ক্যারাক্কাস্‌

ক্যারাক্কাস্‌

আমার কিছু ভাল লাগছিল না! টারজন আমাকে মেরেছে। টারজনকে আমি শ্রদ্ধা-ভক্তি করি, সাধ্যমতো সেবাযত্নও করি। গা-হাত-পা মুছিয়ে দি, তেল ঘষি, পাউডার লাগাই, সব করি। ঘড়ির কাঁটা ধরে ব্যাটারি পাল্টাই, কার্বন পাল্টাই। অথচ মারল। ওর নাভির ‘অয়েল হোল’ –এ মবিল দিচ্ছিলাম, সাবধানেই, লাগবার কথা নয়, হঠাৎ মারল। কেন মারল? রোবট তো আর জবাব দেয় না। আমার সময়টাই খারাপ যাচ্ছে। ছুটি হলে একা একা হাঁটি। মন খারাপের পা নালাটার দিকে চলে যায়। নালার পাড় ধরে হাঁটি। নালায় কালো জল ছরছর বইছে। আহা! জল তো নয়, অ্যাসিড। শুধু কি অ্যাসিড? অ্যালডিহাইড-কিটোন-আর্সেনিক-সোডা…আমি কি আর অত শত নাম জানি? টারজনকে সেবা করাই আমার ডিউটি। কারখানার জলে কী আছে না আছে জেনে কি দরকার? কারখানার জল মানে কারখানার জল। জল থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া। কী সুন্দর। কত রঙের ধোঁয়া। সবুজ রঙের ধোঁয়া, হলুদ… গোলাপি। এই মাত্র এক গাব্বা ধোঁয়া সবুজ রং হয়ে জল থেকে উঠল, হয়ে গেল হলুদ। কোথাও আবার কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে গেল। কি সুন্দর ঝাঁঝালো গন্ধ। কেমন কাশি আসে। কোত্থেকে উড়ে এল একটা ঝরাপাতা। জলের ভিতরে পড়েই সাদা হয়ে গেল। নালার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে নালার এইসব শোভা দেখতে দেখতে পুকুরের পাড়ে পৌঁছাই।

এই পুকুরের পাশে একটা গাছ আছে। গাছের মতন বহু আগে গাছ ছিল। মরে গেছে। কাঠ আছে। মরা কাঠ, কাঠের শরীর। গাছের ঝুরি মিছিমিছি নেমেছে মাটিতে। এখানে মাটিতে কোন ঘাস নেই। পুকুরের কাদার রং ভারী অদ্ভুত। কোথাও সাদা, কোথাও কালো। কোথাও শেওলার মতো সবুজ। কোথাও হলুদ রেখা, কোথাও মাটির গায়ে রামধনুর ছাপ। পুকুরের জলে তেল ভাসে। তাতে রোদ্দুর পড়ে রামধনু হয়। আমি বিষপুকুরের শোভা দেখি।

হঠাৎ দেখলাম পুকুরের জলে বুটবুটি। মনোহর বুটবুটি। বুটবুটি নড়ছে, সামনে এগিয়ে আসছে, পিছনে যাচ্ছে। এ বুটবুটি অন্য বুটবুটি। ভোসকা গ্যাসের বটুর বটুর নয়, প্রাণের বুটবুট। আমি এগিয়ে যাই। সাবধানে যাই। পিছলে পড়লেই মরণ। অবাক তাকাই। নড়ছে। বুটবুটির তলায় একজোড়া চোখ। মাছ? কী করে হবে? এ তে বিষপুকুর। কারখানার জল নালা দিয়ে এসে এই পুকুরে পড়েছে। এই পুকুরের সামনে কঙ্কালের মুখ আঁকা বোর্ড আছে। সাবধান। জল ছুইবেন না। এই পুকুরে কীভাবে বুটবুটি তুলে ঘুরে বেড়াবে মাছ?

আমি চোখ কচলে দেখি।

মাছই তো। হাঁ করে জল খাচ্ছে। জল তো নয়, অ্যাসিড-ট্যাসিড। আমায় দেখেই পালায়। হি-হি। ওই তো ওপাশে আবার মুখ নড়ছে। ওদিকে যাই। আবার পালাল। মাছই তো। বিষ জলেও প্রাণ জন্ম নেয়? আমার মন ভাল হয়ে গেল।

ঘরে ফিরব। বউকে বলব। বউকে খুব ভালবাসি। বউও আমায়। আমরা কতদিন হ্যালোজেনের আলোয় বসে গল্প করিনি। আজ করব। বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার। হাফ প্যান্ট। কুকুর হাগাতে বেরুবেন। স্যার খুব জ্ঞানী। স্যারের ঘরে কত বই, ক্যাসেট, স্যারের ঘরে কত কাঁচ, কত নল, স্যারকে দেখেই বলি, স্যার, মাছ। স্যার কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকান। ভাবি, কী দরকার ছিল বলার। বউকে এনে মাঝে মাঝে দেখাতাম, বেশ, মাছ আমাকে ভয় পেয়ে পালাত বেশ, তখন আমার বেশ ইয়ে ইয়ে লাগত বেশ, তখন আমরা হাসতাম বেশ। কিন্তু আমি পেটে কথা রাখতে পারি না। বলি, স্যার বিষপুকুরে।

ননসেন্স।

ঠিক আছে বাবা, ননসেন্স। আমি চলে যাই।

শোনো!

স্যার!

বিষপুকুর মানে?

ওই যে স্যার, নালাটার জল যেখানে পড়েছে।ওখানে স্যার, মাছ সাঁতার কাটছে।

গাঁজা ধরেছ?

না স্যার।

তবে!

সত্যি বলছি স্যার। নিজের চোখে দেখে এলাম।

ওয়েট এ বিট।

স্যার ঘরে ঢুকলেন। ছিপ বঁড়শি নিয়ে এলেন, আর ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা চিংড়ি। বললেন, চলো তো দেখি।

চললাম। স্যারের দু’পা পিছন পিছন। ওই বিষপুকুরে গিয়ে বললাম, ওই যে স্যার, দেখুন কেমন ঘাই মারছে। স্যার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। স্যারের কপালে কুঁচকানো রেখার ছবি হচ্ছে। স্যার আমার হাতে একটা ছোট পলিথিন ব্যাগ দিয়ে বললেন, ধরো। আমি ধরে রইলাম। স্যার এক টুকরো চিংড়ি বড়শিতে ছিপ ফেললেন। ফাতনা স্থির। ফাতনার এপাশে-ওপাশে ঘাই মারছে মাছ। আমি বললাম, এই মাছ বোধহয় চিংড়ি ভালবাসে না। স্যার ছিপ ওঠালেন। বড়শির মাথায় লেগে রয়েছে কালো খড়খড়ে ছোট্ট একটা কুণ্ডলী পুঁটলি। চিংড়ির টুকরোটা কীরকম কালো হয়ে গেছে ওই জলে। স্যার আবার চিংড়ির টোপ গাঁথলেন, আবার কালো খড়খড়ে হয়ে গেল ওই টোপ।

স্যার কী যেন ভাবলেন। আমি দেখছি কালো জলের কিনারে মাটির কাছে এসে গেছে ওই মাছ। একটা নয়, দুটো নয় তিনটে। আরও আছে? স্যার কী যেন ভাবছেন। তারপর বললেন, এখানে বসে থাকো, আমি এক্ষুনি আসছি। স্যার গেলেন। আমি দেখতে থাকি কাদার গায়ে সবুজ হলুদ রেখা। জলের গ্যাস গন্ধ, গ্যাসের বুটবুটির সঙ্গে খেলা করছে মাছ। গ্যাসের বুটবুটি হারিয়ে দিয়ে জিতে যাচ্ছে প্রাণের বুটবুটি। কী আশ্চর্য। কী আশ্চর্য মাইরি…

স্যার আসেন। ব্যাগ থেকে বের করেন দু’তিন রকম পাউডার। মেশালেন। তার মধ্যে ঢেলে দিলেন কী একটা তেল। দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল। ধোঁয়া হল। ধোঁয়া শেষ হলে পড়ে রইল কীরকম যেন একটা আঠালো আঠালো জিনিস।

স্যারের এত মাছ ধরার শখ। আগে জানতাম না স্যারের কত গুণ। আগে জানতাম না। স্যার বললেন নতুন মাছের টোপ। আঠালো জিনিসটা গোল পাকিয়ে বড়শিতে গাঁথলেন স্যার। ফেললেন। একটু পরেই নড়ে উঠল ফাতনা। ছিপে লাগালেন টান। উঠেছে উঠেছে। উঠেছে। সুতোর তলায় ফড়ফড় মাছ নড়ছে। স্যার লাফিয়ে উঠলেন। মাছটা ঝুলছে চোখের সামনে। ভীষণ আনন্দ আমার। ঝুঁকে দেখতে থাকি মাছটাকে। হাত খানিক লম্বা। ড্যাবা-ড্যাবা চোখ। সারা গায়ে আঁশ নেই একটুও। খড়খড়ে গা। গিরগিটির মতন।

স্যার কীরকম গম্ভীর হয়ে গেলেন। চোখ স্থির। দেহ স্থির। আস্তে আস্তে মন্ত্র পড়ার মতন বলতে থাকলেন–ইউরেকা, ইউরেকা। মিউটেশন। নিউ গেস্ট। নিউ স্পেসিস। নতুন প্রজাতি। নাম দিলাম ক্যারাক্কাস্‌। আবিষ্কার করেছি আমি। আমিই দেখেছি এটা পৃথিবীতে প্রথম।

আমি বললাম, স্যার আমি তো ফাস্ট দেকিচি। আপনাকে তো আমিই দ্যাকালাম।

স্যার কোনও কথা না বলে হঠাৎই ধাক্কা দিলেন আমাকে। আমি পড়ে যাচ্ছি ওই বিষপুকুরে। বউ-এর মুখ ভেসে উঠল। বিধবা হয়ে যাবে। আমি জলে পড়ে গেলাম। এবার কুঁকড়ে পুড়ে কালো হয়ে মরে যাব। আমি হাবুডুবু খেয়ে সাঁতার কেটে কোনওরকমে পাড়ে দাঁড়াই। দেখি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার। স্যার কেন রাগ করলেন আমার উপরে? কেন? স্যারকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাব, এমন সময় দেখি স্যার কোমর থেকে ডান হাতটা তুলে একটা আঙুল ঠোঁটে লাগিয়ে রেখেছেন। তার মানে চুপ। মানে চোপ! চো-ও-প! আমি চুপ হয়ে যাই। আমার জামার কাপড় পুড়ে গেছে। ঝুরঝুর করে ঝরে যাচ্ছে। আমার গায়ের চামড়াটা কীরকম খড়খড়ে হয়ে গেছে। গিরগিটির চামড়ার মতো। আমি মাথা নিচু করে বাড়ি যাই। আমায় দেখেই আমার বউ চোখে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠল। আমি বললুম, ভয় পেয়ো না, আমি গো আমি। বউ বোধহয় আমার গলার স্বর চিনতে পারল। চোখ থেকে হাত সরাল, পরক্ষণেই আবার চোখ ঢাকল হাতে। বলল, না, তুমি না। আমি বললুম, হ্যাঁগো, আমি, তোমার আমি, শুধু একটু পাল্টে গেছি। কিন্তু আমি আমিই। আজ দুপুরে পুঁইশাক হয়েছিল, নুন বেশি ছিল, তাই না? তুমি কাল সন্ধেবেলা রেডিমেড ব্লাউজ কিনেছ, লাল, পরে দেখলে টাইট-টাইট। তখন আমি বললুম…

বউ চোখ থেকে হাত সরাল। তারপর কিছুক্ষণ অপলক আমায় দেখল। তারপর কেঁদে উঠল। বলো বলো তোমার এমন দশা কে করেছে? কী বলব আমি? স্যারের আঙুল ছিল ঠোঁটে। আমি মাথা নিচু করে মিন মিন করে বলি, পা পিছলে বিষপুকুরে পড়ে গিয়েছিলুম। ওখানে পড়ে গেলে এরকম হয়। বউ আবার দু’চোখে হাত চাপা দিল।

আয়নায় দেখলাম, কালো চামড়া, কুঁচকানো, খড়খড়ে। চুল সাদা, ভ্রূ সাদা, চোখ বের হয়ে এসেছে। আমি চোখ বুজি।

রাত্রে বউ মাদুর পাতল নীচে। আমার ভালবাসার বউ, আমার নতুন বিয়ে করা বউ আলাদা শুলো। বলল, কিছু মনে কোরো না লক্ষ্মীটি, তোমায় বড্ড ভয় করছে। বড় দুঃখ হল।

 আমার দুঃখের কথা কাকেই বা বলব? টারজনকেই বলি। ওকে তেল মাখাতে মাখাতে ওর গা মোছাতে মোছাতে আমার দুঃখের কথা বলি। ও শুধু শোনে। তবু তো শোনে। কারখানার সবাই প্রথম প্রথম আমার দিকে অবাক চোখে তাকাত, ভয় পেত, এখন আর ভয় পায় না। এখন আমোদ পায়। আমাকে টিটকিরি দেয়। আমার খড়খড়ে গায়ে অপমান লাগে না।

একদিন স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি স্যারের সুন্দর ঘরে যাই। জীবনে প্রথম! দেয়ালের রঙে বাচ্চা খোকার গালের আভা। ঠাণ্ডা মেশিনের ঝিরিঝিরি। ফল ফুল গন্ধ।

স্যার বললেন, তোমায় দেখে অফিসের লোকেরা সব মজা। করছে?

হ্যাঁ বলি নাকি না বলি আমি?

আমি চুপ করে থাকি।

স্যার বললেন, এতে কাজের ক্ষতি হচ্ছে কোম্পানির। অ্যাটেনশন নষ্ট হচ্ছে। তোমার জন্যে একটা মুখোশ এনেছি। স্যার নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন ওই মুখোশ। বললেন, আয়নায় দেখো। অ্যাটাচড বাথরুমের দরজার দিকে আঙুল দেখান। আমি মুখোশের ঘুলঘুলি চোখ দিয়ে আমাকে দেখি। কী সুন্দর। একদম সত্যিকারের একটা সুন্দর মুখ। মুখে হাসি। পুরো সিনেমার হিরো। স্যার বললেন, কী এবার খুশি? আমি ঘাড় নাড়াই। স্যার বললেন, রোজ এটা পরে অফিসে আসবে। এটা তোমার ইউনিফর্ম। নতুন ইউনিফর্ম পরে বাড়ি যাই। বউ দরজা খুলেই অবাক। বলি, আমি গো, আমি। তোমার আমি। বউ বলল, আবার কোন্ পুকুরে ডুব দিলে? আমি বউ-এর কাছে যাই। আমি বলি, আমার নতুন ইউনিফর্ম। আমি বউ-এর কাছে ঘন হতে যাই। বউ বলে, না গো, এ তো তুমি না। যেন অন্য কেউ। আমি তখন মুখোশ খুলে ফেলি। বউ তখন বলে, এও তো আগের তুমি না। আগের মতোই মাদুরে শোয় বউ, আমি চৌকিতে। খবরের কাগজে স্যারের ছবি উঠল বলে আমার খুব গর্ব হল। আমাদের কারখানার ছবি উঠছে। ওই বিষপুকুরের ছবি উঠেছে। আজব মাছের কথা লিখেছে কাগজগুলো। কত সাহেব সুবো আসছে, দেশ-বিদেশ থেকে। ওই পুকুরে বেড়া দেওয়া হয়েছে। কাঁটা তারের ফেনসিং। একটা গুমটিঘর করা হয়েছে। ওখানে চৌকিদার। আমি কিন্তু ঠিক বুঝেছি আর যেন আমার মতো কেউ না পড়ে যায় সে জন্য এরকম ব্যবস্থা নয়, আসলে ওই আজব মাছের জন্যই এই পাহারা। কাউকে বলিনি।

একদিন ঘুরতে ঘুরতে ওই বিষপুকুরে যাই। দেখি মাছ কিলবিল করছে। কিলবিল নয়, খলবল করছে। বহুত বাচ্চা হয়েছে ওদের। সারা পুকুর জুড়ে মাইরি কী আহ্লাদ। আমার খুব ভাল লাগছিল। একে আর বিষপুকুর বলব না। কী বলব তাহলে?

কারখানার ক্যান্টিনে, চায়ের দোকানে, দেশি মালের ঠেকে কত কথাবার্তা, কত আলোচনা। এই পুকুরের জল কিনতে চাইছে আমেরিকা, জার্মানি। আমাদের কোম্পানি দিচ্ছে না। আমি দেখি কত গাড়ি আসে, কত গাড়ি যায়, কত সাহেব আসে, কত সাহেব যায়। সাহেবরা চলে গেলে কত খালি বোতল পড়ে থাকে, কত চিবোনো হাড়…।

তারপর একদিন হল কি, আমাদের ফোরম্যান একদিন একটা গ্লাভস পরে এলেন। উনি সবাইকে দেখালেন ওই আজব মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি ওই গ্লাভস, উনি বললেন, অ্যাসিড প্রুফ, অ্যালকালি প্রুফ, রেডিও অ্যাকটিভিটি প্রুফ। আমি দেখলাম। উনি বলে দারুণ জিনিস। বললেন, কোম্পানি এখন ওই মাছের চামড়া দিয়ে গ্লাভস বানাবে, এপ্রন বানাবে, মুখোশ বানাবে বললেন, আমাদের কারখানা ছুটি হয়ে যাবে।

আমরা সবাই ছুটির ভয়ে থাকি। কে জানে কবে ছুটির খবর আসবে। কাউকে কিছু বলি না। আমার মুখোশ পরা মুখে মুখোশের হাসি লেগেই থাকে।

আমাদের একজন চালাক বন্ধু আছে। ও বলল, ধুস ভড়কি দেখাচ্ছে। এই কারখানা উঠে যাবার জো আছে? এই কারখানাটা আছে বলেই না বিষজল তৈরি হচ্ছে, আর তাতেই না ওই আজব মাছ। অন্য একজন বলল, ওটা বিষজল নয়, সারজল। আমাদের ওই চালাক বন্ধুর কথাটাই ঠিক কানাঘুসোয় শুনলাম আমাদের কোম্পানি এরকম অনেক বিষপুকুর, ভুল বললাম, সার পুকুর বানাবে, যেখানে এরকম মাছের চাষ হবে, ওই মাছের চামড়া বেচবে কোম্পানি। সুতরাং আরও সার পুকুর বানাতে হলে চাই আরও সারজল। আরও সারজলের জন্য আরও বিষ কারখানা।

আমার তা হলে ছুটি হবে না।বড় আনন্দ হল।

একদিন আমাদের ফোরম্যান একটা মুখোশ পরে অফিসে এলেন; খুব গম্ভীর গম্ভীর মুখের মুখোশ। খড়খড়ে চামড়ার। প্রচুর ব্যক্তিত্ব। সব সময় ব্যক্তিত্ব। ওই ক্যারাক্কাস্‌ মাছের চামড়ায় তৈরি। এরকম একটা মুখোশের হেভি দাম। অ্যাসিড-অ্যালকালি প্রুফ। ফায়ার-রেডিও অ্যাকটিভিটি প্রুফ। উনি বললেন, আমাদের এই কোম্পানির একটা নতুন ইউনিট খোলা হয়েছে। ওখানে ক্যারাক্কাসের চামড়া থেকে এপ্রন-ট্যাপ্রন হচ্ছে, মাস্ক হচ্ছে। আমাদের অফিসারদের একটা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি আসলে এখন হাসছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না; কারণ গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মুখোশ পোশাকে আছেন তিনি।

আমার যে কত সুন্দর মুখখানা, বঊ তাতে খুশি নয়। মুখোশ ভয়। এখনও ভয় গেল না ওর। বড্ড ভয় কাতুরে। কী যে করি। হাসি মুখের ভিতরে আমার মতো দুঃখ শক্ত হয়ে থাকে। বউ কি আমার দুঃখ টের পায়? একদিন রাত্তিরবেলা আমার ঘুম ভেঙে গেলে নিচের মাদুরে শুয়ে থাকা বউ-এর কান্না শুনি। আমি খাট থেকে নেমে যাই। বউ-এর গা ধরে বলি, কেঁদো না। বউ আরও কেঁদে ওঠে। আমি ওর চোখের জল মুছিয়ে দি। ওর গায়ে আমার খড়খড়ে হাত বুলোই। চামড়ায় কষ্ট হলেও ও কিছু বলে না। ওর মুখের দিকে মুখ চলে যায়, ও ছিটকে গিয়ে আবার কেঁদে ওঠে।

ভোরবেলা বউ বলল, ওগো, এভাবে আর পারা যায় না। আমি বরং তোমাদের ওই বিষপুকুরে নেয়ে আসি গে। আমি আঁতকে উঠি। বলি, এত সুন্দর তুমি যে… ও বলে বরং হই বিচ্ছিরি, সুখে থাকব। কাল দেখেছি গাছতলায় দুটো গিরগিটি কত সুখ করছে। আমিও বরং তোমার মতো হই, তাহলে আমরাও সুখী হব। আমি বলি, যদি তুমি মরে যাও? জানো, চিংড়ি মাছের টোপ কুঁকড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল ও বলল, মরলে মরব। এভাবে বাঁচার চেয়ে মরা ভাল। আমি বলি, কী করে নাইবে? ওখানে লোহার বেড়া, ওখানে দারোয়ান। তোমাকে কাছে ঘেঁসতেই দেবে না। বউ বলল, ওগো, দারোয়ানকে কয়ে বলে একটা ব্যবস্থা কি হয় না?

একদিন আমার বউ কীভাবে যে জানে দারোয়ানকে হাত করে না কি যাদু করে ভোর রাতে ওই পুকুরে নেয়ে এল। হাসতে হাসতে বাড়ি এসে আমার ঘুম ভাঙাল। সাদা ভ্রূর তলায় বেরিয়ে আসা চোখে আনন্দ আলো ফোকাস মারছে। সারা গায়ে গুঁড়ি গুঁড়ি কাটা–কালচে, খড়খড়ে। ঝোলা চামড়ার মুখে ফুল হাসি। আমি কিছু বলবার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরল ও। অনেকদিন পর আমাদের সুখ এল।

কোম্পানির সাহেবসুবোদের মনে মোটে সুখ নেই। বড় দুশ্চিন্তা। স্যারের মাথায় হাত। খবরের কাগজে বের হয়ে গেছে ম্যানেজমেন্টের লোভ এবং অদূরদর্শিতার জন্য একটি নতুন প্রজাতি সম্পূর্ণ নিঃশেষ। আমাদের স্যার চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে পুকুর পাড়ে বসে থাকেন যদি কোনও নতুন বুটবুটি চোখে পড়ে। এরই মধ্যে আবার কারখানার অ্যাসিড ট্যাংকি লিক। পিচকিরির মতো অ্যাসিড ছিটকোচ্ছে চারিদিকে। অ্যাসিডের ফোয়ারা। কত লোক মারা গেল, কতজন অন্ধ হয়ে গেল, কতজনের চামড়া কুঁচকে গেল। আমার গায়েও অ্যাসিড পড়েছিল, আমার কিচ্ছু হল না। আমি দিব্যি হাত দিয়ে গায়ের অ্যাসিড মুছে নিলাম। যাদের চোখ-টোখ নষ্ট হয়েছিল, কোম্পানি ওদের পয়সা কড়ি দিল, কিন্তু আমার কিচ্ছু হয়নি বলে আমার কিচ্ছু জুটল না। তারপর কোম্পানি সারকুলার ইস্যু করল– সবাই যেন ওই সার পুকুরে স্নান করে আমার মতো হয়ে যায়। কেউ রাজি হল না। বলল, বরং চাকরি যাক, না খেয়ে মরব, তবু গিরগিটি হব না। তখন কোম্পানি জানাল– ফারদার এরকম কিছু হলে কোম্পানি আর কোনও টাকা পয়সা দেবে না। এরই মধ্যে আর এক কাণ্ড। আমার বউ-এর প্রসব ব্যথা। হাসপাতালে নিতে হবে। প্রতিবেশীরা বলল, এই মেয়েছেলেকে হাসপাতালে রাখবে না। একে দেখেই তো পোয়াতিরা ভিরমি খাবে। তা হলে উপায়? ধাই ঠিক করো। ধাই নিয়ে এলাম। বউ কাতরাচ্ছে। আমি বাপ হচ্ছি। একটু পরেই কান্না শুনলাম, শিশুর কান্না। আমার বুকের মধ্যে কারখানা ছুটির ভোঁ বাজল। ধাই বের হল। বললাম, ছেলে না মেয়ে? ধাই বললে, জেবনে এই পরথম ভূতের জন্ম করালুম। পেত্নির গভ্‌ভে ভূতের জন্ম। ট্যাকা দাও।

ছেলেটার চামড়া ঝোলা ঝোলা। সারা চামড়ায় গুঁড়ি গুঁড়ি কাটা। মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে ড্যাবা ড্যাবা চোখ। আমার মুখে স্থির হাসি লেগেই থাকে। পাড়া প্রতিবেশীরা ভূত দেখতে আসছে। ভূতের জন্মকথা ছড়িয়ে গেছে দূর দূরান্তে। ভূত দেখতে আসছে সব। একদিন সক্কালবেলায় আমার স্যারের গাড়িও থামল আমার ঘরের সামনে।স্যার আসছেন, স্যার। আমি দাঁত মাজা বন্ধ করে হাসি মুখোশটা পরে নিই তাড়াতাড়ি। বউ ঘোমটা তুলে দেয় মাথায়।

তোমার ছেলেটাকে দেখব হে…। স্যার বললেন। আমি কাঁথা মুড়িয়ে ছেলেটাকে নিয়ে আসি। স্যার কাঁথা সরিয়ে দিলেন। স্যার মন দিয়ে দেখছেন। স্যার চামড়া টিপে টিপে দেখছেন, শিশুর চামড়া। স্যার স্যাম্পল দেখছেন, স্যাম্পল। স্যারের চোখ চকচক। নিঃশ্বাস ঘন ঘন। স্যার আমার ছেলের চামড়া টিপছেন, কাপড়ের জমিন দেখার মতো শিশুর ঝুলে থাকা চামড়ার দুপাশে আঙুল লাগিয়ে ঘষছেন। স্যার হাসলেন। বললেন, বাঃ। তারপর স্থির হলেন। চোখ স্থির, দেহ স্থির। মন্ত্র পড়ার মতো বলতে থাকলেন– ইউরেকা…ইউরেকা… নতুন প্রজাতি। নিউ স্পেসিস। ক্যারাক্কাস… নিউ ক্যারাক্কাস…

আমার শরীরের ভিতরে বুটবুটি কাটা তীব্র গোঙানি।

তবু আমার হাসি হাসি মুখ।

আমার হাসি মুখ।

আমরা হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *