মানুষ কিংবা কোলবালিশ

মানুষ কিংবা কোলবালিশ

ক’দিন আগেই রাস্তায় পিচ দিয়েছে। সাইকেল ছুটিয়ে বড় সুখ, তারাদাস তাই পোঁ-পোঁ ছুটছিল। মোটর গাড়ি ওকে ওভারটেক করে সামনে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে বের হয়ে এল একজন রোগাপানা, পাকা চুল, ফর্সা মানুষ। বলল, শোন তারাদাস, কথা আছে। লোকটাকে আগে কখনো দেখেনি তারাদাস।

 তারাদাস বলল, কী কথা?

 লোকটা বলল, তুমি উড়বে?

 ‘এ্যাঁ?’

বলছি, ‘তুমি উড়বে?’

‘মাইরি আর কী! – মানুষ কি উড়তে পারে?’

‘মানুষ পারে না। এতদিন পারেনি। এবার পারবে।’

‘ইঃ।’

‘শোন তারাদাস। তোমায় ওড়া শেখাব।’

‘ও’। বুঝে গেল তারাদাস। পাগল-ফাগল হবে। ও প্যাডেলে চাপ মারে।

লোকটা আবার বলে, ‘যেও না, কথা আছে।’

তারাদাস বলে, ‘এখন আমার কথা শুনবার সময় নেই, আমার এখন দ্বারকপাটি যেতে হবে।’

‘দ্বারকপাটি কার বাড়ি?’

‘ভোলা ঘোষের বাড়ি। ভোলা ঘোষকে চেনেন? বাড়িতে ডেয়ারি বানিয়েছে। জার্সি গোরু। জেনারেটর আছে ঘরে। জেনারেটারে টি.ভি. চালায়, ভি.ডি.ও. চালায়…’

‘আর এখন তুমি ওর জন্য ভি.ডি.ও. ক্যাসেট নিয়ে যাচ্ছ,- কেমন না?’

‘হ্যাঁ। শোলে, ডন, আর…ইয়ে।’

‘বুঝেচি। বলে যাও।’

‘ওটা বেশি রাতে চলবে। ভোলা ঘোষের শালা এসেছে বাড়িতে।’

‘নাও তারাদাস রেডি হও। ওড়া শেখাব। তোমার আর কষ্ট হবে না। এই চেন খুলে গেল, এই টায়ার পাংচার–টিউব লিক্ এসব হ্যাপা আর পোহাতে হবে না তোমার। তুমি আকাশে উড়ে…’ তারাদাস এখন আকাশের দিকে তাকায়। দু’ফালি মেঘ ভাসছে। দুটো চিল উড়ছে।

গাড়ির পিছনের ক্যারিয়ার থেকে বুড়োটা কী একটা বের করে বলল, ‘এই দেখ ডানা। লাল ডানা’। খুলে ধরল বুড়োটা। রূপকথার বইয়ের ছবিতে পরিদের যেরকম ডানা হয়, ঠিক সে-রকম। লোকটা যাদুকরের মতো হাসছে।

‘এটা তোমার পিঠে বেঁধে দেব তারাদাস।’

এঃ। মাইরি আর কী। আমাকে উড়িয়ে দিয়ে সরে পড়ো আর আমি পড়ে মরি আর কি। তারাদাস এবার বুদ্ধি করে বলে, ‘আগে আপনি উড়ে দেখান তো দেখি কি রকম উড়তে পারেন তারপর নয় আমি উড়ছি।’

‘আমার যে হার্টের দোষ, আমি উপরে উঠতে পারি না। তবে আমি অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছি। শূন্যে বাঁদর পাঠিয়েছি। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’ এই বলে ক্যারিয়ার থেকে বার করে আনল একটা খাঁচা। শূন্য খাঁচা। ‘এই খাঁচাতেই বাঁদরটা ছিল, সেদিন পালিয়েছে।’ বুড়োটা এরপর বার করে আনল একটা কোলবালিশ। রেশমী কাপড়ে মোড়া, জরির ঝালর ঝুলছে।

বলল,‘কোলবালিশটাকে মনে করো একটা মানুষ। মানুষটা শুয়ে আছে। এইবার দ্যাখো এই মানুষটার পিঠে এই ডানাজোড়াটা বেঁধে দিলুম।’

‘বাঃ কী সুন্দর কাচ বসানো ডানা।’ তারাদাস দেখল কোলবালিশটার পিঠে ডানাটা বেঁধে দিতেই কোলবালিশটা প্রজাপতি হয়ে গেল।

‘এগুলো কাচ নয় খোকা, এগুলোকে বলে ফোটো ইলেকট্রিক সেল। এতে সূর্যের আলো পড়লে বিদুৎ তৈরি হয়, সেই বিদ্যুতেই এই ডানা নড়ে। পেট্রোল-ব্যাটারি কিস্‌সু লাগে না। দিনের আলোয় সারাদিন চিলের মতো আরামসে ওড়ে, কোনো অসুবিধা নেই। তবে রাতে বেশিক্ষণ ওড়া যাবে না। সোলার এনার্জি তো, সারাদিন ডানায় রোদ খাইয়ে তবে রাত্রেও কিছুক্ষণ ওড়া যায়, তারপর আস্তে আস্তে এনার্জি ফুরিয়ে যায়। “ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল” আছে না–জীবনানন্দের কবিতায়? তুমি তো আবার পড়নি এইসব, ঐ রকম ধারা। বুঝলে না?’ কিছুই বুঝল না তারাদাস। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল।

এবার দ্যাখো, খাঁচাটাকে ঝুলিয়ে দিলাম। এই যে মানুষটা শুয়ে আছে, এর পেটে বেল্ট বেঁধে বাঁদরের খাঁচাটা ঝোলালাম। চাঁদে যাবার আগে কুকুর, বাঁদর এদের পাঠিয়ে ছিল না মানুষ?–তারপর তো মানুষ বিশ্বাস করে রকেটে উঠল। –তা তুমিও তো মানুষ, তাই তোমার বিশ্বাস তৈরির জন্য বাঁদর পাঠাচ্ছি। যদিও বাদর পালিয়ে গেছে, খাঁচাটাই পাঠাচ্ছি তাই।

‘এবার দ্যাখো মানুষটার মানে কোলবালিশটার বেল্টের এই বোতামটা টিপলাম। সবুজ আলোটা জ্বলল। মানে ফুল এনার্জি। এবার সুইচ অন করলেই ডানা নড়বে। দ্যাখো তারাদাস এখানে কী করছি। এক হাজার ফিটের বোতামটা টিপে দিলাম। –কেন বলো তো? কারণ এই রেশমি জামা পরা মানুষটা তো আসলে কোলবালিশ বোধ বুদ্ধি নেই, বিবেচনা নেই। কখন থামতে হবে জানে না। কখন বাঁয়ে ঘুরবে, কখন ডাইনে ঘুরবে জানে না। এইজন্য এক হাজার ফুটের বোতামটা টিপে দিলাম। এক হাজার ফিট উঠেই আবার নেমে আসবে। আমি আমার ইচ্ছেমতো ওকে বাঁয়ে ঘোরাতে পারি, ডাইনে ঘোরাতে পারি, ওঠাতে পারি, নামাতে পারি, আমার ইচ্ছেমতো। পুরো আমার ইচ্ছেমতো।’

বোতাম টিপল লোকটা,আর কোলবালিশটার পিঠে ডানা নড়তে লাগল। কোলবালিশটা একটা প্রজাপতি। উড়ছে। চাকতি বসানো সুন্দর ডানায় উড়ছে। শূন্য খাঁচাটা অবাধে উঠে যাচ্ছে আকাশে। তারাদাস ঘাড় উঁচু করে কোলবালিশটা দেখে। আহা। ডানা নড়ছে। প্রজাপতি। বাতাসে একটা হাল্কা গোঁ গোঁ শব্দ। তারাদাস ভীষণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। একটু পরেই গোঁত্তা খেয়ে কোলবালিশ – পাখিটা নামতে থাকে। লোকটা বলে, দেখলে, এবার কেমন নেমে যাচ্ছে? যা বলব, ও তাই করবে।’ কোলবালিশটা নাটিতে নেমে গেলে বাঁদরের খাঁচাটা ভুঁয়ে এলিয়ে পড়ে। কোলবালিশটার দিকে তাকিয়ে বুড়ো লোকটা বলে, ‘এভ্‌রিথিং ওকে?’ কোলবালিশের জরির ঝালর বাতাসে নড়ে।

‘তারাদাস, এবার তুমি।’

তারাদাস মাথা চুলকোলো। বলল, ‘না। আমি পারব না।’

‘বোক্কা ছেলে। পারব না আবার কী? সুইচটা অন করলেই তো উড়বে, আর সামনের হাতের কাছেই এটা স্টিয়ারিং। ডাইনে, বাঁয়ে, উপরে, নিচে, যেদিকে সরাবে সেদিকেই যাবে। কোলবালিশটা স্টিয়ারিং জানে না, তাই উঠেছে আর নেমেছে। কোলবালিশটার বিবেচনা নেই তাই আমি যা হুকুম করেছি ও তাই করেছে। নাও, কাছে এসো, ডানা বেঁধে দি।’

‘তা আমাকেই ধরলেন কেন? আমার ভাল্লাগে না।’

‘ভাল্লাগে না? তুমি বলনি তোমার নিজের মনে মনে–যখন ছ’মাইল আটমাইল দূরে দূরে ভাঙা সাইকেল চালিয়ে ক্যাসেট সাপ্লাই করতে যাও বা ফেরত আনতে যাও,– বলনি হে ভগবান আমি যদি পাখি হতাম?’

‘সে তো কত লোকেই বলে।’

‘কিন্তু সবাই তো আর তোমার মতন নয়। তুমি তোমার মাতামহীকে অতিশয় ভালোবাস। তিনি যে উপদেশ দেন তুমি তাহা পালন কর। তুমি মিথ্যা কথা কহ না। অন্যায় কর্ম কর না।যদি দৈবাৎ কর, অনুতপ্ত হও। তুমি কটুবাক্য, কুবাক্য কহ না। পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ, সেই হেতু পরের দ্রব্য লও না। আলস্যে কাল কাটাও না। ভিডিও. ভাণ্ডারের মালিক নারায়ণবাবু যাহা আদেশ দেন তাহা প্রফুল্ল বদনে সত্বর পালন কর। ব্লু ক্যাসেটগুলি ঠিক ঠিক স্থানে লুক্কায়িত রাখ।’

ইতিমধ্যে তারাদাসের পেটে বেল্ট বাঁধা হয়ে গেছে। পিঠে সেট হয়ে গেছে ডানা। ‘নাও স্টিয়ারিং ধরো। ওঠো, ওয়ান, টু, থ্রি।’ বোতাম অন করে দিল লোকটা। ডানা নড়তে লাগল। “স্টিয়ারিং উপরের দিকে ঠেলো”..বুড়ো চিল্লাল।তারাদাস তাই করল। তারাদাস উপরে উঠতে লাগল। তখন চ্যাচাল, ‘আমার সাইকেলটা দেখো…’

বুড়োটা বলল–‘সাইকেল পড়ে থাক।সাইকেল স্তর পার হয়ে গেছ তুমি। তুমি ওড়ো। উড়তেই থাকো।’ তারাদাস আকাশে উঠছে। দুধারে বিস্তৃত সবুজ। বুড়োটা দু’বাহু উপরে তুলে বলে চলেছে–‘ডানাটার সম্মান রেখো তারাদাস। এটাকে খারাপ কাজে লাগিও না। ডানাটার মর্যাদা রেখো তারাদাস। মানুষের কাজে লাগিও এটাকে।’…বুড়োটা বকেই চলেছে। তারাদাস ঘাড় উঁচু করে মেঘ দেখে। স্টিয়ারিং সামনে ঠেলে, পেছনে ঠেলে, উঁচু করে, নিচু করে, বাঁয়ে ঘোরায়, ডাইনে ঘোরায়, তারাদাস ওড়ে। সারাটা আকাশ নিয়ে খেলা করে। বহু নিচে কালো সুতোর মতো মদালসা নদী। ঐ নদীটা পড়েছে মধুক্ষরা নদীতে। ঢেউ-কলকল মধুক্ষরা নদীটা কী শান্ত এখন। নকশি কাঁথার মতো আলপনা আঁকা মাঠ। কৃষিক্ষেত্র। চাষের মানুষেরা মিশে আছে মাঠের সবুজে, আর মাঠের সবুজ মিশেছে বহু দূরের আকাশের নিচে। কোনটা যে চম্পাহাটি, কোনটা যে সজনেহাটি বোঝা যায় না। কোনটা যে দুধসাগর গাঁ আর কোনটা যে ক্ষীরসাগর গাঁ বোঝা যায় না। তিন কাঠা তেরো ছটাকের সঙ্গে দুই-কাঠা বারো ছটাকের ঝগড়ার কথা মিথ্যে মনে হয়। জনার্দনের আতাগাছের ডাল হরিপদর সীমানায় দু’হাত ঠেলে আসা মিথ্যে মনে হয়। শুধু মাঠের বিশাল সবুজ সত্যি। মদালসা নদীর দুপাশে দুধের ফেনার মতো জমে থাকা কাশবনের সাদা রঙ সত্যি। আকাশের গায়ে ওড়া তুলোর মেঘ সত্যি। ঐ তিন সত্যি সারা গায়ে মেখে মেঘে মেঘে লুটোপুটি খায় তারাদাস। তারপর এক সময় তারাদাস নামতে থাকে। আবার দেখতে পায় মাঠের সবুজে খোপ খোপ আলের সীমানা। সবুজের ভিতর থেকে উঠে আসে বিড়িখোর মানুষ। তারাদাস দেখে সবুজের ভিতর দিয়ে কালো রাস্তা। কালো রাস্তায় ভ্যান-রিকশা দেখে তারাদাস। তারাদাস দেখে একটা লোক সাইকেল চেপে যাচ্ছে। লোকটা ধনা-মনা-ঘনা যে কেউ হতে পারে। কে লোকটা বোঝা যাচ্ছে না। সাইকেলটা হিরো-র‍্যালি-বি,এস.এ. যা খুশি হতে পারে। কী সাইকেল বোঝা যাচ্ছে না। লোকটা সাইকেল চালিয়ে আম-জাম-পাকুড়-অশ্বথের ভিতরে একটা গ্রামের গভীরে মিশে যায়। তারাদাস যেখান থেকে উড়েছিল সেখানে গিয়ে দেখে ওর সাইকেলটা নেই। তখনই চিৎকার করে–‘সাইকেল…আমার সাইকেল…’। নেই সাইকেল নেই। বুড়োটার কথা মনে হল একবার। তুমি সাইকেল স্তর পার হয়ে গেছ তারাদাস। তখন শ্যামল মিত্রের গানটা একবার গাইল – ‘যাক্‌ যা গেছে তা যাক…’ তারাদাস এ-সময় দেখে কালো রাস্তা দিয়ে একটা ভ্যান-রিক্‌সা আসছে। ভ্যান-রিক্‌সা থেকে কথা আসছে। ভ্যান-রিক্সার ৰডিতে মাইক ফিট করা।

আউর ক’ গোলি বা?

ছে গোলি–

তেরা ক্যা হোগা কালিয়া!

আপকা নিমক খায়া সরকার।

অব গোলি খা…

শোলের ডায়লগ। পার্বতী হলে শোলে এসেছে। শোলের কথা মনে হতেই আর্তনাদ করে ওঠে তারাদাস। ক্যাসেট?

ক্যাসেট সাইকেলের বাস্কেটে ছিল। তারাদাস কালো ফিতের মতো রাস্তাটার দিকে হতবাক তাকায়। তারাদাস দেখে একজন খালি-গা মানুষ রাস্তা থেকে কী যেন কুড়িয়ে নিল, তারপর ফেলে দিল। মাথার ঝুড়ি নামিয়ে অন্য একজন মহিলা কী যেন তুলে নিল, আবার ফেলে দিল। সাঁই করে মাটিতে নেমে এল তারাদাস। ঐ তো, ওগুলোই তো ভি.ডি.ও. ক্যাসেট। শোলে, ডন, আর ডট্ডট্‌। খালি-গা মানুষদের এসব দরকার হয় না। কিন্তু এসবে ভোলা ঘোষদের সুখ হয়। ভোলা ঘোষের সুখের খোঁজে তারাদাস অনেকক্ষণ পরে পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়াল। ওগুলো কুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলল দ্বারকপাটি।

ভোলা ঘোষ তখন তার শালা, শালা-বৌ-এর সঙ্গে রসিকতা করছিল। ‘বলো তো–এটার উপর ওটা দিয়ে মাগ-ভাতারে রইল শুয়ে…এটা কী?’ ভোলা ঘোষের শালা-বৌ বলল, ‘ইশ্‌ কী অসভ্য।’ ভোলা ঘোষ বলল, ‘তোমার মনের মধ্যে পাপ। ওটা হ’ল খিল। দরজার খিল।’ এমন সময় ঘেউ ঘেউ আর হাম্বা হাম্বা ডাক শুনে বাইরে তাকাল ভোলা ঘোষ, দেখল একটা ডানাওলা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। ভোলা ঘোষ বাইরে বেরোলে হাতজোড় করে দাঁড়ায় তারাদাস। যেন গরুড়। নারায়ণের বাহন। তারাদাস বলে, ‘নারায়ণ ক্যাসেট ভাণ্ডার থেকে এসেছি। এই যে ক্যাসেট। ডন, শোলে আর ইয়ে।’ কুকূররা ঘিরে ধরেছে তারাদাসকে। ভীষণ ঘেউ ঘেউ তারাদাস চোঁ করে উপরে ওঠে। সূর্য লালচেপানা হয়ে আসছে। আর বেশিক্ষণ ওড়া যাবে না, বুড়োটা বলে দিয়েছিল। আকাশে দিক ঠিক রাখা মুস্কিল। উত্তরে মধুক্ষরা নদী, দক্ষিণে গোপেশ্বরের মন্দিরের চূড়া। এবার নিজের গ্রামের দিকে যায় তারাদাস।

জনার্দন মল্লিক চেক লুঙ্গি পরে মজুর চরাচ্ছে। বগলে ট্রান্‌জিস্টার, হাতে সিগারেট। বাগানের গাছের আগায় আতা পেকে আছে।তোতা পাখির কিচির মিচির। তারাদাস যেতেই পাখিরা উড়ে পালায়। বেশ বড়ো-সড়ো একটা আতা ছিঁড়ে নিল তারাদাস। তিতু আতা খেতে ভালোবাসে। তিতু জনার্দন মল্লিকের মেয়ে। জনার্দনবাবুর বাড়ির চারিদিকে মাটির পাঁচিল, দরজায় গণেশ। পাঁচিলের গায়ে লেখা: জাতীয় সংহতি রক্ষা করুন। আরও আছে ৷

গাছ লাগান গাছ বাঁচান, গাছ হ’ল প্রাণাধিক।

নিবেদন করিছেন শ্রী জনার্দন মল্লিক।

জনার্দন মল্লিকের ভগ্নীপতি পাশের গ্রাম ক্ষীরসাগরের পঞ্চায়েত প্রধান। জনার্দনের জমির কাছে সরকারি ডিপকল হয়েছে। এখন বছরে তিনটে চাষ। এখন জনার্দন মল্লিককে সবাই জনার্দনবাবু বলে। তিতুর খোঁপায় একদিন কাঠালিচাঁপা গুঁজে দিচ্ছিল তারাদাস, জনার্দনবাবু দেখে ফেলেছিল। বলেছিল–‘আর কক্ষনো এ বাড়ির দরজা মাড়াবি না হারামজাদা।’ তারাদাস দরজা মাড়ায় না। সাঁই করে সোজা পাঁচিল-ঘেরা উঠানের মধ্যখানে নামে। তিত্বু তখন গুড়াখু দিয়ে দাঁত মাজছিল। হাতের মধ্যে আতাটা দিয়েই উপরে উঠে যায় তারাদাস। কদমগাছের মগডালে আনন্দে ক’বার দোল খায়। ওকে ঘিরে জড়ো হতে থাকে লোকজন। সবার চোখ উপরে। আকুল আহ্বানে বলে, নেমে এসো, কদম্বের শাখা হতে নেমে এসো ত্বরা। তারাদাস উড়ে উড়ে নেমে আসে। বাচ্চারা আনন্দে হাততালি দেয়। তিতু ভীষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। হাতে তখনো আতা। তারাদাস মাটিতে নেমে কোমরের বেল্ট খুলে ডানাটা পিঠ থেকে খুলে পাশে রাখে। মানুষজন আর তরাদাসকে দেখছে না তেমন। ডানাটাকেই দেখছে। তারপর তারাদাসকে ঘিরে মিটিং বসে। জনার্দন মল্লিক হাঁকে, ‘অ্যাই তিতু, এখানে কী? যা-ঘর যা…’ তারপর তারাদাসকে বলে, ‘ঝেড়ে বল তো তারাদাস, ব্যাপারটা কী?’ তারাদাস সব বলে। প্রথম থেকে সব বলে। মতিলাল ভট্চাজ ফিসফিস করে হীরালাল মিত্রকে বলে, ‘সিডিউল কাস্টরা সব দিক থেকেই সুবিধে পাচ্ছে হে।’ জনার্দন মল্লিক সব শুনে নিয়ে কদমগাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলতে থাকে –

‘শুন বলি জনগণ শুন সবে এক মন তারাদাস গর্ব সবাকার…’

ঠিক সেই সময় জনার্দনের উপরে গলা চড়িয়ে বলতে শুরু করল ‘বন্ধুগণ, তারাদাস একটা ওড়ার যন্ত্র পেয়েছে’ – তা যেভাবেই হোক। কিন্তু তার ঐ ওড়ার ফয়দা নারায়ণ বিশ্বাসকে একা ভোগ করতে দেয়া হবে না। তারাদাসের ডানার সাহায্যে নারায়ণ বিশ্বাস ওর দোকান থেকে আরও দূরে দূরে আরও তাড়াতাড়ি ক্যাসেট সাপ্লাই করে আরও বেশি মুনাফা করবে। আমরা তারাদাসকে অনুরোধ করব হে তারাদাস, তুমি তোমার ডানা জনগণের কাজে লাগাও। আমের মুকুলে মেটাসিড স্প্রে করো উড়ে উড়ে। তাতে সব মুকুলেই ওষুধ লাগবে। ক’টা বাঁদর এসে প্রায়ই জ্বালাতন করে, তাড়া করলে এ ডাল থেকে ও ডালে পালায়। তুমি রাক্ষসের মুখোশ পরে উড়ে উড়ে বাঁদর তাড়িও।’

তারাদাস বলে, ‘বেশ তো।’

তারাদাসের ঠাকুর্মা চোখের জলে নাকের জলে একশা। বাপ-মা মরা নাতিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘হ্যারে, তের ভয়ের কিছু নেই তো, ডানাটা বিগড়োবে না তো?’ তারাদাস বলে, ‘না-না, কিচ্ছু ভয় নেই। ডানা চালানো ভীষণ সোজা। আমার তো এখন আর মাটিতে পা দিতেই ইচ্ছে করে না।’ বুড়ি বলে, ‘হ্যারে, তোর মালিক এবার তার একটু মাইনে বাড়াবে তো?’ তারাদাস বলে, ‘না বাড়াক। এবার মেলার সময় দেখো–কী রকম কামাবো। মোটর সাইকেলের আশ্চর্য খেলা আসে না, ভোঁ ভোঁ ঘোরে, কত টাকা কামায়। আমিও বোঁ-বোঁ উড়ব। মাইকে বলব আসুন দেখুন–উড়ন্ত মানুষ…’

নারায়ণ বিশ্বাসের হাটের নারায়ণ ক্যাসেট ভাণ্ডারের সাইন বোর্ডের তলায় আর একটা ছোট সাইন বোর্ড জুড়ে দেয়া হয়েছে। বি.দ্র: খবর পাইবা মাত্র উড়ন্ত মানুষ দ্বারা দ্রুত অর্ডার সাপ্লাই করা হয়।

এই গ্রামে ইলেকট্রিক এসেছে বছর দুই। ফোন ছ’মাস। নারায়ণ ক্যাসেট ভাণ্ডারের ফোন নম্বর দুই। প্রাইমারি হেলথ সেন্টারের ফোন নম্বর তিন। আট মাইলের মধ্যে আর হেল্‌থ সেন্টার নেই, আট মাইলের মধ্যে আর ভি.ডি.ও. ভাণ্ডারও নেই। তারাদাসকে নতুন পোশাক দিয়েছে নারায়ণ। কালো প্যান্ট, সাদা জামা। তারাদাস ছন্দে ছন্দে ওড়ে আনন্দে।

তারাদাস পাঁচজনের উপকারও করে দেয়। এ নিয়ে ওর সমস্যা। কেউ হয়তো বলল–‘তারাদাস, নারকোল গাছ থেকে দুটো নারকোল পেড়ে দিবি?’ ও পেড়ে দিল–ওর তো এক মিনিট। পরে দুখীরাম এসে বলল–‘তারাদাস, আমার ভাত মারিস না। আমি একটাকা নিয়ে নারকোল পাড়ি। তুই এসব করলে আমার কী হবে?’ একদিন জনার্দন বলল–‘তারাদাস, এই কাগজগুলো ধর, আকাশ থেকে ছড়িয়ে দিবি।’ তারাদাস তাই করল। হরিপদ মাস্টার তো রেগে বলল, “তারাদাস, জনার্দনের চক্রান্তে পা দিও না। ওরা আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। জনার্দনের ভগ্নীপতি ক্ষীরসাগর থেকে এসব করাচ্ছে। আমার কথা ছাড়া আর কোনো কাজ করবে না, এই তোমায় বলে দিলুম। আমি এই গাঁয়ের প্রধান।’ তারাদাস মাথা নাড়ে।

গাঁয়ে একদিন জনার্দন মল্লিকের বাড়িতে ডাকাতি হল। পুলিস কী করে জানতে পেরেছিল ঠিক ক’টার সময় ডাকাতি হবে, তাই পুলিস জীপ নিয়ে এসেছিল আবার ডাকাতও জানতে পেরেছিল পুলিস আসবে, তাই ডাকাতরা একটু আগেভাগেই এসে গিয়েছিল। পুলিস যখন এল ততক্ষণে ডাকাতি হয়ে গেছে। ডাকাতরা মাঠ ভেঙে পালাচ্ছে। জীপ তো আর মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটতে পারে না, তাই আর ডাকাতগুলোকে ধরা গেল না। পুলিস বলল–“খবর আছে আসছে হপ্তায় হরিপদবাবুর বাড়িতে ডাকাতি হবে।’ হরিপদ বলল–‘সে কী? তবে তো আপনাদের এলার্ট থাকতে হয়।’ পুলিসের বড়বাবু বললেন– ‘এলার্ট না হয় থাকলাম, তবে মাঠ ভেঙে ডাকাত পালালে আমরা কী করব? মাঠে তো আর জীপ যায় না।’ হরিপদবাবু তক্ষুনি তারাদাসকে ডেকে আনিয়ে বলল, ‘তারাদাস, পুলিস সাহেবকে একটু ওড়া শিখিয়ে দে ভাই, সামনের সপ্তাহে ডাকাত আসবে, আমার বাড়িতে ডাকাতি হবে, ডাকাতি করে মাঠ ভেঙে পালাবে।ট্রেনিংটা থাকলে তোর ডানাটা নিয়ে মাঝমাঠে উড়ে গিয়ে পুলিস ডাকাতকে গুলি করে দিতে পারবে।’

এ আর বেশি কথা কী। তারাদাস রাজি হয়।

বড়োবাবুর হাই-ব্লাডপ্রেসার। মেজবাবু ট্রেনিং নিতে এলেন। নাম কানাই পাত্র। ট্রেনিং হল। তারপর মেজবাবু উড়তে উড়তে করল কী, বলা নেই, কওয়া নেই মধুক্ষরা নদীর ধারে চলে গেল। নদীর পাড়ে সুহাসিনী গ্রাম। গ্রামের ধারের পুকুরে গ্রাম্যবালারা সব কলহাস্য সহকারে স্নানরতা ছিল। তাদের বস্ত্র ছিল পুকুরপাড়ে ছাড়া। কানাই করল কি, সাঁই করে কয়েকটা কাপড়-চোপড় তুলে নিয়ে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ডালে উঠে বসে রইল। কানাইয়ের হাতে মোহন বন্দুক।

ব্যাপারটা জানাজানি হল যখন সাপ্তাহিক বিষদাঁত পত্রিকায় ব্যাপারটা লেখা হ’ল। জনার্দন মল্লিক ওর মাঠের মুনিষ-মজুরদের শোনাল–

‘আরে শুন সবে মন দিয়া আজব কাহিনী

সম্প্রতি হইয়াছে ইহা লোক জানাজানি

মাস্টার হরিপদ

মাস্টার হরিপদ-কানাই পাত্র চক্রান্ত করিয়া

নারীর বস্ত্র নারীর ইজ্জত লইল যে হরিয়া

শুন সেই বৃত্তান্ত…’

হরিপদ বলল, ‘তারাদাস, তার ডানাটারই যত দোষ। যত অশান্তির কারণ। এই ডানাটা ভেঙে ফেলা হবে কিনা এ নিয়ে আমরা আলোচনায় বসব।’

নারায়ণবাবু বললেন–‘তারাদাস, তোর ঠাক্‌মা আমার হাতে পায়ে ধরে বলেছিল বাপ-মা মরা নাতিটার একটা গতি করে দিতে। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়েই তোকে আমি চাকরি দিয়েছিলাম। শোন্ তুই আমার চাকরি করিস। ওসব হরিপদদের কথা শুনবি না। জনার্দনের কথাও না। আমি যা বলব তাই শুনবি, যা বলব তাই করবি। তার ডানা কাউকে দিবি না। ওটা আমার।’

তারাদাস বলল, ‘বুড়োটা ডানাটা দেবার সময় যে বলেছিল–ডানাটার অমর্যাদা হতে দিস নি, মানুষের উপকারে লাগাস….’

নারায়ণ বিশ্বাস বলল: ‘বিচার করে উপকার করতে হয়। তার ছোট্ট মাথায়, বোকা মাথায় কি এত বিচার-বিবেচনা আসে? বরং আমিই বিচার-বিবেচনা করে বলে দেব তোকে।’

নারায়ণ ক্যাসেট ভাণ্ডারে লক্ষ্মী এল। ফুলে ফেঁপে উঠল দোকান। দোকানের নাম সামান্য চেঞ্জ। ভাণ্ডারটা হলো সেন্টার। নারায়ণবাবু দোকানে রঙ করালেন, নতুন লাইট বসালেন:ধূমধাম করে বিশ্বকর্মা পূজা হ’ল। ভি.সি.পি, ভি.সি.আর–এ মালা পড়ল, তারাদাসের ডানায় মালা পড়ল, চন্দন পড়ল, ধূপকাঠি গোঁজা হল স্টিয়ারিং-এর ফাঁকে। ইঞ্জিনীয়ার ডেকে নারায়ণবাবু ডানায় ওয়ারলেস সিস্টেম করালেন। স্টিয়ারিং-এর মাঝখানটায় তো একটা স্পিকার দেয়া হল। উড়ন্ত তারাদাসকে এখন নারায়ণবাবু নির্দেশ দিতে পারেন, আবার তারাদাসের কথাও শুনতে পান নারায়ণবাবু। যেমন :

‘ভূদেব সামন্তর বাড়িতে পৌঁছে গেছি স্যার…’

‘ইয়েস।’

‘শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য আরও দু’দিন রাখতে চাইছে স্যার।’

‘না, তা কী করে হয়; মালতীমাধবপুরে অষ্টপ্রহর হরিসংকীর্তন চলছে, ওখানে তো আজই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য দিতে হবে।’

‘স্যার, অবনী সাঁতরার বাডি পৌঁছে গেছি স্যার।’

‘ইয়েস।’

‘অবনী বাড়ি নেই।’

‘ওনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বল।’

‘স্যার?’

‘ইয়েস…’

‘ডট্ডট্ ক্যাসেটের ব্যাপারে বৌদির সঙ্গে কথা বলা কি ঠিক হবে?’

‘এতদিনেও কায়দা শেখনি? একটু বুদ্ধি করে বল।’

তখন তারাদাস এইভাবে কথা বলে!–‘তিনটে ক্যাসেট দিয়ে গেলুম বৌদি, সতী সাবিত্রী, হাণ্টারওয়ালী আর দ্রৌপদী কী বস্ত্র হরণ। লাস্টেরটার ডবল দাম কিন্তু– দেব?’

বৌদি বললেন, ‘রেখে যাও…’।

নারায়ণ তারাদাসকে কোয়ার্টার দিয়েছে বৈকুণ্ঠ ভবনের চিলেকোঠায়। বৈকুণ্ঠ ভবন নারায়ণের নতুন বাড়ি। অল মোজাইক। তারাদাসের ঠাক্‌মা চিলেকোঠায় মনের সুখে ঝোল চচ্চড়ি রাঁধে। মুখে আর হাসি ধরে না। বলে, এবার লাতবৌ আনবো।

তারাদাস কাজে যাবার সময় বুড়িকে পেন্নাম করে। উড়াল দেবার আগে ডানার বোতাম টেপার সময় শোনে–‘দুগ্গা-দুগ্গা’। তারাদাসের হাতে নতুন ঘড়ি, পরনে নতুন ইউনিফর্ম। বুড়ি তাকিয়ে থাকে…

তারাদাস যায়

জরির জুতো পায়

একশো টাকার জামাজোড়া

তারাদাসের গায়

মন্দা মন্দা বাতাস লাগে

সোনামণির পায়।

এদিকে জনার্দন ভার্সেস হরিপদর ঝগড়া উঠেছে তুঙ্গে। জনার্দন তো নিমিত্ত মাত্র। আসলে ঝগড়াটা হল দুধসাগরের প্রধান হরিপদর সঙ্গে ক্ষীরসাগরের প্রধান গোবর্ধনের। জনার্দনের দোষ হল গোবর্ধন ওর ভগ্নীপতি। জনার্দনের আতাগাছের ডালগুলো হরিপদর সীমানার মুখে পড়েছিল। গাছের ডাল তো আর দাগ নং জে.এল. নং বোঝে না। কাটলেও আবার ডাল গজায়। এ নিয়ে ঝামেলা। সালিশি হয়েছিল গাছটা কেটে ফেলতে হবে। তখনই ঐ বিখ্যাত কবিতাটার জন্ম। ঐ যে, জনার্দনের পাঁচিলের গায়ে যেটা লেখা আছে: গাছ লাগান, গাছ বাঁচান গাছ হ’ল প্রাণাধিক, নিবেদন করিছেন জনার্দন মল্লিক। গাছটা সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল। এবার কাটতেই হল।

আতাগুলো ভুঁয়ে লুটোপুটি, তোতা পাখিরা সব উড়ে পালাল। জনার্দনের বোকা মেয়ে তিতুর সে কী কান্না। কান্না আর থামে না। তারাদাস বলে, কাঁদিস না তিতু, আমি, আমি তোকে…

গাঁয়ের শেষ প্রান্তে আতা বাগানের বস্তিতে যে ছোটলোকগুলো থাকত, ওখানে আগুন লাগল। দুটো বাচ্চা পুড়ে মরে গেল। আতাগাছ যে-কটা ছিল পুড়ে কালো। আতাবাগান বস্তির লোকগুলো হরিপদর হয়ে খুব খেটেছিল ভোটে।

অনন্ত মাঝিকে পাওয়া যাচ্ছিল না। মদালসা নদীর জলে ভেসে উঠল ওর লাশ।

নারায়ণ বিশ্বাসের বাড়িতে এখন অনেকবার বাজে টেলিফোন।

নারায়ণবাবু এখন কেউকেটা লোক। চিন্তামগ্ন লোক।

নারায়ণবাবুর সঙ্গে গোবর্ধনের ফুসুর ফুসুর

নারায়ণবাবুর সঙ্গে হরিপদর ফুসুর ফুসুর

নারায়ণবাবুর সঙ্গে পুলিসের ফুসুর ফুসুর।

তারাদাস এখন ঘর আটকা। নারায়ণবাবু বলেন, এখন ক’দিন বাইরে বেরুতে হবে না তারাদাস। তোর ডানার দিকেই সবার নজর। পেলে কেড়ে নেবে, নয়তো ভেঙে দেবে।

বুড়ি ঠাক্‌মা তারাদাসের ডানায় থুথু দেয়, ঝাঁটার কাঠি বেঁধে দেয়।

একদিন বৈকুণ্ঠ ধামে অনেক জুতো। বসার ঘরে দোর বন্ধ করে আলোচনা। ঘরে কে কে আছে জানে না তারাদাস। আকাশে সেদিন সকাল থেকে মেঘ।

তারাদাসের ঠাক্‌মা খিচুড়ি চাপিয়েছে। এমন সময় নারায়ণবাবু এলেন তারাদাসের চিলেকোঠার ঘরে।

‘তারাদাস, কথা আছে।’

‘কী কথা?’

‘একটু বেরুতে হবে তোকে।’

‘আজ যে মেঘলা দিন। সূর্যের আলো না পড়লে যে আমার ডানা নড়ে না।’

‘আলো আছে। আলো আছে বলেই তুই আমাকে দেখছিস, আমি তোকে দেখছি। একবার দেখ্না-রে ভাই তারাদাস, ভীষণ দরকার।’

‘ভাই’ ডাক শুনে তারাদাস গলে যায়। ডানা লাগিয়ে একবার ট্রায়াল দিল। একপাক উড়ে এল। ভাবল সত্যিই তো, আলো কী অদ্ভুত। সূর্যকে দেখতে না পেলেও সূর্য আছে চরাচরে।

তারাদাস বলল, ‘কোথায় যেতে হবে?’

নারায়ণ ছাদের কোনায় ডেকে নিয়ে যায়। বলে ‘সোজা উত্তরে। মধুক্ষরা নদী পার হরে হবে।’

‘ওখানে তো আমাদের ক্যাসেটের কেলায়েন্ট নেই,–’

‘ক্যাসেট নয়-রে, অন্য জিনিস।’নারায়ণের গলার স্বর গাঢ়। ‘জিনিসটা আনতে হবে তোকে।’

‘কী জিনিস?’

‘পরে জানবি। শোন তারাদাস, নলখাগড়ার মাঠ পার হয়ে মধুক্ষরা নদীর পাড়ে যাবি। তারপর নদী পার হয়ে একটু গেলেই একটা মন্দির, সেই মন্দিরের পাশে নামবি। তারপর কোথায় যাবি কী করতে হবে ওয়ারলেসে বলে দেব তোকে। এই-নে চাবি। লাগবে তোর। জিনিসটা খুব সাবধানে আনবি, খুব সাবধানে।’ ক্যাসেট রাখার বাস্কেটটা পেটের তলায় ভালো করে বেঁধে দেয় নারায়ণ। তারাদাস যাত্রা করে। বুড়ি ঠাক্‌মা বলে, ‘দুগ্‌গা দুগ্‌গা।’ নারায়ণ হাত নেড়ে বলে, ‘গুডলাক।’

নদীর উপরে আসে তারাদাস। বর্ষার জলে ফুলে ফেঁপে নদী এখন বিশাল। তাকালে ভয় লাগে।

নদী পার হয়েই দেখল আতাবন। পাকা পাকা আতা ফলে আছে। ওয়ে ওয়ে..ওয়ে ওয়ে…। দুটো তিতুকে দেবে, দুটোর বীজ সারা দুধসাগরে ছড়িয়ে দেবে। আতা ফলগুলো বাস্কেটে পুরে নিল তারাদাস। গাছের কোটরে পেল তোতা পাখির ছানা। তুলে নিল। তারাদাস বাঁচাবে। মাউথ পিসে কণ্ঠস্বর শুনতে পেল তারাদাস।

‘মধুক্ষরা নদী পার হয়েছ?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘এবার অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলো। ওর কথা মতো কাজ করে যাও।’

‘ইয়েস স্যার।’

একটা খ্যাড়খেড়ে গলায় শুনতে পায়, ‘তারাদাস এখন কোথায় আছ?’

‘আতাবনে। কী সুন্দর আতাবন।’

‘গুলি মারো আতাবন। সামনে যাও।’

‘ইয়েস স্যার।’

‘মন্দির দেখেছ?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘চূড়ায় ত্রিশূল?’

‘ইয়েস স্যার।’

‘মন্দিরের পিছনে নেমে যাও।’

‘ইয়েস স্যার।’

মন্দিরের পিছনের কাশবনে নেমে যায় তারাদাস। তারপর কথামতো লাল রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে যেতেই একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির দরজায় তালা। কথামতো চাবিটা বার করে তারাদাস। তালাটা খোলে।ঘরের জানালা-টানালা সব বন্ধ। ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ।

টর্চটা বার করে। জ্বালায়। ঘরের কোনায় চারটে প্যাকেট। টার্চের আলোয় তারাদাস খুঁজতে থাকে পদ্মফুল আঁকা প্যাকেট। তারাদাস পায় না। প্যাকেটগুলো উল্টেপাল্টে দেখে। কোনোটাতেই পদ্মফুলের ছবি নেই। তারাদাস খুব সমস্যায় পড়ে। হনুমান কী করেছিল, হনুমান?

বিশল্যকরণী খুঁজতে গিয়ে হনুমান বিশল্যকরণী চিনতে না পেরে পুরো গন্ধমাদনটাই নিয়ে এসেছিল না? তারাদাস চারটে প্যাকেটই তুলে নেয়। হেড অফিসের সঙ্গে কথা বলে:

‘কোনো প্যাকেটে পদ্মফুলের ছবি নেই স্যার। ওভার।’ আবার সেই খ্যাড়খেড়ে – ‘ভালো করে দ্যাখো।’

‘দেখেছি স্যার, খুব খুব ভালো করে দেখেছি। ওভার।’

‘সে কী?–নিশ্চয়ই আছে। ভালো করে দ্যাখো।’

‘নেই স্যার।’

‘সব রাসকেল। কেউ ঠিক করে কাজ করে নি। তুমি এক কাজ করো। চারটে প্যাকেটই নিয়ে এসো, আমরা পরে দেখে নেব।’

‘প্যাকেটে কী আছে স্যার।’

‘তা তোমার জেনে কাজ নেই। তুমি প্যাকেটগুলো নিয়ে এসো।’

তারাদাস চারটে প্যাকেটই তুলে নেয়। অজানা প্যাকেট। আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেল্টের বোতামটা টিপল তারাদাস। হলুদ আলো। মানে ডানায় শক্তি বেশি নেই। মধুক্ষরা নদী পার হতে পারবে তো? দুগ্গা বলে উড়ান দিল তারাদাস।

উড়তে উড়তে আতাবন পার হলো তারাদাস। উড়তে উড়তে যেন টের পায় একটু একটু করে নিচে নেমে যাচ্ছে ও। নদীর উপরে চলে আসে তারাদাস। ডানা যেন আর তত জোর কাঁপছে না। একটু করে নিচু হয় তারাদাস। নদী মাঝ বরাবরও আসেনি। নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে তারাদাস। তারাদাস ভয় পায়। ওয়ারলেসে জানায়–‘নদীর উপর দিয়ে উড়তে উড়তে আমি তারাদাস বলছি, আমি নিচে নেমে যাচ্ছি ক্রমশ। আমাকে একটু হাল্কা হতে হবে। একটু ওজন কমাতে হবে আমার। একটা প্যাকেট ফেলে দিচ্ছি জলে….’

তক্ষুনি সমবেত স্বর– ‘সর্বনাশ তারাদাস, প্যাকেট ফেলো না।’

‘আমায় যে হাল্কা হতে হবে।’

‘তা হলে পেচ্ছাপ করে দাও।’

তাই করল তারাদাস। মধুক্ষরা নদীর জলে তারাদাস পেচ্ছাপ করল।

একটুক্ষণ পরে আবার যেন নিচে নামছে তারাদাস। একটু পরেই তারাদাস আবার চিৎকার করল–‘আমি আবার নিচে নেমে যাচ্ছি। এবার একটা প্যাকেট ফেলে দিচ্ছি আমি, যে-কোনো একটা প্যাকেট।’

‘যে-কোনো একটা প্যাকেটের মধ্যেই আমাদের দরকারি প্যাকেটটা আছে।প্যাকেট ফেলো না। তুমি তোমার প্যান্ট খুলে ফেলো।’

তাই করল তারাদাস। কায়দা করে প্যান্টটা খুলে ফেলে দিল মধুক্ষরা নদীর জলে। কিছুক্ষণ ঠিক, কিন্তু, একটু পরেই আবার নিচে নামতে লাগল তারাদাস। বর্ষায় উথাল- পাথাল নদী। তারাদাস চিৎকার করল–‘আবার নিচে নেমে যাচ্ছি আমি। জলে ডুবে যাব। একটা প্যাকেট ফেলে দিই আমি?’

‘আর কি কিছুই নেই তোমার কাছে তারাদাস ঐ প্যাকেটগুলো ছাড়া? ধারালো কিছু নেই? শরীরের কিছুটা রক্ত ঝরিয়ে দিতে পারো না তুমি?’

‘আমার কাছে কটা আতা ফল আছে, আর তোতা পাখির ছানা।’

‘আতা ক্যালানে কোথাকার। ফেলে দাও। এক্ষুনি ফেলে দাও সব।’

তখনই ডুকরে কেঁদে ওঠে তারাদাস। তারাদাস তখন ঝুড়ির ভিতর থেকে বের করে নিল একটা আতাফল। পরিপূর্ণ গন্ধ ছিল। তারপরই মুঠিতে শক্ত করে চেপে ধরল আতা ফল ফেটে যায়, ভেঙে যায়।

একটু একটু করে জলের দিকে নেমে যাচ্ছে তারাদাস।তখন আকাশকে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মহিমাকে সাঁই সাঁই বাতাসকে বলল, ‘আমাকে বাঁচাও…’

আর অল্প কয়েক হাত নিচেই তোলপাড় জল। তারাদাস চোখ বুজে তুমুল আর্তনাদ করে–‘আমাকে বাঁচাও।’ তারাদাসের চতুর্দিকে তখন শুধুই বৃষ্টির গুঁড়ো, আর কালো স্পিকারের যান্ত্রিক কলরব, ‘ফেলে দে–ফেলে দে আতা।’

এখন তারাদাসকে বাঁচতে হলে যে কোনো একটা জিনিস বেছে নিতে হবে। আতা কিংবা বাদামি প্যাকেট। প্যাকেটে কী আছে জানে না তারাদাস। বিষ না বীজ–না বীজাণু– না ড্রাগ–হেরোয়িন না নাপাম না শালগ্রাম নিউক্লিয়ার ছাই, তারাদাস জানে না। অথচ তারাদাসেরই ডানায় ভর করে চলেছে। হুকুম।

তারাদাসের আগে কোলবালিশটাও উড়েছিল। ওড়ানো হয়েছিল। কোলবালিশটার নিজের কোনো ইচ্ছে ছিল না। প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত ছিল না। তারাদাস তো কোলবালিশ নয়। ডুবে যাবার আগে ওকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *