অনন্তবালা

অনন্তবালা

চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে।

কদমতলায় আমি। একা একা বিড়ি খাচ্ছি বসে।

কদমের কুঁড়ি এসে গেছে। কিছুদিন পরে বের হবে রোঁয়া। ঘ্যাং ঘ্যাং ব্যাং ডাকে। পাতাপচা-পাটপচা গ্যাস বাতাসেতে ভর করে আসে। দুই-চার মশা ও মশার বাচ্চার ভনর ভনর অবিরাম। আকাশের চাঁদ যেন জিপে বসা অঞ্চলপ্রধান, ‘উলস ফ্ল্যাগ’ ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন। মেঘ হয়ে উড়ে যাচ্ছে ধোঁয়া। এ সময় কাছে এল ঘোড়া, হ্যাঁ-গো, ঘোড়া। ঘোড়া, হর্স। স্তন্যপায়ী চতুষ্পদী জীব। সাদা সাদা রং। তাগড়াই ল্যাজ। কী আশ্চর্য, ঘোড়া কোথা থেকে এল ? এ গ্রামে তো ঘোড়া নেই, গাধাও নেই একটাও। খচ্চর কিছু আছে, মনুষ্য আকৃতি। ঘোড়া এল কোথা থেকে ? তবে কি ঈশ্বর এলেন ? ঘোড়া কোন দেবতার বাহন ! মনে পড়ছে না তো। চোখটা কচলিয়ে দেখি। সাদা সাদা রং। সত্যি সাদা, নাকি চাঁদের কিরণে শালা এমন হয়েছে।

ঘোড়াটির ভয় নেই কোনও। হেবি স্মার্ট। মেজ ভায়রাভাইটি যেমন। সি আর পি-তে কাজ করে। বুট জুতো সদা খটখট। ঘোড়াটিও খটখট করে। ঘোড়ার পায়েতে থাকে ঈশ্বরের বুট। ঘোড়া বলে, হ্যালো, ভাল ? আমি চিল্লিয়ে বলি, ওলো ভ্যাবলার মা, দেকে যাও, দেকে যাও কী কাণ্ড হচ্ছে এখানে। ভ্যাবলার মা নিশ্চয়ই মুখখানা ভ্যাক করে ঘুমোচ্ছে এখন। ভ্যাবলা ও ক্যাবলার মাথায় দু’হাত। স্বপ্ন দেখছে বম্বে খাট, ঢং ঘড়ি, পুরী গিয়ে তেরাত্তির থাকা মন্দিরের পাশে কোনও ধর্মশালায়। এইসব অঘটন স্বপ্ন দেখছে শুধু। অথচ উঠান জুড়ে অঘটন ঘটে যাচ্ছে স্বপ্নেও ভাবছ না তুমি ভ্যাবলার মা।

ঘোড়া এবার ল্যাজটা ওঠাল অল্প। সোজা বলল, ডিম পাড়ব। পোয়াতির লজ্জা-হাসি নেই, মুখ নিচু নেই। সোজা বলল, ডিম পাড়ব, ভাল দেখে জায়গা বেছে দাও। মাথা চুলকিয়ে বলি, পাড়বে যদি পাড়ো, গাছের তলায় পাড়ো, উঠান রয়েছে পাড়ো, পাড়ো বাঁশঝাড়ে। ঘোড়া বলে, নাকি ঘোড়ী হবে এটা। স্ত্রীলিঙ্গে ঘোড়া কী ? ভ্যাবলা ঘুমোচ্ছে। ওর আছে একের ভিতরে চার। ব্যাকরণ, পত্রলিখন, ভাবসম্প্রসারণ ও রচনা। ঘোড়ার স্ত্রীলিঙ্গে কী ? ঘোড়ী, ঘোড়ানী, না স্ত্রী ঘোড়া ! যাই হোক, পরে দেখে নেব। এখন ঘোড়াই বলি।

ঘোড়া বলে, তুমি হচ্ছ গাধা, কিচ্ছু জানো না। একের ভিতরে চার খোলো, খুলে দেখে নাও ঘোড়ার রচনা। ‘ঘোড়া দাড়াইয়া ঘুমায়’। তার মানে বসতে বড় কষ্ট হয় আমাদের। ভক্ করে পেড়ে দিই যদি, ডিম ফেটে যাবে। নষ্ট হবে জাতীয় সম্পদ। কত রতি, কত কুদরতি পরে প্রস্তুত হয়েছে ডিম। নরম, নরম জায়গা বলো। মন্ত্রীর চেয়ার যেমন। আমি তো নরম খুঁজি এধারে-ওধারে। ঘরের চাটাইয়ে ভ্যাবলার মা। ওর গায়ে পাড়া যায় ? ও কি আর ততটা নরম ? বরং গোবর গাদা ভাল হবে গোয়ালের কোণে। এই পাশে গাদা করে রাখা আছে পাট। সেই ভাল। পাটের ওপরে পাড়ো। ঘোড়া ঘাড় নাড়ে। মানে রাজি হল। বলে ও কে। অ ও ক্কে। পাটের গাদার পাশে স্থির হয়। পোজ নেয়। পেড়ে দেয় ডিম। সোজা চলে যায়। এদিক ওদিক নাহি চায়। কী রকম মা তুমি হে ঘোড়া ? নিজের ডিমের প্রতি সামান্য মমতা নেই ?—মমতার কথা তুমি বোলো না মানুষ; ঘোড়েল ঘোড়াটি বলে। জন্ম দিয়ে শকুন্তলাকে, তার মা গিছিল কোথায় ? স্তন দিয়েছিল ? পালটেছিল কাথা ? মালিশ করেছিল তেল ? শান্তনুর গল্প জানা আছে। গঙ্গা ছুঁড়ি করেছিল কী ? ম্যালা বকিও না। অ্যাত ছ্যানাপোনা কোথা থেকে পায় মাদার টেরেসা ? এই বলে মৃদু হ্রেষাধ্বনি করে ঘোড়াটি পালায়। অশ্বক্ষুরধ্বনি ঢেকে দেয় ব্যাং। আবার ঘ্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং। ডিমটিকে দেখি বেশ চাঁদের আলোয়। আহা, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে। কী সুন্দর সাদা। বেশ বড়। বড়সড়ো কুমড়ো সমান। ঈশ্বরের কী মহান লীলা। চুপচাপ নিরীক্ষণ করি। নিরীক্ষণ শেষ হলে হাই ওঠে। পুনরায় টের পাই মশার ভনর। বিলের ওপারে ওই চলে গেল এগারোটা বাইশের ট্রেন। এবার শুতে যেতে হয়। কিন্তু কী করে ঘুমাব ? আমি মাইরি না-বিয়ানো কানাইয়ের মা। ঘোড়াটা বিশ্বাস করে আমার কাছেই পেড়ে গেল ডিম। কী করে ঘুমাতে যাই ! শেয়ালে খেয়ে নেয় যদি ? শেয়াল কি ডিম খায় ? জানা নেই। বেড়ালেও ফেলে দিতে পারে। পুরো একটা ঘোড়া নষ্ট হয়ে যাবে। তুলে নিয়ে ঘরে রাখি যদি ? কী দরকার বাবা, ফাইব পাস আমি। কীসে কী অনর্থ হবে, দুষবে অন্তর্যামী, কিংবা পাবলিক। তার চেয়ে আজ রাতে বসে থাকি। কাল ভোরে, পাঁচমাথা মিলে ঠিক করা যাবে। ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ ঠিক করা যাবে। এই কথা বড় চালু আজকাল। পঞ্চায়েত লোকজন, জিন্দাবাদ চ্যাংড়াচোটারা সব ‘আলাপ আলোচনার মাধ্যমে’ বলে। আমিও মনে মনে তাই বলে রাতে বসে থাকি। ব্যাঙেদের শব্দ ক্রমে ক্রমে ঘুমন্ত মনে হয়। রাতের তারাদের সাথে কথা বলি। কোন তারা বম্বে খাট হয়ে বসে আছে, কোন তারা আমূল মাখন, কোন তারা পুরী গিয়ে তে-রাত্তির বাস। তারাদের দেখি। জোনাকির আঁকা বাঁকা আলো। অফুরান ঝিঁঝি ডাক, বি ডি ও অফিসে যেন টিফিন হয়েছে। চাঁদ ডুবে গেলে, ঘোড়ার ডিমটির গায়ে অদ্ভুত আঁধার, আঁধারের পর্দা পড়েছে। ঠাহর হয় না কোন পাতা, কোন ঠ্যাং। ঘোড়ার ডিমটিও ঠাহর হয় না ঠিক। তবু আছে। আঁধারের ভিতরে সে সত্যি সত্যি আছে। অন্ধকার সহে গেলে, টগর ফুলটিকে যেন দেখি উঠানের কোণে। গোয়ালের গাইটিকে দেখি। ঘোড়ার ডিমটিও দেখি, যেন অল্প অল্প শিশির পড়েছে। ডিমটির শরীরে যেন আহ্লাদ আহ্লাদ।

তারপর অনন্তবালা ডেকে ওঠে। তার মানে এইবার ভোর হয়ে যাবে। পাখি সব করে রব হবে। রাতি পোহাইবে। টর্চ লাইট দেখা যায় মাঠে। ফার্স্ট ট্রেনে যাবে বলে বাহ্যে বসেছে কিছু কাজের মানুষ। অনন্তবালা ডেকে ওঠে ফের। অনন্তবালা মানুষ নয়। অনন্তবালা এক লক্ষ্মীমন্ত মুরগির নাম। চলনে বলনে তার মা-মা ভাব। অনন্তবালাই ডেকে ডেকে সূর্যকে ওঠায়। সূর্য ওঠা মানে সকাল হয়ে গেল। ঘাস বীজ দেখা যাবে মাঠে, খুঁটে নেওয়া যাবে দানা। পুব দিক লালচেপানা হল। আমিও ডাকতে থাকি। হ্যাঁগো, শুনছ ও ভ্যাবলার মা, ঘুম ভেঙে উঠোনে এসো, দ্যাখো কত বড়…অনন্তবালার মতো আমিও ডাকতে থাকি। ভ্যাবলার মার আগে আলুথালু চলে আসে হৈমবতী পিসি৷ কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রাত্রি রয়ে গেছে। হল কী রে, কী হল ! চ্যাঁচাস কেন বাপা !

ডিমটি দেখিয়ে বলি, দ্যাখো পিসি, কত বড় ডিম। ঘোড়া পেড়ে গেছে কাল রাত্রি নিশীথে। সব বলি। পিসির কাপড় থেকে রাত্রি সরে যায়। কোমরে আঁচল গুঁজে ডিমটির সামনে দাঁড়ায়। তারপর দুই হাত জোড়া করে কী সব বলতে থাকে। কী বলছে এই হৈমবতী বুড়ি ? বরণ করছে নাকি নতুন সৃষ্টিকে ? নতুন বস্তু পৃথিবীতে এল বলে তার এই মন্ত্র-অনুরাগ ? বুড়ি বলে, এইবার হবে। সব হবে। পৃথিবীর সব দোষ কেটে যাবে। সেই কবে, ছোটকাল থেকে শুনি আসতেছি ঘোড়ার ডিমের কথা, এতদিনে সত্যি হল। দেখে নিস, এইবারে পরি এসে নেচি যাবে ফুলের বাগানে। সব খড়চাল এইবারে এসবাসটেস হবে। এলমনি বাসনের সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে। বেগুনে লাগবে না পোকা, আলুতে হবে না ধসা রোগ। ফলিডল-টলিডল খেয়ে আর মরবে না কোনও বউ।

তিন টাকা জোড়া কমলার খোসার মতো রং দেখি সূর্যের আলোর। ফোকাস মারল ঠিক ডিমের উপরে। সত্যি, যেন হয়, আহা, বুড়িটির সব কথা সত্যি যেন হয়।

এইবারে এসে গেল ভ্যাবলার মা। এখন চোখের কোণে মরে যাওয়া স্বপ্নের আঁশ। অপর কথায় তাকে পিচুটি বলে লোকে। আমি তো ডিমের কাছে। চোখের ইশারায় বলি, দ্যাখো। পাটের গাদার পরে তুলে দিই পা। পায়ের পাতায় বেশ রাজা রাজা ভাব।

মিত্তিরদের বড় ঘরে এরকম বড় ছবি টাঙানো রয়েছে। ডোরাকাটা বাঘের উপরে পা। একহাত ছুঁয়ে আছে শুঁড় ওঠা গোঁপ। বলাই মিত্তিরের ঠাকুরদার ছবি। আমি ভ্যাবলার বাপ এখন আশ্চর্য এই ডিমের মালিক।

ডিম দেখে ভ্যাবলার মা ভ্যাবাচাকা খায়। চোখ মোছে দু’ হাতের চেটোয়। চোখের পিচুটি সূক্ষ্মরেণু হয়ে মিশে যায় হাতে। এত বড় ডিম সে তো জীবনে দেখেনি। বলে কীসের ? আমি গর্বভরে বলি, ঘোড়ার ! ঘোড়ার ! আমার কীসের গর্ব ? কেন গর্ব ? নিজেই বুঝি না ! তবু গর্ব হয়। ঘোড়া পেড়ে গেছে ডিম, বলা যায় জোর করে। আমার অবদান নেই কোনও, তবু গর্ব। কোন গর্ব নিজেই বুঝি না। ভ্যাবলার মা হতভম্ব হল। আবার প্রশ্ন করে, কীসের ? কীসের ? গর্বে গম্ভীর হয়ে মৃদু উচ্চারণে আকাশে তাকিয়ে বলি, বললুম তো, ঘোড়ার। হতভম্ব ভাব কেটে গেল। হাসিই থামে না। বলে ইয়ার্কি দিচ্ছ কেন ? বলো না কী ওটা ? হৈমবতী পিসি বলে, বলছে তো ঘোড়ার।—ইঃ, তা আবার হয় নাকি ? তোমরা সব পাগল হয়েছ ? আমি বলি, ওরে ভ্যাবলা, ওঠ দেখি, খোল দেখি একের ভিতরে চার। মনে আছে ? কাল রেতে পড়েছিলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সন্ধি বিচ্ছেদ। ব্ৰহ্ম যোগ অণ্ড ব্রহ্মাণ্ড। ব্রহ্মের অণ্ড এই বিশাল পৃথিবী। পৃথিবীটা সত্যি যদি, ঘোড়ার ডিমটি তবে মিথ্যে হয়ে যাবে ? নাকের ফুটোয় নড়ে ভ্যবলার মার কড়ে আঙুল। তার মানে চিন্তায় পড়েছে খুব। গভীর চিন্তা করলে ভ্যাবলার মা এরকমই করে। তারপর ডিমটিকে ছুঁয়ে দেখতে আসে। হই হই করে ওঠে হৈমবতী পিসি। করো কী, করো কী, বাসি কাপড়েই ছুঁয়ে দেচ্চ ! যাও, আগে কাপড় পেলটে এসো…। ভ্যাবলার মা থেমে যায়। চোখটা নামায় মাটিতে। যেন বুঝতে পারল নিজের দোষ। তড়িঘড়ি কাপড় পালটে সে এয়ো হয়ে এল। সঙ্গে এল ভ্যাবলা ক্যাবলা। আমি হাসি হাঃ হাঃ হাঃ। ছেলেরা অবাক। বাপের জন্মে এ জিনিস দেখেনি ছেলেরা। ক্যাবলা ছোটটার নাম। অবাক বিস্ময়ে সে মায়ের শরীরে লেপটে থাকে। কথা নেই, বার্তা নেই, ভ্যাবলাটা বলে ফেলে, ইয়া বড় মামলেট হবে একখানা। হেসে ফেলে ভ্যাবলার মা। বলে, এত বড় কড়াই কোথায় ?— ক্যানো ? পরথমে বালতিতে গুলে নেব, তারপরে খুব কম করে নংকা প্যায়াজ দে বেশ হবে। কতগুলি মামলেট হবে মা ? ভ্যাবলার মা আমার চোখের দিকে চেয়ে বলে, এক কুড়ি হতে পারে বলো ? আমি খুব রেগে যাই। চোখটা ঘোরাই গোবর গাদাটির দিকে বলি, স্ত্রীবুদ্ধি সর্বনাশী এ কারণেই শাস্ত্রে বলেছে। আরে জানো, এর মধ্যে আছে গোটা একখানা ঘোড়া। একটি ঘোড়ার মূল্য কত জানো ? অঙ্ক করছিলি না একটি ঘোড়ার মূল্য দশটি গাধার সমান। একটি গাধার মূল্য এত টাকা হইলে…। তা হলেই বোঝ। এমন অবুঝ তোরা, গোটা ঘোড়াটাকে মামলেট বানাতে চাস ! এই কথা শুনে সংবরণ হয়ে গেল যাবতীয় লোভ। ক্যাবলাটি নেচে ওঠে। নেচে যায়। প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনায় কার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে…নেচে নেচে বলে রাজা হব… রাজা হব…। ঘোড়া চড়ে রাজা হয়ে যাব।

অনন্তবালা আসে ল্যাংচানো চরণে। চমকে চকিতে চায় ডিমটির দিকে। বিস্ময়ে কোঁকর কোঁ হাঁকে। এত বড় ডিম সে জীবনে পাড়েনি। বেচারি দেশি মুরগিটা। ছোট ছোট সাইজের ডিম পেড়ে গেছে সমস্ত জীবন। মিত্তির বাড়ির, চৌধুরি বাড়ির, দত্ত বাড়ির পুষ্টি অভিলাষী মানুষেরা হাফ বয়েল খেয়েছে কিছু কিছু। বাকি ডিমগুলি জড়িয়েছে সে নিজস্ব উত্তাপে। ওম্‌ দিয়ে ফুটিয়েছে ডিম। ডিমগুলি হচ্ছে সব আশা-আকাঙক্ষার মতো। উত্তাপে-ভালবাসায় জন্ম হয়, ডিম ফোটে। তারপর বড় হলে কারা যেন ঠ্যাং বেঁধে, সাইকেলে উলটো ঝুলিয়ে নিয়ে হাটে চলে যায়। অনেক আশা-আকাঙক্ষা আর কামনা বাসনার গল্প অনন্তবালা জানে। অনন্তবালা এক মুরগির নাম। হৈমবতী পিসি একে পোষে। কম ডিমে তা দেয়নি অনন্তবালার নারীজীবন। এইবার ডিমখানি ঘুরে ঘুরে দেখে। ডিমটিকে প্রদক্ষিণ করে। বিস্ময় কেটে গেলে মাতৃহৃদয় তার লজ্জা পেয়ে যায়। এত বড় ডিম সে পাড়তে পারবে না। পারবে না কোনওদিন।

সাইকেল ক্রিং চলে আসে। ওঁ হ্রীং ভট্‌চায্যি মশাই এসে গেছে। তার মানে এই বার্তা রটে গেছে ক্রমে। লোক জমে। ধনা-মনা-ঘনা ছাড়াও প্রাইমারি মাস্টার এসেছে। স্বয়ং এসেছে এ গ্রামের বিখ্যাত মেম্বার। হাতে টুথ ব্রাশ, ঠোঁটের কোনায় আহা মোলায়েম ফেনা।—কলিকাল সত্যি সত্যি এসে গেল হে…ভট্‌চায্যি মশাই বলেন। ঘোড়াতেও ডিম পাড়ছে। এবার বন্ধ্যা মাগীর অন্ধপুত্র চন্দ্র দেখতে পাবে। সবকিছু মিলে যাচ্ছে শাস্ত্রের বচন। অবাক মেম্বার বলে, বললেই হল এটা ঘোড়ারই ডিম ? টুমিও যেমন, অন্য কোনও চক্কান্ত নিশ্চই। কী বলোহে অবনী মাট্টার। ঘোড়া কি ডিম পাড়ে ? পাড়তে পারে কি কখনও ? মেম্বারের মুখে সাদা কলগেট ফেনা। প্রাইমারি মাস্টার অবনী গুছাইত মাথা চুলকায়। বলে, ঘোড়া এক চতুষ্পদী স্তন্যপায়ী মেরুদণ্ডী প্রাণী। সূচনা থেকে উপসংসাহ পর্যন্ত আটতিরিশ লাইন পুরোপরি মুখস্থই আছে। ডিম পাড়ে কি না কোথাও লেখেনি। ডিম যে পাড়ে না, এমন কথাও কিন্তু বলেনি কোথাও। এটা যে ঘোড়ারই ডিম পোমান করতে পারো ? বলেন মেম্বার। কী প্রমাণ করি আমি ? পোড়ামুখী ঘোড়ী, ডিম জন্ম দিয়ে তুই কোথায় পালালি ? ধনা-মনা-ঘনা বলে, পোমান কঠিন কী ?—ভাঙলেই হল, ভাঙলেই বেরুবে আঠা-আঠা-লাল। ভাঙলেই হল ? থুক করে ফেনা ফেলল ভিলেজ মেম্বার। সাধে কি এস সি, এস টি বলে ? ভাঙলে বিস্ফোরণ ঘটে যদি ? জাতীয় সংহতি ভাঙে যারা হতে পারে তাদেরই এ কাজ। সিনিমা এয়েছিল বৈশালী হলে, ঘোড়ার পেটেতে ঢুকে জনাকত সৈন্য নুকেছিল। ঘোড়াটা কাঠের। সিনেমার নাম ভুলে গেছি। ভাঙতে হয় যদি তার আগে ডাকব দমকল। ইনফরম করতে হবে পুলিশের কাছে। ধনা-মনা-ঘনা বলে ওঠে, তা হলে ভাঙব কেন ? ধান সিঝা যে কড়ায়ে হয়, সে কড়ায়ে চইড়ে দ্যাও ডিম, সিঝা হয়ে যাক, ভেঙে ভেঙে খাব তারপর। সে এক ভোজী হবে, বলো ? ভিলেজ মেম্বার বলে, থাম। খালি খালি খাই। পাঁচ মাথা এক করে ভাবা যাক। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যাক। তারপর সে একাই পাঁচমাথা হয়ে যায়। বলে, পুলিশে ইনফর্ম করি, রিক্স নেয়া মোটেই ভাল না।—ও বাবা পুলিশ, তা হলে তো ধরে নিয়ে যাবে, মারবে ডান্ডা। আমি ভয় পেয়ে বসে পড়ি। বলি, মা কালীর দিব্যি। চক্রান্ত কিচ্ছুটি নেই। একটি জলজ্যান্ত ঘোড়া কাল রাতে এসেছিল।—প্রমাণ রয়েছে কিছু ? ভিলেজ মেম্বার বলে। আমি বলি, প্রমাণ তো ডিমটার ভেতরেই আছে। ডিম ফুটে ঘোড়াটা বেরুক, তারপর সব কিছু সমাধান হয়ে যাবে ঠিক।—ঘোড়া কি এমনিতেই হবে ? অটোমেটিক বেরুবে কি ডিম থেকে ঘোড়া ? কী যা তা বললো, তা দেবে কে ? চিন্তা করেছ তা ? ভিলেজ মেম্বার বলল একথা। সত্যিই, তবে তো চিন্তার কথা। ও রে ভ্যাবলা, জলচৌকিটা জলদি নে আয়। বসুক মেম্বার। মাথাটা ঠান্ডা করে চিন্তা করবেন তিনি। জলচৌকির উপরে বসেন ভিলেজ মেম্বার। জাতিতে নাপিত তিনি। এদিকে ভটচায্যি মশাই দাঁড়িয়ে আছেন ঠায়, ভাবেন কলিকাল সত্যিই এসেছে। গায়ে অপমান লাগে। চলে যেতে চান তিনি। ভিলেজ মেম্বার সিগ্রেট ধরিয়ে বলে, যাও কোথা ? মন্ত্রে তন্ত্রে কিছু হবে ? ঘোড়ার ডিম ফোটানোর মন্ত্র আছে কিছু ? এই সব ব্যঙ্গোক্তি তাঁর আদৌ পছন্দ নয়। অর্বাচীন এই সভা তিনি ত্যাগ করলেন। প্রাইমারি মাস্টার বলে, কিন্তু দাদা সমস্যা রয়েছে। নম্বর ওয়ান হচ্ছে, ঘোড়াটা বেরোয় যদি স্তন খাবে কার ? রচনা বইতে পষ্ট লেখা আছে ঘোড়া এক স্তন্যপায়ী জীব। ধনা বলল, বাগদি বউ সরলা তো আছে। বছর বিউনি। দত্তদের বউগুলো বডি টাইট রাখবে বলে সরলাকে ডাকে। সরলাই মাই দেয় ওদের বাড়িতে।—কিন্তু ঘোড়ার বাচ্চা যে মানুষের স্তন খাবে এমন গ্যারান্টি আছে কিছু ? সন্দিগ্ধ মেম্বার বলে। পাঁচমাথা চুপ মেরে যায় এমন যুক্তির কাছে। নম্বর টু হল, ঘোড়াটা বেরোয় যদি, কে হবে ঘোড়ার মালিক ?

ক্যাবলাটা বলে ওঠে, আমি হব…আমি হব…। এ জন্যই ক্যাবলা নাম তোর। যা ভাগ—যা ভাগ। আমি বলি, স্যারেরা শুনুন। আমি বাপু গরিব মানুষ। ঘোড়ার মালিক হতে চাইনি কোনওদিন। আমাকে পায়নি ঘোড়া রোগে। বড়জোর শখ ছিল ঘোড়ালেবু গাছে। জাম্বুরার মতন খানিক। ওই গাছ পুঁতেছিলাম উঠোনের কোণে, মরে গেছে। সত্যি সত্যি ঘোড়া আমি চাইনি কোনওদিন। ঘোড়া যদি ফুটেই বেরোয়, আপনারা পাঁচমাথা মিলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যা করবেন, তাতেই ভোট দেব আমি।—শোনো বলি। ভিলেজ মেম্বার মৃদু হেসে বলে, ঘোড়াটা বেরুলে পরে সেটা হবে জাতীয় সম্পদ। এলাকার কাজেই লাগবে। অশ্বমেধ যজ্ঞ তো হয় না এখন, ঘোড়াটির গায়ে আমার প্রতীক চিহ্ন এঁকে অঞ্চলে ঘোরাব। তারপর ধরো, ভোটকেন্দ্রে ঘোড়া চেপে ভোট দিতে যেতে পারে জনসাধারণ। ধনা-মনা-ঘনা তালি মারে। কী ভালই না হবে।—তারপরে ধরো ভোটে জিতে গেলে ঘোড়ার ওপর চড়ে হবে প্রশেসন। কেমন। মেম্বার তার আঙুলে গুনছে পয়েন্ট। প্রাইমারি মাস্টার বলে সব নতুন নতুন পয়েন্ট। রচনা বইতে এর একটাও নেই। হেঁ হেঁ হেসে ওয়ার্ড মেম্বার ধোঁয়া ছাড়লেন। এবার গম্ভীর হলেন হঠাৎ। পালটে গেলে মুখের ভূগোল। গোল গোল রিং ছাড়লেন গোটা পাঁচ-ছয়। চিন্তাক্লিষ্ট হলে তিনি এমনই করেন। সুতরাং গোটা সভা চুপ। চুপ ধনা-মনা-ঘনা। এমনকী অনন্তবালা মুরগিটিও চুপ। চুপ ! আদালত চলছে এখানে। মেম্বার খুললেন মুখ। মূল পয়েন্ট থেকে বহুদূরে সরে গেছি সব। শোনো বলি, আমার দিকে মুখ। মানে আমায় বলছেন। আমি মনোযোগ সহকারে শুনি। ঘোড়ার মালিকানা রিফিউজ করছ তুমি তো ?— রিফিউজ মানেটা কী যেন ? মানে বলে দিলে, হ্যাঁ-হ্যাঁ, রিফিউজ।—ঠিক আছে, তা নয় করলে, ডিমটির মালিকানা তোমারই থাকছে এবং যাবতীয় রিস্‌ক ও দায়িত্ব। কিন্তু ঘোড়া হলে ফোটানোর ভারটা তোমার।

এ যে গুরুভার, বলি আমি। আমাদের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল। বললেন তিনি। এ কী আতান্তরে পড়ে গেছি আমি। ও রে মুখপুড়ি ঘোড়ী, সর্বনাশী, ওলাউঠো, ফিরে আয় মা, ডিমটির উপরে বসে তা দিয়ে যা। আমি বলি, ঘোড়াটি ফেরার। তার ফেরার কোনও নিশ্চয়তা নেই। পাশের গাঁয়ের ধোবাদের গাধাটিকে নিয়ে এলে ভাল হয়। কেননা, কোকিলের ডিমে ওম্ দিয়ে ছানা করে যাবতীয় কাক। তা ছাড়া হাসেদের ছানাপোনা অনন্তবালাই ফোটায়। সুতরাং…। এ সময়ে এসে গেল বলাই মিত্তির। সঙ্গে ছোটছেলে। লোকজন সচকিত হল। এমনকী খালি হয়ে গেল জলচৌকিটিও। বলাই মিত্তির বলে, শুনলুম ঘোড়া হচ্ছে, বেশ, বেশ কথা। বেশ হবে। চাবুক মারা যাবে বেশ। বহুদিন অকর্মণ্য পড়ে আছে বাবার চাবুক। চাবুক মারলে ঘোড়া জাতি কিচ্ছু বলে না। সব্বাই হে হে করে। বলাইবাবুর ছেলের প্যান্ট ও গেঞ্জিতে মনোহর শোভা। গেঞ্জির গায়ে কত চিত্র আলপনা। অবনী মাস্টার বলে, এসে গেছ ভালই হয়েছে। তুমি বাবা ভেটারনারি ফাইনাল দিয়েছ। জন্তু জানোয়ারের বিদ্যা জানা আছে ভাল। মুরগির ডিম ফোটে একুশ দিনেতে। ঘোড়ার ডিম কত দিনে ফোটে ?

গেঞ্জি গায়ে ছেলেটি প্রকৃতই স্মার্ট। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, হর্স আগের বার পরীক্ষায় এসে গেছে। সাজেশনে এ বছর ইমপর্টেন্ট ছিল না মোটেই। পড়িনি। তবে আর কেই-বা আছে এই গাঁয়ে ? কেইবা বলবে ঘোড়ার বদলে গাধার ওমে ডিম ফুটবে কি না ? তা ছাড়া এতদিন গাধাটাকে ছেড়ে দেবে ওরা ? গাধার কি কাজ নেই ? তবে ও ভ্যাবলার মা, তুমিই বসবে ? চেষ্টা করে যদি দ্যাখো…

এ সময়ে হৈমপিসি আসে। কোলে তার অনন্তবালাটি। অনন্তবালাকে সে ধীরে ধীরে ডিমটির উপরে বসায়। অনন্তবালা মুশকিল আসান হয়ে বসে থাকে।

অনন্তবালা মানুষ নয়, একটি মুরগির নাম। এ জীবনে বহু ডিম থেকে সে নিংড়েছে প্রাণ। ডিম ফোটানোই তার হবি। অনন্তবালা ঘোড়ার ডিমটির উপর বসে থাকে। হৈমবতী পিসি দিল উলুধ্বনি একা। অনন্তবালা কত ছোট, ছোট্টপ্রাণীটা। এতবড় ডিমে তবু সে বসেছে। রোগা রোগা বিবর্ণ পালকে তবু কিছু ইচ্ছা পুষে রাখে। বসেছে অনন্তবালা ডিমের মাঝখানে। এ পাশের ও পাশের শূন্যতাকে দেখে। ডানদিকে বাঁদিকে তার শূন্যতার সাদা। ডানদিকে সরে গেলে বাঁদিকের শূন্যতা বড় হয়, বাঁয়ে সরলে ডানের শূন্যতা। তবু বসে থাকে এ পাশে ও পাশে…জমায়েত ক্রমে সরে যায়। অনন্তবালা ক্রমে একাকিনী। ডিমটিকে নিজস্ব করে নিয়ে অনন্তবালা ওখানে রয়েছে।

শারদীয় আজকাল, ১৯৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *