কাকায়ন

কাকায়ন

বিকাশ বাগচির বাড়িতে সর্বদাই কা-কা রব। বারান্দার খাঁচায় এখন ডজন খানেক কাক রয়েছে। মিসেস বাগচি কাকের খাঁচার সামনে বসে আছেন আরাম চেয়ারে, হাতে কাকচরিত্র। বাঁদিকে গ্রিল, গ্রিলের বাইরে অনন্ত অ্যাপার্টমেন্ট। দু বছর আগে অনন্ত আকাশ ছিল ওখানে। অনন্ত অ্যাপার্টমেন্টের চারিপাশে অনন্ত পাঁচিল, পাঁচিলে অনন্ত ঘুঁটে। সব বাড়িতেই গ্যাস, অথচ এত ঘুঁটে কী যে হয়…। কাক ডাকে কা-কা, আগে অ পরে আ। কাক ডাকে যা-যা…। নাইস। ‘যদি কাক উত্তর দিকে যা যা রব করে তবে বিদেশ হইতে সুসংবাদ আসিবার লক্ষণ বলিয়া জানিবে…।’ ওগো, শুনছো, ইউ উইল গেট ইয়ার গ্র্যান্ট ফ্রম সুইডেন…। খাঁচার মধ্যে যে-কাকটা যা-যা রব করছে সেটা নর্থেই ছিল, নর্থেই তো।

সখা দেখা দাও আমায়

নইলে এ জীবন যায়

ত্রিতাপ তাপিত তৃষিত এই চিত

তোমারই ভাবনায় বিমুগ্ধ সতত

কবে কাছে এসে দেখা দিবে হেসে

হেরিব মধুর অধর হায়

অনন্ত অ্যাপার্টমেন্টের ছাতে শামিয়ানা। লাউড স্পিকার চালু হ’ল। কারুর গুরুদের এসেছেন। হায়। হেরিব কি মধুর অধর হায়। কাক যদি দক্ষিণ দিকে বসিয়া হায় হায় রব করে তবে তুমি শুভ সংবাদ জানিবে। এই কাকটা কি সাউথে নেই? ইয়েস্। দক্ষিণেই তো হায় হায় টাইপের একটা সাউণ্ড করল না ব্যাটা? …খুব কনফিউসিং। যে-কাকটা এখন খাঁচার নর্থ-এ বসে একটা সাউণ্ড দিল, সেটা যে একটু পরেই সাউথে চলে যাবে না, তার কোনো মানে নেই। যাচ্ছেও। ওমনি কিন্তু মানেটাও চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। শুভটা অশুভ আর অশুভটা হয়ে যাচ্ছে শুভ।

গ্রিলের উপর কয়েকটা কাক বসেছে। এরা বাইরের কাক। খাঁচার কাক দেখতে এরা এসেছে। এসেই কা-কা করছে। কাক জাতির বড় ঐক্য। আগে অনেক বেশি বেশি কাক আসত। খাঁচার বাইরে বসে, খাঁচার দিকে চেয়ে চ্যাঁচাত। এসে মুক্ত কর বলত। তখন কাকতাড়ুয়া রাখা হ’ত। মাটির হাঁড়ি, মানে টেরাকোটা, পোড়ামাটি আর কি, তাতে চুনের বড় বড় সাদা চোখ। মিস্টার বাগচির একটা ছেড়া কোটও ছিল। কয়েকটা দিন কাক কম এসেছিল। তারপর একদিন একটা কাক হাঁড়ির মাথায় বসল, একটা কাক ভয় কীরে পাগল, আমি তো আছি, বলে কোটের হাতায় হেগে দিল। এরপর থেকে কাকেরা আবার আসতে লাগল খাঁচার সামনে। কাকতাড়ুয়ার মডেল চেঞ্জ করতে হয়েছে কয়েকবার। হাঁড়ির গায়ে চক্ষুস্থানে গর্ত করে তাতে বাল্ব ফিট করা হ’ল। তাতে লাল আলো, জ্বলছে নিবছে জ্বলছে। ক’দিন কম ছিল। আবার কাক করে কা-কা আগে অ পরে আ। এরপর আরও সফিসটিকেটেড কাকতাড়ুয়া বানানো হ’ল। হাঁড়ির মুখের জায়গায় গর্ত করে ওখানে ফিট করা হ’ল একটা স্পীকার। রেডিওর কারেন্ট অ্যাফেয়র অনুষ্ঠানের গ্যাট চুক্তির পক্ষে ও বিপক্ষে বিশেষজ্ঞদের ভীষণ ভাষণ টু-ইন-ওয়ানে রেকর্ড করে ঐ ক্যাসেট চালানো হল। কিছু জীবনমুখী বাংলা র‍্যাপ চালানো হ’ল। কিছুদিন স্বাধীন কাকেদের উপদ্রব কম। এরপর আবার ছাপিয়ে, কারও বুকে মাথা রাখা কোনো নীলাঞ্জনার জন্য ইকো সমম্বিত জীবনমুখী হায় হায় ছাপিয়ে, স্বাধীন কাকের খাঁচার কাকেদের জন্য সমবেত হায় হায় করে ওদের প্রাচীন কা-কা শব্দ। শেষকালে ভল্টুকেই কাকতাডুয়া করা হ’ল। কাকতাড়ুয়া লাইভ।

ভল্টু এখন গ্রিলের সামনেই বসে থাকে। হাতে এলুমিনিয়ামের বন্দুক। ক্যাপও থাকে। ফটাস্ ফটাস্। ফাটালে কাকেরা চলে যায়। তাই বলে যখন তখন ফটাস্ ফটাস্ ক্যাপ ফাটাতে পারে না ভল্টু। কারণ, হয়ত মিঃ বাগচি রিসার্চ করছেন। বিকাশ বাগচি হলেন একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। তিনি ল্যাবরেটরিতে কাকের পাকযন্ত্র নিয়ে রিসার্চে মগ্ন। তখন তো আর ফটাস্ ফটাস্ ক্যাপ ফাটানো চলে না। কিংবা গ্রিলের বাইরে লালগাড়ি, নীলগাড়ি, গণ্যমান্য মানুষেরা এসেছেন সব, তখন তো আর ফটাস্-ফটাস্ চলে না। তাই, হাতে যদিও বন্দুক ও বারুদ, বন্দুকটা শুধুই সামনে উঁচিয়ে হুস্ হুস্ করে প্রাচীন কায়দায় কাক তাড়াতে হয়। বাগচি বলছিলেন- এটাই শাশ্বত ভারত। টেকনোলজি আসে, কিন্তু প্রিমিটিভিটি থেকেই যায়। মুক্ত হওয়া যায় না। কিন্তু ভল্টুর হাতে যখন বন্দুক তুলে দেওয়া হয়েছিল, ভল্টুর খুব আনন্দ হয়েছিল। ভেবেছিল…

কাকের খাঁচাটাকে বারান্দা থেকে সরিয়ে ঘরের ভিতরে যে নিয়ে যাওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু কাক সম্পর্কে যা-যা জানা গেছে তাতে মনে হচ্ছে স্বাধীন কাকেরা ঘরের ভিতরেও ঢুকে যেতে পারে। ঘরের ভিতরে কা কা রব কি ভালো? কাকের রবে বেডরুমে বেদনা আসে। কাকস্য পরিবেদনা বলে একটা কথা আছে। ঘরের ভিতরে কা-কা রব হলে কী হয়? – কাকচরিত্রে লেখেনি। কাকচরিত্র ব্যাপারটাই ফালতু। ওটায় কি খুব একটা বিশ্বাস করেন নাকি মিসেস বাগচি? এটা একটা ফান্! মজা।

গড়াই এল। নো গড়াই, নো মোর। আর কাক দরকার নেই এখন।

-আর কাগ লাগবেনে? গড়াই তবুও বলে। না, দেখছে তো আছে। মিসেস বাগচি বলেন।

গড়াই দুঃখ পায়। গত এক বছর ধরে কাক সাপ্লাই করছে গড়াই। বাগচি বহুল প্রচারিত বাংলা কাগজে জ্যান্ত কাক চাই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। চিঠিপত্র এসেছিল। বেশির ভাগই দালাল। দালাল নিঃ প্রঃ কথাটা লেখা হয়নি বিজ্ঞাপনে। দালালরা ভেবেছিল বোধ হয় মোটা কোনো দাঁও। ফরেনে কাক যাবে।একজন দালালের সঙ্গে এরকম কথাবার্তা।

-আপনার এডভাটাইজ দেখে ফোন লাগাচ্ছি। কোত মাল চাই।

-বেশি না, মাসে দেড় ডজন।

-ব্যাস! এতো কোম এক্সপোর্ট করে আপনার কি ফয়দা হোবে!

-এক্সপোর্ট করব কে বলল!

-তোবে কী কোরবেন?

-আছে, কাজ আছে।

-ও, তান্ত্রিক কিরিয়া কোরবেন। ওসব কাজে আমি হার্গিস ক্রো সাপ্লাই কোরি না।

আর একজন কম বয়সী সাপ্লায়ার ঠিকানা জোগাড় করে এল।

-কাক চাইছেন?

-হ্যাঁ।

-কটা?

-মাসে দশ বারোটা।

-দাম কী রকম দেবেন?

-কত চান?

-আপনিই একটা রেট দিন না আগে।

-কুড়ি টাকা পিস্।

-মাত্র?

-একটা কাক আবার কত? প্লেন্টি অ্যাভেইলেব্‌ল।

-ধরাটা যে মুশকিল। এ জন্যই রেট বেশি, পায়রা সস্তা।

-আপনি কীভাবে ধরবেন?

-আমি ধরতে যাব কেন? গৌতম ঘোষের ফ্লিমটা দেখেননি?

-কোনটা?

-ঐ যে একটা আর্ট ফ্লিম। টিভিতে দেখিয়েছিল। কাকমারাদের নিয়ে। যদি বাল্ক নিতেন, শ হিসেবে, ওদের সঙ্গে কন্‌ট্যাক্ট করতম।

-কীভাবে?

-যে ভাবেই হোক। আমি হলুম সাপ্লায়ার। করতেই হ’ত। তবে মাসে দশ বিশটার অর্ডারে কোনোও ডীলই চলে না।

মাসে দশটার বেশি কাক কোন কাজে লাগবে ডক্টর বাগচির? ওঁর দরকার কাকের পাকযন্ত্রের। ডিসেকশন করে ঈসোফ্যাগাস থেকে অ্যানাল হোল পর্যন্ত ইনট্যাক্ট বার করে নেবেন তিনি। তারপর পুরো সিস্টেমটাকে বড় করবেন, লম্বা করবেন, বৃহৎ করবেন, তারপর মানুষের মধ্যে রিপ্লেস্‌ করবেন। এই হচ্ছে তাঁর কাজ। আগামী প্রজন্মকে সুখী করবার মহং প্রকল্পনা। সমাজসেবা।

আইডিয়াটার জন্য স্ত্রীর কাছে ওবলাইজ্‌ড্‌ মিঃ বাগচি। একদিন একটা শার্ট পরেছিলেন মিঃ বাগচি, ইউনিভার্সিটিতে যাবেন, এমন সময় মিসেস বাগচি চিৎকার করে উঠেছিলেন – পোরো না, পোরো না ওটা। ওখানে কাক পটি করেছে। বাগচি দেখলেন বাঁ হাতের কাফলিংকের পাশে একটা গুটলি পাকানো ইয়োলোইশ সলিড মাস। ডান হাতের দু আঙুলের মৃদু টুস্কিতে ওটা ফেলে দিলেও একটা হাঙ্কা দাগ রয়ে গেল। মিসেস বাগচি বলেছিলেন, এঁ ম্যাঁ… ডান হাতে ধরলেঁ! কিঁ করে খাঁবেঁ…। মিঃ বাগচি বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলেছিলেন, ধুৎ, কাকের গুয়ে কি জার্ম থাকে নাকি? কিছু না ভেবেই কথাটা বলেছিলেন। এমনিই। গাড়িতে যেতে যেতে ঐ কথাটা মিঃ বাগচিকে চেপে ধরল। আচ্ছা, সত্যিই কি কাকের স্টুলে জার্ম নেই! অথচ কাক কী না খায়। কফ, পুঁজ, রক্ত, পচাগলা আবর্জনা, সব খায়। কোনো কক্কাস, কোনো কোলাই, কোনো… ইনফেক্‌শন হয় না কেন? হতেই তো পারে। স্ট্রং ডাইজেস্টিভ সিস্টেম কিন্তু মানুষের হয় এমন কেন! অল্পেই অসুখ।

রতনবাবু ওর শালার দশ হাজার টাকা চুরি করে পাগল হয়ে গেল। হজম হয়নি। উইক ডাইজেস্টিভ সিস্টেম। অথচ মানসবাবু দিব্বি সিমেন্টে মাটি মিশিয়ে চলেছে। স্কুল বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, মেয়ে পড়ে লোরেটোতে, নিজে রোটারি ক্লাবের মেম্বার হয়েছেন। স্ট্রং ডাইজেস্টিভ সিস্টেম। কাকের। এটা অবশ্য অন্য কথা। তবে এটা ঠিক, যে কাকের বডিতে জীবাণু মারার কল সাটানো রয়েছে।

ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে বাঁ হাতের হাতা থেকে হলুদাভ সাদা গুঁড়ো, যা কিনা কাকমল, কাচের স্লাইডে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ব্যাকটেরিয়া নেই। বৈজ্ঞানিক বিকাশ বাগচি নতুন গবেষণার একটা যুগান্তকারী বিষয় পেলেন। এখন দেখতে হবে, পরীক্ষা করতে হবে, কাকের পাকস্থলীতে কী আছে। কী এনজাইম বেরচ্ছে প্যাংক্রিয়াস থেকে, স্টমাকের অ্যাসিডের পি.এইচ. কত, বিলিরুবিনে ঘনত্ব কত: এজন্যই দরকার কাক।

ভল্টুকেই বলেছিলেন মিঃ বাগচি। ভল্টু প্রচেষ্টা চালাতে লাগল। প্রথমত ধামার গায়ে দড়ি বেঁধে সেই দড়ির এক মাথা হাতে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকত, ধামার তলায় কুচো নিমকি। কাক এলেই দড়িতে টান। কিন্তু ধামাটা স্থিতাবস্থার সামান্যতম বিঘ্ন ঘটার আগেই কাক পালায় প্রতিবার। এ ভাবে কাক ধরা যায় না। অন্যান্য কিছু পাখি অবশ্য এভাবে ধরা যায়। কাকের বুদ্ধি কি বেশি! সে আবার অন্য গবেষণার ব্যাপার।

ধামাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে রেখে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করল ভল্টু। হ’ল না। নতুন বুদ্ধি করল ছোট পিচকিরিতে ক্লোরোফর্ম ভরে কাকের নাক টিপ করে মেরে দেখেছে, ক্লোরোফর্ম কখনই কাকের নাকের আশেপাশে লাগেনি। এই বুদ্ধিটা মিসেস বাগচির। উনি গৃহিণী সচিব জায়া। কিন্তু কাকেরা মিসেস বাগচিকে নয়, ভল্টুকেই ঠোকরাত, দেখলেই। এর পরই বিজ্ঞাপন। এখন কাক দেয় গড়াই। ও অদ্ভুত কায়দায় কাক ধরে। ও থাকে হাওড়া জেলায় আমতার কাছে। একটা গর্ত করে নেয়। ফুট তিনেকের। গর্তের ভিতরে ছিটিয়ে দেয় ছেড়া রুটি। রুটির লোভে কাক গর্তে নেমে গেলেই গর্তের উপরে বিছিয়ে দেয় জাল। পলিটিকাল মাতব্বররা এ ভাবেই মানুষ ধরে।

এখন গড়াই এসেছে। কিন্তু ও কাকের নতুন অর্ডার পায় না। ওর কাঁধে ঘা। কাকেরা ঠোকরায়।

-কেন, স্যারের রিচার্স কি বন্ধ!

মিসেস বাগচি বললেন – না, বন্ধ কেন হবে, এখন আর লাগছে না।

-কবে লাগাদ খপর করব?

-দিন পনের পরে এসো।

-বাবু যদি লোবেল প্রাইজটা পেয়েই যায়, আমি কিন্তু মোটা টাকা বকশিস লোবো, বলে রাখলুম, হ্যা।

গড়াই ওর কাঁধের ক্ষতের উপর হাত বুলোয়। যাবার সময় ল্যাবরেটরির কোনায় রাখা কাকের পালকগুলি পলিথিনে নেয়। ওগুলো পাচলায় বেচে দেবে। ওসব দিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলার শাটল কক্ হয়। কালো কক্ কম দামি। ছেলে পিলেরা খেলে। শাট্‌ল কক্‌ ওড়ে, কাকও ওড়ে।

গড়াই এখন যাচ্ছে। পাঁচিলে, ইলেকট্রিক তারে, ঝোলানো ব্যালকনিতে ঝুলে থাকা দোলনায় বসে থাকা উদাস কাকেরা গড়াইকে দেখে কিংবা দেখে না। কাকেরা জানে না, খেলা হবে বলে ওদের পালক বন্দি আছে পলিথিন ব্যাগে।

কাকেদের খিদে পেয়েছে। খেতে দে ভল্টু… মিসেস বাগচি স্টিরিও ছাপিয়ে বললেন। ভল্টু রুটি দেয় ছিড়ে ছিড়ে। কাকেরা ঝাপিয়ে পড়ে। রুটি ছো মারে। নাচে। আহা নাচে নাচে। এইসব কাকেরা একে একে মরবে।

এখন খুব একটা কাক দরকার হচ্ছে না মিস্টার বাগচির। আগে প্রতিদিন তিন চারটে করে লাগত। আলাদা আলাদা করে স্টমাক, লিভার, গলব্লাডার, স্প্লিন (spleen), প্যাংক্রিয়াসের টিস্যু, এনজাইম অ্যানালিসিস করতে হয়েছে, DNA সংস্থান জানতে হয়েছে, এরকম কত কঠিন কঠিন কাজ। ভল্টু ছিল এ্যাসিস্ট্যান্ট। কনুই পর্যন্ত ঢাকা গ্লাভস্‌ পরে খাঁচায় হাত ঢুকিয়ে খপ্ করে কাক ধরে নিত। তারপর নিয়ে যেত স্যারের কাছে। স্যার ক্লোরোফর্ম মাখা রুমাল চেপে ধরতেন কাকের মুখে।কাক কা বলারও সুযোগ পেত না। মানব কল্যাণে শহিদ হয়ে যেত।

মিঃ বাগচি ভেবেছিলেন পুরো সিস্টেমটাকেই ক্লোনিং করাবেন। কোষ যেভাবে বাড়ে,একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে…আটটা…ষোলটা…সেই ভাবেই এক কঠিন কৃত্রিম উপায়ে কাকের পুরো ডাইজেস্টিভ সিস্টেমটাকে বাড়িয়ে বড় করে মনুষ্যোপযোগী করে তুলবেন। আর একেবারে গলনালী থেকে পায়ু পর্যন্ত মানুষের সিস্টেম টাকে উপড়ে ফেলে ওখানে ল্যাবরেটরির কাকেদের এনলার্জড সিস্টেমটাকে ফিট করে দেবেন। মানুষের সব কিছু হজম হয়ে যাবে এর পর। ব্যাপারটা খুবই গোপন। মিসেস বাগচি ছাড়া আর কেউ জানে না। ভল্টুও নয়। ভল্টু শুধু জানে কাকেদের নাড়ি থেকে ওষুধ তৈরি হচ্ছে। বেশি জানাজানি হয়ে গেলে বিদেশের কে কখন পেটেন্ট করে নেবে ঠিক আছে! জগদীশ বসু – মার্কনির কেস্ কে না জানে।

এই ব্যাপারটা সাকসেসফুল হ’লে মানুষের কোনো পৈটিক রোগ থাকবে না। আন্ত্রিক-টান্ত্রিক হবে না। যেমন কাকদের হয় না। হাসপাতালগুলিতে কাজের চাপ কমে যাবে। জল ফুটিয়ে খেতে হবে না। ফলে প্রচুর ফুয়েল সাশ্রয় হবে।

কীগো, ব্যাপারটা দারুণ হবে না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিকাশ বাগচি। স্ত্রী বলেছিলেন, দারুণ! দারুণ! এবং চুম্বন। সে সময় বৈজ্ঞানিকের বাঁধানো দাঁত খুলে গিয়েছিল।

ব্যাপারটা প্রচুর ভোগালো। কাকের ঈসোফ্যাগাস, মানে গলনালীর সেলগুলো মরে যাচ্ছিল, কিন্তু লিভারের সেলগুলো বেঁচে থাকছিল। কাকেদের লিভার বড় স্ট্রং। তখন সেলগুলো বাঁচাবার জন্য একট সল্যুশন দিতেই গলনালীর সেল বেঁচে যায় তো লিভারের সেল মরে যায়। কারণ লিভারের সেল-এর পক্ষে সেটা আবার ওভার ডোজ। এইভাবেই কালো পাথরের টেবিলতলে কত কাক হ’ল বলিদান।এর কোনো স্মারকস্তম্ভ নেই। শুধু কালো শাট্‌ল কক্‌।

 শেষকালে অনেক কৌশলে সেলগুলো বাঁচাবার একটা কায়দা করা গেল তো বেশি বাড়ানো গেল না। মানুষের ইনটেসস্টাইন বাইশ ফুট, কাকের নয় ইঞ্চি। মানে, ইনটেসস্টাইনটা বড় করতে হবে উনত্রিশ গুণ। অথচ গলব্লাডারটা ষোল গুণ বড় হ’লেই চলবে। লিভার আঠের গুণ! কাকের প্যাংক্রিয়াস্ ছোট। কারণ গ্লুকোজ পোড়াবার জন্য ইনসুলিন বেশি দরকার হয় না কাকের। ওড়াউড়িতেই গ্লুকোজ শেষ হয়ে যায়। ফলে কাকের প্যাংক্রিয়াসকে চল্লিশ গুণ বড় করতে হবে। ব্যাপারটা একদম হোমোজিনিয়াস নয়। মোস্ট হেট্রোজিনিয়াস। সেল বাড়াবার জন্য স্টিমুলাস্ দেওয়া হয়। আটগুণ বাড়ার পর লিভার বেড়ে যায় তো প্যাংক্রিয়াস ছিড়ে যায়। এরকম আর কি।

ব্যাপারটা ছেড়ে দেবার কথা ভাবলেন মিঃ বাগচি। ইতিমধ্যে হাজারটা কাক মরে গেছে, তাতে পাঁচ হাজার শাট্‌ল কক্ তৈরি হয়েছে। বৈজ্ঞানিক বিকাশ বাগচি সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নন। উনি প্রবাদ বাক্য জানেন। মহম্মদ পবর্তের কাছে না গেলে পর্বত মহম্মদের কাছে যায়। উনি ভাবলেন কাকের পরিপাক যন্ত্র যদি বড় না-ই করা যায় তো মানুষকে কি কাকের সাইজে আনা যায় না, কাকের মতো না হোক, কিছুটা ছোট? মানুষকে যদি একের চার বা একের পাঁচ করে দেওয়া যায়, আর কাকের পাকযন্ত্রকে পাঁচগুণ বড় করে দেওয়া যায়, তা হলেই তো ব্যাপারটা মিটে যাবে। একেই তো বলে অ্যাডজাস্টমেন্ট।

আমি কিছু ছোট হই, তুমি কিছু বড় হও, তাই না? – মিসেস বাগচিকে বলেছিলেন বৈজ্ঞানিক। আবার তুমি রিসার্চ কর, আমি তোমার পাশে আছি, মিসেস বাগচি বলেছিলেন মিস্টারকে। এরপর আবার দাঁত খুলে গিয়েছিল।

আবার রিসার্চ। নাড়ানাড়ি, ঘাটাঘাটি, পরিশ্রম, মাইক্রোস্কোপ, চা-কফি, সিগারেট। কী একটা ইনজেকশন আবিষ্কার করলেন মিঃ বাগচি।

একদিন ভল্টুকে ডাকলেন। ওর গায়ে হাত বুলোলেন। মাথায় হাত বুলোলেন ইঞ্জেক্শন্ দিলেন। বললেন কিচ্ছু না, ভিটামিন। হাত বুলোলেন আবার, স্পিরিট-তুলোর হাত। একমাস পর ভল্টুকে মাপা হ’ল। ওজন নেওয়া হল। ওজন দু কেজি কমেছে। হাইট কমেছে দেড় সেন্টিমিটার। ওটা কিছু প্রমাণ করে না। ওজন এমনিতেও কমতে পারে। আর হাইটের ক্ষেত্রে দেড় সেন্টিমিটার কোনো ব্যাপারই নয়। সুতরাং আবার পরিশ্রম। কফি, সিগারেট।

দিন সাতেক পর আবার ভল্টুর ডাক পড়ল বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরিতে। আবার হাত বোলালেন। ইঞ্জেক্শন্। হাত বোলালেন। এখন কাকের খাঁচার সামনে ভল্টু। ভল্টু রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে কাককে দিচ্ছে। কাকেরা খায় আর নাচে। আহা নাচে নাচে।

সখা দেখা দাও আমায়

নইলে এ জীবন যায়।

গুরুবন্দনা চলছে অনন্ত অ্যাপার্টমেন্টে। অনন্ত পাঁচিলের গায়ে অনন্ত ঘুঁটে। একে চিলতে আকাশে একটা কাক। ল্যাবরেটরির দরজা ঠেলে বার হলেন মিঃ বাগচি।

-কী করছিস ভল্টু! খাওয়াচ্ছিস? বাঃ। আয়। ওঘরে চল। ঠিক সাতদিন আগেই ইঞ্জেক্শন্ দিয়েছিলাম না?

-হ্যাঁ। আজও আবার? না। উহু।

-না, আজ আর নয়। আজ তোর ওজন নোবো।

-ভিটামিনের কাজ দেখাবেন বুঝি?

-হুঁ।

ওজন নিলেন। উচ্চতাও। দ্রুত চলে গেলেন বেডরুমে।

ওগো শুনছ? ইউরেকা। ভল্টুর হাইট চার সেন্টিমিটার কমে গেছে। ওজন তিন কেজি।

বাঁধানো দাঁত নড়ে গেল।

বাইরে এসে ভল্টুকে ডাকলেন ডঃ বাগচি। মাথায় হাত বুলোলেন।

গান চালালেন ডঃ বাগচি। কলের ট্যাপ খুলে দিলেন, ডানলোপিলোয় ঝাপ মারলেন, কাচের শার্সি ভাঙলেন একটা লাথি মেরে। ভল্টু অবাক দেখতে লাগল। কী লজ্জা! ভল্টুর পায়ে হাত দিয়ে ফেললেন ডঃ বাগচি। তারপর হঠাৎ কাকের খাঁচার দরজা খুলে হাত পুরে দিয়ে খপাৎ ধরলেন একটা কাক। তারপর জওহরলাল নেহেরুর পায়রা ওড়ানোর ছবি যেমন, সেই কায়দায় কাক ছেড়ে দিলেন একটা। বললেন, ছুটি। কাকটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে মেঘ ছিটানো আকাশের দিকে বের হবার আগে ভল্টুর মাথায়, হ্যাঁ, ভল্টুরই মাথায় ঠুকরে গেল একবার।

তখন গোধূলি।

গোধূলি লগনে কাকে ঠোকরাইলে অভীষ্ট সিদ্ধ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *