মোবাইল সোনা

মোবাইল সোনা

টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে ম্যাক্সিপরা বুড়িরা।

আকাশ এখনও ম্যাক্সি পরতে শেখেনি। এখন আকাশের গায়ে নীল খোলের শাড়ি, মেঘের কলকা বসানো। শাড়ির পাড়ে গাছগাছালি, ধোঁয়ার কুণ্ডলীর নকশা বসানো চিমনিও। গঙ্গামুখো বারান্দায় শীতসকালে দাঁড়িয়ে শোভা দেখছেন দুই বৃদ্ধা। ইজি চেয়ারগুলি চুপচাপ বসে আছে। এখন দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে। জল বয়ে যায়। পাখি ওড়ে, দু-চারটে নৌকো কেমন স্থির। চুপচাপ জলে ভাসা উদাস। আঙুরবালার গানের রেকর্ডের কথা মনে পড়ে কমলিনীর।

এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কমলিনী মিত্র আর নমিতা মুখার্জি। আর ছটি শূন্য কাপ। সকালের চা খাওয়ার পর চারজন ঘরে চলে গেছেন। কেউ পুজো করছেন, কেউ রেডিয়ো শুনছেন। এই দু’জন এখনও দাঁড়িয়ে। কমলিনীও পুজো করবেন। ওঁর নাড়ুগোপাল আছে। কিন্তু কমলিনীর মনে হয় এখানে এমন দাঁড়িয়ে থাকাটাও একটা পুজো।

এটা একটা বৃদ্ধাশ্রম। গঙ্গার ধারে। গঙ্গামুখো ছটি ঘর। এসব ঘরের রেট বেশি।

তাঁরা দু’জন দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ কথা কইছেন না, কিন্তু ওঁদের অনন্ত কথা আছে। প্রত্যেকেরই আলাদা জীবনবৃত্তান্ত আছে। অথচ কিছুই বলার নেই। কথাগুলো যেন সব স্ট্যাচু করে রাখা।

তবু এই রৌদ্রে, পৃথিবীর সকালবেলায়, কমলিনীর মনে হয় লিকারের ভেতরের অজানা চিনির মতোই আনন্দ অদৃশ্য থাকে। নইলে এই বিষাদও ভাল লাগে কেন।

কমলিনী হঠাৎই কথা বললেন—

এই, তোমার ভাল লাগে?

নমিতা কমলিনীর দিকে তাকান। বুঝতে চেষ্টা করেন প্রশ্নটা ওঁকে উদ্দেশ্য করেই কি না। কমলিনী তাকিয়ে আছেন নমিতার দিকে। নমিতার এই প্রশ্নটা বড় কঠিন মনে হয়। এর কি কোনও উত্তর হয়? কিছু বলবেন ভেবেই অনেকটা বাতাস টেনে ফুসফুস ভরতি করেন। কিন্তু বললেন একটিমাত্র বর্ণ।

কী?

এইসব…। বলেই ছানি চোখেই চারিদিকে তাকালেন কমলিনী। তবে কি এইসব মানে এই নদী-আকাশ-মেঘ-স্রোত-ব্ৰহ্মাণ্ড? নমিতা রোদ মাখতে মাখতে ছুটে যাওয়া কচুরিপানার দিকে তাকিয়ে বলেন— ঢং।

তারপর আর ওখানে দাঁড়ান না নমিতা। ঘরের ভেতরে ঢুকে যান।

কমলিনী বোঝেন এই ঢং শব্দটা শুধু ওই কচুরিপানার দিকে ছুড়ে দেননি নমিতা। কমলিনীর দিকেও।

কমলিনী মাঝে মাঝেই এরকম ঢং পান। আকাশের মেঘে দু’ হাত বাড়ালে আলিঙ্গন দেখতে পান, বিদ্যুতের ‘দ’-এর মধ্যে উনি দেখেন মোরে আরও আরও আরও কর দান। পাখির ডাকে শোনেন ভালবাসি ভালবাসি, এমনকী গাড়ির হর্নেও শুনেছেন তোমাকে চাই। দিন দশেক আগে তো, শীতের মধ্যে বারান্দায় ন্যাপথালিনের গন্ধ মাখা প্রাচীন ঢাকাই শাড়ি পরে বসেছিলেন অনেক রাত অবদি। পূর্ণিমা ছিল। ওই ঢং-এর কারণ নমিতাও জানেন। বিবাহবার্ষিকী। তেষট্টিতম। কমলিনীর ধারণা ‘উনি’ ঠিকই দেখছেন কমলিনীকে। কমলিনী আর নমিতা এক ঘরে থাকেন। ওঁরা দু’জন পরস্পরের রুম মেট। ঘরের দেওয়ালে একটি পুরুষের ছবি। কমলিনীর ‘উনি’। কমলিনী রোজ সকালে ছবির সামনে ছোট গেলাসে একটু চা রাখেন। কমলিনীর একটি নাড়ুগোপালও আছে। কুলুঙ্গিতে। ওখানে ছোট গেলাসে জল। ওরকমই একটা ছোট গেলাসে চা রাখেন। নাড়ুগোপালকে রোজ বাতাসা দেন। মাঝেমধ্যে সন্দেশ। কিন্তু ওঁর উনির ছবির সামনে এসব রাখেন না। ওঁর উনির মিষ্টি খাওয়া বারণ ছিল। হাই সুগার। তাই শুধু জল। নমিতার ওসব বালাই নেই। নমিতার গোপাল-টোপালও নেই। নমিতা বই-টই পড়েন। কমলিনী ইদানীং পড়তে পারছেন না কারণ চোখে ছানি। ছেলে বলেছে অপারেশন করিয়ে দেবে, কিন্তু সময় পাচ্ছে না। নমিতার কোনও উনি নেই। নমিতার বিয়ে করা হয়নি, ভাইদের মানুষ করেছেন, বোনের বিয়ে দিয়েছেন। ইস্কুলের দিদিমণি ছিলেন, শেষ তিন বছর বড়দিদিমণি। নিজের কথা বেশি বলেন না নমিতা। কমলিনী বলেন৷ ওঁর ছেলেমেয়ের কথা, নাতিনাতনি, বউমা। লাকসাম, লামডিং, আলিপুরদুয়ার স্টেশনের কথাও বলেন কমলিনী, যেখানে কমলিনীর স্বামী চাকরি করতেন, রেলে, স্টেশনমাস্টার। নমিতা জানেন কমলিনীর উনি কাঁঠালের বিচি খেতে খুব ভালবাসতেন। আর মুড়ি-চানাচুর। সজনের ডাঁটাও। যখন দাঁত তুলে ফেলতে হল, তারপরও মাড়ি দিয়ে চিবোতেন। গোঁফ ছিল। বিয়ের ফটোতে গোঁফ আছে। বিয়ের পর কমলিনী বলেছিলেন সুড়সুড়ি লাগে, তাই কেটে ফেলেছিলেন। রিটায়ার করার পর বলেছিলেন এবার রাখি? রেখেছিলেন। কিন্তু তবুও বেশিদিন রাখতে পারেননি ওঁর শখের গোঁফ। আবার কাটতে হয়েছিল। সুড়সুড়ি।

ষাটের পরেও? নমিতার প্রশ্নে কাচভাঙা হাসি হেসেছিলেন কমলিনী। নমিতা বলেছিলেন— ঢ-অ-অং।

এত কিছু বলেন কমলিনী, কিন্তু নমিতা কিছুই বলেন না। কমলিনী জিজ্ঞাসা করেছেন ওঁর ভাইপো-বোনঝিদের কথা, নমিতা বলেছেন— ওরা সব প্রতিষ্ঠিত, বিবাহিত। ব্যাস। কমলিনী একদিন ঝরঝর মুখর বাদরদিনে নমিতাকে জিজ্ঞাসা করেছেন— বিয়ে না হয় করা হয়ে ওঠেনি তোমার, কিন্তু মন দেওয়া-নেওয়াও করনি কখনও?

নমিতা মাথা নিচু করে ঠোঁট উলটে নিশ্চুপ ছিলেন। এর মানে— কে জানে? উনি বড্ড চুপচাপ। এত চুপচাপ ভাল লাগে না কমলিনীর। নমিতা তো বলতে পারতেন— প্রেম করা সই আমার হল না, কিংবা প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে, সে তো হায়, নিরুপায়, পারিনি তো কভু তারে জানতে। না হয় রবীন্দ্রসংগীতের লাইনই বলতিস। প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে। দিইনি তাহারে আসন। দেখতে শুনতে এত ভাল নমিতা, কেউ ওর প্রেমে পড়েনি তা কখনও হয়? বুকের মধ্যে সবসময় পাষাণ চাপা দিয়ে রাখেন নমিতা। তবে শোনেন। কমলিনী একটু কথা বলতে ভালবাসেন। বয়েস হলে সবাই কথা বলতে চায়, কিন্তু শোনার লোক থাকে না। নমিতারই শুধু কথা কম, শোনা বেশি। নমিতাকে জিজ্ঞাসা করেও পেট থেকে কথা বার করা যায় না। ওঁর চিঠিপত্রও আসে না, ফোনও নয়। তবে ঠাকুরের কাছে হাতজোড় করে উনি কী বলেন? কার জন্য বলেন? কমলিনী যেমন বলেন, হে ঠাকুর, আমার বাবলুকে সুস্থ রাখো, ওকে শান্তি দাও। নতুন বউমা যেন বাবলুকে সুখে রাখে। যেন না দাগা দেয়। নাতিটাকে পরীক্ষায় ফার্স্ট করো, নাতনিটাকে একটু মোটা করো, ওর যেন ভাল বিয়ে হয়… কিন্তু নমিতার বিড়বিড়ের মধ্যে কী থাকে? কার জন্য প্রার্থনা থাকে?

আজ রবিবার। ওঁদের রোজই রবিবার। রোজই ছুটি-ছুটি। এ রকম অফুরন্ত ছুটির মধ্যেও অনেকের সময়াভাব হয়। লাবণ্য বলছিল, খবরের কাগজটাই পড়া হয় না। সময় পাই না। কমলিনী বলেছিলেন, কুকুরের যেমন, কাজও নেই, আবার অবসরও নেই।

আজ রবিবার। বোঝা যায় ইডলিতে। সাড়ে আটটায় ঢনঢনাঢন হয়। ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা। তখন নীচে নামলে গরম গরম পাওয়া যায়। নইলে ঝর্না এসে ঘরে দিয়ে যায়। নমিতা সাধারণত নীচে নামেন না। আজ কমলিনী বললেন— চলো, গরম খাবে। কমলিনী আজ একটু বেশি উচ্ছল। কারণ আজ বিকেলে বাবলু আসবে। গতকাল ফোন করেছিল।

এ বাড়িতে একতলা দোতলা মিলে মোট দশজন। সবাই মহিলা। স্নেহলতা নামের একজন বৃদ্ধা বলেছিলেন— স্কুল করলুম দয়াময়ী। কলেজ বেথুন। বৃদ্ধাশ্রমেও কো-এডুকেশন জুটল না, এমনই বরাত।

এই বৃদ্ধাশ্রমের নাম নারীমহিমা। উত্তরপাড়ার জমিদার বংশের এক মহিলা তাঁর বাড়িটি দান করেছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে এই শর্তে, যে এখানে শুধুমাত্র বৃদ্ধাদেরই জন্য একটি ওল্ড এজ হোম করতে হবে। মিস মাধবী এখন এখানেই থাকেন। এককালে ক্যাবারে নেচে কলকাতা কাঁপিয়েছিলেন। থিয়েটারেও নাচতেন। মিস শেফালি, মিস জে, মিস মাধবী— এঁরা সব ছিলেন কতজনের হার্টথ্রব। মিস মাধবীর পায়ে বাত। একতলায় থাকেন। ইনি মিস লিখতেন বটে, কিন্তু মিস ছিলেন না। মিস মাধবী বলছিলেন, আমার কর্তার ছিল বড় সন্দেহবাতিক। এখন স্বর্গে গিয়ে শান্তি পাচ্ছেন, কারণ এ বাড়িতে কোনও ব্যাটাছেলে নেই।

বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিলেন কমলিনী। নিজেই। ‘গঙ্গার ধারে ঘরোয়া পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রম। কেবল মহিলাদের জন্য।’ ‘গঙ্গার ধারে’ শব্দটাই বড় লোভনীয় ছিল। বাবলুকে নিয়েই দেখতে এসেছিলেন। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। বাবলু বলেছিল, তুমি যদি এখানে শান্তি পাও তো থাকো। বাবলু নিজে থেকে কখনওই বলেনি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে। কিন্তু কমলিনীর তো বুদ্ধি-বিবেচনা আছে। উনি বেশ বুঝতে পারছিলেন এ সংসারে তিনি বাড়তি। ওদের অসুবিধে হচ্ছে। দশ বছর আগেই যদি মরে যাওয়া যেত, তা হলে হয়তো বাবলুর সংসারটা ভাঙত না। আবার নতুন করে বিয়ের উজ্জুক করতেই কমলিনী সরে এসেছেন। স্বামীর ফ্যামিলি পেনশন আছে না? পোস্টাপিসের সুদও। মেয়েটাকে দিল্লির হস্টেলে রেখেছে বাবলু, ছেলেটাকে নরেন্দ্রপুরের মিশনে৷ বাবলু যখন কাজেকম্মে বাইরে যায়, নতুন বউমাও সঙ্গে যায়। বেশ তো। ভালই তো। কমলিনী এখানে না এলে নতুন বউমা কি এরকম হুটহাট যেতে পারত? ওরা সুখে থাক। ফাসক্লাস থাক। ওদের জন্য গঙ্গার জলে কড়ে আঙুলের দাগ টেনে ফাড়া কাটান কমলিনী। এখন আর গঙ্গায় নামতে পারেন না, উলটো দিকেই ঘাট আছে। প্রথম প্রথম ঘাটে নামতেন, গঙ্গার স্রোতেই ফাঁড়া কাটাতেন, এখন কমণ্ডলুর গঙ্গার জল বাটিতে ঢেলে ফাঁড়া কাটান। নিজের ফাঁড়াটা কাটান না। হট করে পড়ে গিয়ে, কিংবা বাজ পড়ে… বেশ হয়, সবচেয়ে ভাল হার্ট অ্যাটাক, দু’ মিনিট, কাউকে ভোগাবার গপ্পো নেই, বাবলু ফোন পেল আপনার মা…

সাদা সাদা ইডলির গা থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পাশের বাটিতে সম্বর। সেখানেও ধোঁয়া। কারিপাতার গন্ধ। নীচের অফিসঘরে টেলিফোন। রবিবার সকালে অনেকের ফোন আসে। অনেকে ফোন করেন। রবিবারই তো ছেলে, জামাই, বউমা, নাতিনাতনিরা বাড়িতে থাকে। একজন ফোনে জিজ্ঞাসা করছেন বাড়িতে, কী টিফিন হচ্ছে? লুচি? তারপর কিছুক্ষণ নিচুস্বরে কথা, ফোনটা যখন ছাড়লেন, চোখে জল। চোখ মুছলেন। কমলিনীর ফোন করার ইচ্ছে হল, কিন্তু আবার কাউকে সাধ্যসাধনা করে বলতে হবে নম্বরটা টিপে দে না। কমলিনীর চোখে ছানি বলে নম্বর দেখতে পান না ঠিকঠাক। ছায়াদি নামে একজন আছেন। তিনি আবার ফোন নম্বর ভুলে যান। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে হলে মোবাইলে বলতে হয়। মোবাইলের নম্বরটা আবার লম্বা। তখন ম্যানেজারবাবু খাতা খুলে নম্বর বলে দেন। ছায়াদির খুব ভুলো মন। উনি আবার ম্যাক্সি পরেন না। শাড়ি। সবকটা শাড়ির আঁচলে অনেক গিট। কিছু মনে পড়লেই আঁচলে গেরো বাঁধেন। কাল বিকেলে ভিটামিন বড়ি খাওয়া হয়নি, আজ খেতে হবে। একটা গেরো। ক্যালেন্ডারে দেখলাম আগামী বুধবার মাঘী ষষ্ঠী। নাতি-নাতনির নামে গঙ্গায় পয়সা ফেলতে হবে। একটা গেরো। ছ’ তারিখ নাতনির জন্মদিন। ফোন করে হ্যাপি বার্থ ডে বলে গঙ্গায় এক টাকার ছোলাভাজা ফেলতে হবে। মাছের জন্য। বাচ্চাদের জন্মদিনে মাছকে খাওয়াতে হয়। একটা গেৱো। এরকম কত। কিন্তু কোনও গেরো যে কী মনে করে, সেটাই মনে থাকে না। কমলিনী ভাবলেন নমিতাকে নয়, ম্যানেজারবাবুকেই বলবেন একবারটি নম্বরটা টিপে দিতে। কিন্তু আজকাল কিছু রিকোয়েস্ট করতে ইচ্ছে করে না একটা কথা শোনার পর।

ঝর্নাই বলেছে। ম্যানেজারবাবু নাকি খাতায় নামের পাশে কিছু চিহ্ন দিয়ে রেখেছেন। দুটো গোল (০০) মানে ছিঁচকাঁদুনে। দুটো দাগ (— —) মানে ঘ্যানঘ্যান করে। স্টার মানে ঝগড়াটে। সমান চিহ্ন মানে বেশি কথা বলে। প্রশ্নচিহ্ন মানে কী যেন একটা আছে। কমলিনীর নামের পাশে নাকি অনেক দাগ আছে। কমলিনী একদিন খাতা খুলে দেখেছেন ওঁর নামের বাঁ পাশে —— =? আছে। ম্যানেজারের বয়েস সত্তর। এ বাড়ির একমাত্র ব্যাটাছেলে। কিন্তু সৎসাহস নেই। এসব চিহ্নের মানে কী জিঞ্জাসা করায় বলেছিল, এসব আমাদের কনফিডেনশিয়াল ম্যাটার। এতদিনে আরও কী চিহ্ন যোগ হয়েছে কে জানে! চোখে ছানি কিনা, দেখতে পান না ভাল। কালো বোর্ডে চক দিয়ে বড় বড় করে লেখা হয়েছে আজকের মেনু। বাঁধাকপি, বরবটি ভাজা, অড়হর ডাল। শোল মাছ/ধোঁকার ডালনা। বাবলু অড়হর ডাল খেতে ভালবাসে, শোল মাছও। আজ এক্কেবারে ওর পছন্দের মেনু।

ও মা, কী আশ্চর্য, বাবলু! হ্যাঁ তো, বাবলুই তো। সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোট।

মা, বিকেলে একটু অসুবিধে, সকালেই চলে এলাম।

খুব ভাল করেছিস। তোর কথাই ভাবছিলাম। দুপুরে গেস্ট চার্জ দিয়ে খেয়ে যা। অড়হর ডাল, শোল মাছ…

না মা, একটু পরই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরতে হবে। দুর্গাপুর যাব। বেশিক্ষণ থাকতে পারব না মা। চলো, তোমার ঘরে চলো।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, তুই একা যাচ্ছিস যে বড়, বউমার সঙ্গে ঝগড়াটগড়া করিসনি তো? বাবলু হেসে বলে, না মা, ওসব কিছু হয়নি। ওর কি সবসময় ঘুরতে ভাল লাগে! কমলিনী নাতি-নাতনিদের কথা জিজ্ঞাসা করেন। ওরা ফোন করে না। কতদিন দেখিনি ওদের। আগের বউমাকেও খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে কথা বাবলুকে বললেন না কমলিনী।

বাবলু কোটের পকেট থেকে একটা মোবাইল ফোন বার করল। বলল, মা, এটা তোমার জন্য এনেছি। আর নীচে নেমে আমার ফোন ধরতে হবে না, ফোনটা তোমার কাছেই থাকবে। মানে তোমার কাছেই থাকব আমি।

ফোনের কায়দাটা বুঝিয়ে দেয়। ফোন এলে কোনটা টিপতে হবে, আর শেষ হয়ে গেলে কী করতে হবে।

কমলিনী বলেন, এসব আমার দ্বারা হবে না রে। দাঁড়া, নমিতা আসুক। কমলিনী নমিতাকে ডাকেন। বাবলু ওর নিজের মোবাইল ফোন থেকে কমলিনীর ফোন নম্বর ডায়াল করে। কমলিনীর হাতের মুঠোয় রিংটোনে বেজে ওঠে ‘বাঁধো তার তরীখানি’। আঙুরবালা। এ যে খুব প্রিয় গান কমলিনীর। বাড়িতে রেকর্ড ছিল, মিস আঙুরবালা। কতদিন শোনেননি। গানটা বেজে ওঠা মানে সেই কিশোরীবেলা। জামাইবাবুর কলের গান। শান্তিপুরের বাড়ি। তুই কী করে করলি রে এটা?

আমি কায়দা করে ভরে নিয়েছি। আমি তো জানি তুমি এই গানটা ভালবাস। কেউ ফোন করলেই এই গানটাই বেজে উঠবে।

একটা কাগজে এই মোবাইল ফোনটার নম্বর লিখে দেয়। কমলিনী বলতে পারেন না আমার চোখে যে ছানি, দেখতে পাই না, অপারেশন করিয়ে দিবি বলেছিলি, ভুলে গেলি?

আবার হইহই করে নমিতাকে বুঝিয়ে দেয় বাবলু। বাবলু মানে সৌম্যকান্ত মৈত্র। বয়স উনষাট। চুলে কলপ।

বাবলু চলে যায়। দোতলায় দুই বুড়ি। ট্যাক্সি থেকে হাত নাড়ে বাবলু।

সাড়ে এগারোটা নাগাদ বালিশের পাশে বেজে উঠল ‘বাঁধো তার তরীখানি আমি যে দাঁড়ায়ে কূলে। কোথা তুমি যাও চলি আমারে গিয়েছ ভুলে।’

বাবলু বলছি। ট্রেনে চাপলাম।

খাবি কোথায়?

সে আমি খেয়ে নেব।

সাবধানে যাস।

রাত্রে আবার গান বাজল।

হোটেলে ফিরলাম।

শীত কেমন?

খুব।

দুর্গাপুরে তো খুব শীত। কষ্ট পাচ্ছিস বাবা…

না মা।

খেলি?

এবার খাব। তুমি?

আমার হয়ে গেছে।

কী খেলে মা?

রুটি দু’খানা, কুমড়োর তরকারি। দুধও। তুই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়। বেশি রাত করিস না।

আজ কেমন যেন পাগল পাগল লাগছে। আনন্দ। ঘুম আসছে না। আজ কতবার বাবলু এল। এখন বাবলু পাশে। বালিশের পাশে। বাবলুটা। বাবলুসোনা। ঘুমু কর। ঘুমু ঘুমু কর। মোবাইল ফোনটার গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে থাকেন কমলিনী।

রাত্তিরের স্টিমারের আনন্দ ভুটভুটি গঙ্গার জলে। গঙ্গার জলে আনন্দ স্রোত। রাতচরা পাখির আনন্দ ডাক। কমলিনী পাশ ফিরে শুয়ে বাবলুসোনাকে ঘুম পাড়াতে থাকেন এই আনন্দমঠে।

কমলিনীর মনে হয় বাবলুসোনার শীত করছে। ছোট্ট মুবু মুবু মুবুলু ফোনুটাকে লেপের ভেতরে ঢুকিয়ে নেন। তারপর মনে হল লেপের ভেতরে ওর কষ্ট হচ্ছে। এই ছোট্ট সোনামনাটার গায়ে এত মোটা লেপ ঠিক নয়। বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালান কমলিনী। নমিতা ঘুমুচ্ছে তো? ও টের না পেলেই হল। আস্তে আস্তে ওঠেন। খাটে যেন শব্দ না হয়। নাভুগোপালের কুলুঙ্গির কাছে যান। নাড়ুগোপালের ছোট ছোট সাটিনের চাদর আছে। তারই একটা চাদর ভাঁজ করে মোবাইল সোনাকে ঢেকে দেন। পাশে রাখেন, আলো নিভিয়ে দেন। সকাল হলেই চাদর সরিয়ে নেন। নমিতা দেখে ফেললেই আবার বলবে—ঢং।

ওঁরা দু’জনে সুখে নিদ্রা গেলেন। সকালবেলা কমলিনী ওঁর দেওয়াল আলমারি থেকে একটা পুরনো শাড়ি বেছে নিলেন। ওটার মাঝখান থেকে ছিড়লেন। অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সটা থেকে সুতোর রিল বের করলেন। সুতোর রিলে একটা সুচও আছে। সুচ ও সুতো নিয়ে গুটি গুটি ছাদে চলে যান কমলিনী। একটা কাঁথা সেলাই করা দরকার। ছোট্ট একটা কাঁথা। বাবলু যখন পেটে, কাঁথা সেলাই করেছিলেন কমলিনী। সে কী আনন্দ! আবার, কতদিন পরে। মধুর, তোমার শেষ যে না পাই।

অনেকক্ষণ ধরে সুচে সুতো পরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। নমিতা কি পারবে? থাক। ওকে নয়। ঝর্নাকে বলবেন। আর কাঁথাটা সেলাই করবেন গোপনে, দুপুরে। যখন নমিতা ঘুমোবেন।

ছাদ থেকে ব্যর্থ ফিরে এসে ঘরে ঢুকে দেখেন নমিতা উল বুনছেন। দুটো কাঁটার টানে একটা হলুদ উলের বল মেঝেতে খেলছে। কার জন্য? কী লো? কার জন্য?

বলতে গিয়েও বলেন না কমলিনী। নমিতা মনে ব্যথা পাবেন। নমিতার কেউ নেই। নিজের জন্যই বুনছেন হয়তো, এই বুড়ো হাতে, বুড়ো বয়সে। দুপুরে নমিতা ঘুমালেন না। উল বুনছেন। কমলিনী ঘুমোন। বিকেলবেলা নমিতা কমলিনীর হাতে একটা এক বিঘত সাইজের উলের চাদর তুলে দিয়ে বললেন, এই নাও দিদি, তোমার মোবাইলের। কাল রাতে সব টের পেয়েছি।

ও মা! কী লজ্জা, আর কী আনন্দ। গোপন কথাটি রবে না গোপনে। মধুর, তোমার শেষ যে না পাই।

কমলিনীই বললেন— ঢ-অ-অং।

শারদীয় আজকাল, ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *