আবর্জনা হইতে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের আশ্চর্য প্রযুক্তি

আবর্জনা হইতে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের আশ্চর্য প্রযুক্তি

পঞ্চাননের বয়স যখন ছ’মাস মাত্র, কান্নার মধ্যে বলেছিল নাকি পিড়িং পিড়িং। আসলে বলতে চেয়েছিল ইসপিরিং, শুদ্ধ বাংলায় যা স্প্রিং। পঞ্চানন দু বছর বয়সে একটা হাত ঘড়ি ভেঙে ফেলে ঘড়ির ভিতরের নাড়ি ভুঁড়ি পর্যবেক্ষণ করেছিল, পাঁচ বছর বয়সে রেডিওর ভিতর থেকে চুম্বক সমন্বিত স্পিকারটি ডিসেকশন করে ফেলে। কিন্তু তখন সে জগদীশচন্দ্র বসুর নাম জানত না, সুতরাং ওকে আরও বারো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল যখন ও রেডিওর স্পিকারটি মুখে লাগিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বলে বেড়াতে পারছে আই অ্যাম জে. সি. বোস। আরও কিছুদিন পরে ও আইনস্টাইনের নাম শোনে, ছবিও দেখে। জগদীশ বোসের চেয়ে ওর আইনস্টাইনকেই পছন্দ হয়। ও তখন আইনস্টাইনের মতো গোঁপ রাখার চেষ্টা শুরু করে কিন্তু ওরকম হয়নি। ওর গোঁপ পাতলা। এবং এই সময় ও গ্যালিলিও, নিউটন, এঁদের ভুল ধরতে শুরু করে। প্রথমে যে ভুলটি ধরেছিল সেটা হ’ল জোয়ার ভাটা সম্পর্কিত তত্ত্বের। ও হাটে মাঠে বক্তৃতা করে বেড়াত চন্দ্রের আকর্ষণের ফলে নদী-সমুদ্রের জল ফুলে গিয়ে জোয়ার ভাটা হয় এটা পুরো গাঁজা। চাঁদ যদি সমুদ্রের জলকেই টানবে, তার আগে মেঘকে টেনে নিত। কারণ মেঘ চাঁদের আরও কাছে। তা হলে আকাশে মেঘ থাকত না, সব মেঘ চলে যেত চাঁদে।

পঞ্চানন প্রথাগত শিক্ষা বেশিদূর নিতে পারেনি। স্কুলের গণ্ডি পেরুনো হয়নি ওর। অনেক মহাপুরুষেরই তা হয়নি।

স্কুলের বাংলার স্যার অসীমবাবুর একটা কথা পঞ্চাননের বারবার মনে হয়। অসীমবাবু বলেছিলেন জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা। পরে জেনেছিল আসলে ওটা রামকৃষ্ণর বাণী। আর পঞ্চানন তো জানেই পৃথিবীতে বহু বড় বড় আবিষ্কারের অনেকগুলিই অ্যাক্সিডেন্ট। নিউটন যদি তখন মন খারাপ করে বাগানে না বসে একটু লুডো খেলতেন, দেখতেন আপেল? আর আপেল না হ’লে কি অভিকর্ষ আবিষ্কার হ’ত? এক্সরের আবিষ্কারও একটা অ্যাক্সিডেন্ট। আরবের বণিকরা বালির উপর এক ধরনের কাঠ দিয়ে রান্না করতে গিয়ে হঠাৎ দেখলেন বালির উপর কাচের জন্ম। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পিছনেও একটি অ্যাক্সিডেন্ট। পঞ্চাননও একটি অ্যাকসিডেন্টের অপেক্ষায় থাকতে লাগল।

পঞ্চানন সর্বদাই এটার সঙ্গে ওটা মেশায়। ছাগমূত্রের সঙ্গে কোকাকোলা, তার মধ্যে ডিজেল; ভিটামিন A ও D সমৃদ্ধ শিশুর মালিশের সঙ্গে দেখো আমি বাড়ছি মাম্মির গুঁড়ো মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করেছে, গিনিপিগের অভাবে ঝুপড়ির বাচ্চাদের গায়ে মালিশ করতে গিয়ে পেটাই খেয়েছে, তবু দমে যায়নি। মাছের একোরিয়ামে মাছের বাচ্চাদের কমপ্লানের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়ে মন্ত্র পড়েছে বাড়ন্ত বাচ্চার জামা গেঞ্জি ছোট হয়…। পঞ্চানন হাতিবাগান থেকে কেনা খরগোশের বাচ্চাকে উজালাতে চুবিয়ে দেখেছে আরও সাদা হয় কিনা। এরপর অন্য ধরনের পরীক্ষা শুরু করেছে। দাঁত মাজে না। বাঘ কি দাঁত মাজে? অথচ বাঘের দাঁত মানুষের চেয়ে অনেক শক্ত, অনেক সাদা, সাবানও মাখে না। খরগোশ সাবান মাখে? হরিণ মাখে? আর নিজের পোশাকে প্রয়োগ করেছে আইনস্টাইনের অপেক্ষিক তত্ত্ব। ধরা যাক একটা পরিষ্কার জামা পরে চলেছে পঞ্চানন, আস্তে আস্তে জানাটা হ’ল। তখন ঐ এক নম্বর জামাটা রেখে দু নম্বর পরিষ্কার জামাটা পরতে থাকল। ক্রমে ক্রমে দু নম্বর জামাটাও নোংরা হ’য়ে গেল। এবার এক নম্বর এবং দু নম্বর জামা দুটোর মধ্যে যেটা পরিষ্কার সেটা পরতে থাকল এবং এটা বেশি নোংরা হয়ে গেলে ওটা। কারণ আপেক্ষিক ভাবে ওটা তখনো পরিষ্কার। এইভাবে সে কোনদিনও না কেচেও পরিষ্কার জামাটাই পরে থাকে। পঞ্চানন এখন পাঁচু। পাঁচু পাগলা ডাকলেও উত্তর দেয়, আইনস্টাইন ডাকলেও।

পরিবেশ নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু হল বিশ্বজুড়ে। পঞ্চাননও সেই চিন্তা ভাবনার শরিক হল। পঞ্চানন গাছ লাগাল। গরু গাছ খেয়ে নিল বলে গরুকে প্যাদাল, গো-ভক্তেরা পেটাই খেল। এরকম নানারকম পেটাইয়ের ফলস্বরূপ শরীরে বেশ কিছু দাগ। ‘এসেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা’ – এ ভাবেই পঞ্চাননের জীবনে সত্য হয়েছে।

পঞ্চানন একদিন খবর কাগজে দেখল আবর্জনার সদ্ব্যবহার করার জন্য আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা আসছেন। আবর্জনা থেকে জ্বালানি উৎপাদন হতে পারে, সার হতে পারে, এমনকি কাগজ, পিসবোর্ড, বা প্লাস্টিকও হ’তে পারে। এই খবরটা যেন পঞ্চাননের চোখ খুলে দিল। পঞ্চাননের ডেইলি লাইফের অনেকটাই কাটে আবর্জনার পাশে পাশে। ফুটপাতে শোয়। পাশেই আবর্জনা, আবর্জনাকে তেমনভাবে কখনো দেখেনি পঞ্চানন। নদীর কিনারে যারা থাকে তারা নদীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় না। পঞ্চানন এবার আবর্জনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি দিল। ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখিও তাই, পেলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’ – ছোটবেলায় শেখা ঐ লাইনটায় সুর সংযোগ করল পঞ্চানন, এবং এই গানটা ওর জাতীয় সঙ্গীত হয়ে উঠল। জঞ্জালগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পরম শ্রদ্ধায় এই গানটা গায় পঞ্চানন। পঞ্চানন ক্রমশ আবর্জনা এক্সপার্ট হয়ে উঠল। পঞ্চানন লক্ষ করতে থাকল এক এক জায়গার আবর্জনার চরিত্র এক এক রকম। দমদম প্রফুল্লনগর কলোনির সামনের আবর্জনায় লটে মাছের মাথা, কাঁঠালের ভূতি, কয়লার ছাই, এসব পাওয়া যায় – সল্টলেক, লেক গার্ডেনস বা গল্ফ গ্রীনের আবর্জনায় এই দ্রব্যগুলি একেবারেই পাওয়া যায় না। এখানে ম্যাগির প্যাকেট, পলিথিনের ব্যাগ, চকোলেটের রাংতা। গোল, চ্যাপ্টা ইত্যাদি বোতল, নানা ধরনের প্যাকিং কাগজ ইত্যাদি প্রভূত পরিমাণে পাওয়া যায়। বড়বাজার অঞ্চলে শালপাতা, ফলের টুকরো এসব বেশি, কিন্তু খিদিরপুর রাজাবাজারে মাংসের হাড়গোড় বেশি। অনেকদিন আগে শুনেছিল আমেরিকার আবর্জনায় নাকি পুরোন রেডিও, টেলিভিশন, টেপরেকর্ডার, ওয়াশিংমেশিন এমনকি গাড়িও পাওয়া যায়। সল্টলেক এলাকার আবর্জনায় দু একটা ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি পেয়েছিল পঞ্চানন, দু একটা স্প্রিংয়ের খেলনা, ব্যাগ, অন্য যস্ত্রপাতি তেমন পায়নি। পঞ্চানন ঘুরতে ঘুরতে ইস্টার্ন বাইপাসে ‘শিল্পে ভরিয়ে দাও’ উপনিবেশে একটু নতুন ধরনের আবর্জনার সন্ধান পেল। ‘শিল্পে ভরিয়ে দাও’ আবাসনে শিল্পোদ্যোগীরা থাকেন। বিদেশী এক্সপার্টরাও আছেন। ঘন ঘন বিদেশে যান, এবং দেশী সাহেবরাও প্রচুর পরিমাণে বসবাস করেন সেখানে। সেখানে প্রতিটি বাড়ির ছাদে ডিশ এন্টেনা, প্রতিটি বাড়ির নিচে গাড়ি, প্রতিটি বারান্দায় ক্যাকটাস, পাতাবাহার, বাহারি শাড়ি, ম্যাক্সি, স্কার্ট, সন্ধের সময় হরি ওঁ! এই উপনিবেশের পাশেই কয়েকটা কারখানা, কারখানায় বিদেশী প্রযুক্তি, বিদেশী পেটেণ্ট – কী ডিসেন্ট। এখানে যে আবর্জনা, তা কিন্তু অন্যধরন, অন্যবরণ, অন্যরকম সেন্ট। এখানে আবর্জনা স্তুপে একদিন ভাঙা টেলিভিশন পেয়ে গেল পঞ্চানন, টেবিল ল্যাম্প, ফিউজ আর্ক লাইট, পিভিসি টিউব, স্পঞ্জ, কনভেয়ার বেল্ট, এটা ওটা কলকব্জা, নানান জিনিস।তা ছাড়াও গল্ফ গ্রীন সল্টলেক লেক গার্ডেনস- এ যা পাওয়া যায়, তা তো আছেই।

পঞ্চানন একদিন ঐ জঞ্জালের স্তুপ থেকে মেশিনপত্রগুলি আলাদা করে বাছতে লাগল। একটা বড় চুম্বক পেয়ে গেল, বাচ্চার ছবি আঁকা ফোটোটা কেবলই ঐ চুম্বকের গায়ে লেপ্টে থাকে। একটা ভাঙা টেবিল ফ্যান পেল। পেয়ে গেল একবাক্সো সিলিকন চিপস।আরও আরও নানা ধরনের কলকজ্জা পেল। ভাঙা টেলিভিশনটা খুলে কলকব্জাগুলি সব আলাদা আলাদা করল। এত টেকনিকাল জিনিস ও জীবনে একসঙ্গে দেখেনি। ঐ জঞ্জাল স্তুপকে মনে হ’ল একটা বিশাল ওপেন এয়ার ল্যাবরেটরি, এবং ও নিজে ঐ ল্যাবরেটরির ডিরেক্টার, ওর মনে হ’ল এত সুন্দর ল্যাবরেটরি পেয়ে ওর কিছু নিশ্চয়ই আবিষ্কার করা উচিত।ও আবিষ্কার করতে শুরু করল।

পঞ্চানন একটা আশ্চর্য মা কালীর মূর্তি পেয়েছিল, দম দিয়ে দিলে জিভটা নড়ে, চোখের তারা ঘোরে, একটা পা পদতলের মহাদেবের বুকে পড়ে, আবার পা উঠে যায়। মহাদেবের বুকে পা পড়লেই মহাদেব বলে ওঠে – আঃ। যন্ত্র একটু খারাপ ছিল, পঞ্চানন নিজ গুণে এটা ঠিকঠাক করে নিয়েছিল। কালীমাতার পায়ে তার পেঁচিয়ে সেই তার টিভির পিকচার টিউবে, তারপর সেই তারে নানারকম বাতিল বিদেশী টুকরো-টাকরা যন্ত্রপাতির অংশ, ট্রান্‌জিস্‌টার, সিলিকন চিপস, মদের বোতল, অসভ্য বইয়ের ছেড়া পাতা, এইসবের সঙ্গে কানেক্শন্ করতে লাগল। এক একটা কানেক্শন্ করেই প্রত্যাশা করছে একটা অ্যাক্সিডেণ্টের। অ্যাক্সিডেণ্ট মানেই আবিষ্কার। কিন্তু এ্যাক্সিডেণ্ট কিছুতেই হচ্ছিল না। এমনি করে অনেক দিন গেল। পঞ্চানন আবিষ্কারের নেশায় মশগুল। তারপর পঞ্চানন কে জানে কী ভেবে আটফুট লম্বা, পিভিসি পাইপটার মাঝখানে একটা গর্ত করল। পাইপটার দু ফুট মতো ব্যাস। মাঝখানের গর্তে একটা গাড়ির ভাঙা স্টিয়ারিং ফিট করে দিল। নানা জিনিস পেঁচিয়ে তারের নেগেটিভ পাইপের এক প্রান্তে আর পজিটিভ আর এক প্রান্তে যোগ করে দিল, আর অমনি বহু প্রতীক্ষিত অ্যাক্সিডেণ্ট।মা কালীর জিভ মুখের ভিতরে ঢুকে গেল। মহাদেব উঠে দাঁড়ালেন, টিভির পর্দায় কী যেন আঁকি-বুকি –পাইপটা কাঁপছে।

আর্কিমিদিস ইউরেকা ইউরেকা বলেছিল। উত্তেজনায় পঞ্চাননের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ‘জয় হিন্দ’।

এই পিভিসি পাইপটা প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু এটার কী নাম দেয়া যায়? নিজের নামটা অক্ষয় করে রাখা যায়, ও একটা চক দিয়ে পি ভি সি পাইপের গায়ে নাম লিখবে ভাবে। কী লিখবে – পঞ্চানলোগ্রাফ? পাঁচুস্কোপ? ও চিন্তা করতে থাকে। নাম রাখবার আগে তো জানা দরকার এই যন্ত্রটা মানুষের কোন কাজে আসবে, কী উপকারে লাগবে। সেসব পরে হবে। যন্তর হল যন্তর। সব যন্তরই কি মানুষের উপকারে লাগে। অনেক যন্তর আছে ফর শো। শুধু ঘর সাজানোর জন্য। অনেক যন্তর আছে, সভ্যতা সাজানোর জন্য। সেসব পরে ভাবা যাবে।ও চক দিয়ে নাম লিখল PANCH, পাঁচুর হ্রস্ব উকারটুকু বাদ দিল। ও উচ্চারণ করবে পঞ্চ। অনেকে পড়ল প্যানচ। দেশি বাঙালি যদি পড়ে এটা, উচ্চারণ করল প্যাঁচ। পাঁচু কিছুই না ভেবে জ্যান্ত পাইপের একধারে কিছু জঞ্জাল পুরে দিয়ে হাতল ঘোরাল, পাইপের অন্য প্রান্ত থেকে বেরিয়ে এল জিনের প্যান্ট। কী আশ্চর্য রে ভাই, আবার জঞ্জাল পুরে দিয়ে একই রকম হাতল ঘোরাল, বেরিয়ে এল মোটা হিলের জুতো। পঞ্চাননের বুক ধুকপুক করতে লাগল। অন্ধকার দেখতে লাগল। জঞ্জালের মধ্যে শুয়ে পড়ল পঞ্চানন। কিন্তু জঞ্জালের গোপনে লুকিয়ে থাকা স্প্রিং ওকে আবার উঠিয়ে দিল। পঞ্চানন কিছু পুরোন খবরের কাগজ, নতুনের প্যাকেট, জুতোর বাক্সো, মুরগির হাড়, ঢুকিয়ে দিল–বেরিয়ে এল একটা স্যাণ্ডউইচ টোস্টার। ছেঁড়া ব্রেসিয়ার, ন্যাপকিন, গিট বাঁধা রবার ঢুকিয়ে দিয়ে হাতল ঘোরাল, গ্লসি পর্ণোগ্রাফির বই বেরিয়ে এল। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতে উঠেছে পঞ্চানন। আবর্জনা থেকে তৈরি হচ্ছে জিনিসপত্র। এইসব গরীবদের বিলোবে ও, বিলি বন্দোবস্ত করবে। পঞ্চানন এবার হর্ষবর্ধন, দাতাকর্ণ, রবিনহুড। অসীমবাবু, অসীমবাবু গো, দ্যাখো দাগ রাখলাম। ওরে ওই ভেঁপু, পল্টু, ছাকু, পল্টি, বান্টু, আমায় টিল মারতিস না, এবার নোবেল প্রাইজের টাকাটা একবার পেতে দে, দুনিয়ার সব কাকদের ডেকে ঝালমুড়ি খাওয়াব, তোদের দেবনা। পঞ্চানন পাইপের ওপাশের প্রোডাক্টগুলির দিকে মায়াদৃষ্টিতে দেখে। নেকটাই, ব্লু জিনস, স্পোর্টস সু, গীটার, সেলুলার ফোন, ফ্যাক্‌স পেপার, মোটর সাইকেলের সীট…এসবে ভরে উঠেছে। এইসব কাকে বিলোবে পঞ্চা! হারু জ্যাঠা কী করবে নেক টাই? জটিবুড়ি কী করবে ব্লু জিনস? এসব ভিখিরিদের কোন কাজে লাগবে। দিলেও নেবে না। ওই ভেঁপু পল্টু পল্টি বাণ্টুদেরই এসব দিয়ে দিতে হবে। পঞ্চানন কিন্তু তুলো, ব্যাণ্ডেজ, প্যাড এসব খুঁজে মেশিনে পুরে হাতল চালাল-জয় মা কালী, মা কালী হে-একটা গামছা, একটা গামছা যেন আসে, মাইরি, একটা শক্তপোক্ত গামছা…।বেরিয়ে এল সুইমিং কস্টিউম।

জঞ্জাল কমে আসছে, জড়ো হচ্ছে জিনিসপত্তর। পশ্ লোকজন সব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে এই আজব কল। এই ঘটনাটা এরকম ‘শিল্প বাড়াও’ উপনিবেশে না হয়ে যদি আহিরিটোলা বা বৌবাজারে ঘটত, এতক্ষণে সব প্রোডাক্ট লুট হয়ে যেত।

‘শিল্প বাড়াও’ প্রজেক্টের মহানির্দেশক কী করে যেন খবর পেলেন। উনি এলেন। উনি বিদেশী। কোট, স্যুট, মাথায় টুপি। সঙ্গে দোভাষী ও চামচে। সবার হাতে কোকের ক্যান।

–এই প্যানচ মেশিনটা তুমি তৈরি করেছ?

–ইয়েস স্যার।

–এর থিয়োরিটা কী?

–দেখে নাও।

–কী ভাবে ডিভাইস করেছ?

–দেখে নাও।

–মেশিনটা আমাদের বিক্রি কর।

–না।

–এইসব জিনিসপত্র কিন্তু একটাও তোমার নয়। এসব আমাদের র’ মেটেরিয়াল থেকে তৈরি হয়েছে।

–আমার দরকার নেই এসব জিনিসে।

–তোমার প্রযুক্তি আমাদেরই কাছে বেচতে হবে, অন্য কারুর কাছে নয়। কারণ ইন্টারন্যাশনাল পেটেণ্ট ল সেকশন নাইনটিটু…।

–ধুর, কী সব বলছেন–ভাল্লাগেনা।

–তবে তুমি এসব করছ কেন?

–অসীমবাবু স্যার ছিলেন না? উনি বলেছিলেন পৃথিবীতে এলি যখন একটা দাগ রেখে যা।

–খুব ভাল কথা! তাহ’লে এক কাজ করা যাক। তোমার এই মেশিনটাই আমরা বরং কিনে নি। আমরা এটা অন্য জায়গায় বসাব। কারণ–এখানে জঞ্জাল তো বেশি হয়না, আবার অন্য জায়গা থেকে ভাল জাতের জঞ্জাল যদি এখানে নিয়ে আসি তবে আমাদের এলাকায় হেলথ হ্যাজার্ড হবে। তোমাকে এই মেশিনটা দিয়ে দিতে হবে। তোমাকে আমরা অনেক টাকা দেব।

–আমি নিজের হাতে তৈরি করব স্যার,ম্যাশিন ছাড়বনি।

–তোমাকে সুইজারল্যাণ্ডে বাংলো কিনে দেব।

–বাংলাল্যাণ্ড ছাড়া অন্য কোথাও যাবনি।

–তা হলে পুরো প্রজেক্টটা অন্য জায়গায় শিফট করে দিচ্ছি।

–ম্যাসিন লড়চড় করা যাবেনি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে কালেকশন করা হয়েছে, লড়চড় হলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। পঞ্চাননের কথার মধ্যে কেমন যেন কমাণ্ড এসে গেছে। ও হাত নেড়ে কথা বলছে। মহানির্দেশকের চামচে বলল–ও হয়তো ঠিকই বলেছে।ওর তো কোনো ব্লুশিট নেই, ও হচ্ছে একজন কোয়াক সায়েন্টিস্ট। বরং এক কাজ করা যাক। আমরা গারবেজ এরিয়াটাকে একটু বাড়িয়ে দি। কলকাতার বড়বাজার, রাজাবাজার, বৌবাজার থেকে গারবেজ নিয়ে আসি। বাংলাদেশ–টিউনেশিয়া–তানজানিয়াতে ভাল জাতের গারবেজ পাওয়া যাবে, আমরা ইমপোর্ট করতে পারি। জঞ্জালে ভ্যারাইটি হলে প্রডাক্টও ভাল হবে। মহানির্দেশক মাথা নাড়লেন।

মহানির্দেশকের চামচে বললেন–একটু প্রব্লেমও আছে স্যার। গারবেজ এরিয়াটা এভাবে বাড়িয়ে দিলে রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় হেলথ হ্যাজার্ড হতে পারে। এজনাই ভাবছিলাম পুরো ইউনিটটা যদি শিফট করে অন্য কোথাও নেয়া যায়…মহানির্দেশক বলল–এরিয়া বাড়াবার দরকার নেই। গারবেজ যেমন যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, প্রসেসিংটা এখানে করলেই হবে। আর জায়গাটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয়া হোক, এবং পাঁচিলের চারিপাশে ডিজইনফাকট্যাণ্ট-এর সনিটিফিউয়াস স্প্রে থাকুক।

ইয়েস স্যার!

এবার ডিলটা করে নিন। কিন্তু তার আগে একটু ক্রস চেক করে নেয়া উচিত।

ক্রশ চেক মানে?

যেমন দ্যাখো, বাঁ দিকের মুখে ছেড়া কাপড় চোপড় দিচ্ছে, হাতল ঘোরানোর পর ডান দিকের মুখ থেকে নেকটাই বেরুচ্ছে। এবার এক কাজ কর। ডান দিকের মুখে নেকটাই গুঁজে উল্টো দিকে হাতল ঘোরাও দেখি, কী হয়।

পঞ্চাননকে বলা হল এরকম করতে। উল্টো দিকে হাতল ঘোরালো পঞ্চানন, নেকটাইগুলো আবার নেকড়া হয়ে গেল।

কয়েকটা আধ খাওয়া ভুট্টাকে বাঁদিকের মুখে ভরে হাতল ঘুরিয়ে কর্নফ্লেকস-এর প্যাকেট বানিয়েছিল পঞ্চানন, প্যাকেটের গায়ের লেখা পড়ে পঞ্চানন জেনেছিল কর্নফ্লেকস খেতে দুধ দরকার। ও তখন ভেবেছিল ধুস। এখন কর্নফ্লেকসগুলোকে উল্টো ঘুরিয়ে আবার পোকাখাওয়া ভুট্টা বানাল।

কয়েকটা প্যাকেটে কী যেন লেখা ছিল পড়তে পারেনি। খায় না মাথায় দেয় পঞ্চানন জানেনা। সেই প্যাকেটগুলি ডানদিকের মুখে ঢুকিয়ে উল্টো হাতল চালালো পঞ্চানন, বাঁদিকের মুখ থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকডোনাল্ড নাম লেখা আধ খাওয়া, চোবানো ফ্রাইড চিকেনের প্যাকেট। করো কী করো কী বলে উত্তেজিত হাত নাড়তে থাকেন মহানির্দেশক। ওর মাথার টুপি হাওয়ায় উড়ে গিয়ে জঞ্জালের স্তুপে পড়ে। পঞ্চানন ওর আশ্চর্য কলের ডানদিকে টুপিটা ঢুকিয়ে উল্টো হাতল ঘুরিয়ে দেয়, বাঁদিক দিয়ে বেরুতে থাকে রোগা রোগা শিশু। হ্যাঁ, শিশু। হাত পা নড়া ক্রন্দনরত। কালো কালো।

বসনিয়ার? ইয়েমেনের? কালাহাণ্ডির?

মহানির্দেশক বলতে থাকেন–রি-সাইকেল,রি-সাইকেল, রি-সাইকেল…।

পঞ্চানন শিশুদের কোলে তুলে নেয়।

ওরে আমার সোনা মনা ধনা। আমার লব কুশ, নাডুগোপাল–

জঞ্জাল স্তূপে টুপ টুপ যোগ হ’ল আধখাওয়া কোকের ক্যান। মহানির্দেশক উত্তেজিত।

শিশুরা কাঁদছে।

মহানির্দেশক ভীষণ উত্তেজিত। চেঁচালেন-রি-সাইকেল ইমিডিয়েটলি।

পঞ্চা শোনেনা। বলে আর টুপি আছে?

এরপর আরো লোক জড়ো হ’ল। পরনে খাঁকি উর্দি, হাতে বন্দুক। বন্দুকে সাইলেন্সার আছে। বুলেট বমি হল নিঃশব্দে।

উৎপাদন ইউনিটটি নিঃশব্দে দখল হয়ে গেল। মহানির্দেশক টুপি ফিরে পেলেন ফের, নিঃশব্দে লাগালেন শিরোদেশে।

আর পঞ্চানন–পলিমারের জঞ্জালের তলায়, চকোলেটের রাংতা, ছেঁড়া মোজা-গ্লাভস-স্প্রিং-নাটবল্টু সিলিকন চিপস্-এর ভিতরে নিঃশব্দে জঞ্জাল হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *