রাক্ষসায়ন

রাক্ষসায়ন

কিছুদিন ধরে সুখময় সারা গায়ে একটা লোশন মাখছে। এই লোশনটি একজন রসায়নবিদের কাছ থেকে পাওয়া। অত্যন্ত তেতো, দুর্গন্ধযুক্ত এবং বিস্বাদ এই লোশন। বেশ ভালরকম টাকা খরচ করে এই লোশনটা তৈরি করতে হয়েছে জীবনের জন্য। ওর স্ত্রীর সঙ্গে ওর দাম্পত্য বন্ধ। রাত্রে দামি ফরাসি পারফিউম মেখেও জীবন-লোশনের দুর্গন্ধ তাড়াতে পারেনি সুখময়। সুখময়ের যুবতি বউ, রূপসী বউ, পাশের ক্যাম্প খাটে শোয়। সুখময়ের গায়ে রেতে মশা দিনে মাছি বসে না।

সুখময় শোবার সময় দরজা বন্ধ করে। দক্ষিণ খোলা জানালাও। খিল, ছিটকিনি, তালা সবকিছু দিয়ে শোয়। শোয়, কিন্তু ঘুমোয় না।

সুখময় এতদিন ধরে বউকে না জানিয়ে যে টাকাপয়সা জমাচ্ছিল, একদিন সেটা বউয়ের কাছে ফাঁস করে দেয়। বউকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট করে। বলে ওগো, আমি মরে গেলে একদম বিধবার মতো থেকো না। মুরগিটুরগি সব খেয়ো। আবার বিয়ে করে নিয়ো। বলতে গিয়ে গলা ধরে এসেছিল।

সুখময় হল এই নব্যবিজ্ঞানকালের মানুষ। ইলেকট্রনিক্স-তথ্যপ্রযুক্তি-কলসেন্টার- জিনেটিক যুগের সন্তান। তাই তার মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহের প্রস্তাব নিজের প্রেয়সীকেও দিতে পারল। গলা কাঁপলেও।

সুখময়ের বাঁ হাতে একটি মাদুলি বাঁধা আছে। মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ। ইংলণ্ডেশ্বরী এলিজাবেথ কর্তৃক প্রশংসিত ঈশ্বরীপ্রসাদ ব্রহ্মচারীর সুযোগ্য পৌত্র; অটলবিহারী বাজপেয়ী ও ঐশ্বর্য্য রাই কর্তৃক প্রশংসিত শ্রীউত্তমেশ্বর ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে পাওয়া। হাওড়ার জানবাড়িতে। নিজের জানের জন্যই এই কবচ পিটার ইংল্যাণ্ড বা ভ্যান হুসেন সার্টের তলায় ঢাকা থাকে, না, রাখা থাকে।

রসায়নবিদ প্রদত্ত ওই বিস্বাদ ও বীভৎস লোশনটিও সুখময় জানবাড়িতে গিয়ে মহারক্ষা ‘ফু’ দিয়ে নিয়ে এসেছে। ওটাই মাখে। মাখতে হয়। জীবনের জন্য। কে না ভালবাসে জীবন? সুখময় আজ ছুটি নিয়েছে। ও এখন যাচ্ছে এক তন্ত্রবিজ্ঞানীর কাছে। বিজ্ঞানের সঙ্গে তন্ত্রকে মিলিয়ে তিনি তন্ত্রবিজ্ঞানী। নাম ডা. বি সি বটব্যাল এম ডি-এফ ডব্লু টি (ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ট্রেনিং) বৈজ্ঞানিক কায়দায় তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ করেন তিনি। তিনি কবচের বদলে ইনজেকশন দেন। তার আবিষ্কৃত ইনজেকশনগুলির নাম এরকম।

মাদার টেরিজা ইনজেকশন (কোমল ভাব আনবার জন্য)।

রবি ইনজেকশন (পণ্ডিত রবিশঙ্করের নামে। উল্লেখ্য, রবিশঙ্কর সত্তর বছরেও পিতৃত্বলাভ করেছিলেন)।

লাদেন ইনজেকশন (বোঝা যাচ্ছে। ব্যাখ্যার দরকার নাই)।

মমতা ইনজেকশন (এটা কিন্তু মনের মমতাময়তার জন্য নয়। অগ্নিকন্যা মমতা ব্যানার্জির নামে। লাদেন ইনজেকশনের তুলনায় অনেক মৃদু কাজ)।

তিনি একটা ওয়েবসাইট-ও খুলেছেন। তার ওয়েবসাইট খুললে কামদায়িনী ইনজেকশন নেবার পর নরনারীর কী অবস্থা হয় তা দেখানো হয়। ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ইনজেকশন, অপারেশন ও থেরাপির কথা বলা আছে। এসব পাবেন, যদি খোলেন।

স্বামী-স্ত্রী উভয়েই চাকরি করেন? অথচ সন্তান দুরন্ত? তাকে শান্ত রাখার জন্য মাসে একদিন লুলুপুপু ইনজেকশনেই কাজ হয়।

লজ্জা লজ্জা ভাব? নিজেকে প্রকাশ করতে অনিচ্ছা! লালু থেরাপি। বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত চনমনে থাকতে চান। জ্যোতি থেরাপি (জ্যোতিবাবুর নামে উৎসর্গীকৃত)। মেয়েরা পাত্তা না দিলেও আমরা পাশে আছি। শাহরুকামির সাবান মাথুন (শাহরুক খান + আমির খানের মিলিত ফল)।এ ছাড়া দুর্যোধন ক্যাপসুল, বুশ ট্যাবলেট, দ্রৌপদী পাউডার, নৃসিংহ অবতার ইনজেকশন ইত্যাদিরও ব্যবস্থা আছে। ওয়েবসাইটে নৃসিংহ অবতারকে দেখানো হয়। একবার সিংহের মতো মুখ ও নখ হয়ে গিয়েছিল বিষ্ণুর।নৃসিংহ অবতার হয়ে হিরণ্যকশিপুকে কোলে তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। খাওয়া নয়, ভক্ষণ। খাওয়ার মধ্যে ততটা সম্মান প্রকাশ নেই, যতটা ভক্ষণে আছে।

সুখময় এখন যাচ্ছে ওই তন্ত্রবিজ্ঞানীর কাছে। কারণ ওর খুব ভয়। সবসময় মৃত্যুভয়।ও বাচতে চায়।

বিজ্ঞানী বটব্যাল যে-সমস্ত কাজকর্ম করেন, আগেই বলেছি, তিনি ওয়েবসাইটে বলেছেন তার মধ্যে বিজ্ঞান ভরপুর থাকে। ঝোড়ো হাওয়া আর ভাঙা দরজাটা…ইত্যাদি তিনি পড়েননি নিশ্চয়ই,না পড়ুন,তিনি তন্ত্রবিজ্ঞানী। তিনি বলেন বিভিন্ন হরমোন, এনজাইম ইত্যাদি মিশিয়ে তিনি একধরনের পাঁচন ইনজেকশন তৈরি করেন। এই তন্ত্রবিজ্ঞানীর সঙ্গে আগেভাগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। প্রথমে মোবাইলে ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়।কেসটা কী জানতে চান।পছন্দ হলে টেক আপ করেন।সুখময়ের কেসটা খুব জটিল।ও ফোনে বলছিল, কিন্তু তন্ত্রবিজ্ঞানী বুঝতে পারছিলেন না। ওরা ব্যস্ত মানুষ।এত সময় কোথায়? তাই সুখময়কে বললেন -কেস হিষ্ট্রিটা লিখে নিয়ে যেতে।ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট পড়ে দেখবে। অ্যাসিস্ট্যান্টের পছন্দ হলে ওকে দেবে, তখন উনি দেখবেন। সুখময় তন্ত্রবিজ্ঞানীর কাছে যাবার আগে কেস হিষ্ট্রিটা লিখবে। অফিসে পারেনি। এ কেসের হিষ্ট্রি অফিসে বসে লেখা যায় না।বাড়িতেও নয়। বাড়িতে এসব লিখলে যদি বউ পড়ে ফেলে, তো নিদারুণ ভয় পাবে। বউ ভাবছে লোকটা পাগল হয়ে গেছে। তাই ভাবুক।

যে-লোশনটা সুখময় গায়ে মাখে, তার একটা কী যেন নাম বলেছিল রসায়নবিদ। ডাই মিথাইল মনো সালফো প্যারা হাইড্রো কুইনো কী যেন। কিন্তু ও নিজেই এই লোশনটার নিজের মতো করে একটা নাম রেখেছে। ‘জীবনামৃত’। বেঁচে থাকার জন্য এটা মেখেই যেতে হবে? সারাজীবন? কিন্তু শুধু এই লোশনেই বাঁচা যাবে? আরও কিছু চাই।কিছু থেরাপি। সাহস চাই মনে। প্রতিশোধস্পৃহা চাই। কী থেরাপি নেবে ও। লাদেন না বুশ?

সেটা তন্ত্রবিজ্ঞানীই ঠিক করে দেবে।

তার আগে একটা কেস হিষ্ট্রি লেখা দরকার।

একটা ছোট বার-এ ঢুকল সুখময়। লোকজন নেই। একটা বিয়ার নিল। একটা দু’নম্বর খাতায় কেস হিষ্ট্রি লিখতে থাকে সুখময়…

আমার নাম শ্রীসুখময় সাহা। বয়স ছত্রিশ বছর। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। ইলেকট্রনিক্স।আমি চাকরি করি একটি কম্পিউটার চালিত ফার্ম হাউস-এ।ওই ফার্ম হাউসে অনেক কম্পিউটার আছে।একটা মাস্টার কম্পিউটারও আছে। কম্পিউটার খারাপ হয়ে গেলে সারানোই আমার কাজ।আমাদের ফার্মে গোরু, ভেড়া, মানুষ, এইসব পোষা হয়। ওদের শরীরে বায়োটেকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং করা আছে। যেমন ধরা যাক ইনসুলিন গোরু। মানে কয়েকটা গোরুর শরীরে বায়োটেকনিকালি এমন করা হয়েছে, যে ওদের প্যাংক্রিয়াস থেকে প্রচুর পরিমাণে ইনসুলিন বের হবে। এবার ওই গোরুদের মধ্যে বিট করিয়ে এমন একটা নতুন গোরু প্রজাতি করা হল যে যাদের শরীরে ইনসুলিনের প্রস্রবন। ওই গোরুর প্রস্রাব ইনসুলিনে ভরপুর।ওই গোরুর দু’ফোঁটা প্রস্রাব দু’ফোঁটা ফেলে দিলে কম্পিউটার বলে দেয় ক’ পার্সেন্ট ইনসুলিন রয়েছে।এভাবে পিটুইটারির ছাগল, থাইরয়েডের ভেড়া, এড্রানালিনের মানুষ এসবও রয়েছে।

স্কুলে পড়ছে বাচ্চারা, কাবুলে বা ইরাকে বা কাশ্মীরে, বোমা ফেলতে হবে। হায়ার এড্রানালিনের মানুষ ছাড়া পারবে কেন? বুলডেজার দিয়ে ঝুপড়ি ওড়াতে হবে। চাই উপযুক্ত এড্রানালিনসম্পন্ন মানুষ। আমাদের ফার্ম বিদেশি টাকা ও প্রযুক্তির ফার্ম। কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিংটা ওসব দেশে হয় না। এসব দেশেই হয়। আমরা ওদের কাঁচা মাল সাপ্লাই করি।

টেস্টোস্টেরন পুরুষ, প্রজেস্টন নারীও আছে আমাদের ফার্ম হাউসে। এসব কাঁচা মাল বিদেশে যায়। মেয়েদেরও কৃত্রিমভাবে মাসে দু-তিনবার ঋতুস্রাব করানো হয়। তাদের ঋতুরক্ত থেকে প্রয়োজনীয় কাচা মাল সংগ্রহ করা হয়।সবাই মাইনেপত্র ভালই পায়।বছরে দু’বার কোম্পানি বোনাস দেয়। আপনি স্যার আমাদের কোম্পানির কথা ভালভাবেই জানেন শ্রীতন্ত্রবিজ্ঞানী, আপনি একবার আমাদের কোম্পানিতে এসেছিলেন, কিন্তু আমাদের কোম্পানি খুচরো বিক্রি করে না শুনে দুঃখিত হয়েছিলেন। দু-তিন হাত ঘুরে এই দ্রব্যগুলি আপনার কাছে যায়, ফলে দাম বেশি পড়ে। আপনি স্যার আমার উপকারটা করে দিলে মাঝে মাঝে আপনাকে স্যাম্পল পৌঁছে দেব।

আমার কাজ, আপনাকে আগেই বলেছি কম্পিউটারের টুকটাক মেইনটেনেন্স। আমার আণ্ডারে একজন হেলপার আছে। মোটামুটি ভালই। বললে কথা শোনে। স্টেটমেন্টে একটু গ্রামারের ভুল হয়ে গেল। এখানে পাস্ট টেন্স হবে। হেলপারটি ছিল। এখন নেই। স্যাড কেস। কেন স্যাড কেস বলব। সব খুলে বলব।

বছর খানেক আগেকার একটা ঘটনার কথা বলি। কম্পিউটারে একটা স্পার্মের স্যাস্পেল দিয়ে টি ওয়াই টিপেছি, স্ক্রিনে দেখি কিছু মাছ খেলা করছে। কিউ টিপে বেরিয়ে গেলাম। আবার টি ওয়াই। আবার মাছ। রি স্টার্ট করলাম। সেই মাছ। রঙিন মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। এরকম কী করে হয়? বারো বছর ওই কাজ করছি, কখনও এরকম সমস্যা হয়নি। আমি কম্পিউটারটা খুলি। আমার যা বিদ্যেবুদ্ধি, তাতে কোনও গণ্ডগোল পাইনি। আমার উপরে একজন ইঞ্জিনিয়ার আছেন। তিনি আই আই টি-র ইঞ্জিনিয়ার। হেভি স্মার্ট। পাইপ খান। আজকাল মেয়েদের কাগজে দেখবেন ‘হে পুরুষ! বলে একটা কোলাম থাকে। ওখানে চুল্বুল সেন – শতাব্দী রায়-রা সব তাঁদের ভালোলাগা পুরুষদের কথা লেখেন। ওদের কলমের পুরুষ যেন তিনি। আমার বস। সুকান্ত রায়। সুদর্শন। খুব ওডি কোলন মাখেন। ওকেই আমার ভয়। ওর হাত থেকে বাঁচান। সব বলব। পরে আসছি। কিছুই গোপন করব না। যাহা বলিব সত্য বলিব।

আমি যখন কম্পিউটারটা সারাতে পারলাম না, তখন আমি রায় সাহেবকে ডাকা করালাম। ঊনি আলমারি থেকে ব্লু সিট বার করে দেখলেন, কম্পিউটারটা খুলে অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিচ্ছু হল না। বলছেন মাছ কী করে আসবে। কোনও সফ্টওয়ারেই তো রঙিন মাছ ইনপুট দেওয়া নেই। যে-কোনও ফ্লপি দিলেই স্ক্রিনে মাছ। যে-কোনও সি ডি দিলেই মাছ। মাছ ঘুরছে। ছোট্ট স্ক্রিনে সমুদ্রতল। অ্যানজেল, গোল্ড ফিস, গাপ্পি, মলি…।

আমিও ভাবছি এটা কী? কী করে হচ্ছে? কম্পিউটার ভাইরাসে এমন হয়? অজানা ভাইরাস? আমি ভেবেই বা কী করব? আমি ভাববার কে? বস আছেন। আই আই টি-র বি-টেক।

বস বললেন, এর লিটারেচারগুলো বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। কাল দেখব। কম্পিউটারের ডালা খোলা। আমাকে তো থাকতেই হবে। যতক্ষণ ডিউটি ততক্ষণ।কাজ না থাকলেও।আমি বসে আছি। কম্পিউটার রুমের উলটোদিকে একটা ছোট ঘর আছে। অ্যান্টি চেম্বার। ওখানে থাকে সব স্পেয়ার, ব্যাটারি, ট্রানজিস্টার, আই সি, সিলিকন চিপ্‌স…। হঠাৎ দেখি ওই ঘর থেকে একটা ইঁদুর এল। ইঁদুররা যেমন আসে ওরকম নয়। বেশ স্মার্টলি। এসেই টুক করে ডালাখোলা কম্পিউটারের পিছন দিকটায় ঢুকে পড়ল। কুটুস কুটুস শব্দ। আমি তাড়া করে তাড়ালাম। এরপর ডালা খোলা রাখা ঠিক নয় ভেবে ডালাটা আটকে দিলাম। আবার চালালাম। ও মা? দেখি আগেকার মতো। কোয়াইট নর্মালি। স্পার্ম কনটেন্ট IDKI পার MM2 …। ঠিকঠাক বলছে। তা হলে? তা হলে কি ইঁদুরটাই ঠিক করে দিল?

পরদিন বস এলেন। আমি বললাম– স্যার আমি আবার ট্রাই করে ঠিক করে দিলাম। বস জানতে চাইলেন কোথায় গণ্ডগোলটা হয়েছিল? কোন সার্কিটে? কোন সেকশনে? আমি ঠিকমতো বোঝাতে পারলাম না।

এরপরও মাঝেমাঝেই খারাপ-হত মেশিনটা। মেশিনটা খারাপ হলে শ্রেফ ডালাটা খোলা রেখে চুপচাপ বসে থাকতাম ইঁদুরটা ঠিক চলে আসত। সারিয়ে দিয়ে চলে যেত। ভাল করে লক্ষ করে দেখছি, সবসময় একটা ইঁদুরই আসত এমন নয়। কয়েকটা ছিল। বিভিন্ন সাইজের।

একদিন দেখলাম একটা ইঁদুর একবার ডালাখোলা কম্পিউটার দেখে গেল, তারপর চলে গেল স্টোর রুমে। তারপর বেছেবুঝে একটা আই সি নিয়ে এল ঠোঁটে করে।ইঁদুর তো সোলডারিং করতে পারে না, দাঁত দিয়ে গর্ত করে… যা পারে আর কী। আমরা পরে সোলডারিং করে দিয়েছি।

এই ব্যাপারটা আমার হেলপারটাও জেনে গেল।ওর নাম বৃন্দাবন পাল। আমি বৃন্দাবনকে বলেছিলাম, কাউকে বোলো না।

যন্ত্রটা বড্ড বিগড়োতে লাগল। স্ক্রিনে কখনও মাছ, কখনও প্রজাপতি উড়ছে, কখনও সাপ কিলবিল করেছে, কখনও বললে বিশ্বাস করবেন না, বিল গেট্স বাপের জন্মে শোনেনি এমন কিছু কড়া কিয়া গণ্ডা কিয়া। ইঁদুরটা ঠিক চলে আসত। ভেরি পাংকচুয়াল। বিদেশি কোম্পানির ইঁদুর তো।

আমাদের ফার্মে জেনেটিক্স-এর কাজ কারবার চলে, আর ওইসব পরীক্ষার জন্য ইঁদুর-টিদুর লাগে। এইসব ইঁদুর হয়তো ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে চলে এসেছে কম্পিউটার রুমে। কী খাচ্ছে কে জানে? বাক্মে নানা ওম্‌স্‌–এর ট্রানজিস্টার থাকে। একদিন দেখি কয়েকটা নেই। কয়েকটা খুবলে খাওয়া। কে খেল? ইঁদুরটা? মাঝে মাঝে বস ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে একটা খেলা খেলতাম। মেশিন বিগড়োলে স্টোর রুমের দরজাটা আগে বন্ধ করি, তারপর বসকে ডাকি। ঊনি কিস্সু করতে পারেন না। আমি তখন ওঁকে জিজ্ঞাসা করতাম আই আই টি-তে বিরাট ক্যাম্পাস, তাই না স্যার? ওদের পড়াশুনোর স্ট্যান্ডার্ড জার্মানি-আমেরিকার চেয়েও উন্নত, তাই তো স্যার? ওখানে বুঝি প্রচুর অ্যাডভান্স স্টাডি হয়?

উনি মাথা নিচু করে চলে যান। পরে ফাঁক বুঝে স্টোরের দরজা খুলে দিতাম। তারপরই ইঞ্জিনিয়ার ইঁদুর সারিয়ে দিত। একদিন আমার বস আচমকা ঢুকে পড়ল ঘরে। তখন একটা নয়, দুটো ইঁদুর মেশিন সারাচ্ছিল। বস দেখলেন। বললেন, সে কী? ইঁদুর কোত্থেকে এল। আমাকে বকলেন। এসব দেখবেন তো? ইঁদুর দুটে স্টোরে চলে গেল।

বস ঝাড়ুদার বুধনকে বলল স্টোরটা পরিষ্কার করে দিতে। বুধন এল। দরজা বন্ধ করে কী সব করল। চলে গেল। সেদিন ছিল শুক্রবার। দু’দিন ছুটি। সোমবার যন্ত্র বিগড়ে গেল। স্ক্রিনে প্রজাপতি উড়ছে। বসে আছি ইঁদুরের ভরসায়। আসছে না। গোডোর জন্য অপেক্ষা। এলেন না। বস ইঞ্জিনিয়ারের কাছে যাব কি না ভাবছি, এমন সময় উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকল বুধো। মানে বুধন জমাদার। বুধোর গাম বুটে নোংরা। কম্পিউটার রুমে ঢুকবার আগে জুতো খুলে আসাই নিয়ম। তা জানে, কিন্তু ও বিচ্ছিরি অবস্থায় ছুটে চলে এল। বুধো সোজা কম্পিউটারের পিছনে চলে গেল খুট খুট করে কী যেন করল, এবং বেরিয়ে গেল।

এবার চালিয়ে দেখলাম সব ঠিক আছে। আমি আর আমার হেলপার বৃন্দাবন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ব্যাপারটা কিছু বুঝলাম না। ইঁদুরের বদলে বুধো?

ক’দিন পরে যন্ত্রটা আবার খারাপ হয়ে গেলে একইভাবে বুধো এল, সারাই করল। আমি বুধোকে আটকালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, বুধো, ব্যাপারটা কী সত্যি করে বলো। বুধো বলল, হচ্ছে আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথায় কেমন যেন হয়, তখন চলে আসি। একটু আগে বড় সাহেবের কমোড পরিষ্কার করছিলাম, তখনই মাথার মধ্যে কীরকম বিপ বিপ শব্দ তারপর কিছু জানি না। কীরকম যেন নেশালাগা ঘোর। এখন দেখি আমি এখানে।

বলি মেশিনের কী করলে তুমি? ও বলে, জানি না স্যার। কিছু খারাপ করলাম? মাপ করে দেন স্যার।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। সাদা হাফ প্যান্টের ভিতরে নীল শার্ট গোঁজা। পায়ে গাম বুট। বুধন। অপরাধে নিচু মুখ।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, একটা সত্যি কথা বলো তো বুধন– স্টোর রুমের ইঁদুরগুলো তুমি কী করেছ?

বুধো সরলভাবে বলল– কেন স্যার? নষ্ট করব কেন? খেয়েই নিলাম।

ইঁদুর খেলে কেন? তুমি কি জানতে ওই ইঁদুর খেলে…

স্যার, আমরা জাতে ‘কোরা’। ইঁদুর তো পেলেই খাই। প্যাঁজ-রসুন-লঙ্কা…। ইঁদুর খেতে খুব ভাল স্যার। সেদিন চার-পাঁচটা বড় ইঁদুর পেয়ে গেলাম, আর গোটা কত বাচ্চা। একবেলা বেশ ভালই হল…।

হায়। একটা ইঞ্জিনিয়ার প্রজন্ম নষ্ট করে দিল বুধো…

বুধো আমাদের ফার্ম হাউসেই থাকে। একদিন খারাপ হল মেশিন, ও তখন ঘরে বসে মদ খাচ্ছিল। ওর সেদিন অফ ডে। ও টলতে টলতে এসে ঠিক করে দিয়ে গেল।

ঠিক সেইসময় আমার মায়ের হার্ট অ্যাটাক হল। মারাও গেলেন। দিন পনেরো ছুটি নিতে হয়েছিল। ফিরে এসে দেখি আমার হেলপার বৃন্দাবন পালের জয়-জয়ক্কার। মেশিনপত্র খারাপ হলেই সারিয়ে দিচ্ছে। কোম্পানি বলছে এরকম একটা ট্যালেন্টকে সুখময় সাহা অ্যাদ্দিন চেপে রেখেছিল, ছিঃ। ও সামান্য ইলেকট্রিশিয়ান সার্টিফিকেট হোল্ডার হতে পারে কিন্তু অসামান্য ট্যালেন্টেড।এতদিন বোঝা যায়নি। আমি দেখলাম সত্যিই। আমার হেলপারটি খুব তাড়াতাড়ি মেশিনপত্তর সারিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু বুধো নেই। বুধো নিপাত্তা।

বুধো মাঝেমধ্যে ডুব মেরে যায়। কাউকে না জানিয়ে। কিন্তু ও খুব ‘কাজের’ বলে চাকরি যায় না।

বুধোর দেশের ঠিকানায় টেলিগ্রাম পাঠানোর পর বুধোর খুড়তুতো ভাই এসে জানাল বুধো আদৌ দেশে যায়নি। তার মানে বুধো নিখোঁজ।

আমি সন্দেহ করি বৃন্দাবনকে। বৃন্দাবন কি ক্যানিবাল? নাকি ক্যারিয়ার মানুষকে ক্যানিবালও করে দিতে পারে?

আমি একদিন বৃন্দাবনকে মাল খাওয়াই। মালের ঘোরে ও বলেছিল–ও বুধোকে খেয়ে ফেলেছিল। তন্ত্রবিজ্ঞানী ডা. বটব্যালের নৃসিংহ অবতার ইন্টারভেনাস ইনজেকশনের কথাও বলেছিল। বলেছিল দারুণ ইনজেকশন।

তারপর স্যার আমারও ইচ্ছে হল বৃন্দাবনকে খাই। হবে নাই বা কেন? দোষের? আমি একটা শনিবার আপনার চেম্বারে গেলাম। আমি তো জানতাম না যে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে আপনার সঙ্গে দেখা করা যায় না। আমি যেদিন আপনার চেম্বারে গেলাম, সেদিন দেখি আপনার চেম্বার থেকে ব্যস্তভাবে বের হচ্ছেন আমার বস সুকান্ত রায়। উনি কিন্তু আমাকে দেখতে পাননি। আই অ্যাম শিয়োর। তারপর দিন থেকেই বৃন্দাবন নিখোঁজ।

বৃন্দাবন তো আমার পাওনা ছিল, তাই না? আমার রাগ হয়। রাগ হলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। আমি একদিন বসকে ফেলি বৃন্দাবন পালের কী হয়েছে আমি জানি।আই নো হোয়াট হ্যাপেণ্ড। আপনি ‘নৃসিংহ অবতার’– নেননি?

বসের মুখ হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেল। উনি হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, আই উইল সি ইউ।

অফিসারের সি মানে কি ইট? ই এ টি? সেই থেকে আমি গায়ে দুর্গন্ধ মেখে ঘুরি। বিস্বাদ মেখে ঘুরি। শরীরে মেখেছি মৃত্যু শুধু জীবনের জন্য। শরীরে তেতো। আমার বউকে ভালবাসার ঝোঁকে চুমু খেয়েছিলাম। ওর ঠোঁটে তিন দিন তেতো লেগে ছিল।

আমার তেতো চামড়াও কি খেয়ে নেবে আমার বস! হয়তো তাও খাবে। ক্যারিয়ার স্যার। একজনকে না মারলে যে অন্যজন টিকছে না। স্যার এখন দারুণ কাজ করছেন। সব মেশিন ঠিক করে দেন। কিন্তু আমি যে লুপ্ত বৃন্দাবন কথা জানি…।

মাননীয় তন্ত্রবিজ্ঞানী, আমাকে নৃশংসতা দিন, প্রতিশোধ স্পৃহা দিন, থাবা দিন, শ্বা দন্ত দিন আমাকে…।

আমি সুখময়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *