রেখে আসা

রেখে আসা

ছেলেটির নাম নখা। নখা শুনেই বুঝেছি ওর আসল নাম লখিন্দর, বহুদিন এসব লাইনে আছি। বলি, পুরো নামটাই বল তো, ও বলল, নখাই। ওর সঙ্গী ছেলেটি বলে, ওর নাম হল নখ্‌খিন্দর। আমি গেয়ে দি—কেলে যারে যারে তুই চম্পাই নগর/দংশি এসোগা তুমি বালা লখিন্দর।

তখনই কী একটা ডেকে ওঠে জানালার পাশে। আমি বলি, প্যাঁচা ডাকল। নখা বলে গো-সাপ। আঁতকে উঠি। সাপ? সাপ আছে নাকি ? ওরা হাসে। মুহুর্তেই সেই হাসিকে রুগ্‌ণ করে বলে, গোসাঁপ আঁইগা বড় বকা। ঘর ডং ডং দুয়ারে কুলুক। জারে আরও দুব্‌লা।

কৃষ্ণা মুখ হাত ধুয়ে এল। হাতে একটা ঢাউস গ্যাঁদা। বলল, গাছ ভরতি ফুল।

ছেলে দুটো ঘর পরিষ্কার করে দিল। ওদের চাদরের উপর আমাদের নিয়ে আসা চাদরটা পেতে দিল টানটান। এবার বলল, রান্নার হুকুম দ্যান স্যার। লক্ষ করি স্যার উচ্চারণ কী নির্ভুল।

হ্যাঁরে, মুরগি টুরগি জোগাড় করতে পারবি ?

না স্যার, এই রাতে আর হঁবেক নাই। ডিমের ঝল ভাত।

আর তক্ষুনি ‘এইরে’ বলে কৃষ্ণা সাত তাড়াতাড়ি ব্যাগের চেন খুলে জামা কাপড় হাতড়ে একটা পলিথিনে মোড়া টিফিন বাটি বার করল। বাটিটা খুলে গন্ধ শুঁকেই জিভ কামড়াল। ইশশ। নষ্ট হয়ে গেছে। তুমি ভালবাস বলে ডিমের ওমলেট করে আলু দিয়ে মাখা মাখা ঝোল করেছিলাম, একদম ভুলে গেছি। আমি ওর মুখের দিকে একটু উদাস তাকালাম। এটা ওর কোনও নতুন ব্যাপার নয়। ভীষণ ক্যালাস ও। কতবার যে কত কিছু ভুলে গেছে আর হারিয়ে ফেলেছে, তার কোনও ইয়ত্তা নেই। বিয়ের পর প্রথম প্রথম কবিতা লিখে ওকে শোনাতাম, আমার তো খাতা বা ডায়েরি-ফায়েরি কিছু ছিল না, ওসব সিসটেম আমার টেমপারামেন্টে পোষায় না। আমার যখন মুড আসে, আইডিয়া আসে তখন হাতের কাছে যা কাগজপত্র পাই, লিখে রাখি। আমার কবিতা সৃষ্টি হয় ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া কাগজে, ইনল্যান্ড কভারে, গেঞ্জির প্যাকেটে—এইরকম। বিয়ের পরপর দশ-বারোটা পদ্য ফটাফট লিখেছিলাম। ওর কাছে দিয়েছিলাম রাখতে। সোদপুরে একটা কবি সম্মেলনে পড়তে যাব, পদ্যগুলো চাইলাম, সর্বনাশ ! একটাও নেই। তোশকের তলা, আলমারির লকার, ফিক্সড ডিপোজিটের প্লাস্টিকের খাম, সব খুঁজতে লাগল, কেবল বলছে, আমি খুব যত্ন করে রেখেছি। ওই ব্যাপারটা নিয়ে অবশ্য পরে একটা পদ্য লিখি, পদ্যটার নাম ‘যত্ন ছিল’। ‘যত্নে ছিল ভালবাসা কাজললতা মেঘের মধ্যে…’

আমেরিকা দেশে শুনি পুরনো হলে জিপগাড়ি, মটরগাড়ি ফেল্যে দ্যায় লোকে—ইটা সত্যি স্যার ? লখিন্দরের সঙ্গী ছেলেটি আচমকা প্রশ্ন করে। কৃষ্ণা এইমাত্র টিফিন কৌটোটা পরিষ্কার করে নিয়ে এল। আমি ওই আচমকা প্রশ্নের উৎসমুখ পেয়ে যাই। রান্নাঘর থেকে লখিন্দরের গলা—ডাহা লষ্টো হয়নি বউদি, খাবা চলত। ভোর চারটের সময় উঠে রান্নাবান্না শুরু করেছিল কৃষ্ণা। সকাল সাড়ে আটটায় পুরুলিয়ার গাড়ি। ভাত খেয়েই বেরিয়েছিলাম আমরা। পুরুলিয়া থেকে বাঘমুণ্ডি। বাঘমুণ্ডিতে CADP-র জিপ রেডি ছিল অযোধ্যা পাহাড়ে উঠবার জন্য। বাঘমুণ্ডির মোড়ে আবার ক্ষিধে পেলে জিপে বসে মুড়ি আর রেপসিডে ভাজা ঠান্ডা জিলিপি খাওয়া হল। আশ্চর্য, যখন ওই বাজে জিনিসগুলো খাচ্ছিলাম, কৃষ্ণা তখন ওই কৌটোটা বার করল না কেন, অ্যাঁ ? কৃষ্ণা লজ্জাগ্রস্ত বলেই কাচের গ্লাসটা পরিষ্কার করছিল। ও কি জানত না, এগুলো নখা-টখাদেরই কাজ। কেন বার করলে না তখন ? প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার হতেই কৃষ্ণার কৈফিয়তের সঙ্গে যেন অপরাধবোধ মিশে যায়।

…তখন এমন হয়ে গিয়েছিলাম না, ওইসব লাল রাস্তা, গাছগাছালি, কাঠবেড়ালি, পাহাড়ের রেখা…তখন ওই ওমলেটের তরকারির কথাটা না, একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

স্যার, আমরিকায় কি মেঁয়াছেল্যাদের গালে দাঁড়ি হয় ? ছেলেটির আবার আচমকা প্রশ্নে আমি হাঁ। লখিন্দর বলল, ভিডোতে দেঁখাইছে মেঁয়াছেলার দাঁড়ি গজাইছে।

এখানেও ভিডিও আছে ?

মাথা নাড়ে ও।

নাম কী তোমার ?

লখিন্দর তাড়াতাড়ি নাম বলে দেয়। বলে, উয়ার নাম মিঠুন আজ্ঞা। আর তখনই দেখি ছেলেটার জুলফি কামানো।

লখিন্দর বলে, যেথা ভিডো, সেথা এই খ্যাংড়াটা। এক্কেবারে পকা।

মি. দত্ত এলেন। কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো ?—কৃষ্ণার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণা না না করে শুধু মাথা নাড়ল। ম্যানার্স-ট্যানার্স একেবারেই জানে না কৃষ্ণা। এখানে কত কিছু বলবার স্কোপ ছিল। আসলে মি. দত্তের জন্যেই আমরা এসেছি এখানে, এই অযোধ্যা পাহাড়ে। উনিই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মি. দত্ত আমার এক বন্ধু অরুণের ভগ্নীপতি, এখানকার CADP প্রজেক্টের অফিসার।

মি. দত্ত বললেন, নখাটাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি। এই ছোঁড়াটা রইল, যা যা দরকার ওকেই বলবেন। কাল সকালে ওকে সঙ্গে নিয়ে নেবেন, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখিয়ে দেবে সব।

মিঠুনকে কিছু বলতে হয় না। বেতের চেয়ার পেতে দেয়, মাঝে ছোট টেবিল। আমরা বসি। দুটো খালি গেলাস এনে বলে, টেবিলে রাখব ? বলি, একটা রাখো। ও জিজ্ঞাসা করে, জল দি ? বলি, মহুয়া আনতে পারো ? ওকে দশটা টাকা দিই। শীত রাত। কুয়াশার ওড়নার উপর চন্দ্রকিরণ পড়েছে। কৃষ্ণা শালটা জড়িয়ে নেয়। মৃদু ফুলগন্ধ। ঝিঁঝি পোকার অর্কেস্ট্রা, আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা মাদলের শব্দ। আমি বলি, শোনো, শোনো। মাদলের শব্দ শোনো। শব্দের প্রতিবিম্ব শোনো। কৃষ্ণা কিছু বলে না।

শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ নিয়ে মিঠুন এল। হাতে বোতল। করিৎকর্মা ছেলে। দু’টাকা ফেরত দেয়। দরকার নেই, তুই নে। গ্লাসে ঢালি। মহুয়া বড় ফার্স্ট ক্লাস। আঃ।

পড়ে আছে মিহিন কাচের মতো জ্যোৎস্না।

শুকনো পাতার শব্দ এমন নিঃসঙ্গ।

সেইসব পাতা ভেঙে ভেঙে ভেঙে ভেঙে চলে যেতে যেতে

যেতে যেতে যেতে

বাতাসের স্পর্শ যেন কার যেন কার ?

কৃষ্ণাকে বলি, বলো তো কার ?

কৃষ্ণা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

জানে না, সুনীলদার।

তখন মিঠুন বলে, রাঙাহাড়ির। আমাদের দেবতা রাঙাহাড়ি হাওয়া দেয়, গরম হাওয়া…ঠান্ডা হাওয়া…

কৃষ্ণা মিনমিন করে বলে, বেশি খেয়ো না অ্যাঁ ? কৃষ্ণাটা এই রকমই। কোথাও নিয়ে যাই না ওকে। আট মাস বিয়ে হয়েছে, ওই একবারই পূরী নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাস। ক’দিন ধরে বায়না করছিল—এই তো আটকে গেলাম, ব্যাস, আর তো বেরোতেই পারব না বাচ্চা হবার পর দু’বছর তো একেবারে বন্দি, চলো না, কোথাও দু’দিন ঘুরে আসি। ঠিক আছে, এলাম। শাশুড়ির সেবা-টেবা করতে দাও, লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে দাও, জবাব নেই। কিন্তু আমার মন ? মনও তো কিছু চায়। রূপ যৌবন কি সব ? জামাইবাবু ছবিটা নিয়ে এল আমিও ভজে গেলাম। শ্রাবণীটা শেষকালে একটা পাইলট ছেলেকে বিয়ে করে ফুটে গেল, আমার মাল খাওয়া বেড়ে গেল। জামাইবাবু তখন উঠেপড়ে লাগল। বারোটা ছবির মধ্যে আমি কৃষ্ণাকেই পছন্দ করি। মুখটা হেভি লেগেছিল, বাংলায় এম এ। মেয়েটেয়ে দেখতে যাবার মতো ফিউডাল ব্যাপার-স্যাপারগুলো সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করতেই হল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, প্রিয় কবি ? বলল, জীবনানন্দ। নাইন্টি পার্সেন্ট মেয়ে রবীন্দ্রনাথ বলে থাকে। জীবনানন্দ বলতেই ভাবি ফিট। পরে তো জানলাম জীবনানন্দের মোট ন’টা কবিতাই পড়েছে ও, সে বছরের ইমপরট্যান্ট আর এ কে বি’র নোট জীবনানন্দের রূপচেতনা ঝাড়া মুখস্ত করেছে, তাতেই ফোর্থ পেপারে ফিফটি পার্সেন্ট।

কৃষ্ণাকে বলি, একটু খাবে ? ও বলল, প্লিজ, না। আমি বলি, কাল সকালে মহুয়া গাছ দেখাব। মহুয়া ফল দেখলে অবাক হয়ে যেতে, আঙুরের মতো, আর মিষ্টি। মহুয়া নামটাই ভারী মিষ্টি। আমাদের মেয়ে হলে নাম রাখব মহুয়া।

আর ছেলে হলে ?

ছেলে হলে তুমি ঠিক কোরো…

ছোঁড়াটাকে ডেকে বলি, মিঠুন, ক’টা আলু ভেজে দিবি ?

ও বলে, উরা মিঠুন মিঠুন হেঁকে খ্যাপায় মোকে। মোর নাম কেঁক।

কেঁক ?

হ স্যার ?

কেক কী ?

কেঁক দিগার।

দিগার ? তোরা খেড়িয়া ?

হ স্যার।

কেক নাম কেন ?

বাপ একবার একটুস খিয়েছিল কেঁক। আর কেঁক-এর কিচিমিচি। তারপর বাপের খঁকা হল্যে পেরানের আল্লাদে কেঁক নাম রাখা করে দিল্যাক।

সকাল। মায়া মমতার মতো এখন শীতের রোদ মাঠে শুয়ে আছে। চল কেক, আমরা তৈরি, ঘুরে আসি অযোধ্যা পাহাড়। নারীর চেয়েও গরবিনী এই মাঠ সহস্র চোখের সামনে গায়ে নিচ্ছে রোদের আদর৷ তুই মিঠুন অথবা কেক চাদর জড়িয়ে নে, চল আমরা বেরোই। কৃষ্ণার কারুকাজ করা লাল চাদরটা হিমরেণু মাখা। রোদের ঝালর নাচে। কৃষ্ণার সারাটা মুখে হাসির প্রলেপ, পাদমূলে, সোনালি স্ট্রাপের কাছে সুন্দর থেমেছে। ‘আহা, দারুণ’ বলতে গিয়ে গলা দিয়ে বের হল অম্বল ঢেকুর। মহুয়ার গন্ধ। কেক বলল, আসুন মেমসাহেব, সীতাকুণ্ডে যাই।

লোধা-খেঁড়িয়া সম্পর্কে আমি খুব ইনটারেস্টেড। ওদের চুনী কোটালের নাম জানি। টেপটা আনা হয়নি, কৃষ্ণাকে বলেছিলাম ও ভুলে গেছে। টেপটা থাকলে ওকে দিয়ে গাইয়ে নেওয়া যেত। বেতলা গিয়ে একটা স্কোপ পাওয়া গিয়েছিল, ফরেস্ট বাংলোয় মুণ্ডাদের আনিয়ে গান রেকর্ডিং করা হয়েছিল। তারপর অনির্বাণ যখন টিভি সিরিয়ালে সাঁওতাল পরগনার পটভূমিতে একটা মাল নামাচ্ছিল, আমি অনির্বাণকে হেল্প করেছিলাম। পূর্ব পুঁটিয়ারী প্রাচীন কলাকেন্দ্রের ছেলেমেয়েদের মুখে কালো রং মাখিয়ে নাচিয়ে নিল, পিছনে আমার কালেক্ট করা মুণ্ডাদের গান। তা আমি কেককে জিজ্ঞাসা করি—গান জানো ?

…হাঁ…

কী গান ?

ওয়ে ওয়ে—

তোমাদের গান ? লোধাদের গান ?

মৃদু মাথা নাড়ে ও।

কী খেতে ভালবাসো ?

ভাত—

তোমার দেশ কোথায় ?

কুকড়া টাঁড়

কোথায় সেটা ? ঝাড়গ্রামের কাছে ?

আমার ধারণা ছিল লোধা-খেড়িয়ারা সব ঝাড়গ্রামের ধারে কাছে থাকে। এখন জানলাম বাঁকুড়া-পুরুলিয়াতেও থাকে। ওর দেশ বাঘমুণ্ডি থেকে কুড়ি কিলোমিটার দক্ষিণে।

জিজ্ঞাসা করি—তা অযোধ্যাতে তুমি এলে কী করে ?

ও বলল, লুথান সাহেবরা বসাইল স্যার।

সেটা কী রকম ?—আমি তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছি…

ও যা বলল, তার থেকে বুঝে নিলাম যে ওয়ার্ল্ড লুথেরান সার্ভিসের লোকজন লোধা-খেড়িয়াদের মধ্যে কাজ করত। অযোধ্যা পাহাড়ে ওদের অনেকগুলো প্রজেক্ট ছিল। এই ছেলেটাকে বাচ্চা বয়সে ওদের গ্রাম থেকে তুলে এনেছিল, এখানকার স্কুলে ভরতিও করে দিয়েছিল। পরে লুথেরান সার্ভিস উঠে গিয়ে সি এ ডি পি প্রজেক্ট হয়। ব্যাপারটা সরকারি। ছেলেটা ফোর পর্যন্ত পড়েছিল। এখন গেস্ট-হাউসের বয়। মাসে মাসে মাইনে পায়।

জিজ্ঞাসা করি, বাড়ি যাস না ?

বলল, মাসে একবার যায়, মাইনে পেয়ে। ওর গাঁয়ে ওরাই সবচেয়ে বড়লোক। ওদের ট্রানজিস্টার রেডিয়ো আছে।

ইটা সীতাকুণ্ড স্যার। রাম সীতা বনবাসে আঁসেছিল, এইঠানে সীতার বড় পিপাসা লাগল, বুকের ছাতি ফাটে, কুথাকে জল নাই। লক্ষ্মণ করলে কী, মারলেক এক তির, আর ভূঁই ফাঁড়ে হুদাম জল ভকভক বাইর হল।

দেখলাম জল বুটিবুটি ফাটছে এক জায়গায়। কৃষ্ণা সেই জল আঁজলায় তুলে নিল, মাথায় ছেটাল। মেয়েরা এসেছে সব কলসি নিয়ে, জল নিচ্ছে।

অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে হাঁটলে পাহাড় বলেই মনে হয় না। চুড়াটা প্রায় সমতল ক্ষেত্র। চাষ হয়। সি এ ডি পি জল-সেচেরও ব্যবস্থা করেছে। ভাল বীজ, সার, লোন; তাই মাটির মিহিন গুঁড়োয় টায়ারের দাগ। অনেক টায়ার, অনেক অফিসার, তাই মহুয়া গাছের তলায় গোল্ড ফ্লেকের শূন্য প্যাকেট, সীতাকুণ্ডের পাশে বোতলের ভাঙা কাচ, ব্ল্যাক লেভেল, কনডোম নিয়ে যায় কাক।

চলুন যাই সীতার চুল দেখাব।

ছেলেটা নিয়ে এল এক জঙ্গুলে জায়গায়।

দ্যাখেন স্যার, হুইয়ে, সীতা মায়ের চুল।

দেখি ওখানে কতগুলো গাছ থেকে ঝুলছে কালো কালো ফাইবার।

দ্যাখেন, দ্যাখেন গো, ক্যামন খাঁকড়িতেলা চুল…

ছেলেটি একটা গল্প বলে। আশ্চর্য গল্প। বনবাসে এসেছিলেন রামচন্দ্র। রামচন্দ্র নাকি পান্তা ভাতের সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা খেতে চেয়েছিলেন। আর সীতা মা সারাটা পাহাড় ঢুঁড়েও একটা কাঁচা লঙ্কা পেলেন না। রাম তাই রাগ করে ভাতই খেলেন না। সীতা তখন রাগে-দুঃখে অভিমানে মাথার চুল ছিঁড়লেন। আর সেই চুল পাহাড়ের লতায় পাতায় জড়িয়ে রয়েছে।

কৃষ্ণা পায়ের গোড়ালি উঁচু করে ওই সীতার চুল ধরার চেষ্টা করে। হাতের নাগালে একটু পায়, হাতে জড়িয়ে নেয়, আর উঁচু বৃক্ষচুড়ার দিকে তাকিয়ে বলে, সীতার প্রতিবাদ।

ছেলেটা বলে, ডঁগে লিবেন মেমসাহেব ? বলে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ে। একটা পাতায় মুড়ে কৃষ্ণাকে দেয়। কৃষ্ণা ওর কাঁধ চাপড়ে বলে, বাঃ। ছেলেটা চনমনে হাঁটে, শালিখের পা।

কেক গান ধরে:

সরু সরু কানালী।

ধান লাগা করালি

জিলপি দিব বল্যে

জুনার পড়ায় ভুলালি৷

ওই তো গান। গানে ধানের কথা…

ধান চাষ জানো ?

কেক আনমনা হয়। থমকে দাঁড়ায়।…এ ছড়া, চা বানা, এ ব্যাটা গেলাস দে, হেই শালা, মহুয়া আন…এইসব করি স্যার। সে কারণেই গায়ে জামা, পায়ে হাবাই চটি। ঘরের খুড়া জ্যাঠার উদলা গা। খুড়া-জ্যাঠা আমাকে বলে, কাঁকড়া লক। ঘর মোকে চক ঠারছে, বাহিরে মোকে শালা হাঁকছে।

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে কেক। কাঁকড় মাড়ানো শব্দ। পাতার মর্মর। একাকী পাখি। সীতার দুঃখ।

আমি বলি, কেক, কদ্দিন ঘর যাসনি ?

মাসটাক হয়েছে। ইবার যাব। আলাদীর বিহা। আলাদী মোর জ্ঞাতি বুন।

ও কর গুনে বলে, আর পাঁচ দিন মাঝে। ও এবার কৃষ্ণার কাছে যায়। ভীষণ অনুনয় করে কী যেন বলে।

কৃষ্ণা আমাকে বলে পুরুলিয়া যাবার পথেই ওদের গ্রামটা পড়বে। কাল দুপুরে যখন আমরা যাবই, দত্তকে বলে একটা লিফট দিলে হয় না ? পরশু থেকে ওর ছুটি করা আছে।

আমি বলি, কেক, তোদের বিয়েতে গানটান হয় ?

হয়,…হয় না।

মানে ?

প্যাটে দানা, তবে গান।

আমি বলি, দত্তকে বলে তোকে জিপে করেই নিয়ে যাব তোদের গ্রামেও ঘুরে আসব। গান শোনাতে হবে কিন্তু।

জিপ চলল৷ নীচে নামছে। যখন উঠেছিলাম, তখন প্রায় সন্ধে, চারপাশ পাহাড়ি কুয়াশায় ঢেকে আসছিল, বনরাজি-লীলা দেখা হয়নি তেমন। জিপের হেডলাইটে নার্ভাস এক খরগোশকে জুবুথুবু হয়ে থাকতে দেখেছিলাম রাস্তায়। কালো রাস্তায় সাদা খরগোশ। দারুণ লাগছিল।

এখন সদ্যশীতের হেমবর্ণ দুপুর। গাছেরা কেউ কেউ পাতা ঝরানো শুরু করেছে। এইমাত্র ঝরনা জল দেখা গেল। একটা গাছ সারা গায়ে লাল পুঁতির মালা পরে সেজেছে সুন্দর। টুকুস থামাও হে—চিৎকার করে কেক। পাহাড়ি ঢালে ইচ্ছে হলেই গাড়ি থামানো যায় না, বেচারা জানে না। ও আবার চেঁচায়। গাড়ি থামলে ছুটে যায় উপরের দিকে। ওই লাল ফল ছিঁড়ে আনে। জামাটা কোঁচড়ের মতো করেছে, তাতে ভরতি ওই লাল ফল। ও বলে চুংড়া। কৃষ্ণার কাছে একটা পলিথিন পেয়ে খুশি হয় কেক। ওর জামায় কালো কষ লেগেছে। আমাকেও ক’টা দেয়। অচেনা ফল আমি খাই না। কৃষ্ণা খায় না, ড্রাইভার খায় না। কেক ওর লোধা গ্রামের ভাইবোনদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।

তোরা ক’ ভাইবোন রে কেক ?

জড়ায় বুন, জড়ায় ভাই। আমি বড়—

দুটো দুটো ?

হ স্যার।

লেখাপড়া করে ? স্কুলে ?

বুন জড়া ছোট। ভাই যায়।

কোন ক্লাস ?

টু স্যার। ক খ গ ঘ ফটাফট হাঁইকতে পারে কোনটা ক কোনটা গ চিনে না। আমাদিগের লধা ইস্কুলে কালো কাঠ নাই স্যার।

বিয়েটা কার ?

খুড়ার মেঁয়ার—

বয়স কত ?

টিসি—

টিসি মানে ?

ছোট—

এইভাবে ওর কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলাম ওদের বিয়ের পদ্ধতি। ওদের বরপক্ষ কনেপক্ষকে পণ দেয়। ছোট মেয়ে মানে বড় যাদের ঋতু শুরু হয়নি, তাদের পণ জাঠা, মানে বড় মেয়েদের তুলনায় বেশি। এখন কন্যাপণের পরিমাণ ১২৫ টাকা। এই টাকাটা মেয়ের বাপ পাবে। কৃষ্ণা হঠাৎ বলল, লোধা মেয়ে হয়ে জন্মালেই ভাল হত। আমি বললাম, কিছু নিয়েছি নাকি আমি ? এক পয়সাও ক্যাশ ? ফ্রিজ ?

কৃষ্ণা আস্তে করে বলে যাচ্ছিল, রিলাকশন…বোম্বে ডাইং…ক্যাসারোল…সোফাসেট… দ্রুত সরে যাচ্ছিল গাছপালা, নদীখাত, মাঠের পাথর।

বাঘমুণ্ডি ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ যাবার পর ডান দিকের একটা সরু রাস্তা দেখিয়ে কেক জিপের পিছন থেকে জানাল ওই পথে ওর গ্রাম। ড্রাইভার নিরঞ্জন গুঁই ওকে বলল এখানে নেমে হেঁটে চলে যেতে। আমি বললাম, তা কী করে হয় ? আমি ওদের গ্রামে যাব যে। গুঁইবাবু বলল—যাবে ? খুব নোংরা। গাড়ি ডান দিকে ঘুরল। লাল মাটির পথ। একটা দোকানও দেখছি না যে এক প্যাকেট বিস্কুট বা ক’টা টফি কিনে নেব।

খুবলে খাওয়া জঙ্গলে বিক্ষিপ্ত ইউক্যালিপটাস গাছ আর পাথর সাজানো এবড়ো খেবড়ো মাঠ দেখতে দেখতে কুড়ি মিনিট কাটালাম। ড্রাইভার অধৈর্য। বলে, আর কতদূর রে তোতড়া, কেক বলে, হুই দ্যাখা যায়। কিন্তু সামনে তাকিয়ে কোনও গ্রামের চিহ্ন দেখতে পাই না, দেখি জঙ্গল অনেকটা ফাঁকা হয়ে এসেছে, আর ফাঁকে ফাঁকে লাল টুকটুকে এক ধরনের সরু সরু গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। ভারী সুন্দর গাছ, পাটগাছের মতো লম্বা, আগাগোড়া লাল এবং ওই গাছগুলিতে ছেয়ে আছে লাল লাল এক ধরনের ছোট ছোট ফল।

কৃষ্ণা, এই গাছের শুকনো ডাল আর ফলগুলো দিয়ে কী রকম ইকেবানা হয়, বলো ?

এগুলো কীরে কেক ? কী গাছ ? কী হয় ?

ইসব কুদরুম স্যার। ডাইল কুথা পাবেক গা-গরামের লক ? কত দাম। ইগুলার বীজ সিঝা খায়, আর আঁশদড়ি ব্যাচে।

পথের ধারে বিষ্ঠা, তার ভিতরে মরা মরা কৃমি। গ্রাম এসে গেছে। জিপ থামে।

গাছতলায় বেদি। বুঝি এটাই গরাম থান। গ্রামের ভিতরে যাই। ধীরে ধীরে বেলা পড়ে আসছে। ভাঙা ভাঙা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ভাঙা ভাঙা মানুষ, ইশশ, কী দারিদ্র্য, বলো কৃষ্ণা। ওরা জুলজুল চোখে জিপ গাড়ি দেখে, তন্তুজ শাড়ির কলকা কাজ, চটির সোনালি স্ট্র্যাপ, ফটোক্রোমাটিক চশমা।

কেক ছুটে যায়। এটা ওর ভিটে বাড়ি। ওর আত্মীয় পরিজনের কানে কানে কী সব বলে, আমরা উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকি। মুরগির ছানাগুলো আর লোধা গ্রামের ন্যাংটো শিশুরা যে যার মায়ের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভিতর থেকে আসে একটা দড়ির খাটিয়া। বসতে বলে। একজন বয়োবৃদ্ধ লোক হাতজোড় করে দাঁড়ায়; বাড়ির কর্তা। একমাত্র ওঁর গায়েই শীতের কিছু রয়েছে— একটা ছেঁড়া কাঁথা।

কার বিয়ে ? মেয়েরা হাসাহাসি করে। বয়োবৃদ্ধটি বলে—ওই—উয়ার। লাতনি। আলাদি। বছর বারোর একটি মেয়ে, ইজেরের উপর গামছা জড়ানো, অন্য ছেলেমেয়েরা উদোম গা। যুবতী মেয়েরাও ব্লাউজহীন খাটো শাড়িতে শরীর জড়িয়ে রেখেছে।

একটা সদ্যশিশু স্তন খায়। হাওয়ায় শিরশিরানি। শিশুটির গায়ে কিছু নেই, হাওয়ার কনকনানি লাগলে ওর মা বুকে চেপে ধরে, আঁচলে জড়ায়।

বলি গানটান হোক না, বিয়ের গান।

ওরা হাসাহাসি করে। কেক ওদের কীসব বোঝাল, তারপর কয়েকজন মেয়ে শুরু করল গান। যে শিশুরা মায়ের ওম পাচ্ছিল, এবার ওরা ওই বুড়ো দাদুর গা ঘেঁষল, বুড়োর কাঁথার কাছে। কেউ হাত ঢোকাল কাঁথার ভিতরে।

আমার হাফ সোয়েটার ছিলই, ফুল হাতাটাও পরলে ভাল হত। লজ্জা পাই।

গান শুরু হয়। টেপ রেকর্ডারটা না আনার দুঃখের ‘ইশ’ ভাব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে গান শুনি—

ঝিকাশুলি মামাঘর কুকুড়া টাঁড় বাপঘর।

হল হল ধনি তর সিরাডহে শ্বশুরঘর।

তাড়ুলে তর মাসিঘর বিড়াশুলি পিসিঘর

হল হল ধনি তর সিরাডহে শুশুরঘর।

বাঘমুণ্ডির হলদ মশলা বড় বড় ধনা গো

দর শুধালে বলে দিব সিরাডহে বর গো।

আর একটা। আর একটা।

জল সাইতে গেলিরে আলাদী জল নাঁহি মিলে সাবন দিঞে গা ধবি আলাদী জল নাঁহি মিলে। কৃষ্ণার কানে কানে বলি, দ্যাখো, জলের ক্রাইসিসের কথা, মর্মবেদনা, কেমন করে লোকসংগীতে চলে আসে।

জল সাইতে গেলিরে আলাদী জল নাঁহি মিলে এথা কথা জল পাবি শাবন মাস বিনে…

ঘড়ি দেখি। চারটে। বেশ শীত। এবার উঠতে হবে। দশটা টাকা দিই আহ্লাদীর হাতে। আহ্লাদী প্রকৃত অর্থে আহ্লাদী হয়ে যায়।

জিপ পর্যন্ত এগিয়ে আসে কেক, আর ওর পিছন পিছন ন্যাংটো শিশুর দল।

জিপ চলতেই ঠান্ডা আরও বেশি করে বুঝি। ঠান্ডাটা যেন আজই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি এবার ফুলহাতা সোয়েটারটা চড়িয়ে দিই। কৃষ্ণাকে ব্যাগ থেকে শালটা বার করে গায়ে জড়িয়ে নিতে বলি। ও বলল, ওর উলের ব্লাউজ আছে, আর কিছু লাগবে না। বাসরাস্তায় জিপটা এল। বেশ জোরে চালাচ্ছে ড্রাইভার। পুরুলিয়া থেকে ওকে ফিরতে হবে আবার।

এরকম শর্টট্যুর মন্দ নয়, বলো ?

বেশ কাটল, আমি বলি। কৃষ্ণা আরও গা ঘেঁষে বসল। হাতের মুঠোয় নিল আমার হাত। কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম এই ঘনিষ্ঠতা ভালবাসার নয়, শীতে ও যখন ব্যাগের চেন টেনে ভিতর থেকে চাদর বের করল।

গতকাল রাতের মহুয়ার পর বমির সামান্য নোংরা চিহ্ন লেগে থাকা চাদর। আমি বলি—ইশ এটা কেন, শাল কোথায় ? ও কিছু বলে না। শালটা পরছে না কেন বুঝি না। ওটা আমিই দিয়েছিলাম জাস্ট শীত পড়তে শুরু করার আগে আগে। আমি ব্যাগ দেখি। কত কী হাবিজাবি। পাতায় মোড়া ওটা কী ? সীতার মাথার চুল ? শালটা ?

শালটা ফেলে এসেছ, তাই না ?

ও চুপচাপ। অদ্ভুত। ক্যালাস। দুশো চুরাশি টাকা দাম, জানো ? কোথায় ভুলে ফেলে এলে ? অযোধ্যা পাহাড়ে ?

না।

তবে ? তা হলে কি ওই ছেলেটার গ্রামে ? ওখানে কি ব্যাগ থেকে বার করেছিলে শালটা ?

হ্যাঁ।

তা হলে ওখানেই। ইশ। জিপটা ঘোরাবেন প্লিজ ? না থাক। ট্রেন পাব না। কী ক্যালাস তুমি, ছিঃ এরকম ভাবে ভুলে ফেলে এলে ?

ফেলে আসিনি।

তবে ?

রেখে এসেছি।

মাঠ দাপানো হাওয়া শরীর ফুঁড়ছে। হাওয়ার দংশন। ও চুপচাপ বসে আছে। আহ্লাদী।

ওর চুল উড়ছে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে যাই ওর কাঁধ। হাত গুটিয়ে নিই। চারিপাশে ছড়ানো পাথর। পাথরের সঙ্গেও আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা ছিল।

কথা রেখে আসি।

শারদীয় বর্তমান, ১৯৯২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *