অ্যালোপ্যাথ

অ্যালোপ্যাথ

পিতৃঋণ

মাসচটক বাড়িটার আর সেই চটক নেই। এখানে-ওখানে পলেস্তরা খসে ইট বেরিয়ে গেছে। শেওলা জমেছে কোথাও কোথাও, বাড়ির পশ্চিমদিকটায় একটা অশ্বত্থগাছ গজিয়ে গেছে। সিংহটার লেজ খসে গেছে, সিংহর হাঁ-মুখের ভিতরে কাকের বাসা। একটা পরির একটা ডানা ভেঙেছে, অন্য পরিটার হাত ভেঙেছে। কার্নিশ খসেছে কোথাও কোথাও। বাড়িটার চারপাশ ঘুরে দেখছেন ডাক্তার মৃত্যুঞ্জয় মাসচটক। এই বাড়ির একজন বড় অংশীদার। মৃত্যুঞ্জয়ের ঠাকুরদা ছিলেন জমিদারের নায়েব। তাঁরই তৈরি করা এই বাড়ি। এই বাড়িতে এখন এক খুড়তুতো ভাই থাকে, আর এক পিসি। এক খুড়তুতো ভাই কাছাকাছি একটা স্কুলের মাস্টারমশাই। অন্য এক খুড়তুতো ভাই রেলের চাকরি করে। বহুদিন বাইরে ছিল, এখন গড়িয়ার দিকে কোথাও ফ্ল্যাট নিয়েছে।

বাড়ির চারদিকে জঙ্গল। একপাটি হাওয়াই চটি পড়ে আছে উলটে, মাটির ভাঙা হাঁড়ি—কে জানে কবেকার, পলিথিন মোড়কে জয়গুরু বস্ত্রালয় আর থার্টি পার্সেন্ট একট্রা বোর্নভিটার প্যাকেট। বাড়ির চারপাশটাই পরিষ্কার করানো হয় না, তো বাড়ির সংস্কার। ওরা এখানে থাকে কী করে? একটু পরিষ্কার করাতে কত খরচ? একটা মুনিষের একদিনের রোজ। একুটুও খরচা করবে না ওরা? বছর তিনেক আগেই তো ফেটে যাওয়া তিনটে থামের পাশে নতুন কংক্রিটের পিলার করে দিয়েছেন। হাজার সাতেক টাকা বেরিয়ে গেছে। এই বাড়িটা তো মৃত্যুঞ্জয় মাসচটকের একার নয়, তবু কেন খরচ করতে যাবেন। পিলারটুকু না করলে বাড়ি ধসে যেত, তাই ওটুকু করেছেন। মৃত্যুঞ্জয়ের কী দায় পড়েছে পরির পিঠে নতুন ডানা বসানোর? সিংহের লেজ নিয়ে কেন ভাবতে যাবেন? তবে বাড়ির গায়ের গাছগুলো উপড়ে ফেলা দরকার, নইলে বাড়িটার ক্ষতি করে দেবে। তাঁর অংশের দেয়ালের অশ্বত্থগাছটা বেশ বড় হয়ে গেছে। যেখানে পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়েছে, ওখানে একটু সিমেন্ট-বালির কাজ করানো দরকার। নিজের অংশটুকু করে নিতেই পারেন, কিন্তু বাড়ি মানুষের বডির মতোই অনেকটা। পেটে গ্যাস-অম্বল তো মাথা টনটন, মাথা টনটন তো ঘুম হল না, ঘুম হল না তো প্রেসার বাড়ল। বাড়ির ওধারের দেওয়াল হেলে গেলে কি এধারের দেওয়াল ঠিক থাকবে? চকাই-বকাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চকাই-বকাই ওদের খুড়তুতো ভাই। বকাই তো নেই, চকাই আছে।

দিন পনেরোর জন্য চেম্বার বন্ধ করে দেশের বাড়িতে। সামনেই ওঁর পিতা ঈশ্বর ব্রজবিহারী মাসচটকের জন্মশতবর্ষ। এই গ্রামেই একটা বড় করে অনুষ্ঠান করবেন। সিডিএমও-কে আসতে বলেছেন। বিডিও, পঞ্চায়েত প্রধান এঁরা তো অবশ্যই থাকবেন। চকাই তো আবার পঞ্চায়েতের মাতব্বর। মেম্বার। ওরই নাকি প্রধান হওয়ার কথা ছিল। কেউ কাঠি করে হতে দেয়নি। কী করে এত সময় বের করে ওরা কে জানে! স্কুলের মাস্টারি, তার ওপর টিউশনি, তার ওপর আবার গ্রামের মাতব্বরি। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, এত টাইম কোত্থেকে পাস রে চকাই? ও বলেছিল, টাইম হল রবার জীবুদা। টানলে বাড়ে। টানতে জানতে হয়। তুমি কী করে টাইম পাও? তিনটে চেম্বার, তার ওপর কোন নার্সিং হোমে যাও।

মৃত্যুঞ্জয়ের ডাকনাম জীবু। এ নিয়ে বেশ একটা কাহিনি আছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা সদব্রাহ্মণ। সন্ধে-আহ্নিক করতেন, আসলে মাসচটকরা হলেন অনেক পুরোনো বামুন। বটব্যাল, চম্পটি, বিশি এঁরাও তাই। চাটুজ্যে, বাঁড়ুজ্যেরা তো উড়ে এসে জুড়ে বসা। মাসদহ নামে একটা জায়গা আছে নদীয়ায়, মাসচটকরা সেখান থেকেই এসেছে।

তো, মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নপ্রাশনের আগে জ্যোতিষীকে দিয়ে কোষ্ঠী তৈরি করিয়েছিলেন ব্রজবিহারী। গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে ‘খ’ কিংবা ‘ম’ আদ্যক্ষরে নাম রাখার উপদেশ দিয়েছিলেন। ‘খ’ দিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে ‘খগেন’। এছাড়া খল, খটাশ, খড়গ, খঞ্জ, খ্যাঁদা এইসব মনে হল। খচ্চরও। ‘খ’ বাদ দিয়ে তাই ‘ম’ দিয়েই নাম রাখা হল। মৃত্যুঞ্জয় নামটার বেশ ভালো মানে। মৃত্যুকে জয় করে যে। ওটাই রাখা হল। কিন্তু ওকে আদর করার সময় ঝামেলার এক শেষ। আদর করার সময় পুরো নামটা কেউ বলে নাকি? মৃত্যুঞ্জয় নামটা ছোট করে বললে ভারী মুশকিল। মৃত্যু মৃত্যু বলে শিশুকে আদর করা যায় নাকি? এসো এসো সোনা আমার মৃত্যু। মৃত্যু আমার কোলে এসো…অসহ্য। তাই মিতু বলা চলছিল। কিন্তু মিতুর মধ্যে মৃত্যুর স্মৃতিটা তো রয়েই গেল। ওর মা বলেছিল, না, ওকে মিতুও ডাকতে পারব না। অবশেষে চিন্তাভাবনা করে ঠিক হল ওকে জীবন নামেই ডাকা হবে।

ডাকনামে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব নেই, তাই ডাকনাম যে-কোনও অক্ষর দিয়েই হতে পারে। তাই মৃত্যুর একেবারে বিপরীত নাম জীবন। জীবন থেকেই জীবু। কিন্তু মন্ত্র পড়ে, অগ্নিসাক্ষী রেখে যে নামটি রাখা হয়েছিল, সেই নামটাই তো ভগবানের খাতায় রেজিস্ট্রি হয়েছে, তাই সেই নামটাই স্কুলের নাম, সার্টিফিকেটের নাম। ডাক্তারি সার্টিফিকেটেও এই নামটাই। সুতরাং এই মানুষটা জীবন ও মৃত্যু দুটোই ধরে আছে। কিন্তু মৃত্যু নামেই তো বেশি খ্যাতি হয়ে গেল। চেম্বারের গায়ে বড় বড় করে ডা. মৃত্যুঞ্জয় মাসচটক লেখা থাকলেও মৃত্যু ডাক্তার বলেই মানুষ জানে। কোনও রিকশাওয়ালাকে যদি বলা হয়—ডাক্তার মৃত্যুঞ্জয় মাসচটকের চেম্বারে নিয়ে চলো, হাঁ করে থাকবে। মৃত্যু ডাক্তার বললে ঠিক আছে। মৃত্যু ডাক্তার নামে বিখ্যাত হলে কী হবে, পশার তো ভালোই। এই যে পনেরোটা দিন দেশের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে, তাতে কি কম লস নাকি? তিনটে চেম্বারে এবেলা-ওবেলায় গড়ে প্রতিদিন একশো রুগি। কিছুদিন হল একশো টাকা থেকে ফি বাড়িয়ে দেড়শো করেছেন। তার মানে পনেরো হাজার টাকা এক দিনে। এর মধ্যে কিছু খাতিরের রুগি আছে, যারা এখনও একশো টাকা দেয়। কিন্তু আসে শুধু রিপোর্ট দেখাতে, তখন ফি নেওয়া যায় না, ওসব ধরলেও বারো হাজার তো মিনিয়াম। পনেরো দিনে দুটো রবিবার বাদ গেল। তেরো দিন। বারো হাজার ইনটু তেরো। ক্যালকুলেটারে এল এক লাখ ছাপ্পান্ন হাজার। দেড় লাখই ধরা যাক। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, এসব করিয়ে প্যাথলজি সেন্টার থেকে পনেরো দিনে পাঁচ হাজার টাকা, এক্স-রে থেকেও মন্দ না, আলট্রাসনোগ্রাফি, সি.টি. স্ক্যান করাতে পারলে ভালো আমদানি। মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়েও দিনে শ-দুই টাকা আসে। এছাড়া চেম্বারটা একটু মফস্সলের দিকে। এখানে বসবাসকারী কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা শহরের ডিসপেনসারির সুবিধা পায় না। তাই সরকার কিছু ডাক্তারকে প্যানেলভুক্ত করে দিয়েছে। ডাক্তার মাসচটক সেই প্যানেলের ডাক্তার। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা দেখায়, মেডিকেল বিল থেকে দশ পার্সেন্ট। কর্মচারীরা বলেন, একটু বেশি করেই খরচাটা দেখিয়ে দিন। ডাক্তারবাবু সেই অনুরোধটুকু রাখেন। কেউ কেউ আবার পুরোটাই ভুয়ো বিল করতে অনুরোধ করেন। ছোট করে এটাকে বলা হয় এফ.এম.বি.। আরও ছোট করে বা আদর করে এফ.এম.। মানে ‘ফলস মেডিকেল বিল’। একটা এফ.এম. করব বললেই ডাক্তারবাবুরা বুঝে যান।

এফ.এম-এর বাজার চলতি রেট হচ্ছে ফিফটি পার্সেন্ট। কিন্তু উনি ফর্টি পার্সেন্টই নিয়ে থাকেন। মানে, এক হাজার টাকার এফ.এম. হলে উনি নেবেন চারশো টাকা। ওষুধ দেবেন না, কিন্তু ক্যাশমেমো হয়ে যাবে। ওষুধের দোকানের সঙ্গে সেটিং আছে। ডাক্তার নিজের কমিশন থেকেই ওটা দিয়ে থাকেন। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে ডাক্তাররা ওষুধের দোকানকে দেন, নইলে উলটোটাই হয়। দুটো-একটা করে এফ.এম. কেস রোজই হয়। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের আজকাল নাকি খুব ভালো মাইনেপত্র হয়েছে। এর পরেও ওরা এমন করে কেন? অবশ্য সবাই তা করে না, কয়েকজনই ঘুরে ফিরে আসে। প্রশ্নটা মনে হতেই মনে মনে জিভ কেটে ফেলেন মাসচটক। মনে হল—’আমিও তো কম রোজগার করি না, তাহলে আমিই বা এটা করি কেন?’। ফিক করে হেসে ফেলেন মাসচটক। ও কিছু নয়। এদিকের সবাই তো করে। সব প্যাথলজি সেন্টারই তো কমিশন দেয়। ওষুধের দোকানগুলোও তো এফ.সি. করে। মানে ফলস ক্যাশমেমো আর কি। ওষুধ দিতে হয় না, শুধু ক্যাশমেমো দেয়, বদলে কমিশন খায়। অথচ প্রায় সব ওষুধের দোকানেই দেব-দেবীর ছবি থাকে। কেউ-বা রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দর ছবি রেখেও এসব করে। ও কিছু না। যে হিসেবটা হচ্ছিল, পনেরো দিনে প্রায় লাখ দুয়েক টাকা লস।

তা হোক লস। বাবার জন্য তো করতেই হবে। বাবা যদি ডাক্তারি না পড়াতেন, তাহলে কি ডাক্তার হওয়া হত? পিতার কাছে তো ঋণী। চিরঋণী। বাড়িতে তো দেয়ালে টাঙানোই আছে ‘পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমন্তপঃ/ পিতরি প্রিতিমাপন্নে প্রিয়ন্তে সর্ব দেবতা।’ ফটো বাঁধাইয়ে দোকানে রেডিমেড কিনতে পাওয়া যায়।

বাবার মৃত্যুর সময়ে বাবার শয্যার পাশে ছিলেন না মৃত্যুঞ্জয়। বাবাকে শেষ জলটুকু দিতে পারেননি। তবে মুখাগ্নি করেছিলেন। ভুগছিলেন বৃদ্ধ বয়সের রোগে। এদিকে আর জেরিয়াট্রিসিয়ান কোথায়? ওঁর বন্ধু শিবুই চিকিৎসা করছিল। শিবু মানে শিবনাথ যশ। এদিকে ও হল আদি ডাক্তার। তখন তো মোবাইল ফোন হয়নি, এদিকে সবে টেলিফোন লাইন বসেছে। টেলিফোনেই শিবুকে নির্দেশ দিত মৃত্যুঞ্জয়। ব্লাডসুগারটা ঠিক থাকছিল না। খুব বাড়া-কমা হচ্ছিল। ওষুধের ডোজটাও ঠিক করা যাচ্ছিল না। হঠাৎ হাইপোগ্লোইসিমিয়া হয়ে গেল। অজ্ঞান। শিবু ওর মোটরসাইকেল নিয়ে বাড়ি পৌঁছে একটু নুন-চিনির জল খাওয়াতে গেল চামচ দিয়ে, কিন্তু জলটা গড়িয়ে পড়ল। মানে, ইতিমধ্যেই হুট করে একটা মেজর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।

খবর পেয়েই গাড়ি নিয়েই পৌঁছে গিয়েছিলেন মৃতুঞ্জয়, সপরিবারে। সেই শ্মশান। যেখানে ওঁর ঠাকুরদা কিংবা ঠাকুরদার বাবার দেহ দাহ হয়েছে, ওখানেই বাবাকে রাখলেন।

এবার ওখানে একটা সমাধিফলক করে দিতে হবে। শ্বেতপাথরের।

বাবার আলমারি খোলা হয়েছিল পরের দিন। দলিল-দস্তাবেজ, ব্যাঙ্কের পাশবুক। পাশবুকে হাজার বিশেক মতো। বাকিটা ফিক্সড। মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গেই তো জয়েন্ট। একমাত্র সন্তান। একটা ডায়েরি পেলেন। নীল মলাট। ডায়েরিতে বেশ কিছু কবিতা। ব্রজবিহারীর একটু সাহিত্যপ্রীতি ছিল। বাড়ির কাচের আলমারিতে বাবার বেশ কিছু বই আছে। বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইন, ভূমি সংস্কার আইনের রূপরেখা, সহজ দলিল লিখন শিক্ষা, ইজি লেটার রাইটিং, ইংরেজিতে কথা বলা শিক্ষা, শ্রীকান্ত, বিন্দুর ছেলে, বিষবৃক্ষ, কবিতা কুসুমাঞ্জলি, ছড়া ও কবিতায় হোমিওপ্যাথি শিক্ষা…এরকম কত বই। কবিতার খাতাটা খুলেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। অনেক কবিতা। প্রায় ৭০-৮০টা কবিতা লিখেছেন। বাবার যে এই রোগটা ছিল মৃত্যুঞ্জয় তা বোঝেননি কখনও। ছি ছি ছি, রোগ বলতে নেই। রোগ কেন হবে। লোকে বলে বটে কাব্যরোগ, কিন্তু ওটা রোগ নয়।

কবিতাগুলি পড়ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়—

সেগুনের বহু গুণ

দাম বাড়ে বহুগুণ

শ’ খানেক সেগুন পুঁতে

সন্তান রাখ দুধেভাতে।

সত্যিই তো এক বিঘা ভাঙা জমিতে বাবা সেগুন পুঁতেছেন বিশ বছর আগে। হতে পারে শ-খানেক গাছ আছে, গোনা হয়নি। এখন প্রতিটি সেগুন গাছের দাম এক লক্ষ টাকার উপর।

একটা কবিতা—সর্বশিক্ষা।

সবার জন্য শিক্ষা চাই উঠিয়াছে রব।

নেতা মন্ত্রী জড়ো হয়ে করে মহোৎসব।

ডোম মুচির ছেলেপিলে ইস্কুলেতে যাবে,

বছর কয়েক পরেই সবাই টেরটি কেমন পাবে।

মাঠের ধান মাঠেই রবে গোলাতে আসবে না।

কি করে আনিবে বল লেবার তো পাবে না।

সত্যিই, বাবার ছন্দজ্ঞান কী সুন্দর। একেবারে তালে তালে। এবার বোঝা গেল, নিজেরও মাঝে মাঝে কবিতা কেন পায়। পুরীতে গিয়ে মনে হয়েছিল—হে সমুদ্র! তুমি কি শুধুই স্যালাইনের জল? / নাকি তোমায় আশ্রয় করে শত মৎস্য দল?—এরকম আর কি। লেখা হয়ে ওঠে না। একবার এক নৃত্যশিল্পীর পায়ের এক্স-রে দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল—

তুমি কি শুধুই অস্থি? পাটেলা, টিবিয়া?

শত ছন্দে নৃত্য কর এই অস্থি দিয়া।

অস্থির উপরে মাসল, চর্ম আচ্ছাদন

কি সুন্দর শোভা মোরা করি আস্বাদন।

অথচ এই পায়ে ধরে আর্থারাইটিস…

এরপর আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যাক গে। বাবার কবিতা লেখা ডায়রি নিয়ে কথা হচ্ছিল। ডায়েরিতে পরলোকগতা মায়ের জন্য শোক-উচ্ছ্বাস আছে। বাবার মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে মাতৃবিয়োগ হয়েছিল মৃত্যুঞ্জয়ের। বাবার চেয়ে মায়ের বয়েস পনেরো বছর কম ছিল। তার মানে মায়ের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের এখনও পনেরো বছর বাকি। এই পনেরো বছরে নিজেই একটা নার্সিং হোম করে নিতে পারবেন। নার্সিং হোমটা ওঁর মায়ের নামেই রাখবেন বলে ভেবেছেন—বিন্দুবাসিনী আরোগ্য নিকেতন।

ডায়েরিতে মেঘ, প্রজাপতি, বর্ষা, এরকম কিছু কবিতা দেখা গেল। এইগুলো হল প্রকৃতি পর্যায়। বর্ষা কবিতায় আছে—

যখন তখন নামো বৃষ্টি

আমাদের কর অনাসৃষ্টি

সবে স্প্রে করিলাম ধানগাছে কীটনাশ

জলে ধুয়ে হয়ে গেল কী যে সর্বনাশ

তবুও তোমারে পূজি হে যৌবনবতী

তুমি না আসিলে হ’ত চাষিদের ক্ষতি।

এরকম পড়তে পড়তে পড়তে একটা কবিতায় এসে চোখ আটকে গেল মৃত্যুঞ্জয়ের।

সাত বর্ষ ধরি

বহু ব্যয় করি

পুত্ররে করিনু ডাক্তার

তারই হবে গাড়ি

তারই হবে বাড়ি

শত লোকে জানিবে নাম তার

(আমি) রাখিব এ দেহ

জানিবে না কেহ

কী বা মোর ছিল অবদান

আমি ভাবি মনে মনে

ওর ডাক্তারির পিছনে

রয়েছে ক’হাজার বস্তা ধান

(যদি) ডাক্তারি না পড়িত

(মোর) জমি বেড়ে যেত

কিংবা করিতাম চাল কল

(তাই) গীতা কাছে আনি

মনে স্মরি বাণী

কর্ম কর, নাহি চাহ ফল।

এই কবিতাটাই বলা হয় মৃত্যুঞ্জয়ের আই ওপেনার। এটা পড়েই বোধোদয় হল—বাবা কতটা ত্যাগ করে, ক’হাজার বস্তা ধানের বিনিময়ে ডাক্তারি পড়িয়েছেন। সম্পত্তি একটা মোহ। সম্পত্তি একটা আত্মতৃপ্তি। নিজের ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স দেখতে, দলিলে নিজের নাম দেখতে কার না ভালো লাগে। একটা চালকল করা মানে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে যাওয়া। ওর ডাক্তারি পড়ার জন্যই তো বাবার শখটা মিটল না। কেবল জোতদার হয়েই রইলেন।

জোতদার একটা গালাগাল। আগে জমিদার, জোতদার, তালুকদার, এসব ছিল অহংকারের ব্যাপার। জোতদার-তালুকদাররা আলাদা খাতির পেত। যদিও মেডিকেল কলেজে হোস্টেলে শুনতে হয়েছে শালা, জোতদারের বাচ্চা। অথচ কৌটোয় ভরা মায়ের দেওয়া তিলের নাড়ু, নারকোল নাড়ু সব্বাইকে খাইয়েছে মৃত্যুঞ্জয়।

মৃত্যুঞ্জয়ের ঠাকুর্দা নায়েবি করতেন। নায়েবির সঙ্গে জমিদারবাড়ির পুজো-আচ্চার ভারও ওঁর ওপর ছিল। মানে, উনি নিজে বসে পুজো করতেন না, তবে সুপারভাইজারি করতেন। এটা করো-ওটা করো করতেন। নতুন জমি কেনার আগে শুভদিন দেখে দেওয়া, জমিদারকন্যার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যেন কন্যার তাঁবে থাকে সেজন্য উপযুক্ত তন্ত্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করা, এরকম নানা কাজ করতে হত। তাই জমিদার প্রসন্ন হয়ে কিছু জমি দান করেছিলেন। সেসময়ে সেটা নিষ্কর জমি ছিল। আসলে, মৃত্যুঞ্জয়ের পিতামহ ছিলেন ব্রাহ্মণ নায়েব।

স্বাধীনতার পাঁচ-সাত বছর পরই জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে গেল। নায়েবি-টায়েবি চলে গেল। জমির আয়তন সব মিলে কম ছিল না। কিন্তু ল্যান্ডসিলিং অ্যাক্ট এসে গেল। জমির একটা ঊর্ধ্বসীমা করে দিল। তিপ্পান্ন নাকি চুয়ান্ন বিঘের বেশি কেউ জমি রাখতে পারবে না। বাড়তি জমি সরকার নিয়ে নিল। যে জমিটা ছিল সেটা বাবা-কাকার মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এ-নামে—সে-নামে কিছু জমি ছিল, বামফ্রন্টের টাইমে তা-ও গেল। জমিজমার বেশিরভাগই ছিল বর্গায়। বর্গাদাররা জমি চাষ করে ভাগ দিত। একটু তেড়িবেড়ি করলে বর্গাদারদের সরিয়ে দেওয়া যেত। বর্গা রেকর্ডিং হয়ে যাবার পর বর্গাদারদের পোয়াবারো হয়ে গেল। ভাগ দিক, না-ই দিক, আর কিছু বলা যাবে না। কে আর জে.এল.আর.ওর কাছে নালিশ করতে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর পর জমিজমার ব্যাপারটা খুড়তুতো ভাইরাই দেখেছে। ওরা যা দেয়, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়কে। কিন্তু বাবার ধ্যান-জ্ঞান ছিল জমি। মুনিষ, মাইন্দর, মজুররা চাষ করত, বাবা কোলে রেডিয়োটা নিয়ে চাষ দেখতেন, আলে আলে ঘুরতেন, বাড়িতে আগে বড় গোলা ছিল, পরে একটা ধানের ঘর হয়। ধান যা হয় বেচে দেওয়া হত। এই ধানের চাল মোটা, সরু চাল বাজার থেকে কেনা হত। সাধারণভাবে থাকতেন তিনি। একটিমাত্র সিল্কের পাঞ্জাবি ছিল। অনেক বলে-টলে বাড়িতে একটা ফ্রিজ কেনানো গেল। বাবা-মা বলতেন ফ্রিজের খাবারে ভিটামিন নষ্ট হয়। ভিটামিন নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে। ডাক্তারের বাবা হয়েও ব্রজবিহারী ব্যতিক্রমী ছিলেন না।

বাবার কবিতাটা পড়ে মৃত্যুঞ্জয় বাবার দুঃখটা টের পান এবং এরপরই ভাবেন বাবার জন্য কিছু করতে হবে।

কিন্তু স্বর্গত পিতার জন্য এখন স্মৃতিরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়া আর কী-ই বা করা যায়। এতদিন সময় হয়ে ওঠেনি। সামনেই জন্মশতবর্ষ। তাই কিছু কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। যথা—(১) শ্মশানে একটা সমাধিফলক নির্মাণ, (২) ঝাপানডাঙা বিদ্যাসুন্দর বিদ্যালয়ে বছরের শ্রেষ্ঠ ছাত্রকে দেবার জন্য বাবার নামে একটা পুরস্কার চালু করা, (৩) নিজের বাড়িতেই বাবার নামে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় চালু করা (৪) জন্মশতবার্ষিকীতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। গ্রামোন্নতিতে ৺ব্রজবিহারী মাসচটকের অবদান সম্পর্কে বক্তব্য রাখবেন পঞ্চায়েতের কেউ। মৃত্যুঞ্জয় বলবেন দরদী মানুষ ব্রজবিহারী। শেষে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সমাধিফলকে কী লেখা থাকবে সেটা লেখা হয়ে গেছে—

দাঁড়াও ক্ষণকাল জন্ম যদি তব এই গ্রামে,

এখানে পঞ্চভূতে বিলীন ব্রজবিহারী নামে

মাসচটক বংশীয় ব্রাহ্মণ। গ্রামের অধিবাসীগণ

কৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁরে করিছে স্মরণ।

নিজেই লিখেছেন মৃত্যুঞ্জয়। বোঝাই যাচ্ছে কিছুটা অমিত্রাক্ষর ছন্দ ছিল।

ঝাপানডাঙা স্কুলটা এদিকের প্রাচীন স্কুল। গুড়াপ-এর জমিদারের বদান্যতায় স্কুলটা হয়েছিল। ঠাকুরদা গুড়াপের জমিদারেরই নায়েব ছিলেন।

জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটা নিয়ে ভাবতে হবে। পঞ্চায়েতের প্রধানকে বলে দিতে হবে কী কী করতে হবে। ওঁর জন্য একটা শাল কিনতে হবে। বর্ধমান থেকে কিনে আনলেই চলবে। শালির মেয়েটাকে আনা করাতে হবে। রেডিয়োতে অডিশনে ফেল করেছে বলে মন খারাপ। ফাংশানে গাইতে পারলে খুশি হবে। ও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। অন্যান্য আইটেম লোকাল ট্যালেন্ট দিয়ে হয়ে যাবে।

আর দাতব্য চিকিৎসালয়টা নিয়েই যা ঝামেলা। ওটাই প্ল্যান করে করতে হবে।

মৃত্যুঞ্জয় এখন বাড়ি পরিক্রমা সেরে দোতলায় ওঁর ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে। লোহার শিকের গায়ে নিজের গালটি লাগিয়ে লোহার শীতলতার স্বাদ নেন। লোহার শিকের গায়ে কী সুন্দর একটা গন্ধ! যেন ছেলেবেলার গন্ধ। শিকের গায়ে পাখির বিষ্ঠা শুকিয়ে আছে। কী পাখির? শালিক? কাক। টিয়াও তো হতে পারে। ছোটবেলায় অনেক টিয়া দেখা যেত। এবারও দু-চারটে দেখা গেছে। সামনের সজনেগাছে একজোড়া পাখি। চেনা, নাম মনে পড়ছে না। দুটো মুনিষ বাইরের উঠোনে বসে বাসি তরকারি দিয়ে জলভাত খেয়ে নিচ্ছে। দেওয়ালে পেণ্ডুলামের ঘড়িটায় ন’টা বাজার ঘণ্টা বাজতে শুরু করে দিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় এই সময়ে বেলঘরিয়ার চেম্বারে বসে যান। সকাল আটটার আগেই টয়লেটে ঢুকে যেতে হয়। খুব কায়দার বাথরুম। একটা বাথটব আছে। ব্যবহার হয় না। গরম-ঠান্ডা জল, বেসিনটপ, ড্রাই ফ্লাওয়ার। টলিফোন শাওয়ারটা ঘাড়ে গর্দানে বাহুসন্ধি-ঊরুসন্ধিতে ঘোরাতে ঘোরাতে বাবার শোখানো স্নানমন্ত্রটা পড়ে নেন—ওঁ কুরুক্ষেত্রং গয়া গঙ্গাং প্রভাস পুষ্করাণি চ তীর্থন্যেতানি পুণ্যানি স্নান কালে ভবন্থি হ। আগে পুকুরে স্নান করার সময় পড়তে হত। ওই যে পুকুরটা। পানায় ভরেছে। শাপলাও আছে। স্নানটা সেরে, জানলার দিকে তাকিয়ে ফট করে সূর্যপ্রণামটা সেরে নেন মৃত্যুঞ্জয়। স্নান সেরে কালী, বাবা-মার ছবিতে মালা দেন, ড্রেস করেন, ব্রেকফাস্ট করেন, এবং বেলঘরিয়ার চেম্বার। বাড়ি ফিরতে আড়াইটে-তিনটে বেজে যায়। বাড়িতে সন্ধের পর বসেন রোজই।

লুচির ভাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘিয়ের। ব্রেকফাস্ট তৈরি হচ্ছে। সরি, ব্রেকফাস্ট নয়, জলখাবার। দেশের বাড়িতে জলখাবারই তো।

ঘোলায় বাড়িটা করার আগে বেলঘরিয়াতে বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন মৃত্যুঞ্জয়। হাউসস্টাফশিপের পর বেলঘরিয়া জুট মিলের ডিসপেনসারিতে চাকরি হল। সকালে চাকরি, বিকেলে প্র্যাকটিস। এরপর এদিকেরই বাসিন্দা হয়ে গেলেন মৃত্যুঞ্জয়। কলকাতার কাছাকাছি ফ্ল্যাট কিনতেই পারতেন, কিন্তু এদিকের প্র্যাকটিস ক্রমশ জমে উঠেছে। ঘোলার দিকে একটা বারো কাঠা জমির প্লট পেয়ে গেলেন। কয়েকটা আম-কাঁঠাল-নারকেলগাছ সমেত। গ্রামের ছেলে। খুপরি ফ্ল্যাটে মন ওঠে না। ওখানেই মনের মতো বাড়ি। দোতলায় দু-পাশে দুটো বারান্দা। বারান্দা নয়, ব্যালকনি। একতলায় ড্রাইভার এবং সারভেন্ট এবং গ্যারেজ। দোতলায় চারটে বেডরুম, এছাড়া ঠাকুরঘর, ডাইনিং, লিভিং।

শ্যালো পাম্পের ডিগ ডিগ ডিগ শুরু হল। এই শব্দটা এখনও নতুন লাগে। ছোটবেলায় এই শব্দটা ছিল না। পিঠে সিলিন্ডার বেঁধে হাতে পাইপ নিয়ে দুজন লুঙ্গি-পরা মুনিষ। পোকা মারার ওষুধ ছড়াবে। এই দৃশ্যটাও ছোটবেলায় ছিল না। একটা মাছরাঙা পাখি ছুঁয়ে গেল জল, জল কেঁপে উঠল। বহু পুরোনো ছবি, পুরোনো হয় না। কাঁঠালগাছটার গা বেয়ে একটা কাঠবিড়ালি উঠছে। কাঠবিড়ালি চিরকাল ব্যস্তই থেকে গেল। নারকেলগাছের মাথায় একটা ঘুড়ি আটকে বাতাসে কাঁপছে। ডাক্তারবাবু ছবি দেখছেন। কিন্তু ছবি দেখলে চলবে কেন? কত কাজ বাকি। জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। দাতব্য চিকিৎসালয়ের চেয়ার-টেবিল অর্ডার দিতে হবে। বাড়িটায় চুনকাম। বিকেলে ডাক্তারের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলতে হবে। দাতব্য চিকিৎসালয় হচ্ছে, অথচ ডাক্তারই ঠিক হল না এখনও…।

ঝাপানডাঙায় ওদের বাড়ি থেকে গুড়াপ প্রায় তিন কিলোমিটার। এখানেই ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টার। হালে একটা নার্সিংহোম হয়েছে এখানে। মা তারা নার্সিং হোম। দুটো ওষুধের দোকান, ওখানে ডাক্তার বসে। এখন বহুত নতুন কথার আমদানি। রুগিকে বলে পেশেন্ট। পথ্যকে বলে ডায়েট। গর্ভপাতকে এম.টি.পি। গুড়াপে একটা বহুদিনের পুরোনো হাট আছে। মঙ্গল-শুক্র হাটবার। আগে হাটবার ছাড়া অন্য দিন বাজার বসত না। আজকাল রোজই বাজার বসে। গুড়াপ অঞ্চলের কলা বেশ বিখ্যাত। এটা হুগলি জেলার শেষ, একটু পরই বর্ধমান জেলা শুরু। হাটবারে কলা পাইকারি বেচা-কেনা হয়। এই হাটেই মৃত্যুঞ্জয়ের ছোটবেলার বন্ধু তারক গড়াইয়ের চেম্বার। ওর চেম্বারের ওপর বেশ বড় বোর্ড, ওখানে রেডক্রস, তারপর ওর নাম। ডা. টি.কে. গড়াই। আর.এম.পি। ডানদিকে একটা স্টেথোস্কোপের ছবি। এই ছবিটা দেখলে হঠাৎ কুণ্ডলি হয়ে থাকা সাপ ভাবা অস্বাভাবিক নয়।

মৃত্যুঞ্জয়কে দেখেই তারক ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন।—’আরে আরে তুই? আয় আয় আয়। কী সৌভাগ্য।’ ডাক্তারের পিছনে নাড়িভুঁড়ির ছবি। তলায় ইংরেজিতে লেখা—ডাইজেস্টিভ সিস্টেম। একজন রুগি, রুগি তো নয়, পেশেন্ট টুলের ওপর জিভ বের করে বসে আছে। তারক ডাক্তার বললেন—জিভ এবার জিভের জায়গায় যাক। অন্য রুগিদের দিকে তাকিয়ে বললেন—চিনঅ? চিনঅ ইনাকে? ঝাপানডাঙার জীবন ডাক্তার। মস্ত ডাক্তার। কলকাতায় থাকে। আমার নেংটাবেলার বন্ধু।

তারক তো মৃত্যুঞ্জয়কে ওঁর ডাকনামেই ডাকে।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন, তোর কাছে একটা মতলব নিয়ে এসেছি তারক। বাড়িতে বাবার নামে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করব। তার জন্য একটু শলাপরামর্শ করব।

অপেক্ষারত রুগিদের বললেন—একটু বসতে হবে। একজন বড় ডাক্তার এয়িচেন, ওঁর সঙ্গে প্রাইভেট কথা আছে।

তারক বললেন—চ’, ভিতরে চ’।

ওঁর বসার জায়গার ডানদিকে একটা টুল, তার পিছনে একটা বেড। আর ডানদিকে একটা ঘর। ঘরের সবুজ দরজা ভেজানো। দরজার গায়ে কালো অক্ষরে লেখা আছে—অপারেশন থিয়েটার।

ডা. মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলেন ডা. তারক।

এই ঘরে একটা বেড। দেয়ালে একটা সুন্দরীর মুখ, কিন্তু দেহে কোনও চামড়া নেই। হার্ট-লাং-লিভার-কিডনি-ইনটেসস্টাইন-ইউরেটাস সব দেখানো আছে। এ-ছবি দেখলে কাঞ্চনে না হোক, কামিনীতে বিতৃষ্ণা আসতে পারে। বেডের ওপর ঝুলছে একটা শেড দেওয়া আলো। স্যালাইন অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। জল ফোটানোর ব্যবস্থা এবং একটা সাদা কলাইকরা ট্রে-র ওপর ছুরি, কাঁচি, সন্না ইত্যাদি কিছু যন্ত্রপাতি আছে। ফোঁড়াটোড়া কাটা, অর্শের বলি ফাটানো, কেটে গেলে সেলাই করা, খুব দরকারে এম.টি.পি. যাকে গ্রাম্যভাষায় পেটখসানো বলে।

অপারেশন টেবিলের ওপরে বন্ধুকে বসালেন তারক। নিজে টুলে বসলেন। বললেন, পাক্কা তিন বছর পর দেখা। বাড়িতে আসিস না? মৃত্যুঞ্জয় বলেন, বাবা চলে যাবার পর আসা-যাওয়া কমে গেছে। এসেছি যাহোক—কিন্তু তোর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।

তারক বলে—আরে তুই আসবি কেন বস? জানলে আমিই দেখা করে আসতাম। যাক গে, তোর ছেলের খবর বল। এমবিবিএস তো পাশ করে গেছে…।

—হ্যাঁ। তোদের শুভেচ্ছায়। চণ্ডিগড়ে এমডি করতে গেছে। ডার্মাটোলজিতে।

—কেন ডার্মা কেন? স্কিনের ডাক্তার হয়ে কী হবে? এখন হল হার্টের বাজার। ক্যানসারের বাজারটাও বেশ খুলেছে।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—আমার ছেলের হচ্ছে গে সুখী নেচার। ওর মায়ের জন্য এমন পানা হয়েছে। একটাই তো নিধি। খাইয়ে দিলে ভালো। ওইজন্যই চামড়ায় দিলাম। ছেলে ঘুমোতে বড় ভালোবাসে।

—ঘুমের সঙ্গে চামড়ার কী কানেকশন? তারক জিজ্ঞাসা করেন।

—আরে চামড়ার ডাক্তারকে রাতে কেউ ডাকে না। রাতবিরেতে চামড়ার রুগির ক্রাইসিস হয় না। আর চামড়ার রোগ সারে না, রুগি একবার এলে দু-তিন বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। তাছাড়া যদি চাকরি করতে হয়, হুজ্জোতি হবে না। পেশেন্ট পার্টি ইট ছুড়বে না। কারণ চামড়ার রুগি মরে না।

তারক নিঃসন্তান। মাঝবয়েসে ওর ছোট শালির মেয়েকে ঘরে এনে বড় করে বিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করে, তোর মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ভালো তো?

—আরো মেয়েকে তো ওরা মাথায় তুলে রেখেছে। জামাইয়ের দুটো বাস, দুটো টাটা সুমো খাটে। কিন্তু বাড়িতে আগে চাউ ঢোকেনি। মেয়ে তো চাউ, পাস্তা-ফাস্তা, পুডিং আরও সব রকমারি আইটেম বানায়। টিভি দেখে শিখেছে তো।

—চেম্বার কেমন চলছে? মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করেন।

গড়াই একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছাড়ার ভিতরে ক্ষোভ। ডাউন। বাজার একেবারে ডাউন। একটা নার্সিং হোম হয়েছে, দিনের বেলায় আবার স্পেশালিস্ট সেন্টার। বর্ধমান থেকে ডাক্তার আসছে। দুটো ওষুধের দোকানে ডাক্তার বসছে। গণ্ডাখানেক হোমিওপ্যাথ ছিটিয়ে আছে। তার ওপরে বড় বিপদটা হল হেলথ সেন্টারে এখন ডাক্তার থাকে। কত রুগি আছে এধারে আট-দশটা গাঁয়ে? গরিবরা সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছে, বড়লোকরা নার্সিং হোমে। আমার কাছে রুগি আসবে কেন আর?

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—আমিও শুনেছি হাসপাতালে ডাক্তার থাকে। এজন্যই মনে হল তোর চেম্বার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাইরের বেঞ্চিগুলো ভর্তি থাকে অন্য সময়।

তারক বলেন—আগের দিন হলে কি এসময়ে তোর সঙ্গে গপ্পো করতে পারতাম? দুপুরে গিয়ে তোর সঙ্গে দেখা করতাম।

মৃত্যুঞ্জয় কপাল কুঁচকে বলেন—তো ডাক্তার থাকে যে বড়? কেন?

তারক বলেন—কে জানে কী মধু এখানে? লেডি ডাক্তার। কোয়ার্টারেই পড়ে থাকে।

—কুমারী?

—কুমারী-টুমারী কিনা কী করে বলব? তবে যদ্দূর জানি বিয়ে হয়নি। তবে আজকাল বিয়ে হলেও বোঝা যায় না। শাখা-সিঁদুরের পাট তো উঠে গেছে। আমার মেয়ে কিন্তু শাখা-সিঁদুর পরে। এই হাসপাতালের নতুন ডাক্তার খুব স্টাইলে থাকে। ব্যাটাছেলেদের মতো ড্রেস পরে। শুনেছি নাকি সিগারেটও খায়।

—খেলুড়ে?

—আমি কী করে জানব? খেলতে গেছি নাকি? তারকের চোখে কারুকাজ।

তারকের জন্য মৃত্যুঞ্জয়ও চিন্তিত।—চিরকাল শুনে আসছি হেলথ সেন্টারে ডাক্তার থাকে না, থাকলেও সপ্তাহে দু-তিন দিন। হাটবারের মতো। লোক সেই দিনগুলোতেই আসে। এর কী হল যে এখানে পড়ে থাকে!

—হ্যাঁ ভাই। শুনেছি ওর ঠাকুর মাকেও এখানে নিয়ে এসেছে।

মৃত্যুঞ্জয় বলেন—চিন্তায় ফেললি। তাহলে কি আমার দাতব্য চিকিৎসালয়ে রুগি হবে না?

তারক বললেন—তা হবে না একদম তা কেন? গুড়াপ থেকে ঝাপানডাঙা তো তিন কিলোমিটার দূর। আজকালকার লোক হাঁটতে চায় না। অলস হয়ে গেছে। সব কাছাকাছি চায়। তোদের ওই দিকের কিছু লোকজন নিশ্চয়ই যাবে। তাছাড়া এই দিদিমণি কি চিরকাল থাকছে নাকি?

—ঠিক কথা। মৃত্যুঞ্জয় বলেন। লোক আসবে না হতেই পারে না। প্রতিটি মানুষের রোগ। ভালো ডাক্তার পেলে রুগি হবেই। ওখানে ডাক্তার কাকে রাখা যায়, এ নিয়ে পরামর্শ করতেই এইচি। আমাদের গাঁয়ের অশ্বিনী রেলে কাজ করত, ডাকযোগে হোমিওপ্যাথি পাশ দিয়েছে। বলেছিল দাতব্য চিকিৎসালয় করলে ও বসবে। আমি ওকে কিছু ধরে দেব, ওষুধপত্র যা লাগে দেব। এখন অশ্বিনী বলছে—রিটায়ার করেচি, শিবাইচণ্ডীতে ভগ্নীপতির সারের দোকান আছে। ওই দোকানের বারান্দায় নিজের চেম্বার দেব ভাবচি। এখানে সন্ধের পর বসতে পারি। সন্ধেতে বসাব কেন? একে হোমিওপ্যাথি, তা-ও ডাকযোগে। তাতেই পোঙায় এত রস। ওকে আর রিকোয়েস্ট করব না। এধারে যারা বসে তাদের কাউকে রাজি করাতে পারবি কি? মাসে মাসে কিছু দেব।

তারক বললেন—মনে হয় না ওরা কেউ যাবে। তবে আমি তো এখন সমিতির প্রেসিডেন্ট, বলে দেখতে পারি।

—সমিতি? ডাক্তাররা সব মিলে অ্যাসোসিয়েশন করেছিস বুঝি?

—না, ওটা গুড়াপ হাটতলা ব্যবসায়ী সমিতি।

—ব্যবসায়ী সমিতির মধ্যে ডাক্তার?

—অবাক হবার কী হল? ছোটবেলায় রচনা বইতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিল। ওখানে লেখা ছিল তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরাও কি চিকিৎসা ব্যবসায়ী না?

—ও। এর বেশি কিছু বললেন না মৃত্যুঞ্জয়।

তারক আবার বলতে লাগলেন—প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটু রিকোয়েস্ট করতে পারি। একটা নোবেল কাজে অংশ নেওয়া…। তবে গ্যারান্টি দিতে পারব না ভাই। ওরা এটা-ওটা বলে ঠিক কাটিয়ে দেবে। নোবেল কাজ ঠিক আছে। আমি তো ওটাই বলব। কিন্তু ঘরের খেয়ে বনের মোষ….।

মৃত্যুঞ্জয় বলেন—তা হলে কি আমার স্বপ্নটা ইয়ে হয়ে যাবে? আমার পক্ষে তো এসে সম্ভব নয়, ভেবেছিলাম বাবার স্মৃতিতে একটা দাতব্য চিকিৎসালয়….বাবা খরচাপাতি করে ডাক্তারিটা পড়িয়েছিলেন…।

তারক বললেন—এক কাজ কর। উদ্বোধনটা করিয়ে দে। উদ্বোধনটাই আসল। উদ্বোধনের পর তো কত কিছুই বন্ধ হয়ে যায়..। আমিও দেখছি কী করা যায়।

একটু আশার আলো দেখতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়। ও হয়তো এবার বলবে—আমিই না হয় বসব’খনে হপ্তায় দুদিন…। আসলে এটাই তো বলতে চেয়েছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। এখানে আসার উদ্দেশ্য তো তাই। মৃত্যুঞ্জয় আশা করেছিলেন তারক নিজে থেকেই বলবে—ডাক্তার নিয়ে ভাবছিস কেন? আমি তো আছি। কিন্তু বলল না তো। মৃত্যুঞ্জয় নিজে থেকেও বলতে পারছেন না, কারণ একটা কাঁটা রয়ে গেছে ওর জীবনে।

তারক আর মৃত্যুঞ্জয় একই ক্লাসে পড়ত ক্লাস এইট অবধি। তারপর তারক পিছিয়ে পড়ে। তারক আর মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। তারক মৃত্যুঞ্জয়কে ডাকনাম জীবন বলেই ডাকত। তারকের মায়ের হাতের মাছের টক খেয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়, আবার মৃত্যুঞ্জয়ের মায়ের হাতের পায়েস খেয়েছে তারক। একই গ্রামে বাস। দুজনেরই অ্যাটলাস সাইকেল, ঝাপানডাঙার চড়কের মেলায় একইসঙ্গে কালো চশমা কিনেছে দুজনে, লুকিয়ে সিগারেট। তারকের বাবার এনামে-ওনামে বাষট্টি বিঘে জমি, মৃত্যুঞ্জয়ের বাবার ভাগে আটচল্লিশ বিঘে। দুই পরিবারই যথেষ্ট সম্পন্ন গৃহস্থ। হয়তো তাই ওদের মধ্যে যথেষ্ট ভাব

গ্রাম ছিল কী সুন্দর ফুলে ফুলে অলি,

বিষে বিষে শেষ ওরা, গ্রামে দলাদলি

মানুষে মানুষে ছিল ভাই ভাই ভাব

কতই শান্তি ছিল, যদিও অভাব

মান্যজনে মান পেত, গরিব পেত দয়া,

বললে লোকে কথা শুনত, করিত না তর্ক…

মিলল না। না মিলুক গে। বহুদিন পরে অন্তরে কেমন কাব্য জেগেছে। কাব্যের প্রজাপতি। চেম্বারে চেম্বারে প্র্যাকটিসের ব্যস্ততায় এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রজাপতি শুঁয়োপোকা হয়েই থাকে।

সেগুনের একটা হলুদ পাতা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ঠিক মৃত্যুঞ্জয় মাসচটকের কোলে এসে পড়ল। দু-পাশের রাস্তায় এবার সামাজিক বন। দু’-একটা সেগুন আর সব আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস। মনের মধ্যে কী একটা হচ্ছে। কাব্য কাব্য ভাব, ছন্দের অভাব। বমি আসব আসব করছে অথচ হচ্ছে না টাইপের। কবিতা পাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না। অনেক রোগের মতোই কাব্যরোগও বোধহয় জেনেটিক। বাবার ছিল, এটা আগে জানা ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর নীল মলাটের ডায়েরিটার খোঁজ না হলে জানাই যেত না। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের গোয়ালঘরে কী একটা বই পেয়েছিলেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ছিল। চর্যাপদ, চর্যাপদ। ওটা না পেলে জানা যেত, বাংলা ভাষা কত পুরোনো? পরে, একটা সুটকেসে আরও সব পুঁথি আবিষ্কার করেছেন মৃত্যুঞ্জয় যা ব্রজবিহারীর সাহিত্যপ্রীতি প্রমাণ করে। যথা—রাই উন্মাদিনী, পাষাণের কান্না, প্রেমের আলেয়া, বাৎসায়ন ঋষির উপদেশ, যাবার বেলায় পিছু ডেকো না…। এই গ্রন্থসমূহকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুনিষ ডাকিয়ে আম-বকুলের পোকামারার ওষুধ মেটাসিড স্প্রে করিয়েছিলেন।

যেদিন উদ্ধোধনটা হবে, সেদিন যে বক্তৃতা দেবেন, সেটা কাব্যে বললে কেমন হয়? অনেকটা এরকম—

পিতঃ, বহু ঋণে বেঁধেছ আমারে

সাধ্য নাই পিতৃঋণ শোধ করিবারে

তুমি ছিলে মহাপ্রাণ, পুত্রবৎসল…।

তারপর, এই নীল আকাশের নীচে, অনন্ত চরাচর ব্যাপী সবুজে সহজ সত্য কথাটা বুকের ভিতরে এল—লইয়াছি কত টাকা করি কত ছল।

কিন্তু এটা কি প্রকাশ্যে বলা যায়?

মৃত্যুঞ্জয়ের পুরোনো কথা মনে পড়ে। কত টাকা কতভাবে উড়িয়েছে। অনসূয়া, বনশ্রী, আলপনাদের কথা মনে এল। অচিন্ত্য, সর্বজিৎ, পিনাকীদের কথাও। মেট্রো, লাইস হাউস, অনাদি কেবিন। থার্ড ইয়ারের পর মোকাম্বো, অলিম্পিয়া…। যাক কে। ওসব নিতান্তই প্রাইভেট। এরপর—

তুমি যবে শয্যা নিয়া ডাকিতেছ মোরে

আমি মূঢ় মোহগ্রস্ত প্র্যাকটিসের ঘোরে।

এটা অনুতাপ।

বেশ হচ্ছে তো। এই রিকশাতে বসেই তো বেশ হচ্ছে। বাড়ি গিয়েই লিখে নিতে হবে।

এমবিবিএস পাশ করার পর প্রথম চাকরিটার সঙ্গে সঙ্গেই তো প্র্যাকটিস। চার টাকা ফি। ডাক্তারির কী-ই বা জানা ছিল তখন। জ্বর-জারি পেট খারাপ। খারাপ কিছু বুঝলেই সুধাংশু ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া, বুক কিংবা ফুসফুসের কিছু বুঝলেই আরএন চ্যাটার্জি। উনি তো বেলঘরিয়াতেই থাকতেন। আস্তে আস্তে ডাক্তারি শিখেছেন মৃত্যুঞ্জয়। কিংবা পয়সা রোজগারের নানা কায়দা তাড়াতাড়িই শিখে নিতে পেরেছেন।

রিকশাওয়ালাটি বলল, হাসপাতালে কার জন্য যাবেন?

মৃত্যুঞ্জয় বললেন, নিজের জন্য।

আপনার কী রোগ?

কঠিন প্রশ্ন। রিকশার টায়ারের সঙ্গে রাস্তার মোরামের কথা হচ্ছে খরখর-খরখর। আমার একটু হাইপার টেনশন। বি.পি. হান্ড্রেড বাই ওয়ান ফিফটি। ওষুধ খেয়েও। একটু ইসেনোফিল বেশি। একটু কুশিং সিনড্রোম, একটু ডারমাটো মাওয়াসাইটিস, একটু এনলার্জড প্রস্টেট, চোখের নীচটা ফোলা ফোলা, লোকে ভাবে খুব মাল খাই। কিন্তু বড় রোগটা হল শান্তি পাই না। কিছুতেই শান্তি নাই রে ভাই…। সবটাই মনে মনে বললেন মৃত্যুঞ্জয়। রিকশার চাকার সঙ্গে রাস্তার মোরামের খরখর…।

রিকশাওয়ালাটি বলল—ওই যে হাসপাতাল।

আর পাঁচটা গ্রামীণ হাসপাতাল যেমন হয়, এটাও তেমনই। লাল ত্রিকোণের ছবির দুই পাশে স্বামী-স্ত্রী, মাঝখানে সন্তান। ত্রিকোণের মাঝখানে পোস্টার বকেয়া ডি.এ. দিতে হবে। পোলিওর টিকা…এডস…স্তন্যদুগ্ধ…। সামনে দুটো চায়ের দোকানের গুমটি, ওখানে পাউরুটি-আলুর দম, দুটো কুকুর, সিঁড়িতে পানের পিক, যেমন হয় আর কি। তবে একটু পরিষ্কার। কোথাও গজ-তুলো পড়ে নেই, সামনে একটাও শুয়োর নেই। হাসপাতালের ভিতরে ফিনাইল-লাইজল মেশানো গন্ধ। লম্বা বারান্দায় পর পর ঘর। একটা বড় ঘরের সামনে আউটডোর লেখা।

এখন বেলা ক’টা? একটা চল্লিশ। হাসপাতালে বেশ ভিড় আছে এখনও। আউটডোরের ভিতরে টেবিলে দুজন। একজন নার্স সাদা পোশাকে। একটা কমবয়সি মেয়ে, তিরিশের কমই তো মনে হয়, রোগা পাতলা, সালোয়ার কামিজ পরা, রুগি দেখছে। টুলে বসা একটা মেয়ের চোখের তলা উলটে দেখল, জিভ দেখল। ওর হাতে, কনুই-এর ওপর চার-পাঁচটা মাদুলি, শিকড়। ডাক্তার দিদিমণি বলল, তোমার চেয়ে তো তোমার এসব গয়নার ওজন বেশি। বড়িগুলো খেয়ো, খাবারের পরে দু’বার, আর মাছ-টাছ হলে স্বামী আর ছেলের পাতে সব না দিয়ে নিজেও খেয়ো। একদম সমান সমান ভাগ, বুঝলে?

মেয়েটা জিভ বের করে দাঁতে কাটল। মানে—ছি ছি, এমন কথা বলে?

এবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চোখ পড়ল লেডি ডাক্তারের। এরকম চেহারার কোনও রুগি তো আসে না, নেতারা তো ডেকে পাঠান। সারপ্রাইজ চেকিং করছে নাকি কোনও নেতা বা মন্ত্রী? ও বোধহয় এখন দেখতে অনেকটা ওদের মতোই হয়ে গেছে। চোখের তলাটা ফোলা, গলায় তিনটে ভাঁজ, ভুঁড়িটাও হয়ে গেছে…।

মেয়েটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছু বলবেন স্যার?

মৃত্যুঞ্জয় বলেন—আমি একজন ডাক্তার। কাছেই ঝাপানডাঙায় আমার বাড়ি। এখন অবশ্য কলকাতায় প্র্যাকটিস করি। আপনার সঙ্গে একটু দরকার। পার্সোনাল।

মেয়েটি বলে—একটু ফাঁকা হয়ে নি, কেমন?

একজনকে ডেকে বলে, অনিল, এঁনাকে আমার ঘরে বসাও।

মৃত্যুঞ্জয়ের ইচ্ছে করছে এখানে থাকতে। বহুদিনের পুরোনো স্মৃতি উড়ে আসছে। ওঁর সেই জুট মিলের ডিসপেনসারি। তবে ওটা ঠিক এরকম নয়। এরকম গ্রামীণ হাসপাতালে অবশ্য কখনও কাজ করেনি।

মৃত্যুঞ্জয় বলেন—ওখানে একা বসে কী করব? এখানেই থাকি?

—থাকবেন? থাকুন। একটা চেয়ার নিয়ে এসো অনিল…। এখানে থাকে, সেটা খুব একটা মনঃপুত হল না মনে হল।

জবা দলুই…। ডাকল ম্যাডাম। অনিল ওই নামটাই আবার। এক মহিলা এল, কোলে বাচ্চা। বাচ্চাটার বয়স বছর খানেক হবে।

—কী হয়েছে?

—বাচ্চাটা হাগছে না।

—ক’দিন?

—তিন দিন।

—আগেও এমন হয়েছে? দু’-এক দিন পরপর হাগে, নাকি রোজই?

—ওজই তো হাগে। কিন্তু ক’দিন পরে পাদলা হাগছিল, তখুন ওষুদের দোকানে গে বল্লাম তো এই ওষুদটা দিল।

একটা ওষুধের রুপোলি মোড়ক দেখাল মেয়েটা।

ম্যাডাম কপাল-কুঁচকে দেখল। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হয় নরফ্লকস-টি। বাচ্চার মাকে জিজ্ঞাসা করল—ক’টা খাইয়েছ?

—দুইটা।

ওই দোকানে গিয়ে বলো—আটকে গেছে, কী করবেন করুন। পেট খারাপ হলে নুন-চিনির জল। এইটুকু নুন, দু-চিমটি চিনি, বারবার। পাশের টেবিলে শুইয়ে দেয় বাচ্চাটাকে। তলপেট টিপে দেখল। ম্যাডাম বলল, অনিল, প্যানটা নিয়ে এসো। নার্সকে বলল, গ্লাভসটা বার করুন। নার্স জিজ্ঞাসা করল, ডুস দেবেন? ম্যাডাম বলল—মনে তো হল স্টুল খুব একটা হার্ড হয়নি। অন্য একটু বুদ্ধি করে দেখি..।

আউটডোরের ঘরটা বেশ বড়সড়। অনিল প্যান নিয়ে এল, কলাই করা। ম্যাডাম মেয়ের মাকে নিয়ে এক কোণে গেল। গ্লাভস পরে নিল হাতে। প্যানের দু’পাশে বাচ্চাটার দুটো পা টেনে নিল। বাচ্চাটার মাকে বলল ধরে থাকতে। ম্যাডাম নিজেও মেঝেতে একটা কাগজ পেতে বসে গেলেন। গ্লাভস-এর উপর দিয়েই মাঝের আঙুলটায় ভেসেলিন মাখিয়ে আঙুলটা গুহ্যদেশে প্রবিষ্ট করিয়ে দিল, বোধহয় নাড়ল, স্কুপ করল। একটা শক্ত গুটলি বেরিয়ে এল। গুটলিটা বেরিয়ে যাবার পরই বাচ্চাটার পায়খানায় প্যানটা প্রায় ভরে গেল। এবার ওর মাকে বলল—হাসপাতালের পায়খানায় গিয়ে এগুলো ঢেলে এসো, আর ওখানে জল আছে। ভালো করে ধুয়ে দিও।

মৃত্যুঞ্জয় দেখল এখনও বাইরে দশ-বারোজন রয়েছে। ক্ষিধেটাও পেয়েছে। বাইরের পাউরুটি-আলুরদম চলবে না। দু-চারটে বিস্কুট খেয়ে নিয়ে আজই ব্যাপারটা ফয়সলা করে নিলে ভালো। যদি রাজি না হয়, তাহলে তো মিটেই গেল। তখন অন্য ভাবনা।

এবার বাচ্চাটার নাম জিজ্ঞাসা করল ম্যাডাম। টিকিট হবে। আগেই তো টিকিট করার ছিল।

বাচ্চার নাম কী?

বাজাজ দলুই।

বাজাজ?

আজ্ঞে।

এমন নাম তো শুনিনি? বাজাজ তো ফ্যান হয়, গিজার হয়—জল গরম করার।

ট্যাকটরও হয় আজ্ঞে।

হ্যাঁ, ট্র্যাক্টরও হয়। ম্যাডাম বলে। তো ট্র্যাক্টরের নামে ছেলের নাম রেখেছ?

জবা বলে, আমি না, ছেলের বাপ।

য্যাখন কর্তাবাবু ট্যাকটর কিনল, তারপর দিন ও জন্মাল। ম্যাডাম কী বুঝল কে জানে, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় ভূস্বামী ঘরের ছেলে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝে নিল ব্যাপারটা। এই বাচ্চাটির বাবা নিশ্চয়ই কোনও জোতদারের বাঁধা মুনিষ। বাবুবাড়ির সুখ-দুঃখই বাঁধা-মুনিষের সুখ-দুঃখ হয়। বাবুরা হয়তো আগে ট্রাকটর ভাড়া করে কাজ চালাত। ট্রাক্টর কিনল, সেই সুখে বাঁধা মুনিষ নিজের ছেলের নাম ট্রাক্টরের নামে রেখে দিল।

একটা বাড়িতে রতন টাটাও ছিল। দুই ভাই—রতন বড় ভাই, টাটা ছোট ভাই। টাটা কোম্পানির কোনও চাষের যন্ত্রের নামের নাম দেখা গেছে। পুলিশ, দারোগা এসব নামও হয়। এরা সব অপূর্ণ ইচ্ছে।

এবার একটা সাপে-কাটা কেস। সেরেছে। কোনও কথাই তো বলা যাবে না।

একটা ভ্যানে করে একটা বউ। ভ্যানওয়ালা আর একজন একটা চাদরে শুইয়ে চাদরটাকে স্ট্রেচার বানিয়ে নিয়ে এসেছে। সঙ্গে আর একজন মাঝবয়সি। মুখে দাড়ি।

লোকটা বলল, চিতি সাপ।

কী করে বুঝলেন? ম্যাডাম বললেন।

আমি তো ওঝা। বুঝি।

ওঝা! ঝাড়ফুঁক না করে এখানে এলেন যে বড়।

ওঝা বলে, সে একটু করিচি। কিন্তু ওতে কিছু হয় না। বিষ কম থাকলে ভালো হয়ে যায় অনেক সময়, আমাদের কারিকুরি কিছু নাই, যা করি, মনের সান্ত্বনা।

সত্যি অবাক হয় মৃত্যুঞ্জয়। গ্রাম এতটাই পালটে গেছে নাকি? কী করে হল? বিজ্ঞান আন্দোলন? এটা আগে ছিল, এখন কই? এসব কি আগের এফেক্ট? তাই বলে কি ন্যাবার মালা নেই? মসজিদে পানিপড়া নেই? অত তাড়াতাড়ি যায় না।

ওঝাটি বলল—হালকা করে বাঁধন দিয়েছি। ঠিক আছে না!

ম্যাডাম বলে, একদম ঠিক। ম্যাডাম নাড়ি দেখছে। বলছে ঠিক সময় এনেছ। অ্যান্টি ভেনাম আছে এখানে।

মানুষের মানসিকতা কি এগিয়েছে তা হলে? তাহলে যে এতগুলো চ্যানেলে জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বশীকরণ, ফেংশুই, বাস্তুবিদ…। এদের বিচিত্র পোশাক, গলায় সোনার হার। এদের নাকি অনেক আগে থেকে বুকিং করতে হয়। এরা নাকি বিএমডাবলু গাড়ি চড়ে। কাদের পয়সায়? এইসব মানুষই তো ওদের পয়সা দেয়। কোন মানুষ? শহুরে মানুষেরা। শহরের লোক কি তবে বেশি কুসংস্কারগ্রস্ত? কে জানে? এই একটা ঘটনা দিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তা ছাড়া সংস্কার-কুসংস্কার হল কি বলে রিলেটিভ ব্যাপার। নিজের আঙুলের দিকে নজর পড়ে। দুটো পাথর। পাথর তো নয়, রত্ন। গোমেদ আর প্রবাল। প্রবাল মঙ্গলের জন্য, আর গোমেদ কীসের জন্য যেন মনে নেই। গুপ্ত শত্রু যাতে ক্ষতি করতে না পারে ওই জন্যে। না-না, ওই জন্য তো কি একটা যন্ত্রম দিয়েছিল। এসব গিন্নীর ব্যাপার। গোমেদ বোধ হয় ব্লাড সার্কুলেশনের জন্য। কে জানে কী কাজ হয়? উপকার হোক না হোক, ক্ষতি তো নেই…।

ম্যাডাম পেশেন্টকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। বেড-এ। মৃত্যুঞ্জয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল, গুডলাক।

এবার আর মৃত্যুঞ্জয়ের কাজ নেই এখানে। যে কথা বলতে এসেছিলেন সেটা হাসপাতালের ব্যস্তুতার মধ্যে বলা সম্ভব নয় বোঝাই গেল। বাড়িতে গিয়ে সন্ধের পরে বলতে হবে। হাসপাতালের বাইরে কয়েকটা ছোট বাড়ি, কোয়ার্টার যেমন হয়। ম্যাডাম কি কোয়ার্টারেই থাকেন! হাসপাতালের একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যুঞ্জয়। জানলেন—কোয়ার্টার ভাঙাচোরা, ছাত থেকে জল পড়ে, আর একটু এগিয়ে হেলাবটতলার পাশে নতুন পাড়া, ওখানে রতন বিশ্বাসের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। ডাক্তারের নাম ইন্দ্রাণী রায়। এবার আর কী কাজ। চলে গেলেই হয়। সাপে-কাটা মেয়েটার বাড়ির লোকজন বসে আছে সিঁড়িতে। বাইরে একটা রিকশাও দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করল না। কী মনে হল শেষটা দেখেই যাওয়া যাবে। কী আশ্চর্য কাণ্ড, সাপে-কাটা মেয়েটার আত্মীয়দের মতো অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করল, এবং বুকের ভেতরে রহস্যময় কেউ বলছে বাঁচবে তো বাঁচবে তো? মৃত্যুঞ্জয় বলছেন, দেখা যাক, দেখা যাক। মৃত্যুঞ্জয় আকাশে মুখ তোলেন। মেঘ ভাসছে। যেন মেঘকেই বললেন, যেন বাঁচে। আসলে ঈশ্বরকেই বললেন।

মৃত্যুঞ্জয় রিকশায় উঠলেন না। চায়ের দোকান একটা বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যটা বন্ধ করার তোড়জোড় করছে। ওদের বেঞ্চিতে বসলেন। বিস্কুটের প্যাকেট রাখে ওরা। দশ টাকার একটা প্যাকেট কিনে দু’-তিনটে কুকুরকে দিলেন। এক কাপ চা বানিয়ে দিল, ফ্রেশ। বহুদিন পর এরকম বেঞ্চিতে বসে গ্রাম্য চা।

দোকান বন্ধ হল। বেঞ্চিটা ঢুকিয়ে দেবে ভিতরে।

মৃতুঞ্জয় বাইরে গিয়ে এক পাক ঘুরে এসে তারপর সিঁড়িতেই বসলেন।

মেয়েটির স্বামীর নাম রাজা। ওকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করো তুমি?

বলল—বাবুবাড়িতে বাবা কাজ করত। আমিও ছোটবেলায় ওদের বাড়ির কাজকর্ম করতাম। তারপর টাক্টর চালানো শিখিয়ে দিল, ওরা নিজেদের জমি চষে, ভাড়াও দেয়। আমি টাক্টর চালাই। টাক্টর বলছি বটে, আসলে টারাকটার। রফলা উচ্চারণ করার চেষ্টা করে।

মৃত্যুঞ্জয় বলেন, স্কুলে যাওনি?

গেছি তো, এইট পাশ।

—ও আচ্ছা। সঙ্গে কারা?

পড়শিরা এসেছে। শ্বশুরবাড়ি দূরে। দু’ ঘণ্টার সাইকেল।

বাবা-মা আছেন।

বাবা সগ্গে। মা আছে।

আচ্ছা তোমার নাম রাজা, কেউ খেপায় না!

ও বলে, ধুর, নাম নিয়ে কার কী যায় আসে?

এরকম গল্প করতে করতে আরও ঘণ্টা দেড়-দুই গেল।

নার্স এসে বলল—ভালো আছে। নাড়ি বেড়েছে। জ্ঞান আছে।

হাততালি দিল কে? কেউ না। ওটা বুকের ভিতরে।

একটু পরেই ম্যাডাম এল।

মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে বলল—কী ব্যাপার, আপনি এখনও এখানে?

মৃত্যুঞ্জয় হাসলেন। বললেন, কেসটা নিয়ে আমিও…।

ম্যাডাম বলল—আমি একটু পরেই মেয়েটাকে বর্ধমানে পাঠিয়ে দেব। পেশেন্ট স্টেবল আছে। কমপ্লিকেশন হতে পারে। এখানে তো সবরকম ব্যবস্থা নেই। আপনি কী বলতে এসেছিলেন? খুব জরুরি কিছু?

মৃত্যুঞ্জয় বললেন, তেমন জরুরি নয়, দুদিন পরেও বলা যাবে। আমি অপেক্ষা করছিলাম কেসটার জন্য। কী হয়…এখন বেশ ভালো লাগছে।

ম্যাডামের মুখে যেন একটা চন্দ্রমল্লিকা ফুটল।—ওমা, তাই?

মৃত্যুঞ্জয় রিকশায় উঠলেন। অন্য রিকশাওয়ালা। স্টেশন যাবেন। সূর্য হেলে পড়েছে। রিকশা যাচ্ছে। চরাচর জোড়া বিস্তীর্ণ সবুজের ওপারে সূর্য। এক্কেবারে রিভোফ্লোবিনের মতো রং। প্রকৃতি জুড়ে অক্সিটোসিন।

একদিন পর সন্ধের দিকে আবার গুড়াপ স্টেশনে। সেই রিকশাওয়ালাটাকে দেখতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়, দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা গামছা পেঁচানো। প্রথমে ওর পিঠের দিকটায় গেলেন। হারপিসের ঘা বেশ ঘন হয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন—জ্বালা করে না? খুব জ্বালা করার কথা তো।

—ও করুক গে যাক। কোথায় যাবেন?

—যাবে?

—নিয়ে যাবার জন্যই তো আছি।

ডাক্তার দিদিমণির ঘরে যাব। হেলাবটতলা ছাড়িয়ে নতুন পাড়ার রতন…

—তা বলতে হবে নে। উনার বাড়ি আমার যাওয়া-আসা আছে।

—ও, আচ্ছা।

স্টেশন থেকে খুব বেশি দূর নয়। আগের দিন বাজার থেকে যাবার জন্য দূরত্ব বেশি ছিল। ‘নতুন পাড়ায়’ ঢোকা হল। বারান্দার গ্রিলে জুঁই লতিয়েছে। বারান্দাতেই একটা কম পাওয়ারের আলো জ্বলছে। আর সেই ম্যাডাম একটা ইজিচেয়ারে বসে আছে। হাতে ধরা মোবাইল, কানে হেডফোন। পরনে একটা ঢোলা পায়জামা ধরনের। কুর্তিও বলা যায় বোধহয়, আর একটা পাঞ্জাবি।

রিকশাটা থামতেই মেয়েটা কান থেকে হেডফোন সরাল। হেডফোনের ছোট্ট বহির্দ্বার থেকে মৃদু ভেসে আসছে ‘এসেছিলে পরশু আজ কেন আসোনি।’ শচীনদেবের গান। পরশুই তো এসেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। আজও এলেন। একবার বলতে ইচ্ছে করল, পরশুও এসেছিলাম, আজও এলাম। কিন্তু এটা ঠাট্টা-ইয়ার্কির হয়ে যাবে। সেই সম্পর্কটা তো হয়নি। তাছাড়া ওর কাজকর্মের ধরন-ধারণ দেখে ওর ওপর কেমন একটা শ্রদ্ধাভক্তি হচ্ছে।

মেয়েটা বলল—আসুন, আসুন, কী খবর?

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—আমিই তো জিজ্ঞাসা করছি কী খবর। ওরা কেমন আছে? সাপে-কাটা মেয়েটা, আর বাচ্চাটা?

মেয়েটা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল—বেঁচে গেছে, আউট অফ ডেঞ্জার।

এবার রিকশাওয়ালাটা ম্যাডামকে বলতে লাগল—ভালো আছি দিদি। আপনি কেমন আছেন দিদি?

তার মানে ‘কী খবর’-টা মৃত্যুঞ্জয়কে বলা হয়নি নাকি? রিকশাওয়ালাকে বলা হয়েছিল? তাই তো মনে হচ্ছে।

দিদিমণি আবার জিজ্ঞাসা করল—তোমার ওই অর্জুনপুরের পেশেন্টের খবর কী?

—এক্কেবারে আরাম হয়ে গেছে দিদি। চাষের কাছে লেগে গেছে ফের।

ম্যাডাম এবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকায়। কী হল, বসুন। বারান্দায় চেয়ারও আছে দুটো প্লাস্টিকের। ম্যাডাম ইজিচেয়ারে আধা শোয়া ছিল, এবার শরীরটা ওঠাল। তুমিও বোসো শিবা।

মৃত্যুঞ্জয় প্লাস্টিকের চেয়ার বসল, পাশের চেয়ারেই রিকশাওয়ালা। একটা ছোট গোল টেবিল, ওখানে অ্যাসট্রে। ভিতরে সিগারেটের অবশেষ। এই মেয়েটা সিগারেট খায় নাকি?—নাকি বাইরের লোকেরা এলে খায়। নিষেধ করে না কেন?

মৃত্যুঞ্জয় হোস্টেল জীবনের পরই সিগারেট ত্যাগ করেছেন।

মেয়েটা এবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকায় আবার।—বলুন কী ব্যাপার?

কীভাবে কথা শুরু করবেন ভেবে পান না মৃত্যুঞ্জয়। বলেন—আপনি খুব ডেডিকেটেড।

—ডেডিকেটেড না, বলতে পারেন ফাঁকি মারি না। পাশ করার পর একটা ওথ নিতে হয়েছিল না আমাদের? হিপোক্রেটিক ওথ।

—হ্যাঁ, ওটা তো নিতে হয়, কিন্তু মেনে চলে ক’জন?

—সে যা হোক। আপনি নিশ্চয়ই এই কথাটা বলতে আসেননি আমাকে…।

—না, সেটা না, আমি দু’ স্টেশন দূরে ঝাপানডাঙায় থাকি। থাকি মানে থাকতাম। ওটাই জন্মভূমি। এখন কলকাতার কাছে সাবার্ব-এ প্রাকটিস করি।

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে ম্যাডামকে দিলেন।

ম্যাডাম সামান্য দেখে অ্যাসট্রের পাশে রেখে অ্যাসট্রেটা দিয়ে আংশিক চাপা দিল।

—হ্যাঁ, তো? মেয়েটি বলে।

মৃত্যুঞ্জয় বলে—শুনলাম আপনি এখানেই থাকেন। আপনার মাকেও নিয়ে এসেছেন। আমি আমার গ্রামে, পৈতৃক বাড়িতে আমার বাবার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় করতে চাই।

যেন একটা হ্যান্ডবিল পড়ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় মাসচটক।

মা নয়, ঠাকুমাকে নিয়ে থাকি। হ্যাঁ, বলে যান।

—এজন্য একজন ডাক্তার দরকার, যিনি ওখানে বসবেন। আপনি তো রবিবার এখানেই থাকেন। রবিবারটা বেশিরভাগ ডাক্তারখানা বা হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ থাকে। সেদিন আমার ডিসপেনসারি চালু থাকবে। আপনি যদি দয়া করে আসেন, আর একটা দিন সন্ধের দিকটা একটু সময় করে…।

বাক্যটা সম্পূর্ণ না করেই থামলেন এবং একটু বেশি বাতাস গ্রহণ করলেন ফুসফুসে।

—কিছু অনারারিয়ামেও ব্যবস্থা রেখেছি।

লেডি ডাক্তার ইন্দ্রাণী রায় বলল—আচ্ছা, আমি ধরুন গেলাম। রুগি দেখলাম, প্রেসক্রিপশন করলাম। কিন্তু ওষুধপত্র?

তারও কিছু কিনে দেব, ধরুন টিংচার আয়োডিন, মারকিউরিক্রোম, বোরিক…

—এসব কাটাছেঁড়ার ওষুধ দিয়ে কী হবে? ম্যাডাম হেসে বলল।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—গাঁয়ে তো মারপিট হয় খুব। হেসেই অবশ্য। তারপর বললেন—অন্য ওষুধও থাকবে নিশ্চই। প্যারাসিটামল, মেট্রানিয়াডাজোল, ক্লোরোকুইন, অ্যালকালি, ও.আর.এস…।

—এসব তো দামি ওষুধ নয়, আপনি মেবিনডাজোল দিতে পারবেন, যা কৃমির উৎপাত, এরিথ্রোমাইসিন? প্যান্টোপ্রাজোল দিতে পারবেন—অ্যাসিড ব্লকার? সেসুরক্সিন-এর মতো ওষুধ দিতে পারবেন?

—বড্ড কস্টলি এসব…।

—তবে আর বাবার স্মৃতি করে লাভ কী?

মৃত্যুঞ্জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ। এ সময়ে মাথা চুলকানো আনস্মার্টনেস। সোজাসুজিই বললেন—তাহলে যাবেন না, তাই তো?

—যাব না বলিনি। আমার তো যেতেই হয় ওধারে। ঝাপানডাঙা ছাড়িয়ে কুঁদো গ্রামে আমাদের একটা সাবসিডারি হেলথ সেন্টার আছে। আপনাদের গ্রামেও যাই। ওখানে আমাদের হেলথ ওয়ার্কার আছে মালতী সর্দার। আমি যাব। সপ্তাহে দুদিন করে যেতে পারব। এই কারণেই যাব—আপনি আজ ছোট করে শুরু করলে কাল বড় হবে। কাল অন্য কেউ বসবে। কাজটা শুরু হওয়া দরকার।

মৃত্যুঞ্জয় ভাবতেও পারেননি উনি রাজি হয়ে যাবেন। তারক থ’ বনে যাবে। এবার তারক নিজে থেকে বলবে আমিও দুদিন বসব। খুব তানাই-মানাই করছিল। ব্যাটা ভুলে গেছে সব। এবার দেখ তুই..।

বাতাস ঢুকল যেন জুঁই ফুলের গন্ধ নিয়ে। বারান্দার শেষে একটা ঘর। ঘরে পর্দা। পর্দা সরে গেলে অন্য একজন মহিলাকে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। এবার মহিলা বাইরে এলেন। খুব বৃদ্ধা নন। জিজ্ঞাসা করলেন, চা!

ইন্দ্রাণী বলল—তোমার কিছু করতে হবে না ঠাকমা, আসছি তো আমি।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—না, না—ওসব আবার কী হবে।

ইন্দ্রাণী বলে—দু’মিনিট। আসছি।

চা-চামচের টুংটাং। মধুর মধুর ধ্বনি বাজে একটা গান আছে না? চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল ডা. ইন্দ্রাণী রায়। তিন কাপ।

ডাক্তার—চা নিয়ে যাও।

মানে?

রিকশাওয়ালাটি চা তুলে নিল।

ওকে ডাক্তার ডাকল কেন?

চায়ে দুটো চুমুক দেবার পর মৃত্যুঞ্জয় বলে, তাহলে আপনার নাম পাবলিসিটি করে দিই?

—পাবলিসিটি আবার কী?

—না, বলছি, উদ্ধোধনের দিন অনুষ্ঠানের কার্ডে আপনার নাম..

—হ্যাঁ, লিখে দিন না…

—বেশ। থ্যাঙ্ক ইউ।

কিছুক্ষণ মৌনতার পর বললেন—আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? বলছি কি, এই রিকশাওয়ালাকে ডাক্তার বলে ডাকলেন, ও আবার মেনেও নিল…

ইন্দ্রাণী খিলখিল করে হাসল। অনেকটা হাসি। হাসতে হাসতেই বলল—’ও তো ডাক্তার-ই। তবে বলি শুনুন। আমার কাছে ও প্রথমদিন এল, একটা মেয়েকে এনেছিল। পোস্ট ডেলিভারি পেইন উইথ পিউয়্যারপ্যারল ফিভার। বলছে আমার চিকিচ্ছেয় কাজ হল না তাই আপনার কাছে আনলাম।

—কী চিকিৎসা করে ও? ঝাঁড়ফুঁক?

—ওকেই জিজ্ঞাসা করুন না।

রিকশাওয়ালা চা খাচ্ছিল। ও খুব বিনয়ের সঙ্গেই বলল, না আইজ্ঞে, সের’ম কিছু নয়, আমি মোটে তিনটা রোগের ওষুধ জানি। আমার বাপ আমায় কয়ে গিয়েছিল। আর কিছু না।

—কী কী রোগ?

—ওই তো, কান পাকা, হেঁতাল ব্যথা আর অর্শরোগ।

—কী চিকিচ্ছে?

—লতাপাতা।

—কান পাকায় কী দাও?

—কানশিরে পাতার বোঁটা ভেঙে রস।

—হেঁতাল ব্যথাটা কী?

ইন্দ্রাণী বলে দিল—পোস্ট ডেলিভারি পেইন।

—কী ওষুধ?

—বাপ চিনিয়ে দেছিল, গাছের নাম জানি না। গাছের গায়ে শুঁড় আচে।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন, আপনি বাঁচালেন ম্যাডাম। আবার একদিন এসে কথা বলে যাব আমি।

রিকশাওয়ালাও বলল—আসি দিদি।

ইন্দ্রাণী রায় ওর পিঠে হাত রাখল। রিকশাওয়ালা ককিয়ে উঠল।

—কীরে, পিঠে কী হয়েছে?

—ও কিছু না।

মৃত্যুঞ্জয় বললেন—হারপিস জস্টার।

—তাই? বলেনি তো কিছু, দেখি…কবে থেকে? কাল এসো হাসপাতালে। ওষুধ আছে। দিয়ে দেব।

রিকশাওয়ালাটা ওসব কথা গায়ে না মেখে চালকের সিটে গিয়ে বসে। পিছনের সিটে মৃত্যুঞ্জয়। দিদিমণি রাজি। বেশ একটা শান্তি শান্তি ভাব। আকাশে বরিক পাউডার মাখানো চিলতে চাঁদ। সামাজিক বনে চাঁদের আলোর অ্যানাসথেসিয়া।

সিগারেটখোর মেয়েটার জন্যই ওর কাজটা হতে চলেছে, বাবার আত্মা শান্তি পেতে চলেছে। তবে সিগারেট কি খায়? চোখে তো দেখা হয়নি। খাগ সে সিগ্রেট, বৃথাই রিগ্রেট। তবে ব্যাভার কিন্তু বেশ। বে’ থা করেনি। ওর কি বাপ-মা-র দায়িত্ব নেই? রিকশাওয়ালাটার সঙ্গে ভাবসাব হল কী করে?

মৃত্যুঞ্জয় রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসাই করলেন—হ্যাঁ রে, ডাক্তার দিদিমণির সঙ্গে তোর এত ভাব হল কী করে র‍্যা?

—আমুও চিকিচ্ছে করি, উনিও চিকিচ্ছে করেন। তা বাদে আমুও রুগি দেখে টাকা লিই না, উনিও ল্যান না।

—ও ব্বাবা।

—আমুও আমার সুখ-দুঃখের কথা উনাকে বলি, উ-ও সুখ-দুঃখের কথা মোকে বল্যেন।

—বাব্বা! তোদের খুব মিল দেখছি।

—মিল আচে, কিন্তু গরমিলও আচে। নাটকীয়ভাবে এটুকু বলেই রিকশাওয়ালাটা ডানদিকে রিকশা ঘোরাল। বিশাল বটগাছটার তলা দিয়ে যাবার সময় ডান হাতটা হ্যান্ডেল ছেড়ে কপালে ছোঁয়াল।

—মিল তো শুনলাম। এবার গরমিল কিছু কিছু শুনি।

পায়ের উপর পা তুলে বেশ গপ্পো করতে করতে যাওয়া যাবে।

—গরমিল তো অনেক রকমই আছে। তার মধ্যে পরধান হচ্ছে দিদিমণির কম্ম ওর বাপের দায়, আর আমার ধম্ম আমার বাপ যা চায়।

আকাশে ছায়াপথ। ঝিঁঝির শব্দ। দূরে ট্রেন যায়। রাতপাখি ডাকে। হেঁয়ালি হেঁয়ালি।

—বাপের দায় মানে?

—মানে? মানে হল গে—ওই দিদিমণির বাবা হচ্ছেন গে ডাক্তার। কলকাতা শহরে খিদিরপুর আচে, হোতায় বসে।

—ও আচ্ছা।

—রুগি ছুঁলেই দেড়শ’ ট্যাকা লেয়।

—বেশ তো।

—রুগি এলেই বেলাড টেস, পেসাব টেস। বর্ধমানের হোটেলে খদ্দের ধরে আনতে পারলে রিকশাওয়ালারা যেমন কমিশল লেয়, ওই দিদিমণির বাপও তেমন কমিশল লেয়। কমিশলে লোভে মিছামিছি টেস করায়।

—হুঁ।

—কমিশলের লোভে শুধুমুদু বুকের কাঠির ফটোক তোলায়।

—নাকি?

—তা বাদে সরকারি বাবুদের মিছা চিকিচ্ছার হিসাব দিয়ে কমিশল লেয়।

মৃত্যুঞ্জয় এবার নিঃশব্দ।

দিদিমণির ইসব মোটে পছন্দ লয়। এজন্য পটে না মোটে। ওই জন্য ঘরে থাকে না। ওই জন্য ঠাকমা লিয়ে চলে আসেছে। তা বাদে উর মা, ঠাকমাকে কুকথা কয়। তাই দিদিমণি বিচার লিল, কী, ঠাকমা উ নিজেই রাখবে।

কী একটা যেন ডেকে উঠল বাইরে। মৃত্যুঞ্জয় কোনও কথা বলেন না আর।

—বাপের কাজ নিজে করে ধম্মে আছে থির।

হাওয়া কি বন্ধ হয়ে গেল? গা-টা একটু জ্বলছে। ইওসিনফিল বাড়ল নাকি? চাঁদটা কি মেঘে ঢাকলো? অন্ধকার।

—আর একটা কথা বলি। শুনছেন বাবু?

আকাশে ছায়াপথ। নক্ষত্রের হীরে-কুঁচি। মৃত্যুঞ্জয় বলেন—বলো।

—আমার বাপ আমায় ক’টা বৃক্ষলতা চিন্যে দে বলেছিল—এই গাছের এই গুণ। চিনে রাখ। এই এই গাছ এই এই ভাবে ব্যাভার করবি, রুগি এলে কখুনো ফির‍্যা দিবি না। সব কাজ আমরা জানি না। কেউ কাপড় বুনে দেচ্ছে, কেউ মাটির বাসন বানায় দেচ্ছে, কেউ হোলার লোহার শাবল খুরপি কোদাল। কোদাল পাই বলেই তো মাটি কোপায়ে দুটো খাই। তাই মানুষের কাজে লাগা মানে আমাদিগের ধার শোধ করা। আমার ঠাকুরদা ছিল রোজা। রোজা মানে বোঝেন তো? ওঝা, ওঝা। জড়িবুটি দিতেন। কম বয়সে মরে যায়। বাবা বেশি বিদ্যে শিখতে পারেনি। যেটুকু শিকেছে, আমাকে দান করি গেছেন। বুঝলেন বাবু। বাপ আমাকে ওষুধের গাছ দে’ পয়সা নিতে বারণ করে গেছেন। কয়েছেন গাছ তো ভগবান দেছেন। ফিরি। সেই গাছ দিয়ে পয়সা লিবি কেন? খেটে খাবি।

জোনাকি! উঃ জোনাকি!

আমি বুইজলেন, একটা পাপ কইর‍্যে ফেলাছি। দিদিমণিকে ওই পাপের কথা বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু নজ্জায় বলা হয়নি। রিকশাটা একটু থামায় ও। বলল, অন্ধকার। ল্যাম্পোটা ধরাব।

ও দেশলাই জ্বালে। চরাচর ভরা অন্ধকারের মধ্যে উৎসারিত আলোয় রিকসাওয়ালাটির মুখ। ওর নাম শিবা। শিবা, না সেবা?

—পাপের কথাটা বলেই ফেলি আইজ্ঞা। জিজ্ঞাসা নিছিলেন না পিঠের উডা কী? এখন বলি। উডা পাপের চিহ্ন। একটা রুগি বাড়ি গেছিলাম শনিবার। পরথম পোয়াতি। খুব সোন্দর। হেঁতাল ব্যথা। ওষুধ দিলাম। সোমবার দেখতে গেলাম।

ও চুপ করল। মৃত্যুঞ্জয় একটু আঁচ করলেন কী পাপ। সুন্দরী রোগিণী…। কিছু একটা হয়তো…

ও বলে, গিয়ে দেখি ব্যথা নাই। আরাম হয়ে গেছে। মেয়েটার বাচ্চাটা পাশে শুয়ে। মেয়েটার বাবা টাকা দিতে চাইলে। উরা বড়লোক। আমার সামনে ধরা একটা পাঁচশো টাকার নোট বাতাসে কাঁপছে। কী মতি হল…লোভ হল খুব। টাকাটা খপ করে ধরে নিলাম। বাজার থেকে একটা হরলিস নিলাম ছেলেটার জন্য, আর মাখম, আর মঙ্গলবার আমার পিঠ ফুঁড়ে বেরুল পাপ। পাপের চিহ্ন।

কী একটা রাতপাখি বিচ্ছিরিরকম ডেকে উঠল।

দু’পাশের অন্ধকারকে সাপটে ধরতে চাইলেন মৃত্যুঞ্জয়। হাওয়া নেই। গায়ে এত জ্বালা কেন? পাপ? আকাশটা বড্ড ঝুঁকে পড়েছে গায়ের ওপর। আকাশ, ক্ষমা করো। নিজের মাটি, দেশের মাটি, ক্ষমা চাইছি, ক্ষমা করো। বটবৃক্ষ হে, ক্ষমা করে দাও। চোখে জল আসে কেন, ধুস!

চারিপাশের অন্ধকারে রিকশাটার কেরোসিন-আলোয় ওর মুখে রেডিয়াম।

ও আবার বলে—বাবা আমার সগ্গ থেকে দেখছে, আর বলছে বেশ হয়েছে।

হাওয়া দিচ্ছে ফের। হাওয়া বলছে, আছে আছে আছে। শেষ হয়নি। সহজে শেষ হয় না।

স্টেশন আসছে। রাস্তায় আলো। অন্ধকারের পর আলোই তো আসে চিরকাল।

স্বর্গ থেকে পিতৃপুরুষরা কি সত্যিই দেখছেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *