, মুখের ঘা, পায়ের হাজা, আঙুলের নখকুনি নিয়েও ময়নামতীর কী ভাল যে লাগে পিরথিমিটার বর্ষা—তখন কলমিলতার ডাঁটিগুলোয় জিনপরি ভর করে, তখন ওরা কেবলই হা-হা করে হাসে, ব্যাঙেরা পরবের বাজনদার হয়, কিংবা চিতেগাছের বেড়ায় কখন হঠাৎ এসে যায় লাল লাল ফুল, এক সময় খেজুরগাছেও রস আসে, এইসব কিছু, এই মাঠ দাপিয়ে আসা হাওয়া, খেজুররসের গন্ধ, কানেহাঁটা কই, হঠাৎ পাওয়া কাঁকড়া এইসব কিছুর পিরথিমিটাতে কী আহ্লাদ, মরার কথা ভাবলেই প্রাণটা শামুকমাংসের মতো ছোট হয়ে যায়। ও রাজি হয়নি।

দয়ার বাপ বলেছিল—তবে দয়াময়কে এবার লিয়ে যাব। হিঙ্গলগঞ্জের চায়ের দোকানে দিয়ে দুব। ওর রোজগারে ও খাবে তবে।

সে কী কথা, দয়াময়, হাড্ডিসার কচি, কাঁকাল দেখা যায়, পেটভত্তি কিরমি, পির ফকিরের মাদুলিতে বেঁচে আছে, ওকে ছাড়তে পারবনি।

এ নিয়ে ঝগড়া চলল ক’দিন। তারপর একদিন ভোরবেলায় ‘এই সোংসারের সোগা মারি’ বলে চলে গেল।

এইসব কথা তো ঠাকুরমশাইকে বলা যায় না। তাই দয়ার মা বলল, ‘সোয়ামি-স্তির ঝগড়া হত বইকী। তা এখন ইনি যেথায় আছেন, কেমন আছেন ঠাকুরমশাই।’

একটা কাগজ সামনে ফেলে ঠাকুরমশাই বললেন—একটা অক্ষর ধরো দেখি। তারপর—‘ধয়ে ধুতরো। তোর স্বামী সন্ন্যেসী হয়েছে।

তবু যাক সন্ন্যেসী হয়েছে। ময়না ভাবে—একজন বলেছিল, দয়ার বাপ হাসনাবাদে শুঁটকি মাছের আড়তে কাজ করে, সঙ্গে নাকি মেয়েছেলে আছে। আবার এমন কানাঘুষোও শুনেছে ময়নামতী, হিঙ্গলগঞ্জের চিংড়ি ভেড়িতে মাছ চুরির সময় নেপালি পাহারাদারের গুলিতে নাকি দু’জন…গোর দিয়েছে নাকি পাঁকে,—তার মধ্যে একজন নাকি—ঢ্যাঙাপানা, লম্বাপানা, হলুদ জামা…না গো না, একথা যে ওলাউঠা বলে তার মুখে ঝ্যাঁটা, সন্ন্যাসীই হয়েছে দয়ার বাপ। তবু ভাল !

আজ এই সতীমায়ের মেলায় কর্তাবাবার পায়ের আবির মাথায় নিয়ে আবার বলে দয়ার মা— ‘ঝ্যানো ফিরে আসেন উনি, ঝ্যানো আসেন।’

‘সতীমায়ের পাঁচালি শুনে হিমসাগরে চ্যান করে, ডালিমতলায় দণ্ডী কেটে যা, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে’—কর্তাবাবা বললেন। দয়াময় ভাবে বাপ যদি সাধুই হয়, তবে যেন এরকম কর্তাবাবাসাধু হয়,—ঠং ঠঙাৎ পয়সা পড়চে।

একজন গাইছে—

ফল সব কি মিঠে হয়

সুমিষ্ট সে কভু নয়।

কতক গেল রৌদ্রে পুড়ে

দু-একটা তো পচে যায়—

বিপদ নাই তার কোনো মতে

গুরু কৃপা তারে কয়।

শতকণ্ঠ বলে উঠছে—জয় সতীমা হে, জয়বাবা দুলালচাঁদ।

ভদ্দরলোকের বউয়ের মতো দেখতে একজন বউ আর ভদ্দরলোকের ছেলেদের মতো একজন বাচ্চাকে একজন মহাশয় বললে—‘দুলালচাঁদ কে ছিলেন, কে ছিলেন সতীমাতা, শুনবে নাকি ?’—

দয়াময় তখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে শুনে নেয়—

শ্রীচৈতন্য নীলাচলে গিয়া চিন্তা করে।

সৃজিবেন নব ধর্ম সবাকার তরে ॥

আইল পাগলবেশে ঘোষপাড়া গ্রামে।

বিখ্যাত হলেন তিনি আউলচাঁদ নামে ॥

প্রচার করেন তিনি করিয়া যতন।

মানুষ সবার সেরা মানুষ রতন ॥

সৃজিলেন নব ধর্ম, ‘কর্তাভজা’ নাম।

সেই হেতু পুণ্যমস্ত ঘোষপাড়া ধাম ॥

শ্রীরামশরণ তার শিষ্য আগে হয়।

সবাকার মন তিনি করিলেন জয় ॥

শুন রামশরণের অমর কাহিনী।

ভক্তিমতী সতীমাতা হল অর্ধাঙ্গিনী।।

শক্তিময়ী সতীমাতা সিদ্ধ হলে পরে।

তাহার প্রচার হল প্রতি ঘরে ঘরে ॥

তাহারই গর্ভেতে লভে শ্রীদুলাল চান্দ।

চৈতন্যেই অংশ তিনি তাতে নাই খাদ ॥

জয়। জয় দুলালচাঁদ। দুলালচাঁদের জয়।

দয়ার মা গেল হিমসাগরে ডুব দিতে। দয়া তার ছোটভাই এবং মুড়ির পুঁটলি সাপটে ওর মায়ের পিছল পথে ফিরে আসা দেখে। কাদাজলে কাপড় লেপটে গিয়ে পেটখানা বিরাট উঁচু লাগছে। ঘাটে দাঁড়ানো যে লোকটা সিঁদুর বিক্রি করছে, তার চোখ ময়নামতীর পেটের দিকে। সে বলছে— সতীনারীগণ সতীমায়ের পুজোর জন্য নোহা-সিঁদুর নিয়ে যান গো…সতীনারীগণ…ময়নামতী একভাগ কিনে আঁচলে গিট দিল। ময়নামতী দণ্ডী কাটবার জন্য গড় হল। সতীনারীগণ…

দয়াময় তখনও পেটে আসেনি। বিয়ের ক’দিন পরে পরেই দয়ার বাপ চলে গেল মাছ মারতে। নাকের নোলকের পুরনো দামটার জন্য কয়েকবার ঘুরবার পর হরিপদ সেঁকরা দুপুর নির্জনে ময়নার ঘরে এসে বলেছিল, ‘সব দামই যে ট্যাকায় দিতে হয় এমন কি কথা আছে, শুধু একটিবার, আপিত্য করিসনি ময়না, বহুদিনের শখ রে ময়না…’

যাকে দয়ার বাপ বলে লোকে জানে, সে তখন মাছ মারতে গেছে জলে। লোকটা ফিরে এসে শোনে সে বাপ হবে।

ময়নামতী পিছল পথে জলকাদার মধ্যে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ছে, টানটান হাত—সামনে মেলা। হে সতীমা, লোকের মুখের হিঙ্গলগঞ্জের চিংড়ি ভেড়ির কথা ঝ্যানো মিথ্যে হয়, ঝ্যানো মিথ্যে হয় গুলির শব্দ, রক্তমাখা হলুদ জামাটা ঝ্যানো মিথ্যে হয়, ঝ্যানো মিথ্যে হয় ঝ্যানো মিথ্যে হয়।…

এইভাবে ময়নামতীর শরীর সতীমায়ের থানের দিকে এগিয়ে আসে। ময়নামতীর ঘাম ও লোল কাদায় মেশে, শ্রবণ ও দৃষ্টি কাদার মতো বেতাল হয়, দয়াময়ের কোলে ময়নার বাচ্চাটার মায়ের বার বার শুয়ে পড়া দেখে ভয়ার্ত তুমুল চিৎকার ময়না শোনে না, বস্তুতপক্ষে হাজার মানুষের কলরব খৈ ফোটার শব্দের মতো চিড়বিড় করে; তৃষ্ণা, শরীরটা চৈত্রের মাটি, মাথায় ঘুরছে ডাল ভাঙার জাঁতি। ময়নামতীর শরীর স্রোতের ডাব-খোলার মতো ভিড়ের মধ্যে এইভাবে অসহায় এগিয়ে চলছিল। তারপর এক সময়—‘জয় সতীমা, মনের আশা পুন্নো করোগো’—এই কথা বলার চেষ্টা করে সামনের ভিড়ের উপর দিয়ে ছুড়ে দেয় লোহা-সিঁদুর। তারপর জনস্রোত ওকে নিয়ে নেয়। ওর শরীর এলিয়ে পড়ে। ও সতীমার থানের কাছে পড়ে যায়। ওর শরীর মাড়িয়ে দেয় ভিড়ের পাগুলো। জয় সতীমা শব্দের মুহুর্মুহু আওয়াজ। ময়নামতী বলার চেষ্টা করে—পেটেতে পা দিওনাগো তোমরা, বাচ্চা আছে, বাচ্চা। জনতার ছুঁড়েদেয়া সিঁদুরের দু-একটা মোড়ক ময়নামতীর গায়ে এসে পড়ে, জয়,—জয় সতীমা, হে…কতগুলো পায়ের চাপ ময়নামতীর হাতে, বুকে, পেটে, ময়নামতীর শাড়ির কাদার আস্তরণ ক্রমশ লাল হতে থাকে। কাদার সঙ্গে মাখামাখি হয় রক্তের। দু’বার মাথা ঝাঁকুনি দিল ময়নামতী।

সব ফল কি মিঠে হয়

সুমিষ্ঠ সে কভু নয়

কতক গেল রৌদ্রে পুড়ে

দু-একটা তো পচে যায়।

এখন ভিড়ের বাইরে, অন্য ভিড়ের মধ্যে ময়নামতী। রক্তপিণ্ড জমাট বেঁধেছে। দয়াময় ভাই-কোলে নিশ্চুপ। ময়নামতীর খাংলাচুল সিঁদুরে সিঁদুর। সতীমা সাক্ষাৎ ভর করেছেন এঁকে। ইনি কে কি-সে সতী ? মায়ের থানে লোহা-সিঁদুর উৎসর্গ করে, তবে না দেহ রাখলেন। বহু জন্মের পুণ্য চাই, তবেই না এমন ভাগ্য হয়। এই বুঝি এঁনার ছেলে, আহারে…

দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা, সিকি…

দয়াময় একবার ভাবল মা মরে গিয়ে সাধু হয়েছে, নইলে কেন এত ঠং ঠঙাৎ পড়ছে ? একজন ময়নামতীর পা মুছিয়ে দিল আঁচল দিয়ে।

ময়নামতীর সেই খড়মঠেঙী পা, ময়নামতীর সে অলক্ষ্মী অপয়া পা এখন আলতায় রাঙা। উঁচকপালী নয়মামতীর সারা কপালে সিঁদুর। সবাই পেন্নাম করছে। রক্তে, সিঁদুরে, আলতায়— ময়নামতী এখন কী সুন্দর লাল ! সতী ময়নামতী ! দয়াময় শুধোয়, মা তো মরে গেছে, এখন কোথায় যাবে ?

তোর মা স্বর্গে যাবে বাছা, স্বর্গে।

‘এই, লাশ উঠাও, মর্গে যাবে, মর্গে।’

পুলিশ আসে। গাড়ি ছাড়ল। কালো ধোঁয়া; মর্গে গেল সতী ময়নামতী। এয়ো নারী হুলুধ্বনি দিল।

দয়াময় থ। ওর ভিখিরি মা কেমন করে ভগবান হয়ে গেল। উলু, পেন্নাম, দয়াময়ের মাথায় কে একজন হাত বুলিয়ে দিল।

‘সতীমায়ের ছেলে তুই—তুই সাক্ষাৎ দুলালচাঁদ। নে বাবা, কলাটা ধর। খা !’ দয়াময়কে দাঁড় করিয়ে পেন্নাম করল। কোলের বাচ্চাটা চ্যাঁচায়…অন্য একজন বলল—সতীমায়ের ছেলে কলিতে জন্মেছে গো—সাক্ষাৎ দুলালচাঁদ। চার আনা পয়সা দিল হাতে। দয়াময় ছোটভাইটাকে নিয়ে বসল একটা গাছতলায়। ভাই কাঁদছে। দশ পয়সা পাঁচ পয়সা পড়তে লাগল।

এক টাকা হলে মেলার একটা মেঠাই দোকানে গেল দয়াময়। দোকানের মালিক বলল—তোর মা মরেছে বুঝি সকালে ?

হুঁ।

আহারে,—নাম কী তোর ?

আমি দুলালচাঁদ।

বাব্বা দুলালচাঁদ ! জব্বর নাম রেখেছে বা-মা। তুই থাকবি এই দাকানে ? এই দ্যাক না, তোর মতো কত ছেলে কাজ করছে। দয়াময় বলল—আমি যে সতীমায়ের ছেলে, মেলার লোক বলেছে আমি দুলালচাঁদ।

লোকটা বলে, বুঝিচি। হাসল। দুলালচাঁদ তুই আজকে। কালকে মেলা ভেঙে গেলে তুই হাভাতে। কাজ করবি তো বল। ওই দ্যাখ, রসগোল্লা, পান্তুয়া দেখেচিস ? খেতে পাবি।

দয়াময় সম্মতির মাথা নাড়ে। লোকটা বলে, তবে তোর ভাইয়ের একটা গতি করেত হয়। দোকানের সামনে বসা লাল চোখ জটাচুলের একটা লোককে ডেকে বলে, ‘আছে একটা। নেবে নাকি ?’ আঙুল দেখায় দয়াময়ের কোলের দিকে। দয়াময় দেখে সামনের চটের উপর দুটো নুলো বাচ্চা চ্যাঁচাচ্ছে, ওদের আশেপাশে পয়সা।

দয়াময় কেন যেন ভয় পায়। ভাইকে বুকে চেপে ধরে ছুট…

শিশুভ্রাতা ক্রোড়ে লৈয়া দয়াময় ধায়

হাজার শব্দের ভিড় পার হৈয়া যায় ॥

তারপরে বসে দুরে আম্রবৃক্ষ তলে।

এমন সময় সূর্য যায় অস্তাচলে ॥

ক্রমশ আন্ধার হৈল রূপসী বসুধা।

শিশু দুটি জল চায়, দেহে লাগে ক্ষুধা ॥

এয়োস্ত্রীরা গ্রাম্যপথে ফিরিতেছে ঘরে।

মেলা হতে ক্রয়করা দ্রব্য সঙ্গে করে ॥

মানুষ যাচ্ছে। দয়াময় এবার কেঁদে ওঠে, মা গো মা…এই প্রথম মায়ের জন্য আর্তনাদ করে দয়াময়।

মহিলাদের একজন ব্যাগ থেকে টর্চ বাতি বের করে।

‘আরে, এ যে দেখি সেই ছেলেটাগো, সকালের সেই…’

দয়াময় তাড়াতাড়ি বলে ওঠে—আমি—দুলালচাঁদ না, আমি দয়াময়, আমি ভগবান না, আমি দয়াময়…। আমার মা ভগবান না, আমার মা মরেছে সকালে; খিদে লাগে গো মা…

পুরস্ত্রী এয়োরা সবে কথা না কহিয়া

অন্ধকারে গ্রাম্য পথে গেল যে চলিয়া

ভাবিল ভবের লীলা বুঝি কেমনেতে

গৃহে গিয়া আঁচ দিতে হবে উনানেতে।

অতঃপর দয়াময় ক্ষুধায় কাতর হয়।

বড় ভীত হয় মনে মনে।

আবার মেলায় গিয়া দুরুদুরু করে হিয়া

পৌছায় সেই মিঠাই দোকানে

দয়াময় বলে শুন আবার এসেছি পুনঃ

এইবার দয়া করো মোরে

মালিক বলে দুলালচান্দ কেন তুমি মিছা কান্দ

নিশ্চিন্তে থাকো এই ঘরে।

দয়াময় ওরফে দুলালচাঁদ ক’বছর পরে এই মেলায় এল আবার। মহামায়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক ওকে দয়াময় নামে ডাকেনা, ডাকে দুলালচাঁদ। সেবার দুলালচাঁদ দোকান থেকে এক ছপ্পরে কেটে গিয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে একবার দেখে এসেছিল সতীমায়ের ঠেক, যেখানে ওর মা টসকে গিয়েছিল।

প্রমা,১৯৮৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *