লাপ্পা

লাপ্পা

লাপ্পার দাম আবার বাড়ছে সরকার কিছুটা ভরতুকি দিত, সেই ভরতুকি উঠিয়ে নেবে, ফলে লাপ্পার দাম আবার বাড়বে।

একটা মিছিল বের হল এই দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে। মিছিলে সমবেতভাবে গাওয়া হল : লারে লাপ্পা লারে লাপ্পা লাপ্পা লাপ্পা লারে, লাপ্পা লারে…। কিন্তু সেই মিছিলের তেজ একটু পরই ফুরিয়ে গেল, কারণ মিছিলের লোকজনের যথেষ্ট পরিমাণে লাপ্পা নেওয়া ছিল না। যে কয়েকজন নেতা মঞ্চে উঠে বক্তৃতা করেছিলেন, তারা লাপ্পা সেন্টার থেকে জনগণের চাঁদায় যথেষ্ট পরিমাণে লাপ্পা নিয়েছিলেন। তাই জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতায় নেতারা বলেছিলেন, দেশের মানুষকে লাপ্পা বঞ্চিত করা চলবে না। দেশের যদি উন্নতি করতে হয় সরকারকে সস্তায় লাপ্পা সরবরাহ করতেই হবে। যাদের টাকা আছে, তারা তাদের শরীর ফুল চার্জ করে নিচ্ছে, যারা গরিব, তারা ফুল চার্জ দূরের কথা, হাফ চার্জ করতে পারছে না। এই সব মূঢ় ম্লান মুখে দিতে হবে লাপ্পা। সমুখেতে কষ্টের সংসার। বড়ই দরিদ্র, শূন্য, বদ্ধ অন্ধকার। অন্ন চাই প্রাণ চাই আলো চাই, মুক্তবায়ু। তারও আগে লাপ্পা চাই, আনন্দ উজ্জল পরমায়ু। লাপ্পাই যদি না পাব, তবে যে শুয়ে থাকতে হবে ঘরে। মৃতের মতো। বল লাপ্পাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়? আমরা যদি লাপ্পা না পাই, ঘরের ভেতরে শুয়ে না থেকে সবাই রাস্তায় শুয়ে থাকব। ট্রেন লাইনে শুয়ে থাকব। সবকিছু অচল করে দেব…

সুবোধ শুনছিল এই বক্তৃতা। সুবোধ এমনিতেই একটু ভীরু প্রকৃতির, লাপ্পা কম পেয়ে আরও থম মেরে গেছে।শহরে চাকরি। চাকরিটা হয়েছে বছর দশেক। মফস্বল থেকেই যাতায়াত করছিল। যাকে বলে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করা। সুবোধ বিয়ে করেছে বছর পাঁচেক আগে, ওদের একটি পুত্রসন্তান আছে। সন্তানের বয়স তিন। সন্তানের লেখাপড়া শহরে ভালো হবে। আর লাপ্পা চার্জ করার জন্য দূরে যেতে হবে না, ঘরের ভেতরে কানেকশন নেওয়া সম্ভব না হলেও আশপাশেই নিশ্চয় লাপ্পা বুথ থাকবে। আর এসব ভেবেই শহরে এসে বাড়ি ভাড়া নেওয়া। শহরে ওরা যে বাড়িতে আছে, একটু পুরোনো ধরনের। মালিকদের গণ্ডগোলের কারণে প্রোমোটিং হয়নি। একটা উঠোন, উঠোনের চারদিকে দালান। দালানগুলো তিনতলা। মোট বারোটি পরিবার। যাকে বলে বারো ঘর এক উঠোন। উঠোনে একটা কল বসানো। কল মানে জলের কল নয়, লাপ্পা কল। ওই এ টি এম মেশিনের মতো দেখতে একটা বাক্সের মধ্যে একটা পাইপ। পাইপের সঙ্গে জড়ানো টুপি। মাথায় টুপিটা পরে পাসওয়ার্ড টাইপ করতে হয়। তারপর ও কে টিপতে হয়। লাপ্পা আসতে থাকে টুপিতে। লেখা ফুটে ওঠে ‘চার্জিং’ আর মিটারে দেখানো হয় কত খরচ হচ্ছে। একদম পেট্রল পাম্পের মতো। আগে একটাই লাপ্পা কোম্পানি ছিল। এখন বিভিন্ন কোম্পানি হয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানির লাপ্পা বেশ স্ট্রং। ফুল চার্জ হয়ে যায়। কোনো কোম্পানির লাপ্পা একটু ডাইলিউট। কোনো কোম্পানি চব্বিশ ঘণ্টাই সাপ্লাই করে, কোনো কোম্পানি দিনে কয়েকবার।

সুবোধরা যে কোম্পানির গ্রাহক, সেই কোম্পানি দিনে চারবার করে লাপ্পা সাপ্লাই করে। অনেকটা কর্পোরেশনের জলের মতো। জল আসার আগে কল থেকে যেমন গরর্ গরর্ শব্দ বের হয়, অনেকটা সেরকম একটা শব্দ বের হয় – হরর্ হরর্….এই মেশিন থেকে।

যাদের ২৪ ঘণ্টা সাপ্লাই আছে, তারা তো যখন খুশি টুপি পরে নিয়ে চার্জড হয়ে যেতে পারে, তাদের অসুবিধা নেই, কিন্তু যে সব গ্রাহক সস্তার কোম্পানির লাপ্পা কেনে, তাদের আবার টাইমকলের মতো টাইমে টাইমে হাজির হতে হয়। এজন্য লাপ্পা লাং পাওয়া যায়। ওটা একধরনের চৌবাচ্চা। একটু খরচ করে চৌবাচ্চা কিনে নিতে হয় যখন টাইমকলে লাপ্পা আসে, ওই চৌবাচ্চায় জমা পড়ে, আর গ্রাহকদের যার যখন সময় হয়, ওই চৌবাচ্চা থেকে লাপ্পা ভরে নিতে পারে। চৌবাচ্চা মানে একটা বাক্স।

সুবোধদের বাড়িতে যারা থাকে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই উলটো পালটা ডিউটি। কেউ টিভি চ্যানেলে কাজ করে, কেউ মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, কেউ তান্ত্রিক জ্যোতিষী, কেউ যৌন পরিষেবাবিদ। যদিও সুবোধ দশটা-পাঁচটা (প্রকৃত অর্থে নটা-আটটা) চাকরি করে, কিন্তু বেশিরভাগ ভাড়াটের সিদ্ধান্তে লাপ্পা লাং-এর জন্য ভালোরকম চাঁদা দিতে হয়েছে।সুবোধ পারতপক্ষে চৌবাচ্চা ব্যবহার করে না।সকাল সাতটায় দাঁত মাজতে মাজতেই ও হরর্ হরর্ শব্দ শোনে, এবং মুখ ধুয়েই তাজা লাপ্পা নিয়ে নেয়, এরপরই দোলনকে পাঠিয়ে দেয়। দোলন সুবোধের বউ। দোলন সঙ্গে করে দ্রোণকে নিয়ে যায়। দ্রোণ ওদের সন্তান। চার্জ করিয়ে নেয়। দোলন এখনও চাকরি পায়নি। তবে কিছু আয়ও করে।একটা বিদেশি কোম্পানির সাবান কসমেটিক্স, টুথপেস্ট–এসব গছায়। কমিশন পায়। ওদের পরিবারের সবাই একটাই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। একটাই বিল আসে সুবোধের নামে বিলে ব্যবহৃত ইউনিট এবং তার খরচ লেখা থাকে। এ নিয়ে সংসারে একটু খিটিমিটি হয়। ঝগড়ার ধরনটা এরকম:

দো। তো বিলটা আমায় দেখাচ্ছ কেন?

সু। বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

দো। সে কি আমার জন্য হচ্ছে? আমি কি বেশি নিচ্ছি? তুমিই তো দু-বার করে নিচ্ছ।

সু। আমাকে অনেক খাটতে হয়। অনেক মাথার পরিশ্রম।

দো। আমি বুঝি বসে বসে খাই? মাল গছাবার হ্যাপা জানো? এ জন্য কত লাপ্পা দরকার হয় জানো? তাও তো আমি দু-বার নিই না। অতই যদি সন্দেহ, তবে ইনডিভিজুয়াল বিলের জন্য অ্যাপ্লাই করো। আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড হোক…

সু। আলাদা হওয়ার কথা উঠছে কেন আবার…

দো। তুমিই তো ওঠাচ্ছ। প্রতি মাসেই ওঠাও, কিন্তু জানি তো, আলাদা পাসওয়ার্ড করিয়ে দেবে না, ওতে তো খরচ বেশি। তোমার ক্ষমতা তো জানি। একে একটা বাজে কোম্পানির লাপ্পা নিচ্ছি, তাও কমন। তার ওপর বড় বড় বাত।

সু। আহা-হাহা, রেগে যাচ্ছ কেন এমন, আমি শুধু বলছিলাম একটু বুঝে চলতে, আর কিছু না। দ্রোণকে এত চার্জ করাচ্ছ কেন? ও তো বাচ্চা। ওর কি এত লাগে?

দো। ওকে এ বছর স্কুলে ভর্তি করাতে হবে তো, নাকি? স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্টগুলো কি তুমি দিয়ে আসবে?

সু। বেশি লাপ্পা দিলেই আই কিউ বাড়ে না। বরং ক্ষতি হয়। পরশুদিন একটা আর্টিকেল বেরিয়েছিল পড়োনি? লাপ্পা একটা ধাপ্পা।

দো। ধাপ্পা তো তুমি নিচ্ছ কেন?তুমি তো দিব্যি দু-বেলাই টুপি পরছো। আর কেবল নজর আমি বেশি নিচ্ছি কি না। ঠিক আছে, আমি নেবই না। চুপচাপ শুয়ে থাকব।তুমি চারবার করে নাও।একেই বলে পুরুষতন্ত্র। পুরুষরা যত খুশি নেবে, কেবল আমরা নিলেই দোষ…

সু। উঃ প্লিজ, আমি এভাবে বলিনি…

দো। প্রতি মাসে বিল এলেই ডাইরেক্টলি হোক, ইনডাইরেক্টলি হোক আমাকে খোঁটা দাও…

সু। খোঁটা কেন দেব খামোকা। বলছিলাম গত মাসে দুশো ইউনিট ছিল, এ মাসে তিনশো কুড়ি। এবার আমাদের চেক করতে হবে, এ নিয়ে একটু আলোচনা করার জন্য…

দো। ছাড়ো ছাড়ো…। একটা চাকরি পাচ্ছি না বলে। একটা চাকরি পেলে তোমার পরোয়া করব না। আমি আলাদা পাসওয়ার্ড ইউজ করব। আমার আলাদা বিল আসবে। দরকার হলে পোর্টেবল কিট কিনব…।

হ্যাঁ, এখন পোর্টেবলও পাওয়া যাচ্ছে। দাম বেশ বেশি পড়ে। ব্যস্ত সিরিয়াল শিল্পীরা, যাঁরা পরপর ফ্লোরে ফ্লোরান্তে শুটিং করেই চলেছেন, তারা গাড়িতে পোর্টেবল কিট রাখেন, শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে একটু করে লাপ্পা নিয়ে নেন। যাঁদের ট্যুরের চাকরি, তারাও পোর্টেবল নিচ্ছেন। আর ভোটের সময় তো পোর্টেবলের বিক্রি খুবই বেড়ে যায়। তখন ব্ল্যাকও হয়।

সুবোধরা যখন মফস্বলে ছিল, তখন পঞ্চায়েতের পরিচালনায় কমিউনিটি লাপ্পা সেন্টারে যেত। একটু ভিড় হত, একটু লাইন দিতে হত।অনেক গ্রামে এখনও পর্যন্ত লাপ্পা লাইন পৌঁছোয়নি। ওখানকার মানুষরা এখনও লাপ্পাহীন। ওদের চাকরি পেতে অসুবিধা হচ্ছে। ওদিককার এম এল এরা লাপ্পাহীনদের জন্যও সংরক্ষণ দাবি করছে। শহরের মানুষের নানা সুবিধে। তার মধ্যে অন্যতম হল সহজলভ্য লাপ্পা।

শহরের অভিজাত আবাসনে প্রত্যেক ফ্ল্যাটে আলাদা আলাদা লাপ্পা কানেকশন আছে। এটা খালি দেখলেই হয় না, খরচা আছে। যারা সস্তায় চায়, তারা ভাগ করে নেয়। সুবোধরাও এরকমই ভাগাভাগির মধ্যে আছে। ভাগাভাগি শব্দটা যখন এলই, তাহলে বলতেই হয় লাপ্পা সমাজটাকে শ্রেণিবিভক্ত করে দিয়েছে। যারা লাপ্পা ব্যবহার করে না বা করতে পারে না, তারা হল নারে লাপ্পা শ্রেণি। বা বি এল এল মানে বিলো লাপ্পা লেভেল। আর যারা পারে, তারা হাঁরে লাপ্পা। হাঁরে লাপ্লাদের আবার কয়েকটা ভাগ। আটকা, ঠেকনা, টাইমকা, ছুটকো–এরকম। মানে কারা ঘরে চব্বিশ ঘণ্টার কানেকশন নিয়েছে, কারা নির্দিষ্ট সময়ের, কারা রোজ নেয় না, যখন পারে পাবলিক বুথ থেকে নিয়ে নেয়–এরকম। সোশ্যাল স্ট্যাটাসও নির্ভর করে এর ওপর। যদি ডট কম বা ওই জাতীয় বিশেষ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পাত্রপাত্রী খুঁজতে হলে যে ফর্ম ফিল আপ করতে হয়, ততে দুটো কলাম থাকে, যেখানে লাপ্পা সম্পর্কেও তথ্য দিতে হয়।

তো, লাপ্পার দাম বেড়ে গেছে। সুবোধ সত্যিই কম কম নিচ্ছে কিন্তু আরও নেওয়ার একটা তৃষ্ণা থেকে যাচ্ছে। লাপ্পা একটা নেশার মতো। না নিলে কেমন যেন কষ্ট হয়। ছোটবেলায় তো লাপ্পা ছিল না, তখন তো অসুবিধে হত না। কিন্তু এখন সারা শরীর যেন নুন কম নুন কম লাগছে।

আন্দোলনও চলছে। একদিন বন্ধও ডাকা হল। অবশ্য বন্ধের আওতা থেকে সমস্তরকম লাপ্পা সার্ভিস বাদ দেওয়া হয়েছিল। বন্ধে কোনো লাভ হল না। সরকার আর ভরতুকি দিতে রাজি নয়। কোম্পানিগুলোও দাম কমাতে রাজি নয়। কোম্পানিগুলোর বক্তব্য আন্তর্জাতিক বাজারে লাপ্পার দাম অনেক বেশি। এখন যা কিছু হিসেব হয়, সব ডলারে। এই লাপ্পা ফিলিপিনস বা ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডে বিক্রি করলে অনেক বেশি টাকা পাওয়া যায়। ভারত সরকার আগে বলেছিল কনজিউমারদের থেকে কিছু কম নিতে বাকিটা সরকার পুষিয়ে দেবে। এখন সরকার যদি ভরতুকি না দেয়, ওইসব বিদেশি কোম্পানিগুলি ব্যাবসা গুটিয়ে অন্য দেশে চলে যাবে। এখন যে সব লাপ্পা কোম্পানি আছে প্রায় সবাই বিদেশি। একটিমাত্র আধা দেশি কোম্পানি আছে, তার নাম স্বস্তিকা এল.পি.জি. এল পি জি মানে লাপ্পা প্রোডাকশন গ্রুপ। ইউনিট প্রতি এদের রেট একটু কম। সুবোধরা এদেরই মেম্বার।

সরকার অনড়। দু-একজন নেতা বললেন ভারতবর্ষে লাপ্পার দরকার নেই। যে দেশে যোগব্যায়াম আছে সে দেশে লাপ্পার কী দরকার। মানুষ ঠিক জানে যে-সব নেতা এসব বলছে, তারা নিয়মিত লাপ্পা নেয়। ভারতবর্ষে যদি বন্ধ হয়ে যায়, ওরা বিদেশ থেকে নিয়ে আসবে।

চারিদিকে আন্দোলন চলতে থাকল। বাস-টাস পুড়তে লাগল। দুটি মাত্র দল, যারা কেন্দ্র সরকার চালাচ্ছে, তারা ছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক দল লাপ্পা বাঁচাও আন্দোলনে শামিল। রিলে অনশন চলছে। অনশন মঞ্চে লাপ্পা লারে লারে গান চলছে, কিন্তু অতিবিপ্লবী স্বস্তিকা লাপ্পা কোম্পানির সদর দপ্তরে ইট দাগল। কাচ ভাঙল। ভেতরে ঢুকে কয়েকজন কর্মকর্তার মাথা ফাটিয়ে দিল। স্বস্তিকা কোম্পানি পরদিন সাপ্লাই বন্ধ করে দিল। স্বস্তিকা কোম্পানি খবর কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিল ওরা ব্যাবসা বন্ধ করে দেবে, এবং যাদের যা সিকিউরিটি মানি জমা আছে, অমুক তারিখের মধ্যে তুলে নাও।

একটা সামাজিক আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। এ তো চাল নয় যে বস্তা বস্তা তুলে রাখা যাবে। চ্যানেলে চ্যানেলে তর্ক, আপনার মতামত। এটা কি বহুজাতিক চাল? সত্যি সত্যিই কি লাপ্পা ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যাবে? এ নিয়ে এস এম এস, ওপিনিয়ন পোল।

বেচারা সুবোধ। বিদ্যাসাগরের গোপাল। গোপাল বড় সুবোধ বালক। সেই টাইপের। সকাল থেকে স্বস্তিকা কোম্পানির সাপ্লাই নেই।

চৌবাচ্চায় মানে, লাপ্পা লাং-এ হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। সবাই নিতে চায়। দোলন বলল দাঁড়িয়ে হাবার মতো দেখছ কী! কিছু একটা কর! সুবোধ কী করবে বুঝতে পারে না। দোলন নিজেই এগিয়ে আসে। বলে হচ্ছেটা কী? কোনো ডিসিপ্লিন শেখেননি? লাইনে দাঁড়ান, সবাই লাইনে দাঁড়ান!

বারোটা পরিবারের সদস্য হুড়োহুড়ি করছে। তবু যাহোক করে একটা লাইন তৈরি হল। দোলন বাইশ নম্বর, দ্রোণ তেইশ এবং সুবোধ চব্বিশ নম্বর। চৌবাচ্চার থেকে সবাই ফুল চার্জ করে লাপ্পা নিচ্ছে। দোতলার কেতকী সমাদ্দার একটি গর্ভজাত মেয়ে এবং কাজের মেয়ে নিয়ে থাকেন। তিনি যৌন পরিষেবা সেক্টরে আছেন। নিজেদের পরিবারের সবার নেওয়া হয়ে গেলে একটা ছোট ইঁদুরকলের মতো প্লাগ লাপ্পা লাং-এর আউট পয়েন্টে গুঁজে দিলেন। এ কী হচ্ছে বলে অনেকে চিৎকার শুরু করে দিল। কিন্তু চিৎকার ও প্রতিরোধ প্রবল হওয়ার আগেই ওই ভদ্রমহিলার কাজ শেষ। উনি চলে গেলেন। তারপরই চ্যাঁচামেচি প্রবলতর হল। কেউ বলল হুকিং চলবে না। কেউ বলল চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। বোঝা গেল পেন ড্রাইভ জাতীয় একটা যন্ত্র দিয়ে ওই ভদ্রমহিলা বেশ কিছুটা লাপ্লা বার করে নিয়েছেন ভবিষ্যতের জন্য। উনিশজনের মাথায় চৌবাচ্চায় লালবাতি জ্বলে উঠল, মানে আর মাল নেই।

এবার কী হবে? দোলন চোখ বড় বড় করে তাকাল সুবোধের দিকে। দৃষ্টিটা সুবিধের মনে হল না সুবোধের। সুবোধ আগেই সারেন্ডার করল। বলল, আমি কী করব শেষ হয়ে গেলে। দোলন বলল, তুমি ওরকম একটা যন্তর আগেভাগেই কিনে রাখোনি কেন?

আমি ঠিক জানতাম না… সুবোধ কুঁই কুঁই করে।

কিন্তু আমি তো অ্যাড দেখেছি। এল এল বি। লাপ্পা লোডিং ব্যাঙ্ক। ওর মধ্যে জমিয়ে রাখা যায়। তুমি আজই কিনে আনো।ব্যাঙ্ক থেকে টাকা উঠিয়ে নাও।

সুবোধ বলল, আচ্ছা।

দোলন বলল, আচ্ছা তো বলে দিলে। কোথেকে লোড করবে তুমি? চৌবাচ্চায় তো মাল নেই।

সুবোধ বলল, তাই তো।

তবে?

এর উত্তর তো সুবোধের কাছে নেই। সুবোধ চিন্তা করতে থাকে। ওর মনে হয় ও চিন্তাটাও ঠিকমতো করতে পারছে না। লাপ্পা পড়েনি শরীরে। লাপ্পা ছাড়া চিন্তাও করা যায় না।

জানা গেল অন্য কোম্পানিগুলো সাপ্লাই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সুবোধের পক্ষে এক্ষুনি কানেকশন নেওয়া মুশকিল। বাড়ির সবাই মিলে যদি নেয়, তবে হয়তো সম্ভব।

স্বস্তিকা কোম্পানি সাপ্লাই বন্ধ করে দিলেও অন্য কোম্পানিগুলো সাপ্লাই দিচ্ছে। দু-একটা কোম্পানি গাড়ি নামিয়ে দিয়েছে। ভ্রাম্যমাণ লাপ্পা সাপ্লাই। বন্দুক হাতে পুলিশ আছে সেই সব গাড়িতে। মানুষ লাইন দিয়ে বেশি দাম দিয়ে লাপ্লা নিয়ে যাচ্ছে।

সুবোধ রাস্তায় এসব দেখল। ওর পকেটে এ টি এম কার্ড থাকে। ওই কার্ড দিয়ে টাকা তুলল। ওই টাকায় একটা এল এল বি কিনল। ভ্রাম্যমাণ গাড়ির লাইনে দাঁড়াল। নিজে নিল, এবং নতুন কেনা এল এল বি তে যতটা ধরে লাপ্পা কিনে নিয়ে গর্বিত পায়ে বাড়িতে গেল। আজি এনেছি, আজি এনেছি তোমাকে করিতে সব দান। দোলন খুশি হল। সুবোধ বলল, এটায় কুড়ি ইউনিট ধরে। তিন-চারদিন চালাতে পারবে তো? দোলন দ্রোণকে আড়াল করে প্রথমে একটা চুমু খেল সুবোধকে। তারপর টুপিতে কানেকশন দিয়ে মাথায় পরে নিল।

সুবোধ বলল, আগে তো দ্রোণকে দিতে পারতে…।

দোলন বলল, আগে আমি ঠিক হয়ে নিই, ওকে তো দেবই…

সুবোধ লক্ষ করল বউটা লক্ষ্মী হয়েছে। মাত্র দেড় ইউনিট নিজে নিল, তারপর দ্রোণকে। সুবোধ তাকিয়ে আছে। দোলন বলল, ভয় নেই, ভয় নেই, তোষার জন্য রাখব…। মিষ্টি করে তাকাল দোলন।

অফিসে আর কোনো কাজ নেই, কেবল এ নিয়ে আলোচনা। সবাই বলাবলি করছে স্বস্তিকা কোম্পানি এই শক সামলাতে পারবে না। এমনিতেই কোম্পানিটার শেয়ারের দাম দিনকে দিন নেমে যাচ্ছে। অন্য কোম্পানিগুলো টিকে যাবে। সরকার যদি ভরতুকি উঠিয়েও নেয়, মানুষ লাপ্পা ছাড়া বাঁচতে পারবে না। বেশি দাম দিয়েই কিনতে হবে, কোনো উপায় নেই।

অফিসের ওর এক হিতৈষী বন্ধু উপদেশ দিল আলফা কোম্পানির কানেকশন নিতে। অন্য বন্ধু আলফা হল আমেরিকান কোম্পানি। ডলারের দাম পড়ে যাচ্ছে। আমেরিকার ভবিষ্যৎ নেই, বিটা কোম্পানির কানেকশান নাও। বিটা হল ডাচ কোম্পানি। ডাচরা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী জাতি। ইউরোর দাম কিন্তু বাড়ছে। অন্য বন্ধু বলল, বরং গামা কোম্পানির কানেকশান নাও। জাপানি কোম্পানি। খরচটা একটু বেশি, কিন্তু সার্ভিস ভালো। জাপানিরা সহজে বিট্রে করে না। সুবোধ পি এফ থেকে টাকা তোলার জন্য দরখাস্ত করে দিল, এবং হেড ক্লার্কের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়াল। তাড়াতাড়ি কাজটা করে দিন। ছোট্ট করে স্যারও বলল সুবোধ। সুবোধের একটা মামাতো ভাই আছে এ শহরে। ও সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ করে। সুবোধ জানে ওর নিজস্ব হোম কানেকশন আছে। তা ছাড়া ও প্রতি মাসে একটা ভালো অঙ্কের লাপ্পা অ্যালাউন্স পায়। ওর কথা মনে পড়তেই ওকে ফোন করল সুবোধ। মামাতো ভাই বলল, আজ আমার অফ, চলে আয়। দেখা যাক কী করা যায়।

সুবোধ গেল। কী সুন্দর ফ্ল্যাট। লাপ্পার দাম বেড়েছে বলে কোনো চিন্তা নেই। বিল কোম্পানি মেটাবে। বলল, এত চিন্তা করছিস কেন তুই, লাপ্পা ভরে নে। সুবোধ বলল, আমার জন্য এত ভাবছি না। আমার তো পরিবার আছে।

আই টি কোম্পানির ভাইটি বলল, লোড করে নিয়ে যা। আমার কাছে একটা এল এল বি আছে। আগেকার মডেল, একটু বড়। হারমোনিয়াম বাক্সের সাইজ। ভরে দিচ্ছি, নিয়ে যা। তিন চারদিন চলে যাবে। কিন্তু বারবার দিতে পারব না। হিউজ বিল হলে কোম্পানি ভাববে আমি বাইরে বিক্রি করছি।

তাই করল সুবোধ। এল এল বি-তে লাপ্পা ভরল। তারপর ট্যাক্সি করে বাড়ি নিয়ে গেল। বউকে বলল এনেছি, আমি এনেছি…

আলফা-বিটা-গামা কোম্পানির ফ্রানচাইজিতে গেল সুবোধ। বুঝল সহজে কানেকশন পাওয়া যাবে না। কারণ আলফা কোম্পানি প্রোডাকশন বাড়াবে না আর। নতুন গভর্নমেন্টের শক্তিমন্ত্রীর সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ভালো নয়। নববিবাহিত পুত্র গ্রিনল্যাণ্ডের ইগলুতে হনিমুন করতে চেয়ে আলফা কোম্পানিকে স্পনসরও ব্যবস্থা করতে বলেছিল, কোম্পানি ভুল করেছিল। রাজি হয়নি। অনেকের ধারণা আলফা কোম্পানিকে হাটাবার জন্যই সরকার এসব করছে।

পরদিন অফিস যাওয়ার পথে সুবোধ দেখল একটা মিশনারি সংস্থা লাপ্পা বিতরণ করছে। যেন লঙ্গরখানা। আবার লাপ্পা লোড করল। বাড়ি গেল। আমি এনেছি…।

ওর ঘরের চৌকির তলাটা ভরে গেছে। ভবিষ্যতের লাপ্পা সঞ্চয়। শেষ হয়ে গেলে আবার ভরে আনবে। এ বাড়ির লোকেরা দেখছে ওর অভাব নেই। দেখুক। এখন দশ-বারোদিন চলে যাবে। শুধু একটু সাবধানে থাকতে হবে। ঘর খোলা রেখে কোথাও যাওয়া চলবে না।

গামা কোম্পানির এজেন্ট খবর দিল–আপনি কানেকশন পাবেন। কনগ্র্যাচুলেশন। নতুন যারা অ্যাপ্লাই করেছিল, তাদের মধ্যে লটারি হয়েছে। লটারিতে আপনার নম্বর উঠেছে। আপনার ঘরেই কানেকশন চলে যাবে।

কত খরচ পড়বে?

টাকার অঙ্কটা শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল সুবোধ। অ্যা-অ্যা-ত্তো?

হ্যাঁ, বেড়ে গেছে।

তার ওপর আবার লাপ্পার দাম দিতে হবে?

হ্যাঁ! সেটাও বেড়ে গেছে।

তার ওপর সার্ভিস চার্জ।

হ্যাঁ, ওটাও বেড়ে গেছে।

পোর্টেবল নেই? পোর্টেবল? ছোট ছোট কিট? শেষ হয়ে গেলে আবার ভরে নেব?

পোর্টেবলের তো খুব ডিমাণ্ড। শেষ হয়ে গেছে। কাল আবার মাল আসার কথা আছে। রাত থেকেই লাইন পড়বে।

পি এফ এ-র টাকা পেয়ে গেছে সুবোধ। ওই টাকাগুলো পকেটের ভেতরে পুরে রাতে খাওয়াদাওয়া করে লাইনে দাঁড়াল। ওদের বাড়ির দু-একজনকে দেখল। দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল। একটু পরে রাস্তায় বসে পড়ল। একজন বৃদ্ধ মানুষ তার ছোটবেলাকার গল্প করতে লাগল। জলের পাইপ ফেটে যাওয়ার গল্প। তখন অন্য পাড়ায় জল আনতে গিয়ে মারপিট। তারপর পরিবারের সবাই মিলে এখান থেকে ওখান থেকে হাঁড়ি, বালতি, কলসি ভর্তি করে জল স্টক করার গল্প।

এইসব গল্প চলছিল, সবাই শুনছিল। কয়েকজন মহিলাও ছিল। এমন সময় কয়েকটি যুবকের আবির্ভাব হল। হিন্দি সিনেমার ভিলেনের মতো ওদের পোশাক। ছিট ছিট জামা। ওদের মুখ থেকে মদের গন্ধ। ওরা বলল, এক থেকে কুড়ি নম্বর আমাদের রিজার্ভ। যে লাইনের এক নম্বরে আছে, সে আসলে একুশ নম্বর। কিছু লোক প্রতিবাদ করল। ছেলেগুলো চড়চাপড় মারতে লাগল। হুটোপুটি লেগে গেল। মেয়েদের চিৎকার শোনা গেল। একটা নারীকণ্ঠের চিৎকার–আমার ব্লাউজ ছিড়ছেন কেন? এই গলাটা দোলনের মতো নয়? ছুটোছুটিতে রাস্তায় পড়ে গেল সুবোধ। মাথা ফেটে গেল। তবু বাড়ি ফিরল না। একটু পরে আগন্তুক যুবকরাই ম্যানেজমেন্টের লোক হয়ে গেল। ওরা প্রথম কুড়িটা নিজেদের জন্য রেখে একুশ থেকে লাইন ঠিক করে দিল। আকাশে শুকতারাটা ম্লান হল। সূর্য উঠল। যাদের মাথা ফেটেছিল, যাদের ঠোঁট কেটেছিল তাদের সব রক্ত চাক হয়ে গেল। ঘরে ঘরে টিভিতে, এফ এম-এ ভৈরবী রাগ বেজে উঠল। বেলা আটটায় লাপ্পা গাড়ি এল।

সবাই লাইন ঠিক করল। মেয়েটিও লাইনে দাঁড়িয়ে। ছেঁড়া ব্লাউজ ঝুলে আছে। আঁচল চাপা কাঁধের কাছে রক্তের ছড় দেখা যাচ্ছে, সে দোলন। আর ওই বৃদ্ধটি, যে জলের গল্প বলেছিল, সে লাইনে নেই। রাস্তার একধারে শুয়ে আছে। বোধহয় মৃত।

সুবোধ একটা পেল। পোর্টেবল। দিন কয়েক চলে যাবে। বুকে জড়িয়ে ধরে বাড়ি ফিরল সুবোধ আর দোলন। সুবোধের কপালের রক্তের রং এখন কালো। আর দোলনের…।

চৌকির তলায় ওরা রাখল ওসব। চৌকির তলাটা ভরে আছে। আহা টইটম্বুর। যেন হাঁড়ি, কলসি, জারিকেন, বালতি, ডেকচি ভর্তি জল। যেন বহুদিন কলে জল না এলেও দুঃখ নেই। বৃষ্টি না হলেও দুঃখ নেই। সুবোধ দু-চোখ ভরে লাপ্পা ভরা যন্ত্রগুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। দোলনও বসেছে মেঝেতে। দোলনও তাকিয়ে আছে। একটা সুন্দর সুখে আছে দুজন। এত স্টক ও বাড়ির কারও নেই। কী নিশ্চিন্তি। আড়চোখে দেখল বাড়ির অন্যদের চিন্তামগ্ন পদচারণা। অস্থিরতা। আঃ কী সুখ!

ঠিক এমন সময় একটা শব্দ। হরর্ হরর্ শব্দ, লাপ্পার মূক মেশিন থেকে শব্দটা আসছে। যে শব্দটা আসার কথা ছিল না, সেই শব্দটা আসছে। উঠোনের মানুষরা চিৎকার করে উঠল। হইহই করল, হাততালি দিল, গতকাল রাতে কি কিছু ঘটে গেল?

সরকার কি আবার কিছুটা ভরতুকি দিতে রাজি হয়েছে? শক্তিমন্ত্রীর ছেলে কি শেষ অবধি ইগলুতে হনিমুনে গেল?

চৌকির তলায় পড়ে আছে সুবোধদের পি. এফ. এ টি এম নিংড়ানো টাকা।

সুবোধ কপালে হাত দিয়ে বসে থাকে। হাতে গতরাতের বাসি রক্ত।

সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে ওই বন্ধ লাপ্পা মেশিনে। লাপ্লা আসছে। হরর্..হরর্…।

বাইরে হইহই শব্দ।দোলনের শরীর জুড়ে কান্না আসছে এখন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *