একটি সতর্কতামূলক রূপকথা

একটি সতর্কতামূলক রূপকথা

এক যে আছে লোক। ওর একটা ফ্যাট আছে। টিভি-ভিসিআর-ভিসিনি মেশিন আছে, কর্ডলেস ফোন আছে, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আছে, একটা স্কুটার আছে, গাড়ি নেই বলে দুঃখ আছে, আর আছে একটা বউ। বউ বড় দুঃখী। সবার কত গাড়ি আছে, ওর একটাও নেই। সবাই কেমন ফরেন যায়, ও একবারও যায়নি। সবার ছেলে টাই ঝুলিয়ে ঘাড় দুলিয়ে টা-টা করে স্কুলে যায়, ওর কোনো বাচ্চা নেই।

লোকটার বউ রান্নাঘরে রবিবারের রান্না করছে আর লোকটা সোফায় বসে রবিবারের টিভি দেখছে–দুঃশাসন দ্রৌপদীর শাড়ির আঁচল ধরল। বেগুনি রঙের সিনথেটিক শাড়ি। বলল–হাম তুমকো নাঙা করেঙ্গে। শাড়ির আঁচল ধরে টানতে লাগল। চুমকি বসানো শাড়িতে ঝিকিমিকি–ঝিকিমিকি। রুবি মালহোত্রা, মানে দ্রৌপদী ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। দুঃশাসন হাঃ হাঃ হাঃ অট্টহাস্য হেসে যাচ্ছে। রুবি বলল– হে কৃষণ্‌ তুমকো মে সর্বস্ব সমর্পণ কিয়া, মুঝে বাঁচাও। তখনই স্ক্রিনের কোনায় মদন মিশ্র, মানে শ্রীকৃষ্ণ। মদন ওর পেটেন্ট হাসিটা দিল, আর তখনই বেগুনি শাড়ি শেষ হয়ে গোলাপি এল। গোলাপি শেষ হল, হলুদ এল। ঝিকিমিকি-ঝিকিমিকি। রুবি ঘুরে যাচ্ছে। দুঃশাসন-দুর্যোধনের হা হা হাসি থেমে যায়। ভেসে আসে মমতাজ-মমতাজ-মমতাজ। মমতাজ শাড়ি অফুরন্ত… দ্রৌপদী ঘুরে যাচ্ছে। দ্রৌপদীর গায়ে গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে মমতাজ প্রিন্টেড, চেক, বুটি… জড়িয়ে যাচ্ছে, ভয়েল, জর্জেট…। পরদায় বারবার ঝলক – মমতাজ শাড়ি অফুরন্ত…

লোকটা দেখে। ঠিক দেখে না, চেয়ে থাকে। সোফায় আধশোয়া হয়ে চেয়ে থাকে। হাতে সিগারেট। টানছে না। তবু আঙুলে রয়েছে। টিভি কেসের মাঝের তাকে ভিসিপি-ভিসিআর। কতদিন চালানো হয় না, আছে। ব্যালকনিতে একটা দোলনা ঝুলছে। একা একা ঝুলছে। বুককেসে কত বই, কতদিন খোলা হয় না। টিভি দেখে লোকটা। দেখে না, চেয়ে থাকে।

এমন সময় সেই মিউজিক। যেই না মিউজিকটা শুরু হল, বউটা মাইক্রোওয়েভ উনুনটা অফ করল, চিংড়ি মাছ ফ্রিজে তারপর সোফায় এসে বসল। বউটার মুখে হাসি নেই। বউটা লোকটার দিকে তাকায় না, লোকটা বউটা দুজনেই টিভি-র কাঁচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

দারুণ মিউজিক। ভিতর পর্যন্ত ঝনঝন-শিরশির। পর্দায় H.O.P.E অক্ষরগুলি নাচে। অক্ষরগুলি দুভাগ হয়ে যায়। তার মধ্যে জুড়ে যায় নতুন অক্ষর। শেষঅব্দি তৈরি হয় হোমোসেপিয়েন্স্। মিৎসুবিসি প্রেজেনট্স্ ইনকুবেটার ফর হোমোসেপিয়ন্স্। হোপ। হোপ। হোপ। হোপ।

কর্তা চায় গিন্নির দিকে। গিন্নির চোখ টিভিতে। গিন্নির দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তাই দেখে কর্তারও দীর্ঘশ্বাস পড়ে। এই হোপ যন্ত্রটি ওদের নেই। হোপ মানে ইনকুবেটার। মানুষের ডিমে তা দেবার যন্ত্র। যান্ত্রিক তা। এটা কিনলে, কিনতে পারলে তবে ওদের বাচ্চা হবে।

লোকটা বলল, বুঝলে বিপাশা, এবার এটা কিনতেই হবে। বউটা বলল, আর কিনেছ। বউটার চোখ টিভির দিকে। ওরা বেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। এক এক দিন এক এক রকম।

টিভির পর্দায় বন্দনা ঘোষ।প্রখ্যাত মহিলা পত্রিকার সম্পাদিকা।। ছেলেরা দিব্যি কোনো কষ্টটষ্ট না করে বাবা হয়ে যেত, আর মেয়েরা ক্যারি করে মরত। এবার মেয়েদের মুক্তি। পেট ফুলিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে না। আজ অম্বল কাল পেট ফাঁপায় ভুগতে হবে না। শেষের দিনগুলোতে মেয়েরা সেক্স এনজয় করতে পারত না। এবারে পারবে। মেকানিকাল ইনকুবেশন ওয়েলকামড।

রুবি মালহোত্রা।। চিত্রাভিনেত্রী। আমার বেবি তো ইনকুবেটারে বেড়েছে। কোনো অসুবিধেই হয় নি। লিটারেচার ফলো করে বটনিং করে শ্যুটিং-এ চলে যেতাম। একটা চিন্তা ছিল শেলটা ফাটবে তো, কিন্তু শিডিউল টাইমের সাত মিনিট আগেই শুনি বিপ্‌বিপ্‌। শেল থেকে বেবি বেরিয়ে গেল। শী ইজ নাও পারফেক্টলি ওকে। দেড় বছরের হল। দিব্যি মা বলছে।

এবার এল একজন সুন্দরী মহিলা। সারা মুখে মা-মা ভাব। পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিন্দুর।মুচকি হাসল। বলল, এ পর্যন্ত আমাদের দেশের একলক্ষ একাশি হাজার মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছি আমরা।ওই দীর্ঘ কষ্টের দিনগুলির কথা ওরা জানে না। তারপর টেলিভিশনের পর্দায় পরপর আসে কতকগুলি হাসিরাশি সুন্দরী।

অদৃশ্য কণ্ঠ: আপনি কী ভাবছেন?

বউটা বলল, কী ভাবছ?

লোকটা বলল, এক লক্ষ একাশি হাজারের মধ্যে আমরা নেই। আমরাও হব। হতে হবে।

তারপর লোকটা চোখ বোজে।

স্টিরিওতে কী একটা গান হচ্ছে। ওয়াশিং মেশিনে কী একটা শব্দ হচ্ছে। লোকটা ভাবছে ওই এক লক্ষ একাশি হাজারের মধ্যে ওর জানা চেনা কে কে আছে।

জেনারেল ম্যানেজার? –নো, নো।

ওয়ার্কস ম্যানেজার? –নো।

সেলস ম্যানেজার? –নো।

জার্মানি ফেরত মাসতুতো ভাই বিল্টু একটা কিনবে কিনবে করছিল। কিনেছে কি? ফোন করল লোকটা।

–না ভাই কিনতে পারিনি এখনো। বউ তো আর দেরি করতে চাইচে না।এখনো না হলে বাচ্চা বড় হবে কবে। ভাবছি এমনিই হোক, বায়োলজিকালি। তোরা নিচ্ছিস নাকি?

 –ভাবছি। তা তোরা নিলি না কেন?

 –আরে, আমার একার চাকরি। তোর তো ডবল ইঞ্জিন। নিয়ে নে, নিয়ে নে।

 –তোর জানাশুনো কেউ কিনেছে?

 –নন্তুই তো কিনল। আমার মেজ শালাটা। কন্ট্রাক্টর।

ওয়াশিং মেশিনের বাদামি প্ল্যাটফর্মের উপর বাঁ-হাতের কনুইটা রেখে গালে হাত দিয়ে মেশিনটার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে বিপাশা। পলক পড়ে না। দেখলে মনে হবে বুঝি আদর করছে দৃষ্টিতে। ওর ডান হাতের পাতা মেশিনটার গায়ে লাগল। নড়ল। দেখলে মনে হবে মমতায় হাত বুলোল। আসলে ধুলো ঝাড়ল। মেশিনকটাকে ভালো লাগে না বিপাশার। সবকটা পাজি। একদণ্ড তিষ্টোতে দেয় না। এটার বরফ পরিষ্কার করো, ওটার বলবেয়ারিং চেঞ্জ, ওটার গায়ে তেল দাও, এটার হেড পরিষ্কার করা… লেগেই আছে। আর খালি খাইখাই। এবার আবার হাত বুলাল মেশিনটার গায়ে। এটা আদরের। তারপর মেশিনটার আনন্দ ঘড়ঘড় শব্দ শুনল কিছুক্ষণ, চোখ বুজে। এবার অন্য একটা বোতাম টিপবার কথা–জিনিসগুলো শুকোবার জন্য। ঠিক তখনই থেমে নখচকচক আঙুল। ভাবল আজ শাড়িগুলোকে বাইরে মেললে কেমন হয়, বাইরের রোদ্দুরে? তাহলে একটু অন্যরকম হয়। রোদ্দুরের একটা আলাদা গন্ধ আছে।বিপাশা তখন লোকটার গলায় কথা শুনল।

–তোমার জানাশোনা কার কার আছে?

–কতবার তো বলেছি৷ মধুরিমারই তো আছে–

–তোমার কলিগ?

–হু। বড্ড ভুলে যাও তুমি। নাকি ভান করা?

–ওর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা একবার দেখে আসা যায় না?

–না।ওর বাড়ি যাওয়া যায় না। বড্ড আদেখলা ভাববে।

–ঠিক আছে। ওটা ছেড়ে দাও। আর কে নিয়েছে?

–টুম্পার বউদিরা।ওখানেও যেতে চাই না।

–তা হলে বিল্টুর শালার বাড়িতেই যাওয়া যাক। বুঝলে…

তারপর বিল্টুকে নিয়ে ওরা বিল্টুর শালা নন্তুর বাড়ি গেল। নন্তুবাবুকে সবাই চেনে। বাড়ির জানালাগুলোয় এ-সি বাক্স এঁটে আছে বলে নয়, সে তো অনেকেরই আছে, নন্তুবাবু দিলদরিয়া, নন্তুবাবুর অনেক শখ। কালীপুজোয় অনেক বাজি, অনেক মদ, পয়লা বোশেখে অনেক মিষ্টি, পনেরোই আগস্টে অনেক কাঙালিভোজন… সবাই চেনে। এখন আরো চেনে কারণ ও বাড়ির বউদির ডিম ফুটছে যন্তরে।

টেবিলে বসানো একটি কাচের বাক্স।বাক্সের গায়ে কাঠের ফ্রেমে লাইন করা অনেকগুলো বোতাম। বোতামের গায়ে 1, 2, 3, 4… লেখা। কাচের গায়ে চন্দন এবং সিঁদুরের ছিটে। বাক্সটার পাশে আর একটা ছোট যন্ত্র তাতে আলো দপদপ করছে। একপাশে কয়েকটা সিলিণ্ডার, তাতে পাইপ লাগানো, পাইপ গিয়েছে বাক্সে। বাক্সটার অন্যপাশে একটা ফ্রেমে বাঁধানো মা কালী। স্ট্যাণ্ডে ফিট করা; ছবির তলায় রক্তজবা। বাক্সের মধ্যে একটা স্টেনলেস স্টিলের প্লেটে কাশীর পেয়ারা সাইজের বাদামি রঙের ডিম।

বিপাশা জিজ্ঞাসা করল–কমাস চলছে?

নন্তুবাবুর বউ মুচকি হাসি হেসে বলল, পাঁচ মাস।

কোনো কিছু অসুবিধে বুঝছেন?

না ভাই, এখনো তো ভালোই।

নন্তুবাবুও তখন বাড়ি ছিল। ফট করে যন্ত্রটার একটা সুইচ টিপে দিল। ওমনি যন্ত্রটার গায়ের একটা সাদা পর্দায় সবুজ রেখার ঢেউ খেলে যেতে থাকল। নন্তুবাবু বলল, এটা মনিটর। জিনিসটা কেমন আছে, বোঝা যায় এখানে।নন্তুবাবুর গলায় কথা লাফাচ্ছে, পর্দায় রেখা লাফাচ্ছে। প্রাণ।

লোকটা মাথা চুলকোল, আঙুল মটকাল। বলল, মেশিনটা বাড়ি নিয়ে এলেন কেন? শুনেছি কোম্পানিরই ব্যবস্থা আছে, ওদের ওখানেই ডিম ফোটানো যায়।

নন্তুবাবু বলল, যায়, কিন্তু আমার শখ বাড়িতেই হোক। সবাই বেশ দেখবে…

নন্তুবাধুর স্ত্রীর নাম মুন। কমবয়সী ছটফটে। ওর সঙ্গে বিপাশার বেশ ভাব হয়ে গেল!…

মুন।। না দিদিভাই, কিস্‌সু ঝামেলা নেই। খুব ইজি প্রসেস্। এখানে বাক্সের গায়ে লাইন করা দুশো আশিটা বোতাম আছে। রোজ একটা করে টিপে দাও, ব্যাস।

বিপাশা।। যদি ভুলে যাও?

মুন।। ভুল হবে কেন?

সকালে দাঁত মাজার সময়ই বোতামটা পুশ করে দিই।

বিপাশা।। তোমার তো এটা সেকেণ্ড ইস্যু। আগেরটা কি গো? ছেলে না মেয়ে?

মুন।। মেয়ে। ও কিন্তু পেটে হয়েছে। তখন তো এসব আসে নি। ওর এখন চার বছর চলছে। কেবল জিজ্ঞাসা করত মা আমি কি করে হলাম, কি করে হলাম… এবারে নিজে দেখছে। হি-হি।

বিপাশা।। এবারে কী হচ্ছে জান? ছেলে না মেয়ে?

মুন।। ছেলে। টেস্ট করিয়েছিলাম গত সপ্তাহে।

বিপাশা।। কীভাবে?

মুন।। কোম্পানির লোক তো আসেই প্রতি সপ্তাহে। সব চেকটেক করে যায়। একশো কুড়ি দিন হলেই ওরা বলে দেয় ছেলে না মেয়ে।

বিপাশা।। তুমি তো ছেলেই চাইছিলে?

মুন।। চাইব না? আগেরটা তো মেয়ে।

বিপাশা।। যদি এটাও মেয়ে হত?

মুন।। তহলে হয়তো কোম্পানিতে যেতে হত। এটা নষ্ট করে আবার নতুন করতে হত। সেকেণ্ড টাইম অবশ্য কনসেশন দেয়।

বিপাশা।। কী করে ওরা?

মুন।। কিছু না। মেয়েদের পেট থেকে ফুটিয়ে কি একটা বার করে নেয়।

বিপাশা।। ওভা।

মুন।। লাগে না। তরপর ছেলেদের ওই জিনিসটা লাগে। পাশেই একটা ঘর আছে এজন্য। তারপর ওরা কী সব করে পরদিন বলে দেয় হল কিনা। না হলে আবার মেয়েদের ইয়ে অনুযায়ী ডেট দেয়।

ওদের এইরকম কথাবার্তা চলছে, আর লোকটা বিল্টুবাবু নন্তুবাবুর সঙ্গে ইনকাম ট্যাক্স রিবেট, শেয়ারবাজার, ডলার-এক্সচেঞ্জ রেট, এসব নিয়ে কথাবার্তা বলছে। এ সময় একটা বুড়ি এল ওই ঘরে। মুখে হাসি। বলল, কী রে, নাতি আমার ঠিক আছে তো? এই বলে মেঝেতে কিছুক্ষণ বসে থাকল। বাক্সটাকে দেখতে থাকল। ‘একমাস আগে আরো কত ছোট ছিল ডিমটা, ফত বড় হয়ে গেছে রে।’ এই বলে উঠে গিয়ে ডিম বাক্সটার কাঁচের দেয়ালে হাত বুলোতে লাগল। বুড়ির পানরাঙা ঠোঁটে হাসি। মুন বলল, সরে আসুন মা। এরকম করবেন না, কোন বোতামে কখন হাতটাত লেগে যাবে, কেলেঙ্কারি হবে।

লোকটা স্কুটার চালাচ্ছে, লোকটার বউ পিছনে বসে আছে। বউটা কখনো গাড়িটার স্টেপনি, কখনো লোকটার কোমর ধরে টাল সামলাচ্ছে। কেমর ধরা অবস্থায় বউটা বলল, তাহলে কী ভাবছ? লোকটা ওই ভট্ভট্ শব্দের মধ্যে বলল, ওটা নিলে আর এটা হচ্ছে না। বউটা কোমর ছেড়ে স্টেপনি ধরল। লোকটা বলল, ঠিক কর। গাড়ি না ইনকুবেটার। বউটা স্টেপনি ছেড়ে কামর ধরে আদুরে গলায় বলল, বেবি। লোকটা বলল, খরচাটা শুনেছ? বউটা বলল, ঠিক হয়ে যাবে, দেখো…

রাত্রিবেলা ফ্যান ঘুরছে। লোকটা বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে চোখ। বউটা বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে, ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে চোখ। জানালার গ্রিল ফুঁড়ে হলুদ হ্যালোজেন দেয়ালের উপর গ্রিলছায়ার আলপনা এঁকেছে। একটা চাঁদও এমনি এমনি রয়ে গেছে আকাশে। নিমগাছের নিমফুলের গন্ধ আসছে মিছিমিছি। বউটা ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে। লোকটা ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে।

লোকটা।। আর একটা কিছু করতে হবে।

বউটা।। তুমি তো অনেক কিছু করছই। আমিই আরো কিছু করব।

লোকটা।। শেয়ারের দামটা আর বাড়ল না।

বউটা।। নোটবই লিখতে বলেছি… সাজেশন লিখতে বলেছি… কোশ্চেন আউট করে দিতে বলেছিল…

লোকটা।। পারচেজ-এ যদি ট্রান্সফার পাই একবার…

ওরা চোখ খুলে থাকে। চোখ বুজে ভাবে…

ওরা একদিন ভেবেছিল একটা ফ্ল্যাট হোক। তখন বউটা একটা চাকরি খুঁজে পেল। ফ্ল্যাট হল। তারপর ভেবেছিল কালার টিভি, ভিসিপি, ভিসিআর হোক। লোকটা চাকরির সঙ্গে পার্টটাইম, বউটা টিউশনি করতে থাকল। ওরা ভাবল চাকরি-টিউশনি-কনসাল্টেন্সিতে অনেক সময় চলে যাচ্ছে। তাই সময়ের জন্য অনেক যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রপাতির জন্য অনেক সময় বয়ে গেল। ওরা ভাবল এবার আহা, একটা বাচ্চা আসুক। তখন আরো বেশি রোজগারের জন্য লোকটা দুবছর আবুধাবি কাটিয়ে এল। এখন লোকটা কুঁজো-কুঁজো। চুলটা সাদা-সাদা। বউটা মুখের বলিরেখায় অনেক দামের মলম ঘষে। ইতিমধ্যে আবার কি মুশকিল, নতুন যন্ত্র বেরিয়ে গেছে। যান্ত্রিকতা।

একদিন এক বসন্তকাল। স্কাইস্ক্র্যাপারে কোকিল ডাকছে। স্কাই স্ক্র্যাপারের দরজায় পিভিসির পলাশ। লিফট-এ চড়ে এগারোতলায় ওঠে লোকটা। লোকটা জানতে এসেছে। ইন ডিটেইলস। ফুল আঁকা লতা আঁকা সুইংডোর-এ হোপ লেখা। খুলতেই বনসাই করা বটগাছের ফাকে বসা সুন্দরী। লোকটা কিছু বলতেই সুন্দরী সুন্দর হেসে বলে, ওয়েলকাম।

অন্য একটা ফুল আঁকা সুইংডোর খুললে অন্য একটা ঘর। টেবিলে টেবিলে কাঁচের বাক্স। বাক্সের গায়ে আহা, আলো পড়েছে রঙিন রঙিন। বাক্সের গায়ে নম্বর। বাক্সের পাশে অদ্ভুত যন্ত্র। যন্ত্রের গায়ে আলো জ্বলছে, আলো নিভছে। যন্ত্রের পাশে অদ্ভুত সিলিণ্ডার। সিলিণ্ডার থেকে নল গিয়েছে যন্ত্রে, যন্ত্র থেকে বাক্সে।

–যে শেলটা দেখছেন, ওনলি নাইনটিন ডেজ। লোকটা দেখল ছোট্ট সরষের দানার মতো একটা প্রাণ সিংহাসনে বসে আছে।

–এই যে এটা দেখছেন, এতে একজন ভেরি ফেমাস পলিটিসিয়ানের স্পার্ম রয়েছে।

–বাপ বুঝি পলিটিসিয়ান?

–নো-নো, নট দ্যাট। পার্টি চেয়েছিল। আমাদের স্পার্ম ব্যাঙ্কও আছে তো…।

–দেখুন, এটায় একজন ফেমাস ক্রিকেট প্লেয়ারের।ওটায় মিউজিশিয়ান। সবরকমই আছে আমাদের স্টকে। চার্জেবল।

লোকটা বলল– না। আমিই বাপ থাকতে চাই।

–ওয়েলকাম।ইটস আপটু ইউ।

লোকটার কীরকম যেন নার্ভাস-নার্ভাস লাগতে লাগল। বলল, যারা আসছে, ধরুন আমার বাচ্চা, কোনো রিস্ক নেই তো? ঠিক ভাবে বড় হবে তো?

–আরো বেটার হবে। আমরা কনডিশনড করে দিচ্ছি। এরা এইট পার্সেন্ট পর্যন্ত অ্যাটমোসফেয়ারিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড কনজিউম করার ক্ষমতা রাখবে। ইয়ারলি সেভেন হানড্রেড মিলিরেম রেডিও অ্যাকটিভিটিতেও কিসসু হবে না। বাতাসে নাইন পার্সেন্ট ক্লোরিন বা সালফার ডাই-অক্সাইড থাকলেও একটুও কাশবে না। ব্লাডে বত্রিশ পার্সেন্ট ইসেনোফিল থাকলেও শ্বাসকষ্ট হবে না। আট মিলিগ্রাম বিলিরুবিনও স্কিনে র‍্যাশ বার করতে পারবে না। অনেক ফেসেলিটি। লোকটা লিটারেচারটা নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, পেমেন্ট, ইনস্টলমেন্ট, এসব ডিটেলস আছে তো?

এভরিথিং।

তারপর জেব্রা ক্রসিং দিয়ে অনেক অ্যামবাসেডর মারুতি পদ্মিনী বয়ে যায়। অনেক টিভি সিরিয়াল শেষ হয়। তারপর একদিন এক শুভদিনে লোকটা আর বউটা ট্যাক্সি করে ওই এগারোতলার বাড়ির ভিতরে লতাপাতার ভিতরে হোপ লেখা সুইংডোর খুলে ভিতরে ঢুকল। টাকা-পয়সা জমা দিল। রসিদ নিল। পেটের ফোটানোর ব্যথাই লাগল না। লোকটা বাঁহাতে টেস্ট টিউবটা নিয়ে ছোট ঘরটায় গেল। ডান হাতে নিয়ে এল।

ফেরার সময় চাইনিজ খেল। ওদের আজ খুব আনন্দ। আনন্দ আর রঙ্গরস। বাড়ি ফিরে স্প্রিং-এর পুতুল দম দিয়ে নাচাল। স্টিরিওতে গান বাজাল, ভিডিওতে পর্ন চালাল।

বউটা।। শোন, যদি এরকম হত, তোমার দরকারই হত না, তা হলে আমার জিনিসটা আমি বড় করতাম! আর একটা আমি হতাম বেশ।

লোকটা।। আর আমিও তা হলে আমার জিনিসটা বড় করতাম, আর একটা আমি হত বেশ, আর সেই আমি আবার তোমার আমিকেই বিয়ে করত।

তারপর হি-হি হাসি, স্প্রিং-এর পুতুল, আলিঙ্গন…বরটা খেল জিন সেং, বউটা নিল কন্ট্রাসেপটিভ।

লোকটা এগারাতলায় ফোন করল পরদিন। মিষ্টি গলায় ওপাশ থেকে ‘সরি’। বলছে স্পার্মকাউন্ট পুওর। ভেরি পুওর। “লো লেভেলেও আমরা করে দিই। কিন্তু সাম্পলটা ভেরি লো।” হয়নি। কাউন্ট বাড়াতে হবে। আদারওয়াইজ আমাদের স্টক থেকে নিয়ে নিন। ইঞ্জিনিয়ার, মিউজিশিয়ান, পলিটেশিয়ান…

–ন্‌না, আমি বাবা হতে চাই…

ডাক্তারবাবু,ওটা বাড়বে?

বাড়তে পারে, এটা খেয়ে যান…

কবিরাজমশাই, হবে?

শিলাজিত, স্বর্ণভস্ম আর অশ্বগন্ধার ওষুধ দিয়েছি, সেবন করুন…

হোমিওপ্যাথিতে ওষুধ আছে?

আছে। টাইম লাগবে।

লোকটা অতঃপর পাবলিক ইউরিনালের হতাশ হইয়াছেন? গ্রান্টিপ্রদত্ত চিকিৎসার খোঁজে সোনারপুর, নৈহাটি, আমতা ঘুরে এসে পঞ্চমবার এগারোতলা বাড়ির ওই ছোট ঘরটায় গেল। স্পার্ম কাউন্ট করা হবে। চারিপাশ সাদা। ধবধবে। দেয়ালে গ্লেজটালি চকচক করছে। ওই আলোমাখা সাদা বাক্সে ও একা। কাঁচের তলায় কলকাতা শহর। জেব্রা ক্রশিং, পুতুল মানুষ। এগারোতলার উপরে ওই পুতুল মানুষটার, ওই বেচারা মানুষটার এক হাতে একটা টেস্ট টিউব। অসহায় অন্যহাত ধরে আছে কাতর পুরুষাঙ্গ। পাশের ঘরে ইকেবানা আর বনসাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে, রঙিন আলোর যত্নে, মান্টিন্যাশনাল কোম্পানির হেফাজতে মানুষের ডিম। আগামী প্রজন্ম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *