১.৫ আমার মা

আমার মা বরাবর বৈষ্ণবসাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট বিদূষী। বৈষ্ণবসাহিত্য পড়বার জন্য তিনি ওড়িয়াভাষাও শিখেছেন। কাকা যখন এম এ পরীক্ষা দেন তখন মা তার সঙ্গে বাংলায় এম, এর বই সব পড়েছেন। চর্যাপদ, মঙ্গলকাব্য এসব মার আয়ত্ত। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি। আমি মাকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম—“এই লাইনটার অর্থ কি—“জনম অবধি হাম রূপ নেহারিনু, নয়ন না তিরপতি ভেল, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়া রাখনু, তবু হিয়া জুড়ন না গেল’—এই কবিতাটির বক্তব্য কি? এ তো সত্যিই লাখ লাখ যুগ হতে পারে না, কারণ অতদিন কেউই বঁচে না। তাহলে এটা অত্যুক্তি—অত্যুক্তি কি কাব্যবিচারে দোষ নয়? তাহলে তোমরা এটা এত ভালো বল কেন?”

মা হাসছিলেন—“না এটা অত্যুক্তি নয়–”

“অতুক্তি নয়!”

“কি করে বোঝাই তোকে—যা কিছুতে শেষ হতে চায় না, যে আনন্দ বা বেদনা ফুরায় —যাকে সময় দিয়ে মাপা যায় না, এ হচ্ছে তারই বর্ণনা।” আমি ঠিক বুঝতে পারলাম। অনেক ভাবতে লাগলাম-রবীন্দ্রনাথের গানে বা কবিতায় ঠিক এই কথাটা কোথায় আছে তা আমার মনে পড়ল না। লাখ লাখ যুগ অর্থাৎ অনন্তকাল। যে সুখ কোনো দিন তৃপ্ত হয় না তা ভালো কি মন্দ কে জানে? এই চির অতৃপ্তির কথাটা ভেবে আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল–

সাবির অসুখ খুব বেড়েছে। কবিরাজকাকা ওর চিকিৎসা করছেন। ও নানা রকম অদ্ভুত কথা বলে। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখিয়ে কি সব বিড়বিড় করেছে। আর ভজন গান করছে। আর মির্চাকে এক মুহূর্ত ছাড়বে না। তাকে ওর বিছানার পাশে বসে থাকতে হবে। ওর হাত ধরে থাকতে হবে। মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য ওর মাথায় তেল লাগানো হচ্ছে চুল, মাঝখান থেকে কেটে ফেলে সে তেলও মির্চাকে লাগিয়ে দিতে হবে। ভালোই হয়েছে। কারণ এজন্য মির্চা অনেক সময়ে ওপরে আমার ঘরে থাকছে, ঐ ঘরেই তো সাবির বোগশয্যা। ঘরে অনেক লোকজন ঘোরাফেরা করে, সাবির কাছে বসে থাকে। যদি আমার অসুখ করত তাহলে পারত না। সাবি কিনা ছোট তাই এটা সহজ। কিন্তু এতে আমার মন কানায় কানায় ভরে গেছে— ও যে এত আপন হয়ে গেছে, আমাদের আত্মীয়ের মত—এতে একটা অদ্ভুত সুখ পাই আমি! একদিনের কথা আমার মনে আছে, কবিরাজকাকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাকে ওষুধের বিষয় বিস্তারিত বলছেন মির্চা সাবির কথা শুনছে—আমি বেশ অনেকটা দূরে আমার খাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ও একবার আমার দিকে চেয়ে একটু হাসল—আর সেই মুহূর্তে ঠিক সেই মুহূর্তে আমার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল। আমার মেরুদণ্ড ঝিঝিন্ করতে লাগল, আমি খাটের উপর বসে পড়লাম। আমি তো জ্যেষ্ঠতাত’ তাই সব বিষয় বিশ্লেষণ করা আমার স্বভাব। এই অদ্ভুত অনুভূতিটা আমাকে প্রশ্নে প্রশ্নে ভরিয়ে ফেলল—এটা হল কি? এটা হলই বা কি করে? এটা তো শরীরের ব্যাপার, সম্পূর্ণ শরীরের ব্যাপার, কোনো সন্দেহ নেই—আত্মা-টাত্মা কিছু নেই এর মধ্যে কিন্তু সেই শরীরও তো স্পর্শিত নয়। শুধু দৃষ্টিপাতমাত্র এরকম কি হতে পারে? কাকেই বা জিজ্ঞাসা করা যায়? ওকে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে না, বেড়ে উঠবে, তাছাড়া ও জানবেই বা কি করে? ও তো ডাক্তার নয়। শরীরের ব্যাপার ডাক্তার কবিরাজরাই জানতে পারে, তবে তাদের তো আর জিজ্ঞাসা করা যায় না! ধর, যদি কবিরাজকাকাকে জিজ্ঞাসা করি, কাকা মির্চাকে দেখলে এ রকম লাগে কেন মাঝে মাঝে তাহলে কি হয়? হাঃ হাঃ হাঃ—তাহলে আর একটা খাটে শুইয়ে মাথায় মধ্যমনারায়ণ তেল দেওয়া হয়। নয়ত সোজা বহরমপুর পাগলের ফাটক।

 

আমরা ছাদে বসে কিম্বা বারান্দায় বসে প্রায়ই ছোট ছোট নাটিকাগুলি পড়ি ও আবৃত্তি করি। আমরা পড়ি অর্থ, আমি পড়ি, অন্যের। শোনে। ছোট নাটিকা অর্থাৎ ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘কর্ণকুন্তী-সংবাদ’ বা ‘বিদায়-অভিশাপ। বিদায়-অভিশাপটা আমার ভালো লাগে বেশি, কিজানি কেন? এই সভায় থাকে মীলু, গোপাল, খোকা, কাকীমা। শান্তিও থাকে, তবে সে এ সব বেশি বোঝে না। মির্চাও বোঝে না, তবু সেও মাঝে মাঝে থাকে। ছাদে বসতে সকলেরই ভালো লাগে, এটুকুই প্রকৃতিকে পাই আমরা। পড়তে পড়তে অন্ধকার হয়ে আসে, আকাশে তারাগুলো একে একে ফুটে ওঠে, তারপর গুটিগুটি একদিক থেকে অন্য দিকে চলতে থাকে। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে আসে। পাশের বাড়ির কামিনীর ঝাড়টা থেকে সুগন্ধ পাওয়া যায়। অন্ধকার হয়ে গেলেও আমার থামবার দরকার নেই, আমার তো মুখস্থ। একদিন গোপাল আমায় বললে, “তুমি এতবার করে বিদায় অভিশাপ’ পড়ছ—ভাগ্যে না ঐ রকমই ঘটে যায়।”

“অর্থাৎ? আমি ভ্রূকুটি করলাম।”

“যা হয় অর্থ বুঝে নাও।”

“তোমার ভারি আস্পর্ধা হয়েছে—যা খুশি আমায় বলতে শুরু করেছ।”

“রাগ করলে আমি নাচার। আমি তোমায় সাবধান করছিলাম রু।”

এই উপমাটা আমি আরও দু-একবার আত্মীয়স্বজনের মুখে আভাসে শুনেছি। আমার রাগ হয়েছে, ভয় হয় নি। ভয় হবে কেন? ওটা তো কাব্য এটা তো জীবন। দুটো দুই জগতের ব্যাপার। মির্চা কখনো কচের মত করবে না। দেবযানীকে কচ স্বর্গে নিয়েই বা গেল না কেন? নিতে ঠিকই পারত, শুধু তাতে গল্প হত না।

 

একদিন মির্চা আমায় বললে, “তোমাদের দেশে নতুন বিবাহিতাদের জীবন কেমন আমার জানতে ইচ্ছে করে।”

“বুঝতে পারলাম না–”

“এই যেমন তোমার কাকা ও তার পত্নী, তাদের মধ্যে তো কোন উচ্ছ্বাস দেখতে পাইনা।”

“তাদের উচ্ছ্বাস তোমাকে দেখাতে যাবে কেন?”

“আমাদের দেশে দেখা যায়—তাছাড়া আমি তো তোমার কাকীমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।”

“সে সি!” আমার খুব রাগ হয়েছে, “কাকীমার মুখের দিকে তোমার দেখবার দরকার কি! খুব বিশ্রী কথা।”

“না, না, সে কথা নয়—ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মুখে তো কোনো দাগ দেখতে পাই না।”

আমি তো অবাক–“বিয়ে হওয়া তো আর জলবসন্ত হওয়া নয়, মুখে দাগ হবে কেন?”

ও হাসছে। মুখ টিপে টিপে হাসছে—

“আমাদের দেশে হয়। কি রকম দাগ হয় তুমি দেখতে চাও?”

“হ্যাঁ—”।

ও দু হাত বাড়িয়ে আমায় ধরল। আমার মুখের উপর উষ্ণ চাপ অনুভব করলাম— তীক্ষ এবং মধুর-একটু পরে ও আমায় ছেড়ে দিল, “আয়নায় দেখ–”

আমি উঠে দেওয়ালে টাঙান ওর আয়নাটায় মুখ দেখে চমকে উঠলাম।

নিচের ঠোঁটের ঠিক মাঝখানে গোল ছোট্ট কালো একটা দাগ–স্পষ্ট এবং উগ্র। আমি তাকিয়ে আছি—ভয়ে আমার চোখ বিস্ফারিত—“কি হবে মির্চা, কি হবে?”

ও নির্বিকার মুখে একটা বই খুলে পাতা ওল্টাচ্ছে।

“মা তো বুঝতে পারবেন। পারবেন না? বল, বল মির্চা।”

“পারাই তো সম্ভব।”

“ও বাবা, তবে কি বলব মাকে, শিখিয়ে দাও!”

“তোমার মাকে তুমি কি বলবে আমি কি জানি!”

“তুমি এ রকম করলে কেন, এ্যা করলে কেন?”

নিরুপায় আমি ক্রন্দনের উপক্রম করলাম। ও একটা বই হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আমার দিকে চেয়েই বললে—“যদি কান্নাকাটি কর তাহলে আর একটা দাগ করে দেব।”

আমি সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, আমার হাত পা কাঁপছে। ভয়, ভীষণ ভয়। মৃত্যুভয়ও বোধহয় এরকম হয় না। জানি না মৃত্যুভয় কি রকম কিন্তু সেই মুহূর্তে যদি ঈশ্বর আবির্ভূত হয়ে বলতেন, তুমি এখুনি মরে যেতে চাও, না দোতলায় তোমার মার সামনে যেতে চাও, তাহলে আমি প্রথমটাই সহস্রগুণে শ্রেয় মনে করতাম। কিন্তু তা হল না। ঈশ্বর কোথায় ছিলেন জানি না, তিনি ভয়ার্ত বালিকার ডাক শুনতে পেলেন না। কিছুক্ষণ পরই মার। সামনে পড়লাম। মা তো আমায় দেখে চমকে উঠলেন। তারপর আমার দিকে স্থির তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “রু, তোমার ঠোঁটের উপর ঐ বিশ্রী দাগটা কি করে হল?”

“কোথায় দাগ?” গলা অত্যন্ত সহজ এবং নিরুত্তাপ।

“আয়নায় দেখ না–”

“ও বুঝেছি, দরজায় ধাক্কা লেগেছে।”

“কোন্ দরজায়! ওঃ কি জানি…হয়ত…হয়ত—লাইব্রেরীর দরজায়।–”

“হয়ত লাইব্রেরীর দরজায়! অতটা ব্যথা পেলে আর জানো না কোথায় ধাক্কা লাগল। রু, সত্যি কথা বল।”

“না, না, ব্যথা তো লাগে নি। ওঃ মনে পড়েছে, আমি নিজেই দাত দিয়ে চেপে ফেলেছি।”

“তাই বল। দরজার ধাক্কায় কখনো ও রকম হয়। যাও একটু ক্রিম লাগিয়ে ওটা ঢেকে রাখ।”

সরল ভালোমানুষ বিশ্বাসপরায়ণ মা নিশ্চিন্ত মনে বিশ্বাস করতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

 

আমার জন্মদিন এগিয়ে আসছে। উৎসবের আয়োজনে বাড়ি মুখর। উৎসব হবে প্রাচীন ভারতে যেভাবে জন্মতিথি পালন হত সেই নিয়ম অনুসারে। সমস্ত সাহিত্যিকরা আসবেন। বয়োবৃদ্ধ জলধর সেন সাদা পায়রা উড়িয়ে দেবেন—পায়রা উড়বে, বদ্ধ জীব মুক্ত হবে। উৎসবের আয়োজন চলছে। এদিকে সাবির অসুখ বাড়ছে। আবোল-তাবোল কথা বলে, ওর অশান্ত মনের পক্ষে সেগুলো হয়ত আবোল-তাবোল নয় কিন্তু সে কথা মেলাচ্ছে কে? অভিভাবকরা নিজেদের খুশিমতো কাজ করেন, ছেলেমেয়েদের মনের খবরও যে রাখতে হবে, সে দিকে খেয়ালই নেই তাদের। তারা মনে করেন, যেমনটি হওয়া উচিত অর্থাৎ যা হলে সব নিরুপদ্রব হয় তেমনটি আপনিই হয়ে যাবে। সাবি এত অসুস্থ তা সত্ত্বেও উৎসবের আয়োজন পুরোদমে চলছে। ওর প্রতি অবহেলা হচ্ছে নিশ্চয়ই তাই ও অধীর কিন্তু অধৈর্য ও আপত্তি আর কি করে প্রকাশ করে বেচারা! এই রোগের মূল বীজাণু একটি ছোট্ট তীক্ষ্ণমুখ বিষাক্ত আশঙ্কা, ‘দিদিকে সবাই ভালোবাসে আমাকে কেউ বাসে না।

আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও মৃদু গুঞ্জন, নরেনবাবু মেয়েকে নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন। এতে ওর মাথা ঘুরে যাবে। আমার বন্ধুরাও আশঙ্কিত যে আমি তাদের থেকে যেন পৃথক হয়ে যাচ্ছি। এমন কি মির্চাও, যে ধরেই নিয়েছে আমার মা-বাবা ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবার জন্য উৎসুক এবং সময়মতো ওরাই ওকে বলবেন, সেও আমাকে সেদিন হঠাৎ বললে, যদি তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে নাও হয় আমি তোমায় তিনবার দেখতে চাই। একবার তুমি মা হবার পর, একবার যখন তুমি খুব বৃদ্ধা আর একবার তোমার মৃত্যুশয্যায়। খুবই রাগ হয়েছে আমার একথা শুনে। আমি জানি এটা কবিত্ব করে বলা, আমিও তো অনেক কবিত্ব করে কথা বলি, শব্দার্থেই যার অর্থ নেই। কিন্তু এর মর্মার্থই বা কি? বুদ্ধদেব যে রকম জরা মৃত্যু দেখেছিলেন উনিও সেই রকম দেখবেন। মজা মন্দ নয়।

 

জন্মদিনের দিন বাংলাদেশের সমস্ত খ্যাতনামা সাহিত্যিকরা এসেছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ আসেন নি, কেন আসেন নি তা আমার মনে নেই—সম্ভবতঃ এখানে ছিলেন না। কিন্তু তিনি আমাদের বাড়িতে যে কখনো আসেন নি, তা নয়। বেশ কয়েকবার এসেছেন, এই বাড়িতেই এসেছিলেন কিছুদিন আগে, হঠাৎ একটা দুপুরবেলায় খবর না দিয়ে। আমি তখন উঠোনের সিঁড়িতে বসে উচ্চৈঃস্বরে কবিতা আবৃত্তি করছি, দুঃখের বিষয় সেটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা নয়—সম্ভবতঃ অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ‘অমাবস্যা বলে একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল তাই থেকে বলছি, এমন সময় একজন লোক গলির দিকের আধখানা দোলান দরজা ফাক করে বললে “রবিবাবু এসেছেন?” তখন তাকে সবাই রবিবাবু বলত, যদিও আমি এ বইতে তাকে সে নামে উল্লেখ করি নি—আমি কিয়ৎক্ষণ তার কথাটাই বুঝতে পারি নি। এত অপ্রত্যাশিত এ ঘটনা। তারপর সামলে নিয়ে দরজা খুলে দেখি মির্চার ঘরের সামনে গলির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন—“নিরঞ্জন আনন্দ মূরতি সোজা দীর্ঘদেহ, চশমা থেকে কালো ফিতে ঝুলছে, ঐ চশমার নাম প্যানে-কানের উপর উঁটি নেই। কেঁাচান ধুতি মাটি ছুঁয়ে আছে। এ যেন স্বর্গ থেকে সহসা কোনো দেবতা আমাদের এই বাড়ির মাঝখানে আবির্ভূত হয়েছেন। আমার অবস্থা দেখে তিনি হেসে বললেন, “বিশু ডাকাতের মতো খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল নাকি?” আমি ভাবছি ভাগ্যিস আমরা সব বাড়ি আছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উনি বললেন—“এসেছিলুম রামানন্দবাবুর বাড়িতে, উনি বললেন তোমরা কাছেই থাক তাই ভাবলুম, তোমায় একবার দেখে যাই। তারই লোক পথ দেখিয়ে এনেছে।”

রামানন্দবাবু কাছেই থাকতেন টাউনসেণ্ড রোডে। রোজ সকালবেলা তিনি প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে লাঠি হাতে ধীরে ধীরে হেঁটে আমাদের বাড়ি আসতেন। আমাদের বাড়িতে সকালের চায়ের টেবিলে কিছুক্ষণের জন্য তার উপস্থিতি একেবারে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তিনি অবশ্য চা খেতেন না। খেতেন এক গ্লাস দুধ। যত দূর মনে পড়ে, ঐরকম সময়ই একটা ঘটনা নিয়ে তিনি খুব উত্তেজিত ছিলেন। একজন বিখ্যাত পণ্ডিত তার নিজের বইয়ের মধ্যে তাঁর ছাত্রের গবেষণার বিষয়টি অর্থাৎ ঐ ছাত্রের রচনা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এ কথা নিয়ে তখন দেশ জুড়ে তোলপাড় চলছিল। রামানন্দবাবু দুর্বল পক্ষের সহায় হয়েছিলেন, তাঁর মতে বেচারা ছাত্রটির হয়ে বলবার কেউ নেই—বাবার সঙ্গে এ বিষয়ে তার আলোচনা হত।

টাউনসেণ্ড রোড রামানন্দবাবুর বাড়িতে সেদিন দুপুরে কবি এসেছিলেন শেষের কবিতার পাণ্ডুলিপি নিয়ে। প্রবাসী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সব রচনা চিরকাল প্রকাশিত হয় শুধু নয়, ঐ পত্রিকা তাকে ধারণ করে আছে সব রকমে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় যেন বিরাট পক্ষ বিস্তার করে তাকে রক্ষা করছেন। পক্ষী মাতা যেমন করে তার শাবককে রক্ষা করে। উপমাটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে। রামানন্দ কি করে রবীন্দ্রনাথকে রক্ষা করবেন, তিনি কি এর চেয়ে বড়? তা নয়। তবে রক্ষা করবার শক্তি তাঁর আছে—তাঁর হাতে ভারতের শ্রেষ্ঠ পত্রিকা, যে পত্রিকা শুধু সাহিত্যের জন্য নয়, নির্ভীক সাংবাদিকতা, সততা, সব কিছু নিয়ে বিশেষ সম্মানযোগ্য এবং প্রচারও যার সর্বাধিক। ওর চেয়ে বহুগুণে প্রচারসংখ্যা বেশি এমন তো কত পত্রিকা আজকাল আছে কিন্তু অত শ্রদ্ধার সঙ্গে কোনো পত্রিকার নাম আজ কেউ করবে না। তখনকার দিনে আরো যে দুটি বড় পত্রিকা ছিল বসুমতী’ ও ‘ভারতবর্ষ এ দুটোর কোনোটাতেই আমার যতদূর মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একটি লেখাও প্রকাশিত হয়নি। কারণ রবীন্দ্রকাব্যের মেজাজের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বিরোধী পত্রিকার সংখ্যাও কম নয়। হয়ত তারাই সংখ্যাগুরু, নিন্দমুখর এই দেশের ঈর্ষাজর্জর ছোটবড় প্রত্যেকটি লোকের সঙ্গে অবিশ্রান্তভাবে লড়াই করেছেন রামানন্দ। তার তীক্ষ্ণ নিপুণ পরিহাস-উজ্জ্বল ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’-এ রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কাজের সমর্থন ও বিপক্ষের প্রতি যুক্তিশানিত বিদ্রুপবাণ নিক্ষিপ্ত হয়েছে। যদি কেউ বলেন এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল? তা ছিল। রামানন্দের সহায়তা না পেলে নিন্দার কুশাঙ্কুরে রবীন্দ্রনাথের কোমল মন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত।

আমি রামানন্দের সঙ্গে এক বিশেষ আত্মিক যোগ অনুভব করতাম। উনিও কবিকে আমারই মতন ভালোবাসেন। অতএব রামানন্দেরও নিশ্চয় কখনো কখনো ঈর্ষা করবারও অধিকার ছিল। কাজেই যখন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা আধুনিক সজ্জায় অলঙ্কৃত হয়ে, রবীন্দ্রনাথের দুটি বৃহৎ রচনা ‘ঋতুরঙ্গ’ ও ‘তিন পুরুষ’-এ সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশ পেতে লাগল তখন তিনি যে একটু ক্ষুন্ন হবেন এ আর আশ্চর্য কি। তাই সেদিন রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে ‘শেষের কবিতা’র পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসেছিলেন প্রবাসী সম্পাদকের মান ভাঙ্গাতে। ফলে আমারই লাভ হয়ে গেল—এরকম অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবের চেয়ে আর কি সুখকর ঘটনা ঘটতে পারে?

আমার জন্মদিনের উৎসবে ঐ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকা সম্পাদক উপেন গঙ্গোপাধ্যায়ও এসেছিলেন। তিনিও প্রায়ই আসতেন, ভারি মিষ্টভাষী মানুষ। রামানন্দবাবুর মত উপেন গঙ্গোপাধ্যায়ও বালিকার রচনা পকেটে করে নিয়ে যেতেন। আমাদের সে সময়ে সাহিত্যের ক্ষেত্রে এত ভীড় ঠেলাঠেলি ছিল না। সম্পাদকের পছন্দ হলেই লেখা প্রকাশিত হত এবং পছন্দটা নির্ভর করত লেখার উপরে, লেখকের ঠিকুজীকুষ্ঠির উপরে নয়।

সেদিন জন্মোৎসবে যারা যারা এসেছিলেন সকলের কথা লিখতে গেলে এ মহাভারত হয়ে যাবে। শ্রদ্ধেয়া কামিনী রায়ের তখন কবিখ্যাতি দেশজোড়া—তাছাড়া আরো একটা কারণে আমরা মেয়েরা তার প্রতি সমবেদনা অনুভব করতাম। আমরা শুনতাম জগদীশচন্দ্র বসুকে তিনি ভালোবাসতেন, জগদীশচন্দ্রও বাসতেন।

এদের বিবাহ ঠিক ছিল, হল না। শুনেছি এই বিরহের ফলশ্রুতি ‘আলোছায়া’ কবিতার বই। আর চিরকুমার পি. সি. রায় চিরকুমার রইলেন যাকে ভালোবেসে তিনিও এই কামিনী রায়। বিরাট পুরুষদের শ্রদ্ধা ও প্রীতি পাবার যোগ্য ছিলেন রমণীয়া কামিনী রায়।

সেদিন আমাদের বাড়িতে কামিনী রায়কে একজন নবীনা মহিলা কবি হঠাৎ বলে বসলেন যে তাঁরা পুরানো হয়ে গেছেন, এখনকার যুগে তাদের লেখা গ্রহণযোগ্য নয়। কামিনী রায় অন্তরের জ্যোতিতে জ্যোতিষ্মতী, ও অপমানে একটু বিচলিত হলেন না—স্নিগ্ধ মুখে চুপ করে রইলেন। আমার মার খুব খারাপ লেগেছিল এই দাম্ভিকতা। মা বললেন, “কামিনী রায় পুরনো হয়ে গেছেন, ইনি যেন আর কোনদিনও পুরনো হবেন না। পুরনো হলেই কি দাম কমে গেল নাকি! রবিবাবু যা বলেন, “নূতন গোফ গজালে যেমন বার বার আয়নায় মুখ দেখে, এরা তেমনি সর্বক্ষণ অদৃশ্য গোফে তা দিচ্ছে!” এই পুরনো হয়ে যাওয়া কথাটা আমারও কোনো দিন ভালো লাগে না…কি পুরনো হয়? মানুষ? না তার ভাব? সত্তার যে অংশ অমর সেইখানেই তো সাহিত্যের জন্ম। কাজেই একদিন যা ভালো ছিল, যদি সত্যিই ভালো হয়ে থাকে অন্য দিনে কি তা নষ্ট হয়? আর বিচারই বা করে কে? বিচারকও তো কোন অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড হতে করে বসে নেই। শরৎচন্দ্রকে সেই আমি প্রথম দেখলাম…প্রথম ও শেষ কারণ তাকে আর আমি দেখি নি। যদিও তার প্রায় সমস্ত রচনাই আমি তখন সাগ্রহে গিলে ফেলেছি। “বিপ্রদাস আমাকে তার প্রতি বিমুখ করেছে। বিচিত্রাতে ‘বিপ্রদাস’ বেরুচ্ছে। আমি সেই অল্প বয়সেই ভেবেছি যিনি ‘পল্লীসমাজ’ লিখেছেন তিনি ‘বিপ্রদাস’ লিখছেন কেন? বিপ্রদাস যে খাওয়া ছোঁয়া নিয়ে হিন্দু কুসংস্কার মানছেন, লেখক তো তার সমর্থন করেছেন। বিপ্রদাস যদিও যোগাযোগের বিপ্রদাসের মত করেই কথা বলে তবু তার কথাগুলি নিরর্থক। যদি তা গোরার অনুরূপ হয়ও তবু গোরার লেখক গোরাকে দিয়ে গোড়ামীর সমর্থনে যত কথাই বলুন তিনি নিজে তো তা সমর্থন করেন না…গোরাকে সাহেব বানিয়ে তিনি সমস্ত হিন্দুয়ানী ও গোড়ামীর মূলোচ্ছেদ করেছেন। আর শরৎচন্দ্রের বিপ্রদাস, এর হাতে খাব না, ও ছুঁয়ে দিলে হবে না–ইত্যাদি করে কোন্ সত্যে উত্তীর্ণ হচ্ছেন? কিন্তু তাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস আমার সেদিন হয় নি।

কবি প্রিয়ংবদা দেবী তার ছোট ছোট মাপের কবিতার বইগুলি সব আমায় দিয়েছিলেন। তাকে তো খুব কাছ থেকে দেখেছি। অমন স্নেহপ্রবণ মধুরভাব বিদূষী আজকাল তো দেখি না। কেউ হয়তো জানে না, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহের প্রস্তাব হয়েছিল—রবীন্দ্রনাথের পত্নীবিয়োগের পর। মহর্ষিদেবও ইচ্ছা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ করেন নি। শুনেছি প্রসিদ্ধ জাপানী শিল্পী ওকাকুরা তাঁকে ভালোবেসেছিলেন—একটা ছবিও এঁকেছিলেন! এসব কথা আভাসে শুনতাম—মধুর সুখস্পর্শ কাহিনী—এঁরা কেউ এদের জীবন লিখে গেলেন না, আমরা ভালো করে কিছু জানতে পারলাম না। কোন কোন মানুষের জীবনই তো দীপ যা অন্যের পথে আলো ফেলে। পৃথিবীকে চিনতে শেখায়।

প্রিয়ংবদাদেবীর কথা মনে পড়লে একসঙ্গে অনেকগুলি নারীমূর্তি মনে আসে—এঁরা সকলেই বিদগ্ধা ও বহুগুণসম্পন্না—এবং প্রত্যেকেরই নানা বৈশিষ্ট্য—সরলা দেবী, হিরন্ময়ী দেবী, প্রিয়ংবদা দেবী, ইন্দিরা দেবী—সমস্ত নাম উল্লেখযোগ্য, সভাসমিতিতে এদের পাশাপাশি দেখতে আমাদের চোখ অভ্যস্ত ছিল—সকলেরই ব্রাহ্মিকা করে শাড়ি পরা, হাতে জাপানী পাখা—আভিজাত্যের প্রতিমূর্তি। সরলা দেবী শুনেছি খবু কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার কাছে আমি যে স্নেহ পেয়েছি তাতে আমার সে কথা সমর্থন করতে ইচ্ছে হয় না। বস্তুতঃ ঠাকুরবাড়ির সম্পর্কিত প্রত্যেককেই আমার খুব ভালো লাগত, কাজেই আমার তাদের সম্বন্ধে মতামত পক্ষপাত-দোষে দুষ্ট। অনুরূপা দেবীকে খুব কাছ থেকে আমি দেখি নি, তিনি এ সমাজের মানুষ নন।

কান্তিচন্দ্র ঘোষের গোফ ছিল কিন্তু তিনি তা দিচ্ছিলেন না। যদিও ওমর খৈয়ামের রুবায়েৎ-এর অনুবাদ করে তখন তিনি বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছেন তিনি সুন্দর আবৃত্তি করতেন—’Oh! take the cash and let the credit gonor heed the rumbling of the distant drum’—কথাটা সেদিন বড় সত্য ছিল—ভবিষ্যতের কোনো বিভীষিকা সেদিন আমি দেখতে পাইনি—আমার দুই হাত cash-এ পূর্ণ—নগদ মূল্যে ভরা, মোহর বাজছে ঝম্‌ঝম্‌।

এখনকার সঙ্গে একটা তুলনা আমার মনে আসে, এখন যারা ইনটেলেকচুয়াল বলে খ্যাত তাদের উন্নাসিকতা মনে হয় অনেক বেশী। অল্পবয়সী ছেলেরাও কেউ অমুক কাগজে লিখছে, কেউ অমুক প্রাইজ পেয়েছে, ব্যাস তাদের সামনে এ বয়সেও ভয়ে আমরা মাথা তুলতে পারি না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় তবে তারা ব্যতিক্রমই। আমি তো আজ রীতিমত হীনমন্যতা রোগে ভুগি কারণ পুরনো হয়ে গেছি। কিন্তু সেদিন এইসব প্রসিদ্ধ সাহিত্যিকরা যারা জ্ঞানে গুণে বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়, তাঁদের ব্যবহারে এতটুকু অবজ্ঞা দেখতে পাই নি। আমার বাবা যে এইটুকু একটা মেয়েকে নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করেছেন তাতেও কেউ তাচ্ছিল্যের ভাব দেখাচ্ছেন না তারা খুব খুশি তুষ্ট ও তৃপ্ত। তারা আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন যেন সহযাত্রীকে গাড়িতে তুলে নিলেন। ১৯৩০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর আমি হঠাৎ কামিনী রায়, প্রিয়ংবদা দেবী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, জলধর সেন প্রভৃতির কটেম্পরারি হয়ে গেলাম।

উদয়শঙ্করকে নিয়ে তো আমরা মনে মনে মেতেছিলাম, বাবা তাকেও নিয়ে এলেন। তার সঙ্গে একটু একলা কথা বলবার ইচ্ছায় দোতলার বারান্দায় আলাদা করে ‘চা’ দিলাম। বাড়ি তখন লোকারণ্য। আমি গল্প করবার চেষ্টা করছি, মির্চা কোচাটি সামলিয়ে সেখানে এল, ওতো আমার চেয়েও ভক্ত, তা ও কথা বলুক না। আমি কি বারণ করেছি, ইচ্ছে করলে ওর নিচের ঘরেও নিয়ে যেতে পারে, একলা কথা বলতে যদি চায়, আমার কোন আপত্তি নেই। তা নয়, একপাক ঘুরে বিমর্ষমুখে চলে গেল।

সত্যি বলতে কি কাছ থেকে তাকে দেখে আমি একটু নিরাশ হলাম। কারণ কথা বলা তো আর তার শিল্পের মাধ্যম নয়, যে মানুষটিকে স্টেজের উপরে কখনো পর্বতচূড়া কখনো সমুদ্রের ঢেউ মনে হয়েছিল সে হঠাৎ মানুষ হয়ে গেল!

 

আমার আগে সকলে একসঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে যেতাম দূরে দূরে, বাবার চোখের অসুখের পর বাবা আর যেতে পারেন না—তাই আমরা অর্থাৎ আমি, সাবি, ছোট দুটি ভাই, শান্তি, মির্চা আমরা লেকে বেড়াতে যেতাম। তখন ঢাকুরিয়া লেক সবে কাটা হয়েছে বা হচ্ছে। বড় লেকটার সাজান গোছান শেষ হয়েছে, ওপাশের ছোট লেকটা কাটা হচ্ছে। তখন সেখানে এত জনসমাগম হত না। কলকাতাতে লোক এর এক চতুর্থাংশ ছিল কিনা সন্দেহ, সাদার্ন এভিন্যু দিয়ে হয়ত ঘণ্টায় দু-তিন খানার বেশী গাড়ি চলত না।

বেড়াতে যাবার সময় মির্চা রোজই ধুতি পাঞ্জাবী ও চটি পরে নিত, ও যেন বাড়িরই একজনবাড়ির অল্পবয়সীরা মোটামুটি সকলেই আমাদের ব্যাপারটা জানত—কেউ কিছু বলত না। শান্তি তো বরং বেশ সুযোগ করে দিত বাচ্চাদের নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে চলে গিয়ে।

জন্মদিনের উৎসব আয়োজনের মধ্যে ও একটু দূরে চলে গিয়েছিল, আবার আমাদের আগের মত ভাব হয়ে গেল। ক্রমেই এমন অবস্থা হচ্ছে যে আমরা একজন আর একজনকে ছেড়ে একটুও থাকতে পারি না। অথচ থাকতে হয়। তাই সর্বদা দুঃখ এবং সুখ পাশাপাশি মেশামেশি করে মনকে ব্যাকুল করে রাখে—ও বলছে কয়েক দিনের জন্য ও দেশে ঘুরে আসবে, তাহলেই বা কি হবে। ভবিষ্যতের চিন্তা করবার বয়স আমার নয়। আমাদের যে বিয়ে হবে না সেটা মোটামুটি আমি জানি। কিন্তু ওকে ছেড়ে থাকতে পারব না তাও জানি,

তবু এ দুয়ের মধ্যে যে সামঞ্জস্য করা দরকার তা আমার মনেও আসে না, চেষ্টাও করি না।

একদিন হঠাৎ ঝড় উঠে বৃষ্টি নেমেছে। আমি দুপুরবেলা নিচে নেমে এসেছি—ভাবছি উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজব, ও বললে—“অমৃতা এদিকে এস।”

আমরা ওর ঘরের সামনের দিকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, ও চৌকাঠে হেলান দিয়ে ছিল, দু হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিল।

“কেন তুমি আমার হাতটা সরিয়ে দিচ্ছ অমৃতা?”

“আমার ভয় করে।”

“ভয়, না ঈর্ষা?”

“ঈর্ষা আবার কাকে?”

“তোমার নিজেকে কি তুমি ঈর্ষা কর? তোমার শরীরকে কি তুমি ঈর্ষা কর? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার চেয়ে তোমার শরীরটাকে বেশি ভালোবাসছি? তা নয় অমৃতা তা নয়, আমি তোমাকেই খুঁজছি তোমার আত্মাকে খুঁজছি। তুমি তো তোমার শরীরেই আছ, যে তোমাকে চোখে দেখা যায় না হাতে হেঁয়া যায় না সেই দেহের অতীত তোমার সত্তাকেই আমি পাচ্ছি তোমাকে স্পর্শ করে।” ও আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।

“আমি বুঝতে পারি না মির্চা, বুঝতে পারি না।”

 

১৯৩০ সালের কাহিনী শেষ হয়ে এল। আমার দুর্ধর্ষ তত্ত্বজ্ঞানী পিতা ও অভিজ্ঞ মাতা এই দুই তরুণ তরুণীর প্রণয়লীলার কোনো খবরই রাখেন না। কোনো সন্দেহ তাঁদের হয় নি, তারা খবর পেলেন এগার বছরের একটা মেয়ের কাছ থেকে।

সাবির অসুখের কোনো স্থিরতা নেই, ওর মেজাজ অনুসারে তা কমে বাড়ে। যখন মনোযোগ আকর্ষণের সময় হয় তখন ওলট পালট কথা বেড়ে ওঠে। সেদিন আমরা সকলে অর্থাৎ ভাইবোনদের নিয়ে লেকে বেড়াচ্ছি, ওরা ছুটোছুটি খেলছে। আমরা দুজনে একটা ঝোপের পাশে বসে আছি নূতন লেকটার উত্তর দিকে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। লোকজন বিশেষ কেউ নেই। আমার মনে পড়ে না শান্তি আমাদের সঙ্গে সেদিন ছিল কিনা। আমরা দুজনে কাছাকাছি বসে আছি, নীরব অন্ধকার মাখান আকাশ আমাদের ঘিরে আছে, সামনের তরঙ্গহীন নিথর জলে পিছনের বাতির আলোতে আমাদের যুগল ছায়া দীর্ঘীকৃত। চারিদিক নিস্তব্ধ, আমার মনও শান্ত। এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে আমি আবিষ্ট। ও কিন্তু চঞ্চল, অস্থির, ধৈর্যহারা হঠাৎ ও আমার উরু স্পর্শ করল।

“না না মির্চা না!”

“কেন না? তুমি আমার হবে না? আমাকে তোমার ভালো লাগছে না?”

“হবে না মির্চা হবে না। ওরা কখনো রাজি হবেন না।”

“সে কি, ওরা তো তোমায় আমাকে দিয়েই দিয়েছেন।”

বেচারা ও একেবারে আমাদের বুঝতে পারে না। আমাদের সংস্কার ধর্ম আচার ব্যবহার ও যতই শুনুক বুঝতে পারে না। ও আমাকেও বুঝতে পারে না।

“ছেড়ে দাও মির্চা আমার ভয় করছে।”

“কখনই তোমাকে ছাড়ব না। কখনই না, এ জীবনে নয়।”

এমন সময় হঠাৎ একটা চেঁচামেচি, কে যেন ডাকল, আমরা ছুটে গিয়ে দেখি সাবি মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে, চিৎকার করে আবোল-তাবোল বকছে। মির্চা তাকে তুলে এনে বড় লেকের পাশে একটা বেঞ্চিতে শুইয়ে দিল। আমি ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে চাঁদ উঠছে, চাঁদের ছায়া পড়েছে লেকের জলে। সাবি ছটফট করছে “ইউক্লিডদা তুমি আমার কাছে বস। আমাকে একটু আদর কর।” মির্চা এগিয়ে এল “কি কষ্ট হচ্ছে তোমার, কি কষ্ট হচ্ছে?” সে ওর কপালের উপর একটা ছোট্ট চুমো খেল। সাবি বলছে, “এবার দিদিকে আদর কর, কর, কর” ও উন্মত্তের মতো হয়ে উঠেছে। “আঃ সাবি চুপ কর, কি পাগলামি হচ্ছে।” আমি যত থামাতে চাই ও বার বার জেদ করছে, মির্চাও এ সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। “আচ্ছা আচ্ছা করছি” এই বলে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল। কিন্তু সাবি সেই মুহূর্তে আবার চিৎকার করতে লাগল “কি করেছ তুমি দিদিকে, কি করেছ।” যত বোঝাই কিচ্ছু না কোথায় কি, এই তো মির্চা তোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে তা সে থামবেই না। অনেকক্ষণ গল্প করে ওকে থামাচ্ছি ভোলাচ্ছি—আর আমার বুকের ভেতর কাপতে শুরু করেছে। প্রেমের অমৃতকে ছাপিয়ে ভয়ের বিষ আমার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে গেছে, আমাকে বিষধর ছোবল মেরেছে। আমরা গাড়িতে উঠলাম। মির্চার কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। ও কল্পনাও করতে পারে নি কি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে।।

বাড়ি এসে পৌঁছলাম। সাবি গাড়িতে চুপ করে ছিল। আমি ভাবছি ও হয় ভুলেই গেছে। অসুস্থ তো। মির্চা গাড়ি থেকে নেমে নিচের ঘরে চলে গেল…আমি উপরে।

এদিক থেকে, ওদিক থেকে বাবা মার গলা পাচ্ছি আর আমার বুকের ভিতর কেঁপে কেঁপে উঠছে। পরে যখন এ সময়ের কথা ভেবেছি, তখন মনে হয়েছে সেদিনের আনন্দের সঙ্গে ভয় কি ওতঃপ্রোত হয়েই না মিশে ছিল, এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ে নি, সত্যিই কি আশ্চর্য চোখ রাঙানো ভয়-দেখানো সমাজে আমরা বাস করতুম।।

ঘণ্টাখানেকও হবে না মা এসে আমার ঘরে ঢুকলেন, “রু ছাতে চল।” মার মুখ গম্ভীর, গলা কাঁপছে। আমরা ছাদে এলাম, তারা ভরা ঠাণ্ডা রাত—আমার এখন আর তত ভয়। নেই। পারব, আমি হয়ত মার সঙ্গে কথা বলতে পারব।

“সাবির কাছে এ-সব কি শুনলাম রু? আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না।”

ছাদে একটা বড় তক্তপোষ আছে, মা তার উপর বসেছেন—দুহাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে। মার চুল খোলা পড়ে আছে, মুখের উপর চাদের আলো পড়েছে। মাকে দেবতার মত দেখাচ্ছে। মার বয়সই বা কত? আমার চেয়ে মাত্র মোল বছরের বড়। আমরা আস্তে আস্তে বন্ধুর মত হয়ে উঠছি।

মা বললেন, “সব আমাকে খুলে বল।”

আমি খাটের উপর উপুড় হয়ে মার পায়ের উপর মাথা রাখলাম—“মা মা মা”

“বল রু বল, তুমি ওকে কি বিয়ে করতে চাও?”

গুরুত্বপূর্ণ সময়েও আমার অনেক সময় লঘু কথা মনে পড়ত—আমি ভাবছি এবার তো আমার নিজ মুখে বলতে হবে যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই, কি লজ্জার কথা! ছোটবেলার ঘটনার মত হবে। ছোট থেকে শুনে আসছি বিয়ের কথাটাই খুব লজ্জার ব্যাপার, যার বিয়ে সে কোনো কথা বলতে পারে না। মাথা নিচু করে থাকে লজ্জায়। আমি ভাবতুম বিয়ের কথাতেই যখন এত লজ্জা তখন বিয়েটা করে কি করে, লজ্জায় মরে যায় না কেন? তারপর ঠাকুমার সঙ্গে এক বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সারাদিন ছিলামকনে খুব চটপটে—নিজেই সবাইকে বসাচ্ছে, আপ্যায়ন করছে, আলমারী খুলে গয়না দেখাচ্ছে, লজ্জার চিহ্নমাত্র দেখলুম না। ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ঠাকুমা, কনের তো লজ্জা করছে না?” ঠাকুমাও খুব বিরক্ত, “বেলজ্জা বেহায়া মেয়েমানুষ” আজ? আজ ঠাকুমা থাকলে?

মা বলছেন, “বল রু বল সত্যি তুমি চাও কিনা। যদি তুমি চাও তাহলে ওরই সঙ্গে নিশ্চয় তোমার বিয়ে দেব। আমি আমার মেয়েকে মনে মনেও দ্বিচারিণী হতে দেব না।” আমি মার পায়ে মাথা রেখে বললুম, “হ্যাঁ মা আমি চাই, চাই আমি। ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।”

“তাই নাকি?” মা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, “আচ্ছা তাই হবে।” আমি অনেকক্ষণ মার কোলে শুয়ে রইলাম, আকাশের নিচে রাত্রের শীতল স্পর্শ মার স্নেহের মতই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমার মন শান্ত, শান্ত। চারদিক কী নীরব প্রগাঢ় শান্তি। আমরা এত দিনের এত আশঙ্কা ধুয়ে মুছে গেল এক মুহূর্তে। আমার অনেক আগেই মাকে বলা উচিত ছিল। আমি মাকে সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছিলাম। মা তো একবারও বললেন না ওকে ভালোবাসা আমার পাপ হয়েছে। আর সাবি যদি সবটা বলেও থাকে তাও তো কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ পরে মা বললেন, “তুই তোর ঘরে চলে যা রু। আজ আর নিচে যাসনে। আমি তোর ঘরে খাবার নিয়ে আসব।”

 

সে রাত্রে ওর সঙ্গে আর দেখা হল না। ও সেদিন পিয়ানোও বাজাল না। নিচে পিয়ানো বাজালে আমি মনে এবং শরীরেও অর্থাৎ আমার চেতনার পর্বে পর্বে মিলনের গভীর আনন্দ অনুভব করতাম। একেক দিন আমার মনে হত—ওর সঙ্গে যদি আমার দেখা নাও হয়—শুধু সুরের মধ্যে ওর অস্তিত্বের খবর ভেসে আসে সেও যথেষ্ট। সেদিন রাতে কেবল মনে হতে লাগল ওকে আমি এত ভয়ের কথা বলেছি কিন্তু আজ বলতে পারলাম না। ভয় নাহি ভয় নাহি। কাল সকালে মা হয়ত ওকে প্রথম বলবেন। বিনিদ্র চোখে অনেক রাত অবধি আমি বিবাহরাত্রির উৎসবের দিবাস্বপ্ন দেখতে লাগলাম। আমি ওকে দেখছি আলপনা দেওয়া পিড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে—গরদের ধুতি চাদর পরে—চন্দনচর্চিত নীল কলেবর, পীত বসনে বনমালী, নীল কলেবর যতই ভালো হোক তার চেয়ে শ্বেত কলেবরই বেশী ভালো। ওকে কি যজ্ঞােপবীত রান হবে? নাঃ, তা কি করে হবে? আর শুভদৃষ্টির সময়? যখন চাদরটা মাথার উপর দিয়ে দেবে আমাদের তখন শ্ৰীমতী মালবিকা অর্থাৎ মালাদেবী যিনি হিংসায় মরে যাবেন বা এখনই যাচ্ছেন কারণ তিনি ইতিমধ্যে একবার ঠোঁট বাকিয়ে আমাকে বলেছেন, কচ ও দেবযানী অভিনয় কেমন চলছে? তিনি বললেন, এচোড়ে পাকা মেয়েটি তো শুভদৃষ্টি আগেই সেরে নিয়েছে। আর রানু, আমার স্কুলের বন্ধু রানু, সে বিস্ফারিত চোখে আমায় বলবে, “তুই শেষ পর্যন্ত লভম্যারেজ করলি, তোর তো খুব সাহস!”

সকলের কথা আমার মনে পড়ছে—মীলু কি বলবে, দিদিমা কি বলবেন, আরাধনা? আমার মনে হচ্ছে সকলেই খুশি হবে। কেউ-ই আমাকে নিন্দে করবে না। সব ছাপিয়ে নিচে ওর ঘুমন্ত মুখটা চোখে ভেসে উঠছে, বেচারা এখনও কিছু জানে না ওর ইচ্ছা পূর্ণ হবে। ও আমাকে এত করে চায়, আমরা কখনো চার-পাঁচ মিনিটের বেশী কাছাকাছি হতেই পারি না, এখন? তোমাতে করিব বাস দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস। কিন্তু বাবা মাকে ছেড়ে থাকতে পারব ত? তা থাকতে হবেই বা কেন, ও তো এখানেই থাকবে বলেছে। বাঃ, ও যাই বলুক ওদের দেশেও যেতে হবে নিশ্চয়ই, ওর মাকে আমি দেখব না? ওর বোনকে? ওর দেশে যাবার কথায় আমার প্রিনসেপ ঘাটের কথা মনে পড়ল—একবার রবীন্দ্রনাথ বিলেতে যাবেন, তাকে বিদায় অভিনন্দন, যাকে বলা হত ‘সী অফ করার জন্য আমরা গিয়েছিলাম, সে দিনের কথাটা মনে এল, কী রকম প্রকাণ্ড জাহাজ! এবার ভয়-টয় কেটে গেছে, লজ্জা, দারুণ লজ্জায় আমার কান ঝা ঝা করছে—তাকে তো বলতে হবে, কে বলবে? আমিই বলব। কখন? যখন উনি কলকাতায় আসবেন! প্রায় এক বছর উনি বিদেশে।

রাত্রি গভীর হচ্ছে, আধো ঘুমে আধো জায়ায় আমি স্ট্র্যাথেয়ার্ড জাহাজটাকে দেখতে পাচ্ছি, দু’ধারে তটরেখার ভিতর দিয়ে সরু জলপথে এগিয়ে চলেছে দুলে দুলে— এটা সুয়েজ ক্যানাল—ওধারে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশি, সেদিকে যেতে যেতে জাহাজটা ময়ূরপঙ্খী হয়ে গেছে।

পরের দিন মার মুখ দেখে আমার বুক কেঁপে উঠল। মার চোখ ফোলা স্বর গম্ভীর। মা কি সারারাত ঘুমোন নি?

“রু তুমি আজ নিচে নেমো না, তোমার ঘরেই থাক, কারু সঙ্গে কথা বোলো না—শান্তি, ছুটকি কারু সঙ্গেই নয়। আমি আসছি একটু পরে।”

আমি স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে রইলাম–কি হল আবার?

আমার হাত পা ঝিম ঝিম করতে লাগল, দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব, আমি রাত্রের বিছানাতেই আবার শুয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ বাদে মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

“এটা খেয়ে নাও। তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

আমি দুধ খেতে ভালোবাসি না, একেবারে নয়। কিন্তু এখন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলাম। মা আমার পাশে খাটে বসে খুব কঠিন স্বরে, আমাকে বললেন, “তোমার বাবা আমাকে খুব ভালো করে খোঁজ নিতে বলছেন তোমরা কতদূর পর্যন্ত গিয়েছ?”

আমি চুপ করে আছি। আমি ভাবছি সাবি বা শান্তি কেউই বানিয়ে মিছে কথা বলবে! শান্তি যদিও বানিয়ে গল্প করতে পারে–সাবি কখনো বলবে না। আমরা ভাইবোনেরা মিছে কথা বলি না। মা বলে দিয়েছেন—“যদি দণ্ড সহিতে হয়, তবু মিথ্যা বাক্য নয়। আমরা তো দুরে কোথাও যাই নি ওখানেই তো ছিলাম। মা আবার বললেন, “বল বল কথার উত্তর দাও, কতদূর পর্যন্ত গেছ তোমরা?” মার প্রশ্ন আমার ঠিকমতো হৃদয়ঙ্গম হয়নি—আমি বললাম, “তুমি ওদের জিজ্ঞাসা কর না লেকের থেকে অন্য কোথাও দূরে যাইনি আমরা।” মা নিশ্চিন্ত হলেন। আমার অজ্ঞতায় খুশি হলেন।

অনেকক্ষণ আমরা চুপ করে আছি। নিচে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। জাগ্রত বাড়িতে রোজকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়েছে কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের যেন কোনো যাগ নেই—এই মুহূর্তে আমি আর মা যেন অনেক দূরে অন্য জগতে অন্য কোনো সময়ে চলে গেছি। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ পরে মা বললেন, “রু সত্যি কথা বল, মির্চা তোমায় কি কি করেছে?” আমি বালিশে মুখ গুঁজলাম। আমি এসব প্রশ্নের উত্তর দেব না, কিছুতে না, নয়ত মিথ্যা কথা বলব। কি করে আমি সত্য কথা বলব? তাহলে সব তো ওর দোষ হবে। শুধু ওরই কি দোষ? আমার দোষও কম নয়, একটুও কম নয়, ওর এখানে মা নেই বাবা নেই কেউ নেই, পরের বাড়িতে আছে। এখানে আমার বাবাই ওর সব, এখন তিনিও যদি বিরূপ হয়ে যান ও কোথায় যাবে?

মা বললেন, “রু ওঠ, মুখ তোলো, আমার দিকে তাকাও।” মার স্বর কঠিন, স্নেহলেশশূন্য। আমি মুখ তুলেছি কিন্তু মার দিকে তাকাতে পারছি না, মার চোখে চোখ রেখে মিথ্যা কথা বলা! আমার মুখ শুকিয়ে গেছে, গলা শুকিয়ে গেছে, কথা বলতে পারছি না। অত সুন্দর জিনিস পাবার জন্য এত নিচে নামতে হবে কেন?

“তুমি কথা বলছ না কেন রু, তুমি আমার দিকে তাকাচ্ছই বা না কেন? তোমার মুখ এমন কাল হয়ে গেছে কেন? কোথায় আমার তেজস্বিনী সত্যবাদিনী মেয়ে যে মিথ্যার সঙ্গে কখনো আপস করে না? আজ তার এ’দশা কেন? ছিঃ অপরাধের ভারে তোমার মাথা নিচু হয়ে গেছে এও আমায় দেখতে হল” মার গলা ধরে এসেছে। আমি জানি মা যা বলছেন তা সত্য কিন্তু যত অন্যায়ই হোক আমি মিথ্যা কথাই বলব। ওকে কখনো বিপদে ফেলব না।

“বল রু, ও তোমাকে চুমো খেয়েছে?”

“হ্যাঁ—”

“কোথায়?”

এইবার মনে পড়ে গেছে, একটা নিরাপদ উত্তর দিতে হবে—

“কপালে—”

“শুধু এই?”

“হ্যাঁ—”

“তোমরা কোনো গন্ধর্ব বিবাহটিবাহ কর নি তো?”

“সে আবার কি?”

“কেন গন্ধববিবাহ কি তুমি জান না? মালা বদল, আংটি বদল বা ঐ রকম কিছু?”

“না মা, ও সব কথা আমাদের মনেই হয়নি।” পরে বুঝতে পেরেছি মা ভাবছিলেন ও রকম একটা কিছু হয়ে থাকলে মার পক্ষে আমাদের সাহায্য করা সহজ হবে।

“দেখ রু, আমি তোমাকে যা বলেছলাম, তা পারলাম না, তোমার বাবা কিছুতে রাজী হলেন না।”

আমি কাপছি—মা আমার গায়ের উপর হাত রাখলেন—“শান্ত হও।”

“কেন মা? কেন মা?”

“তোমার বাবা বলেছেন ওদের আমরা কিছু জানি না—ওদের বংশ জানি না, ওর বাপ কেমন ঠাকুর্দা কেমন কে জানে? ওর হয়তো কোনো খারাপ অসুখও থাকতে পারে।”

আমি অবাক হয়ে গেছি, এ আবার কি অদ্ভুত কথা—“মা আজ প্রায় এক বছর ও আমাদের এখানে আছে একদিনের জন্য জ্বর পর্যন্ত হয়নি। ওর অসুখ হবে কেন?”

“সে অসুখ নয়, সে সব অনেক কথা ও তোমার দরকার নেই জেনে। তুমি তো জান ফরাসীরা কি রকম খারাপ লোক হয়, একেবারে অসভ্য।”

“কিন্তু ও তো ফরাসী নয়”

“ওই একই হল—ওদের সভ্যতাটা ফরাসী সভ্যতা।”

“ফরাসী সভ্যতা খারাপ হবে কেন? সমস্ত ইয়োরোপই তো ফরাসীদের অনুকরণ করে।”

“করে করে কি উন্নতি হয়েছে?”

“ইয়োরোপের উন্নতি হয় নি?”

“আরে সে কথা নয়—ওদের জীবনটা কি তা তো তুই জানিস না। বড় হলে মোপার্সার গল্পগুলি পড়লে বুঝতে পারবি। স্বামীস্ত্রীতে বিশ্বস্ততা নেই—এ ওকে ক্রমাগত ঠকাচ্ছে—একজনকে বিয়ে করছে আর একজনের সঙ্গে চলে যাচ্ছে, ওরকম একটা বিশ্রী সমাজে তুই বাঁচতে পারবি না।”

“আমি মোপাসার গল্প পড়েছি ‘নেকলেস’, কিছুই খারাপ না।–”

“আরে না না, কত গল্প আছে—আর তোর বাবা যা সব বললেন, ভয়ে আমার হাত পা গুটিয়ে যায়।…এ কখনো ভালো হবে না রু।”

“মা মা মাগো।”

“কি করব রু—উনি বলেছেন এ বিষয়ে আমি যদি জোর করি তাহলে উনি মরে যাবেন। তুমি ওঁকে মেরে ফেলতে চাও? তুমি ওঁকে একটুও ভালোবাস না? ঐ ছেলেটাই তোমার অত আপন হল?”

আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি, আমার মনে বাবার অসুখের কথায় কোনো দুশ্চিন্তা আসছে না—বরং রাগ হচ্ছে—এই অসুখের ভয় দেখিয়েই মাকে উনি সর্বদা নিজের মতে নিয়ে আসেন। আর কি কারু ব্লাডপ্রেসার হতে পারে না? আমার কেন ব্লাডপ্রেসার হয় না? হে ভগবান আমার এখুনি ব্লাডপ্রেসার হোক। মা বলছেন “রু তুমি যদি এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কর তাহলে ওর স্ট্রোক হয়ে যেতে পারে। সেটা কি তুমি চাও? নিজেকে সামলে নাও, যা চাওয়া যায় তার সব কি পাওয়া যায়?”

 

জানি না আমার-ঘণ্টা মিনিট কোথা দিয়ে কেমন করে কাটল। দুপুরবেলা এলেন, ‘রু ওঠ, মির্চা চলে যাচ্ছে, ও বলেছে যাবার আগে ও তোকে একটি বার দেখতে চায়।”

আমি উঠতে পারছি না, আমার শরীরের সমস্ত হাড় যেন গুড়ো হয়ে গেছে—আমি কি করে উঠে দাঁড়াব?

“রু ওঠ ওঠ, ও নিচে রোদে পঁড়িয়ে আছে—তুই ওপরের বারান্দায় দাঁড়াবি—তোর বাবা রাজি হয়েছেন, ও শুধু তোকে একবার দেখেই চলে যাবে।”

এই উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে যখন আমি আবার উনিশ শ’ ত্রিশ সালে প্রবেশ করলাম তখন আবার ঠিক সেই আঠারই সেপ্টেম্বরের অবস্থা হল! আবার আমার হাড় গুঁড়িয়ে গেল, বুকে মোচড় দিতে লাগল—কী আশ্চর্য আমি জানতামই না তেতাল্লিশ বছর ধরে আমার সত্তার একটা অংশ উনিশ শ ত্রিশ সালেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে—‘অজঃ নিত্য শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’—আজ সে শরীর নেই কিন্তু সে আছে, সেই আছে, সে অমৃতা।

 

আমি বারান্দার মাঝখানের ফাকটার কাছে দাঁড়িয়েছি, ও নিচে দাঁড়িয়েছে— মাধবীলতাটার অল্প ছায়া ওর মুখের উপর পড়েছে—সেই যন্ত্রণাকাতর মুখ আমার দিকে তুলে আছে—মনে হচ্ছে ওকে যেন কেউ আগুনের শলা দিয়ে বিঁধছে। আমি আজ পর্যন্ত কারু মুখে অমন যন্ত্রণার চিহ্ন দেখি নি। ও হাত তুলে আমায় নমস্কার করল—“বিদায়—”

“না, না, মির্চা না”—আর ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলাম, ওকে তো বলা হল না, কতবার ভেবেছি এইবারে বলব কিন্তু বলাই হল না। আর কোনও দিনও বলা হবে না…।

তারপর আমার কিছু স্পষ্ট মনে পড়ে না—আমার ধারণা মা আমাকে শুইয়ে দিয়েছিলেন। পরে শুনেছি আমি পড়ে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য নয়। আমার হাড়গুলোই যে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। যখন আমার জ্ঞান হল,দেখি আমার ঘরের পাশের সরু বারান্দা যেটা মির্চার ঘরের সামনের সরু গলির উপর সেখানে শুয়ে আছি—মা আমার মাথায় জল দিচ্ছেন আর তার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, তিনি বলছেন, “দুর্গা শ্রীহরি, দুর্গা শ্রীহরি কি করি আমি, কি করি এখন?”

মির্চা চলে গেছে—কোথায় গেল কে জানে? কে আমাকে বলবে? আমার সঙ্গে কারু দেখা হচ্ছে না—মা আমাকে বেরুতে দিচ্ছেন না, আমার শোকাহত মূর্তিটা সকলের সামনে। থেকে আড়াল করে রাখতে চান-লোকে যে হাসবে। আমি শরবৎ ছাড়া কিছু খাই না, খাওয়া অসম্ভব। মা তো ছোটখাট ডাক্তার বললেই হয়, মাও জোর করেন না। মা বলেন—দুঃখ শোক রাগ এর যে কোন অবস্থায়ই শরীরে বিষ হয়। তখন জলীয় কিছু খেলেই যথেষ্ট। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয় সাবিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি যাবার সময়। ওকে কিছু বলে গেছে কিনা। আবার ভাবি, না থাক, ও ছেলেমানুষ, ওর সামনে এই যে কাণ্ডটা হল এটাই যথেষ্ট অন্যায় হয়েছে, এ রকমটা না হওয়াই উচিত ছিল। তা ছাড়া ওকে আর বলবেই বা কি?

পরে শুনেছি ও বলেছিল—“কি করলে সাবি, এ কি করলে?” সাবি বেচারা কেঁদে কেঁদে বলেছে—“আমি বুঝতে পারি নি ইউক্লিডদা, আমি বুঝতে পারি নি। তোমার এত কষ্ট হবে, দিদির এত কষ্ট হবে।”

 

ক’দিন পরে কি জানি–একটা সন্ধ্যা দেখতে পাচ্ছি–বাইরে তখনও ম্লান আলো আছে—ঘরের ভিতর অন্ধকার—এককোণে নীল বাতি—ঢাকনা পরান—বেশির ভাগ দরজা বন্ধ। আমাকে বন্দী করা হয় নি, লোকচক্ষুর আড়ালে রাখা হয়েছে, হঠাৎ দরজা ফাক করে একজন কে ঢুকল—তার কথাগুলো মনে আছে, কিন্তু তার মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। তার শাড়ির বেড় দেওয়া পা দুটো আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, সে কে? কাকীমা, না শান্তি, না চাপা পিসি, না অন্য কেউ? সে আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল—“দেখো রু, পালাবার চেষ্টা করো না। জেনো তুমি এখনও নাবালিকা–তুমি যদি পালাও, তোমাকে তো ধরে আনা হবেই—অবশ্য তোমার আর কোন ক্ষতি হবে না, কিন্তু ওকে জেলে দেওয়া হবে। সে কোনো ভদ্রলোকের জেল নয়, চোর ডাকাতের সঙ্গে থাকতে হবে। হাফ প্যান্ট পরিয়ে ওকে দিয়ে পাথর ভাঙাবে।”

“কেন তোমরা আমাকে শাসাচ্ছ”—আমি বালিশে মুখ গুঁজে আছি, কি নিরুপায় আমি কি নিরুপায়–“আমি কি কোথাও যাচ্ছি? আমি তো এই ঘরে একলা পড়ে আছি—এত বাক্যযন্ত্রণার দরকার কি?”

“তোমার ভালোর জন্যই বলছি।”

 

বেশ দু’একটা দিন কেটে গেছে। আমার সবচেয়ে কষ্ট এই, ওকে কোনো কথা বলা হল না। কত কথা বলার ছিল, এ জীবনে আর বলা হবে না। যাবার আগে যদি একটা ঘণ্টাও একলা কথা বলতে পারতাম। যতদিন ছিল শুধু কষ্টই দিয়েছি ওকে, আর কিছু না, আর কিছু না

এখন ভোরবেলা দরজাটা একটু ফাক হল, খোকা ঘরে ঢুকল, ঢুকেই ওর স্বভাবসিদ্ধ ভাড়ামি শুরু করেছে—“এ্যাঃ পড়ে পড়ে কান্না, ধিক্ ধিক্ কোথা হতে এলে তুমি নির্মম পথিক…” ও বিদায়-অভিশাপ থেকে দেবযানীর বক্তব্য আওড়াচ্ছে—“ওঠো, মির্চা তোমার একখানা বই চেয়েছে, ওর কাছে নেই।”

“তুমি জানো সে কোথায় গেছে?”

“জানি বইকি, সেই রিপন স্ত্রীটে।”

“সেই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের বাড়িতে?” হায় কপাল! ও যে ওদের একেবারে ঘৃণা করে, ওদের ওখানে থাকতে ভালোবাসে না-ওখানকার মেয়েগুলো ভালো না রে…”

“তা যাবে কোথায়? একদিনের মধ্যে তাড়িয়ে দিলে এই বিদেশে বেচারা যাবে কোথায়?”

“ও খোকা ভাই-ওরে খোকা রে—কি করি ভাই এখন…?”

“চুপ চুপ চুপ” ও মুখে তর্জনী ঠেকিয়ে ভঙ্গিমা করে ঘুরে নিল এক পাক—“চারিদিকে স্পাই—আমি পালাব—শীঘ্র বই বার কর আমি বারান্দায় দাঁড়াই।”

আমি বইটা বের করে বারান্দায় এলাম…তখনই আমার মনে হল ওকে সাবধান করে দিই—বাবা যদি জিজ্ঞাসা করেন তাহলে কিছু যেন স্বীকার না করেও তো জানেই না যে অন্যায় কাজ করেছে তাই বলে ফেলতেও পারে—আমি বইটার পিছনের পাতা খুলে লিখতে গেলাম—আমার হাত কেঁপে গেল, লাইন বেঁকে গেল, আমি একটা মিথ্যা কথাকে প্রেমের মূল্যে অক্ষয় করে দিলাম সেকথা জানতেও পারলাম না—Mircea Mircea Mircea I have told my mother that you have kissed me only on my forehead.

“খোকা ভাই আমি একটা চিঠিও দেব। নিয়ে যাও, উত্তর নিয়ে এস।”

“তাড়াতাড়ি কর-মামা টের পেলে এই মুহূর্তে বিদায় করে দেবেন আমাকে।”

আমি ছোট্ট একটা কাগজ নিয়ে চিঠি লিখতে বসলাম। কি লিখব? কত কিছু লেখার ছিল মনে পড়ছে না। থাক। দুটোই কথা আছে খুব জোরের সঙ্গে বলতে হবে। মনে একান্ত বিশ্বাস নিয়ে এ সত্য আমি রাখবই রাখবই…আমি লিখলাম, তোমাকে কখনও ভুলব না I shall never forget you…never forget you, never forget you আর লিখলাম তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব—I shall wait for you, wait for you.’লাইনের পর লাইন একই কথা লিখে কাগজটা ভরিয়ে আমি খোকাকে দিলাম—

“খোকা এই চিঠি ওকে দাও তারপর যা হয় করা যাবে।”

আমার অনেক চুল এই ক’দিনে জটা হয়ে গেছে। আমি মাকে ছুঁতে দিই নি। মার সঙ্গে সর্বদা খিটিমিটি করছি, মা সমস্ত সহ্য করছেন। আমি চিঠিটা ওকে দিয়ে ঘরে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। আমার দীর্ঘ কেশভার ঝুলিয়ে দিয়ে চোখের উপর বাহু ঢাকা দিয়ে আমি প্রতিজ্ঞা করতে লাগলাম—“ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না।” মনের উপর তো বাবার হাত নেই—সেই প্রতিজ্ঞা নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আমার অগোচরে নামতে লাগল-পা ফেলে সন্তর্পণে নিচে বহু নিচে মনের অতলে যেখানে বাইরের জগতের যাতায়াত নেই, যেখানে দিন রাত্রি পৌঁছয় না, যেখানে সকাল সন্ধ্যা নেই, যেখানে সূর্য ওঠে না, চন্দ্র তারা জ্বলে না, সেইখানে নেমে গিয়ে মহাযোগনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ল—তখন কে জানত তেতাল্লিশ বছর পরে তার ঘুম ভাঙবে?”

 

দুতিন দিন কেটে গেল খোকার আর দেখা নেই—শেষটায় একদিন ওকে ধরলাম, “কি হল? আমার বই আর চিঠিটা দিয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“তারপর?”

“তারপর আর কি?”

“তারপর আর কি মানে? ও কিছু বলল না?”

“না তো।”

“না তো! তুমি আজই একবার যাও ভাই, বল তাকে আমি উত্তর চাই।”

“সে তো ওখানে নেই, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ওদের বাড়িতে বললে সে সেখানে নেই।”

“ও মা। সে কি কথা! এতদিন আমায় বল নি কেন?”

“বললে তুমি কি করবে? ও যদি জলেই ঝাঁপ দেয় তোমার কিছু করবার আছে?” “ও খোকা, ভাই তুমি কিছু কর লক্ষ্মীটি, তোমার পায়ে ধরছি ওর খবরটা আমাকে এনে দাও—”

“আচ্ছা আচ্ছা”, খোকা পালিয়ে গেল—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *