হাতুড়ে

শুরুর আগে

পিতামহর মুখে প্রায়ই শুনতাম ‘শরীরম ব্যাধিমন্দিরম’। আবার একটা প্রবচন ও শোনা যেত—’শতংমারি ভবেৎ বৈদ্য’। মানে—শ’খানেক মানুষ না মারলে বৈদ্য হওয়া যায় না। আবার এও শুনতাম, ডাক্তাররা হলেন জ্যান্ত ভগবান। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাধি ও বৈদ্য সম্পর্কিত বোধের মধ্যে একটা জটিলতা ছিল। ব্যাধিমুক্তি ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এই জটিলতাকে আরও বাড়িয়েছে।

উপন্যাস সামাজিক নিবন্ধ নয়, কিন্তু সামাজিক সমাজ তো উঠে আসে বিভিন্ন চরিত্রের আশ্রয়ে। বিভিন্ন সময়ে লেখা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিষয়ক চারটি আখ্যান একত্র করে এক মলাটে রাখা হল। চারটি আলাদা আখ্যান হলেও সচেতন পাঠক এর মধ্যে যোগসূত্র খুজে পাবেন। এরকম নতুন ধরনের একটি উপন্যাস প্রকাশ করলেন বলে পত্রভারতীকে ধন্যবাদ জানাই।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

.

হাতুড়ে

পিতৃসত্তা

তারাপীঠে স্পেশাল লাইন দিলে আগে পুজো দেওয়া যায়। সেই লাইন কিনতে হয়। একশো টাকার আছে, দুশো টাকার আছে…। যত বেশি টাকার লাইন, ভিড় তত কম।

ডাক্তার ভজন মৃধা সপরিবারে পুজো দিয়ে বেরুল। সবার কপালেই সিঁদুরের টিপ। ওরা চারজনই তারা মায়ের বডি টাচ করতে পেরেছে। পাণ্ডাকে খুশি হয়ে কিছু বেশিই দিল। ওরা ভিআইপি লাইনের টিকিট কিনেছিল।

তারা মায়ের কাছে মানসিক আছে ভজন ডাক্তারের। মায়ের কাছে প্রার্থনা আছে। না-চাইতেই অনেক দিয়েছেন মা। বাড়ি, গাড়ি, ফ্রিজ, পয়সাকড়ি সবই দিয়েছেন। একটা ভালো জামাই দিয়েছেন, মদ খায় না। বউ-অন্ত প্রাণ। একটা খুব ভালো কম্পাউন্ডার দিয়েছেন, মোটে কামাই করে না। রুগিপত্র মোটামুটি ভালোই হচ্ছে। একটা ওষুধের দোকান করেছে। সবই মা নিজের ইচ্ছেয় দিয়েছেন। একটাই আশীর্বাদ শুধু মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নেবে ভজন ডাক্তার। সেটা চাইতেই এখানে আসা।

চেয়েছে। মায়ের গায়ে হাত দিয়ে চেয়েছে ভজন ডাক্তার। ডাক্তারের স্ত্রী রেবতী, ছেলে সুবোধ, মেয়ে অপর্ণা সবাই মিলেই মায়ের কাছে মনোবাঞ্ছার কথা জানিয়েছে। আজ অমাবস্যা। মা আজ বেশি পাওয়ারফুল। গতকাল নিরামিষ খেয়েছে সবাই। আজ সকালে স্নান সেরে নতুন কাপড়-জামা পরে সবাই মন্দিরে এসেছে। পুজো-টুজো হল, এবার খাওয়া দাওয়া। এখন মাংস-টাংস খেতে কোনো বাধা নেই।

ভজন মৃধা পাশ করা ডাক্তার নয়। ভজন ডাক্তারি শিখেছে ওর বাবার কাছে। ভজনের বাবার নাম বিলাস মৃধা। বিলাসের বড় বিচিত্র জীবন। বিলাসের জীবন-কথা যদি লিখতে পারত ভজন, একটা উপন্যাস হয়ে যেত।

ওর বাবা চাকরি করত একটা মর্গে। মর্গের ডোম নয়, স্টোরকিপার ধরনের কাজ। মৃতদেহ ভেজাবার ফর্মালিন, দুর্গন্ধ তাড়াবার ব্লিচিং পাউডার, সাবান, বস্তা এসব সহ মৃতদেহের স্টক রাখতে হত। বেওয়ারিশ মৃতদেহগুলো মাটি চাপা দিয়ে দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু ডোমেরা ওইগুলো খুচরো বিক্রি করত। পেট কেটে কিডনি, প্যাংক্রিয়াস, লিভার, স্পিলিন। বুক কেটে ফুসফুস, হার্ট এসব বার করে নিয়ে ফর্মালিনে ভিজিয়ে রাখত। আর ওইসব পার্টসগুলো ডাক্তারদের বিক্রি করে দিত।

মেডিকেল কলেজে এর একটা বাজার ছিল। এ ব্যবসাটা ডোমরাই করত মূলত, কিন্তু বিলাস মৃধাকে এড়িয়ে ওই কাজ করা যেত না। বিলাস আস্তে আস্তে বিজনেসে জড়িয়ে গিয়েছিল। হাতেকলমে কাজ শিখে ফেলেছিল। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পেটে হাত ঢুকিয়ে কচাৎ করে গলব্লাডারসহ লিভারটা কেটে বার করে আনত। বিলাসের ডিসেকশনের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসগুলো সন্তোষ ডোমের আন্ডারে মর্গেই হয়েছিল। এবং সত্যি বলতে কী, সত্যিকারের এমবিবিএস পাশ ডাক্তাররাও এতগুলো ডিসেকশন ক্লাস পায়নি। বিলাস হালকা করে কঙ্কালের বিজনেসের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিল। কঙ্কালের প্রসেসিংটা মর্গে হত না। সন্তোষ ডোম ওর বাড়িতে নিয়ে যেত। মাটি চাপা দিত। কিছুদিন পর মাটি খুঁড়ে চুন, কস্টিক সোডা মেশানো বালি চাপা দিয়ে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিত। তারপর পরিষ্কার-টরিষ্কার করে কঙ্কাল তৈরি হত। কাজটা ঝামেলার। এক পিস, দু-পিস-এ ঠিক পোষায় না। তাই জন্য সন্তোষ বডি বেচে দিত। বাদু থেকে একটা লোক আসত, সে বস্তা পেঁচিয়ে বডি নিয়ে যেত। তার বড় কারবার। সে কবর-টবর থেকেও মাল তুলত। বিলাসের সঙ্গে আরজিকর-এর ছাত্রদের ভাবসাব ছিল। কঙ্কাল, খুলি, এসবে ওদের কাছ থেকে কমিশন পেত বিলাস। বিলাস প্যাটিলা, আলনা, ইলিয়াম, কারপাস-এসব অ্যানাটমির কথাবার্তা ডাক্তারি ছাত্রদের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে পারত। এ-লাইনে ওর বেশ নাম হয়ে গিয়েছিল।

অঙ্গপ্রতঙ্গের কিছু আদরসূচক ডাক নাম ছিল। আদরে শেষে একটা ‘উ’ যুক্ত হয়। নব যেমন নবু, রতন যেমন রতু, তেমনি প্যাংক্রিয়াসকে প্যাংকু, লিভারকে লালু, পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে পুটু বলে ডাকা হত। এটাকে সাংকেতিক ভাষাও বলা যেতে পারে। এ ছাড়া হাড়গোড়গুলোর কিছু নিজস্ব নাম ছিল সন্তোষ ডোমের—যেমন তেকোনা (পেলভিক বোন), পাঞ্জা, বড় কাঠি, চাক্কি এসব। এই সাংকেতিক ভাষা ওরাই বুঝত, আপনি, আমি বুঝব না।

দিনেরবেলা এই কাজ। রাতে তেমন কাজ ছিল না বিলাসের। একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় ওর। ওই ডাক্তারকে এক সময় মাল সাপ্লাই দিয়েছিল বিলাস। ওই ডাক্তার চেম্বার দিয়েছিল বারাসতে। বিলাস ওখানে চেম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে লাগল। বিলাসের বয়েস তখন চল্লিশ পেরোয়নি। ওই চেম্বারের রুগির নাম ডাকা দিয়ে নতুন কেরিয়ার শুরু। তারপর নানা কাজ শিখেছে চেম্বারে। ইনজেকশন দেওয়া, রক্ত টানা, ব্লাডপ্রেশার মাপা এই সবকিছু শিখে গেল। ব্যান্ডেজ বাঁধা, টুকটাক সেলাই করাও শিখে গেল। আগে মৃত শরীর সেলাই করতে পারত। পার্টস হাতিয়ে নেওয়ার পর বডিটা হাঁ করে রাখা চলত না। কিন্তু সে সেলাই যেমন তেমন করে দিলেই চলত। কারণ, মৃতদের ব্যথা লাগে না। জ্যান্তদের ব্যথা লাগে। জ্যান্ত বডিতে কেটে গেলে সেলাই-টেলাই করার সময় হাত-টাত টেনে ধরত বিলাস। তারপর আস্তে আস্তে টুকটাক সেলাই করাও শিখে গেল। শেখার ইচ্ছেটাই আসল। বিলাসের কাজ শেখার প্রবল ইচ্ছে ছিল।

দেশ ক্রমশ এগোচ্ছিল। দেশের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে গর্ভপাতও বাড়তে লাগল। দেশ যখন পিছিয়ে ছিল, তখন কুমারীরা গর্ভসঞ্চার হলে আত্মহত্যা করে ফেলত। পরবর্তীকালে আত্মহত্যা করার দরকার হয় না। গর্ভপাত করে নিত। দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওই চেম্বারটিও নার্সিংহোমে উন্নীত হল। বিলাস মৃধা ওই নার্সিংহোমেও কাজ শিখতে লাগল। গর্ভপাতের কাজ। বিলাস দেখল ভ্যাকুয়াম অ্যান্ড সাকশন মেশিন, দেখল কিউরেটিং মেশিন—যে মেশিনটার যান্ত্রিক হাত জরায়ুর ভিতর ঢুকে গিয়ে কচি ভ্রূণ কুরে কুরে কাটে। ভালো কথায় যা স্যালাইন ওয়াটার, আসলে নুন জল, সেটা ইনজেকশন করে দিলেও ভ্রূণ নিধন হয়। এরকম অনেক কায়দা শিখে গেল বিলাস। সভ্যতার আরও উন্নতির ফলে এখন ভালো ওষুধ বেরিয়ে গেছে, যা পরে খেয়ে নিলেও চলে। ফলে ওই কায়দার গর্ভপাত এখন কিছুটা কমেছে, তবে যে সময়ের কথা বলছি, তখন গর্ভপাত বেশ চালু ছিল। দেয়াল, রেলের কামরা, লাইটপোস্ট পোস্টারে ভরা থাকত—’ঋতুবন্ধ? চিন্তা কী? পাঁচ মিনিটেই মুক্ত।’

বিলাসের গ্রামে হাট বসে। দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ওটা বাজারে উন্নীত হল। ওর গ্রামের নাম শুঁটিয়া। বারাসত থেকে বনগাঁর দিকে বারাসতের পরের স্টেশন বামনগাছি থেকে চার কিলোমিটার ভিতরে এই গ্রাম। এখান থেকেই যাতায়াত করত বিলাস। এই এলাকায় কোনও ডাক্তার ছিল না। বিলাস তার পাশের বাড়ির এক পেট ডিং ডিং কিশোরকে কৃমির ওষুধ খাইয়ে কৃমি বের করে দিয়ে ওর পেটের অবস্থা স্বাভাবিক করে দেয়। কিছুদিন পর এক মৃত প্রায় কলেরার রুগিকে গ্লুকো-স্যালাইন চালিয়ে বাঁচিয়ে দেয়। এরপর ওর ডাক্তার হওয়া রোখা যায় না। ওকে ডাক্তার হতেই হয়। শুঁটিয়া বাজারে একটা টিনের ঘর ভাড়া নিল বিলাস, একটা টিনের পাতে লাল রং দিয়ে বাঁ-দিকে একটা লাল ক্রস চিহ্ন আঁকল, তারপর লিখল ডা. বিলাস চন্দ্র মৃধা। নিজের নামের পাশে ডা. শব্দটা বসিয়ে অনেকক্ষণ অবাক চোখে দেখেছিল বিলাস। আরও কিছুটা জায়গা ছিল ওই টিনের পাতে। ডাক্তারদের নামের পর ডিগ্রি লেখার নিয়ম। বিলাসের নামের পর ডানদিকের ধূসর শূন্যতা বড় চোখে লাগছিল বিলাসের। বিলাস রং-তুলি দিয়ে দিয়ে সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটা স্টেথো এঁকেছিল। তখন বিলাসের বয়েস পঞ্চাশ প্রায়। ১৯৬৯ সাল। যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে গেছে। বিলাস মৃধা নিজে স্বয়ম্ভর ডাক্তার। আশেপাশে কোনো পাস করা ডাক্তার নেই। বিলাসের ভালোই রুগিপত্র হতে লাগল। আগে কেউ জল-হাজা, খোস-পাঁচড়া-দাদের চিকিৎসা করাত না। ওসব নিজে নিজেই মনুষ্যশরীরে জন্মাত, আবার সময় হলেই সেরে যেত। বিলাস পেট্রোলিয়াম জেলির মধ্যে বোরিক পাউডার আর স্যালিসাইলিক অ্যাসিড মিশিয়ে একটা মলম তৈরি করেছিল, সেটা আশ্চর্য কাজ করতে লাগল। সালফা গুয়াডিনিন আর মেকসাফর্ম-এর গুঁড়ো মিশিয়ে পুরিয়া করেছিল, পেটখারাপে দারুণ কাজ দিত। একবার একটা ঘটনা ঘটল। ভ্যানরিকশা করে একটা সাপে-কাটা রুগি নিয়ে হাজির হল কয়েকজন। রুগির গা কালচে হয়ে গেছে। মুখ থেকে লালা গড়াচ্ছে। জ্ঞানও নেই। বহুদূর থেকে এসেছে। দেখেই বুঝেছিল বিষাক্ত সাপ কেটেছে। বিলাস বলেছিল, এখানে কেন আনলেন? হাসপাতালে নিয়ে যান। ওরা বলেছিল, আমরা ভেবেছিলাম এখানে সাপে-কাটার স্পেশাল চিকিৎসা হয়। সাইনবোর্ডে সাপের ছবি আঁকা আছে কিনা। সাপের ছবিগুলো দেখাল আঙুল উঁচু করে। আসলে ওই বিলাসের আঁকা স্টেথোস্কোপের দিকে ওদের আঙুল। এরপরই স্টেথোর ছবি সাদা রং বুলিয়ে মুছে দেয় বিলাস। কিছুদিন পর একটা রুগি এসেছিল, প্রেশার পড়ে গেছে। নাড়ি প্রায় নেই। মুখে কোরামিন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল বিলাস। সেই লোক বেঁচে গেল। তারপর বিলাসকে দেখে কে! ওর নামের বোর্ডের সেই সাদা জায়গায় আবার লিখতে হল ধন্বন্তরি।

ডা. বিলাস চন্দ্র মৃধা, ধন্বন্তরির ছেলে ভজন। ভজন মৃধা। এখন ডা. ভজন চন্দ্র মৃধা, এমডি। এই এমডি-র পর একটা ছোট্ট ব্র্যাকেটে আরও ছোট করে লেখা এএম। এএম মানে হল অলটারনেটিভ মেডিসিন। এই এমডি ডিগ্রিটা অনেক পরে হয়েছে। ডাক্তারি শাস্ত্রে ওর হাতেখড়ি ওর বাবার কাছেই। ভজনের বাবা বিলাস না হয় গ্রাম-জীবনে মর্গে কাজ করেছে, দেহ সম্পর্কে ওর ধারণা ছিল, তবে সেটা মৃতদেহ সম্পর্কে। কিন্তু ভজনের দেহ সম্পর্কে ধারণা জন্মে যায় ওর কৈশোরেই। নারীদেহ সম্পর্কে ওর সম্যক ধারণা তৈরি হয়ে যায় আঠারো বছর বয়সেই। শুধু শরীরের আকৃতি-প্রকৃতি নয়, নানাধরনের গুপ্তজ্ঞানও রপ্ত করেছিল ভজন। নারীদের ঋতুচক্র এবং কোন কোন দিন নিরাপদ এসব ও জেনে গিয়েছিল মেনকা হালদার নাম্নী এক প্রোষিতভর্তৃকার কাছে। মেনকার বয়স ছিল ভজনের চেয়ে বেশ বেশি। মেনকাই ওকে আহ্বান করেছিল প্রথমে। স্কুলে প্রায়শই যেত পারত না ভজন, যাওয়া হত না। পরীক্ষার ‘টেস্ট’-এ অ্যাল্যাউ হল না। বিলাসের গোচরে আসে তার ছেলে স্কুলের পরিবর্তে কোথায় যায়। বাড়িতে প্রায় বন্ধ করে রাখল। বাড়ির ষোড়শী পরিচারিকা জোছনা গর্ভবতী হয়ে পড়ল। ডা. বিলাস মৃধা নিজ হাতেই গর্ভপাত করাল, কিন্তু গর্ভপাতকালে পুত্র ভজনকে একটি অভিনব শাস্তিপ্রদান করেছিল। বলেছিল, তোকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি। গর্ভপাতের পুরো প্রক্রিয়া চলার সময় সেই গুপ্তঘরে অয়েলক্লথের পাশে ভজনকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আসলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পিতা শাস্তি দেওয়ার ছলে পুত্রকে ট্রেনিং দিয়েছিল। এটা সেই উচিত শিক্ষা বলা যায়।

বাবার মেডিকেল কলেজেই ভরতি হয়ে গেল ভজন। বাবার সঙ্গেই বসতে লাগল।

ততদিনে চেম্বারের রূপ পালটে গেছে। রুগিদের অপেক্ষা করার জন্য চেয়ার, মাথার উপরে ফ্যান, ডাক্তারের ঘরের সামনে কাচের দরজা, এক্স-রে পেট দেখার আলো, আরও কত কী! বড় সাইনবোর্ড হয়েছে—ধন্বন্তরি মেডিকেল হল। এখানে আমাদের ভজন অ্যাপ্রেন্টিস। না, ডাক্তারি লাইনে অ্যাপ্রেন্টিস বলে না। ইনটার্নি।

ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ধোয়া দিয়ে কাজ শেখা শুরু হল। তখন ডিসপোসেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার হত না। ইথার দিয়ে সিরিঞ্জ ধুয়ে নিতে হত, সুচ মুছে নিতে হত। ইনজেকশন দেওয়াটাও শিখল। প্রেশার মাপা, নাড়ি দেখা, নারী দেখাও। যদিও এটা আগেই অনেকটা শেখা ছিল।

কিছু কিছু কাজ শেখার ঘটনা মনে পড়ে ভজন ডাক্তারের। তখন এরকম ডায়াবেটিস মাপার কাগজ বেরোয়নি। আজকাল পেচ্ছাপের মধ্যে কাগজ ডুবিয়ে রং দেখে সুগার লেভেল সহজে বোঝা যায়। কোনো রুগি এলে যদি মনে হত সুগার আছে, তাকে একটা পাথরের বাটিতে পেচ্ছাপ করতে বলা হত। সেই বাটিটা বাইরের রোদ্দুরে ফেলে রাখা হত। পেচ্ছাপের জলটা উবে গেলে—সেই বাটিতে পিঁপড়ে আসে কিনা দেখা হত। মল পরীক্ষা নিজেই করতে পারত বিলাস। একটা কলাপাতায় মলটা ফেলে কাঠি দিয়ে নেড়ে দেখত কীরকম জীর্ণ হয়েছে। কৃমির অস্তিত্ব দেখত, আম আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করত। গন্ধও শুঁকত। গন্ধ শুঁকে আমের পরিমাণ বুঝতে পারত। এতে কোনো ঘেন্না ছিল না। থাকার কথাও নয়। কারণ, বিলাস ছিল মড়া-ঘাঁটা মানুষ। ভজন এতটা পারত না। মল পরীক্ষা-টরীক্ষা ওর দ্বারা হত না। তাছাড়া পরীক্ষা করে লাভ কী? পরবর্তীকালে কত প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি হয়েছে। ওখানে পার্টি পাঠালেই কমিশন পাওয়া যায়। যত পরীক্ষা, তত পয়সা। এখন আবার সিটি স্ক্যান, আলট্রাসোনো—এসব হয়েছে। ওখানে কমিশন অনেক বেশি। ওইসব কোম্পানিকে পেশেন্ট পাঠিয়েছিল ভজন ডাক্তার, কিন্তু কমিশন পায়নি। ওরা এইসব ডাক্তারদের পাত্তা দেয় না। না দিকগে যাক। ভজন ডাক্তারের দিব্যি চলে যাচ্ছে। রুগি কম নেই। শুঁটিয়া বাজারে গত চার বছর ধরে একটা ওষুধের দোকান একজন এমবিবিএস বসিয়েছে বটে, কিন্তু ভজন ডাক্তারের চেম্বারেই ভিড় বেশি। এখানে ফি হল কুড়ি টাকা মাত্র। কারুর কারুর কাছ থেকে আরও কম নেয় ভজন ডাক্তার। ভজনের বাবা পাঁচ টাকার বেশি কোনওদিন ফি নেয়নি। কথা হচ্ছিল কাজ শেখা নিয়ে। ভজনের বাবা বিলাস ডাক্তার রুগিকে শুইয়ে পা দুটো মুড়ে পেটের কাছে নিয়ে যেত, এতে রুগির বাতকর্ম হয়ে যেত। সেই বাতকর্মের গন্ধে বলত—গতকাল খুব আন্ডা খাওয়া হয়েছে বুঝি? এরকম আরও কত কথা মনে পড়ে ভজনের। কাচের গেলাসে পাশাপাশি রেখে তারা বুঝিয়েছে বিকোসুল খাওয়া পেচ্ছাপ আর জন্ডিসের পেচ্ছাপ। দুটোই হলুদ। বিকোসুল মানে ভিটামিন-বি সমন্বিত একটি ওষুধ। কিছুটা ওষুধ পেচ্ছাপের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এতে রং হলুদ হয়। আর জন্ডিস হলে পিত্তের কারণে রং হলুদ হয়। মদ খাওয়া বমি আর অ্যাসিডিটির বমির কধ্যে কী তফাত বুঝিয়েছিল বিলাস। গ্রামের বাড়িতে ইলেকট্রিকের লাইন এসেছিল ১৯৮২ সালে। এর আগেই বাড়ি দোতলা হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে হ্যাজাক এবং ব্যাটারিচালিত আলো জ্বলত। ইলেকট্রিক কানেকশন আসার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্যান, ফ্রিজ, একটি ১৪ ইঞ্চির সাদা-কালো টেলিভিশন সেট কেনা হয়েছিল। ফ্রিজটা ছিল বিলাসের খুব শখের। রাতে ঠান্ডা জল দিয়ে বাংলা খেত বিলাস। টাকাপয়সা হওয়ার পরও হুইস্কি বা বিলিতি মদ ধরেনি বিলাস মৃধা। বাংলাই। ফ্রিজটা এলে ঠান্ডা জলে। ভজনের মা ফ্রিজটা সকড়ি করতেন না। আগে সকড়ি-টকড়ি নিয়ে এত বাছবিচার ছিল না। বামুন-কায়েতরা খুব সকড়ি-টকড়ি মানে। টাকাপয়সা হওয়াতে বিলাসের বউও বেশি বেশি সকড়ি-টকড়ি মানতে লাগল। সন্ধেবেলা বেশি ধরে ধূপকাঠি এবং শাঁখের আওয়াজ ইত্যাদি। ফ্রিজে রাখা হত ফল, দই, মিষ্টি। আর জল। রান্না খাবার ফ্রিজে ঢুকত না।

একবার হয়েছিল কী, একটা লোক এসে একটা ভাঁড় দিয়ে গেল। মুখ বন্ধ। দড়ি দিয়ে বাঁধা। বলল, ডাক্তারবাবুকে দিয়ে দেবেন। বিলাসের স্ত্রী ভাঁড়টা ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সন্ধের সময় ফ্রিজ খুলতেই একটা বিচ্ছিরি গন্ধ। গন্ধের কারণটা বোঝা গেল না। রাত্রে বিলাস এসে ফ্রিজ খুলল যখন, তখন বিটকেল গন্ধ হয়ে গেছে। এমনকী জলেও গন্ধ ধরে গেছে। অনুসন্ধান করে দেখা গেল গন্ধের উৎস হল ওই ভাঁড়। খুলে দেখা গেল ওর মধ্যে রয়েছে মনুষ্যমল। বিলাস হতবাক। বিলাসের স্ত্রী ওই ভাঁড়ের আগমন কাহিনি বলে। এরপর ব্যাপারটা কিছুটা বোধগম্য হয়। এক রুগিকে বলা হয়েছিল আপনার মল পরীক্ষা করতে হবে। নিয়ে আসবেন। ও নিয়ে এসেছিল। চেম্বারে বিলাসকে পায়নি, হয়তো কল-এ গিয়েছিল। লোকটা ভাঁড়টা নিয়ে এসে যদি বলে, ডাক্তারবাবুকে দিয়ে দেবেন, তাকে কী বোধগম্য হয়! কতজনই তো ভালো হয়ে গেলে ডাক্তারবাবুর জন্য দই-মিষ্টি নিয়ে আসে। কত লোকই তো বাড়ির লাউ-চালকুমড়ো নিয়ে আসে। সরল মনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে ছিল বিলাসগিন্নি।

ম্যাট্রিকটা পাস দেওয়ার জন্য অনেক করে বলেছিল বিলাস, কিন্তু ওটা আর হয়নি। বিলাস যখন মারা গেল, ভজন তখন চৌত্রিশ। বিলাসের লিভারে সিরোসিস হয়েছিল। পেটটা যখন ফুলে গেল, সবাই ভেবেছিল চর্বি হয়েছে। বিলাস ঠিকই বুঝেছিল ওটা জল। কালোমেঘ-এর বড়িতে কমবার নয়। ল্যাসিক্স বড়িতে এ জল যাবে না। বারাসতে গিয়ে ডাক্তার দেখালেন, কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যেই দেহাবসান হল। বাবার চেয়ারে বসল ভজন। বাবার শিক্ষা ছাড়া ও আরও কিছু মেডিকেল বইপত্র কিনল কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে। যেমন ডা. মদন রানা বিরচিত সচিত্র অ্যালোপ্যাথি শিক্ষা, সহজ ধাত্রীবিদ্যা, আবুল হাসনতের যৌন বিজ্ঞান ইত্যাদি। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভরা দুজন-একজন করে আসতে শুরু করেছিল আগেই। ওরা যেসব কাগজপত্র দেয় তা পড়ে মানে বুঝত পারত না বিলাস, ভজনও পারে না। একটা ডায়েরি আছে, ওখানে বাংলায় লিখে রাখে আলমিনডাজোল—কৃমির ওষুধ। ১০ এমজি ওয়ান ডোজ। হাঁটুর ক্ষয় হলে—কার্টিলেজ বানায় অট্রিভিট। ফ্যাম একটি নতুন অম্বলের ওষুধ। খালি পেটে খাইলে উত্তম। বেশি খাইলে মাথা ঘুরিবে। অ্যাম্পিসিলিনে অনেকের পেট খারাপ হয়। অ্যাম্পিজোলের মধ্যে কিছুটা মেটরোনিয়াডাজোল মিশ্রিত থাকে বলিয়া পেট খারাপ চেক হয়। এই নোটবুক ভরা আছে এরকম সব কিলবিল লেখাতে। ভালো কথা শুনলেই চট করে লিখে ফেলে। এই বইটাই মৃধা পরিবারের মেটিরিয়া মেডিকা। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিতার নোটবুকটি পূর্ণ করেছিল পুত্র।

এইভাবেই ডাক্তারি চলছিল। এমডি পড়ার সুযোগ হয়েছিল ধন্বন্তরি মেডিকেল কলেজে। ধন্বন্তরি শব্দটা ভজনের জীবনের সঙ্গে বেশ জড়িয়ে গেছে বলা যায়।

ধন্বন্তরি মেডিকেল কলেজের সূচনা হয় বারাসত রেল স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে, ১৯৯০ নাগাদ ওইখানে একটা লোক ট্যাংকি-সাফ পাউডার বিক্রি করে। এখানে ট্যাংকি মানে পেট। হরিতকি, বেলশুঁঠ ইত্যাদি পাউডার মিশিয়ে তৈরি হয় ওই পাউডার। লোকটা খুব ভালো বক্তৃতা করে। বলে সকালের কোষ্ঠ সাফ মানে হল ভৈরবী রাগিণী, মানে সকালবেলার ফুল ফোটা…অনেকের মুখে থাকে পিছনদ্বারের গন্ধ। কারণ হল পেট সাফ না-হওয়া। মেজাজ গরম, খিটখিটে ভাব—যদি না হয় পেট সাফ। পেট ক্লিয়ার মানে লাইফ ক্লিয়ার। আপনি খুশমেজাজে কাজে যান দাদারা…এরকম কত কথাই বলে। ওই পাউডার কিনে নিয়ে যায় ভজন। ওই পাউডারের সঙ্গে এনট্রোকুইনলের গুঁড়ো মিশিয়ে পুরিয়া বানায় ভজন। ওই ট্যাংকি-সাফ কিনতে গিয়েই দেখল প্ল্যাটফর্মে ডালপুরির দোকানের পাশে লেখা, ‘ডাক্তার হইবার সুবর্ণ সুযোগ। অলটারনেটিভ মেডিসিনে এমবিবিএস ডাক্তার হউন’। ওখানে ওভারব্রিজের তলায় ছোট একটা টেবিল-চেয়ার নিয়ে একটা লোক বসে আছে। একটা খাতা রয়েছে সামনে। লোকটার চোখে লাল, আর ঠোঁটের কোনায় ঘা। ওকে জিজ্ঞাসা করল ভর্তির পদ্ধতি। লোকটা বলল, ভরতির পদ্ধতি খুব সরল। টাকা দিলেই ভর্তি।

—আর এমবিবিএস ডিগ্রিটা?

—ওটা পেয়ে যাবেন।

—কারা দেবেন?

—বোর্ড অফ…ইয়ে।

—ইয়ে মানে?

—ওই, অলটারনেটিভ মেডিসিন।

লোকটা জিজ্ঞাসা করে,—আপনি কী করেন?

ভজন বলে, ডাক্তারি। আমি একজন কোয়াক ডাক্তার।

—ডাক্তার? তবে এমবিবিএস পড়তে যাবেন কেন? এক্কেবারে এমডি করে নিন।

—ক’দিনের কোর্স?

—দেড় বছরের। একটা হ্যান্ডবিল ধরিয়ে দিল লোকটা।

‘সারা বিশ্বে এখন অলটারনেটিভ মেডিসিনের রমরমা। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ক্রমশ ব্যাকডেটেড হইয়া যাইতেছে। নেচারোপ্যাথি, ম্যাগনেটো থেরাপি, আকুপাংচার, ইলেকট্রো হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি ক্রমশ জনপ্রিয় হইতেছে। আমেরিকান কাউন্সিল অফ অলটারনেটিভের সহযোগিতায় আমরা সিলেবাস প্রস্তুত করেছি। কোর্স কমপ্লিট করিয়া একজন আধুনিক মেডিকেল প্র্যাকটিশনার হিসেবে স্বাধীন জীবিকা গ্রহণ করিতে পারিবেন ও দেশের ও দশের উন্নতি সাধন করিতে পারিবেন।

কোর্স :

১) এমবিবিএস—৩ বৎসর। শনিবার ও রবিবার। যোগ্যতা—স্কুল ফাইনাল/ হায়ার সেকেন্ডারি।

২) এমডি—দেড় বছর। কেবলমাত্র রবিবার। যোগ্যতা এমবিবিএস বা ৩ বৎসর ডাক্তারির অভিজ্ঞতা।

৩) ডিপ্লোমা ইন নেচারোপ্যাথি—১ বৎসর। শনিবার ও রবিবার।

৪) ডিপ্লোমা ইন ম্যাগনেটোথেরাপি—১ বৎসর। শনিবার ও রবিবার।

৫) ব্যাচেলার্স ডিগ্রি ইন ইলেকট্রো-হোমিও—২ বৎসর। শনিবার ও রবিবার।

অভিজ্ঞ ও উপযুক্ত কোয়ালিফাইড শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা শিক্ষাদান। ক্যামপাস :—বহিরগাছি বগলাচরণ বিদ্যালয়। বারাসত স্টেশন হইতে দুই কিলোমিটার, টাকি রোডের উপর। ক্লাস বিকেল পাঁচটার পর।

স্থান—বগলাচরণ বিদ্যালয়

কাল—১৯৯১

সময়—সন্ধ্যা।

এমডি-র প্রথম ক্লাস। ক্লাস শুরুর আগে প্রিন্সিপাল অরূপ সাহা বক্তৃতা দিচ্ছেন—আপনারা হলেন ঐতিহাসিক এমডি কোর্সের ঐতিহাসিক ফার্স্ট ব্যাচ। যারা সরকারি মেডিকেল কলেজে এমডি পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের আমরা সুযোগ করে দিয়েছি। আপনারা এখান থেকেই হায়ার স্টাডি করবেন। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা মূলত আপনাদের উপরই নির্ভরশীল। আমাদের এই গ্রাম বাংলায় সরকারি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারদের তুলনায় আপনাদের মতো ডাক্তারই বেশি। আপনারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন আমাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা। রাতবিরেতে আপনারাই পরিষেবা দিয়ে থাকেন। আপনারাই সুদূর গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ করে দেন। আপনারা না হলে এখনও গাঁয়ের মানুষ তাবিজ-মাদুলি-ঝাড়ফুঁক-জলপড়ার উপরই নির্ভরশীল থাকত। প্রাইমারি হেলথ ক্লিনিকের কথা তো সবাই জানি। ডাক্তার থাকে না। যদিও কোথাও কোথাও সপ্তাহে এক-আধদিন ডাক্তার যায়, ওষুধ থাকে না। আন্ত্রিকের রুগি গেলে শুধু এক খাবলা নিরোধ দিয়ে দেওয়া হয়। (হাসি)

সরকারি ডাক্তাররা খুব অহংকারী। রুগির সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না। সরকারের কাছ থেকে গাদা গাদা মাইনে নেন। সরকার কাদের টাকায় চলে? আমাদের টাকায়। আমরাই সরকারি ডাক্তারদের গাদা গাদা টাকা দিয়ে থাকি, বিনিময়ে পাই অবজ্ঞা আর অবহেলা। এই কোর্স আমাদের প্রতিবাদ। আপনারা মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবেন, মাটির কাছাকাছি থাকবেন…।

দশজন এমডি-র ছাত্র ছিল ফার্স্ট ব্যাচে। এরমধ্যে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করছিল ছ-জন, তিনজন অ্যালোপ্যাথি প্র্যাকটিস করছিল, আর একজন ছিল বায়োসায়েন্সে বিএসসি পাশ।

অধ্যাপক যারা ছিল—তাদের অধিকাংশ ছিল একটু অভিজ্ঞ কোয়াক ডাক্তার। কয়েকজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারও ক্লাস নিত। ফিজিওলজির ক্লাস নিত বগলাচরণ বিদ্যালয়ের ডে বিভাগের বায়োসায়েন্স টিচার।

স্পেশালাইজেন ছিল মদ খাওয়া ছাড়ানোর উপায়। গ্রামঘরে এই সাবজেক্ট-এর খুব ডিমান্ড। ডাক্তার পোড়েল একজন নামকরা কোয়াক ডাক্তার। গলায় তুলসী মালার কন্ঠি। উনি পড়াতেন কম্বাইন থেরাপি। অ্যালোপ্যাথি, ইউনানি, হোমিওপ্যাথি এবং কবিরাজি ওষুধের মিশ্র ব্যবহার শেখাতেন। বেশ কিছু টোটকাও দিতেন।

ভজন মৃধার এমডি-র খাতায় আজও খুঁজলে পাওয়া যাবে এইসব কাটিং তিলা-সুলতানি : পুং ইন্দ্রিয়ে মালিশ করার তেলগুলির মধ্যে ইহা বেস্ট। কেঁচো, বীর বহুটি (বর্ষার প্রারম্ভে দেখা যায় গাঢ় লাল রং-এর এক জাতীয় পোকা, বুকে ভর দিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়) এবং এর সঙ্গে বন্য গিরগিটি বা সান্ডার তেল নিংড়ে লবঙ্গর তেল, কস্তুরী মিশিয়ে যে তেল তৈরি হবে, তা শিথিল ইন্দ্রিয়ে মালিশ করলে ইন্দ্রিয়ের দৃঢ়তা আসে।

কামচন্দ্রোদয় মাজন : মনাক্কা, জটামাংসির সঙ্গে সামান্য খৈনি, এলাচ গুঁড়া এবং পালসেটিলা-৩০ দুই ফোঁটা মিশ্রিত করে একটি মাজন প্রস্তুত করো। রাত্রে শয়নের পূর্বে ওই মাজন দ্বারা দাঁত মাজলে সংগমেচ্ছা জাগবে।

পাঁঠার অণ্ডকোষ ছাগলের দুধে সেদ্ধ করে তার মধ্যে সামান্য মধু মিশ্রিত করে খেলে বীর্য ঘন হবে।

এইসব শিক্ষা ভজনের কাজে লেগেছে বই-কি। ভজন শিমুল মূলের গুঁড়োর সঙ্গে ইস্টনস সিরাপ মিশিয়ে যৌনতাবর্ধক ওষুধ দেয়। সকালে চিলিডিয়াম মাদার টিংচার, তারপর দুপুরে হিঞ্চেপাতার রস দিয়ে মেট্রোজিল, সন্ধ্যাবেলা লিভোজেন সিরাপ—এই ধরনের প্রেসক্রিপশন করে। কালো জামের বিচির গুঁড়ো, নাক্সভমিকা আর জিনট্যাক একই প্রেসক্রিপশনে লেখা হয়।

বাংলার মানুষ এইসব টোটকা খেতে পছন্দ করে। যখন বলা হয় কাঁচা হলুদের রস খাবেন রোজ সকালে, দু-একটা থানকুনি পাতা ভালো করে ধুয়ে চিবিয়ে খাবেন, মানুষের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মানুষের মনে হয়, এই ডাক্তার যেন নিজেদের লোক, যেন আপনজন। চিন এবং জাপানে নাকি ওদের দেশীয় ওষুধের সঙ্গে পাশ্চাত্য ওষুধের মিলিত চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। চিন ওদের আকুপাংচার নানা রোগের চিকিৎসার কাজে লাগিয়েছে। আমাদের দেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্রিটিশরা যেমন চেয়েছিল তেমনই আছে। বরং দেশীয় চিকিৎসা উপেক্ষিত হয়েছে। বিশেষত পশ্চিমবাংলা, কেরল, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান—এরকম আরও রাজ্যে আয়ুর্বেদ বেশ উন্নত। গবেষণা হয়েছে। পশ্চিমবাংলাতেই উপেক্ষার চোখে দেখা হয়েছে আয়ুর্বেদকে। পশ্চিমবাংলার গ্রামেগঞ্জে আয়ুর্বেদকে অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে সমন্বিত করার ভার নিতে হয়েছে ধন্বন্তরি মেডিকেল কলেজদের, ভজন মৃধাদের।

ভজন মৃধা এখন তারাপীঠে। একটা দিন চেম্বার কামাই মানে গ্রেট লস। কিন্তু করার কী আছে। মায়ের কাছে এলে এত চিন্তা করলে চলে না। গতকাল রাত্রে একটা শুটিং দেখেছিল ভজনরা। এক বাবা যজ্ঞ করছিল, সেই যজ্ঞের ভিডিয়ো তোলা হচ্ছিল। কোন এক কেবল চ্যানেলে দেখানো হবে। শ্মশানে একটা ছোট ফোল্ডিং টেবিলে মেক-আপ ম্যান বসে আছে। টেবিলের উপরে পাউডার, লিপস্টিক, ভ্রূ রং করার পেনসিল এইসব। যজ্ঞে বসার আগে বাবার চুলে কিছুটা পরচুলা মিশিয়ে দেওয়া হল। চুল ঝাঁকড়া করা হল। বাবার নাম দুর্বাসা মুনি (আসল)। কয়েকটা চ্যানেলে নিয়মিত বসেন। এক সুন্দরী উপস্থাপিকা মেক-আপ করে নিল। বলল—মহা তান্ত্রিক দুর্বাসা মুনি মানুষের কল্যাণের জন্য যজ্ঞ করছেন। পৃথিবীর শান্তির জন্য, রোগব্যাধি বিনাশের জন্য যজ্ঞ করছেন। এই যে আমাদের আকাশের ওজোনস্তর ফুটো হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, ঢুকে যাচ্ছে আলট্রা ভায়োলেট রে, এই মন্ত্রপূত যজ্ঞের ধোঁয়া আকাশে উঠে ওজোন স্তরের ফুটো মেরামত করে দেবে…।

বেশ। বেশ। একটা মানসিক শান্তি পায় ভজন ডাক্তার। বেলশুঁঠে এনট্রোকুইনাল কিংবা সুগার অফ মিল্ক-এ একটু স্টেরয়েড মিশিয়ে এমন কী অন্যায় করেছেন?

যজ্ঞ ঘিরে তীর্থযাত্রীরা। স্থানীয় মানুষও আছে। যজ্ঞ হচ্ছে, ঘি পড়ছে, ধোঁয়া উঠছে। ভজন ডাক্তারের স্ত্রী রেবতী হাতজোড় করল। তাই দেখে ছেলে সুবোধও। সুবোধ বোধহয় এখানেও ওর মনস্কামনা জানাচ্ছে। ভজন হাতজোড় করেনি। হয়তো জানে এটা যজ্ঞ নয়, যজ্ঞের অভিনয়। সুবোধ সব জায়গায় ওর মনস্কামনা জানাচ্ছে। তারামায়ের কাছে তো বটেই, শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গের কাছে বসে হাতজোড় করে বিড়বিড় করেছে, এমনকী মন্দিরের বাইরে স্থাপিত শিবের ষাঁড়টির কাছেও।

সুবোধ সত্যি বড় সুবোধ বালক। মা-বাবার বড় ভক্ত। সুবোধের বাপ-মায়ের ইচ্ছে ও যেন ডাক্তার হয়। বাপ-দাদুর মতো ডাক্তার নয়, পাশ করা ডাক্তার। বাপ-মায়ের এত ইচ্ছে বলে সুবোধেরও তাই ইচ্ছে হয়েছে। জয়েন্ট দিয়েছে। পরীক্ষা খুব খারাপ হয়েছে। খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।

ছেলেকে ডাক্তার করানোর ইচ্ছে বহুদিনের। ছেলের বয়স যখন পাঁচ, তখনই বারাসতে একটা বাড়ি কিনে নিয়েছিল ভজন ডাক্তার। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনোর জন্যই মূলত। ভদ্রলোক হওয়ার দুটো পথ। ক্রমশ ব্রাহ্মণত্বের দিকে যাত্রা এবং ক্রমশ শহরের দিকে যাত্রা। বাড়িতে ঠাকুর রেখেছে ভজন, উঠোনে তুলসী গাছ। এসব ভজনের বাবার আমলে ছিল না। ভজনের বাবার শ্রাদ্ধে বামুন ভোজন করিয়েছিল। বাবার শ্রাদ্ধ করেছিল উনিশ দিনে। বামুনরা এগারো দিনে করে। ভজন লিখে যাবে ওর মৃত্যুর পর যেন তেরো দিনে শ্রাদ্ধ করা হয়। যা হওয়ার হবে। ওর ছেলে সুবোধের সময় ওটা এগারো দিনে হয়ে যাবে। বামুনদের এগারো দিনে শ্রাদ্ধ হয়। বাড়ির সামনের দরজার এক দিকে ওঁ অন্য দিকে রেডক্রশ। শহরের দিকে যাত্রাটাও তো চলছে। আর বারাসতে বাড়ি কিনেছিল বেশ কয়েক বছর আগেই। শুঁটিয়া ছেড়ে বারাসতে বসবাস করছে দশ বছর হয়ে গেল। ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয়নি ঠিকই, তবে ছোট মেয়ে অপর্ণাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হচ্ছে। রাস্তায় কারোর সঙ্গে ঝগড়া হলে ফটাফট ইংলিশ বলে দেয়। রাজস্থান বেড়াতে যাওয়ার সময় ট্রেনে চেকারকে ইংলিশ বলে কাবু করে দিয়েছিল। এখন জলখাবারে ব্রেড-বাটার, এগ পোচ, জ্যাম এইসব খাওয়া হয়। অপর্ণাকে টিফিনে স্যান্ডুইচ করে দেওয়া হয়। অপর্ণার ক্লাস নাইন। জিনস পরে। বারাসতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না ভজন। বারাসতে কারুর সঙ্গে খুব একট মেশামিশিও করে না। সময়ই বা কোথায়! সকালবেলায় জলখাবার, স্যরি, ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে যেতে হয় শুঁটিয়া। বেলা দুটোয় ঘরে ফেরা, স্নান খাওয়াদাওয়া, সামান্য দিবানিদ্রা। আবার সন্ধের সময় চেম্বার। শুঁটিয়া থেকে আরও চার কিলোমিটার দূরে নতুন ঘোলা গ্রামে একটা চেম্বার হয়েছে কয়েক বছর হল। বিকেলে ওখানে এক-দেড় ঘণ্টা বসছে, তারপর আবার শুঁটিয়া। একটা গাড়ি কিনেছে। ডিজেল অ্যাম্বাসাডর। মেয়ে বলে অ্যাম্বি। গাড়ির সামনে-পিছনে লাল ক্রস-এর স্টিকার মারা। বারাসাত শহরের ওপর দিয়ে যখন গাড়িটা যায় তখন রেড ক্রসটার দিকে তাকালে মনের ভিতরে একটু পোড়ে। ও জানে এই শহরে ও ডাক্তার নয়। এই শহরে অনেক ডাক্তার আছে। এই বারাসত শহর ওকে সত্যিকারের ডাক্তার মনে করে না। মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে গেলেই গাড়ির কাচে গাছের ছায়ায় মেশানো রেড ক্রসটার দিকে লুঙিপরা মানুষেরা, ড্রপ আউট ছেলেমেয়েদের বাপ-মায়েরা, উকুন বাছতে থাকা, ছাগল খুঁজতে থাকা, কাপড় শুকোতে দেওয়া মানুষরা সম্ভ্রমে তাকায়। যতই বারাসতে থাকুক, বারাসতকে ভালো লাগে না ভজনের। তবু এখানেই থাকতে হচ্ছে। কলকাতা তো আরও খারাপ। তবু ওখানে যেতে হবে। একটা ফ্ল্যাট বুক করেছে দমদম নাগের বাজারের কাছে। কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট না থাকলে প্রেস্টিজ থাকে না। ছেলেমেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ এলে বলা যাবে কলকাতায় ফ্ল্যাট আছে। ক্রমশ কলকাতার কাছাকাছি যাওয়া মানে ক্রমশ কুলীন হয়ে ওঠা।

ছেলে যদি ডাক্তার হয়ে যায় তখন কলকাতার ফ্ল্যাটেই থাকবে ও। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে লিখবে—পাত্র ডাক্তার, নিজস্ব ফ্ল্যাট। লিখবে উচ্চ অসবর্ণে আপত্তি নাই। বামুন, কায়েতের ঘর থেকে সম্বন্ধ আসবে।

খাওয়াদাওয়ার পর এখন ব্যাগট্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ভজন ডাক্তার। নিজেদের গাড়ি করেই এসেছে ওরা। এখন যাচ্ছে বামাখ্যাপার ভিটে দেখতে। যেতে যেতে দেখল রাস্তার ধারে একটা খড়ের চালের বাড়ির মাটির দেয়ালে আলকাতরায় লেখা—ডা. মদনমোহন হাটি। প্রাইভেট প্যাকটিশনার। হ্যাঁ, ঠিক এই বানান। ভজন এর সঙ্গে একাত্মতা বোধ করল না। নিজেকে মনে হল এর থেকে আলাদা। অনেক এগিয়ে থাকা। ওর গাড়ি আছে। মদন হাটির গাড়ি নেই। হয়তো সাইকেল চেপেই রুগি দেখতে যায়। হয়তো সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে বা রডে বেঁধে নিয়ে আসে লাউ, কুমড়ো, কুঁচো মাছ…। রুগি দেখার ফি। ও প্র্যাক্টিস নয়, প্যাকটিস করে।

আজকের খবর কাগজটা খুলল গাড়িতে। একটা নিবন্ধের মতো দেখল—

পশ্চিমবঙ্গের ৭৮ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভোগে।

প্রসূতিদের মধ্যে মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রসবের সময় ডাক্তার, নার্স বা অন্য কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পেয়ে থাকে।

৪০ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম।

৪২ শতাংশ শিশুর পেটে কৃমি আছে।

৬০ শতাংশ মানুষ জীবাণুবর্জিত পরিশুদ্ধ জল পান করতে পারে না।

অর্ধেকেরও বেশি কৃষিজীবী নিরক্ষর। কৃষি পরিবারগুলির ৭০ শতাংশ মহিলা অক্ষরজ্ঞানহীন।

বামাখ্যাপার ভিটেতে পৌঁছোল ওরা। বামাখ্যাপার বংশধরদের এখন অনেক শরিক। সবাই একটা করে মন্দির করে রেখেছে। প্রত্যেকেই উঠোনে একটা করে মাটির ঘর দেখিয়ে বলছে এখানেই বামাখ্যাপা জন্মেছিলেন। সব ঘরের ভিটে থেকেই এক চিমটি করে মাটি উঠিয়ে নিল রেবতী। এইসব পুণ্য মাটি যত্ন করে কাগজে মুড়িয়ে রাখল। বারাসতের বাড়িতে উঠোন নেই, ঠাকুরঘর আছে। ঠাকুরঘরে রেখে দেবে। রেবতী ছেলেকে বলেছিল—পাত্থনাটা ঠিকমতো জানাস। সুবোধ চারটি ভিটেতেই মাথা ঠেকিয়ে বামাখ্যাপাকে বলেছিল—জয়েন্টে যেন মেডিকেলে চান্স পাই।

কেউ কথা শোনেনি। শিব, ষাঁড়, তারা মা, বামাখ্যাপা, কেউ না। জয়েন্টের লিস্টে নাম নেই। থাকার কথাও নয়। তবু দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করেছে, যদি কিছু অলৌকিক কাণ্ড ঘটে যায়। যদি ভুল করে ৩৮-এর পরিবর্তে ৮৩ ছাপা হয়ে যায়। যদি তন্ত্রবল কম্পিউটারকে ভুল করিয়ে দেন। এরকম কতভাবেই তো কত কী হতে পারে, পৃথিবীতে কত কী হয়, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না।

কিন্তু ওরকম কিছু হল না। জয়েন্টে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং কিছুতেই নাম নেই। এ নিয়ে বাড়িতে শোক-টোক কিছু হয়নি। কিছুদিন পর হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বের হল। সেকেন্ড ডিভিশন নম্বর ছিল। কোনওরকমে পাসকোর্সে বিএসসি-তে ভর্তি হল। সময়টা ২০০১।

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল ভজনের—এমবিবিএস হন ম্যানেজমেন্ট কোটা। ঠিকানা, ফোন নম্বর সব রয়েছে।

একদিন দুপুরে খোঁজ করতে গেল ভজন। মহাত্মা গান্ধি রোড-এ লোহার ট্যাংকের দোকানের পাশে একটা ঘর। ঘরটা দু-ভাগ করা। ডানদিকে মুখরুচি ক্যাটারার, বাঁ-দিকে ক্যারিয়ার পয়েন্ট। একটা লোক বসে আছে, চোখের তলায় ফোলা, একটা সাদা দাগ। ভজন মাল খাওয়া মুখ চিনতে পারে। এটা ওর ক্লিনিকাল অবজারভেশন। এমনকী বিলিতি খাওয়া মুখ, না দিশি খাওয়া মুখ বুঝতে পারে। বিলিতির মধ্যেও স্কচ খাওয়া মুখও আলাদা করতে পারে। গাঁজা খাওয়া মুখও চিনতে পারে। এটাই অভিজ্ঞতা। বিলেত থেকে পাশ করা ডাক্তারদের এই অভিজ্ঞতা নেই। লোকটা বিলিতি খায়। বাঁ-হাতে একটা লাল সুতো বাঁধা। দু-হাতে গোটা সাতেক আংটি। লোকটা ঝিমোচ্ছিল। ভজনকে দেখে চাঙ্গা হল। ভজন ওর আসার কারণ জানাল। লোকটা ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বার করল।

জিজ্ঞাসা করল,—কোন ডিভিশন?

—সেকেন্ড।

তবে মণিপালে হবে না। ভেলোরে হবে না। পুনের সাভারকার মেডিকেল কলেজে সিট আছে। তেইশ লাখ।

—তে-ই-শ লাখ?

—ভালো কলেজ। রেপুটেড কলেজ। আপনি এক কাজ করতে পারেন, ইন্দোর ঝাঁসিরানি মেডিকেলে করে দিচ্ছি। কমেই হবে। আঠারো।

—এত?

ইনস্টলমেন্টে দেবেন। ব্যাংক লোন পাবেন। আঠারো লাখ উঠিয়ে নিতে ক-দিন লাগে?

এত টাকা খরচ করার সাহস নেই ভজনের। ভজন চুপ করে থাকে।

—নেপালে পড়তে পারেন। নেপালে কিন্তু কম হয়।

—কম মানে—

—পনেরোয় করে দেব। এটাই লোয়েস্ট।

—একটু ভাবি।

আর এক জায়গায় গেল ভজন। সেটা বেশ সাজানো-গোছানো, এসি বসানো ঘর। ঝকঝকে টেবিলে একজন মহিলা। পুরু ঠোঁটে কালচে-খয়েরি লিপস্টিক। বলল,—চায়নায় পাঠিয়ে দিন। ইন্ডিয়ান কারেনসিতে মাত্র সাত লাখ টাকা টিউশন ফি। হোস্টেল চার্জ তিন লাখ মতো, আর যাতায়াত ভাড়া। ইন্ডিয়ার চাইতে চিপ। এমনকী নেপালের তুলনাতেও সস্তা। আমরা গত বছর একশোজনকে চিনে পাঠিয়েছি।

—চিনারা কি আরশোলা খায়? মাথা চুলকোতে চুলকোতে ভজন জিজ্ঞাসা করে। লিপস্টিক-ঠোঁট হেসে ওঠে। বলে,—চিনারা খায় খাক, তাতে আমার-আপনার কী? ফরেন স্টুডেন্টদের কনটিনেন্টাল ডিশ দেয়। এখন এত বেশি ইন্ডিয়ান ছাত্র যাচ্ছে, লুচি-পুরি-দোসা—এসব মেনুর মধ্যে ঢুকে যাবে।

চিনে খরচ কিছুটা কম সত্যি কথাই। কিন্তু গিন্নি চিনে পাঠাতে রাজি হল না। আরশোলা-টিকটিকি-গিরগিটি—এসব ভয় তো ছিলই, তাছাড়া পাঁচ বছর ছেলেকে দেখতে না পাওয়ার আশঙ্কা। ভারতের যে-কোনও জায়গায় পড়লে ছেলের সঙ্গে দেখা হওয়া সম্ভব, কিন্তু চিন মানে তো সেই অচিনপুর।

ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল ভজন। ছেলে তো সত্যিই সুবোধ। বলল,—তোমরা যেখানে পাঠাবে সেখানেই যাব।

—মাকে ছেড়ে চার বছর থাকতে পারবি? সুবোধ বুঝতে পারে না ‘হ্যাঁ’ বলা উচিত নাকি ‘না’ বলা উচিত, ও হাঁ করে থাকে।

অপর্ণা বলে, চিন মানে তো ফরেন, তাই তো? দাদাকে চিনেই পাঠাও। বেশ ফরেন ডিগ্রি হবে…।

ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল আবার চিনের এমবিবিএস মানে না। ভারতবর্ষে প্র্যাকটিস করতে হলে আবার পরীক্ষা দিতে হয়। ঝামেলা আছে। তার চেয়ে ইন্ডিয়ান ডিগ্রিই ভালো। যদি লাখ দশেক টাকা লোন নেওয়া যায়, তবে মাসে দশ হাজার করে শোধ করতে হবে বছর বিশ। ছেলের নামে এডুকেশন লোন হতে পারে। কিন্তু পাশ করেই মাসে দশ হাজার টাকা করে লোন শোধ করা কি ওর দ্বারা সম্ভব হবে? ছেলে খুব একটা খেলুড়ে নয়। রুগি খেলাতে পারবে? টাকা তুলবার কায়দা আছে।

নিজের কাছে এখন খুব বেশি টাকা নেই। গাড়ি আছে, ড্রাইভার আছে, কলকাতায় ফ্ল্যাট বুক করা হয়েছে, মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। এত আমদানি নেই। অন্য ডাক্তাররা যেমন নানারকমের রোজগার করে, ভজনের তত নেই। ভজন মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে পারে না। ওর মেডিকেল সার্টিফিকেটে এখন প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারও আপত্তি করছে। বড় প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি থেকে কমিশন পাঠায় না। ছোটগুলো পাঠায়। ভজন ছোট ছোট ল্যাবেই স্যাম্পল পাঠায়। কোনও কোনও পেশেন্ট পার্টি বড় ল্যাব থেকে করিয়ে আনে, ভজন কিছু বলতে পারে না। কিছু মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ আসে, কিন্তু বড় কোম্পানি আসে না। কোনও বাঁধা মাইনের চাকরি নেই, পেশেন্ট যা দেয়। পেট খসানোও কমে গেছে। এখন যেখানে অবৈধ সম্পর্ক আছে, সেটা কনডোমের মাধ্যমেই হচ্ছে। কনডোম কিনতে এখন আর লোকের লজ্জা নেই। মুদি দোকানেও কনডোম বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মেয়েরা আজকাল মালা-ডি খেয়ে নিচ্ছে। আর আলট্রাসোনোগ্রাফি করে যারা পেটের বাচ্চা ছেলে না মেয়ে জেনে নিয়ে মেয়ে বাচ্চা খসিয়ে দিচ্ছে, ওদের অনেক টাকা। ওরা বড় নার্সিংহোমে-এ যায়। সব নিয়ে একটু ক্রাইসিসে আছে ভজন। এরকম অবস্থায় এতগুলো টাকা…।

রেবতীর সঙ্গে পরামর্শ করে ভজন। রেবতী বলে,—সামনের বার যদি ভালো করে পড়াশোনা করে আর…কথা থামিয়ে দেয় ভজন।

—যতই পড়ুক হবে না। জামের বিচি থেকে কি আপেল গাছ হয়! আমি কী আমি জানি। তুমি কী তাও জানি। তোমার বাবা কী তাও জানি। জয়েন্ট দিয়ে পাওয়ার গপ্পো নেই।

অথচ মন মানে না। দাদু ডাক্তার, বাবা ডাক্তার, দুজনে কেউ আসলে ডাক্তার ছিল না। দুই পুরুষের প্রত্যাশার মেঘ তৃতীয় পুরুষে বৃষ্টি হয়ে নেমেছে।

বেচারা সুবোধ। ও কী করে? ওদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বৃষ্টিতে ভিজছে। ওর করবার কিছু নেই। পরের সপ্তাহে আবার নতুন বিজ্ঞাপন দেখে ভজন। লেখা হচ্ছে এমবিবিএস ইন ভেরি চিপ রেট। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট বুক। ফিউচার বিল্ডার্স।

এটা মৌলালির কাছে। একটা ঘর পার্টিশন করা। ভিতরে চেম্বার, বাইরে ভিজিটার্স। ডাক্তারদের যেমন থাকে। বাইরে একটা লোক বসে আছে। ও একটা খাতায় ভিজিটারদের নাম-ঠিকানা, কীসে ভর্তি করাতে চায় টুকে নিচ্ছে। খাতায় একটা ঘর আছে। ওখানে মান্থলি ইনকাম লিখতে হয়। ভজন ভাবতে লাগল কত লেখা উচিত। বেশি লিখলে ওরা পেয়ে বসবে। ও একটু কম করেই লিখল। ভিতরে যেতে বলল। ভজন ভিতরে গেল। একটা কমবয়সি ছেলে বসে আছে। ঘরে খুব সুন্দর একটা ক্যালেন্ডার। তাজমহলের একটা ভারী সুন্দর ছবি। ঘরের ভিতরে সুগন্ধ। ছেলেটার বেশ সুন্দর চেহারা। ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল,—ডাক্তারি?

—হ্যাঁ।

—আপনি কী করেন?

—আমি ডাক্তার। কোয়াক ডাক্তার, কোয়াক।

—কর্ণাটকে পাঠাবেন?

—কীরকম খরচা?

—সাতাশ লাখ।

—তবে যে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন চিপ রেট।

—বিডিএস পড়ান, কম হয়ে যাবে।

—বিডিএস? ডেন্টাল সার্জন? কত পড়বে?

—উনিশ।

—এ আর কম হল কী।

—তাহলে বিএএমএস পড়ান, আয়ুর্বেদ।

—কবিরাজি? না-মানে…

—আয়ুর্বেদ বিএএমএস ডাক্তাররা সারা ভারতে এমবিবিএস ডাক্তাদের অ্যাট পার জানেন?

—না, মানে পশ্চিমবঙ্গে তো…

—পশ্চিমবঙ্গেও চাকরি হয়। হেলথ সার্ভিসে নেয়।

—ওটা কত পড়বে?

—দশ লাখ।

—এত পারব না।

—তা হলে হোমিওপ্যাথি পড়িয়ে নিন। হোমিওপ্যাথিতেও জয়েন্ট এনট্রান্স দিয়ে ঢুকতে হয়। বিএইচএমএস ডিগ্রি দেয়। মেডিকেল সার্টিফিকেট দিতে পারে, ডেথ সার্টিফিকেটও দিতে পারে।

—ওটা কত?

—ওটা সাত লাখ।

খুব মোক্ষম জায়গায় ব্যথাটা লাখল ভজন মৃধার। ভজন সার্টিফিকেট দিতে পারে না। সার্টিফিকেট দেওয়ার শখ বহুদিনের। কীভাবে সার্টিফিকেট দিতে হয় তার বয়ান ওর মুখস্থ।

ভজন চুপ করে বসে থাকে। একবার ভাবে হোমিওপ্যাথিটা পড়িয়ে নেবে কিনা। ভজনের নিজের হোমিওপ্যাথির ডিগ্রি নেই। ও যখন অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়েছিল, তখন একজন হোমিওপ্যাথির কয়েকটা ক্লাস নিয়েছিল। ভজন এখনও আর্নিকা, নাক্সভোমিকা, ব্রাইওনিয়া, রাসটক্স, বেলেডোনা এইসব ব্যবহার করে। সেই টিচার আবার ছড়ায় পড়াতেন। কয়েকটা ছড়া আজও ভোলেনি। হুট করে মনে পড়ে গেল ভজনের।

ছোট ছোট কৃমি যদি থাকে মলদ্বারে,

টিউক্রিয়াম ত্রিশ শক্তি দিয়ো বারে বারে।

শিশুদের শয্যামূত্র, দাঁত কড়মড় করে—

সিনা ২০০ সপ্তাহে এক কৃমি-দোষ সারে।

সেন্টোনাইন এক গ্রেন দুইবার করিয়া,

খাইলে কৃমির বংশ যাবে বাহিরিয়া—

এটা কৃমির ক্লাসে পড়ানো হয়েছিল।

পৃষ্ঠাটা টেবিলের কাচের তলায় রেখেছিল বহুদিন।

হোমিও পাশ করলে সুবোধকে চেম্বারে রেখে কিছুটা অ্যালোপ্যাথি নিজে শিখিয়ে দিতে পারবে…। মিক্সড নয়। মিক্সড করে পাতি কোয়াকগুলো। পিওর হোমিওপ্যাথিই ভালো। তো হোমিওপ্যাথিই যদি পড়ানো হবে তো সাত লাখ টাকা দিয়ে কেন? সামনের বছর জয়েন্ট দেওয়া যাবে। হোমিওপ্যাথি পড়াতে পঞ্চাশ হাজার টাকাও লাগবে না।

—কী স্যার, এতক্ষণ চুপ করে আছেন যে…। লোকটা বলে।

—ভাবছি।

—কী ভাবছেন? ভাবনার কোনও শেষ নেই।

—না, ভাবছি হোমিওপ্যাথিই যদি পড়াব, সামনের বার হোমিওর জয়েন্টে বসিয়ে দেব। এত টাকা খরচা করতে যাব কেন? কষ্টের টাকা…।

—ইয়ার লস করাবেন কেন? এক বছর আগে থেকে যদি ডাক্তারিটা শুরু করে আপনার টাকা উশুল হয়ে যাবে।

তা বটে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ভজন। তারপর বলে, নাঃ, সামনের বছর হোমিওপ্যাথিই পড়াব। কিন্তু আপনারা মিথ্যে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। লিখেছেন চিপ রেট-এ এমবিবিএস পড়াচ্ছেন। হোমিওপ্যাথি লেখেননি কিন্তু।

মিথ্যে বিজ্ঞাপন দিইনি। চিপ রেটেই হবে। আগে তিনদিন ধরে ভাবুন ছেলেকে কী পড়াবেন। তিনদিন পর ফোন করব। খাতায় ফোন নম্বর লেখা আছে তো?

বাড়ি ফিরে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে ভজন। গিন্নির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার কোনও মানে নেই। ও কোনও স্পষ্ট মতামত দেবে না। বিএসসি পাস কোর্সে পাশ করে কী চাকরি পাবে কে জানে? তার চেয়ে হোমিওপ্যাথি পড়াটা খারাপ না। তৈরি চেম্বার, তৈরি রুগি। বলছে বটে, দু-হাজার দশ সালে সকলের জন্য স্বাস্থ্য। ক্যাঁচকলা হবে। চুল্লু যতদিন আছে, লিভার আর গ্যাস্ট্রিকের অসুখ ততদিন থাকবে। লিভারের রুগিদের চিকিৎসার করা সহজ, কারণ চিকিৎসা হয় না। কোনও কোনও জন্ডিস এমনিই সেরে যায়। না সারলে সোজা বলে দাও হাসপাতালে যাও। গ্যাস্ট্রিকের অনেক ওষুধ আছে, খাওয়ালে কিছুদিন ভালো থাকে, আবার হয়। চামড়ার রোগী প্রচুর। চাষিরা মাঠে নামে, জুতো-টুতো পরার অভ্যেস নেই। জল-হাজা লেগেই আছে। দাদও প্রচুর। চামড়ার রুগির সুবিধে হল, চামড়ার রুগি মরে না, আর সহজে সারে না। পেটের রোগও থাকে যাবে। হাত ধোয়ার অভ্যেস নেই। ইস্টিশন-বাজারে যেসব খাবার-দাবার বিক্রি হয়, তাতে মাছি-টাছি ভালোই পড়ে। পেটটাও ভালো করে ধোয়া হয় না। যে জলে ধোয়া হয়, তার চেয়ে না ধোয়াই ভালো। বলে না, জলই জীবন। এই জলই, মানে খারাপ জলই বাঁচিয়ে রেখেছে কোয়াক ডাক্তারদের। প্রতি পাঁচ জনের তিন জনের পেটের গন্ডগোল। পায়খানা মাঠে। কৃমির ডিম ছড়াচ্ছে জলে, শরীরেও। রুগির সাপ্লাই যদি থাকে, আর রুগি যদি গরিব হয়, হোমিওপ্যাথির মার নেই। আবার অনেক মুসলমান রুগি আছে যারা পুরিয়া নেয় না, লিকুইড চায়। শিশি মসজিদে নিয়ে শিশির দাবাইটাতে ইমাম সাহেবের ফুঁ মারিয়ে নেয়।

কিন্তু হোমিওপ্যাথিই যদি পড়বে তো বাইরে এত টাকা দিয়ে পড়তে যাবে কেন? কলকাতাতেই তো আছে। তাছাড়া একটা কথা আছে, যার নাই কোনও গতি সে পড়ে হোমিওপ্যাথি। তবে এক কাজ করলে হয়। কলকাতার ফ্ল্যাট এখন থাক। যে টাকা দিয়ে বুকিং করা হয়েছে সেটা ফেরত চেয়ে নিলে হয়। যা আছে সব জোগাড় করে নেপালে পাঠালে কেমন হয়?

এইসব চিন্তায় ঘুম হয় না ভজনের। ছেলের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে। বউকে জিজ্ঞাসা করে ভজন—হ্যাঁ-গো, তোমার মোট ক-ভরি গয়না আছে বলবে? রেবতী বলল,—কেন, গয়নার খোঁজ নিচ্ছ কেন!

—না, জানতে চাই আমাদের কী আছে। ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে হবে না?

—তা বলে গয়নায় হাত দিতে হবে?

—ছেলের জন্য গয়নাগুলো ছাড়তে পারবে না!

—কত কষ্ট করে করেছি ওগুলো…। পঞ্চাশ টাকা, একশো টাকা করে সরিয়ে-সরিয়ে গয়নাগুলো করিয়েছি।

—তোমার ছেলে কি তোমার গয়না নয়! বুঝবে কী করে। বিদ্যাসাগরের মায়ের কথা পড়েছিলাম ইস্কুলে, এখনও মনে আছে। বিদ্যাসাগর ওর মাকে গয়না গড়িয়ে দিতে চাইল, তখন বিদ্যাসাগরের মা বলল,—তুই তো আমার গয়না, আমার আর গয়নার দরকার নেইকো।

—সে আলাদা কথা। কিন্তু তোমার কী এমন দুরবস্থা হল যে সামান্য গয়নাগুলোও বেচতে হবে?

—ডাক্তারি পড়াতে কত খরচ লাগছে জানো? বারাসতের এই পুরো বাড়ি বেচে দিলেও হবে না।

রেবতী একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, তুমি যেরকম ডাক্তারি পড়েছ সেরকম পড়লে হয় না? তুমি তো খারাপ নেই। ছেলে বিএসসিটা পাশ দিক, তারপর এইটা পড়ুক। ডিগ্রিটাও লম্বা হবে। তুমি ওকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ো’খনে। এতগুলো টাকা…। আমাদের যদি বড় অসুখ-বিসুখ করে তো কী হবে?

ভজন বলে—আর ওটা নেই। বামফ্রন্ট সরকার ওসব উঠিয়ে দিয়েছে। অলটারনেটিভ মেডিসিনের সব কোর্স উঠিয়ে দিয়েছে। চার বছর হয়ে গেল।

মোটামুটিভাবে একটা সিদ্ধান্তে আসে।—এ বছর নয়, আগামী বছর হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদে জয়েন্টে বসবে।

একটা ফোন এল।

ফিউচার বিল্ডার্স থেকে বলছি। তিন দিন পর ফোন করব বলেছিলাম। কিছু ভাবলেন? ভজন বলল,—ভেবেছি, সামনের বছর আবার জয়েন্টে বসাব।

—সামনের বছরও হবে না।

—কবিরাজি আর হোমিওপ্যাথির জয়েন্টে বসাব।

—ওখানেও হবে না।

—কেন?

—আপনার ছেলের মার্কশিট আমি দেখেছি। ওসব জয়েন্টেও টাফ কম্পিটিশন। একটা পাশ করা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারদের এখন ফি কত জানেন? মিনিমাম ফর্টি রুপিস। আর আয়ুর্বেদ ডাক্তাররা কীসে টাকা কামাচ্ছেন জানেন তো, কিছু মনে করবেন না স্যার, পেনিস মোটা করার ঢপ দিয়ে। আজকাল পেনিস মোটা করার ক্রেজ হয়েছে। আবার এ-ও শুনছি, আজকাল সবাই নাকি কম বয়সে ধ্বজ হয়ে যাচ্ছে, আর সব কবিরাজের কাছে ছুটছে। কবিরাজদের এখন বাজার ভালো। কবিরাজি পড়াতেই পারেন। বিএএমএস। সে তো আগেই বলেছি। তবে লিখে নিন, জয়েন্টে হবে না। ম্যানেজেমেন্ট কোটা দরকার হবে। আপনি ম্যাক্সিমাম কত খরচ করতে পারবেন?

—সাত-আট লাখ।

—আরও কিছু উঠুন।

—পারব না স্যার।

স্যার বলে ফেলল ভজন। একটু আগে ওই ছেলেটাই স্যার বলেছিল ভজনকে। এখন ভজন স্যার বলে ফেলল।

—আসুন দু-একদিনের মধ্যে দেখি কী করতে পারি।

আবার গেল ভজন। কলকাতা যেতে ভালো লাগে না ভজনের। বিচ্ছিরি হট্টগোল, ধোঁয়া, বাস, মিনিবাস, অটোর চেঁচামেচি। রাস্তাও ভুল হয়ে যায়। কলকাতায় গাড়ি আনে না ভজন। অনেকটা তেল পোড়ে। ট্রেনে শিয়ালদহ নেমে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডে কেমন বে-দিশা লাগে ভজনের। বারাসত-বামনগাছি-দত্তপুকুর কেন্দ্রিক জীবনটাতেই অভ্যস্ত ভজন। মাছওয়ালা খাতির করে, রিকশাওয়ালারা ডাক্তারবাবু বলে জোড় হাত করে। যে মাছওয়ালার বউকে ভুল চিকিৎসায় মেরে ফেলেছিল ভজন, সেই মাছওয়ালাটিও পাতলা ডিমওয়ালা পদ্মার ইলিশ বেছে রাখে।

ফিউচার বিল্ডার্স-এ আবার গেল ভজন। বুক ধুকপুক করছে। অন্য একটা বিল্ডার্স আছে বারাসতে, সেটাও ফিউচার বিল্ডার্স। ওখানে যখন যেত, মনে আনন্দ হত। ওখান থেকে বেসিন কিনেছে, কমোড কিনেছে, আয়না…

কমোড ব্যাপারটা রপ্ত হতে বেশ টাইম লেগেছিল। বাপের আমলে তো মাঠেই যেত। শুঁটিয়ার বাড়িতে যখন পায়খানা তৈরি হল, তখন ভজনের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। যখন পুরী গেল, বছর পাঁচ-ছয় আগেকার কথা, হোটেলে কমোড ছিল। কিছুতেই হয় না। পরদিন পারগেটিভ নিতে হল। সেটাই প্রথম কমোড ফুল। তারপরই বাড়ির জন্য কমোড কেনা হল ফিউচার বিল্ডার্স থেকে।

এই ফিউচার বিল্ডার্সে গেলে ক-লাখ টাকা বলবে, কে জানে?

ছেলেটা আজ অন্য জামা পরে এসেছে। বেশ দেখতে ছেলেটাকে। ছেলেটা বলল,—রোজ আসি না। আপনার জন্যই এলাম।

ছেলেটার পাশে অন্য চেয়ারে একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা দেখতে মন্দ না। আজকাল সব মেয়েই কীরকম যেন একই রকম দেখতে হয়। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স হবে।

ছেলেটা বলল,—নেপালে সাড়ে তেরো লাখে করে দিতে পারি।

ভজন বলল,—আমার সাধ্য নেই।

মেয়েটা এবার মিষ্টি হেসে বলল, সাধ আছে?

ভজনের হ্যাঁ বলতে লজ্জা-লজ্জা করল। সদ্য কিশোরীকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়—মেনস শুরু হয়েছে? তখন যেমন করে ঘাড় নাড়ায়, তেমন করেই ঘাড় কাত করল ভজন। ছেলেটা বলল,—তা হলে টাকা জোগাড় করুন। সামনের বার। একটা জীবনের পক্ষে একটা বছর এমন কিছু বেশি নয়। আরও চার-পাঁচ লাখ টাকা জমিয়ে ফেলুন, সামনের বারে করে দেব।

ভজন বলল,—এই কথা তো ফোনেও বলতে পারতেন। এই কথাটা বলার জন্য এত দূরে টেনে আনার কোনো মানে হয়?

ছেলেটা হাসল।

মেয়েটা বলল, নো কষ্ট, নো কেষ্ট।

বুঝতে সামান্য লেট হল ভজনের। ভজন বলল,—কই কেষ্ট? কেষ্ট মিলল নাকি?

মেয়েটা বলল,—সবুরে মেওয়া ফলে।

ভজন বলল,—সে তো আমি জানি।

ছেলেটা বলল,—আপনি কতটা সিরিয়াস সেটাই দেখছিলাম। যদি সত্যিই সিরিয়াসলি ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে চান তো টাকা জমিয়ে ফেলুন।

জমিয়ে ফেলুন বললেই কি জমানো যায় নাকি! ভজন গজগজ করতে থাকে ভিতরে ভিতরে। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে ভজন।

—চা খাবেন?

ভজন বলে,—না। ইনজেকশন দেওয়ার পর—ব্যথা লাগল? জিজ্ঞাসা করলে বালক যেমনভাবে না বলে।

ছেলেটা বলল,—মাঝে মাঝে ফোন করে জিজ্ঞাসা করব কত জমল।

রোজগার বাড়ানোর কী উপায়?

ফি বাড়ানো চলবে না। আর ফি বাড়ালে রুগি কমে যাবে। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের দেওয়া স্যাম্পল এমন কিছু বেশি আসছে না। ওরা আজকাল স্যাম্পল কম দিচ্ছে। ফ্লাস্ক, মানিব্যাগ, টি-সেট এইসব গিফট দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, গোয়া-সিমলা—এসব জায়গায় কনফারেন্সের নামে বেড়াতেও নিয়ে যাচ্ছে। বারাসতের অতীন গুপ্ত, এন্তার সুবামাইসিন আর কোরেক্স প্রেসক্রাইব করে। সব কিছুতেই সুবামাইসিন। আর কাশি হলেই কোরেক্স। কোম্পানি থেকে মস্ত বড় ফ্রিজ দিয়েছে। গত বছর শীতকালে ব্যাংকক-পাট্টায়া ঘুরিয়ে এনেছে। পাট্টায়াতে নাকি ন্যাংটো নাচ দেখা যায় সস্তায়। এখন ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের কিনে রেখেছে। যার যত প্র্যাকটিস তার দাম তত বেশি। রুগি-সংখ্যার বিচারে ভজনেরও প্র্যাকটিস খারাপ নয়। কিন্তু রুগির সংখ্যায় ভালো প্র্যাকটিসের বিচার চলে না। যে রুগিরা ডাক্তারের কাছে আসছে সেইসব রুগিরা কত ওষুধ কিনছে, কত টাকার ব্যবসা দিচ্ছে সেটাই দেখার। ভজন অম্বল হলে সব চেয়ে সস্তার ওষুধ জিনট্যাক লিখছে। ওর তো গরিব রুগি। জিনট্যাকের দাম চল্লিশ পয়সা। ভজন প্যান ফর্টি লেখে না। সাড়ে ছ-টাকা করে দাম। ভজন তো বেলশুঁট পুরিয়া করে দেয়, হিঞ্চের রস খেতে বলে। আজ যদি অতীন ডাক্তারের ছেলে প্রাইভেট কলেজে ম্যানেজমেন্ট কোটায় ডাক্তারি পড়তে চাইত, তবে হয়তো কোনও ওষুধ কোম্পানিই টাকা দিয়ে দিত। রোজগার বাড়াবার কী উপায়? ভজন বুঝে উঠতে পারে না।

একটা ঘটনা মনে পড়ল ভজনের। বছর তিন আগেকার কথা। চেম্বারে একটা লোক এল। এসে বলল, স্যার একটা প্রাইভেট কথা আছে। তখন বেলা সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। চেম্বারে সাত-আট জন রুগি আছে।

ভজন জিজ্ঞাসা করেছিল, কী ব্যাপার? কীসের প্রাইভেট?

লোকটা বলল, আপনার সব পেশেন্ট চলে যাক, তারপর বলব।

ঘণ্টাখানেক বসে রইল লোকটা। তারপর চারদিকে চোখ বুলিয়ে একটু গলাটা নামিয়ে বলল,—আমি স্যার একটা ব্যবসা করি। কিডনির ব্যবসা। অনেক গরিব লোক আছে, যাদের হঠাৎ টাকার দরকার। কোথাও টাকা পাচ্ছে না। ও কিন্তু তখন তার একটা কিডনি বেচে দিতেই পারে। ভালো টাকা পাবে লোকটা। আপনিও পাবেন স্যার।

ভজন বলে কিডনি বেচা-কেনাটা তো বেআইনি তাই না?

—সে তো কত কিছুই বেআইনি।

—কিডনি ডোনেট করা যায়, বিক্রি করা যায় না।

—এটা ডোনেটই হবে। যার কিডনি সে টাকা পাবে। এমনি এমনি কেউ খামোখা ডোনেট করতে যাবে কেন?

—তো আমি কী করে বুঝব কেউ কিডনি বেচবে কিনা।

—আপনাদের সঙ্গে তো কত লোকের আলাপ-সালাপ হয়। কত লোক আসে…

—তা আসে, কিন্তু কার কিডনি খারাপ হয়ে গেছে, তা হয়তো বুঝতে পারি। কিন্তু কে কিডনি বেচতে চায় সেটা বুঝব কী করে? আর খারাপ কিডনি বেচতে চাইলেও তো বিক্রি হবে না।

—তা হবে না, আসলে মানুষের দুটো কিডনি আছে কিনা, একটাতেই কাজ চলে। একজোড়া করে দেছেন ভগবান। একটা স্পেয়ার। দুটা ফুসফুসের দরকার নাই, একটাতেই চলে। দুটা বিচির দরকার নাই, দুটা কিডনিরও দরকার নাই। একটা না হলে ক্ষতি নাই।

একটা কার্ড দিয়েছিল লোকটা। নাম আর মোবাইল ফোন নম্বর লেখা আছে। বলল, এটা রাখেন। খোঁজ পেলেই জানাবেন। বুঝলেন স্যার, যোগাযোগটাই আসল। এই সময় দেখুন কত লোক বাড়ি চাইছে, আবার কত লোক বসে আছে ঘর ভাড়া দেবে বলে। কাগজের এপাশে লিখছে পাত্র চাই আবার ওপাশে লিখছে পাত্রী চাই। কিডনিও সেরম, কেউ দিতে চায়, কেউ নিতে চায়। কিন্তু নিতে চাওয়ার লোকই বেশি। ডিম্যান্ড আছে।

কার্ডটা খুঁজছে ভজন। না, কোনো কিডনি বিক্রেতার সন্ধান পায়নি। ও শুধু জানতে চায় টাকার অংক। আসলে ওটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি ভজন। কাকেই বা জিজ্ঞাসা করতে যাবে, কিডনি বেচবেন? কোনো দরিদ্র রুগিকে ফিসফিস করে বলতে হত—একটা কিডনি বেচে দিন না ভাই, আমি ব্যবস্থা করে দেব। বেশ কিছু টাকা পাবেন।

কিন্তু কত টাকা? লাখ দুই? তাহলে নিজের একটা কিডনি চুপিচুপি ঝেঁপে দেওয়া যায়। কাউকে জানানোর দরকার নেই। শুধু বলা হবে গলব্লাডার অপারেশন। বউকে বলা চলবে না। বউ চেঁচামেচি করবে। বিধবা হওয়ার ভয়।

মনটাকে স্থির করার চেষ্টা করে ভজন। আজকাল টিভিতে রামদেবের প্রাণায়াম দেখে। মাঝেমাঝে প্রাণায়াম করার চেষ্টাও করে। অনুলোম-বিলোম, কপালভাতি। দুই ভ্রূ-র মাঝখানে—মনটাকে স্থির করার চেষ্টা করে ভজন। কিন্তু দুই ভ্রূর মধ্যে একটি কিডনির ছবি ব্রহ্মকমলের মতো ফুটে থাকে। কিডনি।

শরীরের মধ্যে কত টাকার মাল বহন করে চলেছি আমরা। এজন্যই তো বাউল-খ্যাপারা বলেন শরীরে আছে মণিমানিক-গুপ্তধন, ওসব জানতে হয় রে, বুঝতে হয় রে মন। একটা বডিতে ছ-লিটার রক্ত। আড়াইশো সিসি রক্ত নিলে চারদিনের মধ্যেই রক্ত তৈরি হয়ে যায়। হাড়ের ভিতরে নাকি রক্ত তৈরির কারখানা। এসব মদন রানার বইতে লিখেছে। একটা লোক বছরে হেসেখেলে বিশ হাজার টাকার রক্ত বেচতে পারে। দশ বছরে আড়াই লাখ। এই যে বউ-এর বুকে দুটো মাই, এ দিয়ে কী হবে ছাই? এখনে তো ধরতেও ইচ্ছে করে না। ওগুলো বেচা যায় না? কত করে দাম হবে? কাগজে উঠেছে কোনও কোনও ছেলে নাকি মেয়ে হতে চায়। প্লাস্টিক সার্জারি করাচ্ছে। ওদের কাছে বিক্রি করা যায় না? ওরা কি ঝোলা জিনিস নেবে? তবে ঠিকঠাক করে নেওয়া যায়। সার্জারির কত উন্নতি হয়ে গেছে। টিসুগুলো তো অরিজিনাল। ঊরুর মাংস বুকে লাগালে কী আসল জিনিস হয়? আসল টিসু চাই। কোন বইতে যেন লেখা ছিল—ঠোঁট থেকে শুরু করে মুখ, খাদ্যনালী মায় স্টমাক, ইনটেসস্টাইন থেকে এক্কেবারে পায়ুদ্বার পর্যন্ত এক জাতের টিসু দিয়ে তৈরি। ঠোঁটের টিস্যু আর পাইখানা করার জায়গাটার টিসু নাকি সেম। কারুর যদি ঠোঁট পুড়ে যায়, সেখানে পোঁদের চামড়া গ্রাফটিং করে দেওয়া যায়।

কত যে বিজনেস আসছে সামনে। শরীরের স্পেয়ার বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। কেউ হয়তো কোনো লোককে পুষে রেখে দেবে। তাকে রোজ উরুত্থকলাই ভেজানো জল খাওয়ানো হবে কিডনি ভালো রাখার জন্য। দরকার মতো কিডনি সাপ্লাই হয়ে যাবে, গরম গরম। কাউকে রোজ রোজ পদ্মগুলঞ্চের রস, কালোমেঘ পাতার বড়ি খাওয়ানো হবে রেগুলার। কোয়ালিটি লিভার। একদম এ-গ্রেড লিভার সাপ্লাই হবে। বলা হবে, এ লিভারে কোনওদিন অ্যালকোহল ঢোকেনি। কালোমেঘ খাওয়া আয়ুর্বেদিক লিভার। বায়ো-প্রোডাক্ট।

নিজের একটা কিডনি বেচার কথা ভাবছে ভজন, কিন্তু ভনভন করা মাছি। সব বিক্ষিপ্ত চিন্তা। সিরিয়াসলি নিজের কিডনিটার কথা ভাবতে থাকে ভজন। কিডনির অপর নাম বৃক্ক। ধন্বন্তরি মেডিকেল কলেজে যিনি পড়াতেন, তিনি বৃক্ক উচ্চারণ করতে পারতেন না। বলতেন বিক্ক। বোর্ডে ছবি এঁকে বোঝাতেন। ডাক্তার স্বপন পালের সচিত্র অ্যালোপ্যাথিক শিক্ষা বইটাতে কিডনির কার্য পড়েছিল ভজন। নেফ্রন-এর কার্যপদ্ধতি পড়েছিল। কিডনিতে পাথর জমে। এক্স-রে করলে পাথর বোঝা যায়। খুব জল খেতে হয়, আর হোমিওপ্যাথিক ফাইটোকক্কাস ওষুধ দিতে হয়। কুলত্থকলাইয়ের জল আর হিমালয়ান ড্রাগস কোম্পানির সিসটোন বড়ি। কিডনি খারাপ হয়ে পা ফোলা দেখা দিলে ওই রোগী হাতে রাখতে নেই। চোখ বুঁজে ফেলে ভজন। পিঠের দিকে মেরুদণ্ডের দু-পাশে দুটো পদ্মকুড়ির মতো কিডনি। কত দাম হবে নিজের কিডনি দুটোর।

দুটো কেন? দুটো বেচে দিলে নিজের কী থাকবে? একটা। কত দাম হবে?

লাখ দুয়েক।

কলকাতার ফ্ল্যাটের বুকিং মানি + জমানো টাকা + বউ-এর গয়না + নিজের একটা কিডনি = নেপালে ডাক্তারি পড়া হবে তো? হিসেব মেলে না।

নিজে বেচতে গেলে ভালো দাম পাওয়া যায় না। কোনও জিনিসেরই নয়। কেউ যদি কিনতে আসে, নিজের মালের বেশি দাম চাওয়া যায়? এখন যদি ওই কিডনির দালালের কাছে গিয়ে বলা হয়—নিজের কিডনিটা বেচব, ওইসব ঘাঘুমাল এমন ভাব দেখাবে যেন এখন দরকার-টরকার নেই, আচ্ছা, বলছ যখন কিনছি..। আর ভজনের যা রোগীপত্তর, বা ওর যা পরিচিত গণ্ডি, ওখানে সব গরিব-গুরবোর দল। কে-ই বা দু-চার লাখ দিয়ে কিনবে?

মনে মনে এলাকার এমএলএ-র কথা ভাবে। এমএলএ সাহেবের কিডনিটা যদি মহান ভগবানের দয়ায় খারাপ হয়ে যায়, আর যদি এক্ষুনি দরকার হয়, আর সেই খবর যদি ভজন পেয়ে যায়, তবে লাখ দশেক দর হাঁকা যেতেই পারে। একজন এমএলএ-র জীবনের দাম অনেক বেশি। ওদের টাকা ভূতে জোগায়। ভূত কেন? জনগণ। জনগণ কিংবা ভূত। ইশ, যদি একটা এমএলএ খদ্দের জুটে যায়, তবে কিডনিটা দিয়ে-দি…।

চুপচাপ বসে আছে ভজন। একটা বাক্সের মধ্যে সব কার্ডটার্ড রাখে। বেশিরভাগ কার্ডই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের।

ওরই মধ্যে কোথাও কিডনির দালালের কার্ডটা আছে। কার্ডের বাক্সটা সামনে নিয়ে বসেই আছে। আসলে কিন্তু খুঁজছে না কার্ডটা। প্রকৃত প্রস্তাবে খুঁজছে না কার্ডটা, খোঁজার ভান করছে। আসলে পুত্রের প্রতি পিতার কর্তব্য এবং নিজস্ব শরীরের প্রতি নিজের কর্তব্য—এই দ্বন্দ্ব ওকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে।

মনে হল কর্তব্যে অবহেলা হচ্ছে। কার্ডটা খোঁজায় গাফিলতি হচ্ছে। মন দিয়ে কার্ডটা খুঁজতে লাগল। কিন্তু কী নাম? কার কার্ড খুঁজবে? নামটাই তো মনে পড়ছে না। অনেকগুলো কার্ড পাওয়া গেল। মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভদের, প্যাথোলজি ক্লিনিকের, সিমেন্ট বালি সাপ্লায়ার বিল্ডার্সদের, কেরিয়ার বিল্ডার্সের, ম্যাসাজ ক্লিনিক, ফিজিওথেরাপিস্ট, জ্যোতিষ, তান্ত্রিক, ফকির বাবা, বাস্তুবিদ…কিছু কার্ডে শুধু নাম। লোকটার কার্ডে শুধু নামই তো ছিল। নিশ্চয়ই ওখানে লেখা ছিল না কিডনি মার্চেন্ট…।

যাক!

তাহলে কিডনিটা বেঁচেই গেল।

বাক্সটা বন্ধ করবার উপক্রম করতেই একটা কার্ড চোখে পড়ে ভজনের। কার্ডের উপরে লেখা ‘কিডনি’। ভজনেরই হাতের লেখা।

কার্ডটা নিতেই হয়।

নিত্যানন্দ পাড়ুই।

অর্ডার সাপ্লায়ার্স।

তখন কার্ডটা ভালো করে পড়েইনি ভজন। পাছে অন্য কার্ডের সঙ্গে মিশে গিয়ে ভুলে যায়, তাই পেন দিয়ে কার্ডের কোনায় ‘কিডনি’ শব্দটা লিখে রেখেছিল।

ওই কার্ডটা হাতে পেয়ে গিয়ে এবার ঝামেলায় পড়ে গেল ভজন। কার্ড যখন পাওয়াই গেল, তাহলে তো ফোনটা করতেই হয়। করা যাবে। একটু পরে।

সামান্য বিছানায় চিৎ হল ভজন। নিত্যানন্দ পাড়ুইকে স্বপ্ন দেখল। অর্ডার সাপ্লায়ার্স। নিত্যানন্দ বলছে—কিডনি বেচবেন? ভেরি গুড। আগামী রবিবার আমার বাড়ির ছাদে কিডনিমেলা বসিয়েছি, ওই মেলায় আসুন…। ওখানে কথা হবে।

কিডনি মেলা।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

ওখানে কী হবে?

যারা কিডনি বেচবে, আসবে, আমি পছন্দমতো কিডনি বুক করব।

বাবা, এত লোক বেচতে আসে? হ্যাঁ। খুব ডিমান্ড তো।

আমি তো কিডনি এক্সপোর্ট করি।

খুব লাভ?

লাভ মানে? খুব। লাল হয়ে গেছি। ভজন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ফস করে বলে দেয়—স্যার, আমাকেও নেবেন?

আপনি বিজনেস পার্টনার হবেন? ভালোই তো। একজন ডাক্তারকে সঙ্গে পেলে ভালোই তো। হোক না কোয়াক ডাক্তার, আসুন তাহলে।

স্বপ্নের দ্বিতীয় চ্যাপটারে দেখা যাচ্ছে, ডা. ভজন মৃধা এবং নিত্যানন্দ পাড়ুই। ট্যাক্সিতে যাচ্ছে বেলেঘাটা অঞ্চল দিয়ে। একটা বস্তির সামনে ট্যাক্সিটা থামল। নিত্যানন্দ পাড়ুই বুকপকেট থেকে একটা কাগজ বার করল। কাগজে একটা খবরের কাগজের টুকরো। ওখানে লেখা একটি O+ কিডনি বিক্রয়কারীর নাম। সুকুমার দাস। ১৬/৪/৩A চালতা বাগান। নিত্যানন্দ বলছে,—এরকম ঠিকানা খুঁজে বের করা বেশ মুশকিল। ওরা খুঁজছে। একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল। ছেলেটা বলল,—কিডনি খুঁজছেন?

পাড়ুই বলল,—হ্যাঁ। তুমিই বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলে বুঝি?

ছেলেটা বলল,—আমার বিজ্ঞাপন দেওয়ার পয়সা নেই। তবে আমারও একটা কিডনি বিক্রি আছে।

মানে?

মানে আবার কী? যে পয়সা খরচা করে অ্যাডভাটাইজ দিয়েছিল সে ভিতরের শোকেস-এ বসে আছে। আমি ফুটপাথে হকারি করছি।

নিত্যানন্দ বলল,—বেছে নিতে পারলে ফুটপাথেও ভালো মাল পাওয়া যায়। তোমার কী গুরুপ? আমার স্যার বি প্লাস।

কত দেবে?

বেশি বলব না। এক লাখ। নিত্যানন্দ বলল,—দাঁড়াও, ওটা আগে দেখে আসি।

নিত্যানন্দের পিছনেই ভজন। একটা শেওলা ধরা উঠোন পার হয়ে একটা বারান্দার সামনে দাঁড়াল। একটা ছেলে চেয়ারে বসে আছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করল নিত্যানন্দই—

—মাল আছে?

—হ্যাঁ।

—কী গুরুপ?

—বি প্লাস।

—কতয় ছাড়চ?

—এক থাবড়া।

—এক? কিছু কম করো। বাইরে এর চেয়ে কমে পাওয়া যাচ্ছে।

ভজন দেখল বাইরের ছেলেটা ভিতরে চলে এসেছে। উঠোনের সবুজ শেওলায় দাঁড়িয়ে বলছে আমি আশি হাজারে দিয়ে দেব। চেয়ারের ছেলেটা বলে , বাইরের মালের কোনো গ্রান্টি নেই কিন্তু। চুল্লু খাওয়া কিডনি নেবেন না। আমি রেগুলার নেবু-জল খাই। হিঞ্চেসেদ্ধ খাই। ছেলেটা বলে উঠল, হিসু চেক করে নেবেন স্যার। আপনাদের সামনে দুজনকে মুততে বলুন, চেক করে নিন কার মুত বেশি সাদা।

চেয়ারের ছেলেটা বলল,—বডি ঠিক রাখার জন্য ভিটামিন বি ক্যাপসুল খাই ওই জন্য আমার ইউরিন একটু ইয়োলো হয়। ও কিছু না।

—ও কিছু না বললে হবে? ড্যামেজ কিডনি। আমি কাগজে অ্যাডভাটাইজ করতে পারিনি, কিন্তু আমার একদম ফিট কিডনি। ঠিক আছে পঁচাত্তর হাজার।

—বাহাত্তর।

—সত্তর।

—পয়ষট্টি।

—পঞ্চাশ।

—আমি তিরিশেই দিয়ে দেব।

তিরিশ হাজার এক…

তিরিশ হাজার দুই…

তিরিশ হাজার তিন…

আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায় ভজন মৃধার। কিডনির দাম কীভাবে কমে যাচ্ছে। নিলাম নয়, উলটো নিলাম। বিশ্ববাজারে সেনসেক্স ফল করছে না, অথছ কিডনির দাম কমে যাচ্ছে। তাহলে নিজের দামও যে কমে যায়। তাহলে ছেলে, ছেলের ডাক্তারি পড়া? এতদিন ধারণা ছিল পিঠের খাঁচার ভিতরে দু-লাখ টাকার মাল ডিপোজিট আছে। কিন্তু সেই মালের ডাউনফল আশা করেনি। ঘুম ভাঙলে মনে হল এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল, দিবাস্বপ্ন, তাহলে খুব বাঁচা বাঁচা গেল। দিনে-দুপুরে এরকম স্বপ্ন দেখা ভালো নয়। হোমিওপ্যাথিতে আছে—দিবাভাগে উদ্ভট স্বপ্ন দেখিলে ক্যান্থারিস—৩০।

জলটল খেল ভজন ডাক্তার, চোখেমুখে জলের ছিটে দিল।

হাতে নিত্যানন্দ পাড়ুই-এর ওই কার্ড। ফোনটা করে ফেলা যাক। ফোন করতে গিয়ে মনে হয়, এতদিনে যদি মোবাইল নম্বরটা পালটে গিয়ে থাকে তা হলে মন্দ হয় না। নিজের কাছে ক্লিয়ার। ফোন করা হয়েছিল, কিন্তু পাওয়া যায়নি। ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেল। তাহলে ফোনটা করতেই হয়। কর্ম করো, ফল চেয়ো না। কর্মই ধর্ম। সুতরাং টেলিফোন কর্মটি করতেই হল।

রিং বাজছে। মেহবুবা মেহবুবা রিংটোন।

—নিউ সান কনসালটেন্সি…।

যাক। নম্বরটা পালটে গেছে তাহলে। ভজন যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। বলুন কাকে চান…

—বোধহয় রং নাম্বার হয়ে গেছে। আমি নিত্যানন্দ পাড়ুই নামে একজনকে খুঁজছিলাম…।

—ইসপিকিং। আমিই পাড়ুই বলছি, হু আর ইউ ইসপিকিং প্লিজ!

—আমি ডাক্তার মৃধা। শুঁটিয়া, শুঁটিয়া, বামনগাছি। বামনগাছি মানে নিয়ার বারাসাত। আপনি এসেছিলেন একবার, তা বেশ কিছুদিন হয়ে গেল…

—ইয়েস স্যার। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কিন্তু খবর আছে? সরি স্যার, আমি এরপরে আর ফলো আপ করতে পারিনি। বলুন স্যার!

—বলছি কী, আমার একটা কিডনি যদি বেচে দি, কীরকম দাম হতে পারে?

—ছ্যাঃ, কী বলছেন স্যার? কেন? আপনার হঠাৎ এত কী অভাব হয়ে গেল?

—অভাব নেই নিত্যানন্দবাবু, কিন্তু একটা স্বপ্ন আছে, বুঝলেন! নিজে ঠিকমতো ডাক্তার হতে পারিনি তো, তাই ছেলেকে ডাক্তার করতে চাইছিলাম। আপনাকে সত্যি কথাটাই বলছি। এমনি জয়েন্ট পরীক্ষা দিয়ে ও পাবে না। বাইরের প্রাইভেট কলেজে ম্যানেজমেন্ট কোটায় ভরতি করাব ভাবছিলাম। অনেক খরচ। তাই আমি আমার স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কত হিসেব করছিলাম। কিডনিটা কি স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে পড়ে?

—শিয়োর স্যার। নিশ্চয়ই স্যার। কিডনি তো আপনার সম্পত্তিই। একটা তো বেচেই দিতে পারেন। কিন্তু নিজেরটা বেচতে যাবেন কেন? দুটো আছে, থাক না। একটা যদি ফেল করে অন্যটা কাজে লাগবে। কিন্তু একটা যদি আগেই বেচে দেন। তখন অন্য মালটা ব্যাগড়বাই করলে আপনার কিছু করার থাকবে না। তাই বলছিলাম—আপনারটা আপনারই থাক। আপনি বরং অন্যের মাল সাপ্লাই করুন।

—না, মানে বলছি কী, নিজের মাল থাকতে অন্যের মাল…মানে আগে নিজের প্রপার্টি বেচে তারপর অন্য প্রপার্টির কথা ভাবছিলাম আর কী। বলছিলাম কী, আমার টেসটিস দুটো কোনো কাজে লাগে না, ওটাও কি বেচা যায়?

ডাক্তার হয়ে এ কী বলছেন? ওটার হয় তো এক্সপায়ারি ডেট হয়ে গেছে। ওটার কোনো বাজারদর নেই।

তা অবশ্য ঠিক, এই প্রশ্নটাই ঠিক হয়নি। তবে ওই নিত্যানন্দ পাড়ুইও পুরো জানে না। ওই যন্ত্রটার কোনো এক্সপায়ারি ডেট নেই। নিত্যান্দ বলল,—আমি যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা করব। আপনার টাকার অভাব হবে না। টাকা উড়ছে। শুধু ধরতে জানতে হবে।

নিত্যানন্দ পাড়ুই আর আগের মতো নেই। দেখতে-শুনতে অন্যরকম হয়ে গেছে। ওর পরনে সাফারি সুট। চোখের কালো চশমায় গাছপালার ছবি। পকেটে সিগারেটের প্যাকেট। লম্বা সিগারেট। বেশি পাউডার ঢেলেছিল বলে গলায় সাদা ছোপ।

চেম্বারে রোগীপত্তর আছে বলে বাইরে এসেই কথাটা হচ্ছে। একটা বড় অশ্বত্থ-গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ভজনের প্রায় গা-ঘেঁসে দাঁড়িয়েছে নিত্যানন্দ। প্রায় ফিসফিস করে কথা বলছে। বোঝাই যাচ্ছে গোপন কথা হচ্ছে।

নিত্যানন্দ—কী আছে? অতশত ভাবলে চলে না।

ভজন মাথা চুলকোচ্ছে। বলছে ভেবে দেখি। নিত্যানন্দ বলছে, ভাববার কী আছে? কাজ শুরু করে দিন। ভজন বলছে, লোকে জানতে পারলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে।

—আরে ধুৎ, জানবে কী করে?

—যদি কখনও পেট স্ক্যান করায় কেউ, তখন ধরা পড়ে যাবে না যে একটা কিডনি নেই…

আরে ধুর, স্ক্যান কে করাবে?

টারগেট তো হবে রিকশাওলা কিংবা ছোটখাটো শ্রমিকরা। মেয়ের বিয়ে দেবার সময় ওরা টাকা খোঁজ করে। ওদের তো জমিজমা থাকে না যে বেচে মেয়ের বিয়ে দেবে। ওদের তো সেই কী বলে—অ্যাওয়ারনেস নেই যে নিজের একটা কিডনি বেচে দেবে। ওদের মাথায় সেই বুদ্ধিটা দিতে হবে। তক্কে তক্কে থাকবেন ডাক্তারবাবু। ছেলেমেয়েদের কথা জিজ্ঞাসা করবেন, মেয়ের বে-থার কী করলে—এসব জিজ্ঞাসা করতে করতে ওদের মাথায় অ্যাওয়ারনেসটা পুশ করে দেবেন। ওরা তো পরে আর স্ক্যান করাতে যাচ্ছে না। একটা কিডনি নিয়ে এরপর যদ্দিন বাঁচে বেঁচে থাকবে। ভয় পাবেন না, কাজে নেমে যান।

মাথা চুলকোচ্ছে ভজন। ঘাড় নাড়াচ্ছে। এই ঘাড় নাড়ানো সম্মতির চিহ্ন নয়।

নিত্যানন্দর আরও বক্তব্য ছিল, খামোখা নিজের কিডনি বেচতে যাবেন কেন? পৃথিবীতে কিডনির কমতি পড়েছে নাকি? অন্যের কিডনি পাঠিয়ে দিন। তারপর একটা বুদ্ধি দিয়েছিল নিত্যানন্দ।

শুনুন ডাক্তার মৃধা, মনে করুন কেউ আপনার কাছে পেটব্যথার কেস নিয়ে এল। আপনি কায়দা করে বললেন, অপারেশন কেস। আপনি সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, মানে রেফার করে দিলেন। সার্জন তখন একটা নার্সিংহোমে পাঠিয়ে দিল, ওখানেই কিডনিটা কালেকশান হয়ে যাবে। নার্সিং হোমগুলোর নাম-টাম সব বলে দেব। পাক্কা কাজ। একেকটা কেস-এ বিশ-পঁচিশ হাজার কমসে কম পাবেন ।

প্রথমে বুঝতে পারেনি ভজন ডাক্তার। ব্যাপারটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারল। বলা হচ্ছে—অ্যাপেন্ডিসাইটিস, বা গলস্টোন, বা গ্যাসট্রিক আলসারের নামে পেট কাটা হবে এবং পেট কেটে একটা কিডনি টুক করে চুরি করে নেওয়া হবে। লোকটা জানতেই পারবে না ওর কিডনি ঝেড়ে দেওয়া হল।

এরকম যে হয়, কানাঘুষোয় শুনেছিল ভজন। কিন্তু ওকেই কেউ এরকম প্রস্তাব দেবে ভাবতে পারেনি। নিত্যানন্দ আরও বলেছিল—ফিটাস-এর খবর থাকলেও বলবেন। টুয়েনটি সেভেন উইকস অ্যান্ড অ্যাবাভ। বেশ ভালো দাম পাবেন। শুনেছি স্টেম সেলের রিসার্চের কাজে লাগে। স্টেম সেল বোঝেন? ভজন বোঝে না।

নিত্যানন্দ বোঝে না। ও শুধু এটুকুই জানে বেশ পরিণত হয়ে যাওয়া ভ্রূণের বাজারদর বেশ ভালো। ডিমান্ড আছে। ভালো দাম পাওয়া যাবে।

নিত্যানন্দবাবু চলে গেল। ভজন ওকে ঠিকমতো কথা দিতে পারল না। কতরকমের বিজনেস আছে পৃথিবীতে। গদাধর দোলুই স্রেফ মুত বেচে বড়লোক হয়ে গেল। ও অর্গানন কোম্পানিতে ইউরিন সাপ্লাইয়ের কনট্রাক্ট নিয়েছিল। অর্গানন কোম্পানিটা হল মধ্যমগ্রামের কাছে। ওরা কনট্রাসেপটিভ তৈরি করে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট। ওই ওষুধ তৈরি করতে দুটো হরমোন দরকার হয়। ইস্ট্রোজেন আর প্রোজেস্টেরন। এই হরমোন পাওয়া যায় গর্ভবতী মহিলাদের প্রস্রাবের মধ্যে। গদাধর সাইকেলের পিছনে জারিকেন বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পেচ্ছাপ সংগ্রহ করত। রেললাইনের ধারে যে ঝুপড়িগুলো, সেখানে ভালো বিজনেস ছিল গদাধরের। সারাদিনের পেচ্ছাপ রেখে দিত ওরা, গদাধর জারিকেন ভরে নিত। পেচ্ছাপের জন্য টাকাও পেত গর্ভবতীরা। আর পেচ্ছাপ বেচবে বলে বারবার গর্ভবতী হত ঝুপড়ির বউরা। কিন্তু বাচ্চা করত না, কিছুদিন পরই পেট খসাত। আবার গর্ভবতী হত। একেই বলে ডাউনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি। খবর কাগজে লেখে না? একটা শিল্প তৈরি হলে তার সহযোগী কিছু শিল্প তৈরি হয়ে যায়। একদম চেন সিস্টেম। যেমন—কারখানা হল, কাঁচামাল হিসেবে গর্ভবতী নারীর পেচ্ছাপ দরকার হল। সেইজন্য মেয়েরা কাঁচামাল সাপ্লাই করার প্রয়োজনে গর্ভবতী হতে লাগল। বারবার গর্ভবতী হওয়ার জন্য পেট খসাতে লাগল, এজন্য আবার নার্সিং হোম-ইন্ডাস্ট্রি বেড়ে গেল। নার্সিং হোম গজালেই ওষুধের দোকান, চা-পাউরুটি-ঘুগনির দোকান। ছোট ছোট নার্সিং হোম তো। বড় নার্সিং হোমের সামনে হয় কেক বার্গারের দোকান। এখানে চা পাউরুটি ঘুগনি আলুর দম। কত লোকের রোজগার ভাবুন। আবার রাস্তায় চায়ের দোকান হলে দোকানদার ছাড়াও কিছু লোকের অন্ন সংস্থান হয়—যারা তোলা তোলে। প্রত্যেক চায়ের দোকানদারকে হপ্তা দিতে হয়। ব্যাপারটা চেন সিস্টেম। আবার গর্ভবতী হতে হলে তো একটা বিয়ে করতেই হবে। কুমারী অবস্থায় মা হলে পেচ্ছাপে ইস্ট্রোজেন বা প্রোজেস্টেরন কম পড়ে না ঠিকই, কিন্তু পাবলিক মানে না। তাই বিয়ের রেটও বেড়ে যায়। বিয়ে বেড়ে গেলে পুরোহিতের দু-পয়সা হয়, শোলাশিল্পীদের দু-পয়সা হয়, রান্নার ঠাকুরের দু-পয়সা হয়।

সাত-আট বছর চুটিয়ে বিজনেস করেছে গদাধর। কর্মচারীও রেখেছিল, যারা দূর গ্রাম থেকে জিনিসটা নিয়ে আসত।

তারপর ওই কোম্পানি সিন্থেটিক উপায়ে হরমোন তৈরি করার কাদয়া শিখে গেল, তখন প্রাকৃতিক উপায়ে পাওয়া জিনিসটার ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেল।

এখন পেচ্ছাপ নয়, জ্যান্ত ভ্রূণ কিনতে চাইছে। সাত মাসের, আট মাসের…। সিজার করে বার করে দিলে একদম হাতে গরম। জ্যান্ত জিনিসের বোধহয় দাম বেশি।

সেই রাতে একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখল ভজন ডাক্তার।

ওর মেয়ের দিকে জুলজুল করে তাকাচ্ছে ভজন। কোনো পিতা নিজের কন্যার দিকে এভাবে তাকায় না।

ভজনের মনে হল ওর মেয়েটি গর্ভবতী। পেটটা যেন বড় বড় লাগছে। বেশ আনন্দ হচ্ছে মনে।

স্বপ্নের তৃতীয় বা চতুর্থ চ্যাপটারে নিজের মেয়ের পেট কাটছে ভজন। ট্রে-র মধ্যে সাত মাসের গোলাপি গোলাপি ভ্রূণ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে নাইলনের বাজারের থলে হাতে নিত্যানন্দ পাড়ুই। খপ করে ধরে বাজারের ব্যাগে পুরে নিল নরম ভ্রূণটিকে।

আর পকেট থেকে বের করল একতাড়া ময়লা নোট।

ওই টাকাগুলো দিয়ে ছেলের ডাক্তারি পড়া হবে।

রাত্রে ভজনের বউ ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল। বলল,—এত না-না-না বলছ কেন ঘুমের ঘোরে?

অ্যাসোসিয়েশন অফ প্র্যাকটিসিং ডকটরস নামে একটা সংগঠন আছে। আসলে এটা হল কোয়াক ডাক্তারদের সংগঠন। অনেকে বলেন কোয়াক ডাক্তার বলে কোনো কথা হয় না। কোয়াক কখনও ডাক্তার হয় না। কোয়াকদের বাংলায় বলে হাতুড়ে। হাতুড়ে কেন বলে কে জানে? হাতুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই হয়তো। হাতুড়েদের সম্মেলন চলছে। ডা. আনসারউদ্দিন বারি বক্তৃতা করছেন। মাথায় ফেজ টুপি।

সরকার যখন ব্যর্থ, হাসপাতালের মধ্যে কুকুর বিড়ালে শিশুর গা খুবলে খায়, যুবতি মেয়ে হাসপাতালে যেতে ভয় পায় কারণ, কর্মচারীরা যৌবন খুবলে নেয়, ডাক্তার থাকে না, ওষুধ থাকে না। একেবারে দোজখ। নরক। মানুষ যাবে ক’নে? পাশ করা ডাক্তারগুলান চেম্বার সাজিয়ে বসে আছে, তারা সব এক-একটা শকুন। লোভ ওদের এমন করেছে। লোভের কোনো শেষ নাই। পঞ্চাশ টাকার কমে কোনো ভিজিট নাই। আমাদের দেশের লোকের সারাদিনের ইনকাম তিরিশ টাকাও হয় না, আর ওরা একবার রুগির বুকে চাকতি লাগিয়ে আর দুবার পেট টিপে পঞ্চাশ টাকা হাতিয়ে নেচ্ছে…

আনসারুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আলাপ আছে ভজনের। উনি গরুর ডাক্তারিও করেন। সামনেই একজন বসে আছে, মাথায় প্রায় জটা। উনি তাবিজ-কবচও দেন আবার ইনজেকশনও দেন। ইনজেকশন ফুঁড়বার আগে মন্ত্র পড়ে দেন। ওঁর চোখ দিয়ে নাকি এক্স-রে বের হয়। বাইরে থেকে দেখেই বুঝতে পারেন ভিতরে হাড় ভেঙেছে কিনা। যদি বোঝেন হাড় ভেঙেছে, হাড়ভাঙা লতা বেটে ব্যান্ডেজ করে দেন। টিবি হয়েছে কিনা, তাও নাকি বুঝতে পারেন। বুকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েই বলে দেন, ‘তোর বুকের কাঠিতে পোকা ধরেছে র‍্যা…।’

দাবি উঠেছে—এইসব ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশন দিতে হবে। যদি রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়, তবে এরা আরএমপি কথাটা লিখতে পারবে। ‘রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার।’ আইএমএ, এদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিপক্ষে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিলও এদের বিপক্ষে।

একজন বক্তৃতা দিতে উঠলেন। তিনি ডাক্তার নন। রাজনৈতিক নেতা।

এই নেতাটি আইএমএ-র বিরুদ্ধে কথা বলছেন।

বলছেন—কতজন মানুষ এমবিবিএস পড়তে পারে? গরিব ঘরের সন্তানরা ওই স্বপ্ন দেখতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে ডাক্তার দরকার। অনেক ডাক্তার দরকার। এখন আমাদের দেশে প্রতি ১৪০০ মানুষ পিছু একজন ডাক্তার আছে। ওটা হওয়া উচিত ৪০০ মানুষ পিছু একজন ডাক্তার। একথা মাথায় রেখেই পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকার তিন বছরের একটা মেডিকেল কোর্স তৈরি করেছিল। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার কাজ এমবিবিএস-রা করবে না। এমবিবিএস-রা অহংকারী, ওরা সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গী নয়। ওই জন্যই তিন বছরের কোর্স। খালি-পায়ের ডাক্তার। কিন্তু বড়লোকের দালাল আইএমসি, প্রতিক্রিয়া চক্রের স্বার্থরক্ষাকারী আইএমএ ওই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের অনেক ডাক্তার প্রয়োজন। আপনাদের মতো অনেকেই আছেন কোনো মেডিকেল কলেজে না-পড়েই চিকিৎসা করছেন। আপনাদের অভিজ্ঞতা আছে, সেবা করার মনোভাব আছে। আপনাদের কিছুটা ট্রেনিং দিয়ে, কিছুটা থিয়োরি পড়িয়ে যদি একটা সার্টিফিকেট দেওয়া যায়, সেটা সমাজের পক্ষে ভালো হবে। জানি এমবিবিএস লবি এই প্রচেষ্টাকে বাধা দেবে, কিন্তু আপনাদের লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে।

এমবিবিএস-দের যখন গালাগাল দেওয়া হয়, বেশ ভালো লাগত ভজনের। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। কোথায় যেন অস্বস্তি হচ্ছে। ওর সুবোধ তো এমবিবিএস হয়নি, হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। তবু গায়ে লাগে। প্রতিনিধিদের সবাইকে একটা করে কুপন দেওয়া হয়েছিল। কুপনটা দেখালে লক্ষ্মীবিলাস হোটেলে ভাত আর মুরগির মাংস।

কুপনটা আগে দেখেনি ভজন। এখন দেখল। কুপনের গায়ে লেখা—দুপুরের খাবার স্পনসর করলেন—নিত্যানন্দ পাড়ুই।

১০

খবরের কাগজে বের হল—হাতুড়ের চিকিৎসায় যুবকের মৃত্যু। গণপ্রহারে হাতুড়ের অবস্থা সংকটজনক। গণপ্রহারে নিবারণ মণ্ডল নামে এক হাতুড়ের অবস্থা সংকটজনক। তাঁকে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কুলপিতে ওই হাতুড়ে চিকিৎসা করতেন। ছাব্বিশ বছরের যুবক আতর সাঁই জন্ডিসে ভুগছিলেন। ওই হাতুড়ের কাছে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করাচ্ছিলেন এবং অচিরেই ভালো হয়ে যাবে এই স্তোকবাক্য দিচ্ছিলেন। গত শনিবার তাঁর মৃত্যু হয়। আতর সাঁই ছিলেন ভ্যানরিকশা চালক। তাঁর মৃত্যুর পর কিছু ভ্যানরিকশা চালক এবং স্থানীয় মানুষ ওই হাতুড়ের বাড়িতে হামলা চালায়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নিবারণ মণ্ডলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, কুলপি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনও ডাক্তার নেই। ওখানে হাতুড়েদেরই দৌরাত্ম্য।

পড়ল ভজন। ডাক্তার শব্দটা একবারও উচ্চারিত হল না। হাতুড়ে। এমবিবিএস-দের চিকিৎসায় যেন লোক মরে না।

পরেরদিনও কাগজে এই ধরনের একটা খবর। একটা বড় আর্টিকেল বেরিয়েছে—পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে একটা বড় লেখা।

‘ডাক্তারি পড়তে যারা আসে, তারা নানারকম উদ্দেশ্য নিয়ে আসে। কেউ আসে তাদের বাবা, কাকা ডাক্তার বলে, কেউ আসে জয়েন্টে ভালো নম্বর পেয়েছে বলে, কেউ আসে সম্মানের জন্য, কেউ আসে অর্থের জন্য। সবচেয়ে কম আসে, বা আসেই না—মানুষের সেবা করব এই উদ্দেশ্য নিয়ে। সামান্য কিছু আসে চিকিৎসাটা ভালোবাসে বলে, কেউ আসে অন্যতর প্রতিজ্ঞা নিয়ে, যেমন ওয়াকসম্যান। যক্ষ্মা রোগের ওষুধ স্ট্রেপ্টোমাইসিনের আবিষ্কর্তা ওয়াকসম্যান জন্মেছিলেন ইউক্রেনে। দারিদ্র্যপীড়িত এই পরিবারে ওয়াকসম্যানের ছোটবোন যক্ষ্মারোগে তিল তিল করে মারা যায়। বোনের মৃত্যুর পর ওয়াকসম্যান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—একদিন যক্ষ্মারোগের ওষুধ আবিষ্কার করবেন। ডাক্তারি পড়েছিলেন, কিন্তু করেছিলেন গবেষণা। এখন কি এভাবে ডাক্তার আসে?

যে-সব ডাক্তার আমরা পাই, তাঁরা কতটা প্রতিবাদী? যে-সব ওষুধ তাঁরা লেখেন, তাঁরা জানেন এর বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয়? তবুও লেখেন। কারণ, ওষুধ কোম্পানিগুলির প্রলোভন থাকে। ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি নানা ভেট পাঠায় ডাক্তারদের। অনেক ডাক্তারদের প্রায় কিনে রাখে।

বহুকাল আগে জয়সুখলাল হাতির নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠিত হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, কতগুলি অত্যাবশ্যক ওষুধ বেধে দেওয়া যায়, যাতে গরিব দেশের মানুষেরা নিত্যনতুন ওষুধের হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে। কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। বহুজাতিক সংস্থাগুলির ক্ষমতা অপরিসীম। তবে বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলির উপর সরকারের যা নজরদারি আছে, আমাদের দেশে নেই। আমাদের দেশে গোটা স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপরই কোনও নজরদারি নেই। বিহার-উত্তরপ্রদেশের বড় বড় ওষুদের দোকানে সিল করা বোতলে পাওয়া যায় গরুর মূত্র। সারা দেশে হাতুড়েগুলো যা খুশি তাই করছে।

বেশ কিছুদিন দেশে এমএলএফ ডাক্তাররা ছিলেন। এমবিবিএস-এর তুলনায় ওই ডিগ্রি কিছুটা খাটো। কিন্তু তাঁরা ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল। তাঁরা কোনও ভুল করলে অনুতপ্ত হতেন এবং ভুলের কারণ খুঁজতেন। সেই ভুল থেকে শিক্ষালাভ করতেন, এখন ডাক্তার ভুল করলে আর একটা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আগের ভুলটা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা হয়। বিদেশে, প্রায় সমস্ত সভ্য দেশেই ডাক্তাদের কিছুদিন পরপরই নিজেকে আধুনিক করতে হয়। এতে ডাক্তাররা আধুনিক থাকেন। আমাদের দেশে এরকম কোনও কোর্স চালু করতে হলে এই শিক্ষা কে দেবে তাই নিয়ে রাজনৈতিক দলাদলি, মারামারি, পার্টিবাজি শুরু হয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলবাজি এবং গোষ্ঠীবাজি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে একজন মানুষের মধ্যে যে আত্মজিজ্ঞাসা থাকে, সেটাও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে-র এথিকস-এ আছে কোনও রোগীর ওপর কোনও ওষুধ বা অস্ত্রোপচারের আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে হয়, যদি আমার বা আমার কোনও প্রিয়জনের এই অসুখ হত, তখন আমি কী করতাম?

আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের গর্ব হতে পারতেন যে বাঙালি চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যিনি প্রথম টেস্ট টিউব বেবি করেছিলেন আমাদের দেশে, তিনি অবহেলিত, অপমানিত হয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। যেখানে ওই ডাক্তারকে নিয়ে দেশ গর্ব করতে পারত, একজন অজ্ঞ মন্ত্রী এবং তাঁর অর্ধশিক্ষিত পরামর্শদাতারা ডাক্তারটিকে খুন করে দিল। এবং পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবসাটা চলছে কমিশনের ওপরে। হাতুড়ে ভূতুড়ে থেকে নামীদামি ডাক্তার সবাই কমিশন কামাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু সৎ ডাক্তার আছেন। তাঁরা বিবেক জাগ্রত রেখেছেন। কিন্তু ওদের করার কিছু নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থায় যেটা স্তম্ভ ছিল, সরকারি হাসপাতাল, তার অধঃপতনই আজকের নৈরাজ্যের কারণ। সরকার ব্যবস্থাটা ঠিক না করে ডাক্তার ডাক্তারে ঝগড়া বাধাচ্ছে। ডাক্তারদের ভিতরে পাঁচরকম অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলছে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখন রাজনৈতিক চাকরি। মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ভয় পান কোনও টেকনিশিয়ান বা কোনও গ্রুপ ডি কর্মচারীকে যে-কোনও ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। সমস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা লুটের মাল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে হাসপাতাল ভাঙচুর হয়, ডাক্তার প্রহার হয়। গতকাল হাতুড়েকে মারা হয়েছে, আগামীকাল এমবিবিএস বা এমডি-কেও মারা হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ নিয়েই বড় হচ্ছে।’

চতুর্থ পৃষ্ঠায় এই প্রতিবেদনটা ছাপা হয়েছে, পঞ্চম পৃষ্ঠায় তিন লাইনের ছোট্ট খবর—প্রহৃত হাতুড়ে ডাক্তারের মৃত্যু।

১১

ফিউচার বিল্ডার্স থেকে ফোন পেল ভজন।

কী স্যার কী ভাবছেন! টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করছেন তো?

—হবে না হবে না হবে না। টেলিফোন রিসিভারের সামনেই তিনবার মাথা নাড়ল ভজন।

—কেন হবে না?

—এত টাকা কিছুতেই হবে না। অসম্ভব। আমার কিডনি-লাং-লিভার বেচলেও হবে না।

—আরে স্যার ঘাবড়াবেন না। হবে, হবে। সব হবে। শুধু প্রতিজ্ঞাটা বুকে আগলে রাখুন যে, আপনার ছেলেকে আপনি ডাক্তারি পড়াবেন।

—না, পড়াব না।

—সে কী স্যার, আপনি নিজে ডাক্তার, আপনার ছেলেকে ডাক্তারিটা পড়াবেন না!

—কে বলল আমি ডাক্তার? আমি একজন কোয়াক। হাতুড়ে।

—তো? ডায়রিয়া হলে আপনি ওআরএস খাওয়ান না? একজন এমডি ওই ওআরএস-ই খাওয়াবে। জ্বর বেশি হলে আপনিও প্যারাসিটামল দেবেন এমডি-ও তাই দেবে। আপনি নিজেকে ছোট ভাবছেন কেন? আপনি ডাক্তার, আপনার ছেলেকেও ডাক্তার করবেন সেই প্রতিজ্ঞাটার প্রদীপ এলআইসি-র লোগোর মতো বাঁচিয়ে রাখুন।

—বাইরে বড় বদ হাওয়া। ওসব প্রদীপ-টদীপ থাকবে না। তাছাড়া এসব প্রদীপ জ্বালিয়ে নিজেই পুড়ছি। বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার দরকার নেই।

—তো ছেলের ভবিষ্যতের কথা কিছু ভাবছেন না?

—ও দেখা যাবে খ’নে। ওর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

—ভাগ্য তো স্যার আপনার নিজের হাতে। হাতে মানে হাতের রেখার মধ্যে নয়, কবজির মধ্যে, হাতের আঙুলে, কনুইয়ে, পাঞ্জায়। বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলতে চাইছি?

—আমি এবার ফোনটা ছাড়তে চাইছি।

—ছেড়ে দিন। শুধু জিজ্ঞাসা করছি আপনি কি আপনার ছেলেকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে ডাক্তার বানাতে চান? যদি মনে করেন, তাই করুন। বাইরে এখন আইটি ছাড়া চাকরি নেই। বরং যেভাবে হোক, যে ধরনেরই হোক ডাক্তার বানানোই ভালো। যে ডাক্তার হোক, যেভাবে হোক।

—শুনুন, একটা কথা বলি। আমার ছেলেকে আমি কোয়াক বানাব না, কিছুতেই না। বরং মুদি দোকান করবে, সেলসম্যান হবে, বরং প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টারি করবে, কিন্তু হাতুড়ে ডাক্তার হবে না।

রেগে গেছে ভজন। মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়ে।

ফোনের ও-প্রান্ত থেকে ভেসে আসা গলাটি বড় পেলব এখন। বলল,—শুনুন স্যার, আপনার ছেলেকে আপনি ডাক্তারই করাবেন। রীতিমতো সরকারি মেডিকেল কলেজে। বেশি টাকাও লাগবে না, এত কম যে ভাবতেও পারবেন না।

—কত কম?

—যা বলেছিলাম তার প্রায় হাফেই হয়ে যাবে। আপনি আমাদের অফিসে আসুন। ফোনে এসব কথা বলা যাবে না।

সব কেমন ঘোলাটে ঘোলাটে লাগে। এত দরদাম হয় নাকি এ লাইনে? গরুহাটাতেও এত দরাদরি হয় না। মাছের বাজারে কেজিতে দু-টাকাও দাম কমায় না। ডাক্তারি পড়ার বাজারে এত দরদাম চলে? এসব জানা ছিল না।

পরদিনই দুর্গা নাম করতে করতে ফিউচার বিল্ডার্স-এ ঢুকল।

সুন্দর দেখতে ছেলেটার হাসিটাও কী সুন্দর!

—আজ বেশ গরম, তাই না?

—হ্যাঁ।

—ঘামছেন দেখছি।

—হ্যাঁ।

—ঠান্ডা খাবেন?

—না। শুধু জল।

একটা ঠান্ডা জলের বোতল সামনে চলে এল।

ঘরে ওই ছেলেটা। আর কেউ নেই। দুটো কেবিন ফ্যান ঘুরছে।

ছেলেটা সামান্য কেশে নিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিল।

বলল, দেখুন ডক্টর মৃধা, পৃথিবীটা বড় কঠিন ঠাঁই। এখানে বেঁচে থাকতে হলে শুধু পরিশ্রম নয়, বুদ্ধিরও দরকার হয়। নানা লোক নানাভাবে বুদ্ধি খাটাচ্ছে, মেধাও। বুদ্ধি বিক্রি করছে, মেধা বিক্রি করছে। আপনার ছেলের জন্য আমরা মেধা কিনব। বুঝলেন, মাথা নাড়ে ভজন ডাক্তার। কিছুটা নার্ভাস। আর এক ঢোক জল খায়। বলে, না তো, কিছুই তো বুঝলাম না।

—বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনার ছেলের জন্য আমরা বুদ্ধিমান ছেলে ভাড়া করব। ট্যালেন্টেড। বলে বলে জয়েন্টে পাশ করে। আপনার ছেলের হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দিবে। ছেলেটাকে তিন লাখ দিতে হবে, আর আমাদের জন্য প্রসেসিং ফি তিন লাখ। মোট ছ-লাখ টাকা মাত্র খরচ আপনার। আরও পাঁচশো লাগবে, সেটা মিষ্টির খরচ। ভরতি হয়ে গেলে সবাই মিলে আমরা পেট ভরে নকুড়ের সন্দেশ খাব। নকুড়ের সন্দেশ খুব ভালো, তাই না?

গলা শুকিয়ে গেছে ভজনের। সন্দেশ ছাড়াই। বেশ খানিকটা জল খেয়ে নেয় ভজন। ভজন তোতলায়। বলে,—মানে আমার সুবোধকে জয়েন্ট পরীক্ষাতে বসতেই হবে না?

কোনও দরকার নেই। ওর কাজ করে দেবে অন্য এক ট্যালেন্টেড ছেলে। ওর কেরিয়ার খুব ভালো। গত চার বছরে পাঁচটা স্টেট-এ কুড়িটা জয়েন্টে বসেছে, উনিশটাতেই পাশ করেছে। ওর স্ট্রাইক রেটটা বুঝতে পেরেছেন স্যার!

—কী রেট?

—স্ট্রাইক রেড। বুঝতে পারবেন না। এজন্যই ওর রেটটা বেশি। তিন লাখের চেয়ে দশটা টাকা কমায় না। ওই ছেলেটা যদি পরীক্ষা দেয়, আপনার ছেলে শিওর পাস। তবে ওই ছেলেটাকে অ্যাডভান্স দিতে হবে। জয়েন্টের রেজাল্ট বেরুলে আমাদের টাকাটা দিয়ে দেবেন।

—তার মানে তিন লাখ অ্যাডভান্স দিতে হবে আমাকে?

—আজ্ঞে।

—যদি না হয়।

—হবেই।

—যদি…

—ফেরত পেয়ে যাবেন।

—লিখে দেবেন?

—মুখের কথা। জবান।

—তারপর যদি শেষ পর্যন্ত…

—বললাম তো জবান।

—যে ছেলেটা পরীক্ষা দেবে ওর সঙ্গে একটু কথা বলা যায়?

—না।

—ওর সঙ্গে আপনাদের কোনো সম্পর্ক নেই। ওকে আমরা দেখাবই না। ভজন বলে, আর একটু খোলসা করে দিন ভাই। পরীক্ষা যে দেবে তার ফোটো লাগে, অ্যাডমিট কার্ড লাগে। গেজেটেড অফিসার দিয়ে সই করাতে হয়, অথচ ছেলে আমার পরীক্ষাটাই দেবে না বলছেন, অন্য ছেলের মুখের সঙ্গে আমার সুবোধের মুখের মিল হবে কী করে?

ছেলেটা হাসে। দু-বার কলমটা ঠুকল টেবিলে। টেবিলে কাচ। ঠকঠক করে শব্দ হল।

বলল,—সব ভাবনা আমাদের। আমরাই ফর্ম তুলে নেব, আমরাই ছবি সাঁটব। ফর্মের তলায় সুবোধ কুমার মৃধা যে সইটা থাকবে, সেই সইটা আপনার ছেলের করতে হবে না, আমার ছেলেটাই করবে। ছবিটাও ওরই সাঁটব। একটু আউট অফ ফোকাস করে তুলব আর কী। ওসব ভাবনা আমাদের। এজন্যই তো প্রসেসিং ফি-টা নিচ্ছি। আমরা সব রেঁধে, বেড়ে, আসন পেতে দেব, আপনি শুধু খেতে বসবেন।

বুঝলেন?

তবুও বুঝল না ভজন।

এমন করে ঘাড় নাড়াতে লাগল, যেন মাথাটা কাঁপছে।

এরপরেও যদি না বুঝতে পারেন তো আমি কী করব বলুন। বাড়ি চলে যান। ঠান্ডা মাথায় মিসেসের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

ভজন বলে, একটা কথা বলব?

—বলুন…

—ওই যে আপনাদের ছেলেটা, তো একটা রত্ন, তাই না? শত ছেলেকে ডাক্তার করেছে, শত বাবা-মাকে খুশি করেছে, ওর খুব পুণ্য। ও খুব পুণ্যবান। ওকে একটু দর্শন করা যায় না?

—আপনার পেটে এত বুদ্ধি আছে আগে বুঝিনি তো? ছেলেটার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করিয়ে দেব না, সেটা তো আগেই বলেছি।

ভজন বলে, তাহলে আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, অ্যাঁ? আপনার ছেলেটা পরীক্ষা দিল, তারপর আমার ছেলেটা পাশ করবে তো?

—মানে?

—মানে—আপনার ছেলে জয়েন্ট দিল, আমার ছেলে ডাক্তারিতে ঢুকল, তারপর আমার ছেলে ডাক্তারিটা পাশ করবে তো?

—হে-হে-হে-হে। তা কী করে বলি।

—ডাক্তারি পরীক্ষাগুলো দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয় না?

—সরি। সেটা এখনও করে উঠতে পারিনি। তবে হয়ে যাবে। একবার ভরতি হয়ে গেলে সবাই পাস করে। আগে ডাক্তারিতে মুখ্যমন্ত্রীর কোটা বলে একটা বস্তু ছিল। ওখানে ওই কোটায় যা খুশি ভর্তি হত। ওরা তো ফেল করেনি কেউ।

মাথা চুলকোতে থাকে ভজন। তারপর দু-হাতে চুল টানতে থাকে।

টেনশন করছেন কেন ডক্টর মৃধা?

তার মানে ছ-লাখ?

পাস করার পর এক বছরে উশুল হয়ে যাবে।

১২

বি এসসি পড়ছে সুবোধ, পাস কোর্স। দোতলার ঘর। টেবিল চেয়ার, একটা ইজিচেয়ারও রাখা আছে, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে ইজিচেয়ারে একটু আরাম করবে। এটা সুবোধের ঘর। ঘরে তারা মায়ের একটা ছবিও রাখা আছে, তারাপীঠ থেকে কেনা। ছবিতে প্লাস্টিকের জবা, কখনও শুকোবে না। একটা তারাস্তবাঞ্জলি কিনে আনা হয়েছিল—তারাপীঠ থেকেই, সুবোধের মা বলেছেন রোজ স্নান করে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে একটা করে স্তব পড়বি, আর মনের আশা জানাবি। সুবোধ সত্যিই সুবোধ। ও তাই করে। সুবোধ জানে ওর মা-বাবার মনোবাঞ্ছা। কিন্তু সুবোধ জানে—ওটা হবে না। জয়েন্ট পাস করার কোনও সিন নেই। আর একবার জয়েন্ট দেবার কথা ভাবছেই না। কিন্তু বাবা বলছে আবার পরীক্ষায় বসতে। বাবা কি ভাবছে কোনও ম্যাজিক হয়ে যাবে? তারা মা পাস করিয়ে দেবে? কুড়ি হাজার র‍্যাংকের ডান দিকের দুটো শূন্য ভ্যানিশ হয়ে দুশো হয়ে যাবে!

বাবা মাঝে মধ্যে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, এগুচ্ছে? সুবোধ চোখ নামিয়ে মাথা কাত করে। কী এগোনোর কথা জানতে চায় বাবা! জয়েন্ট-এর প্রিপারেশন? তা কেন হবে, তা হলে বাবা নিশ্চয়ই মাস্টার রেখে দিত, কিংবা কোনও ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিত। কত কী কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন দেখে কাগজে। আকাশ, স্কাইপার, ক্র্যাকার…। কত ছবি, যারা ওখান থেকে পাস করেছে…। ওগুলোর দিকে তাকায় না সুবোধ। খবর কাগজে, চোখ থেকে দু-ফুট দূরে থাকলেও ওরা সব বহু দূরের, ওরা স্টার। স্টারেরা কোটি কোটি মাইল দূরে থাকে। তা হলে হয়তো বাবা বি এসসি কেমন এগোচ্ছে, সেটাই জানতে চায়। কিন্তু বলে না—ক্যালকুলাসের ওইসব ইকরিমিকরি বুঝতে পারছি না বাবা, কেমিস্ট্রির ফর্মূলাগুলো ভুলে যাই…। অঙ্কের জন্য একটা স্যার রাখা দরকার, নইলে অঙ্কে পাস করা মুশকিল।

অপর্ণা ইংলিশ মিডিয়াম। ও ফটফট ইংলিশ বলে। ফোনে যখন কথা বলে, ফুল ইংলিশ বের হয়, গোটা সেনটেন্স। ওর কোল্ড ড্রিংক চাই। ফ্রিজে থাকে। ওর জন্যই আনা হয়। আর কেউ খায় না, ও একাই খায়। খাক গে, ছোট বোন।

অপর্ণা ক্লাস নাইন। ও ডাক্তার হবে না বলে দিয়েছে। যেদিন মা ভুল করে একটা ভাঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছিল ফ্রিজে, ভাড়টার ওপরে সাদা কাগজ, গার্ডার দিয়ে বাধা, একজন দিয়ে দিয়েছিল, রুগি বা অনেকে ভালো হলে মিষ্টি দিয়ে যায়, পরে দেখা গেল ভাঁড়ের মধ্যে অ্যা… ছি ছি। স্টুল পরীক্ষার জন্য দিয়ে গিয়েছিল…। তখনই বলেছিল আমি জীবনে ডাক্তারি লাইনে যাব না। মা বলেছিল—বাবার মতো ডাক্তার হবি কেন, পাস করা ডাক্তার হবি, পাস করা ডাক্তারদের কাছে কেউ এসব পাঠায় না। অপর্ণা বলেছিল—না বাবা, ডাক্তারের কাজ খুব ঝামেলার। ব্লাড, ইউরিন, একজিমা, খোশ পাঁচড়া, বমি ওয়াক। আমি টিচিং লাইনে থাকব। টিচিং শব্দটা এধার ওধার করে দিলেই তো চিটিং। বাবা কি ওরকম কিছু করতে চাইছে? ফোনে কী সব কথা হচ্ছে, আস্তে আস্তে, কখনও ফিসফিস। কেউ কাছে থাকলে বলছে পরে কথা বলব, কখনও হ্যান্ড সেটটা নিয়ে দূরে গিয়ে কথা বলছে। কী কথা বলে?

একদিন বাবা বলেছিল তোর ম্যাপের বইটা খোল তো সুবোধ, ইউক্রেন কোথায় দেখি…।

ইউক্রেন নামটা শোনা, কিন্তু ঠিক কোথায় মনে পড়ছিল না। ম্যাপ বইটা তাক থেকে খুঁজে বের করল সুবোধ। এশিয়ার ম্যাপেই ইউক্রেন পেয়ে গেল সুবোধ। কাস্পিয়ান সাগরের ধারে। আঙুল ছোঁয়াল ওখানে।

কতদূর হবে?

সুবোধ বলল সাত-আট হাজার কিলোমিটার হতে পারে। এখান থেকে দিল্লি যা, তার চার গুণ ধরে নাও। সুবোধ বুঝতে পারছে ওখানে ডাক্তারি পড়াবার কথা ভাবছে বাবা।

—ওখানে কী ভাষায় লোকে কথা কয়? ভজন জিজ্ঞাসা করল।

সুবোধ কি জানে এত? জানি না বলে না। বলে—ওদের নিজেদের ভাষা নিশ্চয়ই আছে, তবে পড়াশুনোটা বোধ হয় ইংলিশ মিডিয়ামেই হয়।

ওখানে ডাক্তারিতে চান্স পেলে পড়তে যাবি?

সুবোধ মাথা নীচু করে। বলে তুমি যদি বলো, যাব।

আসলে সুবোধ জানে ওর বাবার ভিতরকার ইচ্ছেটা। নিজের ভিতরেও কি ইচ্ছে-পাখি ডানা ঝাপ্টায়নি? সেই ছোটবেলায় একটা ‘আবোল তাবোল’ পেয়েছিল। সুকুমার রায়ের। মা জন্মদিন করেছিল, অনিলদা দিয়েছিল বইটা। অনিলদা ছিল ওর প্রাইভেট মাস্টার।

‘আবোল তাবোল’ বইতে একটা কবিতা আছে। কবিতাটা পড়ার সময় বিচ্ছিরি লেগেছিল। কবিতার নাম ‘হাতুড়ে’। ‘শুয়ে কেরে? ঠ্যাং ভাঙ্গা ধরে আন এখেনে, স্ক্রুপ দিয়ে এঁটে দেব কি রকম দেখেনে। কালাজ্বর পালাজ্বর পুরোনো কি টাটকা, হাতুড়ির এক ঘায়ে একেবারে আটকা।’

ছবিটাও কী বিচ্ছিরি। টেবিলের ওপরে রাখা কাঁচি, হাতুড়ি। হাতুড়ে ডাক্তার কেন বলে? হাতুড়ির সঙ্গে কী সম্পর্ক? হাতড়ে হাতড়ে চিকিৎসা করে বলে! ইস্কুলে একটা ছেলে প্রাইজের ফাংশানে ‘হাতুড়ে’ আবৃত্তি করেছিল নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে।

পাশের ছেলেরা সুবোধের দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। সুবোধের মনে হচ্ছিল ওরা মুচকি মুচকি হাসছিল। ওগুলো কি ব্যঙ্গ? তাচ্ছিল্যের হাসি? বাবা কি রোগী ভালো করেনি? সুবোধ জানে, অনেক কঠিন কঠিন রোগী ভালো করে দিয়েছে বাবা। বাবার দুঃখ—কোনও সার্টিফিকেট দিতে পারে না, বাবার রেজিস্ট্রেশন নেই।

সুবোধ বলে হোমিওপ্যাথি ডাক্তাররা সার্টিফিকেট দিতে পারে, তাই না? ওদের তো রেজিস্ট্রেশন নম্বর হয়, তাই না?

ভজন বলে হোমিওপ্যাথদের না, বুঝলি বাজারে ইয়ে নেই। হোক পাস করা, বিএইচএমএস, লোকে বলে পুরিয়া ডাক্তার। সে অবশ্য আমাদেরও হাতুড়ে বলে লোকে। কিন্তু অ্যালোপ্যাথদের মানুষ একটু গণ্যমান্য করে। বিদেশ থেকে পড়ে এলে তো আরও বেশি। কিন্তু অনেক টাকা রে সুবোধ। ইন্ডিয়ার চেয়ে ইউক্রেন টিউক্রেনে কিছু সস্তা পড়ে বটে, তবে এতদিন তোকে ছাড়া থাকতে পারবে তোর মা? বুঝলি সুবোধ, হোমিওপ্যাথিটাও খারাপ নয়। প্র্যাকটিস ভালোই হয়। গলায় স্টেথোস্কোপটা তো ডাঁটসে ঝোলানো যায়। আমি বহুদিন ওটা গলায় ঝোলাতে পারিনি রে, লজ্জা করত। হাতে গুটিয়ে রাখতাম। পড়বি, হোমিওপ্যাথি পড়বি?

—তুমি যা বলবে বাবা।

ভজন চুপ করে যায়।

ফিউচার বিল্ডার্স-এর লোকটার মুখ ভেসে এল।

ও একটা ছেলে ভাড়া করে দেবে বলেছিল, যে সুবোধের হয়ে অ্যাডমিশন টেস্ট দেবে।

কিছুতেই মনস্থির করতে পারছে না ভজন। নেপাল না চিন না ইউক্রেন না জাল পরীক্ষা না হোমিওপ্যাথি?

১৩

ভিটেটা বেচে দিচ্ছে ভজন মৃধা। শুঁটিয়ার সেই ভিটেটা। যেখানে জন্মেছিল। সেই কাঁঠাল গাছ, পেয়ারা গাছ—কলতলা, কলাঝাড় সব। আগামীকাল বায়না হবে। বেশি তো নয়, দশ কাঠা।

এখন অনেকদিন এ বাড়িতে থাকে না। বারাসাতে ফ্ল্যাটে থাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে আসত। গাছের ছায়ায় বসে একটা সিগ্রেট খেত। জংলি লতাটার দিকে, ঘোড়াকলমির নীল ফুলে বসা ফড়িংটার দিকে, সযত্নে বেড়ে ওঠা আকন্দ ঝোপের দিকে তাকিয়ে থাকত। বাড়িটা তালা দেওয়া। তালা খুলে একটা ঘরে ঢুকে পায়রার বকম বকম শুনত, এ চত্বরের বাসিন্দা কাঠবিড়ালির সঙ্গে মনে মনে কথা বলত।

কাল বায়না হবে। আজ চেম্বার যাওয়ার পথে এখানে এল। ঘরের পিছনদিকে গেল। আপনমনে একটা কুমড়ো লতা তার শরীরে কমলা রং-এর ফুল সাজিয়েছে। তার পাশে গুচ্ছের শুশনি ল’ ল’ করছে। উঠোন। সেই উঠোন। মায়ের উঠোন। চারদিকে তাকিয়ে গোপনে একটা প্রণাম ঠুকে নিল। তারপর বারবার মাথা কুটতে লাগল।

মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে ভজনের। ছেলেটাকে কিছুই বলেনি এখনও। সুবোধ বড় সুবোধ ছেলে। বড় ভালো। ওকে এখনও বলতে পারেনি। কী ভাবে বলবে? বেশ কিছুদিন ধরে একদম ঘুমোতে পারছে না ভজন। ঘুম হচ্ছে না একদম। ঘুম আসে না। মাথার ভিতরে কী যেন দপদপায়। কে যেন ঘোরে। ঘুমের ওষুধ খায়। তবু ঘুম নেই।

পরেরদিন চেম্বার গেল না ভজন। বাড়িতে কারুর সঙ্গে কথা বলল না। সারাদিন চুপচাপ। দুপুরবেলাটা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ছাদ থেকে ঝুলছে বাবুইপাখির বাসা। বাবুইপাখির বাসা কেন ছাদ থেকে ঝুলবে? ওটা একটা ঝোলা, একটা ব্যাগ, যেখানে আশা আকাঙ্ক্ষা রাখা আছে। না, ওটা ঝুল। ঝুলঝাড়নি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়নি কতদিন।

রেবতী বলল, শুয়ে আছ কেন? শরীর খারাপ?

ভজন রেবতীর দিকে তাকিয়ে থাকে। রেবতীর মুখটাও যেন পুরোনো ভিটে। ভজনের কপালে হাত দেয় রেবতী। গায়ে হাত দেয়।

না, গা তো গরম নয়। মাথা টিপে দেব?

ভজন বলে—না, ওসব করতে হবে না। একটু বিশ্রাম করছি। আর কিছু নয়। ভজন বুঝতে পারছে না, কাকে কী করে বলবে। সুবোধকে এখন কি কিছু জানাবে, নাকি হয়ে গেলে জানাবে? সারপ্রাইজ! সুবোধ খুশি হবে তো? সুবোধ ভয় পাবে না তো?

সুবোধ, সোনা আমার, আমি কি তোকে নষ্ট করছি? নিজে নিজে বলে ওঠে ভজন, নিজেও শুনতে পায় না।

ওরা ফোন করে ছিল আমায়। আপনি রেডি তো স্যার?

রেডি হচ্ছি।

রাইটারকে বলে দি?

রাইটার মানে?

সেই ছেলেটা, যে আপনার ছেলের হয়ে….।

ও, হ্যাঁ। ধরা পড়লে?

ধরা পড়লে আমরা পড়ব। আপনার তো কোনও ভয় নেই। কোনও রিস্ক নেই আপনার। আপনার কোনও রেজিস্ট্রেশন নম্বরও নেই যে ক্যানসেল করে দেবে। আর আপনার ছেলেরও ক্ষতি নেই কোনও, এখন যা করছে, তাই করবে। কেস খেলে আমরা খাব, তবে আজ অব্দি কিছু হয়নি।

তা ছাড়া সব সেটিং করা আছে।

ও।

চার-পাঁচ বছর পর আমাদের কাছে আসবেন, রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে, যখন আপনার ছেলে এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে আপনার কাছে যাবে, উইথ রেজিস্ট্রেশন নাম্বার।

ও।

ছেলেটাকে তো অ্যাডভান্স করতে হবে।

ও।

কী ও-ও করছেন? আমাদের তো তিন লাখ অ্যাডভান্স করতে হবে।

ও।

কবে আসবেন?

কবে?

হ্যাঁ, কবে আসবেন বলুন, ছেলেটাকে যদি অন্য কেউ নিয়ে নেয়, তাহলে আমরা পাব না। কবে আসছেন?

দুদিন—না না, তিন দিন। আজ কী বার?

মানডে। সোমবার।

বৃহস্পতিবার চলে যাব।

ওকে। উইদাউট ফেল।

কাল বায়না হবে। ওরা কিছু আগাম দেবে। আর জমানো যা আছে, তা নিয়ে লাখ তিনেক হয়ে যাবে। মাস দুয়েক পরে জমি বিক্রি। চান্স পেলে বাকি টাকাটা দিতে হবে।

শুঁটিয়ার বাড়ির জামগাছে একটা দোলনা ছিল। ঠাকুরদাদার পায়ের ছাপ ছিল ঘোষেদের বাঁধানো পুকুরের সিমেন্টে। পুকুরে দুটো বড় কাতলা ছিল জগাই আর মাধাই।

জমিটা বেচতে তো হতই। আজ না কাল। কী হবে রেখে। জমিটা বেচলে মেয়ের বিয়ের জন্যও কিছু টাকা রেখে দেওয়া যাবে।

চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে ভজন। সন্ধে হয়। জানলার ফাঁকে আকাশ। কি একটা গান আছে, শোনা যায় মাঝে মাঝে। রবীন্দ্রসঙ্গীত-ই হবে। আমি কেবল-ই স্বপন করেছি বপন আকাশে। আকাশে চাঁদ। চাঁদের যেন জন্ডিস। লাইটপোস্টে আলো বমি করছে। রাস্তার অটোরিকশার হর্নে শূলবেদনার রোগীর চিৎকার।

চা নিয়ে আসে রেবতী।

বেরুলে না একটু?

টিভিটা চালায়। এসময় একটু টিভি দেখে রেবতী।

কী করে তোকে বলব বলতে যা চাই…একটা গান। সিনেমার।

ভজন ঘুরে আসে বাইরে থেকে। কাল বায়না। লিখে দেবে ভিটের অঙ্গীকার। রাত্রে শুয়েছে ভজন। ঘুম আসে না। পিতা, পিতামহ আসে। বলে বসতে দিবি তো, নাকি তাড়াবি? ঘোষেদের পুকুরের জগাই মাধাই বিছানায় লুটোপুটি খায়। একটা দড়িওয়ালা লোক আসে, চেনা, কিন্তু ঠিক চিনতে পারছে না, বলে ছেলেটাকে নিজে হাতে নষ্ট করছিস? ও কি যাত্রার বিবেক? ঘুম ভেঙে যায়।

ঘুমের ওষুধ খেয়েই তো ঘুমিয়েছিল ভজন। গত ছ’মাস রোজই খায়। গত সাতদিন ধরে ডবল ডোজে খাচ্ছে, তবু ঘুম আসছে না। বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালায়। আরও দুটো খেয়ে নেয়। রেবতী মেয়ের সঙ্গে শোয়।

ঘুম আসছে। কালো। কালো গাড়ি। কালো গাড়ির ভিতরে কালো ছায়া। কালো ছায়ার ভিতরে কালো পোশাক-পরা ভজন আর সুবোধ। সাদা পোশাক পরা ওরা কে? মাথা টলমল করে। উঠে জল খায়। এভাবে বাঁচার কোনও মানে হয় না। কতদিন এই অশান্তি? সারা জীবন? ছেলের হাতে একটা জাল ডিগ্রি তুলে দিচ্ছে বাবা হয়ে?

জাল ডিগ্রি কেন হবে? ডিগ্রিটা তো জাল নয়, কিন্তু পরীক্ষাটা তো জাল। সারা জীবন বয়ে বেড়াবে এই পাপ? দুজনেই?

ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। সুবোধ।

সুবোধের এই রূপ কখনও দেখেনি। আঙুল উঁচিয়ে রেখেছে। হাতের তর্জনী যেন পিস্তলের নল।

আমাকে তুমি নষ্ট করলে বাবা?

ভজন মিন মিন করে, সুযোগ বারবার আসে না, তাই ভাবলাম…

আমি কিন্তু তোমাকে সারা জীবন…

ধুর, এ জীবন রাখবই না।

ষ্ট্রিপ খুলে আরও কয়েকটা বড়ি হাতের তালুতে তুলে নেয় ভজন, তার পর একসঙ্গে মুখে দিয়ে জল খেয়ে নেয়। টাটা বাই বাই। সুখে থেকো।

জমিটা রইল। চেম্বারও রইল। দরকার হলে চেম্বারে মুদি দোকান করিস সুবোধ। যা করতে চেয়েছিলাম তোর ভালোর জন্যই। বারবার এসে বাগড়া দিচ্ছিস। যা খুশি করগে যা। আমি চল্লাম।

সকাল হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। খবর কাগজ দিয়ে গেছে। ভজন এখনও ঘুমোচ্ছে।

রেবতী ধাক্কা দিল। কেঁপে উঠল ভজনের দেহ। রেবতীর মনে হল সুবোধের বাবার ঠোঁট কালো। ঠোঁটের কোনায় ফেনা। রেবতী চিৎকার করে ওঠে। সুবোধ আর অপর্ণা কাছে আসে।

বাবা, ও বাবা, ওঠো।

ভজন ওঠে না।

সুবোধ চিৎকার করে ওঠে। বাবা গো….।

সুবোধ দেখে ঘুমের ওষুধের খালি রুপোলি রাংতা। এবার আরও জোরে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর বাবার শরীরে। অপর্ণা বলে, শিগগিরি ডাক্তার ডাক দাদা, নিঃশ্বাস পড়ছে ।

ভজন সমুদ্রের শব্দ শোনে। ঢেউ। দেখে সাঁতরে সাঁতরে ক্রমশ পাড়ের দিকে আসছে। সাইরেন শব্দের মতো একটা আওয়াজ। পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সুবোধ। সুবোধ সেই ছোট্টবেলার মতো। নেংটু। বাবা ফিরছে বলে আনন্দে লাফাচ্ছে, সাঁতরাচ্ছে ভজন। পাড়ে এসে দাঁড়িয়েই সুবোধকে কোলে তুলে নেয়। বলে তোকে আমি নষ্ট করব না সোনা।

ডাক্তার বড়ুয়া জিজ্ঞাসা করলেন ক’টা বড়ি খেয়েছিলেন ভজনবাবু? ভজন বলল—গুনিনি। কিন্তু আজ আমায় একবার ডাক্তার মৃধা বলা যেত না ডাক্তার?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *